শনিবারের আড্ডায় কথা উঠল সাহিত্যিকদের খাওয়া নিয়ে। কোন সাহিত্যিক কি রকম খেতে পারেন তারি আলোচনা প্রসঙ্গে বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কথা উঠতেই সবাই একবাক্যে স্বীকার করলেন-হ্যাঁ, খেতে পারতেন বটে বিভূতিবাবু।
বিভূতিবাবুর খাওয়া সম্পর্কে যার যা অভিজ্ঞতা একে একে বলে চলেছেন। একজন বললেন—মেদিনীপুরে একবার এক সাহিত্যসভায় বিভূতিবাবু গিয়েছিলেন সভাপতি হয়ে। চার পাঁচজন সাহিত্যিক কলকাতা থেকে গিয়েছিলেন, আমিও ছিলাম দলে। শনি-রবি দুদিন থেকে সোমবার সকালে আমাদের ফেরবার কথা। খড়গপুর স্টেশনে নেমে সেখান থেকে মোটর গাড়িতে আমরা যাব মেদিনীপুর। দুপুরে যথাসময়ে ট্রেন খড়গপুর পৌঁছতেই কয়েকজন ভদ্রলোক আমাদের অভ্যর্থনা করতে এগিয়ে এলেন। বিভূতিদা আমাদের দলপতি, তাঁকে এগিয়ে দিয়ে আমরা পিছন পিছন চলেছি। আচ্ছা, আপনারাই বলুন, উদ্যোক্তাদের সঙ্গে তিনি কোন বিষয় নিয়ে কথা বলতে বলতে হাঁটছিলেন?
আমি বললাম, কেন? সভা সম্পর্কে নিশ্চয়ই। কখন সভা, কী বিষয়ে বলতে হবে ইত্যাদি।
উহুঁ, হল না। তার প্রথম প্রশ্নই ছিল, দুপুরে আহারের বন্দোবস্ত কোথায় হল, কী কী রান্না হয়েছে। প্রশ্নের উত্তরে জানলাম দুপুরে খড়গপুর স্টেশনের রিফ্রেশমেন্ট কম-এ খাওয়া-দাওয়া সেরে আমাদের মেদিনীপুরের .এক উকিলের বাড়ি অতিথি হতে হবে, কিছুক্ষণ বিশ্রামের পর বেলা পাঁচটায় সভাস্থলে যাত্রা।
রিফ্রেশমেন্ট রুম-এ খেতে খেতে পাওয়ার গল্পই চলছে, বক্তা বিভূতিবাবু একাই। মেদিনীপুরে খাওয়ার বৈশিষ্ট্য কী তার এক লম্বা ফিরিস্তি দিয়ে বিভূতিবাবু উদ্যোক্তাদের বললেন–মেদিনীপুরের কাঁকড়ার ঝোল শুনেছি খেতে খুব ভাল। তা কাল তো রবিবার, কাল দুপুরে কাঁকড়ার বোল খাওয়াতে পারেন?
উদ্যোক্তারা এ-হেন ফরমাইশের জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। কিন্তু তারাও পেছ-পাও হবার লোক নন। বললেন–আগে খবর পেলে লোক লাগিয়ে ভাল জাতের কাঁকড়া সংগ্রহ করে রাখতাম। তবু যে-করেই হোক কাল আপনাদের কাঁকড়ার ঝোল খাওয়াবই।
রাত্রে আহারাদির পর একটা হল-ঘরে আমরা সবাই শুয়েছি। সবে তন্দ্রা এসেছে, এমন সময় ঘরের এক কোণ থেকে খড়খড় আওয়াজ উঠল। আমি পাশের ভদ্রলোককে ডেকে বললাম-ও মশায়, শুনছেন? ইঁদুরের উৎপাত বলে মনে হচ্ছে। আমাদের মিটিংকা কাপড়া অর্থাৎ সিল্কের পাঞ্জাবি কেটে তছনছ করে দেবে না তো?
বিভূতিদা অন্যদিক থেকে পাশ ফিরতে ফিরতে বললেন—তোর বড় বকরবকর করিস। ঘুমোতে দে। কাল আবার ভোরে উঠে তিন-তিনটে সাহেব ম্যাজিস্ট্রেটের কবর দেখতে যেতে হবে না, যাদের বিপ্লবীরা খুন করেছিল?
কিন্তু জামা-কাপড়গুলো স্যুটকেস-এ ভরে রাখলে হত না? ইঁদুরের যে-রকম আওয়াজ পাচ্ছি।
বিভূতিদা একটু রাগতস্বরেই বললেন–দেখ, তোরা শহরে থেকে থেকে অমানুষ হয়ে গেছিস। ওটা ইঁদুরের আওয়াজ নয়, কাঁকড়ার।
কাঁকড়া? একসঙ্গে হুড়মুড় করে বিছানায় উঠে বসে সবাই বলে উঠল–বিছে নয় তো?
বালিশের তলা থেকে টর্চলাইটটা বার করতে করতে বিভূতিদা বললেন–শহরে থেকে থেকে তোদর আর বুদ্ধিশুদ্ধি হল না। কাঁকড়াবিছের আবার ওরকম খড়খড় আওয়াজ হয় নাকি? ওটা কাঁকড়ার-ঝোলের কাঁকড়া। এই দ্যাখ–
বিভূতিদা টর্চের আলো ফেললেন ঘরের কোণে রাখা একটা ছালার বস্তার উপর। আলো পড়াতে বস্তার ভিতরে জীবগুলি আরও আওয়াজ করে নড়তে লাগল। বিভূতিদা বাতি নিবিয়ে বললেন–দেখলি তো? এখন শুয়ে পড়।
একজন জিজ্ঞেস করলে-এক বস্তা কাঁকড়া কেন বিভূতিদা, তাছাড়া আমাদের শোবার ঘরেই বা এনে কেন রাখল?।
বিভূতিদা ঘুমজড়িতকণ্ঠে বললেন—সারারাত ধরে আমাদের জানান দিতে যে আমাদের জন্যে কাঁকড়া সংগ্রহ হয়েছে। আর এক বস্তা কেন জিজ্ঞেস করছিস? কাল দুপুরে অর্ধেক রান্না হবে আর বাকি অর্ধেক পরশু ভোরে ফেরবার সময় ট্রেনে তুলে দেবে। কাঁকড়ার বোল খেতে চেয়েছিলুম কি-না!
পরদিন দুপুরে খেতে বসে খাওয়া কাকে বলে বিভূতিবাবু তা দেখিয়ে দিলেন। শুধু দেখানো নয়, দেখিয়ে তাক লাগিয়ে দিলেন। নানারকম ভাজাভুজির পর যখন জামবাটির একটি করে কাঁকড়ার ঝোল দিয়ে গেল–শুধু তাকিয়ে দেখলাম বিভূতিদার চোখ-মুখের উল্লসিত ভাব। অন্যসব তরিতরকারি সরিয়ে রেখে কাঁকড়ার ঝোলের বাটিটা টেনে নিয়ে তার উপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন তিনি। বাটিটা নিঃশেষ করে হুঁশ হল আমাদের দিকে তাকাবার। আমাদের বাটির ঝোল যেমন-কে-তেমনই আছে দেখে বিভূতিদা বিদ্রুপের সুরে বললেন–শহরে থেকে থেকে তোরা ভাল জিনিস আর ভাল রান্নার কদর বুঝলি না। রেস্টুরেন্টে বসে কতকগুলো ফাউল কটলেট, মটন কটলেট, ব্রেস্ট কটলেট, কবিরাজী কটলেট খেয়ে খেয়ে তোদের রুসনার বিকৃতি ঘটেছে। আরে, ওগুলো তো সব ভেজাল, বিষ।
ততক্ষণে উকিল-গিন্নী বিভূতিদার নিঃশেষিত বাটিটা আবার কাঁকড়ার ঝোলে ভরে দিলেন। বিভূতিদার দিক থেকে আপত্তির কোন লক্ষণই দেখা গেল না।
আমরা আমাদের খাওয়া শেষ করে হাত গুটিয়ে বসে আছি। বিভূতিদার খাওয়া শেষ না হলে আসন ছেড়ে উঠতে পারছি না এবং বেশ বুঝতে পারছি আরও আধ ঘণ্টার আগে ওঠা সম্ভবও হবে না। বিভূতিদা বাটি থেকে একটি একটি করে কাঁকড়া তুলছেন, তার বাড়াটা ভেঙ্গে নিয়ে প্রথমে বেশ খানিকক্ষণ চুষিকাঠির মতন চুষে দাঁত দিয়ে কুটুস করে কামড়ে দাঁড়াটা ভেঙ্গে নিয়ে তার ভিতরের মাংস কুরে কুরে খেতে লাগলেন।
কী পরিষ্কার পরিপাটি খাওয়া! রসিয়ে খাওয়াও যে একটা আর্ট তা বুঝলাম সেদিন বিভূতিদার খাওয়া দেখে।
দ্বিতীয় বাটি শেষ করার পর গৃহকর্মী যখন তৃতীয়বার কাঁকড়ার কোলে বাটি ততি করবার জন্য এগিয়ে এলেন—বিভূতিদা তখন একটা কাঁকড়ার আত খোল মুখে পুরে চিবোত চিবোতে মৃদুস্বরে বললেন—আমায় আর কেন। অগত্যা আবার বাটি ভরতি হল, বিভূতিদা নিশ্চিন্ত মনে কাঁকড়া চিবোতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন। বাধ্য হয়েই আমরা তখন উঠবার অনুমতি চাইলাম। ততক্ষণে কাঁকড়ার ঝোল আমাদের হাতের চেটো আর আঙ্গুলে শুকিয়ে আঠার মত এটে গেছে। বিভূতিদা একটু সলজ্জ হেসে অনুমতি দিলেন। বললেন—তোরা ওঠ। আমার একটু দেরিই হবে। ভাল জিনিস রেখে-চেখে না খেলে আমি তৃপ্তি পাইনে।
এই পর্যন্ত বলেই সেদিনের আন্ডার গাল্পিক বন্ধুটি থামলেন। শুধু বললেন–পরের ঘটনা আর না-ই বললাম, অনুমান করে নিন।
অনুমান আমরা সবাই ঠিকই করে নিলাম। তবু প্রশ্ন উঠল আধ বস্তা হয় রান্না হয়েছিল। বাকি আধবস্তা কাঁকড়া কি সত্যি সত্যিই ট্রেনে তুলে দিয়েছিল?
বন্ধুটি বললেন—তা বলতে পারব না মশাই। আমরা তো পরদিন ভোরের গাড়িতেই কলকাতা চলে এলাম। ডাক্তারের নির্দেশে বিভূতিদা থেকে গেলেন। বাকি অর্ধেক কাঁকড়ার খবর বলতে পারব না।
আজ্ঞার আরেক কোণ থেকে একজন প্রশ্ন করলেন-আচ্ছা এই ঘটনার পরে বিভূতিদার সঙ্গে আপনার দেখা হয়েছিল কি?
হয়েছিল মাস দুই পরে কলেজ স্ট্রীটে। মেদিনীপুরের প্রসঙ্গ নিজে থেকেই তুলে বললেন–তিনদিন বিছানা থেকে উঠতে পারি নি। অবশ্য ওদের দোষ নেই। অসময়ে পুকুরের জাত কাঁকড়া যোগাড় করতে না পেরে ধান ক্ষেতের কাঁকড়া ধরে এনেছিল। তা ছাড়া রান্নটা বড়ই উপাদেয় হয়েছিল রে, তাই লোভে পড়ে মাত্রাতিরিক্ত খেয়ে ফেলেছিলাম।
বিভূতিদাকে নিয়েই আমাদের সেদিনকার বৈঠক সরগরম। মেদেনীপুরের কাহিনী শেষ হতেই কে একজন বলে উঠল–বিভূতিদার মেয়ে দেখে বেড়ানোর গল্পটা শুনেছেন?
গল্প পেলেই বৈঠক যেন টগবগিয়ে ওঠে। সঙ্গে সঙ্গে ফরমাশ চা-চাই। এর আগে তিন রাউণ্ড চা হয়ে গেছে তবুও তৃপ্তি নেই। আমার ঘরের বেয়ারা অমর এক কোনায় তার ছোট টেবিলটায় বসে কতকগুলি চিঠি ফাইল করতে ব্যস্ত। দেখতে ছেলেমানুষ, বুদ্ধিতে সেয়ানা। কাজের ভান করে কান দুটো সর্বদা খাড়া রাখে বৈঠকের গল্পের উপর। চায়ের কথা বলতেই অমর বললে—আধ মাইল দূরে চায়ের দোকান। যেতে-আসতে আধঘণ্টা কাবার। তার চেয়ে আমাকে একটা হিটার কিনে দিন আর কয়েকটা পেয়ালা পিরিচ। আমি ঘরে বসে আপনাদের গরম চা করে খাওয়াব। খরচ খাতায় লেখা থাকবে, মাস কাবারে যার ভাগে যা পড়ে হিসেব করে দিয়ে দেবেন।
প্রস্তাবটা সবার ভালই লাগল, সবাই একবাক্যে রাজী। আমি দেখছি ছোকরা ফন্দিটা এঁটেছে ভাল। ব্যবসা-কে ব্যবসা, মনিবেরও পয়সা বাঁচানো ইল। তার চেয়ে বড় কারণ চায়ের জন্য বলতে গিয়ে গল্প থেকে বাদ পড়ে যাওয়া—সেটি আর হচ্ছে না।
অগত্যা চা না আসা পর্যন্ত বিভূতিদাকে আর বৈঠকে আনা গেল না।
চতুর্থ কিস্তির চায়ের কাপে চুমুক মেরে বৈঠকের সেই বন্ধুটি বললেন–বিভূতিদা ঠিক করলেন তার ছোট ভাইয়ের জন্যে একটি পাত্রীর সন্ধান করবেন। বাংলাদেশের প্রত্যেক জিলার শহরে গ্রামে পরিচিত ব্যক্তির কাছে চিঠি চলে গেল। শর্ত শুধু এই, পাত্রীর স্বহস্তে রন্ধন। এবং যে দেশের পাত্ৰী, সে দেশের রান্নার বৈশিষ্ট্যটুকু দেখানোই নির্বাচন-পরীক্ষার একমাত্র মাপকাঠি।
বিভূতিদার ধারণা, ভাল রাঁধুনি না হলে ভাল গৃহিণী হওয়া যায় না।
দিনক্ষণ দেখে বিভূতিদা এক জেলা থেকে আর এক জেলার গ্রামে-গঞ্জে ঘুরে বেড়াতে লাগলেন পাত্রী সন্ধানে। বিভূতিদা ভাল করেই জানতেন যে, পাত্রী সু-রাধুনি হোক চাই না হোক, পাত্রীর মা-দিদিমা ঠাকুরমারা তাদের পাত্রীকে পার করবার জন্য রাঁধুনি-জীবনের অভিজ্ঞতার যাবতীয় এলেম দিয়ে ভক্ত-চচ্চড়ি-ঘন্ট ইত্যাদি রান্না করে পাত্রীর নামেই চালাবেন।
প্রায় মাস-দুই কাল সারা বাংলা দেশ ঘুরে প্রচুর অভিজ্ঞতা নিয়ে বিভূতিদা ফিরলেন। আপনাদের মনে আছে কি না জানি না, সেই বছরের পুজোর সময়ে বিভিন্ন শারদীয়া সংখ্যায় কয়েকটি গল্প বেরিয়েছিল এই পাত্রী দেখানিয়ে, আর কি অসাধারণ সে গল্প। বাঙ্গালী মায়ের অন্তরের বেদনার কী সহজ সরল প্রকাশ।
এইটুকু বলেই বৈঠকী বন্ধুটি সিগারেট ধরালেন। সকলেরই মন ভারাক্রান্ত। সংসারে এক-একজন মানুষ থাকে যাদের বাইরের চালচলন দেখে হাসি পায় বটে, কিন্তু তাদের ভিতরে লুকিয়ে থাকে শিশুর মত সরল ও আপন ভোলা একটি মানুষ যার সংবেদনশীল হৃদয় সংসারের শোক তাপ জ্বালা যন্ত্রণার ঊর্ধ্বে থেকে গভীর প্রশান্তির মধ্যে বিরাজ করে। এমন একটি খাঁটি জীবন-শিল্পী আজ আমাদের মধ্যে নেই, সে-দুঃখেই মন ভারাক্রান্ত। কিন্তু বৈঠকের সেই কশত সাহিত্যিক, ব্যঙ্গাত্মক মন্তব্যে গুমোট আবহাওয়াকে তরল করতে যার জুড়ি মেলে না, তিনি বলে উঠলেন—আসল কথা কি জানেন? বিভূতিবাবু সত্যিই খেতে ভালবাসতেন। তাঁর প্রধান লক্ষ্য ছিল খেয়ে দেখা, মেয়ে দেখা ছিল উপলক্ষ্য।
আমাদের বৈঠকের এক অরসিক বন্ধু বললেন–আজ যদি বিভূতিবাবু বেঁচে থাকতেন এবং গল্প-উপন্যাস না লিখে একখানা প্রমাণ সাইজের গবেষণামূলক বই লিখে তার নাম দিতেন বাংলার রান্না ও রাঁধুনী বা পশ্চিমবঙ্গ রন্ধন সংস্কৃতি তাহলে আকাদমী না পেলেও রবীন্দ্র পুরস্কারটা মারে কে।