শিয়রে জ্বলছে বাতি, আর জ্বলছে তিনজোড়া চোখ। ডাক্তার এনেছিলাম, তিনি পরীক্ষা করবার পর কোরামিন ইনজেকশন দিলেন এবং বললেন, অত্যধিক উত্তেজনা ও উইকনেস থেকেই এর উৎপত্তি। হার্টফেল হতেও পারত। কিন্তু এখন আর ভয় নেই। মানসিক উদ্বেগ থেকে দূরে রাখা ও ভালো পথ্য দেয়া এই দুটো জিনিস আপনাদের দেখা দরকার!
ক্রমে সকাল হয়ে আসে। একটি দুটি করে পাখি ডাকল। রোগী তখনো ঘুমাচ্ছেন। বৌদি দরজা খুলে বাইরে গিয়ে বারান্দার ভাঙা রেলিংটা ধরে দাঁড়িয়ে রইলেন। পুব আকাশে উষার আভাস। শুকতারাটা দপদপ করে জ্বলছে তখনো। রাতে হাস্নাহেনা ঝাড়ে ফুল ফুটেছিল, ভোরের হাওয়ায় তারই গন্ধের রেশ এসে লাগছে।
বৌদি ঘরে এলে আমরা দু’জন বেরিয়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু আমাদের থামিয়ে দিলেন।
আমি এখন আসি জাহেদ! বিপদ কেটে গেছে এখন তোমরাই—
আমি দৃঢ়স্বরে বললাম, সে হয়না বৌদি! আপনাকে আর কিছুতেই যেতে দিচ্ছিনা।
ছবি তাকে আগলে ধরে বলল, বৌদি তুমি এমন কঠিন হয়েছ কিভাবে বুঝতে পারছি না! কেমন করে চলে যেতে চাইছ তুমি!
বৌদির মুখটা একটু কেঁপে উঠল। কণ্ঠ ঠেলে একটা বেদনাকে সংবরণ করতে করতে যেন বললেন, সে তুই বুঝবিনে ছবি। আমাকে যেতেই হবে।
দু’জনে যথেষ্ট শাস্তি পেয়েছ। ছবি মৃদুস্বরে মিনতি জানাল, ভুলের বোঝা আর বাড়িও না, বৌদি! আমি কি তোমার কেউ নই? অন্তত আমার মুখ চেয়ে তুমি যেয়ো না। দাদাকে কত ভালোবাসতে, কেমন করে সব ভুলে গেলে তুমি!
হ্যাঁ ভুলে গেছি, আসি সব ভুলে গেছি! মীরা বৌদি ফিসৃফিস্ করে বললেন, এবং আরো ভুলে যেতে চাই!
বৌদি আবার বারান্দার দিকে পা বাড়ালে তার শাড়ির আঁচলটা উড়ল হাওয়ায়, প্রান্তটা গিয়ে লাগল জামিলের মুখে আর তৎক্ষণাৎ ধড়মড় করে উঠে বসলেন।
কে? কে ওখানে? দরজার কাছে মীরা ফিরে দাঁড়াতেই আবার জোরে উচ্চারণ করলেন জামিল, কে?
মীরা নড়তে পারছিলেন না, আমরাও কতকটা আড়ালে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছি। কিছুক্ষণ চেয়ে দেখার পর জামিল ভাই ত্রস্তভাবে খাটের ওপর থেকে নামলেন, ছুটে গিয়ে ব্যাকুল গভীর আলিঙ্গনে আবদ্ধ করে বলতে থাকেন, মীরা! আমার মীরা আমাকে রক্ষা করো, মীরা আমি নিঃশেষ হয়ে গেছি আমাকে বাঁচাও!
মীরা-বৌদির মনের কপাটও এক ঝাঁপটায় হয়তো খুলে গেল। স্বামীর বুকে মুখ লুকিয়ে শুধু কাঁদছেন। অনেকক্ষণ পরে মুখ না তুলেই বললেন, তুমি আমাকে শাস্তি দাও! আরো শাস্তি!
ছিঃ এমন কথা বলো না, মীরা! ভুল দুজনেই করেছি! তিলে তিলে তার শাস্তিও পেলাম। এখন থেকে তোমার সব কথা আমি শুনবো। তোমার কোনো আফসোস রাখবো না। দেখবে সত্যই আমি ভালো আঁকতে পারছি। অনেক নাম হবে। তুমি পাশে থাকবে আমার!
জামিল দরজার পাট টেনে নিলে আমি জিজ্ঞেস করলাম, ছবি! কোদাল আছে?
ছবি ভাবনায় যেন আচ্ছন্ন ছিল, সচেতন হয়ে বলল, হ্যাঁ ভাঙামতো আছে একটা! দেবো?
দাও! আমি বললাম, আজকের সকালটা সত্যই স্মরণীয়। তুমি স্টুডিও গুছাও গে, আমি বাড়ির জঞ্জালগুলো সাফ করি।
ওমা সে কেন! একটা ছেলেকে ডেকে চার আনা দিলেই সব পরিষ্কার করে দেবে!
আহ্ তুমি বড্ড বেরসিক! বুঝতে পারছ না কাজ করবার জন্য আমার হাত দুটো সাহিত্যের ভাষায় যাকে বলে নিসৃপিস্ করছে!
ছবি আর দাঁড়াল না। কোদালটা নিয়ে এসে মিষ্টি হেসে বলল, দেখ আমার ফুলের গাছগুলোকে আবার সাফ করে ফেলো না। অনেক কষ্ট করে বাঁচিয়ে রেখেছি। শিল্পীদের তো কোনদিকে খেয়াল থাকে না।
তাই বলে ফুলের গাছের দিকেও থাকবে না!
থাকে যদি ভালো তবু সাবধান করে দিলাম। শিল্পীরা ফুল রচনা করে কিন্তু সত্যিকারের ফুলকে ছিঁড়ে দলা পাকাতেই ওদের আনন্দ কি না।
সে কেমন করে বুঝলে তুমি? তোমার ধারণা ভুলও তো হতে পারে?
না, ভুল নয়। এতো বড় দুজন শিল্পীর কাছে থেকে ভুল শিখব আমি? তা ছাড়া ময়রা রসগোল্লা খায়না এতো জানা কথা।
ছবি মুখ টিপে হাসলেও আমি গম্ভীর হয়ে যাই। বললাম, আমি শিল্পী কিনা জানি না, তবে ফুল আমি ভালোবাসি। তোমার ফুলগাছ নষ্ট হবে না এ বিষয়ে নিশ্চিন্ত থাকতে পারো!
এবার ছবি খিলখিল্ করে হেসে উঠল। বলল, বাহ! এত অল্পতেই অভিমান! বেশ তুমি আমার সব ফুলগাছ উপড়ে ফেলে দাও।
পাগল! আমি উঠানে নেমে প্যান্ট গুটিয়ে জঞ্জাল সাফ করতে লেগে যাই। ছবি হাসিমুখে দাঁড়িয়ে রইল খানিকক্ষণ, এরপর কোমরে আঁচল জড়িয়ে সেও গেল স্টুডিও ঘরের ভিতর।
মেঘ যখন কেটে গেছে তখন সারা পৃথিবীই আলোকিত হবে সোনালি রুপালি ধারায়। গাছের পাতারা নাচবে, গান গাইবে পাখি। নর্দমা পরিষ্কার করতে গিয়ে আমার মনে গুঞ্জন উঠেছে একটি রাত তো ছবির আরো কাছে এলাম, এর চেয়ে বড় লাভ আর কি হতে পারে। এখনই সুযোগ। যদি কিছু করতে হয় অনেক দিনের পর এই ছোট্ট সংসারে আনন্দধারার উৎস মুখটি যখন খুলে গেছে তখনই করা দরকার। এর মধ্যে ক্ষেত্র সম্পূর্ণভাবে তৈরি করে ফেলা চাই।
দরজা বন্ধ করেছেন ওরা, কখন বেরিয়ে আসবেন ঠিক নেই। তবু ভালো নাশতার আয়োজন করে ফেললাম।
পকেটে এখনো যা আছে তা দিয়ে দুপুরে পোলাও কোর্মার ব্যবস্থা করা যাবে। না, ঘুষ দেওয়া আমার উদ্দেশ্য নয়! ওদের দুজনের যা অবস্থা দু’একদিন না খেলেও কুচ পরোয়া নেই কিন্তু বাড়িতে লোক থাকতে একেবারেই না খাইয়ে রাখা ঠিক নয়।
সকাল থেকে দুপুর, দুপুর থেকে বিকেল কেমন একটা মত্ততার মধ্য দিয়ে কেটে গেল। দুপুরে গিয়ে ছেলেমেয়ে দুটোকে আনায় খাওয়াটা জমলো ভালো। ওদের কলকাকলিতে বাড়ি ঝক্তৃত। সন্ধ্যার আগে চায়ের টেবিলে জামিল বললেন, তুমি আমাদের এখানে এসেছ অথচ আমরাই দেখছি তোমার অতিথি!
মৃদু হেসে বললাম, সে কিছু নয়। আমি তো রোজই খাই একদিন খাওয়াতে পারব? তাছাড়া আমার বলতে তো আলাদা কিছু নেই!
কথা বলছি বটে কিন্তু আমার চোখজোড়া গোপনে একেকবার চলে যাচ্ছে ওদের মুখের দিকে, ভাবছি এরই নাম বুঝি প্রেম! একটা দিনে কি সুন্দর করে তুলেছে দু’জনকেই! ঠোঁটে মুখে রং ধরেছে, চোখে চাউনির গাঢ়তা। মীরা বৌদির চেহারায় ব্যক্তিত্বের সেই কাঠিন্য নেই বরং লাজনম্র। কথা বলছেন না। দু’একটি শব্দ বললেও বলছেন মৃদুস্বরে একের আত্মাকে অন্যে আজ স্পর্শ করেছেন তাই তারা হয়েছেন পূর্ণ। চায়ে চুমুক দিতে দিতে অর্থহীন আলাপের মধ্য দিয়ে আমি ওদের অজান্তে সেই পূর্ণতার মাধুর্য পান করছি।
আমিও পূর্ণ হতে চাই আর তাই বোধ হয় এই তন্ময়তা। সে উৎস তারা পৌঁছেছেন সেখানে যেতে এখন অন্যকে কি বাধা দিতে পারেন? এ কখনো সম্ভব নয়।
বৌদিকে নিশ্চয়ই সব খুলে বলেছেন জামিল ভাই, নইলে আমাকে দেখলেই মুখ টিপে হাসবেন কেন? কিন্তু একদিন আমি বললে গম্ভীর হয়ে গেলেন বৌদি। বললেন, দেখ জাহেদ, শিল্পীদের আমি বিশ্বাস করি না। এরা একেকটা পাষণ্ড এবং ছোটলোক। স্বার্থ ছাড়া কিছু বুঝতে চায় না। তুমি সেরকম নও তা কেমন করে বলব? তাছাড়া আমার মনে হয় শিল্পীদের বিয়ে না করাই উচিত!
চমৎকার, একেবারে খাসা! দূরত্বের শেকল থেকে এখনো মুক্ত হতে পারিনি তাই বললাম, আপনি নিজেও তো একজন শিল্পী।
একজন ভুল করেছে বলে সকলকেই তার পুনরাবৃত্তি করতে হবে তার কোনো মানে নেই!
আপনাদের বিয়েটা তাহলে ভুল? আমি গুরুত্বের সঙ্গে জিজ্ঞেস করলাম। তা নয়তো কি। বিয়ে মাত্রই ভুল!
কথা বলবার সময় বৌদির ঠোঁটের কোণে এমন একটা হাসির রেখা ফুটে উঠেছিল যাকে দুষ্টুমি আখ্যা দেওয়াই সমীচীন। তাই দেখে আমি আশ্বস্ত হলাম। বললাম, বেশ, ভুল যদি হয়েও থাকে তবে নিশ্চয়ই তা মহৎ এবং মধুর ভুল! এ ভুল আমিও করতে চাই।
কিন্তু জানো সব জিনিস চাইলেই পাওয়া যায় না?
তা জানি এবং সেজন্যই তো যার কাছে গেলে পাব তাঁর কাছেই এসেছি। লক্ষ্মীর ঘরে তো কোনো অভাব নেই।
বৌদি হেসে বললেন, আমাকে তোয়াজ করে কাজ আদায় করবে ভেবেছো? কিন্তু এত সহজে আমি গলবো না।
সে নিজের চোখে দেখছি বলেই তো আরো ভরসা হচ্ছে! গুণী লোকদের এক জেদ। এক কথা।
বারান্দায় বেতের চেয়ারে বসে রসালাপ করছি বটে কিন্তু মনটা পড়ে আছে অন্যদিকে। কাছে ভিতে ছবিকে দেখছি না তো? জিজ্ঞেস করলে জবাব একটা পাব তবে তাতেও থাকবে ঠাট্টার গাট্টা। কাজেই সুযোগ বুঝে চোরাচোখে এদিক-ওদিক তাকানো। সে যে এখন বাসায় নেই তা সুনিশ্চিত। নইলে অন্তত একটুখানি সাড়া মিলত। কিন্তু যাবে কোথায়? কিছুদিন থেকে একটা জিনিস লক্ষ্য করছি যখনই আসি দেখি নোটন আর শিউলিকে নিয়েই ব্যস্ত ছবি। ভাইয়ের ছেলেমেয়েকে ভালোবাসবে নিশ্চয়ই কিন্তু এমনটা কোথাও দেখিনি। সকালে এলে দেখা যায় দুটিকে নিয়ে পড়াচ্ছে, একটুখানি চেয়ে কাঁধের ওপর আঁচল টেনে আবার মুখ নিচু করে বেলা দশটার আগেই ওদের গোসল করায় আর সেকি যত্ন! যেন ওরা মানব-সন্তান নয় মেজে ঘষে ঝকমকে করে তোলার মতো কোনো ধাতব বস্তু! বিকেলে স্কুল থেকে ফিরে এলে ওদের খাইয়ে দাইয়ে ওই বারান্দাটুকুর মধ্যে নানারকম খেলায় মেতে ওঠে। সন্ধ্যার বাতি লাগিয়ে বলে কিসসা কাহিনি রূপকথা উপকথা আজগুবি গল্প। আমাকে যেন দেখেও দেখে না, সংক্ষিপ্ত কথাটুকুই সেরে চলে যায়। ডাকলে অবশ্যি কাছে আসে কিন্তু এইটুকুই, নিজেকে প্রকাশ করে না। সে যেন আবার গুটিয়ে গেছে এবং নিজেকে নিয়েই পরিতৃপ্ত।
সিগারেট ধরাবার ভান করে রান্নাঘরে যেতে চাইলে বৌদি হেসে বললেন, ওখানে নেই ছবি!
বাহ্ রে আমি কি সে জন্য যাচ্ছি!
লুকিয়ে লাভ কি ভাই আমি সব জানি। ও পাশের বাড়িতে গেছে ছেলেমেয়েদের নিয়ে। ডেকে দেবো?
না, না। তার দরকার নেই। আমি চেয়ারে বসে পড়ে বললাম, দাদা কোথায় গেছেন?
চাকরির খোঁজে! আমাকে নাকি কাজ করতে দেবেন না। একেবারে পাগলামি।
আমি বলি সত্যি বৌদি অফিসে আদালতে মেয়েদের কেমন বেমানান লাগে।
উলের কাঁটাদুটো থামিয়ে বৌদি বললেন, তোমার মুখে একথা শোভা পায়না, জাহেদ। তুমি শিল্পী। সমাজের সবচেয়ে প্রগতিশীল ব্যক্তি!
যাই বলুন এ-ব্যাপারে আমি পুরোপুরি প্রাচীনই থেকে গেছি। মেয়েদের গৃহলক্ষ্মী হিসেবে দেখতেই আমি ভালোবাসি।
সে অভ্যাসের দোষ।
তা হতে পারে। আমি একটু চুপ থেকে বললাম, এটা অবশ্য বুঝি মেয়েদের অর্থনৈতিক মুক্তি না দিলে দেশ দাঁড়াতে পারবে না। তবু আমার গৃহিণীকে অন্য পুরুষের মাঝখানে দেখতে খারাপ লাগে।
বৌদি উচ্চহাস্য করে উঠলেন। বললেন, বাহ! গৃহিণী না হতেই এমন! আর হলে তো অবস্থা কাহিল।
এমন সময় নোটনকে কোলে ও শিউলিকে হটিয়ে নিয়ে পাশের বাড়ি থেকে ছবি এলো। আমাকে দেখে থেমে পড়ে! বৌদি বলে উঠলেন, এই যে নন্দরানি! তোমার পাত্তাই নেই, এদিকে স্বয়ং উনি এসে বসে আছেন!
যাঃ! ছবির মুখটা আরক্ত হয়ে উঠল, বলল, ক্ষেপিওনা বৌদি! তাহলে কিছছু–
হয়েছে হয়েছে। তোমাকে কিছছু করতে হবে না। একজনকে ধরে রাখতে পারলেই যথেষ্ট!
ছবি জিভ বার করে একটা ভেংচি কেটে ঘরের ভেতরে চলে গেল। বৌদি ডেকে বললেন, ছবি দিদি আমাদের চা খাওয়ানা রে! তোর সব ব্যবস্থা করে দেব দেখি!
যেটুকু বা আশা ছিল তাও নষ্ট করে দিলেন!
না। দেখো ছবি খুব ভালো মেয়ে। আমাদের চা না খাইয়ে থাকতেই পারবে না সে!
কিন্তু চা খাওয়ার জন্য বৌদিকে উঠে গিয়ে ওর কাছে নিজের মন্তব্যের জন্য ঘাট স্বীকার করতে হলো। ছবি চা করে আনে। বেতের টেবিলে ট্রের ওপরে রাখা কাপগুলোতে দু চামচ করে দুধ দিল। আমি উপস্থিত এ বিষয়ে সচেতন কিন্তু ওর গাম্ভীর্যের ঠাণ্ডা দেয়ালের ভেতরে রক্তিম হৃৎপিণ্ডটা দেখতে পাচ্ছিনে। বুকের অতলে চিন্ চিন্ করে একটুখানি ব্যথা খেলা করতে থাকে, একি হলো! ছবির এই পশ্চাদপসরণের অর্থ কি? আমার কোনো ব্যবহারে কি ও ক্ষুণ্ণ হয়েছে অথবা অন্য কোনো কারণ?
নোটন এসে কাছে দাঁড়াতেই ছবি তাড়াতাড়ি ওকে কোলে তুলে নিল। বৌদি বললেন, একদিকে আমার ভালোই হয়েছে ভাই। ছেলেমেয়ের ঝামেলা নেই। নোটন শিউলি তো ছবির! ওর একটা গতি হয়ে গেলে সেটাই হবে বিপদ!
আবার! ছবি শাসনের দৃষ্টিতে তাকাল, বুঝতে পারছি তোমাকে আরো শিক্ষা দিতে হবে, বৌদি।
তুমি আর কি শিক্ষা দেবে। নানা রকম শিক্ষা পেয়ে এখন নিজেই আমি শিক্ষয়িত্রী।
বৌদির কথা শেষ হতেই ছবি যে দরজাটা দিয়ে ও বাড়ি থেকে এসেছিল সেটাই ঠেলে আঠার উনিশ বছরের একটি ছেলে প্রবেশ করল। লম্বা ছিপছিপে গড়ন, সুদর্শন। পরনে ছাইরঙা প্যান্ট, গায়ে হাওয়াই সার্ট, চুলগুলো অবিন্যস্ত। সে আমাদের দেখেই বৌদিকে জিজ্ঞেস করল, বৌদি কেমন আছেন? ছবি আছে?
হ্যাঁ, আছে। বৌদি উৎসাহিত হয়ে বললেন, কি ব্যাপার মিন্টু, এতদিনে এলে তুমি।
বছরে একবার ছুটি পাই। গতবারও তো এসেছিলাম। আপনার সঙ্গে দেখা হয়নি।
হ্যাঁ আমি তখন অন্যত্র ছিলাম। বৌদি টেবিলের ধারে উল ও কাঁটাগুলো রেখে বললেন, তুমি বোসো মিন্টু। ছবি দেখে যা, কে এসেছে।
ছবি ছুটে এসে আনন্দে চেঁচিয়ে উঠল, মিন্টু। আমি গিয়েছিলাম, তুমি বাইরে ছিলে।
মিন্টু চেয়ার থেকে উঠে ওর কাছে গেল। বলল, হ্যাঁ বাইরে একটু কাজ ছিল। আচ্ছা তুমি আমার একটা চিঠির জবাব দাওনি কেন?
ছবির মুখটা যেন ধপ করে নিভে গেল। বলল, কই চিঠি তো আমি পাইনি?
পাওনি? একটা চিঠিও না? মিন্টু উত্তেজিত হয়ে উঠল, সে অ্যাবসার্ড ইনপোসিবল!
বৌদি বললেন, এত ব্যস্ত হচ্ছ কেন, বোস মিন্টু। ধীরে সুস্থে কথা বলো।
না না, বৌদি। যদি তাই হয়ে থাকে আই শ্যাল সি টু ইট। পোস্টাল ডিপার্টমেন্টের বারোটা বাজিয়ে দেবো না?
আমার কানদুটো কেন ভোঁ ভোঁ করছিল বলতে পারব না। ম্লান পাংশু মুখে বসে আছি। আমার শিরায় এক আগুন জ্বলে উঠেছে, মনে হয় ঈর্ষার আগুন। আরো কিছুক্ষণ উচ্ছ্বাসের খই ফোঁটানোর পর ছেলেটি চলে গেলেও অবরুদ্ধ আক্রোশের প্রাবল্যে আমি স্তব্ধ হয়ে থাকি। বৌদি আমার মনোভাবটা যেন বুঝলেন। তাই হালকা ভঙ্গিতে বললেন, একদম পাগল! রিসালপুর পর্যন্ত গেছে, কিন্তু পাইলট হতে পারবে বলে মনে হয় না! ছবিকে সে এখনো মনে করে সাত বছরের খুকি!
আমি খানিকটা সহজ হওয়ার জন্য জিজ্ঞেস করলাম, ছেলেটি কে?
ওই তো ও বাড়ির বোরহান সাহেবের ছেলে। ওর বোন পান্না ছবির বন্ধু!
হুঁ। কতকটা অপ্রাসঙ্গিকভাবেই বলে ফেললাম, আমাদের আদাবটা পর্যন্ত দিল না। বেশ উন্নতি হবে ছোকরার!
ছবি ঘরে চলে গিয়েছিল। আমার কথায় একটু বিরস হাসি হেসে বৌদি ডাকলেন, ছবি!
ও ভেতর থেকে বলল, যাই বৌদি!
এরপর বেরিয়ে এলে বৌদি জিগগেস করলেন, আচ্ছা মিন্টু ছোকরা তোর কাছে চিঠি লিখেছিল নাকি?
ছবি আমার কঠিন মুখটার দিকে একবার চেয়ে নিয়ে বলল, হ্যাঁ। তিনটে চিঠি দিয়েছিল।
কোথায় সেগুলো?
সঙ্গে সঙ্গে ছিঁড়ে ফেলেছি। ছবি পায়ের বুড়ো আঙুলে একটা কি টিপতে টিপতে বলল, যত সব বাজে। ছেলেটা আসলে বোকা!
সেজন্য বুঝি কিছু বলিস্ নি?
তাই!
ঠিক আছে আমিই বলে দেব’ খন। বৌদি বেশ জোর দিয়েই বললেন, বুঝিয়ে দেব, সে খোকা হলেও ধাড়ি খোকা! না বুঝলে গার্জিয়ানদের জানাতে হবে। তা, এভাবে বাসার ভেতরেই বা ঢোকা কেন?
হাতে দু’টো প্যাকেট, মিন্টু আবার ব্যস্তভাবে প্রবেশ করল। ডাকতে ডাকতে এগিলে এলো, ছবি! ছবি!
ও আড়ালে গিয়ে বসেছিল, বেরিয়ে এলো না। মিন্টু কাছে এসে জিজ্ঞেস করল, ছবি কোথায় বৌদি?
বৌদি অবলীলাক্রমে বললেন, কি জানি কোথায় গেল। কেন কিছু কাজ আছে তোমার?
হ্যাঁ। কয়েকটা জিনিস এনেছিলাম ওর জন্য! এই যে। নাইলনের ওড়না ও একটা ব্লাউজ পিস, জরির কাজ করা ভ্যানিটি ব্যাগ একটা, মল থেকে কেনা খাঁটি লাহোরের জিনিস। এদেশে পাওয়া যায় না।
মিছিমিছি এগুলি কেন আনতে গেলে। এ সমস্ত ওর কোনো কাজে লাগবে না।
কাজে লাগবে না? কেন?
সালোয়ার কামিজ ওড়না তো পরেই না। নাইলনের ব্লাউজ পরা যায় না। ভ্যানিটি ব্যাগেরও ওর দরকার নেই! তুমি এগুলো বরং তোমার আপাকে দিয়ে দিও!
আপার জন্য তো এনেছি। মিন্টু কিছুমাত্র বিচলিত না হয়েই বলল, সালোয়ার কামিজে কিন্তু ছবিকে বেশ মানাবে! মডার্ন গার্ল ভ্যানিটি ব্যাগ ব্যবহার করবে না কেন!
বৌদি একটু উষ্ণ হয়ে বললেন, সবাই করে না মিন্টু, সবাই ব্যবহার করে না বুঝলে, তাছাড়া তোমার জিনিস নেবেই বা কেন সে? এসব ভাবনা ছেড়ে লেখাপড়ায় মন দাওগে যাও!
আমার মনটা শান্ত হয়ে এসেছিল। মিন্টু বিমূঢ়ের মতো তাকিয়ে থাকলে তার দিকে হাত বাড়িয়ে আমি বললাম, দেখি কি রকম জিনিস!
আমাকে চেনেনা, দেখেওনি কোনদিন, অনিচ্ছার সঙ্গে দিল প্যাকেটগুলো। সেই মুহূর্তে আমি ভাবি, একে অযথা গুরুত্ব দিয়ে লাভ নেই; বরং সহজভাবে গ্রহণ করলেই সব ল্যাঠা চুকে যাবে। আর ছোটবেলার বন্ধুত্বের দাবিতে বয়োসন্ধিকালে যদি কিছু বাচালতাও করে সেটা খুব বড় অপরাধ তো নয়? এক্ষেত্রে তার বেশি কিছু নেই বলেই আমার পর্যবেক্ষণ। তাই, ব্যাপারটাকে জটিলতামুক্ত করবার জন্য জিনিসগুলো খুলে ধরে আনন্দিত-স্বরে আমি বলে উঠি, দেখুন বৌদি! সত্যই সুন্দর জিনিস! ছবিকে বেশ মানাবে।
আমার ব্যবহারে বৌদি একটু আশ্চর্য হলেন। মিন্টু সহানুভূতি পেয়ে বলল, দেখুন না, আমি কি মিথ্যে বলেছিলাম?
না, না কিছুতেই না। আমি উচ্চকণ্ঠে ডাক দিই, ছবি! ছবি! দেখে যাও, কি সুন্দর জিনিস এনেছে তোমার জন্য!
মিন্টুর মুখটা নিরীহ সরল হাসিতে উদ্ভাসিত হয়ে উঠল। সে বলল, ছবি আছে নাকি?
আছে, ঘুমিয়ে পড়েছে বোধ হয়! আমি উঠে গিয়ে দেখি ছবি সত্যি নোটনকে কোলের কাছে রেখে চৌকির ধারে শুয়ে চোখ বুজে আছে। ওর হাত ধরে টেনে তুলে নিয়ে এলাম। টেবিলটা দেখিয়ে বললাম, তোমার জন্য কি সুন্দর জিনিস এনেছে মিন্টু, দ্যাখ।
ঘুমের ভান করে পড়ে ছিল, আসলে ও সব কথা শুনেছে। তার চেহারা থেকে সম্পূর্ণ কেটে গেছে ক্লিষ্টতার মেঘ। আমার চোখে চেয়ে হাল একটুখানি, এরপর সেগুলো হাতে নিয়ে দেখতে থাকে। বৌদির মুখেও হাসি ফুটেছে। মিন্টুর দিকে চেয়ে বলল, কিছু মনে করোনা, ভাই। এদ্দিন পরে এসেছ, তোমাকে একটু যাচাই করে নিলাম।
মিন্টু দাঁত বের করে বোকার মতো নিঃশব্দে হাসতে থাকে। বাড়ির বারান্দা থেকে দেখতে পাওয়া টুকরো নীল আকাশজুড়ে এখন অনেক পাখির মেলা।