০৫. শব্দটা যান্ত্রিক এবং ঠান্ডা

৪১.

শব্দটা যান্ত্রিক এবং ঠান্ডা। ধাতব। রুমের প্রত্যেকে শুনছে।

উচ্চারণটা ধরার চেষ্টা করল ল্যাঙডন। মধ্যপ্রাচ্যের, তাই না?

আমি এক প্রাচীণ ব্রাদারহুডের প্রতিনিধি। অপরিচিত, অপার্থিব আত্মবিশ্বাস লোকটার সুরে, এমন এক ভাতসংঘ যেটাকে শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে আপনারা দমন করে এসেছেন। আমি দ্য ইলুমিনেটির একজন সংবাদবাহক।

ল্যাঙডনের মনে পড়ে গেল আজ সকালে প্রথম দেখা এ্যাম্বিগ্রামটার কথা।

কী চান আপনি? জিজ্ঞাসা করল ক্যামারলেনগা।

আমি বিজ্ঞানের লোকদের শ্রদ্ধা করি। মানুষ, যারা আপনাদের মতই সত্যের সন্ধানে আছে, কিন্তু আরো বেশি ভাল পদ্ধতিতে, আরো বিশুদ্ধ পথে। যারা মানুষের গন্তব্য, তার উদ্দেশ্য, তার স্রষ্টার বিষয়ে প্রশ্নগুলোর উত্তর দিতে চায়।

আপনি যেই হন না কেন, বলছে ক্যামারলেনগো, আমি।

সাইলেঞ্জিও! আপনার কথাগুলো শুনে নেয়াই ভাল। দু হাজার বছর ধরে সত্যের সন্ধানে আপনার চার্চই অগ্রবর্তী ছিল। আপনারা বিনা দ্বিধায় আপনাদের শত্রুদের মূলোৎপাটিত করেছেন। আপনারা সত্যের আরাধনার নামে আখের গুছিয়েছেন। যারা অন্য পথে সত্যের সন্ধানে ছিল তাদের মুখ বন্ধ করে দিয়েছেন বিনা দ্বিধায়। আপনারা কী করে অবাক হন এ কথা শুনে যে সারা পৃথিবীর আলোকিত মানুষের টার্গেট এখন আপনাদের ভ্রান্ত প্রতিষ্ঠান?

আলোকিত মানুষরা ব্ল্যাকমেইল করে না।

ব্ল্যাকমেইল? হাসল কলার, এটা কোন ব্ল্যাকমেইল নয়। আমাদের কোন দাবি নেই। ভ্যাটিকানের ধ্বংস অপ্রতিরোধ্য। আজকের দিনের জন্য আমরা শত শত বছর ধরে প্রতীক্ষা করেছি। মাঝরাতে আপনাদের মহানগরী গুঁড়িয়ে যাবে। আপনাদের করার কিছু নেই।

ফোনের কাছে এগিয়ে গেল ওলিভেট্টি, এ সিটিতে ঢোকা অসম্ভব! আপনাদের পক্ষে এখানে বোমা রাখা সম্ভব নয়!

আপনার কণ্ঠ শুনে মনে হচ্ছে সুইস গার্ডের প্রতিনিধিত্ব করছেন। কোন অফিসার? আপনার জানার কথা যে বছরের পর বছর ধরে আমরা সারা পৃথিবীর সব এলিট বাহি নীর সাথে টক্কর দেয়ার ক্ষমতা অর্জন করেছি। আপনি কি মনে করেন যে ভ্যাটিকান সিটি একেবারে নিরেট?

জিসাস! ভাবল ল্যাঙডন, তারা ভিতরের সাহায্য নিচ্ছে।

এতেই ইলুমিনেটির প্রভাবের প্রমাণ পাওয়া যায়। তারা মেসনদের ভিতরে বেড়ে উঠেছে, দখল করেছে পৃথিবীর ব্যাঙ্কিং পাওয়ার, রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা। একবার চার্চিল বলেছিলেন যে ব্রিটিশ সিক্রেট সার্ভিস জানতে পেরেছে, পার্লামেন্টের ভিতরে নাজি আছে, আছে ইলুমিনেটি। একমাসে যুদ্ধ শেষ হয়ে যেতে পারত।

স্পষ্ট ধাপ্পা! আবার বলল ওলিভেট্টি, আপনাদের ক্ষমতা এতদূরে যেতে পারে না!

কেন? কারণ আপনাদের সুইস গার্ড অত্যন্ত ক্ষমতাবান? কারণ তারা আপনাদের প্রাইভেট ওয়ার্ল্ডের সব কোণা আর গলি-ঘুপচি রক্ষা করে? সুইস গার্ডের নিজেদের সম্পর্কে কী বলবেন? তারা কি মানুষ নয়? আপনি কি সত্যি সত্যি মনে করেন তারা সেই স্বপ্ন বুকে নিয়ে বিনা দ্বিধায় কাজ করছে যে কোন এক কালে কেউ একজন পানির উপর হেঁটেছিল? নিজেকেই প্রশ্ন করুন কীভাবে ভ্যাটিকান সিটির ভিতরে ক্যানিস্টারটা ঢুকল। বা কীভাবে আপনাদের সবচে দামি চার সম্পদ স্বয়ং ভ্যাটিকানের ভিতর থেকে উবে গেল?

আমাদের সম্পদ? অবাক হল ওলিভেট্টি, কী বলতে চান?

এক, দুই, তিন, চার। আপনারা এখনো তাদের হারানোর কথা জানেন না?

কোন চুলার কথা বলছেন আপনি- থমকে গেল ওলিভেটি। কথা ফুঠছে না তার কণ্ঠে এবার।

আমি কি তাদের নাম বলব?

হচ্ছেটা কী? তাড়া দিল ক্যামারলেনগো।

হাসল কলার, আপনার অফিসার এখনো জানায়নি? কী পাপের কথা! অবাক হবার মত কিছু নয়। এতবড় গর্ব! আমি কল্পনা করতে পারি আসল সত্যিটা আপনাকে না জানানোর ব্যাপারটা… যে চার কার্ডিনালকে সে রক্ষা করার প্রতিজ্ঞা করেছিল তারা উধাও হয়ে গেছে…

এ তথ্য কোথায় পেলেন আপনি? ওলিভেট্টি অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করল।

ক্যামারলেনগে, বলল কলার একটু শান্ত কণ্ঠে, আপনার কমান্ডারকে জিজ্ঞেস করুন সব কার্ডিনাল এর মধ্যে সিস্টিন চ্যাপেলে গেছে কিনা।

ওলিভেট্টির দিকে চকিতে তাকাল ক্যামারলেনগো, তার সবুজ চোখে ব্যাখ্য চাওয়ার ভাব।

সিনর, ওলিভেট্টি ফিসফিস করল ক্যামারলেনগোর কানে কানে, কথা সত্যি যে আমাদের চারজন কার্ডিনাল এখনো সিস্টিন চ্যাপেলে যাননি। কিন্তু সেজন্য সতর্কবাণীর কোন প্রয়োজন নেই। আজ সকালে সবাই রেসিডেন্ট হলে চেক ইন করেছেন। তাই আমরা ভাল করেই জানি যে তারা সবাই ভ্যাটিকান সিটির ভিতরে নিরাপদে আছেন। ঘণ্টাকয়েক আগে আপনি নিজে তাদের সাথে চা চক্রে যোগ দিয়েছেন। কনক্লেভের ফেলোশিপের জন্য তারা হয়ত কোন জায়গায় শলা পরামর্শ করছেন। আমাদের সার্চ চলছে পূর্ণ উদ্যমে। আমি নিশ্চিত তারা সময়ের কথা ভুলে গিয়ে ভ্যাটিকানের কোন না কোন অসাধারণ ব্যাপার উপভোগ করছেন। হয়ত বাগানে।

বাগানে উপভোগ করছেন? ক্যামারলেনগোর কণ্ঠ বরফ শিতল হয়ে গেল, চ্যাপেলে তাদের চলে যাবার কথা আরো ঘণ্টাখানেক আগেই।

ল্যাঙডন চকিতে দৃষ্টি ফেলল ভিট্টোরিয়ার উপর। কার্ডিনালরা হারিয়ে গেছে? তাহলে এর খোঁজেই তারা আশপাশ চষে ফেলছিল?

আমাদের কাজে আপনারা বেশ তুষ্ট হবেন। নামগুলো বলছি। কার্ডিনাল ল্যামাসে, প্যারিস থেকে; কার্ডিনাল গাইডেরা, বার্সিলোনা থেকে ফ্রাঙ্কফুর্ট থেকে কার্ডিনাল ইবনার…

প্রতিটা নাম পড়ার সাথে আরো আরো যেন কুঁকড়ে যাচ্ছিল ওলিভেট্টি।

আর ইতালি থেকে… কার্ডিনাল ব্যাজ্জিয়া।

যেন এইমাত্র ডুবে গেল ক্যামারলেনগোর ভরসার জাহাজ। বিমূঢ় হয়ে তাকিয়ে থাকল ফোনের দিকে। এই প্রেফারিটি! ফিসফিস করল সে, চার ফেভারিট… ব্যাঞ্জিয়া সহ… সর্বোচ্চ পদে আসীন হতে যাওয়া চার কার্ডিনাল… কী করে সম্ভব?

ল্যাঙডন আধুনিক পাপাল ইলেকশনের ব্যাপারে অনেক পড়েছে। নির্বাচনের আগে কয়েকজন কার্ডিনালের প্রস্তাব করা হয়। তাদের নিয়েই ভোট হবে। তাদের থেকেই একজন নির্বাচিত হবে পরবর্তী পোপ!

ক্যামারলেনগোর ভ্রূ থেকে টপটপ করে ঘাম ঝরে পড়ছে। তুমি এ লোকদের নিয়ে কী করবে?

আপনার কী মনে হয়, কী করব? আমি হ্যাসাসিনদের সরাসরি বংশধর।

একটা ধাক্কা খেল ল্যাঙডন। নামটাকে সে ভালভাবেই চেনে। চার্চ বছরের পর বছর ধরে একে একে অনেক শক্রর জন্ম দিয়েছে হ্যাসাসিন, নাইট টেম্পলার, আরো নানা জাতের সৈন্যদল-যারা হয় গির্জার দ্বারা প্রতারিত হয়েছে নাহয় তাদের দাবড়ে বেড়িয়েছে চার্চ। খুন করেছে নৃশংসভাবে।

ছেড়ে দাও কার্ডিনালদের, অবশেষে রা ফুটল ক্যামারলেনগোর ঠোঁটে, ঈশ্বরের মহানগরী ধ্বংসের হুমকিই কি যথেষ্ট নয়?

আপনাদের চার কার্ডিনালের কথা স্রেফ ভুলে যান। আপনাদের কাছে তাদের আর কোন নাম-নিশানা নেই। একটা ব্যাপার ঠিক ঠিক মনে রাখুন, তাদের মৃত্যু স্মরণীয় হয়ে থাকবে… লাখ লাখ লোকের কাছে। প্রত্যেক শহীদের মৃত্যুর মত। আমি তাদের মিডিয়া-খ্যাতি পাইয়ে দিব ঠিক ঠিক। একের পর এক। মাঝরাতের মধ্যে ইলুমিনেটি সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। কেন শুধু শুধু পৃথিবীকে বদলে দেয়া যদি পৃথিবী না-ই জানল? লাখ লাখ লোকের কাছে আজো আতঙ্ক হয়ে আছেন আপনারা। অনেক অনেক আগেই তার প্রমাণ দিয়েছেন… হত্যাকান্ড, নাইট টেম্পলারদের উপর করা অত্যাচার, ক্রুসেডার… একটু থামে সে, আর, অবশ্যই, লা পাৰ্জা।

একেবারে নিরব হয়ে গেল ক্যামারলেগো।

আপনার কি আসলেই লা পাৰ্জার কথা মনে নেই? শাসানোর ভঙ্গিতে জিগ্যেস করল কলার, অবশ্যই, মনে থাকার কথা নয়, আপনি একজন দুগ্ধপোষ্য শিশু ছাড়া অন্য কিছুই নন। ঠুনকো একজন প্রিস্ট। প্রিস্টদের ইতিহাস জ্ঞান তথৈবচ। নাকি, এ ইতিহাস মনে রাখতে নেই কারণ এটা তাদের মনে লজ্জার কারণ হয়ে দেখা দেয়?

লা পাৰ্জা। হঠাৎ টের পায় ল্যাঙডন, সে কথা বলছে, মোলশো আটষট্টি, চার্চ চারজন ইলুমিনেটি বিজ্ঞানীকে হত্যা করে বুকে ক্রসের আগুন-ছাপ বসিয়ে দেয়। তাদের পাপ স্খলনের জন্য।

কে কথা বলছে? কণ্ঠটা যেন দাবি করল, যেন সে প্রশ্ন করলে সব প্রশ্নের জবাব দিতে সবাই বাধ্য, একপায়ে খাড়া, এখানে আর কে কে আছে?

আবার একটু ধাক্কা খায় ল্যাঙছন, আমার নাম কোন গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার নয়। বলল সে, চেষ্টা করল সে কণ্ঠ ঠিক রাখতে। ব্যাপারটা এখনো ঠিক স্বস্তিকর লাগছে না। একজন জীবন্ত ইলুমিনেটাসের সাথে সে কথা বলছে… ব্যাপারটা তার কছে জর্জ ওয়াশিংটনের সাথে কথা বলার সমতুল্য। আমি একজন এ্যাকাডেমিক যে আপনাদের ব্রাদারহুডের উপর গবেষণা করেছে।

চমৎকার! সাথে সাথে জবাব দেয় কণ্ঠটা, আমি ব্যাপারটা ভেবে অত্যন্ত আনন্দিত হচ্ছি যে আমাদের সাথে করা তুলনাহীন অন্যায়ের ব্যাপারটা কেউ না কেউ মনে রেখেছে। আজো তা নিয়ে স্টাডি করছে।

আমাদের বেশিরভাগই মনে করে আপনারা বিলুপ্ত।

এমন এক ভ্রান্তি যা অনেক কষ্টে চাউর করেছে ব্রাদারহুড। লা পাৰ্জার ব্যাপারে আর কী জানেন আপনি?

একটু দ্বিধায় পড়ে যায় ল্যাঙডন। আর কী জানি আমি! এই পুরো পরিস্থিতি অত্যন্ত ঘোলাটে আর জটিল হয়ে উঠছে, ব্যস, এটুকুই জানি। চিহ্ন একে দেয়ার পর চার বিজ্ঞানীকে হত্যা করা হয়। তারপর রোমের জনবহুল এলাকাগুলোয় সে লাশ ফেলে রাখা হয়, যেন আর কোন বিজ্ঞানী ইলুমিনেটিতে যোগ না দেয়।

ঠিক তাই। আর সেজন্যেই আমরা একই কাজ করব। কুইড প্রো কিউ। একে ধরে নিন আমাদের ব্রাদারহুডের প্রতিশোধ। আমরা ঠিক তাই করব আপনাদের কার্ডিনালদের নিয়ে যা করা হয়েছিল আমাদের সাথে। আটটা থেকে পালা শুরু হবে। ঘণ্টায় ঘণ্টায় একে একে তারা মারা যাবে। মাঝরাতে ঘটনা চাউর হয়ে যাবে সারা দুনিয়ায়।

ল্যাঙডন ঝুঁকে এল ফোনের কাছে, আপনারা আসলেই সেই চারজনকে ইলুমিনেটির ছাপ দিয়ে রাস্তায় নিক্ষেপ করবেন?

হিস্টোরি রিপিটস ইটসেলফ, তাই নয় কি? অবশ্যই, গির্জা যতটা নিষ্ঠুর ছিল তারচে বেশি করব আমরা। তারা নির্জনে হত্যা করেছে, তারপর ফেলে দিয়েছে এমন সব সময় যখন মানুষ দেখতে পাবে না। ব্যাপারটা কি কাপুরুষ কাপুরুষ নয়?

কী বলছেন আপনি? চিৎকার করে ওঠে ল্যাঙডন, আপনারা মানুষের সামনে তাদের ব্র্যান্ডেড করে হত্যা করবেন?

খুব ভাল। অবশ্য ব্যাপারটা এমন, আপনারা মানুষের সামনে বলতে কী বোঝেন তার উপর নির্ভর করছে। আমার যদ্দূর মনে হয় আজকাল খুব বেশি লোক গির্জায় যায় না।

সাথে সাথে প্রশ্ন করে ল্যাঙডন, আপনারা তাদের চার্চে খুন করবেন?

দয়া করে। তাদের আত্মা যেন স্বর্গে খুব সহজেই তুলে নিতে পারেন ঈশ্বর। ব্যাপারটা এখানেই। অবশ্যই, সংবাদপত্রের লোকজনও থাকবে সেখানে।

ব্লাফ দিচ্ছেন আপনি, ওলিভেট্টি বলল, তার সেই চির শীতল কণ্ঠস্বরে। আপনারা কোন চার্চে একজন মানুষকে হত্যা করে পাততাড়ি গুটাতে পারবেন না মোটেও।

ব্লাফ দিচ্ছি? আপনার সুইস গার্ডের রন্ধ্রে রন্ধ্রে রক্ত প্রবাহের মত আমাদের চলাফেরা। আপনারা দয়া করে মন থেকে ঐ চারজন কার্ডিনালকে সরিয়ে দিলাম, আপনাদের পবিত্রতম জায়গার হৃদপিন্ডে সবচে ভয়ঙ্কর বোমা পেতে দিলাম আর আপনারা ব্যাপারটাকে ব্লাফ মনে করছেন? খুনটা হয়ে যাবার পর মিডিয়া যখন হামলে পড়বে তখন বুঝবেন ব্লাফ কাকে বলে। মাঝরাতের মধ্যে পুরো দুনিয়া জেনে যাবে ইলুমিনেটির কথা।

আর আমরা যদি প্রত্যেক চার্চে গার্ড বসাই? প্রশ্ন তুলল ওলিভেট্টি। হাসল কলার। আমি জানি আপনাদের মান্ধাতার আমলের ধর্ম-মন্দিরে এমন কিছু করার চেষ্টা আপনারা করবেন। আমি ভাল করেই ব্যাপারটা সম্পর্কে ওয়াকিফহাল। আপনি যখন কথাটা বলছেন তখন কি ভাল করে ভাবেননি? রোমে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে চারশ গির্জা। ক্যাথলিক গির্জার সাথে সাথে আরো আছে ক্যাথেড্রাল, চ্যাপেল, ট্যাবারনেল, এ্যাবে, মনাস্টারি, কনভেন্ট, প্যারোসিয়াল স্কুল…।

আরো শক্ত হয়ে গেল ওলিভেট্রির চোয়াল।

নব্বই মিনিটের মধ্যে খেলা শুরু হয়ে যাবে। একটু যেন ব্যস্ত কলার, এক ঘণ্টা অন্তর অন্তর। মরণের একটা গাণিতিক হার। এবার আমার যেতেই হচ্ছে।

দাঁড়ান! বলল ল্যাঙডন, আপনি তাদের গায়ে যে চিহ্ন একে দিতে চান সে সম্পর্কে কিছু বলুন।

যেন বেশ মজা পেয়েছে লোকটা, মনে হচ্ছে আগেভাগেই ব্যাপারটা সম্পর্কে। জেনে গেছেন আপনি! নাকি আপনি কোন স্কেপটিক? আর বেশি দেরি নেই, তাড়াতাড়িই দেখতে পাবেন সেগুলোকে। পুরনোদিনের কথাগুলো যে সত্যি তার প্রমাণ হিসেবেই দেখা যাবে সেগুলোকে।

মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে ল্যাঙডনের। সে ঠিক ঠিক জানে লোকটা কী বলতে চায়। লিওনার্দো ট্রোর বুকের সেই চিহ্নটার কথা তার মনে পড়ে যায়। ইলুমিনেটির গল্পগাঁথায় পাঁচটা চিহ্ন একে দেয়ার কথা ছিল। আর চারটা ব্র্যান্ড বাকি, ভাবল সে, এবং চারজন কার্ডিনাল স্রেফ গায়েব হয়ে গেছে।

আমার একটা প্রতিজ্ঞা ছিল, বলল ক্যামারলেনগো, প্রতিজ্ঞা ছিল ঈশ্বরের কাছে। আজ রাতেই আমি একজন নতুন পোপ আনব।

ক্যামারলেনগো, বলল কলার, দুনিয়ার নতুন একজন পোপের কোন প্রয়োজন নেই। আজ মাঝরাতের পর পৃথিবীর উপর ছড়ি ঘোরানোর মানুষগুলো থাকবে না। মিশে যাবে ইট পাথরের গুঁড়ার সাথে। ক্যাথলিক চার্চ শেষ। পৃথিবীতে আপনাদের রাজত্বের অবসান চলে এসেছে। খুব কাছে।

একটা নিরবতা ঝুলে আছে পুরো ঘর জুড়ে।

ক্যামারলেনগার চোখ একেবারে দ্বিধাবিভক্ত। আপনি ভ্রান্ত পথে আছেন। ভুল পথ দেখানো হয়েছে আপনাকে। একটা চার্চ শুধুই ইট পাথরের কোন গাঁথুনি নয়। আপনি দু হাজার বছরের বিশ্বাসকে এক লহমায় খুঁড়িয়ে দিতে পারেন না… কোন বিশ্বাসকেই নয়। কোন বিশ্বাসকে তার দুনিয়াবী সম্পদ ধ্বংস করে শেষ করে দেয়া যায়। ক্যাথলিক চার্চের ধারা চলতেই থাকবে। ভ্যাটিকান সিটি থাক আর নাই থাক।

কী মহৎ মিথ্যাচার! আমরা দুজনেই আসল সত্যিটা জানি। বলুন তো দেখি, ভ্যাটিকান দেয়ালঘেরা দুনিয়া কেন?

ঈশ্বরের মানুষেরা একটা ঝুঁকিপূর্ণ জগতে বসবাস করেন। চটপট বলল ক্যামারলেনগো।

আপনি কতটা তরুণ? ভ্যাটিকান সিটি একটা দেয়ালঘেরা বিশ্ব কারণ ক্যাথলিক গির্জার অর্ধেক সম্পদ এর ভিতরে। দুর্লভ পেইন্টিং, স্কাল্পচার, দামি গহনা, দুর্লভ বই… আর ভ্যাটিকান ব্যাঙ্কের ভিতরে দুনিয়ার তাবৎ গির্জার কাগজপত্র আর সোনার ঢিবি পড়ে আছে। সাড়ে আটচল্লিশ বিলিয়ন ডলার মূল্যের জিনিসপত্র ঐ একটা ব্যাঙ্কে সাজানো আছে। আপনারা একটা ডিম্বাকার ঘরে বসে আছেন, নিরাপদে, নিরুপদ্রব। আর কালকে এই সমস্ত সম্পদ স্রেফ ধ্বংসস্তুপ… বলা ভাল ছাইয়ে পরিণত হবে। এমনকি পোশাকী বাহিনী পাঠিয়েও কোন ফায়দা লুটে নেয়া যাবে না।

কথার সত্যতা সহজেই অনুমেয়। সাথে সাথে ছাইবর্ণ হয়ে গেছে ওলিভেট্টির মুখ আর ক্যামারলেনগোর চেহারা। কোনটা নিয়ে অবাক হতে হবে তা ভেবে পায় না ল্যাঙডন। ক্যাথলিক চার্চের অত সম্পদ আছে সেটা নিয়ে চিন্তায় পড়ে যাবে, নাকি কী করে ইলুমিনেটি এই গোপন খবর পেল সেটা ভেবে হয়রান হবে।

ক্যামারলেনগো আবার শক্ত করে ফেলতে পারল মুখাবয়ব, বিশ্বাস এই গির্জার ভিত্তি। অর্থ নয়।

আবার মিথ্যা কথা! বলল কলার, যেন বেশ মজা পেয়েছে, গত বছর আপনারা একশো তিরাশি মিলিয়ন ডলার ব্যায় করেছেন আপনাদের মেরুদন্ড আরো পোক্ত করার কাজে। সারা দুনিয়া জুড়ে। চার্চে হাজির হওয়ার হার গত বছর ইতিহাসে সবচে নিচে নেমে এসেছে। ছিচল্লিশ ভাগ। দানের হারও সাত বছরে সবচে নিচে নেমে এসেছে। সেমিনারিতে মানুষের আসার হার কমছে তো কমছেই। আপনারা বলেন আর নাই বলেন, চার্চের মরণ ঘনিয়ে এসেছে এম্নিতেই, তার উপর আমরা একটু প্রভাবক যোগ করে দিলাম। আরেকটু দ্রুত হোক হাটা। এই আরকী!

এক পা এগিয়ে গেল ওলিভেট্টি, এখন আর তাকে আগের মত যুদ্ধংদেহী মনে হচ্ছে না। বরং যেন একটু বিদ্ধস্ত। যেন একটু নুয়ে পড়া। সত্যকে যেন সে মেনে নিচ্ছে। তার দৃষ্টি একজন কোণঠাসা মানুষের মত যে পালাবার পথ খুঁজে পাচ্ছে না। আর যদি এমন হয় যে আপনাদের ফান্ডে সেই ক বিলিয়নের কিয়দংশ আপনাদের গাঁটে জায়গা করে নেয়?

আমাদের দু পক্ষকেই অপমান করার কোন মানে হয় না।

আমাদের অনেক অনেক টাকা আছে।

ঠিক আমাদের মতই। আপনারা তার কোন তল খুঁজে পাবেন না।

ইলুমিনেটির অর্থ সম্পদের কথা একবার মনে করার চেষ্টা করল ল্যাঙডন। সেই আদ্যিকাল থেকে তারা সামরিক দিক দিয়ে শক্তিমান হবার বদলে সমস্ত মনোযোগ দিয়েছে অর্থনীতি আর রাজনীতির দিকে। সেই কবেকার মেসনদের সম্পদও তাদের করতলে। প্রথমদিকের ব্যাভারিয়ান মেসনদের সম্পদ, রথসচাইল্ডের টাকার কাড়ি, বিল্ডার বার্গার আর ইলুমিনেটির সেই হীরা।

আই প্রেফেরিতি! প্রসঙ্গ বদল করল ক্যামারলেনগো, অনুনয় ঝরে পড়ল তার ঠান্ডা কণ্ঠে ছেড়ে দিন তাদের। তারা বয়স্ক। তারা

তারা চিরকুমার… হাসল কলার, গা জ্বালানো হাসি, আপনি কি সত্যি সত্যি মনে করেন তাদের কৌমার্য অক্ষত আছে? তাদের মরণের সময় সত্যি কি তাদের জন্য কেঁপে উঠবে ঈশ্বরের সিংহাসন? স্যাক্রিফিসি ভার্জিনি নেল অল্টেয়ার ডি সিয়েঞ্জা।

অনেক অনেক সময় ধরে চুপ করে থাকল ক্যামারলেনগো, তারপর বলল, তারা বিশ্বাসের মানুষ। আর অবশেষে সাহস ভর করল তার কণ্ঠে, তারা মরণকে ভয় পান না।

হাসল কলার। লিওনার্দো ভেট্রাও বিশ্বাসের মানুষ ছিল। গতরাতে তাকে যখন আমি হত্যা করি তখন তার চেহারায় রাজ্যের ভয় ভর করেছিল। এমন একটা ভয় যেটাকে তাড়িয়ে দিয়েছিলাম আমি।

এতোক্ষণ চুপ করে ছিল যে, সেই ভিট্টোরিয়া এবার সাথে সাথে জুলে উঠল তেলে বেগুনে। এ্যাসিনো! সে ছিল আমার বাবা।

একটা মৃদু হাসি শোনা গেল ফোনের অপর প্রান্ত থেকে, আপনার বাবা? কী শুনছি আমি! ট্রোর একটা মেয়েও আছে নাকি? আপনার জানা উচিৎ, শেষ বেলায় আপনার বাবা হাল ছেড়ে দিয়ে ফুপিয়ে কেঁদেছিল। বাচ্চা ছেলের মত। আফসোস। কিন্তু যে

সত্যি তাই বলছি আমি।

কথাগুলো যেন কোণঠাসা করে ফেলল ভিট্টোরিয়াকে! একেবারে পড়ে যেতে নিয়েও দাঁড়িয়ে রইল সে কোনমতে। সাহায্য করার জন্য ল্যাঙডন এগিয়ে যেতেই আবার সামলে নিল। তার গহীন চোখদুটা স্থির হল ফোনের দিকে, আমি আমার প্রাণ হাতে নিয়ে প্রতিজ্ঞা করছি, আজ রাতটা কেটে যাবার আগেই আমি তোমার টুটি চেপে ধরব। তার কণ্ঠ আরো আরো চিকণ হয়ে যাচ্ছে, আর একবার তোমাকে পেলে…

আবার হাসল লোকটা, তেজ আছে মেয়েটার। আমি স্তম্ভিত! হয়ত আজ রাত পেরিয়ে যাবার আগেই আমি তোমাকে খুঁজে পাব, আর একবার তোমাকে পেলে…

কথাটুকু ভেসে থাকল বাতাসে কিছুক্ষণ। তারপর সে চলে গেল।

 

৪২.

কার্ডিনাল মর্টাটি কালো রোব গায়ে দেয়া অবস্থায় ঘেমে একসা হচ্ছেন। সিস্টিন চ্যাপেলের কী অবস্থা তা ঈশ্বরই ভাল জানেন। এটা যেন কোন শোনা বাথের ঘর। আর বিশ মিনিটের মধ্যে কনক্লেভ শুরু হয়ে যাবে। এখনো কোন পাত্তা নেই সেই চার কার্ডিনালের। তাদের অনুপস্থিতিতে অন্য কার্ডিনালদের কথোপকথন এখন অস্থিরতার রসে জারিত হচ্ছে।

ভেবে পান না কোন চুলায় যেতে পারেন ঐ চার কার্ডিনাল। ক্যামারলেনগার সাথে নেই তো? ভাবেন তিনি। তার ভালই জানা আছে, ক্যামারলেনগো আজ বিকালে বেছে নেয়া চারজনের সাথে চা-চক্রে বসেছিলেন। কিন্তু সেটী কয়েক ঘণ্টা আগের কথা। তারা কি অসুস্থ হয়ে পড়েছেন? খাবারের সাথে বেখাপ্পা কিছু গিলিয়ে দেয়া হয়নি তো? এ নিয়েও সংশয় কম নেই। মৃত্যুশয্যায় থাকলেও তারা এখানে হাজির হতেন সময় মত। একটা জীবনে এমন সুযোগ আর আসে না। সুপ্রিম পন্টিফ হিসেবে নির্বাচিত হতে হলে অবশ্যই সেই কার্ডিনালকে এই সিস্টিন চ্যাপেলের ভিতরে থাকতে হবে নির্বাচনের সময়। এ নিয়মের কোন ব্যয় নেই।

চারজন প্রেফারিতি থাকলেও কার্ডিনালদের মধ্যে দ্বিধা আছে, কে হতে পারেন সেই সোনার মুকুটধারী। গত পনেরটা দিন একের পর এক ফোন আর ফ্যাক্স এসেছে, কে হতে পারেন পরবর্তী পোপ। কথামত চারজনকে প্রেফারিতি হিসেবে ধরা হয়। পোপ হবার সমস্ত গুণাবলী তাদের মধ্যে বিদ্যমান।

ইতালিয়, স্প্যানিয়, ইংরেজিতে দক্ষতা,
ক্লজিটের ভিতরে কোন কঙ্কাল থাকতে পারবে না, বয়স হতে হবে পঁয়ষট্টি থেকে আশির মধ্যে।

প্রথমত, একজন প্রেফারিতিকে আর সবার সামনে কলেজ অব কার্ডিনালরা প্রস্ত বিনা করবেন। আজরাতের সেই মানুষের নাম কার্ডিনাল অলডো ব্যাজ্জিয়া, এসেছেন মিলান থেকে। ব্যাজ্জিয়ার কাজের অতুলনীয় রেকর্ড, অসাধারণ ভাষাজ্ঞান আর আত্মিক যোগাযোগে দক্ষতার কারণে তাকেই সবাই সবচে সম্ভাবনাময় বলে ধরে নিয়েছেন।

আর এখন সেই দানব কোথায়? প্রশ্ন ছোঁড়েন মর্টাটি।

এই কনক্লেভ পরিচালনা বা তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব তার ঘাড়ে পড়েছে দেখে মর্টাটি  যুর পর নাই উদ্বিগ্ন হন। এক সপ্তাহ আগে থেকেই কলেজ অব কার্ডিনালস মর্টাটিকে দ্য গ্রেট ইলেক্টর হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিল-কনক্লেভের অভ্যন্তরীণ নেতা। ক্যামারলেনগো আসলে প্রথা অনুযায়ী প্রশাসনের প্রধান হলেও সে সামান্য একজন প্রিস্ট। আর নির্বাচনের জটিলতা বা পদ্ধতি কোনটা সম্পর্কেই তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। তাই সিস্টিন চ্যাপেলের ভিতরে এই পুরো প্রক্রিয়া তদারকির জন্য কার্ডিনালদের মধ্যে একজনকে বেছে নেয়া হয়।

কার্ডিনালরা প্রায়ই বলাবলি করেন যে গ্রেট ইলেক্টর নির্বাচিত হওয়া এক প্রকারের নিষ্ঠুর তামাশার নামান্তর। নির্বাচন যেন সুষ্ঠুভাবে হয় তা দেখার দায়িত্ব তার, আবার তিনি সাধারণত বয়োজ্যেষ্ঠ হন, তার ভিতরে পোপ হবার গুণাবলী থাকে, তবু তিনি অন্য কাউকে নির্বাচিত করার পথে সহায়তা করতে পারেন, ব্যস, এটুকুই। তার নিজের পক্ষে নির্বাচিত হবার কোন সুযোগ থাকে না।

কিন্তু এ নিয়ে মাটির মনে কোন আফসোস নেই। বরং দায়িত্ব পেয়ে তিনি খুশীই। তিনি যে সিস্টিন চ্যাপেলের ভিতরের কার্ডিনালদের মধ্যে সবচে বয়সী তাই শুধু নয়, তিনি ছিলেন বিগত পোপের খুব কাছের মানুষ। যদিও তিনি প্রার্থি হবার যোগ্যতা রাখেন, উনআশি বছর বয়স্ক হিসাবে, তবু পোপ হিসেবে নির্বাচিত করায় কিছু সমস্যা আছে। এখন আর তিনি তেমন শক্তপোক্ত নন। কার্ডিনালদের কলেজ তাঁকে আর এই জীবনের এত লম্বা সময় পেরিয়ে এসে ক্লান্ত-পরিশ্রান্ত অবস্থায় পোপত্বের মত বড় একটা খাটুনির কাজে নিয়োগ দিতে ঠিক রাজি নয়। একজন পোপ গড়ে দিনে চৌদ্দ ঘণ্টা, সপ্তাহে সাতদিন এবং জীবনে ছয় দশমিক তিন বছর কাটান প্রচন্ড ব্যস্ততায়। তারপর ত্যাগ করেন শেষ নিঃশ্বাস। নিষ্ঠুর রসিকতাটা হল, পোপত্ব মেনে নেয়া আর স্বর্গের দিকে দ্রুত ধাবিত হওয়া একই মুদ্রার আরেক পিঠ।

অনেকেই মনে করেন, মর্টটি তার আরো তরুণ বয়সে পোপত্ব পেতে পারতেন যখন তিনি ছিলেন শক্ত-সমর্থ এবং একই সাথে একটু কট্টর। যখন এ পোপত্ব আসে তখন তিনটা পবিত্র বৈশিষ্ট থাকতে হয়

রক্ষণশীলতা, রক্ষণশীলতা, রক্ষণশীলতা।

একটা ব্যাপার মৰ্টিটি বেশ খেয়াল করেছেন, বিগত পোপ, ঈশ্বর তাঁর আত্মাকে শান্তিতে রাখুন, ছিলেন অনেক বেশি উদারপন্থী, অবশ্যই পোপতৃ পাবার পরে। তিনি বুঝতে পারছিলেন, পৃথিবীর গতি এখন অনেক বেশি। মানুষ গির্জার গন্ডি অনেক আগেই পিছনে ফেলে এসেছে, এই হার আরো আরো বাড়ছে, গাণিতিক হারে। তাই তিনি চার্চকে অনেক বেশি উদারপন্থি হিসেবে জাহির করলেন। এমনকি কিছু নির্বাচিত গবেষণার জন্য অর্থও বরাদ্দ করলেন। কিন্তু আসলে এটা রাজনৈতিক আত্মহত্যার শামিল। রক্ষণশীল ক্যাথলিকরা তার উপর ভ্রান্তির কলঙ্ক চাপিয়ে দিল তাৎক্ষণাৎ। তারা শতমুখে বলতে লাগল, পোপ চার্চকে এমন সব ক্ষেত্রে নিয়ে যাচ্ছেন যেখানে এর আওতা নেই।

তো, তারা কোথায়?

ঘুরে গেলেন মাটি।

একজন কার্ডিনাল অনেকটা অনিশ্চয়তা নিয়ে তার কাঁধে টোকা দিচ্ছিলেন। আপনি জানেন তারা কোথায়, তাই না?

মর্টাটি খুব একটা উদ্বিগ্নতা না দেখিয়েই বললেন, সম্ভবত ক্যামারলেনগোর সাথে।

এই সময়ে? এটা একেবারে নিয়ম বহির্ভুত। ক্যামারলেনগো সময়ের কথা ভুলে যাননি তো?

এ কথায় মাটি ঠিক রাজি হতে পারলেন না। কিন্তু চুপ করে থাকাকেই শ্রেয় মনে করলেন। একটা কথা বেশিরভাগ কার্ডিনাল মনে করেন, ক্যামারলেনগোর কোন মূল্য। নেই। এই লোক পোপকে কাছ থেকে দেখাশোনা করার হিসেবে একেবারে বাচ্চা। মর্টাটি জানেন, এদের বেশিরভাগের এই মনোভাবের পিছনে কাজ করে হিংসা। কিন্তু মনে মনে তারিফ করেন মাটি এই কমবয়েসি ক্যামারলেনগোর। পোপ ভুল করেননি এমন একজন চেম্বারলিনকে নিয়োগ দিয়ে। আর একটা ব্যাপার বলার মত, ক্যামারলেনগোর চোখ-মুখে একটা অন্যরকম দীপ্তি আছে। আর অনেক কার্ডিনাল যেটা পারেননি সেটা করে দেখিয়েছেন এই ক্যামারলেনগো। রাজনীতি আর স্বার্থ থেকে চার্চকে সুন্দরভাবেই দূরে রাখতে সমর্থ হয়েছেন। ব্যাপারটা দুর্লভ। আসলেই, এ লোক ঈশ্বরের মানুষ।

তবু এই ক্যামারলেনগোর থলেতে যে কিছুই নেই সেটা বলা যাবে না। বরং অনেক বেশি অতিপ্রাকৃতিক ব্যাপার আছে তাকে ঘিরে, তার ছেলেবেলায়… এমন একটা ব্যাপার ঘটেছিল যার কোন তুলনা নেই। সব মানুষের মনেই একটা স্থির বিশ্বাসের জন্ম। দেয় ব্যাপারগুলো। মনে মনে একটু আফসোসও করেন মর্টাটি। তার কৈশোরে এমন। মিরাকল ঘটলেও ঘটতে পারত।

চার্চের দুর্ভাগ্য, ভাবলেন তিনি, পরিণত বয়সেও কখনোই ক্যামারলেনগো পোপ হতে পারবে না। পোপ হবার জন্য প্রচন্ড রাজনৈতিক জেদ থাকা দরকার যা এই অপেক্ষাকৃত তরুণ লোকটার ভিতরে নেই। বারবার সে পোপের প্রস্তাব ফিরিয়ে দিয়েছে, সে খুব বেশি কিছু হতে চায় না। আর দশজনের মত থেকে চার্চের সেবা করাই তার ইচ্ছা।

এরপর কী হবে? আবার কার্ডিনাল তার কাঁধে টোকা দিলেন।

চোখ তুলে তাকালেন মাটি, আই এ্যাম স্যরি?

দেরি হয়ে যাচ্ছে তাদের। কী করব আমরা?।

আমরা আর কী করতে পারি? সতেজে জবাব ঝাড়লেন মাটি, আমরা অপেক্ষা করব। বিশ্বাস রাখব অটুট।

পুরোপুরি অসন্তুষ্ট হয়ে ফিরে গেলেন কার্ডিনাল ছায়ায়।

একটা দীর্ঘ মুহূর্ত জুড়ে দাঁড়িয়ে থাকলেন মর্টাটি। আসলেই, কী করব আমরা? তিনি ফাঁকা চোখে তাকালেন মাইকেলেঞ্জেলোর করা সেই ভুবনখ্যাত দেয়ালচিত্রের দিকে। দ্য লাস্ট জাজমেন্ট। তার ব্যকুলতা একটু কমাতে পারল না ছবিটা। এটা পঞ্চাশ ফুট লম্বা বিশাল এক ছবি। সেখানে যিশুখ্রিস্ট মানুষের বিশাল এক দলকে দেখাচ্ছেন পথ। পাপীরা চলে যাচ্ছে নরকের দিকে, নিক্ষিপ্ত হচ্ছে। আর পথপ্রাপ্তরা। অপেক্ষা করছে। মাইকেলেঞ্জেলোর শত্রুদের একজন বসে আছে নরকে, তার পরনে গাধার কান। জা দি মপসাঁ একবার বলেছিলেন যে ছবিটা দেখে মনে হয় কোন নিচু স্তরের কয়লা-আকিয়ে কোন রেসলিং বুথের জন্য ছবি একে রেখেছে।

একমত হলেন কার্ডিনাল মাটি।

৪৩.

ল্যাঙডন তাকিয়ে আছে নিচের মিডিয়ার লোকজনের দিকে, তাদের ট্রাকগুলোর দিকে, পোপের বুলেটপ্রুফ অফিসে দাঁড়িয়ে থেকে। বিচ্ছিরি ফোনকলের কথাগুলো তার মনে বারবার আঘাত করছে… কেন যেন তেতে উঠছে মন। তার নিজের প্রতি নয়, অবশ্যই।

ইলুমিনেটি, পুরনো দিনের একটা বিশাল সাপের মত বেরিয়ে এসেছে গর্ত থেকে, আর এসেই সোজা জড়িয়ে ধরেছে তাদের অষ্টেপৃষ্ঠে। কোন দাবি নেই। নেই কোন হাত মেলানো। শুধুই শোধ। শয়তানির মতই সরল। শুষে ফেলা। এমন এক প্রতিশোধ, যার জন্য চারশো বছর অপেক্ষা করতে হল। শতবর্ষের খোলস ছেড়ে বিজ্ঞান এবার তেড়েফুড়ে আসছে প্রচন্ড প্রলয় হাতে নিয়ে।

ক্যামারলেনগো সোজা বসে আছে তার আসনে। ফাঁকা দৃষ্টি ফেলছে ফোনের উপর। ওলিভেটিই প্রথমে নিরবতা ভাঙল, কালো, বলল সে, ক্যামারলেনগোর প্রথম নাম ধরে, তার কণ্ঠে অফিসারসুলভ কোন ভঙ্গিমা নেই, তার বদলে ভয়ে জবুথবু এক বন্ধুর চিহ্ন পাওয়া যায়। ছাব্বিশ বছর ধরে আমি এই অফিসের নিরাপত্তার জন্য প্রাণপাত করেছি। আজ রাতে আমার মনে হচ্ছে আমার যথাযথ সম্মানটুকু পাচ্ছি না।

ক্যামারলেনগো সাথে সাথে বলল, আমি আর আপনি দুজনেই দু পথে ঈশ্বরের সেবা করে গেছি। আর সেবা সব সময় সম্মান বয়ে আনে।

এই ব্যাপারগুলো… আমি কল্পনাও করতে পারি না কী করে… এই পরিস্থিতি… ওলিভেট্টি যেন একেবারে মিইয়ে গেছে।

আপনি জানেন, আমাদের সামনে একটা মাত্র পথ খোলা আছে। কলেজ অব কার্ডিনালের নিরাপত্তার জন্য আমার ঘাড়েও একটা দায়িত্ব বর্তায়।

আমার ভয় হচ্ছে, দায়িত্বটা আসলে পুরোদস্তুর আমার, সিনর।

তার মানে আপনার লোকজন খুব দ্রুত এ জায়গা খালি করার কাজে নেমে পড়বে।

সিনর?

পরের কাজটার জন্য পরে উঠেপড়ে লেগে গেলেও চলবে। ডিভাইসটার খোঁজ পরে করলেও আমাদের চলবে। খোঁজ করতে হবে হারানো কার্ডিনালদেরও। কিন্তু সবার আগে এখানে হাজির কার্ডিনালদের নিরাপত্তার দিকটা দেখতে হবে আমাদের। মানুষের মূল্য আর সবকিছুর উপরে। ঐ লোকগুলো এ গির্জার ভিত।

আপনি বলছেন এখন আমরা কনক্লেভ বাদ দিয়ে দিব?

আর কোন উপায় কি আছে আমার?

নতুন পোপ নির্বাচনের জন্য আপনার উপর যে দায়িত্ব ছিল তার কী হবে?

একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তরুণ চ্যাম্বারলিন ফিরে দাঁড়াল জানালার দিকে। নিচে, রোমের দিকে তার দৃষ্টি ঘুরছে ফিরছে। হিজ হলিনেস একবার আমাকে বলেছিলেন যে পোপ হলেন এমন এক মানব যিনি দুটা জগতের মাঝখানে পড়ে যান… বাস্তব ভুবন আর ঐশ্বরিক দুনিয়া। তিনি সব সময় আমাকে মনে করিয়ে দিতেন যে, কোন চার্চ যখনি বাস্তবতাকে মেনে না নিয়ে কাজ করবে সে-ই বঞ্চিত হবে ঐশ্বরিক জগতে। হঠাৎ তার কণ্ঠে ঝরে পড়ল বাস্তবতা, আমাদের উপর আজ রাতে বাস্তব দুনিয়া ভেঙে পড়ছে। আমরা সেটাকে অবহেলা করার কোন উপায় দেখতে পাচ্ছি না। ঐতিহ্য আর গর্ব কখনোই কারণকে অবজ্ঞা করতে পারে না।

নড করল ওলিভেট্টি, তার চোখেমুখে সত্যিকার বন্ধুত্ব, আমি আপনাকে ছোট করে দেখেছি, সিনর।

কথাটা যেন শুনতে পায়নি ক্যামারলেনগো, তার চোখ ঘুরে ফিরছে রোমের উপরে।

খোলাখুলিই বলব আমি, সিনর। বাস্তব দুনিয়া হল আমার দুনিয়া। আমি প্রতিদিন এত বেশি বার এ নোংরা দুনিয়ার মুখোমুখি হই, এত বেশিবার পৃথিবীর খারাপ দিকগুলোর মোকাবিলা করি, একটা মাত্র কারণে, অন্যরা যেন একটা পরিষ্কার জগৎ উপহার পায়। আমাকে আজ বলতে দিন। এ পরিস্থিতির জন্যই আমাকে বারবার প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে… আপনার সিদ্ধান্ত ভয়ংকর হতে পারে।

ঘুরে দাঁড়াল ক্যামারলেনগো।

একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল ওলিভেট্টো। এখন আপনার পক্ষে সবচে বেশি জটিল হবে

যে কাজটা, তা হল, কলেজ অব কার্ডিনালসকে সিস্টিন চ্যাপেল থেকে বের করে আনা।

ক্যামারলেনগো যেন খুব একটা দ্বিমত পোষণ করছে না। আপনি কী বলেন?

কার্ডিনালদের কিছু না বলা। তাদের কনক্লেভ সিল করে দেয়া। সেই সাথে সময় বুঝে একটা সিদ্ধান্ত নেয়া। আমাদের হাতে যেটা সবচে বেশি প্রয়োজন, তা হল, সময়।

দ্বিধায় পড়ে গেছে যেন ক্যামারলেনগো, আপনি কি বলতে চান যে টাইম বোমার উপরে রেখে কলেজ অব কার্ডিনালসকে কনক্লেভে বন্দি করে ফেলব?

জ্বি, সিনর। এখনকার জন্য। পরে, যদি প্রয়োজন পড়েই যায়, আমরা দ্রুত তাদের সরিয়ে নিতে পারব।

মাথা নাড়ল ক্যামারলেনগো, দরজা বন্ধ হয়ে যাবার আগে যা করার করতে হবে। একবার কনক্লেভ বন্ধ হয়ে গেলে সেটাকে আর কোনমতেই সরানো যাবে না। নিয়ম অনুযায়ী…

বাস্তব ভুবন, সিনর। আজ রাতে আপনি এখানেই আছেন। মন দিয়ে শুনুন। এবার ওলিভেট্টির জবানি শুনতে কোন ফিল্ড অফিসারের সুরের মতই শোনাচ্ছে, একশো পয়ষট্টিজন কার্ডিনালকে রোমে তুলে আনা একই সাথে অনিরাপদ এবং ঝামেলার কাজ। তাদের সর্বাই বয়স্ক। সবাই শারীরিকভাবে একটু হলেও অক্ষম। তাদের এই বয়সে এতখানি সরিয়ে আনা একেবারে অবিবেচকের মত কাজ হবে। এ মাসে একটা চরম স্ট্রোকই যথেষ্ট।

একটা চরম স্ট্রোক। কথাটা মনে করিয়ে দিল ল্যাঙডনের অতীত স্মৃতি। সে হার্ভার্ডে থাকার সময় পত্রিকায় দেখেছিলঃ পোপ স্ট্রোকে ভুগেছেন। ঘুমন্ত অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।

এ ছাড়াও, বলছে ওলিভেট্টি, সিস্টিন চ্যাপেল আসলে একটা দুর্গ। আমরা কথাটা বলে বেড়াই না। কিন্তু এর ভিত যে কোন ধাক্কা সয়ে যাবার মত করে তৈরি করা। আমরা আজ বিকালে পুরো চ্যাপেল খুঁটিয়ে দেখেছি। কোন ছারপোকা বা অন্য কোন ধরনের আড়ি পাতার যন্ত্রের খোঁজেই আমাদের এ কাজ করতে হয়। চ্যাপেল একেবারে পরিচ্ছন্ন। আর আমি নিশ্চিত এন্টিম্যাটারটা আর যেখানেই থাক না কেন, চ্যাপেলের ভিতরে নেই। এখন এমন কোন নিরাপদ জায়গা নেই যেখানে এ মানুষদের থাকতে দেয়া যায়। আমরা পরে অবশ্যই জরুরি নির্গমন করাতে পারব। তাই ব্যাপারটা বাদ দিয়ে দেয়া হচ্ছে না।

আবার চমৎকৃত হল ল্যাঙডন। ওলিভেট্টির এই শীতল যুক্তি আর ধারালো কথা মনে করিয়ে দিল কোহলারের নাম।

কমান্ডার, বলল ভিট্টোরিয়া, তার কণ্ঠ ভয় পাওয়া, আরো চিন্তার বিষয় আছে। এত বেশি পরিমাণে এন্টিম্যাটার আর কেউ বানায়নি। বিস্ফোরণের এলাকা, আমি শুধু হিসাব করতে পারি। আশপাশের রোমের কিছু অংশও ঝুঁকির মধ্যে আছে। ক্যানিস্টারটা যদি আপনাদের ভিতরের মাঝামাঝিতে থাকা কোন ভবনে লুকানো থাকে, যদি আন্ডারগ্রাউন্ডেও থাকে, তবু তার প্রভাব এই দেয়ালের বাইরে খুব একটা ক্ষতিকর নাও হতে পারে… এ বিল্ডিংয়ে, উদাহরনের জন্য বলছি… সে একটা দৃষ্টি বুলিয়ে নেয় সেন্ট পিটার্স স্কোয়ারের দিকে।

বাইরের দুনিয়ার দিকে আমার কী কাজ আছে সে ব্যাপারে আমি ভাল করেই জানি। বলল ওলিভেট্টি, আর তাতে এই পরিস্থিতির কোন উন্নতি হবে না, আর যাই হোক না কেন। দু দশকেরও বেশি সময় ধরে আমার আত্মার ধ্যান-ধারণা এই ভবনগুলোর নিরাপত্তার সাথে জড়িত। আমার কোন ইচ্ছা নেই, এমন কোন ইচ্ছা। নেই… জিনিসটা বিস্ফোরিত হোক এমনটা আমি কখনোই চাইনি।

ক্যামারলেনগো এবার আশা নিয়ে একটা দৃষ্টি দিল, আপনি মনে করেন এটাকে খুঁজে বের করতে পারবেন?

সার্ভেল্যান্স স্পেশালিস্টদের ব্যাপারে কিছু কথা বলতে দিন আমাকে। আমরা যদি ভ্যাটিকানের সমস্ত আলো নিভিয়ে দিই। যদি এখান থেকে বিদ্যুতের সমস্ত কর্মকান্ড বন্ধ করে দিই তাহলে সহজেই বৈদ্যুতিক ক্ষেত্রের পরীক্ষা করে বের করে ফেলতে পারব এন্টিম্যাটারটুকু।

যেন অবাক হল ভিট্টোরিয়া, আপনি ভ্যাটিকান সিটিকে ব্লাক আউট করে ফেলতে চান?

সম্ভবত। আমি বলব না যে ব্যাপারটা খুব একটা সহজ হবে। কিন্তু একটা চেষ্টা চালিয়ে দেখা যায়।

কার্ডিনালরা তখন বোঝার চেষ্টা করবেন কী ঘটছে এখানে। বলল ভিট্টোরিয়া।

ওলিভেট্টি সাথে সাথে জবাব দিল, কনক্লেভ অনুষ্ঠিত হয় মোমবাতির আলোয়। কার্ডিনালরা জানতেই পারবেন না। একবার কনক্লেভ সিল হয়ে গেলেই আমার সব প্রহরী নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়তে পারব, মাত্র কয়েকজনকে পাহারায় রাখলেই চলবে। একশো মানুষ খুব তাড়াতাড়ি বিশাল এলাকা চষে ফেলতে পারবে। পাঁচ ঘণ্টা অনেক সময়।

চার ঘণ্টা। বলল ভিট্টোরিয়া, ক্যানিস্টারটাকে আমার উড়িয়ে নিতে হবে সার্নে। ব্যাটারি রিচার্জ না করলে বিস্ফোরণ অবশ্যম্ভাবী।

এখানে রিচার্জ করার কোন উপায় নেই?

মাথা ঝাঁকাল ভিট্টোরিয়া, ইন্টারফেসটা খুব জটিল। আমি পারলে সেটা তুলে আনতাম।

তাহলে চার ঘণ্টাই সই। বলল ওলিভেট্টি, এখনো সময় আছে হাতে। আতঙ্ক আর যাই হোক, কোন কাজে আসবে না। সিনর, আপনার হাতে দশ মিনিট সময় আছে। সোজা চলে যান কনক্লেভের দিকে, সিল করে দিন। আমার লোকজনকে কাজ করার জন্য কিছুটা সময় দিন। আমরা যত ঝুঁকিপূর্ণ সময়ের কাছে যাব তত ঝুঁকিহীন সিদ্ধান্ত নিব।

ল্যাঙডন ভেবে পেল না আর কত ঝুঁকিপূর্ণ সময়ের দিকে এগুতে চাচ্ছে লোকটা।

ফাঁকা দৃষ্টি ক্যামারলেনগোর চোখে, কিন্তু কলেজ সাথে সাথে প্রেফারিতিদের ব্যাপারে প্রশ্ন করবে… বিশেষত ব্যাজ্জিয়ার ব্যাপারে… তারা কোথায়।

তাহলে সাথে সাথে আপনার অন্য কোন ব্যাপার নিয়ে ভাবতে হবে, সিনর। বলুন, তাদেরকে চায়ের সাথে এমন কিছু খাইয়েছেন যার কারণে এখন তারা আসতে সমর্থ নন।

ক্ষেপে উঠল ক্যামারলেনগো, সিস্টিন চ্যাপেলের দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে কলেজ অব কার্ডিনালসের সামনে কনক্লেভের আগের মুহূর্তে মিথ্যা কথা বলব?।

তাদের নিজেদের নিরাপত্তার জন্যই। উনা ব্যাগিয়া ভেনিয়ালে। একটা শুভ্র মিথ্যা কথা। আপনার কাজ শান্তি বজায় রাখা। দরজার দিকে তাকাল ওলিভেটি, এখন আপনি যদি আমাকে ক্ষমা করেন তো কাজ শুরু করতে পারি।

কমান্ডান্টে, বলল ক্যামারলেনগো, যুক্তি দেখিয়ে, হারিয়ে যাওয়া কার্ডিনালদের ব্যাপারে আমরা পিছন ফিরে থাকতে পারি না।

ওলিভেট্টি সাথে সাথে দরজা থেকে ফিরে তাকাল, ব্যাজ্জিয়া এবং অন্যেরা এখন আমাদের ক্ষমতার বাইরে। আওতায় নেই তারা। এখন অবশ্যই তাদের যেতে দিতে, হবে… সবার কল্যাণের জন্য। সামরিক দৃষ্টিতে এটাকে ট্রায়াজ বলা হয়।

আপনি কি ছেড়ে আসা বোঝাতে চাচ্ছেন না?

তার কণ্ঠ এবার শক্ত হয়ে উঠল, যদি কোন উপায় থাকত, সিনর… স্বর্গে যদি ঐ কার্ডিনালদের চিহ্নিত করার কোন উপায় থাকত, আমি আমার জীবন নষ্ট করে দিতাম তাদের খুঁজে বের করার কাজে। আর এখনো… সে হাত তুলল ডুবে যেতে বসা সূর্যের দিকে, তার রক্তিম আভায় রোমের বিশাল ছাদ-সমুদ্র ঝকঝক করছে, পঞ্চাশ লাখ লোকের সিটিতে সার্চ চালানো আমার আওতার বাইরে। একটা নিস্ফল কাজের জন্য এ মুহূর্তে এক পল সময়ও আমি ব্যয় করতে রাজি নই। আমি দুঃখিত।

কিন্তু হাল ছাড়ার মানুষ নয় ভিট্টোরিয়া, কিন্তু আমরা যদি খুনীকে ধরে ফেলি? আপনি কি তাকে কথা বলাতে পারবেন না?

সাথে সাথে অগ্নিদৃষ্টি হানল ওলিভেট্টি তার দিকে, সৈন্যরা কখনোই সাধু সাজার চেষ্টা করে না, মিস ভেট্রা। বিশ্বাস করুন, আমি আপনার ব্যক্তিগত দুঃখটার ব্যাপারে একমত। এ লোককে ধরার ব্যাপারে আমার মনে কম ক্ষোভ নেই।

শুধু ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে কথা বলছি না আমি, সাথে সাথে ইটের বদলে পাটকেল ছুঁড়ে দেয় ভিট্টোরিয়া, খুনী জানে এন্টিম্যাটারটা কোথায় আছে… জানে কোথায় আছেন হারানো কার্ডিনালরা… যদি কোনক্রমে তাকে একবার বগলদাবা করা যায়…

বিশ্বাস করুন আমার কথা, যে কথা আপনি বলছেন তেমন কিছু করা আদৌ আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়। আমাদের সীমিত জনবল নিয়ে রোমের শত শত গির্জা চষে ফেলতে অনেক সময় লাগবে এবং সেজন্য পুরো ভ্যাটিকান সিটিকে খালি করে ফেলতে হবে… কোন প্রহরী থাকবে না… তার পরও, সেই ইলুমিনেটি লোকটাকে কুপোকাৎ করা কোন সহজ কম্ম হবে না। বাকী যে কার্ডিনালরা আছেন তাদের নিরাপত্তার ব্যাপারে মুখে কুলুপ এটে রাখাই শ্রেয়।

ব্যাপারটা সবাইকে নতুন করে ভাবাল।

রোমান পুলিশের সাহায্য নেয়ার ব্যাপারে কী বলেন আপনি? ক্যামারলেনগো সাথে সাথে বলল। আমরা তাদের সহায়তায় পুরো মহানগরী চষে ফেলতে পারি। অপহরণ করা কার্ডিনালদের খুঁজে বের করার জন্য এরচে ভাল আর কোন উপায় নেই।

আরেকটা ভুল। বলল ওলিভেট্টি, আপনি ভাল করেই জানেন রোমান। কারাবিনিয়েরি আমাদের সম্পর্কে কী মনোভাব পোষণ করে। আমরা সারা দুনিয়ার সামনে আমাদের ক্রাইসিসটার কথা প্রচার করার বদলে সামান্য একটু লোক দেখানো সহায়তা পাব। ব্যস। এই ব্যাপারটাই চাচ্ছে আমাদের শক্ররা। দ্রুত মুখোমুখি হতে হবে মিডিয়ার। তাতেই তাদের উদ্দেশ্য সফল হবে।

আমি আপনাদের কার্ডিনালদের মিডিয়ার সামনে তুলে ধরব, খুনীর কথাটা মনে পড়ে যায় ল্যাঙডনের, রাত আটটায় প্রথম কার্ডিনালের মরদেহ পড়ে থাকবে। তারপর প্রতি ঘণ্টায় একটা করে। প্রেস ব্যাপারটাকে ভালবাসবে।

আবার কথা বলছে ক্যামারলেনগো, তার কণ্ঠে রাগের একটু আভাস, কমান্ডার, আমরা হারানো কার্ডিনালদের ব্যাপারে এমন কোন সিদ্ধান্ত নিতে পারি না।

চোখে মরা মানুষের দৃষ্টি নিয়ে ক্যামারলেনগোর দিকে তাকায় ওলিভেট্টি, সেন্ট ফ্রান্সিসের জন্য যে প্রার্থনা করা হয়, সিনর। আপনার কি কথাটা মনে আছে?

ক্যামারলেনগোর কণ্ঠে ধ্বণিত হয় বেদনার করুণ সুর, হে ঈশ্বর, আমাকে শক্তি দিন এমন ব্যাপার মেনে নিতে যাকে আমি বদলাতে পারি না।

বিশ্বাস করুন আমাকে, বলেছিল ওলিভেট্টি, এটা তেমনি এক পরিস্থিতি। তারপর সে পিছন ফিরে চলে গেল।

 

৪৪.

লন্ডনের পিকাডেলি সার্কাসের পাশেই ব্রিটিশ ব্রডকাস্টিং কর্পোরেশন (বিবিসি)

সেন্ট্রাল অফিস। সুইচবোর্ডের ফোন বেজে উঠল, সাথে সাথে একজন জুনিয়র কন্টেন্ট এডিটর তুলে ধরল ফোনটা।

বিবিসি। বলল মেয়েটা, মুখ থেকে ডানহিল সিগারেট সরিয়ে।

ফোনের অপর প্রান্তের কণ্ঠটা একটু ঘষটানে ঘষটানো। মধ্যপ্রাচ্যের সুর আছে। সেখানে। আমার কাছে একটা ব্রেকিং স্টোরি আছে যেটা আপনাদের কর্পোরেশন লুফে নিবে।

সাথে সাথে এডিটর তুলে নিল খাতা আর কলম। বিষয়?

পোপ সিলেকশন।

সে একটু বিরক্ত হল। বিবিসি সেখানে থেকেই নিউজ কাভার করছে। আজকাল মানুষের এ ব্যাপারে তেমন কোন আগ্রহ নেই। ঐশ্বরিক খবরটা কী?

রোমে কি ঘটনা কাভার করার জন্য কোন লোক পাঠিয়েছেন আপনারা?

আমি তেমনি মনে করি।

আমি সরাসরি তার সাথে কথা বলতে চাই।

আই এ্যাম স্যরি। কিছু আইডিয়া না পেলে আমি আপনাকে সেই নাম্বারটা দিতে পারব না–

কনক্লেভের উপরে একটা হুমকি এসেছে। এরচে বেশি কিছু বলতে চাই না আমি।

সাথে সাথে আরো ঝুঁকে এল সম্পাদক, আপনার নাম?

আমার নাম ইস্মেটারিয়াল।

একটুও অবাক হয়নি এডিটর। আপনার কাছে এই দাবির প্রমাণ আছে?

আছে।

আমি আপনার কাছ থেকে তথ্যটুকু পেলেই বরং খুশি হই। আমাদের পলিসির মধ্যে এমন কোন ফাঁক নেই যে সরাসরি রিপোর্টারের কাছে…

বুঝতে পারছি আমি। আমি নাহয় অন্য কোন নেটওয়ার্কের সাথে যোগাযোগ করব। সময় দেয়ার জন্য অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। শুড়…

এক মিনিট, বলল এডিটর, একটু ধরে থাকতে পারবেন?

কলারকে লাইনে রেখে সম্পাদক গলা লম্বা করল। কলারদের ফোন ট্রেস করার কোন না কোন উপায় থাকে তাদের কাছে। কিন্তু এরই মধ্যে কলার দুটো পরীক্ষায় উৎরে গেছে। সে তার নাম জানানোর জন্য মোটেও উদগ্রীব নয় এবং সে ফোনটা রেখে দিতে চাচ্ছে। মানুষ সাধারণত এমন সব কলে নিজের নামটা প্রচার করতে চায়।

রিপোর্টারদের হাতে মিস করার মত খবর সহজে আসে না। যদি কোনক্রমে একটা সত্যিকার খবর মিস হয়ে যায় তাহলে এডিটরের অবস্থা আর দেখতে হবে না। তাই পাগলদের দেয়া খবরও যত্ন নিয়ে শুনতে হয়। রিপোর্টারের পাঁচটা মিনিট হারিয়ে যেতে দেয়া যায়। তাতে খুব একটা পাপ হয় না। কিন্তু যদি খবরটা মিস হয়ে যায়, যদি খবরটা হেডলাইন হয়, তাহলে আর দেখতে হবে না।

হাই তুলতে তুলতে মেয়েটা তার কম্পিউটারের দিকে তাকাল, তারপর লিখল, ভ্যাটিকান সিটি। তারপর পাপাল সিলেকশনে থাকা ফিল্ড অপারেটরের নাম দেখে মুখ বাঁকিয়ে হাসল সে। বিবিসি তাকে লন্ডনের একটা ট্যাবলয়েড থেকে তুলে এনেছে সাধারণ ফিল্ড রিপোটি কাভার করার জন্য। এডিটররা তাকে একেবারে নিচের স্তরের রিপোর্টার মনে করে।

সে সারা রাত সেখানে এক পায়ে খাড়া হয়ে থাকবে। তারপর তার দশ সেন্ডের লাইভ রিপোর্ট নিয়ে কম্ম সারা করবে। অন্তত বিরক্তিকর কাজগুলো থেকে একটু মুক্তি পেয়ে সে হাঁফ ছেড়ে বাঁচবে।

ভ্যাটিকান সিটিতে থাকা রিপোের্টারের স্যাটেলাইট এক্সটেনশন বের করল এডিটর। তারপর আরেকটা সিগারেট ধরিয়ে নাম্বারটা জানিয়ে দিল কলারকে।

 

৪৫.

এ তে কোন কাজ হবে না। বলল ভিট্টোরিয়া। পোপর অফিসে সারাক্ষণ পায়চারি  করছে সে। চোখ তুলে তাকাল ক্যামারলেনগোর দিকে। যদি সুইস গার্ড পুরো সিটি ব্লাক আউট করতেও পারে, যদি তারা ক্যানিস্টারটার খোঁজ পায়, তাহলে তাদেরকে সেটার ঠিক উপরে থাকতে হবে। এর সিগন্যাল নির্ঘাৎ দুর্বল হবে। যদি সেটা পাওয়াও যায়, তার ফল শুভ নাও হতে পারে। যদি আপনাদের গ্রাউন্ডের কোথাও সেটা লোহার বাক্সে ভরে মাটি চাপা দেয়া থাকে তাহলে? কিম্বা উপরে, ধাতব কোন ভেন্টিলেটিং ডাক্টে থাকে? তাহলে আর তা পাবার কোন উপায় থাকবে না। আর কে বলতে পারে যে আপনাদের সুইস গার্ড গুপ্তচরহীন? কে বলতে পারে তারা ঠিকমত সার্চ করবে?

একেবারে বিদ্ধস্ত দেখাচ্ছে ক্যামারলেনগোর চেহারা, আপনি কী করতে বলেন, মিস ভেট্রা?

এবার বেশ স্বস্তিতে পড়ল ভিট্টোরিয়া। এ কথাটা আসতই, তাই নয় কি? আমি বলি স্যার, আপনারা দ্রুত অন্য কোন প্রস্তুতি নিন। আমরা আর সব আশা বাদ দিয়ে আশা করতে পারি কমান্ডারের সার্চ ঠিকমত শেষ হবে। তারপর? একই সাথে জানালার বাইরে তাকান। ঐ মানুষগুলোকে কি আপনি দেখতে পাচ্ছেন? পিয়াজ্জার বাইরে ঐ বাড়িগুলোকে? মিডিয়া ভ্যানগুলো? ট্যুরিস্টদের? তারা অবশ্যই বিস্ফোরণ এলাকার ভিতরে আছে। আপনাদের যা করার এখনি করতে হবে।

আবারও ফাঁকা একটা নড করল ক্যামারলেনগো।

হতাশ হল ভিট্টোরিয়া। ওলিভেট্টি সফল। সবাইকে সে বুঝিয়ে বসতে পেরেছে যে। হাতে প্রচুর সময় আছে। কিন্তু সে জানে, যদি একবার, কোন না কোন ফাঁক ফোঁকড় দিয়ে খবরটা বাইরের দুনিয়ায় জানাজানি হয়ে যায় তাহলে আর দেখতে হবে না। চোখের সামনে ভরে যাবে সামনের এলাকাটা। সুইস পার্লামেন্ট বিল্ডিংয়ের বাইরে এমন ঘটনা ঘটতে দেখেছে সে। ভিতরে বোমা সহ লোকজনকে আটকে রাখায় চারপাশে মানুষের ভিড় উপচে পড়ছিল। সবাই দেখতে চাচ্ছিল কী ঘটবে। যদিও পুলিশ বারবার তাদের বলছিল যে তারা বিপদে আছে তবু মানুষ প্রতি মুহূর্তে এগিয়ে এসেছিল। মানুষের মনে মানুষের জীবন সংশয়ের মত আগ্রহোদ্দীপক আর কোন ব্যাপার ঘটে না।

সিনর, ভিট্টোরিয়া আবার কথা তুলল, আমার বাবার হন্তা লোকটা বাইরেই কোথাও আছে। এই শরীরের প্রতিটা কোষ প্রাণপণে বাইরে বেরিয়ে গিয়ে তাকে ধরে টুকরা টুকরা করে ফেলতে চাচ্ছে। কিন্তু আমি আপনার অফিসে দাঁড়িয়ে আছি… কারণ একটাই, আমার কিছু দায়বদ্ধতা আছে আপনাদের প্রতি। আপনার প্রতি এবং আর সবার প্রতি। জীবন এখন সংশয়ে আছে। আমার কথা কি শুনতে পাচ্ছেন সিনর?

এবারো কোন জবাব দিল না ক্যামারলেনাগো।

ভিট্টোরিয়া তার নিজের হৃদয়কে ধুকতে দেখল। সুইস গার্ড কেন লোকটাকে চিহ্নিত করতে পারল না? ইলুমিনেটি এ্যাসাসিনইতো সব কাজের চাবিকাঠি। সে জানে কোথায় রাখা হয়েছে ক্যানিস্টারটা… হেল! সে জানে কোথায় আছে কার্ডিনালরা। শুধু খুনিটাকে ধরে আন। বাকি সব আপসে শেষ হয়ে যাবে।

টের পাচ্ছে ভিট্টোরিয়া, অসুস্থ হয়ে যাচ্ছে সে। একটা মানসিক বিকার। ব্যাপারটা ঘটত এতিমখানায় থাকার সময়। এমন হতাশা যেখানে করার মত কিছুই নেই। তোমার হাতে কাজ করার মত চাবিকাঠি আছে। বলল সে নিজেকে, সব সময় তোমার হাতে কাজ করার মত চাবিকাঠি থাকে। কিন্তু এ কথা ভেবেও কোন কাজ হল না তার। তার মনের ভিতরে চিন্তা ঘুরপাক খাচ্ছে সারাক্ষণ। সে একজন রিসার্চার। একজন প্রব্লেম সলভার। কিন্তু এ এমন এক সমস্যা যার কোন সমাধান চোখে দেখে বের করা যাচ্ছে না। কোন ডাটা তোমার দরকার? কী তথ্য তুমি চাও? সে নিজেকে বলল, শ্বাস নাও বড় করে, সমাধান তোমার হাতে কাছেই আছে। এবং অবাক হয়ে দেখল, জীবনে এই প্রথম তার সামনে কোন সমাধান নেই। এই প্রথম, সব কিছুর বদলে সে দেখল, ফোঁপাচ্ছে সে।

 

মাথা ব্যথা করছে ল্যাঙডনের। সেও কোন কূল-কিনারা খুঁজে পাচ্ছে না। সেও অসহায়ভাবে একবার তাকায় ক্যামারলেনগোর দিকে, আরেকবার তাকায় ভিক্টোরিয়ার দিকে। কিন্তু তার চিন্তা ভাবনা ধোঁয়াশাচ্ছন্ন হয়ে আসছে। বারবার মনে পড়ছে কয়েকটা চিত্র। বিস্ফোরণ, সাংবাদিকদের উপচে পড়া ভিড়, ক্যামেরার চলাচল, চারজন চিহ্ন আকা মানুষের লাশ।

শাইত্বোয়ান… লুসিফার… আলোক আনয়নকারী… স্যাটান…

মন থেকে দৃশ্যগুলো তাড়িয়ে দেয়ার চেষ্টা করল সে। পরিকল্পিত সন্ত্রাস, বলল সে নিজেকে, হিসাব কষা ধ্বংস। এক সেমিনারের কথা তার মনে পড়ে যায়। সন্ত্রাসি এ্যালেস এন্ড ডেনস কর্মকান্ডে সিম্বলের ব্যবহারের উপর তাকে একটা বক্তব্য দিতে হয়েছিল। এর পর আর কখনো সে এমন করে সন্ত্রাসের কথা ভাবেনি।

সন্ত্রাসের, বলেছিল এক প্রফেসর, একটা সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য আছে। কী সেটা?

নিস্পাপ মানুষকে হত্যা করা? সাথে সাথে বোকার মত জবাব দিয়েছিল এক ছাত্র।

ভুল। হত্যাকান্ডটা সন্ত্রাসের একটা পথ মাত্র, এরচে বেশি কিছুই নয়।

শক্তিমত্তার প্রমাণ?

না। ক্ষীণতর পথপরিক্রমা নয়।

আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়া?

এতোক্ষণে মূল কথায় এসেছ। সন্ত্রাসের একটা মাত্র লক্ষ্য আছে। ভীতি আর আতঙ্ক ছড়িয়ে দেয়া। সন্ত্রাস সব সময়ই একটু হলেও দুর্বল… তারা তাদের দুর্বলতা ঢাকতে চায় সন্ত্রাস দিয়ে। যে কোন একটা মেসেজ জানিয়ে দেয়া তাদের লক্ষ্য। কথাটা টুকে রাখ। সন্ত্রাস মোটেও শক্তিমত্তার পাগলাটে প্রদর্শনী নয়। এটা একটা রাজনৈতিক হাতিয়ার। সরকারের অকর্মণ্যতা প্রমাণ করে তুমি পরে মানুষের মন জয় করে নাও, এমনও হতে পারে।

মানুষের বিশ্বাস হারিয়ে ফেলা…

এই একটা ব্যাপারেই কি সব রহস্য লুকিয়ে আছে? সারা দুনিয়ার খ্রিস্টানেরা ব্যাপারটাকে কীভাবে দেখবে? পাগলা কুকুরের সময়টায় কুকুরদের মেরে যেভাবে রাস্ত য় ফেলে রাখা হত সেভাবে তাদের কার্ডিনালদের সেখানে পড়ে থাকতে দেখে তাদের মনে কী প্রতিক্রিয়া হবে? যদি একজন কার্ডিনালের মত সৰ্বোচ্চ ক্ষমতার মানুষ শয়তানের হাত থেকে না বাঁচতে পারে, যদি ভ্যাটিকান সিটির মত পবিত্রতম শহর মাটির সাথে মিশে যায় তাহলে সাধারণ খ্রিস্টানদের মনে তার কী প্রভাব পড়বে? ল্যাঙডনের মন আরো দ্রুত কাজ করছে এখন… মনের ভিতরে কোথায় যেন দুটা অস্তি ত্ব লড়াই করছে। একটা সুতা নিয়ে টানাহেঁচড়া করছে।

বিশ্বাস তোমাকে রক্ষা করে না… রক্ষা করে ওষুধ আর এয়ারব্যাগ… ঈশ্বর বলতে কেউ নেই… আর যদিও থেকেও থাকে, তার কোন দায় পড়েনি যে সে তোমাকে রক্ষা করবে… তোমাকে যা রক্ষা করে তার নাম বুদ্ধিমত্তা। আলোই রক্ষা করে তোমাকে। আলোকিত হও। বিজ্ঞানের আলোতে। এমন কিছুর উপর ভরসা রাখ যে তোমাকে রক্ষা করবে। কেউ একজন পানির উপর দিয়ে হেটে গেছে, তারপর কত যুগ পেরিয়ে গেল? আর কেউ কি কাজটা করতে পেরেছে? আধুনিক মিরাকলগুলোর স্রষ্টা হল বিজ্ঞান… কম্পিউটার, ভ্যাকসিন, স্পেস স্টেশন… এমনকি সৃষ্টির আদি দিকগুলোও হাপিস হয়ে গেছে। বিজ্ঞান, জিনতত্ত্ব হাতে তুলে নিয়েছে সে দায়িত্ব। এমনকি সৃষ্টির সবচে বড় যে তত্ত্ব, শূণ্য থেকে জন্ম নেয়া, সেটাও হচ্ছে এখন ল্যাবে। কার আর ঈশ্বরের প্রয়োজন আছে? না! সায়েন্স ইজ গড!

হন্তার কথাগুলো ধ্বণিত প্রতিদ্ধণিত হচ্ছে ল্যাঙড়নের মনে, মস্তিষ্কে। মধ্যরাত… খুনের ধারাবাহিক পথ পরিক্রমা… স্যাক্রিফিসি ভার্জিনি নেল অল্টারে ডি সিয়েঞ্জা।

তারপর হঠাৎ করেই, যেভাবে কোন বন্দুকের গুলি হাপিস হয়ে যায়, সেভাবে মাথা থেকে সমস্ত চিন্তা উধাও হয়ে গেল।

সিট ছেড়ে সটান দাঁড়িয়ে পড়ল রবার্ট ল্যাঙডন। তার পিছনে পড়ে গেল চেয়ারটা, মার্বেলের মেঝের উপর।

ভিট্টোরিয়া আর ক্যামারলেনগো সাথে সাথে চমকে গেল।

আমি আসল ব্যাপারটা ধরতে পারিনি। যেন মোহগ্রস্থ ল্যাঙডন কথা বলছে। আমার সামনেই ছিল। ধরতে পারিনি আমি।

কী মিস করেছ? দাবি করল ভিট্টোরিয়া। প্রিস্টের দিকে মুখ ফিরিয়ে দাঁড়াল ল্যাঙডন, ফাদার, তিন বছর ধরে আমি ভ্যাটিকানের কাছে আবেদন জানিয়ে আসছি। যেতে চাই আপনাদের আর্কাইভে। সাতবার আমাকে ফিরিয়ে দেয়া হয়।

মিস্টার ল্যাঙডন, আমি দুঃখিত, কিন্তু এ সময়ে এমন একটা ব্যাপার নিয়ে অভিযোগ তোলাটা আমার কাছে বিচিত্র বলে মনে হচ্ছে।

ল্যাঙডন সাথে সাথে বলল, আমি এখনি এখানে প্রবেশাধিকার চাই। চারজন কার্ডিনাল হারিয়ে গেছেন। আমি ভেবে বের করতে চাই কোথায় তাদের হত্যা করা

ভিট্টোরিয়া এমন দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যেন সে কিছুই বুঝতে পারছে না।

ক্যামারলেনগোর দৃষ্টিও ফাকা। যেন তাকে নিয়ে কোন নিষ্ঠুর কৌতুক করা হচ্ছে। আপনি বলতে চান যে এই তথ্যটা আমাদের আর্কাইভে আছে?

আমি প্রতিজ্ঞা করতে পারছি না যে ঠিক ঠিক বের করতে পারব তবে আশা করতে কোন দোষ নেই। আমি আশাবাদী…।

মিস্টার ল্যাঙডন, আমি আর চার মিনিটের মধ্যে সিস্টিন চ্যাপেলে থাকব। আর্কাইভটা ভ্যাটিকান সিটির অপর প্রান্তে।

তুমি সিরিয়াস, তাই না? চোখের দিকে তীব্র দৃষ্টি হানল ভিট্টোরিয়া, জানতে চায় কতটুকু সিরিয়াস সে।

মশকরা করার মত সময় নয় এটা। সাথে সাথে জবাব দিল ল্যাঙডন।

ফাদার, ভিট্টোরিয়া বলল ক্যামারলেনগার দিকে তাকিয়ে, যদি কোন সুযোগ থাকেই… যদি বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা থাকে তারা কোথায় মারা যাবেন তা জানার, তাহলে আমরা অন্তত লোকেশনগুলো বের করতে পারব।

কিন্তু আর্কাইভে? অনুনয় ঝরে পড়ল ক্যামারলেনগোর কষ্ঠে, কী করে সেখানে কোন কু লুকিয়ে থাকতে পারে?

ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করা, বলল ল্যাঙডন, অনেক সময় নিবে, অন্তত চার মিনিটে সুরাহা করা যাবে না। কিন্তু আমি যদি সত্যি সত্যি ব্লু টা পেয়ে যাই, তাহলে হ্যাসাসিনকে ধরার একটা সুযোগ থেকে যাচ্ছে।

এমনভাবে ক্যামারলেনগো তাকাল যেন সে এ কথাতে ভরসা রাখার চেষ্টা করছে। কিন্তু কী করে যেন তার বিশ্বাসটা ঠিক খাপ খেল না। খ্রিস্টানত্বের সবচে গোপনীয় ডকুমেন্টগুলো সেখানে লুকিয়ে রাখা হয়েছে। এমন সব সম্পদ সেখানে লুকানো যেগুলোর দিকে চোখ রাখার অনুমতি আমি নিজেও পাইনি।

আমি সে সম্পর্কে ভাল ভাবেই জানি।

ক্যামারলেনগো বলল, ভিতরে ঢোকার একটা মাত্র রাস্তা আছে। কিউরেটর আর বোর্ড অব ভ্যাটিকান লাইব্রেরিয়ানসের লিখিত অনুমতি নিতে হবে।

অথবা, বলল ক্যামারলেনগোকে ল্যাঙড়ন, পাপার পদে আসীন কারো অনুমতি। আপনার কিউরেটর যতবার আমাকে ফিরিয়ে দিয়েছে ততবার চিঠিতে আমি এ কথাটা পেয়েছি।

নড করল ক্যামারলেনগা।

কঠিন হয়ে কথাটা বলছি না, বলল ল্যাঙডন, আমার যদি কোন ভুল হয়ে না থাকে তো পাপাল ম্যান্ডেট আসে এই অফিস থেকেই। আর আমি আরো যতটুকু জানি, আজ রাতে এ অফিসে আসীন আছেন আপনি নিজে। পরিস্থিতি বিবেচনা করে বলা যায়…

পকেট থেকে একটা ঘড়ি বের করে এক পলক তাকিয়ে নিল ক্যামারলেনগো। মিস্টার ল্যাঙডন, আজ রাতে এই চার্চের সুরক্ষার জন্য আক্ষরিক অর্থেই আমার জীবন দিয়ে দিতে প্রস্তুত।

ল্যাঙড়ন তাকাল লোকটার চোখের দিকে। সেখানে সত্যের ঝলক দেখা যাচ্ছে।

এই ডকুমেন্ট, জিজ্ঞেস করল ক্যামারলেনগো, আপনি কি সত্যি সত্যি বিশ্বাস করেন যে পেলে আপনি ঠিক ঠিক চারজন চার্চকে খুঁজে বের করতে পারবেন?

আমি ভিতরে ঢুকে হাজারটা ডকুমেন্ট ধরে একটা হ-য-ব-র-ল লাগিয়ে দিব না। আপনারা যখন কোন শিক্ষককে বেতন দেন তখন ইতালি আপনাদের মাথায় ভেঙে পড়ে না। আপনাদের হাতে যে ডকুমেন্ট আছে তা একই সাথে পুরনো এবং–

প্লিজ, বলল ক্যামারলেনগো, ক্ষমা করুন আমাকে। আমার মনে এরচে বেশি কোন কথা আসছে না এ মুহূর্তে। আপনি কি জানেন কোথায় সেই গোপন ডকুমেন্ট লুকানো আছে?

উল্লাসের একটা ঝলক খেলে গেল ল্যাঙডনের চোখেমুখে, সান্তা এনার গেটের ঠিক পিছনে।

চমৎকার! বেশিরভাগ স্কলার মনে করেন এটা সেন্ট পিটারের পবিত্র সিংহাসনের পিছনে আছে।

না। এটা নিয়ে বেশিরভাগ মানুষই গোল পাকিয়ে বসে। আর্কাভিয়ো দেলা রেভারেন্দা দ্য ফ্যাব্রিকা ডি সন্ত পিতেরো। একটা কমন মিসটেক।

একজন লাইব্রেরিয়ান সব প্রবেশপথে নজর রাখতে পারে না। তাকে সাথে থাকতে হয়। আজ রাতে আমরা কী করব বুঝে উঠতে পারছি না। একজন কার্ডিনাল ঢোকার সময়েও সাথে একজন না একজন থাকেই।

আমি আপনাদের সম্পদকে অত্যন্ত যত্নের সাথে নিরীক্ষণ করব। আপনাদের লাইব্রেরিয়ান আমার সেখানে থাকার কোন প্রমাণ পাবে না।

মাথার উপর সেন্ট পিটারের ঘণ্টা বাজতে শুরু করল। পকেট থেকে বের করে আবার ঘড়িটা দেখল ক্যামারলেনগগা। আমার যেতেই হচ্ছে। আমি আর্কাইভে আপনার জন্য একজন সুইস গার্ড পাঠিয়ে দিব। আপনার উপর বিশ্বাস স্থাপন করলাম, মিস্টার ল্যাঙড়ন। এগিয়ে যান এবার।

মুখে কোন রা সরল না ল্যাঙড়নের।

ফিরে গেল কমবয়েসি প্রিস্ট। যাবার আগে আর একবার ফিরে এল সে। হাত রাখল ল্যাঙডনের কাধে, তারপর সর্বশক্তি দিয়ে চেপে ধরল তাকে। পিছন থেকে। আপনি যা-ই খুজছেন, আশা করি তা পেয়ে যাবেন। আর বের করুন এটাকে। দ্রুত।

 

৪৬.

এ কটা পাহাড়ের উপরে, বর্জিয়া কান্ট্রিইয়ার্ডের পরে, সান্তা এ্যানের শেষপ্রান্তে

ভ্যাটিকানের গোপনীয় আর্কাইভ অবস্থিত। সেখানে বিশ হাজারের বেশি পুরনো বই আর দলিল-দস্তাবেজ আছে। বলা হয় এখানে এমন অনেক বস্তু আছে যার দু একটা বাইরে প্রকাশ পেলেই উল্টে যাবে ইতিহাসের পাশার ছক। আছে লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির গোপন ডায়েরি, আছে বাইবেলের না-ছাপা হওয়া কপি।

এখনো ল্যাঙডন তার মনকে বিশ্বাস করাতে পারছে না যে সে পৃথিবীর সবচে গোপনীয় একটা অঞ্চলে প্রবেশ করছে। তার পাশে পাশেই আসছে ভিট্টোরিয়া। কষ্ট করে তার পায়ের সাথে তাল মিলাচ্ছে। তার খোলা চুলে খেলে যাচ্ছে হাওয়া। বাতাসের সেই প্রবাহ থেকে আসছে অচেনা একটা সুগন্ধ, সেটুকু নির্দ্বিধায় টেনে নিচ্ছে ল্যাঙড়ন।

ভিট্টোরিয়া সাথে সাথে তাকে পেয়ে বসল, তুমি কি আমাকে বলবে কী খুঁজছি আমরা?

একটা ছোট্ট বই। গ্যালিলিও নামের এক লোকের লেখা।

অবাক হয়ে গেল সে। তুমি আর কোন গোল পাকিও না। এর ভিতরে কী লেখা আছে?

এর ভিতরে এমন কিছু থাকার কথা যাকে লোকে এল সাইনো বলে।

দ্য সাইন?

সাইন, ক্লু, সিগন্যাল… নির্ভর করবে তুমি এটাকে কীভাবে অনুবাদ করছ তার উপর।

কীসের সাইন?

ল্যাঙডন আরো বাড়িয়ে দিল চলার গতি, একটা গুপ্ত অবস্থান। গ্যালিলিওর ইলুমিনেটি তাদের দলকে চার্চের হাত থেকে বাঁচানোর জন্য গোপন বিভিন্ন আস্তানা বেছে বের করত। তাই তারা ভ্যাটিকানের হাত থেকে বাঁচার জন্য এখানে, এই রোমেই একটা অতি গোপনীয় আস্তানা বের করে। এটাকে তারা দ্য চার্চ অব ইলুমিনেটি নামে ডাকত।

বাহ্! একটা শয়তানি আড্ডাকে চার্চ নামে ডাকা!

মাথা নাড়ল ল্যাঙড়ন, গ্যালিলিওর ইলুমিনেটি মোটেও শয়তানি সংঘ ছিল না। তারা ছিলেন আলোকবর্তিকা হাতে এক একজন সম্মানিত বিজ্ঞানী। তাদের আড্ডাখানা। কোন শয়তানি কাজে লাগত না। বরং তাদের আড্ডাতে কথা হত এমন সব বৈজ্ঞানিক ব্যাপার নিয়ে যা চার্চ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। আমরা সবাই জানি গোপন আড্ডাটা আছে। এ পর্যন্তই। কেউ জানে না সেটা কোথায়।

শুনে মনে হচ্ছে ইলুমিনেটি ভাল করেই জানে কী করে একটা ব্যাপারকে গোপন রাখতে হয়।

অবশ্যই। ইন ফ্যাক্ট, ব্রাদারহুডের বাইরে কেউ কখনো কোনক্রমে তাদের সেই গুপ্ত সংঘের কথা বলেনি। এর ফলে তাদের গোপনীয়তা রক্ষা পায়। একই সাথে আর একটা সমস্যার উদয় হয়। নতুন রিক্রুট করার সময় খুব সাবধান হতে হয় তাদের।

তারা বেড়ে উঠতে পারত না যদি তারা প্রচার না করত। পায়ের সাথে তাল মিলিয়ে কাজ করছে মেয়েটার মস্তিষ্ক !

ঠিক তাই। মোলশ ত্রিশের দশকে গ্যালিলিওর দুনিয়া বিস্তৃত হতে শুরু করে। এমনকি এ সময়টায় গোপনে গোপনে মানুষ এমনভাবে রোমে আসত যেভাবে কোন মানুষ তীর্থ দেখতে যায়। তারা আসত ইলুমিনেটিতে যোগ দিতে… গ্যালিলিওর টেলিস্কোপে একটা বার চোখ রাখার লিপ্সা তাদের এখানে নিয়ে আসত। মহান শিক্ষকের মুখের একটা কথা শোনার জন্য তারা উদগ্রীব হয়ে থাকত। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, জ্ঞানলিন্দু বিজ্ঞানীর দল জানত না কোথায় মিলিত হতে হবে সেই প্রবাদ পুরুষের সাথে, কীভাবে দেখা করতে হবে ইলুমিনেটির সাথে। তারা বৃথাই ঘুরে মত রোম জুড়ে। ইলুমিনেটি নতুন রক্ত চায়, চায় তরুণ মেধা, কিন্তু একই সাথে তাদের মাথায় রাখতে হয় যে তাদের গোপনীয়তা রক্ষা করতে হবে।

বলল ভিট্টোরিয়া, অনেকটা সিচুয়েজিওনে সেঞ্জা সলিউজিওনের মত শোনাচ্ছে।

ঠিক তাই। একটা ক্যাচ-২২, বর্তমানে আমরা যা বলতে পারি।

তাহলে তারা কী করত?

তারা বৈজ্ঞানিক। পুরো সমস্যা খতিয়ে দেখে একটা করে উপায় বের করে তারা। সত্যি সত্যি খুব মেধাবী কাজ ছিল সেটা। তাদের জন্য আসা বিজ্ঞানীদের জন্য একটা মানচিত্রের ব্যবস্থা করে।

ম্যাপ? শুনতে বোকামি বোকামি ঠেকছে না? একবার যদি কোন ভুল হাতে গিয়ে পড়ে…

কখনোই পড়তে পারবে না। বলল ল্যাঙডন, এর কোন কপি ছিল না কোথাও। কাগজে বসানো কোন ম্যাপ ছিল না সেটা। সারা মহানগরী জুড়ে সেই ম্যাপ আকা ছিল। কেউ সেটা থেকে ভালমন্দ বুঝতে পারবে না।

ওয়াকওয়ের পাশে তীরচিহ্ন দেয়া?

এক কথায়, তাই বলা চলে। কিন্তু তা আরো অনেক বেশি জটিল ছিল। সাধারণ মানুষের পথেই ছড়ানো ছিল সেগুলো, কিন্তু তার প্রক্রিয়া ছিল ভিন্ন। বিভিন্ন চিহ্ন ছড়ানো ছিটানো, সারা রোম জুড়ে। পরের জায়গা… তার পরের জায়গা… একটা পথ… আর সবশেষে ইলুমিনেটির আসল আড্ডা।

ভিট্টোরিয়ার চোখ চকচক করে উঠল, মনে হচ্ছে কোন গুপ্তধন বের করার সন্ধানে নামা ছাড়া উপায় ছিল না কোন।

মুখ ভেঙুচে হাসল একটু ল্যাঙডন, এক কথায়, তাও বলা চলে। এটাকে ইলুমিনেটি বলত, দ্য পাথ অব ইলুমিনেশন। যে কেউ, যে চায় ইলুমিনেটিকে খুঁজে বের করতে, সেখানে যোগ দিতে, তাকে এ পথ ধরেই আসতে হবে। একই সাথে ব্যাপারটা এক ধরনের পরীক্ষা।

কিন্তু ভ্যাটিকান যদি ইলুমিনেটিকে খুঁজে বের করতে চায়? বাদ সাধল ভিট্টোরিয়া, তারা কি সোজাসাপ্টা পাথওয়ে অনুসরণ করে করে পৌছে যেতে পারবে না?

না। পথটা ছিল গুপ্ত। একটা পাজল। শুধু অনুমোদিত মানুষজনই এ পথ দেখে বুঝতে পারবে। আর কেউ নয়। ইলুমিনেটি চার্চ কোথায় লুকিয়ে আছে তা শুধু তারাই বের করতে পারবে। এটাকে শুধু এজন্যই জটিল করে তোলা হয়নি। একই সাথে তারা সবচে মেধাবী বিজ্ঞানীদের হেঁকে তুলতে চেয়েছিল। তাদের দরজায় যেন আর কোন মানুষ কড়া না নাড়তে পারে সে ব্যবস্থা পাকাপোক্ত করা হয়েছিল।

কিন্তু আমি কিছুতেই একমত হতে পারছি না। ষােলশো শতকের রোম ছিল সারা দুনিয়ার সবচে মেধাবী মুখের তীর্থস্থান। চার্চের কেউ না কেউ নিশ্চিত খুঁজে বের করতে পারত জায়গাটা। ভ্যাটিকানে শুধু মূর্খরাই থাকবে এমন মনে করার কোন কারণ নেই।

অবশ্যই। বলল ল্যাঙডন, যদি তারা চিহ্নগুলো সম্পর্কে কিছু জানত। কিন্তু সব ঘটেছিল তাদের অগোচরে। ইলুমিনেটি সেগুলোকে এমন পথে নির্দেশ করেছিল শুধু জানা লোকজনই এগিয়ে যেতে পারবে। তারা যে প্রক্রিয়া ধরে এগিয়েছিল সিম্বলজিতে তাদের বলা হয় ডিসিমিউলেশন।

ক্যামোফ্লেজ।

বেশ আশ্চর্য হল ল্যাঙডন, তুমি অর্থটা জান?

ডিসিমিউল্যাজিওনে, সে বলল, প্রকৃতির সবচে সেরা প্রতিরক্ষা। সাগরের আগাছায় ভেসে থাকা একটা ছোট মাছকে খুঁজে বের করার মত কষ্টকর একটা প্রক্রিয়া।

ওকে। বলল ল্যাঙডন, ইলুমিনেটি একই পদ্ধতি ধরে এগিয়েছে। তারা চাচ্ছিল রোমের ভিতরে যেন হারিয়ে যায় এই প্রতীকগুলো। যেন সেগুলোকে দেখেও না দেখে সাধারণ মানুষ। তারা বৈজ্ঞানিক চিহ্ন ব্যবহার করতে পারত না। ব্যবহার করতে পারত না সাধারণ ভাষা। ব্যবহার করতে পারেনি তাদের প্রচলিত এ্যাম্বিগ্রাম। তাই তারা ডাক দিল তাদের মেধাবী এক আর্টিস্টকে। তিনিই ইলুমিনেটির এ্যাম্বিগ্রামটা তৈরি করেছিলেন। তারা চারটা চিহ্ন বের করল।

ইলুমিনেটি স্কাল্পচার?

ঠিক তাই। এমন স্কাল্পচার যা দিয়ে মাত্র দুটা অর্থ বোঝাবে। প্রথমেই, সেগুলোকে এমন হতে হল যা রোমের সাধারণ আর্টের সাথে মিশে যায়… এমন সব আর্টওয়ার্ক যেগুলোকে ভ্যাটিকান মোটেও সন্দেহ করবে না।

ধর্মীয় চিত্রাঙ্কন!

নড করল ল্যাঙডন, একটু উত্তেজিত হয়ে উঠছে সে। তার কথার বেগ বেড়ে গেছে অনেক গুণ। আর দ্বিতীয় ব্যাপার হল, চারটা চিত্র খুব সুনির্দিষ্ট থিম বহন করবে। প্রত্যেক খন্ড বিজ্ঞানের চার বন্ধুকে নির্দেশ করবে।

চার বস্তু? ভিক্টোরিয়া বলল, কিন্তু প্রকৃতিতে শতাধিক যত আছে।

ষােড়শ শতকে নয়। মনে করিয়ে দিল ল্যাঙডন তাকে, বিজ্ঞানীরা মনে করতেন, পুরো ইউনিভার্স মাত্র চারটা বস্তু দিয়ে গঠিত। মাটি, পানি, বাতাস, আগুন।

প্রথম দিককার ক্রস। ল্যাঙডন ভাল করেই জানে, এ দিয়ে সহজেই চারটাকে বোঝানো যায়। চার হাত দিয়ে আগুন, পানি, বাতাস আর মাটি। যদিও পৃথিবীতে এই চারকে বোঝানোর জন্য ডজন ডজন প্রতীক ছিল পৃথিবীতে- পিথাগরিয়ান সাইকেল অব লাইফ, চাইনিজ হঙ-ফান, জাঙ্গিয়ান পুরুষ এবং মহিলা, জোডিয়াক প্রতীক, এমনকি মুসলিমরাও এই চিহ্ন চতুষ্টয় তুলে ধরে… ইসলামে সেটার নাম ছিল স্কোয়ারস, মেঘমালা, বজ্রপাত আর ঢেউ। তবু একটা ব্যাপার এখনো জ্বালাতন করে লাঙডনকে, মেসনরা আজো চার চিহ্নের বেড়াজালে আটকা পড়ে আছে মাটি, বাতাস, আগুন, পানি।

যেন মোহাবিষ্ট হয়ে গেছে মেয়েটা, তার মানে ইলুমিনেটি এমন প্রতীক বানাল যেটা আসলে দেখতে হবে ধর্মীয়, আদপে ভিতরে ভিতরে তা মাটি পানি, আগুন, বাতাসের প্রতিনিধিত্ব করবে?

ঠিক তাই। বলল ল্যাঙড়ন, ভায়া সেন্টিয়ানেল থেকে আর্কাইভের দিকে ঘুরতে ঘুরতে, রোম জুড়ে থাকা ধর্মীয় আর্টওয়ার্কের সমুদ্রে প্রতীকগুলো মিশে গেল। আগেই এগুলো চার্চে চার্চে সওয়ার হল। তারপর প্রতিটা গির্জার বাইরে একে দেয়া হল এসব চিহ্ন। এতোক্ষণে এগুলো ধর্মের গন্ডিতে পার পেয়ে গেছে। তারপর এল আর সব জায়গায় এগুলো এঁটে দেয়ার কাজ। একটা গির্জায় এঁকে দেয়া হল… দেখিয়ে দেয়া হল পরের গির্জার পথ… সেখানে প্রতীক্ষা করছে পরের চিহ্নটা। তাদের প্রতীক ধর্মচিত র রূপ নিয়ে অপেক্ষা করছে পরের স্টপেজে। কোন চার্চে যদি কোন ইলুমিনেটি-প্রেমী মাটির চিহ্ন পায়, তাহলে সে পরের চার্চে খুজবে বাতাস… এরপর আগুন… সবশেষে পানি… আর তারপরই আসছে চার্চ অব ইলুমিনেশনের কথা।

আরো আরো ঘোলাটে হয়ে যাচ্ছে ভিট্টোরিয়ার মাথা। আর এর সাথে হ্যাসাসিনকে খুঁজে বের করার কোন না কোন সম্পর্ক আছে?

হাসল ল্যাঙডন সুন্দর করে। দৃকপাত করল মেয়েটার দিকে, ওহ! ইয়েস! ইলুমিনেটিরা এই চার চার্চকে অন্য একটা নাম দিয়েছে, দ্য অল্টার্স অব সায়েন্স।

আবার হাসল ল্যাঙডন। চারজন কার্ডিনাল, চারটা চার্চ, চারটা অল্টার, অব সায়েন্স!

কিন্তু খুব একটা তুষ্ট মনে হচ্ছে না ভিট্টোরিয়াকে, তুমি বলতে চাও কার্ডিনাল চারজন যে চার গির্জার ভিতরে স্যাক্রিফাইজড় হবে সে গির্জাগুলোই অল্টার অব সায়েন্স? ইলুমিনেটিকে খুঁজে পাওয়ার পথ?

আমি এমনি মনে করি। ঠিক এমন।

কিন্তু খুনী কোন দুঃখে আমাদের হাতে সূত্র ধরিয়ে দিবে?

কেন নয়? ঠাটপাট জবাব দেয় ভিট্টোরিয়াকে, ল্যাঙডন, খুব কম ইতিহাসবেত্তা এই চার চার্চের খবর জানে। আর অনেক কম জন বিশ্বাস করে তার অস্তিত্ব আছে। আর তাদের সিক্রেটটা চার শতক ধরে গোপনই আছে। কোন সন্দেহ নেই, আর মাত্র পাঁচ ঘণ্টা এই রহস্যটা রহস্যই থাক তা মনেপ্রাণে চাইবে ইলুমিনেটি। আর এখন ইলুমিনেটির প্রয়োজন নেই পাথ অব ইলুমিনেশনের। তাদের গোপন আস্তানা এতোদিনে দূরে কোথাও চলে গেছে। কোন সন্দেহ নেই। তারা এখনকার উন্নততর পৃথিবীতে ঘাঁটি গেড়ে বসেছে। তারা এখন প্রাইভেট ব্যাঙ্কের ঘরে ঘরে আসন পেতে বসে, বসে পাবলিক প্লেসে, বসে খাবার জায়গায়, বসে গলফ ক্লাবে। আজ রাতে তারা চায় তাদের গোপনীয়তা প্রকাশ পেয়ে যাক। এটাই তাদের মহান মুহূর্ত, যার জন্য চারশো বছর ধরে তারা ওৎ পেতে ছিল, যার জন্য তাদের অনেক অনেক বিজ্ঞানী প্রাণপাত করেছে, যার জন্য পুরো দুনিয়ার অর্থনীতি তারা কজা করে রেখেছে, যার জন্য পৃথিবীর বেশিরভাগ উঁচু সারির রাজনীতিকদের তারা নিজেদের দলে টেনেছে, যে মুহূর্তের স্বপ্ন দেখত গ্যালিলিও, পৃথিবী থেকে ক্যাথলিক চার্চের বিদায়, স্রষ্টার নামে বিজ্ঞানকে পদদলিত করার দিনের বিদায়, শ্রেণিহীন-বিজ্ঞান নির্ভর একক বিশ্বের উদয়,

তাদের গ্র্যান্ড আনভেইলিং।

আরো একটা কথা ভেবে মনে মনে ভয় পাচ্ছে ল্যাঙডন। মিলে যাচ্ছে সব। একে একে। সেই চারটা প্রতীকের ছাপ কি থাকবে পোড়া চামড়ায়? কে জানে! সেই খুনি বলেছে, তাদের চারজনের কাছে চারটা প্রতীক থাকবে। বলেছিল সে, প্রমাণ করব আগের দিনের কিংবদন্তীগুলো ভুল নয়। চার পুরনো দিনের এ্যাম্বিগ্রামের চিহ্ন! সেই চারটা চিহ্ন! ইলুমিনেটিরই মত বয়স হয়েছে যেগুলোরঃ আর্থ-এয়ার-ফায়ার-ওয়াটার! মাটি-বাতাস-আগুন-পানি! চারটা শব্দ, পরিপূর্ণ অবস্থা সহ। দ্বিমুখী চিহ্ন। ঠিক ইলুমিনেটির মত। সে নামটা এরই মধ্যে ব্যবহৃত হয়েছে আরেক প্রিস্টের বুকে। প্রত্যেক কার্ডিনালের জন্য অপেক্ষা করছে বিজ্ঞানের প্রাচীণতম প্রতীক। ইতিহাসবেত্তাদের মধ্যে এ নিয়ে আরো একটা বিতর্ক চালু আছে। ইলুমিনেটির চার প্রতীক সহ ইলুমিনেটির নামটাও দ্বিমুখী। সেটা ঠিক আছে। কিন্তু আর একটা ব্যাপার বাকি থেকে যাচ্ছে। নামগুলো ইতালিয় নয়, ইংরেজিতে লেখা। ইংরেজিতে রাখাটা তাদের পাইকারি ব্যাপার হয়ে দাঁড়াবে। আর তাদের মধ্যে কোন কাজেই পাইকারি নয়… খুব গোছানো।

আর্কাইভ ইমারতের সামনে থেমে দাঁড়ায় ল্যাঙডন। প্রশস্ত সিড়িতে। শত শত ছবি ভেসে উঠছে তার চোখের সামনে। কীভাবে ইলুমিনেটি মার খেয়ে গেল একের পর এক, কীভাবে তারা জীবনগুলো হারাল, তারপর কীভাবে ডুব মারল ইতিহাসের পাতা থেকে, কীভাবে ভিতরে ভিতরে শক্তি সঞ্চয় করল, আবার কীভাবে দিনের আলোয় বুক পেতে দিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ার চেষ্টা করছে। তারা এবার উঠে আসবে, তাদের ইতিহাসখ্যাত ষড়যন্ত্রের সত্যতা তুলে আনবে। কিন্তু এখানে কি তারা থামবে, নাকি পুরো বিশ্ব দখলের প্রতিযোগিতায় নেমে পড়বে? যারা এমন গোপন জায়গা থেকে এমন গোপন একটা অস্ত্র ততোধিক গুপ্ত একটা এলাকায় এনে তা আবার ফলাও করে প্রচার করতে পারে তাদের পক্ষে কোন কাজই অসম্ভব নয়। খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টাকাতে তাদের ছাপ শোভা পায়। মানুষের সামনে তাদের কথা প্রচার করার একটা সুযোগ চলে আসছে।

ভিট্টোরিয়া বলল, এইতো এগিয়ে আসছে আমাদের এসকর্ট। সামনের লন থেকে হন্তদন্ত হয়ে এগুতে থাকা সুইস গার্ডের দিকে চোখ তুলে তাকাল ল্যাঙড়ন।

তাদেরকে দেখার সাথে সাথে গার্ড জায়গাতেই থেমে গেল। তাদের দিতে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে লোকটা। যেন ভুল দেখছে চোখের সামনে। আর এক বিন্দু অপেক্ষা না করে সে সেখানেই জমে গেল, পকেট থেকে তুলে আনল ওয়াকি টকি। তড়িঘড়ি করে লোকটা কথা বলে গেল লাইনের অপর প্রান্তে থাকা লোকটার সাথে। যেন সে মেনে নিতে পারছে না ব্যাপারটা। কিন্তু ঠিকঠিক বুঝতে পারল ল্যাঙডন, অপর প্রান্ত থেকে ভাল চোট পেয়েছে লোকটা। অসন্তুষ্ট একটা দৃষ্টি হানল সে।

গার্ড তাদেরকে বিল্ডিংয়ের দিকে গাইডিং করে নিয়ে যাবার সময় কোন কথা হল তাদের মধ্যে। তারা চারটা স্টিলের দরজা পেরিয়ে নেমে এল নিচে। সেখানে আরো দুটা কি প্যাড আছে, সেগুলোতে সঠিক পাসওয়ার্ড দেবার পরই সামনে আরো অনেকগুলো হাইটেক গেট পড়ল। তারপর হাজির হল ওকের তৈরি ভারি পাল্লা। এবার থামল প্রহরী, তাদের দিকে রোষ-কষায়িত নেত্রে একটু তাকিয়ে থেকে বিড়বিড় করতে করতে দেয়ালের একটা ধাতব বাক্সের দিকে এগিয়ে গেল। আনলক করল সেটাকে, ঢুকল ভিতরে, তারপর আরো একটা কোড প্রেস করল। অবশেষে তাদের সামনের দরজার ভারি পাল্লা আস্তে করে খুলে গেল। প্রশস্ত হল তাদের পথ।

গার্ড ঘুরে দাঁড়াল, কথা বলল প্রথম বারের মত। এ দরজার শেষ প্রান্তেই আর্কাইভ। এ পর্যন্ত আসার কথা আমার, তার পরই ফিরে গিয়ে অন্য কাজে ব্যস্ত হতে হবে।

চলে যাচ্ছেন আপনি? প্রশ্ন তুলল ভিট্টোরিয়া।

এই পবিত্র আর্কাইভে সুইস গার্ডদের প্রবেশাধিকার নেই। আপনারা এখানে তার একমাত্র কারণ আমাদের কমান্ডার ক্যামারলেনগোর কাছ থেকে একটা সরাসরি আদেশ পেয়েছেন।

তাহলে আমরা বাইরে বের হব কী করে?

মনোডিরেকশনাল সিকিউরিটি। একপথে যাবার সময় এ নিরাপত্তা নিয়ে ভাবা হয়। বেরুনোর পথে আপনাদের কোন সমস্যায় পড়তে হবে না। কথার এখানেই ইতি টেনে মার্চ করে বেরিয়ে গেল প্রহরী।

কিছু কথা বলল ভিট্টোরিয়া, কিন্তু কান দিতে পারল না ল্যাঙডন। তার চোখ সামনের দুই দুয়ারী ঘরের দিকে। কে জানে তার ভিতরে কী রহস্য লুকিয়ে আছে।

 

৪৭.

যদিও সে জানে, হাতে সময় বেশি নেই, তবু ক্যামারলেনগো কার্লো ভেন্ট্রেস্কা আস্তে আস্তে পা ফেলে এগিয়ে যাচ্ছে। ওপেনিং প্রেয়ারের আগে তার মনটাকে গুছিয়ে নেয়া জরুরী। অনেক বেশি কান্ড ঘটে যাচ্ছে অত্যন্ত কম সময়ের মধ্যে। সে সামনে। এগিয়ে যেতে যেতে টের পায় গত পনের বছরের গুরুভার এবার তার কাধে এসে বর্তাবে।

তার পবিত্র দায়িত্ব অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছে সে। সারা জীবন।

ঐতিহ্য অনুযায়ী পোপের মৃত্যুর পর ক্যামারলেনগো ব্যক্তিগতভাবে এগিয়ে যাবে পোপের দিকে। চেষ্টা করবে তার শ্বাস-প্রশ্বাসের শব্দ শোনার। হাত রাখবে পোপের ক্যারোটিড আর্টারিতে, তারপর তিনবার পোপের নাম নিয়ে ডাকবে। নিয়ম অনুযায়ী আর কোন উপায় নেই। সাথে সাথে সে সিল করে দিবে পোপের বেডরুম, ধ্বংস করে দিবে পাপাল ফিসারমেন্স রিং, লাশের রক্ষণাবেক্ষনের ব্যবস্থা করে শেষকৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন করবে। এ পাট চুকলে পরের ধাক্কা আসবে ক্যামারলেনগোর উপরে, কনক্লেভের জন্য প্রস্তুতি।

কনক্লেভ। ভাবল সে, শেষ ঝক্কি-ঝামেলার কাজ। খ্রিস্টানত্বের সবচে পুরনো ঐতিহ্যের একটা এই ব্যাপার। এর পিছনেও অনেক কথা আছে। এটা খ্রিস্টানত্বের প্রতীক হলেও সমালোচনা হয়েছে এ নিয়ে। ভিতরে কী ঘটে সেটা ভিতরের কার্ডিনালরাই ভাল বলতে পারবে। ক্যামারলেনগো জানে, এটা ভুল বোঝাবুঝি ছাড়া আর কিছুই নয়। কনক্লেভ মোটেও ভোটাভুটির মাধ্যমে পাপা নির্বাচন নয়। এটা প্রাচীণ এক পদ্ধতি। ঐশ্বরিক ক্ষমতা বন্টনের পথ। এই ঐতিহ্যের যেন কোন শেষ নেই… গোপনীয়তা, কাগজের ভাঁজ করা দলা, ব্যালটগুলো পুড়িয়ে ফেলা, পুরনো রাসায়নিক দ্রব্যের মিশ্রণ, ধোঁয়ার সিগন্যাল…।

অষ্টম জর্জের এলাকা পেরুতে পেরুতে চিন্তায় পড়ে যায় ক্যামারলেনগো। কী করছেন এখন কার্ডিনাল মাটি? এখনো ধৈর্য ধরে রাখতে পারছেন কি? নিশ্চই মাটি দেখেছেন প্রেফারিতিরা এখনো হাজির হননি। তারা হাজির না থাকলে সারা রাত ধরে ভোটিং চলবে। মাটিকে গ্রেট ইলেক্টর পদে আসীন করাটা বিজ্ঞোচিত কাজ হয়েছে, নিজেকে একটু আশ্বস্ত করে ক্যামারলেনগো। লোকটা মুক্তচিন্তার মানুষ। ভাল সিদ্ধান্ত নিতে জানেন। আজ রাতের মত নেতা আর কোনদিন কনক্লেভের প্রয়োজন পড়েনি।

রাজকীয় সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে ক্যামারলেনগোর মনে হল সে শেষ বিচারের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। এই উচ্চতা থেকেও সে স্পষ্ট টের পেল একশো পঁয়ষট্টি কার্ডিনালের অস্বস্তি মাখা আলোচনা।

একশো একষট্টি জন কার্ডিনাল। শুধরে নিল সে।

এক মুহূর্তের জন্য নিজেকে হারিয়ে ফেলল ক্যামারলেনগো। সে পড়ে যাচ্ছে, পড়ে যাচ্ছে নরকের পাকে, চিৎকার করছে লোকজন, আগুনের লেলিহান শিখা উঠে আসছে তার দিকে, আকাশ থেকে পাথর আর রক্ত বর্ষাচ্ছে।

আর তারপর, নিথর দুনিয়া।

***

যখন শিশু জেগে উঠল, সে স্বর্গে বাস করছিল। তার চারপাশের সব বস্তু শ্বেত বর্ণের। খাঁটি আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে যায়, যদিও সবাই বলে দশ বছরের কিশোর কখনোই স্বর্গের স্বর্গীয়তা বুঝতে পারবে না। কিন্তু দশ বছরের কার্লো  ভেট্রো ঠিক ঠিক চিনে নিতে পারল স্বৰ্গকে। সে এখন ঠিক ঠিক স্বর্গে আছে, আর কোথায় সে থাকতে পারে? তার দশ বছরের ছোট্ট জীবনটায় কালো ঠিক ঠিক ঈশ্বরকে চিনে নিতে পেরেছিল। পাইপ অর্গানের বজ্রনিনাদ, উঁচু উঁচু গম্বুজ, সুরের মূৰ্ছনায় পরিবেশিত সঙ্গীত, আলো করা কাঁচ আর ব্রোঞ্জ ও স্বর্ণের ছড়াছড়ি। কার্লোর মা, মারিয়া তাকে প্রতিদিন সাধারণ্যে নিয়ে আসতেন। গির্জাই কার্লোর আবাসভূমি।

প্রতিদিন আমরা মানুষের সামনে আসি কেন? একটুও রাগ না করে প্রশ্ন করেছিল কার্লো।

কারণ আমি ঈশ্বরের কাছে ওয়াদা করেছিলাম এমনটাই করব। বলতেন মা,, আর ঈশ্বরের কাছে করা প্রতিজ্ঞা আর সব কাজেরচে দামি। স্রষ্টার কাছে দেয়া কোন কথা কখনো ভঙ্গ করবে না।

কার্লো মায়ের কাছে প্রতিজ্ঞা করেছিল, কখনো স্রষ্টাকে দেয়া কোন প্রতিশ্রুতি সে ভাঙবে না। এই পৃথিবীর আর সবকিছুর চেয়ে সে তার মাকে ভালবাসত। তিনি তার কাছে পবিত্র ফেরেশতী। সে তাকে মাঝে মাঝে ডাকত মারিয়া বেন্ডেট্রা-আশীর্বাদপুষ্ট মেরি–নামে, যদিও তিনি তা ঠিক পছন্দ করতেন না। তিনি যখন প্রার্থনায় বসতেন তখন কালো মায়ের সুগন্ধ নিত, আবেশিত হত তার প্রার্থনার সুর লহরীতে। হেইল মেরি, মাদার অব গড… আমাদের পাতকদের জন্য প্রার্থনা করুন… এখন এবং আমাদের শেষ নিঃশ্বাসের সময়টায়…

আমার বাবা কোথায়? প্রশ্ন করত কার্লো। যদিও সে জানে তার বাবা তার জন্মের আগেই মারা গেছে।

ঈশ্বরই এখন তোমার পিতা। সাথে সাথে তিনি জবাব দিতেন নির্দ্বিধায়। কথাটা মনে রেখ, এখন থেকে তোমার বাবা হলেন ঈশ্বর। তিনি তোমার ভালমন্দ দেখবেন, রক্ষা করবেন সব বিপদ থেকে। ঈশ্বরের কাছে তোমাকে নিয়ে অনেক বড় পরিকল্পনা অপেক্ষা করছে, কার্লো। শিশু জানত তার মায়ের কথা অক্ষরে অক্ষরে সত্যি। সে তখনি অনুভব করত, ঈশ্বর মিশে আছেন তার শোণিত ধারায়।

রক্তে,…
আকাশ থেকে রক্তের বর্ষণ!
নিরবতা। তারপরই স্বর্গ।

তার স্বর্গ, যতটা মনে পড়ে কার্লোর, ছিল সান্তা ক্লারা হাসপাতালের ইনটেনসিভ কেয়ার ইউনিট। পালারমোর বাইরে। সে তখন ছিল একটা চ্যাপেলে, সেটা ভেঙে পড়ে সন্ত্রাসীদের বোমা হামলায়। সেখানে সে ছিল, ছিল তার মা, তারা মানুষের সামনে বেরিয়ে এসে ঈশ্বরের মহিমা নিয়ে গুণকীর্তন করছিল। সাইত্রিশজন মারা পড়ে সাথে সাথে। তাদের মধ্যে তার মা-ও ছিলেন। কার্লোর বেঁচে যাওয়াটাকে পত্রিকারা ডাকে দ্য মিরাকল অব সেন্ট ফ্রান্সিস নামে। কার্লো সৌভাগ্যক্রমে ঠিক বিস্ফোরণের আগ মুহূর্তটায় ছিল একটু নিরাপদ কক্ষে। সেখানে সে সেন্ট ফ্রান্সিসের গল্প নিয়ে মেতে ছিল।

ঈশ্বর আমাকে সেখানে ডেকে নিয়েছিলেন, বলত সে নিজেকে, তিনি চাইতেন আমি টিকে থাকি।

ব্যথায় জর্জরিত ছিল কালো। সে এখনো তার মায়ের কথা ঠিক ঠিক মনে করতে পারে। তার মা, একটা মিষ্টি চুমু ছুঁড়ে দিচ্ছিলেন তার দিকে। তারপরই একটা বিস্ফোরণ, শতছিন্ন হয়ে গেল তার মিষ্টি গন্ধ ভরা শরীর। সে আজো মানুষের কদর্য দিকটার কথা মনে করতে পারে। এখনো তার সামনে রক্তের হোলি খেলার দৃশ্য ভেসে বেড়ায়। তার মায়ের শোণিত উপর থেকে পড়ে তার গায়ে! আশীর্বাদপুষ্ট মারিয়ার রক্ত!

ঈশ্বর তোমাকে সব সময় চোখে চোখে রাখবে। সব সময় রক্ষা করবে তোমাকে। বলত মা।

কিন্তু এখন কোথায় সেই ঈশ্বর?

তারপর, মায়ের কথামত এক লোক এল তার কাছে, হাসপাতালে। সে সামান্য কোন মানুষ ছিল না, ছিল একজন বিশপ। সে তাকে নিয়ে প্রার্থনা করল। প্রার্থনা করল তারা জন্য। সেন্ট ফ্রান্সিসের অলৌকিক মহিমার জন্য। তারপর যখন সে সুস্থ হল, সেই বিশপের আওতায় তাকে একটা মনাস্টারিতে জায়গা করে দেয়া হল। আর সবার সাথে শিক্ষা নেয় কালো। তাকে পাবলিক স্কুলে ভর্তি হতে বলল সেই বিশপ, কিন্তু রাজি নয়

কার্লো। এখন সে সত্যি সত্যি তুষ্ট। সে এখন আসলেই বাস করছে ঈশ্বরের ঘরে।

প্রতি রাতে কালো মায়ের জন্য নতজানু হয়ে প্রার্থনা করত।

ঈশ্বর কোন এক উদ্দেশ্য সামনে রেখে আমাকে রক্ষা করেছেন, সব সময় তার ছিল এই এক ভাবনা। কিন্তু কী সেই কারণ?

কার্লোর যখন ষোল বছর বয়স তখন সে ইতালির বাধ্যতামূলক সামরিক ট্রেনিংয়ে অংশ নেয়। সেটা ছিল রিজার্ভ মিলিটারি। এই কাজ থেকে দূরে থাকতে হলে তাকে সেমিনারিতে ভর্তি হতে হবে, বলেছিল তাকে বিশপ। সাথে সাথে বিজ্ঞোচিত জবাব দিয়েছিল সে, তার প্রিস্ট হবার ইচ্ছায় কোন খাদ নেই, কিন্তু সে খারাপকে চেখে

দেখতে চায়।

কিন্তু কথাটার মর্ম বুঝতে পারল না বিশপ।

সে খুলে বলল, যদি সে চার্চে থেকে সারা জীবন মন্দের হাত থেকে দূরে থাকার কাজ করে তবে আগে তাকে অবশ্যই মন্দ কী তা বুঝতে হবে, জানতে হবে। সে বুঝতে পারছিল, সামরিকতা ছাড়া মন্দকে খুব দ্রুত আর কোথাও চিনতে পারা যাবে না। সেনাবাহিনী গোলা বারুদ নিয়ে কায়-কারবার করে। একটা বোমার আঘাতেই আমার আশীর্বাদপ্রাপ্ত মা ইহলোক ত্যাগ করেছিলেন।

বিশপ তাকে সামরিক বাহিনী থেকে যথা সম্ভব দূরে রাখার চেষ্টা করল। কিন্তু মন স্থির করে ফেলেছে কার্লো।

কিন্তু সাবধান, আমার পুত্র! বলেছিল বিশপ, আর মনে রেখ, চার্চ তোমার, প্রত্যাবর্তনের আশায় দিন গুণবে।

কার্লোর দু বছরের সামরিক চাকুরি আসলেই নরকে কেটেছিল। কার্লোর মত মেঘমন্দ্র, তার ভাবনা সুচিন্তিত, তার ধী স্থির, কিন্তু সামরিক বাহিনীতে এসবের কোন মূল্য নেই। এখানে নিরবতার কোন স্থান নেই। অষ্টপ্রহর শব্দ আর শব্দ। চারধারে অতিকায় যন্ত্র, শান্তির জন্য বরাদ্দ নেই একটা ঘণ্টাও। যদিও সৈন্যরা সপ্তাহে একদিন ছুটি পায়, কেউ কেউ চার্চেও যায়, তবু কালো তার সহকর্মীদের মধ্যে ঈশ্বরের ছায়া দেখতে পায়নি। তাদের মনে-মগজে ধ্বংস সব সময় দামামা বাজায়। ঝংকার তোলে ইন্দ্রিয় কাঁপিয়ে। প্রকম্পিত করে তোলে মনোজগত।

নতুন জীবনকে মনেপ্রাণে ঘৃণা করতে শেখে কালো। ফিরে যেতে চায় শান্তির বসতে। কিন্তু হাল ছাড়ার পাত্র নয় সে। এখনো মন্দকে চেখে দেখতে হবে তাকে। সে অস্ত্র তুলে নিতে অস্বীকার করল, তাই সামরিক বাহিনী তাকে মেডিক্যাল হেলিকপ্টার চালানো শিখাতে চায়। সে শব্দকে ঘৃণা করে, ঘৃণা করে এই যান্ত্রিকতা, কিন্তু সেই হেলিকপ্টারই তাকে নিয়ে যায় মাটির পৃথিবী থেকে উপরে, তার মায়ের কাছাকাছি। যখন কার্লো জানতে পারল এ ট্রেনিংয়ের সাথে আরো আছে প্যারাস্যুটের কারসাজি, সে ব্যাপারটাকে ঠিক মেনে নিতে পারল না। কিন্তু পা বাড়িয়ে রাখা হয়েছে। আর কোন উপায় নেই।

ঈশ্বর আমাকে রক্ষা করবেন। বলে সে নিজেকে।

কার্লোর প্রথম প্যারাস্যুট ট্রেনিং ছিল তার জীবনে সবচে কষ্টকর অভিজ্ঞতার একটা। একই সাথে দামি। যেন ঈশ্বরকে পুঁজি করে সে উড়ছে, উড়ছে তার সাথে। ব্যাপারটার সাথে তাল মিলিয়ে নিতে পারল না কার্লো… সেই নৈঃশব্দ… সেই ভেসে থাকা… সে মেঘের সাদা এলাকা পেরিয়ে নিচের ভূমিতে ফিরে আসতে আসতে দেখতে পায় মায়ের মুখ, মেঘমালাতে। তোমাকে নিয়ে ঈশ্বরের পরিকল্পনা আছে, কালো। মিলিটারি থেকে ক্ষান্ত দিয়ে ফিরে এসে কার্লো যোগ দেয় সেমিনারিতে।

সেটা তেত্রিশ বছর আগের কথা।

 

রাজকীয় সিঁড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আছে ক্যামারলেনগো কার্লো ভেন্ট্রেস্কা, সে মনে করার চেষ্টা করে সেই সময়টার কথা। বেরিয়ে আসতে চায় তারপর। আসতে চায় বর্তমানে।

দূর করে দাও সব ভীতি, বলল সে, আর আজকের রাতটাকে ছেড়ে দাও ঈশ্বরের হাতে।

সিস্টিন চ্যাপেলের বিশালবপু ব্রোঞ্জ গেটটা সে দেখতে পাচ্ছে এখন স্পষ্ট। চারজন সুইস গার্ড আড়াল করে রেখেছে পথটাকে। গার্ডরা পাল্লা খুলে দেয়ার জন্য বিশাল ছিটকিনি খুলল। ভিতরের প্রত্যেক চেহারা ঘুরে গেছে এদিকে। ক্যামারলেনগো তার সামনের কালো রোব আর লাল কাপড়ের ঢাকনার দিকে অবাক চোখে তাকিয়ে থাকে। কিছুক্ষণ। হঠাৎ সে বুঝে যায় তার জন্য ঈশ্বরের কী পরিকল্পনা ছিল।

নিজেকে ক্রস করে নিয়ে পা ফেলে ক্যামারলেনগো সিস্টিন চ্যাপেলের ভিতরে।

 

৪৮.

বিবিসি সাংবাদিক গুন্টার গ্লিক সেন্ট পিটার্স স্কোয়ারে বিবিসির ভ্যানে বসে দরদর করে ঘামতে ঘামতে গালি দিয়ে একসা করছে তার এডিটরকে। কেন এই মরার কাজে তাকে টেনে আনা। যদিও তার প্রথম মাসের কাজের পর অনেক বা জুটেছে কপালে–মেধাবী, দক্ষ, নির্ভরতার পাত্র-তবু এই এখানে বসে বসে শুধু শুধু মাছি মারাটা তার মোটেও ভাল লাগছে না। যদিও বিবিসি তাকে শাবাস জানাতে দ্বিধা। করেনি, তবু এভাবে রিপোর্ট করাটা তার আইডিয়া ছিল না।

গ্লিকের এ্যাসাইনমেন্টটা একেবারে সরল। সে এখানে বসে বসে মাছি তাড়াবে আর তারপর, বুড়োদের দল তাদের নূতন বুড়োকে নির্বাচিত করলে সে পনের সেকেন্ডের লাইভ অনুষ্ঠান প্রচার করবে, আর কিছু নয়। পিছনে থাকবে ভ্যাটিকান সিটির অবয়ব।

ব্রিলিয়ান্ট!

গ্লিক ভেবে পায় না কী করে বিবিসি এখানে রিপোর্টার পাঠায় আরো। তোমরা কি চোখে ঠুলি পরিয়েছ? আমেরিকান নেটওয়ার্ক এখানে ঢু মারছে সে ব্যাপারটা কি চোখে পড়ে না? এখানে পড়ে আছে সিএনএন। তারাও ওৎ পেতে বসে আছে। বসে আছে এমএসএনবিসি। তাদের প্রস্তুতি আরো ঝকমারি। কৃত্রিম বর্ষার ব্যবস্থা করাই আছে। লোকে আর খবর শুনতে চায় না, চায় বিনোদন।

উইন্ডশিল্ড দিয়ে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আরো আরো বিরক্ত হয়ে পড়ে গ্লিক। সামনেই ভ্যাটিকানের রাজকীয় পাহাড়ে বসে আছে গোটা ভ্যাটিকান সিটি। লোকে এখানে মনোযোগ দেয়ার মত কী পায় ঈশ্বরই জানে।

আমি আমার জীবনে কী পেলাম? নিজেকেই সে প্রশ্ন করে সশব্দে, কিস্যু নয়। একেবারে ফাঁকা।

তাহলে হাল ছেড়ে দাও, সাথে সাথে তার পিছন থেকে একটা মেয়ে কন্ঠ বলে উঠল।

লাফ দিয়ে উঠল গ্লিক। সে যে একা নয় এ কথাটাই বেমালুম ভুলে বসেছিল। ফিরে তাকায় যেখানে তার ক্যামেরা ওমান চিনিতা মার্চি বসে বসে তার চশমার কাঁচ পরিষ্কার করছে। এই মেয়েটা সর্বক্ষণ কাঁচ ঘষতে ঘষতে পার করে দেয়। চিনি কালো। এম্নিতে আফ্রিকান আমেরিকানদের প্রতি তার ভাল সহমর্মিতা আছে, কিন্তু আদপে চিনি বিশাল। সে কখনোই কাউকে ভুলে যেতে দিবে না যে সে একজন কালো মানিক। আর গ্লিক তাকে ভালই পছন্দ করে। এখন এই সঙ্গটুকু উপভোগ করতে বাকি।

সমস্যা কী, গান্থ? জিজ্ঞেস করে চিনি।

কী করছি আমরা এখানে?

এক অসাধারণ ব্যাপার দেখছি। এখনো মনোযোগ দিয়ে গ্লাস পরিষ্কার করছে সে।

বুড়ো মানুষগুলো কালিগোলা অন্ধকারে ডুবে আছে এটা খুব বেশি দর্শনীয় ব্যাপার হল?

তুমি ভাল করেই যান যে তোমার শেষ গন্তব্য নরক, জান না?

এখন তাহলে কোথায় আছি?

আমার সাথে কথা বল, যেন শাসাচ্ছে মা কোন দস্যি ছেলেকে।

আমি শুধু অনু করছি, আমার মাথা থেকে সব প্রশংসা উবে যাচ্ছে।

তুমি ব্রিটিশ ট্যাটলারের জন্য আবেদন করেছ?

হুঁ। কিন্তু এতে কোন বদ নিয়ত নেই।

কাম অন! আমি মনে করেছি তুমি একটা দুনিয়া কাঁপানো আর্টিকেল লিখেছ পত্রিকায়, রাণীর সাথে এলিয়েনদের যৌন সম্পর্কের ব্যাপারে।

থ্যাঙ্কস।

হেই, বিধাতা চোখ তুলে তাকিয়েছে। আজ রাতে তুমি জীবনে প্রথমবারের মত পনের সেন্ডের শট নিতে যাচ্ছ, তাও আবার লাইভ।

ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে উঠল গ্লিক। সে এখনি বাহবাটার কথা বলে দিতে পারে, থ্যাঙ্কস গুর, গ্রেট রিপোর্ট। তারপর তার দিক থেকে চোখ চলে যাবে প্রকৃতির দিকে, আমার

একটা স্থির অবস্থান দরকার।

হাসল মাক্রি, এই অভিজ্ঞতার ঝোলা আর মুখটাকা দাড়ি নিয়ে?

হাত বোলাল গ্লিক তার জঙ্গুলে দাড়িতে, আমি মনে করেছিলাম এগুলো থাকলে আমাকে আরো বুদ্ধিমান বুদ্ধিমান লাগে।

কপাল ভাল। গ্লিক আরো একবার হেরে বসার আগে ভ্যানের সেল ফোনটা বেজে উঠল। মনে হয় এডিটর। বলল সে। আশায় চকচক করছে তার চোখে। কী মনে হয়, কোন লাইভ আপডেট জানতে চাইবে কি তারা?

এই কাহিনীর উপর? হাসল ম্যাক্রি আবারও, স্বপ্ন দেখতে থাক। দোষ নেই কোন এ কাজে।

যথা সম্ভব ভারিক্কি চালে গ্লিক তুলে নিল ফোনটা। গুন্টার গ্লিক, বিবিসি, ভ্যাটিকান সিটি থেকে সরাসরি।

লাইনের লোকটার স্বরে আরবি টানের সুস্পষ্ট চিহ্ন, মনোযোগ দিয়ে শুনুন। বলল সে, আমি আপনার জীবনটা বদলে দিতে যাচ্ছি।

 

৪৯.

ল্যাঙডন আর ভিট্টোরিয়া এখন একা একা দাঁড়িয়ে আছে গোপন আর্কাইভের দুই দুয়ারের সামনে। সামনে দেয়াল থেকে দেয়ালে চলে যাওয়া গালিচা, নিচে মর্মরের মেঝে, উপরে সিকিউরিটির ওয়্যারলেস ক্যামেরা। ভেবে পায় না ল্যাঙডন, এটা কোন বিশোধিত রেনেসাঁ নয়ত? সামনে ছোট্ট একটা ব্রোঞ্জের প্লেট, তাতে লেখা :

আর্কিভিও ভ্যাটিকানো
কিউরেটরে, পাদ্রে জ্যাকুই টমাসো

ফাদার জ্যাকুই টমাসো। ল্যাঙডন তার ঘরে রাখা ফিরিয়ে দেয়ার চিঠিগুলোতে লেখা নামটা মনে করতে পারছে ভালভাবেই। প্রিয় জনাব ল্যাঙডন, আমি অতীব দুঃখের সহিত জানাইতেছি যে, ভ্যাটিকানের আর্কাইভে আপনার প্রবেশাধিকার দিতে পুনর্বার। অপারগতা প্রকাশ করিতে হইতেছে…

দুঃখের সহিত জানানো। গোবর! জ্যাকুই টমাসোর রাজত্ব শুরু হবার সময় থেকে কোন নন ক্যাথলিক আমেরিকানকে দেখতে পায়নি যে ভ্যাটিকান আর্কাইভে প্রবেশ করতে পেরেছে। এল গার্ডিয়ানো, তাকে ব্যঙ্গ করে ডাকত ইতিহাসবেত্তারা। জ্যাকুই টমাসসা ইহধামের সবচে রক্ষণশীল কিউরেটর, সবচে কর্কষ লাইব্রেরিয়ান। ভিতরে প্রবেশ করার সময়ই মনে মনে একবার দেখে নেয় ল্যাঙডন কিউরেটরকে। সে পরিপূর্ণ সামরিক সাজে সজ্জিত, তার পাশে বাজুকা হাতে একজন সৈনিক। কিন্তু না। ব্যাপারটা তেমন নয়। পুরো এলাকা জনশূণ্য। খাঁ খাঁ করছে।

নিরবতা আর নিবু নিবু আলো।

আর্কিভিও ভ্যাটিকানো। তার জীবনের সবচে মূল্যবান মুহূর্তগুলোর একটা। ভিতরে চোখ রেখেই মৃদু একটা ধাক্কা খেল ল্যাঙডন। কল্পনার চোখে কী বিচিত্ৰই ছিল ভ্যাটিকান সিটির আর্কাইভ। তার সাথে মোটেও মিলছে না আসল চিত্র। সে কল্পনায় দেখেছিল ধূলিপড়া অতিকায় বুকশেলফগুলো দাঁড়িয়ে থাকবে, সেখানে শোভা পাবে সোনার জলে আকা, চামড়ার মলাটে বাঁধানো বিরাট বিরাট সব বই। সামনে থাকবে আলো-আঁধারি, থাকবে ধর্মনেতাদের উপস্থিতি। নিবিষ্টচিত্তে তারা পড়ালেখা করবে ভিতরে…। কল্পনার ধারকাছ দিয়েও বাস্তব যাচ্ছে না।

প্রথম দৃষ্টিতে যা মনে হল, সামনের এলাকাটা বিশাল কোন হ্যাঙ্গার, আর তার ভিতরে বিরাট বিরাট নাড়াতে পারা মাঠ। এমন প্রতিরক্ষাই থাকার কথা। ভিতরে থাকবে বই, বাইরে কাঁচ। তার মাঝখানে বায়ুশূণ্য স্থান। বাতাসের জলীয়বাষ্প আর ভেসে বেড়ানো এসিড খুব সহজেই ক্ষয়িষ্ণু ভলিউমগুলোকে তুবড়ে ফেলতে পারে। নষ্ট করে ফেলতে পারে বইগুলোকে। তাই তাদের এভাবেই সংরক্ষণ করতে হবে। আর কোন উপায় নেই। সংরক্ষিত ভল্টে ভিট্টোরিয়া কখনো না গেলেও ল্যাঙডন বহুবার গিয়েছে। তাও এ পরিস্থিতির কোন তুলনা নেই… এমন কোন একটা বদ্ধ কন্টেইনারে আটকে পড়া যেখানে লাইব্রেরিয়ানের ইচ্ছানুসারে অক্সিজেন সরবরাহ আসবে।

ভল্টগুলো কালো, ভল্টগুলোর শেষপ্রান্তে আলোর ক্ষীণ একটা রেখা দেখা যাচ্ছে স্পষ্ট। এখানে লুকিয়ে আছে অযুত রহস্য, যা আর সবার সামনে প্রকাশ করা যাবে না। যেন পুরনোদিনের ইতিহাস মুখ ব্যাদান করে আছে। এ সঞ্চয়ের কোন তুলনা নেই।

ভিট্টোরিয়াও যেন মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছে। বিশাল আকারের স্বচ্ছ কাচের দিকে তাকিয়ে সেও পাশে পাশে দাঁড়িয়ে আছে।

হাতে সময় বেশি-নেই। একটুও দেরি করতে রাজি নয় ল্যাঙডন, তার দরকার একটা বিশাল বপু এনসাইক্লোপিডিয়া যেটায় নজর বুলিয়ে জানতে পারা যাবে কোন কোন বই আছে এখানে। তারপর যা দেখা গেল, ঘরের প্রান্তে প্রান্তে কম্পিউটার সাজানো। দেখেশুনে মনে হচ্ছে তারা সমস্ত বইয়ের ক্যাটালগ কম্পিউটারাইজড করে ফেলেছে।

আশান্বিত দেখাচ্ছে ভিট্টোরিয়াকে, এমন হয়ে থাকলে কাজ হয়ে যাবে আলোর গতিতে।

ল্যাঙডন আশা করে তার উচ্ছ্বাসটা ভাল। কিন্তু আসলে সে বেশ দ্বিধায় পড়ে গেছে। কম্পিউটারাইজড করা হলে শাপে বরের বদলে বরে শাপ হতে পারে। একটা টার্মিনালের দিকে এগিয়ে গিয়ে সে টাইপ করা শুরু করল। তার মনে সন্দেহ দানা বঁধছে। পুরনো নিয়মই ভাল ছিল।

কেন?

কারণ সত্যিকার বইগুলোতে পাসওয়ার্ড প্রটেকশন নেই। মনে হয় না ফিজিসিস্টরা স্বভাবসুলভ হ্যাকার।

মাথা ঝাঁকাল ভিট্টোরিয়া, আমি এক-আধটু চেষ্টা করে দেখতে পারি। এই যা।

লম্বা করে একটা দম নিয়ে ল্যাঙডন ফিরে তাকাল ভল্টগুলোর দিকে। সবচে কাছেরটার দিকে এগিয়ে গিয়ে সে চোখ ফেলল ভিতরে। ভিতরে থরে বিথরে বই সাজানো। বুক শেলফ, পার্চমেন্ট বিন আর একজামিনেশন ট্যাবলেট। প্রত্যেক বইয়ের সারির শেষ মাথায় জ্বলজ্বলে ট্যাব আছে। এই সারিতে কী কী বই আছে সেটা লেখা সেখানে। স্বচ্ছ বাধার সামনে সারিবদ্ধ নামগুলো সে দেখতে থাকে।

পিয়েট্রো লেরেমিটা… লা ক্রসিয়াটে… আরবানো টু… লেভান্ট…

লেবেল এঁটে দিয়েছে বইগুলোর গায়ে। বলল সে, হাঁটছে এখননা, কিন্তু এখানে লেখকদের নাম অনুসারে বর্ণক্রমে সাজানো নেই। অবাক হয়নি সে। পুরনো দিনের লাইব্রেরিগুলোতে লেখকের নাম অনুসারে বইয়ের তালিকা দেয়া থাকে না কারণ অনেক অনেক বইয়ের লেখকের নাম অজানা। আর অনেক অনেক ঐতিহাসিক বইয়ের বদলে চিঠিপত্র আর ছেঁড়াখোরা পাতা, পার্চমেন্টও থাকে। যাই হোক, এই ক্রমবিন্যাস কোন কাজে লাগবে না।

ভিট্টোরিয়ার দিকে তাকাল ল্যাঙডন, তার চোখে হতাশা, মনে হচ্ছে ভ্যাটিকান আর্কাইভের নিজস্ব রীতি আছে।

আসলেই, চমক বলা চলে।

আবার সে লেবেলগুলো একবার পরখ করে দেখে। বইগুলোর নামে ক্রম ঠিক বোঝা যাচ্ছে না। কিন্তু সে অনুভব করছে, কোন না কোন সূত্রে সেগুলোকে সাজিয়ে রাখা হয়েছে। মনে হয় কোন গাণিতিক নিয়ম রক্ষা করে বইয়ের তালিকা রাখা আছে।

গাণিতিক? বলল ভিট্টোরিয়া, তার চোখে হতাশা, খুব একটা কার্যকর বলে মনে হচ্ছে না।

আসলে… ভাবল ল্যাঙডন, আরো কাছ থেকে ব্যাপারটা নিরীক্ষণ করছে সে, এ হয়ত আমার দেখা সবচে কিম্ভুত ক্যাটালগিং সিস্টেম। সে সব সময় তার ছাত্রদের বলে এসেছে, পুরো ব্যাপার বুঝে ওঠার চেষ্টা করতে হবে। যেখানে যে সুর ধ্বণিত হয় সেটাই বোঝার চেষ্টা করতে হবে। এখন মনে হচ্ছে এই ভ্যাটিকান আর্কাইভের রীতিও তেমন কিছু, বেসুরো কোন সুর,

এই ভল্টের সবগুলো ব্যাপারকে দেখে মনে হচ্ছে, বলল সে, অবশেষে, এখানকার সব বই ক্রুসেড বিষয়ক… শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে ধর্মযুদ্ধের উপরে লেখাগুলো জায়গা পেয়েছে। সব আছে এখানে, অনুভব করল সে। ঐতিহাসিক ব্যাপার, চিঠিপত্র, আর্টওয়ার্ক, রাজনৈতিক-সামাজিক তথ্য, আধুনিক বিশ্লেষণ। এক জায়গায় সব মিলেমিশে গুবলেট হয়ে গেছে… যে কোন একটা বিষয়ে গভীর মনোেযোগ দেয়া সম্ভব। ব্রিলিয়ান্ট।

তেতে উঠল ভিট্টোরিয়া, কিন্তু ডাটাকে বিভিন্ন পদ্ধতিতে সাজানো যায়।

আর তাই তারা বহুমাত্রিক পদ্ধতিতে ব্যাপারটাকে সাজিয়েছে… একটা সেকেন্ডারি ইন্ডিকেটরের দিকে হাত নির্দেশ করল ল্যাঙডন, এগুলো দিয়ে আরো অন্য বিষয়ের সাথে যুক্ত হওয়া যায়।

অবশ্যই, বলল মেয়েটা, কোমরে হাতদুটা রেখে সে সারা আর্কাইভের বিশাল ঘরের দিকে একবার দৃষ্টি বুলিয়ে নিল। তারপর তাকাল ল্যাঙডনের দিকে, তো, প্রফেসর, আমরা যা খুজছি, এই গ্যালিলিও-লেখাটার নাম কী?

হাসা ছাড়া আর গত্যন্তর নেই ল্যাঙডনের। তাকাল সে ঘরটার চারদিকে, তারপর নিজেকে শুনিয়ে বলল, আছে, এখানেই কোথাও আছে। অপেক্ষা করছে আমার জন্য, মৃদু আলোর কোন কোণে…

ফলো মি। বলল ল্যাঙডন, তাকাল ইন্ডিকেটরগুলোর দিকে। মনে মনে একটু হিসাব কষে নিয়ে বলল, মনে আছে তো? ইলুমিনেটি কীভাবে পথ বের করত? বলেছিলাম না নতুন সদস্যরা কীভাবে চিনে নিত?

গুপ্তধন উদ্ধার করা। বলল ভিট্টোরিয়া, কাছ থেকে দেখতে দেখতে।

চিহ্নগুলো ঠিক মত বসানোর পর তাদের আরো একটা কাজ করা বাকি থেকে যায়। জানানো। জানাতে হয় নতুন বিজ্ঞানীদের, কী করে প্রতীকগুলো চিনে নিবে।

লজিক্যাল। বলল ভিট্টোরিয়া, নাহলে কেউ কশ্মিন কালেও চিহ্নের ব্যাপারটা জানতে পারবে না।

ঠিক তাই। এমনকি যদি তারা জানতেও পারত যে চিহ্নগুলো আছে, তবু বিজ্ঞানীরা জানতেও পারত না কোথা থেকে পথটা শুরু হবে। আদ্যিকাল থেকেই রোম অনেক বড় এক মহানগরী।

ওকে।

পরের সারির দিকে চোখ রেখে ল্যাঙডন বলে চলল। বছর পনের আগে এক বিজ্ঞানী সূত্র আবিষ্কার করে। ইলুমিনেটির সূত্র। দ্য সাইনো।

সাইন। পথটা কোথা থেকে শুরু হল তার হদিস।

ঠিক তাই। এবং তার পর থেকে অনেক অনেক ইলুমিনেটি এ্যাকাডেমিক, আমি সহ, সাইনোর ব্যাপারটা বের করতে পারি। আজ এটা স্বীকৃত সত্যি যে সাইনো বলে কিছু একটা ছিল এবং গ্যালিলিয় বিজ্ঞানীদের কাছে যুগযুগ ধরে ইলুমিনেটির পথে এই চিহ্নগুলো কাজ করে এসেছে। বিন্দুমাত্র বুঝতে পারেনি ভ্যাটিকান।

কীভাবে?

তিনি অনেক অনেক বই লিখেছেন। ছাপিয়েছেন সেগুলোকে। বছরের পর বছর ধরে।

নিশ্চই ভ্যাটিকান ঠিক ঠিক দেখেছিল? দেখেশুনে মনে হচ্ছে ব্যাপারটা অনেক ঝুঁকিপূর্ণ।

ঠিক তাই। সাইনো প্রচার করা হয়েছে।

কিন্তু কেউ কোনদিন সেটা জানতে পারেনি?

না। ব্যাপারটা বেখাপ্পা হলেও, সাইনোর চিহ্ন যাই হোক না কেন–মেসনিক ডায়েরিগুলোয়, আগের দিনের সায়েন্টিফিক জার্নালে, ইলুমিনেটির চিঠিগুলোতে একটা নাম্বার দিয়ে ব্যাপারটাকে মাঝে মাঝে প্রকাশ করা হত।

সিক্স সিক্স সিক্স?

হাসল ল্যাঙডন, না। আসলে ছিল ফাইভ ও থ্রি।

অর্থ?

আমাদের কেউ এখনো অর্থটা বের করতে পারিনি। ফাইভ ও প্রি নিয়ে আমি আমি কম গলদঘর্ম হইনি। সংখ্যাতত্ত্ব, মানচিত্র চিহ্ন, ভূতাত্ত্বিক অবস্থান–নানাভাবে ব্যাপারটাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছি আমরা। সারির শেষ মাথায় চলে গিয়ে ল্যাঙডন পরের সারির দিকে চোখ বুলাতে বুলাতে বলে গেল। অনেক বছর ধরে ফাইভ ও থ্রির একমাত্র যে সূত্রটা আমরা বের করতে পারলাম তা হল, ব্যাপারটা শুরু হচ্ছে ফাইভ দিয়ে। এ সংখ্যাটা ইলুমিনেটির গোপনীয় নাম্বারের মধ্যে একটা। থামল সে একটু।

আমার মন কেন যেন বলছে সম্প্রতি তুমি ফাইভ ও থ্রির একটা সুরাহা করতে পেরেছ এবং সেজন্যই আমরা আজ এখানে।

ঠিক কথা। বলল ল্যাঙডন। একটা মুহূর্তের জন্য তার গর্বকে সমুন্নত করে রাখল সে। তুমি কি গ্যালিলিওর একটা বইয়ের নামের সাথে পরিচিত? নাম ডায়াললাগো?

অবশ্যই। বিজ্ঞানীদের মধ্যে অত্যন্ত পরিচিত। বৈজ্ঞানিক কর্মধারার এক ঐশীবাণী বলা চলে বইটাকে।

ষোলশো ত্রিশের প্রথমদিকে গ্যালিলিও একটা বই প্রকাশ করতে চান। তিনি কোপার্নিকাসের সূর্য কেন্দ্রীক সৌরজগতের মডেল নিয়ে আলোচনা করতে চান সেটায়। কিন্তু ভ্যাটিকান সিটি বইটাকে প্রকাশ করতে দিবে না যে পর্যন্ত না গ্যালিলিও চার্চের পৃথিবীকেন্দ্রীক মডেলের ব্যাপারে যথাযথ যুক্তি দেখিয়ে সেটাকেও সমুন্নত না করছেন। এমন এক মডেলকে সত্যি বলে প্রমাণ করতে হবে যেটাতে গ্যালিলিওর মোটেও বিশ্বাস। নেই। তাই আর কোন পথ থাকল না তার। তিনি দু মডেলেরই পক্ষে বিপক্ষে বিস্তর কাহিনী রেখে লিখলেন বইটাকে।

যদ্দূর মনে হয়, বলল ল্যাঙডন, তুমি জান যে এ বইটার জন্যে আজো বিতর্ক দানা বাঁধে মানুষের মনে। এটার জন্যই ভ্যাটিকান গ্যালিলিওকে বন্দী করে ফেলে।

কোন ভাল কাজই শাস্তি ছাড়া করা যায় না।

হাসল ল্যাঙডন, একেবারে সত্যি কথা। গৃহবন্দি হয়ে থাকার সময়টায় তিনি আরো একটা বই লেখেন। অনেক স্কলারই এটাকেও ডায়ালোগোর সাথে গুলিয়ে ফেলে। আসলে তার নাম ডিসকর্সি।

নড করল ভিট্টোরিয়া, আমি এটার কথাও জানি। ডিসকোর্সেস অন দ্য টাইড।

অবাক হয়ে গেল ল্যাঙডন মেয়েটার কথা শুনে। সে কিনা জোয়ার ভাটার উপর গ্রহগুলোর প্রভাব বিষয়ক বইটার কথাও জানে!

হেই! বলল মেয়েটা, তুমি একজন ইতালিয় মেরিন ফিজিসিস্টের সাথে কথা বলছ যার বাবা গ্যালিলিওর আরাধনা করতেন।

হাসল ল্যাঙডন। তারা ডিসকর্সির খোঁজে জান জেরবার করছে না। ল্যাঙডন ব্যাখ্যা করল, ডিসকর্সিই গ্যালিলিওর গৃহবন্দি হয়ে থাকার সময় একমাত্র লেখা বই নয়। ইতিহাসবিদরা মনে করে তিনি সেই সময়টায় আরো একটা বই লিখেছিলেন। ডায়াগ্রামা।

ডায়াগ্রামা ডেলা ভেরিটা, বলল ল্যাঙডন, ডায়াগ্রাম অব টুথ।

এ নাম কখনো শুনিনি।

অবাক হইনি মোটেও। ডায়াগ্রামা গ্যালিলিওর সবচে গোপনীয় কাজগুলোর মধ্যে একটা। বলা উচিৎ এককভাবে সবচে গোপনীয়। তিনি এমন সব বৈজ্ঞানিক ব্যাপার সেখানে আলোচনা করেছেন যেগুলোকে তিনি সত্যি বলে জানতেন কিন্তু প্রকাশ্যে বলতে পারতেন না। তার আর অনেক লেখার মত এটাও গোপনে রোম থেকে তার এক বন্ধুর মাধ্যমে বাইরে চালান করে দিয়ে হল্যান্ড থেকে সেটাকে প্রকাশ করা হয়। ইউরোপিয় গুপ্ত বৈজ্ঞানিক সমাজের কাছে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয় লেখাটা। ভ্যাটিকান এটার গন্ধ টের পেয়ে বই পোড়ানোর উৎসব শুরু করে।

চোখ তুলে তাকাল আবার মেয়েটা, বলল, আর তুমি মনে কর ডায়াগ্রামাতেই সেই সত্যের সন্ধান আছে? সেটা আসলে শুধু কোন মামুলি বই নয়, বরং তার ভিতরেই লুকিয়ে ছিল সংকেতটা, যেটা ইউরোপের সমস্ত বিজ্ঞানীকে আকৃষ্ট করে ইলুমিনেটির দিকে, যেটা থেকে তারা জানতে পারে কীভাবে ইলুমিনেটির সন্ধান পাওয়া যাবে? দ্য সাইনো? দ্য পাথ অব ইলুমিনেশন?

ডায়াগ্রামাতেই আসলে গ্যালিলিও পথটার সন্ধান ভরে রেখেছিলেন। আমি নিশ্চিত। ল্যাঙডন চলে গেল তৃতীয় সারির দিকে, ট্যাবগুলো দেখতে দেখতে বলে গেল এক সুরে, আর্কাইভিস্টরা ডায়াগ্রামার একটা কপি পাবার জন্য প্রাণপাত করতে প্রস্তুত। অনেক বছর ধরে। কিন্তু ভ্যাটিকানের বই পোড়ানোর উৎসব আর পুস্তিকাটার গোপনীয়তার কারণে পারমানেন্স রেটিংয়ের জন্য পৃথিবীর মুখ থেকে হাপিস হয়ে যায় বইটা।

পারমানেন্স রেটিং?

টিকে থাকার কাল। আর্কাইভিস্টরা বইকে দশের মধ্যে একটা রেটিং দেয়, যেটা বইয়ের কাগজ টিকে থাকার সময়কাল উল্লেখ করে। ডায়াগ্রামা প্রিন্ট হয়েছিল সিজ প্যাপিরাসে। জিনিসটার সাথে টিস্যু পেপারের সাথে তুলনা চলে শুধু। এর জীবদ্দশা এক শতাব্দির বেশি হবে না।

এরচে শক্ত পোক্ত কোন কাগজ নয় কেন?

এটাও গ্যালিলিওর চালাকি। তার অনুসারীদের টিকিয়ে রাখার কৌশল। যদি কোন বিজ্ঞানী একটা বই সহ ধরা পড়ে যায় তাহলে সোজা সে বইটাকে পানিতে ছেড়ে দিবে। হাপিস হয়ে যেতে বেশি সময় নিবে না সেটা প্রমাণ লুকিয়ে ফেলার চমৎকার কৌশল। কিন্তু আর্কাইভিস্টদের জন্য ব্যাপারটা দুঃখজনক। বলা হয়ে থাকে, অষ্টাদশ শতাব্দির পর একটা মাত্র ডায়াগ্রামার কপি টিকে ছিল।

একটা? আর এখানেই আছে সেটা? কপালে চোখ উঠে গেল মেয়েটার। বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছে তার।

গ্যালিলিওর মৃত্যুর পরপর ভ্যাটিকান সেটাকে উদ্ধার করে নেদারল্যান্ড থেকে। আমি এটাকে খুঁজে পাবার আশায় হন্যে হয়ে গেছি যখন থেকে জানতে পারলাম এটার ভিতরে কী আছে।

ল্যাঙডনের মনের লেখা পড়তে পেরে সাথে সাথে ভিট্টোরিয়া চলে গেল অন্য প্রান্তে। বইটা খোঁজার চেষ্টার গতি দ্বিগুণ করার জন্য।

থ্যাঙ্কস, বলল সে, খুজছি এমন কোন রেফারেন্স ট্যাব যেটাতে গ্যালিলিওর কোন

কোন সূত্র আছে, একটু-আধটু নামটা থাকলেও চলবে। সায়েন্স, সায়েন্টিস্ট পেলেও চলে। দেখলেই তুমি বুঝতে পারবে।

ঠিক আছে। কিন্তু এখনো বললানি ঠিক কীভাবে বুঝে উঠতে পারব যে এখানে গ্যালিলিওর কু আছে। ইলুমিনেটির চিঠিগুলোতে যে লেখাগুলো আছে তার সাথে কোন সম্পর্ক নেইতো? কিম্বা ফাইভ ও থ্রির সাথে?

হাসল ল্যাঙডন, আসলেই। আমি প্রথমে যোগ-সাজসটা টের পাইনি। কিন্তু এই ফাইভ ও থ্রির সাথে ভাল যোগ আছে অন্যান্য সূত্রের। আছে সরল একটা ব্যাখ্যা। এটার সাথে সরাসরি ডায়াগ্রামার যোগসূত্র আছে।

এক মুহূর্তের জন্য ল্যাঙডন চলে গেল দু বছর আগের ষোলই আগস্টে। তার এক কলিগের ছেলের বিয়ের দাওয়াতে গিয়ে সে হ্রদের ধারে দাড়িয়ে ছিল। তারপর সেই লেকে ভেসে বেড়াতে লাগল একটা ফুলে ফুলে ছাওয়া প্রমোদতরী। অবাক হয়ে ল্যাঙডন জিজ্ঞেস করল কনের বাবাকে, সিক্স ও টুর সাথে কী সম্পর্ক?

সিক্স ও টু?

ডি সি আই আইর অর্থ রোমান অক্ষরে সিক্স ও টু।

হাসল লোকটা, এটা কোন রোমান অংক নয়। বরং ভাসতে থাকা বার্জটার নাম। ডিসি টু।

দ্য ডিসি টু?

নড করল লোকটা, দ্য ডিক এ্যান্ড কনি টু।

বোকার মত তাকিয়ে থাকল ল্যাঙডন। মাঝে মাঝে সে এমন বোকামি করে ফেলে। নাম দুটা বর আর কনের। অবশ্যই, তাদের প্রতি সম্মান জানাতে বার্জটায় এমন নাম দেয়া হয়েছে। ডিসি ওয়ানের কী খবর?

দুঃখ ভেসে উঠল লোকটার কণ্ঠে, গতকাল সেটা ডুবে গিয়েছিল, লানের সময়।

হাসল ল্যাওড়ন, কথাটা শুনে আমি দুঃখিত। তাকাল সে ডিসি টুর দিকে। মনে পড়ে গেল তার কিউ ই টুর কথা। ব্যাপারটা তাকে স্থবির করে দিল কিছুক্ষণের জন্য।

এবার ল্যাঙডন ফিরে দাঁড়াল ভিট্টোরিয়ার দিকে। ফাইড ও থ্রি, বলল সে, আগেই বলেছি, এটা একটা কোড। এটা ইলুমিনেটির এক ধরনের চালাকি। তারা এটাকে রোমান সংখ্যার সাথে মিলিয়ে নিয়েছে। রোমানে ফাইভ ও থ্রির প্রকাশ হচ্ছে,..

ডি আই আই আই।

চোখ তুলে তাকাল ল্যাঙডন, এত দ্রুত কী করে বললে! আবার বলে বসো না আমাকে যে তুমি একজন ইলুমিনেটা।

হাসল মেয়েটা, আমি রোমান অক্ষর ব্যবহার করি কোনকিছুকে নির্দেশ করার কাজে।

ঠিক তাই, মনে মনে বলল ল্যাঙ৬ন, আমরা সবাই কি একই কাজ করি না? চোখ তুলে তাকাল ভিট্টোরিয়া, তো, ডি আই আই আইর অর্থ কী?

ডি আই আর ডি আই আই এবং ডি আই আই আই অনেক আদ্যিকালের শব্দ সংক্ষেপণ। আগের দিনের বিজ্ঞানীরা গ্যালিলিওর পুরনো দিনের তিনটা বইকে নির্দেশ করত এ তিন নামে। এর আরেক মানে হল…।

আরো একটা শ্বাস নিল ভিট্টোরিয়া, ডায়ালোগো… ডিসকর্সি… ডায়াগ্রামা।

ডি-ওয়ান, ডি-টু, ডি-থ্রি। প্রতিটাই বৈজ্ঞানিক। প্রতিটাই বিতর্কিত। আর ফাইভ ও থ্রির অর্থ হল, ডি-থ্রি। ডায়াগ্রামা। তার বইগুলোর মধ্যে তৃতীয়টা।

এখনো ঠিক মিলে যাচ্ছে না ভিট্টোরিয়ার হিসাব-কিতাব, কিন্তু একটা ব্যাপার পরিষ্কার নয়। এই এত পথ, এই এত গোপনীয়তা, তারপরও কেন ভ্যাটিকান সিটি আসল ব্যাপারটা উদ্ধার করতে পারল না? খুব সহজ। তাহলে বই পোড়ানোর উৎসবে কিম্বা পরে আর্কাইভে সারিবদ্ধ করে রাখার সময় কেন তারা টের পেল না মোটেও?

তারা দেখেছে ঠিকই, বুঝতে পারেনি। ইলুমিনেটির দ্বিমাত্রিকের মধ্যে নামটাকে লুকিয়ে রাখার কারসাজি দেখেছ না তুমি? না জানলে কীভাবে বুঝতে পারতে কোন ছাতমাথা আকা আছে সেখানে? পারতে না। একই ভাবে, যারা সেটা খুজছে না তারা কশিন কালেও বুঝে উঠতে পারবে না।

মানে?

মানে, গ্যালিলিও জিনিসটাকে ভালভাবেই লুকাতে পেরেছিলেন। ইতিহাসবিদরা বলে, সাইনোটা একটা প্রক্রিয়ায় বেরিয়ে এসে ইলুমিনেটির সাথে গাটছড়া বাঁধে। তাকে বলা হয় লিঙ্গুইয়া পিউরা।

দ্য পিওর ল্যাঙ্গুয়েজ?

জ্বি। ম্যাথমেটিক্স?

আমিও তাই ভাবছিলাম। দেখেশুনে মনে হচ্ছে দুইয়ে দুইয়ে চার মিলে যাওয়া মোটেও রহস্যময় নয়। গ্যালিলিও আসলেই একজন বিজ্ঞানী। আর তিনি লিখছিলেন শুধুমাত্র বিজ্ঞানীদের জন্য। স্বভাবতই, গণিতই পথ, যেটা দিয়ে এক বিজ্ঞানী আরেক বিজ্ঞানীকে ঠিক ঠিক বুঝে উঠতে পারবে। ঘুণাক্ষরেও টের পাবে না বাকীরা। পুস্তি কাটার নাম ডায়াগ্রামা। তার মানে গাণিতিক ডায়াগ্রামগুলোও আরেকটা উৎস হতে পারে।

আরো যেন বিভ্রান্ত হয়ে উঠছে মেয়েটা, আশা করি কোনমতে গ্যালিলিও বিজ্ঞানীদের বোধগম্য করে লেখাটা লিখেছিলেন।

তোমার সুর শুনে মনে হচ্ছে হাল ছেড়ে দিচ্ছ? সারির শেষদিকে সরে যেতে যেতে বলল ল্যাঙডন আস্তে করে।

আমি ছেড়ে দিচ্ছি না। আসলে হাল ছাড়ছি না কারণ তুমি এখনো আশা ধরে রেখেছ। তুমি যদি ডি-থ্রির ব্যাপারে এতই নিশ্চিত হয়ে থাক তাহলে কেন এ কথাটা প্রচার করনি? তাহলে এখানে, ভ্যাটিকান আর্কাইভে যারা আসত বা আসার অনুমতি পেত তারা এখানে এসে ডায়াগ্রামাকে নিয়ে বেশ ভালভাবেই ব্যাপারটার সুরাহা করতে পারত।

আমি কথাটা চাউর করে দিতে চাইনি। বলল ল্যাঙডন, তথ্যটা বের করার জন্য গাধার খাটুনি খাটতে হয়েছে আমাকে। বের করতে হয়েছে অনেক অনেক তথ্য আর নিজেকে থামিয়ে দিল সে। একটু অপ্রস্তুত হয়ে নিজেকে থামিয়ে দিল।

তুমি সুনাম চেয়েছিলে।

কথা বলল ল্যাঙডন, বলতে গেলে… আসলে-

অপ্রস্তুত হবার কোন কারণ নেই, বলল সাথে সাথে ভিট্টোরিয়া, তুমি একজন সায়েন্টিস্টের সাথে কথা বলছ। সার্নে এই ব্যাপারটার একটা চলতি নামও আছে।

আমি শুধু প্রথম হবার চেষ্টায় এমন করেছি তা কিন্তু না। এমন চিন্তাও ছিল, কোন ভুল লোকের হাতে প্রমাণটা পৌঁছলে ডায়াগ্রামা হাপিস হয়ে যেতে পারে।

ভুল লোক মানে ভ্যাটিকান?

তাদের কাজ যে ভুল এমন কোন কথা আমি বলছি না। কিন্তু তাই বলে ভ্যাটিকান যে ইলুমিনেটির হুমকিকে কখনো ছোট করে দেখেছে তাও না। এমনকি উনিশো সালের দিকে চার্চ ইলুমিনেটিকে অতিকথনের দোষে দুষ্ট করে। সবচে বড় যে ব্যাপারটা তাদের মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়ায় তা হল, তাদের বিরুদ্ধে একাট্টা হয়ে দাঁড়াল দুনিয়ার খ্রিস্টানত্বের বিরোধী দলগুলো মোটামুটি এক কাতারে। দখল করল অর্থনৈতিক ক্ষেত্র, সামাজিক ক্ষেত্র, রাজনৈতিক মাঠ দখল করল বিশ্ববিদ্যালয়গুলো। কথাটা কি ঠিক হল? এখনো এমন এক শক্তি আছে যা দখল করে আছে অর্থনৈতিক ক্ষেত্র, সামাজিক ক্ষেত্র, রাজনৈতিক মাঠ; দখল করে আছে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো।

আরো একটা প্রশ্ন আছে আমার। ভিট্টোরিয়া তাকে থামিয়ে দিল, তারপর অদ্ভুত চোখে তাকাল তার দিকে, তুমি কি সিরিয়াস?

একটু ধাক্কা খেল ল্যাঙডন, কী বলতে চাও তুমি?

মানে, আজকের দিনটাকে রা করাই কি তোমার সত্যিকার পরিকল্পনা?

ল্যাঙডন ঠিক ঠিক বলতে পারবে না মেয়েটার আতঙ্কে ভর্তি চোখে করুণা দেখতে পেয়েছে কিনা, তুমি কি ডায়াগ্রামাকে খুঁজে বের করার ব্যাপারে বলছ?

আমি বলতে চাই, তুমি ডায়াগ্রামাকে খুঁজে বের করবে, চারশ বছর আগের সাইনো বের করবে, ভাঙবে কিছু গাণিতিক কোড, তারপর এমন কিছু প্রাচীণ শিল্পকর্মের পিছনে ছুটবে যেটার অর্থ বের করতে গলদঘর্ম হতে হয়েছে ইতিহাসের সবচে বিখ্যাত আর মেধাবী বিজ্ঞানীদেরও, তারপর সেই লোকটার গোড়াসুদ্ধ উপড়ে এনে বাকি সমস্যাগুলোর সমাধান করবে… আর এ সবই শেষ হবে আগামী চার ঘণ্টার মধ্যে?

শ্রাগ করল ল্যাঙডন, আমি অন্য যে কোন পরামর্শ নিতে রাজি আছি।

 

৫০.

রবার্ট ল্যাঙডন আর্কাইভ ভল্ট নাইনের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। গাদা করে রাখা বইয়ের সাথের লেবেলগুলো খুটিয়ে পড়ছে।

ব্রাহে… ক্ল্যাভিয়াস… কোপার্নিকাস… কেপলার… নিউটন…

আরেকবার তালিকাটা পড়ে কেমন একটু অস্বস্তি জেঁকে বসতে দেখল সে নিজের মনে, এখানে সব বিজ্ঞানীর কথা উল্লেখ করা আছে, কিন্তু কোথায় গেল গ্যালিলিও?

সাথের আরেকটা ভল্টের লেখা চেক করতে থাকা ভিট্টোরিয়ার দিকে তাকাল সে, আমি পথটা পেয়ে গেছি, কিন্তু গ্যালিলিওর নাম-গন্ধও নেই কোথাও।

না, তিনি নিখোঁজ নন, বলল সে, তাকিয়ে আছে তার সামনের ভল্টটার দিকে, তিনি এখানে। তবে আশা করি তুমি একটা ভাল লুকিং গ্লাস এনেছ, কারণ এ পুরো ভল্টটায় তার নাম, পুরোটাই তার।

দৌড়ে চলে এল ল্যাঙডন, ঠিক কথাই বলেছে ভিট্টোরিয়া, এই ভল্টের প্রতিটা ইন্ডিকেটরে একটা নামই ফুটে উঠছেঃ

এল প্রসেসে গ্যালিলিয়ানো

এবার হঠাৎ করে ল্যাঙডন বুঝে ফেলল কেন গ্যালিলিওর নিজের জন্য মস্ত একটা ভল্ট বরাদ্দ করা হয়েছে। দ্য গ্যালিলিও এ্যাফেয়ার্স, বলল সে সামনে ঝুকে এসে, ভ্যাটিকানের ইতিহাসে সবচে বড় আইনি ধাক্কা। চোদ্দ বছরে কত শত কাজ! সবই এখানে গুটিয়ে রাখা।

কয়েকটা লিগ্যাল ডকুমেন্টও আছে।

আশা করি গত কয়েক শতাব্দিতে খুব বেশি বাগিয়ে নিতে পারেনি আইনজীবিরা।

হাঙররাও খুব বেশি খাবার পায়নি গত কয়েক শতাব্দিতে।

ল্যাঙডন ভল্টটার পাশের বিশাল হলুদ একটা বাটনে চাপ দিল। এটায় চাপ দিতেই উপর থেকে আলোর বন্যা এসে ভাসিয়ে দিল চারপাশ। আলোর রঙ লাল চুনীর মত। ঝকঝকে, ভল্টটাকে রক্তে ভেসে যাওয়া একটা জীবন্ত কোষের মত দেখাচ্ছে, ভিতরের বইয়ের উঁচু উঁচু তাক আরো গভীরতা এনে দেয়।

মাই গড! চিৎকার করে উঠল ভিট্টোরিয়া, তুমি কি এখানে কাজ করার কথা ভাবছ?

পার্চমেন্ট আর ছেঁড়াখোড়া কাগজ খুজতে হবে।

খোঁজাখুজি করতে করতে পাগল না হয়ে যাও!

অথবা আরো খারাপ অবস্থা… ভাবে ল্যাঙডন। ভল্টের দিকে এগিয়ে যেতে যেতে, একটা কথা মনে করিয়ে দিচ্ছি, অক্সিজেন কিন্তু অক্সিডেন্ট, আর ভল্টগুলোতে এ জিনিসটার তেমন উপস্থিতি নেই। ভিতরটা অনেক অংশে ভ্যাকুয়াম। তোমার শ্বাস কিন্তু ক্ষতিকর হতে পারে তোমার জন্য।

হেই, বৃদ্ধ কার্ডিনালরা যদি এখানে উৎরে যেতে পারে তাহলে আমার ভুলটা কোথায়?

হয়ত, ভাবল ল্যাঙডন, আশা করি আমাদের ভাগ্য সুপ্রসন্ন।

ভল্টগুলোতে একটা করে রিভলভিং ডোর আছে, সেগুলো বাইরের পরিবেশের সাথে খুব দ্রুত খাপ খাইয়ে নিতে পারে, এক মুহূর্তে এমনভাবে দরজাটা খুলে যায় যে বাইরে থেকে খুব বেশি বাতাস ভিতরে ঢুকতে পারে না। ভিতরটাকে সংরক্ষিত রাখার একটা উপায় বলা চলে।

আমি ভিতরে ঢুকে যাবার পর, বলল ল্যাঙডন, তুমি বাটনটা টিপে দিয়ে আমার মত করবে, ব্যস। ভিতরের বাতাসে জলীয় বাষ্পের হার আট পার্সেন্ট। সুতরাং একটা খটখটে শুকনো মুখের জন্য প্রস্তুত হও।

ল্যাঙডন ঘুরতে থাকা কম্পার্টমেন্টের বাটন চেপে ধরল। দরজা জোরে শব্দ করে ঘুরতে শুরু করেছে। ভিতরে প্রবেশ করেই সে একটা থাক্কা খেল, বেশ বড়সড় ধাক্কা। কোন মানুষকে সাগরপৃষ্ঠের উচ্চতা থেকে যদি এক মুহূর্তে বিশ হাজার ফুট উপরে তুলে নেয়া হয় তাহলে লোকটার হাল যেমন হবে, ল্যাঙডনের অবস্থাও ঠিক তেমনি। মাথা ঘোরানো আর ফাঁকা ফাঁকা লাগার রোগটা নতুন নয়। এখানে অবাক হবার কিছু নেই। এমন হবেই। ডাবল ভিশন, ডাবল ওভার, মনে মনে আর্কাইভিস্টের শ্যেণদৃষ্টির মন্ত্র আউড়ে গেল সে। ল্যাঙডন টের পেল তার কানের পর্দায় চাপ নেই, টের পেল, পিছনে দরজাটা খুলে গেছে।

ভিতরে চলে এসেছে সে।

প্রথমেই যে কথাটা ল্যাঙডনের মনে পড়ল, তার আশারচে বেশি পাতলা ভিতরের বাতাস। দেখে মনে হচ্ছে ভ্যাটিকান সৰ্বোচ্চরও কিছু বেশি যত্ন-আত্তি করছে ভল্টগুলোয় লুকিয়ে থাকা সম্পদগুলোর। ল্যাঙডন জোর করে শান্ত থাকল যখন তার শিরা-উপশিরা প্রতিবাদ জানাচ্ছিল। কিন্তু এখানেই তার পূর্ব অভিজ্ঞতা কাজে লাগল। দিনে পঞ্চাশ ল্যাপ সাঁতারের সুফল পাওয়া যাবে এখন। ভিতরে ঢোকো, ডলফিন, বলল ল্যাঙডন নিজেকেই। অনেকটা ঠিকমত শ্বাস নিতে নিতে সে তাকাল চারদিকে, চোখ বোলাল। চারপাশে বইয়ের দিকে তাকাতে তাকাতে হঠাৎ করে তার মনে পড়ে গেল পুরনো ভয়টার কথা, মাথাচাড়া দিয়ে উঠল বিরক্তিকর অনুভূতি, আমি একটা বাক্সে বন্দি! ভাবল সে, আমি একটা রক্তলাল স্বচ্ছ প্রায় বায়ুহীন বাক্সে বন্দি!

তার পিছনে দরজা শব্দ করে উঠতেই পিছন ফিরে তাকাল ল্যাঙডন, ভিট্টোরিয়া প্রবেশ করছে। সাথে সাথে বড়বড় হয়ে গেল মেয়েটার চোখ, ভরে উঠল জলে। শ্বাস নিতে শুরু করল সে জোরে জোরে।

এক মিনিট সময় দাও, উপদেশ ঝাড়ল ল্যাঙডন, যদি মাথা ফাঁকা ফাঁকা লাগে তাহলে উবু হও একটু।

আমার… মনে হচ্ছে…খাবি খাচ্ছে ভিট্টোরিয়া, ডাঙায় তোলা মাছের মত, আমি যেন কোন… স্কুবা ডাইভিংয়ে… ভুল মিশ্রণ সহ…

মেয়েটার সয়ে নেয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করল ল্যাঙডন। সে জানে, সয়ে নিতে পারবে যোগ ব্যায়ামের ওস্তাদ মেয়েটা। কী চমৎকার গডন ওর! অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রশংসার দৃষ্টি চলে যায়, টলে যায় মন। সে এমন একটা মেয়েকে দেখেছিল আরেক আদ্যিকালের লাইব্রেরিতে। সেখানে পরে তার ভাগ্যে যে ভদ্রমহিলা জোটে তাকে এক কথায় বুড়ি বললেও কম বলা হবে। ল্যাঙডন নিশ্চিত তার দাঁতগুলোও কৃত্রিম, বাঁধানো।

এখন একটু ভাল লাগছে? প্রশ্ন করল সে।

নড করল ভিট্টোরিয়া।

আমি তোমাদের মরার প্লেনে চড়েছি, তাই আমি মনে করি তোমার মানিয়ে নিতে কষ্ট হবে না।

এ কথায় একটা হাসি উপচে পড়ল মেয়েটার ঠোঁট বেয়ে, উসে!

দরজার পাশের বাক্সের কাছে চলে গেল ল্যাঙডন, সেখান থেকে তুলে আনল কিছু কটন গ্লাভ।

এমনটাই করা উচিৎ? জিজ্ঞেস করল ভিট্টোরিয়া।

আঙুলের এসিড। এগুলো ছাড়া ডকুমেন্ট ধরা অনুচিৎ। তোমারও একজোড়া দরকার।

ভিট্টোরিয়াও নিয়ে নিল একজোড়া, হাতে কতটা সময় আছে?

ল্যাঙডন তার হাতের মিকি মাউস ঘড়ির দিকে একবার চোখ বুলিয়ে নেয়, সাতটা বেজেছে একটু আগে।

এ ঘণ্টার মধ্যেই জিনিসটা পেতে হবে আমাদের।

আসলে, বলল ল্যাঙডন, আমাদের হাতে সেটুকু সময়ও নেই। হাত তুলে দেখাল সে উপরে, সাধারণত কিউরেটর ঐ ডাক্টে করে বাড়তি অক্সিজেন পাঠায় ভিতরে কেউ থাকলে। আমরা এ অবস্থায় তার সহায়তা পাব বলে তো মনে হচ্ছে না। লোকটা ভ্যাটিকানে নেই। বিশ মিনিট। আর দেখতে হবে না। বাতাসের জন্য হাঁসফাঁস করবে ফুসফুস।

কথার ধাক্কা কোনমতে সয়ে নিল মেয়েটা।

একটু হেসে উঠল ল্যাঙডন, হোক বা না হোক, মিসটে মিকি টিকটিক করছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *