০৫. শিব সংযমী দেবতা

শিব সংযমী দেবতা

ইন্দ্র থেকে ব্ৰহ্মা-বিষ্ণু পর্যন্ত সকলেই ব্যভিচারী দেবতা । একমাত্র শিবই ব্যভিচারী বা কামুক দেবতা নন । বরং তার কৃতিত্ব হচ্ছে তিনি কামদেবকে ভস্ম করেছিলেন । শিব মহাযোগী। কিন্তু মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে শিব ঘোর সংসারী ।

বাঙলার লোকের কাছে শিব অত্যন্ত জনপ্ৰিয় দেবতা । বাঙলার লোক লিঙ্গরূপেই শিবকে পূজা করে থাকে। এই লিঙ্গরূপে পূজা করার মধ্যেই শিবের আদিম ইতিহাস নিহিত । শিব জৈবিক-সৃজন শক্তিভিত্তিক কৃষি দেবতা । আর্যরা এদেশে আসবার অনেক আগে থেকেই এদেশের লোক শিবের পূজা করত। শিব ও শক্তির পূজা একসঙ্গেই হত । কিভাবে শিবশক্তি পূজার উদ্ভব হল, তার ইতিহাস এখানে সংক্ষেপে বলে নিই।

আদিম মানুষ যখন খাদ্য-আহরণের জন্য পশুশিকারে বেরুত, তখন অনেক সময় তাদের ফিরতে দেরি হত । মেয়েরা তখন ক্ষুধার তাড়নায় গাছের ফল এবং ফলাভাবে বন্য অবস্থায় উৎপন্ন খাদ্যশস্য খেয়ে প্ৰাণ ধারণ করত । তারপর তাদের ভাবনা চিন্তায় স্থান পায় এক কল্পনা । সন্তান উৎপাদনের প্রক্রিয়া তাদের জানাই ছিল। যেহেতু ভূমি বন্য অবস্থায় শস্য উৎপাদন করে, সেই হেতু ভূমিকে তারা মাতৃরূপে কল্পনা করে নেয়। যুক্তির আশ্রয় নিয়ে তারা ভাবতে থাকে। পুরুষ যদি নারীরূপ ভূমি ( আমাদের সমস্ত ধৰ্মশাস্ত্ৰেই মেয়েদের ‘ক্ষেত্র’ বা ভূমি বলে বর্ণনা করা হয়েছে ) কর্ষণ করে সন্তান উৎপাদন করতে পারে, তবে মাতৃরূপ পৃথিবীকে কৰ্ষণ করে শস্য উৎপাদন করা যাবে না কেন ? তখন তারা পুরুষের লিঙ্গস্বরূপ এক যষ্টি বানিয়ে নিয়ে ভূমিকৰ্ষণ করতে থাকে। প্রৎমুলুসকি তাঁর ‘আর্য ভাষায় অনার্য শব্দ’ প্রবন্ধে দেখিয়েছেন যে ‘লিঙ্গ’, ‘লাঙ্গুল” ও ‘লাঙ্গল’, এই তিনটা শব্দ একই ধাতুরূপ থেকে উৎপন্ন । মেয়েরা এইভাবে ভূমিকৰ্ষণ করে শস্য উৎপাদন করল । যখন ফসলে মাঠ ভরে গেল, তখন পুরুষরা তা দেখে অবাক হল। চিন্তা করল লিঙ্গরূপী যষ্টি হচ্ছে passive, আর ভূমিরূপী পৃথিবী ও তাদের মেয়েরা হচ্ছে active. Active মানেই হচ্ছে শক্তির আধার । ফসল তোলার পর যে প্ৰথম নবান্ন উৎসব হল সেই উৎসবেই জন্ম নিল লিঙ্গ ও ভূমিরূপী পৃথিবীর পূজা । এই আদিম ধারনা হতেই উদ্ভূত হয়েছিল শিব ও শক্তির কল্পনা । শিব ও শক্তির আরাধনা মোটেই বৈদিক উপাসনা পদ্ধতির অন্তভূক্ত ছিল না। আর্যরা এদেশে আসবার পরে শিব ও শিবানীর অনুপ্ৰবেশ ঘটেছিল আৰ্যদেবতামণ্ডলীতে। তবে শিবানীর অনুপ্রবেশের পূর্বেই শিবের অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। তখন আৰ্যর শিবকে রুদ্রের সঙ্গে সমীকরণ করে নিয়েছিল ; মনে হয় অনার্য শিব থেকেই আর্যরা রুদ্রের কল্পনা করেছিল । কেননা সংস্কৃতে ‘রুদ্র’ শব্দের অর্থ হচ্ছে রক্তবর্ণ, এবং দ্রাবিড় ভাষাতেও ‘শিব’ শব্দের মানে হচ্ছে রক্তবর্ণ। বৈদিক রুদ্র যে আর্যদের একজন অর্বাচীন দেবতা ছিলেন, তা বুঝতে পারা যায় এই থেকে যে সমগ্র ঋগ্বেদে তঁর উদ্দেশ্যে মাত্র তিনটি স্তোত্র রচিত হয়েছিল। তাছাড়া, বৈদিক অন্যান্য দেবতাদের অসুরদের সঙ্গে বিরোধিতা করতে দেখা যায় । কিন্তু রুদ্রকে কখনও বিরোধিতা করতে দেখা যায় না । এটা থেকেই প্ৰমাণ হয় যে রুদ্র বা শিব প্ৰথমে অসুরদেরই দেবতা ছিলেন । শতপথব্ৰাহ্মণ ( ১।৭।৩।১১ ) থেকেও আমরা জানতে পারি যে দেবতারা যখন স্বৰ্গে যান, তখন তাদের সঙ্গে শিব ছিলেন না। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে

সমুদ্রমন্থনের যে কাহিনী আছে, সে কাহিনী অনুযায়ীও রুদ্র-শিব অন্য দেবতাদের দলে ছিলেন না ।

 

।। দুই ।।

রুদ্র-শিব গোড়াতে বৈদিক দেবতামণ্ডলীতে ছিলেন না বলেই, তিনি অন্যান্য বৈদিক দেবতাদের মত কামাসক্ত নন। শিব মহাযোগী। তার মনে কামের ভাব জাগাবার জন্য কামদেবকে পাঠাতে হয়েছিল, কিন্তু মহাদেব কর্তৃক কামদেব ভস্মীভূত হয়েছিল ( মৎস্যপুরাণ অনুযায়ী কামদেব ব্ৰহ্মার হৃদয় হতে উৎপন্ন । কিন্তু ব্ৰহ্মা নিজে তার শরে জর্জরিত হয়ে নিজ কন্যা শতরূপাতে উপগত হওয়ার দরুণ, ব্ৰহ্মা কামদেবের ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে অভিশাপ দেন যে, তিনি মহাদেব কর্তৃক ভস্মীভূত হবেন। এখানে আরও উল্লেখনীয় যে বিষ্ণু আৰ্য দেবতা । সেই কারণে আমরা ব্ৰহ্মা ও বিষ্ণু উভয়কেই ব্যভিচারে লিপ্ত হতে দেখি । শিবকে নয় । কোন নারীরই ক্ষমতা ছিল না শিবের রেতঃ ধারণ করবার । এটা আমরা স্কন্দের ( কার্তিকের ) জন্ম বিবরণ থেকে জানতে পারি। শিব লিঙ্গরূপে পূজিত হলেও (শিবের লিঙ্গচ্ছেদের বিবরণ ‘ব্ৰহ্মাণ্ডপুরাণ’-এ আছে) এটাই হচ্ছে শিবের বৈশিষ্ট্য। সেজন্যই যারা শিবের গাজন উৎসবের ব্ৰত পালন করে, তারা সারা চৈত্র মাস সন্ন্যাস গ্ৰহণ করে ও ব্ৰহ্মচৰ্য পালন করে ।

 

।। তিন ।।

শিবের মত জনপ্রিয় দেবতা বাঙলায় আর দ্বিতীয় নেই। সে জন্যই বাঙালী ধান ভানতেও শিবের গীত গায়। বাঙলায় শিবমন্দিরের যত ছড়াছড়ি এ রকম ভারতের আর কোথাও নেই । আর শিবজায়া শিবানীর উৎসবই হচ্ছে বাঙলার শ্রেষ্ঠ উৎসব।

পঞ্চাশ-ষাট বছর আগে পর্যন্ত ছোট ছোট বাঙালী মেয়েরা যখন বোশেখ মাসে শিবপূজা করত তখন ওই পূজার ছড়া-মন্ত্রে স্বগতোক্তি করত-‘গৌরী কি ব্ৰত করে ?’ ব্ৰতের শেষে প্রার্থনা করত–’যেন শিবের মত বর পাই ।’ তখন বাঙলার প্রতি মেয়েই কল্পিত হত গৌরী হিসাবে । আর শিব ছিল বাঙালীর কাছে জামাই বিশেষ ।

শিবকে বাঙালী ঘরের মানুষ করে নিয়েছিল । বাঙালী নিজে ছিল কৃষক। সেজন্য মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে শিবও হয়েছিল কৃষক । এটাই ছিল কবির কাছে ঘরের জামাই শিব সন্মন্ধে স্বাভাবিক কল্পনা !

উর্বর পলি মাটির দেশ বাঙলা ছিল সুজলা সুফলা শস্যশ্যামলা । তার কৃষিসম্পদ ছিল জগৎবিখ্যাত । কৃষি ও কৃষক ছাড়া বাঙালীর কাছে গৌরবের বিষয় আর কিছুই ছিল না । সেজন্য কবিদের কাছে শিব ছিল কৃষক, আর কবিরা ছিলেন কৃষকের কবি ।

শূন্যপুরাণের রামাই পণ্ডিত থেকে শুরু করে শিবায়নের রামেশ্বর পৰ্যন্ত অসংখ্য-কবি শিবের চাষ করার বর্ণনা দিয়ে গেছেন । এ সব কবির মধ্যে ছিলেন–বিনয়লক্ষ্মণ, কবি শঙ্কর, রতিদেব ও রামরাজা, শঙ্কর কবিচন্দ্ৰ চক্রবর্তী, রামকৃষ্ণ রায় দাস, জীবন মৈত্র, সহদেব চক্রবর্তী, দ্বিজ কালিদাস, কবি ষষ্ঠীবর, দ্বিজ ভগীরথী, দ্বিজ নিত্যানন্দ, দ্বিজ রামচন্দ্র রাজ, পৃথ্বীচন্দ্ৰ, কবি কৃষ্ণদাস, প্যারীলাল মুখোপাধ্যায় ও হরিচরণ আচাৰ্য ।

শিব ঠাকুরকে নিয়ে যে কাব্য রচনা করা হত, তাকে ‘শিবায়ন’ বলা হত । অনেকে আবার এগুলিকে শিব-সংকীর্তন বলতেন । যতগুলি শিবায়ন রচিত হয়েছিল তার মধ্যে রামেশ্বরের শিবায়নই প্ৰসিদ্ধ ।

রামেশ্বরের শিব হচ্ছে বাঙালীর নিজস্ব কল্পনা । পৌরাণিক কল্পনা অনুযায়ী শিব মহাদেব । তার মানে শিবের স্থান দেবতাদের পুরোভাগে । কিন্তু গোড়াতে শিব ছিলেন অবৈদিক দেবতা । শুধু অবৈদিক দেবতা নন, তিনি প্রাগ্‌বৈদিক দেবতা। শিবের প্রতীকের সঙ্গে আমাদের প্রথম সাক্ষাৎ হয় প্রাগ্‌বৈদিক সিন্ধু সভ্যতায় । সেখানে আমরা মৃগ, হস্তী, ব্যাঘ্র, গণ্ডার, মহিষ বেষ্টিত যোগাসনে উপবিষ্ট উৰ্দ্ধলিঙ্গ পশুপতি শিবকে এক সীলমোহরের ওপর মুদ্রিত দেখি । তাঁর উপাসকদের মধ্যে ছিল অবৈদিক জাতিগণ–যেমন অসুর, রাক্ষস ইত্যাদি । অসুররাজ বাণ তাঁর পরম ভক্ত ছিল । অনুরূপভাবে লঙ্কেশ্বর রাক্ষসরাজ রাবণও তাঁর পরম ভক্ত ছিল । প্ৰাগাৰ্য বা অনাৰ্য বলেই বৈদিক যাগযজ্ঞে শিবের হবির্ভাগ ছিল না । দক্ষ এই কারণেই তাঁর যজ্ঞে শিবকে আমন্ত্রণ জানান নি । শিব এই যজ্ঞ পণ্ড করবার পরই, শিব আর্যসমাজে স্বীকৃতি লাভ করে । সৃষ্টি, স্থিতি ও ধ্বংসের নিয়ামক হিসাবে দেবাদিদেব শিবের স্বীকৃতি দানে সেদিন সহায়ক হয়েছিলেন বিষ্ণু ।

দক্ষযজ্ঞের পর শিবজায়া সতী হিমালয়-পত্নী মেনকার গর্ভে জন্মগ্রহণ করেন এবং মহাদেবকে পতিরূপে পাবার জন্য কঠোর তপস্যা করেন । তখন মহাদেবও কঠোর তসস্যায় রত ছিলেন। এদিকে তারকাসুরের অত্যাচারে উৎপীড়িত দেবতারা জানতে পারেন যে, মহাদেবের ঔরসে যে পুত্র জন্মাবে সেই পুত্রই তারকাসুরকে বধ করবে। সেজন্য পাৰ্বতী ও মহাদেবের মিলন করাতে এসে কামদেব বা মদন মহাদেবের কোপে ভস্মীভূত হয়। তারপর পাৰ্বতী ও মহাদেবের মিলন হলে মদন পুনর্জীবন লাভ করে। এই মিলনের ফলে কার্তিকের জন্ম হয় । কার্তিককে দেবসেনাপতি করা হয়। কার্তিক তারকাসুরকে বধ করেন । মহাভারতে আছে যে ব্রহ্মা থেকে আরম্ভ করে পিশাচ পর্যন্ত সকলেই মহাদেবকে পূজা করেন। একবার ব্ৰহ্মা মহাদেবকে অসম্মানসূচক কথা বলেছিলেন বলে মহাদেব ব্ৰহ্মার একটি মস্তক কর্তন করেন । সেই থেকে, ব্ৰহ্মা চতুর্মুখ। আগে ব্ৰহ্মার পাঁচ মুখ ছিল। শিবই একটা মুখ কেটে দিয়েছেন।

শিবের নিবাস কৈলাসে। তাঁর তিন স্ত্রী সতী, পাৰ্বতী ও গঙ্গা । দুইপুত্র কার্তিক ও গণেশ। দুই কন্যা লক্ষ্মী ও সরস্বতী। বিষ্ণু শিবের জামাতা । শিবের অনুচরদের মধ্যে আছে নন্দী ও ভৃঙ্গী ।

শিব অত্যন্ত সংযমী দেবতা । আৰ্যদেবতামণ্ডলীর দেবতাগণের মত শিব কামপরায়ণ নয় । ব্রহ্মার আদেশে বিশ্বকর্ম যখন তিলোত্তমা নামে এক অপরূপ সুন্দরী নারী সৃষ্টি করেছিল, তখন তিলোত্তমাকে দেখার জন্য ব্ৰহ্মার চারিদিকে চারিটি মুখ নির্গত হয়েছিল ও ইন্দ্রের সহস্ৰ নয়ন হয়েছিল । একমাত্র শিবই তখন স্থির হয়ে বসেছিলেন । সেইজন্য শিবের আর এক নাম স্থানু ।

গায়ক হিসাবে শিবের সুনাম ছিল। সঙ্গীত বিদ্যায় তিনি নারদকেও পরাহত করেছিলেন । শিবের সঙ্গীতের শ্রোতা ছিলেন। ব্ৰহ্মা ও বিষ্ণু।

মহাদেবের তৃতীয় নেত্ৰ উদ্ভব সম্বন্ধে পুরাণে আছে যে পাৰ্বতী একবার পরিহাসছলে মহাদেবের দুই নেত্রী হস্তদ্বারা আবৃত করেন । তখন সমস্ত পৃথিবী তমসাচ্ছন্ন ও আলোকবিহীন হয়। তাতে পৃথিবীর সব মানুষ বিনষ্ট হবার উপক্রম হয়। পৃথিবীর লোকদের রক্ষা করবার জন্য তিনি ললাটে তৃতীয় নেত্ৰ উদ্ভব করেন ।

ললাটে তৃতীয় নেত্ৰ উদ্ভবের কাহিনী থেকেই আমরা শিবের প্রকৃত স্বরূপের পরিচয় পাই। পৌরাণিক যুগের তিন শ্রেষ্ঠ দেবতা ব্ৰহ্মা, বিষ্ণু ও শিব, এই তিনের মধ্যে শিবই হচ্ছেন সংহারকর্তা । কিন্তু শিব মাত্ৰ সংহারকর্তা নন। সংহারের পর তিনি আবার জীব সৃষ্টি করেন । আমরা আগেই বলেছি যে শিব গোড়াতে সৃজনশক্তিরই দেবতা ছিলেন । সৃজনের জন্য প্রয়োজন হয় প্রজনন । প্রজনন একটা জৈবিক প্রক্রিয়া । এই জৈবিক প্রক্রিয়ার প্রতীক হচ্ছে গৌরীপষ্ট্রের মধ্যে স্থাপিত শিবলিঙ্গ । শিবের এই রূপই হচ্ছে একটা মহান বৈজ্ঞানিক সত্যের প্রকাশ । এর মধ্যে চিত্তবিকারজনিত কোন ব্যাপার নেই।

শিবের যৌনজীবনের এক রমণীয় চিত্র আমরা রামেশ্বরের শিবায়ন-এ পাই । রামেশ্বরের শিব একেবারে বাঙলার ঘরের মানুষ । রামেশ্বরের শিবানী দুলের মেয়ে । সুতরাং বিবাহসূত্রে শিবও দু’লে– বাঙলার নিম্নকোটির লোক । বেদের সময় শিব ছিলেন অনার্য দেবতা । এই কাব্যেও শিব হয়েছেন সেকালের বাঙলার ওই ধরনের শ্রেণীর প্ৰতীক । বাঙলার নিম্নকোটির আর পাঁচজন লোকের মত, রামেশ্বরের শিবও নিঃস্ব । ভিক্ষাবৃত্তি ছাড়া, তার আর কোন উপজীব্য নেই। ভিক্ষায় বেরিয়ে শিব কুচনীপাড়ায় গিয়ে কুচনীদের সঙ্গে প্রেম করে । দিনের শেষে ভিক্ষা করে যা নিয়ে আসে, তুই ছেলে কাৰ্তিক, গণেশ তা খেয়ে ফেলে। কিন্তু কাৰ্তিকের ছয় মুখ আর গজাননের সুবৃহৎ উদার । তাদের ক্ষুধিত উদর কখনই পূর্ণ হয় না। গৃহিণী নিজেও সর্বদা ক্ষুধিতা । উদাসীন স্বামীকে নিয়ে গৌরীর খুবই বিড়ম্বনা । গৌরী স্বামীকে বলেন–‘তোমার এত অভাব । এত অনটন। কোনদিন তোমায় দুটি ভাত দিতে পারি, আবার কোনদিন তা-ও পারি না । তোমার এত দুঃখ আমি দেখতে পারি না । তুমি চাষ কর । তোমার গৃহে অন্নের অভাব হবে না । যেভাবে চাষ করতে হবে, তা আমি বলে দিচ্ছি। পুকুরের ধারে জমি নেবে যাতে জলের অভাবে তুমি পুকুর থেকে জল সেঁচে আনতে পার । ফসল হলে, তুমি নিজের ঘরের ভাত কত সুখে খাবে । আরও, তোমাকে আর সব সময় কেঁদো বাঘের ছাল পরে থাকতে হবে না । তুমি কার্পাসের চাষ করে, তুলা বের কর । তা থেকে তোমার পরবার কাপড়ও তৈরী হবে ।’ এ যেন আত্মভোলা মহাবোধিকে কৰ্মযোগে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে । শিব গৌরীর পরামর্শে চাষী হন। নিজের ত্ৰিশূলের মাথা কেটে লাঙ্গলের ফলা তৈরী করান। ইন্দ্রের কাছ থেকে জমি সংগ্ৰহ করেন, কুবেরের কাছ থেকে ধানের বীজ। আর হলকর্ষণের জন্য নিজের বৃষ তো আছেই। তাছাড়া, যমের কাছ থেকে মহিষও চেয়ে নেন । তারপর রামেশ্বরের ভাষায়— ‘মান্য জান্য মঘবান মহেশের লীলা । মহীতলে মাঘ শেষে মেঘরস দিলা ॥’ এ তো সেই বাঙলার চাষীর মুখে ডাকের বচনেরই প্ৰতিধ্বনি -“ধন্য রাজার পুণ্য দেশ, যদি বর্ষে মাঘের শেষ।’

তারপর শুভদিনে শিব ক্ষেতের কাজ আরম্ভ করলেন । জমি চৌরস করলেন, আল বাঁধলেন। বীজ বপন করলেন । বীজগুলি বেরুল । বর্ষার জল পেয়ে ধানের পাশে আরও নানারকম গাছপালা জন্মাল । তখন শিব নিড়ানের কাজ আরম্ভ করলেন । বর্ষার সঙ্গে জোক মশা মাছির উপদ্রব বাড়ল । কিন্তু তা-বলে তো কাতর হয়ে চাষী চাষ বন্ধ রাখে না । শিবও বিরত হন না । ধানগাছের মূলটুকু ভিজা থাকবে, এমন জল রেখে বাকী জল নালা কেটে, ভাদ্র মাসে ক্ষেত থেকে বের করে দেন। আবার আশ্বিন-কার্তিকে ক্ষেতের জল বাঁধেন । এর মধ্যে ডাক সংক্রান্তি এসে পড়ে । শিব ক্ষেতে নল পুতেন। দেখতে দেখতে সোনালী রঙের ধান দিগন্ত পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ে। শিবের আনন্দ ধরে না । দেখতে দেখতে পৌষ মাসে ধান কাটার সময় আসে। শাখ বাজিয়ে গৌরী ধান ঘরে তুললেন । সব শেষে রামেশ্বর দিয়েছেন বাঙালী কৃষক গৃহস্থের মত নবান্নে ও পৌষ পার্বণে শিবের দুই ছেলের সঙ্গে ভোজনের এক মধুময় আনন্দচিত্র।

রামেশ্বরের শিবায়নে দেবতারা মানুষ । ব্ৰহ্মার গায়ে গা দিয়ে বসে গোপকন্যা । শিব-গৌরীও কৈলাসের শিব-গৌরী নন । তঁরা বাঙলার কৃষক ও কৃষকগৃহিণী, বাঙালী তার দেবতাদের মানুষ ও মানুষীর রূপ দিয়ে তঁদের আপনজন করে নিয়েছিল । আর পাঁচটা বাঙালী মেয়ের মত গৌরী পুতুল খেলা করে । পুতুলের বিয়ে দেয় নিজের । পুতুলের বিয়েতে নিজের সখীদের বিকল্প ভোজন করায় । অন্য বাঙালী মেয়ের মত গৌরীর বিয়েতেও ঘটকের প্রয়োজন হয় । ভাগনে নারদই মামার বিয়ের ঘটকালী করে । বিয়েতে পালনীয় সব কর্মই অনুষ্ঠিত হয় । এয়োরা আসে, কন্যা সম্প্রদান হয়, যৌতুকও বাদ যায় না । রামেশ্বর এয়োদের যে নামের তালিকা দিয়েছেন তা থেকে আমরা তৎকালীন মেয়েদের নামের নমুনা পাই। তবে অন্যান্য মঙ্গলকাব্যে যেমন কবিরা পতি নিন্দার অবতারণা করেছেন, রামেশ্বর তা করেন নি। তার পরিবর্তে তিনি শাশুড়ীদের মুখ দিয়ে জামাতাদের নিন্দা প্ৰকাশ করেছেন । রামেশ্বরের কাব্যের এই অংশ অত্যন্ত কৌতুকাবহ ।

অন্য কৃষকপত্নীদের মত গৌরীও শিবঠাকুরকে খাবার দিতে মাঠে যায়। গৌরীকে দেখে শিবঠাকুর হাল ছেড়ে দিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করেন—’কি গো খাবার আনতে এত দেরী কেন ?’ গৌরী বলে— ‘ছেলেপুলের সংসার এক হাতে সব করতে গেলে এমনই হবে।’ কথায় কথা বাড়ে। ক্ষুধিত শিব গৌরীর চুল ধরে টানে। এটা অবশ্য রামেশ্বরের শিবায়নে নেই। আছে ওড়িয়া সাহিত্যে । তবে বাঙালী গৃহস্থ ঘরে স্বামী-স্ত্রীর কোন্দলের অনুসরণ করে। রামেশ্বর তার শিবায়নে হর-গৌরীর ঝগড়ার বর্ণনা দিয়েছেন । শিব রাগ করে গৌরীকে বলে–’ক্ষেমা কর ক্ষেমঙ্করি খাব নাঞি ভাত । যাব নাঞিঃ ভিক্ষায় যা করে জগন্নাথ ।’ আবার অন্য সময় শিব আদর করে গৌরীর হাতে শাখাও পরিয়ে দেন ।

রামেশ্বর অপূর্ব বর্ণনা দিয়েছেন গৌরীর স্বামী-পুত্রকে খাওয়ানোর–

‘তিন ব্যক্তি ভোক্তা এক অন্ন দেন সতী ।
দুটি সুতে সপ্তমুখ, পঞ্চমুখ পতি ॥
তিন জনে বার মুখে পাঁচ হাতে খায়।
এই দিতে এল নাঞি হাঁড়ি পানে চায় ॥
সুক্ত খায়্যা ভোক্তা যদি হস্ত দিল শাকে ।
অন্নপূর্ণা অন্ন আন রুদ্রমূর্তি ডাকে ॥
কার্তিক গণেশ বলে অন্ন আন মা ।
হৈমবতী বলে বাছা ধৈৰ্য্য হইয়া খা ॥
ঊল্বন চর্বনে ফির‍্যা ফুরাইল ব্যঞ্জন ।
এককালে শূন্য থালে ডাকে তিন জন ॥
চটপট পিষিত কর‍্যা যুষে ।
বাউবেগে বিধুমুখী ব্যস্ত হয়্যা আসে ॥
চঞ্চল চরণেতে নূপুর বাজে আর ।
রিনি রিনি কিঙ্কিনী কঙ্কণ ঝনকার ॥’

এক কথায় রামেশ্বর শিবকে বাঙলার ঘরের মানুষ ও শিবানীকে বাঙালী ঘরের গৃহিণী করেছেন । বাঙালী ঘরের গৃহিণী হিসাবে গৌরীকে দিনরাত পরিশ্রম করতে হয়। মা মেনকা গৌরীকে বিশ্রাম দেবার জন্য বাপের বাড়ি নিয়ে যেতে চান । কিন্তু শিবের মর্যাদাজ্ঞান খুব বেশি । মাত্র তিন দিনের কড়ারে শিব গৌরীকে বাপের বাড়ি পাঠন । সেজন্যই বাঙালী বলে যে শরৎকালে মা মাত্র তিন দিনের জন্য বাপের বাড়ি আসছেন।

1 Comment
Collapse Comments

বীরভদ্রর কি ভাবে জন্ম হয় ?

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *