০৫. লাল রঙের গাড়িটার পেছনের সিটে

এখন আমি আমাদের লাল রঙের গাড়িটার পেছনের সিটে বসে আছি। আমার মা আমার হাত ধরে আছেন। যেহেতু আমার কিছুই করার নেই। আমি মনে মনে ডায়েরি লিখছি। এই কাজটা আমি খুব ভাল করি। আমি কল্পনা করে নেই আমার সামনে মস্ত বড় সাদা একটা কাগজ। সেই কাগজে। আমি পেন্সিল দিয়ে লিখছি। পেন্সিলের রঙ নীল। তার লেখাও নীল। লেখা পছন্দ না হলে কাটাকুটিও করছি। কিছু লেখা আবার ইরেজার দিয়ে মুছে নতুন করে লিখছি। সব বয়স্ক মানুষের কিছু কিছু ছেলেমানুষী খেলা থাকে। এও আমার এক ধরনের খেলা।

কাগজ কলম দিয়ে কিছু লিখতে আমার ভাল লাগে না, তবে মনে মনে ডায়েরি লিখতে আমার ভাল লাগে।

আমার নাম শুভ্ৰ এই বাক্যটি দিয়ে আমি লেখা শুরু করেছি। শুরুতেই ভুল করেছি। — শুরুর বাক্যটা হওয়া উচিত ছিল— আজ আমার বাবা মারা গেছেন। এখন আমরা তাঁর মৃতদেহ নিয়ে বনানী গোরস্তানের দিকে যাচ্ছি। বনানী গোরস্তানে বাবার জন্যে জায়গা কেনা আছে। সেখানে তার কবর হবে। কবর বঁধানো হবে। শ্বেতপাথরের নামফলক বাধানো কবরে লাগিয়ে দেয়া হবে। যতবার আমরা গোরস্তানে আসব নামফলকের নাম আগ্রহ নিয়ে পড়ব। জন্ম এবং মৃত্যুর তারিখ পড়ব। এক সময় তার চেহারা আমাদের কাছে অস্পষ্ট হতে শুরু করবে। শ্বেতপাথরের লেখাটাও নষ্ট হতে থাকবে। মোতাহার-এর র-এর ফোটা উঠে গিয়ে হয়ে যাবে মোতাহাব।

আমার কাছে এখনই বাবাকে অস্পষ্ট লাগছে। তিনি চুলে কীভাবে সিঁথি করতেন? আশ্চৰ্য মনে পড়ছে নাতো। মাকে কি জিজ্ঞেস করব? মা! এখন শান্ত ভঙ্গিতেই বসে আছেন। মাঝে মধ্যে সরু চোখে আমাকে দেখছেন। বনানী যেতে সময় লাগবে। গাড়ি জামে পড়বে, মহাখালি রেল ক্ৰশিং-এ গেস্ট পড়ে যাবে। এতক্ষণ কি আমরা চুপচাপ বসে থাকব!

শুভ্ৰ পানি খাবি?

মার কথা শুনে চমকে উঠলাম। কেন চমকালাম- আমি কি ধরেই নিয়েছি মা সারাপথ কথা বলবেন না। চোখ এবং নাক মুছতে মুছতে সময় পার করবেন।

আমি মার প্রশ্নের জবাবে হ্যাঁ-না কিছুই বললাম না। মা খয়েরি রঙের ব্যাগের ভেতর থেকে পানির বোতল বের করলেন। গ্লাস বের করলেন। পানি ঠাণ্ডা। ফ্ৰীজ থেকে বোতল নিয়ে এসেছেন। আমার যে এতটা তৃষ্ণা পেয়েছিল বুঝতে পারিনি। পরপর দুগ্লাস পানি খেয়ে ফেললাম। তারপরেও মনে হল তৃষ্ণা যায় নি। আরো এক গ্ৰাস পানি খেতে পারব।

মা আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। পিতার মৃত্যু-শোকে আমি কতটা কাতর হয়েছি। এই কি বুঝতে চেষ্টা করছেন? নাকি অন্য কিছু?

খালি পেটে দুগ্ৰাস পানি খাবার জন্যেই বোধহয় এখন কেমন বমি বমি আসছে।

গাড়ি থামিয়ে পানের দোকান থেকে আমি কি একটা পান। কিনে নেব? মিষ্টি পান। খুবই হাস্যকর ব্যাপার হবে না? সাদা রঙের পিক আপ ভ্যানে বাবার মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তার পেছনে পেছনে যাচ্ছি। আমি। পথে গাড়ি থামিয়ে আমার একটা মিষ্টি পান। কিনে নেয়াটা খুব কি দোষনীয় হবে?

কথা ছিল মৃতদেহের সঙ্গে আমি যাব। তাই না-কি নিয়ম— অতি প্রিয়জনরা মৃতদেহের সঙ্গে যায়। আমিও খুব আগ্রহের সঙ্গেই যেতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু মা রাজি হলেন না। তিনি বললেন, না না খোকন ভয় পাবে। শুভ্ৰ ভয় পাবে না বলে তিনি বললেন, খোকন ভয় পাবে। হঠাৎ হঠাৎ মা আমাকে শুভ্ৰ না ডেকে খোকন ডাকেন। কেন ডাকেন? মানুষের প্রতিটি কর্মকাণ্ডের পেছনে কারণ থাকে। শুভ্র না ডেকে খোকন ডাকার পেছনে কারণ কী?

আমি মার দিকে তাকলাম। মা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, কীরে শরীর খারাপ লাগছে?

না।

একটু পরপর ঠোঁট চাটছিস কেন?

শরীর খারাপ লাগছে মা, বমি বমি লাগছে। পান খেতে ইচ্ছা করছে।

মা আবারো তার খয়েরি ব্যাগে হাত দিলেন। ব্যাগ থেকে এখন কি মিষ্টি পান বের হবে? আর কী আছে। এই ক্যাগে? চা আছে? মা কি ফ্লাস্ক ভর্তি চা নিয়ে এসেছেন? নোনতা বিসকিট? মাথা ধরার এসপিরিন ট্যাবলেট?

মিষ্টি পান না, সুপারির কোটা বের হল। সুপারি মুখে দিতে দিতে বললাম, মা আমার শুভ্ৰ নাম কে রেখেছে? তুমি?

না। তোর বাবা।

তুমি যে মাঝে মাঝে আমাকে খোকন ডাক। খোকন নাম কে রেখেছে? কেউ রাখে নি। খোকন, বাবু এইসব নাম রাখতে হয় না। আপনা আপনি হয়ে যায়।

বলতে বলতে মা নিজেও দুটুকরা সুপারি মুখে দিলেন। এতক্ষণ তাঁর মাথায় ঘোমটার মত শাড়ির আঁচল ছিল। এখন সেই আঁচল পড়ে গেল। তিনি আঁচল তুলে দিলেন। তাকে এখন কত সহজ স্বাভাবিক লাগছে; মনেই হচ্ছে না। এই মহিলা তাঁর স্বামীর মৃতদেহ কবর দিতে নিয়ে যাচ্ছেন। বরং মনে হচ্ছে তিনি তাঁর ছেলেকে চোখের ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাচ্ছেন। ডাক্তার দেখিয়ে ফেরার পথে কোনো এক কফি শপের কাছে গাড়ি থামাবেন। মাতা ও পুত্র গাড়িতে বসে থাকবে। ড্রাইভার এক দৌড়ে পেপার কাপে দুজনের জন্যে কফি নিয়ে আসবে। ফেনা ওঠা এক্সপ্রেসো কফি।

গাড়ি জামে আটকা পড়েছে। ট্রাফিক পুলিশ, ট্রাফিক সার্জেন্টিরা ছোটাছুটি করছে। ক্রমাগত বাঁশিতে ফু দিচ্ছে। একজন রিকশাওয়ালাকে কোনো কারণ ছাড়াই ধাক্কা দিয়ে রিকশা থেকে ফেলে দিল। যানজট খুলে দেবার জন্যে তাদের এত ব্যস্ততার কারণটা কী? প্রধানমন্ত্রীর গাড়ি কি এই পথে যাবে? আমি বেশ আগ্ৰহ নিয়ে গাড়ির জানালা দিয়ে তাকিয়ে আছি। যদি প্রধানমন্ত্রীকে এক ঝলক দেখা যায়। গুরুত্বপূর্ণ মানুষদের দেখতে আমাদের ভাল লাগে। তারা কেমন হুস করে সামনে দিয়ে চলে যান। পুরোপুরি দেখা যায় না। রবার্ট ফ্রাষ্টের একটা কবিতা আছে – যে সব দৃশ্য আমরা খুব মন লাগিয়ে দেখতে চাই সে সব দৃশ্য কখনো ভালভাবে দেখতে পারি না। সেই সব দৃশ্য অতি দ্রুত চোখের সামনে দিয়ে চলে যায়।

Heaven gives its glimses only to those
Not in position to look too close.

গাড়ির বহরের মাঝখানে হাসি হাসি মুখ করে বসে থাকা প্রধানমন্ত্রীকে দেখতে আমার ভাল লাগে। পুরনো দিনের কথা মনে হয়। হাতীর পিঠে করে রাজা যাচ্ছেন; সামনে পেছনে পাইক-বীরকন্দাজ। রাজার মুখে কোমল হাসি। রাজার চোখ প্রজাদের জন্যে করুণায় আর্দ্র। বিয়ে করে বির তার স্ত্রীকে নিয়ে চলে যাচ্ছেএই দৃশ্য দেখতেও ভাল লাগে। খুব ইচ্ছা করে নতুন বিয়ে হওয়া মেয়েটির মুখ আমি ভাল করে দেখি। কখনো দেখা হয় না। নতুন বউ ঘোমটা দিয়ে থাকে। মাথা নিচু করে বসে থাকে। বরের মুখ সব সময় দেখা যায়, শুধু কনেরটাই দেখা যায়।

মৃতদেহ নিয়ে যে গাড়ি যায় সেই গাড়ির দিকেও সবাই খুব আগ্রহ নিয়ে তাকায়। গাড়িতে একটা লাল নিশান উড়ে। লাল নিশান মানেই শব বহনকারী গাড়ি। তবে সবাই আগ্রহ নিয়ে তাকালেও মৃতদেহের মুখ কেউ দেখতে চায় না। মৃতদেহ নিয়ে যারা যাচ্ছে তাদেরকে দেখতে চায়। মৃত মানুষকে দেখে কী হবে? মৃত মানুষের কোনো গল্প থাকে না। মানুষ গল্প চায়।

খোকন!

মা আমার আরো কাছে সরে এলেন। আমি মার দিকে তাকলাম।

মা ফিস ফিস করে বললেন, তোর বাবার উপর তুই কোনো রাগ রাখিস না। মৃত মানুষের উপর কোনো রাগ রাখতে নেই।

আমার কোনো রাগ নেই।

তোর বাবা মানুষ খারাপ ছিল না।

খারাপ থাকবে কেন?

মা কথা ঘুরিয়ে বললেন, তোর বমি বমি ভাবটা কি দূর হয়েছে?

হ্যাঁ।

আমাদের ঠিক সামনেই সাদা পিক-আপ ভ্যান। সেই ভ্যানে বাবার অফিসের কর্মচারীরা বসে আছে। তাদের মাঝখানে বাবার মৃতদেহ। এইসব কর্মচারীরা এক সময় বাবার ভয়ে অস্থির ছিল। এখনো তারা ভয় পাচ্ছে। তাদের চেহারা দেখেই বোঝা যাচ্ছে তারা ভয় পাচ্ছে। মৃত মানুষকে সবাই ভয় পায়।

রাস্তার যানজট পরিষ্কার হয়েছে। তবে পুলিশ আমাদের গাড়ি আটকে রেখেছে। শুধু লাশবহনকারী পিকআপ ছেড়ে দিয়েছে। নিশ্চয়ই প্রধানমন্ত্রী বা এই পর্যায়ের কেউ যাবেন। মা বললেন, ভাল যন্ত্রণায় পড়া গেল দেখি।

আমার মনে হচ্ছে এটা মায়ের কথার কথা। তার সামনে থেকে লাশের গাড়িটা চলে গেছে। এই ঘটনায় তিনি আনন্দিত।

শুভ্র!

হুঁ।

শুরুত্ৰ নামটা আসলে তোর বাবা রাখে নি। এখন মনে পড়েছে! তোর বাবার এক বন্ধু তোকে দেখে অবাক হয়ে বলেছিল— ছেলের কী অদ্ভুত গায়ের রঙ! একেবারে তুষার-শুভ্ৰ। সেই থেকে তোর নাম শুভ্ৰ।

বাবার ঐ বন্ধুর নাম কী?

রহমান সাহেব।

তাকে কি আমি দেখেছি?

খুব ছোটবেলায় দেখেছিস। রোড একসিডেন্টে মারা গেছেন।

গাড়ি আবার চলতে শুরু করেছে। গাড়ির ড্যাম বোর্ডের ঘড়িতে চারটা চল্লিশ বাজে। আকাশ অন্ধকার। মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে। বৃষ্টির পানিতে কবর ভর্তি হয়ে যাবে। পানির ভেতর কফিন নামিয়ে মাটি চাপা দিয়ে আমরা চলে আসব। ব্যস শেষ।

শুভ্ৰ, তোর কি মাথা ধরেছে?

না।

চোখ বন্ধ করে হেলান দিয়ে শুয়ে থাক, ভালো লাগবে।

আমি মাতৃভক্ত সন্তানের মতো চোখ বন্ধ করে গাড়ির পেছনের সিটে হেলান দিয়ে শুয়ে আছি। ডায়েরি লেখা এখন প্ৰায় শেষ পর্যায়ে। কারণ আমরা প্ৰায় পৌছে। গেছি। শেষ অংশে ইন্টারেস্টিং কিছু লিখতে হবে।

আমি মাতৃভক্ত সন্তানের মতো চোখ বন্ধ করে গাড়ির পেছনের সিটে হেলান দিয়ে শুয়ে আছি। ডায়েরি লেখা এখন প্ৰায় শেষ পর্যায়ে। কারণ আমরা প্ৰায় পৌঁছে। গেছি। শেষ অংশে ইন্টারেস্টিং কিছু লিখতে হবে।

এখন বাজছে চারটা পঞ্চাশ। টিপটপ করে বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টিকে শুভ ও মঙ্গলময় ধরা হয়। মৃত্যুও শুভ এবং আমার বাবা মোতাহার হোসেন সাহেব মঙ্গলময় বৃষ্টিতে তাঁর যাত্রা শুরু করবেন। এটা মন্ত না। পুত্র হিসাবে তার প্রতি আমার কোনো অভিযোগ নেই। একজন মানুষকে এই পৃথিবীতে নানান ভূমিকায় অভিনয় করতে হয়। পিতার ভূমিকায়, স্বামীর ভূমিকায়, বন্ধুর ভূমিকায়…। সবাই সব অভিনয় পারে না। যে পিতার ভূমিকায় চমৎকার অভিনয় করে দেখা যায় স্বামীর ভূমিকায় তার অভিনয় খুব খারাপ হচ্ছে। অভিনয় এতই খারাপ হয় যে তাকে অভিনয় করতে দেয়া হয় না। স্টেজ থেকে নামিয়ে দেয়া হলো। বাবা নিশ্চয়ই কিছু কিছু চরিত্রে খুব ভালো অভিনয় করেছেন। পিতার চরিত্রে তার অভিনয় ভালো ছিল।

আমরা এসে পৌঁছে গেছি। গেটের কাছে গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। বাবার অফিসের ম্যানেজার এগিয়ে আসছে। তার মুখ গম্ভীর। সে হাঁটছেও মাথা নিচু করে। বেচারা বোধহয় তাড়াহুড়ার কারণে টুপি আনতে ভুলে গেছে। হলুদ রঙের একটা রুমাল মাথায় দিয়েছে।

আমি মার দিকে তাকিয়ে বললাম, আচ্ছা মা, একটা কথা— স্বামী হিসেবে বাবা কেমন ছিল?

মা সঙ্গে সঙ্গে বললেন, ভালো।

ভালো মানে কতটুকু ভালো?

মা একটু থেমে বললেন, তোর বাবা ছিল আদর্শ স্বামী।

মাকে আমার আরো একটা প্রশ্ন করার ইচ্ছা ছিল। প্রশ্ন করা হলো না। ম্যানেজার সাহেব এসে গাড়ির দরজা খুলে দিয়েছেন। বৃষ্টি বেশ ভালোই নেমেছে। আজকের বৃষ্টিটা মনে হয় আকাশের অনেক উপরের থেকে আসছেখুব ঠাণ্ডা! গা শিরশির করছে। খাটিয়া নামিয়ে রাখা হয়েছে। খাটিয়ার উপর দুজন মানুষ ছাতা ধরে আছেন। শবদেহে যেন বৃষ্টির ফোঁটা না পড়ে। খাটিয়ার পাশে হাতলওয়ালা এক চেয়ার। সেখানে মৌলানা সাহেব বসে আছেন। তার গায়ে সৌদিদের মতো পোশাক। আজকাল মৌলানাদের মধ্যে এই জাতীয় পোশাকের খুব চল হয়েছে। মৌলানা সাহেব বিরক্ত মুখে গাড়ি দেখছেন। মনে হচ্ছে তার অন্য কোনো এপয়েন্টমেন্ট আছে; আয় কেউ হয়তো মারা গেছে। তাকেও কবরে নামাতে হবে।

ডক্টর জিভাগো উপন্যাসে শবদেহ সমাধিস্ত করার সুন্দর বর্ণনা আছে- ঝড় বৃষ্টির মধ্যে শবদেহ কবরে নামানো হল। কবরে কয়েকটা জীবন্ত ব্যাঙ। ব্যাঙ সহই মাটি চাপা দেয়া হল। বাচ্চা একটি মেয়ে দৃশ্যটি দেখছে। তার মাথায় ঘুরছে শুধুই জীবন্ত ব্যাঙগুলির কথা।

বৃষ্টি আরো বাড়ছে। ম্যানেজার সাহেব একটা ছাতা এনে মায়ের মাথার সামনে ধরেছেন। আমার মাথায় কবিতার লাইন ঘুরছে—

বাদলা দিনে মনে পড়ে ছেলেবেলার গান
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এল বান।

আমি খুবই অস্বস্তি বোধ করছি, কারণ এই দুটা লাইন আজ আমার মাথায় ঢুকে যাবে। আমার মগজের ভেতর বসে কেউ একজন টানা টানা গলায় ক্রমাগত বলতে থাকবে–

বাদলা দিনে মনে পড়ে ছেলেবেলার গান
বৃষ্টি পড়ে টাপুর টুপুর নদেয় এল বান।

কবর ঘেঁষে বিনু দাঁড়িয়ে আছে। বিনুর বাবা তার মাথার উপর ছাতি ধরে আছেন। ভদ্রলোকের নাম যেন কী? নামটা মনে পড়ছে না— তবে একটু পরেই মনে পড়বে। আমি অন্যকিছু ভাবব আর আমার মস্তিষ্ক স্মৃতির ফাইল ঘেঁটে ভদ্রলোকের নাম বের করে আমাকে জানাবে, হুট করে বলবে, হ্যালো মিস্টার নাম পাওয়া গেছে। বিনু মেয়েটার বাবার নাম হল…।

বিনুর বাবা ভিজছেন। তিনি ভিজবেন কিন্তু মেয়েকে ভিজিতে দেবেন না। ভদ্রলোক তাঁর মেয়েকে নিয়ে যেতে এসে ফেঁসে গেছেন। ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তাকে হয়ত কবরস্থানে আসতে হয়েছে। বিনু কি আজ রাতে চলে যাবে? হয়ত যাবে। আমি আর মা এই দুজন বাড়ি ফিরে যাব। পুরো দুতলাটা থাকবে খালি! কাজের মেয়েটাকে মা আজ দুপুরে বিদেয় করে দিয়েছেন। নিশ্চয়ই সে কোনো একটা অপরাধ করেছে; মার চোখে মস্ত বড় অপরাধ। তবে মার চোখে মস্ত বড় অপরাধগুলি আসলে হয় তুচ্ছ অপরাধ। নিতান্তই তুচ্ছ কোনো কারণে বেচারীর চাকরি গেছে। সেই কারণটা এক সময় মার কাছ থেকে জেনে নিতে হবে। আচ্ছা কাজের মেয়েটার নাম যেন কী? এই মেয়েটার নামওতো জানতাম। আজ দেখি সবই ভুলে যাচ্ছি। বিনুর বাবার নাম এখনো আমার মস্তিষ্ক খুঁজে বের করতে পারে নি। মীরাদের বাড়িতে যে আর্কিটেক্টের সঙ্গে দেখা হয়েছিল তার নাম কী?

হ্যাঁ তাঁর নামটা মনে আছে – আখলাক সাহেব; এই ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা হলে বলতে হবে।— ভাই শুনুন, আমাদের বাড়ির কাছাকাছি একটা পতিতালয় আছে কি-না। আপনি জানতে চেয়েছিলেন। আমি বলেছিলাম আছে। কিন্তু আসল খবরটা দেয়া হয় নি। সেই পতিতালয়ের একটা অংশের মালিক উত্তরাধিকার সূত্রে আমি। পতিতালয়ের ভেতর তিনটা বাড়ি আছে আমাদের। তিনটা বাড়িতে তিনজন মাসি। তারাই মূল ব্যবসা দেখাশোনা করে। মেয়েদের রোজগারের পঞ্চাশ পার্সেন্ট আমরা পাই। মেয়ের সংখ্যা সব মিলিয়ে বাহান্ন। একদিন আসুন আপনাকে নিয়ে যাব।

মীরাকেও খবরটা দিতে হবে। আজ রাতেই খবরটা দেয়া ভালো।

কাজের মেয়েটার নাম মনে পড়েছে। রমিজা। বিনুর বাবার নামও মনে পড়েছে। হাবীবুর রহমান। মানুষের মস্তিষ্কের কাজকর্মের ধারা তো অদ্ভুত। তাকে প্রথমে খুঁজতে বলা হয়েছে বিনুর বাবার নাম। তারপর কাজের মেয়েটার নাম। সে আগে খুঁজে বের করেছে কাজের মেয়েটার নাম। আশ্চর্য তো।

ম্যানেজার ছালেহ একদৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি কী দেখছেন? শোকে কাতর সন্তানের মুখ? আমাকে দেখে কি শোকে কাতর মনে হচ্ছে? তবে মাকে মনে হচ্ছে। তিনি আমার পাশেই দাঁড়িয়ে আছেন। তাঁর শরীর থরথর করে কাঁপছে।

বাবাকে কবরে নামানো হচ্ছে। মৃত মানুষকে বাবা ডাকছি এটা কি ঠিক হচ্ছে? মৃত মানুষ বাবা হতে পারে না। মা হতে পারে না। মৃত হলো মৃত।

কবরে মাটি ছুড়ে দেয়ার নিয়ম। কেউ একজন এসে আমার হাতে এক মুঠ মাটি এনে দিল। মাটি ছুড়ে দেবার সময় কি বলতে হয় Dust to dust? না এটা তো। খ্রিস্টানদের ব্যাপার। মুসলমানরা নিশ্চয়ই অন্য কিছু বলে–

বাবার সম্পর্কে সুখময় কোনো স্মৃতি মনে করার চেষ্টা করছি। মনে পড়ছে না। মনে হচ্ছে বাবার সম্পর্কে আমার মনে কোনো সুখ-স্মৃতি নেই। একটা কিছু মনে করতে চাই। সুখ-স্মৃতি। মন দ্রবীভূত হয়ে যাবার মতো কোনো স্মৃতি।

মনে পড়ছে না। কিছুই মনে পড়ছে না; ম্যানেজার ছালেহ হাউমাউ করে কাঁদছেন। তার সঙ্গে আরো অনেকেই কাঁদছে। বাবার অফিসের লোকজন। তাদের এই শোক লোক দেখানো নয়। এই শোক হৃদয়ের গভীর থেকে উঠে এসেছে। বাবাকে এরা যে ভালোবাসত এ সম্পর্কে কোনো সন্দেহ নেই।

যে ব্যক্তি দশজন ব্যক্তির সত্যিকার ভালোবাসা পাইয়াছে তাহার বিষয়ে সাবধান। কারণ সে ঈশ্বরের অংশ।

এটা কার কথা? স্বামী বিবেকানন্দ নাকি রামকৃষ্ণ পরমহংস? মনে পড়ছে না। আমি মার দিকে তাকালাম। মা ক্ষীণ গলায় বললেন, তোমরা কেউ আমার খোকনকে ধরে; ও কেমন কাঁপছে দেখো। পড়ে যাবে তো।

 

হাবীবুর রহমানের মুখ দুঃশ্চিন্তায় এতটুকু হয়ে গেছে। মনে মনে ক্রমাগত দোয়া ইউনুস পড়ছেন। মহাবিপদে পড়লে এই দোয়া খুব কাজে লাগে। তিনি অতীতেও কয়েকবার বড় ধরনের বিপদে পড়েছিলেন। এই দোয়া পড়ে উদ্ধার পেয়েছেন। এবার কি পাবেন? আল্লাহ বার বার মানুষকে উদ্ধার করেন না। একজনকে তিনি কতবার উদ্ধার করবেন? ইউনুস নবীকে তিনি একবারই মাছের পেট থেকে নাজাত করেছিলেন। তিনি যদি আরো কয়েকবার মাছের পেটে ঢুকতেন তাহলে তাকে উদ্ধার করতেন কি-না কে জানে।

হাবীবুর রহমানের বিপদের কারণ হল তিনি খালি হাতে ঢাকায় এসে উপস্থিত হয়েছিলেন। ভেবে রেখেছেন মোতাহার সাহেবের কাছে যাবেন, তাকে বিপদের কথা বলবেন। তিনি নেত্রকোনায় ফিরে যাবার ভাড়ার টাকা দিয়ে দেবেন। মোতাহার সাহেবের মত মানুষের জন্যে এটা কোনো ব্যাপারই না।

আল্লাহপাকের কাজ বোঝা মুশকিল। এসে দেখেন— সাড়ে সর্বনাশ। মরা বাড়ি। যার কাছে টাকা চাইবেন সে মরে পড়ে আছে। মানকের নোকরের সোয়াল জওয়াবের অপেক্ষা করছে। পুলছিরাত কীভাবে পার হবে সেই ভাবনাতেই সে অস্থির। তার কাছে টাকা চাইবে কী? সে নিজেই পাড়ের কড়ির চিন্তায় অস্থির।

সে বাড়িতে মৃত্যুর মত ভয়াবহ ঘটনা ঘটেছে সে বাড়িতে অন্য কারোর কাছেও টাকা ধার চাওয়া যায় না। হাবীবুর রহমান ভেবেই পেলেন না। তিনি মেয়েকে নিয়ে নেত্রকোনায় কীভাবে ফিরবেন। তার কাছে সর্বমোট আঠারো টাকা পঞ্চাশ পয়সা আছে। এই টাকায় হয়তবা কমলাপুর রেল ষ্টেশন পর্যন্ত যাওয়া যাবে। তারপর? রেলের টিকিট কীভাবে কাটবেন? বিনা টিকিটে যে ট্রেনে উঠবেন সে উপায়ও নেই। কমলাপুর ইস্টশনে ব্যবস্থা ভিন্ন। স্টেশনে ঢোকার আগেই টিকিট চায়। ধরা গেল কোনো এক কৌশলে বিনা টিকিটেই স্টেশন ঢুকলেন, এখানেই বিপদের শেষ না। ট্রেনে চেকিং হবে। টিকিট চেকার যখন টিকিট চাইবে তখন তিনি কী বলবেন? এতবড় মেয়ের সামনে টিকিট চেকার যখন তাকে ট্রেন থেকে নামাবে। তখনইবা তিনি কী করবেন? টিকিট চেকার খারাপ ধরনের অপমানও করতে পারে। তার পরিষ্কার মনে আছে একবার নান্দাইলরোড ষ্টেশনে মোবাইল কোট বসেছে। বিনা টিকিটের বিশ একুশজন যাত্রী পাওয়া গেল। ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের হুকুমে তারা কানো ধরে দশবার উঠবোস করেছে। তিনি ট্রেনের জানালা থেকে এই দৃশ্য দেখে খুবই মজা পেয়ে বলেছিলেন– উচিত শিক্ষা হয়েছে।

আল্লাহপাক মনে হয় এতদিন পর সেই ঘটনার শোধ নিচ্ছেন। সেদিন তিনি নিশ্চয়ই তার উপর খুবই রাগ হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন- হে বান্দা তুমি অন্যের অপমান দেখে মজা পেয়েছে; অন্যের লজ্জা দেখে আনন্দ করেছ। ইহা উচিত কর্ম নহে। একদিন এই অবস্থার ভিতর দিয়ে তোমাকেও যাইতে হইবে। ইহাই আমার বিধান।

গ্রামের কথা আছে – যে যার নিন্দে, তার দুয়ারে বসে কান্দে।

হাবীবুর রহমান পুরোপুরি নিশ্চিত হয়ে গেলেন যে তাঁর কপালে এই দুৰ্দশা আছে। দুয়ারে বসে গলা ছেড়ে তাকেই কাঁদতে হবে।

কমলাপুর রেলস্টেশনে ঢুকতে তাঁর কোনো অসুবিধা হয় নি। টিকিট চেকার অন্যদের কাছে টিকিট চাইলেও তার কাছে চায় নি। ট্রেনের কামরায় তিনি ভাল সীটও পেয়ে গেলেন। জানালার পাশে সীট। কামরাও ফাঁকা, ভিড় তেমন নেই।

সব কিছুই ঠিকঠাক মত এগুচ্ছে। এর ফল শুভ নাও হতে পারে। হাবীবুর রহমান ট্রেন ছাড়ার আগ মুহুর্ত পর্যন্ত ক্টেশনের প্লাটফর্মে হাঁটাহাটি করলেন। তাঁর দেখার বিষয় একটাই। টিকিট চেকার কোন কামরায় উঠে। তার মন একবার বলছে, এত ভয় পাবার কিছু নেই। পাকিস্তান আমলে ট্রেনে যত কড়া চেকিং হত, এখন তত কড়া চেকিং হয় না। পরীক্ষণেই মন বলছে- জীবনের সবচে বড় অপমান আজই হতে হবে। মেয়ের সামনে তাকে নিয়ে হাজতে ঢুকিয়ে দেবে।

হাবীবুর রহমানের হাতের শেষ সম্বল পাঁচ টাকাটা তিনি খরচ করে ফেললেন। মেয়ের জন্যে একটা সাগর কলা, একটা বিসকিট এবং এক কাপ চা কিনলেন। ট্রেন ছাড়তে দেরি আছে। বিনু কিছু খাওয়া দাওয়া করে নিক। মেয়েটা মরা বাড়ি থেকে আসছে- সারাদিন নিশ্চয়ই কিছু খায় নি।

বিনু কোনোরকম আপত্তি না করে কলাটা খেল। চায়ে ড়ুবিয়ে বিসকিট খেল। চায়ের শেষ ফোঁটাটা পর্যন্ত খেল। মেয়েটা এত আগ্রহ করে খাচ্ছে দেখে হাবীবুর রহমানের চোখে পানি এসে গেল। আহা বেচারী, নিশ্চয়ই খুব ক্ষিধে লেগেছে। বোঝাই যাচ্ছে মরা বাড়িতে সারাদিন সে কিছুই খায় নি। তার কাছে টাকা থাকলে মেয়েটার জন্যে এক প্যাকেট বিরিয়ানী কিনে আনতেন। তিনি দেখেছেন রেল স্টেশনের স্টলে প্যাকেট বিরিয়ানী বিক্রি হচ্ছে। ফুল প্লেট পঞ্চাশ টাকা। হাফ প্লেট ত্ৰিশ টাকা। হাফ প্লেটে দুই পিছ মাংস, একটা চপ এবং অর্ধেকটা ডিম আছে।

হাবীবুর রহমান বললেন, মারে পান খাবি?

বিনু বলল, খাব।

হাবীবুর রহমান মেয়ের জন্যে মিষ্টিপােন কিনে আনলেন।

বিনু বলল, বাবা তুমি প্লাটফর্মে হাঁটাহাটি করুছ কেন? উঠে এসো। হাবীবুর রহমান বললেন, ট্রেনের বগির ভিতর কেমন দমবন্ধ দমবন্ধ লাগে। ট্রেন ছাড়ার আগে আগে উঠবরে মা।

তাহলে জানালার কাছে থাক। তুমি দূরে গেলে আমার অস্থির লাগে।

এই কথাতেও হাবীবুর রহমানের চোখ ভিজে গেল। তিনি দূরে গেলে মেয়েটার অস্থির লাগে। মেয়ের বিয়ে হয়ে যাবে। সে তো দূরে চলে যাবেই। আহারে বেচারি। খুব অস্থির থাকবে।

বিনু বলল, বাবা তোমাকে এত চিন্তিত লাগছে কেন?

হাবীবুর রহমান বিব্রত গলায় বললেন, চিন্তিত নারে মা। মনটা খারাপ। মানুষটা মরে গেল। একটা ভাল মানুষ পৃথিবী থেকে কমে গেল।

উনি খুব ভাল মানুষ ছিলেন বাবা?

অত্যাধিক ভাল ছিলেনরে মা। বিপদে পড়ে যতবার তার কাছে সাহায্যের জন্যে গিয়েছি ততবার তিনি সাহায্য করেছেন। তার কাছে আমার যে ঋণ সেই ঋণ কীভাবে শোধ দিব। তাই ভাবতেছি।

সব ঋণ শোধ করতে হয় না।

তাও ঠিক। তবে মা আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছি। গ্রামে ফিরেই উনার জন্যে কোরান মজিদ খতম দিব। কিছু ফকির মিসকিন খাওয়াব।

বিনু বলল, তুমি আবার ফকির মিসকিন কি খাওয়াবা? তুমি নিজেইতো ফকির মিসকিন।

তাও সত্যি মা। অতি সত্য কথা।

বাবা তুমি কি টিকিট করেছ? তোমাকে টিকিট করতে দেখলাম না।

হাবীবুর রহমান চুপ করে রইলেন, কিছু বললেন না। বিনু বলল, তোমার কাছে কি টিকিট কিনার টাকা নাই?

হাবীবুর রহমান এই কথারও জবাব দিলেন না। লজ্জায় তাঁর মরে যেতে ইচ্ছা করছে। বিনু বলল, যাও টিকিট কেটে আনা। আমার কাছে টাকা আছে।

তুই টাকা কোথায় পেলি?

চাচি দিয়েছেন।

হঠাৎ তোকে টাকা দিলেন কেন? তুই চেয়েছিল।

ছিঃ আমি চাইব কেন? তুমি একটা চিঠি লিখেছিলে না। টাকা নেই বলে আমাকে নিতে আসতে পারছি না। এই চিঠিটা উনি পড়েছিলেন। আমার মনে হয়। এই জন্যেই দিয়েছেন। আমি নিতে চাই নি। উনি জোর করেই দিয়েছেন।

কত টাকা?

দুই হাজার টাকা।

হাবীবুর রহমান ধরা গলায় বললেন, অতি মহিয়সী মহিলা। ঠিক নারে মা? কতবড় বিপদ তাঁর মাথার ওপর। স্বামী মারা গেছে। সব আঁউলা ঝাউলা। এর মধ্যেও মনে রেখেছেন– তোর হাত খালি। আল্লাহপাক যে বেহেশতো তৈরি করে। রেখেছেন সেই বেহেশতো আমার মত নাদানের জন্যে না। এইসব মানুষের জন্যে। বুঝলি মা আমি ঠিক করেছি— শুভ্ৰ সাহেবের মার জন্যেও আমি কোরান খতম দিব। ফকির মিসকিন খাওয়াব।

যাকে তোমার পছন্দ হয় তার জন্যেই তুমি কোরান খতম দাও। ফকির মিসকিন খাওয়াও। তোমার জীবনতো কেটে যাবে কোরান খতম দিতে দিতে। আর ফকির মিসকিন খাওয়াতে খাওয়াতে।

মাগো এইটাও আল্লাহপকের নির্ধারণ করা। আল্লাহপাক আমার জন্যে কোরান পাঠ নির্ধারণ করে রেখেছেন। আমি কী করব বল?

 

ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। হাবীবুর রহমান মেয়ের পাশে বসে আছেন। তাঁর মন আনন্দে পরিপূর্ণ। কারণ তিনি টিকিট কেটেছেন। হাফ প্লেট বিরিয়ানী কিনে মেয়েকে খাইয়েছেন। মেয়ে বাবার ঘাড়ে মাথা রেখে ঘুমুচ্ছে। ঘুমের মধ্যে মেয়েটা বোধহয় দুঃস্বপ্ন দেখছে। কেঁপে কেঁপে উঠছে। হাবীবুর রহমান জানোলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছেন। জানালার বাইরে ঘন অন্ধকার। সেই অন্ধকার দেখতেও তার ভাল লাগছে। তিনি মনে মনে তাঁর মেয়ের জন্য পরম করুণাময়ের কাছে প্রার্থনা করছেন

হে আল্লাহপাক। হে গাফুরুর রহিম, ইয়া জালজালালে ওয়াল একরাম— তুমি দয়া করি আমার মেয়েকে। বড়ই ভাল মেয়ে, বড়ই লক্ষ্মী মেয়ে। তাঁর জীবনটা তুমি আনন্দে পরিপূর্ণ করে দাও। তোমার অসীম দয়া; তার এক বিন্দু যদি তুমি আমার মেয়েকে দাও— তোমার দয়া তাতে কমবে নাগো— পারওয়ার দেগার। এই নিশিরাতে আমি আমার মেয়ের হয়ে তোমার দরবারে হাত তুললাম।

জানোলা দিয়ে হুহু করে বাতাস আসছে। হাবীবুর রহমান চিন্তিত বোধ করছেন। মেয়েটার না। আবার ঠাণ্ডক্স লেগে যায়। পাতলা চাঁদর থাকলে মেয়েটাকে ঢেকে দিতে পারতেন। ট্রেনের খোলা জানালার হাওয়া খুব খারাপ জিনিস। ঠাণ্ডক্সটা বুকে বসে যায়। তাঁর একবার এইরকম করে ঠাণ্ড লেগে গেল। তবলীগ জামাতে মুসুল্পীদের সঙ্গে চিটাগাং যাচ্ছিলেন। জানালার কাছে বসেছিলেন। ঠাণ্ডা এক্কেবারে বুকে বসে গেল। জীবন-মরণ সমস্যা। মুসুল্পীরা তাকে চিটাগাং মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের স্বারান্দায় রেখে বান্দারধান চলে গেল। চিটাগাং-এ তিনি কাউকে চেনেন না। সঙ্গে টাকা পয়সা না থাকার মত। আল্লাহর অসীম মেহেরবানী ডাক্তাররা তাকে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে নিল। তাঁর চিকিৎসা করুল খুবই অল্প বয়েসী একজন মেয়ে ডাক্তার। একরাতে তিনি মোটামুটি নিশ্চিতই হলেন মারা যাচ্ছেন। অল্পবয়েসী ডাক্তারমেয়েটা ছোটাছুটি শুরু করল অক্সিজেন সিলিন্ডারের জন্যে। মেয়েটাকে দেখে মনে হল খুব ভয় পেয়েছে। তিনি মনে মনে বললেন, মাগো তুমি ভয় পেও না! মৃত্যু আল্লাহপাকের বিধান। কোরান মাজিদে তিনি স্পষ্ট বলেছেন- প্রতিটি জীবিত প্রাণীকে মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করিতে হইবে। মাগো তুমি যে সেবা এই অচেনা অজানা মানুষটার জন্য করেছ আল্লাহপাক তোমাকে তার পুরস্কার অতি অবশ্য দিবেন। আমি নিজেও খাস দিলে অন্তর থেকে তোমাকে দোয়া দিলাম। আমি নাদান হয়ত পুলসিরাত পার হতে পারব না। কিন্তু মা তুমি হাসিমুখে পার হবা।

সেই যাত্রা আল্লাহপাকের দরবারে তার হায়াত মঞ্জুর হয়েছিল। তিনি সুস্থ হয়ে বিছানায় উঠে বসতে পেরেছিলেন।

ডাক্তার মেয়েটা শাসনের ভঙ্গিতে আংগুল উঠিয়ে বলেছিল— এরকম ঠাণ্ডা আর লাগাবেন না। আপনার নিউমোনিয়া হয়েছিল। দুটা লাঙ্গসই এফেকটেড হয়ে কী বিশ্ৰী অবস্থা। না না হাসবেন না। আপনার হাসি আমার একেবারেই ভাল লাগছে না। আপনি কী মনে করে শীতের কাপড় ছাড়া বাড়ি থেকে বের হলেন?

তাঁর তখন বলতে ইচ্ছা করছিল— মাগো আমার অন্তরের একটা ইচ্ছা যে পিতামাতা তোমার মত সুসন্তানের জন্ম দিয়েছে তাদের সঙ্গে মোলাকাত করা। তিনি তাঁর মনের কথা মেয়েটিকে বলতে পারেন নি, সাহসে কুলায় নি, কারণ ডাক্তার মেয়েটা বদরাগী। কথায় কথায় সবাইকে ধমকাধামকি করে।

আচ্ছা বিনু প্রসঙ্গেও কি কোনোদিন লোকজন বলবে— বিনুর মত সুসন্তানের যে পিতামাতা জন্ম দিয়েছেন তাদের দেখতে পারলে ভাল হত। অবশ্যই বলবে। বিনু সেই জাতের মেয়ে। কে জানে হয়ত শুভ্রর বাবা-মাও এমন কথা বলবেন। শুভ্ৰর মা নিশ্চয়ই মনে মনে ভাবেন- এ রকম একটা মেয়ে তার ছেলের বউ হলে ভাল হত।

 

বিনু ঘুম ভেঙ্গে উঠে বসল। হাবীবুর রহমান ব্যস্ত হয়ে বললেন, পানি খাবি মা? এক বোতল পানি কিনে রেখেছি।

বিনু বলল, পানি খাব না।

জানালার কাচটা নামায় দেই? ঠাণ্ড বাতাস আসছে।

জানোলা খোলা থাকুক। বাবা দেখতো আমার জ্বর কিনা।

হাবীবুর রহমান মেয়ের কপালে হাত দিয়ে চমকে উঠলেন। কপালটা গরম। চিন্তিত হবার মত কিছু না, কিন্তু তাঁর চিন্তা লাগছে। তিনি বললেন, আমার পিঠে মাথা রেখে শুয়ে থাক।

উঁহু। ঘুম কেটে গেছে।

হাবীবুর রহমান মেয়ের দিকে ঝুঁকে এসে বললেন, শুভ্রর মা তোকে খুবই পছন্দ করেন। তাই না রে।

হুঁ করেন।

অতি মহিয়সী মহিলা। নিজের এত বড় বিপদেও মাথা ঠাণ্ডা রেখে তোকে টাকাটা দিলেন। ভাবা যায় না।

টাকা আছে- দিয়েছে।

উনাকে অসম্মান করে এ ধরনের কথা বলবি না। টাকা অনেকেরই আছে। কয়জন আর টাকা বিলায়? ঠিক বলেছি না?

হুঁ।

মানুষের মধ্যে ভাল মন্দ দুইই আছে। ভালটার কথা বলতে হয়। মন্দটা চেপে যেতে হয়। সহি হাদিস আছে— যে ব্যক্তি অন্যের ভাল গুন নিয়া আলোচনা করে, মন্দ বিষয়ে নীরব থাকে, আল্লাপাক তার ভেতর থেকে মন্দ উঠেয়ে নেন।

তাহলেতো বাবা তোমার মধ্যে কোনো মন্দ নেই। আল্লাহপাক সব উঠায়ে নিয়েছেন। তোমার চোখেতে সব মানুষই ভাল।

মানুষ যদি ভাল হয় আমি কী করব বল? যে ভাল আমিতো তাকে জোর করে মন্দ বলতে পারি না।

হাবীবুর রহমান আবারো মেয়ের কপালে হাত দিলেন। জ্বর সামান্য বেড়েছে। বাড়তে যখন শুরু করেছে তখন আরো বাড়বে। আল্লাহপাকের সব কাজের পেছনে ভাল কিছু আছে। এই যে মেয়েটার জ্বর বাড়ছে এরও ভাল দিক অবশ্যই আছে। তিনি ধরতে পারছেন না।

বিনু

হুঁ।

শরীর বেশি খারাপ লাগছে?

না।

আমরা মনে হয় মা একটা ভুল করলাম।

কী ভুল?

একটা মানুষ মারা গেছে। পরিবারের অন্যদের কত বড় দুঃখের ব্যাপার। এই সময় আমাদের উচিত ছিল তাদের পাশে থাকা। সান্ত্বনা দেয়া। বিশেষ করে শুভ্ৰ।

উনার সান্ত্বনার দরকার নেই বাবা।

কেন?

উনি তোমার আমার মত না। খুব আলাদা। একটা ঘটনা বললেই বুঝবে— উনার বাবা মারা গেছেন। উনি সেই খবর পেয়েছেন। খবর পাওয়ার পর খুব স্বাভাবিকভাবে মার সঙ্গে বসে চা খেলেন। তার কিছুক্ষণ পরই আমাকে ডেকে বারান্দায় নিয়ে গভীর ভঙ্গিতে একটা বক্তৃতা দিয়ে ফেললেন।

কী বক্তৃতা?

উনি বললেন- রাস্তায় যে ইলেকট্রিক পোলগুলি দেখছি সেগুলির দুটা তার আছে। একটা দিয়ে ইলেকট্রিসিটি পাস করে। কোনো পাখি যখন সেই তার স্পর্শ করে তার অবধারিত মৃত্যু। পাখিরা এই ঘটনা জানে। এসো নিজের চোখে দেখ কাক ইলেকট্ৰিক তারে বসার আগে কী করে। এই বলে তিনি আমাকে কাক দেখাতে লাগলেন।

হাবীবুর রহমান আগ্রহের সঙ্গে বললেন, শুভ্ৰ কি তোকে খুব পছন্দ করে?

বিনু হাই তুলতে তুলতে বলল, উনি কাউকে পছন্দও করেন না, আবার অপছন্দও করেন না।

ট্রেন দ্রুত গতিতে ছুটছে। বিনু জানোলা দিয়ে তাকিয়ে আছে বাইরে। চলমান অন্ধকার দেখছে।

বিনু।

কী?

একটু দুঃসংবাদ আছেরে মা।

বল শুনি।

থাক বাড়িতে গিয়ে শুনবি।

দুঃসংবাদ শুনে এখন আমার কিছু হবে না। মস্ত বড় দুঃসংবাদেও মাথা ঠাণ্ডা রাখার কৌশল আমি শিখেছি।

শুভ্রর কাছে শিখেছিস?

হ্যাঁ। আমি একেকজনের কাছ থেকে একেকটা জিনিস শিখি। এখন বল দুঃসংবাদটা কী?

লিচু গাছটা তোর মা কাটায়ে ফেলেছে।

ও।

কাজটা সে খুবই অন্যায় করেছে। তুই তোর মার উপর কোনো রাগ রাখবি না। মা যতবড় অন্যায়ই করুক তার উপর রাগ করা কঠিন নিষেধ আছে। পিতা অন্যায় করলে তার উপর রাগ করা যায়। মার উপর করা যায় না।

আমি রাগ করি নি।

আলহামদুলিল্লাহ, শুনে বড় খুশি হলাম মা; বড়ই খুশি হয়েছি। বিনু আবারো জানোলা দিয়ে মুখ বের করল। তার খুবই কান্না পাচ্ছে। কেন কান্না পাচ্ছে সে বুঝতে পারছে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *