৫. শ্ৰীমতী, আপনি কি এটাই মনে করেন? না, এটা তা নয়
(এই প্রবন্ধটি ১৮৯৯ সালে লিখিত হলেও তা পূর্বে ছাপা হয়নি। এই প্রবন্ধটির ঐতিহাসিক মূল্যের জন্যই প্রধানত এটি ছাপা হয়েছে। যেহেতু এই প্রবন্ধটির মধ্য দিয়েই হেগেলের দর্শনের বিরুদ্ধে রাসেলের প্রথম বিদ্রোহ যার প্রতি তিনি অনুরক্ত ছিলেন কেমব্রিজে পড়াশুনোর সময় থেকে। যদিও সেই সময় তিনি ধর্মের প্রতি ততটা বিরুদ্ধ ছিলেন না যতটা তিনি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে হয়েছিলেন। তাঁর কিছু সমালোচনা এই একই ঘটনার উপর নির্ভর করে রচিত হয়েছিল।)
দর্শন তার সমৃদ্ধির সময়গুলোতে, তার কাজ করার শপথ অনুযায়ী, বহু বিচিত্র পথে খুব গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো সম্পাদন করেছিল বলে দাবী করেছিল। বহু বাধার মধ্যেও দর্শন তাদের স্বস্তিকর আশ্রয় দিতে পেরেছিল। বৌদ্ধিক সংকটে সে ব্যাখ্যা প্রদান করে সেই সংকটকে দূর করত এবং নৈতিক বিহ্বলতায় পথ প্রদর্শনের কাজ করত।
যখন দর্শনের ব্যবহারের দৃষ্টান্ত একজন যুবককে বোঝানো হত তখন সেই কনিষ্ঠ ভ্রাতার যুবোচিত উচ্ছ্বাসে আশ্চর্য হবার কিছু নেই;
স্বর্গীয় দর্শন সুন্দর কত!
নয় সে কটু নয় সে কড়া
ভাবে যেমন বোকার মরা
সে যে অ্যাপোলোর বাঁশির মতো
সঙ্গীতময় মনোহরা।
কিন্তু সেই সব সুন্দর দিনগুলো আজ আর নেই। একের পর এক চরম ভন্ডামীগুলোকে দর্শন তার নিজের উত্তরাধিকারীদের ধীরগতিতে বিজয়ের ফলে ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে। বেশির ভাগ জায়গায়, বৌদ্ধিক সংকটগুলো সমাধিত হয়েছে বিজ্ঞানের দ্বারা বিশেষ কিছু অসাধারণ প্রশ্নের উপর দর্শনের ব্যগ্র দাবী, যে প্রশ্নগুলির উত্তর আজও দেবার প্রচেষ্টা হচ্ছে। যে প্রশ্নগুলি সম্পর্কে বেশিরভাগ মানুষ মনে করে যে সেগুলি অন্ধকার যুগগুলির অবশিষ্ট এবং যেগুলো তাদের সমস্ত দ্রুতি নিয়ে মি. এফ ডব্লু মেয়ারের কঠিন বিজ্ঞানে পরিণত হয়েছে। নৈতিক বিহ্বলতাগুলি– যেগুলিকে আজও পর্যন্ত দার্শনিকরা দ্বিধাহীনভাবে তাঁদের রাজত্ব মনে করে থাকেন এবং যেগুলিকে ম্যাক ট্যাগার্ট এবং মি. ব্র্যাডলে পরিত্যাগ করেছেন সংখ্যাতত্ত্ব ও সাধারণ জ্ঞানের খামখেয়ালীপনা হিসেবে। কিন্তু আশ্বাস এবং সান্তনা দেবার ক্ষমতা যা ক্ষমতাহীনের কাছে শেষ ক্ষমতা–ম্যাক ট্যাগার্ট মনে করেন তা হল দর্শন। আজকের রাত্রে এটাই হল সেই শেষ অধিকার যার বলে আমি আমাদের আধুনিক দেবতাদের জীর্ণশীর্ণ জনক-জননীকে ডাকাতি করে নিতে ইচ্ছুক।
কেবলমাত্র দর্শনের ক্ষেত্রে এটা মনে হতে পারে যে, প্রশ্নটি খুব সংক্ষিপ্ত ভাবে স্থির করা যেতে পারে। আমি জানি যে দর্শন আরাম দিতে পারে, ম্যাক ট্যাগার্ট বলতেই পারেন, কারণ এটা অবশ্যই আমাদের আরাম দেয়। যদিও, আমি প্রমাণ করবার চেষ্টা করব যে যে-সব সিদ্ধান্ত তাকে আশ্বাস দেয়, সেই সিদ্ধান্তগুলো হল তাই যা তার সাধারণ অবস্থান থেকে তাকে অনুসরণ করে না বরং সেগুলো। স্বীকৃত ভাবে তাকে অনুসরণ না করে কেবল পড়ে থাকে। এটা হয় কেবল সেগুলো তাকে আশ্বাস দেয় বলেই। দর্শনের আবেগী মূল্য ছাড়া তার সত্য সম্পর্কে আমি আলোচনা করতে ইচ্ছুক নই। আমি এটা ধরে নেব অধিবিদ্যা অবভাস (Appear ances) ও সত্তার (Reality) মধ্যে যে স্বতন্ত্রতা আছে তার উপর নির্ভর করে ও তাকে যথার্থ বলে মেনে নেয়। এই ধরণের যে-কোন অধিবিদ্যাগত আদর্শকে খুব ছোট্ট করে বলা যায়। ‘ঈশ্বরীয় যা কিছু সবই তাঁর স্বর্গের, সবার যা কিছু মন্দ তা জগতের’–এটাই এর শেষ কথা। কিন্তু এটা মেনে নিতে গেলে মনে হয় যে, যেহেতু তিনি তাঁর স্বর্গেই বিরাজ করেন এবং সর্বদাই তিনি সেখানে থাকেন, তাই আমরা এটা আশা করেও নিতে পারি যে তিনি কোন-না-কোন দিন পৃথিবীতে নেমে আসবেন– সজীব ও মৃতকে বিচার করতে না আসলেও, অন্তত দার্শনিকদের বিশ্বাসকে পুরস্কৃত করতে তিনি আসবেনই। যদিও বিশুদ্ধ স্বর্গীয় সত্ত্বার কাছে তার দীর্ঘদিনের আত্মসমর্পণ পার্থিব ব্যাপারগুলোকে বিবেচনা করে স্টোয়িকবাদকে গ্রহণ করবার প্রস্তাব দেয়, যার উপর নির্ভর করে যদি আমরা আমাদের আশাগুলোকে পূরণ করতে চাই, তবে তা একপ্রকার হঠকারিতা হয়ে যাবে।
কিন্তু আন্তরিকতার সঙ্গে বলতে গেলে, বৈচিত্র্যের মধ্যে সান্ত্বনা হিসেবে শাস্ত্রীয় মতবাদগুলির আবেগী মূল্য তার ভবিষ্যতের ভবিষ্যদ্বাণী করার উপর নির্ভর করে আবির্ভূত হয়। ভবিষ্যৎ সম্পর্কে আবেগী কথাবার্তা একটি অতীত যা বর্তমানের থেকেও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। যার শেষ ভালো, তার সব ভালো এই সূত্রটি সর্বসম্মত সাধারণ জ্ঞান সঞ্জাত। অনেকগুলি বিষণ্ণ সকাল একটি সুন্দর দিনে পরিণত হয়। যেখানে দুঃখবাদ বলে :
অনেক দেখেছি আমি উজ্জ্বল দিন।
সার্বভৌম চোখের সাথে
দেখেছি গিরিচূড়াদের–
ছিনাল মেলামেশা।
দেখেছি আমি সবুজ তৃণভূমি আছে যত,
তারা স্বর্ণ-মুখে চুম্বনরত।
দেখেছি ধূসর ছোট নদীদের সেই উজ্জ্বলতা
স্বর্গ-মদিরা পান করে তারা পেয়েছে মাদকতা।
শীঘ্র কর, অনুমতি দাও
উড়ুক হীন মেঘমালা,
তার স্বর্গ-মুখে ঢেলে দিক তার
পুঞ্জীভূত কালো জ্বালা।
লুকিয়ে সে নেবে মুখ
জগতের থেকে,
অদৃশ্যকে রাখবে সে
পশ্চিমে ঢেকে
এই অপমান মেখে,
ভাই, এই অপমান মেখে।
এই জন্যই বলতে হয়, বিশ্ব সম্পর্কে আমাদের আবেগমূলক দিক থেকে ভালো বা মন্দ যে দৃষ্টিভঙ্গিই থাকুক না কেন তা নির্ভর করে ভবিষ্যতের উপর, যার উপর এটা থাকবে। আমরা সর্বদাই কালের পরিপ্রেক্ষিতে অবভাসসমূহকে (Appearances) বিবেচনা করে থাকি এবং যতক্ষণ না আমরা এ সম্বন্ধে নিশ্চিত হতে পারি যে আমাদের ভবিষ্যৎ আমাদের বর্তমানের চেয়ে উত্তম হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত কোথায় আমরা সান্ত্বনা পাব তা দেখাটা সত্যই শক্ত।
ভবিষ্যৎ এত বিপুল পরিমাণে আশাবাদের সঙ্গে আবদ্ধ যে ম্যাক ট্যাগার্টের সমস্ত আশাবাদ কালকে অস্বীকার করার উপর নির্ভর করে গড়ে উঠলেও তিনি বাধ্য হন। বস্তুসমূহের ভবিষ্যৎ অবস্থাস্বরূপ সেই কালকে প্রতিনিধিত্ব করতে যা পরম ‘একটি সঙ্গতি যে অবশ্য কোন-না-কোন দিন প্রকাশিত হবে।‘ এই স্ববিরোধকে উত্তেজিত করে তোলাটা নির্দয়তা হবে। ম্যাক ট্যাগার্ট নিজেই আমাকে এ সম্পর্কে সজাগ করে দিয়েছেন। কিন্তু আমি যে ধারণাটিকে উত্তেজিত করে তুলতে ইচ্ছুক তা হল, যে-কোন আশ্বাস যা ধর্মীয়শাস্ত্র থেকে উৎসারিত হতে পারে এবং যে সত্তা হল কালহীন ও চিরন্তনভাবে মঙ্গ তা এই স্ববিরোধ থেকে একমাত্র এবং সম্পূর্ণরূপে উৎসারিত হয়েছে। একটি কালহীন সত্তা অতীতের চেয়ে ভবিষ্যতের সঙ্গে কখনও অন্তরঙ্গ যোগ রাখতে পারে না। যদি এটার যথার্থতা এখনো এসে উপস্থিত না হয় তা হলে কোন কারণে মনে করা ঠিক হবে না যে এটা কোনদিন উপস্থিত হবে– এরকম প্রতিটি জায়গায় বলা হয় যে ঈশ্বর তাঁর স্বর্গে থাকবেন। আমরা সমানুপাতিক ন্যায্যতার সঙ্গে একটি সঙ্গতি সম্পর্কে বলতে পারি যা অবশ্যই কোন-না-কোন দিন প্রকাশিত হয়েছে। এটা হতে পারে যে, ‘আমার দুঃখ রয়েছে পেছনে’ এবং এটা একেবারেই স্পষ্ট যে কত কম আশ্বাস এটা আমাদের দিতে পারে।
আমাদের সমস্ত অভিজ্ঞতা কালের সঙ্গে বাঁধা এবং কালহীন অভিজ্ঞতাকে কল্পনা করা কোনভাবেই সম্ভব নয়। কিন্তু যদি তা সম্ভবও হত, স্ববিরোধিতা ছাড়া আমরা কখনই মনে করতে পারতাম না যে আমরা কখনও এ ধরণের অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারব। এইজন্য, সমস্ত অভিজ্ঞতা যতটা দর্শনের দেখানো উচিত তা আমাদের জানা অভিজ্ঞতার অনুরূপ– যদি আমাদের কাছে এটাকে মন্দ ভাবা হয় তবে অবভাস থেকে স্বতন্ত্র সত্তা সম্পর্কে কোন মতবাদ আমাদের কোন আশাই জোগাতে পারবে না। প্রকৃতপক্ষে, আমরা একটি দ্বৈতবাদের মধ্যে পড়েছি। একদিকে আমাদের জানা জগৎ যা তার সমস্ত রকম ঘটনাসমূহ, আনন্দদায়ক বা নিরানন্দদায়ক, মৃত্যু, ব্যর্থতা, বিপর্যয় প্রভৃতি নিয়ে আছে, অন্যদিকে কাল্পনিক জগৎ যে-জগৎটিকে আমরা সত্তার জগৎ বলে নাম দিয়েছি। সত্তার বৃহত্বের দ্বারা এবং এইরকম জগৎ সত্যই আছে কিনা তার কোন চিহ্ন না দেখতে পাওয়ার মধ্য দিয়ে আমরা প্রায়শ্চিত্ত করে চলেছি। এখন সত্তার জগতের জন্য আমাদের একটাই জায়গা আছে, তা হল, সত্তাকে তাই হতে হবে যাতে আমরা তাকে বুঝতে পারি। কিন্তু যদি আমাদের শুদ্ধ আদর্শ নির্মাণের ফল হিসেবে আমরা যে জগৎকে জানি তার উল্টো হয়ে দেখা দেয় অর্থাৎ বাস্তব জগৎ থেকে তা ভিন্ন হয়, তবে সেই বিশেষ নির্মাণের থেকে যে ফল বেরিয়ে আসবে তা দিয়ে আমরা তথাকথিত সত্তার জগৎ (World of reality) সম্পর্কে কখনই কোন অভিজ্ঞতা লাভ করতে পারব না। তবে একমাত্র সেই বিষয়ের কথাই বলছি যে বিষয়ে আমরা কোন অভিজ্ঞতাই অর্জন করতে পারিনি। তাই আমি এমন কোন কিছুকে দেখতে পাই না যেটাকে বর্তমান জটিলতার থেকে মুক্তি পাবার সেই আশ্বাস বলা যেতে পারে যা আমরা আমাদের সমস্ত অধিবিদ্যার মধ্যে দিয়ে লাভ করেছি। অমরত্বের প্রশ্নটিকে উদাহরণস্বরূপ নেওয়া যাক। মানুষ অমরত্ব কামনা করেছে এই জগতের অবিচারের প্রতিকার করবার জন্য, অথবা সেই উদ্দেশ্যে যে উদ্দেশ্যটিকে আমরা শ্রদ্ধেয় বলতে পারি, তা হল মৃত্যুর পর মিলনের একটা সম্ভাবনা তৈরি করা যাতে তারা যাদের ভালোবাসত তাদের সঙ্গে মিলতে পারে। দ্বিতীয় কামনাটি এমন যা আমরা সবাই অনুভব করতে পারি এবং যাদের সন্তুষ্টির জন্য দর্শন যদি কিছু করতে পারে তবে তার কাছে আমাদের প্রচুর পরিমাণে কৃতজ্ঞ থাকা উচিত। কিন্তু দর্শন, তার ক্ষমতা অনুযায়ী, আমাদের কেবল নিশ্চিত করতে পারে যে আত্মা হল কালহীন সত্তা। যদি এমন কোন কাল থাকে তবে তার উপস্থিতি একদিন ঘটবেই, এবং তা এই কালহীন কালের ধারণার সঙ্গে সম্পূর্ণভাবে অসঙ্গতিকর। মৃত্যুর পর অস্তিত্বের মতবাদ থেকে কোনরকম আইনসিদ্ধ অনুমান পাওয়া যায় না। কীটস এখনও সখেদে বলতে পারেন :
তবে আমি চাইবো না গো তোমার পানে
অনেক বেশি করে,
চাইনে কখনও সুখী হতে সেই প্রেম ধনে
ভীতির ক্ষমতা ধরে–
যে অবাস্তব ভালোবাসা
বাঁধে তার বাসা।
এটা তাঁকে কুব একটা সান্ত্বনা দিতে পারেনি এই বলে যে এক ঘন্টার সুন্দর সৃষ্টি, অধিবিদ্যাগত সঠিক শব্দগুচ্ছ (Phrase) নয়। এটা এখনও সত্য যে ‘কাল এসে নিয়ে যাবে মোর সকল ভালোবাসা’ ‘এই চিন্তা মৃতের মতো, যাকে বেছে নেওয়া যেতে পারে না’ তাই শুধু হারাবার ভয়ে বসে বসে কাঁদতে হয়। তাই কালহীনভাবে যথার্থ সত্তার মতবাদসমূহের প্রতিটি অংশই এরকমই। যা কিছু এখন অমঙ্গলকর মনে হয় এবং এটা অমঙ্গলের পক্ষে দুঃখজনক বিশেষ অধিকার যে এরকম ভাবলে এরকমই হবে যা কিছু অমঙ্গল বলে মনে হয় তা সব থাকতে পারে এবং আমরা জানি যেগুলোকে সম্বল করে সমগ্র কাল ধরে আমরা আমাদের সাম্প্রতিক উত্তরাধিকারীদের তীব্র যন্ত্রণা দেব। আমার মনের কথা বলতে গেলে বলতে হয় যে এই ধরনের মতবাদে আশ্বাস অথবা সান্ত্বনার কোন চিহ্নই নেই।
এটা সত্য যে খ্রীষ্টীয় মতবাদ এবং পূর্বের সমস্ত আশাবাদসমূহ, জগৎকে দয়ালু বিধাতার চিরন্তন শাসিত স্থান হিসেবে দেখিয়েছে এবং তা অধিবিদ্যাগতভাবে মঙ্গলজনক বলে আখ্যায়িত হয়েছে। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে, এটা কেবলমাত্র একটা কৌশল হিসেবেই ব্যবহৃত হয়ে এসেছে যার দ্বারা জগতের ভবিষ্যতের মহানত্ব প্রমাণ করা যাবে– উদাহরণস্বরূপ, এই প্রমাণ করতে, যে ভালো মানুষেরা মৃত্যুর পর সুখী হবে। এটা সর্বদাই এই রকম সিদ্ধান্তই হয়ে এসেছে যদিও সিদ্ধান্তটি অবৈধভাবে গঠিত তবুও তা আমাদের আশ্বাস দিতে পেরেছে। ‘সে ভালো মানুষ এবং সবটাই ভালো হবে।’
প্রকৃতপক্ষে বলা যেতে পারে যে কেবলমাত্র বস্তু-নিরপেক্ষ মতবাদেই এই আশ্বাস থাকতে পারে যে সত্তা মঙ্গলজনক। আমি নিজে এই মতবাদের প্রমাণকে স্বীকার করি না। এমনকি এটা যদি সত্যিও হয় তবু আমি এটা দেখতে পাব না যে কেন এটা আশ্বাসমূলক হওয়া উচিত। কেননা আমার তর্কের উপাদান সেই সত্তা, যা অধিবিদ্যার দ্বারা নির্মিত এবং অভিজ্ঞতার জগতের সঙ্গে যার কোন রকম সম্পর্ক নেই বললেই চলে। এটা একটা সারগর্ভহীন বস্তু-নিরপেক্ষ বিষয়, যার থেকে অবভার্সের জগতে কোন একটা মাত্র বৈধ অনুমানও গঠন করা যাবে না, তথাপি, যে জগতে আমাদের সব স্বার্থসমূহ নিহিত। এমনকি সেই বিশুদ্ধ আত্মিক স্বার্থ যার থেকে অধিবিদ্যার উত্থান। সেই স্বার্থ আসলে অবভাসের জগৎকে ব্যাখ্যা করার স্বার্থ। কিন্তু এই বাস্তব স্পষ্ট ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য জগৎকে ব্যাখ্যা করার বদলে অধিবিদ্যা নির্মাণ করেছে অন্য আর একটি মৌলিকভাবে স্বতন্ত্র জগৎ এবং তা এতটাই স্বতন্ত্র, এতটাই বাস্তব অভিজ্ঞতার সঙ্গে অসংযুক্ত যে নিত্যনৈমিত্তিক জীবনের জগৎ সম্পূর্ণভাবে এর দ্বারা অপ্রভাবিত রয়ে গেছে এবং এমনভাবে তার নিজের পথে চলেছে যেন সত্তার জগৎ বলে কোনরকম জগই নেই। এমনকি যদি কেউ সত্তার জগৎকে অন্য জগৎ’ হিসেবে, বা আকাশে বিরাজিত স্বর্গীয় নগররূপে বিবেচনা করার অনুমতিও পেত, তাহলে নিঃসন্দেহে অন্তত চিন্তার এই আশ্বাস পাওয়া যেত যে অন্যদের একটি যথার্থ অভিজ্ঞতা আছে যা আমাদের নেই। কিন্তু বলতে গেলে, আমাদের অভিজ্ঞতা, যেমনভাবে আমরা তাকে জানি, তা একটি যথার্থ অভিজ্ঞতা এবং তা অবশ্যই আমাদের ঠান্ডা করে ছাড়ে, যেহেতু এটা প্রমাণ করতে পারে না যে আমাদের অভিজ্ঞতা অন্য রকম অভিজ্ঞতার চেয়ে উত্তম হতে পারে। অন্যদিকে, একথা বলতে হয় যে আমাদের প্রকৃত অভিজ্ঞতা দর্শনের দ্বারা নির্মিত যথার্থ অভিজ্ঞতার মতো নয়। আমাদের প্রকৃত অভিজ্ঞতা সেই ধরণের অস্তিত্বের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করেছে যে অস্তিত্ব দার্শনিক বাস্তবতার থাকতে পারে যেহেতু ঈশ্বর তার স্বর্গে একজন বিচ্ছিন্ন ব্যক্তি হিসেবে কখনই নিজেকে সংরক্ষণ করতে পারেন না। হয় আমাদের অভিজ্ঞতা যথার্থ যা একটি সারগর্ভহীন শব্দগুচ্ছ মাত্র, যে শব্দগুচ্ছটি আগেরগুলোর থেকে কোন অংশে উত্তম না হওয়ায় তাকে ছেড়ে দেওয়াই ভালো– অথবা যথার্থ অভিজ্ঞতা বলেই কিছু নেই এবং আমাদের সত্তার জগৎ সম্পর্কে কারুর কোন অভিজ্ঞতা না থাকায় সেই জগৎ কেবলমাত্র অধিবিদ্যার বইগুলোতেই রয়ে গেছে। এই উভয় ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে আমার মনে হয় যে ধর্মের সান্ত্বনাসমূহকে আমরা দর্শনে দেখতে পাই না। যদিও এমন কতকগুলি বোধ আছে যেগুলোর ক্ষেত্রে এটা অস্বীকার করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াবে যে দর্শন আমাদের আশ্বাস দিলেও দিতে পারে। আমাদের সকালগুলোকে সুন্দর করে কাটাবার উপায়কে আমরা দার্শনিকীকরণ করতেই পারি এই অর্থে। আমাদের সন্ধ্যাগুলোকে সুন্দর করে কাটাবার উপায় হিসেবে মদ্যপানকে আশ্বাসের উৎসরূপে তুলনা করা যেতে পারে। আবার আমরা দর্শনকে সৌন্দর্যবিদ্যাগতভাবে নিতে পারি। সম্ভবত আমাদের মধ্যে অনেকেই স্পিনোজাকে নিতে পারি। আমরা অধিবিদ্যাকে ব্যবহার করতে পারি মেজাজ তৈরি করবার সেই উপায় হিসেবে, যখন কবিতা ও সঙ্গীত, যা বিশ্ব সম্পর্কে বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গি ও জীবন সম্পর্কে বিশেষ আচরণ প্রদানের উপায় হিসেবে কাজ করে মনের পরিমাণবাচক অবস্থা ঠিক সেই অনুপাতে মূল্য পায় যে অনুপাতে কাব্যিক আবেগের মাত্রা উন্মোষিত হয়। কিন্তু তা বিশ্বাসসমূহের সভ্যতার উপর নির্ভর করে হয় না। প্রকৃতপক্ষে, আমাদের পরিতৃপ্তি, এই ধরণের ভাবের পরিপ্রেক্ষিতে, মনে হয় অধিবিদ্যাবিদদের পেশার ঠিক বিপরীত। এটা বাস্তব জগৎ ও তার অমঙ্গলজনক দিকগুলোকে ভুলে যাবার একটা সন্তুষ্টি। কয়েক মুহূর্তের জন্য, আমরা নিজেরা যে বাস্তব জগৎ সৃষ্টি করেছি তাকে ভুলে যাবার জন্য আমরা নিজেরাই নিজেদের প্ররোচিত করে থাকি। মনে হয় এরই পরিপ্রেক্ষিতে ব্র্যাডলে অধিবিদ্যাসমূহকে বিচার করেছেন। তিনি বলেন, যখন কাব্য, কলা এবং ধর্ম কোনরকম উৎসাহ জাগাতে পারে না, অথবা যখন চরম সমস্যাগুলোর সঙ্গে লড়াই করবার কোন প্রবণতা তারা আর দেখায় না এবং সেইসব সমস্যাগুলোর সাথে একটা বোঝাঁপড়ায় আসে, যখন রহস্য-চেতনা ও জাদুমন্ত্র উদ্দেশ্যবিহীন ভাবে ঘুরে বেড়াবার জন্য মনকে আর আকর্ষণ করে না এবং প্রেম জানে না কাকে সে ভালোবাসবে, সংক্ষেপে, যখন গোধূলির মুগ্ধ করার ক্ষমতা থাকে না তখন অধিবিদ্যাসমূহ নিরর্থক হয়ে পড়ে। এইভাবে অধিবিদ্যা আমাদের জন্য যে কাজ করে সেই একই প্রয়োজনে ‘দ্য টেম্পেস্ট’ আমাদের জন্য সেই কাজ করে–কিন্তু এই দৃষ্টিভঙ্গি অনুযায়ী তার মূল্য তার সত্যের থেকে সম্পূর্ণ স্বাধীন। প্রসপেরোর জাদু আমাদের প্রেত আত্মাদের জগতের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছে বলে আমরা দ্য টেম্পেস্ট’-কে মূল্য দিই তা নয়, সৌন্দর্যবিদ্যাগত ভাবে আমরা তাকে মূল্য দিয়ে থাকি। কিন্তু আমরা অধিবিদ্যাসমূহকে মূল্য দিই না এই কারণে যে তা আমাদের প্রেত আত্মাদের জগতের সম্পর্কে খোঁজ দেয়। এর ফলে ধার্মিক আশ্বাস ও সৌন্দর্য-বিজ্ঞানগত সন্তুষ্টির মধ্যে একটা অনিবার্য স্বতন্ত্রতার সৃষ্টি হয়, যে ব্যাপারটাকে আমি স্বীকার করে নিই, কিন্তু দর্শনের ক্ষেত্রে তাকে আমি অস্বীকার করি। সৌন্দর্য-বিজ্ঞানজাত সন্তুষ্টির জন্য বিদ্যাবুদ্ধিসম্পন্ন দৃঢ়বিশ্বাস থাকা একান্ত প্রয়োজন। যখন আমরা এই সন্তুষ্টি খুঁজে থাকি তখন অধিবিদ্যাকে বেছে নিতে পারি যা এই বিষয়ে আমাদের অনেকটা সন্তুষ্টি দিয়ে থাকে। অন্যদিকে, ধর্মীয় আশ্বাসের ক্ষেত্রে বিশ্বাস ব্যাপারটি একান্ত প্রয়োজন। আমি এই ব্যাপারে তর্কের অবতারণা করছি যে আমাদের বিশ্বাস অনুযায়ী আমরা অধিবিদ্যা থেকে কখনই ধর্মীয় আশ্বাস পাই না।
যদিও সৌন্দর্য-বিজ্ঞানগত আবেগের রহস্যময় তত্ত্বকে কাজে লাগিয়ে বিতর্ককে পরিশুদ্ধ করে নেওয়া সম্ভব। এই বিষয়ে তর্কে অবতীর্ণ হওয়া যায় যে যদিও আমরা অভিজ্ঞতা পুরোপুরি লাভ করি না, তবুও কিছু কিছু অভিজ্ঞতা এর খুব কাছাকাছি যায় এবং এই ধরণের অভিজ্ঞতাগুলি, বলা যেতে পারে, কলা ও দর্শনের থেকে পাওয়া যায়। এই অভিজ্ঞতাজাত প্রভাব যা দর্শন ও কলা মাঝেমধ্যে আমাদের দিয়ে থাকে, তা গ্রহণ করা সোজা হয়ে দাঁড়ায়। অধিবিদ্যাগত তীব্র ভাবাবেগ সম্ভবত মানুষকে আবেগের দিক থেকে এতটাই সমৃদ্ধ ও সুন্দর করে তোলে যা সম্পূর্ণভাবে তাদের কাছে আকাক্ষিত এবং মঙ্গলময় সুন্দর দৃষ্টির দ্বারা পরিবর্তিত জগৎ সম্পর্কে রহস্যময় এই চেতনা দর্শন কখনও কখনও দিয়ে থাকে। ব্র্যাডলে যেমন বলেছেন, কেউ কেউ এই পথে, তো কেউ কেউ অন্য আর এক পথে, কিন্তু দৃষ্ট জগতের ওপারে আমরা পরস্পর পরস্পরের সঙ্গে কথা বলে থাকি। বিভিন্ন ভাবে আমরা উচ্চ কিছুকে দেখে থাকি, যা আমাদের সমথনেও করে আবার ছোট করেও রেখে দেয়, যা আমাদের নির্দোষ করে তোলে আবার আমাদের সেই নির্দোষিতাকে সমর্থনও করে। কিছু বিশেষ মানুষদের ক্ষেত্রে বিশ্বকে বোঝবার জন্য পরমেশ্বর সম্পর্কে এইরকম অভিজ্ঞতা অর্জন একমাত্র পথ হয়ে দাঁড়ায়…… এবং এইভাবে পরম সত্যকে জানবার জন্য এই ঘটনাটি আর একটি কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
কিন্তু সমভাবে এই আশা করবার কোন কারণ নেই যে এইসব মানুষগুলো পরম সত্যকে দেখতে পাবে কিনা? যদি পরম সত্যে অবভাস ও সত্তার মতবাদের কোন সাদৃশ্য থাকে তবে তা থাকুক। আমি আবেগের মূল্য অস্বীকার করি না, কিন্তু আমি এটা অস্বীকার করি যে, এটা কোন অদ্ভুত ধরণের কৃপামূলক দৃষ্টি, অথবা দেবতা সম্পর্কে অভিজ্ঞতা। এক অর্থে, সমস্ত অভিজ্ঞতা পরমেশ্বর সম্পর্কে অভিজ্ঞতা, কিন্তু অন্য আর একটি অর্থে, যেহেতু সব অভিজ্ঞতা সমভাবে একই কালে অবস্থিত, তাই তা পরমেশ্বর সম্পর্কিত অভিজ্ঞতা নয়–যেমনভাবে’ পাণ্ডিত্যের অভিমান আমাকে কথা বলালো। অবভাস ও সত্তার মধ্যে অনতিক্ৰমণীয় ব্যবধান এতটাই সুগভীর যে, যতদূর আমি দেখতে পাই, কোন অভিজ্ঞতাকেই সত্তার অভিজ্ঞতার কাছাকাছি ভাবার কোন রকম উপায় নেই। এইজন্যই প্রশ্নের ক্ষেত্রে অভিজ্ঞতাগুলির মূল্য সম্পূর্ণভাবে আবেগের গুণের উপর হওয়া আবশ্যক। কিন্তু ব্র্যাডলের নির্দেশ অনুযায়ী সত্যের কোনচরম মানকে তাদের সঙ্গে যুক্ত করে নয়। যদি তাই হয়, সেগুলো কেবলমাত্র দার্শনিকীকরণের সান্ত্বনা হয়ে দাঁড়াবে, দর্শনের সান্ত্বনা হয়ে দাঁড়াবে না। তারা পরম সত্যকে প্রবর্তন করবার যুক্তি নির্মাণ করবে। কেননা সমস্ত ধরনের ফুল যারা যাবার পথে এক জায়গায় জড়ো হয়ে থাকে কিন্তু তারা তাদের এই প্রাপ্তির জন্য কোন পুরস্কার নির্মাণ করে না, যেহেতু এই সমস্ত ফুল রাজপথের প্রথমেই কেবলমাত্র বেড়ে ওঠে এবং আমরা আমাদের যাত্রা শেষ করার অনেক আগেই তারা মিলিয়ে যায় ঠিক তেমনভাবে যেমনভাবে আবির্ভূত সব কিছু আমাদের যাত্রা শেষে পৌঁছবার আগেই মিলিয়ে যায় ।
যে দৃষ্টিভঙ্গির সমর্থনে আমি বললাম তা নিঃসন্দেহে প্রেরণাদায়ক কিছু নয়। যদি সাধারণভাবে তা গ্রহণীয়ও হয়ে থাকে তবু তা দর্শন অধ্যয়নে কোন রকম উন্নতি ঘটাবে না বলেই মনে হয়। আমি আমার গবেষণাকে বিচার করে দেখতে পারি এবং যদি সত্যই আমি তাই করি তবে এই নীতি অনুযায়ী করব যে, সেখানে সব কিছুই পচে গেছে, যেখানে মানুষের কাজ দুর্গন্ধময় মাছের জন্য কান্না ছাড়া আর কিছুই নয়। কিন্তু আমি এই বিষয়ে নির্দেশ দিতে আগ্রহী যে অধিবিদ্যা যখন ধর্মের স্থানকে যোগান দেবার রাস্তা খোঁজে তখনি সব থেকে বড় ভুলটি করে। আমি স্বীকার করি যে অধিবিদ্যা তা যোগান দিতে পারে। শুধু তাই নয় সে যোগান দিয়েও থাকে, কিন্তু আমি অবশ্যই বলব যে, তা সে করে থাকে নিজেকে অধিবিদ্যায় পরিবর্তিত করে। কোন অধিবিদ্যাকে বিজ্ঞানের মতো করে স্বীকার করে নেওয়া হয় না যা বুদ্ধিবিদ্যাগত কৌতূহলের দ্বারা বিচার্য এবং যার একমাত্র বুদ্ধিবিদ্যাগত কৌতূহলের দ্বারাই পরিচালিত হওয়া উচিত। আমাদের সবাইকে একথা স্বীকার করে নিতে হবে যে অধিবিদ্যার মধ্যে আশ্বাসকে পাওয়ার কামনা প্রচুর পরিমাণে ভ্রমপূর্ণ যুক্তি এবং বুদ্ধিবিদ্যাগত অসততা তৈরি করেছে। যে-কোন ভাবেই হক, ধর্ম পরিত্যাগ এর থেকে আমাদের উদ্ধার করে থাকে। যেহেতু বুদ্ধিবিদ্যাগত কৌতূহলের কিছু কিছু মানুষের বিদ্যমান থাকে, সেহেতু এখনও বিশেষভাবে বিভ্রান্তিগুলির হাত থেকে তাদের মুক্তি পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। ব্র্যাডলেকে উদ্ধৃত করে আরও একবার বলা যেতে পারে, মানুষের প্রকৃতি এমন ধরণের যে একমাত্র একটি পথে তার প্রধান কামনা পূর্ণতায় পৌঁছাবে এবং সেই পথেই তাকে পাবার চেষ্টা করবে, সে যাই হক এবং জগৎ সে সম্পর্কে যা খুশীই ভাবুক না কেন। যদি সে তা না করে, তাহলে সে অতি নীচ।