শফিকের কাণ্ডকারখানাই অন্য রকম।
পাঁচটা ডলার পকেটে নিয়ে ফার্গোতে এসে এক মাসের মধ্যে দু শ চল্লিশ ডলার দিয়ে গাড়ি কিনে ফেলল। আমিন সাহেব খবর পেয়ে বিরক্ত হলেন খুব, গাড়ি কিনলে, গাড়ির দরকারটা কী তোমার?
শফিক মাথা চুলকে বলেছে, দেশের সম্মানের জন্যেই কাজটা করলাম।
দেশের সম্মান! দেশের সম্মান মানে?
গরিব দেশ গরিব দেশ করে তো, বুঝলেন না! শালাদের দেখিয়ে দিলাম আর কি।
তোমার দুই শ ডলারের গাড়ি দিয়ে ওদের দেখিয়ে দিলে? চালাতে জান গাড়ি?
শিখব।
এখানেই শেষ নয়, আর্টসের ছাত্র কীভাবে সায়েন্সের কবিনেশনে চার-পাঁচটা সাবজেক্ট নিয়ে ফেলল। আমেরিকায় এসে ইতিহাস-ভূগোল পড়ে লাভটা কী? পড়তে হলে পড়তে হয় ফিজিক্স কেমিস্ট্রি কম্প্যুটার সায়েন্স।
মিডটার্মের রেজাল্ট হওয়ার পর ফরেন স্টুডেন্ট এ্যাডভাইজার টয়লা ক্লিন ডেকে পাঠালেন শফিককে। রেজাল্ট ভয়াবহ; তিনটি ডি এবং একটি সি।
শফিক, তোমার দেশ কোথায়?
শফিক গম্ভীর হয়ে বলল, ইণ্ডিয়া ম্যাডাম! ক্যালকাটা সিটি।
টয়লা ক্লিন কাগজপত্র ঘেটে শফিকের চেয়েও গম্ভীর হয়ে বললেন, কিন্তু আমার কাছে যেসব কাগজপত্র আছে, সেখানে লেখা বাংলাদেশ।
শফিক মাথা চুলকায়, জবাব দেয় না। তুমি কি দয়া করে ব্যাপারটা আমার কাছে এক্সপ্লেইন করবে?
রেজাল্ট যা হয়েছে ম্যাডাম এতে দেশের একটা বদনাম হয়ে যায়, এই জন্যেই বলি ইণ্ডিয়া।
টয়লা ক্লিনের গাম্ভীর্য মনে হয় খসে পড়ছে। ঠোঁটের কোণায় মৃদু হাসি।
তোমার দেশের সব ছাত্র বুঝি এ পায়? ম্যাডাম, আমার দেশের ছাত্ররা সব বাঘের বাচ্চা। যে-কোনো আমেরিকান স্ট্রেইট এ ছেলেমেয়েদের এরা কুৎ করে পানি দিয়ে গিলে ফেলবে।
তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারলাম না।
অর্থাৎ এরা খুব মারাত্মক। একেবারে গ্রীন পিপার।
টয়লা ক্লিন বলে দিলেন, ফাইন্যালে যে-করেই হোক এভারেজ সি থাকতেই হবে। জিপিএ ২ এর কম হলে ভিসা রিনিউ হবে না, দেশে ফিরে যেতে হবে।
বাইরে দিনে ছয়-সাত ঘণ্টা কাজ করে পড়ারই সময় পাই না, ম্যাডাম।
কোথায় কাজ কর তুমি?
নিক্স প্লেসে। বিয়ার বিক্রি হয় সেখানে।
চার দিন পর শফিকের কাছে টয়লা ক্লিনের এক চিঠি এসে হাজির।
প্রতি ঘণ্টায় মিনিমাম ওয়েজ তিন ডলার পঞ্চাশ সেন্ট করে তোমাকে লাইব্রেরিতে একটি কাজ দেয়া হল। এখন পড়াশোনার ভালো সুযোগ পাবে।
লাভ কিছু হল না। ফাইন্যালে দেখা গেল চারটেই ডি। টয়লা ক্লিন ভ্রূ কুচকে বলল, এখন কী করবে?
গভীর সমুদ্রে ম্যাডাম। বিষ খাওয়া ছাড়া উপায় নাই কিছু।
আরেকটা কোয়ার্টারের সুযোগ যাতে দেয় এই চেষ্টা করব? প্রথম দিকে কিছু সহজ কোর্স নিলে কেমন হয়?
শফিককে দ্বিতীয় কোয়ার্টারের সুযোগ দেওয়া হল। ডীনের অফিস থেকে পার্মিশনের জন্যে টয়লা ক্লিনকে প্রচুর দৌড়াদৌড়ি করতে হল। দ্বিতীয় কোয়ার্টারে হল দুটি ডি এবং একটি সি, ও একটি এফ। টয়লা ক্লিন গম্ভীর হয়ে বলল, এই ইউনিভার্সিটিতে তুমি আর পড়তে পারছ না শফিক। কী করবে এখন? দেশে ফিরে যাবে?
না।
ইল্লিগেল এ্যালিয়েন হিসাবে থাকবে?
হ্যাঁ।
টয়লা ক্লিন শান্ত স্বরে বলল, গুড লাক। আমেরিকা হচ্ছে ল্যাণ্ড অব অপারচুনিটি। কিছু একটা হয়েও যেতে পারে তোমার।
শফিক গ্রেভার ইনের কাছে একটা ঘর ভাড়া করে নিক্স প্লেসের কাজে লেগে গেল।
নিক্স প্লেস যে-মহিলাটি চালায় তার নাম জোসেফাইন নিক্স। লম্বায় চার ফুট তিন ইঞ্চি। দৈর্ঘ্যের স্বল্পতা সে অবশ্যি পুষিয়ে নিয়েছে ওজন দিয়ে। বর্তমান ওজন ২৩০ পাউণ্ড। সে-ওজনও প্রতি সপ্তাহে বাড়ছে। গায়ের রঙ ঘন কৃষ্ণবর্ণ। গত ছয় পুরুষ ধরে আমেরিকায় বাস করেও আফ্রিকার আদিম বর্ণের কিছুমাত্র পরিবর্তন হয় নি। শফিককে চাকরি দেবার সময় সে ঘড়ঘড়ে গলায় বলল, তোমাকে চাকরি দিচ্ছি একটি মাত্র কারণে, তোমার গায়ের রং কালো। সাদা মানুষগুলিকে ঈশ্বর বিষ্ঠা দিয়ে তৈরি করেছেন। সাদা মানুষের রক্তের মধ্যে একটা জিনিসই আছে, সেটা কী জান?
না।
বিষ। আসল হেমলক বিষ। পৃথিবীতে যত অন্যায় অবিচার হয়েছে, সব করেছে সাদা মানুষ।
তাই কি?
একদম খাঁটি কথা। আমার এখানে সাদা মানুষ ঢুকলে পাছায় লাথি দিয়ে বের করে দিতে ইচ্ছা করে। কিন্তু তা দেওয়া যায় না। কারণ ফেডারেল আইনে সাদা এবং কালোর মধ্যে কোনো ভেদাভেদ নাই। কি কুৎসিত আইন। সাদা কখনো কালোর সমান হয়?
জোসেফাইনের এখানে একটি সাদা ছেলেও কাজ করে। কিন্তু তাতে জোসেফাইনের কিছুই যায় আসে না। চক্ষু-লজ্জাটজ্জা বলে তার কাছে কিছু নেই।
সাদা মানুষদের মুণ্ডপাত না করে সে তার দিন শুরু করে না।
হ্যারি (জোসেফাইনের স্বামী) যে আজ জেলে খাবি খাচ্ছে, সে কিসের জন্যে? কী কারণে? একটি মাত্র কারণ, জজ সাহেব ছিল সাদা। জুরীরা ছিল সাদা। যে পুলিশ ধরেছে, সেও ছিল সাদা। এই অবস্থায় হ্যারির বিশ বছরের জেল হবে না তো কার হবে? ইলেকট্রিক চেয়ারে নিয়ে যে বসায় নি, সে আমার উপর মাদার মেরীর অসীম করুণা আছে বলেই।
হ্যারির অভাবে জোসেফাইন যে খুব কাতর, সে-রকম মনে করারও কোনো কারণ নেই। দিনের মধ্যে দু এক বার সে বলবেই যীশু খ্রিষ্ট্রের দয়া, হ্যারি এখন জেলে। বাইরে থাকলে নিক্স প্লেসের অর্ধেক বিয়ার সেই খেয়ে ফেলত। এখন ভালো হয়েছে জেলে বসে আঙুল চুষছে।
কাস্টমারদের সঙ্গে নিত্যদিন খিটিমিটি লেগে আছে। কেউ হয়তো বলল, ব্লাডি মেরীতে জল মনে হচ্ছে বেশি হয়ে যাচ্ছে জোসেফাইন।
বেশি হলে খেও না, তোমাকে পায়ে ধরে সাধছি?
পয়সা দিচ্ছি, ঠিক জিনিস খাব। পানি-মেশান ব্লাডি মেরী খাব কেন?
আলবত খাবে। তুমি একা নও, তোমার চোদ্দগুষ্টি খাবে।
টাকা-পয়সা নিয়েও শফিকের সঙ্গে তার খিটমিটি লেগেই আছে। ঘণ্টায় দু ডলারের বেশি কিছুতেই দেবে না। পোষালে কাজ কর, না-পোষালে করবে না। দশ ঘণ্টা কাজ করলে সে হিসাব করে বের করে সাত ঘণ্টা কাজ হয়েছে। তার বড়ো মেয়ে এ্যালেনকে নিয়েও তার আদিখ্যেতার অন্ত নেই। সুযোগ পেলেই গলা নিচু করে বলবে, খবৰ্দার, কোনো রকম ফষ্টিনষ্টির চেষ্টা করবে না। আমার মেয়েটা খারাপ। একটু ইশারা করলেই সর্বনাশ। আমি যদি দেখি এইসব কিছু হচ্ছে, তাহলে খুন করে ফেলব, হুঁ-হুঁ!
এ্যালেন নিজেও তার মায়ের মতো তিন-মণী বস্তা। তাকে নিয়ে ফষ্টিনষ্টি করার ইচ্ছা হবার কোনো কারণ নেই। কিন্তু মেয়ের মা তা বোঝে না।
মেয়েটির স্বভাব-চরিত্র অবশ্যি সত্যি সত্যি ভালো নয়। আড়ালে পেলেই শফিকের সঙ্গে কুৎসিত সব অঙ্গভঙ্গি করে। একদিন বেশ ভালোমানুষের মতো শফিককে মুভি দেখাতে নিয়ে গেল। মুভি দেখাবার এত সাধ্যসাধনার কারণ জানা গেল মুভি শুরু হবার পর। হার্ড কোর পণো মুভি একটি। মেয়েটি মেঘস্বরে বল, সব কায়দা-কানুন যাতে শিখতে পোর, সে জন্যেই নিয়ে এলাম। অনেক কিছু জানার আছে।