০৫. সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী দলের অভ্যুত্থান

পঞ্চম অধ্যায় – সন্ত্রাসবাদী বিপ্লবী দলের অভ্যুত্থান

স্বদেশী আন্দোলনের ফলেই বাংলায় বিপ্লবীদের মধ্যে গুরুতর মতভেদ উপস্থিত হয় এবং সন্ত্রাসবাদের আরম্ভ হয়। ইহা ক্রমে ভারতের নানা স্থানে ছড়াইয়া পড়ে ও ১৯৪৭ সন পর্যন্ত স্বাধীনতাসংগ্রামে একটি বিশিষ্ট স্থান অধিকার করে। মহাত্মা গান্ধী প্রবর্তিত অহিংস আন্দোলন ভারতের মুক্তিসংগ্রামে বিশেষ ফলদায়ক হইয়াছিল, এ-বিষয়ে কোন সন্দেহ নাই। কিন্তু ইহাই যে ভারতের মুক্তিসংগ্রামের একমাত্র পন্থা ছিল এবং স্বাধীনতালাভের সমস্ত কৃতিত্ব যে মহাত্মা গান্ধীরই প্রাপ্য, এই ধারণা প্রচলিত থাকিলেও ও অনেকের মনে বদ্ধমূল হইলেও ইহা ঐতিহাসিক সত্য নহে। এ সম্বন্ধে পরে বিস্তৃত আলোচনা করা যাইবে এবং নিরপেক্ষ ব্যক্তিমাত্রেই স্বীকার করিবেন যে অহিংস আন্দোলন ও সহিংস বিপ্লব উভয়েই স্বাধীনতালাভের কৃতিত্ব তুল্যরূপে দাবি করিতে পারে। সুতরাং ইহার বিস্তৃত আলোচনা প্রয়োজন।

বঙ্গদেশে বিপ্লববাদের প্রথম ও প্রধান কেন্দ্র অনুশীল সমিতি’র প্রতিষ্ঠার কথা পূর্বেই বলা হইয়াছে। এই সমিতির প্রথম আস্তানা ছিল সুকিয়া স্ট্রীট থানার নিকট এক ভাড়াটে বাড়ীতে। পরে ইহা ৪৯নং কর্ণওয়ালিস্ স্ট্রীটে স্থানান্তরিত হয় এবং ইহার কার্যসূচীও পরিবর্তিত হয়। শারীরিক শক্তি বৃদ্ধির জন্য ব্যায়াম, লাঠিখেলা প্রভৃতি ছাড়াও শিক্ষা, সংস্কৃতি ও চরিত্র গঠনের দিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়া হইত। এইজন্য দেশের অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি এইখানে নানা বিষয়ে আলোচনা করিতেন। ম্যাটসিনি, গ্যারিবী প্রভৃতি জননায়কদের জীবনী, ইংলণ্ডের বিরুদ্ধে আমেরিকার যুক্তরাজ্যে ইংরেজ ঔপনিবেশকদের বিদ্রোহ, ইউরোপে নানা জাতির স্বাধীনতালাভ বা অত্যাচারী শাসকের দমনের বিরুদ্ধে মুক্তিসংগ্রাম প্রভৃতি ঐতিহাসিক বিষয় সম্বন্ধেও আলোচনা হইত। সখারাম গণেশ দেউস্কর নামে একজন কলিকাতাবাসী মারাঠী ইংরেজের আমলে আমাদের আর্থিক দুরবস্থার কথা বুঝাইবার জন্য রীতিমত বিদ্যালয়ের মত ক্লাসে বক্তৃতা দিতেন। তাঁহার প্রণীত ‘দেশের কথা’ নামক গ্রন্থ সে-যুগে খুবই জনপ্রিয় ছিল। সমিতির সভাপতি পি. (প্রমথ) মিত্র ইতিহাস পড়াইতেন এবং ভগিনী নিবেদিতাও মাঝে মাঝে ক্লাস লইতেন। অরবিন্দ ও যুবক ব্যারিষ্টার চিত্তরঞ্জন দাস, এই দুইজন ছিলেন সহকারী সভাপতি। ইঁহারা ছাড়াও তরুণ ব্যারিষ্টারের দল–সুরেন হালদার, রজত রায়, প্রভাতকুসুম রায়চৌধুরী প্রভৃতি অনেকেই এই সমিতিতে আসিয়া সভ্যগণের সঙ্গে দেশের বিষয়ে আলোচনা করিতেন। ফলে অনুশীলন সমিতির খ্যাতি ও প্রতিপত্তি দ্রুতবেগে বাড়িতে লাগিল। মফঃস্বলের নানা স্থানেও ইহার শাখা সমিতি গঠিত হইল। শাখাগুলির মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রসিদ্ধিলাভ করিয়াছিল ঢাকায় অনুশীলন সমিতির’ শাখা। ১৯০৫ সনে পি. মিত্র ও বিপিনচন্দ্র পাল ঢাকায় যান এবং সেখানে একটি শাখা স্থাপন করিয়া পুলিনচন্দ্র দাসকে ইহার অধ্যক্ষ নিযুক্ত করেন। ক্রমে ক্রমে ইহার শাখা-প্রশাখা প্রায় সমস্ত পূর্ববঙ্গে বিস্তৃত হয়। এতদ্ব্যতীত কলিকাতায় ও পশ্চিমবঙ্গের প্রায় সকল জিলাতেই অনুশীলন সমিতির শাখা স্থাপিত হয়। পরে ধীরে ধীরে এই সমিতির নিয়ম-প্রণালী বিধিবদ্ধ হয় এবং সভ্যপদগ্রহণের জন্য নানা বিধি ও অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়। এই সকল অনুষ্ঠানের বিবরণ নানা গ্রন্থে লিপিবদ্ধ হইয়াছে। স্থানভেদে ইহার কর্মপ্রণালীর মধ্যেও স্বাতন্ত্র্য লক্ষিত হইত। সুতরাং এই প্রসঙ্গটি সংক্ষেপেই লিপিবদ্ধ করিব।

সমিতিগুলির দুইটি অঙ্গ ছিল–প্রকাশ্য ও গুপ্ত। ইহার মধ্যেও আবার স্তরের বিভেদ ছিল। নিম্নস্তরের সদস্য তাহার কার্যে নিপুণতা ও বিশ্বস্ততা দেখাইলে উচ্চতর স্তরে পৌঁছিবার অধিকারী হইত। প্রতি স্তরের সদস্যদেরই একটি প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করিতে হইত। এইরূপ চারটি স্তর ও তাহার প্রতিজ্ঞাপত্রের সন্ধান পাওয়া গিয়াছে। এগুলি যথাক্রমে আদ্য, অন্ত্য, প্রথম বিশেষ ও দ্বিতীয় বিশেষ প্রতিজ্ঞা নামে অভিহিত হইত।

আদ্য প্রতিজ্ঞা লইয়া মাত্র প্রকাশ্য সমিতির সদস্য থাকা যাইত। ক্রমে কার্যের ভিতর দিয়া যাহারা যোগ্য বিবেচিত হইত তাহাদের অন্ত্য প্রতিজ্ঞা করাইয়া গুপ্ত সংস্থার সভ্য করা হইত। প্রতিজ্ঞাগুলির নমুনা এই প্রকার (সংক্ষিপ্ত মর্ম দেওয়া হইল) :

(১) আদ্য প্রতিজ্ঞা

(ক) কখনও সমিতি হইতে বিচ্ছিন্ন হইব না।

(খ) সর্বদা সমিতির নিয়ম মানিয়া চলিব, বিনাবাক্যে কর্তৃপক্ষের আদেশ পালন করিব, পরিচালকের (নেতার) নিকট সত্য কথা বলিব, এবং কোন কথা গোপন করিব না।

(২) মধ্য প্রতিজ্ঞা

(ক) সমিতির আভ্যন্তরিক কোন সংবাদ কাহাকেও দিব না।

(খ) পরিচালককে না জানাইয়া স্থানত্যাগ করিব না, এবং সমিতির বিরুদ্ধে কোন ষড়যন্ত্রের সংবাদ কর্ণগোচর হইলে তাহাকে জানাইব এবং তাহার নির্দেশমত প্রতীকারের চেষ্টা করিব।

(৩) অত্য প্রতিজ্ঞা

(ক) উদ্দেশ্য সফল না হওয়া পর্যন্ত এই কেন্দ্র (সংস্থা) পরিত্যাগ করিব না। মাতা, পিতা, ভাই, ভগিনী, গৃহ প্রভৃতির স্নেহে বা মোহে কর্তব্যে অবহেলা করিব এবং পরিচালকের নির্দেশ পালন করিতে বিন্দুমাত্রও ইতস্ততঃ করিব না।

(খ) যদি এই প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করি তাহা হইলে ব্রাহ্মণ, পিতামাতা এবং সকল দেশের দেশপ্রেমিকের অভিশাপে যেন আমি ভস্মীভূত হই।

কাহারও মতে ইহা প্রথম বিশেষ প্রতিজ্ঞা, কিন্তু প্রবীণ বিপ্লবী নেতা ত্রৈলোক্য চক্রবর্তী মহাশয় ইহার সঙ্গে নিম্নলিখিত বিশেষ প্রতিজ্ঞার উল্লেখ করিয়াছেন :

“আমার জীবন ও ঐহিকের সমস্ত সম্পদের বিনিময়ে আমি সমিতির প্রসারের কার্যে আত্মনিয়োগ করিব। সমিতির কোন গোপন বিষয় লইয়া কাহারও সহিত আলোচনা করিব না অথবা আমার বন্ধু বা আত্মীয়ের নিকট প্রকাশ করিব না”।

এই প্রতিজ্ঞাগুলির নানা দফায় চরিত্রগঠন, নিয়মানুবর্তিতা এবং শৃঙ্খলা ও গোপনীয়তা রক্ষার সম্বন্ধে নির্দেশ আছে। প্রতিজ্ঞাভঙ্গের জন্য দলের লোকই বিশ্বাসঘাতককে হত্যা করিয়াছে এরূপ বহু দৃষ্টান্তের কথা জানা যায়। দীক্ষা গ্রহণ

করিলে কেহ অনুশীলন সমিতির সভ্য হইতে পারিত না। ঢাকা সমিতির নেতা বা পরিচালক পুলিন দাস যে-প্রণালীতে পি. মিত্র কর্তৃক দীক্ষিত হইয়াছিলেন তাহা তিনি নিজেই বর্ণনা করিয়াছেন :

“পি. মিত্রের আদেশ মতে একদিন (কলিকাতায়) এক বেলা হবিষ্যান্ন আহার করিয়া সংযমী থাকিয়া পরের দিন গঙ্গাস্নান করিয়া পি. মিত্রের বাড়ীতে তাঁহার নিকট হইতে দীক্ষা লইলাম। ধূপ দীপ নৈবেদ্য পুষ্প চন্দনাদি সাজাইয়া ছান্দোগ্যোপনিষদ্ হইতে বৈদিক মন্ত্র পাঠ করিয়া পি. মিত্র যজ্ঞ করিলেন। পরে আমি আলীঢ়াসনে বসিলাম, আমার মস্তকে গীতা স্থাপিত হইল, তদুপরি অসি রাখিয়া উহা ধরিয়া পি. মিত্র আমার দক্ষিণে দণ্ডায়মান হইলেন। উভয় হস্তে ধারণ করিয়া যজ্ঞাগ্নির সম্মুখে কাগজে লিখিত প্রতিজ্ঞাপত্র পাঠ করিয়া প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হইলাম। পরে যজ্ঞাগ্নিকে ও পি. মিত্রকে নমস্কার করিলাম।”

পুলিনবাবু বলিয়াছেন, গুপ্তচক্রের মধ্যে গ্রহণ করিবার পূর্বে অনুরূপ পদ্ধতিতে তিনিও অন্যকে দীক্ষা দিতেন। একসঙ্গে অনেককে দীক্ষা দিতে হইলে ঢাকা নগরীর উপকণ্ঠে সিদ্ধেশ্বরী কালীমন্দিরে দীক্ষা দেওয়া হইত এবং “দীক্ষান্তে প্রত্যেক সভ্যকে পর্যাপ্তরূপে বিশুদ্ধ ঘৃত ও চিনিসংযুক্ত কাঁচা দুগ্ধ সেবন করিতে” দেওয়া হইত।

কিন্তু অনুশীলন সমিতি প্রতিপত্তির চরম শিখরে উঠিবার সঙ্গে সঙ্গেই ইহাতে ভাঙ্গন ধরিল। ইহার প্রধান কারণ দুইটি। প্রথমটি ব্যক্তিগত। যে-কারণেই হউক যতীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের সঙ্গে পি. মিত্রের মতান্তর হওয়ায় যতীন্দ্রনাথ দল ছাড়িয়া যান এবং পরে যতীন্দ্রনাথ ও বারীন্দ্র ঘোষের মধ্যে প্রবল বিরোধ জাগিয়া উঠে। এইরূপ ব্যক্তিগত মতভেদ আরও ছিল, তাহা ক্রমশঃ বৃদ্ধি পাওয়ায় সমিতির ঐক্য নষ্ট হয়।

কিন্তু দ্বিতীয় কারণটি আরও গুরুতর–এইটি মূলগত নীতির বিরোধ। যখন দেশব্যাপী অভূতপূর্ব আন্দোলনসত্ত্বেও সরকার বঙ্গভঙ্গ রহিত করিতে অস্বীকার করিলেন, তখন অনুশীলন সমিতির একদল সদস্য সিদ্ধান্ত করিলেন যে, সন্ত্রাসবাদ –অর্থাৎ সরকারী কর্মচারীদের হত্যা করাই সরকারের মত-পরিবর্তনে বাধ্য করার একমাত্র উপায়। সুতরাং তাঁহারা অস্ত্রশস্ত্র ও বোমা তৈরীর ব্যবস্থার দিকেই মন দিলেন। কিন্তু ইহার জন্য বহু অর্থ প্রয়োজন। যখন অন্য উপায়ে উপযুক্ত অর্থ সংগ্রহ সম্ভবপর হইল না তখন স্থির হইল, ডাকাতি করিয়াই অর্থ সংগ্রহ করিতে হইবে। এই দলের সংখ্যা প্রথমে কম ছিল এবং পি. মিত্র প্রভৃতি শীর্ষস্থানীয় নেতারা ইহার বিরুদ্ধে ছিলেন। কিন্তু অরবিন্দ ঘোষ সন্ত্রাসবাদের সমর্থন করিতেন। এইরূপে অনুশীলন সমিতির মধ্যে গুরুতর মতভেদ উপস্থিত হইল।

প্রবীণ বিপ্লবী নেতা * ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী লিখিয়াছেন : “অনুশীলন সমিতির কাজ কিছুদূর অগ্রসর হওয়ার পর পি. মিত্র ও বারীনবাবুর সহিত কর্মপন্থা লইয়া মতভেদ ঘটে। বারীনবাবু প্রভৃতি একদল যুবক হিংসাত্মক কাজকর্মের পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু প্রবীণ নেতা মিত্রমহাশয় গঠনমূলক কাজের উপর জোর দেন। ফলে অনুশীলন সমিতির মধ্য ভাঙ্গন ঘটে। বারীনবাবুর দল অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ, বোমা তৈয়ারী ও হিংসাত্মক কাজে মনোনিবেশ করেন। এই দলের মুখপত্র ছিল ‘যুগান্তর’। ১৯০৬ সনের ১৮ই মার্চ ‘যুগান্তর পত্রিকা বাহির হয়। যুগান্তরের সম্পাদক ছিলেন ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত (স্বামী বিবেকানন্দের কনিষ্ঠ ভ্রাতা)। লেখকদের মধ্যে উপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, দেব্রত বসু, অবিনাশচন্দ্র ভট্টাচার্য, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, কিরণচন্দ্র মুখার্জী প্রভৃতি ছিলেন। এই সময় যুগান্তরের লেখনী হইতে অগ্নিস্ফুলিঙ্গ বাহির হইত। যুগান্তর পত্রিকা ঐ সময় খুবই জনপ্রিয় ছিল। গভর্নমেন্ট যুগান্তর পত্রিকা প্রকাশ করা বন্ধ করিয়া দেন। কিন্তু যুগান্তর বন্ধ হইল না, গোপনে বাহির হইতে লাগিল, সকল দলের লোকই যুগান্তর পত্রিকা নিজের মত মনে করিয়া প্রচার করিত।”

মতভেদের এই বিবরণ মোটামুটিভাবে সত্য হইলেও ইহা আক্ষরিকভাবে পুরাপুরি স্বীকার করা যায় না। দৃষ্টান্তস্বরূপ পি. মিত্র সম্বন্ধে তাহার দুইজন অনুরক্ত ভক্ত যাহা বলিয়াছেন তাহা উদ্ধৃত করিতেছি। বিশিষ্ট বিপ্লবী এবং অনুশীলন সমিতির খুব গোড়ার দিকের সভ্য হরিকুমার চক্রবর্তী বলিয়াছেন : “মিত্র মহাশয় বলতেন যে, সমিতির সভ্যরা ব্যায়াম, লাঠি, ছোরা, তরবারি চালনায় বেশ পারদর্শিতা লাভ করেছে। কিছু কিছু সাহসের পরিচয়ও দিচ্ছে। কিন্তু তার বেশী আরও কিছু প্রয়োজন। তিনি সে-সময় অস্ত্রশস্ত্র সংগ্রহ এবং উপযুক্ত জ্ঞান অর্জন করে বোমা তৈরীর কথা চিন্তা করেছিলেন। একটি গোপনীয় স্থানে বোমা তৈরীর কাজ আরম্ভ হইলে তিনি অর্থসাহায্য করেন।

মিত্র মহাশয়ের আর একটি পরিকল্পনা ছিল। সমিতির সভ্যেরা অর্থ সংগ্রহের জন্য ডাকাতি করে ইহা তিনি পছন্দ করিতেন না। কিন্তু কোনও দুর্ধর্ষ ডাকাত দলকে সমিতির উদ্দেশ্য বলিয়া সরকারী অর্থ লুণ্ঠন করার জন্য প্ররোচিত করা এবং তাহাদের হাতিয়ার সংগ্রহ করিয়া দিবার বিনিময়ে লুণ্ঠিত অর্থের অংশ দেশের জন্য দিবে এই উদ্দেশ্যে সমিতির নির্বাচিত দুই-চারিজন সভ্যকে ডাকাতদের সঙ্গে রাখা।

শ্রীকালীচরণ ঘোষ লিখিয়াছেন: “যখন (হুগলি জেলার) বিঘাটি গ্রামে ডাকাতি হয় এবং সমিতির ছেলেদের দ্বারা অনুষ্ঠিত হয়েছে একথা জানতে পারেন, তখন তিনি বিশেষ আনন্দ প্রকাশ করেছিলেন। বিশ্বস্ত বন্ধুস্থানীয় প্রকাশ্য রাজনীতিক্ষেত্রে সহকর্মী, অরবিন্দের অন্তরঙ্গ, জাতীয় শিক্ষা পরিষদের অন্যতম সচিব অধ্যাপক শ্রীপ্রমথনাথ মুখোপাধ্যায় (স্বামী প্রত্যগাত্মানন্দ সরস্বতী)-কে তাঁর আনন্দ জ্ঞাপন করেন এবং বলেন, ‘যা ছেলেরা তাহলে একটি সাহসের পরিচয় দিয়েছে। স্বামীজীকে প্রশ্ন করে জানা গেল যে পি. মিত্র শেষের দিকে বহুলাংশে সংঘর্ষের পথ সমর্থন করেছিলেন। প্রসঙ্গতঃ বলা যায়, এই ডাকাতি সম্পর্কে তাঁর ২০৯ নং লোয়ার সার্কুলার রোডস্থ বাড়ীতে খানাতল্লাসী হয়েছিল।”

উল্লিখিত বিবরণ পড়িলে এ-কথা মনে হয় না যে পি. মিত্রের ও অরবিন্দের মতের মধ্যে গুরুতর প্রভেদ ছিল। অথচ অরবিন্দের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ সমর্থনে তাঁহার ভ্রাতা বারীন্দ্র ঘোষ পি. মিত্র ও অনুশীলন সমিতি ছাড়িয়া যুগান্তর’ নামে যে নূতন একটি দল গঠন করেন, তাহার ফলে পি. মিত্রের নেতৃত্ব নামেমাত্র পর্যবসিত হইল এবং অনুশীলন সমিতির অনেক শাখা ক্রমশঃ নাম পরিবর্তন না করিয়াও যুগান্তর দলের ন্যায় খুন, জখম ও ডাকাতির উপর জোর দিতে লাগিল। ঢাকার অনুশীলন সমিতি ইহার একটি প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। এ সম্বন্ধে রাউলাট কমিটির উক্তি উদ্ধৃত করিতেছি :

“ঢাকা অনুশীলন সমিতির প্রসার হয়েছে দ্রুত; প্রতিষ্ঠানের কার্যকারিতার বিশেষত্ব এবং কর্মক্ষেত্রে দুর্দান্ত সাহস বিশেষ লক্ষণীয়। কারণ হিসাবে মনে হয়, পূর্ববঙ্গের সাধারণ বাঙ্গালী ছেলে পশ্চিমের চেয়ে দুঃসাহসিকতায় ও দৈহিক শক্তিতে অনেক এগিয়ে আছে।”

এই উক্তি উদ্ধৃত করিয়া কালীচরণ ঘোষ মন্তব্য করিয়াছেন : “এই প্রকৃতি-দত্ত ও অর্জিত শক্তি আর যেন বাধা মানতে চাইছিল না এবং এই কারণেই ঢাকা অনুশীলন সমিতি কার্যক্ষেত্রে অনেকটা অগ্রসর হয়ে পড়ে। এদিকে যুগান্তর পত্রিকাকে ঘিরে পরোক্ষে অরবিন্দ এবং প্রত্যক্ষ যে দল গড়ে উঠলো, তার বড় একটা পরিচয় পাওয়া যায়, কতকগুলি সাহসিকতাপূর্ণ বিপজ্জনক ও নামকরা কাজের মধ্যে দিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে আলিপুর বোমার মামলা এবং তার মধ্যে নরেন গোঁসাই নিপাতপর্ব যুগান্তর দলের প্রতিষ্ঠা অনেক পরিমাণে দৃঢ় করে। ক্ষুদিরাম, প্রফুল্ল, কানাই, সত্যেন প্রমুখ ব্যক্তিরা দলকে আরও সমযুক্ত করে তোলেন।” ( মোটের উপর অনুশীলন ও যুগান্তর এবং তাহাদের সহযোগী প্রতিষ্ঠানগুলি দুইটি বিভিন্ন বিপ্লববাদী দলে পরিণত হইল। তবে কালীচরণবাবু যথার্থই বলিয়াছেন, “একই উদ্দেশ্যে গঠিত বলে পরস্পরের মধ্যে কিছু রেষারেষি থাকলেও তারা একেবারে সম্প্রীতিহীন হয়নি। অন্ততঃ পুলিশকে ধোঁকা দেবার জন্য তারা পরস্পরকে সাহায্য করেছে।”

যুগান্তর দলের মুখপত্র যুগান্তর পত্রিকার কথা পূর্বেই লিখিয়াছি। সকল দলের লোকই ‘যুগান্তর পত্রিকা নিজের মত মনে করিয়া প্রচার করিত তাহাও পূর্বেই বলিয়াছি। সম্পাদক ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত লিখিয়াছেন : “যুগান্তর নাম আমার মনোনীত। দেব্রত বসুর সঙ্গে অনেক আলোচনা করিয়া এই নাম নির্ধারিত করিয়াছিলাম। এই নামটি শিবনাথ শাস্ত্রীর যুগান্তর’ নামক সামাজিক উপন্যাস হইতে ধার লওয়া হয়। আমরা অনেকেই ব্রাহ্মসমাজের ছায়ায় বৃদ্ধিপ্রাপ্ত হই; সেইজন্য এই নামটি আমার বিশেষ পছন্দ হয়। শাস্ত্রী মহাশয় যেমন সামাজিক যুগান্তরের চিত্র দেখাইয়াছেন, আমরাও সেইরূপ রাজনৈতিক যুগান্তরের চিত্র দেখাইব এবং বৈপ্লবিক মনোভাব দেশে আনিব ইহাই আমাদের ইচ্ছা ছিল। …কাগজ সম্বন্ধে আমাদের মাথার উপরে ছিলেন অরবিন্দ ঘোষ, দেউস্কর এবং অবিনাশচন্দ্র চক্রবর্তী।”

ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত আরও লিখিয়াছেন : “যুগান্তরের পশ্চাতে সমগ্র বঙ্গদেশব্যাপী বৈপ্লবিক সমিতিই ছিল। ইহা তাঁহাদেরই কাগজ। এই সময় যাঁহারা পি. মিত্রের তাঁবেদার ছিলেন ও যাহারা লাঠি ঘুরাইতেন তাঁহারা একদল হইলেন। তাহা ছাড়া বঙ্গের সমস্ত কেন্দ্র আমাদের সঙ্গে ছিল এবং আমরা অরবিন্দ ঘোষের নেতৃত্বে কার্য করিতাম। এই প্রকারে বঙ্গে বৈপ্লবিক দলের মধ্যে সর্বপ্রথমে দলাদলির ছায়া প্রকাশ পায়। কলিকাতার অনুশীলন সমিতি, ঢাকার অনুশীলন সমিতি এবং ময়মনসিংহের সুহৃদ সমিতি ও ইহার শাখাসমূহ পি. মিত্রের সরাসরি অধীনে ছিল। তাহা ছাড়া বঙ্গে যেসব বৈপ্লবিক কেন্দ্র ছিল তাহাদের সকলেই আমাদের সঙ্গে অরবিন্দ ঘোষের নেতৃত্বাধীনে কর্ম করিতেন এবং সংখ্যাতেও আমাদের দিকের লোক বেশী ছিল। অথচ বাৎসরিক কনফারেন্সে সকলেই পি. মিত্রের নেতৃত্বাধীনেই মিলিতাম। আশ্চর্যের বিষয় ছিল এই যে, এক সহরে দুইটি দলও ছিল–যথা ঢাকা, ময়মনসিংহ ইত্যাদিতে”।[১]

অনুশীলন সমিতির আদর্শ ও উদ্দেশ্যসম্বন্ধে ত্রৈলোক্য চক্রবর্তী লিখিয়াছেন :

“অনুশীলনের নেতারা এরূপ একটি আদর্শ সমাজ কল্পনা করিয়াছিলেন যে, সমাজের প্রত্যেকটি নরনারীর মনুষ্যত্বের পূর্ণ বিকাশ হইবে।….মানুষের শারীরিক ও মানসিক বৃত্তিগুলির পরিপূর্ণ বিকাশই হইতেছে মনুষ্যত্ব, এবং উহার বিকাশ শুধু অনুশীলন দ্বারাই সম্ভবপর।… অনুশীলন’-পরিকল্পিত সমাজে নিরক্ষর, দুর্নীতিপরায়ণ, চরিত্রহীন, ভীরু লোক থাকিতে পারিবে না।…মানব সমাজ হইতে ধনবৈষম্য, সামাজিক বৈষম্য, সাম্প্রদায়িক বৈষম্য, প্রাদেশিক বৈষম্য দূর করিয়া সকল মানুষের মধ্যে সমতা আনিতে হইবে। ইহা একমাত্র জাতীয় গর্ভনমেন্ট দ্বারাই সম্ভবপর, তাই পরাধীনতার বিরুদ্ধে অনুশীলনের বিদ্রোহ ঘোষণা। অনুশীলন চায় ভারতের পূর্ণ স্বাধীনতা”।[২]

সন্ত্রাসবাদ বা বিপ্লববাদ সম্বন্ধে মতভেদের অবকাশ আছে। কিন্তু ইহার উচ্চ ও মহৎ আদর্শ সম্বন্ধে কোন সন্দেহ থাকিতে পারে না। “বিপ্লব-যুগ ছিল বীরত্ব, আত্মত্যাগ ও নির্যাতনভোগের যুগ। বিপ্লবীরা জানিতেন ধৃত হইলে তাঁহাদের মৃত্যু বা দ্বীপান্তর, সুতরাং নিশ্চিত মৃত্যু জানিয়া কাজ করিতে হইত। তাঁহাদের সম্মুখে লোভনীয় কিছু ছিল না। কাউন্সিল ও কর্পোরেশনের সভ্যপদ, মন্ত্রিত্ব প্রভৃতির আশা ছিল না। বিপ্লবীদের প্রাণে ভারতবর্ষকে স্বাধীন করার আকাঙ্ক্ষা এত প্রবল ছিল যে, তাহাদের মধ্যে কোন দুর্বলতা, হীনতা বা ব্যক্তিগত স্বার্থ স্থান পায় নাই।”

অবশ্য এই আদর্শের ব্যতিক্রম ছিল এবং কেহ কেহ বিশ্বাসঘাতকতাও করিয়াছে ইহাতে আশ্চর্যবোধ করিবার কিছু নাই। কিন্তু, নিশ্চয়ই ইহা আমাদের গর্ব ও গৌরবের বিষয় যে, যাহারা নিষ্ঠার সহিত এই আদর্শ পালন করিয়াছেন অথবা হাসিতে হাসিতে ফাসীর মঞ্চে আরোহণ করিয়াছেন তাঁহাদের সংখ্যাও খুব কম নহে।

বিপ্লবীদের অন্যতম বিশিষ্ট নেতা ভূপেন্দ্রনাথের নিম্নলিখিত উক্তি হইতে তাঁহাদের চিন্তা, সাধনা ও আদর্শ সম্বন্ধে কতকটা ধারণা করা যায় :

“ভারতীয় বিপ্লববাদের লক্ষণ বা স্বরূপ এই : গুপ্ত সমিতির রাজনীতিক ডাকাইতি, ব্যায়ামাগার সংস্থাপন, গুপ্তভাবে বিপ্লববাদ প্রচার, রাজনীতিক হত্যা, গণসঙ্ হইতে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্নতা, কেবল ছাত্রশ্রেণী অথবা বুদ্ধিজীবী দ্বারা (Intellectual) আন্দোলনের পুষ্টিসাধন, কোন নির্দিষ্ট রাজনীতিক প্রণালীর (Party programme) অভাব, বিপ্লববাদের কেবলমাত্র রাজনীতিক বিপ্লবের চেষ্টায় পর্যবসান, চিন্তাক্ষেত্রে জড়তার (static) অবস্থা, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিপ্লববাদ হইতে দূরে থাকা, বিপ্লববাদে সমাজ ও অর্থনৈতিক (Socio-economic) প্রোগ্রামের অভাব, ইত্যাদি”।…”যদিও ব্রাহ্মসমাজ ও তৎপূর্ব আন্দোলনাদি বঙ্গে নূতন আলোক আনয়ন করিয়াছিল, মুখ্যভাবে গীতোক্ত রাজনীতি বেশীর ভাগ বঙ্গভাষী বিপ্লবীদের অনুপ্রাণিত করিয়াছিল। সহচরকে সাহস দিবার জন্য যেরূপ ‘ক্লৈব্যং মাস্ম গমঃ পার্থ’ উপদেশ বিপ্লবীরা দান করিতেন, তদ্রূপ আত্মোৎসর্গ করিবার জন্য ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে’ তত্ত্বজ্ঞান তাঁহাদের নৈতিক তেজ আনয়ন করিত।”

সন্ত্রাসবাদের প্রেরণা ও প্রকৃতি

চরমপন্থী দল মতবাদের ও কার্যপ্রণালীর দিক দিয়া যে নূতন পন্থা অবলম্বন করিয়াছিল তাহা পুরাপুরি কার্যে পরিণত করা সম্ভব হয় নাই, গভর্নমেন্টের উপরও ইহার প্রভাব খুব বেশী হয় নাই। বঙ্গভঙ্গের সম্বন্ধে উদারনীতিক (Liberal) মন্ত্রী জন মর্লি স্পষ্ট ঘোষণা করিলেন, ইহার আর কোন পরিবর্তনের সম্ভাবনা একেবারেই নাই।

পূর্বেই বলা হইয়াছে, স্বদেশী আন্দোলনের উদ্দেশ্য এখন আর বঙ্গদেশ বিভাগের প্রতীকারের মধ্যে সীমিত ছিল না। বয়কট আন্দোলনও বিলাতী দ্রব্য বর্জন ছাড়াইয়া বিদেশী শাসন দূর করিবার লক্ষ্যে পৌঁছিল।

নরম-দলের আবেদন-নিবেদন, আর চরম-দলের নিষ্ক্রিয় প্রতিরোধ-ইহার কোন পন্থাতেই যখন সাফল্যের সম্ভাবনা দেখা গেল না তখন বিপ্লবী দল স্থির করিল যে, এইসব পুরানো মামুলি অস্ত্রে যখন কোন কাজ হইবে না তখন ইহার জন্য চাই, বোমা রিভলভার পিস্তল, প্রভৃতি।

ইহাদের কার্যাবলীর বিবরণ দিবার পূর্বে দুইটি কথা বিশেষভাবে স্মরণীয়। প্রথমতঃ যাহারা এই পথ প্রথম নির্দেশ করিয়াছিলেন তাঁহারা ক্লেশ, নির্যাতন ও সর্বস্বত্যাগ স্বেচ্ছায় বরণ করিয়াই অগ্রসর হইয়াছিলেন, তাঁহাদের মধ্যে অরবিন্দ হইতে আরম্ভ করিয়া অনেক বরণীয় মহাপুরুষ ছিলেন। অরবিন্দ সম্বন্ধে কবি রবীন্দ্রনাথ যাহা বলিয়াছিলেন, অল্প-বিস্তর অনেকের সম্বন্ধেই তাহা প্রযোজ্য :

-তোমা লাগি নহে মান
নহে ধন নহে সুখ; কোনো ক্ষুদ্র দান
চাহ নাই কোন ক্ষুদ্র কৃপা ভিক্ষা
লাগি বাড়াওনি আতুর অঞ্জলি।
… … … … যার কাছে
আরাম লজ্জিত শির নত করিয়াছে
মৃত্যু ভুলিয়াছে ভয়–সেই বিধাতার
শ্রেষ্ঠ দান আপনার পূর্ণ অধিকার
চেয়েছ দেশের হয়ে অকুণ্ঠ আশায়।

দ্বিতীয়তঃ, তাঁহাদের উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য কী ছিল সে-সম্বন্ধে বিপ্লবী নেতা বারীন্দ্রকুমার ঘোষের কয়েকটি উক্তি বিশেষ প্রণিধানযোগ্য। একজন মন্তব্য করিয়াছিলেন, যে, ‘গোটাকতক বোমা ছুঁড়ে কয়েকটা সাহেবকে মারলেই কি দেশ স্বাধীন হবে? বারীন্দ্র তাহার উত্তরে বলিয়াছিলেন, না, আমরা সে আশা করিনি। আমরা চেয়েছিলাম ঘুমন্ত দেশটা মোহনিদ্রায় আচ্ছন্ন-বোমার শব্দে তাদের জাগিয়ে তুলতে।

আলিপুরে বোমার মামলায় তিনি তাঁহার স্বীকারোক্তিতে বিপ্লবী ষড়যন্ত্রের যে বিস্তৃত বিবরণ দিয়াছিলেন তাহারও প্রধান উদ্দেশ্য ছিল ইহাই, এবং এই উদ্দেশ্য যে সফল হইয়াছিল তাহাতে সন্দেহ নাই। কারণ, এই মানিকতলার বাগানে বিরাট ষড়যন্ত্রের ব্যাপারটি আলিপুর মামলার ফলে দেশমধ্যে প্রচার হইলে একটা বিরাট জাতীয় জাগরণের যে সূচনা দেখা দিয়াছিল তাহা অনেকেই স্বীকার করিয়াছেন। অন্যত্র বারীন্দ্র বলিয়াছিলেন, ভবিষ্যতে যে সশস্ত্র বিপ্লব অবশ্যম্ভাবী, আমরা তাহার জন্য প্রস্তুত হইতেছিলাম।’

এই সময়ে কবি রবীন্দ্রনাথ যে কয়েকটি গীতিকবিতা রচনা করেন তাহা যে উদ্দেশ্যেই তিনি লিখিয়া থাকুন, কার্যতঃ দেখি, তাহাতে বিপ্লবীদের মনোবৃত্তির অপূর্ব বিকাশ। ভারতের অন্য কোন প্রাদেশিক সাহিত্যে এরূপ পরিচয় আছে বলিয়া জানি না। রবীন্দ্রনাথ নিজে সহিংস প্রতিরোধ সমর্থন করিতেন কিনা তাহা জানিবার উপায় নাই, কিন্তু কবির মস্তিষ্কই তাহার প্রবন্ধের, এবং হৃদয়ই গীতিকবিতার উৎস। সুতরাং একথা মনে করা যাইতে পারে, কবির রাজনীতিক মত যাহাই হউক, বিপ্লবীদের কর্ম ও আদর্শ দেশের মানুষের মনে যে ভাব জাগাইয়াছিল কবি তাঁহার অনন্যসাধারণ ভাষায় তাহা চিরকালের জন্য রূপায়িত করিয়া গিয়াছেন। যতদিন বঙ্গভাষা জীবিত থাকিবে ততদিন ভবিষ্যদ্বংশীয়েরা তাঁহার কবিতা ও সঙ্গীতের মাধ্যমে বিংশ শতকের প্রথম ও দ্বিতীয় দশকে একদল তরুণ প্রাণের দেশপ্রেম এবং দেশের মুক্তির জন্য সাধনা ও আত্মোৎসর্গের পরিচয় পাইয়া মুগ্ধ ও বিস্মিত হইবে–অস্তগামী বঙ্গ-গৌরবরবির শেষ উজ্জ্বল শিখা তাহাদের নয়নে উদ্ভাসিত হইবে।

নিদর্শনস্বরূপ কয়েকটি গীতিকবিতার উল্লেখ করিতেছি, ইহাই আমার উক্তির যথার্থতা প্রতিপন্ন করিবে :

(১) প্রথমে সঙ্কল্প :

শুভ কর্মপথে ধর নির্ভর গান।
সব দুর্বল সংশয় হোক অবসান ॥
চির শক্তির নিঝর নিত্য ঝরে
লহ অভিষেক ললাট ‘পরে।
তব জাগ্রত নির্মল নূতন প্রাণ
ত্যাগব্রতে নি দীক্ষা
বিঘ্ন হতে নিক শিক্ষা
নিষ্ঠুর সঙ্কট দিক্ সম্মান।
দুঃখই হোক তব বিত্ত মহান্।
চল যাত্রী, চল দিন রাত্রি
কর অমৃতলোক-পথ অনুসন্ধান।
জড়তা তামস হও উত্তীর্ণ
ক্লান্তিজাল কর দীৰ্ণ বিদীর্ণ।
দিন অন্তে অপরাজিত চিত্তে
মৃত্যুতরণ তীর্থে কর স্নান ॥

(১) পরে দুর্গম পথে দ্বিধাসঙ্কুল যাত্রীর উদ্দেশ্যে কবির উদাত্ত কণ্ঠের আহ্বান:

ওরে নূতন যুগের ভোরে
দিস্‌নে সময় কাটিয়ে বৃথা সময় বিচার করে।
কী রবে আর কী রবে না, কী হবে আর কী হবে না
ওরে হিসাবি,
এ সংশয়ের মাঝে কি তোর ভাবনা মিশাবি?
যেমন করে ঝর্ণা নামে দুর্গম পর্বতে
নির্ভাবনায় ঝাঁপ দিয়ে পড় অজানিতের পথে।

(৩) দ্বিধাগ্রস্ত মনে সাহস সঞ্চারের জন্য তাঁহার ভরসাবাণী :

নিশিদিন ভরসা রাখিস্, ওরে মন, হবেই হবে।
যদি পণ করে থাকি, সে পণ তোমার রবেই রবে।
সময় হল, সময় হল–যে যার আপন বোঝা তোল রে–
দুঃখ যদি মাথায় ধরিস্ সে দুঃখ তোর সবেই সবে।

(৪) বিপ্লবীদের প্রধান বাধা আত্মীয়স্বজনের পিছুটান, বন্ধুবান্ধবের বিমুখতা, অন্ধকারময় ভবিষ্যৎ, ব্যর্থতা ও দুর্গম পথে সহযাত্রীর অভাব–এগুলি অতিক্রম করিয়া আগাইয়া চলিবার জন্য কবির অভয়বাণী :

তোর আপন জনে ছাড়বে তোরে,
তা বলে ভাবনা করা চলবে না।
ও তোর আশালতা পড়বে ছিঁড়ে,
হয়তো রে ফল ফলবে না।
আসবে পথে আঁধার নেমে,
তাই বলেই কি রইবি থেমে–
ও তুই বারে বারে জ্বালবি বাতি,
হয়তো বাতি জ্বলবে না।
… … … …
বন্ধ দুয়ার দেখলি বলে
অমনি কি তুই আসবি চলে
তোরে বারে বারে ঠেলতে হবে,
হয়তো দুয়ার টলবে না।

(৫) কবি বলিতেছেন, নিতান্তই যদি সঙ্গী না জোটে, তবে তোমাকে একলাই চলিতে হইবে :

যদি তোর ডাক শুনে কেউ না আসে তবে একলা চলো রে।
একলা চলো, একলা চলো, একলা চলো রে ॥
যদি কেউ কথা না কয়, ওরে ওরে ও অভাগা
যদি সবাই থাকে মুখ ফিরায়ে, সবাই করে ভয়–
তবে পরাণ খুলে
ও তুই মুখ ফুটে তোর মনের কথা একলা বলো রে।
যদি সবাই ফিরে যায়, ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি গহন পথে যাবার কালে কেউ ফিরে না চায়–
তবে পথের কাঁটা
ও তুই রক্তমাথা চরণতলে একলা দলো রে।
যদি আলো না ধরে, ওরে ওরে ও অভাগা,
যদি ঝড় বাদলে আঁধার রাতে দুয়ার দেয় ঘরে,
তবে বজ্ৰানলে।
আপন বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে নিয়ে একলা জ্বলো রে।

(৬) নির্ভীকতার আদর্শ সম্বন্ধে কবির বক্তব্য :

আমি ভয় করব না ভয় করব না।
দুবেলা মরার আগে মরব না, ভাই মরব না ॥
তরীখানা বাইতে গেলে মাঝে মাঝে তুফান মেলে
তাই বলে হাল ছেড়ে দিয়ে–ধরব না, কান্নাকাটি ধরব না।
শক্ত যা তাই সাধতে হবে, মাথা তুলে রইব ভবে–
সহজ পথে চলব ভেবে–পড়ব না, পাকের পড়ে পড়ব না।
ধর্ম আমার মাথায় রেখে চলব সিধে রাস্তা দেখে
বিপদ যদি এসে পড়ে–সরব না, ঘরের কোণে সরব না।

বহুদিন পূর্বে বর্তমান লেখকের গৃহে একবার কয়েকজন বিপ্লবী নেতা সমবেত হইয়াছিলেন। তাঁহাদের মধ্যে ছিলেন ঁ ত্রৈলোক্য চক্রবর্তী (মহারাজ), ঁ প্রতুল গাঙ্গুলী, শ্রীনলিনীকিশোর গুহ, প্রভৃতি। কথা প্রসঙ্গে তাঁহারা বলিলেন, “বিপ্লবী জীবনে রবীন্দ্রনাথের এই শ্রেণীর গীতিকবিতাগুলি আমাদের যে কি সাহস ও সান্ত্বনা জোগাইত তাহা বলিয়া বুঝান যায় না। সারা দিন পুলিশের হাত এড়াইবার জন্য বনে জঙ্গলে ঘুরিয়া সন্ধ্যাকালে শ্রান্তদেহে অবসন্ন মনে কোন জলাশয় দেখিলে তাহার জলে তৃষ্ণা দূর করিয়া একাকী এই সব গান গাহিতে গাহিতে দেহের ও মনের শান্তি দূর করিয়াছি।”

বোমার মামলায় আলিপুর আদালতের কাঠগড়ায় বিপ্লবী আসামীগণকে সমবেত করা হইত। একদিন বিচারক আসার পূর্বে একটি তরুণ বন্দী সহসা রবীন্দ্রনাথের গান গাহিয়া উঠিল :

সার্থক জনম আমার জন্মেছি এই দেশে,
সার্থক জনম মাগো, তোমায় ভালবেসে।
জানিনে তোর ধন রতন, আছে কিনা রানীর মতন,
শুধু জানি আমার অঙ্গ জুড়ায় তোমার ছায়ায় এসে,
কোন্ বনেতে জানি নে ফুল গন্ধে এমন করে আকুল,
কোন্ গগনে ওঠে রে চাঁদ এমন হাসি হেসে। আঁ
খি মেলে তোমার আলো প্রথম আমার চোখ জুড়ালো
এই আলোতেই নয়ন রেখে মুদব নয়ন শেষে।

আদালতের সমস্ত লোক স্তব্ধ হইয়া এই গানটি শুনিল। বর্তমান লেখক যখন হিন্দু হোস্টেলে ছাত্রাবাসে বসিয়া একজন প্রত্যক্ষদর্শীর নিকট এই বিবরণ শুনিলেন তখন এই আসন্ন মৃত্যুপথযাত্রীর প্রতি শ্রদ্ধায় মন ভরিয়া গিয়াছিল। কারণ অধিকাংশ আসামীদেরই যে ফাঁসি হইবে ইহা সকলেই বিশ্বাস করিত।

সন্ত্রাসবাদের কর্মপদ্ধতি

বিপ্লবী মনোবৃত্তি যে স্বদেশী আন্দোলনের পূর্বেই গড়িয়া উঠিয়াছিল, পূর্বে তাহা সংক্ষেপে বিবৃত হইয়াছে। কিন্তু স্বদেশী আন্দোলনের ফলে অনেকের মনেই এই মনোবৃত্তি জাগিয়া উঠিল এবং তাহাদের সংখ্যা ও শক্তি বৃদ্ধি হইল। অরবিন্দ ইহার বিশ্লেষণ করিয়া লিখিয়াছেন, “স্বদেশী আন্দোলনের ফলে সরকার-মহলে ভয়ানক চাঞ্চল্য ও ভয়ের সৃষ্টি হয়, ফলে দমননীতি শুরু হয় ভীষণ। স্কুল কলেজের ছেলেদের জরিমানা করা, বের করে দেওয়া, জেলে পোরা, শাস্তি দেওয়া, এমনকি প্রকাশ্যে বেত-মারা ইত্যাদি অত্যাচার যখন বেড়ে উঠল, তখন বিপ্লবীরা স্থির করল, এর প্রতিবিধান চাই, অর্থাৎ বিপ্লববাদ আস্তে আস্তে সন্ত্রাসবাদের রূপ নিল। বোমা তৈরীর কাজ আগেই আরম্ভ হয়ে গেছে বিপ্লবের উদ্দেশ্যে, এখন দমননীতির প্রতিক্রিয়া হিসাবে বারীনের দল স্থির করল তখনকার গভর্নর ও ম্যাজিষ্ট্রেটকে বোমা ছুঁড়ে মারবে।”[৩]

অরবিন্দ মন্তব্য করিয়াছিলেন, “এসব ক্ষুদে ডাকাতি, সাহেব-মারা মোটেই আমার বিপ্লবের অঙ্গ বা অভিপ্রায় ছিল না। কিন্তু, যখন কোন আন্দোলন জনমতের ইচ্ছার অনুকূল হয় তখন তাকে বাধা দেওয়া উচিত নয়”।[৪] বারীন্দ্রও আলিপুর বোমা-ষড়যন্ত্র মামলায় স্বীকারোক্তিতে বলিয়াছিলেন, “আমরা কখনো বিশ্বাস করিনি যে রাজনীতিক (গুপ্ত) হত্যা (political murder) দ্বারা স্বাধীনতা আসবে। কিন্তু আমরা ইহা জনমতের ইচ্ছা বলিয়াই বিশ্বাস করিতাম।”[৫] অর্থাৎ, প্রতিকারের সকল উপায় ব্যর্থ হওয়ায় জনমত ধীরে ধীরে এই সহিংস বিপ্লবকেই আশ্রয় করিতে বদ্ধপরিকর হইয়াছিল। তবে ঘুমন্ত দেশকে একটা নাড়া দিয়া জাগাইবার ইচ্ছাও যে ইহার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল তাহা পূর্বেই বলিয়াছি।

এই সন্ত্রাসবাদের দুইটি অঙ্গ-ডাকাতি ও সরকারী কর্মচারী-হত্যা। এই দুইটি অনেকটা অঙ্গাঙ্গীভাবে সম্বদ্ধ। এ সম্বন্ধে কিছু বলা আবশ্যক। সন্ত্রাসবাদের প্রধান অস্ত্র বোমা তৈরী করিতে ও রিভলভার প্রভৃতি কিনিতে বহু টাকার প্রয়োজন। তাহা ছাড়া গুপ্ত সমিতির সদস্যদের ভরণপোষণের জন্যও অর্থের প্রয়োজন। কারণ তাহাদের গোপনে থাকিতে হয় এবং জীবিকা নির্বাহের জন্য স্বীয় পরিবারের নিকট হইতে সাহায্যের কোন প্রত্যাশা থাকে না। দেশের ধনীদের এবং পরিচিত বন্ধুবান্ধবদের নিকট হইতে অর্থ সংগ্রহের চেষ্টা করা হইয়াছিল। কিন্তু, এ উপায়ে পর্যাপ্ত অর্থপ্রাপ্তির কোন সম্ভাবনা দেখা গেল না। তখন অনেকের ইচ্ছা না থাকিলেও, অগত্যা একমাত্র উপায় হিসাবে, ডাকাতি করিয়া অর্থসংগ্রহ অনুমোদন করিতে হইল। ডাকাতির ফলে মামলা হইলে তাহার খরচের জন্যও যে অর্থের দরকার হইত তাহাও ডাকাতি করিয়াই সংগ্রহ করিতে হইত। এইরূপে ডাকাতি সন্ত্রাসবাদের অপরিহার্য অঙ্গ হইয়া উঠিল। শোনা যায়, বিপ্লবী নেতা অবিনাশচন্দ্র চক্রবর্তী (ভট্টাচাৰ্য) নাকি বঙ্কিমচন্দ্রের ‘আনন্দমঠের’ নজির দেখাইয়া ডাকাতির সমর্থন করিয়াছিলেন। কেহ কেহ বলেন, বিপজ্জনক সাহসিক কার্যের প্রস্তুতিস্বরূপ ডাকাতি ‘শিক্ষা’ হিসাবেও সমর্থন করা হয়।

নৈতিক অপরাধ ছাড়াও ডাকাতির বিরুদ্ধে একটি বড় যুক্তি ছিল যে, ইহা একবার পেশা হিসাবে আরম্ভ করিলে পরিণামে নেশা হইতে পারে, এবং এই আশঙ্কা যে কোন কোন স্থলে সত্যে পরিণত হইয়াছিল তাহা অস্বীকার করাও কঠিন। তবে নৈতিক অপরাধ লাঘব করিবার অভিপ্রায়ে কয়েকটি সাধারণ নীতি অবলম্বন করা হইয়াছিল। দেশের শত্রু বা সরকারের সাহায্যকারী, সুদখোর, অত্যাচারী ও অন্যান্য প্রকারে যাহাদের চরিত্র কলুষিত বলিয়া প্রমাণিত হইয়াছে, বাছিয়া বাছিয়া তাহাদেরই ধন-সম্পদ এবং সরকারী অর্থলুণ্ঠন প্রভৃতিই ডাকাতির প্রধান লক্ষ্য হইবে। অন্যথা কোন কোন স্থলে লিখিত স্বীকৃতিপত্র দেওয়া হইয়াছিল যে, লুণ্ঠিত ধন-সম্পত্তি দেশ-উদ্ধারের জন্য কর্জস্বরূপ নেওয়া হইল, দেশ স্বাধীন হইলেই তাহা ফিরাইয়া দেওয়া হইবে।

প্রথমদিকে অর্থাৎ, ১৯০৬ সনের ডাকাতির চেষ্টা প্রায়ই ব্যর্থ হইয়াছে। মাহিপুর গ্রামে (রংপুর জিলা) কোন বাড়ীতে ডাকাতি করিতে গিয়া শোনা গেল ঐ গ্রামে দারোগা উপস্থিত-অমনি স্বদেশী ডাকাতেরা পলায়ন করিল। ঢাকা জিলার শেখরনগরে এক বাড়ীতে সিন্ধুক খোলা বা ভাঙ্গা সম্ভব না-হওয়ায় শূন্যহস্তে প্রস্থান করিতে হইল। কিন্তু ক্রমে ক্রমে অভিজ্ঞতা সঞ্চয়ের ফলে ডাকাতি করার পূর্বে খুব নিপুণতার সহিত উদ্দিষ্ট বাড়ীর সম্বন্ধে সমস্ত সংবাদ যথাযথ সংগ্রহ করিয়া উপযুক্ত যন্ত্রাদি ও আত্মরক্ষার সম্পূর্ণ ব্যবস্থা এবং যাতায়াতের পথ ঠিক করিয়া অনেক ডাকাতি সফলতার সহিত সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন হইয়াছে। কয়েকটি বড় রকমের ডাকাতির যে বিবরণ দেওয়া হইতেছে তাহা হইতেই বিপ্লবীদের সাহস, সৈনিকসুলভ নিয়মানুবর্তিতা ও শৃঙ্খলাবোধ প্রভৃতি বহু গুণের পরিচয় সহজেই পাওয়া যাইবে।

ডাকাতির সঙ্গে সঙ্গেই সরকারী কর্মচারী-হত্যার কার্যও আরম্ভ হয়।

১৯০৬ সনের ২৩শে ডিসেম্বর ঢাকার ম্যাজিষ্ট্রেট অ্যালেন (Allen) সাহেবকে গোয়ালন্দে গুলি করা হয়। তিনি গুরুতররূপে আহত হন।

১৯০৭ সনে উল্লাসকর দত্ত ও হেমচন্দ্র দাশ বোমা প্রস্তুত করিতে সমর্থ হইলেন। ইহার ফলে ও পূর্ব বৎসরের অভিজ্ঞতায় বিপ্লবীরা কেবল ডাকাতি নহে, অনেক দাঙ্গা-হাঙ্গামায়ও অংশগ্রহণ করে। ময়মনসিংহ জিলার জামালপুরে মুসলমানেরা হিন্দুদের উপর যে অত্যাচার করে তাহা পূর্বে উল্লিখিত হইয়াছে। সেই সময় ডাকাতির উদ্দেশ্যে লব্ধ অস্ত্রচালনায় নিপুণতা, সামরিক শিক্ষা ও দুর্জয় সাহস শত শত হিন্দু নারীর ধর্ম ও প্রাণরক্ষার একমাত্র উপায়রূপে প্রমাণিত হইয়াছিল। কারণ, সরকারী পুলিশ মুসলমান হাঙ্গামাকারীদের প্রতিরোধ করে নাই।

১৯০৭ সনেই ডাকাতি, পুলিশহত্যা, দাঙ্গা-হাঙ্গামা প্রভৃতি নানা আকারে সন্ত্রাসবাদ প্রকট হইয়া উঠে। ৪ঠা সেপ্টেম্বর ঢাকা শহরে শশীকুমার দে নামক এক ব্যক্তিকে পুলিশের গুপ্তচর সন্দেহে হত্যা করা হয়।

১৯০৭ সনে সন্ত্রাসবাদের একটি গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা, ছোটলাট অ্যান্ড্র ফ্রেজারকে (Andrew Fraser) হত্যা করিবার ব্যর্থ প্রয়াস। লাটসাহেব ট্রেনযোগে কটক হইতে কলিকাতায় আসিতেছিলেন (১৯০৭, ৫ই ডিসেম্বর)। তখন মেদিনীপুর জিলার নারায়ণগড় ষ্টেশনের কাছে রেললাইনের তলায় মাটিতে পোঁতা একটি বোমার বিস্ফোরণ হয়, কিন্তু ট্রেনের কোন ক্ষতি হয় নাই। তদন্ত করিয়া পুলিশ পার্শ্ববর্তী গ্রামের কয়েকটি কুলিকে গ্রেপ্তার করে। তাহারা প্রথমে অস্বীকার করে, কিন্তু হাজতে রাখার কয়দিন পরেই দোষ স্বীকার করে। ফলে বহু লোকের দশ বছর, সাত বছর, পাঁচ বছরের কারাদণ্ড হয়। আলিপুরের বোমার মামলার আসামীরা যখন স্বীকারোক্তি করিল, তখনও হতভাগ্য কুলিদের শাস্তি মকুব হইল না। পুলিশ কিভাবে কারাগারের মধ্যে আসামীর নিকট হইতে স্বীকারোক্তি আদায় করে এবং সত্যের অপেক্ষা যে হাকিমের হুকুম অধিকতর মাননীয়–ইংরেজ বিচারালয়ের এই দিটি মোকদ্দমায় পরিস্ফুট হয়। রাজনীতিক অপরাধের বিচারের প্রহসন ইহাই প্রথম, কিন্তু শেষ নহে। প্রসঙ্গক্রমে বলা যাইতে পারে যে, সন্ত্রাসবাদীরা রেললাইনের তলায় এই বোমা পুঁতিয়া রাখার কাহিনী যেরূপ বিশদৃভাবে এবং সবিস্তারে বর্ণনা করিয়াছিল তাহাতে কাহারও মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ থাকিতে পারে না যে তাহাদের দ্বারাই এই দুষ্কর্ম অনুষ্ঠিত হইয়াছিল। ১৯১০ সনে কুড়ি মাস কারাদণ্ড ভোগ করার পর কুলিরা কারাগার হইতে মুক্তিলাভ করে।

১৯০৭ সনেই আরও কয়েকটি ছোটখাট দাঙ্গা ও ডাকাতি হইয়াছিল। পূর্বোক্ত যুগান্তর পত্রিকার সম্পাদক ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত বিদ্রোহসূচক প্রবন্ধের জন্য কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।

এই বৎসরেই সন্ত্রাসবাদের সূচনাতেই ভারত-সরকার ইহা দমন করিবার জন্য কঠোর আইন প্রণয়ন করেন। এই বৎসরই ‘Prevention of Seditious Meetings Act (বিদ্রোহাত্মক সাধারণ সভা রহিতকরণের বিধি) পাশ হয়। ইহার বিধি নিষেধগুলির সারমর্ম এই :

(১) কুড়ি জনের বেশি লোক নিয়া কোন সাধারণ সভা করিতে হইলে তিন দিন পূর্বে গভর্নমেন্টকে জানাইতে হইবে।

(২) গভর্নমেন্ট ইচ্ছা করিলে এইরূপ সভার অনুমোদন না-ও করিতে পারেন।

(৩) সভা করিবার অনুমতি দিলেও কোন ব্যক্তিবিশেষ এই সভায় বক্তৃতা দিতে পারিবে না, এরূপ নির্দেশ দিতে পারেন।

(৪) এরূপ আর যে-কোনও বিধি-নিষেধ পালনের আদেশ দিতে পারেন।

(৫) এইরূপ সভায় পুলিশ উপস্থিত থাকিতে পারিবে। যে-কোন সম্মেলনে কুড়ি জনের অধিক লোক উপস্থিত থাকিলেই (এমনকি, বিবাহ আসরে কোন ব্যক্তির বাড়ীর অভ্যন্তরে ২০ জনের বেশী একত্র হইলেও) এই বিধি-নিষেধ প্রযোজ্য।

নরমপন্থী দলের আদর্শ উদারমতাবলম্বী জন মর্লি এই আইনে সম্মতি দান করেন। এই আইন বিধানসভায় আলোচনা-কালে রাসবিহারী ঘোষ মন্তব্য করিয়াছিলেন : “এই আইনের উদ্দেশ্য এদেশে রাজনীতিক আন্দোলন বন্ধ করা। এ উদ্দেশ্য সফল হয় নাই। কিন্তু রাসবিহারীর আর-একটি উক্তি অক্ষরে অক্ষরে ফলিয়াছিল। তিনি বলিয়াছিলেন, এই আইনের একমাত্র গুরুতর ফল হইবে-গুপ্ত বিদ্রোহের বীজ বপন করা। ইহা কতদূর সত্য হইয়াছিল অতঃপর তাহাই বর্ণনা করিব।

মজঃফরপুরের হত্যাকাণ্ড

কলিকাতার চীফ প্রেসিডেন্সী ম্যাজিষ্ট্রেট কিংসফোর্ড সাহেব রাজনীতিক অপরাধের সন্দেহমাত্রেই গুরুতর শাস্তি দিতেন। একবার সুশীল সেন নামক একটি যুবককে সামান্য অপরাধের জন্য কঠোর বেত্রদণ্ডের আদেশ দেন। ইহার প্রতিশোধ লইবার জন্য সন্ত্রাসবাদী দল তাঁহাকে হত্যা করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। তদনুসারে রংপুরের প্রফুল্ল চাকী (দীনেশচন্দ্র রায়) ও মেদিনীপুরের ক্ষুদিরাম বসু মজঃফরপুরে কিংসফোর্ডের গতিবিধি লক্ষ্য করিতে থাকেন। ১৯০৮ সনের ৩০শে এপ্রিল একটি ঘোড়াটানা “ভিক্টোরিয়া” গাড়ী চড়িয়া ইউরোপীয় ক্লাব হইতে কিংসফোর্ড রাত্রি সাড়ে আটটার সময় বাড়ী ফিরিতেছিলেন। তাঁহার গাড়ীর সম্মুখেই অবিকল এইরূপ আর একটি গাড়ীতে স্থানীয় বড় উকিল কেনেডি সাহেবের পত্নী ও কন্যা ক্লাব হইতে ফিরিতেছিলেন। অন্ধকারে ঠিক চিনিতে না পারিয়া শেষোক্ত গাড়ীখানা কিংসফোর্ডের বাড়ীর ফটকের কাছে আসিবামাত্র ইহাই কিংসফোর্ডের গাড়ী মনে করিয়া ক্ষুদিরাম বোমা নিক্ষেপ করেন। প্রচণ্ড শব্দে গাড়ী ভাঙ্গিয়া চুরমার হয় এবং আরোহিণী দুইজনেরই মৃত্যু হয়।

বোমা ছুঁড়িবার পর প্রফুল্ল ও ক্ষুদিরাম দুইজনেই পলায়ন করিতে সমর্থ হন। প্রফুল্ল চাকী রেলযোগে মোকামাঘাটে পৌঁছিয়াছিলেন, কিন্তু তাঁহার সহযাত্রী দারোগা নন্দলাল বন্দ্যোপাধ্যায় সন্দেহক্রমে তাঁহাকে গ্রেপ্তার করিতে চেষ্টা করেন। “বাঙ্গালী হয়ে এই কাজটা করলেন”-এই কথা বলিয়াই প্রফুল্ল দৌড়াইতে আরম্ভ করেন। কিন্তু, ধরা পড়িয়াই নিজের পিস্তল দিয়া দুইবার নিজের দেহে গুলি করেন এবং সঙ্গে সঙ্গে তাঁহার মৃত্যু হয়।

নন্দলাল গভর্নমেন্টের নিকট খ্যাতি প্রতিপত্তি ও মোটা রকমের পুরস্কার লাভ করেন। কিন্তু, ছয় মাস না যাইতেই কলিকাতায় সার্পেনটাইন লেনের কাছে পিছন হইতে গুলির আঘাতে তাঁহার মৃত্যু হয়। মৃত্যু সম্বন্ধে নিশ্চিত হইবার জন্য ভূপতিত মৃতদেহে আরও দুই-তিন বার গুলি করিয়া প্রফুল্ল চাকীর হত্যার প্রতিশোধ লইয়া গুপ্তঘাতকেরা প্রস্থান করিল; সন্ত্রাসবাদীদের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি কী তাহাও রক্তের অক্ষরে লিখিয়া রাখিয়া গেল। এই হত্যা প্রতিশোধের প্রথম দৃষ্টান্ত হইলেও অনুরূপ ঘটনা পরবর্তী দশ বৎসর বহুবার ঘটিতে দেখা গিয়াছে।

প্রফুল্ল চাকীর সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুদিরামও ভিন্নপথে পলায়ন করেন। রেলপথের ধারে ধারে চব্বিশ মাইল হাঁটিয়া ক্ষুদিরাম পরদিন প্রাতঃকালে ওয়াইনী (অধুনা ওয়েন) ষ্টেশনে পৌঁছেন। ক্ষুৎপিপাসায় কাতর হইয়া এক দোকানে মুড়ি কিনিয়া খাইতেছিলেন, এমন সময় পুলিশ সন্দেহক্রমে তাঁহাকে গ্রেপ্তার করে। প্রফুল্ল চাকীর ন্যায় ক্ষুদিরামও আত্মহত্যার জন্য পকেট হইতে রিভলভার বাহির করিতে উদ্যত হইয়াছিলেন, কিন্তু পুলিশ হাত চাপিয়া ধরায় মৃত্যুবরণ করিতে পারিলেন না। তিনি কিন্তু কিছুমাত্র বিচলিত হন নাই। “চিত্ত যেথা ভয়শূন্য মুক্ত যেথা প্রাণ”–বিশ্বকবির এই আদর্শ তাঁহার মধ্যে মূর্ত হইয়া উঠিল। তিনি হত্যার দায়িত্ব স্বীকার করিলেন। আদালতে যখন তাঁহার মৃত্যুদণ্ডের প্রস্তুতিপর্ব চলিতেছিল তখন তিনি কাঠগড়ায় নির্বিকার চিত্তে বসিয়া থাকিতেন। কখনও কখনও ঘুমাইয়া পড়িতেন-মৃত্যুর কোন ভয় তাহার অন্তর স্পর্শ করিতে পারে না। ফাঁসীর পূর্বদিন আঠারো বৎসর বয়সের এই বালক তাহার উকীলকে বলিয়াছিলেন, তিনি রাজপুত রমণীর ন্যায় ভীতিহীন চিত্তে মৃত্যুবরণ করিবেন। সংবাদপত্রে ফাঁসীর সম্বন্ধে যে বিবরণ বাহির হইয়াছিল তাহাতে দেখিতে পাই, তিনি সোজা খাড়া হইয়া ফাসীর মঞ্চে উঠিলেন এবং তখনও তাঁহার মুখে হাসি। (He mounted the scaffold with his body erect. He was cheerful and smiling). [৬]

প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরাম বসু বাংলার মুক্তিমঞ্চে প্রথম শহীদ। দেশও তাঁহাদের, অপূর্ব আত্মোৎসর্গের উপযুক্ত সমাদর করিয়াছিল। ইঁহাদের নামে তখন মুখে মুখে অনেক কবিতা ও গান বাংলার পথে-ঘাটে, গ্রামে-শহরে ও সভা-সমিতিতে গীত হইত। প্রত্যেকের সম্বন্ধে একটি করিয়া গানের নীচে উল্লেখ করিতেছি।

(ক) আজিও তোমাকে ভুলিতে পারিনি
বীর প্রফুল্ল চাকী
…. ….
তব পবিত্র সুকঠোর দেহ
স্পর্শিতে কভু পারে নাই কেহ
নিজ হাতে দিলে পরাণ আহুতি
বন্ধন লাজ ঢাকি।

(খ) ক্ষুদিরাম তুমি দিয়েছিলে প্রাণ
বাঙলারে ভালবাসি
হাসিতে হাসিতে মরণমঞ্চে
গলায় পরিলে ফাঁসি।

কেবল দুঃখ বা শোক নহে, প্রফুল্ল ও ক্ষুদিরাম যে বোমা হুঁড়িয়াছিলেন তাহা কেবল মজঃফরপুরে নহে, সমস্ত বঙ্গদেশে তথা ভারতবর্ষে আকাশে বাতাসে ধ্বনিত হইয়া দেশের জড় নিদ্রা ভাঙ্গিয়া দিয়াছিল।

তোরা প্রাণ খুলে বল্ ‘বন্দে মাতরম্’।
তোদের ঘুমের নেশা ভাঙ্গিয়ে দিলে
ক্ষুদিরামের একটি বম্ ॥
তোরা শক্তিমায়ের শক্ত ছেলে
তোদের জোড়া কোথায় মিলে?
তোরা মা অভয়ার অভয় পেলি
তোরা নয় রে ছোট নয় রে কম ॥
একবার তোরা ফিরে দাঁড়া
তুলে নে মা’র বলির খাঁড়া।
ছুটবে তোদের মনের ধাঁধা
বুঝবি নিজের পরাক্রম ॥

পরিধেয় কাপড়ের পাড়ে এইসব গানের অংশ বুনিয়া দেওয়া হইয়াছিল। এইসব পাড়ের কাপড়ের ব্যবহারও সরকার নিষিদ্ধ করিয়াছিলেন।

মুরারিপুকুর বাগানের বিপ্লবী-কেন্দ্র

প্রফুল্ল চাকী ও ক্ষুদিরামের করুণ একাঙ্ক নাটকের উপর যবনিকা পড়িতে-না পড়িতেই আর একটি বিয়োগান্ত মহানাটকের প্রথম দৃশ্য সমগ্র ভারতবর্ষের চক্ষুর সম্মুখে উদ্ভাসিত হইল। এই পঞ্চমাঙ্ক বিয়োগান্ত নাটকের অভিনয় চলিয়াছিল প্রায় ত্রিশ বংসর। ইহাই আধুনিক যুগের বাঙ্গলার ইতিহাসের প্রধান বিষয়বস্তু।

এই নাটকের অভিনয় শেষে যবনিকাপতনের সঙ্গে সঙ্গে বাংলার যে গৌরবময় যুগের অবসান হইল, আর কখনও তাহা ফিরিবে কিনা তাহা একমাত্র ভগবান জানেন। ঐতিহাসিকের দৃষ্টি ততদূর পৌঁছায় না। সংস্কৃত নাটকের রীতিনীতি অনুসারে প্রফুল্ল ও ক্ষুদিরাম ছিলেন এই বিয়োগান্ত নাটকের সূত্রধার। তাহারা মঞ্চ হইতে নিষ্ক্রমণ করিলেন, যবনিকা উঠিল, বাহির হইল কলিকাতার উপকণ্ঠস্থিত মানিকতলায় মুরারিপুকুর রোডে এক বাগানের দৃশ্য। তারিখগুলি বিশেষভাবে স্মরণীয়। ১৯০৮ সন, ৩০শে এপ্রিল সন্ধ্যায় মজঃফরপুরে বোমা ফাটে। পরদিন ১লা মে প্রফুল্ল চাকী আত্মহত্যা করেন এবং ক্ষুদিরামকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। পরদিন প্রাতঃকালে সন্ত্রাসবাদীদের প্রধান ঘাঁটি মুরারিপুকুর রোডের বাগান এবং কলিকাতার আরও পাঁচটি কেন্দ্র পুলিশ ঘেরাও করিয়া খানাতল্লাসী করে, শ্রীঅরবিন্দ প্রমুখ নেতাদের প্রায় সকলেই ধরা পড়েন এবং বাংলার সন্ত্রাসবাদের প্রথমপর্বের পরিসমাপ্তি ঘটে।

মজঃফরপুর ও মুরারিপুকুর রোড বাগানের ঘটনাবলী সমগ্র ভারতবর্ষে যে আলোড়ন এবং স্বাধীনতা সংগ্রামের অগ্রদূতরূপে জাগরণ ও বিস্ফোরণের ঢেউ তুলিয়াছিল আধুনিক যুগের ভারতের ইতিহাসে তাহার তুলনা নাই। কিন্তু ইহার বিবরণ দিবার পূর্বে ইহার প্রস্তুতিপর্বের সম্বন্ধে কিছু বলা প্রয়োজন।

১৯০৭ সনের প্রথম হইতেই উত্তর কলিকাতায় মানিকতলা অঞ্চলে মুরারিপুকুর রোডে একটি বাগানে সন্ত্রাসবাদীদের প্রধান কেন্দ্রটি স্থাপিত হয়।

প্রথম উদ্দেশ্য ছিল, নূতন এক সৈন্যদল গঠন এবং ব্রিটিশের ভারতীয় সৈন্যদলে বিদ্রোহবীজবপন। কিন্তু, তারপর “কর্মগতির মুখ ঘুরে গেল। Military organisation-এর পরিবর্তে এখন থেকে হল Terrorist organisation.”[৭] এই সন্ত্রাসবাদের যেসব কাহিনী পূর্বে উল্লেখ করিয়াছি তাহার প্রায় সবগুলিতেই মুরারিপুকুর বাগানের কর্মীরা সাক্ষাৎভাবে সংশ্লিষ্ট ছিল। সঙ্গে সঙ্গে ধর্মচর্চাও ছিল, গীতা-পাঠও হইত। পাড়ার সাধারণ লোকও পাঠ ও আলোচনায় যোগ দিত। তাঁহাদের অনেকে স্বপ্নেও ভাবেন নাই যে, এই বাগানের নিভৃত কক্ষে মারণাস্ত্র ও খুন-ডাকাতির জন্য অস্ত্রশস্ত্র বা হাতিয়ার তৈরী হয়। এককথায়, গীতা-পাঠ হইতে বোমা তৈরীর মন্ত্রণা–সবই এই বাগানে চলিত এবং সন্ত্রাসবাদী নূতন শিষ্যের দল শিক্ষালাভ করিত ও কয়েকজন ঐ বাগানেই স্থায়ীভাবে বাস করিত। “বাগানের গৃহস্থালী ব্যবস্থা ছিল অতি সরল সহজ ও সাধারণ, হাঙ্গামা যত কম হয়, সময় ও শ্রম যত অল্প ব্যয় হয়। এক বেলাই বোধ হয় রান্না হত, আর রোজই প্রায় খিচুড়ি, আর একবেলা বাজার থেকে কিছু কেনা খাবারই যথেষ্ট ছিল। নিজেরাই রান্না করতাম, নিজেরাই ধোয়া পাখলা করতাম। কাঁসার নয়, আমার মনে হয় সব ছিল মাটির পাত্র।…তারপর যে বাড়িখানা ছিল বসবাসের জন্য, তাও পোডড়াবাড়ি ছাড়া বড় কিছু নয়।”[৮]

সন্ত্রাসবাদীদের প্রধান অস্ত্র ছিল বোমা। অনেকদিন ধরিয়া ইহার জন্য প্রাথমিক অনুসন্ধান গবেষণা-প্রচেষ্টা ও প্রস্তুতি চলিয়াছিল। ১৯০৭ সনের শেষ অথবা ১৯০৮ সনের প্রারম্ভে “উল্লাসকর বললেন, Eureka-সব ঠিক হয়েছে, এবার পুরোপুরি পাকা পরীক্ষা। একটা গোটা বোমা নিয়ে action-এ দেখাতে হবে।”[৯] স্থির হইল, দেওঘরের নিকট একটি ক্ষুদ্র পাহাড়ের উপর নির্জন স্থানে বোমার কার্যকারিতা পরীক্ষা করা হইবে। ১৯০৮ সালের ফেব্রুআরি মাসে বোমাটি সঙ্গে লইয়া পাঁচজন কর্মী দেওঘর পৌঁছিলেন। ইঁহাদের নাম বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, উল্লাসকর দত্ত, প্রফুল্লচন্দ্র চক্রবর্তী, বিভূতিভূষণ সরকার ও নলিনীকান্ত গুপ্ত। প্রথম তিনজন আজ পরলোকে। শেষোক্ত দুইজন শেষজীবন পণ্ডিচেরী অরবিন্দ-আশ্রমে কাটাইতেছেন। নলিনীকান্ত গুপ্ত বর্তমানে পণ্ডিচেরী আশ্রমের অধ্যক্ষ। লেখক ১৯৭১ সালের অক্টোবর মাসে পণ্ডিচেরীতে গিয়া তাঁহাদের বিপ্লবী জীবনের কাহিনী সংগ্রহ করিবার চেষ্টা করিয়াছিলেন। বিভূতিবাবুর স্মৃতিশক্তি এখন অত্যন্ত ক্ষীণ, কথাগুলিও এলোমেলো; সুতরাং বিশেষ কিছু নির্ভরযোগ্য তথ্য তাঁহার নিকট হইতে পাওয়া গেল না। নলিনীবাবু ছাত্রজীবনে বর্তমান লেখকের সহপাঠী ছিলেন। ষাট বছর পরে সাক্ষাতে দুইজনেরই মনের ভাব কিরূপ হইয়াছিল তাহা বলিবার প্রয়োজন নাই। তিনি তখন আশ্রমের একজন প্রধান ব্যক্তি, কিন্তু শরীর অসুস্থ। তাঁহার নিকট হইতে বহু মূল্যবান ঐতিহাসিক তথ্যের সন্ধান পাইয়াছি। প্রথম বোমার প্রস্তুতকাহিনী ও আলিপুর মোকদ্দমার বিবরণী তাঁহার নিকট যাহা শুনিয়াছি তাহাই এ-বিষয়ে প্রচলিত অসংখ্য কাহিনীর মধ্যে সর্বাপেক্ষা প্রামাণিক বলিয়া গ্রহণ করিয়াছি। তিনি মৌখিক কিছু বলিলেন, তারপর তাঁহার সদ্য প্রকাশিত গ্রন্থ ‘স্মৃতির পাতা’ লেখককে উপহার দিলেন। এই গ্রন্থ হইতেই মুরারিপুকুর বাগানের পূর্বোক্ত বিবরণ সংগ্রহ করিয়াছি। অবশিষ্ট বিবরণ যথাসম্ভব তাহার ভাষাতেই বিবৃত করিতেছি।

“স্থান দেওঘর। ঠিক দেওঘর শহর নয়, শহর থেকে মাইল পাঁচেক আগে মেইন রেললাইনে যশিডি জংশন, সেখান থেকে মাইলখানেক দূরে রেললাইনের কাছে একখানা বাড়ি, একতলা-চারিদিকে খোলামাঠ-লোকালয়বহির্ভূত নির্জন স্থান।…মনে আছে, সেই শান্ত পরিবেশে ব্রাহ্মমুহূর্তে উঠে, স্থিরাসনে বসে, ভাবমগ্ন হয়ে উপনিষদের মন্ত্র পাঠ করেছি-তখন কে বলবে এটা হল বোমার কারখানা!”

(পূর্বে বিপ্লবী ও সন্ত্রাসবাদীদের উপর ধর্মের প্রভাবের কথা উল্লেখ করিয়াছি। এই উক্তিটি তাহার একটি বিশিষ্ট প্রমাণ।)

“একদিন বিকালে দিঘিরিয়া পাহাড়ের একেবারে মাথায় একটা প্রকাণ্ড পাথরের গায়ে ছুঁড়ে বোমা পরীক্ষা করার জন্য গেলাম। এই পাথরের একদিক খাড়া উঁচু, বুক-প্রমাণ হবে, আর একটা দিক ক্রমে ঢালু হয়ে নীচে চলে গিয়েছে বিশ-পঁচিশ হাত। প্ল্যান হল প্রফুল্ল ছুঁড়বে খাড়া দিকটির আবডালে পিছনে দাঁড়িয়ে ঢালুটার উপর তাক করে, ছুঁড়েই বসে পড়বে যাতে ফাটার পরে কোন টুকরো গায়ে না লাগে।…উল্লাস থাকবে প্রফুল্লর পাশে।…একটু দূরে একটা গাছের ওপর থেকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে রয়েছি পাথরটার দিকে হঠাৎ দেখি, সেখানে একটি আগুনের ফুলকি জ্বলে উঠল, খানিকটা ধোঁয়া ছড়িয়ে পড়ল আর সঙ্গে সঙ্গে কি বিকট আওয়াজ! সমস্ত আকাশটা যেন ছিঁড়ে কুঁড়ে ফেটে চৌচির হয়ে গেল–শত মেঘগর্জন যেন যুগপৎ।…’সাকসেসফুল, সাকসেসফুল’-চেঁচিয়ে বলতে বলতে চেয়ে দেখি বীভৎস দৃশ্য। প্রফুল্লর মৃতদেহ উল্লাসের বুকের উপর। কপালের একটা পাশ চৌচির, তার ভিতর দিয়ে খানিকটা ঘিলু বের হয়ে পড়েছে। ব্যাপারটা যা হয়েছিল তা এই। আমরা মনে করেছিলাম বোমাটা নীচে পড়লে শক্ত জায়গার সঙ্গে ঘর্ষণ হলে, তবে বিস্ফোরকটায় আগুন জ্বলবে। কিন্তু তা না হয়ে বিস্ফোরকটি এত জোরালো অর্থাৎ সহজে দাহ্য হয়ে উঠেছিল যে আকাশে ছোঁড়ামাত্র বাতাসের সঙ্গে ঘষা লেগেই তা জ্বলে উঠেছে।”

উল্লাসকরও আহত হইয়াছিলেন। কলিকাতায় বিপ্লবীদের একজন বিশস্ত ডাক্তার ছিলেন প্রসিদ্ধ ইন্দুমাধব মল্লিক। তিনি বলিলেন, ক্ষত আশঙ্কাজনক নয়। উল্লাসকর শীঘ্রই সুস্থ হইল।

“ঠিক হল, এ-পর্ব শেষ। পুলিশে জানাজানি হতে পারে, এখান থেকে আস্তানা ভেঙে সরে যাওয়াই যুক্তিসঙ্গত। বোমা তৈরির সাজ-সরঞ্জাম দু-তিনটি ট্রাঙ্কে ভরে এক বন্ধুর দোকানের পিছনে গুদামের ভিতর অন্যান্য জিনিসপত্রের মধ্যে লুকিয়ে রাখা হল।”

বিপ্লবী সন্ত্রাসবাদীদের মনোভাবের পরিচয় হিসাবে প্রফুল্লর মৃতদেহটি পাহাড়েই রাখিয়া ফিরিবার বর্ণনাটি প্রণিধানযোগ্য। “পাহাড় থেকে নামতে শুরু করলাম, স্তব্ধবাক্ রুদ্ধকণ্ঠ বিমূঢ়চিত্ত সবাই। মনে পড়ল চিত্র-Not a drum was

heard, not a funeral note. ….আমি একবার একটু উচ্ছ্বাসভরে বলে উঠলাম, ‘আমরা এসেছিলাম পাঁচজন, ফিরে যাচ্ছি চারজন। বারীনদা আমাকে ধমকে

7046619, “No sentimentality, please.”

বোমার সফলতা নির্ধারণের তিন-চারি মাস পর ইহার সার্থক প্রয়োগ প্রকাশ্যে হইল মজঃফরপুরে–৩০শে এপ্রিল (১৯০৮) সন্ধ্যার পরে রাত্রি প্রায় নয়টার সময়। ঠিক পরদিন রাত্রেই কলিকাতায় মুরারিপুকুর বাগান পুলিশ ঘেরাও করে এবং ২রা মে (১৯০৮) বাগানবাড়ী এবং কলিকাতার পাঁচটি বিভিন্ন স্থানে খানাতল্লাসী করিয়া বহু লোককে গ্রেপ্তার করে।

এই প্রসঙ্গে প্রথম প্রশ্ন, গভর্নমেন্ট কোন তারিখে কী উপায়ে সন্ত্রাসবাদীদের এইসব গুপ্ত আড্ডার সন্ধান পাইল? এ সম্বন্ধে বিগত ৬০ বৎসরে অনেক জল্পনা কল্পনা হইয়াছে, কিন্তু কোন স্থিরসিদ্ধান্তে পৌঁছানো সম্ভব হয় নাই। ইতিহাসের দিক হইতে এই দুইটি প্রশ্নের গুরুত্ব বেশী। সুতরাং এ সম্বন্ধে একটু বিস্তৃত আলোচনা প্রয়োজন।

মজঃফরপুরের ঘটনার অব্যবহিত পরেই মুরারিপুকুর বাগানে খানাতল্লাসী হওয়ায় স্বভাবতই সন্দেহ হয় যে, এই দুই ঘটনার মধ্যে ঘনিষ্ঠ কোন সম্বন্ধ আছে। এই দুইটি ঘটনা যখন ঘটে সেইসময়ে একটি জনশ্রুতি প্রচলিত ছিল যে, মুরারিপুকুরের গুপ্ত সমিতির সদস্য নরেন্দ্র গোঁসাইকে মজঃফরপুর যাইতে নির্দেশ দেওয়া হয়। প্রথমে স্বীকৃত হইলেও পরে ইহার বিপদ সম্বন্ধে অবহিত হইয়া সে পশ্চাৎপদ হয়, কিন্তু সন্ত্রাসবাদী সমিতির নিয়মানুসারে ইহার ফলে মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত জানিয়া সে তাহার পিতা শ্রীরামপুরের জমিদার কিশোরী গোস্বামীর নিকট সমস্ত বৃত্তান্ত নিবেদন করে। কিশোরীবাবু তখন গভর্নমেন্টের সম্মানিত পদস্থ ব্যক্তি। তিনি পুত্রকে লইয়া ছোটলাটের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং সমস্ত ব্যাপার শুনিয়া লাটসাহেব কলিকাতা পুলিশ কমিশনারকে এই গুপ্ত সমিতির বৃত্তান্ত জানান। ইহার ফলেই মুরারিপুকুরের বাগান সম্বন্ধে পুলিশ সমস্ত জানিতে পারে।

এই জনশ্রুতি কতদূর সত্য তাহা নির্ণয় করার উপায় নাই। সম্প্রতি শ্রীকালীচরণ ঘোষ সরকারী দলিলপত্র হইতে অতি গোপনীয় কোডে’ (code) লিখিত মজঃফরপুর হইতে কলিকাতা পুলিশের নিকট প্রেরিত টেলিগ্রামের একখানি নকল পাইয়াছেন। ইহার মর্ম এই যে, “ক্ষুদিরামের স্বীকারোক্তি কতদূর সত্য তাহা নির্ণয় করিবার জন্য অবিলম্বে যথোপযুক্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করিবে, যথেষ্ট পুলিশ পাহারা সঙ্গে রাখিবে যাহাতে কলিকাতায় বোমার উৎপত্তি এবং কলিকাতার অপরাধীদের সঙ্গে ক্ষুদিরামের সম্বন্ধ প্রমাণিত হয়। (Please take immediate steps to verify Khudiram’s confession under strong guard so as to connect him with Calcutta criminals and to trace explosives to that source.)”

এই টেলিগ্রাম হইতে স্বভাবতঃ ইহাই মনে হয় যে, ক্ষুদিরাম পুলিশের নিকট স্বীকারোক্তি করে এবং তাহাতে জানা যায়, বোমার উৎপত্তিস্থান কলিকাতা এবং সেখানকার সন্ত্রাসবাদী দলের পক্ষ হইতেই ক্ষুদিরাম মজঃফরপুরে বোমা ছেড়ে। “Under strong guard”–এই শব্দকয়টির মর্ম বোঝা কঠিন। সম্ভবতঃ সন্ত্রাসবাদীরা যে দলে ভারী এবং ক্ষুদিরামের স্বীকারোক্তির সত্যাসত্য যাচাই করিতে (verify) মুরারিপুকুর বাগানে গেলে সংঘর্ষ হইবার সম্ভাবনা–এইজন্যই বাংলার পুলিশকে পূর্বেই সতর্ক করা হয়।

শ্রীকালীচরণ ঘোষ মহাশয় এই টেলিগ্রামের ভিন্ন অর্থ করিয়া লিখিয়াছেন : “কলিকাতায় খবর এলে, বিহার পুলিশকে নির্দেশ যায়, যেন কড়া পাহারার মধ্যে (under strong guard) ক্ষুদিরামের বিবৃতি যাচাই করা হয়, যার সাহায্যে কলিকাতার পাণ্ডাদের জড়িয়ে ফেলা যায়।”

আমার মনে হয়, এ টেলিগ্রামটি বিহারের পুলিশের উপর নির্দেশ নহে, বিহার হইতে কলিকাতা পুলিশের উপর নির্দেশ। কারণ ‘ক্ষুদিরামের বিবৃতি যাচাই’ কলিকাতাতেই হইতে পারে এবং কয়েদী ক্ষুদিরামের ব্যাপারে বিহার পুলিশের পক্ষে strong guard বা কড়া পাহারার কোন প্রয়োজন বোঝা যায় না।

কিন্তু সে যাহাই হউক, এখানে মূল প্রশ্ন “ক্ষুদিরামের স্বীকারোক্তি” (confession)। ক্ষুদিরাম মুরারিপুকুর বাগানের সন্ত্রাসবাদ সমিতির খবর পুলিশকে বলিয়া দিয়াছিলেন, আপাতদৃষ্টিতে ইহাই অনুমিত হয়। কিন্তু ক্ষুদিরাম সম্বন্ধে উপরে যাহা বলা হইয়াছে তাহার সহিত এই কাপুরুষোচিত স্বীকারোক্তির কোন সঙ্গতি নাই। আমার মনে হয়, ইহার একমাত্র সুসঙ্গত অর্থ এই যে, ক্ষুদিরাম তাঁহার স্বীকারোক্তিতে বলিয়াছিলেন তিনি নিজেই এই বোমার ব্যাপারের জন্য দায়ী। কিন্তু পুলিশ অন্য কোন উপায়ে মুরারিপুকুরের বাগানে সন্ত্রাসবাদীদের বোমা তৈরীর ব্যাপার জানিতে পারে এবং ক্ষুদিরামকে তাহার সহিত যুক্ত করিয়া ঐ বাগানের আস্তানায় যাহারা ছিল তাহাদের সকলেরই ইহার সহিত যোগ আছে ইহা প্রতিপন্ন করিবার চেষ্টা করে। মজঃফরপুরে বোমা-নিক্ষেপের অন্ততঃ কয়েকদিন পূর্ব হইতেই যে মুরারিপুকুর বাগানের আস্তানা সম্বন্ধে পুলিশের সন্দেহ জন্মিয়াছিল, ইহার সমর্থক প্রমাণ হিসাবে শ্রীনলিনীকান্ত গুপ্তের নিম্নলিখিত উক্তিটি উদ্ধৃত করা যাইতে পারে।

“কিছুদিন থেকে আমরা প্রায় সকলেই একটা জিনিস লক্ষ্য করতে শুরু করলাম। আমরা বাইরে যখন যাই, যে কোন কাজে, হাটে বাজারে, কি লোকজনের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে, কেউ যেন আমাদের পিছনে চলেছে একটু দূর থেকে, তবে বেশ স্পষ্টই বোঝা যায় অনুসরণ করছে। থামলে সেও থেমে যায়; দেরি হলে, সে-ও একটা ছুতো নিয়ে নিজেকে ব্যাপৃত রাখে। আমরা নিজেদের মধ্যে বলাবলি করলাম, আবিষ্কার করলাম, এরই নাম তা হলে যাকে বলে ‘স্পাই’ (পুলিশের চর)। সুতরাং এখন থেকে আমাদের বিশেষভাবে সাবধান হতে হবে।”[১০]

পয়লা মে অর্থাৎ বাগান-ঘেরাওয়ের আগের দিনের কথা শ্রীনলিনীকান্ত গুপ্ত লিখিয়াছেন :

“সেদিন সন্ধ্যা হয়ে গেল। আমরা যার যার স্থানে গিয়ে কিছু বিশ্রাম করব ভাবছি। এমন সময়ে অস্বাভাবিকভাবে কতকগুলি মানুষের কণ্ঠস্বর শোনা গেল। অন্ধকারে কতকগুলি লণ্ঠন চলাফেরা করছে দেখা গেল।

কে তোমরা? কি কর এখানে? আমরা যথাসাধ্য বাজে উত্তর দিতে চেষ্টা করলাম। আচ্ছা, বেশ, কাল সকালে এসে ভাল করে জিজ্ঞাসাবাদ করা যাবে’ এই বলে তারা চলে গেল। তাদের মধ্যে সহৃদয় কোন ব্যক্তি আমাদের সাবধান হতে বলে দিয়ে গেল কি?”

তাহার পর স্থির হইল পরদিন প্রাতঃকালেই সকলে বাগান ছাড়িয়া চলিয়া যাইবেন। যদিও তৎক্ষণাৎ বাগান ত্যাগ করার সুবুদ্ধি হয় নাই, তথাপি তাহারা যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন করিয়াছিলেন। “শ্রীঅরবিন্দের বাসায় দুই-তিনটি রাইফেল ছিল তা আনা হল। এগুলি এবং যে-ক’টি রিভলবার ছিল এবং বোমার সাজসরঞ্জাম সব, লোহার পাত দিয়ে তৈরী দুটি বাক্সের মধ্যে পুরে মাটির তলায় পুঁতে ফেলা হয়। তারপর কাগজপত্র নামধাম প্ল্যান প্রভৃতি যার মধ্যে আছে যথাসাধ্য সব অগ্নিসল্কার করা হল, অনেক রাত্রি অবধি। সবকিছু পুড়িয়ে ফেলা সম্ভব হয়নি–অনেক নাম ছিল, তা ধরে খোঁজ করে পুলিশ অনেককে অনেক জায়গা থেকে গ্রেপ্তার করেছে পরে।…যতটা সম্ভব শেষ করে আমরা শুয়েছি, কল্পনা–ভোর হতে না হতেই দেব সব ছুট।”

কিন্তু এ কল্পনা কার্যে পরিণত হইল না। দোসরা মে প্রাতঃকালে পুলিশ বাগানের সকলকেই গ্রেপ্তার করিল। সঙ্গে সঙ্গে কলিকাতার আরও পাঁচটি বিভিন্ন স্থানে এই একই সময়ে খানাতল্লাসী ও অনেককে গ্রেপ্তার করা হইল। ৪৮নং গ্রে

স্ট্রীটে শ্রীঅরবিন্দকে গ্রেপ্তার করা হয়। ২৪ পরগণার জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট বার্লী (Leonard Barley) ছত্রিশ জনকে প্রাথমিক বিচারের পর দায়রা সোপর্দ করেন। দায়রা জজ বীচক্র (Charles Porten Beachcroft) ১৯শে অক্টোবর (১৯০৮) শুনানী আরম্ভ করেন। ১৯০৯ সনের ১৩ই এপ্রিল বিচার শেষ হয় এবং মে মাসের ছয় তারিখে দায়রার রায় ঘোষণা করা হয়। শ্রীঅরবিন্দ ও অন্য ষোল জনের মুক্তি, বারীন্দ্র ও উল্লাসকর এই দুইজনের ফাঁসী, দশজনের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর, তিনজনের দশ বছর দ্বীপান্তর, তিনজনের সাত বছর ও একজনের এক বছর সশ্রম কারাদণ্ড হয়। হাইকোর্টে আপীলের ফলে দুইজন জজ জেনকিন্স (Jenkins) এবং কার্নােফ (Carmduf) ২৩শে অগষ্ট (১৯০৯) যে রায় দেন, তাহার ফলে ফাসীর হুকুম রদ হয়, চারজনের যাবজ্জীবন দ্বীপান্তর, তিনজনের দশ বছরের দ্বীপান্তর, তিনজনের সাত বছরের দ্বীপান্তর এবং দুইজনের পাঁচ বছরের জন্য সশ্রম কারাদণ্ড হয়। পাঁচজন আসামী সম্বন্ধে বিচারকদের মধ্যে মতদ্বৈধতা হওয়ায় তৃতীয় জজ রিচার্ড হ্যাঁরিংটনের (Richard Harrington) পুনর্বিচারের ফলে তিনজনের মুক্তি হয় এবং আর দুইজনের যথাক্রমে সাত বৎসর দ্বীপান্তর ও পাঁচ বৎসর সশ্রম কারাদণ্ডের আদেশ হয়।

আলিপুরের এই বোমার মামলা ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবে। ইহার বিস্তৃত বিবরণ দিবার স্থান এখানে নাই। তবে কয়েকটি বিশেষ ঘটনার সংক্ষিপ্ত আলোচনার প্রয়োজন আছে।

প্রথমতঃ, বারীন্দ্রকুমার ঘোষ, যাঁহাকে দলের প্রধান বা একজন বিশিষ্ট নেতা বলিয়া গণ্য করা হয়, তিনি মামলার প্রথমেই (৪ঠা মে) স্বেচ্ছায় স্বীকারোক্তি করেন এবং অকপটে সন্ত্রাসবাদীদের ইতিহাস, কার্যপ্রণালী ও প্রধান ঘটনাবলী বিবৃত করেন। এই প্রসঙ্গে তিনি নরেন গোঁসাই যে এই দলে ছিলেন, তাহা বলেন এবং ইহার ফলেই পুলিশ নরেন গোঁসাইকে গ্রেপ্তার করে। কেবলমাত্র শ্রীঅরবিন্দ যে এই দলের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন, তাহার আভাসমাত্র দেন নাই। সমগ্র দলটি ও ইহার সদস্যশ্রেণীভুক্ত ব্যক্তিবিশেষকে যে এই স্বীকারোক্তির ফলেই পুলিশ সহজে অপরাধী বলিয়া প্রমাণিত করিতে সমর্থ হইয়াছিল তাহাতে কোন সন্দেহ নাই।

বিগত ষাট বৎসর ধরিয়া বারীন্দ্র ঘোষের এই স্বীকারোক্তি নিয়া বহু আলোচনা হইয়াছে। কেহ তাহাকে সমর্থন করিয়াছেন–অনেকে তাঁহার কার্য অসঙ্গত বলিয়া মত প্রকাশ করিয়াছেন। বারীন্দ্র নিজের কার্যের কৈফিয়ৎস্বরূপ তাঁহার আত্মকাহিনীতে যাহা লিপিবদ্ধ করিয়াছেন তাহার সারমর্ম যথাসম্ভব তাহার ভাষাতেই এখানে বলিতেছি।

“আমাদের দফা ত এইখানেই রফা হইল, এখন আমরা যে কী করিতেছিলাম তাহা দেশের লোককে বলিয়া যাওয়া দরকার…

এই প্রকারে আত্মকীর্তি রাখিতে গিয়া অপরাধ স্বীকার করিয়াছি। ইহার মধ্যে একটা প্রচ্ছন্ন বাহাদুরীর বেশ গাঢ় প্রলেপ আছে।…আমাদিগকে প্রকাশ্য রাজদ্বারে ঘাতকহস্তে স্বেচ্ছায় যাচিয়া জীবন দিতে না দেখিলে বুঝি, এ মরণভীরু জাতি মরিতে শিখিবে না।…খুন চাপিয়া যাওয়ায় সে সময়ে নরেন গোঁসাই-এর নাম বলা হইয়াছিল।”

শোনা যায় শ্রীঅরবিন্দ তাহার ভ্রাতা বারীন্দ্রের এইপ্রকার স্বীকারোক্তির বিরোধী ছিলেন এবং তাহাকে বারে বারে এই স্বীকারোক্তি প্রত্যাহারের নির্দেশ দিয়াছিলেন। বারীন ঘোষ উপেন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়কে বলিয়াছিলেন যে আমার কাজ ফুরিয়ে গেছে’ (My mission is over)। কিন্তু উপেন্দ্র তাহা স্বীকার করেন নাই, বলিয়াছিলেন দেশের কাজ ত সবই বাকী।” কিন্তু তথাপি তিনি ও উল্লাসকর দত্ত সম্ভবতঃ বারীন্দ্রের প্রভাবেই স্বীকারোক্তি করিয়াছিলেন।[১১]

শ্রীনলিনীকান্ত গুপ্ত বলেন : “বারীনদা এবং আমাদের জ্যেষ্ঠ কয়েকজন ধরা পড়েই স্বীকারোক্তি করেছিলেন এক উদ্দেশ্যে কয়েকজনের আত্মবলি দিয়ে দলটিকে বাঁচাতে। কয়েকজন সমস্ত দায়িত্ব নিজেদের উপর গ্রহণ করে যদি আর সকলকে নির্দোষ বলে প্রমাণ করান যায়।[১২]

শ্রীঅরবিন্দ কেন ইহার বিরোধী ছিলেন সে-সম্বন্ধে নলিনীবাবু বলিয়াছেন :

“শ্রীঅরবিন্দ বলেন, ব্যক্তিগত মান-অপমানের চেয়ে, ব্যক্তিগত গুণপনা দেখানোর চেয়ে, বড় কথা হল কর্মসিদ্ধি। তিনি দিতেন শ্রীকৃষ্ণের উদাহরণ

শ্রীকৃষ্ণ জরাসন্ধের কবলে পড়তে চাননি, তাই পালিয়ে গিয়েছিলেন দ্বারকায় ব্যবস্থা সব তৈরী করে নেবার জন্যে। তাই শ্রীঅরবিন্দ বলতেন, পৃষ্ঠ প্রদর্শন মাত্রই যে হেয় তা নয়, we live to fight another day-এই হল সৈনিকের ধর্ম। সুতরাং বারীনদা প্রভৃতিকে তিনি পরামর্শ দিয়ে রেখেছিলেন যে ধরা পড়লে, কখনো কিছু হঠাৎ স্বীকার করবে না–চুপ করে থাকবে, সময়ে প্রয়োজনমতো যা বলবার পরে বলবে।”

এ সম্বন্ধে কোন চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা কঠিন। শ্রীকালীচরণ ঘোষের মন্তব্য উদ্ধৃত করিয়াই ইহার উপসংহার করিব : “আজ আমার নিকট এ বিষয়ের ভাল মন্দ বিচারের যৌক্তিকতা নেই। সে যুগে এই তেজোব্যঞ্জক বিবৃতির ফলে বহু সন্দেহবাদী অথচ দেশপ্রেমে মাতোয়ারা যুবক ঘর ছেড়ে সাহসে ভর করে বেরিয়ে পড়েছিলেন এবং উত্তরকালে বিপ্লবে বড় অংশগ্রহণ করেছিলেন, সে কথা একাধিক লোকের মুখ থেকে শুনছি।”[১৩]

আলিপুর মামলার দ্বিতীয় বিশেষ ঘটনা নরেন গোঁসাইয়ের স্বীকারোক্তি ও তাহার ভয়াবহ পরিণাম। বারীন্দ্রের স্বীকারোক্তির ফলেই যে নরেন গোঁসাইকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে এবং নরেনের সংবাদ দেওয়ার ফলেই যে পুলিশ মুরারিপুকুর বাগানের সন্ত্রাসবাদী আড্ডার সন্ধান পায়-এরকম সন্দেহের কথা পূর্বেই বলিয়াছি। অন্যান্য আসামীদের সঙ্গে নরেনও আলিপুর জেলে ছিল। কিন্তু ক্রমে ক্রমে তাহার প্রতি অন্যান্য বিপ্লবী বন্দীদের মনে সন্দেহের উদয় হয়। পুলিশ নরেনকে জেল-অফিসে কয়েকদিন ডাকিয়া নিয়া যায়। নরেন প্রায়ই দলের অন্যান্য কর্মীদের, বিশেষতঃ যাহারা বাংলার বাহিরে থাকে তাহাদের বিবরণ জানিবার জন্য ঔৎসুক্য প্রকাশ করেন। অবশেষে ২৩শে জুন গভর্নমেন্ট তাহার বিরুদ্ধে মামলা প্রত্যাহার করে এবং নরেন চারিদিন যাবৎ সমস্ত কাহিনী, বিশেষতঃ অরবিন্দের সক্রিয় অংশ সম্বন্ধে, বিস্তৃত বিবরণ দেয়। তখন নরেনকে অন্যান্য সকল আসামীর সঙ্গে না রাখিয়া ইউরোপীয় অভিযুক্তদের ওয়ার্ডে রাখা হয়।

শ্রীঅরবিন্দের বিরুদ্ধে পুলিশ বেশী প্রমাণ সংগ্রহ করিতে পারে নাই। সম্ভবতঃ সেই জন্যই পুলিশের পরামর্শে নরেন এমন সব কথা বলিয়াছিল যাহাতে অরবিন্দের গুরুতর দণ্ড সম্বন্ধে কোন সন্দেহ রইল না। অরবিন্দকে বাঁচাইতে গিয়া বারীন্দ্র গুপ্ত সমিতির প্রসঙ্গে অরবিন্দের নামোল্লেখও করেন নাই। বারীন্দ্রের স্বীকারোক্তির ফলেই নরেনকে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। সম্ভবতঃ তাহার প্রতিশোধ লইবার জন্যই নরেন অরবিন্দের বিরুদ্ধে সত্য মিথ্যা অনেক কাহিনী বলে। অন্যান্য আসামীরা অরবিন্দের এই বিপদে মুহ্যমান হইয়া পড়িল। হঠাৎ একটু আশার আলো দেখা দিল। আইনের স্পষ্ট বিধি অনুসারে নরেনের উক্তিসম্বন্ধে আসামীপক্ষ তাহাকে আদালতে জেরা না করা পর্যন্ত এই উক্তি সাক্ষ্য বলিয়া গ্রহণ করা যাইবে না, সুতরাং জেরার পূর্বে নরেনকে হত্যা করিবার বন্দোবস্ত হইল। এই কার্যের ভার নিলেন আসামী সত্যেন ও কানাই।

সত্যেন অসুখের অজুহাতে মাঝে হাসপাতালে যান এবং আদালতে অনুপস্থিত থাকেন। রোগবৃদ্ধি পাওয়ায় ২৭শে অগষ্ট তাঁহাকে হাসপাতালে স্থানান্তরিত করা হইল। পেটে হঠাৎ কলিক বেদনা হওয়ায় কানাই ৩০শে অগষ্ট হাসপাতালে গেলেন। ইতিমধ্যে সত্যেন নরেনকে একবার হাসপাতালে আসিয়া তাহার সঙ্গে দেখা করিতে অনুরোধ করেন। কারণ, তিনি বিপ্লবী কর্মের জন্য অনুতপ্ত এবং তাঁহার সঙ্গে পরামর্শ করিয়া কর্তব্য স্থির করিবেন। নরেন তদনুসারে সত্যেনের সঙ্গে দুইবার দেখা করে এবং সত্যেন নরেনের ন্যায় পুলিশের নিকট স্বীকারোক্তি করিবেন এরূপ আভাস দিলেন। ইহা শুনিয়া পরদিন (৩১শে) আবার সত্যেনের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করেন।

৩১শে অগষ্ট সকাল সাতটার সময় এক ফিরিঙ্গি ওয়ার্ডার সঙ্গে করিয়া নরেন হাসপাতালে যায় এবং দোতলায় সত্যেনের ঘরের সম্মুখে অপেক্ষা করে। এমন সময় কানাই আসিয়া গুলি করেন। নরেনের হাতে গুলি লাগে এবং সে সিঁড়ি দিয়া নামিয়া দৌড়াইতে থাকে। ইতিমধ্যে সত্যেনও রিভলভার হাতে বাহির হন। তিনি ও কানাই গুলি ছুঁড়িতে ছুঁড়িতে নরেনের পশ্চাদ্ধাবন করেন। ওয়ার্ডার বাধা দেয় এবং সত্যেনকে গুলি করে। হাতের তালুতে গুলি লাগা সত্ত্বেও দুইজনেই নরেনকে অনুসরণ করেন। হাসপাতালের গেটের কাছে ওয়ার্ডারেরা সত্যের ও কানাইকে ধরিয়া ফেলে। কোনরকমে ডানহাতটা ছাড়াইয়া কানাই তাহার শেষ বুলেটটি নরেনকে লক্ষ্য করিয়া ছোঁড়েন এবং নরেনের মৃতদেহ কতকটা নর্দমা আর কতকটা তাহার পারে লুটাইয়া পড়ে। সত্যেন ও কানাই তখন আনন্দিত চিত্তে বিনাবাধায় পুলিশের হাতে আত্মসমর্পণ করেন।

এই ঘটনায় সমগ্র দেশ আনন্দমুখর হইয়া ওঠে। সকলেরই মুখে এবং সংবাদপত্রে প্রচণ্ড উল্লাস ব্যক্ত হয়। এমনকি, ইংরেজ সম্পাদিত ‘পাইওনিয়র পত্রিকাও কানাই ও সত্যেনের বিপুল সুখ্যাতি করে।

বলা বাহুল্য, উভয়েরই ফাঁসী হয়। কানাই-এর ফাঁসী হয় ১০ই নভেম্বর (১৯০৮)। মৃতদেহ আলিপুর জেল হইতে কেওড়াতলার শ্মশানঘাটে নীত হয়।

“বিপুল শঙ্খধ্বনি আর পর্বতপ্রমাণ ফুলের মধ্য দিয়ে বিরাট মিছিল চলতে থাকে। জয়, দৃঢ়প্রতিজ্ঞা, আদর্শনিষ্ঠার প্রতীককে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্য হাজার হাজার ছাত্র জুটেছিল–আর তাদের দলপতি হলেন, রামানন্দ চট্টোপাধ্যায়। চন্দনকাঠের চিতার মাঝে কানাইয়ের নশ্বর দেহ ভস্মীভূত হয়ে গেল”।[১৪] এই ছাত্রদলের অন্যতম বর্তমান লেখক যে-দৃশ্য দেখিয়াছিলেন, ৬৬ বছর পরেও আজিও তাহা বিস্মৃত হইতে পারেন নাই। কালীঘাটের রাস্তায় আগাগোড়া শোকাভিভূত দর্শকের অসম্ভব ভীড়-রাস্তার পাশে দুইদিকের বাড়ী হইতে শবাধারে পুস্প ও লাজ (খৈ) বৃষ্টি এবং মুহূর্মুহূ শঙ্খধ্বনি এক অপরূপ দৃশ্যের সৃষ্টি করিয়াছিল। ইহার বিবরণ জানিয়া ২১শে নভেম্বর সত্যেনের ফাঁসী হইলে গভর্নমেন্ট তাঁহার মৃতদেহ জেলের বাহিরে শ্মশানঘাটে লইবার অনুমতি দিলেন না। সত্যেনকে জেলের মধ্যেই দাহ করা হয়। এই সংবাদে অনেকের মনেই ইংরেজী কবিতাটির একটি লাইন ভাসিয়া Giontigo-”Not a drum was heard, not a funeral note.”

এই প্রসঙ্গে একটি বহুবিতর্কিত প্রশ্ন–সত্যেন ও কানাই কোথা হইতে রিভলভার সংগ্রহ করিল? এ সম্বন্ধে শ্রীনলিনীকান্তের উক্তি উদ্ধৃত করিতেছি :

“জেলের মধ্যে পিস্তল আমদানি করা হল কি রকমে তা নিয়ে অনেক রকম জল্পনা-কল্পনা করা হয়েছিল; বিস্কুটের বাক্সের ভিতরে, মাছের পেটে বা কাঁঠালের নাড়ী-ভুঁড়ির মধ্যে, কত কি! এখন আমি বলি কি রকমে পিস্তলটা এসেছিল।….

“পুলিশ যখন দেখল যে আমরা অত ভয়ঙ্কর হিংস্র জানোয়ার কিছুই নই তখন আত্মীয়-স্বজন বন্ধুবান্ধবদের সঙ্গে মাঝে মাঝে দেখা করবার সুযোগ দিত। একটা ঘরের মাঝখানে একটা গরাদের বেড়া তুলে দেওয়া হয়েছিল–একদিকে দাঁড়াত অভ্যাগতরা, অন্যদিকে দাঁড়াতাম আমরা। শান্ত্রী এ-পাশে ও-পাশে থাকত বটে, কিন্তু বিশেষ কিছু নজর করত না। গায়ে আলোয়ান বা মোটা চাদর জড়িয়ে রেলিংয়ের ভিতর দিয়েই বেশ ছোঁয়াছুঁয়ি চলতে পারে। এইভাবে গরাদের ভিতর দিয়ে কানাই ও সত্যেনের রিভলভার দুটি হস্তান্তরিত হয়।”[১৫]

অন্য বিবরণ হইতে জানা যায় যে, বিছানার তলায় মাটি খুঁড়িয়া গর্ত করিয়া তাহার মধ্যে এই রিভলভার দুইটি রক্ষিত হয়। কে বা কাহারা এই রিভলভার জেলে নিয়া আসিয়াছিল, সে-সম্বন্ধেও বহু জল্পনা-কল্পনা হয়। প্রায় কুড়ি বছর আগে যখন ভারত গভর্নমেন্ট স্বাধীনতা আন্দোলনের ইতিহাস লিখিবার জন্য একটি কমিটি গঠন করেন তখন ঐ কমিটি ঘোষণা করিয়াছিল, যিনি উপযুক্ত প্রমাণসহ এই তথ্যটির সন্ধান দিতে পারিবেন তাঁহাকে পুরস্কার দেওয়া হইবে। ইহার উত্তরে অন্ন পাঁচজন দাবি করিয়াছিলেন যে, তিনিই এই পিস্তল দিয়াছিলেন। বলা বাহুল্য, এই সকল দাবি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন। এ-বিষয়ে যে বিশ্বস্ত প্রমাণ পাওয়া গিয়াছে তদনুসারে চন্দননগরের কর্মী বসন্তকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় ও শ্রীশচন্দ্র ঘোষ বারীন্দ্র ঘোষের নির্দেশমত অগষ্ট মাসের একেবারে শেষদিকে পূর্বোক্ত উপায়ে রিভলভার দুইটি আসামীদের সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তাঁহাদের হাতে দিয়া যান।

আলিপুর বোমার মামলার বিবরণ শেষ করিবার পূর্বে আলিপুর সেসন জজের আদালতে শ্রীঅরবিন্দের পক্ষ সমর্থন করার সম্বন্ধে কিছু বলা প্রয়োজন। সেসন জজ বীচক্রক্ট (Beachcroft) ইংলণ্ডে অরবিন্দের সহপাঠী ছিলেন। আসামীদের পক্ষ সমর্থনের জন্য প্রথমে বিচক্ষণ ব্যারিষ্টার ব্যোমকেশ চক্রবর্তী নিয়োজিত হইয়াছিল। তাহার পরের ঘটনা সম্বন্ধে ব্যারিষ্টার শ্ৰীচিত্তরঞ্জন দাশের কন্যা অপর্ণা দেবী লিখিয়াছেন:

“প্রথম থেকেই বাবার এ মামলা সমর্থন করবার খুব ইচ্ছা ছিল। এই সময়ে তিনি খুব পরলোকতত্ত্ব আলোচনা করতেন, এবং প্রায়ই রাত্রে আমাদের রসা রোডের বাড়ীতে আত্মা আনয়ন করবার জন্য চক্রে বসতেন। একদিন বাবা বল্লেন, আজ আত্মা-চক্র বৈঠকে অরবিন্দের মোকদ্দমার কথা জিজ্ঞাসা করব। নাটোরের স্বর্গীয় মহারাজা জগদিন্দ্রনাথ রায়ও এ বৈঠকে থাকতেন। সেদিন ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়ের আত্মা এসেছিলেন। বাবা অরবিন্দের কথা জিজ্ঞাসা করতেই ইংরেজীতে লেখা হলো– you must defend Aurobinda এবং এই একই কথা চঞ্চল পেনসিল ঘুরে ফিরে বারবার লিখতে লাগল।…মোকদ্দমা সত্যই তার কাছে এলো। কারণ মামলা পরিচালনা করবার অর্থ নিঃশেষিত হলে ব্যোমকেশ চক্রবর্তীর মত বিচক্ষণ ব্যারিষ্টারকে আর নিযুক্ত করা সম্ভব হলো না। এবং তিনিও থাকতে চাইলেন না। তখন অরবিন্দের তরফ থেকে ‘বন্দে মাতরম্‌’-এর কর্মিগণ, শ্যামসুন্দর চক্রবর্তী ও কৃষ্ণকুমার মিত্র বাবাকে প্রথম এ মামলা পরিচালনার জন্য অনুরোধ করেন। (পরে) উল্লাসকরের জননী এসে পিতৃদেবকে এ মামলা চালাতে বল্লেন-”আমি শুধু আমার ছেলের জন্য আসিনি, সব ছেলেদের বাঁচাবার ভার তুমি নাও, বাবা। এরপর বাবা প্রথমে নামমাত্র পারিশ্রমিকে মামলা আরম্ভ করলেন।”[১৬]

চিত্তরঞ্জনের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ ছিল। তথাপি কী কঠোর পরিশ্রম ও অধ্যবসায় সহকারে ও একাগ্র মনে সামান্য অর্থের বিনিময়ে তিনি অন্য সমস্ত কাজকর্ম ও আমোদ-আহ্লাদ ত্যাগ করিয়া এই মোকদ্দমার কার্যে আত্মনিয়োগ করিয়াছিলেন, কন্যা স্বর্গীয়া অপর্ণা দেবী তাহার যে বিবরণ দিয়াছেন তাহা পড়িলে শ্রদ্ধায় মস্তক অবনত হয় এবং আমরা ভবিষ্যৎকালে দেশের জন্য সর্বত্যাগী চিত্তরঞ্জনের পূর্বাভাস পাই।

কোর্টে মামলার শুনানী প্রসঙ্গে চিত্তরঞ্জন সম্বন্ধে অপর্ণা দেবী লিখিয়াছেন :

“পিতৃদেবের আইন-বিশ্লেষণ শক্তি ও যুক্তিতর্কের প্রভাব এবং অধৌত ভাবাভিভূত হৃদয়গ্রাহী বক্তৃতায় বিচারপতিদ্বয় স্তম্ভিত হয়েছিলেন। তাঁর সুযুক্তিপূর্ণ বাগ্মিতা আইনের ইতিহাসে চিরস্মরণীয় হয়ে রইল আলীপুরের বোমার মামলায়।”[১৭]

পিতার সম্বন্ধে কন্যার উক্তি হইলেও ইহা যে সমগ্র দেশেরও অভিমতের প্রতিধ্বনি ইহা নিঃসংশয়ে বলা যাইতে পারে।

অরবিন্দের জবানিতে তাঁহার সমর্থক ব্যারিষ্টার চিত্তরঞ্জন তাঁহার ভাষণে বলিয়াছিলেন, “আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ যে, আমি দেশে স্বাধীনতার আদর্শ প্রচার করিয়াছি–আমি এই অপরাধ স্বীকার করি। ইহার জন্যই আমি কলিকাতায় আসিয়াছি। ইহার জন্যই আমি জীবন ধারণ করি, পরিশ্রম করি-জাগরণে ইহাই আমার একমাত্র চিন্তা, নিদ্রায় ইহাই আমার স্বপ্ন।”

ইহার পর অরবিন্দ সম্বন্ধে চিত্তরঞ্জন বিচারকদের সম্বোধন করিয়া নিম্নলিখিত যে কয়টি কথা বলিয়াছিলেন, তাহা স্বর্ণাক্ষরে লিখিত হইবার যোগ্য :

“I appeal to you, therefore, that a man like this stands not only before the bar in this court but stands before the bar of the High Court of History…Long after this controversy is hushed in silence, long after this turmoil, this agitation ceases, long after he is dead and gone, he will be looked upon as the poet of patriotism, as the prophet of nationalism and the lover of humanity. Long after he is dead and gone his words will be echoed and re-echoed not only in India but across distant seas and lands.”

ইহার মর্মার্থ :

আপনাদের কাছে আমার নিবেদন এই, আপনাদের সম্মুখে এই-যে অভিযুক্ত ব্যক্তি বিচারের জন্য দণ্ডায়মান, একদিন মানব-ইতিহাসের সর্বোচ্চ ধর্মাধিকরণে তাঁহার বিচার হইবে। তাহার বিরুদ্ধে বাদ-বিতণ্ডা, কোলাহল ও আন্দোলন নিস্তব্ধ হইবার বহুদিন পর, তাঁহার তিরোধানের দীর্ঘকাল পরেও, তিনি স্বদেশপ্রেমের কবি, জাতীয়তাবাদের গুরু এবং মহা-মানবপ্রেমিকরূপে জাগতে পূজিত হইবেন। তাঁহার তিরোভাবের বহুকাল পরেও তাঁহার বাণী কেবল ভারতে নহে, বিস্তৃত সমুদ্রের পরপারে দেশে দেশে ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত হইবে।

এই ভাষণ দিতে দিতে ভাবাবেগে চিত্তরঞ্জনের নয়ন সজল হইয়া উঠিয়াছিল এবং সমস্ত আদালত-কক্ষে মন্ত্রমুগ্ধবৎ নীরবতা বিরাজ করিতেছিল।

উপসংহারে শ্রীঅরবিন্দ সম্বন্ধে একটি বহুবিতর্কিত বিষয়ে দুই-একটি কথা বলা প্রয়োজন। আলিপুর মোকদ্দমার সময় যখন তিনি নির্জন কক্ষে কারারুদ্ধ ছিলেন তখন হইতেই সাত্ত্বিক ভাবের আবির্ভাবে তাহার জীবনের গতি সম্পূর্ণভাবে পরিবর্তিত হইতে আরম্ভ করে। শ্রীঅরবিন্দ নিজেই উত্তরপাড়ায় প্রদত্ত প্রসিদ্ধ বক্তৃতায় বলেন, কারাগারে ভগবানের বাণী তাঁহাকে সম্পূর্ণ এক নূতন পথের নির্দেশ দিয়াছিল এবং সেই অনুসারে তাহার অবশিষ্ট জীবন পণ্ডিচেরীতে আধ্যাত্মিক সাধনাতেই কাটিয়াছিল। পণ্ডিচেরী আশ্রমে তাঁহার এই ঋষিতুল্য সুদীর্ঘ জীবনের পরিপ্রেক্ষিতে অনেকেই স্বীকার বা বিশ্বাস করেন না যে, তাঁহার পূর্বজীবনে তিনি সন্ত্রাসবাদী দলের অবিসংবাদিত নেতা ছিলেন–এমনকি, মারণাস্ত্র ও বোমা প্রভৃতি ব্যবহারেরও সমর্থক ছিলেন। কিন্তু, অপ্রিয় বা অবিশ্বাস্য মনে হইলেও অরবিন্দের জীবনের শেষভাগে–ঋষিতুল্য সাত্ত্বিক জীবন-যে পরিমাণে সত্য, কলিকাতা জীবনের প্রথম ভাগ-সন্ত্রাসবাদের ধারক ও বাহক–সেই পরিমাণেই সত্য। শ্রীঅরবিন্দ নিজে ইহা স্বীকার করিয়াছেন। শ্রীনলিনীকান্ত গুপ্ত এই প্রসঙ্গে লিখিয়াছেন :

“জেলে বসে শ্রীঅরবিন্দের লেখা সম্বন্ধে বলতে গেলে একটি গূঢ়গুপ্ত তথ্য প্রকাশ করতে হয়। তিনি একটি প্রবন্ধমালাই লিখেছিলেন বোমাসম্বন্ধে। কাগজে পত্রে বোমাতন্ত্রীদের গালাগালি দেওয়া হত, তাদের সম্বন্ধে ভুল মিথ্যা অভিযোগ সব আনা হত, তাই তাদের স্বপক্ষের উকীল হয়ে যেন তিনি কলম ধরলেন। বোমাতত্ত্বের বিশদ ব্যাখ্যা তিনি দিলেন চারটি প্রবন্ধে–তাদের নাম আমার এখনো (১৩৭০) মনে আছে : (1) The Message of the Bomb, (2) The Morality of the Bomb, (3) The Psychology of the Bomb, (4) The Policy of the Bomb. লেখাগুলি আমার কাছে ছিল এবং তা বাইরে পাঠিয়ে দিই আমার এক বন্ধুর হাত দিয়ে।…(পুলিশের ভয়ে) বন্ধুবর লেখাগুলি একটি বাঁশের চোঙায় বন্ধ করে, মাটির নীচে পুঁতে রেখেছিলেন। কিছুদিন পরে খোঁজ করতে গিয়ে দেখেন সবই উইপোকার কল্যাণস্পর্শে ধূলিমুষ্টিতে পরিণত হয়েছে।”[১৮]

ইহার অব্যবহিত পরেই নলিনীবাবু যাহা লিখিয়াছেন তাহাও নিতান্ত অপ্রাসঙ্গিক হইবে না :

“এই সম্পর্কে তা হলে আর একটি গুপ্ত কথা ব্যক্ত করি। শ্রীঅরবিন্দ যেমন বোমার সমর্থনে কলম (অর্থাৎ পেনসিল) ধরেছিলেন, নিবেদিতাও এসব ঘটনার পরবর্তীকালে কলম একদিন ধরেছিলেন স্বদেশী ডাকাতদের পক্ষ সমর্থনে। দেশভক্তেরা কি ভাবের ভাবুক হয়ে, কি অনুপ্রেরণার ধারায় এপথে আসে, নিবেদিত অতি দরদের সঙ্গে সেই বিবরণ ও ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন তাঁর লেখাটি একখানি কাব্য কাহিনী।”

বোমা ও ডাকাতি-সন্ত্রাসবাদের দুইটি প্রধান অঙ্গ। এক মহাপুরুষ ও এক মহীয়সী নারী এ-সম্বন্ধে যে অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন, সন্ত্রাসবাদের মূল্যায়ন ও বিচার করিবার পক্ষে তাহার গুরুত্ব খুবই বেশী।[১৯]

শ্রীঅরবিন্দ

আলিপুর মোকদ্দমায় বেকসুর আলাস পাইয়া অরবিন্দ তাঁহার মেসোমশাই ‘সঞ্জীবনী’র সম্পাদক কৃষ্ণকুমার মিত্রের বাড়ীতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। যদিও নির্জন কারাবাসের ফলে তাঁহার মনপ্রাণ অধ্যাত্মসাধনার দিকে আকৃষ্ট হইয়াছিল, তথাপি তিনি রাজনীতিক আন্দোলন হইতে অবসর গ্রহণ করেন নাই। যদিও চরমপন্থী দলের নেতৃস্থানীয় অনেক প্রসিদ্ধ ব্যক্তি তখন নিষ্ক্রিয়ভাবে অথবা বিদেশে বাস করিতেছিলেন, অরবিন্দ তখনও রাজনীতিক কর্মে নিজেকে নিযুক্ত রাখিয়াছিলেন। তিনি ১৯০৯ সনে বরিশালে প্রাদেশিক কনফারেন্সে যোগ দিয়াছিলেন। সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁহাকে নরমপন্থী দলের সঙ্গে কংগ্রেসে যোগ দিতে অনুরোধ করিলেন। কিন্তু অরবিন্দ দাবি করিলেন, যদি সুরাটের বিবাদের ফলে যে নূতন কংগ্রেসের সংবিধান (constitution) গৃহীত হইয়াছিল, তাহার পরিবর্তন করিয়া চরমপন্থী দলকে প্রতিনিধি পাঠাইবার অধিকার দেওয়া হয়, তাহা হইলে তিনি কংগ্রেসে যাইতে প্রস্তুত আছেন। কিন্তু সুরেন্দ্রনাথের দল ইহাতে রাজী হইল না।

শ্রীঅরবিন্দ রাজনীতিক সভা-সমিতিতে বক্তৃতা দিতেন, কিন্তু পূর্বের ন্যায় লোকসমাগম হইত না। দুইখানি সাপ্তাহিক পত্র তিনি প্রকাশিত করেন-ইংরেজী ‘কর্মযোগিন্‌’ ও বাংলা ‘ধর্ম’। ইহাদের গ্রাহকসংখ্যা ভালই ছিল এবং কাগজ প্রকাশের ব্যয় উহাদের বিক্রয়লব্ধ অর্থেই নির্বাহ হইত। ১৯০৯ সনের শাসনসংস্কার তিনি অনুমোদন করেন নাই, তাই কর্মযোগিন’ পত্রিকায় ‘খোলা চিঠি’ নাম দিয়া এক প্রবন্ধে লেখেন যে, প্রকৃত ক্ষমতা না পাইলে সরকারের সহিত কোনপ্রকার সহযোগিতা করা হইবে না।

শ্রীঅরবিন্দ গোলদীঘির নিকট শ্রীকৃষ্ণকুমার মিত্রের বাড়ীতে থাকিতেন। বিকালে শ্যামপুকুরে ‘ধর্ম’ ও ‘কর্মযোগিন্‌’ অফিসে আসিতেন। শ্রীনলিনীকান্ত গুপ্ত লিখিয়াছেন : “এরই মধ্যে একদিন বিকেলের দিকে এক যুবক ছুটতে ছুটতে এসে উপস্থিত-শ্রীঅরবিন্দকে খবর দেবার জন্য যে, সামশুল আলম (আমাদের আলিপুর মোকদ্দমায় সরকারের প্রধান সহায় পুলিশ ইনস্পেক্টর) খতম হয়ে গেল হাইকোর্টে বীরেনের হাতে (বীরন্দ্রেনাথ দত্তগুপ্ত)। সেও সঙ্গে ছিল–সে পালাতে পেরেছে, বীরেন পারল কিনা সন্দেহ।” ইহা হইতে বুঝা যায় যে, সন্ত্রাসবাদীর দল তখনও একেবারে নিষ্ক্রিয় হয় নাই এবং অরবিন্দও তাহাদের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ছিলেন।

কিন্তু শীঘ্রই অরবিন্দ কলিকাতা ত্যাগ করিয়া প্রথমে চন্দননগরে যান। ছয় সপ্তাহ সেখানে কখনও মতিলাল রায়ের আশ্রমে, কখনও বা নরেন্দ্র ব্যানার্জির আশ্রয়ে নানাস্থানে থাকেন এবং পরে চন্দননগর হইতে ফরাসী-অধিকৃত পণ্ডিচেরীতে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেন। এখানেই তাঁহার আধ্যাত্মিক জীবন পরিপূর্ণতা লাভ করে এবং রাজনীতির সহিত তাঁহার প্রত্যক্ষ সম্বন্ধ ছিন্ন হয়। তবে তিনি যে ভারতীয় রাজনীতির সহিত পরোক্ষসম্বন্ধ রাখিতেন, তাহাতে সন্দেহ নাই। ইহার দুই-একটি দৃষ্টান্ত পরে দেওয়া যাইবে। আলিপুর জেলে কিভাবে সত্যেন ও কানাই-এর হাতে রিভলভার পৌঁছিয়াছিল, সে-সম্বন্ধে যেমন অনেক আজগুবি কাহিনীর সৃষ্টি হইয়াছিল, অরবিন্দের কলিকাতা ত্যাগ সম্বন্ধেও সেইরূপ অনেক গল্প আছে।

সৌভাগ্যের বিষয়, অরবিন্দ নিজেই ইহার বিবৃতি দিয়াছেন। অরবিন্দ একদিন সন্ধ্যাকালে কর্মযোগিন্‌’ পত্রিকার অফিসে বসিয়া আছেন, এমন সময় ঐ পত্রিকার একজন কর্মচারী রামচন্দ্র মজুমদার আসিয়া সংবাদ দিলেন যে, কর্মযোগিন পত্রিকায় ২৫শে ডিসেম্বর (১৯০৯) “আমার দেশবাসীর প্রতি”-শীর্ষক তাঁহার যে প্রবন্ধ প্রকাশিত হইয়াছিল তাহার জন্য পরদিন ঐ পত্রিকার আফিসে পুলিশ খানাতল্লাসী করিবে ও ভারতীয় দণ্ডবিধি আইনের ১২৪-এ ধারামতে তাহাকে গ্রেপ্তার করিবে। এই সংবাদ একজন উচ্চপদস্থ পুলিশ কর্মচারীর নিকট হইতে জানা গিয়াছে। অরবিন্দ লিখিয়াছেন, “এই সংবাদ শুনিয়া উপস্থিত সকলেই খুব উত্তেজিত হইয়া উঠিলেন এবং কী করা উচিত সে-বিষয়ে বাদানুবাদ হইতে লাগিল। তখন হঠাৎ উপর হইতে এক সুপরিচিত স্বরে তিনটি শব্দের একটি আদেশ আমার কানে আসিল : তুমি চন্দননগর যাও। রামচন্দ্র মজুমদার আমাকে সঙ্গে করিয়া (গঙ্গার) ঘাটে নিয়া একখানি নৌকা ডাকিয়া আনিল। আমি আমার আত্মীয় বীরেন ঘোষ এবং মণিকে (সুরেশচন্দ্র চক্রবর্তী) সঙ্গে লইয়া তৎক্ষণাৎ নৌকায় চন্দননগর যাত্রা করিলাম-বাগবাজার বা আর কোথাও থামি নাই। রাত্রি ভোর হইবার আগেই অন্ধকার থাকিতে থাকিতে চন্দননগরে পৌঁছিলাম। বীরেন ও মণি সকালবেলা কলিকাতা ফিরিয়া গেল।

প্রচলিত কাহিনীগুলির একটিতে আছে, বাগবাজারের রামকৃষ্ণ মঠে ‘যোগিনী মা’ তাহার আত্মীয় পুলিশ কর্মচারী শশীভূষণ দে-র নিকট পরদিন অরবিন্দ গ্রেপ্তার হইবেন এই সংবাদ পাইয়া স্বামী সারদানন্দকে জানান এবং তিনিও গণেন মহারাজকে (মঠের ব্রহ্মচারী) অরবিন্দের নিকট পাঠান। অরবিন্দ তৎক্ষণাৎ “আমার দেশবাসীর প্রতি খোলা চিঠি” (Open Letter to my Fellow Citizens) শীর্ষক প্রবন্ধে তাঁহার শেষ ইচ্ছা জানান, এবং ঐ রাত্রেই নিবেদিতার সঙ্গে দেখা করিয়া তাঁহাকে কর্মযোগিনের দায়িত্বভার গ্রহণ করিতে অনুরোধ করিয়া নৌকাযোগে চন্দননগর যান। আর একটি কাহিনীতে আছে, নিবেদিতার অনুরোধ ও পরামর্শ শুনিয়াই শ্রীঅরবিন্দ ফরাসী রাজ্যে আশ্রয় গ্রহণ করেন। তৃতীয় কাহিনীতে পাই, “শ্রীঅরবিন্দ দেয়াল টপকে পার হয়েছিলেন এবং গলির মধ্যে ভুলপথে গিয়ে কার বাড়িতে উঠেছিলেন এবং কী নাটকীয় আলাপন হয়েছিল, ইত্যাদি” সবিস্তারে বর্ণিত হইয়াছে।[২০]

এই সমস্ত মিথ্যা নিরসনের জন্যই সম্ভবতঃ অরবিন্দ লিখিয়াছেন যে, তিনি যাত্রা করিয়া বাগবাজারে বা আর কোথাও থামেন নাই।

তবে নিবেদিতার সম্বন্ধে পূর্বোক্ত যে কাহিনী প্রচলিত আছে তাহার কিছু ভিত্তি আছে। শ্রীঅরবিন্দ মুক্তি পাইলেও গভর্নমেন্টের উচ্চপদস্থ কর্মচারীরা মনে করিতেন অরবিন্দই সন্ত্রাসবাদী দলের নেতা এবং অরবিন্দকে “সরাইতে না পারিলে শান্তি ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠিত হইবে না।” বাংলা গভর্নমেন্টের চীফ সেক্রেটারী গেইট সাহেব (E. A. Gait) এই মর্মে ভারত গভর্নমেন্টের কাছে লেখেন। নিবেদিতা এই সংবাদ জানিতেন এবং একবার অরবিন্দকে বলিয়াছিলেন, গভর্নমেন্ট স্থির করিয়াছে যে তাঁহাকে ভারতের বাহিরে আটক করিয়া রাখিবে (deport)। সুতরাং অরবিন্দের পক্ষে হয় গোপনবাস নয়ত ব্রিটিশরাজ্য ছাড়িয়া না গেলে কোন কাজ করিতে পারিবেন না। অরবিন্দ লিখিয়াছেন, “আমি নিবেদিতাকে বলিলাম যে, তাঁহার পরামর্শ গ্রহণ করা আবশ্যক মনে করি না। আমি কর্মযোগিনে একখানি ‘খোলা চিঠি’ (open letter) প্রকাশ করিব–তাহার ফলে গভর্নমেন্ট আমাকে অন্তরীণ (deport) করিবে না। তদনুসারে আমি ঐ প্রকার চিঠি ছাপাইলাম। ইহার পরে নিবেদিতার সহিত সাক্ষাৎ হইলে নিবেদিতা বলিলেন, আমি যাহা বলিয়াছিলাম তাহাই ঠিক, গভর্নমেন্ট আমাকে ‘অন্তরীণ করিবার সংকল্প ত্যাগ করিয়াছে। নিবেদিতা আমার চন্দননগর যাওয়ার কথা কিছুই জানিতেন না এবং চন্দননগর যাওয়ার পূর্বে নিবেদিতাকে চিঠি লিখিয়া কর্মযোগিনের দায়িত্ব গ্রহণ করিতে অনুরোধ করিয়াছিলেন এবং নিবেদিতা সানন্দে এই ভার গ্রহণ করিয়াছিলেন।

পূর্বে যাহা বলা হইয়াছে তাহাতে সহজেই প্রতীয়মান হইবে যে, ভারতের রাজনীতিক ক্ষেত্রে অরবিন্দের দান অসামান্য। কিন্তু একথা অনস্বীকার্য যে স্বদেশে ও বিদেশে অরবিন্দ আজ ‘পণ্ডিচেরীর ঋষি-রূপেই জগৎপূজ্য। জীবনের এরূপ আমূল পরিবর্তন সচরাচর বড় দেখা যায় না। তবে ইহাও লক্ষ্য করিবার বিষয়, সন্ত্রাসবাদীদের মধ্য হইতে অন্ততঃ পাঁচ-ছয় জন, সম্ভবতঃ আরও বেশি, এইরূপ ধর্মজীবন গ্রহণ করিয়াছিলেন। অবশ্য অরবিন্দের ন্যায় আধ্যাত্মিক জীবনের সাফল্য কাহারও ভাগ্যে ঘটে নাই। মনে হয়, যে বিরাট আধ্যাত্মিক শক্তি লইয়া তিনি জন্মগ্রহণ করিয়াছিলেন, মেঘাবৃত সূর্যের ন্যায় তাহার পূর্ণ দীপ্তি প্রথমে কেহই অনুধাবন করে নাই–তাঁহাকে রাজনীতিক গুরু বা নেতার পদে বরণ করিয়াই ধন্য হইয়াছিল। কিন্তু এখন মনে হয়, চিত্তরঞ্জনের ভাষায়, তখন আমরা “শালগ্রাম শিলা দিয়া বাটনা বটিয়াছি।” শ্রীঅরবিন্দের এই গুরুতর পরিবর্তনের কারণ লইয়া

অনেক জল্পনা-কল্পনা, তর্ক-বিতর্ক হইয়াছে। সম্ভবতঃ শ্রীঅরবিন্দের নিজের উক্তির মধ্যেই আমরা ইহার প্রকৃষ্ট ব্যাখ্যা পাই। ১৯২২ সনের ১৮ই নভেম্বর তিনি চিত্তরঞ্জন দাশকে একখানি চিঠিতে লিখিয়াছিলেন :

“I see more and more manifestly that man can never get out of the futile circle; the race is always treading, until he has raised himself to a new foundation…I am determined not to work in the external field till I have the sure and complete possession of this new power of action, not to build except on perfect foundation.”

একজন ইহার অনুবাদ করিয়াছেন :

“আমি দিনে দিনে স্পষ্টতর দেখছি মানুষ যে ব্যর্থ চক্রে আবর্তিত হচ্ছে তার থেকে সে মুক্তিলাভ করবে না–যতদিন সে একটা নূতন সত্য ভিত্তির ওপর নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে। এই নবশক্তিতে যতদিন না সম্পূর্ণ হই, আমিও বহির্জগতের কাজ করব না। নূতন ভিত্তির ওপর গঠনকার্য শুরু করব”।

১৯২৮ সনে রবীন্দ্রনাথ পণ্ডিচেরীতে অরবিন্দের সঙ্গে সাক্ষাৎ করিয়া লিখিয়াছিলেন : “অরবিন্দকে তাঁর যৌবনের মুখে ক্ষুব্ধ আন্দোলনের মধ্যে যে তপস্যার আসনে দেখেছিলুম, সেখানে তাঁহাকে জানিয়েছি–অরবিন্দ রবীন্দ্রের লহ নমস্কার’। আজ তাকে দেখলুম তাঁর দ্বিতীয় তপস্যার আসনে, অপ্রগলভ স্তব্ধতায়

-আজও তাকে মনে মনে বলে এলুম ‘অরবিন্দ রবীন্দ্রের নহ নমস্কার।”২১

তথ্যনির্দেশ

১. ভারতের দ্বিতীয় স্বাধীনতা সংগ্রাম ২৬ পৃ.

২. জেলে ত্রিশ বৎসর ৭-৮ পৃ.

৩. শ্রীকালীচরণ ঘোষ, জাগরণ ও বিস্ফোরণ, ২৮০ পৃ.

৪. তদেব।

৫. তদেব ২৮০-২৮১ পৃ.

৬. Kalicharan Ghosh, The Roll of Honour. p. 166

৭. নলিনীকান্ত গুপ্ত, “স্মৃতির পাতা”, ৩৫ পৃ.

৮. তদেব, ৩৭.

৯. তদেব, ৪০ পৃ.

১০. স্মৃতির পাতা, ৫১ পৃ.।

১১. ভূপেন্দ্র দত্ত, তদেব ৮৮-৯ পৃ.

১২. স্মৃতির পাতা, ৫৫ পৃ.

১৩. জাগরণ ও বিস্ফোরণ, ৩০১ পৃ.

১৪. কালীচরণ ঘোষ, তদেব ৩০৭, পৃ.

১৫. স্মৃতির পাতা, ৬২ পৃ.

১৬. অপর্ণা দেবী, “মানুষ চিত্তরঞ্জন ৬৫-৬৬ পৃ.

১৭. তদেব, ৬৮ পৃ. ১৮. নলিনীকান্ত গুপ্ত, স্মৃতির পাতা ৫৯-৬০ পৃ.

১৯. তদেব ৬০ পৃ.

২০. নলিনীকান্ত গুপ্ত, স্মৃতির পাতা, ৯০ পৃ.

২১. সাহিত্যতীর্থ ১৩৭৯, পৃ.৬১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *