সাদারল্যান্ড সায়েবের অনুগ্রহে অতীতের যে সিংহদ্বার সেদিন অকস্মাৎ আমার চোখের সামনে খুলে গিয়েছিল, তা আজও মাঝে মাঝে আমাকে বিহ্বল করে তোলে। মনে মনে আপন ভাগ্যকে ধন্যবাদ দিই। মানুষের এই সংসারে দীর্ঘদিন ধরে জীবন-যন্ত্রণায় কাতর হয়েছি আমি; জীবন-দেবতার নির্মম পরীক্ষায় অধৈর্য হয়ে বার বার নীরবে অভিযোগও জানিয়েছি; কিন্তু আজ মনে হয়, আমার সৌভাগ্যেরও অন্ত নেই। জীবনের কালবৈশাখী ঝড়ে বার বার সঙ্কীর্ণতার কারাগার ধ্বংস করে আমাকে বার বার মুক্ত আকাশের তলায় দাঁড়াবার সুযোগ দিয়েছে। পরম যন্ত্রণার মধ্যেই শাজাহান হোটেলের ছোট ঘরে পৃথিবীর গোপনতম বৈভব আবিষ্কার করেছি। এই ঐশ্বর্যের কতটুকুই আর আপনাদের উপহার দিতে পারব? তার অনেক কিছুই যে প্রকাশের যোগ্য নয়। অনেক লাজুক প্রাণের গোপন কথা শাজাহান হোটেলের নিভৃতে আমি শুনেছি। লেখক-আমি সে-সব প্রকাশ করতে চাইলেও মানুষ-আমি কিছুতেই রাজি হয় না। বিশ্বাসের অংশটুকু বাদ দিয়ে যা থাকে তা কেবল দর্শকের গ্যালারি থেকে দেখা। এবং সেটুকু নিয়েই আমাদের চৌরঙ্গী।
মানুষের ভিতর এবং বাইরের ভালো এবং মন্দ এক অপরূপ আভায় রঙিন হয়ে আমার চোখের সামনে বার বার এসে হাজির হয়েছে। সেই রঙিন ভালোবাসার ধনই আমার চৌরঙ্গী। সে এমন এক জগৎ যেখানে অন্তরের কোনো অনুভূতিরই কোনো মূল্য নেই—অন্তত যে অনুভূতি কাঞ্চনমূল্যে কেনা সম্ভব হয় না, তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামাতে চায় না। বায়রন, মার্কোপোলো এবং স্যাটাদার অনুগ্রহে আমি যে রাজ্যে বিচরণ করছি সেখানকার মানুষেরা কেবল দুটি জিনিসই চেনে—একটির নাম মানিব্যাগ, আর একটি চেক।
যেদিন সকালে একটা চামড়ার ব্যাগ হাতে রোজি আবার শাজাহান হোটেলে ফিরে এসেছিল, সেদিনটা আজও আমার বেশ মনে আছে। হোটেলে ব্রেকফাস্টের পাট চুকে গিয়েছে। লাঞ্চের তদ্বির তদারক শেষ হয়ে গিয়েছে। মেনু কার্ড, ওয়াইন-কার্ড কখন টাইপ করে, সাইক্লোস্টাইল হয়ে টেবিলে সাজানো হয়ে গিয়েছে। অন্য সব জায়গায় লাঞ্চের কার্ডটাই রোজ ছাপানো হয়; ওয়াইন কার্ড অনেকদিন থাকে। শাজাহান হোটেলের আভিজাত্য এই যে, লাল রংয়ের ওয়াইন-কার্ডও রোজ ছাপানো হয়—এক কোণে তারিখটা লেখা থাকে। তা ছাড়া, ডাইনিং হল-এর পাশে আমাদের একটা ব্যাংকোয়েট হল আছে। সেখানে আজ রায়বাহাদুর সদাসুখলাল গোয়েঙ্কার পার্টি। রায়বাহাদুর সদাসুখলাল এই সভাতেই রাজধানীর দেশপ্রেমিক এক হোমরাচোমরাকে সাদর অভ্যর্থনা জানাবেন।
এই লাঞ্চ পার্টিতে টেবিলের কে কোথায় বসবেন, সে এক বিরাট অঙ্ক। সরকারি মহলে অতিথিদের এক নম্বরী তালিকা সযত্নে রক্ষা করা হয়। তার নাম লিস্ট অফ প্রিসিডেন্স। তাছাড়াও কলকাতার নাগরিকদের এক অলিখিত লিস্ট অফ প্রিন্সিডেন্স হোটেল-কর্তাদের এবং অনেক গৃহকত্রীর মুখস্থ আছে। সেই তালিকার সামান্য উনিশ-বিশের জন্য কোন বিখাত হোটেলের আকাশচুম্বী খ্যাতি যে ধুলায় লুণ্ঠিত হয়েছিল তা স্মরণ করে আমরা বেশ ভীত হয়ে পড়ি। টেবিল সাজাবার এই দায়িত্ব তাই সহজে আমরা নিজেদের কাঁধে নিতে চাই না। যিনি পার্টি দিচ্ছেন, তিনি যাকে যেখানে বসাতে চান বসান। বোসদার ভাষায়, তোমার হি-গোট, তুমি যেদিক থেকে খুশি কেটে নাও। আমার পৈতৃক প্রাণটা শুধু শুধু কেন নষ্ট হয়!
রায়বাহাদুরের সেক্রেটারি তাই নিজেই এসেছেন অনেকগুলো কার্ড নিয়ে। সঙ্গে আর-এস-ভি-পির ফাইল। এই ফাইলেই নেমন্তন্নর উত্তরগুলো রয়েছে।
আর-এস-ভি-পি রহস্যটা কাসুন্দেতে থাকার সময় একদম বুঝতাম না। বোসদা বললেন, শুধু তুমি কেন, আমিও বুঝতাম না। ইস্কুলে আমরা বলতাম, কথাটার মানে রসগোল্লা-সন্দেশ-ভর-পেট। নেমন্তন্নর চিঠির তলায় ওই চারটি অক্ষর থাকলেই বুঝতে হবে, প্রচুর আয়োজন হয়েছে।
এই লাঞ্চ পার্টির জন্য রায়বাহাদুরের—অর্থাৎ কিনা তার কোম্পানি লিভিংস্টোন, বটমূলে অ্যান্ড গোয়েঙ্কা লিমিটেডের নির্দেশে, বিশেষ ধরনের মেনুকার্ডের ব্যবস্থা হয়েছিল। সেই সুদৃশ্য কার্ড কলকাতার সেরা ছাপাখানা থেকে সাতরংয়ে ছাপানো হয়েছিল। সেই কার্ডের পরিকল্পনা করেছিলেন কলকাতার আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এক প্রচার প্রতিষ্ঠান। শেষ পৃষ্ঠায় রায়বাহাদুর নিজের এবং মাননীয় অতিথির একটি ছবি ছাপিয়ে দিয়েছিলেন। কিন্তু রায়বাহাদুরের মতো শখের কার্ড শেষ পর্যন্ত ব্যবহার করা সম্ভব হল না। কার্ডের গোড়াতেই গতকালের তারিখ দেওয়া রয়েছে। গতকালই পার্টির কথা ছিল। কিন্তু শেষ মুহূর্তে মাননীয় অতিথি পাটনা থেকে এসে পৌছুতে পারবেন না জানালেন। ওখানেও তাঁর এক গুরুত্বপূর্ণ কমিটি বৈঠক ছিল। বৈঠক শেষ করে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে এসে পৌছানো তার পক্ষে সম্ভব হয়নি। তারিখটা তার একান্ত সচিব ট্রাঙ্ককলে একদিন পিছিয়ে দিয়েছিলেন।
টেলিফোন পেয়ে লিভিংস্টোন, বটমলে অ্যান্ড গোয়েঙ্কা কোম্পানির অফিসাররা সারারাত ঘুমোতে পারেননি। প্রত্যেকটি অতিথিকে ফোনে ডেকে মাননীয় অতিথির অনিবার্য কারণে না-আসার সংবাদটা জানাতে হয়েছে। অত তাড়াতাড়ি আবার সাতরংয়ের কার্ড ছাপানো সম্ভব হয়নি। প্রথমে ঠিক হয়েছিল, শুধু তারিখটা কালো কালিতে বুজিয়ে দেওয়া হবে। কিন্তু রায়বাহাদুর সদাসুখলালের তা পছন্দ না হওয়ায়, আমাদের স্পেশাল কার্ডেই আজকের মেনু ছাপিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা হয়েছে। সেই মেনুই আমি কার্ডে ছাপাবার ব্যবস্থা করছিলাম। জব্বর মেনু। প্রথমে-Les Hors doeuvre Sajahan, তারপর সুপ-Crene de Champignors, এবার Filets de Beckti Sicilience:
Jambon Grille Kualalampur
Chicken Curry & Pilao;
Pudding de Vermicelle et Creme;
Tutti Frutti Ice cream:
Cream Cheese, এবং সর্বশেষে–
Cafe et The, অর্থাৎ কফি এবং চা। যাঁরা নিরামিষাশী তাদের জন্যে–
Papya Cocktail:
Potato & Cheese soup :
Green Banana Tikia (কাচকলার চপ!)
Mixed Vagetable Grill :
Dal Mong Piazi;
Pilao ইত্যাদি।
এই মেনুই নিজের মনে কাউন্টারে বসে টাইপ করে যাচ্ছিলাম। এখনই সত্যসুন্দরদা কার্ডগুলো নিয়ে ব্যাংকোয়েট হ-এ ঢুকে যাবেন। ঠিক সেই সময় এক ভদ্রমহিলা হাতে একটা ঝোলানো এয়ার-ব্যাগ নিয়ে কাউন্টারের সামনে এসে দাঁড়ালেন। স্টুয়ার্ড জিমিও কাউন্টারের মধ্যে দাঁড়িয়ে ছিলেন। তিনি হঠাৎ উল্লাসে চিৎকার করে উঠলেন। সুদীর্ঘ বিরহের পর কাকে যেন তিনি আবার ফিরে পেয়েছেন।
মুখ ফিরে তাকিয়েই, এক মুহূর্তে বুঝলাম ওই যুবতী মহিলাটি কে। আমি যে এত কাছাকাছি বসে আছি, তা অবজ্ঞা করেই স্টুয়ার্ড বলে ফেললেন, রোজি, ডার্লিং, তোমার আঙুরের মতো মুখ শুকিয়ে কিসমিস হয়ে গিয়েছে। তোমার সোনার মতো রং পুড়ে তামা হয়ে গিয়েছে।
রোজি এবার খিলখিল করে হেসে উঠল। বললে, আমার দাঁত?
জিমি ঘাড় নেড়ে বললেন, তোমার দাঁতগুলো কিন্তু ঠিক মুক্তোর মতোই রয়েছে।
মাথা ঝাঁকিয়ে বিশৃঙ্খল চুলগুলো সামলাতে সামলাতে রোজি বললে, হোটেলে কাজ করে জিমি, তুমি কিছুতেই সত্যি কথা বলতে পারো না। সোনার মতো রং আমার আবার কবে ছিল? তুমিই তো বলেছিলে কালো গ্রানাইট পাথর থেকে কুঁদে কে যেন আমাকে বার করেছে!
জিমি যেন একটু লজ্জা পেয়ে গেলেন। আস্তে আস্তে বললেন, এতদিন কোথায় ছিলে? বলা নেই, কওয়া নেই।
রোজি জিমিকে কোনো পাত্তা দিলে না। তার নজর হঠাৎ আমার দিকে পড়ে গিয়েছে। তার মেসিনে বসে, বাইরের কেউ যে টাইপ করতে পারে, তা সে কিছুতেই যেন সহ্য করতে পারছিল না। স্বভাবসিদ্ধ ওয়েলেসলি স্ট্রিটীয় কায়দায় সে আমাকে উদ্দেশ করে বলে উঠল, হ্যালো ম্যান, হু আর ইউ?
রাগে অপমানে আমার সর্বশরীর জ্বলে যাচ্ছিল। কোনো উত্তর না দিয়ে, আমি একমনে টাইপ করে যেতে লাগলাম।
জিমি এবার সুযোগ বুঝে আমাকে আক্রমণ করলেন। হ্যালো ম্যান, তোমাদের সোসাইটিতে তোমরা কি লেডিদের সম্মান করো না? একজন ইয়ং লেডি তোমাকে একটা প্রশ্ন করছেন, আর তুমি তার উত্তর দিতে পারছ না?
রোজিও এবার কি বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই জিমি বললেন, রোজি, তুমি নিশ্চয়ই খুব ক্লান্ত হয়ে পড়েছ। বাইরে কি খুবই গরম? তোমার বগলের জামাটা ভিজে উঠেছে।
সেদিকে আড়চোখে একটু তাকিয়ে রোজি বললে, হ্যাঁ। তারপর বেশ রাগতস্বরে চিবিয়ে চিবিয়ে বললে, কিন্তু জিমি, কোনো লেডির শরীরের পার্টিকুলার অংশের দিকে ওইভাবে খুঁটিয়ে তাকানো কোনো ভদ্রলোকের কাজ নয়।
জিমি জিভ কেটে বললেন, ছিঃ ছিঃ, তোমাকে এমব্যারাস করবার জন্যে আমি কিছু বলিনি, বিশ্বাস করো। কিন্তু ওইভাবে জামা ভিজে থাকলে মেয়েদের স্মার্টনেস যে নষ্ট হয়ে যায় তা নিশ্চয়ই মানবে।
রোজি এবার আমার দিকে তাকিয়ে বললে, হ্যালো ম্যান, তুমি কিন্তু আমার একটা প্রশ্নেরও উত্তর দাওনি। হু আর ইউ?
আমি বলতে যাচ্ছিলাম, তাতে তোমার দরকার কী? তুমি নিজের চরকায় তেল দাও।
কিন্তু তার আগেই আমার পিছন থেকে কে বলে উঠল, হি ইজ মিস্টার ব্যানার্জিস ব্রাদার-ইন-ল। এঁর আর এক মাসতুতো ভাই-খোকা চ্যাটার্জি বোম্বাইতে থাকেন!
এতক্ষণে পালে যেন বাঘ পড়ল। জিমি থতমত খেয়ে বললে, ডিয়ার স্যাটা, তুমি তাহলে এসে গিয়েছ। আমি রোর্জির সঙ্গে তোমার ফ্রেন্ডের আলাপ করিয়ে দেবার চেষ্টা করছিলাম।
রোজির মুখে ততক্ষণে কে যেন এক দোয়াত কালি ছুড়ে দিয়েছে। এয়ারকন্ডিশনের মধ্যেও তার নাকের ডগা ঘামতে আরম্ভ করেছে। বোসদা এবার কাউন্টারের মধ্যে ঢুকে এসে বললেন, তা রোজি, হঠাৎ কোথায় চলে গিয়েছিলে? আমরা তো ভেবে ভেবে কূল-কিনারা পাচ্ছিলাম না।
রোজি এবার ভয় পেয়ে একটুকরো কাগজের মতো হাওয়ায় কাঁপতে লাগল। জিমি ওকে ইশারায় একটু দূরে সরিয়ে নিয়ে গেলেন।
স্যাটাদা বললেন, তোমার কার্ডগুলো হয়ে গিয়ে থাকলে আমাকে দিয়ে দাও। গোয়েঙ্কা সায়েবের মাননীয় অতিথিরা কোনোরকম অসুবিধেয় না পড়ে যান।
জিমি ও রোজি দুরে দাঁড়িয়ে নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করে কী সব কথাবার্তা বললে। কথা বলতে বলতে ওরা আমার দিকে তাকাল। তারপর ফিরে এসে দুজনে আবার কাউন্টারের সামনে দাঁড়াল। জিমি বোসদাকে শুনিয়ে শুনিয়ে বললে, পুওর গার্ল! আহা রে! তা রোজি, তোমার আন্টি এখন কেমন আছেন? ভাললা তো? বৃদ্ধা মহিলা কদিন তাহলে খুব ভুগলেন।
রোজি বললে, আমার কপাল। কিন্তু আমার চিঠি পাওনি, সে কেমন কথা। ম্যানেজার ছিলেন না বলে, আমি তোমার ঘরে খামটা রেখে গিয়েছিলাম।
বোসদা কপট গাম্ভীর্যের সঙ্গে বললেন, হ্যাঁ, হা, কিছুই আশ্চর্য নয়। হয়তো ইঁদুর টেনে নিয়ে কোথায় ফেলে দিয়েছে।
জিমি বললেন, ইয়েস, খুবই সম্ভব। আমার ঘরের ইঁদুর-সমস্যাটা কিছুতেই গেল না। এক একটা ইঁদুর দেখলে ভয়ে আমার বুক শুকিয়ে যায়। এই ইঁদুরগুলোই আমাকে শেষ পর্যন্ত মারবে। উইপোকা মারবার জন্যে যেমন কোম্পানি আছে, তেমনি বাড়িতে বাড়িতে ইঁদুর মারবার জন্যে কেন কোম্পানি হচ্ছে না? এমন জরুরি একটা চিঠি আমার হাতে এল না!
বোসদা বললেন, আমার সময় নষ্ট করবেন না, এখনই গিয়ে মার্কোপোলোকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে আসুন!
জিমি যেতে গিয়েও একবার থমকে দাঁড়ালেন। কিন্তু তোমার ফ্রেন্ড। পুওর ফেলো।
বোসদা গম্ভীর হয়ে বললেন, তোমাকে আগেও বলেছি, এখনও বলছি, আমার কোনো ফ্রেন্ড নেই। দিস বয় ইজ নট মাই ফ্রেন্ড। সিমপ্লি, আমার কোলিগ, আমার সহকর্মী। যাই হোক, ওর জন্যে চিন্তা করো না। তুমি রোজির জন্যে চেষ্টা করো। কৃতজ্ঞতায় গদগদ হয়ে জিমি বললেন, ধন্যবাদ। রোজিকে বললেন, চলো। কিন্তু ঘামে ভেজা এই জামাটা পরেই যাবে? একটু পাখার তলায় দাঁড়িয়ে নাও।
রোজি চোরা কটাক্ষ হেনে বললেন, বরফের মধ্যে চুবিয়ে রাখলেও আমার বগলের ঘাম বন্ধ হবে না। আর চাকরিই যদি না থাকে, তবে আমার সব স্কার্টই সমান।
ওরা দুজনে এবার দ্রুতবেগে ম্যানেজারের খোঁজে চলে গেলেন। বোসদা হেসে আমাকে একটা আলতো চাটি মেরে বললেন, শাজাহান হোটেল না বলে, এটাকে শাজাহান থিয়েটার বললে বোধহয় ভালো হয়। চাকরি অবশ্য রোজির কিছুতেই যাবে না। রোজির গুণগ্রাহীর সংখ্যা এ-হোটলে কম নেই। তাছাড়া মার্কোপোলোর কী যে হয়েছে, সারাদিন মনমরা হয়ে পড়ে থাকেন। কারুর চাকরি তিনি নিশ্চয়ই খেতে চাইবেন না। যত দোষ্ট করুক, একটা মোটা-মুটি যুক্তিসঙ্গত কারণ খাড়া করে নিবেদন করতে পারলেই তিনি ওয়ার্নিং দিয়ে ছেড়ে দেবেন।
মার্কোপোলো তখন একতলায় কিচেনে ঘোরাঘুরি করছিলেন। রোজিকে নিয়ে জিমি সেই দিকেই চলে গেলেন। একটু পরেই মুখ কাচুমাচু করে রোজি একলা ফিরে এল। ফিরে এসে সে সোজা কাউন্টারের কাছে দাঁড়াল। বোসদা বললেন, কী হল?।
নখগুলো আবার দাঁতে কামড়াতে কামড়াতে রোজি বললে, জিমি বেচারার কপালটাই মন্দ। আমার জন্যে সে শুধু শুধু বকুনি খেলো। মার্কোপোলো দাঁত খিঁচিয়ে ওর দিকে তেড়ে গেলেন। অসভ্য ভাবে বললেন, মেয়ে মানুষের ওকালতি করবার জন্যে তাকে হোটেলে রাখা হয়নি। আর লেডি টাইপিস্টের ঘ্যানঘ্যানানি শোনবার মতো অঢেল সময় তার নেই। আগে লাঞ্চ এর সময় শেষ হয়ে যাক, তারপর যা হয় হবে।
বোসদা গম্ভীর হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। সেই সময় রোজি হঠাৎ এক কাণ্ড বাধিয়ে বসল। ভাগ্যে তখন কাউন্টারে কেউ ছিল না। বাইরে সারি সারি গাড়ি এসে পড়বার সময়ও তখন হয়নি। রোজি হঠাৎ কান্নায় ভেঙে পড়ল। কাঁদতে কাঁদতে বললে, আমি জানি স্যাটা, তুমি আমাকে দেখতে পারো। কিন্তু বলো তো আমি তোমার কী করেছি? তুমি আমাকে দেখতে পারো। কোনোদিন তুমি আমাকে দেখতে পারো না। আমার সর্বনাশ করবার জন্যে তুমি নিজের কাজিনকে এনে আমার চাকরিতে বসিয়ে দিয়েছ।
বোসদা ঘাবড়ে গিয়ে বললেন, রোজি, এটা হোটেলের কাউন্টার। এখানে সিন ক্রিয়েট কোরো না। কী বললে তুমি? তোমাকে তাড়াবার জন্যে আমি লোক নিয়ে এসেছি!
রোজি ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললে, এর আগেও তো একবার আমি চারদিনের জন্যে চলে গিয়েছিলাম। কিন্তু তখন তো কেউ আমার চেয়ারে এসে বসে যায়নি।
বোসদা বললেন, রোজি, তুমি কী সব বলছ?
রোজি রুমালে চোখ মুছতে মুছতে বললে, জানি আমি কালো কুচকুচে; জানি আমি সুন্দরী নই। লোকে আমাকে আড়ালে নিগ্রো বলে। তোমরা আমাকে দেখতে পারো না। ইচ্ছে করে তুমি ম্যানেজারকে আমার বোম্বাই পালানোর কথা বলে দিয়েছ। আবার অতগুলো লোকের সামনে বললে, ওই ছোকরা মিস্টার ব্যানার্জির ব্রাদার-ইন-ল।
বোসদা পাথরের মতো নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। আস্তে আস্তে বললেন, রোজি, জীবনে কারুর অন্নে হাত বসাবার চেষ্টা আমি করিনি। কখনও করবও না। তবে মিস্টার ব্যানার্জির প্রসঙ্গটা তোলার জন্যে আমি লজ্জিত। প্লিজ, কিছু মনে কোরো না।
লাঞ্চের মেনুকার্ডগুলো গুছিয়ে নিয়ে বোসদা কাউন্টার থেকে বেরিয়ে গেলেন। আর রোজিও সঙ্গে সঙ্গে ভিতরে এসে ঢুকল। আমাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে সে দেখতে লাগল। তারপর হঠাৎ বললে, স্যাটার ডানদিকের ড্রয়ারটা খোললা তো।
আমি বললাম, মিস্টার বোস তো এখনই আসছেন। আমি ড্রয়ার খুলতে পারব না।
রোজি ঝুঁকে পড়ে পায়ের গোছটা চুলকোতে চুলকোতে বললে, ওই ড্রয়ারে গোপন কিছু থাকে না। উইলিয়ম ঘোষ ওর মধ্যে অনেক সময় আমার জন্যে চকোলেট রেখে যায়। দেখো না, প্লিজ।
ড্রয়ারটা খুলতেই দেখলাম গোটাকয়েক চকোলেট রয়েছে।
রোজির মুখে হাসি ফুটে উঠল। বললে, উইলিয়মটা এখনও নেমকহারাম হয়নি। হি ইজ সাচ্ এ সুইট বয়। ওর সঙ্গে আমার কথা ছিল, আমার জন্যে সবসময়ে চকোলেট-বার রেখে দেবে। ড্রয়ার খুললেই পাব।
চকোলেট থেকে ভেঙে খানিকটা আমার হাতে দিয়ে রোজি বললে, বাবু, একটু নাও। হাজার হোক তুমি ইনফ্লুয়েন্সিয়াল লোক। তুমি স্যাটাকে পর্যন্ত হাত করেছ। আমরা তো জানতাম স্যাটার হার্ট বলে কিছু নেই। থাকলেও সেটা প্লাস্টিকের তৈরি। অথচ তুমি সেখানে জেঁকে বসেছ।
না বলতে পারলাম না। চকোলেটটা নিয়ে চুষতে আরম্ভ করলাম। রোজি বললে, তুমি ভাবছ, উইলিয়ম পয়সা দিয়ে কিনে আমাকে চকোলেট খাওয়ায়? মোটেই তা নয়। উইলিয়মের বয়ে গিয়েছে। ওরা কাউন্টারে অনেক চকোলেট পায়। আমেরিকান ট্যুরিস্টরা রিসেপশনের লোকদের টিপস দেয় না—ভাবে, তাতে ওদের অসম্মান করা হবে। টিপসের বদলে ওরা হয়, পকেটের পেন অথবা চকোলেট দিয়ে যায়।
বোসদা কাউন্টারে আবার ফিরে এলেন। বললেন, রোজি, বড়সায়েব এখনও খুব ব্যস্ত রয়েছেন। তা তারই মধ্যে তোমার সম্বন্ধে কথা হয়ে গেল।
কী কথা? রোজি সভয়ে প্রশ্ন করল।
সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বোসা আমাকে বললেন, তুমি ওপরে চলে যাও। নিজের মালপত্তরগুলো রোজির ঘর থেকে বার করে প্যামেলার ঘরে ঢুকিয়ে দাওগে যাও।
সে কি? আমি বলতে যাচ্ছিলাম।
কিন্তু তার আগেই বোসদা বললেন, প্যামেলার শো কলকাতায় চলবে। পুলিসে নোটিশ দিয়েছে। প্যামেলা ঘর খালি করে দিয়েছে। সে আজই চলে যাচ্ছে।
এবার বোসদা গম্ভীর হয়ে উঠে বললেন, আজকের লাঞ্চ পার্টিতে তোমাকে কাজ শেখাব ভেবেছিলাম। কিন্তু স্টুয়ার্ড রাজি নন। বলছেন, নতুন লোক, হয়তো গণ্ডগোল করে ফেলবে। যা হোক, পরে অনেক সুযোগ আসবে। এখন উপরে চলে যাও। আমি ফোনে গুড়বেড়িয়াকে বলে দিচ্ছি।
রোজি এবার সত্যদার মুখের উপর হুমড়ি খেয়ে বললে, স্যাটা, ডিয়ার, আমার সম্বন্ধে ম্যানেজার কী বললেন?
বোসদা হেসে বললেন, আর চিন্তা করতে হবে না। এখন গিয়ে নিজের পুরনো ঘরটা দখল করোগে যাও। তোমার কামাই করবার কারণটা সায়েবকে আমি বুঝিয়ে দিয়েছি।
রোজির মুখ আনন্দে ও কৃতজ্ঞতায় উজ্জ্বল হয়ে উঠল।
ছাদের উপরে আমাকে দেখে রোজি আহত কেউটে সাপের মতো ফোঁস ফোঁস করতে লাগল। আমি আস্তে আস্তে গুড়বেড়িয়াকে দিয়ে আমার জিনিসগুলো তার ঘর থেকে বার করে অন্য ঘরে সরিয়ে নিলাম। রোজি আমার দিকে তাকিয়ে বললে, ঠিক হ্যায়, আমারও দিন আসবে। তখন স্যাটাকেও দেখব। শাজাহান হোটেলে কত মহাজনকেই দেখলাম! সব পুরুষমানুষই তো হয় যীশু না হয় সেন্ট পিটার!
আমার পূর্ববঙ্গীয় রক্ত তখন গরম হয়ে উঠেছে। এই পরিষ্কার হোটেলের নোংরা অন্তরের কিছুটা পরিচয় আমি এর মধ্যেই পেয়ে গিয়েছি। তাও সহ্য করেছি। চাকরি করতে এসেছি—ভিখিরিদের বাছ-বিচার করা চলে না। কিন্তু বোসদার সম্বন্ধে কোনো গালাগালিই এই নোংরা লোকগুলোর মুখে আমি শুনতে রাজি নই।
রাগে অন্ধ হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে বললাম, আপনি বোধহয় ভদ্রতার সীমা অতিক্রম করে যাচ্ছেন।
হোয়াট? কী বললে তুমি? রোজি এবার যেন আগুনের মতো জ্বলে উঠল।
দূরে গুড়বেড়িয়া দাঁড়িয়েছিল। সে তার রোজি মেমসায়েবকে চেনে। এই কদিনে আমাকেও কিছুটা চিনে ফেলেছে। বুঝলে এবার বোধহয় গুরুতর গোলমাল শুরু হয়ে যাবে। নিজেকে বাঁচাবার জন্যে সে যেন কাজের অছিলায় কয়েক গজ দূরে সরে গেল।
ইতিমধ্যে রোজি খপাং করে সজোরে আমার হাতের কজিটা ধরে ফেলেছে। এই কলকাতা শহরে কোনো অনাত্মীয়া মহিলা যে এইভাবে এক অপরিচিত পুরুষের হাত চেপে ধরতে পারে তা আমার জানা ছিল না। আমার মধ্যেও তখন কী রকম ভয় এসে গিয়েছে। জোর করে হাতটা ছাড়িয়ে নিতে গিয়ে শেষ পর্যন্ত এক কেলেঙ্কারি বাধিয়ে বসব? এখনই হয়তো চিৎকার করে, কান্নাকাটি করে এই সর্বনাশা মেয়েটা লোকজন জড়ো করে বসবে।
দূর থেকে গুড়বেড়িয়া আড়চোখে আমার এই সঙ্গীন অবস্থা দেখেও কিছু করল না। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই রোজি হঠাৎ হিড় হিড় করে আমাকে টানতে টানতে নিজের ঘরের মধ্যে ঢুকে পড়ল। তারপর দড়াম করে দরজাটা বন্ধ করে দিল।
আমি কিছু বোঝবার আগেই যেন চোখের নিমেষে সমস্ত ব্যাপারটা ঘটে গেল। শুধু ঢোকবার আগের মুহূর্তে মনে হল গুড়বেড়িয়ার মুখে একটা রহস্যময় অশ্লীল হাসি ফুটে উঠেছে।
ঘরের মধ্যে নিছিদ্র অন্ধকার, কোনো জানলা পর্যন্ত খোলা হয়নি। তারই মধ্যে হাঁপাতে হাঁপাতে রোজি ভিতর থেকে দরজায় চাবি লাগিয়ে দিল।
এক ঝটকায় ওর হাতটা ছাড়িয়ে দিয়ে, ঘর থেকে বেরিয়ে আসবার জন্য আমি দরজার দিকে এগিয়ে এলাম। কিন্তু রোজি হঠাৎ পাগলের মতো এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে পড়ল। উত্তেজনায় ওর বুকটা হাপরের মতো ওঠানামা করছে। তারই মধ্যে চাপাগলায় সে বললে, কিছুতেই তোমাকে যেতে দেব না। তোমাকে এখানে বসতে হবে।
আমি জোর করে ওকে ডানদিকে সরিয়ে দিয়ে দরজাটা খোলবার চেষ্টা করতে, রোজি সপিণীর মতো আমার হাতটা জড়িয়ে ধরল। তারপর অভ্যস্ত কাটা কাটা ইংরেজিতে বললে, ছোকরা, এখন যদি তুমি বেরিয়ে যাবার চেষ্টা কর, আমি চিৎকার করে উঠব। বলব, তুমি আমার শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেছ। দরকার হয় আমি আরও এগিয়ে যাব। বলব, ঘরের দরজা বন্ধ করে তুমি একটা অবলা মেয়ের উপর অত্যাচার করবার চেষ্টা করেছ।
অমন অবস্থায় পড়বার জন্যে আমি একেবারেই প্রস্তুত ছিলাম না। অভিজ্ঞ পাঠক হয়তো আমার উপস্থিতবুদ্ধি ও মনোবলের অভাবের জন্যে আমার প্রতি করুণা পোষণ করবেন। কিন্তু স্বীকার করতে লজ্জা নেই, সেই মুহূর্তে আমি সত্যিই ভয় পেয়ে গিয়েছিলাম। মনে হয়েছিল, এখনই রোজি চিৎকার করে বলে উঠবে, সেভ মি, সেভ মি—কে আছো কোথায়, আমাকে বাঁচাও।
আইনের সঙ্গে যতটুকু পরিচয় ছিল, তাতে তার পরবর্তী অধ্যায়গুলোর কথা চিন্তা করে, আমার শরীরে কাটা দিয়ে উঠেছিল। রোজিকে জোর করে সরিয়ে দিয়ে দরজা খুলে ফেলবার শক্তি এবং সাহস তখন আমার ভিতর থেকে একেবারে উবে গিয়েছে।
আমি দরজা খোলবার চেষ্টা পরিত্যাগ করে কিছুক্ষণের জন্যে দাঁড়িয়ে রইলাম। নিরীহ টাইপিস্টের চাকরি করতে এসে কোথায় জড়িয়ে পড়লাম ভাবতে যাচ্ছিলাম। রোজি তখন ওর উদ্ধত বুকটাকে একটু সামলে নেবার চেষ্টা করতে লাগল।
তারপরেই দাঁতে দাঁতে চেপে সে বললে, ইন ফ্যাক্ট, তুমি আমার মডেস্টি আউটরেজ করেছ। তুমি বলেছ আমি সভ্য নই। আমি সভ্যতার সীমা ছাড়িয়ে গিয়েছি।
আমি বললাম, প্লিজ। আপনি উত্তেজিত হয়ে পড়ছেন।
রোজি বললে, তুমি আমাকে ইনসাল্ট করেছ।
আপনার সঙ্গে আমার আধঘণ্টা হল দেখা হয়েছে। এর মধ্যে আপনার সঙ্গে আমি কোনো কথাই বলিনি।
রোজি বললে, তুমি মিসেস ব্যানার্জির ভাই। তুমি নিশ্চয়ই অনেক কথা শুনেছ।
এ আর-এক বিপদ হল। রসিকতা করে বোসদা আমাকে কী বিপদে ফেলে গেলেন।
রোজি সেই অন্ধকারেই বললে, তোমরা নিশ্চয়ই বলে বেড়াচ্ছ, আমি ব্যানার্জির কাছ থেকে অনেক পয়সা হাতিয়েছি। পয়সার লোভেই ওর সঙ্গে বম্বে পালিয়েছিলাম?
আমি কী বলব? চুপ করে রইলাম।
রোজি রেগে গিয়ে বললে, এমন ন্যাকা সেজে দাঁড়িয়ে রয়েছ, যেন তুমি ভাজা মাছটি উলটে খেতে জানো না। মিস্টার ব্যানার্জি, মিসেস ব্যানার্জিকে যেন জীবনে কোনোদিন তুমি দেখনি।
রোজি হাঁপাতে হাঁপাতে বললে, তোমার দিদিকে বলো, বেচারা একটা জানোয়ারকে বিয়ে করেছেন। আমাকে সে মিথ্যে কথা বলেছিল। ব্যানার্জি বলেছিল, সে বিয়ে করেনি।
আর ওই শয়তান বায়রনটা। নিশ্চয়ই বলেছে, আমরা যাবার আগে অন্য হোটেলে দুজনে ছিলাম। ছিলাম, কিন্তু টাকা নিইনি। এখানে তো আর তাকে আমি আনতে পারি না। এই ঘরে এনে কারও সঙ্গে তো কথাবার্তা বলবার হুকুম নেই।
রোজির চোখ দিয়ে এবার জল গড়িয়ে পড়ছে মনে হল। স্কার্টের কোণ দিয়ে সে চোখটা একবার মুছে নিল। তারপর চুলগুলো বাঁহাতে সরিয়ে নিতে নিতে সে বললে, তুমি, তোমার ব্রাদার-ইন-ল, তোমার সিস্টার—তোমরা সবাই মিলে আমার মডেস্টি আউটরেজ করলে।
কাঁদতে কাঁদতে রোজি বললে, জানো, আমার মা আছে, প্যারালিসিসে পড়ে-থাকা বাবা আছেন। দুটো আইবুড়ো বেকার বোন আছে। আমরা কিন্তলী। কিন্তু কলকাতার তোক তোমরা আমাদের নিগ্রো বলে চালাও। দেশের বাইরে গিয়ে তোমরা বড় বড় কথা বল। কিন্তু আসলে তোমরা আমাদের ঘেন্না করো। আমি ভেবেছিলাম, ব্যানার্জির সঙ্গে আমি বিয়ে করে চলে যাব। জিমিকে বলে যাব, আমার কাজটা যেন আমার বোনকে দেয়। জানো, আমার বোনের শাজাহান হোটেলে ডিনার খাবার কী ইচ্ছে? ওরা পাঁউরুটি, পেঁয়াজ আর পটাটো খেয়ে বেঁচে থাকে। আর জিমির অনুগ্রহে এখানে আমি ফুল কোর্স ডিনার খেয়ে থাকি।
একটু থেমে রোজি বললে, তোমার ভগ্নিপতিকে নিয়ে আমি কেটে পড়তে পারতাম। কিন্তু হঠাৎ শুনলাম তোমার বোন রয়েছে। এখন আবার দেখছি, বোনের ভাই রয়েছে। আমার গা ঘিনঘিন করছে!
আমি বললাম, এবার আমাকে যেতে দিন।
রোজি বললে, হ্যাঁ, যেতে দেব। কিন্তু যাবার আগে যার জন্যে ডেকেছি, তাই বলা হয়নি।
আমি যে ব্যানার্জিদের কেউ নই, তা বোঝাবার বৃথা চেষ্টা না করে বললাম, কী বলুন?
রোজির মুখটা যে বীভৎস রূপ ধারণ করেছে তা সেই অন্ধকারেও বুঝতে পারলাম। সে বললে, তোমার বোন বলে বেড়িয়েছে ব্যানার্জি একজন ডার্টি হোটেল গার্ল-এর সঙ্গে পালিয়েছে। সেটা মিথ্যে—আটার লাই। অ্যান্ড টেল ইওর সিস্টার, তোমার বোনকে বলল—আই স্পিট অ্যাট হার হাজবেন্ডস ফেস—আমি তার স্বামীর মুখে থুতু দিই। এই বলে রোজি সত্যিই মেঝের মধ্যে এক মুখ থুতু ফেলে দিলে।
সেই থুতুটাই জুততা দিয়ে ঘষতে ঘষতে রোজির আবার চৈতন্যোদয় হল। মুখটা বেঁকিয়ে বললে, আই অ্যাম স্যরি। তোমাকে বলে কী হবে? তোমাকে বলে কিছুই লাভ নেই। থুতুটা নষ্ট করলাম। ওটা ব্যানার্জির জন্যেই রেখে দেওয়া উচিত ছিল।
রোজি নিজেই এবার দরজাটা একটু ফাঁক করে আমাকে বাইরে বেরিয়ে আসতে দিল। তারপর দড়াম করে ভেতর থেকে আবার দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল।