মানুষের ছবি আঁকা পাপ জেনেও আমি বুঝি না কেন আমার ভাল লাগে মানুষের ছবি আঁকতে।
আমাকে ছবি আঁকতে দেখলেই মা বলেন–গাছপালা আঁক, ফুল আঁক , ক্ষতি নাই। মানুষের প্রাণ দিতে না পারলে মানুষের ছবি আঁকিস না। এক আল্লাহ ছাড়া মানুষের প্রাণ কেউ দিতে পারে না।
সেদিন আমার মুখ ফসকে বেরিয়ে যায়–গাছ যে আঁকতে কইলা, গাছেরও তো প্রাণ আছে।
মা ঠোঁটজোড়া মুখের ভেতর ঠেসে টাসেল বাঁধতে বাঁধতে চুলে, বলেন–যা কইছি, তাই কর। বেয়াদ্দপি করিস না।
মা যা বলেন তাই করতে হবে, যেহেতু মা বলেছেন। মা আমাকে গু খেতে বললেও গু খেতে হবে, ব্যাপারটি এরকম। ছবি আঁকলে প্রাণ যে দিতেই হবে এমন কি কথা! আমি তো মানুষ বানাচ্ছি না, আঁকছি। দুটোর মধ্যের তফাৎটুকু মা বোঝেন না। যুক্তিহীন কথা বলেন, অনেকটা গায়ের জোরে, নাকি মায়ের জোরে কে জানে। নিষেধ করার পরও মানুষের ছবি আমি এঁকেছি সে মানুষের ছবি আঁকব বলে নয়, এঁকেছিলাম নৌকো, নৌকোর প্রাণ নেই বলে সে ব্যাপারে কারও কোনও আপত্তি নেই, কিন্তু দোষ হয়েছে নৌকোয় মাঝি বসিয়েছি। নৌকোর কি নদীতে একা একা ভাসা মানায়! বৈঠা হাতে নৌকোর গলুইতে একটি মাঝি না বসিয়ে পারিনি। নানিবাড়ি বেড়াতে এসে হুমায়রা সে ছবি দেখে ছি ছি করে যাওয়ার পর মা সন্ধে বেলা আমার রঙপেনসিল আর ছবি আঁকার কাগজ কেড়ে নিয়ে বললেন–আঁকাআঁকি থইয়া লেখাপড়া কর।
ভ্যাঁ করে কাঁদার মেয়ে আমি নই, ঝিম ধরে বসে থাকি।
খোলা জানলার পাশে শুয়ে গায়ের ব্লাউজ খুলে বাঁ হাতে বুকের ঘামাচি মারেন আর ডান হাতে হাতপাখা নাড়েন মা। আমার কাগজ পেনসিল কেড়ে নেওয়াটা মা’র কাছে উঠোনের আবর্জনা কুড়িয়ে পাগারে ফেলার মত তুচ্ছ ঘটনা।
জোরে পড়। পড়া ত শুনা যায় না। মা’র ধমকে ঝিম ভাঙে আমার।
গলার স্বর বুজে এলে কি চড়া স্বরে পড়া যায়! সেটিও আমার দ্বারা হয় না।
সে রাতেই মা যখন মাথায় আমার হাত বুলিয়ে আদুরে গলায় বললেন আসো মা, আমার সাথে নামাজে দাঁড়াও।
মা’র ওইটুকু ষ্পর্শে আমার সব ক্ষোভ উড়ে যায় দখিনা বাতাসে। মা এরকম, মেরে ধমকে আবার কোলে নিয়ে আদর করতে বসবেন। দাদাকে সকালে কঞ্চি দিয়ে পিটিয়ে পিঠ লাল করে দুপুরে সে পিঠে নিজের হাতে সর্ষের তেল মালিশ করে দিয়েছিলেন। নামাজ পড়লে মা বলেন আল্লাহ তোমারে ভালবাসবেন, তুমি যা চাইবা আল্লাহ তুমারে তাই দিবেন।
যা চাইব তাই আল্লাহ দেবেন, এর মত মজা আর হয় না। মা ওঠবস করেন, সেটিই অনুসরণ করে মোনাজাতের হাত তুলে চোখ মুদে মনে মনে বলি যেহেতু আল্লাহ মনে মনে বলা কথাও শুনতে পান, আল্লাহগো আমারে দুইটা পোড়াবাড়ির চমচম দেও। মোনাজাত শেষ করে চোখ খুলে দেখি কোথাও পোড়াবাড়ির চমচম নেই। জায়নামাজের তলেও খুঁজি, নেই। মা’কে পরে প্রায় কেঁদে বলি–কই যা চাইছি আল্লাহ তো দিল না।
মা বলেন–মন দিয়া চাস নাই, তাই পাস নাই।
এরপর প্রায় রাতেই মা’র সঙ্গে নামাজে দাঁড়িয়ে মন দিয়ে আল্লাহর কাছে নানা জিনিস চেয়েছি–চাবি দিলে ঘোরে এমন গাড়ি, মুক্তাগাছার মন্ডা, বয়াম ভর্তি মার্বেল, বাঁশিঅলা বেলুন, পাইনি। এর চেয়ে বেশি মন কি করে দিতে হয় আমি জানি না। নিজেকে আমার বিষম এক পাপী মানুষ বলে বোধ হতে থাকে। তবে কি সেটিই আমার পাপ ছিল যে শরাফ মামা আমাকে ন্যাংটো করেছিলেন একা ঘরে! সেই পাপের কারণে কি আল্লাহ আমাকে ঘৃণা করছেন! হবে হয়ত। মন ভরে থাকে বিষাদে। বিষাদাচ্ছ্বন্ন আমাকে মা যেদিন নানির ঘরে গিয়ে ঘুমোতে বললেন, আমার যেতে ইচ্ছে করেনি, মামাদের সঙ্গে ঘুমোতে আমার ভয় হয়। মা জানেন না আমার ভয়ের কারণ। আমাকে ন্যাংটো করার কদিন পরই চুম্বকের খেলা দেখাতে পুকুর ধারে ডেকেছিলেন তিনি, যাইনি। মাথায় আমার চাটি মেরে চলে গেছেন শরাফ মামা। টুটু মামা ঘরের দরজা বন্ধ করে প্রায় বিকেলেই সিরাজউদ্দোলার অভিনয় করেন। বাড়ির ছেলেমেয়েরা সে ঘরে বসে টুটু মামার যাত্রা দেখে হাত তালি দেয়। দরজায় উঁকি দিয়ে যখন দেখেছি ঘর অন্ধকার, ঢুকিনি। অন্ধকার কোনও ঘরে আমার ঢুকতে ইচ্ছে করে না। চাঁদনি রাতে উঠোনে বসে কানা মামু হরিণ শিকার করতে করতে কি করে একদিন তাঁর চোখ অন্ধ হয়ে গেল, সে গল্প বলেন। বাড়ির লোকেরা জলচৌকিতে নয়ত শীতল পাটিতে শুয়ে বসে কানা মামুর শিকারের গল্প, আমির হামজা, সোহরাব রুস্তমের পালা শোনে। আমি শুনি মা’র গা ঘেঁসে বসে। গা এত ঘেঁসে বসি যে মা বলেন–শইল ছাইড়া ব। গরম লাগে।
আমার তবু শরীর ঘেঁসে থাকি। মা নিজে দূরে সরে বসেন। মা দূরে গেলে আমার ভয় হয়, এক্ষুণি কেউ বুঝি আমার হাফপ্যান্ট ধরে টান দেবে।
মা যখন আমাকে ঘরে একা ফেলে সিনেমায় যান, আমি বলি–মা যাইও না। আমার ডর লাগে।
মা ধমক লাগান–সারা বাড়ি ভর্তি মানুষ, তর ডর লাগব ক্যা?
আমাকে নানির ঘরে রেখে সিনেমায় চলে যান মা। নানি সারাদিন রান্না করেন। পাকঘরের চৌকাঠে মন খারাপ করে বসে থাকি, নানি কুকুর তাড়ানোর মত আমাকে বলেন–দূর হ দূর হ। কামের সময় ভেজাল ভাজাইস না।
রোদ নিচের সিঁড়িতে এলে মা বাড়ি ফিরবেন। আমি রোদের দিকে তাকিয়ে থাকি আর মনে মনে রোদকে বলি রোদ তুই নিচের সিঁড়ি নাম। রোদ এত দেরি করে নিচের সিঁড়ি নামে কী বলব!
উঠোনে নেড়ি কুকুর হাঁটে, কালো বেড়াল হাঁটে, গাছে বসে কা কা কা ডাকে দাঁড়কাক, পাতিকাক। দরজায় ফেরিঅলা হাঁকে, লাগব শিলপাটা ধার, আসে কটকটি অলা, পুরোন জামা কাপড় জুতোর বদলে কটকটি দেয়, হাঁকে চুরিফিতাঅলা, কাঠের চিকন বাক্সে কাচ বাঁধানো ঢাকনার নিচে চুরি ফিতা, ঝুনু খালা ফেরিঅলা দেখলেই নিমতলায় বসে চুরি ফিতা দেখেন, কানের দুল দেখেন, আসে বেদেনিরা মাথায় ঝুড়ি নিয়ে রঙিন কাচের চুরির, আসে হাওয়াই মিঠাই অলা, গোলাপি হাওয়াই মিঠাই মুখে পুরলেই হাওয়া, আসে ভালুক অলা, ভালুক খেলা দেখায়, বাঁদর অলা, বাঁদর নাচাতে নাচাতে আসে, আসে লাল রঙের জামা পরা, মাথায় লম্বা টোপর পরা চানাচুরঅলা, হাতের ঘুঙুর বাঁধা লাঠি ঝাকিয়ে গান গায় আর বলে হেই চানাচুর গররররম। গান শুনে রুনু খালা ঝুনু খালা দৌড়ে ঘরের বার হন, ঠোঙায় করে চানাচুর কেনেন। আসে বাদাম অলা, আসে ঝালুমড়িঅলা, হেই ঝালমুড়ি। বিকেল হলেই মামা খালাদের মধ্যে ধুম পড়ে বাদাম আর ঝালমুড়ি কেনার। শরাফ মামা এক ঠোঙা গরম বাদাম নিয়ে বাড়ি ঢোকেন। ফেলু মামার হাতে আইসক্রিম। জিভে জল চলে আসে দেখে। কুয়োর পাড়ে অসহায় দাঁড়িয়ে থাকি। একা। হঠাৎ বেদেনি ঢোকে বাড়ির ভেতর, ঝুড়ি মাথায় নিয়ে। মামারা সাপ খেলা দেখবেন। ঝুড়ি নামিয়ে বসে বেদেনি উঠোনে, উঠোন ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকে মামা খালারা, নানি রান্নাঘরের দরজায়। ঝুড়ি থেকে সাপ নেমে আসে কালো সাপ, হলুদ সাপ, পদ্মগোখরা, নেমে আসে মস্ত এক অজগর। অজগর সারা উঠোন একেঁ বেঁকে চলে। এমন ভয়ংকর, বিভৎস জিনিস এর আগে কখনও আমি দেখেনি। কুয়োর পাড় থেকে দৌড়ে যাই ফুলবাহারির কাছে, ও বসে বিড়ি টানছিল রান্নাঘরের দাওয়ায়। বলি–ও ফুলবাহারি আমার ডর লাগে।
ফুলবাহারি কালো মুখে শাদা হাসি–ডরানির কি আছে? এইতা সাপের বিষ নাই। বিষ দাঁত ফালাইয়া আনছে বাইদ্যানিরা।
আমার তবু ভয় হয়। বেদেনি চলে গেলেও আমার ভয় যায় না। পা ফেলতে ভয় হয় উঠোনে, মাঠে, যেন পায়ের কাছে এক্ষুণি এক সাপ ফণা উঁচু করে দাঁড়াবে। রাতে বিছানায় শুয়ে মনে হয় সাপ কুন্ডুলি পাকিয়ে শুয়ে আছে খাটের নিচে, সাপ উঠে আসছে ধীরে ধীরে বিছানায়, বালিশের তলায়, গায়ের ওপর। ঘুমিয়ে রাতে স্বপ্নও দেখি শয়ে শয়ে সাপ ফণা তুলে আছে আমার চারদিকে, আমি একা, একা কোথাও, রেললাইনে অথবা বড় রাস্তার মাঝখানে অথবা কোনও পুকুরঘাটে, কোনও গাছতলায়, বা কোনও বন্ধ ঘরে আমি ঠিক মনে করতে পারি না। চারদিকে কারও কোনও শব্দ নেই, কেবল সাপের হিসহিস ছাড়া। আমি মা মা বলে চিৎকার করছি, মা নেই। ওই সাপের রাজ্যে গা মুচড়ে নিজেকে গুটোতে গুটোতে, নিজের ভেতরে নিজেকে ঠেলতে ঠেলতে, ঘুম ভেঙে যায়, শুনি বুকের ধুকপুক শব্দ।
তখনও সাপের আর মানুষের ভয় আমাকে কেঁচো করে রাখে আর মা কি না বলেন মামাদের সঙ্গে ঘুমোতে! মা’কে আমার বলা হয়নি শরাফ মামা আমাকে যে ন্যাংটো করে নুনু ঠেসেছিলেন। কে যেন আমার ঠোঁটদুটো অদৃশ্য সুতোয় সেলাই করে রাখে।
গলায় নাল শরিফের তাবিজ ঝোলে আমার, তবু ভয় দূর হয় না।
নানির কাছ থেকে আড়াই কাঠা জায়গার ওপর ঘর ভাড়া নেওয়ার পর আমাদের পাকঘরে পাতা হয়েছে টেবিল চেয়ার, দিব্যি সাহেবদের মত তিনবেলা খেতে বসি। বাবা আবার সাহেবি ব্যাপার বেশ পছন্দ করেন। জুতো পরে মচমচিয়ে হাঁটেন। সেই পাজামা ফতুয়া পরা হারকিউলিস সাইকেল চড়া চিকন শরীরের বাবা দ্রুত বদলে যাচ্ছেন। তিনি প্যান্টে শার্ট গুঁজে পরেন, টাই পরেন গলায়, সময় সময় আবার শার্টের ওপর কোটও পরেন। সাহেব বাবা পিঁড়ি বা মাদুর পেতে বসে খাবেন কেন! বৈঠক ঘরের জন্য বাবা বেতের সোফা কিনেছেন। চেকনাই বেড়েছে এ বাড়ির, নানির বাড়ি সে তুলনায় মরচে ধরা। রুই কাতলার ঝোল খায় ওরা যদিও, মাদুর পেতেই খায়। কেবল খাবার নয়, পড়ালেখা করার জন্যও টেবিল চেয়ার এসেছে এ বাড়িতে, মামাদের সঙ্গে এক মাদুরে বসে এক হারিকেনের আলোয় ঝুঁকে ঝুঁকে পড়ার পাট তবু চুকি চুকি করে চুকছে না।
একা একা শুয়ে ছিলাম, চোখ ছিল জানালার ওপারে, হঠাৎ হট্টগোল শুনে দৌড়ে নানির উঠোনে দাঁড়াতেই ফেলুমামা বলেন ঝুনুখালার সোনার কানের দুল চুরি গেছে। কে নিয়েছে, কেউ জানে না। এ ওর দিকে সন্দোহ-চোখে তাকায়। ঝুনুখালা আমাকে টেনে ঘরের ভেতর ঢুকিয়ে ফিসফিস করে বললেন নিয়া থাকলে দিয়া দে, কাউরে কইতাম না তুই যে নিছিলি।
আমি মাথা নেড়ে না বলি। কিন্তু আমার ভয় হতে থাকে ঝুনুখালার সন্দেহে, মনে হতে থাকে সম্ভবত আমিই চুরি করেছি দুল। আমিই সম্ভবত কোথাও কোনও মাটির তলে লুকিয়ে রেখেছি। ঝুনু খালা বলে যাওয়ার পর থেকে নানিবাড়ির কেউ আমার দিকে তাকালেই আমার বুক ধড়ফড় করে। শুনি চাল পড়া খাওয়ানো হবে সবাইকে, যে চুরি করেছে চাল পড়া খেলে তার রক্তবমি হবে, এভাবেই ধরা পড়বে চোর। আকুয়া মসজিদের ইমাম খতিবুদ্দিন এসে চাল পড়ে দিল। চাল পড়া মানে বিড়বিড় করে কি সব বলে এক বাটি চালের মধ্যে ফুঁ দেওয়া। সেই ফুঁ দেওয়া চাল বাড়ির সবার হাতের তালুতে একমুঠ করে দিয়ে খেতে বলা হল। সকলে চাল চিবোয় আর এর ওর দিকে তাকায় রক্তবমি কার হয় দেখতে। আমার গা কাঁপছিল চাল চিবোতে গিয়ে। মনে হচ্ছিল এই বুঝি বমি করব, এই বুঝি সকলে উবু হয়ে আমার বমি পরীক্ষা করে বমিতে রক্তের কণা পাবে। এই বুঝি বাড়ির সব গাছ থেকে সব ডাল ভেঙে এনে উঠোনের কাদায় ফেলে পেটানো হবে আমাকে। কোনও এক মাটির তল থেকে বের করে দিতে হবে ঝুনুখালার দুল। আমি কি নারকেল গাছের তলে নাকি খড়ির ঘরের সিঁড়ির কাছে নাকি বারবাড়ির পায়খানার পেছনে লুকিয়েছি দুল! কোথাও হয়ত। ঝুনুখালার চোখের দিকে তাকালে নিজেকে চোর মনে হয়, ঝুনুখালা হয়ে আমি আমাকে দেখি তখন। তখন আমি নিজের আলাদা কোনও অস্তিত্ব টের পাই না।
চাল পড়া না খাওয়ার দলে নানা, শরাফ মামা আর ফুলবাহারি। নানা আর শরাফ মামা বাড়ি ছিলেন না, আর ফুলবাহারি বাড়ি থেকেও তার কালো গ্রীবা শক্ত করে দাঁড়িয়ে থেকে কোমরে শক্ত করে আঁচল গুঁজে বলেছে আমি চুরি করি নাই, আমি চাইল পড়া খাইতাম না। যে বেডা চাইল পইড়া দিছে, বেডারে আমি চিনি, বেডা একটা আস্তা বদমাইশ। মোলবি বেডার বাড়িত আমি কাম করছি, বেডার চরিত্র আমার জানা আছে। হে পড়ব চাইল পড়া, আর আমি তা মুহো দিমু! জীবনেও না।
ফুলবাহারি থুতু ছোঁড়ে মাটিতে। সে খাবে না তো খাবেই না।
মা ধমকান–মৌলবিরে বদমাইশ কও ক্যা ফুলবাহারি, গুনাহ হইব।
ফুলবাহারির শরীর তেলমাখা বাঁশের মত, কালো, ছিপছিপে। মুখে বসন্তের দাগ। বিড়ি খাওয়া কালো ঠোঁট। কানের ওপর বিড়ি রেখে সে মশলা বাটে, বাসন মাজে,.ঘর মোছে, উঠোন ঝাট দেয়, দিয়ে পাকঘরের দেয়ালে পিঠ ঠেস দিয়ে বসে বিড়িতে আগুন ধরায়।
ফুলবাহারি চাল পড়া না খাওয়ায় কানের দুল চুরি করেছে যে সে ই, এ ব্যাপারে নিশ্চিত হয় সকলে। ও চাল পড়া খাবে না ঠিক আছে বাটি চালানের আয়োজন হোক। এরকম একটি প্রস্তাব দেন রুনুখালা। বাটি চালান দেবে জবেদা খাতুন, কানা মামুর বউ। উঠোনে এঁটেল মাটি লেপে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে কাসার বাটি, এই বাটিতে তুলা রাশির কেউ হাত রাখলে বাটি আপনা মতে চলবে, চোরের সামনে গিয়ে থামবে বাটি। বাটি চালান হচ্ছে বাড়িতে, জবেদা খাতুন তুলারাশি, বাটি তার হাতে চলছে, এ ঘরের আঙিনা ওঘরের কোণা পেরিয়ে আমাদের পাকঘরে বাটি এসে থামে, একেবারে ফুলবাহারির পাছার তলায়। ফুলবাহারি তখন মশলা বাটছে। বাটির পেছনে পেছনে বাড়ির লোক এসে জড়ো হয়।
হাশেম মামা চড়া গলায় বলেন–ফুলবাহারি দুল বাইর কইরা দেও।
ফুলবাহারি ফুঁসে উঠে পদ্ম গোখরার মত, ওর কানে ঝিলমিল করে সস্তা সোনালি দুল, বলে–আমি চুরি করি নাই। আমি গরিব বইলাই আপনেরা মনে করতাছুইন আমি চুর। মানুষ গরিব অইলেই চুর অয় না। চুর অইলে চুরিই করতাম, খাইটা খাইতাম না। আপনেগো বাটি ভুল চলে।
রুনু খালা ফুলবাহারির গায়ে ঠোনা মেরে বলেন–
যে নারী ঝনঝনাইয়া কয়রে কথা, ধপধপাইয়া হাঁটে
সেই নারীর খসমের জাতি মরে হাটে ঘাটে।
বাটি ভুল মানুষের কাছে গেছে এ কথা কেউ মানে না। নানি বলেন–ফুলবাহারি, দুল জুড়া দিয়া দেও। যেহানে রাখছ কও, আমরাই বাইর কইরা লই।
ফুলবাহারির হাত ভরা হলুদ, দাঁড়িয়ে আছে হলুদ হাত শূন্যে ধরে, শুকিয়ে চড়চড় করা বিড়ি খাওয়া কালো ঠোঁট ফুলিয়ে ফুলবাহারি বলে–আপনেগো মদ্যেই কেউ চুরি করছুইন দুল। আমি করি নাই।
কথা শেষ হওয়ার আগেই মা ঝাঁপিয়ে চুলের গোছা ধরে টেনে ওকে নিয়ে আসেন পাকঘরের বাইরে উঠোনে, আমগাছ তলায়। ফুলবাহারির চুল যায় আগে আগে, শরীর যায় পেছনে, পা পারে না আঁকড়ে রাখতে চেয়েও মাটি। টুটু মামা চুলো থেকে আধপোড়া খড়ি এনে বেদম পেটাতে শুরু করেন ফুলবাহারিকে। ওর কানের বিড়ি মাটিতে পড়ে গায়ের নিচে চিপসে যায়, সারা উঠোন গড়াতে গড়াতে গলা ছেড়ে চেঁচায়–ফুলবাহারি চুরি করে না।
ফুলবাহারিকে সেদিনই কাজ ছেড়ে চলে যেতে হল। খোঁড়াতে খোঁড়াতে চলে গেল ফুলবাহারি। ওকে দেখে আমার মনে হয়েছিল ঝুনুখালার দুল ও চুরি করেনি। ও ঠিকই বলেছে যে বাটি ভুল চলেছে।
ফুলবাহারি চলে যাওয়ার পরদিনই বস্তির মাঝবয়সী মেয়েমানুষ তইতইকে কাজে রাখা হল। তইতইএর নাম আসলে নূরজাহান। নূরজাহানের কিছু পোষা হাঁস আছে, হাঁসগুলোকে সন্ধে হলে সে বাড়ি নিয়ে যায় আয় আয় তই তই বলে ডেকে ডেকে। হাঁসেরা পুকুরঘাট থেকে প্যাঁক প্যাঁক করে উঠে এসে নুরজাহানের পেছন পেছন হেঁটে বাড়ি ফেরে। গোঁধুলির আলস্য ভেঙে পুকর পাড়ে দাঁড়িয়ে নুরজাহানের তই তই ডাক শুনে টুটুমামা নূরজাহানকে তইতই বলে ডাকা শুরু করল। সেই থেকে তাকে তইতই বলেই সবাই ডাকে, এক নানি ছাড়া। তইতই ওরফে নুরজাহান ওরফে আলেক খালেকের মা, বেটে, পান খাওয়া লাল দেঁতো, আমাদের তখন ছুটা কামের বেটি। তইতই সকাল দুপুর বাড়ির মশলা বাটার, থাল বাসন ধোয়ার, ঘর দোর ঝারু দেওয়ার কাজ করে। আমাদের আলাদা সংসারের চুলোয় রান্নাবান্না করে। মাসিক পাঁচ টাকা বেতন তইতইএর, ভাত পায় এক বেলা।
বাড়িতে ছুটা বা বাঁধা কামের বেটি পাওয়া মোটে মুশকিল নয়। পা বাড়ালে বস্তি, হাত বাড়ালে মেয়েমানুষ। একটিকে বিদেয় করলে জোটে আরেকটি। ফুলবাহারি কানের দুল চুরির দায়ে চেলা কাঠের মার খেয়ে বাড়ির বার হল, তইতই এল। তইতইকে ছাঁটাই করা হল কাজে ফাঁকি দেওয়ার অপরাধে। কি রকম ফাঁকি, না, সন্ধের আগেই তড়িঘড়ি বাড়ি ছাড়ে সে, ঘরে তার আলেক খালেক আছে, আছে ছ’জোড়া হাঁস। মা নানিকে বললেন– তইতইর কামে মন নাই। রাইতের রান্ধাবাড়া আমারে একলা করতে হয়। বান্ধা কামের বেটি ছাড়া আমার পুষাইত না।
নানি বললেন–দেখ আর কয়ডা দিন। নুরজাহানের স্বভাব টভাব ত ভালাই। চুরি টুরি করে না।
মা নানির কথায় গললেন না। আধা মাসের আড়াই টাকা হাতে ধরিয়ে তইতইকে বলে দিলেন–যতদিন কাম করছ, হিশাব কইরা বেতন লইয়া যাও। আমি নতুন কামের বেডি রাইখ্যা লইয়াম।
তইতই বিদেয় হলে কারও কোনও আফসোস নেই।
বস্তিতে কি আর মেয়েমানুষের অভাব!
তইতই নেই, মাকে একাই রান্নাঘরে বসতে হয়, চুলো ধরাতে হয়, আনাজপাতি কুটতে হয়, মাছ মাংস ধুয়ে রান্না চড়াতে হয়। চুলোয় আগুন ধরাতে মা দেশলাই খোঁজেন, ফুলবাহারি বা তই তই চুলো ধরাতো, দেশলাই ওরাই জানে রেখেছে কোথায়।
— যা আমানুদ্দৌলার কাছ থেইকা একটা ম্যাচ লইয়া আয় তো।
তইতই যেদিন গেল, সেদিনই মা ফরমাশ দেন আমাকে। মা জানেন কাকার কাছে দেশলাই আছে, তাঁকে সিগারেট ফুঁকতে দেখেছেন তিনি। আমার কাকার ঘরটি সেটি, যে ঘরে খড়ি থাকত, যে ঘরে মজার একটি জিনিস দেখাবেন বলে শরাফ মামা এক মরা বিকেলে আমাকে নিয়ে এসেছিলেন। ঘরের দরজা ঠেলে ঢুকে দেখি কাকা শুয়ে আছেন চৌকিতে। কাকা দেখতে বাবার মত। কোঁকড়া চুল, খাড়া নাক, বড় বড় চোখ, ঘন কালো ভুরু, ফর্সা গায়ের রং। বাবাকে ইটের তলে চেপে খানিকটা চ্যাপ্টা করে মাথা চেপে লম্বায় খানিকটা খাটো করে দিলে আমান কাকাই দাঁড়াবে। ঘরটির চেহারা পুরো বদলে গেছে। খড়ি নেই, ইঁদুর নেই। টিনের বেড়ায় লাগানো একটি বাঁধানো ছবি, চুলে ঢেউ তোলা পায়ে পাম্পসু পরা কাকার ছবি। ছবির ডান পাশে মেয়েমানুষের মুখের ছবি অলা ক্যালেন্ডার। বেড়ায় গোঁজা আয়না, চিরুনি। আলনায় অভাঁজ কাপড় চোপড়।
–কাকা, মা ম্যাচ চাইছে। ক্যালেন্ডারের ছবি দেখতে দেখতে বলি।
–তুমার মা ম্যাচ দিয়া কি করব? বিছানা থেকে নেমে বুকের লোমে আঙুল ঘসতে ঘসতে আমান কাকা প্রশ্ন করেন।
বলি–চুলা ধরাইব। ভাত রানব।
কাকা বলেন–আমার কাছে ত ম্যাচ নাই।
দেশলাই নেই শুনে পা বাড়াই ঘরের বাইরে।
কাকা টেনে আমাকে ঢোকান ভেতরে। দাঁত মেলে হাসতে হাসতে বলেন –আরে খাড়ও, খাড়ও, ম্যাচ লইয়া যাও। ম্যাচ আছে।
যাদু দেখানোর মত হঠাৎ একটি দেশলাইএর বাক্স চোখের সামনে ধরেন আমার। হাত বাড়াতে গেলে তিনি সরিয়ে নেন হাত। আবার ধরতে যাই, আবার সরিয়ে নেন। এই ভেসে ওঠে চোখের সামনে দেশলাই, এই নেই। জোনাক পোকার মত, এই আলো, এই আঁধার। দেশলাই ধরতে কাছে যাই কাকার, কাকা টেনে আমাকে আরও কাছে নেন। আরও কাছে গেলে কাকা দেশলাই না দিয়ে পেটে বগলে কাতুকুতু দিতে দিতে আমাকে বিছানায় ফেলেন চিৎ করে। আমি কুঁকড়ে থাকি শামুকের মত। আমার শামুক শরীরটি কাকা শূন্যে তুলে ছুঁড়ে দেন, কাকা ডাং, আর আমি যেন তাঁর ডাংএর গুটি। আমার শরীর বেয়ে কাকার হাত নেমে আসে আমার হাফপ্যান্টে, হাতটি নামাতে থাকে হাফপ্যান্ট নিচের দিকে। গড়াতে গড়াতে আমি বিছানা থেকে নেমে যেতে থাকি। আমার পা মেঝেয়, পিঠ বিছানায়, হাফপ্যান্ট হাঁটুর কাছে, হাঁটু বিছানাতেও নয়, মেঝেতেও নয়। গলায় আমার নাল শরিফের তাবিজ। কাকা তাঁর লুঙ্গি ওপরে তোলেন, দেখি কাকার তলপেটের তল থেকে মস্ত বড় এক সাপ ফণা তুলে আছে আমার দিকে যেন এক্ষুণি ছোবল দেবে। ভয়ে আমি সিঁটিয়ে থাকি, আমাকে আরও ভয় পাইয়ে দিয়ে আমার দু’উরুর মাঝখানে ছোবল দিতে থাকে সেই সাপ। এক ছোবল দুই ছোবল তিন ছোবল।
ভয়ে আমার গা হাত পা কাঠ হয়ে থাকে। আমার বিস্ফারিত চোখের দিকে তাকিয়ে কাকা বলেন–লজেন্স খাইবা? তুমারে কালকা লজেন্স কিইনা দিমু। এই নেও ম্যাচ। আর শুন মামনি, কাউরে কইও না তুমি যে আমার নুনু দেখছ আর আমি যে তুমার সুনা দেখছি। এই সব খারাপ জিনিস, কাউরে কইতে হয় না।
আমি দেশলাই হাতে ঘর থেকে বেরিয়ে আসি। দুউরুর মাঝখানে ব্যথা হয়, পেচ্ছাব পায়, আবার দেখি পেচ্ছাবে ভরে গেছে আমার হাফপ্যান্ট। জানি না কি নাম এই ন্যাংটো- খেলার। আমি বুঝে পাই না কি কারণে শরাফ মামা বা আমান কাকা আমার ওপর চড়ে বসেন। কাকা বলেছেন এসব কাউকে বলতে হয় না। আমারও তাই মনে হয়, এসব কাউকে বলতে নেই। সাত বছর বয়সে হঠাৎ এক বোধ জন্ম নেয় আমার ভেতর, যে, এসব বড় শরমের কাজ, এসব কথা কখনও কাউকে বলা ঠিক নয়, বড় গোপন ব্যাপার এসব।
কেন আমি বাড়ির কাউকে জানাইনি অমন দুটো ঘটনার কথা সে আজও ভাবি। মামা কাকাদের লোকে মন্দ বলুক আমি চাইনি বলে! সংসারে ওদের মান রক্ষা করার দায় কি কেউ আমাকে দিয়েছিল! যেহেতু ওরা আমার কাকা মামা, যেহেতু বাল্যশিক্ষায় পড়েছিলাম গুরুজনকে সর্বদা মান্য করিবে! যেহেতু ওঁদের আমি ভাল মানুষ বলে জানি, সেই জানাই যেন সত্য হয়! যেন যা ঘটে গেছে সেটি সত্য কোনও ঘটনা নয়, সর্বৈব মিথ্যে, আসলে সে আমারই দুঃস্বপ্ন, অথবা কাকা বা মামার রূপ ধরে ওরা অন্য কেউ, ছিল জন্মের শত্তুর কেউ! কে আমাকে বোবা করে রেখেছিল, গোপনে পুষতে বলেছিল সব যন্ত্রণা একা একা! বাড়ির সবাই আমার অভিযোগকে হাওয়ায় উড়িয়ে বলবে আমাকে জিনে ভূতে ধরেছে, অথবা আমি পাগল, অথবা আমি মিথ্যুক, আমি একটা পিঁচকে শয়তান, আমাকে কেউ কোলে নিয়ে চুমু খাবে না উল্টে চড় চাপড় লাগাবে এই ভয়ে বা দ্বিধায় কি মুখ খুলিনি! নাকি কাউকে আপন বলে আমার মনে হত না, যার কাছে মন খুলে কাঁদতে পারি, যার কাছে শুরু থেকে শেষ অবদি খুলে খুলে বলতে পারি, দেখাতে পারি ক্ষত, মা’কেও এমন আপন মনে হয়নি আমার যে মা’র আঁচলের তলে আমার জগত, যে মা একটি বৃক্ষের মত, যার ছায়ায় আমি প্রাণ জুড়োই, যে মা স্বচ্ছ জলের পুকুর, যার জল পান করে আমি বাঁচি, সেই মা’কেও যদি আপন মনে না হয় তবে আর কাকে হবে!
আমার ভেতরে তখন দু’জন আমি, এক আমি দল বেঁধে অপেনটো বায়োস্কোপ খেলি, গোল্লাছুট গোলাপপদ্ম খেলি। আরেক আমি উদাস বসে থাকি একা, পুকুর ঘাটে, রেললাইনের ধারে, ঘরের সিঁড়িতে। হাজার মানুষের কোলাহলে একা। একা এই মেয়ের সঙ্গে ক্রোশ ক্রোশ দরত্ব তৈরি হয় সবার। মেয়েটির হাত এই দূরত্ব ডিঙিয়ে কারুকে ছুঁতে পারে না, এমনকি মা’কেও নয়, হাত বাড়ালে হাতের ভেতর মুঠো মুঠো শূন্যতা জমা হয়।