০৫. শাহি ফরমান জারি হয়েছে

শাহি ফরমান জারি হয়েছে। সম্রাট হুমায়ূন শের খাঁ’র বিরুদ্ধে যুদ্ধযাত্রা করবেন। শের খাঁকে বন্দি অবস্থায় দিল্লী আনা হবে। সেই উপলক্ষে মাসব্যাপী উৎসব। উৎসবের নাম ঠিক হয়েছে ‘শের খাতেমুন’, যার অর্থ-শেরের শেষ।

শের খাঁকে বন্দি করতে কতদিন লাগবে এটা বোঝা যাচ্ছে না। সে সরাসরি সম্মুখ সমরে আসে না। চোরাগোপ্তা হামলা করে। তার যুদ্ধ কাপুরুষের যুদ্ধ। মোঘল বাহিনী কাপুরুষ যুদ্ধে অভ্যস্ত না বলেই সমস্যা।

সম্রাট বাংলা মুলুক কখনো দেখেন নি। শের খাঁকে পরাস্ত করে তিনি বাংলা মুলুকে কিছুদিন বাস করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। বাংলা মুলুকের বর্ষার অনেক গল্প শুনেছেন। সেই বর্ষা দেখবেন। বর্ষায় সেখানকার সব নদী নাকি সমুদ্রের মতো হয়ে যায়। এক কুল থেকে আরেক কুল দেখা যায় না। তাঁর নদী দেখার শখ আছে। বাংলা মুলুকের হিজড়ারা নাকি নৃত্যগীতে বিশেষ পারদর্শী। তাদের নৃত্যগীত সাধারণ নৃত্যগীতের চেয়ে আলাদা। কতটা আলাদা সেটাও সম্রাটের দেখার ইচ্ছা। (*সম্রাটের ভাই আসকারি মীর্জা বঙ্গ বিজয়ের পর সম্রাটের কাছে উপহার হিসেবে কয়েকজন হিজড়া চেয়েছিলেন।)

মোঘল সম্রাটদের যুদ্ধযাত্রা বিশাল ব্যাপার। চারদিকে সাজ সাজ রব পড়ে গেল। যুদ্ধযাত্রার খরচ হিসেবে আমীররা সঞ্চিত ধনরত্ন জমা দিতে শুরু করলেন। শুধু ধনরত্ন না, তাদেরকে ঘোড়াও দিতে হলো। যে এক হাজারি আমীর সে দেবে এক হাজার ঘোড়া। পাঁচ হাজারি আমীর দেবে পাঁচ হাজার ঘোড়া। করদ রাজ্যের রাজাদের বাধ্যতামূলকভাবে সৈন্য এবং স্বর্ণমুদ্রা পাঠাতে হলো।

যুদ্ধযাত্রার জন্যে একটা বরগা তাঁবু রওনা হয়ে গেছে। বরগী তাঁবুতে একসঙ্গে দশ হাজার মানুষ দাঁড়াতে পারে। এই তাঁবু খাটাতে এক হাজার তাঁবুর কারিগরকে সাত দিন খাটতে হয়।

সম্রাটের জন্যে যাচ্ছে ডুরসানা-মঞ্জেল তাঁবু। এটি দোতলা। উপরের তলায় সম্রাট নামাজ পড়বেন। নিচতলায় বেগমরা থাকবেন।

সম্রাট রাতে ঘুমাবেন চৌবিলরৌতি তাঁবুতে। এই তাঁবুর চালের নিচে খসখসের সিলিং দেওয়া। নিচেও থাকে খসখস। খসখসের উপর কিংখাব ও মলমল। তাঁবু খাটাবার দড়ি রেশমের।

সম্রাট হুমায়ূন আনন্দের সঙ্গে যুদ্ধপ্ৰস্তৃতি লক্ষ করতে লাগলেন। তাঁর আনন্দ কিছু বাধাগ্রস্ত হলো বৈরাম খাঁ’র কারণে। বৈরাম খাঁ বললেন, দিল্লী ত্যাগ করা মোটেই ঠিক হবে না।

সম্রাট বললেন, সমস্যা কী ?

বৈরাম খাঁ বললেন, সমস্যা আপনার তিন ভাই। আপনার অনুপস্থিতিতে তারা দিল্লীর সিংহাসন দখলের চেষ্টা চালাবে।

হুমায়ূন বললেন, আমি আমার ভাইদের নিজের প্রাণের মতোই ভালোবাসি। তারা তিনজনই আমার সঙ্গে যুদ্ধযাত্রা করবে।

তারা আপনার সঙ্গে যুদ্ধযাত্রা করবে না।

তুমি আমার সঙ্গে বাজি রাখতে চাও ?

সম্রাটের সঙ্গে বাজি রাখার স্পর্ধা এই নফরের নেই। আমার এই তিন ভাইয়ের কারণেই কি তুমি যুদ্ধযাত্রা করতে চাচ্ছ না, নাকি আরও কারণ আছে ?

বাংলা মুলুকে বর্ষা এসে যাবে। মোঘল সেনাবাহিনী বর্ষার সঙ্গে পরিচিত না।

এখন পরিচয় হবে। আমিও পরিচিত হব। কলমচিকে খবর দাও, আমি তিনভাইকে পত্ৰ লিখব। এখনই লিখব।

সম্রাট পত্র লিখলেন। তিনজনকে আলাদা আলাদা চিঠি। মীর্জা কামরানকে লেখা চিঠির নমুনা–

আমার প্রাণপ্রিয় ভ্ৰাতা কামরান মীর্জা।
আমার হৃদয়ের পাখি। বাগিচার সৌরভময় গোলাপ।

প্রিয় ভ্রাতা, বাংলা মুলুকের শের খাঁ নামের দুষ্টকে শায়েস্তা করতে বিশাল মোঘল বাহিনী অতি শীঘ্ৰ যাত্রা শুরু করবে। তুমি তোমার সৈন্যবাহিনী নিয়ে লাহোর থেকে চলে এসো। বড়ভাইয়ের দক্ষিণ বাহু হও। আমার তিন ভাই পাশে থাকলে আমি বিশ্ব জয় করতে পারি। যেমন করেছিলেন জুলকারলাইন। (*আলেকজান্ডার দি গ্রেট)

আমার বহরের সঙ্গে তোমার অতি আদরের ভগ্নি গুলবদন থাকবে। সে তোমার সাক্ষাতের জন্যে আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষায় আছে। প্রিয় ভ্রাতা, তোমার প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন হিসাবে আমি একটি নীলা এবং একটি পোখরাজ পাঠালাম। তুমি রত্ন দু’টিকে প্রতিদিন দুগ্ধমান করাবে। এর অন্যথা হলে রত্নের ঔজ্জ্বল্য নষ্ট হবে। এখন তাৎক্ষণিকভাবে তোমার উদ্দেশে রচিত পঞ্চপদী–

কামরান
চন্দ্ৰ প্ৰস্ফুটিত তার দু’নয়ন।
হৃদয় আর্দ্র আবেগে
যার কেন্দ্ৰে তার ভাই
মীর্জা হুমায়ূন।

কামরান মীর্জা পত্রের জবাব দিলেন না। তার দরবারের এক আমীরকে সম্রাটের কাছে পাঠালেন। আমীর সম্রাট হুমায়ূনকে জানালেন, পাঁচটি কারণে কামরান মীর্জা তাঁর সঙ্গে যেতে পারছেন না।

১. তিনি অসুস্থ। পেটের পীড়ায় ভুগছেন।

২. তাঁর প্রধান গণক গণনা করে পেয়েছে, যুদ্ধযাত্রায় তার প্ৰাণনাশের সম্ভাবনা।

৩. লাহোর অরক্ষিত রেখে রওনা হওয়ার অর্থ শত্রুর হাতে লাহোর তুলে দেওয়া।

৪. স্বপ্লে তিনি তাঁর পিতা সম্রাট বাবরকে দেখেছেন। সম্রাট বাবর তাকে লাহোর ছেড়ে যেতে নিষেধ করেছেন।

৫. তাঁর প্রিয় ঘোড়া লালী মারা গিয়েছে। তিনি ভালো ঘোড়ার সন্ধানে আছেন। শিক্ষিত এবং পরিচিত ঘোড়া ছাড়া যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হওয়া যায় না।

আমার সঙ্গে না যাওয়ার পাঁচটি কারণ উল্লেখ করেছে। একটি কারণই যথেষ্ট ছিল। পাঁচটি কারণের একটিতে সে আমার মহান পিতাকে টেনে এনেছে। তার প্রয়োজন ছিল না। আপনি আমার ভাইকে বলবেন, যা ঘটবে আল্লাহ্‌পাকের হুকুমেই ঘটবে। আমি কামরান মীর্জার জন্যে একটি শিক্ষিত আরবি ঘোড়া আপনার সঙ্গে দিয়ে দিচ্ছি। পেটের পীড়া একটি নোংরা ব্যাধি। আমি দ্রুত তার আরোগ্য কামনা করছি।

সম্রাটের নির্দেশে আমীরকে একপ্রস্থ পোশাক, একটি রত্নখচিত তরবারি, দশটা আশরাফি দেওয়া হলো। ভাইয়ের পাঠানো দূতের প্রতি সম্মান দেখানো হলো। এই আমীরের নাম মীর হামজা।

মীর হামজা লাহোর ফিরছেন। তার সঙ্গে বিশজন অশ্বারোহীর একটি ক্ষুদ্র দল। রসদ বহনকারী একটা ঘোড়ার গাড়ি। এই গাড়ির সঙ্গেই কামরান মীর্জাকে দেওয়া সম্রাট হুমায়ূনের আরবি ঘোড়া বাধা। ঘোড়ার রঙ সাদা। তার নাম ফাতিন। ফাতিন শব্দের অর্থ সুন্দর।

বিশ ক্রোশ অতিক্রম করার পর মীর হামজাকে থামতে হলো। অশ্বারোহী বিশাল বাহিনী নিয়ে বৈরাম খাঁ দাঁড়িয়ে আছেন। বৈরাম খাঁ বললেন, সম্মানিত আমীর মীর হামজা! আপনার সঙ্গে একান্তে কিছু কথা বলার জন্যে দাঁড়িয়ে আছি।

মীর হামজা বললেন, অশ্বারোহী বিশাল বাহিনী নিয়ে একান্তে কথা?

আমরা দুজন দূরে সরে যাব। একান্ত কথা সেখানেই হবে।

আপনি আপনার বাহিনী নিয়ে এসেছেন কেন?

বৈরাম খাঁ হাসতে হাসতে বললেন, গাধার বেপারি সঙ্গে গাধা নিয়ে চলাফেরা করে। গাধাগুলি হচ্ছে তার শোভা। একজন সেনাপতির শোভা তার সৈন্যবাহিনী।

আমি আপনার সঙ্গে একান্তে কথা বলব না। যা বলতে চান। এখানে বলুন।

আমার সম্রাটের সঙ্গে আপনার কথা হয়েছে। সম্রাটকে আপনার কেমন মনে হয়েছে?

তিনি ভীতুপ্রকৃতির মানুষ।

ভীতু?

হ্যাঁ ভীতু৷ ভীতু বলেই ভাইকে খুশি রাখার চেষ্টা করছেন।

ভ্ৰাতৃস্নেহও তো হতে পারে। সম্রাটদের ভ্রাতৃস্নেহ থাকে না। ভ্রাতৃভীতি থাকে।

সম্রাট হুমায়ূন যুদ্ধযাত্রার পরপর কি কামরান মীর্জা নিজেকে দিল্লীর সম্রাট ঘোষণা করবেন?

সেটা উনিই ভালো বলতে পারবেন। আমি অন্তর্যামী না।

আমি এই তথ্য বিশেষভাবে জানতে চাচ্ছি। সম্রাটের অমঙ্গল আশঙ্কায় আমি অস্থির।

মীর হামজা বললেন, আপনাকে আগেই বলেছি আমি অন্তর্যামী না। কামরান মীর্জার পরিকল্পনা আমি জানি না।

বৈরাম খাঁ বললেন, আমি কামরান মীর্জার পরিকল্পনা আঁচ করতে পারছি। আপনি এই খবর কামরান মীর্জাকে জানাবেন।

অবশ্যই জানানো হবে।

বৈরাম খাঁ বললেন, আপনাকে মুখে কিছু জানাতে হবে না। আমি এমন ব্যবস্থা করব যে আপনি লাহোরে উপস্থিত হওয়ামাত্ৰ কামরান মীর্জা যা বোঝার বুঝে নেবেন।

কী ব্যবস্থা করবেন?

আপনার জন্যে একটি গাধা সংগ্ৰহ করা হয়েছে। আপনি গাধার পিঠে চড়ে লাহোরে যাবেন। নগ্ন অবস্থায় যাবেন।

আপনি উন্মাদের মতো কথা বলছেন।

হতে পারে। আপনার সঙ্গের অশ্বারোহীরা আমার সেনাবাহিনীতে যোগ দিবে। এরা ভাড়াটিয়া সৈন্য। দলত্যাগে তাদের কখনো সমস্যা হয় না।

সম্রাট হুমায়ূনের কানে এই খবর পৌঁছানোর পরিণাম হবে ভয়াবহ।

তার কানে এই খবর আমিই পৌঁছোব। তাকে বলব, মীর হামজা লাহোরের পথে রওনা হওয়ার পর একদল ডাকাতের হাতে পড়েন। ডাকাতরা তাঁর সব লুটে নিয়ে তাকে নগ্ন করে গাধার পিঠে তুলে দেয়। সম্রাট এই খবরে আমোদ পাবেন, তিনি আমোদ পছন্দ করেন।

মীর হামজাকে সত্যি সত্যি নগ্ন করে গাধার পিঠে চড়িয়ে দেওয়া হলো।

ফজরের নামাজের পরপরই সম্রাট হুমায়ূনের বিশাল বাহিনী বঙ্গদেশের দিকে যাত্রা শুরু করল। তারিখ : ২৭ জুলাই ১৫৩৭ খ্রিষ্টাব্দ।

সম্রাট আনন্দিত, কারণ তার দুই ভাই হিন্দাল মীর্জা এবং আসকারি মীর্জা তার সঙ্গে আছেন।

যাত্রার সময় আশ্চর্য এক ঘটনাও ঘটেছে। দু’টি কবুতর সম্রাটের মাথার উপর চক্রাকারে ঘুরেছে। এটি অতি শুভ লক্ষণের একটি।

অগ্রগামী দলে আছে অশ্বারোহী বাহিনী। তার পেছনেই পদাতিক বাহিনী। পদাতিক বাহিনী চলছে হন্তীযুথের সঙ্গে। হাতির সংখ্যা আট শ।

সেনাদল কোথাও না থেমে আসর পর্যন্ত একনাগাড়ে চলবে। আসরের সময় বিশ্রাম এবং আহারের জন্যে থামা হবে। পরদিন আবারও ফজরের নামাজের পর যাত্রা শুরু হবে। যুদ্ধযাত্রার সময় সম্রাট একবেলা আহার করেন।

প্রথম যাত্রাবিরতিতে সম্রাটকে যে খাবার দেওয়া হয়েছিল, তার বর্ণনা দেওয়া যেতে পারে।

পোলাও : পাঁচ ধরনের।

রুটি : সাত প্রকারের।

পাখির মাংস : কিসমিসের রসে ভেজানো পাখি ঘিতে ভেজে দেওয়া।

পাখিদের মধ্যে আছে হরিয়াল, বনমোরগ, বিশেষ শ্রেণীর ময়ূর।

ভেড়ার মাংস : আস্ত ভেড়ার রোষ্ট।

বাছুরের মাংস : কাবাব।

পাহাড়ি ছাগের মাংস : আস্ত রোস্ট (সম্রাটের বিশেষ পছন্দের খাবার)।

ফল, শরবত, মিষ্টান্ন।

সম্রাট হুমায়ূন এবং তাঁর পরিবারের জন্যে যুদ্ধকালীন বাবুর্চির সংখ্যা ছিল এক হাজার। প্রধান বাবুর্চি নকি খান নতুন নতুন খাবার উদ্ভাবন করতেন। তাঁর উদ্ভাবিত একটি খাবার পুরনো ঢাকার কিছু রেস্তোরায় এখনো পাওয়া যায়। খাবারের নাম গ্লাসি।

গ্লাসির রেসিপি (মোঘল আমলের) দেওয়া হলো। পাতলা স্লাইস করে কাটা খাসির মাংস সজারুর কাঁটা (বিকল্প, খেজ্বরের কাটা) দিয়ে কেঁচতে হবে। কেঁচানো মাংসে দিতে হবে কিসমিচের রস, পোস্তদানা বাটা, পেস্তা বাটা, শাহী জিরা বাটা, আদার রস, পেঁয়াজের রস, রসুনের রস, দই, দুধ এবং গম বাটা। পরিমাণমতো লবণ। এতে যুক্ত হবে জয়ত্রি গুড়া, জায়ফল গুড়া, দারুচিনি গুড়া। সব ভালোমতো মেখে মাটির হাঁড়িতে রেখে ঢাকনা লাগিয়ে দিতে হবে। মাটির হাঁড়ি সারা দিন রোদে থাকবে। খাবার পরিবেশনের আগে আগে অল্প আঁচে মাংসের টুকরা মহিষের দুধের ঘিতে (ভৈসা ঘি) ভাজতে হবে।

বঙ্গদেশের দিকে যাত্রার সময় তাঁর রসদখানায় মহিষের দুধের ঘি ছিল দশ মণ এবং গরুর দুধের ঘি ছিল ত্রিশ মণ।

সৈন্যদের খাবার ছিল : এক ঘটি দুধ, যবের রুটি, এক পোয়া ছাতু, মাংস এবং পেঁয়াজ।

 

যাত্রাবিরতির প্রথম রাত্ৰি।

হুমায়ূন এশার নামাজ শেষ করে তাঁর জন্যে খাটানো চৌবনরৌতি তাঁবুতে গেছেন। গানবাজনা শুনে আফিং খেয়ে ঘুমাবেন।

তাঁর নিজস্ব ভৃত্য জওহর আবিতাবচি তাঁকে জানাল শের খাঁ তাঁর জন্যে কিছু উপহার পাঠিয়েছেন। উপহারের মধ্যে আছে তিনজন অতি রূপবতী বাঙ্গালমুলুকের তরুণী এবং সাতজন হিজড়া। উপহারের সঙ্গে একটি পত্রও আছে।

সম্রাট পত্র পাঠ করলেন। শের খাঁ লিখেছেন—

দিল্লীশ্বর সম্রাট হুমায়ূন,

আপনি অধম তুচ্ছতিতুচ্ছ শের খাঁকে শায়েস্তা করতে যাচ্ছেন। আমি আপনার দাসানুদাস। আমার কারণে এই তীব্ৰ গরমে আপনার কষ্ট হচ্ছে, এটা আমি নিতেই পারছি না।

আপনি দিল্লীতে ফিরে যান।

আপনাকে চুনার দুর্গ আমি দিয়ে দিচ্ছি।

কিছু উপহার পাঠালাম। আমি জানি উপহার আপনার পছন্দ হবে।

ইতি
অধম শের খাঁ (ফরিদ)

চিঠিতে কাজ হলো। সম্রাট নির্দেশ দিলেন, একদিন বিশ্রামের পর মূল সেনাবাহিনী দিল্লী ফেরত যাবে। ডেকে পাঠানো হবে শের খাঁকে। চুনার দুর্গের দখল নেওয়ার জন্যে রুমী খাঁকে পাঠানো হবে। রুমী খাঁর নেতৃত্বে থাকবে বেশ কিছু কামান এবং দুই শ কামানচি। কামানের প্রয়োজন হবে না। তারপরেও থাকল।

ফজরের নামাজের পর দিল্লী যাত্রা শুরু হবে। নামাজের পরপর হুমায়ূন ঘোষণা করলেন চুনার দুর্গ হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় তিনি উপস্থিত থাকতে চান। কাজেই যুদ্ধযাত্রা অব্যাহত থাকবে। সম্রাটের খামখেয়ালির সঙ্গে তার সেনাপতি এবং আমীররা পরিচিত। কেউ অবাক হলেন না।

চুনার দুর্গের অধিনায়ক শের খাঁ’র পুত্র কুতুব খাঁ।

চুনার দুর্গে পৌঁছতে হুমায়ূনের চার মাস সময় লাগল। তিনি নভেম্বরে পৌঁছলেন। আরামদায়ক আবহাওয়ায় হুমায়ূন প্রসন্ন। ভেষজবিদ্যার উপর কিছু দুর্লভ বই তার কাছে এসেছে। বইয়ে বর্ণিত গাছের গুণাগুণ পরীক্ষার বাসনায় তিনি অস্থির। দুর্গ দখলের পর পরীক্ষা-নিরীক্ষা পর্ব শুরু করবেন।

দুর্গের দায়িত্ব ছেড়ে দেওয়ার জন্য কুতুব খাঁর কাছে দূত গেল। কুতুব খাঁ বললেন, সম্রাট স্বয়ং উপস্থিত হলেই দুর্গ তার হাতে তুলে দেওয়া হবে।

সম্রাটের দূত বললেন, সামান্য দুর্গ দখলের জন্যে হিন্দুস্থানের অধিপতির আসা শোভা পায় না।

কুতুব খাঁ বললেন, হিন্দুস্থানের অধিপতিকে অনেক তুচ্ছ কাজ কিন্তু করতে হয়। শব্দ করে তিনি বায়ু ত্যাগ করেন। আপনি হয়তো শোনেন নি।

আপনার ঔদ্ধত্যমূলক আচরণের সমুচিত জবাব দেওয়া হবে।

শুনে খুশি হলাম। আফগানরা সমুচিত জবাব ভালোবাসে।

আপনি যে নোংরা কথাগুলি বলেছেন আমি নিজে সম্রাটকে তা জানাব।

সেই সুযোগ আপনি পাবেন না।

এই কথার অর্থ কী?

আপনাকে বাধ্য করা হবে সম্রাটকে একটা পত্ৰ পাঠাতে। সেই পত্রে আপনি বিনয়ের সঙ্গে লিখবেন যে, আপনি স্বেচ্ছায় দলত্যাগ করে আমার সঙ্গে যোগ দিয়েছেন।

জীবন থাকতে এ ধরনের চিঠি আমি লিখব না।

জীবন থাকা অবস্থাতেই আপনি লিখবেন। আমার নির্দেশে আপনাকে খোজা করানো হবে। খোজা করার প্রক্রিয়া শুরু হওয়ামাত্রই আপনি চিঠি লিখতে রাজি হবেন।

সম্রাট হুমায়ূন তাঁর দূতের কাছ থেকে একটা চিঠি পেলেন। চিঠিতে জানলেন এই আমীর দলত্যাগ করেছে। তাঁর শক্তি ও সামথ্য সে ব্যয় করবে। আফগানদের জন্যে।

হতভম্ব সম্রাট রুমী খাঁ-কে দুর্গ দখলের নির্দেশ দিলেন। রুমী খাঁ কামান দাগতে শুরু করলেন। এর উত্তরে কুতুব খাঁ’র দুর্গের ভেতর থেকে কামানের গোলা বৃষ্টির মতো পড়তে শুরু করল। কুতুব খাঁ’র কামানগুলি ছোট। তবে তাদের নিশানা অব্যৰ্থ। রুমী খাঁ-কে পেছনে হটতে হলো।

মোঘল সৈন্যরা দুর্গ অবরোধ করে পাঁচ মাস বসে রইল। দুর্গ দখল করতে পারল না। এর মধ্যে শুরু হলো বঙ্গের বিখ্যাত বৃষ্টি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *