০৫. শ্রেণি ও সংশয়

শ্রেণি ও সংশয়

আমাদের মুখ্য আলোচ্য বিষয় বেদে সংশয় ও নাস্তিক্য, তবুও এই অবৈদিক প্রতিপক্ষদের নিয়ে আলোচনা করলাম দুটি কারণে। প্রথমত, এঁরাও বৈদিক যুগেরই সংশয়ী, দ্বিতীয়ত, এঁদের প্রতিবাদের যে-সুদূরপ্রসারী ফল হয়েছিল তা বেদের যুগকে অন্য প্রকারে, কিন্তু গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিল। প্রথমত, তখন সমাজে লোকসংখ্যা কম ছিল, সেই পরিপ্রেক্ষিতে এতগুলি বিরোধী দল ও তাদের বেশ ভাল সংখ্যায় অনুগামী, এটা সমাজে একটা গুরুত্বপূর্ণ সংকটের সৃষ্টি করেছিল। লোকে দেখল এত বিভিন্ন মতাবলম্বী মানুষরা সমাজে যজ্ঞ না করেও তো দিব্যি খেয়ে-পরে বেঁচে আছে, এদের মড়কও লাগছে না, মাথার ওপরে বাজও পড়ছে না; কাজেই যজ্ঞ না করেও বেঁচে থাকা যায়। এদের সংখ্যা নিশ্চয়ই ক্রমে স্ফীত হচ্ছিল, তাই এদের অস্তিত্বকে একেবারে উপেক্ষা করাও যাচ্ছিল না। এর ফলে ব্ৰাহ্মণ্য সমাজে প্রথম যে-প্রতিক্রিয়া হল তা হল ব্রহ্মচর্য ও গার্হস্থ্য আশ্রমের পরে শাস্ত্রকারদের আরও দুটি (হয়তো প্রথমে তৃতীয়টি ও পরে চতুর্থটি) আশ্রম সংযোজন। তারা বলল, পঞ্চাশ বছর পর্যন্ত গার্হস্থ্য আশ্রম পালন করবার পরে বনে বাস করতে পার, তখন অগ্নিহোত্র-র মতো নেহাত স্বল্প উপকরণের ও স্বল্প সময়সাপেক্ষ ছোট ছোট হোমগুলি ছাড়া আর কোনও বড় যজ্ঞ করতে হবে না। এ আশ্রমকে তারা নাম দিল বানপ্রস্থ, বনে প্রস্থানের কাল। সাধারণ মানুষ দেখল গৃহীজীবনের অন্তে এক সময়ে মধ্য বয়সের সূচনাতেই যজ্ঞ থেকে তাদের ছুটি মিলবে। হয়তো কিছু লোকের তাতেও মন ভরেনি, তাই যোগ করতে হল চতুর্থ একটি আশ্রম সন্ন্যাস বা যতি। মনে রাখতে হবে, প্রাগার্য সমাজে বেদবিরোধী একটি দল ছিল ‘যতি’, যাদের সঙ্গে ব্রাহ্মণ্য সমাজের বিরোধ ছিল এ-কথা আগেও বলেছি। ঋগ্বেদে পড়ি ইন্দ্র যতিদের সালাবৃকদের কাছে দিয়েছিলেন।[১] বৃক মানে নেকড়ে। সালা মানে বাড়ি, সালাবৃক সম্ভবত গৃহপালিত কোনও নেকড়ে বাঘের মতো কুকুর (wolfhound?), যারা এত হিংস্র যে অচিরে যতিদের ছিঁড়েখুঁড়ে মেরে ফেলেছিল। সম্ভবত ঋষিরা নানা নামে বেদের সময় থেকেই ছিল। এই যতি বা সন্ন্যাস আশ্রম এই সব সন্ন্যাসী-সম্প্রদায়কে ব্রাহ্মণ্য সমাজের অন্তর্ভুক্ত করল। হয়তো শাস্ত্রকারদের এমন আশা ছিল এতে দলে দলে বেদবিরোধী সম্প্রদায়ে যোগ খানিকটা কমবে, এবং সম্ভবত তাঁদের সে-আশা কতকটা পূর্ণও হয়েছিল। ব্রাহ্মণ্য সমাজের গঠনের মধ্যে বানপ্রস্থ ও যতিকে স্বীকার করে ও-দুটিকে সংশয়ীদের ধারা থেকে বিচ্ছিন্ন করে নেওয়ার চেষ্টা করা হল।

সংশয় কি তাতে গেল? না, সেটা অন্য চেহারায় দেখা দিল। মানুষের প্রধান সন্দেহ দেবতায় ও যজ্ঞে। দেবতারা সংখ্যায় বাড়তে বাড়তে তেত্রিশেরও বেশি হয়েছিল; আঞ্চলিক প্রাগার্য দেবতা ক্রমেই আর্য দেবমণ্ডলী মধ্যে অনুপ্রবেশ করছিল। সুতরাং মানুষের কতকটা বিভ্রান্তি জন্মানো খুবই স্বাভাবিক। তা ছাড়া শেষের দিকে কিছু প্রায়-বিমূর্ত দেবতা দেখা দিচ্ছিলেন, তার আগের বিস্তর দেবতা তো ছিলেনই, ফলে শেষ দিকে দিগ্‌ভ্রান্ত মানুষের সংশয় তো জাগবেই: কোন দেবতাকে হব্য দেব? যে সব দেবতাকে যজ্ঞে হব্য দান করাটাই ছিল ধর্মাচরণ, তাঁরা তো আছেনই, তাঁদের সঙ্গে জুড়ছেন নতুন সর্বাতিগ দেবতারা। এদের মধ্যে হবিদান করব কাকে? প্রশ্নটা সমাজে অনুত্তরিতই রইল কিন্তু যজ্ঞবিধির শেকড়ে টান লাগল। ফলে ওই সন্ন্যাসী-সম্প্রদায়গুলির অবিশ্বাস ও জিজ্ঞাসা এবং ব্রাহ্মণ্য সমাজের মধ্যেই ক্রমবর্ধমান সংশয়— এ দুইয়ে মিলে ব্রাহ্মণ্য সমাজেরই অভ্যন্তরে নতুন একটি ধর্মধারা প্রবর্তিত হল।

সংহিতাব্রাহ্মণে যজ্ঞ নিয়ে যে-কর্মকাণ্ডের বিবরণ পাওয়া যায় নতুন ধারার মধ্যে তার প্রথম দিকের সাহিত্য আরণ্যক। এগুলি এবং এগুলির পূর্ববর্তী কিছু ব্রাহ্মণের শেষ দিকে একটা নতুন প্রবণতা হল যজ্ঞের রূপক ব্যাখ্যা দেওয়া। যেমন তৈত্তিরীয় আরণ্যক (৩:১)-এ বলা হয়েছে, ‘ওম্, বুদ্ধিই হল চমস, চিন্তা হল ঘৃত, বাক বেদি, কুশ ধ্যান, অগ্নি কামনা…’ ইত্যাদি। এই ধরনের বহু কথা আরণ্যকে আছে। আরণ্যকসাহিত্য খুবই ক্ষীণকলেবর, মাত্র তিনটি: ঋগ্বেদের একটি ঐতরেয়, যজুর্বেদের দুটি, শাঙ্খায়ন (বা কৌষীতকি) আর তৈত্তিরীয়। প্রাণ এখানে খুব প্রাধান্য পেয়েছে। তাকে নানা দণ্ড, অগ্নি ও যজ্ঞীয় বস্তুর সঙ্গে একাত্ম করে দেখানো হয়েছে। স্বভাবতই মনে আসে, এর পেছনে কী তাগিদ কাজ করছিল? যজ্ঞ-অনুষ্ঠানের জন্য যজ্ঞীয় বস্তুগুলির স্বরূপ নির্ণয়ের কোনও প্রয়োজন নেই, তবে কেন এই ধরনের সমীকরণ বারে বারে দেখা দিচ্ছে এখন? স্পষ্টতই যজ্ঞ যখন তার অভিধাগত অর্থে নিষ্ফল প্রতিপন্ন হয়েছে, তখনও তাকে সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্যে এই ভাবে তাকে ভিন্নতর ব্যাখ্যার দ্বারা প্রতিষ্ঠিত করার চেষ্টা করা হয়েছে। আগে কয়েকশো বছর যজ্ঞ তার সাধারণ আক্ষরিক অর্থেই মানুষের কাছে চলিত ছিল, যজ্ঞ ও যজ্ঞফলে মানুষের কতকটা বিশ্বাস ছিল বলে অন্য রকম ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা ছিল না। এখন যজ্ঞের সার্থকতা নিয়ে জনমানসে সংশয় দেখা দেওয়ার ফলে সাধারণ শব্দার্থকে পেরিয়ে অন্য ভাবে দেখানো হচ্ছে। বলা হচ্ছে, ইন্দ্রিয়গোচর, বুদ্ধিগোচর যে-যজ্ঞগুলির অনুষ্ঠান করা হচ্ছিল সেগুলি শুধুমাত্র সেই অর্থেই পর্যবসিত নয়, তার এক গূঢ়তর অর্থই তাদের মর্মবস্তু। ব্রাহ্মণসাহিত্যেও মাঝে মাঝে যজ্ঞীয় বস্তুগুলির সঙ্গে অন্যান্য বস্তুর সমীকরণ আছে, কিন্তু সেখানে অন্যান্য বস্তু দার্শনিক হয়; বস্তুজগতের থেকেই তা অনেক বেশি সংকলিত এবং তাতে যজ্ঞ প্রচলিত অর্থে যজ্ঞই থাকছে। কিন্তু এমন একটা সময় নিশ্চয়ই এসেছিল যখন ওই অভিধাগত অর্থে মানুষ আর যজ্ঞকে মানতে পারছে না, অথচ পুরোহিততন্ত্র যজ্ঞকে সচল রাখতে চায়। সাধারণ মানুষের মনের মধ্যে যজ্ঞ সম্বন্ধে একটা দুর্বোধ্য সম্ভ্রমবোধ রয়ে গেছে, তাই সেইটেকে কাজে লাগিয়ে শাস্ত্রকাররা বলতে চাইলেন, ‘যে-যজ্ঞ চোখে দেখছ, কানে শুনছ, প্রকৃত প্রস্তাবে যজ্ঞ তাকে অতিক্রম করে অন্য এক ভাবলোকে এক অতীন্দ্রিয় স্তরে সত্য।’

এ ব্যাখ্যার অন্তরালেও এক ধরনের সংশয় সক্রিয়। যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হচ্ছিল অথচ তার থেকে প্রতিশ্রুত ফল যে পাওয়া যাচ্ছিল না তার প্রমাণ পাওয়া যায় যজ্ঞ নিয়েই যে দর্শনপ্রস্থান— জৈমিনির মীমাংসা, যা আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে গড়ে উঠেছিল প্রায় হাজার বছর পরে (খ্রিস্টীয় সপ্তম শতকে) তার ওপরে কুমারিলভট্ট ভাষ্য রচনা করেন। তাঁর বড় গদ্যগ্রন্থটি তন্ত্রবার্তিক আর ছোট ছন্দোবদ্ধ গ্রন্থটি শ্লোকবার্তিক। তন্ত্রবার্তিক-এর প্রথম অধ্যায়ে দ্বিতীয় পাদের তৃতীয় সূত্র বলছে, ‘যদি (বৈদিক) শাস্ত্রাংশগুলি বর্তমানকালের ঘটনা সম্বন্ধে বলছে এমন না ধরা হয়, (কিন্তু ভবিষ্যতে যাতে ফল দেখা দেয় এ জন্য বিধান নির্দেশ করছে ধরে নেওয়া হয়) তা হলে সেগুলি খণ্ডিত হয়। এটা এই কারণে যে, তেমন ফল কেউ দেখে না।’ ওইখানেই চোদ্দো-সংখ্যক সূত্র বলে, ‘যজ্ঞ থেকে সেই সব মহৎ ফল যে ফলবে এ কথা কে জানে?’ শ্লোকবার্তিকের দশম অধ্যায়ের দ্বিতীয়-তৃতীয় পাদের পঞ্চম সূত্রটি বলে, ‘চিত্রা, যাগ, ইত্যাদি সম্বন্ধে শাস্ত্রাংশগুলি যে বলে, সে সব থেকে পশুলাভ, ইত্যাদি ফল পাওয়া যাবে, তা মিথ্যা; কারণ যদিও সেগুলি (শাস্ত্রাংশগুলি) দৃশ্যমান ফল সম্বন্ধে বলে তবু বাস্তবে তেমন কোনও বস্তুই দেখা যায় না।’ দর্শনটির একটি বৈশিষ্ট্য হল এতে মোক্ষের আলোচনা একেবারেই নেই; যজ্ঞ এবং ঐহিক যজ্ঞফলই এর বিষয়বস্তু। যজ্ঞকর্মকে অবলম্বন করে যে একটিমাত্র দর্শনপ্রস্থান গড়ে উঠেছে তা হল মীমাংসাদর্শন, তারই ভাষ্য করেছেন প্রখ্যাত পণ্ডিত কুমারিলভট্ট এবং এই ভাষ্য দ্ব্যর্থতাহীন ভাবে ঘোষণা করছে যে, যজ্ঞ যে সব ফলপ্রাপ্তির আশা দেয় বাস্তবে তা ঘটে না। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের মধ্যেই বৈদিক ব্রাহ্মণ্য ধারার অন্তর্গত শাস্ত্রই স্বীকার করছে যজ্ঞ থেকে যে-ফল পাওয়ার কথা তা পাওয়া যায় না।

খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতক থেকে বেদবিরোধী ও যজ্ঞবিরোধী যে সব মতবাদ, জৈন, বৌদ্ধ, আজীবিক, ইত্যাদির অভ্যুত্থান ঘটেছিল তার সবগুলিরই পিছনে এই ধরনের ব্যর্থতাবোধের অভিজ্ঞতা ছিল। মানুষের সব প্রয়োজন যদি যজ্ঞে মিটত তা হলে যজ্ঞ সম্বন্ধে সংশয়ের কোনও অবকাশই থাকত না। কিন্তু যজ্ঞ করে যখন গোধনপ্রাপ্তির আশা জাগে, তখন যজ্ঞের কিছুকাল পরেও যদি গোধন না পাওয়া যায়, তা হলে যে-কোনও মানুষের মনেই সংশয় জাগবে। ব্যাপক ভাবে এমন সংশয় সমাজে না থাকলে বেদে তার উল্লেখ রক্ষিত হত না। একাধিক উচ্চারণে যে-সন্দেহ ব্যক্ত হয়েছে তার ভিত্তিতেই মীমাংসাদর্শনের ওই সাহসী ঘোষণা। যজ্ঞ ও যজ্ঞফলের মধ্যে স্বল্প কিছুকালের ব্যবধান থাকলে মানুষ ধৈর্য ধরে প্রতীক্ষাই করত, হতাশ বা সন্দিহান হত না; কিন্তু সুদীর্ঘকালের মধ্যেও যখন প্রতিশ্রুত যজ্ঞফলের দেখা মিলত না তখন অনিবার্য ভাবেই দেখা দিত সংশয়।

আরণ্যকে প্রথমবার স্পষ্ট করে মরণোত্তর জীবন সম্বন্ধে বেশ কিছু কথা আছে (ব্রাহ্মণসাহিত্যেই এর সূত্রপাত, তবে সেখানকার উল্লেখগুলি খুব স্পষ্টও নয়, বিস্তৃতও নয়)। শাঙ্খায়ন আরণ্যকে দেখি, মৃত্যুর পরে আত্মা পরলোকে গেলে তার কী রকম অভ্যর্থনা হয়: তার পাপ ও পুণ্য কর্ম তার প্রিয়জন ও বিদ্বেষভাজনদের মধ্যে ভাগ করে দেওয়া হয়, তার পর সে ব্রহ্মার দিকে এগোয় (পথের ভূদৃশ্য, গাছপালা, নদী, এ সবের স্পষ্ট বিবরণ দেওয়া আছে)। ব্রহ্মা তাকে প্রশ্ন করেন, ‘তুমি কে?’ সে উত্তর দেয়। তখন ব্রহ্মা তাকে বলেন, ‘তুমি যে আমিও সেই’ এবং তাকে ব্রহ্মলোকে আমন্ত্রণ জানান। এ পর্যন্ত পরলোক সুখের স্থান; ঋগ্বেদে যম (যিনি তখনও মৃতদের অধিদেবতা, মৃত্যুর নন) পরলোকগত আত্মার দেখাশোনা করেন ও পূর্বাগতদের সঙ্গে তাকে আনন্দে রাখেন। এখানে ব্রহ্মা তাকে আহ্বান করে ব্রহ্মলোকে সমাদরে স্থান দেন। অর্থাৎ মৃত্যুর পর মানুষ এক ইচ্ছাপূরক অস্তিত্বের সন্ধান পায়, যেখানে আছে আনন্দ ও অভ্যর্থনা। নরকের কল্পনা তখনও আসেনি। সকলেই স্বর্গে স্থান পায়। জন্মান্তরের জন্যে প্রার্থনা আছে, ‘চন্দ্রের মতো যেন আমি পুনর্জাত হই’। (ঐতরেয় আরণ্যক ৫:১) জন্মান্তরের ক্ষয় বা মোক্ষের কোনও কল্পনা এখনও নেই। ‘যদি কেউ অ-সৎকে (অবিদ্যমান) ব্রহ্ম বলে জানে, যদি কেউ সৎকে ব্রহ্ম বলে জানে…’। (তৈত্তিরীয় আরণ্যক ৯:১৯) অর্থাৎ অস্পষ্টতার দিকে, অনির্দেশ্যতার দিকে একটা প্রবণতা লক্ষ করা যায়।

পূর্বের যজ্ঞ ও দক্ষিণার সঙ্গে রূপকস্তরে একটা আপস লক্ষ করা যায়। মনে রাখতে হবে যে, আরণ্যকের গ্রন্থগুলি অরণ্যে পাঠ করতে হত। তৈত্তিরীয় আরণ্যকের একটা অংশের নাম ‘কুবের সংহিতা’ (কুবের বৈদিক সাহিত্যে সদ্যসমাগত)। সেখানে কুবেরের উপাসনা অরণ্যে করার বিধান আছে, কারণ তা সমস্ত কামনা পূরণ করে; এর দক্ষিণা হয়, একটি গাভি, পিত্তল, ক্ষৌমবস্ত্র অথবা সূক্ষ্ম শুভ্র বসন।’ (১:৩২:৩) আনুমানিক খ্রিস্টপূর্ব ষষ্ঠ-পঞ্চম শতকে তৈত্তিরীয় আরণ্যক রচিত হয়। এ সময়ে দেশে অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্যের অবস্থা বেশ ভাল, নানা ভাবে দেশে সম্পত্তি ও সমৃদ্ধি আসছে; কাজেই এ পটভূমিকায় কুবেরের উপাসনা প্রবর্তিত হওয়া স্বাভাবিক। যেটা চোখে পড়ে তা হল, আরণ্যকে বা অরণ্যে পাঠ করতে হবে ছত্রকে, সেখানে সম্পদ বৃদ্ধির জন্য কুবেরের উপাসনাও একটি পাঠ্য বিষয়। ঐতরেয় আরণ্যকে ঋষি কাবষেয় বলছেন, ‘কেন আমরা স্বাধ্যায় অভ্যাস করব, কেন যজ্ঞ করব? তার চেয়ে বরং বাক্‌কে প্রাণে বা প্রাণকে বাকে আহুতি দেব।’ (৩:২:৬) এখানে লক্ষণীয় যে স্বাধ্যায় ব্রহ্মচর্যের এবং যজ্ঞ গার্হস্থ্য আশ্রমের, ঋষি এ দুটির উপযোগিতা সম্বন্ধে প্রশ্ন তুলেছেন, এবং নিজেই সমাধান দিচ্ছেন: বাক স্বাধ্যায়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত এবং আহুতি দেওয়া যজ্ঞকর্মের অন্তর্গত। তাই বাস্তবে ব্রহ্মচর্য পালন এবং যজ্ঞ করার রূপক বিকল্প দিচ্ছেন, যেটা মানুষ কেবল মনে মনেই করতে পারে। তা হলে কর্মকাণ্ড অর্থাৎ ব্রহ্মচর্য ও গার্হস্থ্য আশ্রমে পালনীয় কর্তব্য এখন দুটো মানসিক প্রক্রিয়ার দ্বারাই সাধন করা যাবে। এই ভাবে কর্ম থেকে জ্ঞানে উত্তরণ ঘটছে।

মনে রাখতে হবে যে, ব্রহ্মচর্য ও গার্হস্থ্য ছিল সংহিতা ও ব্রাহ্মণের ধর্মাচরণ। এবং এই পর্যায় সম্বন্ধে অনেক সাধারণ মানুষের মনে সংশয় দেখা দিয়েছে, অথচ সহসা এত শতাব্দীর আচরণকে বাতিল করা যাচ্ছে না; তাই রূপক আকারে সেগুলির অনুষ্ঠান করবার বিধান দেওয়া হচ্ছে। এখন লক্ষ করতে হবে, বিকল্পগুলি কী ধরনের: যজ্ঞ, যা কায়িক ভাবে বাস্তবে সম্পাদন করা হত তার বিকল্প প্রাণকে বাক্-এ, এবং বাক্‌কে প্রাণে আহুতি দেওয়া, অর্থাৎ প্রত্যক্ষ কর্মসাধ্য যজ্ঞের বিকল্প হল পরোক্ষ মানসক্রিয়া। উপকরণ দিয়ে, কায়িক প্রয়াস দিয়ে যা করবার কথা ছিল, সংহিতা ব্রাহ্মণের সেই পর্বকে বলা হত কর্মকাণ্ড; মন, চিন্তা, ধ্যান, কল্পনা দিয়ে যে-প্রয়াস তার বিকল্প হিসেবে উপস্থাপিত হল এ বার তার নাম হল জ্ঞানকাণ্ড। মৃত্যু নিয়ে এখানেও যথেষ্ট উৎকণ্ঠা আছে বরং তা বেড়েছে বলা যায়, ‘মৃত্যুর পরেও মানুষের আবার মৃত্যু হয়, তার নিজের কর্মগুলি তাকে গ্রাস করে।’ (তৈত্তিরীয় আরণ্যক ১:৮:৩) তা হলে মরণোত্তর অবস্থা নিয়ে উৎকণ্ঠার সঙ্গে সংশয়ও আছে। পুনর্বার মৃত্যু একটা ভয়াবহ সম্ভাবনা। অতএব স্বভাবত এর থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার আগ্রহ আরণ্যকে প্রবল এবং এর আগ্রহ প্রবলতর হয় জ্ঞানকাণ্ডের শেষ ভাগ উপনিষদে।

বিশ্বচরাচর নিয়ে কৌতূহল ও সংশয়ও আরণ্যকে ব্যক্ত হয়েছে:

আকাশ কীসে আশ্রিত? সংবৎসরের গূঢ় রহস্যটি কী? দিন কোথায়, হে দেব, এই রাত্রিই-বা কোথায়? মাস ও ঋতুগুলি কোথায় বিধৃত? সলিলের নিবাস কোথায়? সে কোন্ সত্তা, যার মধ্যে এই দুটি (আকাশ ও পৃথিবী) আধৃত? আমি তোমাকে প্রশ্ন করি : মৃত্যুর পরে কী থাকে সে সম্বন্ধে… যম কোথায় পাপীকে নির্যাতন করে? (তৈত্তিরীয় আরণ্যক ১:৮:১-৪)

এখানে মরণোত্তর অবস্থা নিয়ে সংশয় অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় ব্যক্ত হয়েছে। আরও লক্ষণীয় যে, খুব আবছা ভাবে হলেও নরকের একটি কল্পনা এখানে আছে— নরকে যম পাপীকে শাস্তি দেয়, অত্যাচার করে। অর্থাৎ এখানেই প্রথম দেখছি, মৃতদের রাজা যম, পৃথিবীর রাজারা যেমন অপরাধী এবং/বা অসহায় প্রজাকে পীড়ন করে তেমন করেই যমও অপরাধীকে দণ্ড দেন। এ অংশে যে-প্রশ্নগুলি উচ্চারিত সেগুলির প্রথম প্রকাশ সংহিতাতেই; অতএব মনে হয়, যুগে যুগে এইসব সংশয় মানুষকে উত্তরোত্তর বিচলিত করেছে। প্রজাপতির পুত্র আরুণি সুপর্ণেয় পিতার কাছে এসে প্রশ্ন করে, ‘কাকে আপনারা শ্রেষ্ঠ (মহত্তম) বলেন?’ পিতা উত্তর দিলেন, ‘সত্য, তপঃ, সংযম, দান, ধর্ম এবং সন্ততি।’ (তৈত্তিরীয় আরণ্যক ১০:৬৩:১) এখানে কর্মকাণ্ডের পরে জ্ঞানকাণ্ডের যে-স্বকীয় বৈশিষ্ট্য তা স্পষ্ট ভাবে চোখে পড়ে: এ উত্তরগুলির অধিকাংশেরই কর্মকাণ্ডের সঙ্গে প্রত্যক্ষ কোনও যোগ নেই— সন্ততি ছাড়া। আরণ্যকে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে নৈতিকতা, জ্ঞানকাণ্ডে বিশেষ ভাবে গুরুত্ব দেখা যায়, তপ ও ধর্মের কারণ এখন দৈহিক প্রয়াসসাধ্য যজ্ঞের চেয়ে মানসিক প্রচেষ্টাসাধ্য জ্ঞানেরই তাৎপর্য বেশি।

এই যুগে দেখা গেল ধনী ও দরিদ্রের মধ্যে প্রথম শ্রেণিবিভেদ। মানসিক শ্ৰম প্ৰাধান্য পেল কায়িক শ্রমের ওপরে, এ-ও আর-একটা বিভাজন। এই সঙ্গেই আর-একটা বিভাজন ঘটেছিল সমাজে: পাকাপাকি একটি পুরোহিত-শ্রেণির অভুত্থান। এরা পরোপজীবী, এই সঙ্গে ধর্ম বা শাস্ত্র হয়ে উঠল প্রাথমিক ভাবে জ্ঞানলভ্য। যখন নগরসভ্যতা বিভক্ত হয়ে একটি পুরোহিত-শ্রেণিকে অন্তর্ভুক্ত করে যে-শ্রেণি চিন্তাজগতের বস্তুকে শাস্ত্রে বিধিবদ্ধ করে তখন তার ফল হয় ধর্মতত্ত্বের উদ্ভব।[২] মানসিক শ্রম এক বিশেষ অর্থে পুরোহিতরা করে, তাই এই সময় থেকে পুরোহিত-সম্প্রদায়ও বিশেষ করে শ্রদ্ধা-সম্ভ্রমের পাত্র হয়ে উঠল। ব্রাহ্মণসাহিত্যের শেষ অংশ থেকে আরণ্যক উপনিষদ পর্যন্ত এই ধরনের আধ্যাত্মিক ও দার্শনিক তত্ত্বের আলোচনা বিশেষ একটি মহিমায় মণ্ডিত হয়ে ওঠে। এই যুগে দেহ ও আত্মার পৃথক সত্তার স্বীকৃতিও নতুন একটি বিভাজন। আত্মা শব্দটি প্রথম দিকে দেহকেই বোঝাত, (জার্মান ভাষায় atmen মানে শ্বাস নেওয়া। ওই ধাতুর থেকে নিষ্পন্ন ইন্দো-ইউরোপীয় একটি শব্দ আত্মা)। কিন্তু পরে দেহাতিরিক্ত স্বতন্ত্র একটি সত্তাকে অভিহিত করল আত্মা শব্দ। এই বিভাজনটি এ যুগের একটি অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ বিভাজন। আত্মাই সত্য এবং গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত হতে লাগল। এর পর থেকে দেহ গৌণ, নশ্বর ও হীন বলে গণ্য হল, পুরোহিত শাস্ত্রকারদের সমস্ত ঝোঁকটা পড়ল আত্মার ওপরে। ফলে মানসিক শ্রমের তুলনায় কায়িক শ্রমের ন্যূনতা ও হীনতা সমর্থিত হল। সমাজে এ সময়ে, অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম থেকে ষষ্ঠ-পঞ্চম শতকের মধ্যে, লিপি, মুদ্রা, জ্যোতিষ ও বেদাঙ্গে আলোচিত নানা নতুন বিদ্যাচর্চার সূত্রপাত হয় এবং এর পশ্চাতে সমাজে ধীরে ধীরে মৌলিক কতকগুলি স্থায়ী পরিবর্তনও ঘটছিল। তার মধ্যে প্রধান একটি হল প্রাচীন গোষ্ঠী (tribe)গুলি ভেঙে প্রথমে কৌম (class) ও পরে কুলের (বৃহৎ একান্নবর্তী পরিবার, যেখানে তিন-চার প্রজন্ম একই বাড়িতে বাস করে) উদ্ভব। পিতৃতান্ত্রিক সমাজের প্রাচীন এককগুলি ক্রমশ কৃষিভূমি ও গোচারণভূমিনির্ভর ছোট ছোট খণ্ডে বিভক্ত হচ্ছিল। এই সব প্রক্রিয়া যখন সমাজে চলছে তখন মানুষ তার আশপাশের জগৎকে যে ভাবে দেখত সে-দেখা বদলাতে লাগল। সমাজে এই যে নানা বিভাজন ঘটছিল এর একটা দৃঢ় ও স্থায়ী প্রতিক্রিয়া মানুষের মনোজগতে অনিবার্য ভাবেই ঘটছিল। ‘এতে প্রতিফলিত হচ্ছিল প্রকৃতি সম্বন্ধে মানুষের চেতনার একটা বিভাজন, যেটির উৎস… সমাজে অনুরূপ একটি বিভাজন।[৩]

সারা পৃথিবীতেই এই যুগে মননের জগতে একটা প্রকাণ্ড তোলপাড় লক্ষ করা যায়। গ্রিস, মিশর, চিন, পারস্য, ভারতবর্ষ— সর্বত্রই এই যুগে পুরোনো চিন্তাধারায় একটা আমূল পরিবর্তন দেখা দিল, পূর্ব যুগের তুলনায় এ পরিবর্তনগুলি যেমন মৌলিক, তেমনই আপেক্ষিক ভাবে দ্রুত। বৃহৎ ভূমধ্যসাগরীয় মধ্যপ্রাচ্যে, চিন ও ভারতবর্ষে এটা দেখা গেল। ব্যাপারটা তুলনামূলক ভাবে দ্রুত ঘটলেও বাস্তবে আকস্মিক নয়। এটি নিয়ন্ত্রিত হয়েছিল ওই বৃহৎ ভূখণ্ডে মানুষের ব্যবহারিক জীবনের অবগঠনে (infrastructure) যে সব মৌলিক পরিবর্তন ঘটেছিল, মানুষের অধিগঠনে (superstructure) তারই প্রতিফলন হিসাবে। সমাজের মানুষ দেখেছে গোষ্ঠী ভেঙে কৌম হয়েছে; খ্রিস্টপূর্ব সপ্তম শতকের আগে থেকেই কৌম ভেঙেছে, সৃষ্টি হয়েছে ‘কুল’, বৃহৎ একান্তবর্তী পরিবার; অর্থাৎ সমাজের এককটি ক্রমেই ছোট হচ্ছে। শ্রৌতযাগ যখন চলিত ছিল তখন সমস্ত গোষ্ঠী এবং পরে বহু কৌম একত্রে যজ্ঞ অনুষ্ঠান করত, গৃহ্যযাগ হয় প্রতি পরিবারে, অর্থাৎ সেখানে পরিসর ছোট। বাণিজ্য, বিশেষত বহির্বাণিজ্যের প্রসারের সময়ে মুদ্রার প্রচলন হয়। আগে কেনাবেচা হত প্রধানত গাভি এবং অন্যান্য বস্তু ও দ্রব্যের বিনিময়ে, এখন মুদ্রা, লিপি প্রবর্তন হওয়ায় সব কিছুরই লিখিত হিসাব বা দলিল থাকে। এ সব কিছুরই গভীর ও স্থায়ী প্রতিক্রিয়া ঘটে সাধারণ মানুষের মনে। সংখ্যায় তারা সংখ্যাগরিষ্ঠ, অথচ তাদের অধিকাংশই গ্রাসাচ্ছাদনের বেশি কিছু পায় না, ফলে বিপদে-আপদে ধনী মহাজনের কাছে ঋণ নিতে বাধ্য হয়; সুদ দিতে হয়, না পারলে কঠোর শাস্তি। তাই অথর্ববেদে প্রার্থনা আছে: আমাকে এমন লোকে নিয়ে যাও মৃত্যুর পরে যেখানে খাতকের ওপর উৎপীড়ন নেই।

যে সমাজে ধনী-দরিদ্র শ্রেণিবিভাগ ঘটেছে সেখানে অধিকাংশ দরিদ্রের ওপরে ধনীর পীড়ন আছে। যেখানে মননশ্রমিক প্রভুত্ব করে কায়িক শ্রমিকের ওপরে, সেখানেও মুষ্টিমেয় কিছু লোকের প্রতাপের অধীন সংসারের বহু সংখ্যক লোক। আত্মা নিয়ে পুরোহিত-শাস্ত্রকাররা যখন আলোচনায় মগ্ন, তখন সাধারণ মানুষ দেহের পুষ্টি, ক্ষুধার খাদ্য, পরনের বস্ত্র, রোগের ওষুধ, বিপদের সমাধান, ঋণের বোঝা ও শোধ না করতে পারার যন্ত্রণা কমাতে পারছে না। এ জীবন তার পক্ষে ক্রমেই দুঃসহ হয়ে উঠছে।

এই আবহাওয়াতে, এই সময়ে দেশের বাতাসে ভেসে বেড়াচ্ছে জন্মান্তরবাদ— কী ব্রাহ্মণ্য, কী বৌদ্ধ, কী জৈন, কী আজীবিক সব ধর্মমতই জন্মান্তরকে স্বীকার করে নিয়েছে। সাধারণ মানুষের কাছে জীবন যতই মূল্যবান হোক, এই ঋণ-ব্যাধি-দারিদ্র্য-সংকুল জীবনের পুনরাবৃত্তি কেমন করে লোভনীয় হবে? যমের সন্নিধানে পরলোকে পূর্বমৃতদের সঙ্গে আনন্দে থাকার পরিবর্তে আবার পৃথিবীতে এসে মালিকের মারধর, মহাজনের অত্যাচার, মনিবের গঞ্জনার সঙ্গে আবার আধপেটা খাওয়া, অধিকাংশ অভাব না মেটা, রোগব্যাধিতে নিষ্প্রতিকার যন্ত্রণা সহ্য করে তিলে তিলে অচরিতার্থ জীবনের অবসান— এ সম্ভাবনা কেন তাকে প্রলুব্ধ করবে? সমাজ সব দিকেই পালটাচ্ছিল এবং প্রত্যেক পরিবর্তনে নিচের তলার মানুষের জীবনযাত্রা ক্রমেই দুর্বিষহ হয়ে উঠছিল।

সংহিতাব্রাহ্মণের যুগে যে জীবনের ছকে, সমাজের যে অবগঠনে মানুষ পরিচিত ছিল, উৎপাদনব্যবস্থা ও উৎপাদন সম্পর্কিত যে মানবিক সম্পর্কগুলির সম্বন্ধে তাদের যে বোধ ছিল সেগুলি প্রবল ভাবে আলোড়িত হল। ফলে চিন্তার জগতে প্রাচীন মূল্যবোধ ও প্রত্যয়গুলি আর পূর্বের মতো রইল না। গোষ্ঠী থেকে কৌম থেকে কুল— এ পরিবর্তনে সামাজিক একক ক্রমেই আয়তনে হ্রস্ব ও ক্ষীণ হয়ে যাচ্ছিল। এর ফলে মানুষের অভ্যন্তরীণ একাকিত্বের বোধ বাড়ছিল। আরণ্যকেই পূজার প্রাথমিক চিহ্নগুলি পাওয়া যায় আর পাওয়া যায় নানা নতুন দেবদেবীর নাম, যাঁরা পূর্বের যজ্ঞবিধির সঙ্গে সম্পূর্ণ অসম্পৃক্ত; আর্য-প্রাগার্য সংমিশ্রণের অনিবার্য ফল হল, দুটি দেবমণ্ডলীর পরস্পরের সম্মুখীন হওয়া এবং একটির মধ্যে অন্যটির ধীরে ধীরে অন্তর্লীন হয়ে যাওয়া। এরই ফলে ব্রাহ্মণ্য দেবমণ্ডলী খুব দ্রুত স্ফীত হয়ে উঠছিল, সৃষ্টি হল ‘বিশ্বে দেবাঃ’ সংজ্ঞা, উদিত হল প্রশ্ন: কস্মৈ দেবায় হবিষা বিধেম। ‘একটি সমাজের আদিমতম সাংবিধানিক সংগঠন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে একাকী হয়ে পড়াটা মানুষকে সেই সব অভিজ্ঞতাতে অংশগ্রহণ করতে দেয় না যেগুলি থেকে অতিলৌকিক বিশ্বাস উৎপন্ন হতে পারে বা সমর্থিত হতে পারে। মানুষ যে সব সংগঠনের সবটা অথবা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ জানতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, এটা ধরে নিলে তত্ত্বগত ভাবে কতকগুলি সামাজিক সংগঠনের বহু লক্ষণকে ধ্বংস করা হয় যা এ সংগঠনগুলিকে একটা অতিলৌকিক মহিমা দান করে— এগুলির অদৃশ্যত্ব, অমরত্ব, ব্যাপ্তিত্ব, অজ্ঞাতত্ত্ব, অলঙ্ঘ্যত্ব এবং উদ্দেশ্যকে সরাসরি প্রভাবিত করে (মানুষের) আচরণ নিয়ন্ত্রণ করা।’ এই উদ্ধৃতির রচনাকাররা যে-মূল কথাটি বলতে চান তা হল, সমাজ-সংগঠনের অর্থাৎ উৎপাদন, বণ্টন এবং এগুলির সঙ্গে সম্পৃক্ত যে-মানবিক সম্পর্কগুলি, তার ওপর থেকে যখন সমাজের সাধারণ মানুষের নিয়ন্ত্রণের অধিকার একেবারে চলে যায় তখন মানুষের মধ্যে এমন এক ধরনের বিচ্ছিন্নতাবোধ জন্মায় যাতে অতিলৌকিকে তার বিশ্বাস টলে যায়। মানুষ যে সমাজ-সংগঠনের মূল চরিত্রগুলি জানতে বা নিয়ন্ত্রণ করতে পারে এ কথা মেনে নিলে সমাজের কিছু সংগঠনে— যেমন— ধর্মবিশ্বাস বা ধর্মাচরণে— যে একটা অতিলৌকিকের মহিমা আরোপিত আছে তা নষ্ট হয়ে যায়। এই অতিলৌকিকতা হল অদৃশ্যত্ব, ইত্যাদি। যে কালপর্বের আলোচনা হচ্ছিল, সেই সময়ে এই ধরনের বিশ্বাস টলে যাচ্ছিল; গোষ্ঠীর অভ্যন্তরে অবস্থানের যে সমবেত নিরাপত্তাবোধ তা কৌমে ও কুলে এসে ভেঙে গেল। মানুষ এক ধরনের একাকিত্ব ও হতাশার সম্মুখীন হল, যার প্রতিকার তৎকালীন সমাজ-সংগঠনে ছিল না। সে সমাজে মুষ্টিমেয় সুবিধাভোগী একটি শ্রেণিই প্রধান, যাদের বাড়তি সুবিধাগুলি আসছিল সাধারণ মানুষকে বঞ্চিত রাখা থেকেই। এই সময়ে শ্রেণিবিভাজন ও পরে নগরায়ণে সমাজে যে বিন্যাস দেখা দিল তাতে সমাজের ওপরতলার মুষ্টিমেয় লোক নীচের তলার অগণ্য মানুষের ভাগ্যনিয়ন্তা হয়ে উঠল, ফলে সমাজের গতিপ্রকৃতি নিরূপণে বা নিয়ন্ত্রণে সাধারণ মানুষের আর কোনও যোগ বা অধিকার রইল না। এ দিকে নানা কারণে— যেগুলি আলোচনা করা হল— সাধারণ মানুষের জীবন কষ্টকর ও নানা ভাবে আপৎসংকুল হয়ে উঠল। তখন সমাজের সব স্তরেই জন্মান্তরবাদ প্রবল ভাবে গৃহীত, ফলে হতাশা। ভবিষ্যৎ জন্মান্তর সম্বন্ধে অনীহা খুব স্বাভাবিক ভাবেই প্রকাশ পেল। সমাজের ওপরতলায় যারা চাষি-মজুরের মালিক, নিজেরা কায়িক শ্রম করে না কিন্তু কায়িক শ্রমে উৎপাদিত উদ্বৃত্ত, প্রাচুর্য ও সুখ ভোগ করে তাদের পক্ষে জন্মান্তর কাঙ্ক্ষণীয়। ফলে সে-মহলে জন্মান্তরবাদ যে সাদরে গৃহীত হবে তা তো খুবই স্বাভাবিক; কিন্তু জীবনের অর্থ যাদের কাছে আধপেটা খেয়ে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করেও নানা কারণে ওপরওয়ালার কাছে নিগ্রহ ভোগ করা তাদের কাছে জন্মান্তর যে বিভীষিকারূপে দেখা দেবে তাতে বিস্ময়ের কিছু নেই।

এ ছিল অনিবার্য কিন্তু ধীরগতির এক প্রক্রিয়া, ‘…প্রাথমিক এক প্রকৃতিনিষ্ঠ সমন্বয়ের মনোভাব, যাতে মানুষের অন্তরাত্মা তখনও প্রবল ভাবে পৃথিবীবিরোধী মনোভাব থেকে চূড়ান্ত ভাবে বিশ্ববিদ্বেষী, দেহবিদ্বেষী অবস্থানে পৌঁছোয়নি এবং সে-অবস্থান থেকে স্বভাবত দ্বৈততা ও নৈরাশ্যে পৌঁছোয়নি, (কিন্তু) ধীরগতিতে সেই জ্ঞানমার্গের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে…।[৫] এই অংশে দুটো শব্দ লক্ষ করা প্রয়োজন: বিশ্ববিদ্বেষী ও দেহবিদ্বেষী। বিশ্ব, যা তাদের সামাজিক সত্তার কাছে প্রকৃতির রূপে প্রতিভাত হত, তার প্রকাশ কতকগুলি প্রাকৃতিক বিপর্যয়, যার বিরুদ্ধে সাধারণ দরিদ্র মানুষ সম্পূর্ণ অসহায়: খরা, অজন্মা, প্লাবন, অকালবর্ষণ, অতিবৃষ্টি, বন্যা, ভূমিকম্প এ সবে সকলেরই ক্ষতি, কিন্তু গরিব মানুষ এ সবে সর্বস্বান্ত হয়। তাই বিশ্বপ্রকৃতি সম্বন্ধে সম্ভ্রম বিস্ময়ের চেয়ে এর থেকে সম্ভাব্য বিপদ ও আতঙ্কতেই মানুষ বিপর্যস্ত হয় বেশি। দ্বিতীয় শব্দটি, দেহবিদ্বেষী। প্রথমত, মানুষ মোটাদাগের দুঃখকষ্টগুলি দেহ দিয়েই অনুভব করে, তাই দেহ এদের কাছে দুঃখভোগের আধারমাত্র। (লক্ষণীয়, সংস্কৃতে দেহবাচক শব্দগুলির মধ্যেই একটা হতাশা অন্তর্নিহিত: দিহ্যতে, কষ্ট পায়; (দেহ) চীয়তে, চিতায় চয়ন করা হয়; (কায়) শীর্ষতে, শীর্ণ হয়; তা ছাড়া ব্রাহ্মণসাহিত্যের শেষ অংশ থেকে দেহাতিরিক্ত আত্মা সম্বন্ধে একটি ধারণা উদিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই গুরুত্বে দেহ গৌণ হয়ে যাচ্ছে, আত্মাই হয়ে উঠছে মুখ্য। অতএব এ সময়ে দেহবিদ্বেষ খুবই স্বাভাবিক। যারা তত্ত্ব প্রতিপাদন করেছিলেন, দেহ এবং দেহ দিয়ে ভোগ্য সমস্ত আরাম ও বিলাস তাঁদের আয়ত্তের মধ্যে। কাজেই আত্মার প্রাধান্য স্বীকার করলে তাঁদের কোনও ক্ষতি নেই, ভোগ্যবস্তু তাঁদের হাতছাড়া হবে না এবং জন্মান্তরে ওই সব ভোগ করার সম্ভাবনা থাকায় তাঁদের দেহবিদ্বেষ ঘোষণা করার কোনও দরকার ছিল না। কিন্তু তত্ত্বটা শুনছে যারা, তাদের তিক্ত অভিজ্ঞতা তাদের এমনই দেহবিমুখ করে রেখেছে। কাজেই আত্মা থাক বা না থাক, দেহ যে কষ্টভোগের আধার এ নিয়ে তাদের কোনও দ্বিমত নেই। আত্মার তত্ত্বটা মনন দিয়ে বুঝবার; তা এত সূক্ষ্ম যে সাধারণ মানুষ সহজে বোঝে না, বুঝলেও যে আত্মা কোনও আশু প্রয়োজন সিদ্ধ করে না, যন্ত্রণা লাঘব করে না, তা-ই যদি জীবের শ্রেষ্ঠ সত্তা হয়ও, তা হলে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার তাতে কোনও হেরফের হয় না। ক্ষুধাতৃষ্ণা, রোগব্যাধি, কশাঘাত ও নানা রকম অত্যাচার, যা গরিব মানুষের জীবনের নিত্যসঙ্গী একে তো আত্মা ভোগ করে না, করে দেহ, অতএব তেমন এক ক্লেশবোধবিনিমুক্ত আত্মা থাক বা না থাক তাতে এদের কিছু এসে যায় না।

এই পরিস্থিতিতে বিগত তিন-চারশো বছর ধরেই মানুষের জীবনবোধে বেশ-কিছু আমূল পরিবর্তন ঘটছিল, সাহিত্যে তার প্রতিফলন অবশ্যম্ভাবী এবং তা হয়েওছিল। ঋগ্বেদে, যেখানে, একশো বছর এই পৃথিবীতে সুখী হয়ে বাঁচবার এবং উদীয়মান সূর্যকে দীর্ঘকাল ধরে দেখবার জন্যে প্রার্থনা, ঐহিক সুখসমৃদ্ধি, স্বাস্থ্য, পশু, ধন, খাদ্য, শস্য ও দীর্ঘপরমায়ুর জন্যে শত শত প্রার্থনা, সেখানে স্পষ্টতই মানুষের দৃষ্টি ঐহিক, জীবনমুখী। সংহিতাব্রাহ্মণের কর্মকাণ্ডের শেষ দিকেই যখন মানুষের চেতনায় জন্মান্তরতত্ত্ব কায়েম হয়ে গেল, তখন স্বাভাবতই মানুষ জীবনের মূল্যায়ন করতে উদ্যত হল নতুন করে: পৃথিবীতে দীর্ঘকাল বাঁচাটা কাম্য কি না। প্রশ্ন উঠল, বিকল্প কী? প্রথমত, ঋগ্বেদেই মানুষের ইচ্ছাপূরক কল্পনা মৃত্যুর পর একটি মোটামুটি সুখকর অবস্থান যম ও পূর্বে মৃতদের সান্নিধ্যে সৃষ্টি করেছিল। সেটাতে এক ধরনের সান্ত্বনা ছিল, কারণ সেখানেও ঐহিক সুখভোগের অনুবৃত্তি থাকবে এমন আশ্বাস ছিল। কিন্তু তখনই দুটি সংশয় দেখা দিয়েছে: প্রথমত, ‘ইহলোক থেকে পরলোকে যাওয়া সহজ নয়— মনুষ্যল্লোকান্নাস্নাল্লোকাৎ স্বেতব্যমিত্যাহুঃ’; দ্বিতীয়ত, ‘কে তা জানে যে ওই লোকে (=পরলোকে কিছু আছে বা নেই— কো হি তদ্বেদ যদমুন্মিল্লোকেঽস্তি বা ন বেতি।’ (তৈত্তিরীয় আরণ্যক ৬:১:১:১) এ ছাড়াও পরলোক নিয়ে নানা সন্দেহ ছিল; এটা আমরা পরে দেখতে পাব।

কিন্তু এ সংশয়ের থেকে দুটি সিদ্ধান্ত হয়। প্রথমত, পরলোকের অস্তিত্ব এবং সেখানে গিয়ে সুখে থাকা সম্বন্ধে নিশ্চিন্ত হওয়া যায় না। দ্বিতীয়ত, তা হলে ইহলোকেই একমাত্র জীবন। অতএব এখানেই যথাসম্ভব জীবনকে ভোগ করা উচিত। কিন্তু মুশকিল হল, শতকরা নব্বইজন লোকের পক্ষে ইহলোকের এই জীবনটাও মোটেই সুখের বা ভোগের নয়। ভোগের বাসনা থাকলেও তার উপকরণগুলি একে একে সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছিল, কাজেই বাসনা ও তার পূরণের মধ্যে ব্যবধান যতই দুস্তর হতে লাগল, সাধারণ মানুষের অবস্থা ততই ত্রিশঙ্কুর মতো হয়ে উঠতে লাগল। ইহলোকে সুখ নেই, চাইলেও পাওয়া যাবে না; সুখকর পরলোকের অস্তিত্ব সম্বন্ধে কোনও নিশ্চয়তা নেই। এমন অবস্থায় শাস্ত্রকাররা তাঁদের মোক্ষম অস্ত্রটি নির্মাণ করলেন: জন্মান্তরবাদ। এই তত্ত্ব বলল, ইহলোকে অচরিতার্থ বাসনা অনেক রইল, স্বর্গে গিয়ে পাবে কি না তার কোনও নিশ্চয়তা নেই, বেশ তো পরজন্মে ওই সব অপূর্ণ বাসনা পূরণ কোরো। সাধারণ মানুষের কাছে এ সমাধানও কোনও যথার্থ সমাধান যে নয় সেটা সহজেই বোঝা যায়। প্রথমত, যে সংশয়ের বশে সুখের পরলোক সম্বন্ধে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ কোনও প্রমাণই মেলে না, সেই সংশয়ের বশে পরজন্ম সম্বন্ধেও কোনও যথার্থ প্রমাণ পাওয়া যায় না। দ্বিতীয়ত, যদি ধরেও নিই, মৃত্যুর পরে মানুষ আবার জন্মায়, তা হলেও সেটা তো এ জীবনেরই পুনরাবৃত্তি হবে, কে জানে যে সেখানে অচরিতার্থ বাসনাগুলির পূরণ হবে? আবার যে সেখানে এই রকম দারিদ্র্যদীর্ণ, রোগক্লিষ্ট, নিরাপত্তাহীন, অত্যাচারপীড়িত জীবনযাপন করতে হবে না সে বিষয়ে নিশ্চয়তা কী? সে-ক্ষেত্রে এক জীবনের যন্ত্রণাভোগ এই জীবনের সঙ্গেই শেষ হয়ে যাক, আর তার পুনরাবৃত্তিতে প্রয়োজন নেই।

মুশকিল হল, পুনর্জন্মতত্ত্ব যখন সমাজে প্রবর্তিত হল তখন সাধারণ মানুষ কী চায় না-চায় তা নিয়ে তো তত্ত্বের হেরফের ঘটানো চলে না। তা হলে, ব্যাপারটা দাঁড়াল এই রকম যে, মানুষ চাক বা না-চা’ক তাকে আবার জন্মাতে হবে। এ অবস্থায় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ চাইবে বারংবার এ যন্ত্রণাভোগের জীবনের পুনরাবর্তন নিবারণ করা, পুনর্জন্মের শৃঙ্খল ছিন্ন করা। ঋগ্বেদ থেকে মননের জগতে প্রকাণ্ড বিবর্তন ঘটেছে: ‘সুখিনঃ স্যাম শরদঃ শতম্— একশো শরৎ (= বর্ষ) সুখে থাকব’, থেকে ‘মৃত্যুর পর সুখের স্বর্গে যমের তত্ত্বাবধানে পূর্বপুরুষদের সঙ্গে সুখে বাস করা’ এবং ‘এ জীবনের অপূর্ণ বাসনা পরজন্মে পূর্ণ হওয়ার সম্ভাবনা’ পর্যন্ত। কিন্তু সাধারণ মানুষের সাধারণ বুদ্ধিই এর ফাঁকটা ধরে ফেলেছিল: পরজন্ম যে এ জন্মের চেয়ে সুখের হবে এমন দৃঢ় আশ্বাস কে দিতে পারে? অতএব উচ্চবর্ণের প্রতিষ্ঠাপন্ন ধনীর কাছে যা কাম্য অগণ্য দুঃখী মানুষের কাছে তা পরিহার্য মনে হবেই।

এই মানসিক আবহাওয়ার মধ্যে জ্ঞানকাণ্ডের উদ্ভব— আরণ্যক ও উপনিষদে। আরণ্যকে যজ্ঞকে রূপক ব্যাখ্যা দিয়ে সমর্থন করার চেষ্টা ও প্রবণতা আছে। যজ্ঞ শুধু যে ধনী, রাজন্য যজমানের ও ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের পক্ষে অপরিহার্য ছিল, তা নয়, সাধারণ মানুষও তো যজ্ঞ ছাড়া ইষ্টসিদ্ধির কোনও উপায় জানত না। বাস্তব জীবনে যেমন একটা উপায় ব্যর্থ হলে মানুষ ইষ্টসিদ্ধির জন্যে অন্য একটা বিকল্প উদ্ভাবন করে, সে যুগে ঠিক তেমনই যজ্ঞের বিকল্প ও প্রকারভেদ। দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, ‘প্রাচীন গোষ্ঠীগত সমাজবিধান ধ্বংস হওয়ার পরে তার থেকে উৎপন্ন একটি নতুন সামাজিক বিধানকে ব্রাহ্মণসাহিত্যের শাস্ত্রকাররা যজ্ঞের এই সব খুঁটিনাটি দিয়ে সমর্থন করবার চেষ্টা করেছিলেন।[৬] এতে যজ্ঞ সমর্থিত হলেও তা মানুষের ইষ্টসিদ্ধির অভ্রান্ত উপায় বলে গৃহীত হল না। মহাবীর ও গৌতমবুদ্ধের সমকালীন ধর্মগোষ্ঠীগুলির সঙ্গে দু-তিন শতক পর থেকেই যুক্ত হচ্ছিল মাধ্যমিক, যোগাচার, সৌত্রান্তিক, বৈভাষিক মতের বৌদ্ধ প্রস্থান, দিগম্বর জৈনরা, বার্হস্পত্য এবং চার্বাক ও তাঁর অনুগামী অন্যান্য লোকায়তিক প্রস্থান। এরা বলত, ‘নাস্তি যজ্ঞফলং নাস্তি পরলোকঃ— যজ্ঞে ফল হয় না, পরলোক নেই।’ সাধারণ ভাবে এদের বলা হত পাষণ্ড, ঈশ্বরনাস্তিত্ববাদী বা বেদাপ্রামাণ্যবাদী অর্থাৎ ঈশ্বরের অস্তিত্ব এবং বেদের প্রামাণ্যতায় অবিশ্বাসী। এদের সন্দেহ বৈদিক যজ্ঞের উপযোগিতায় ও পরলোকে। যে-বেদ বিভিন্ন সংকট থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যে নানা যজ্ঞের বিধান দিয়েছে, মানুষ যখন বিধিপূর্বক যজ্ঞ অনুষ্ঠান করে সে সংকট থেকে ত্রাণ পায়নি তখন সে শুধু যজ্ঞেই বিশ্বাস হারায়নি, যে-বেদ যজ্ঞের নির্দেশ দিয়েছে সেই বেদেই বিশ্বাস হারিয়েছে। আর বিশ্বাস হারিয়েছে পরলোকে। জন্মান্তরে বিশ্বাস করতে বলছে শাস্ত্রকাররা, কিন্তু যে-বিশ্বাসের সঙ্গে বর্তমানের চেয়ে সুখের কোনও ভবিষ্যৎকে বিশ্বাস করা যাচ্ছে না, জনসাধারণের ওপরে শাস্ত্রকারদের চাপিয়ে দেওয়া সে বিশ্বাসে মানুষ কোনও সান্ত্বনা বা মানসিক আশ্রয় খুঁজে পাচ্ছে না। বিশ্বাস করলে পরজন্মে এই দুঃখময় জীবনের অনুবর্তন— সে একটা ত্রাস, একটা আতঙ্ক।

***

১. ইন্দ্রো যতীন্ সালাবৃকেভ্যো অদাৎ। তৈত্তিরীয় সং (৬:২:৭); তৈত্তিরীয় ব্রাহ্মণ; (৭:২৬); তাণ্ড্যমহাব্রাহ্মণ (৮:১:৪)

২. ‘When urban society is differentiated to include also a priestly class which dogmatizes the concepts the result is the theological phase.’— Mogens Bronsted, ‘The Transformations of the concept gate in literature’. p. 173

৩. ‘It reflects a cleavage between man’s consciousness of nature, which springs … from a corresponding cleavage in society. ‘ – George Thomson, Vol II, p. 133

৪. ‘Isolation and alienation from a society’s primordial and constitutional structures prevent one from having experiences from which beliefs in the supernatural can arise or gain support. To assume that humans can know and control all, or the most important aspects of such structures, is to destroy, in principle, many of the features which give certain social organisations a supernatural aura— their properties of invisibility, immortality, pervasiveness, unknownness, inescapability, and their control over conduct thorugh what seems to be the direct indirection of purpose.’ – Guy & Swanson, p. 188 )।

৫. ‘…a gradual passing from an initial naturistic-harmonistic attitude where the human soul is not yet violently, opposed to the world, to a final anti-cosmic and anti-somatic and as such dualistic and pessimistic which is peculiar to gnosis.’— Corranda Pensa, The Field of Indian Religions, p. 107

৬. ‘Ritual trivialities) in terms of these the authors of the Brahmans also try to validate a new social norm that emerges on the runs of the ancient tribal one.’ – DP Chatterjee, p. 112

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *