০৫. শুক্লযজুর্বেদ – পঞ্চম অধ্যায়

পঞ্চম অধ্যায়

মন্ত্রঃ– অগ্নেস্তরসি বিষ্ণবে ত্বা সোমস্য তনুরসি বিষ্ণবে ত্বা হতিথেরাতিথ্যমসি, বিষ্ণবে বা শ্যেনায় ত্বা সোমভৃতে বিষ্ণুবে ত্বাহগুয়ে ত্বা রায়ম্পোষদে বিষ্ণবে জ্বা৷৷৷৷ অগ্নের্জনিমসি বৃষণৌ স্থ উর্বশ্যায়ুরসি পুরূরবা অসি। গায়ত্ৰেণ ত্বা ছদসা মন্থমি ত্রৈষ্টুভেন ত্বা ছন্দসা মন্থমি জাগতেন ত্বা ছন্দ মন্থমি৷৷২৷৷ভবতংনঃ সমনসৌ সচেতসাবরেপসৌ। মা যজ্ঞং হিংসিষ্টং মা যজ্ঞপতিং জাতবেদসৌ শিবৌ ভবতমদ্য নঃ ৷৩৷৷ অগ্নাবগ্নিশ্চরতি প্রবিষ্ট ঋষীণাং পুত্রো অভিশস্তিপাবা। সনঃ স্যোনঃ সুজা যজেহ দেবেভ্যা হব্যং সদমপ্রযুচ্ছ স্বাহা।।৪। আপতয়ে ত্বা পরিপতয়ে গৃহূমি তন্নত্ত্বে শারায় শকুন ওজিষ্ঠায়। অনাধৃষ্টমসনাধৃষ্যং দেবানামোজোইনভিশস্ত্য ভিশস্তিপা অনভিশস্তেন্যমঞ্জসা সত্যমুপগেষং স্বিতে মা ধাঃ৷৷৷৷ অগ্নে ব্রতপাস্ত্রে ব্রতপা যা তব তনূরিয়ং সাময়ি যো মম তনূরেষা সা ত্বয়ি। সহ নৌ ব্রতপতেব্রতান্যনু মেদীক্ষাংদীক্ষাপতির্মন্যতামনু তপস্তপস্পতিঃ৷৬৷৷ অংশুরংশুষ্টে দেব সোমাপ্যায়মিন্দ্রায়ৈকধনবিদে। আ তুভ্যমিঃ প্যায় তামা ত্বমিন্দ্রায় প্যায়স্ব। আপ্যায়য়াম্মা সখী সন্যা মেধয়া স্বস্তি তে দেব সোম সুত্যামশীয়। এষ্টা রায়ঃ প্রেষে ভগীয় ঋতমৃতবাদিভ্যো নমো দ্যাব্যপৃথিবীভ্যাম্৷৷৷৷ যা তে অগ্নেহয়ঃশয়া তদূর্বর্ষিা গহ্বরেষ্ঠা। উগ্রং। বচো অপাধীত্ত্বেষং বচো অপাবধীৎ স্বাহা। যা তে অগ্নে রজঃশয়া তদূর্বর্ষিষ্ঠা গহ্বরেষ্ঠা। উগ্রং বচো অপাধীত্ত্বেষং বচো অপাধীস্বাহা। যা, তে অগ্নে হরিশয়া তদূর্বর্ষিা গহ্বরেষ্ঠা। উগ্রং বচো অপাধীত্ত্বেষং বচো । অপাবধীৎ স্বাহা।।৮৷৷ তপ্তায়নী মেহসি বিত্তায়নী মেহস্যবতা নাথি তাদবতাত্মা ব্যথিত্যৎ। বিদেদগ্নির্নভো নামাইগ্নে অঙ্গির আয়ুনা নামেহি যোহস্যাং পৃথিব্যামসি যত্তেহনাধৃষ্টং নাম যজ্ঞিয়ং তেন জ্বা দুধে বিদেদগ্নির্নভোনামাগ্নে অঙ্গির আয়ুনা নামেহি যো দ্বিতীয়স্যাং পৃথিব্যামসি যত্তেহনধৃষ্টং নাম যজ্ঞিয়ং তেন ত্বা দধে বিদেদগ্নিভো নামাইগ্নে অঙ্গির আয়ুনা নাশ্নেহি যস্তৃতীয়স্যাং পৃথিব্যামসি যত্তেহনাধৃষ্টং নাম যজ্ঞিয়ং তেন ত্ব দধে। অনু ত্বা দেববীতয়ে।৯৷৷ সিংহসি সপত্নসাহী দেবেভ্যঃ কল্পস্ব সিংহ্যসি সপত্নসাহী দেবেভ্যঃ শুন্ধস্ব সিংহ্যসি সপত্নসাহী দেবেভ্যঃ শুম্ভ৷৷১০৷৷ ইন্দ্রঘোষস্থা বসুভিঃ পুরস্তাৎ পাতু। প্রচেষ্যা রূদ্রৈঃ পশ্চাৎ পাতু। মনোজা পিতৃভিদক্ষিণতঃ পাতু। বিশ্বকর্মা ত্বাহহদিত্যেরুত্তরতঃ পাত্বিদমহং তপ্তং বাহির্ধা যজ্ঞানিঃ সৃজামি।।১১৷৷ সিংহ্যসি স্বাহা সিংহ্যস্যাদিত্যবনিঃ স্বাহা সিংহ্যসি ব্রহ্মবনিঃ স্বাহা সিংহসি সুপ্রজাবনী রায়ম্পোষবনিঃ স্বাহা। সিংহ্যস্যা বহ দেবান যজমানায় স্বাহা ভূতেভ্যস্থা৷১২। ধ্ৰুবোহসি পৃথিবীং দৃংহ ধ্রুবক্ষিদস্যন্তরিক্ষং দৃংহাতক্ষিদসি দিবং দৃংগ্নেঃ পুরীষমসি৷৷১৩৷৷ যজুতে মন উত যুঞ্জতে ধিয়ো বিপ্রা বিপ্রস্যবৃহততা বিপশ্চিতঃ। বি হোত্রা দধে বয়ুনাবিদেক ইন্মহী দেবস্য সবিতুঃ পরিস্তুতিঃ স্বাহা।১৪৷৷ ইদং বিষ্ণুর্বিচক্ৰমে ত্রেধা নি দধে পদসমূঢ়মস্য পাংসুরে স্বাহা।১৫৷ইরাবতী ধেনুমতী হিভূতং সূয়বসিনী মানবে দশস্যা। ব্যাস্কভু রোদসী বিষ্ণবে তে দাধর্থ পৃথিবীমভিতো ময়ুখৈঃ স্বাহা।।১৬৷৷ দেবশ্রুতৌ দেবো ঘোষতং প্রাচী প্রেতমধ্বরং কল্পয়ন্তী উং যজ্ঞং নয়তং মা জিহরতম। স্বং গোষ্ঠমা বদতং দেবী দুর্ষে আয়ুৰ্মা নির্বাদিষ্টং প্রজাং মা নির্বাদিষ্টম রমেথাং বৰ্মন পৃথিব্যা৷১৭৷৷ বিষ্ণোর্কং বীর্যাণি প্ৰ বোচং যঃ পার্থিবানি বিমমে রজাংসি যো অস্কভায়দুত্তরং সধস্থং বিচক্ৰমাণস্ত্রেধোরুগায়ো বিষ্ণবে ত্বা।।১৮। দিবো বা বিষ্ণ উত বা পৃথিব্যা মহো বা বিষ্ণু উয়োরন্তরিক্ষাৎ। উভা হি হস্তা বসুনা পৃণস্বা প্রযচ্ছ দক্ষিণাদোত সব্যাদ্বিষ্ণবে ত্বা।১৯৷৷ প্রতদ্বিষ্ণুঃ স্তবতে বীর্ষেণ মৃগোন ভীমঃ কুচরো গিরিষ্ঠাঃ। যশস্যারূষু ত্ৰিষু বিক্রমণেবধি ক্ষিয়ন্তি ভুবনানি বিশ্বা।।২০ বিষ্ণো বরাটমসি বিষ্ণোঃ শস্ত্রে স্থা বিষ্ণোঃ স্যুরসি বিষ্ণোন্ধ্রবোহসি। বৈষ্ণবমসি বিষ্ণবে ত্ব৷৷২১৷ দেবস্য ত্ব সবিতুঃ প্রসবেংশ্বিনোর্বাহুভ্যাং পূষ্ণো হস্তাভ্যাম্ আদদে। নার্যসীদমহং রক্ষাং গ্রীবা অপিকৃন্তামি। বৃহন্নসি বৃহদ্রবা বৃহতীমিন্দ্রায় বাচংবদ৷৷২২৷৷ রক্ষোহণং বলগহনং বৈষ্ণবীমিদমহং, তং বলগমুৎকিরামি। যৎ মেনিষ্ট্যো ««- = যজুর্বেদ-সংহিতা-৭ স্ত্র যমমাত্যো নিচখানেদমহং তং বলগমুৎকিরামি। যংমে সমানো যমসমাননা নিচখানেদমহং তং বলগমুৎকিরামি। যং মে সবন্ধুর্যমসবন্ধুর্নিচখানেদমহং তং বলগমুৎকিরামি। যং মে সজাতো যমসজাতো নিচখানোকৃত্যাং কিরামি৷৷২৩৷৷স্বরাডসি সপত্নহা সত্ৰরাডস্যভিমাতিহা জনরাডসি রক্ষোহী সর্বরাডস্যমিত্ৰহা৷৷২৪৷৷ রক্ষোহণো বো বলগহণঃ গোঙ্গামি বৈষ্ণবা। রক্ষোহণণা বো বলগহনোইবনয়ামি বৈষ্ণবান্। রক্ষোহণণা বো বলগহনোহবস্তুণামি বৈষ্ণবান্। রক্ষোহণে বাং বলগহনা উপদধামি বৈষ্ণবী। রহণেী বাং বলগহণেী পর্যহামি বৈষ্ণবী। বৈষ্ণবমসি বৈষ্ণবা। স্থ৷৷২৫৷৷ দেবস্য ত্বা সবিতুঃ প্রসবেংশ্বিনোর্বাহুভ্যাং পূষ্ণো হস্তাভ্যাম্। আ দদে নার্যসীদমহং রক্ষস্যাং গ্রীবা অপি কৃন্তামি। যবোহসিযবয়াস্মযো যয়ারাতী দিবে ত্বাহন্তরিক্ষায় জ্বা পৃথিব্যৈ ত্বা শুদ্ধতাঁশ্লোকঃ পিতৃসদনাঃ পিতৃষদনমসি৷৷২৬৷ উদ্দিবং শুভানান্তরিক্ষং পৃণ দৃংহ পৃথিব্যাং দ্যুতানা মারুত মিনোতু মিত্রাবরুণৌ বেণ ধর্মণ। ব্রহ্মবণি ত্বাক্ষত্রবণি রায়ম্পোষবনি পযূহামি। ব্রহ্ম দৃংহ ক্ষত্রং দৃংহাযুদৃংহ প্রজাং দৃংহ৷৷২৭৷৷ ধ্রুবাসি ধ্ৰুবোইয়ং যজমানোহস্মিন্নায়তনে প্রজয়া পশুভিয়াৎ। ঘূতেন দ্যাবাপৃথিবী পূর্যেথমিন্দ্রস্য ছদিরসি বিশ্বজনস্য ছায়া৷৷২৮৷৷ পরি ত্ব। গির্বণণা গির ইমা ভবন্তু বিশ্বতঃ। বৃদ্ধায়ুমনু বৃদ্ধয়ো জুষ্টা ভবন্তু জুষ্টয়ঃ ॥২৯৷ ইন্দ্রস্য সুরসীন্দ্রস্য ধ্ৰুবোহসি। ঐন্দ্রমসি বৈশ্বদেব মসি৷৷৩০৷৷ বিভূরসি প্রবাহণণা বহিরসি হব্যাবাহনঃ। শ্বালাইসি প্রচেস্তুথোহসি বিশ্বেবেদাঃ৷৷৩১৷ উশিগসি কবিরজারিরসি বম্ভারি রবসূরসি দুবস্বাক্রসি মার্জালীয়ঃ সম্রাড়সি কৃশানুঃ পরিষদ্যোহসি পবমাননা নভোহসি প্রতকৃা মৃষ্টোহসি হব্যসূদন ঋতধামাইসি স্বর্জোতিঃ৷৷৩২৷৷ সমুদ্ৰোহসি বিশ্বব্যচা অজোহস্যেকপাদহিরসি বুস্ন্যো বাগস্যৈন্দ্রমসি সদোহস্তস্য দ্বারৌ মা মা সন্তাপ্তমধ্বনামধ্বপতে প্র মা তির স্বস্তি মেহস্মিন্ পথি দেবযানে ভূয়াৎ৷৷৩৩৷৷ মিত্রস্য মা চক্ষুষেধ্বমগ্নয়ঃ সগরাঃ সগরা স্থ সগরেণ নান্না রৌদ্রেণানীকেন পাত মাহগ্নয়ঃ পিপৃত মাহগ্নয়ো গোপায়ত মা নমো বোহস্তু মা মা হিংসিষ্ট৷৷৩৪৷৷ জ্যোতিরসি বিশ্বরূপং বিশ্বেষাং দেবানাং সমিৎ। ত্বং সোম তনুকৃষ্ঠ্যো দ্বেষোভ্যান্যকৃতেভ্য উরূ যন্তাসি বরূথং স্বাহা। জুষাণো অপ্রাজ্যস্য বেতু স্বাহা।।৩৫৷৷ অগ্নে নয় সুপথা রায়ে অস্মাম্বিশ্বানি দেব বয়ুনানি বিদ্বান। যুষোধ্যম্মজ্জহুরাণমেনো ভূমিষ্ঠাং তে নম উক্তিং বিধেম।।৩৬। অয়ং নো অগ্নিবরিবস্কৃণোত্বয়ংমুধঃ পুর এতু প্রভিন্দ। অয়ং। বাজাঞ্জয়তু বাজসাতাবয়ংশক্রঞ্জয়তু জহঁষাণঃ স্বাহা।।৩৭। উরু বিষ্ণো বি, ক্ৰমম্বোরু ক্ষয়ায় নস্কৃধি। ঘৃতং ঘৃতযোনে পিব প্র যজ্ঞপতিং তির স্বাহা।।৩৮৷৷ দেব সবিতরেষ তে সোমস্তং রক্ষস্ব মা ত্বা দভ। এতত্ত্বং দেব সোম দেবো দেবাঁ উপাগা ইদমহং মনুষ্যান্ সহ রায়পোষেণ স্বাহা নির্বরূণস্য পাশাচ্যে ।৩৯৷ অগ্নে ব্রতপাত্তে ব্রতপা যা তব তন্মৰ্য্যভূদেষা সা ত্বয়ি যো মম তনুষ্যভূদিয়ং সাময়ি। যথাযথং নৌ ব্রতপতে ব্ৰতান্য মে দীক্ষা দীক্ষাপতিরমংস্তানু তপস্তপম্পতিঃ৷৪০৷৷ উরু বিষ্ণো বি ক্ৰম ক্ষয়ায় নস্কৃধি। ঘৃতং ঘৃতযোনে পিব প্র যজ্ঞপতিং তির স্বাহা৷৪১। অত্যন্য অগাং নান্য উপাগামর্বাক ত্বা পরেডভ্যাহবিদং পরোহবরেভ্যঃ। তং ত্বা জুমহে দেব বনম্পতে দেবযজ্যায়ৈ দেবেত্ত্বা দেবযজ্যায়ৈ জুষস্তাং বিষ্ণবে ত্বা। ওষধে ব্রায় স্বধিতে মৈনং হিংসীঃ৷৷৪২৷৷ দ্যাং মা লেখীরন্তরিক্ষং মা হিংসীঃ পৃথিব্যা সম্ভব। অয়ং হি ত্বা স্বধিতিস্তেতিজানঃ প্রণিনায় মহতে সৌভগায়। অত্যুৎ দেব বনস্পতে শতবশো বিরোহ সহস্ৰশা বি বয়ং রূহেম৷৪৩

[কণ্ডিকা-৪৩, মন্ত্র–১৫০]

.

মন্ত্ৰার্থঃ– ১। হে আমার হৃদয়াধিষ্ঠিত শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি প্রজানরূপী ভগবানের শরীররূপ (অঙ্গীভূত অথবা তার বিভূতিরূপ বা ধারক) হও; অতএব, বিশ্বব্যাপক ভগবানের প্রীতির জন্য তোমাকে নিয়োজিত করছি। (ভাব এই যে, শুদ্ধসত্ত্ব ভগবানের স্বরূপ; শুদ্ধসত্ত্বের সাহায্যেই ভগবানকে পাওয়া যায়)। [অগ্নেঃ– প্রজ্ঞানরূপস্য ভগবতঃ, বিষ্ণবে–বিশ্বব্যাপকায়, ভগবৎপ্রীতয়ে।(১)। হে আমার হৃদয়াধিষ্ঠিত শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি ভগবানের শরীররূপ বা অঙ্গীভূত (অথবা তার বিভূতিরূপ বা প্রকাশক) হও। অতএব, বিশ্বব্যাপী ভগবানের প্রীতির জন্য অথবা তাকে লাভ করবার জন্য তোমাকে উৎসর্গ করছি। (সত্যের দ্বারা সৎস্বরূপ ভগবানকে পাওয়া যায়। অতএব শুদ্ধসত্ত্বের এবং সভাব ইত্যাদির দ্বারা যাতে ভগবানের সন্নিকর্ষ লাভ করতে পারা যায়, তা করব)। [সোমস্য–সস্বরূপস্য ভগবতঃ]।(২)। হে আমার হৃদয়াধিষ্ঠিত শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি অতিথিরূপে জগৎপ্রীতিকর (অথবা অতিথিরূপে সকলের পূজ্য) ভগবানের প্রীণনসাধনভূত উপকরণ বা তুষ্টিসম্পাদক হও। অতএব, বিশ্বব্যাপনশীল ভগবানের প্রীতির জন্য তোমাকে উদ্বুদ্ধ বা নিয়োজিত করছি। (ভাব এই যে,ভগবান্ অতিথিরূপে জগতের আরাধনীয়। তার আরাধনার প্রধান উপকরণ সম্ভব ও শুদ্ধসত্ত্ব। তাই সঙ্কল্প–ভগবানের প্রীতির জন্য হৃদয়ের শুদ্ধসত্ত্বভাবকে নিয়োজিত করি)। [অতিথে–অতিথিরূপেন জগৎপ্রীতিকরস্য ভগবতঃ, যদ্বা– সর্বেষাং পূজাৰ্হস্য ভগবতঃ; আতিথ্যং-প্রীণনসাধনমূপকরণং তুষ্টি সম্পাদকং বা] (৩)। হে আমার হৃদয়াধিষ্ঠিত শুদ্ধসত্ত্ব! সোম-আনয়নকর্তা অথবা হৃদয়ে সৎ-ভাবজনয়িতা, ভক্তিমান্ অৰ্চনাকারিদের প্রতি শ্যেনের মতো ক্ষিপ্রগমনকারী, ভগবানের প্রীতির জন্য অথবা সৎকর্ম সাধনের জন্য, তোমাকে আহরণ করছি; এবং বিশ্বব্যাপক ভগবানের উদ্দেশ্যে অথবা তাকে লাভ করবার জন্য তোমাকে হৃদয়ে প্রতিষ্ঠাপিত করছি। (সৎকর্মের এবং সম্ভবের দ্বারা পরিতুষ্ট হয়ে ভগবান্ ত্বরায় ভক্তের উদ্ধারসাধন করেন। অতএব সঙ্কল্প–সত্তাবের উন্মেষে সকর্মের সাধনে হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্ব আহরণ করে মোক্ষলাভের জন্য তাকে নিয়োজিত করব)। [সোমভৃতে–সোমানয়নকত্রে, হৃদি সদ্ভাবজনয়িত্রে]।(৪) হে আমার হৃদয়-নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! পরমার্থরূপ ধনসমূহের পুষ্টিদানকারী জ্ঞান জ্যোতিঃ লাভের জন্য তোমাকে উদ্বুদ্ধ করছি। অপিচ, বিশ্বব্যাপী ভগবানের উদ্দেশ্যে তাঁর প্রীতির জন্য তোমাকে সমর্পণ করি।(ভাব এই যে, জ্ঞানই পরমার্থপ্রদ। শুদ্ধসত্ত্বের সাহায্যে জ্ঞানকিরণ আহরণ করে ভগবৎপ্রাপ্তির জন্য তাকে নিয়োজিত করি)। [রায়ষ্পেষদে–পরমার্থরূপধনানাং পুষ্টিদায়িনে; অগ্নয়ে–জ্ঞানজ্যোতিঃ লাভায়]।(৫)।

২। হে আমার হৃদয়-নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি জ্ঞানময় ভগবানের প্রজননের হেতুভুত বা প্রাপ্তির কারণ হও। (ভাব এই যে, শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা জ্ঞানের উৎপত্তি ঘটে এবং জ্ঞানের সাহায্যে ভগবানকে প্রাপ্ত হওয়া ১ যায়)। [অগ্নেঃ–প্রজ্ঞানময়স্য ভগবতঃ] (১)। হে শুদ্ধসত্ত্বাঙ্গীভূত জ্ঞানকর্ম! তোমরা অভীষ্টবর্ষক সর্বাভীষ্টপূরক অথবা মোক্ষপ্রদায়ক হও। (ভাব এই যে, সৎ-জ্ঞান ও সৎকর্মের দ্বারা মানুষ অভীষ্ট লাভে সমর্থ হয়)। [বৃষণৌ–সেক্তারৌ, অভীষ্টবর্ষকৌ সর্বাভীষ্টপূরকৌ বা, মোক্ষপ্রদায়কৌ ইত্যর্থঃ] (২)। হে শুদ্ধসত্ত্বাঙ্গীভূতে ভক্তিরূপিণী দেবি। তুমি মহতের বশকারী অথবা মহাদীপ্তিবিশিষ্টা ষড়ৈশ্বর্যশালিনী হও। (ভাব এই যে, বিশুদ্ধা (অনন্যা) ভক্তির দ্বারা মহান্ ঐশ্বর্যশালী ভগবানও বশীভূত হন, অপিচ, ভক্তির দ্বারাই তিনি ভক্তের সাথে সম্মিলিত হয়ে তার উদ্ধার-সাধন করেন)। [উর্বশী–মহান্তং বশয়িত্রী, মহাদীপ্তিবিশিষ্টা, যদ্বাষড়ৈশ্বর্যশালিনী] (৩)। হে আমার হৃদয়াধিপতি শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি আয়ুঃ-দাতা অথবা অকালমৃত্যুর নিবারক হও। (ভাব এই যে, সৎ-ভাবের প্রভাবে মানুষ পূর্ণ-আয়ুষ্কাল পর্যন্ত জীবিত থাকে। প্রার্থনা, আমাকে পূর্ণ-আয়ুষ্কাল বা চিরজীবন প্রদান করুন)। [আয়ু–আয়ুষো দাতা, অকালমৃত্যুনিবারয়িতা] (৪)। হে শুদ্ধসত্ত্বরূপী দেব! তুমি বহুপ্রদাতা বা বহুফলদাতৃত্বহেতু অভীষ্ট-পূর্বক হও। (প্রার্থনা, আমাকে অভীষ্ট মোক্ষফল প্রদান করো)। [পুরূরবা বহুপ্ৰদাতা, বহুবিধফলপ্রদাতৃত্বাৎ অভীষ্টপূরকঃ ইত্যর্থঃ]।(৫)। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! গায়ত্রীছন্দোবদ্ধ ব্ৰহ্মমন্ত্রের বা স্তুতির দ্বারা তোমাকে হৃদয়ে উদ্দীপিত করি। [মন্থমি-জনয়ামি, হৃদি সন্দীপয়ামীতি ভাবঃ] (৬)। ত্রিষ্ঠুভছন্দোবদ্ধ ব্ৰহ্মমন্ত্রের তা স্তুতির দ্বারা তোমাকে হৃদয়ে উৎপন্ন। করি।(৭)। জগতীচ্ছন্দোবিশিষ্ট ব্রহ্মমন্ত্রের উচ্চারণ বা স্তুতির দ্বারা তোমাকে উৎপন্ন করি। (ভাব এই যে, নিখিল সৎ-ভাবমূলক সৎকর্মগুলির দ্বারা অজ্ঞানতা দূর করে প্রজ্ঞানতা লাভ করব, অপিচ শুদ্ধসত্ত্ব দেবভাব সঞ্চয় করব)। [এই কণ্ডিকার প্রথম, পঞ্চম, ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম মন্ত্র শুদ্ধসত্ত্বের সম্বোধনে, দ্বিতীয় মন্ত্র শুদ্ধসত্ত্বাঙ্গীভূত জ্ঞান-কর্মের এবং তৃতীয় মন্ত্র শুদ্ধসত্ত্বাঙ্গীভূতা ভক্তির বা ভক্তিরূপিণী দেবীর সম্বোধনের বিনিযুক্ত।–এই কণ্ডিকার মন্ত্রগুলির ভাষ্যপাঠে অনেকে এগুলিকে অশ্লীলতাপূর্ণ বলে মনে করতে পারেন। কিন্তু একটু অভিনিবেশ-সহকারে দেখলে, মনে আপনা-আপনিই প্রশ্ন ওঠে,–নিত্য-সত্য বেদ-মন্ত্র সত্যই কি অশ্লীলতাময়? উত্তর আপনিই আসে–তা কখনই হতে পারে না।–ভাষ্যকারের মতে, প্রথম মন্ত্রটি শকল নামক দেবতার সম্বোধনে বিনিযুক্ত। দ্বিতীয়, তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম মন্ত্রে অরণির সম্বোধন আছে। ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম–এই তিনটি মন্ত্র অরণিদ্বয়-ঘর্ষণে প্রযুক্ত হয়েছে। আমরা তা মনে করি না, এবং আমাদের মত উপরে বর্ণিত হয়েছে। মন্ত্রের অন্তর্গত বৃষণৌ, উর্বশ্রী, পুরূরবা ও আয়ু প্রভৃতি পদ চারটির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণেই যত কিছু গণ্ডগোলের এবং অশ্লীলতার সৃষ্টি হয়েছে। — বৃষণ অর্থে সাধারণতঃ সেচক বোঝায়। তাতে ভাষ্যমতে, মন্ত্রের অর্থ হয়,সন্তান উৎপাদনে মুম্বুদ্বয় যেমন বীর্যসেচক হয়, তেমনি হে দৰ্ভৰ্দয়, অরণিদ্বয়-মন্থনে অগ্নি উৎপাদনে তোমরাও মুম্বুবৎ হও।– কিন্তু আমরা মনে করি, বর্ষাণার্থক বৃষ ধাতু থেকে বৃষণ পদের উৎপত্তি। আর তা থেকেই বৃষণ পদের অর্থ করি,–অভীষ্টবষ্টকৌ, সর্বাভীষ্টপূরকৌ বা মোক্ষপ্রদায়কৌ। এখানে আমাদের সম্বোধ্য জ্ঞান ও কর্ম। তৃতীয়, চতুর্থ ও পঞ্চম মন্ত্রে প্রকারান্তরে উর্বশী-পুরূরবার পৌরাণিক উপাখ্যানের সম্বন্ধ টেনে আনা হয়েছে। কিন্তু একটু অভিনিবেশ সহকারে বিচার করে দেখলে, মন্ত্রের সাথে কোনই পৌরাণিক উপাখ্যানের সম্বন্ধ সূচিত হয় না। যে শব্দ তিনটিকে অবলম্বন করে ঐ উপাখ্যানের বিষয় প্রখ্যাপিত হয়ে থাকে, সে দৃষ্টিতে সে অর্থও সম্পূর্ণ উল্টিয়ে যায়, আর তাতে মন্ত্রে এক অভিনব ভাবের সূচনা হয়। যেমন,–উর্বশী শব্দ–উরু+বশ+অ(অ) এইরকম নিষ্পন্ন হয়। উরু শব্দে মহৎ, এবং বশ অর্থে বশীভূত করাঅর্থ বুঝিয়ে থাকে। তাতে উর্বশী পদের অর্থ হয়,–মহৎকে যিনি বশীভূত করতে সমর্থ। উরু–মহৎ শব্দে ভগবানকে বোঝায়।–পুরূরবাঃপদে, আমাদের মতে, নৃপবিশেষকে বোঝায় না। আমাদের মতে, ঐ পদের অর্থ–বহুপ্রদাতা, যদ্বা বহুবিধফলপ্ৰদাতৃত্বাৎ অভীষ্টপূরক। আমরা মনে করি, পুরূরাবা বা পূরূরাবন্শব্দ থেকে পুরুররা পদ নিষ্পন্ন। তা থেকেই বহুফলপ্রদাতা এবং তা থেকেই অভীষ্টপূরক অর্থ অধ্যাহৃত হয়ে থাকে। শুদ্ধসত্ত্ব যে অভীষ্টপূরক-ভগবৎ-প্রাপ্তির মূলীভূত, সে বিষয় আর বেশী আলোচনার অপেক্ষা রাখে কি?–তৃতীয় মন্ত্রের আয়ুঃ পদের লক্ষ্যও পুরূরবার ঔরসে স্বর্বেশ্যা উর্বশীর গর্ভজাত পুত্র আয়ুকে নয়। তাতে পূর্ণায়ুষ্কাল বিধাতা–মৃত্যুভয়নিবারণকারী হৃদয়াধিষ্ঠিত শুদ্ধসত্ত্বকেই বোঝাচ্ছে। জীবের সংহারে অবস্থিতির বা জীবিত কালের একটা সময় নির্দিষ্ট আছে; কিন্তু মৃত্যুর সময় নির্দিষ্ট নেই। বিষয়টি একটু প্রহেলিকাময়। নির্দিষ্ট কাল পূর্ণ না হলে যদি জীব দেহত্যাগ না করে, তাহলে মৃত্যুরও নির্দিষ্ট সময় না থাকবে কেন? তার কারণ এই যে, জীব যদিও নির্দিষ্ট আয়ুষ্কাল নিয়ে সংসারে উপস্থিত হয়, কিন্তু কৃতকর্মের দ্বারা-পাপে বা পুণ্যানুষ্ঠানে স্বল্পায়ুঃ বা দীর্ঘায়ু হয়ে থাকে। বয়স বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে নিজের অভীষ্টসিদ্ধির জন্য জীব যখন ইতস্ততঃ ধাবমান হয়, তখন মায়া বা অবিদ্যার সহচর পাপ এসে তার মোহ উৎপাদনে প্রয়াস পায়। যদি পূর্বসুকৃতি বলে বা সভাবের প্রভাবে হৃদয়স্থিত দেবভাব শুদ্ধসত্ত্বের অনুকম্পায় সে, সেই প্রলোভনে বশীভূত না হয়, তবেই তার কল্যাণ সাধিত হয়; নচেৎ সে পাপের অতল তলে ডুবে মরে। সৎকর্মে সৎ-ভাবে মানুষ দীর্ঘজীবন লাভ করে বা নির্দিষ্ট আয়ুষ্কাল তো বটেই, এমন কি তা-ও অতিক্রম করে জীবিত থাকতে পারে।পাপ কার্যে আয়ুক্ষয় হয়–অকাল মৃত্যু ঘটে। সৎকর্মের দ্বারা সৎ-ভাব-সঞ্চয়ে সংসারে প্রধাবিত হলে, পাপ মানুষকে স্পর্শ করতে পারে না; জ্ঞানবহ্নিতে বিদগ্ধ হয়ে পাপ নির্মূল হয় হৃদয় জ্ঞানের অরুণ আলোকে উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে। জীবের কর্ম-ফলভোগ অবশ্যম্ভাবী; সুতরাং সৎকর্মে সুফল-লাভ এবং কুকর্মে দণ্ডভোগ–অনিবার্য। কুকর্মকারীর জীবন-মৃত্যু দুটিই সমান। মন্ত্রের তাই ভাব এই যে, শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে সঙ্কর্মের অনুষ্ঠানে যেন অকালমৃত্যু নিবারণ করে পূর্ণায়ুষ্কাল ভোগ করতে পারি, আমরা যেন চিরজীবন বা ভগবৎসামীপ্য লাভ করতে সমর্থ হই]।

৩। সকর্মসঞ্জাত হে জ্ঞানভক্তিরূপী দেবদ্বয়! (আমার হৃদয়-নিহিত এবং আমার হৃদয়গৃহস্বামী অথবা হৃদয়রূপ গৃহের পালকরূপে বিদ্যমান শুদ্ধসত্ত্বাঙ্গীভূত হে জ্ঞানাধিদেব!) আপনারা উভয়ে আমাদের সাথে সমান-মননযুক্ত অথবা আমাদের প্রতি অতিশয় প্রীতিযুক্ত, পরস্পর সমান-চিত্তযুক্ত অথবা আমাদের প্রতি অনুগ্রহের জন্য পরস্পর সখিত্বসম্পন্ন, এবং পাপরহিত অর্থাৎ অজ্ঞান ইত্যাদির দ্বারা অনভিভূত অথবা আমাদের অনুষ্ঠানেও আমাদের প্রতি অনুগ্রহ পরায়ণ হোন। অপিচ, সৎকর্মকারী আমাকে এবং আমার অনুষ্ঠিত কর্মকে বিনাশ করবেন না (অর্থাৎ আমাকে এবং আমার কর্মকে পরিত্যাগ করবেন না); পরন্তু অদ্য অর্থাৎ সর্বকালে আমাদের উপকারের জন্য আপনারা কল্যাণকারী ও মঙ্গলপ্রদ হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাবার্থ– আমাতে জ্ঞান ও ভক্তি অবিচলিত হোক। আর, আমাদের কর্ম জ্ঞানের অনুসারী ও সৎ-ভাবমণ্ডিত হাক)। [হে জাতবেদসৌ–সৎকর্মণ্য সঞ্জাতৌ জ্ঞানভক্তিরূপৌ দেবৌ, মম হৃন্নিহিতৌ তথা মম হৃদয়গৃহস্বামিনৌ, যদ্বা–হৃদয়রূপগৃহস্য পালকরূপেণ বিদ্যমানৌ শুদ্ধসত্ত্বাঙ্গীভূতৌ হে জ্ঞানধিদেব! যজ্ঞপতিং–সৎকর্মানুষ্ঠাতারং–মামিতি ভাবঃ; শিবৌ কল্যাণকারিণৌ, মঙ্গলপ্রদৌ বা]।

৪। আত্ম উৎকর্ষ-সম্পন্ন জনের অথবা অতীন্দ্রিয়-দ্রগণের পুত্রস্থানীয় অর্থাৎ তাদের সৎকর্ম ইত্যাদি হতে সঞ্জাত, অভিসম্পাত অর্থাৎ পাপ হতে পরিত্রাণকারী, প্রজ্ঞান-স্বরূপ ভগবান, হৃদয় বিহিত শুদ্ধসত্ত্বে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্বকে প্রাপ্ত হয়ে পরিচর‍্যা করেন অর্থাৎ সেই শুদ্ধসত্ত্বনিহিত হবিঃ বা ভক্তিকে গ্রহণ করেন। (ভাব এই যে, সম্ভব–শুদ্ধসত্ত্ব ভগবানের প্রীতির সামগ্রী। তা ভগবানের তৃপ্তিসাধক এবং তার দ্বারাই ভগবানকে প্রাপ্ত হওয়া যায়)। [ঋষিণাং পুত্রঃ–আত্মোৎকর্ষসম্পন্নানাং অতীন্দ্রিয়দ্রষ্টুণাং বা পুত্রস্থানীয়ঃ, যদ্বা–তেষাং সৎকর্মাদিভিঃ সঞ্জাতঃ; অগ্নৌঃ হৃন্নিহিতৌ শুদ্ধসত্ত্বেী] (১)। তথাবিধ প্রজ্ঞানরূপী সেই আপনি, হে ভগবন্! আমাদের অভীষ্টসিদ্ধির জন্য অথবা পরমার্থ-প্রদানের জন্য, সুখদায়ক অথবা কল্যাণপ্রদ অর্থাৎ পরমানন্দদায়ক হয়ে, অপিচ সর্বকালে আমাদের প্রমাদপরিশূন্য করে অথবা (আমাদের প্রতি) অনোন্যচিত্ত হয়ে, শোভনযাগ অর্থাৎ পরমসুখসাধক সকর্ম ও সম্ভাবগুলির দ্বারা, সর্বদা সকল স্থানে বা আমাদের অনুষ্ঠিত সকল কর্মে, দেবগণের উদ্দেশ্যে অর্থাৎ প্রীতির জন্য অথবা আমাদের মধ্যে নিখিল দেবভাবের প্রজননের জন্য, আমাদের প্রদত্ত হবিঃ দেবগণকে প্রাপ্ত করুন, অর্থাৎ তাদের শুদ্ধসত্ত্ব অথবা হৃদয়ের ভক্তিভাব প্রদান করুন। এই হবিঃ স্বাহামন্ত্রে আপনাকে অর্পণ করছি অনুষ্ঠান সুহৃত হোক। (ভাব এই যে, সৎকর্মে এবং সৎ-ভাবে দেবভাব সঞ্চাত হয়। তার দ্বারাই সুদ্ধসত্ত্বের আধার ভগবান্ পরিতুষ্ট হন। অতএব প্রার্থনা,-হে ভগবন্! যাতে আমরা দেবভাবের অধিকারীও সৎকর্মপরায়ণ হই, আপনি তা-ই করুন)। [সঃ–তথাবিধঃ প্রজ্ঞানস্বরূপো ত্বং;স্যেনঃ– সুখদায়ক, কল্যাণপ্রদঃ, পরমানন্দদায়কো বাসন্নিতি যাবৎ] (২)।

৫। হে আমার হৃদয়াধিষ্ঠিত শুদ্ধসত্ত্ব! সতত-সর্বত্র গমনশীল অথবা জগতের প্রাণস্বরূপ, সর্বব্যাপী অথবা বিশ্বের সকলের মনোধিষ্ঠাতা, প্রভূত শক্তিসম্পন্ন অথবা শক্তিস্বরূপ, জগতের যাবতীয় প্রাণীর শক্তিবিধায়ক অথবা সকর্মের সাধনে শক্তিপ্রদানকারী, প্রভূত তেজোবীর্য-সম্পন্ন অথবা অনাধৃষ্টবল, বিশুদ্ধ সত্ত্বভাবের সংরক্ষক অথবা জন্মকারণ-বিনাশকারী, ভগবানের উদ্দেশ্যে অথবা ভগবানের প্রীতির জন্য তাকে লাভ করবার জন্য তোমাকে (তার উদ্দেশ্যে) নিবেদন করি বা উৎসর্গ করি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক এবং আত্ম-উদ্বোধন-সূচক। মন্ত্রে ভগবানকে হৃদয়গত নিখিল সৎ-ভাব প্রদানের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন্ আমার হৃদয়ের শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণ করে, পরিতুষ্ট হয়ে আমাতে সৎভাব সংরক্ষণ করুন এবং আমার জন্মকারণ নিবারণ করুন)। [তন্নপত্রে–বিশুদ্ধসত্ত্বভাবসংরক্ষকায়, জন্মকারণনিবারকায় ভগবতে, যদ্বা–ভগবত্যৈ বা তল্লাভায়েত্যর্থঃ]।(১)। হে আমার হৃদয়াধিষ্ঠিত শুদ্ধসত্ত্ব! অ-তিরস্কৃত অর্থাৎ প্রমাদপরিশূন্য অহিংসিত ও হিংসা ইত্যাদি রহিত অপিচ সর্বসাফল্যপ্রদ হও; অতএব আমাতে অথবা আমাদের সম্পর্কে তুমি তেমনই অহিংসিত ও অ-তিরস্কৃত অর্থাৎক্লেদকলঙ্কপরিশূন্য সদা-নির্মল অথবা সুখসাধক হও। তুমি নিখিল সৎ-ভাবসমূহের অথবা সৎ ভাবসম্পন্ন জনের বলশক্তিস্বরূপ এবং অনিন্দনীয় বা পাপসংসর্গরহিত; অপিচ, তুমি অভিসম্পাত বা পাপ হতে পরিত্রাণকর্তা এবং অনিন্দিত পরমলোকে নয়নক্ষম অথবা ভগবৎ-সন্নিকর্ষের প্রাপক হও। অতএব নির্মলচিত্তে ঋজুমার্গে গমন করে অথবা নিখিল স্নেহার্দুভাবের বা শুদ্ধসত্ত্বভাবের দ্বারা যাতে সস্বরূপ ভগবানে গমন করতে পারি অথবা সৎস্বরূপ ভগবানকে পেতে পারি, তেমন শোভন বা সাধুগত কল্যাণপ্রদ মার্গে আমাকে অবস্থাপিত করো। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থী বিশুদ্ধচিত্তে সৎকর্মের সাধনে সৎপথে গমন করে ভগবৎ-প্রাপ্তি কামনা করছেন। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে দেব! শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে সৎপথে চলে সঙ্কর্মের সাধনে যাতে আমি ভগবৎ-সন্নিকর্ষ লাভ করতে পারি, আপনি তা করুন)। [অনাধৃষ্টং সদৈব অতিরস্কৃতং, যদ্বা–প্রমাদপরিশূন্যং, অহিংসতিং, হিংসারহিতমিত্যর্থঃ, অপিচ অনভিভূতং, সর্বসাফল্যপ্রদমিতি ভাবঃ; অনাধৃষ্যং–কেনাপ্যহিংসিতং অতিরস্কৃতং বা, যদ্বা ক্লেদপরিশূন্যং সদানির্মলং, সুখসাধকমিত্যর্থঃ; অনভিশস্তি–অনিন্দনীয়, পাপসংসর্গরহিতঃ ইতি ভাবঃ; অভিশক্তিপা–অভিসম্পাতাৎ পাপাদ্বা পরিত্রাতা; অনভিশস্তেন্যং–অনিন্দিতে পরমে লোকে নয়নক্ষমং, যদ্বা–ভগবৎসন্নিকর্ষপ্রাপকং; অঞ্জসা–ঋজুমাৰ্গেণ, নির্মলচিত্তেন, যদ্বা– নিখিলস্নেহার্ভাবৈঃ, শুদ্ধসত্ত্বভাবৈবা] (২)। [এই কণ্ডিকার মন্ত্র দুটি আত্ম-উদ্বোধন-মূলক ও প্রার্থনাসূচক। উভয় মন্ত্রই শুদ্ধসত্ত্বের সম্বোধনে বিনিযুক্ত]।

৬। হে সঙ্কর্মের পালক অথবা সৎকর্মকারিদের প্রতি অনুগ্রহপরায়ণ প্রজ্ঞানময় দেব! আপনি সৎকর্মের পালক অথবা সঙ্কৰ্মকারিদের প্রতি প্রীতি অতিশয়যুক্ত, অর্থাৎ তাঁদের মধ্যে সৎ-ভাবের সংরক্ষক হন। অতএব, আমি আপনার শরণ নিলাম। আমাকে সৎ-ভাবের অধিকারী করুন। হে দেব! তথাবিধ সৎকর্মের পালক আপনার যে পবিত্র কারক পুণ্যময় শরীর, আপনার সেই পবিত্রকারক শরীর আমাতে বর্তমান হোক; এবং কলুষ কলঙ্ক-পরিমগ্ন আমার যে পাপপঙ্কিল দেহ, তা আপনার শরীরে বর্তমান হোক অথবা লীনপ্রাপ্ত হোন। (মন্ত্রাংশ প্রার্থনামূলক। এখানে প্রার্থনাকারী পরমাত্মায় আত্মসম্মিলনের আকাঙ্ক্ষা জানাচ্ছেন। প্রার্থনার ভাব এই যে,–কলুষ-কলঙ্কপরিলিপ্ত আমার এই ভৌতিক শরীর নাশ করে আমাতে আপনার পুণ্যপূত দেবদেহ স্থাপন করুন। মর্মার্থ এই যে আমাকে পাপ থেকে পরিত্রাণ করে পবিত্র সত্ত্ব-সমন্বিত করুন অর্থাৎ আপনার অনুগ্রহে পাপ থেকে মুক্ত হয়ে আমি যেন পবিত্র শুদ্ধসত্ত্বযুক্ত হই)। [ব্রতপাঃ–সৎকর্মপালক, যদ্বা সকর্মকারিণং প্রতি সদা অনুগ্রহপরায়ণঃ] (১)। হে সৎকর্মপালক প্রজ্ঞানাধার দেব! (আপনার ও আমার উভয়ের এমন বিনিময় হলে) আমার অনুষ্ঠিত সকর্মসমূহ আপনার ও আমার উভয়ের সাথে প্রবর্তিত হোক অর্থাৎ আমার কার্যে আমার মতো আপনারও আদর বা প্রীতি হোক। অপিচ হেদীক্ষার বা সৎকার পালক দেব! আমার দীক্ষারূপ শোভন অনুষ্ঠান আপনি স্বীকার বা গ্রহণ করুন। হে আমার শর? বাঁচিক-মানস অথবা সাত্ত্বিক-রাজস ও তামস তিনরকম তপঃ কর্মের পালক দেব! আমার উক্তরূপ তিন রকম তপঃ কর্ম আপনি স্বীকার করুন বা গ্রহণ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। আমার অনুষ্ঠিত কর্ম সম্ভাবসমন্বিত হোক, অপিচ আমার প্রতি অনুগ্রহপরায়ণ হয়ে আপনি আমার পূজা গ্রহণ করুন–মন্ত্রে এইভাব পরিব্যক্ত)। [ব্রতপতে–সঙ্কৰ্মপালক, প্রজ্ঞানাধার দেব); দীক্ষাপতিঃ-দীক্ষায়াঃ সৎকর্মণণা বা পালকঃ দেবঃ; দীক্ষাং–শোভনানুষ্ঠানং, মমানুষ্ঠিতং সৎকর্ম ইত্যর্থঃ; তপস্পতে–তপসঃ পালক, শারীরবাচিকমানস যদ্বা সাত্ত্বিকরাজসতামসস্ত্রিবিধতপঃকারিণাং পালকো রক্ষকো বা স দেবঃ] (২)। [অগ্নিকে ব্রতপাঃ ব্রতপতি দীক্ষাপতি ও তপস্পতি বলবার তাৎপর্য বিশ্লেষিত হচ্ছে। পাপক্ষয়কারী পুণ্যজনক কর্মমাত্রই ব্রতপর্যায়ভুক্ত। আবার পবিত্রকারী মানসিক নির্মলতা-সাধক ব্রত-নিয়ম ইত্যাদি তপঃ পর্যায়ভুক্ত। ব্রত ইত্যাদি কর্মে স্থিতি–দীক্ষা। জ্ঞান–এ-সবগুলির পথ প্রদর্শন করে বলে, জ্ঞানাগ্নিকে ব্রতপাঃ ব্রতপাঃ ব্রতপতে প্রভৃতি সম্বোধনে অভিহিত করা হয়েছে। স্বরূপ জ্ঞান না জন্মালে, কোনটি সৎকর্ম কোনটি অসৎকর্ম–তা কেমন করে চিনতে পারা যায়? অনেক সময় আমরা যাকে সৎকর্ম বলি, যাকে ভগবানের প্রীতিসাধক বলে মনে করি, তা হয়তো ভ্রান্তিবিমিশ্র বা কলুষিত হয়ে থাকে। অগ্নিপরীক্ষায় পরীক্ষিত না হলে, সকর্ম অসৎকর্ম নির্বাচন করা কঠিন হয়ে ওঠে। ভ্রান্তির বশে অনেক সময় অনেক কর্মকে সৎকর্ম বলে মনে করি বটে; কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার সবই সৎকর্ম নয়। অগ্নিদেব অর্থাৎ জ্ঞানাগ্নিই তা পরীক্ষা করতে সমর্থ। ক্লেদরাশি আবর্জনারাশি ভস্মীভূত করতে তিনিই অদ্বিতীয়। পরীক্ষার অনলে দগ্ধীভূত হয়ে কর্ম ঔজ্জ্বল্যসম্পন্ন হয়–তারই কাছে। তাই অগ্নিদেবকে বা অন্তরস্থিত জ্ঞানবহ্নিকে ব্রতপাঃ দীক্ষাপতিঃ ব্রতপতিঃ তপস্পতিঃ প্রভৃতি বলা হয়েছে। আবার, গীতায় তিনরকম তপের বিষয় উল্লিখিত হয়েছে, যথা, কায়িক, বাঁচিক ও মানস। দেব, দ্বিজ, গুরু ও ৬ প্রাজ্ঞজনের পূজা, শৌচ, ঋজুতা, ব্রহ্মচর্য ও অহিংসা–এই কটি শরীর তপঃ। প্রিয় হিত, সত্য, অনুদ্বেগকর বাক্য ও স্বাধ্যায়-অভ্যাস–ঐ কটি বাঁচিক তপঃ। আর মনঃপ্রসাদ, সৌম্যত্ব, মৌন, আত্মনিগ্রহ ও ভাবশুদ্ধি–এই কটি মানস তপঃ। কোনও কোনও মতে আবার সাত্ত্বিক, রাজস ও তামস–এই তিন, রকম তপের বিষয় উল্লিখিত হয়। যাতে কোনও ফলাকাঙ্ক্ষা নেই, তার নাম সাত্ত্বিক তপঃ। সত্ত্বার মান ও পূজার জন্য দম্ভের দ্বারা যা অনুষ্ঠিত হয়, তার নাম রাজস; রাজস তপঃ অস্থায়ী ও ভঙ্গুর। পরের উৎসাদন বা সেইরকমই দুরাগ্রহবশতঃ আত্মাকে পীড়িত করে যার অনুষ্ঠান করা হয়, তার নাম তামস তপঃ। মরীচির মতে–যার দ্বারা জ্ঞান-বিজ্ঞান সম্পন্ন, পাপ বিনষ্ট, স্বর্গসাধন ও সিদ্ধি সংঘটিত হয়, তার নাম তপঃ। বেদান্ত ইত্যাদি দর্শনশাস্ত্রের মতে, তপঃ ঈশ্বরের বিভূতি-বিশেষ। অগ্নিতে ধাতুর মতো পাপ ইত্যাদি মলভার: বিগলিত হয়; এই জন্য এর নাম তপঃ। তন্ত্রমতে দীক্ষা-র অর্থ–মন্ত্রের উপদেশ। দীয়তে জ্ঞানমত্যন্তং ক্ষীয়তে পাপসঞ্চয়ঃ। তস্মাৎ দীক্ষেতি সা পোক্তা মুনিভিস্তত্ত্বদর্শিভিঃ। ফলতঃ, জ্ঞানই সকলের মূলীভূত। বিশুদ্ধ জ্ঞান ভিন্ন সৎ-অসৎ বিচারে আর কেউ সমর্থ নয়]।

 ৭। হে দ্যোতমান্ দীপ্তিমান ইত্যাদি গুণযুক্ত আমার জন্মসহজাত অন্তর্নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তোমার সকল অবয়ব অর্থাৎ উৎকর্ষপ্রাপ্ত ও হীনতেজষ্ক সকল অংশ, একধনবিৎ অর্থাৎ মোক্ষধনপ্রদায়ক পরমৈশ্বর্যশালী ভগবানের প্রীতির বা সেবার জন্য নিবেদিত অর্থাৎ উৎসর্গীকৃত হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাবার্থ–আমার হৃদয়স্থিত সকল সত্তাবরাজি ভগবানের সন্নিকর্ষ প্রাপ্ত হোক)। [সোম-মমজন্মসহজাত অন্তর্নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব; অংশুরংশুঃ–সর্বোহপি অবয়বঃ; ইন্দ্রায়–পরমৈশ্বর্যশালিনে ভগবতে]।(১) হে শুদ্ধসত্ত্ব! তোমাকে গ্রহণের জন্য পরমৈশ্বর্যশালী ভগবান্ অভিবৃদ্ধ হোন, অথবা তোমাকে অভিবৃদ্ধ করতে উদ্বুদ্ধ হোন। অপিচ, তুমিও ভগবানের প্রীতির জন্য অভিবৃদ্ধ অর্থাৎ ঔৎকর্ষ রা পবিত্রতা প্রাপ্ত হও। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনমূলক। এখানে ভগবানকে পাবার জন্য সাধক চিত্তের ঔকর্ষ প্রার্থনা করছেন)। [ইন্দ্রঃ– পরমেশ্বর্যশালী ভগবান; ইন্দ্রায় ইন্দ্রদেবপ্রীত্যর্থং, যদ্বা–ভগবতঃ গ্ৰহণায়েত্যর্থঃ] (২)। হে দ্যোতমান্ দেব! সখীর মতো প্রীতির সামগ্রী অথবা তোমার প্রতি প্রীতি-অতিশয়যুক্ত, সাধনসম্পন্ন বা ভক্তিযুক্ত সাধকবর্গকে (অর্চনাকারী আমাদের) পরমধনদানে এবং আপনাকে হৃদয়ে ধারণযোগ্য শক্তির দ্বারা প্রবর্ধিত করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। এখানে হৃদয়ে ভগবানকে প্রতিষ্ঠিত করবার জন্য এবং মোক্ষলাভের জন্য ভক্ত সাধক প্রার্থনা জানাচ্ছেন। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে ভগবন্! আমাকে মোক্ষের অধিকারী ও মেধাবী করুন)। [সন্যা–পরমধনদানেন]। হে দ্যোতমান্ শুদ্ধসত্ত্ব-স্বরূপ দেব! তোমার সম্বন্ধীয় মঙ্গল আমাদের মধ্যে অবিনাশী হোক। তোমার অনুগ্রহে আমরা যেন বিনাশরহিত হয়ে ভগবৎ প্রাপ্তিরূপ কর্মফল প্রাপ্ত হই, অথবা তোমার কার্য (সৎকর্ম সম্পাদনে ব্যাপৃত থাকি। (মন্ত্রটি প্রার্থনা মূলক। আমাতে সৎ-ভাব ও শুদ্ধসত্ত্ব অবিচলিতভাবে অবস্থিত, করুক; এবং তার দ্বারা সৎস্বরূপ ভগবানকে প্রাপ্ত হই)। [সোম–হে দ্যোতমান্ শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপ দেব!; সুত্যাং-কর্মফলং ভগবৎপ্রাপ্তিরূপং ইতি ভাবঃ] (৩)। হে ভগবন্! আমাদের অভিলষিত পরমৈশ্বর্য (মোক্ষরূপ ঐশ্বর্য) লাভের জন্য, আমাদের সকল কর্মফল (নিখিল শুদ্ধসত্ত্ব সৎ-ভাব ইত্যাদি) আপনাকে সর্বতোভাবে আমাদের দ্বারা প্রদত্ত হচ্ছে; প্রার্থনা, আপনার প্রসাদে আমাদের অভিলষিত মোক্ষধন অধিগত হোক। সৎকর্মকারী আমাদের কর্মফল অর্থাৎ মোক্ষফল প্রদান করুন। (ভাবার্থ–আপনার অনুগ্রহে আমাদের কর্ম সুফল-মণ্ডিত এবং মোক্ষফলসমন্বিত হোক)। [প্রেষে–প্রেষ্যমাণায়, অভিলষিতরূপায়েত্যৰ্থঃ; এষ্টা–সর্বতোভাবেন দত্তা–অস্মাভিরিতি শেষঃ] (৪) অন্তরিক্ষস্থ এবং পৃথিবীস্থ দেবগণকে অথবা ৬ নিখিল-দেবভাবগুলিকে নমস্কার করছি। তাদের অনুগ্রহে আমাদের সঙ্কল্প সিদ্ধ হোক। অথবা, আমার নমস্কার-রূপ সৎকর্ম ভূলোক ও স্বর্গলোক ব্যেপে প্রকাশ পাক। [দ্যাবাপৃথিবীভ্যাং–নিখিল দেবভাবভ্যাং, অথবা,ভূলোকস্বলোকাভ্যাং, ভূলোকস্বলোকৌ ব্যাপ্য ইত্যর্থঃ] (৫)। [এই কণ্ডিকার : প্রথম তিনটি মন্ত্র শুদ্ধ-সত্ত্ব-সম্বোধনে এবং চতুর্থ মন্ত্রটি ভগবৎ-সম্বোধনে বিনিযুক্ত। শেষ মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক]।

৮। হে প্রজ্ঞানস্বরূপ দেব! শ্রেষ্ঠতম অথবা ভক্তগণের অভীষ্টবর্ষণশীল, হৃদয়ের অতি নিগূঢ়প্রদেশে স্থিত, লৌহময় অথবা বজের মতো অতি কঠোর অর্থাৎ তমোরূপ তোমার যে প্রসিদ্ধ শরীর বা অঙ্গ আছে, তোমার সেই শরীর, শত্রুদের অতি-তীব্র বাক্যকে অর্থাৎ হিংসা প্রলোভন ইত্যাদির পাপসঙ্কল্পব্যঞ্জক কর্মগুলিকে নাশ করে; অপিচ, শত্রুদের পৌরুষব্যঞ্জক বাক্যকে অর্থাৎ কাম-ক্রোধ ইত্যাদি অন্তঃশত্রুর হৃদয়-অভিভবকারিণী শক্তিকে নাশ করে। অতএব, তোমাকে স্বাহা মন্ত্রে পূজা করি; আমার অনুষ্ঠাম সুহুত অর্থাৎ সুসিদ্ধ হোক। (ভাব এই যে,–তমোরূপে ভগবান্ সকল শত্রুকে নাশ করেন। অতএব, তমোভাবের দ্বারা আমাদের অন্তঃশত্রুকে নাশ করে আমাদের আরব্ধ কর্ম সুসিদ্ধ করুন)। [বর্ষিষ্ঠা–উরুতমং, শ্রেষ্ঠতমং, যদ্বা ভক্তানাং অভীষ্টবর্ধণশীলমিতি ভাবঃ; অয়ঃশয়া–লৌহময়ং, বজ্রবৎ, অতিকঠোরং, তমোরূপং ইতি ভাবঃ; উগ্রং বচঃশত্ৰুণাং অতিতীব্রং বাক্যং, হিংসাপ্রলোভনাদীনাং পাপসঙ্কল্পব্যঞ্জকানি কৰ্মাণীতি ভাবঃ;ত্বেং বচঃশত্রণাং পৌরুষব্যঞ্জকং বাক্যং, কামক্রোধাদীনং হৃদয়াভিভবকারিণীং শক্তিমিত্যর্থঃ] (১)। হে প্রজ্ঞানস্বরূপ দেব! শ্রেষ্ঠতম অথবা ভক্তগণের অভীষ্টবর্ষণশীল, হৃদয়ের অতি নিগূঢ় প্রদেশে অবস্থিত, রজতময় অর্থাৎ রজোভাবাপন্ন তোমার যে প্রসিদ্ধ শরীর বা অঙ্গ আছে, রজোভাবময় তোমার সেই শরীর বা অঙ্গ শত্রুদের অতি তীব্ৰবাক্যকে অর্থাৎ হিংসা-প্রলোভন ইত্যাদির পাপসঙ্কল্পব্যঞ্জক কর্মসমূহকে নাশ করে; অপিচ, শত্রুদের পৌরুষব্যঞ্জক বাক্যকে অর্থাৎ কামক্রোধ ইত্যাদি অন্তঃশত্রুর হৃদয়-অভিভবকারিণী শক্তিকে নাশ করে; অতএব, তোমাকে স্বাহা মন্ত্রে পূজা করি, আমার অনুষ্ঠান সুহুত অর্থাৎ সুসিদ্ধ হোক। (ভাব এই যে, –রজোভাবে ভগবান্ সকল শত্রুকে নাশ করেন; অতএব, রজোভাবের দ্বারা আমাদের অন্তঃশত্রুকে নাশ করে আমাদের আরব্ধ কর্ম সুসিদ্ধ করুন)। [রজঃশয়া-রজতময়ং, রজোভাবসমন্বিতমিতিভাবঃ]। হে প্রজ্ঞাস্বরূপ দেব! শ্রেষ্ঠতম অথবা ভক্তগণের অভীষ্টবর্ষণশীল, হৃদয়ের অতিনিগুঢ় প্রদেশে অবস্থিত, হিরন্ময় অথবা সত্ত্বভাবসম্পন্ন তোমার যে প্রসিদ্ধ শরীর বা অঙ্গ আছে, সত্ত্বভাবময় তোমার সেই শরীর বা অঙ্গ শত্রুদের অতি-তীব্র বাক্যকে অর্থাৎ হিংসা-প্রলোভন ইত্যাদির পাপসঙ্কল্পব্যঞ্জক কর্মসমূহকে নাশ করে; অপিচ শত্রুদের পৌরুষব্যঞ্জক বাক্যকে অর্থাৎ কাম-ক্রোধ ইত্যাদি অন্তঃশত্রুর হৃদয় অভিভবকারিণী শক্তিকে নাশ করে; অতএব, তোমাকে স্বাহা-মন্ত্রে পূজা করি, আমার অনুষ্ঠান সুহুত অর্থাৎ সুসিদ্ধ হোক। (ভাব এই যে,–সত্ত্বভাবে ভগবান্ সকল শত্রুকে নাশ করেন; অতএব, সত্ত্বভাবের দ্বারা আমাদের অন্তঃশত্রুদের নাশ করে আমাদের আরব্ধ কর্ম সুসিদ্ধ করুন)। [হরিশয়া হিরন্ময়মিত্যর্থঃ, সত্ত্বভাবময়মিতি ভাবঃ] (৩)। [এই কণ্ডিকার তিনটি মন্ত্রই প্রজ্ঞানস্বরূপ ভগবানের সম্বোধনসূচক। তিনটি মন্ত্রই প্রার্থনামূলক। কণ্ডিকার মন্ত্রগুলির সাথে একটি উপাখ্যান বিজড়িত দেখি। সে উপাখ্যান,–দেবগণ কর্তৃক পরাজিত হলে অসুরেরা তপস্যা আরম্ভ করে; ফলে তিনলোকে তাদের তিনটি পুর নির্মিত হয়–পৃথিবীতে লৌহময়, অন্তরিক্ষে রজতময় এবং স্বর্গলোকে হেমময়। তখন সেই তিনটি পুর দগ্ধ করবার জন্য, দেবগণ উপসদ অগ্নির আরাধনা আরম্ভ করেন। উপসদ-দেবতারূপ অগ্নি যখন সেই তিন পুরে প্রবেশ করে দগ্ধ করেন, তখন তার তিন-লৌহময়, রজতময় ও হিরন্ময়–দেহ উৎপন্ন হয়। মন্ত্রে অগ্নিদেবের সেই তিনরকম শরীরের বিষয় উল্লিখিত। ভাষ্যে এই আখ্যায়িকার অবতারণায় মন্ত্রের অর্থ জটিলতা প্রাপ্ত হয়েছে এবং অগ্নির দাহিকা-শক্তিতে স্বর্ণ, রৌপ্য, লৌহ-সবই দগ্ধীভূত হয়, তাই প্রকাশ পেয়েছে মাত্র। আমরা এ-সব অর্থ অনুমোদন করি না; মন্ত্রের সাথে কোনও উপাখ্যান জড়িত আছেবলেও আমরা স্বীকার করিনা। মন্ত্রের অন্তর্গত অয়ঃশয়ারজঃশয়াও হরিশয়া পদ তিনটিতে আমরা ভগবানের তমঃ, রজঃ ও সত্ত্ব এই তিনরকম ভাব উপলব্ধি করি। এই তিনটি রূপে ভগবান্ সৃষ্টি-স্থিতি-লয় সাধন করেন। এখানে এ মন্ত্রে সেই ভাবই পরিব্যক্ত বলে মনে হয়। শত্রু অনেকরকম; নানা উপায়ে তাদের বশীভূত করতে হয়। যাদের তমোভাবে সংহার করা সম্ভবপর, তারা সেই তমোভাবের দ্বারাই বিনষ্ট হয়; আবার যাদের প্রতি সত্ত্ব বা রজোভাবের প্রয়োগ আবশ্যক, তাদের সংহার-সাধনে সেই শক্তিই প্রয়োগ করতে হয়। সেইজন্য আমরা ঐ তিনরকম ভাবকেই শত্রু সংহারকরূপে পরিকল্পনা করেছি। উগ্রং বচঃ আর ত্বেষং বচঃ পদগুলি থেকে আমরা যে ভাব গ্রহণ করি, তা এই, মানুষ যখন হিংসা-প্রলোভন ইত্যাদির দ্বারা অভিভূত হয়, কাম-ক্রোধ ইত্যাদি এসে যখন তার হৃদয় অধিকার করে, তখন তার হিতাহিত জ্ঞান লোপ-প্রাপ্ত হয়; তখনই তার মুখ থেকে অন্যায় অবৈধ বাক্যগুলি নির্গত হতে থাকে। তখনই মারমার কাটকাট হিংসা-ক্রোধ ইত্যাদি বিম্ভিত পৌরুষবচন প্রযুক্ত হয়। এই ভাব থেকে যথাক্রমে ত্বেং বচঃ অর্থে কামক্রোধাদীনাং হৃদয়াভিভবকারিণীং শক্তিঃ এবং উগ্রং বচঃ অর্থে হিংসাপ্রলোভনাদীনাং পাপসঙ্কল্পব্যঞ্জকানি কর্মানি অর্থ পরিগ্রহণ করেছি। ভগবানে সংন্যস্তচিত্ত হলে হৃদয়ের অজ্ঞানান্ধকার এবং তৎসহচর কামক্রোধ ইত্যাদি নানারকম অন্তঃশত্রুর আক্রমণ নিবারণ করবার প্রথম আবশ্যক হয়। মোক্ষলাভেছু সাধকের প্রার্থনা সেইরকমই হয়ে থাকে। মন্ত্র তিনটিতে তাই প্রার্থনার ভাব প্রকাশ পেয়েছে–হে ভগবন্! আপনি সত্ত্বরজস্তমঃ তিন রকম ভাবে আবির্ভূত হয়ে আমার সাধনার পরিপন্থী শত্রুদের বিনাশ করুন। আমার সাধনা সিদ্ধ হোক। আমাদের মনে হয়, এইরকম ভাবই মন্ত্রগুলির মধ্যে অন্তর্নিহিত আছে।

৯। হে শুদ্ধসত্ত্বাঙ্গীভূত ভক্তিরূপিণি দেবি! তুমি আমাকে অনুগ্রহ করবার জন্য (অথবা আমার সম্বন্ধে) পাপ তাপ শান্তিকারিণী অথবা পাপসন্তপ্তদের আশ্রয়ভূতা হও। (অতঃপর পাপ থেকে আমাকে রক্ষা করো)। [তপ্তায়নী–পাপতাপশান্তিকারিণী, যদ্বা–পাপসপ্তানাং আশ্রয়ভূতা ইতি ভাবঃ) (১)। অপিচ, আমাকে অনুগ্রহের জন্য (অথবা আমার সম্বন্ধে) দারিদ্র্যদুঃখনাশিনী অথবা পরমধনদাত্রী অর্থাৎ শ্রেষ্ঠধনসমূহের আধারস্বরূপা হও। (অতঃপর আমাকে পরমধন মোক্ষ প্রদান করো)। [বিত্তায়িনী দারিদ্র্যদুঃখনাশিনী, পরমধনদাত্রী, যদ্বা,শ্রেষ্ঠধনানামাধারস্বরূপা] (২)। অপিচ, তুমি আমাকে দারিদ্র্য দুঃখ অথবা পাপের প্রভাব থেকে রক্ষা করো। (অতঃপর, পাপে যেন আমি অভিভূত না হই, তা-ই করো)। [নাথিতাৎ–দারিদ্রদুঃখাৎ, যদ্বা–পাপপ্রভাবাৎ অবতাৎরক্ষ]।(৩)। অপিচ, পাপভয় থেকে অথবা প্রলোভন ইত্যাদিজনিত পদঙ্খলন থেকে অথবা পাপসম্মোহ থেকে আমাকে রক্ষা অর্থাৎ পরিত্রাণ করো। [ব্যথিতাৎ–পাপভরাৎ, প্রলোভনাদিজনিতত্বাৎ পবঙ্খলনাচ্চ, যদ্বা–পাপসম্মোহাদিতি। ভাবঃ) (৪)। [এই চারটি মন্ত্রই প্রার্থনা-মূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,হে পাপসন্তাপহারিণি ভক্তিরূপিণি দেবি! তুমি আমাকে পাপসম্বন্ধ থেকে বিচ্যুত করো এবং মোক্ষপথে স্থাপন করো)। হে ভক্তিরূপিণি দেবি! নভঃ-সংজ্ঞা অর্থাৎ ত্বদধিষ্ঠিত অথবা হৃদয়রূপ নভেদেশে অধিষ্ঠিত প্রজ্ঞানস্বরূপ ভগবান তোমাকে জানুন অর্থাৎ গ্রহণ করুন। [অগ্নি–প্রজ্ঞানস্বরূপঃ ভগবান্‌] (৫)। হে প্রজ্ঞানস্বরূপ দেব! হে সর্বাধারভূত সর্বব্যাপী সর্বতোগমনশীল অথবা নিখিল-জ্ঞানের আধার দেব! আপনি আয়ুঃ নামে অভিহিত হয়ে অথবা চিরায়ুঃ বা চিরনবীন রূপে (আমার হৃদয়ে) গমন অর্থাৎ আগমন করুন। [অঙ্গিরঃ–সর্বসাধারভূত, সর্বব্যাপিন, সর্বত্রগমনশীল, যদ্বা–নিখিলজ্ঞানানামধারভূত দেব] (৬) হে প্রজ্ঞানস্বরূপ দেব! যে আপনি এই পরিদৃশ্যমান্ অর্থাৎ স্থূলসূক্ষ্মাত্মিকা অথবা সকলের আধারভূতা পঞ্চভূতাত্মিকা পৃথিবীতে (ইহলোকে) বর্তমান আছেন, অপিচ, অহিংসিত অনভিভূত সর্বসাফল্যপ্রদ যজ্ঞযোগ্য আপনার যে নাম আছে, সেই নামে আমি আপনাকে আহ্বান করছি (অর্থাৎ হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করি)। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক; জ্ঞান ও ভক্তির প্রভেদ সম্বন্ধ। যেখানে জ্ঞান, সেখানেই ভক্তি; আবার যেখানে ভক্তি, সেখানেই জ্ঞান। অতএব, জ্ঞান ও ভক্তিসহকারে ভগবানকে আহ্বান করি)। [অস্যাং-দৃশ্যমানায়াং, স্থূলসূক্ষ্মাত্মিকায়াং, যদ্বাসর্বেষাং আধারভূয়াং; অনাধৃষ্টং–কেনাপ্যাহিংসিতং, অনভিভূতং, সর্বসাফল্যপ্রদমিত ভাবঃ]।(৭)। হে ভক্তিরূপিণি দেবি! নভঃ-সংজ্ঞা অর্থাৎ ত্বৎ-অধিষ্ঠিত অথবা হৃদয়রূপ নভোদেশে অধিষ্ঠিত প্রজ্ঞানস্বরূপ ভগবান্ তোমাকে জানুন অর্থাৎ গ্রহণ করুন।](৮)। হে প্রজ্ঞানস্বরূপ দেব! হে সর্ব-আধারভূত সর্বব্যাপী সর্বতোগমনশীল অথবা নিখিল ও আধার দেব! আপনি আয়ুঃ-নামে অভিহিত হয়ে অথবা চিরায়ুঃ বা চিরনবীন রূপে (আমার হৃদয়ে) গমন অর্থাৎ আগমন করুন।(৯)। হে প্রজ্ঞানস্বরূপ দেব! যে আপনি এই পরিদৃশ্যমান অন্তরিক্ষলোকে বর্তমান আছেন; অপিচ, অহিংসিত অনভিভূত সর্বসাফল্যপ্রদ-যজ্ঞযোগ্য আপনার যে নাম, সেই নামে (আমি) আপনাকে আহ্বান করছি (অর্থাৎ হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করি)।(এ মন্ত্রও সঙ্কল্পমূলক। এখানেও পূর্বৰ্মন্ত্রের অনুরূপ প্রার্থনাই দ্যোতিত হয়েছে)। [দ্বিতীয়স্যাং পৃথিব্যাং–অন্তরিক্ষলোকে ইতি যাবৎ] (১০)। হে ভক্তিরূপিণি দেবি! নভঃ-সংজ্ঞ অর্থাৎ ত্বদধিষ্ঠিত অথবা হৃদয়রূপনভোদেশে অধিষ্ঠিত প্রজ্ঞানস্বরূপ ভগবান্ তোমাকে জানুন অর্থাৎ গ্রহণ করুন।(১১)। হে প্রজ্ঞানাধার ভগবন্! হে সর্ব-আধারভূত সর্বব্যাপী সর্বতোগমনশীল অথবা নিখিল জ্ঞানের আধার দেব! আপনি আয়ুঃ-নামে অভিহিত হয়ে অথবা চিরায়ুঃ বা চিরনবীনরূপে (আমার হৃদয়ে) গমন অর্থাৎ আগমন করুন।(১২)। হে প্রজ্ঞানস্বরূপ দেব! যে আপনি স্বর্গলোকে বর্তমান আছেন; অপিচ, অহিংসিত অনভিভূত সর্বসাফল্যপ্রদ যজ্ঞযোগ্য আপনার যে নাম আছে, সেই নামে (বা স্থানে) আপনাকে আহ্বান করছি (অর্থাৎ হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করি)।(এ মন্ত্রটিও সঙ্কল্পমূলক। এ মন্ত্রেও পূর্ব-মন্ত্রের অনুরূপ প্রার্থনা রয়েছে)। [তৃতীয়স্যাং পৃথিব্যাং–দ্যুলোকে ইত্যর্থঃ] (১৩)। হে ভক্তিরূপিণি দেবি! দেবগণের প্রীতির জন্য অথবা হৃদয়ে দেবভাবগুলির প্রতিষ্ঠার জন্য তোমাকে গ্রহণ করি অর্থাৎ আহরণ করি।-(মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক। ভক্তির দ্বারা ভগবানকে লাভ করবার আকাঙ্ক্ষা এই মন্ত্রে বিদ্যমান রয়েছে। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে দেবি! যে রকমে. আমি দেবভাবের অধিকারী হই, তা বিহিত করুন) (১৪)। [আমরা মনে করি, এই কণ্ডিকার মন্ত্রগুলি প্রার্থনামূলক; অপিচ, ভক্তির এবং ভগবৎ সম্বোধনে বিনিযুক্ত। ভাষ্যমতে এই মন্ত্রগুলির প্রথম চারটি মন্ত্র পৃঙ্খীদেবতা সম্বন্ধী; পঞ্চম, ষষ্ঠ সপ্তম মন্ত্র অগ্নি দেবতাকে; ইত্যাদি। এই মতে, তায়নীর অর্থ তপ্ত পুরুষকে যে প্রাপ্ত হয়, সেই তপ্তায়নী, বিত্তের জন্য মানুষ যাকে আশ্রয় করে, অথবা বিত্তের জন্য যে নির্ধন পুরুষকে আশ্রয় দান করে, সেই বিত্তায়নী ইত্যাদি। ভাষ্যকার মন্ত্রের মধ্যে অনায়াসে পৃথিবী বা মৃত্তিকা সম্বোধন-মূলক পদ অধ্যাহার করে মন্ত্রের অর্থান্তর ঘটিয়েছেন। কিন্তু আমরা তার কোনও আবশ্যকতা দেখি না। কর্মকাণ্ডের প্রয়োজন অনুসারে মন্ত্রের সম্বোধ্য যদি ঐরকমই হয়, হোক; তাতে আপত্তির বিশেষ প্রয়োজন অনুভব করি না। আমাদের দৃষ্টিতে, মন্ত্রের সম্বোধ্য অন্যরকমই মনে হয়। আমাদের পরিগৃহীত পন্থার অনুসরণে, প্রথম থেকে পঞ্চম, অষ্টম, একাদশ ও চতুদর্শ–এই মন্ত্রগুলি হৃদয়ের সার-সামগ্রী ভক্তির সম্বোধন আছে বলেই মনে করি। তাতে তপ্তায়নী বিত্তায়নী নাথিতাৎব্যথিতাৎ প্রভৃতি পদের সুন্দর অধ্যাত্মিকতামূলক অর্থ প্রকটিত হয় ও হয়েছে। অন্যান্য মন্ত্রের সম্বোধ্য যে অগ্নি, তা মন্ত্রেই উল্লিখিত আছে। কিন্তু আমরা সে অগ্নি অর্থে জ্ঞানাগ্নি বা নিখিল প্রজ্ঞানের আধার ভগবানকেই লক্ষ্য করেছি। হৃদয়ে মানস-যজ্ঞের অনুষ্ঠান হয়েছে ভগবানের আগমন ও উপবেশনের জন্য বেদি-নির্মাণের–তার উপযুক্ত আসন-প্রস্তুতের–আবশ্যক হয়েছে। জ্ঞান ও ভক্তিই সে আসনের একমাত্র উপাদানভূত। তাই ভক্ত, হৃদয়-রূপ চাত্বাল খনন করে, জ্ঞান-ভক্তিরূপ বেদি-নির্মাণে উদ্বুদ্ধ হয়েছেন; আর সেই ভাবে অনুপ্রাণিত ও সঙ্কল্পবদ্ধ হয়েই ভগবানের কাছে সেই মতোই প্রার্থনা জানাচ্ছেন। তিনি পৃথিবীতে, অন্তরিক্ষলোকে ও স্বর্গলোকে অর্থাৎ বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ব্যেপে সর্বদা সর্বত্র বিরাজমান রয়েছেন। তিনি যখন যেখানেই থাকুন, তার পবিত্র নাম ধরে প্রাণ খুলে ডাকতে পারলে, সেখান থেকে সেই নামেই এসে তিনি সাধকের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হন।…মন্ত্রে অগ্নিকে অঙ্গিরঃবলে সম্বোধন করা হয়েছে। ভাষ্যকার বলেন, অঙ্গিঅর্থাৎ গতি যাঁর আছে, তিনিই অঙ্গিরাঃ। তার সম্বোধনে অঙ্গিরঃ পদ হয়। তা থেকে গতিশীল অর্থের এবং এহি ক্রিয়াপদের অধ্যাহার। অগ্নি সকল জিনিসকে দগ্ধ করতে গমন করে, এবং দগ্ধীভূত সামগ্রী অঙ্গার হয়ে যায়, ভাবে এটাই অনুমিত হয়। কেউ কেউ আবার বলেন,–অঙ্গীরস নামে এক ঋষিবংশ ছিল। অগ্নি তাদের পূর্বপুরুষ। অগ্নি থেকে অঙ্গিরস ঋষিবংশের উৎপত্তি হয়; এইজন্য অগ্নি অঙ্গিরঃ নামে অভিহিত। ঋগ্বেদ-সংহিতার ভাষ্যে সায়ণাচার্যই এই মত প্রকাশ করেছেন। কিন্তু বেদমন্ত্রের নিত্যত্ব ও অপৌরুষেয়ত্ব স্বীকার করলে অনিত্য ঋষিবিশেষের সাথে তার সম্বন্ধ সূচনা করা যায় না। যাই হোক, আমরা ঐ অঙ্গিরঃ পদের অশেষপ্রজ্ঞানাধার অর্থ গ্রহণ করেছি। আমরা মনে করি, অগ্নে সম্বোধন এখানে ভগবানের সম্বন্ধে (সমষ্টিভূত কেন্দ্রীভূত বিভূতির বিষয়ে) প্রযুক্ত হয়েছে। অঙ্গ অর্থাৎ জ্ঞান+রস (বিদ্যমান) যাতে আছে, সেই অঙ্গিরস। জ্ঞানবিশিষ্ট জ্ঞানস্বরূপ অশেষপ্রজ্ঞানাধার অর্থই সে পক্ষে সমীচীন। ভগবান–জ্ঞানের আধার–জ্ঞানময়, অগ্নির অঙ্গির সম্বোধনে তা-ই প্রকাশ করেছে। সায়ণাচার্যও অনেক স্থলে আঙ্গিরঃ পদের ব্যাখ্যা-ব্যাপদেশে ঋষির সম্বন্ধ পরিহার করেছেন। তিনি প্রয়োজন অনুসারে বিভিন্ন স্থলে বিভিন্ন রূপ অর্থ অধ্যাহার করেছেন। (ঋগ্বেদ-সংহিতার ভাষ্যগুলিতে এর বহু নিদর্শন আছে)। কিন্তু আমাদের অর্থে সর্বত্রই একই রকম ভাব প্রকাশ পায়। কোনও স্থলেই ভাব-পরিবর্তন করার আবশ্যক হয় না। — মন্ত্রে তিনটি পৃথিব্যাং পদ আছে–পৃথিব্যাং, দ্বিতীয়স্যাং পৃথিব্যাং এবং তৃতীয়স্যাং পৃথিব্যাং। এই পদগুলির কেউ কেউ ভিন্ন অর্থও গ্রহণ করে থাকেন। তাদের মতে–পৃথিব্যাংপদে পঞ্চভূতাত্মক দেহ, দ্বিতীয়স্যাং পৃথিব্যাং পদে হৃদয়রূপ অন্তরিক্ষলোক, এবং তৃতীয়স্যাং পৃথিব্যাং পদে সহস্রারোপরি অবস্থিত সহস্রদলকমল অর্থ গ্রহণ করা যেতে পারে। আমরা কিন্তু ঐ পদ তিনটি ভাষ্যানুমোদিত অর্থই পরিগ্রহণ করেছি। আমাদের ভাব এই যে,ভগবান্ পৃথিবীতে, অন্তরিক্ষলোকে এবং স্বর্গধামে,এক কথায় এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সর্বত্রই বিদ্যমান আছেন। সুতরাং যেখান থেকে যে নামেই তাকে ডাক না কেন, ভক্তিভাবে ডাকার মতো ডাকতে পারলে, তিনি সেখান থেকে সেই নামে এসেই ভক্তের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ করে থাকেন]।

১০। হে শুদ্ধসত্ত্বাঙ্গীভূতে ভক্তিরূপিণি দেবি! তুমি সিংহীর মতো শক্তিসম্পন্না অথবা সর্বশক্তিশালিনী এবং বহিরন্তঃ-শত্রুদের (রিপুরূপ অন্তঃশত্রুর এবং লোভ-মোহ-প্রলোভন ইত্যাদিরূপ বহিঃশত্রুদের) অভিভকারিণী হও; অতএব, তুমি দেবগণের প্রীতির জন্য অথবা হৃদয়ে দেবভাব সংরক্ষণের জন্য লিপ্ত অর্থাৎ তাদের প্রীণনসমর্থ হও অর্থাৎ হৃদয়ে অধিষ্ঠিতা হও। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভক্তির সাহায্যে হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্ব আহরণের সঙ্কল্প এই মন্ত্রে বর্তমান)।[সপত্নসাহী-বহিরন্তঃশত্রণাং– রিপুরূপাণাং লোভমোহপ্রলোভনাদীনাঞ্চ অভিভবিত্রী ইত্যর্থ; কল্পস্ব–ক্লিপ্তা প্রীণনসমর্থ ভবেতি যাবৎ, হৃদি অধিতিষ্ঠ ইতি ভাবঃ] (১)। হে শুদ্ধসত্ত্বাঙ্গীভূতে ভক্তিরূপিণি দেবি! তুমি সিংহীর মতো শক্তিসম্পন্না অথবা নিখিলশক্তির আধারভূতা, বহিরন্তঃ-শত্রুদের (অর্থাৎ রিপুরূপ অন্তঃ-শত্রুদের এবং লোভ-মোহ-প্রলোভন ইত্যাদি বহিঃশত্রুদের) অভিভবকারিণী হও; অতএব, তুমি দেবগণের প্রীতির জন্য অথবা হৃদয়ে দেবভাব-সংরক্ষণের জন্য শুদ্ধ অর্থাৎ অনন্যা বিশুদ্ধা হও। (অনন্যাভক্তির সাহায্যে ভগবানকে লাভ করবার সঙ্কল্প এই মন্ত্রের অন্তর্নিহিত। [শুন্ধস্ব–শুদ্ধা অনন্যা ইতি ভাবঃ–ভবেতি শেষঃ]।(২)। হে শুদ্ধসত্ত্বাঙ্গীভূত ভক্তিরূপিণি, দেবী! তুমি সিংহীর মতো শক্তিসম্পন্না অথবা নিখিল শক্তির আধারভূতা এবং বহিরন্তঃশত্রুর (রিপুরূপ অন্তঃশত্রুগণের এবং লোভ-মোহ-প্রলোভন ইত্যাদিরূপ বহিঃশত্রুদের) অভিভবকারিণী হও। অতএব তুমি দেবগণের প্রীতির জন্য অথবা হৃদয়ে দেবভাব সংরক্ষণের জন্য অলঙ্কৃতা হও। (এই মন্ত্রেও পূর্ব-মন্ত্র দুটির অনুরূপ প্রার্থনা ও সঙ্কল্প সূচিত হয়েছে)। [শুম্ভস্ব–অলঙ্কৃতা ভব, শোভনীরা ভবেতি যাবৎ] (৩)। [এই কণ্ডিকার মন্ত্র তিনটি শুদ্ধসত্ত্বাঙ্গীভূতা ভক্তিরূপিণী দেবীর সম্বোধনে বিনিযুক্ত]

১১। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! ভগবানের মাভৈঃরূপ অভয়বাণী অর্থাৎ পরমৈশ্বর্যসম্পন্ন স্বয়ং ভগবান, আপন পরমধনমুক্ত বিভূতির দ্বারা তোমাকে পূর্বদিকে অর্থাৎ সম্মুখভাগ থেকে রক্ষা করুন।[ইন্দ্রঘোষঃ–ভগবতঃ মাভৈরিতি অভয়বাণী, পরমৈশ্বর্যসম্পন্নো ভগবান্ ইতি যাবৎ] (১)। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! প্রকৃষ্ট-জ্ঞানসম্পন্ন চৈতন্যস্বরূপ চিন্ময় ভগবান্ শত্ৰুসংহারক উগ্র-প্রভাবের দ্বারা অর্থাৎ কঠোর ভাবাপন্ন আপন বিভূতিসমূহের দ্বারা, তোমাকে পশ্চিমদিকে অর্থাৎ পশ্চাৎ-ভাগ থেকে রক্ষা করুন। [প্রচেতাঃ-প্রকৃষ্টজ্ঞানসম্পন্নঃ, চৈতন্যস্বরূপঃ চিন্ময়ো বা ভগবান; রুদ্রৈঃ–শত্ৰুসংহারকৈঃ উগ্রৈঃ প্রভাবৈঃ, কঠোরভাবাপন্নাভিঃ স্বকীয়াভিঃ বিভূতিভিঃ ইত্যর্থঃ] (২)। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! মনের ন্যায় গতিশীল অর্থাৎ মননশীল হৃদয়াধিষ্ঠিত ভগবান্ পিতৃগুণের দ্বারা অর্থাৎ স্নেহকারুণ্যপূর্ণ আপন বিভূতিসমূহের দ্বারা তোমাকে দক্ষিণদিকে অর্থাৎ দক্ষিণভাগ থেকে রক্ষা করুন। [মনোজবাঃ–মনোৎ-গতিশীলঃ, প্রকৃষ্টমননশীল, হৃদধিষ্ঠিতঃ,ভগবান্ ইতি ভাবঃ] (৩)। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! নিখিল কর্মকুশল অর্থাৎ নিখিল কর্মসমূহের আধারভূত অর্থাৎ সকল-কর্মতত্ত্ববিৎ ভগবান, অজ্ঞানতার নাশক প্রভাবের দ্বারা অর্থাৎ তত্ত্বজ্ঞানং-প্রদায়িকা আপন বিভূতিসমূহের দ্বারা তোমাকে উত্তরদিকে অর্থাৎ বামভাগ থেকে রক্ষা করুন। [বিশ্বকর্মা–নিখিল-কর্মকুশলঃ, নিখিলকৰ্মনামাধারভূতঃ, সর্বকর্মতত্ত্ববিৎ বা ভগবান্‌; আদিত্যৈঃ– অজ্ঞানতানাশকৈঃ প্রভাবৈঃ তত্ত্বজ্ঞানপ্রদায়িকাভিঃ স্বকীয়াভিঃ বিভূতিভিঃ]।(৪)। [এই মন্ত্র চারটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব,–সকল বিভূতি-পরিবৃত হয়ে ভগবান্ হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হোন এবং সকল দিক থেকে আমাকে রক্ষা করুন]। আমার হৃদয়ে বর্তমান ভগবান্ কর্তৃক সুরক্ষিত, উদ্বোধনা-প্রাপ্ত, সকর্মলব্ধ সৎ-ভাবসমূহের আধার শুদ্ধসত্ত্বকে (সৎকর্মের ফলকে) আমি আমার হৃদয়রূপ যজ্ঞদেশ থেকে, বাহ্য-প্রদেশে অর্থাৎ ভগবানে নিক্ষেপ করি–সমর্পণ করি। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক। আমার সকল কর্মফল ভগবানে সমর্পণ করি, মন্ত্রে এমন সঙ্কল্প বিদ্যমান)। [ইদং–মম হৃদি বর্তমানং ভগবতা সুরক্ষিতমিতি ভাবঃ; তপ্তং–প্রবৃদ্ধং, উদ্বোধিতমিতি ভাবঃ]। (৫)। [ভাষ্যানুসরণে মন্ত্রে উত্তরবেদির সম্বোধন আছে। এক সময়ে অসুরগণ দেবর্গকে হত্যা করতে আসেন। তখন ইন্দ্রঘোষ ইত্যাদি দেবসেনাপতিগণ সেই অসুরদের চারদিকে বিতাড়িত করেন। তারা যজ্ঞবেদি হিংসা করতে না পারে, –এই জন্য এই কণ্ডিকার প্রথম চারটি মন্ত্রে দিক চারটিতে বেদিরক্ষার প্রার্থনা সূচিত হয়েছে। ক্রিয়াকাণ্ডে হোমের জন্য বেদিরক্ষাকল্পে প্রার্থনাসূচক এই মন্ত্রগুলির যেমন প্রয়োগের বিষয় সূত্র-গ্রন্থে উল্লিখিত হয়েছে, ভাষ্যে তার আভাস পাওয়া যায়। প্রথম মন্ত্র চারটির অর্থে (ভাষ্যানুসারে) বসুনামক অষ্টসংখ্যক গণদেবতা, রুদ্ৰাখ্য একাদশসংখ্যক গণদেবতা পিতৃসংজ্ঞক স্বলোকবাসী দেববিশেষ, আদিত্যাখ্য দ্বাদশ-সংখ্যক গণদেবতা ইত্যাদির উল্লেখ পাওয়া যায়। মন্ত্রের ব্যাখ্যা-প্রসঙ্গে এই যে গণদেবতাগণের উল্লেখ, তাঁদের নাম ও সংক্ষিপ্ত পরিচয়–(১) বসু। গঙ্গা থেকে উৎপন্ন গণদেবতাবিশেষ। তাদের সংখ্যা আট–ভব, ধ্রুব, সোম, বিষ্ণু, অনিল, অনল, প্রত্যুষ ও প্রভব। বসু শব্দে যথাক্রমে কুবের, সূর্য, অগ্নি প্রভৃতিকেও বোঝায়। আমরা বসু পদে–আপন পরমধনযুক্তবিভূতি অর্থ করেছি।(২)। রুদ্র। রুদ্র বলতে প্রধানতঃ শবকে বোঝায়। কিন্তু রুদ্রদের সংখ্যা একাদশ। তাদের নাম সম্বন্ধে বিভিন্ন গ্রন্থের বিভিন্ন মত। যথা,একমতে, অজ, একপাদ, অহিব্ৰধ, পিণাকী, অপরাজিত, ত্র্যম্বক, মহেশ্বর, বৃষাকপি, শম্ভু, হর ও ঈশ্বর–এই একাদশ গণদেবতা বিশেষ। অন্য মতে–অজৈকপাদ, অহিব্রম্ন, বিরূপাক্ষ, সুরেশ্বর, জয়ন্ত, বহুরূপ, ত্র্যম্বক, অপরাজিতা, বৈবস্বত, সাবিত্র ও হর। আমরা রুদ্র পদে–ভগবানের শত্ৰুসংহারক উগ্রপ্রভাব অর্থাৎ তাঁর কঠোরভাবাপন্ন বিভূতি অর্থ করেছি)।(৩)।। পিতৃলোক সাতটি যথা, অগ্নিবৃত্ত, বহিষদ, সুভাস্বর, আজ্যপ, উপহৃত, ক্ৰবাদ ও সুকালীন। এইসব লোকে যেসব দেবতা অধিষ্ঠিত আছেন, তাঁরাই পিতৃভিঃ পদের লক্ষ্যস্থানীয়। পিতা সাতরকম– কন্যাদাতা, অন্নদাতা, জ্ঞানদাতা, ভয়ূত্রাতা, জন্মদাতা, মন্ত্রদাতা ও জ্যেষ্ঠভ্রাতা। অন্যমতে পিতা, পাঁচরকম–অন্নদাতা, ভয়ত্ৰাতা, শ্বশুর, জন্মদাতা ও উপনেতা। (আমাদের কাছে পিতৃভিঃ পদের অর্থ পিতৃগুণের দ্বারা অর্থাৎ স্নেহকারুণ্যপূর্ণ বিভূতিসমূহ)। (৪) আদিত্য। কশ্যপের ঔরসে দিতির গর্ভে দ্বাদশ আদিত্যের জন্ম। তাঁদের নাম–বিবস্বান্, অর্যমা, পূষা, ত্বষ্টা, সবিতা, ভগ, ধাতা, বিধাতা, বরুণ, মিত্র, অতিতেজা বা উরুক্রম, কালিকাপুরাণে বিধাতার পরিবর্তে সোম নামের উল্লেখ দেখা যায়। ঋগ্বেদে আদিত্যের সংখ্যা ছয়। যথা,-মিত্র, অর্যমা, ভগ, বরুণ, দক্ষ ও অংশ। এ ছাড়াও কোন স্থলে সাত, আবার কোনও স্থলে আটটি আদিত্যের নামও দেখতে পাওয়া যায়। তৈত্তিরীয় সংহিতায় আটটি আদিত্যের নাম দেখা যায়; যথা,–মিত্র, বরুণ, ধাতা, অর্যমা, অংশু, ভগ, ইন্দ্র ও বিবস্বান্। শতপথ ব্রাহ্মণে দ্বাদশ আদিত্যের উল্লেখ আছে, সেখানে তারা দ্বাদশ মাসের স্বরূপ বলে উল্লেখিত হয়েছেন। মতান্তরে আবার দ্বাদশ আদিত্য দ্বাদশ রাশিরূপেও পরিকল্পিত হন। কল্পান্তরে সূর্যপত্নী সংজ্ঞা আদিত্যের তেজ সহ্য করতে না পারায় সংজ্ঞার পিতা বিশ্বকর্মা আদিত্যকে (অর্থাৎ সূর্যকে) দ্বাদশ খণ্ডে বিভক্ত করেন। সেই দ্বাদশ খণ্ড দ্বাদশ মাসে বিভিন্ন নামে উদিত হন। যথা, মাঘ মাসে অরুণ, ফাল্গুনে সূর্য, চৈত্র মাসে বেদজ্ঞ, বৈশাখে তপন, জ্যৈষ্ঠ মাসে ইন্দ্র, আষাঢ়ে রবি, শ্রাবণ মাসে যম, ভাদ্রে যম, আশ্বিন মাসে হিরণ্যবেতা, কাৰ্ত্তিকে দিবাকর, অগ্রহায়ণে চিত্র, পৌষ মাসে বিষ্ণু।–আমাদের মতে প্রথম মন্ত্রে পরমধন মোক্ষলাভের প্রার্থনা আছে। দ্বিতীয় মন্ত্রে শত্রুনাশের প্রার্থনা–রুদ্ৰেঃ পাতু।তৃতীয় মন্ত্রে পিতৃভিঃ পাতু প্রার্থনায় স্নেহকারুণ্য ইত্যাদি সৎগুণে গুণান্বিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা দেখতে পাই। চতুর্থ মন্ত্রে আদিত্যৈঃ পাতু প্রার্থনার জ্ঞানের অধিকারী হবার কামনা প্রকাশ পেয়েছে। পঞ্চম মন্ত্রে যজ্ঞ বলতে আমরা মানস-যজ্ঞকে বুঝি। হৃদয়-রূপ যজ্ঞপ্রদেশে সেই মানস-যজ্ঞের অনুষ্ঠান হয়েছে। সেই যজ্ঞের ফললাভ হলো–শুদ্ধসত্ত্ব সেই শুদ্ধসত্ত্বকে যজ্ঞপ্রদেশ বা হৃদয় হতে গ্রহণ করে যজ্ঞাৎ বহির্ধা অর্থাৎ হৃদয়ের বহির্ভাগে ভগবানে অর্পণ করা হচ্ছে। ফললাভ এই হবে যে, তার দ্বারা আকৃষ্ট হয়ে ভগবান্ হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হবেন এবং মানসযজ্ঞে পূর্ণাহুতি প্রদান করবেন]।

১২। হে শুদ্ধসত্ত্বাঙ্গীভূতে ভক্তিরূপিণী ৬ দেবি! তুমি সিংহীর মতো শক্তিসম্পন্না অর্থাৎ সকল শক্তির আধারভূতা হও। কর্ম-শক্তিলাভের জন্য, তোমাকে স্বাহা-মন্ত্রে আবাহন অর্থাৎ পূজা করছি। আমার অনুষ্ঠান সুহুত হোক। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক। ভক্তির দ্বারা ভগবৎ-পূজার সামর্থ্য লাভ করব,–এখানে এমন সঙ্কল্প দ্যোতিত হচ্ছে)। [সিংহী সিংহীসমানা শক্তিসম্পন্না, সর্বক্তয়োরাধারভূতা ইত্যর্থঃ]](১)। হে শুদ্ধসত্ত্বাঙ্গীভূতে ভক্তিরূপিণি দেবি! তুমি সিংহীর মতো শক্তিসম্পন্না অর্থাৎ সর্বশক্তিরূপিণী হও; প্রজ্ঞানময়ী অর্থাৎ বিবেকরূপিণী তোমাকে (প্রজ্ঞান লাভের জন্য) স্বাহা-মন্ত্রে আবাহন অর্থাৎ পূজা করি; আমার সঙ্কল্প সুসিদ্ধ হোক। (এই মন্ত্রটি সঙ্কল্প-মূলক। প্রজ্ঞানলাভের জন্য সাধক এই মন্ত্রে ভগবানের অনুগ্রহ কামনা করছেন)। [আদিত্যবনিঃ– প্রজ্ঞানময়ী, বিবেকরূপিণী] (২)। হে শুদ্ধসত্ত্বাঙ্গীভূতে ভক্তিরূপিনি দেবি! তুমি সিংহীর মতো শক্তিসম্পন্না অর্থাৎ সর্বশক্তিস্বরূপিণী। হও; ব্রাহ্মণ-ভাবাপন্না অর্থাৎ সত্ত্বাগুণণাপেতা ব্রহ্মস্বরূপা এবং ক্ষত্ৰভাবোপেতা রজোগুণসম্পন্না তোমাকে (সত্ত্ব রজঃ ইত্যাদি গুণলাভের জন্য) অথবা ত্রিগুণ-সাম্যের জন্য স্বাহা-মন্ত্রে পূজা করি অর্থাৎ হৃদয়ে প্রতিষ্ঠাপিত করি; আমার অনুষ্ঠান সুহুত হোক। (এই মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। এ মন্ত্রে সাধক ভগবৎ-অনুকম্পা লাভের জন্য আপন হৃদয়ে ভগবৎ-ভাব শুদ্ধসত্ত্ব প্রার্থনা করছেন। [ব্রহ্মবনিঃ–ব্ৰহ্মণভাবাপন্না, সত্ত্বগুণোপেতাঃ- ব্রহ্মস্বরূপা; ক্ষত্রবণিঃ–ক্ষত্ৰভাববাপেতা, রজোগুণসম্পন্না] (৩)। হে শুদ্ধসত্ত্বাঙ্গীভূতে ভক্তিরূপিণি দেবি! তুমি সিংহীর মতো শক্তিসম্পন্না অর্থাৎ সর্বশক্তিরূপিণী হও। সৎ-ভাবের জনয়িত্রী, পরমার্থরূপ ধনের পোষণকারী তোমাকে (সৎ-ভাব উৎপাদনের জন্য এবং পরমার্থ লাভের জন্য)। স্বাহা-মন্ত্রে পূজা করি অর্থাৎ হৃদয়ে প্রতিষ্ঠিত করি; আমার সঙ্কল্প সুসিদ্ধ হোক। (মন্ত্রটি সঙ্কল্প-মূলক। এই মন্ত্র পরমার্থ লাভের জন্য সাধকের সঙ্কল্প বিজ্ঞাপিত করছে। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে দেবি! আমাকে সম্ভাবসম্পন্ন করুন এবং আমাকে পরমার্থ প্রদান করুন)। [সুপ্রজাবনিঃসৎ-ভাবানাং জনয়িত্রী; রায়স্পোষবনিঃ–পরমার্থরূপধনস্য পোষয়িত্রী]।(৪)। হে শুদ্ধসত্ত্বাঙ্গীভূতে ভক্তিরূপিণি দেবি! তুমি সিংহীর মতো শক্তিসম্পন্না অর্থাৎ সর্বশক্তিস্বরূপিণী হও। তুমি (আপন শক্তির প্রভাবে) যজমানের উপকারের জন্য অর্থাৎ আমাকে অনুগ্রহ করাবার জন্য অথবা লোকহিতের জন্য শুদ্ধসত্ত্বরূপ দেবভাব-সমূহকে আনয়ন করো অর্থাৎ আমার হৃদয়ে প্রতিষ্ঠাপিত করো।(প্রার্থনামূলক এই মন্ত্র সৎ-ভাবের সঞ্চয়ে সাধকের সঙ্কল্প সূচনা করছে। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে দেবি! আমাকে সম্ভব পরমার্থ প্রদান করো) (৫)। হে শুদ্ধসত্ত্বাঙ্গীভূতে ভক্তিরূপিণি দেবি! ভূতসমূহের বা লোকসমূহের পালনের জন্য অর্থাৎ জগতের উপকারের জন্য বিশ্বের সেবায় তোমাকে স্বাহা-মন্ত্রে নিয়োজিত করি অর্থাৎ উদ্বোধিত করি। (বিশ্বের সেবায় বা লোকহিতসাধনের জন্য এই মন্ত্রে সঙ্কল্প বিদ্যমান। জগতের উপকারের জন্য অর্থাৎ বিশ্বের সেবায় আমি আমার হৃদয়গত শুদ্ধসত্ত্ব বিমিশ্র ভক্তিকে নিয়োজিত করি–মন্ত্রটি এমন সঙ্কল্পমূলক)। [ভূতেভ্যঃ–ভূতানাং লোকানাং বা পালনয়ে, জগদুপকারায়, বিশ্বসেবায়েতি ভাবঃ] (৬)। [এই কণ্ডিকার মন্ত্রগুলির সাথে যে উপাখ্যানের সম্বন্ধ সূচিত হয়, তা এই,–কোনও কারণে উত্তরবেদিদেবতা দেবতাদের পরিত্যাগ করে অসুরদের আশ্রয় করেন। সেইসময় সিংহরূপ ধারণ করে তিনি দেবতাদের ও অসুরদের সৈন্যের মধ্যস্থলে এসে অবস্থিত হন। এই উপাখ্যান অবলম্বনেই ভাষ্যের সূচনা] ।

১৩। হে আমার মন! তুমি স্থির অবিচলিত হও; তোমার আধারক্ষেত্র বা সৎ-বৃত্তির মূলকে দৃঢ় করো। (অবিচলিত মনের দ্বারা সৎবৃত্তি সঞ্চয় করব–মন্ত্রে এমন সঙ্কল্প বিদ্যমান)। [ধ্রুবঃ–স্থির, অবিচলিতঃ ইত্যর্থঃ পৃথিবীং–আধারক্ষেত্রং, তব সবৃত্তিমূলং] (১)। হে আমার হৃদয়-নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি সত্যে সৎস্বরূপে বাসয়িতা অথবা সত্যের ৬ সৎস্বরূপের আধারভূত হও। অন্তরিক্ষের মতো অনন্তপ্রসরিত তোমার সকর্মমূলকে দৃঢ় করো। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। মন্ত্ৰার্থ-হে দেব! আমাকে সকর্ম সাধনের সামর্থ্য প্রদান করুন)। [বক্ষিৎ–সত্যে স্বসস্বরূপে বা বাসয়িতা, অথবা সত্যস্য সৎস্বরূপস্য বা আধারভূতঃ]।(২)। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি বিনাশরহিত ভগবানে বাসয়িতা অথবা অক্ষর পরব্রহ্মের আধারস্বরূপ হও। তুমি হৃদয়রূপ দেবস্থানকে অথবা পরমসুখমূলকে দৃঢ় করো।(শুদ্ধসত্ত্ব ভগবানের স্বরূপ এবং পরমসুখনিদান। শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে যাতে আমি পরমসুখনিদান ভগবানকে প্রাপ্ত হই, হে দেব! তার বিধান করুন)। [অচ্যুতক্ষিৎ– বিনাশারহিতে ভগবতি নিবসয়িতা, অথবা অক্ষরব্রহ্মণঃ আধারস্বরূপঃ]।(৩)। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি জ্ঞানাধার ভগবানের অথবা প্রজ্ঞানের পূরক অর্থাৎ পূর্ণতাসাধক হও। (অতএব আমাকে পূর্ণজ্ঞান প্রদান করো)। [অগ্নে–জ্ঞানধারস্য ভগবতঃ, যদ্বা প্রজ্ঞানস্য; পুরীষং–পূরকঃ, পূর্ণতাসাধকঃ] (৪)।

১৪। মহত্ত্ব ইত্যাদি গুণোপেত, সর্বসাধনক্ষম, সর্বতত্ত্বজ্ঞ, ত্রিকালজ্ঞ, প্রাপ্তকর্মশক্তি, ধর্মতত্ত্ববিৎ, ত্রিকালদর্শীর পরমার্থতত্ত্বপ্রকাশক হে সৎ-গুণাবলি! তোমাদের অনুগ্রহে অন্তঃকরণ নির্মল হয়ে পরমাত্মায় যুক্ত হয়; আরও, তোমাদের অনুগ্রহে চিত্তবৃত্তি সমূহও পরমাত্মায় যুক্ত হয়; সৎকর্মসাধক দেবভাবসমূহের আনয়নকর্তা হে বিপ্রগুণাবলি! তোমাদের অনুগ্রহে মনঃ ও ধী, সর্বসাক্ষী সকলের মনস্তত্ত্ববিৎ অন্তর্যামী সেই ভগবান্ যে অদ্বিতীয়–এ তত্ত্ব ধারণ করে অর্থাৎ জানতে সমর্থ হয়; আরও, তোমাদের অনুগ্রহে জ্ঞানপ্রেরক, জ্ঞানময় জ্ঞানাধার অর্থাৎ বিশ্বপ্রসবিতা দীপ্তিদান ইত্যাদি গুণযুক্ত ভগবানের মহতী অর্থাৎ সকলের বরণীয় নিত্যস্তুতি বা নিত্যাৰ্চনা স্বাহামন্ত্রে উদ্যাপিত হয়। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যতত্ত্বপ্রকাশক)। সাধু-সজ্জনগণই পরমার্থপথপ্রদর্শক। মানুষ যদি তাঁদের আদর্শ অনুসরণে উদ্বুদ্ধ হয়, তাদের অভীষ্টসিদ্ধি হয়ে থাকে)। অথবা মহৎ অর্থাৎ সৎকর্মফলপ্রদাতা সর্বতত্ত্বজ্ঞ অন্তর্যামী জ্ঞানময় বিরূপী ভগবানের সৎ-ভাবপ্রেরক সত্ত্বভাবজনক বিভূতিসমূহ, অজ্ঞানজনের আত্মাকে ভগবানের সাথে সংযোজিত বা সংবদ্ধ করে; অথবা, ভগবৎপ্রাপ্তির নিমিত্ত সুন্বত বা পবিত্র করে; অজ্ঞানজনে অনুগ্রহ জন্য, দেবভাবসমূহের জনয়িতা অর্থাৎ সর্বসিদ্ধিপ্রদ ভগবৎ-বিভূতিসমূহ, অদ্বিতীয় অন্তর্যামী ভগবানকে ধারণ করায় অর্থাৎ অজ্ঞানদের উপলব্ধি করায়; তাদের অনুগ্রহে প্রজ্ঞানাধার ভগবানের মহৎ স্তুতি বা পূজা স্বাহা-মন্ত্রের দ্বারা সম্পাদিত হয় অথবা সাধকগণ কর্তৃক উদযাপিত হয়। (মন্ত্রটি সত্যতত্ত্বপ্রকাশক; ভগবৎ প্রেরণা ভিন্ন মানুষ কোনও সৎকর্মর্সাধনেই সমর্থ হয় না। অতএব সকর্ম সাধনের জন্য ভগবানের অনুগ্রহ লাভ কর্তব্য। তার দ্বারা সকল অভীষ্ট সিদ্ধ হয়)। [বৃহতঃমহতঃ, মহত্ত্বাদিগুণোপেতস্য, সর্বসাধনসম্পন্নস্য; বিপশ্চিতঃ–সর্বতত্ত্বজ্ঞস্য, ত্রিকালজ্ঞস্য; বিপ্রস্য–প্রাপ্তকর্মশক্তেঃ, ধর্মকর্মতত্ত্ববিদ, ত্রিকালদর্শিনঃ ইতি যাবৎ; বিপ্রঃ–পরমার্থতত্ত্বদর্শকাঃ হে সদ্গুণাদয়ঃ; মনঃ অন্তঃকরণং; ইত্যাদি। অথবা-বৃহতঃ–সর্বকর্মফলপ্রদাতুরিত্যর্থঃ; বিপশ্চিতঃ–অন্তর্যামিনঃ, জ্ঞানময়স্য; বিপ্রস্য–বিপ্ররূপস্য ভগবতঃ; বিপ্রাঃ–সদ্ভাবপ্রেরয়িঃ । সত্ত্বভাবজয়িত্র্যঃ বিভূতয়ঃ; মনঃ–আত্মানং–অজ্ঞানানামীতি ভাবঃ; ইত্যাদি] (১)

১৫। বিশ্বব্যাপী পরমেশ্বর বিষ্ণু এই সমগ্র জগৎকে বিশেষভাবে ব্যেপে আছেন; অতীত অনাগত বর্তমান–তিন কালেই তাঁর ঐশ্বর্য ধৃত (অক্ষুণ্ণ) রয়েছে; অথবা তিনি ধারণ করে আছেন; সেই বিষ্ণুর জ্যোতিময় পদে (প্রভুত্বে) এই নিখিলজগৎ সম্যভাবে অবস্থিত আছে। সেই বিষ্ণুকে স্বাহা-মন্ত্রে পূজা করি; আমার অনুষ্ঠান সুহুত হোক। (এই মন্ত্রে বিষ্ণুর স্বরূপ পরিবর্তিত রয়েছে। বিশ্বব্যাপক বিষ্ণুর প্রভুত্বে নিখিল জগৎ সদাকাল অবস্থিত। বিষ্ণুই বিভূতিস্বরূপে অণুপরমাণুক্রমে বিদ্যমান্ সকলকে অধিকার করে আছেন)। অথবা বিশ্বব্যাপী পরমেশ্বর বিষ্ণু বিশ্ব-ব্রহ্মাণ্ড বিশেষভাবে ব্যেপে আছেন অর্থাৎ স্থাবরজঙ্গমাত্মক সকল প্রাণীর মন ও জীবভাব সকলের মধ্যেই অনুঃপ্রবিষ্ট রয়েছে; অগ্নি-বায়ু-সূর্যরূপে পৃথিবীতে অন্তরিক্ষে এবং স্বর্গলোকে তার মাহাত্ম্য নিরন্তর বিধৃত বা নিহিত রয়েছে; সেই বিষ্ণুর বিজ্ঞানঘনানন্দ-অজ-অদ্বৈত-অক্ষর-লক্ষণযুক্ত পরম পদ বা স্বরূপ, অতি নিগূঢ় প্রদেশে নিহিত অর্থাৎ অজ্ঞানের নিকট অপরিজ্ঞাত; সেই বিষ্ণুর স্বাহা-মন্ত্রে পূজা করি; আমার অনুষ্ঠান সুহুত হোক। (মন্ত্রটি ভগবানের স্বরূপ বর্ণন করেছে। বিশ্বব্যাপক বিষ্ণুর মাহাত্ম্য জগৎ-বিশ্রুত। সেই বিষ্ণুর অদ্বৈত অক্ষর স্বরূপ সূরিগণই দর্শন করতে পারেন; অজ্ঞজন তা উপলব্ধি করতে সমর্থ হয় না)।(১)। [বিষ্ণুঃ বিশ্বব্যাপী পরমেশ্বরঃ; ত্রেধা অতীতানাগতবর্তমানত্রিকালমেব; পাংসুরে-রশ্মিকণাযুক্ত প্রভুত্বে, জ্ঞানস্বরূপে পদে; ইত্যাদি। ত্রেধা–অগ্নিবায়ুসূর্যরূপেণ ভূম্যন্তরিক্ষদুলোকেষু ত্রিধা; পাংসুরে–পাংসুল ইব প্রদেশে অতিনিগূঢ়প্রদেশে ইতি ভাবঃ; ইত্যাদি]। [ভাষ্যে ত্রেধা পদে তিনবার এবং বিচক্ৰমে পদে ভ্রমণ করেছিলেন–এইরকম অর্থ পরিগ্রহ করা হয়। পদং পদে পা এবং নিদধে পদে ধারণ বা রক্ষা করেছিলেন–এইরকম অর্থ পরিগ্রহ করা হয়। তারপর পাংসুলে পদে ধূলিকণায় এবং সমূঢ়ং পদে সমাবৃত হয়েছিল, এইরকম অর্থ স্থির হয়ে যায়। তাতে এক শ্রেণীর ব্যাখ্যাকারের ব্যাখ্যায় মন্ত্রের ভাব দাঁড়িয়ে গেছে,–বিষ্ণু যখন মধ্য এশিয়া থেকে দলবল সহ এ দেশে আসছিলেন, তখন পথে তিনি তিন স্থানে বিশ্রাম করেছিলেন এবং তার চরণধূলিতে জগৎ পরিব্যাপ্ত হয়েছিল। কেউ বা, বিষ্ণুর পদধূলিতে জগৎ আচ্ছন্ন–এমন উক্তি থেকে জগতে বিষ্ণুর অধিপত্য বিস্তৃত হয়েছিল বলে মনে করেন। কেউ বা বিষ্ণুকে সূর্য জ্ঞান করে সূর্যরশ্মির বিষয় ধূলি-বিস্তৃতির উপমায় ব্যক্ত হয়েছে সিদ্ধান্ত করে নেন]

১৬। যেহেতু হে বিষ্ণু তোমার প্রশাসনে এই দ্যাবাপৃথিবী শস্যবতী, গবাশ্ব ইত্যাদি পশুসমূহযুক্ত, শোভন অন্নবতী বা সুশস্যবতী এবং মানবগণের উপকারের জন্য যজ্ঞসাধন দ্রব্য ইত্যাদির প্রদাত্রী হয়; সেই হেতু। হে বিশ্বব্যাপক ভগবন্! তুমি এই দ্যাবাপৃথিবীকে বিশেষভাবে স্তম্ভিত বা ব্যাপ্ত করো; অপিচ আপন তেজের,শক্তির বা মাহাত্মের দ্বারা এই পৃথিবীকে সব রকমে ধারণ করো। এইরকম মহিমাপেত তোমাকে স্বাহামন্ত্রে পূজা করি। (মন্ত্রটি ভগবানের মাহাত্ম-প্রকাশক। সকল বস্তুতেই ভগবান সমভাবে করুণাসম্পন্ন। ভগবান তাদের অভ্যন্তরে অবস্থিত আছেন। তাদের সৃষ্টি-স্থিতি-লয়ও ভগবানের লীলা সাপেক্ষ। বিশ্বব্যাপক সেই ভগবান্ সকলেরই পূজনীয় এটাই ভাবার্থ)। অথবা–হে বিশ্বব্যাপক দেব! তোমার অনুগ্রহেই হৃদয়-নিহিত জ্ঞান ও ভক্তি স্নেহকারুণ্যরূপিণী, সৎ-ভাবরূপ শোভন অপত্যের জনয়িত্রী, প্রজ্ঞানবতী, সৎকর্মের সুফল বা মোক্ষ প্ৰদাত্রী, মানবের উপকারের জন্য বা বিশ্বের মঙ্গলের জন্য সৎকর্মের সাধন-সামর্থ্য-প্রদাত্রী হয়। অতএব, সেই জ্ঞান ও ভক্তিকে তুমি বিশেষভাবে স্তম্ভিত করো, অর্থাৎ ব্যোপে অবস্থিত করো; অপিচ আপন তেজের বা মহিমার দ্বারা সেই জ্ঞানভক্তির আধারমূলকে সর্বতোভাবে ধারণ করো। এইরকম মহিমোপেত তোমাকে স্বাহা-মন্ত্রের দ্বারা পূজা করি। (মন্ত্রটি ভগবানের মাহাত্ম-প্রকাশক। সকল সৎ-ভাবের আধারস্থানীয় ভগবানের কৃপায় আমাদের মধ্যে সৎ-ভাবের উন্মেষ হোক, মন্ত্রের এটাই ভাবার্থ)। [ইরাবতী–শস্যবতৌ; ধনুমতী–গবাশ্বাদিভিঃ পশুভিযুক্তে; সূয়বসিনী–শোভনান্নরত্যৌ, সুশস্যবত্যৌ বা; মনবে–মানবুপকারায়, দশস্যা যজ্ঞসাধনানাং দাত্যৌ; ইত্যাদি। অথবা–ইরাবতী–স্নেহকারুণ্যরূপিণ্যৌ, সৎ-ভাবরূপাণাং শোভনাপত্যানাং জনয়িত্ৰেী; ধেনুমতী–প্রজ্ঞানবত্যৌ, সূয়বসিনী–সঙ্কর্ম-ফলং মোক্ষং বা দাৗ, মনবে–বিশ্বহিতায়েতি; দশস্যা–সকর্মসাধনসামর্থপ্রদাৗ ইত্যাদি।(১)

১৭। দেবগণের আহ্বানকারী হে হৃদয়-নিহিত জ্ঞানভক্তি! সৎকর্ম-সাধন-সামর্থ্য-প্রদানকারী তোমরা (আমার হৃদয়ে) দেবভাব শুদ্ধসত্ত্ব আনয়ন করো। (মন্ত্রটি-প্রার্থনামূলক। হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্ব সঞ্চয়ের জন্য এখানে প্রার্থনা আছে)। [দেবশ্রুতৌ–দেবানাং আহ্বায়িত্রৌ হে হৃন্নিহিতে জ্ঞানভক্তি]।(১)। হে হৃদয়-নিহিত জ্ঞানভক্তি! তোমরা প্রাজুখে অর্থাৎ ভগবানের নিকটে প্রকৃষ্টরূপে গমন করো। অথবা আমাকে নিয়ে যাও; অপিচ হে হৃদয়-নিহিত জ্ঞান ভক্তি! তোমরা আমার অনুষ্ঠিত সঙ্কর্ম দেবগণের অর্থাৎ ভগবানের প্রতি সংবাহিত করো অথবা ভগবানকে প্রাপ্ত করাও; আরও, হে হৃদয়নিহিত জ্ঞানভক্তি! তোমরা কুটিল হয়ে অর্থাৎ আমাকে পরিত্যাগ করো না, অথবা বিচলিত হয়ো না অর্থাৎ অবিচলিতভাবে আমার হৃদয়ে অবস্থিতি করো। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। জ্ঞান ও ভক্তি উভয়েই সৎকর্মের সহায়ক। তাদের অনুকম্পায় ভগবৎ-প্রাপ্তি সুগম হয়। ভাব এই যে, হে জ্ঞান ও ভক্তি। তোমরা আমাকে সৎকর্মপরায়ণ করো এবং ভগবৎ-প্রাপ্তি-সামর্থ্য দাও)। [প্রাচী–প্রাজুখে–ভগবৎসকাশে ইতি ভাবঃ; অধ্বরং কল্পয়ন্তী– সৎকর্মসাধনসামর্থ্যপ্রদাৗ; মা জিহ্বরতং-মা কুটিলে ভবতং]।(২)। হে দ্যোতনাত্মিকে দেবভাবজনয়িত্রে হে গৃহভূতে অর্থাৎ সৎ-ভাবসমূহের আধারভূতে ভক্তিরূপিণি দেবি! তুমি আমার, হৃদয়রূপ আধার স্থানকে সর্বতো ভাবে প্রাপ্ত হত; অপিচ, আমার পূর্ণ-আয়ুঃ কালকে নিরাকৃত বা নাশ করো না। আরও, আমার সৎ-বৃত্তি-সমূহকে নিরাকৃত বা নাশ করো না। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভগবানের অনুকম্পায় হৃদয়ে ভক্তি-ভাব পরিবৃদ্ধি হয়। সৎবৃত্তি এবং সৎ-ভাবের দ্বারা পূর্ণ-আয়ুকাল প্রাপ্ত হয়ে সাধনার প্রভাবে ভগবানকে লাভ করি– এই ভাব মন্ত্রের অন্তর্নিহিত)। [দেবি–হে দ্যোতনাত্মিকে দেবভাবজনয়িত্রে; দুর্যে–হে গৃহভূতে, সৎ-ভাবানামাধারভূতে; প্রজাং–মম সবৃত্তিঃ] (৩)। হে আমার হৃদয়-নিহিত জ্ঞানভক্তি! তোমরা এই শরীরভূত দেব্যজনে অর্থাৎ আমার এই সঙ্কর্মে অথবা আমার হৃদয়ে ক্রীড়া করো অর্থাৎ সর্বদা বর্তমান থাকো। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক; আমাতে জ্ঞানভক্তি অবিচলিতভাবে অবস্থিত থাকুক এবং তার দ্বারা আমার অভীষ্ট লাভ হোক, মন্ত্রে এমন প্রার্থনা দ্যোতিত)। [পৃথিব্যা বৰ্ম্মন্ শরীরভূতে দেবযজনে; রমেথাং-ক্রীড়াং কুরুতং, সদা তিষ্ঠতমিত্যর্থঃ] (৪)। [এই কণ্ডিকার চারটি মন্ত্রের মধ্যে তৃতীয়টি ভক্তিরূপিণী দেবী সম্বোধনে এবং অবশিষ্টগুলি জ্ঞানভক্তির সম্বোধনে প্রযুক্ত]।

১৮। যে বিষ্ণু পৃথিবীসম্বন্ধী পঞ্চভূতাত্মক সারভূত কারণসমূহ অর্থাৎ নিখিল অনুপরমাণুজাত সৃষ্টির উপকরণসমূহ নির্মাণ করেছেন, সেই বিশ্বব্যাপক ভগবানের অলৌকিক কার্যের মহাত্ম্যের বিষয় আমরা নিত্যই কীর্তন করছি বা করে থাকি। (ভাবার্থ-L. ভগবানের মহিমা আমাদের নিত্যপ্রত্যক্ষীভূত)। [যঃ–যো বিষ্ণু; বিষ্ণোঃ–বিশ্বব্যাপস্য ভগবতঃ;. বীর্যানি–অলৌকিককার্যানি, মাহাত্মনীতি ভাবঃ]।(১)। সকল প্রাণীর মনোজীবভাব-সমূহের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট, অথবা অগ্নি-বায়ু-সূর্যরূপে পৃথিবী-অন্তরিক্ষ-দুলোকে আপন মহিমা-বিজ্ঞাপক, মহাত্মগণের আরাধনায় যে বিষ্ণু অর্থাৎ ভগবান্ শ্রেষ্ঠস্থানীয় তিন লোকের আশ্রয়ভূত অন্তরিক্ষকে অর্থাৎ দেবভাব সমূহের আধারস্থান সাধনসম্পন্নগণের হৃদয়কে মন্থন করেন অর্থাৎ অজ্ঞান-মাহে স্থানভ্রষ্ট হয়ে যাতে, অধঃপতিত না হয়, এমনভাবে যিনি ধারণ করেন। [ত্রেধা বিচক্ৰমাণঃ–সর্বপ্রাণিনো মনোজীবভাবেষু অনুপ্রবিশ্যমানঃ, যদ্বা–অগ্নিবায়ুসূর্যরূপেণ ভূম্যন্তরিদ্যুলোকে স্বমাহাত্ম্যবিজ্ঞাপকর; উরুগায় মহাত্মভিগীয়তঃ, ক্রান্তদর্শিভিঃ স্তুতঃ] (২)। সেই বিশ্বব্যাপক ভগবানের প্রীতির জন্য, হে হৃদয়-নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব, তোমাকে নিয়োজিত করছি। [বিষ্ণবে–বিশ্বব্যাপকায় ভগবৎপ্রীতয়ে] (৩)। [বিশ্বপ্রকাশক সেই ভগবান সকলের আরাধনীয়। তিনি সকল প্রাণীর মনোজীবভাবের মধ্যে অনুপ্রবিষ্ট হয়ে তাদের। সর্বদা সকল সময়ে নিয়মিত করেন, কেবল তারই অনুগ্রহে মানুষ চিত্তের উৎকর্ষ লাভ করে। মোক্ষেছু ব্যক্তি সেই ভগবানের প্রীতির জন্য সারভূত শুদ্ধসত্ত্বকে নিবেদন করেন। মন্ত্র তিনটির এই তাৎপর্য।

১৯। হে বিশ্বব্যাপক ভগবন্! আপনি দ্যুলোক বা স্বর্গলোক থেকে অপিচ পৃথিবী বা ভূলোক থেকে এবং মহৎ অনন্তপ্রসারিত অন্তরিক্ষলোক থেকে সমানীত ধনের দ্বারা আপনার উভয় হস্তই পূর্ণ করুন এবং দক্ষিণ ও বাম উভয় হস্ত থেকে (দ্বারা) অর্থাৎ মুক্তহস্তে বা কৃপণতারহিত হয়ে (সেই ধন) আমাদের প্রদান করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভগবান্ কার্পণ্যরহিত হয়ে আমাদের প্রতি তাঁর করুণাধারা বর্ষণ করুন এবং সর্বলোক থেকে শুদ্ধসত্ত্বরূপ পরমধন এনে আমাদের মধ্যে স্থাপন করুন,-মন্ত্রে এই ভাব পরিব্যক্ত)।(১)। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! বিশ্বব্যাপক ভগবানের প্রীতির জন্য তোমাকে নিবেদন করছি। [পূর্বের মন্ত্রে অধ্বর্যু যেমন বিষ্ণবে ত্বা (সেই বিশ্বব্যাপক ভগবানের প্রীতির জন্য হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্বকে নিয়োজিত করি) প্রভৃতি মন্ত্রে দক্ষিণ শকটের স্থণা (কাষ্ঠ) নিখনন করবেন, তেমনই প্রতিপ্রস্থাতা এই মন্ত্রে উত্তর শকটে তেমনই কার্য সম্পন্ন করবেন। এটাই মন্ত্রের প্রয়োগবিধি। মন্ত্রটির লৌকিক অর্থ-গ্রহণে ভাষ্যকার মন্ত্রের অন্তর্গত বসুনা পদে মণিমুক্তা ইত্যাদি পার্থিব ধনঅর্থ পরিগ্রহণ করেছেন। কিন্তু আমরা ঐ পদের লৌকিক অর্থের সঙ্গে সঙ্গে এক অলৌকিক অর্থ অধ্যাহার করি। ভগবানের করুণায় যেমন পার্থিব ধনৈশ্বর্য লাভ হয়, তেমনি পরমার্থধনও প্রাপ্ত হওয়া যায়। যিনি যেমন অধিকারী, যিনি তার কাছে যেমন ধনলাভের আকাঙ্ক্ষা করেন, তার তেমন ধনই অধিগত হয়ে থাকে। সাধক যিনি, আত্মজ্ঞানসম্পন্ন যিনি, তিনি, পার্থিব-ধনলাভের প্রলোভনের অতীত; তাঁর লক্ষ্য–পরমার্থধনের প্রতি। ভগবানের কাছে তিনি সেই ধনই যাচ্ঞা করে থাকেন। তাই আমরা, বসুনা পদের ভাষ্যাতিরিক্ত পরমধনের–শুদ্ধসত্ত্বারূপেণ অর্থ অধ্যাহার করলাম।–এইভাবেই আমাদের অনুবাদ লৌকিক পর্যায়কে অতিক্রম করে আধ্যাত্মিকতার প্রকাশক হয়ে উঠেছে(২)।

২০। যে বিশ্বব্যাপক ভগবানের অনন্তপ্রসারিত মহৎ পৃথিবী অন্তরিক্ষ ও স্বর্গরূপ তিন লোকে অথবা অগ্নি-বায়ু-সূর্য তিন রূপে বিদ্যমান বা অবস্থিত বিশ্বের সকল ভূতজাতসমূহ প্রকাশমান রয়েছে; সিংহের ন্যায় যিনি ভীষণ অর্থাৎ সিংহ যেমন অন্যান্য প্রাণীর হননের জন্য তাদের ভীতিজনক, তেমন ভগবানও পাপরূপ বৈরিগণের হননহেতু পাপাত্মগণের ভীতি উৎপাদক, অথবা যিনি পাপত্মগণকে পরিশুদ্ধ করে পাপসম্বন্ধ নাশ করেন, যিনি শত্রুদের বা পাপাত্মগণের ভীতিজনক, যিনি প্রলয়কালে অনন্তশায়ী অথবা মৎস্য ইত্যাদি রূপে পৃথিবীর ধারণ কর্তা অথবা সর্বলোকে সর্বত্রসঞ্চারী বিশ্বব্যাপী, যিনি বেদমন্ত্র ইত্যাদি বাক্যে আত্মারূপে অধিষ্ঠিত অথবা দেহের মধ্যে অন্তর্যামিরূপে বিরাজিত, সেই মহানুভাব ভগবান্ আপন বীরকার্যের বা মহিমার দ্বারা সকলের কর্তৃক প্রকৃষ্টভাবে স্তুত হন। (মন্ত্রটি ভগবানের মাহাত্ম প্রকাশক। চেতন অচেতন সকলের মধ্যেই ভগবান্ অন্তর্যামিরূপে বিরাজমা। তিনি সকলের বন্দনীয়। প্রার্থনার ভাব এই যে, হে মন! তুমি ভগবানের শরণ গ্রহণ করো, তার দ্বারাই সকল অভীষ্ট সিদ্ধ হবে)। [মৃগো ন ভীমঃ সিংহ ইব ভীষণঃ; অথবা, মৃগঃ–শুদ্ধোপহতপাপ্পা, পাপসম্বন্ধং নাশয়িতা বা; ন (এবং) ভীমঃ –শক্ৰণাং পাপাত্মনাং বা ভীতিজনকঃ; কুচরা–প্রলয়কালে অনন্তশায়ী, মৎস্যাদিরূপেণ পৃথিবীং ধারয়িতা বা; গরিষ্ঠা– গিরিবদুচ্ছিতলোকস্থায়ী, বেদমন্ত্রাদিরূপায়াং বাঁচি আত্মত্বেন অধিষ্ঠিতঃ]। [এই মন্ত্রের অন্তর্গত মৃগো ন ভীমঃ কুচরো গিরিষ্ঠাঃ মন্ত্রাংশটি সম্বন্ধে নানা বিতর্ক উপস্থিতি হয়। যাস্ক, উবট, মহীধর, সায়ন–ঐ অংশের নানারকম অর্থ-নিষ্কাশনে প্রয়াস পেয়েছেন; কিন্তু তার প্রকৃত তাৎপর্য যে কি, সেই বিষয়ে কেউই স্থির-সিদ্ধান্তে উপস্থিত হতে পারেন নি। তাদের ব্যাখ্যায় মৃগো ন ভীমা অংশ কখনও উপমার মধ্যে ৬ পরিগণিত হয়েছে, কখনও বা তাঁরা ঐ অংশকে উপমারূপে গ্রহণ করেন নি। এইরকম ভাষ্য ব্যাখ্যাগুলিতে। দুটি পক্ষ পরিগৃহীত হয়েছে। একটি লৌকিক পক্ষ, অপরটি দেবপক্ষ। লৌকিক পক্ষে মৃগোন ভীমঃ অংশটি উপমা বলে ধরা হয়েছে, আর দেবতাভিধানে নপদ পাদপূরণে ব্যবহৃত বলে উপমা পরিত্যক্ত হয়েছে। মৃগো ন ভীমঃ অংশকে উপমা বলে স্বীকার করে লৌকিক প্রয়োগ-অনুসারে মন্ত্রের যে অর্থ, প্রচলিত আছে, তা এই–যেহেতু বিষ্ণুর তিন পদক্ষেপে সমস্ত ভূবন অবস্থিতি করে, অতএব ভয়ঙ্কর হিংস্র, গিরিশায়ী আরণ্য-জন্তুর মতো বিষ্ণুর বিক্রম লোকে প্রশংসা করে।–এ রকম অর্থে মন্ত্রের যে কি ভাব প্রকাশ পায়, সুধীগণেরই তা বিচার্য (১-২)।

২১। হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি বিশ্বব্যাপক ভগবানের ললাটরূপ শ্ৰেষ্ঠস্থানবর্তী হও। (মন্ত্রটি সত্ত্বতত্ত্ব-প্রকাশক। শুদ্ধসত্ত্ব ভগবানের স্বরূপ। শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারাই ভগবানকে লাভ করা যায়)। [বিষ্ণোঃ বিশ্বব্যাপকস্য ভগবতঃ] (১)। হে জ্ঞানভক্তি! তোমরা বিশ্বব্যাপক ভগবানের কর্মের অর্থাৎ আমার অনুষ্ঠিত সত্যকর্মের সাথে লিপ্ত থাকো; অথবা, বিশ্বব্যাপক ভগবানের সাথে, আমার অনুষ্ঠিত সকর্মের সংযোজক হও। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধনামূলক। আমার অনুষ্ঠিত সঙ্কর্মের সাথে জ্ঞান ও ভক্তি অবিচলিত থাকুক এবং জ্ঞান ও ভক্তির প্রভাবে আমার কর্ম ভগবানে যুক্ত হোক,–মন্ত্রে এই ভাব সূচিত)। [বিষ্ণো বিশ্বব্যাপকস্য ভগবতঃ কর্মর্ণা সহ মদনুষ্ঠিতেন সকর্মর্ণা সহেতি ভাবঃ; শ্নপ্তে –লিপ্তে; স্থঃ—তিষ্ঠতঃ। অথবা, বিষ্ণোঃ বিশ্বব্যাপকস্য ভগবতা সহ; শ্নপ্তে–সংযোজয়িত্রে-মম সঙ্কর্মণঃ ইতি যাবৎ; স্থঃ–ভবথঃ]।(২)। হে আমার হৃদয়-নিহিত ভক্তি! তুমি বিশ্বব্যাপক ভগবানের গ্রন্থিস্বরূপ অর্থাৎ বন্দনহেতুভূতা হও। (মন্ত্রটি নিত্য সত্য-প্রকাশক। ভক্তির দ্বারাই ভগবানকে পাওয়া যায়। অতএব ভক্তি-সামর্থ্যের দ্বারা ভগবানকে লাভ করব, মন্ত্রে এমন প্রার্থনা দ্যোতিত)। [সূঃ–গ্রন্থিরূপা, বন্ধনহেতুভূতা] (৩)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি বিশ্বব্যাপক ভগবানের নিত্য-সত্যরূপ হও।(সত্যের দ্বারাই সৎস্বরূপ ভগবানকে প্রাপ্ত হওয়া যায়। সুতরাং শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারাই ভগবানকে লাভ করো)। [ধ্রুবঃ–নিত্যসত্যরূপঃ] (৪)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি ভগবৎ সম্বন্ধী অর্থাৎ ভগবানের স্বরূপ হও। অতএব ভগবানের প্রীতির জন্য তোমাকে নিয়োজিত করি। (সদ্ভাবের দ্বারা ভগবৎ-প্রাপ্তি সুগম হও। ভগবৎ-প্রাপ্তির জন্য নিখিল সভাব প্রদান করা কর্তব্য)। [বৈষ্ণবং–বিষ্ণুসম্বন্ধিনং, ভগবতঃ স্বরূপপমিত্যর্থঃ; বিষ্ণবে–ভগবৎপ্রীত্যর্থং]।(৫)। [কর্মকাণ্ডের দিকে লক্ষ্য রেখে ভাষ্যকারের সম্বোধ্যগুলি এই–প্রথম মন্ত্রে–দৰ্ভময় মালাধার বংশ (বাঁশের খুটি, যাতে মালা পরানো হয়েছে), দ্বিতীয় মন্ত্রেররাট্যন্তৌ (কল্পিত ললাটস্থানীয়), তৃতীয় মন্ত্রে–স্যু বা লস্যুজনি (অর্থাৎ শকটদ্বারের অর্গল), চতুর্থ মন্ত্রে রক্ষ্মগ্রন্থি এবং শেষ মন্ত্রের অর্থ–হে হবির্ধান্! তুমি বিষ্ণুদেবতা বলে তার সম্বন্ধীয়হও; অতএব বিষ্ণুর প্রীতির জন্য তোমাকে স্পর্শ করছি।–মন্ত্রের এই ভাষ্যানুমোদিত সম্বোধ্য বা অর্থে কি ভাব প্রকাশ পায়, সুধীগণেরই তা বিচার্য। মন্ত্রগুলির মধ্যে কোনও সম্বোধ্য পদ নেই। সে ক্ষেত্রে শকট, হবিধান, ররাট্যন্ত, লজানি প্রভৃতি পদ অধ্যাহার করবার। প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধ হয় না। আমরা মনে করি, এই কণ্ডিকার মন্ত্রগুলির মধ্যে দ্বিতীয়টি জ্ঞানভক্তির সম্বোধনে ও তৃতীয় মন্ত্রটি ভক্তির সম্বোধনে এবং অন্যান্য তিনটি শুদ্ধসত্ত্বের সম্বোধনে বিনিযুক্ত]।

২২। আমার অন্তরের শুদ্ধসত্ত্বভাবরূপ হে হবিঃ! দীপ্তিমান্ জ্ঞানপ্রদ ষড়ৈশ্বর্যশালী সকলের প্রসবিতা সবিতৃদেবের প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে, আত্মবাহুকে দেবগণের অধ্বর্যুস্থানীয় ভবব্যাধি-নিবারক অশ্বিদ্বয়ের বাহু দুটির মতো মনে করে, এবং নিজের কর দুটিকে দেবগণের পূজাংশভাগী হবির্ভাগপূরক পূষা দেবতার কর-স্বরূপ মনে করে, সেই বাহু দুটির ও কর দুটির দ্বারা, তোমাকে ভগবানের উদ্দেশ্যে নিবেদন করছি। (ভগবৎকর্মে নিজেকে বিনিযুক্ত করতে হলে, আপন বাহু দুটিকে এবং কর দুটিকে দেবতার বাহু ও হস্ত বলে মনে করা কর্তব্য। সর্বাত্মক ভগবানের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হবিঃ মানুষ কিভাবে গ্রহণ করতে পারবে? দেবতার স্মরণ না করলে, মানুষের অন্ত-রূপ হেতু, তার অনুষ্ঠিত কর্মকে নিষ্ফল করে এবং অনিষ্ট উৎপাদন করে। সেইজন্য সকল কার্যেই দেবতার স্মরণ কর্তব্য। (দেবগণ সত্যস্বরূপ। দেবগণের অনুস্মরণ করে কর্মের অনুষ্ঠান করলে তা ফলোপধায়ক হয় এবং সত্যস্বরূপ হয়। মন্ত্রের এটাই তাৎপর্য)। [সবিতুঃ–সর্বস্য প্রসবয়িতুঃ জ্ঞানপ্ৰদস্য; দেবস্য–দ্যোতমানস্য, ষড়ৈশ্বর্যসম্পন্নস্য বা ভগবতঃ]।(১)। হে শুদ্ধসত্ত্বরূপ হবিঃ! তুমি ভগবানের সম্বন্ধি অর্থাৎ ভগবানের স্বরূপ হও। অতএব, এই হবির অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা প্রার্থনাকারী যাজ্ঞিক সাধক আমি, যজ্ঞবিঘাতকদের অর্থাৎ সকর্মনাশকারী সসহচর অজ্ঞানতা প্রভৃতিকে সর্বতোভাবে বিনাশ করি। (হৃদয়গত সম্ভব অন্তঃশত্রুদের বিনাশ করে)। [নাসি–ভগবৎসম্বন্ধিনঃ, যদ্বা–তদংশস্বরূপা] (২)। হে শুদ্ধসত্ত্বরূপ হবিঃ। তুমি মহান্ অনন্তস্বরূপ এবং মহৎ-ধ্বনিযুক্ত অর্থাৎ মহামহিমোপেত শব্দব্রহ্মরূপ হও। পরমৈশ্বর্যযুক্ত ভগবানের প্রীতির জন্য তুমি স্তোত্রলক্ষণযুক্ত বাক্য অর্থাৎ স্তোত্রমন্ত্র উচ্চারণ করো। [বৃহৎ-মহান, অনন্তস্বরূপঃ, বৃহদ্রব্য মহদ্ধনিযুক্তঃ, মহামহিমোপেতঃ শব্দব্রহ্মরূপঃ; ইন্দ্রায়–পরমৈশ্বর্যযুক্তায় ভগবৎপ্রীতয়ে]।(৩)। [এমন যে উচ্চভাবপূর্ণ মন্ত্র, প্রচলিত ভাষ্যে এবং ব্যাখ্যা ইত্যাদিতে তারও বিকৃতি সংঘটিত হয়েছে। প্রথম ও দ্বিতীয় মন্ত্রে কাষ্ঠনির্মিত খনন-সাধন অভ্রিকে এবং তৃতীয় মন্ত্রে সেই অভ্রি দ্বারা খনিত উপরবাখ্য গর্তকে সম্বোধন করা হয়েছে। তাতে মন্ত্রের অর্থ দাঁড়িয়েছে,–(১) সবিতৃদেবের প্রেরণায় অশ্বিদ্বয়ের বাহুযুগল এবং পুষাদেবতার হস্তের দ্বারা, হে অত্রি, তোমাকে গ্রহণ করছি।(২) খনন-সাধন কর্মের উপযোগী বলে। তুমি অনুষ্ঠাতা যাজ্ঞিকদের সম্পর্কীয় হও। এই অভ্রির দ্বারা আমি যজ্ঞের বিঘ্ন-উৎপাদনকারীদের কণ্ঠদেশ ছিন্ন করি। (৩) অভ্রির দ্বারা খনিত গর্তকে সম্বোধন করে তৃতীয় মন্ত্রে বলা হয়েছে–হে উপরবাখ্য গর্ত! তুমি মহান্ হও এবং তুমি মহদ্ধনি (মহৎ বা মহান্ ধ্বনি) উচ্চারণ করে। সেই হেতু ইন্দ্রের প্রীতির জন্য তুমি প্রৌঢ়ধ্বনিযুক্ত বাক্য বলো।–আসলে কর্মকাণ্ডে মন্ত্রের প্রয়োগ-বিধির জন্যই ভাষ্যে ঐরকম অর্থ দেওয়া হয়েছে। আমাদের বক্তব্য আমাদের অনুবাদেই প্রকাশিত হয়েছে, আমরা মনে করি ভগবানের উদ্দেশ্যে হবিঃ-প্রদানকালে যজ্ঞিক যে ভাবে অনুপ্রাণিত হবেন, এই কণ্ডিকার মন্ত্র তিনটিতে সেই ভাবের অধ্যাস হয়েছে। মন্ত্র তিনটি অন্তরের শুদ্ধসত্ত্বভাবরূপ হবিঃ-সম্বোধনে বিনিযুক্ত]।

২৩ হে শব্দব্রহ্মস্বরূপা মন্ত্ররূপা বাক্‌! সঙ্কর্মের বিঘ্ন-উৎপাদনকারী অজ্ঞান-অন্ধকার-নাশিকা, মায়ামোহ-বিনাশকারিণী, ভগবানের উদ্দেশ্যে প্রযুক্ত হেতু ভগবৎস্বরূপা তোমাকে উদ্বোধিত করি। সৎকর্মকারী ভক্ত সাধক আমি এই প্ৰবৰ্তমান মন্ত্ররূপা বাক্যের দ্বারা মোহজনক সকল রকম অন্তর-বাহ্য প্রকৃতিকে সমূলে বিনাশ করি। [বলগহনং–মায়ামমাহাদিনাশিকাং; বৈষ্ণবীং–ভগবদ্যুদ্দেশ্যে প্রযুক্তত্বস্বরূপাং; বলগং মোহজনকং আন্তর্বাহ্যপ্রকৃতিং] (১)। আমার অনুষ্ঠিত কর্ম যে মোহজনক কুত্রবৃত্তিরূপ শত্রুকে উৎপাদন করে, এবং আমার জন্মসহজাত কুসংস্কার যে মোহজনক পাপ-প্রবৃত্তিরূপ শত্রুকে উৎপন্ন করে, প্রবর্তমান এই মন্ত্ররূপা বাক্যের দ্বারা সেই সকল অন্তরবাহ্য প্রবৃত্তিকে সকর্মকারী ভক্ত সাধক আমি সমূলে বিনাশ করি। [অমাত্যঃ–মম জন্মসহজাতঃ, সহাবস্থিতো বা কুসংস্কারঃ; শত্ৰুং-মোহজনকং কুপ্রবৃত্তিরূপং]।(২)। আমার সহাধিষ্ঠিত অন্তরস্থ রিপু যে মোহজনক কুপ্রবৃত্তিরূপ শত্রুকে উৎপন্ন করে, অপিচ বহিরাগত রিপু যে মোহজনক অন্তর-বাহ্য প্রকৃতিকে ৎপাদিত করে, প্রবর্তমান এই মন্ত্ররূপা বাক্যের দ্বারা সেই সব মোহজনক অন্তর বাহ্য বৃত্তিকে সকর্মকারী ভক্তসাধক আমি উৎকীর্ণ করি অর্থাৎ সমূলে নাশ করি। [অসমানঃ বহিরাগতঃ রিপুঃ] (৩)। আমার আত্মসম্বন্ধী অন্তঃশত্রু যে মোহজনক পাপপ্রবৃত্তিরূপ শত্রুকে উৎপন্ন করে এবং সম্ভাব্য বহিঃশত্রু যে মোহজনক কুপ্রবৃত্তিরূপ শত্রুকে উৎপাদন করে, প্রবর্তমান এই মন্ত্ররূপা বাক্যের দ্বারা সেই সব মোহজনক অন্তর-বাহ্য-বৃত্তিকে সৎকর্মকারী ভক্তসাধক আমি উত্তীর্ণ করি অর্থাৎ সমূলে বিনাশ করি। [সবন্ধু–আত্মসম্বন্ধী অন্তঃশত্রু; অসবন্ধুঃ–সম্ভাব্যবাহীঃশত্ৰুরিত্যর্থঃ] (৪)। আমার জন্মসহজাত অসৎ-বৃত্তি যে মোহজনক পাপপ্রবৃত্তিরূপ শত্রুকে উৎপন্ন করে এবং বহিরাগত অর্থাৎ কর্মের দ্বারা সঞ্জাত কুপ্রবৃত্তি যে মোহজনক পাপপ্রবৃত্তিরূপ শত্রুকে উৎপন্ন করে, প্রবর্তমান এই মন্ত্ররূপা বাক্যের দ্বারা সেই সব মোহজনক বৃত্তিকে উৎকীর্ণ করে দূরে নিক্ষেপ করি। [সজাতঃ–জন্মসহজাতা অসৎ বৃত্তি; অসজাতঃবহিরাগতা, কর্মর্ণা সঞ্জাতা ইত্যর্থঃ বৃত্তিঃ] (৫)। [এই কণ্ডিকার মন্ত্রগুলি সঙ্কল্পমূলক। অন্তঃশত্রু বহিঃশত্রু অথবা হিংসাপরায়ণ আর যে সব শত্রু আছে, মন্ত্র-প্রভাবে সেই সব শত্রুকে আমরা যেন বিনাশ করতে সমর্থ হই। সে পক্ষে বেদ-মন্ত্র আমাদের রক্ষক হোন। মন্ত্রসমূহে এই ভাব পরিব্যক্ত। দুর্গাদাস লাহিড়ী মহাশয় বলেন, প্রথম দৃষ্টিতে মনে হয়, মন্ত্রে যেন মানুষের সাথে মানুষের যুদ্ধের বিষয় প্রখ্যাপিত। তা থেকে কেউ কেউ দেবাসুরের, কেউ কেউ আর্য ও অনার্যের দ্বন্দ্বের বিষয় টেনে আনেন। ভাষ্যকার মন্ত্রের যে অর্থ অধ্যাহার করেছেন, তাতে পুত্র, অমাত্য, জ্ঞাতি, স্বজাতি, সবন্ধু, সমবলসম্পন্ন, অল্পবলসম্পন্ননানা রকম মানুষ শত্রুর উপদ্রব-নিবারণ-কল্পে এই মন্ত্রের প্রয়োগের বিষয় উপলব্ধ হয়। মন্ত্রের অন্তর্গত বলগ শব্দটি সকল সমস্যার মূলীভূত। বলগ পদ বহুভাবদ্যোতক। এর এক অর্থ–অভিচাররূপেণ ভূমৌ নিখাতা অস্থিকেশনখাদিপদার্থাঃ কৃত্যাবিশেষা বলগাঃ। শত্ৰুসংহারের জন্য একগজ মাটির নীচে গর্ত করে বস্ত্রে আচ্ছাদিত যে অস্থি-কেশ-নখ ইত্যাদি প্রোথিত করা হয়, তাকে বলগা বলে। অধুনাতন কালে যে তুক-তাক, প্রাচীনকালের বলগং বা বলগা তারই ভিত্তিস্থানীয় বলে মনে হয়। আবার নিরুক্ত মতে বলগাঃ পদের অর্থ–বলগো বৃণ্যেতে অথবা বলো বৃণ্যেতেঃ। বল পদে মেঘ বোঝায়। মেঘ সূর্যরশ্মি আচ্ছাদন করে; মেঘে আকাশ সমাচ্ছাদিত হয়। এই অর্থে বলগা পদে মেঘ বা অজ্ঞানান্ধকারকে বোঝাতে পারে। ভাষ্যকার তুক-তাক ভাবজ্ঞাপক অর্থই গ্রহণ করেছেন এবং সেই ভাবেই মন্ত্রের অর্থ নিষ্পন্ন করে গেছেন। সাধারণ ক্ষেত্রে শক্ৰহননের জন্য এই মন্ত্রের সহায়তায় অভিচার ক্রিয়া সম্পন্ন করা হয়। যেমন পুরাকালে অসুরেরা পরাজিত হলে বিজেতা দেবতাদের সংহারের জন্য তারা অভিচাররূপে অস্থি-কেশ নখ প্রভৃতি পদার্থ নিয়ে মৃত্তিকায় প্রোথিত করে। সেই সব বলগা উৎকীর্ণকালে কণ্ডিকা মন্ত্রগুলি উচ্চারিত হয়েছিল বলে উপাখ্যান আছে। আমাদের কার্য ভিন্ন পথ অবলম্বন করেছে। পূর্ববর্তী এবং পরবর্তী মন্ত্রগুলির অর্থের সাথে সামঞ্জস্য রক্ষা করতে হলে এবং আধ্যাত্মিক জগতের সাথে এই সব মন্ত্রের সম্বন্ধ আছে বুঝতে পারলে আমাদের মন্ত্রৰ্থ বা অনুবাদের যৌক্তিকতা উপলব্ধ হবে]।

২৪। হে ভগবন! আপনি স্বয়ংই আপনাতে বিদ্যমান, দীপ্যমান্ এবং প্রকাশমান এবং অন্তরস্থিত সহাধিষ্ঠিত অর্থাৎ জন্মসহজাত শত্রুদের বিনাশকারী হন। (অতএব আমাদের হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হয়ে আমাদের অন্তঃশত্রুকে বিনাশ করুন–এটাই প্রার্থনা)। [স্বরাষ্ট্র–স্বাত্মমি স্বয়নেব রাজমান্যে দীপ্যমানে বা]। হে ভগবন্! আপনি সকল সৎকর্মে বিরাজমান, দীপ্যমান ও প্রকাশমা; এবং অনুকূল মোহ-উৎপাদক অন্তর-বাহ্য শত্রুদের বিনাশকারী হন।(অতএব আমাদের কর্মসমূহে দীপ্যমান্ হোন এবং আমাদের শত্রুবিনাশের সামর্থ্য প্রদান করুন–এটাই প্রার্থনা)। [সত্ররা-কর্মেসু সৎকর্মসু রাজমানে বিদ্যমানো বা]। (২)। হে ভগবন্! আপনি সাধনসম্পন্নগণের হৃদয়ে সর্বদা বিদ্যমান, দীপ্যমান্ ও প্রকাশমান্ আছেন; এবং সকর্মধিঘাতক শত্রুদের নাশয়িতা হন।(অতএব আমাদের হৃদয়ে বিরাজমান হয়ে আমাদের কর্মবিঘাতক শত্রুদের বিনাশ করুন–এটাই প্রার্থনা) [জনরাটুজলেষু, সাধনসম্পয়ানাং হৃদয়েষু ইত্যর্থ রাজমানো দীপ্যমাননা বা]।(৩)। হে ভগবন্। আপনি বিশ্বচারাচরের সকলের অন্তরেই বিরাজমান। দীপ্যমান্ বা প্রকাশমান, এবং শত্রুদের বিনাশক হন। (অতএব আমাদের মধ্যে অধিষ্ঠিত হয়ে আমাদের শত্রুনাশক সৎ-ভাবসম্পন্ন করুন–এটাই প্রার্থনা)। [সর্বরা–বিশ্বচরাচরস্য সর্বের্যাং অন্তরেষু রাজমানো দীপ্যমানো বা]।

২৫। হে আমার হৃদয়গত শুদ্ধসত্ত্বভাবসমূহ! ভগবানের অংশভূত, সৎকর্মের বিঘাতকাদের নাশয়িতা অর্থাৎ অজ্ঞান-অন্ধকার-নাশক, মোহজনক আন্তঃবাহ্য-প্রবৃত্তি-নাশকারী অথবা মায়ামোহ ইত্যাদি বিনাশক তোমাদের ভগবানে নিয়োজিত করি অথবা প্রকৃষ্টভাবে সুসংস্কৃত করি, অর্থাৎ ভগবানের প্রীতির জন্য প্রকৃষ্টভাবে উৎকর্ষসাধন করি। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক। হৃদয়গত সৎ-ভাবরাজি ভগবৎ-প্রীতিসাধক। ভগবানের প্রীতির জন্য সেই সেই সৎ-ভাবগুলি বিনিযুক্ত করি,–সাধকের এটাই সঙ্কল্প)। [বৈষ্ণবান্ভগবদংশভূতা; বলগহনঃ–মোহজনকান্ আন্তর্বাহ্যবৃত্তিনাশকা, যদ্বা– মায়ামোহাদিনাশকান্ ইতি যাবৎ; প্রেক্ষামি–নিয়োজয়ামি–ভগবতী ইতি শেষঃ, প্রকৃষ্টরূপেণ সুসংস্কৃতা করোমি, যদ্বা–ভগবৎ প্রীত্যর্থং প্রকৃষ্টরূপেণ উৎকর্ষসম্পন্না করোমিতি ভাবঃ]।(১)। হে আমার হৃদয়গত শুদ্ধসত্ত্ব-ভাবসমূহ! ভগবানের অংশভূত, সৎকর্মের বিঘাতকদের বিনাশকারী অর্থাৎ অজ্ঞানরূপ অন্ধকারনাশক, মোহজনক আন্তঃ বাহ্য-প্রবৃত্তিনাশক অথবা মায়ামোহবিনাশকারী তোমাদের অবনত অর্থাৎ ভগবানের প্রীতিসাধনের উপযোগীরূপে সুসংস্কৃত করছি। (এ মন্ত্রটিও সঙ্কল্পমূলক। আমার হৃদয়গত সৎ-ভাবরাজি যাতে ভগবানের প্রীতিসাধনে সমর্থ হয়, সেইরকমভাবে তাদের ঔকর্ষসম্পন্ন করি)। [অবনয়ামি–অবনতান্ করোমি, যদ্বা–ভগবৎপ্রীতিসাধনোপযোগিরূপেণ সুসংস্কৃতান্ করোমি।(২)। হে আমার হৃদয়গত শুদ্ধসত্ত্বভাবসমূহ! ভগবানের অংশভূত, সৎকর্মের বিঘাতকদের বিনাশকারী অর্থাৎ অজ্ঞান-অন্ধকার-বিনাশক, মোহজনক আন্তঃবাহ্য-প্রবৃত্তি নাশক অথবা মায়ামমাহ বিনাশকারী তোমাদের সংপাতিত করি অর্থাৎ যাতে তোমরা ভগবানের প্রীণনসাধক হও, তেমনভাবে তোমাদের আস্তীর্ণ অর্থাৎ ঔকর্ষসম্পন্ন করি। [অবক্তৃণামি–সংপাতয়ামি, যথা যুয়ং ভগবৎপ্রীণনসাধকাঃ ভবন্তি তথা যুম্মা আস্তীর্ণান উৎকর্ষসম্পন্না করোমীত্যর্থঃ] ।(৩)। হে আমার জ্ঞানকর্ম! ভগবৎ-অঙ্গীভূত সকর্মের বিঘাতকদের বিনাশক অর্থাৎ অজ্ঞানরূপ অন্ধকারের নাশক, মোহজনক আন্তঃ-বাহ্য-বৃত্তিনাশকারী অথবা মায়া-মোহ ইত্যাদির বিনাশক তোমাদের প্রকৃষ্টরূপেস্থাপিত করি, অর্থাৎ শত্রুনাশের জন্য এবং ভগবানের প্রীতিসাধনের উদ্দেশ্যে নিয়োজিত করি। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে,–আমার জ্ঞান ও কর্ম ভগবানের প্রীতিসাধনের যোগ্য হোক)। [উপদধামি–স্থাপয়ামি–শত্ৰুহনোয় ভগবৎপ্রীতয়ে চ নিয়োজয়ামিতি ভাবঃ] (৪)। হে আমার জ্ঞানকর্ম! ভগবানের অঙ্গীভূত, সৎকর্মের বিঘাতকদের বিনাশক অর্থাৎ অজ্ঞানতারূপ অন্ধকারের নাশক, মোহজনক আন্তঃ বাহ্য-প্রবৃত্তি-নাশকারী অথবা মায়া-মোহ ইত্যাদির বিনাশক তোমাদের প্রকৃষ্টরূপে আচ্ছাদন করি অর্থাৎ ঔৎকর্ষ সাধনের দ্বারা ভগবানকে প্রাপ্ত করি অথবা ভগবানের সাথে বিলীন করছি। (এ মন্ত্রটিও সঙ্কল্পমূলক। আমার জ্ঞান ও কর্ম এমন হোক, যাতে ভগবৎ-প্রাপ্তি সুগম হয়)।[পযুহামি– সদ্ভাবেন পরিতঃ ছাদয়ামি, ঔৎকর্ষসাধনেন ভগবন্তং প্রাপয়ামি, যদ্বা–ভগবতা সহ নিলীয়ামীতি ভাবঃ] (৫)। হে শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি বিশ্বব্যাপক ভগবানের স্বরূপ হও। [বৈষ্ণবং–বিশ্বব্যাপকস্য ভগবতঃ স্বরূপং]।(৬)। অতএব হে আমার হৃদয়গত শুদ্ধসত্ত্ব! তোমরা বিশ্বরূপ ভগবানের প্রীতিসাধক হও। (ভাব এই যে, আমার হৃদয়গত সত্তাবরাজি ভগবানের প্রীতিসাধনের অনুকূল হোক)। [বৈষ্ণবাঃ- বিশ্বরূপস্য ভগবতঃ প্রীতিসাধকাঃ]](৭)। [ভাষ্যকার এই কণ্ডিকার মন্ত্রগুলির যেমন ব্যাখ্যা অধ্যাহৃত করেছেন, তা থেকে মন্ত্রের প্রকৃত ভাব পরিগ্রহণ করা সহজসাধ্য নয়। ভাষ্যকারের সাথে আমাদের প্রথম ও প্রধান মতান্তর, মন্ত্রের সম্বোধন পদ নিয়ে। ভাষ্যকারের মতে, মন্ত্রে, যজ্ঞকর্মের প্রয়োজনে, চারটি খনিত গর্তের সম্বোধন আছে, মন্ত্রে অভিস্রবণাশ্য চর্মের সম্বোধণ আছে, মন্ত্রে সোমরস নিঃসারক শিলাখণ্ডের সম্বোধন আছে। আমরা অবশ্য, অন্যান্য বিষয়ের মতোই, এই বিষয়েও ভাষ্যকারের সাথে একমত হতে পারিনি। আমাদের পরিগৃহীত পন্থার অনুসরণে, মন্ত্রের মহান্ উদ্দেশ্য প্রকটন করতে, আমরা মনে করি, এই কণ্ডিকার মন্ত্রগুলি হৃদয়ের সৎ-ভাব শুদ্ধসত্ত্বকে, জ্ঞান-কর্মকে, সম্বোধন করা হয়েছে। আধ্যাত্মিক, আধিভৌতিক ও আধিদৈবিক তিনরকম শত্রুর নাশে, সৎ-ভার সকর্ম সজ্ঞান যেমন পূর্ণশক্তিসম্পন্ন তেমন আর কিছুই নয়]।

২৬। আমার অন্তরের শুদ্ধসত্ত্বভাবরূপ হে হবিঃ! সকলের প্রসবিতা জ্ঞানপ্রদ দীপ্তিমান্ ষড়ৈশ্বর্যশালী ভগবানের প্রেরণায় অনুপ্রাণিত হয়ে, আপন বাহুকে দেবগণের অধ্বর্যুস্থানীয় ভবব্যাধি-নিবারক অশ্বি দুজনের বাহুযুগলের মতো মনে করে, এবং আপন করযুগলকে দেবগণের হবির্ভাগপূরক পূষাদেবতার করস্বরূপ মনে করে, সেই বাহুদুটির ও করদুটির দ্বারা, তোমাকে ভগবানের উদ্দেশ্যে নিবেদন করছি। (ভগবৎ-কর্মে নিজেকে বিনিযুক্ত করতে হলে নিজের বাহুযুগলকে এবং করযুগলকে দেবতার বাহু ও হস্ত বলে মনে করা কর্তব্য। সর্বাত্মক ভগবানের উদ্দেশ্যে নিবেদিত হবিঃ মানুষ কিভাবে গ্রহণ করতে পারবে? দেবতার স্মরণ না করতে, মানুষের অনৃতত্বরূপহেতু, তার অনুষ্ঠিত কর্ম নিষ্ফল হয় এবং তাতে অনিষ্ট-উৎপাদন ঘটে। সেইজন্য সকল কার্যেই দেবতার স্মরণ করা কর্তব্য। দেবতাগণ সত্যস্বরূপ। দেবগণের অনুস্মরণ করে কর্মের অনুষ্ঠান করলে, তা ফলের উপধায়ক হয় এবং সত্যস্বরূপ হয়।–মন্ত্রেই এটাই তাৎপর্য।প্রসঙ্গতঃ জ্ঞাতব্য, পূর্বের ২২শ কণ্ডিকার ১ম মন্ত্রেও বাহু ও হস্ত সম্পর্কে উল্লিখিত আছে। ঐ মন্ত্রটি এখানে উধৃত)। [বাহু ও হস্ত–সাধারণতঃ দুটিই একার্থবোধক বলে মনে হয়। ওগুলির পার্থক্য সহসা উপলব্ধ হয় না। সাধারণতঃ বাহু শব্দের অর্থে আমরা হাত প্রতিশব্দ ব্যবহার করে থাকি। কিন্তু তা ভ্রমপ্রমাদপূর্ণ। বাহুভ্যাং এবং হস্তাভ্যাং পদের অর্থে সে পার্থক্য উপলব্ধ হবে। বাহু বলতে অংসমণিবন্ধয়োর্মধ্যভাগে দীর্ঘদণ্ডাকারো বাহুঃ; আর হস্ত বলতে পঞ্চাঙ্গুলিযুক্তাগ্রভাগে হস্তঃ বোঝায়। তাহলেই বোঝা গেল,—অংস অর্থাৎ স্কন্ধদেশ থেকে মণিবন্ধপর্যন্ত অংশকে বাহু এবং মণিবন্ধ থেকে পঞ্চাঙ্গুলি সমেত অগ্রাংশকে হস্ত বলে] (১)। আমার অন্তরের শুদ্ধসত্ত্বরূপ হে হবিঃ! তুমি ভগবানের সম্বন্ধি অথবা ভগবানের অংশস্বরূপ হও। অতএব, এই হবির অর্থাৎ শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা, প্রার্থনাকারী যাজ্ঞিক সাধক আমি, যজ্ঞের বিঘাতকদের অর্থাৎ সৎকর্ম নাশকারী সসহচর অজ্ঞানতা প্রভৃতিকে সর্বতোভাবে বিনাশ করছি। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভাব এই যে, হৃদয়গত সৎ-ভাবের প্রভাবে সকল শত্রু বিনাশপ্রাপ্ত হয়)। [পূর্বের ২২শ কণ্ডিকার ২য় মন্ত্রটিই এখানে উধৃত]। [নার্যসি–ভগবৎসম্বঞ্ছিনঃ, যদ্বা–তদংশস্বরূপা। মন্ত্রের অন্তর্গত এই নারী পদের ভাষ্যকার যে সাধারণ অর্থ পরিগ্রহণ করেছেন, তা এই–পুরুষাণামনুষ্ঠাতৃণাং সমন্ধিনী। কিন্তু আমাদের অর্থ স্বতন্ত্র। নরঃ শব্দে ভগবান বিষ্ণুকে বোঝায়। সেই থেকে ঐ পদে ভগবৎ-সম্বন্ধি বা তদংশস্বরূপ অর্থ পরিগৃহীত হয়েছে। এখানে নরঃ পদের স্ত্রীলিঙ্গে নারী শব্দের সাধারণ অর্থ স্ত্রীলোক পরিগৃহীত হয়নি] (২)। আমার অন্তরের শুদ্ধসত্ত্বরূপ হে হবিঃ! তুমি ভগবানের সাথে মিলনসাধক অর্থাৎ পরমাত্মার সাথে আত্মার মিশ্রণকারী হও। অতএব তুমি আমাদের থেকে আমাদের শত্রুদের পৃথক অর্থাৎ দূরে অপসারণ ও বিনাশ করো; অপিচ, দানপ্রতিবন্ধক অর্থাৎ সৎ-বৃত্তির নাশক শত্রুদের বিনাশ করো। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমাদের অন্তর-বাহির সকল শত্রুকে বিনাশ করে আমাদের পরমাত্মার সাথে সম্মিলিত করো)। [যবঃ–ভগবতা সহ মিলনসাধক, যদ্বা–পরমাত্মনা সহ আত্মানং মিশ্ৰয়িতা ইতি ভাবঃ, যবয়–পৃথক কুরু, দূরে অপসারয়, নাশয়েতি যাবৎ; অরাতীঃ– দানপ্রতিবন্ধকান, যদ্বা–সবৃত্তিনাশকান্ শক্রনপি ইত্যর্থঃ; যবয়নাশয় ইতি ভাবঃ]।(৩)। আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্বরূপ হে হবিঃ! দ্যুলোকস্থিত ভূতসঙ্ঘের প্রীতির জন্য অথবা স্বর্গলোকের হিতসাধনের জন্য তোমাকে সুসংস্কৃত অর্থাৎ নিয়োজিত করছি। [দিবে–দিবিস্থানানাং ভূতসঙ্ঘানাং প্রীত্যর্থং, যদ্বা– স্বর্গলোকস্য হিতসাধনায়]।(৪)। আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্বরূপ, হে হবিঃ! অন্তরিক্ষ-লোকস্থিত ভূতসঙ্ঘের উপকারের জন্য অথবা অন্তরিক্ষলোকের হিতসাধনের জন্য তোমাকে সুসংস্কৃত অর্থাৎ নিয়োজিত করছি।(৫)। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্বরূপ হবিঃ! পৃথিবী-নিবাসী ভূতসঙ্ঘের উপকারের জন্য অথবা পৃথিবীর হিতকামনায় তোমাকে সুসংস্কৃত অর্থাৎ নিয়োজিত করছি।(৬)। [৪র্থ, ৫ম ও ৬ষ্ঠ মন্ত্রে বিশ্বচরাচরের মঙ্গল-আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ পেয়েছে। আমার চিত্তবৃত্তি এইরকম হোক, যার আদর্শে বিশ্ববাসী সকলে উন্নত ও ঔৎকর্ষসম্পন্ন হয়–মন্ত্র তিনটিতে সাধকের এমনতর কামনা বর্তমান]। আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্বরূপ হে হবিঃ! তোমার প্রভাবে পিতৃগুণসমূহের আশ্রয়ভূত সকল লোক অর্থাৎ পিতৃগুণসমূহের আশ্রয়ভূত হৃদয় বিশুদ্ধতা প্রাপ্ত হোক অথবা পরিত্রাণ লাভ করুক। [পিতৃষনা পিতৃগুণানাং আশ্রয় ভূতাঃ](৭)। হে আমার হৃদয়! তুমি–পিতৃগুণসমূহের আশ্রয়ভূত হও; অতএব তুমি বিশুদ্ধতা লাভ করো।(৮)। [ভগবানের উদ্দেশ্যে হবিঃ–প্রদানকালে যাজ্ঞিক যে ভাবে অনুপ্রাণিত হবেন, এই কণ্ডিকার প্রথম মন্ত্রে সেই ভাবের অধ্যাস হয়েছে। ভাষ্যমতে এই কণ্ডিকার মন্ত্রগুলি উদুম্বরী-শাখা অর্থাৎ যজ্ঞডুমুরের শাখা প্রোথিত করবার মন্ত্র]।

২৭। হে আমার মন! তুমি দ্যুলোককে অথবা দ্যুলোক-সম্বন্ধি দেবভাবকে উৎকৃষ্টরূপে স্তম্ভিত করো অর্থাৎ যাতে তা পরিক্ষীণ না হয়, তেমনভাবে রক্ষা করো; এবং পৃথিবীতলে অবস্থিত অথবা ভূলোকসম্বন্ধি সৎ-ভাবকে দৃঢ় করো। (ভাব, এই যে, সকল দেবভাব আমার হৃদয়ে অধিষ্ঠিত হোক)। [দিবং–দ্যুলোকং দ্যুলোকসম্বন্ধিনং দেবভাবং ইত্যর্থঃ; উৎ–উৎকৃষ্টরূপেণ শুভান–স্তম্ভয়, তথা পরিক্ষীণো ন ভবতি তথা রক্ষ ইত্যর্থঃ; আপৃণ–আপূরয়, সর্বতোভাবেন পরিপূর্ণ কুরুত্ব; পৃথিব্যাং– পৃথিতলে অবস্থিতং, ভূলোকসম্বন্ধিনং]। অথবা–হৈ শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি আমার হৃদয়রূপ দেবস্থানকে অর্থাৎ পরম-সুখ মূলকে উন্নতভাবে বা প্রকৃষ্টরূপে স্তম্ভিত করো, অর্থাৎ পাতন হতে রক্ষা করো, অন্তরিক্ষের মতো অনন্তপ্রসারিত আমার সৎকর্মের মূলকে অথবা সৎ-ভাবগুলির সর্বব্যাপকত্বে পরিপূর্ণ অর্থাৎ পরিবর্ধিত করো; এবং সৎ ভাবগুলির আধারক্ষেত্রেকে অর্থাৎ আমার সৎ-বৃত্তিকে দৃঢ় করো। (সৎ-ভাব ও শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে আমাতে সৎকর্ম-সাধনের সামর্থ্য অবিচালিতভাবে অবস্থিতি করুক। তাতে পূর্ণজ্ঞান লাভ হবে এবং ভগবানকে প্রাপ্ত হতে পারব)। [দিবং–সম হৃদরূপং দেবস্থানং, পরমসুখমূল মিতি ভাবঃ; অন্তরিক্ষং–অন্তরিক্ষবৎ অনন্তপ্রসারিতং মম সৎকর্মমূলমিতি যাবৎ, যদ্বা–সদ্ভাবানাং সর্বব্যাপকত্বমিতি ভাবঃ; আপৃণ–পরিপূরয়, পরিবর্ধয়েতি ভাবঃ; পৃথিব্যাং –সদ্ভাবানাং, আধারক্ষেত্রং, মম সবৃত্তিমূলমিতি যাবৎ] (১)। হে আমার মন! দীপ্যমান পরমজ্ঞানময় মরুৎ-দেবতা বা বিবেক-অনুমত জ্ঞান অথবা প্রাণবায়ুরূপে অধিষ্ঠিত ভগবান্ তোমাকে অবিচলিত বা অবিচ্ছিন্ন রক্ষার দ্বারা রক্ষা বা পোষণ করুন; অপিচ, মিত্রবরুণদেবতা অর্থাৎ সকলের প্রীতিসাধক ও অভীষ্টপূরক দেবতা অর্থাৎ মিত্রের $ মতো হিতসাধক এবং অভীষ্টবর্যকরূপ শ্রেয়ঃবিধায়ক দেবতা দুজন তোমাকে অবিচলিত অর্থাৎ অবিচ্ছিন্ন রক্ষার দ্বারা রক্ষণ ও পোষণ করুন। (মটি প্রার্থনামূলক। দেবভাবের প্রভাবে মন চাঞ্চল্যরহিত ও ভগবৎপরায়ণ হোক, এটাই প্রার্থনা)। [মারুতঃ–মরুদ্দেবতা, বিবেকানুমতং জ্ঞানং বা, সদ্বা– প্রাণবায়ুরূপেণ স্থিতঃ ভগবান; রেণ–অবিচলিতেন, অবিচ্ছিন্নেন; মিত্রাবরুণৌমিত্রাবরুণদেবৌ, প্রীতিসাধকাভীষ্টপ্ৰদৌ দেবৌ, যদ্বামিত্রস্বরূপো হিতসাধকঃ তথা অভীষ্টবর্ষকরূপো শ্রেয়ঃবিধায়ক তৌ দেবদ্বয়ৌ ইতি ভাবঃ] (২)। হে মন! ব্রাহ্মণভাবাপন্ন অর্থাৎ সত্ত্বগুণেপেত ব্রহ্মস্বরূপ, ক্ষত্রভাবোপেত অর্থাৎ রজোভাবাপন্ন, পরমার্থরূপ ধনের পোষক তোমাকে প্রকৃষ্টভাবে স্থাপন করছি, অথবা পরমাত্মায় নিয়োজিত করছি। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক। মন যাতে সর্বদা ভগবৎপরায়ণ হয়। সেইমতো বিহিত করো, –এটাই ভাবার্থ)। [ব্রহ্মবণি ব্রাহ্মণভাবাপন্নং সত্ত্বগুণেপেতং ব্রহ্মস্বরূপং বা; ক্ষত্রবণি ক্ষত্রভাবোপেতং, রজেগুণসম্পন্নং ইত্যর্থঃ; রায়স্পোষবণি–পরমার্থরূপধনস্য পোষকং]।(৩)। হে মন! তুমি ব্রাহ্মণভাবকে অর্থাৎ শুদ্ধভাবকে দৃঢ় অর্থাৎ পোষণ করো। [ব্রহ্ম-ব্রাহ্মণভাবং, সত্ত্বভাবমিত্যর্থঃ] (৪)। হে মন!তুমি ক্ষত্রভাবকে বা রজোগুণকে অর্থাৎ কর্ম-সামর্থ্যকে দৃঢ় অর্থাৎ পোষণ করো।] (৫)। হে মন! তুমি জীবনকে অর্থাৎ সৎকর্ম সাধনের সামর্থকে দৃঢ় অর্থাৎ পোষণ করো। [আয়ুঃ–জীবনং, সৎকর্মসাধনসামর্থ্যমিতি ভাবঃ] (৬)। হে মন! তুমি সৎ-ভাবকে দৃঢ় অর্থাৎ পোষণ করো। [প্রজ্ঞাং–সদ্ভাবং] (৭)। [শেষের চারটি মন্ত্র প্রার্থনামূলক। সকল সৎ-ভাব আমাকে প্রাপ্ত হোক, অপিচ পরমার্থ-প্রাপ্তির পক্ষে তারা আমার সহায় হোক, এমন প্রার্থনার ভাব মন্ত্রে প্রকটিত।–ভাষ্যকারের মতে এই কণ্ডিকায়, সাতটিনয়, পাঁচটি মন্ত্র আছে। সেই পাঁচটি মন্ত্রেই ঔদুম্বরীর সম্বোধন আছে]।

২৮। হে মনোবৃত্তি! তুমি নিত্যসত্যস্বরূপ বা সৎস্বরূপ হও। তোমার অনুগ্রহে অথবা তোমার প্রভাবে, সৎ কর্ম সাধন-পরায়ণ ব্যক্তি অর্থাৎ আমি, এই কার্যে অথবা ইহলোকে যেন ধন ও পুষ্টির দ্বারা স্থির অর্থাৎ নিত্য সমৃদ্ধ হই। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব–আমার মনোবৃত্তি এমন হোক, যাতে আমি ইহলোকে ও পরলোকে ধনপুষ্টি সহ পরমাগতি লাভ করতে পারি)। [ধ্রুবা–নিত্যসত্যরূপা, সৎস্বরূপা বা; প্রজয়া পশুভিঃ–ধনেন পুষ্টিভিস্ট]।(১)। হে মনোবৃত্তি! তোমার প্রভাবে শুদ্ধসত্ত্বরূপ হবির দ্বারা দ্যুলোক ভূলোক অর্থাৎ সকল লোক পরিপূর্ণ হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। আমার অন্তরস্থিত সৎ-ভাবরাজি সকল লোকে অবস্থিত অর্থাৎ সকল লোকে অধিকার করুক)। [ঘৃতেন–হবিষা–শুদ্ধসত্ত্বরূপেণ ইতি ভাবঃ] (২) হে মনোবৃত্তি! তুমি পরমৈশ্বর্যশালী ভগবানের আশ্রয়স্বরূপ অর্থাৎ আধারস্থানীয় হও। [ইস্য–পরমৈশ্বর্যশালিনঃ ভগবতঃ; ছদি–আশ্রয়স্বরূপ আধারস্থানীয়ঃ বা] (৩) অতএব হে মনোবৃত্তি! তুমি নিখিলভূতসমূহের অথবা নিখিল সৎ-ভাবের আশ্রয় বা ধারক হও। [ছায়া–আশ্রয়ঃ, ধারকঃ বা]।

২৯। স্তুতিমন্ত্রের দ্বারা সেবনীয় হে ভগবন্! সর্বরকমে সকল কর্মে প্রযুজ্যমান্ আমাদের এই স্তুতিবাক্যগুলি সর্বতোভাবে আপনাকে প্রাপ্ত হোক; (তার দ্বারা) নিত্যসত্যস্বরূপ আপনার সন্তোষসাধনেই আমাদের সন্তোষ হোক; (তার দ্বারা) আপনার সেবাই আমাদের প্রীতির হেতুভূত হোক। (ভাব এই যে, হে ভগবন্! আমাদের বাক্যসমূহ আপনাকেই প্রাপ্ত হোক; আপনার সেবায় নিযুক্ত হওয়াই আমার প্রীতি হোক)! [গির্বণঃ–স্তুতিমন্ত্রসেব্য হে ভগবন্! বিশ্বতঃ–সর্বতঃ, সর্বেষু কর্মসু প্রযুজ্যমানাঃ বৃদ্ধায়ুং–দীর্ঘায়ুষং, নিত্যং ত্বং সন্তোষ্য ইতি ভাবঃ; বৃদ্ধয়ঃ–সুখং বর্ধয়ন্তু] (১)।

৩০। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি পরমৈশ্বর্যশালী ভগবানের সীবনহেতুভূত অথবা গ্রন্থিস্বরূপ অর্থাৎ বন্ধনহেতুভূত হও। (মন্ত্রটি নিত্যসত্যপ্রকাশক। ভক্তির ও শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারাই ভগবানকে পাওয়া যায়। ৬ ভক্তি-সামর্থ্যের দ্বারা এবং সৎ-ভাবের দ্বারা আমি আমাকে ভগবানে লীন করি,–মন্ত্রে এই ভাব পরিব্যক্ত)। [ইন্দ্রস্য–পরমৈশ্বর্যশালী ভগবতঃ; স্যু–সীবনহেতুভূতং, গ্রন্থিস্বরূপং, যদ্বা– বন্ধনহেতুভূতং]।(১)। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি প্ররমৈশ্বর্যশালী ভগবানের নিত্যসত্যস্বরূপ হও। (ভাব এই যে, সত্যের দ্বারা এবং সৎ-ভাবের দ্বারাই সৎস্বরূপ ভগবানকে প্রাপ্ত হওয়া যায়। মোক্ষ-ইচ্ছু ব্যক্তি আপন হৃদয়গত ভক্তিসুধারূপ শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা ভগবানকে পূজা করেন। অতএব, শুদ্ধসত্ত্বের সঞ্চয়ে প্রবৃত্ত হও)।(২)। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি ভগবৎসম্বন্ধি অর্থাৎ ভগবানের স্বরূপ হও। (মন্ত্রটি সত্যতত্ত্বপ্রকাশক। শুদ্ধসত্ত্ব ভগবানের স্বরূপ। শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারাই ভগবানকে পাওয়া যায়)।[ঐন্দ্রং ইন্দ্রসম্বন্ধিনং, ভগবতঃস্বরূপমিত্যর্থঃ] (৩)। হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি বিশ্বদেবসম্বন্ধি অর্থাৎ সর্বদেবাত্মক বা সর্বদেবময় হও।(ভগবৎপ্রীতির জন্য নিখিল সৎ-ভাব প্রদান করা কর্তব্য)। [বৈশ্বদেবং–বিশ্বদেবসম্বন্ধিনং, যদ্বা–সর্বদেবাত্মকং সর্বদেবময়ং বা ইতি ভাবঃ]।(৪)। [এই কণ্ডিকার ভাষ্যের মধ্যে তিনটি সম্বোধন পদ দেখা যায়; যথারঞ্জু, গ্রন্থি ও সদস্। সেটি কর্মকাণ্ডের উপলক্ষেই প্রযুক্ত]।

৩১। হে ভগবন! আপনি বিবিধ রকমে বা রূপে স্বপ্ৰকাশ অথবা সর্বব্যাপী অর্থাৎ বহুরূপ এবং প্রকৃষ্টরূপে বহনকর্তা অর্থাৎ মনুষ্যদের ভবসমুদ্রের পারে নয়নকর্তা। (অতএব আমাকে উদ্ধার করুন এবং আমার ভববন্ধন ছেদন করে দিন)। [বিভু–বিবিধরূপেণ প্রকাশশীলঃ স্বপ্রকাশো বা, যদ্বা–সর্বব্যাপী বহুরূপো বা ইতি ভাবঃ] (১)। হে ভগবান্! আপনি সৎকর্মের পূরক সকর্মময় বা যজ্ঞেশ্বর এবং আত্ম-উৎকর্ষ-সম্পন্ন জনের হৃদয়ে শুদ্ধসত্ত্ব-রূপ সৎ-ভাবের সংরক্ষক হন। (অতএব, আমাতে শুদ্ধসত্ত্বরূপ সৎ-ভাব সংস্থাপিত করুন)। [বহ্নিঃ–সকর্মসম্পূরকঃ, সকর্মময়ঃ, যজ্ঞেশ্বরো বা; হব্যবাহনঃ–আত্মোৎকর্ষর্সম্পন্নেষু জনেষু শুদ্ধসত্ত্ব সদ্ভাব-সংরক্ষকঃ, যদ্বা–সদ্ভাবজনকঃ]।(২)। হে ভগবন্! আপনি জগতের মিত্রভূত হিতসাধক ও অভীষ্টবর্ষক শ্রেয়ঃবিধায়ক এবং প্রজ্ঞানস্বরূপ অর্থাৎ প্রকৃষ্টজ্ঞানসম্পন্ন হন। (অতএব আমাকে প্রজ্ঞানসম্পন্ন করুন এবং আমার অভীষ্ট পূরণ করুন)। [শ্বাত্র–জগতাং মিত্রভূতঃ হিতসাধকঃ অপিচ অভীষ্টবর্ষকঃ শ্ৰেয়োবিধায়কঃ; প্রচেতাঃ-প্রজ্ঞানস্বরূপঃ প্রকৃষ্টজ্ঞানসম্পন্নো বা] (৩)। হে ভগবন্! আপনি পাপীদের সন্তাপক পূর্ণব্রাহ্মস্বরূপ, সর্বধনোপেত এবং সর্বতত্ত্বজ্ঞ হন। (অতএব আমার অভীষ্ট পূরণ করুন এবং আমার পরমগতি বিধান করুন)। [তুথঃ পাপীনাং সন্তাপকঃ যদ্বা–পূর্ণব্রহ্মস্বরূপঃ; বিশ্ববেদাঃ সর্বধনোপেতঃ, সর্বতত্ত্বজ্ঞো বা]।(৪)। [ভাষ্যকারের মতে, মন্ত্র চারটির সম্বোধ্য–ধিষ্যাস্থিত অগ্নি। অগ্নি আশ্রয়ভূত মাটির নির্মিত স্বল্পবেদিকা বিষ্ণ্যা নামে অভিহিত হয়। সেই ধ্যিায় যে অগ্নি প্রজ্জ্বলিত হয়, মন্ত্র-কটির সম্বোধ্য–সেই বিষ্ণ্যাধিষ্ঠিত অগ্নি। আমাদের মতে মন্ত্রকটির সম্বোধ্য ভগবান। নানা গুণবিশেষণে মন্ত্রে তাঁরই স্বরূপ প্রকটিত হয়েছে। আর সেই গুণ-ব্যাখ্যানের সঙ্গে সঙ্গে প্রার্থনাকারীর নানারকম প্রার্থনা সংসূচিত হয়েছে।

৩২। হে ভগবন্! আপনি সকলেরই কামনীয় এবং ক্রান্তদর্শন অর্থাৎ প্রজ্ঞানের আধার হন।(ভাব এই যে, ভগবানের অনুগ্রহেই মানুষ প্রজ্ঞানসম্পন্ন হয়। তা থেকে প্রার্থনার ভাব এই হয় যে,–হে ভগবন্! আমাদের প্রজ্ঞানসম্পন্ন করুন)। [উশি কান্তঃ অপি কামনীয়ঃ; কবি–ক্রান্তদর্শিনঃ, যদ্বা প্রজ্ঞানাধারঃ] (১)। হে ভগবন্! সর্বপাপনাশক আপনি সকলের পালক ও ধারক হন। (ভাবার্থ, হে ভগবন্! সর্বপাপনাশক আপনি আমাদের সকল পাপ থেকে রক্ষা করুন এবং পালন করুন)। অঙ্রিঃ –সর্বপাপনাশকঃ; বম্ভারিঃ–সর্বেষাং পালকঃ ধারকঃ চ ইত্যর্থঃ] (২)। হে ভগবন্! শুদ্ধসত্ত্বরূপ হবির গ্রাহক অথবা সকলের রক্ষক আপনি শুদ্ধসত্ত্বের আধার হন। (ভাব এই যে, হে ভগবন্! আমাদের শুদ্ধসত্ত্বসম্পন্ন করুন)।[অবসূ–শুদ্ধসত্ত্বরূপঃ হবিগ্ৰাহকঃ ইতি ভাবঃ, যদ্বা– সর্বেষাং রক্ষকঃ] (৩) হে ভগবন্! বিশুদ্ধতাপ্রাপক নিত্যশুদ্ধ আপনি সকলের পরমপবিত্রতাবিধায়ক হন। (ভাবার্থ,ভগবানের অনুগ্রহে আমাদের সকল রকম কলুষ দূরীভূত হোক এবং আমাদের হৃদয়, নির্মল হোক)–[শুন্ধু নিত্যপূত নিত্যশুদ্ধ বা ইত্যর্থঃ; মার্জালীয়ঃ–পরমপবিত্রতাসাধকঃ ইতি ভাবঃ]](৪)। হে ভগবন্! সকলের অধিপতি–স্বামী আপনি, সকলের জীবনস্বরূপ হন অর্থাৎ ক্ষীণপাপ বা তপঃক্ষীণ ধর্মবুদ্ধিসম্পন্নদের রক্ষক হন। (ভাবার্থ,–ভগবানই সকলের প্রাণ বা আয়ুঃ তার অনুগ্রহেই সকলে জীবিত থাকে; অথবা সৎ-জ্ঞানসম্পন্ন জনের হৃদয়ে ভগবান আপনা আপনি প্রকাশিত হন)। [সম্রাট–সম্যক্‌বিরাজমান, সর্বেষাং অধিপতিঃ স্বামীঃ ইত্যর্থঃ; কৃশানুঃ–সর্বেষাং জীবনস্বরূপ, যদ্বা, ক্ষীণপাপানাং তপঃক্ষীণানাং ধর্মবুদ্ধিসম্পন্নানাং বা রক্ষকঃ ইতি ভাবঃ] 1(৫)। হে ভগবন্! আপনি ভক্তের ভক্তির সাথে বর্তমান আছেন; অতএব আপনি পতিত উদ্ধারক পুণ্যবিধায়ক হন। (ভাবার্থ,ভগবান্ ভক্তির স্বরূপ। একমাত্র ভক্তির দ্বারাই ভগবানকে পাওয়া যায়। [পরিসদ্যঃ–ভক্তেন ভক্ত্যা সহ বর্তমানঃ ইত্যর্থঃ; পুবমানঃ–পতিতোদ্ধারকঃ পুণ্যবিধায়কঃ ইত্যর্থঃ] (৬) হে ভগবন্। আপনি আকাশরূপ–বিরাট এবং বিশ্বরূপ বা সকলের পরমাশ্রয় হন। (ভাব এই যে, একমাত্র ভগবানই পরম আশ্রয়। সেই ভগবান আমাদের পরম আশ্রয় দান করেন)। [নভঃ:–আকাশরূপঃ, বিরাটরূপঃ ইত্যর্থঃ প্রতক্কা–সর্বেষাং পরমাশ্রয়ঃ, বিশ্বরূপঃ বা] (৭) হে ভগবন্! পবিত্রতাকারক আপনি অন্তর-বাহ্য উভয়েরই পবিত্রতাসাধক অর্থাৎ সৎ-ভাব-জনক হন। (ভাব এই যে,ভগবানের অনুগ্রহে আমাদের বাহ্য ও অন্তর পবিত্র হোক এবং শুদ্ধসত্ত্ব উপজিত হোক)। [মৃষ্টঃ–পবিত্রকারকঃ; বাহ্যসূদনঃ– বাহ্যান্তরস্য পবিত্রতাসাধকঃ ইতি যাবৎ, সদ্ভাবজনকঃ ইতি ভাবঃ] (৮)। হে ভগবন্! সৎকর্মের কারণভূত আপনি বিশ্বের প্রকাশক বা সঙ্কর্মে প্রবর্তক হন। (ভাবার্থ,–জ্যোতির আধার ভগবান্ জ্ঞানজ্যোতিঃ বিচ্ছুরণে আমাদের প্রদীপ্ত করুন)। [ঋতধামা–সকর্মণাং কারণভূতঃ; স্বর্জোতিঃ–বিশ্বেষাৎ সর্বেষাং প্রকাশকঃ, সকর্মণি প্রবর্তকঃ বা ইত্যর্থঃ]।(৯)।

৩৩। হে ভগবন্! আপনি সমুদ্রের ন্যায় অগাধ প্রজ্ঞানসম্পন্ন অথবা অদ্বিতীয় প্রজ্ঞানাধার; অপিচ, আপনি বিশ্বের সকল দেবভাবের বা সৎকর্মের আধারস্বরূপ ইন। অথবা,–বিশালত্ব-হেতু সমুদ্র যেমন বারিরাশির আধার, হে ভগবন্! অনন্তত্ব-হেতু আপনিও তেমনি বিশ্বের সর্ববিধ জ্ঞান-কর্মের কারণ-স্বরূপ। অথবা,–বিশ্বের সকল বারিরাশি যেমন সমুদ্রকে প্রাপ্ত হয়, তেমনি নিখিল জ্ঞানকর্মধারা, কৃতাকৃতনির্বিশেষে, ভগবানে লীন হয়ে থাকে। (ভাব এই যে, আমাদের সকল জ্ঞানকর্ম ভগবানকে প্রাপ্ত হোক)। [সমুদ্র–সমুদ্রঃ ইব অগাধঃ প্রজ্ঞানসম্পন্নঃ, যদ্বা, অদ্বিতীয় প্রজ্ঞানাধারঃ ইত্যর্থঃ; অথবা, সমুদ্রঃ সমুদ্রবৎ, সমুদ্র যথা বিশালত্বাৎ সর্বেষাং বারীণং আধারঃ ভবতি তৎ; বিশ্বব্যচাঃ–বিশ্বেষাং সর্বেষাং দেবভাবানাং কৰ্মৰ্ণং বা ব্যচয়িতা আধাররূপঃ ইত্যর্থ, অথবা বিশ্বব্যচা–অনন্তত্বৎ বিশ্বেষাং সর্বেষাং জ্ঞানকর্মণাং কারণস্বরূপ, অথবা বিশ্বব্যচঃ–সর্বস্য ধারকঃ] (১)। হে ভগবন্! জন্মজরারহিত অথবা সকল ভূতে বর্তমান আপনিই একমাত্র ত্রাণকর্তা, অথবা সর্বভূতের পরমাশ্ৰয় বিশ্বমূলাধার হন। (ভাবার্থ-ভগবান্ বিশ্বমূলাধার পরমাশ্রয়। প্রার্থনা–তিনি আমাদের পরমাশয় বিধান করুন)। [অজঃ–জন্মজরারহিতং, যদ্বা–সর্বেষু ভূতজাতেষু বর্তমানঃ ইত্যর্থঃ; একপাৎ–একঃ এব পাতা ত্রাণকর্তা, যদ্বা–সর্বভূতানাং পরমাশ্রয়ঃ বিশ্বমূলাধারঃ বা ইত্যর্থঃ] (২)। হে ভগবন্! আপনি বিকাররহিত নির্বিকার অতএব জগকারণ হন; অথবা, হে আমার হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! তুমি উৎকর্ষসাধক এবং কারণস্বরূপ ভগবান্ থেকে সমুদ্ভূত হও। (নিত্যসত্যমূলক এই মন্ত্র ভগবানের মাহাত্ম-প্রকাশক। ভাব এই যে, আমাদের হৃদয়নিহিত হয় শুদ্ধসত্ত্ব ভগবানের সম্বন্ধযুত হোক)। [অহিঃ– বিকাররহিতঃ নির্বিকারঃ ইত্যর্থঃ; বুধঃ–জগকারণঃ সবেষাং উৎপত্তিমূলঃ ইতি ভাবঃ, অথবা, অহিঃ–ঔৎকর্ষসাধক, বুপ্ল্যঃ–কারণরূপাৎ ভগবতঃ সমুদ্ভুতঃ ইতি ভাবঃ] (৩)। হে আমার হৃদয়! তুমি কর্ম-সমূহের নিম্পাদক; অপিচ, তুমি ভগবৎসম্বন্ধযুত অর্থাৎ ভগবানের প্রীতিসাধক হও; অতএব তুমি ভগবৎ-অধিষ্ঠানের প্রকৃষ্ট আসন হও। (ভাব এই যে, আমাদের কর্মসমূহ ভগবানের প্রীতিসাধক হোক এবং আমাদের কর্মের প্রভাবে যেন আমরা ভগবানকে প্রতিষ্ঠাপিত করতে সমর্থ হই)। বাক্কৰ্মৰ্ণাং নিষ্পদকঃ, ঐন্দ্রং–ভগবৎসম্বন্ধযুতঃ ভগবৎপ্রীতিসাধকঃ ইত্যর্থঃ] (৪)। হে আমার জ্ঞানভক্তি! তোমরা সৎকর্মের প্রবর্তক হও; (অর্থাৎ দ্বারদেশ যেমন গৃহকে প্রাপ্ত করায়, জ্ঞানভক্তিও তেমনি লোকসমূহকে সৎকর্মে প্রবিষ্ট করে), অতএব তোমরা আমাকে সন্তাপিত করো না অর্থাৎ আমাকে পরিত্যাগ করে কষ্ট দিও না। (ভাব এই যে, জ্ঞানভক্তিই সকল সক্কর্মের মূল। প্রার্থনার ভাব এই যে, আমাতে যেন সেই জ্ঞানভক্তি অবিচলিতভাবে বর্তমান থাকে)। [ঋতস্য দ্বারৌ–সকর্মণিঃ প্রবর্তকৌ, যদ্বা–দ্বারদেশঃ যথা গৃহং প্রাপয়তি, তদ্বৎ জ্ঞানভক্তী লোকান্ সৎকর্মাণি প্রাবিশয়াতে ইতি ভাবঃ]।(৫)। সৎপথে প্রবর্তক অথবা সৎপথের প্রদর্শক হে জ্ঞানদেব! আপনি সৎপথে বর্তমান বা সৎকর্মে নিযুক্ত আমাকে প্রবর্ধিত বা প্রকৃষ্টরূপে পরিচালিত করুন। আরও, আপনার অনুগ্রহে, দেবভাবজনক বা ভগবৎ-প্রাপক প্রবর্তমান এই কর্মমাগে যেন আমার কল্যাণ বা সিদ্ধি লাভ হয়। (ভাবার্থ, ভগবান্ আমাদের সৎপথে পরিচালিত করুন এবং আমাদের সকল মঙ্গল বিধান করুন। [অধ্বপতে–সৎপথি সৎকর্মাণি বা প্রবর্তক, সৎপথ প্রদর্শক হে জ্ঞানদেব ইত্যর্থঃ; অধ্বনাং–সৎকর্মণি নিয়োজিতঃ; দেবযানে–দেবভাবজনকে ভগবৎপ্রাপকে বা ইত্যর্থঃ] (৬)। [ভাষ্যমতে প্রথম মন্ত্রের সম্বোধ্য ব্রহ্মাসন, দ্বিতীয় মন্ত্রের সম্বোধ্য শালদ্বার, তৃতীয় মন্ত্রের সম্বোধ্য প্রজাহিত নাম গার্হপত্য-অগ্নি, চতুর্থ মন্ত্রের সম্বোধ্য সদ, পঞ্চম মন্ত্রের সমোধ্য শাশদ্বার এবং ষষ্ঠ মন্ত্রের সম্বোধ্য মার্গপালক রবি। বিভিন্ন মন্ত্রের পূর্বোক্তরূপ বিভিন্ন সম্বোধ্য পদ অধ্যাহারে, মন্ত্রগুলির ক্রিয়াকাণ্ড-অনুমোদিত যে অর্থ অধ্যাহৃত হয়, ভাষ্যে তার পরিচয় আছে]।

৩৪। হে ভগবন! আপনি মিত্রভূত ব্যক্তির চক্ষুর দ্বারা অর্থাৎ সখা যেমন সখাকে হিতচক্ষুতে দর্শন করে তেমনিভাবে আমাকে দর্শন করুন। (প্রার্থনার ভাব এই যে,–হে ভগবন্! আপনি আমাদের মিত্রভূত হয়ে আমাদের পরম মঙ্গল বিধান করুন)। [চক্ষুসা–নেত্রেণ, যদ্বা–সখা যথা সখায়াং হিতচক্ষুষা পশ্যতি তথা]।(১)। কর্মের সাথে সঞ্জাত হে প্রজ্ঞানরূপী দেবগণ বা দেবভাবসমূহ! আপনারা আমার কর্মের বা স্তুতির সাথে সম্মিলিত হোন। (ভাব এই যে, আমাদের কর্ম এবং উপাসনা জ্ঞানসমন্বিত হোন)। [সগরাঃ-কর্মণা সহ সঞ্জাতাঃ ইত্যর্থ; সগরা সম্মিলিতাঃ, সঙ্গতাঃ ইতি যাবৎ](২)। হে প্রজ্ঞানরূপী দেবগণ বা দেবভাবসমূহ! রুদ্রদেব অর্থাৎ ভগবৎ-সম্বন্ধযুত সুখের দ্বারা অথবা শত্রুনাশক উগ্র বলের দ্বারা আমাকে পালন করুন। (ভাব এই যে,হে ভগবন্! আমাদের শত্রুসম্বন্ধ থেকে বিচ্ছিন্ন করুন এবং আপনার সম্বন্ধী পরম সুখের বিধান করুন)। [রৌদ্রেণরুদ্রদেবত্যেন, ভগবৎসম্বন্ধযুতেন ইতি.ভাবঃ; অনীকেন–সুখেন; অথবা–রৌদ্রেণ–শত্রুবিনাশকত্বাৎ উগ্রেণ; অনীকেনবলেন; পাত পালয়ত, পরিত্রায়ত]।(৩)। হে প্রজ্ঞারূপী দেবগণ! আপনারা পরমধনের দ্বারা আমার অভীষ্ট পূরণ করুন। এবং শত্রুর আক্রমণ হতে নিরন্তর রক্ষা করুন। (ভাব এই যে,-হে ভগবন্! পরমধন দানে অভীষ্ট পূরণ করুন এবং শত্রুর আক্রমণ থেকে রক্ষা করুন)। [পিপৃত–ধনাদিভিঃ অভীষ্টং পূরয়তঃ, যদ্বা। পরমধনদানেন প্রবধয়ত ইতি ভাবঃ; গোপায়ত–নিরন্তরং রক্ষতঃ–শত্রোরাক্রমণাৎ ইতি ভাবঃ](৪)। হে দেবগণ! আপনাদের নমস্কার করি অর্থাৎনমস্কার্যের দ্বারা পরিচর‍্যা করি। আপনারা আমাকে পরিক্ষীণ করবেন না অর্থাৎ আমার কর্ম-সামর্থের হীনতা-সাধন করবেন না। (ভাব এই যে-ভগবানের অনুগ্রহে আমাদের কর্ম-সামর্থ্য প্রবর্ধিত হোক) (৫)। [এই কণ্ডিকার প্রথম মন্ত্র ভগবৎ-সম্বোধনে এবং দ্বিতীয় মন্ত্র হৃদয়-নিহিত শুদ্ধসত্ত্বের সম্বোধনে বিনিযুক্ত। তৃতীয় মন্ত্র আত্ম উদ্বোধক ও প্রার্থনামূলক বলে মনে করি। অবশ্য এ সবই আধ্যাত্মিক দৃষ্টিকোণের বিচারে প্রযুক্ত। ভাষ্যকার ক্রিয়া-কাণ্ডের দিকে লক্ষ্য রেখে স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা দিয়েছেন, এবং আমরা তা অস্বীকার করছিনা; কারণ আমরা ক্রিয়া কাণ্ডের বিরোধী নই)।

৩৫। হে ভগবন্! আপনি দৃশ্যমান, জ্যোতীরূপ হন। সর্বরূপযুক্ত সময় আপনি বিশ্বের সমস্ত দেবভাবের বা শুদ্ধসত্ত্বের দীপক বা উদ্দীপক হন। (কেবলমাত্র ভগবানের অনুগ্রহেই জ্ঞানজ্যোতীর দ্বারা হৃদয় উদ্ভাসিত হয়। তিনিই একমাত্র সৎ-ভাবের সঞ্চার করেন। অতএব প্রার্থনা–হে ভগবন্! জ্ঞানজ্যোতিঃ বিচ্ছুরণ করে সৎ-ভাব উন্মোষণের দ্বারা আমাদের পরমপদে প্রতিষ্ঠাপিত করুন)। [বিশ্বরূপং–সর্বরূপৈযুক্তঃ, সর্বময়ঃ ইত্যৰ্থঃ, সমিৎ–দীপকঃ, উদ্দীপকঃ ইত্যর্থঃ] ।(১)। হে আমার হৃদয়নিহিত দেবভাব! ইহজন্মে কৃত কর্মের দ্বারা সঞ্জাত, জন্মসহ আগত অথবা পূর্বজন্মকৃত কর্মের সাথে জাত এবং অপরের কৃত অর্থাৎ বহিঃ-অন্তঃ শত্রুর কৃত দুরিতসমূহের আপনি প্রভূত রকমে নিয়ন্তা অর্থাৎ বিনাশক হন। (শত্রুগণ যাতে আমাদের কর্মের অনুষ্ঠানে আমাদের বাধা দিতে না পারে, সেইভাবে আপনি আমাদের সুরক্ষিতভাবে প্রতিষ্ঠাপিত করুন); সেইজন্য, আপনি লোকসমূহের অশেষ কল্যাণকারী হন। স্বাহা মন্ত্রে আপনাকে উদ্বোধিত করছি, আমাদের কর্ম সুসিদ্ধ হোক। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধন-মূলক। ভাব এই যে, আমাদের হৃদয় নিহিত শুদ্ধসত্ত্বের প্রভাবে আমাদের পরম মঙ্গল সাধিত হোক)। [তনুকৃতেভ্যঃ ইহজন্মনি কৃতেন কমণা সঞ্জাতেভ্যঃ ইতি ভাবঃ, দ্বেষোভ্যঃ–জন্মনা সহ আগতেভ্যঃ যদ্বা– পূর্বজন্মকৃতেন কর্মর্ণা সহ আগতেভ্যঃ ইত্যর্থঃ; অন্যেভ্যঃ–অপরৈঃ কৃতেভ্যঃ, যদ্বা–বহিরন্তঃশত্রণাং কৃতেভ্যঃ ইতি যাবৎ দুরিতস্য ইতি ভাবঃ]।(২)। আমাদের সৎ-ভাব-গ্রহণে (অথবা সকর্মর দ্বারা) প্রিয়মাণ সর্বতোব্যাপ্ত ভগবান, আমাদের হৃদয়-নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণ করুন। সেই ভগবানকে স্বাহা মন্ত্রে পূজা করি; আমাদের অনুষ্ঠান সুসিদ্ধ হোক। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, ভগবান্ আমাদের কর্মের দ্বারা প্রীত হয়ে আমাদের হৃদয়ের শুদ্ধসত্ত্ব গ্রহণ করুন, অপিচ, আমাদের পরম-মঙ্গল বিধান করুন)। [জুষাণঃ-প্রিয়মাণঃ; আজ্যস্য অস্মাকং হৃন্নিহিতং শুদ্ধসত্ত্বং] (৩)। [আমাদের মতে, আধ্যাত্মিক ভাবানুসারে, এই কণ্ডিকার প্রথম মন্ত্র ভগবৎ-সম্বোধনে এবং দ্বিতীয় মন্ত্র হৃদয়-নিহিত শুদ্ধসত্ত্বের সম্বোধনে বিনিযুক্ত। তৃতীয় মন্ত্র আত্ম-উদ্বোধক ও প্রার্থনামূলক। ভাষ্যমতে, ক্রিয়াকাণ্ডের প্রয়োজনে, প্রথম মন্ত্র আজ্য সম্বোধনে, দ্বিতীয় ও তৃতীয় মন্ত্র সোম-সম্বোধনে প্রযুক্ত। দ্বিতীয় মন্ত্রে আমরাও সোম-সম্বোধন সমর্থন করেছি। তবে আমাদের সোম-হৃদয়ের শুদ্ধসত্ত্ব–সোমরসরূপ মাদকদ্রব্য নয়]।

৩৬। প্রজ্ঞানরূপী হে ভগবন্! শুদ্ধসত্ত্বজনক দীপ্তিদান ইত্যাদি গুণযুক্ত বিশ্বের সকল রকম প্রকৃষ্ট জ্ঞানের (প্রজ্ঞানের) উন্মেষকারী আপনি আমাদের পরমধনদানের জন্য আমাদের শোভনমার্গে (সৎপথে) পরিচালিত করুন। (ভগবানের বিজ্ঞানশক্তির পরিমাণ বা পরিসীমা নেই। সেই ভগবান আমাদের সৎপথে পরিচালিত এবং সৎকর্মে নিয়োজিত করুন)। অপিচ হে দেব! আমাদের থেকে অর্থাৎ আমার অনুষ্ঠিত আরব্ধ কর্ম হতে অভিলষিতক্রিয়া-প্রতিবন্ধক পাপকে বিমুক্ত অর্থাৎ প্রথ করুন। হে দেব! আপনার প্রীতির জন্য নমস্কর্ম-সহযুত স্তুতিবাক্য উচ্চারণ করছি। (সকর্মের প্রতিবন্ধক শত্রুর অন্ত নেই। প্রজ্ঞানরূপী ভগবানের প্রভাবে সকল বাধক শত্রুই বিনাশপ্রাপ্ত হয়। অতএব প্রার্থনা হে ভগবন্! আমাদের সকর্মের বিরোধীদের বিনাশ করুন এবং সৎ-ভাবের উন্মেষণে আমাদের অভীষ্ট ফল প্রদান করুন)। [অগ্নে–প্রজ্ঞানরূপিন্ হে ভগবন্!; দেব–দানাদিগুণযুতানি অপিতু শুদ্ধসত্ত্বজন কানি; জুহুরাণং-কুটিলীকর্তুমিচ্ছ অভিলষিতক্রিয়াপ্রতিবন্ধকং ইতি যাবৎ] (১-২)

৩৭। আমাদের প্রার্থিত প্রজ্ঞানস্বরূপ ভগবান্ আমাদের পরমধন প্রদান করুন। আরও সেই জ্ঞানদেব শত্রুদের বিদূরিত করে আমাদের অধিষ্ঠিত হোন। তারপর সেই ভগবান্ আমাদের পরমধনদানের জন্য শত্রুদের অথবা শত্রুসম্বন্ধী ধনসমূহকে জয় করুন এবং সেই ভগবান্ আমাদের হৃদয়নিহিত শুদ্ধসত্ত্বগ্রহণে প্রীত হয়ে আমাদের সকর্মবিরোধী অন্তঃশত্রুকে বিনাশ করুন। স্বাহা মন্ত্রে সেই ভগবানকে পূজা করি; আমার, কর্মানুষ্ঠান সুহুত অর্থাৎ সুসিদ্ধ হোক। (ভাব এই যে,ভগবান্ অশেষ প্রজ্ঞানের আধার। তাঁর অনুগ্রহে আমাদের মধ্যে প্রজ্ঞান উপজিত হোক। সজ্ঞানদানে সেই ভগবান্ আমাদের শত্রুদের বিনাশ করুন এবং আমাদের পরমপদে প্রতিষ্ঠাপিত করুন। মন্ত্রে এই প্রার্থনা প্রকটিত)।(১)।

৩৮। বিশ্বব্যাপিন্ হে ভগবন্! আপনি অনন্ত সত্ত্বসমুদ্রের দ্বারা আমাদের ব্যাপ্ত করুন এবং অনন্তনিবাস বা শ্রেষ্ঠনিবাস লাভের জন্য আমাদের সামর্থ্যসম্পন্ন করুন। [বিষ্ণো–বিশ্বব্যাপিন্ হে ভগবন্ উরু–বিস্তীর্ণেন, অনন্তেন বা সত্ত্বসমুদ্রেব ইতি ভাবঃ; উরুক্ষয়ায়–অনন্তনিবাসায়, শ্রেষ্ঠনিবাসায়]।(১)। আরও, হে শুদ্ধসত্ত্বের জনক ভগবন্! আমাদের হৃদয়-নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব বা ভক্তিসুধা গ্রহণ করুন এবং সৎকর্মের অনুষ্ঠাতা আমাদের প্রকৃষ্টরূপে প্রবর্ধিত করুন। স্বাহামন্ত্রে আমরা আপনার পূজা করি; আপনার অনুগ্রহে আমাদের কর্মানুষ্ঠান সুহুত হোক। [ঘৃতঘোনে–হে শুদ্ধসত্ত্বজনক ভগব; ঘৃতং-হৃদয়নিহিতং শুদ্ধসত্ত্বং, ভক্তিসুধা বা ইত্যর্থঃ] (২) মন্ত্র দুটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, শুদ্ধসত্ত্বের সাথে আপনি আমাদের মধ্যে আগমন করুন; আমরা যাতে শ্রেষ্ঠনিবাসভূত আপনাকে প্রাপ্ত হই, সেইরকম ভাবে আমাদের সামর্থ্য সম্পন্ন করুন। অপিচ, আপনার প্রদত্ত শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা আমাদের উদ্ধার করুন এবং আপনাতে প্রতিষ্ঠাপিত করুন)।

৩৯। স্বতঃ-প্রকাশমান্ জ্ঞানপ্রেরক (বা জ্ঞানপ্রদাতা) হে ভগবন্! আমাদের হৃদয়সঞ্জাত এই শুদ্ধসত্ত্ব আপনাকে সমর্পণ করছি। আপনাকে অর্পিত সেই শুদ্ধসত্ত্বস্বরূপ সোম আপনি গ্রহণ করুন। শুদ্ধসত্ত্বের প্রেরক অথবা শুদ্ধসত্ত্বের সংরক্ষক আপনাকে আমাদের অন্তঃশত্রুগণ যেন হিংসা না করে। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। সাধক ভগবানকে আপন অন্তরস্থিত উৎসর্গ করছেন। প্রার্থনা করছেন, যেন আমাদের অন্তঃশত্রু আপনাকে হৃদয় হতে অপসারিত করতে সমর্থ না হয়, অথবা আমাদের অন্তঃশত্রুর উপদ্রব যেন বিনষ্ট হয়। অপিতু, শত্রুবিনাশে শুদ্ধসত্ত্ব যাতে অবিচলিতভাবে তিষ্ঠিতে পারে, হে ভগব, আপনি তার বিহিত করুন)। [দেব–স্বতঃপ্রকাশমান্? সবিতঃ-জ্ঞানপ্রদাতঃ জ্ঞানপ্রেরক বা হে ভগব; সোমঃশুদ্ধসত্ত্বঃ] (১)। দীপ্যমান্ শুদ্ধসত্ত্বরূপী হে ভগবন্! আপনি নিত্যকাল স্বতঃপ্রকাশমান হয়ে দেবভাবসম্পন্নদের প্রাপ্ত হন অর্থাৎ দেবভাবগুলির সাথে কিংবা দেবভাবসম্পন্নদের হৃদয়ে আগমন করেন। প্রার্থনাকারী আমি মনুষ্যোচিত অর্থাৎ নরদেবতাদের মধ্যে সম্ভোবিত পৌরুষ-সামর্থ্য প্রার্থনা করি। আপনি ধনের ও পোষণের সাথে অর্থাৎ পরমুধনের সাথে আমাকে প্রাপ্ত হোন। (প্রার্থনামূলক এই মন্ত্রটি নিত্যসত্য-প্রকাশক। ভগবান্ সৎ-ভাব-সম্পন্নদের মধ্যে নিজেই আপনা-আপনি প্রকাশমান্ হন। এখানে সাধক নরদেবতাদের মধ্যে সম্ভাবিত পৌরুষ-সামর্থ প্রার্থনা করছেন। প্রার্থনার ভাব– পরমধনদানে ভগবান্ আমাকে উদ্ধার করুন)। [দেব–দীপ্যমান; দেবঃস্বতঃপ্রকাশমানঃ সুন্ ইতি যাবৎ]।(২)। হে ভগবন্! স্বাহা মন্ত্রে আপনাকে পূজা করি, অথবা শুদ্ধসত্ত্ব নিবেদন করি। তাতে, আপনার অনুগ্রহে, কামনাবাসনা ইত্যাদি-রূপ পাপসম্বন্ধের বন্ধন হতে অর্থাৎ ভববন্ধন হতে মুক্তিলাভ করি। (ভাব এই যে, শুদ্ধসত্ত্বরূপী ভগবান্ সৎ-ভাব ইত্যাদির দ্বারা আমাদের প্রবর্ধিত করুন এবং ভববন্ধন হতে মুক্ত করুন)। [বরুণস্য-সংসার-বন্ধন-জনকস্য কামনাবাসনাদিরূপস্য পাপসম্বন্ধস্য]।

৪০। হে সৎকর্মের পালক অথবা সকর্মকারিগণের প্রতি অনুগ্রহপরায়ণ প্রজ্ঞানময় দেব! আপনি সৎকর্মের পালক অথবা সৎকর্মকারিগণের প্রতি প্রীতি-অতিশয়যুক্ত অর্থাৎ তাঁদের মধ্যে সভাবের সংরক্ষক হন। (অতএব আমি আপনার শরণ নিলাম। শরণাগত আমাকে আপনি সৎ-ভাবের অধিকারী করে ত্রাণ করুন)। হে দেব! সেইরকম সৎকর্মপালক আপনার যে পবিত্রকারক পুণ্যময় শরীর, আমাতে সংন্যস্ত বা বর্তমান ছিল, আপনার সেই পবিত্রকারক শরীর আপনাতেই বর্তমান থাকুক; আর কলুষকলঙ্কপরিমগ্ন পাপপঙ্কিল আমার যে দেহ কলুষনাশের জন্য আপনাতে সংন্যস্ত করেছিলাম, আপনার সহযোগে পবিত্রতাপ্রাপ্ত আমার সেই দেহ সৎকর্মসাধনের জন্য আমাতে ফিরে আসুক অথবা পরমাত্মায় লয়প্রাপ্ত হোক। অথবা হে দেব! সেই রকম সৎকর্মের পালক আপনার যে পবিত্রকারক পুণ্যময় শরীর আপনাতে অবস্থিত আছে, পবিত্রকারক পতিত-উদ্ধারক আপনার সেই দেহ আমাতে বর্তমান হোক; আর, কলুষকলঙ্ক-পরিশ্লান আমার যে শরীর, আমাতে অবস্থিত থেকে অশেষ ক্লেশ-প্রদানে বন্ধনমূল উৎপাদন করছিলেন; সেইরকম অকিঞ্চিৎকর আমার সেই পাঞ্চভৌতিক দেহ, পাপকলুষনাশের জন্য অর্থাৎ ভববন্ধন মোচনের জন্য আপনার পুণ্যময় পবিত্রকারক শরীরে বিলীন হোক।(মন্ত্রাংশ প্রার্থনামূলক। এখানে প্রার্থনাকারী পরমাত্মায় আত্মসম্মিলনের আকাঙ্ক্ষা জানাচ্ছেন। প্রার্থনার ভাব এই যে, কলুষকলঙ্কপরিলিপ্ত আমার এই ভৌতিক শরীর নাশ করে আমাতে আপনার পুণ্যপূত দেবদেহ স্থাপন করুন। মর্মার্থ এই যে, আমাকে পাপ হতে পরিত্রাণ করুন; আমাকে পবিত্র সত্ত্বসমন্বিত করুন; আপনাতে আত্ম-সম্মিলন করে আমি যেন পরাগতি লাভ করি, হে দেব! তা বিধান করুন)। [ব্রতপা–সকর্মপালক; ব্রতপাঃ–সকর্মণঃ পালকঃ; ময়ি অভূৎ–ময়ি সংন্যক্তং অভবৎ; অথবা–ত্বয়ি অভূৎ ত্বদীয় আত্মনি অবস্থিতং ভবতি]।(১)। হে সঙ্কর্মের পালক। প্রজ্ঞানের আধার দেব! (আপনার ও আমার উভয়ের শরীরে এইরকম বিনিময় হলে) আমার অনুষ্ঠিত সকর্মসমূহ, আপনার ও আমার উভয়ের সাথে প্রবর্তিত হোক অর্থাৎ আমার কার্যে আমার মতো আপনারও আদর বা প্রীতি হোক। (ভাব এই,অনুষ্ঠানরূপ ব্রত আমি সম্পন্ন করি, আর সেই কর্মের পালনরূপ ব্ৰত আপনি গ্রহণ করুন)। অপিচ, দীক্ষার বা সৎকর্মের পালক ভগবান, আমার দীক্ষারূপ শোভন অনুষ্ঠান অবগত হোন অর্থাৎ স্বীকার বা গ্রহণ করুন। আমার শারীর বাঁচিক মানস অথবা সাত্ত্বিক রাজস ও তামস তিন রকম তপঃকর্মের পালক ভগবান্ আমার উক্ত রকম তিনপ্রকার তপঃ কর্ম অবগত হোন অর্থাৎ স্বীকার বা সুসিদ্ধ করুন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। আমার অনুষ্ঠিত কর্ম সৎ-ভাব-সমন্বিত হোক, অপিচ, আমার প্রতি অনুগ্রহপরায়ণ হয়ে ভগবান্ আমার পূজা গ্রহণ করুন– মন্ত্রে এই ভাব পরিব্যক্ত)। [ব্রতপতে–সৎকর্মপালক প্রজ্ঞানাধার হে দেব!; ব্ৰতানি–মদনুষ্ঠিতানি কর্মানি ইতি যাবৎ; নৌতুভ্যং মহং চ; দীক্ষাপতি-দীক্ষায়ঃ সকর্মণঃ বা পালকঃ দেবঃ; দীক্ষাং-মদনুষ্ঠিত সৎকর্ম ইত্যর্থ; তপস্পতি–তপসা পালকঃ, শারীরবাচিকমানস যদ্বা সাত্ত্বিকরাজসস্তামসত্রিবিধতপকারিণাং পালকো রক্ষকোঃ বা সঃ দেবঃ]। [অগ্নে ব্রতপা ইত্যাদি মন্ত্রে আহবনীয়ে সমিধ আধান করতে হয়। এই কণ্ডিকার মন্ত্র দুটি অগ্নি-বিষয়ক। অগ্নি-শরীরের দ্বারা আত্মশরীরের কৃত ব্যত্যয় অধস্তন কর্মকলাপের পরিশোধন করে, স্বশরীর-কামনায় মন্ত্রে প্রার্থনা জানান হয়েছে। ভাষ্যের প্রারম্ভে ভাষ্যকার এই ভাবেরই অভিব্যক্তি করেছেন। কিন্তু কণ্ডিকার মন্ত্র দুটির বিভিন্ন অংশে চরম প্রার্থনা প্রকাশ পেয়েছে বলেই আমরা মনে করি। নিষ্কাম-কর্মের চরম পরিণতি এখানেই দেখতে পাই]।

৪১। বিশ্বব্যাপিন্ হে ভগবন্! আপনি অনন্ত সত্ত্বসমুদ্রের দ্বারা আমাদের ব্যাপ্ত করুন এবং অনন্তনিবাস বা শ্রেষ্ঠনিবাস লাভের জন্য আমাদের সামর্থ্যসম্পন্ন করুন। [বিষ্ণো–বিশ্বব্যাপি হে ভগব; কৃষি-কুরু, সামর্থ্যসম্পন্নান্ কুরু ইতি ভাবঃ] (১)। আরও, হে শুদ্ধসত্ত্বজনক ভগবন্! আমাদের হৃদয়-নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব বা ভক্তিসুধা গ্রহণ করুন এবং সঙ্কর্মের অনুষ্ঠাতা আমাদের প্রকৃষ্টভাবে প্রবর্ধিত করুন। স্বাহামন্ত্রে আমরা আপনার পূজা করি; আপনার অনুগ্রহে আমাদের কর্মানুষ্ঠান সুহুত হোক। [ঘৃতঘোনে–হে শুদ্ধসত্ত্বজনক ভগব; ঘৃতং হৃদয়-নিহিতং শুদ্ধসত্ত্বং, ভক্তিসুধা বা ইত্যর্থঃ]।(২) মন্ত্র দুটি প্রার্থনামূলক। প্রার্থনার ভাব এই যে, শুদ্ধসত্ত্বের সাথে আপনি আমাদের মধ্যে আগমন করুন; আমরা যাতে শ্রেষ্ঠনিবাসভূত আপনাকে প্রাপ্ত হই, সেইরকমভাবে আমাদের সামর্থ্য সম্পন্ন করুন। অপিচ, আপনার প্রদত্ত শুদ্ধসত্ত্বের দ্বারা আমাদের উদ্ধার করুন এবং আপনাতে প্রতিষ্ঠাপিত করুন। ভাষ্যের প্রারম্ভেই ভাষ্যকার বলেছেন, এটি ঘূপসম্পাদন মন্ত্র। ভাষ্যকার মন্ত্রের যে অর্থ নিষ্পন্ন করেছেন, তা এই–হে ব্যাপক, আহবনীয়, শত্রুদের মধ্যে বহুল পরাক্রম করো এবং ব্রহ্মগৃহনিবাসের জন্য আমাদের বহু করো। হে ঘৃতেনে অগ্নে! হুয়মান এই আজ্য গ্রহণ করো এবং যজমানকে অতিশয়িতভাবে প্রবৃদ্ধ করো। তেমনি আপনার উদ্দেশ্যে বিহিত আমাদের যজ্ঞ সুসম্পন্ন হোক। ভাষ্যের এ অর্থে লৌকিক প্রার্থনায় লৌকিক ঐশ্বর্য-লাভের বিষয়ই সূচিত করে। যে অর্থ ভাষ্যকার নিষ্পন্ন করেছেন, কর্মকাণ্ডের দিক দিয়ে দেখলে হয়তো সে সম্বন্ধে মতভেদ না হতে পারে; কিন্তু আমাদের পন্থার অনুসরণে, আমরা কোনক্রমেই ভাষ্যকারের সাথে একমত হতে পারি না। আমাদের মতে এই কণ্ডিকার মন্ত্র দুটির লক্ষ্য ভগবান্। মন্ত্রে তাঁকেই সম্বোধন করা হয়েছে]।

৪২। হে ভগব। একমেবা দ্বিতীয় আপনি বিশ্বের সকলকে অতিক্রম করে রয়েছেন; অথবা আপনি বিশ্বের সকল জ্ঞানবিজ্ঞানের অতীত হন। (ভাব এই–ভগবানই সর্বমূলাধার)। [অন্যান–বিশ্বান-সর্বান; অতি অতিক্রম্য বর্তসি ইতি শেষঃ; অথবা, অন্যান্য বিশ্বেষাং সর্বেষাং, অতি–অতীতঃ, জ্ঞানবিজ্ঞানানাং অতীতঃ ইতি ভাবঃ] (১)। এটি জেনে, হে ভগবন্! আমি আপনার শরণ নিচ্ছি; আপনি আমাকে উদ্ধার করুন। আপনি ভিন্ন অপর কারও শরণ নিচ্ছি না; কারণ, আপনি ভিন্ন অন্য কেউই ত্রাণ করতে সমর্থ নন। [অন্যান–তত্তঃ অপরান্ কাঞ্চিদপিব্ৰজাম্যহং, যদ্বা–তত্ত্বঃ। অন্যঃ কোহপিতারয়িতুং ন শক্লোতি ইতি ভাবঃ]।(২)। মন্ত্রে দুটি ভগবানের মাহাত্ম্য-বিজ্ঞাপক। বিশ্বের সকলের অতীত অপিচ অবামনসোগোচর সেই ভগবান্ আমাকে উদ্ধার করুন; আমি সেই ভগবানের স্মরণ নিচ্ছি।হে ভগবন্! আপনি ভিন্ন কেউই ভব-সাগর পার করতে অর্থাৎ ত্রাণ করতে সমর্থ নয়। হে ভগবন্! আপনিই একমাত্র উদ্ধারকর্তা। মন্ত্রে এই ভাব পরিব্যক্ত]। হে ভগবন্! আপনার সমীপে আগমন করলাম। কাছে, দূরে অথবা কাছে ও দুরের বাহিরে যে কোনও স্থানে, আপনি থাকুন না কেন, সেই স্থানেই যেন আমি আপনাকে প্রাপ্ত হই। [উপাগাং–ভবৎসমীপে আগতবানস্মি; অবাক্‌–নিকটে; অবরেভ্যঃ পরঃ–নিকটেভ্যঃ পরস্তাৎ, দূরে ইত্যর্থঃ; অথবা, পরেভ্যঃ –নিকটাৎ দূরাৎ বা তদন্তরে বর্তসি] (৩)। হৃদয়রূপ অরণ্যের স্বামি অথবা অরণ্যসদৃশ হৃদয়ের পরিত্রাণকারী দ্যোতমান স্বপ্ৰকাশ হে দেব! সেইরকম আপনাকে, হৃদয়ে সভাব জননের অর্থাৎ দেবভাব-উন্মেষণের জন্য সেবা করি অর্থাৎ প্রীত করি। অপিচ, আমাদের মধ্যে সৎ-ভাব প্রতিষ্ঠার জন্য দেবভাবগুলি আপনাকে সেবা অর্থাৎ উদ্দীপিত করুক। (মন্ত্রটি আত্ম-উদ্বোধক। হে ভগবন্! পরমপদ প্রাপ্তির কামনায় সৎ-ভাবলাভের জন্য এবং শুদ্ধসত্ত্ব প্রজননের জন্য আমি যাতে আপনার সেবা করতে পারি, আপনি কৃপা করে তার বিধান করুন)। [বনস্পতে–হৃরূপস্য অরণ্যস্য স্বামিন, যদ্বা–অরণ্যসদৃশস্য হৃদয়স্য পরিত্রাণকারিণ; দেবযজ্যায়ৈ–দেবযাগায়, সদ্ভাবজননায় দেবভাবানাং উন্মেষণায় চ ইত্যর্থঃ; দেব্যজ্যায়ৈ–অস্মাসু সদ্ভাবপ্রতিষ্ঠাপনায় ইত্যর্থঃ] ।(৪)। হে মম হৃদয়-নিহিত শুদ্ধসত্ত্ব! বিশ্বব্যাপক ভগবানের প্রীতির জন্য তোমাকে নিয়োজিত বা উৎসর্গীকৃত করছি। (ভাব এই যে, সভাবের দ্বারা ভগবৎপ্রাপ্তি সুগম হয়। ভগবানকে প্রাপ্তি জন্য নিখিল সৎ-ভাব প্রদান করা কর্তব্য)। [বিষ্ণবে–বিশ্বব্যাপকস্য ভগবতঃ প্রীণনায় ইত্যর্থঃ]](৫)। কর্মফল নাশকারি হে দেব! আমাকে অজ্ঞান মোহ থেকে উদ্ধার করুন। (ভাবার্থ-হে দেব! শীঘ্র আমার কর্মফল ধ্বংস করুন)। [ওষধে-কর্মফলনাশক হে দেবঃ] (৬)। হে ভববন্ধন ছেদনকারী দেব! এই জনের (আমার) প্রতি প্রতিকূল বিরূপ হবেন না। (ভাব এই যে, আমাকে সংসার-বন্ধন থেকে মুক্ত করুন)। [স্বধিতে–ভাববন্ধনছেদক হে দেব!; এনং–জনং–মামিতি যাবৎ]।(৭)। মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভগবান্ আমাদের কর্মফল ও ভববন্ধন নাশ করে আমাদের পরমপদে প্রতিষ্ঠিত করুন শেষ মন্ত্র তিনটিতে এমনই প্রার্থনা বিদ্যমান রয়েছে)।

৪৩। হে ভগবন্! আপনার অনুগ্রহে দ্যুলোকে অবস্থিত দেবভাবসমূহ আমাকে যেন হিংসা না করেন। অর্থাৎ পরিত্যাগ না করেন; অন্তরিক্ষলোকে সদ্ভবিত অর্থাৎ অন্তরিক্ষলোকে অবস্থিত দেবভাব সমূহও যেন আমাকে হিংসা না করেন অর্থাৎ পরিত্যাগ করে না যান অথবা আমার প্রতি বিরূপ না হন। পরন্তু সৎ-বৃত্তিমূল হৃদয়রূপ আধারক্ষেত্রের সাথে সকলে এসে সঙ্গত হোন। (মন্ত্রটি প্রার্থনামূলক। ভগবানের অনুগ্রহে নিখিল দেবভাব সমূহ আমাদের মধ্যে উপজিত হোক। তাতে আমরা ভগবানকে লাভ করতে সমর্থ হবো)। [দ্যাং– দ্যুলোকসম্ভবাঃ, দ্যুলোকে অবস্থিতাঃ দেবভাবাঃ ইতি ভাবঃ; মা লিখ-মা হিংসস্তু, যদ্বানা পরিত্যজ্যন্তু ইত্যর্থঃ; পৃথিব্যা–হৃরূপেণ আধারক্ষেত্রেণ সবৃত্তিমূলেন বা সহ ইতি যাবৎ] (১)। সংসারবন্ধন-নাশক সেই ভগবানই একমাত্র ভবসমুদ্রের পারে নয়ন সমর্থ। অতএব হে ভগবন্! ঐশ্বর্যসমন্বিত সৌভাগ্যলাভের জন্য অথবা শোভন সকর্মসাধনের জন্য আপনাকে ভজনা করি। (ভাব এই যে, সেই ভগবানই একমাত্র ভবসমুদ্র-পারের নায়ক। সংসার-বন্ধন মোচনের জন্য আমি সেই ভগবানকে পূজা করি। হে ভগবন্! আমার সংসার বন্ধন ছেদন করুন)। [স্বধিতিঃ–সংসার বন্ধননাশকঃ; তেতিজানঃ-তূর্ণং ভবান্ধিপিরনয়নসমর্থঃ ইতি ভাবঃ] (২)। দ্যোতমান্ স্বপ্রকাশ হৃদয়রূপ অরণ্যের অধিস্বামী হে ভগবন্! আপনি বহুরূপ হয়ে বিশেষভাবে আমাদের মধ্যে অধিষ্ঠিত হোন। তাতে উপাসক আমরা বহু-সামর্থোপেত সৎ-ভাব ইত্যাদি সমন্বিত হয়ে বিশেষভাবে প্রবৃদ্ধ হতে পারব। (মন্ত্রটি সঙ্কল্পমূলক। ভাব এই যে, ভগবান্ আমাদের মধ্যে অধিষ্ঠিত হয়ে আমাদের সৎ-ভাব সমন্বিত করুন এবং পরম ধন প্রদান করুন)। [বনস্পতে–হৃদয়রূপস্য অরণ্যস্য স্বামিন হে ভগবন! শতবলশঃ–বহুরূপঃ সন ইত্যর্থ, সহস্রবলশাঃবহুসামর্থোপেতাঃ, নিখিলৈঃ সদ্ভাবাদিভিঃ যুক্তাঃ সন্ত ইতি ভাবঃ] (৩)। [ভাষ্যের অনুসরণে মন্ত্রের অর্থ নিষ্কাশনে কোনও বিশিষ্ট ভাব উপলব্ধ হয় বলে মনে করি না। ভাষ্যে আছে, –পত্যমান ছিন্ন ঘূপকে দ্যাং মা লেখি প্রভৃতি মন্ত্রে অভিমন্ত্রিত করবে। ভাষ্যের অর্থ, –হে যুপবৃক্ষ! দ্যুলোক যেন তোমাকে হিংসা না করে, অন্তরিক্ষ যেন তোমাকে হিংসা না করে। তুমি পৃথিবীর সাথে সঙ্গত হও। ভাব এই যে, বজরূপত্ব-হেতু ঘূপ লোকসমূহের শান্তির আকর। অতঃপর অয়ং হি প্রভৃতি মন্ত্রে শোধন বা অভিমন্ত্রণের বিশেষ বিধি উক্ত হয়েছে। অর্থ,–যেহেতু হে ছিন্ন বৃক্ষ! অতিতীক্ষ্ণ এই কুঠার মহৎ যজ্ঞ ও সুদর্শনের জন্য তোমাকে যূপত্বে পরিণত করুক। অতস্তং ৬ প্রভৃতি মন্ত্রে বৃশ্চনে আহুতি দেবে। মন্ত্ৰাৰ্থ– এই জন্য হে স্থাণু! তুমি বন্ধুর হয়ে বিশেষভাবে উৎপন্ন হও। এদিকে আমরাও পুত্রপৌত্রাদিরূপ বহুশাখোপেত হয়ে প্রবৃদ্ধ হই।–এখানে কর্মকাণ্ডেরই অনুসৃতি পরিলক্ষিত হয়। নচেৎযুপ,যুপবৃক্ষ বা স্থাণু প্রভৃতি পরিজ্ঞাপক কোনও পদই মন্ত্রে পরিদৃষ্ট হয় না। আমরা কিন্তু ভাষ্যকারের সাথে একমত হতে পারিনি। আমাদের মতে, অধ্যায়ের উপসংহারে এই কণ্ডিকায় চরম প্রার্থনা ফুটে উঠেছে। মন্ত্র কটি ভগবৎ-সম্বন্ধেই প্রযুক্ত।-মন্ত্রগুলির ব্যবহারিক বা লৌকিক প্রয়োগ সম্বন্ধে আমাদের কোনও বক্তব্য নেই। বেদমন্ত্র নিত্য; সেগুলির প্রয়োগ সর্বত্র সকল কার্যেই সম্ভবপর। সেগুলির লক্ষ্য সার্বজনীন ভাবমূলক। সুতরাং ব্যবহারিক প্রয়োগ ব্যতিরিক্ত বেদমন্ত্রের আধ্যাত্মিক প্রয়োগও সম্ভবপর। সেই বিষয় স্মরণ করেই আমরা এ পর্যন্ত বেদমন্ত্রের ব্যাখ্যায় প্রবৃত্ত হয়েছি। আর সেই জন্যই ভাষ্যকারের সাথে আমাদের মতপার্থক্য ঘটেছে। কিন্তু তাতে যে আমরা ভাষ্যের প্রতি বা কর্মকাণ্ডের প্রতি কোনরকম অবজ্ঞার ভাব প্রকাশ করেছি, তা নয়। মনে রাখা প্রয়োজন, বেদমন্ত্রের তিনরকম ব্যাখ্যার বিষয় নিরুক্ত ইত্যাদিতে উল্লিখিত আছে। এ পর্যন্ত আমাদের ব্যাখ্যা তারই একটিকে আশ্রয় করে বিগঠিত।।

পূজ্যপাদ স্বর্গীয় দুর্গাদাস লাহিড়ী মহাশয় শুক্লযজুর্বেদ সংহিতার এই পর্যন্ত আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণাত্মক অনুবাদ সম্পন্ন করেন। অবশিষ্ট অংশ আমরা উভট, মহীধর প্রমুখ ভাষ্যকারগণ কর্তৃক ব্যাখ্যাত ভাষ্যাবলম্বনে অনুদিত এবং উত্তর ভারতে বিশেষ প্রচলিত মর্মার্থগুলিকে অনুসরণে প্রবৃত্ত হয়েছি। বলাবাহুল্য শুক্লযজুর্বেদ-সংহিতার এই অবশিষ্ট অংশটুকু কর্মকাণ্ডানুসারেই রচিত। আমরা কর্মকাণ্ডের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করি না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *