০৫. রেশমা ক্যান্টিনে চা খেতে ঢুকেছে

রেশমা ক্যান্টিনে চা খেতে ঢুকেছে

রেশমা ক্যান্টিনে চা খেতে ঢুকেছে। এফডিসির ক্যান্টিনে এই সময় জায়গা পাওয়া মুশকিল-আজ ফাঁকা। শুধু যে ক্যান্টিন ফাঁকা তাই না–পুরো এফডিসিই ফাঁকা। সবার শুটিং প্যাকআপ হয়ে গেছে–ফাইটার গ্রুপের একটা ছেলে মারা গেছে। শুটিং এই কারণে বন্ধ। ক্যান্টিনের ম্যানেজার বিরস মুখে বসে আছে। এক কোণায় দিলদার খাঁ বৃদ্ধা একজন এক্সট্রার সঙ্গে জমিয়ে আড্ডা দিচ্ছে–নানি নানি করে ডাকছে। নানির সঙ্গে ঝলমলে পোশাক পরা এক কিশোরী। চোখ বড় বড় করে সে গল্প শুনছে। দিলদারের দৃষ্টি কিশোরীর দিকে। রেশমাকে দেখে দিলদার খাঁ আনন্দিত গলায় বলল, এই যে ম্যাডামকে পাওয়া গেছে। আস আস। কিশোরী মেয়েটি প্রবল বিস্ময়ে তাকে দেখছে। সত্যি সত্যি রেশমাকে বোধহয় নায়িকা ভেবেছে। রেশমা এগিয়ে গেল। দিলদার খাঁ দরাজ গলায় বলল, ম্যাডামকে চা দাও। সিঙ্গাড়া দাও। তারপর ম্যাডাম, খবর কী?

কোনো খবর নাই।

শুটিং নাকি আবার শুরু হয়েছে। খবর নাই বলছি কেন? এইটাই তো বড় খবর।

দিলদার ব্যস্ত হয়ে মানিব্যাগ বের করল। রঙচঙে একটা কার্ড বের করে বলল, নাও যত্ন করে রাখ।

এটা কী?

ভিজিটিং কার্ড। ছাপিয়ে ফেললাম। অ্যাড্রেস টেলিফোন নাম্বার সব লেখা আছে।

ভালো করেছেন। ভালো মন্দ জানি না, যে ব্যবসায় যে চাল। এখনকার চাল হচ্ছে–দু’টা কথা বলার পরই হাতে ভিজিটিং কার্ড গুঁজে দেয়া। কিছুদিন পর দেখব লোকজনের দেখা হবে কিন্তু কথাবার্তা হবে না। দু’জন দু’জনের হাতে ভিজিটিং কার্ড দিয়ে যে যার পথে চলে যাবে—হা-হা-হা।

বৃদ্ধার চা খাওয়া শেষ হয়ে গেছে। সে বলল, দিলদার ভাই উঠি?

দিলদার বলল, আরো না এখনই কী উঠবে? কথাই তো হয় নি। এই মেয়ে কে? তোমার নাতনি?

হুঁ।

চেহারা ছবি তো ভালো–অভিনয় করবে? নাম কী?

জমিলা।

আগ্রহ থাকলে কোনো এক জায়গায় ঢুকিয়ে দেব–অসুবিধা নাই। মেয়ের অবশ্য ঠোঁট মোটা, সেটা কোনো ব্যাপার না। কপালে থাকলে নায়িকা হওয়া কিছু না।

রেশমা লক্ষ করল। জমিলার চোখ চকচক করছে। রেশমার মনটা খারাপ হয়ে গেল। দিলদার রেশমার দিকে ঝুকে এসে বলল, তোমাদের ছবির সমস্যা মিটমাট কীভাবে হলো?

জানি না।

সবাই জানে। তুমি কিছু জান না–এটা কেমন কথা। সত্যি জান না?

না।

তাহলে শোন আমার কাছে। সে এক ইতিহাস…

ইতিহাস শোনা হলো না। রেশমাদের একজন প্ৰডাকশন বয় ক্যান্টিনে ঢুকেছে। সে রেশমাকে দেখে রাগী গলায় বলল, ওস্তাদ তোমারে খুঁজে।

রেশম চা রেখেই উঠতে যাচ্ছিল। দিলদার বলল, চা শেষ করে তারপর যাও। যত বড় ওস্তাদই হোক–খাওয়া ফেলে ছুটে যেতে হবে না। তাছাড়া শুটিং তো আজ হচ্ছে না। পুরো এফডিসি প্যাকআপ।

চা আগুনগরম। দ্রুত খাওয়া যাচ্ছে না। দিলদার বলল, ম্যাডাম আস্তে আস্তে খান। জিভ পুড়ে কয়লা হয়ে যাবে। হা করলে দেখা যাবে কুচকুচে কালো জিভ।

জমিলা মেয়েটি এই রসিকতায় খুব হাসছে। মেয়েটা সুন্দর। সত্যিকার রূপবতী মেয়েদের লক্ষণ হলো হাসলেও এদের সুন্দর দেখা যায়। বেশিরভাগ রূপবতী মেয়ে হাসলে কুৎসিত হয়ে যায়। এই মেয়েটা হচ্ছে না। সে যতই হাসছে ততই সুন্দর হচ্ছে।

রেশম চায়ের টাকা দিতে গেল। দিলদার হুংকার দিয়ে উঠল, খবরদার ম্যাডাম। তুমি দিলদারের গেস্ট। ভিজিটিং কার্ডটা যত্ন করে রেখে দিও–কখন দরকার হয় কে জানে। রাত ন’টার পর টেলিফোন করলে পাবে। অনেক সময় টেলিফোন লাইন নষ্ট থাকে–তখন সরাসরি চলে আসবে, অ্যাড্রেস লেখা আছে।

 

ন’নম্বর শুটিং ফ্লোরে লোকজন নেই। এক ঘণ্টা আগে প্যাকআপ হয়েছে। এতক্ষণ লোক থাকার কথা না। লাইট সরানো হয় নি। সেকেন্ড শিফটে কাজ হবে–কাজেই যেটা যেখানে আছে সেখানেই থাকবে। আজমল তরফদার এখন বাড়ি যাবেন না। শট ডিভিশনের কিছু কাজ বাকি আছে। কাজ শেষ করবেন। ট্রলি শট যে কটা ছিল সব বদলাতে হচ্ছে। ফ্লোর উঁচুনিচু হয়েছে। ট্রলি স্মুথলি মুভ করছে না। ক্যামেরা কাঁপছে।

আজমল তরফদার চোখ বন্ধ করে চেয়ারে বসে আছেন। তাঁর মাথা ধরেছে। একজন ফ্লোর-ব্যয় তাঁর মাথা টিপে দিচ্ছে। তাঁর ঠিক দু’হাত পেছনে ফ্লোর ফ্যান বসানো হয়েছে। ফ্যান থেকে বাতাস যত না হচ্ছে শব্দ হচ্ছে তারচেয়েও বেশি।

রেশমা আজমল তরফদারের সামনে দাঁড়াল। ভয়ে ভয়ে বলল, আজমল ভাই, আমাকে খবর দিয়েছেন? আজমল তরফদার চোখ মেললেন, চোখ টকটকে লাল। এটা কোনো অসুখ না বা রাত্রি জাগরণের ফলও না। সব সময় তাঁর চোখ এ রকম। প্রথমবার দেখলে মনে হয়–কিছুক্ষণ আগেই আলতা দিয়ে চোখ ধোয়া হয়েছে।

আজমল তরফদার চেয়ারে সোজা হয়ে বসলেন। যে ফ্লোর-বয় মাথা বিলি দিয়ে। দিচ্ছিল তাকে বললেন, ঠাণ্ডা এক গ্লাস লেবুর শরবত আমার জন্যে আন। চিনির শরবত না, লবণের শরবত।

রেশমা দাঁড়িয়ে আছে। এই মানুষটাকে তার ভয় ভয় লাগে। তবে মানুষটা ভালো। মেয়েদের সঙ্গে ফষ্টিনষ্টির কোনো বদনাম এই মানুষটার নেই।

রেশমা তোমার নাম?

জ্বি।

দাঁড়িয়ে আছ কেন? বোস।

বসার জন্যে চেয়ার বা টুল কিছুই নেই। বসতে হলে মেঝেতে বসতে হয়। রেশম মেঝেতে বসে পড়বে কিনা বুঝতে পারছে না। আজমল তরফদার হুংকার দিলেন–এই কেউ নেই, এখানে চেয়ার দিয়ে যা।

ফ্লোর-ব্যয় চেয়ার নিয়ে ছুটে এল। রেশমার অস্বস্তি লাগছে। এক্সট্রা মেয়ের জন্যে কোনো পরিচালক হুংকার দিয়ে চেয়ার আনায় না। রহস্যটা কী?

বোস। চা খাবে?

জ্বি না।

তাহলে ঠাণ্ডা কিছু খাও।

জ্বি না।

বার বার না বলবে না। বার বার না শুনতে ভালো লাগে না। ফ্লোরে কে আছে, ঠাণ্ডা কোক আন।

গ্লাসভর্তি কোক হাতে রেশমা জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। তার মাথা ঘুরছে, সে কিছুই বুঝতে পারছে না। আজমল তরফদার আবার চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করেছেন। ফ্লোর-ব্যয় তার মাথার চুল টেনে দিচ্ছে।

রেশমা।

জ্বি।

তুমি মোবারক সাহেবকে চেন?

জ্বি না।

আজমল তরফদার চোখ মেললেন। টকটকে লাল চোখ দেখলেই ভয় লাগে। তিনি ভুরু কুচকে বললেন, মোবারক সাহেবকে চেন না?

জ্বি না।

জাহাজের ব্যবসা করেন যিনি সেই মোবারক। টেক্সটাইল মিল আছে–মোবারক টেক্সটাইলস–কোটিপতির ওপরে যদি কিছু থাকে সেই পতি।

জ্বি না, আমি চিনি না।

কোনোদিন তাঁর সঙ্গে দেখা হয় নি?

জ্বি না।

ও আচ্ছা। ঠিক আছে এইটা জানার জন্যে।

আমি চলে যাব আজমল ভাই?

আচ্ছা যাও। শোন শোন তোমার পেমেন্ট হয়েছে?

জ্বি না, মিজান ভাই বলেছেন কোনো কাজ হয় নাই। সেজন্য পেমেন্ট হবে না।

তোমার পেমেন্ট হবে। অফিস থেকে পেমেন্ট নিয়ে যাও–আমি ম্যানেজারকে টেলিফোন করে দেব। আচ্ছা এখনি করছি।

আজমল তরফদার কর্ডের কোটের পকেট থেকে সেলুলার টেলিফোন বের করলেন। রেশমার বিস্ময়ের সীমা রইল না। ব্যাপারটা কী।

 

আজ ম্যানেজার মুনশি রেশমাকে দেখামাত্ৰ ভাউচার বই বের করল। রেশমা সই করতে গিয়ে দেখে পাঁচ শ টাকা লেখা। তার পেমেন্ট দিন হিসেবে। এক দিনে তার প্রাপ্য হয় আড়াই শ। দেয়া হচ্ছে পাঁচ শ।

মুনশি টাকা বের করতে করতে বলল, চা খাবেন?

এও এক বিস্ময়কর ব্যাপার। বাণী কথাচিত্রের ম্যানেজার মুনশি তাকে আপনি করে বলছে।

চা খাব না। আমার কাজ আছে। যাই?

জ্বি আচ্ছা।

তার কোনো কাজ নেই। শুটিং প্যাকআপ হওয়ায় সারাটা দিন তার হাতে। সেকেন্ড শিফটে কাজ হবে। সেকেন্ড শিফট কাগজে-কলমে বিকেল চারটা থেকে শুরু হলেও ফ্লোর ম্যানেজার বলে দিয়েছে কাজ শুরু হবে মাগরেবের নামায্যের পর। এই দীর্ঘ সময় এফডিসিতে বসে থাকার কোনো অর্থ হয় না। মবিন ভাইয়ের মেসে হুট করে চলে যাবে নাকি? অনেকদিন যাওয়া হয় না। এই সময় তাকে মেসেই পাওয়ার কথা। সকাল, বিকাল, সন্ধ্যা আর রাত এই সময়গুলোতে মবিন ভাই ব্যস্ত থাকেন–প্ৰাইভেট পড়ান। বিকেলের আগ পর্যন্ত সময়টা অবসর।

মবিন ভাইয়ের জন্যে একজোড়া স্যান্ডেলও কেনা দরকার। তার স্যান্ডেলের যে অবস্থা। বাড়তি কিছু টাকা পাওয়া গেছে। যখন…।

স্যান্ডেল কেনার ব্যাপারটায় সে মনস্থির করতে পারছে না। তার টাকা-পয়সার খুব টানাটানি যাচ্ছে। চার মাসের বাড়ি ভাড়া বাকি পড়েছিল। ঐ দিনের দু’হাজার টাকা বাড়ি ভাড়ায় চলে গেছে। তারপরেও খালি হাতে মবিন ভাইয়ের কাছে যাওয়া যায় না।

কমদামি স্যান্ডেলও ছিল, সে ঝোঁকের মাথায় তিন শ পঁচিশ টাকা দিয়ে একজোড়া স্যান্ডেল কিনে ফেলল। মাপে হবে। এর আগের স্যান্ডেল জোড়াও তার কিনে দেয়া, সে মাপ জানে।

বাস প্রায় ফাঁকা। সে জানালার পাশে বসেছে। বাস দ্রুত চলছে। তার কেমন যেন শান্তি শান্তি লাগছে। অথচ শান্তি লাগার কিছু নেই। সে বুঝতে পারছে তার সামনে অনেক অশান্তি—মোবারক সাহেব হঠাৎ উদয় হয়েছেন কেন? সে ধরেই নিয়েছে তার জীবনের কিছু আলাদা অংশ আছে। মূল জীবনের সঙ্গে সেই জীবনের কোনো মিল নেই। মূল জীবনের সঙ্গে তা যুক্তও নয়। ওই জীবন তার নয়-অন্য একটা মেয়ের জীবন, যার নাম টেপী। সে টেপী নয়–সে রেশমাও নয়; সে মিতু। মোবারক নামের লোকটিকে টপী হয়তো চেনে, সে চেনে না।

জয়দেবপুর চৌরাস্তায় রেশমা বাস থেকে নামল। নেমেই সে মিতু হয়ে গেল। এক প্যাকেট ভালো সিগারেট কিনতে হবে। মানুষটার ভালো সিগারেটের এত শখ, টাকার অভাবে খেতে পারে না। পৃথিবীটা যদি এ রকম হতো— দোকান ভর্তি জিনিস থরে থরে সাজানো। যার যা প্রয়োজন উঠিয়ে নিয়ে যাবে, কাউকে কোনো টাকা দিতে হবে না। সিগারেট কেনার পর মিতুর মনে হলো–একটা কী যেন বাকি আছে। এর আগের বার মবিন ভাইয়ের কাছে যখন এসেছিল তখন ঠিক করে রেখেছিল। পরের বার আসার সময় অবশ্যই কিনে আনবে। এখন মনে পড়ছে না।

 

দরজির দোকানের ওপরে একটা ঘর নিয়ে মবিন থাকে। এক শ টাকা ভাড়া। ঘরে প্লাস্টার হয় নি–জানালা লাগানো হয় নি। জানালার খোলা অংশ করোগেটেড টিন দিয়ে বন্ধ। মবিনের ঘরে ওঠার সিঁড়ি অসম্ভব সরু। রোলিং নেই। সাবধানে উঠতে হয়। বর্ষাকাল বলে সিঁড়ি ভিজে স্যাঁতস্যাঁতে হয়ে আছে। মিতু খুব সাবধানে উঠছে। তার হঠাৎ মনে হলো–এখন যদি দেখে মবিন ভাই নেই তখন কেমন লাগবে?

মবিন ঘরেই ছিল। সে দরজা খুলে অবাক চোখে তাকিয়ে রইল। মিতু বলল, দরজা ছাড়। দরজা ধরে থাকলে ভেতরে ঢুকবা কীভাবে?

মবিন বলল, হাত ধরে তোমাকে ভেতরে নিয়ে যাই?

সেটা আবার কী?

খুব সম্মানিত যারা তাদের হাত ধরে ঘরে ঢোকাতে হয়।

আমি কি খুব সম্মানিত?

অবশ্যই।

তাহলে হাত ধরে নিয়ে যাও।

মবিন দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়াল। হাত ধরল না। ধরবে না মিতু জানত। অশোভন কিছু কখনোই সে করবে না। মবিন বলল, পা তুলে আরাম করে বিছানায় বোস। তুমি কি দুপুরে খেয়ে এসেছ?

না।

তাহলে দুপুরে আমার সঙ্গে খাবে।

হোটেলের কুৎসিত খাবার? রবারের গোশত আর টকে যাওয়া ডাল?

মবিন হাসিমুখে বলল, ভালো খাবার। টিফিন কেরিয়ারে করে আসবে।

কোথেকে আসবে?

এক কনট্রাকটর সাহেবের বাসা থেকে। উনার বড় মেয়ে এসএসসি দেবে। তাকে এখন ইংরেজি শিখাচ্ছি–বিনিময়ে মাসে সাত শ টাকা পাচ্ছি প্লাস দু বেলা খাবার। রাতের খাবার ঐ বাসাতেই খাই–দুপুরেরটা তারা টিফিন কেরিয়ারে করে পাঠিয়ে দেয়।

তোমাকে এতে খুব আনন্দিত মনে হচ্ছে।

হ্যাঁ আনন্দিত। মহিলার রান্না অসম্ভব ভালো। যা রাঁধে তাই অমৃতের মতো লাগে। ঐদিন আলুভর্তা বানিয়ে পাঠিয়েছে। আলুভর্তার সঙ্গে সর্ষে বেটে দিয়েছে–আর দিয়েছে ধনেপাতা। এতগুলা ভাত খেয়ে ফেলেছি শুধু আলুভর্তা দিয়ে। আচ্ছা তুমি এ রকম শক্ত হয়ে বসছ কেন? আরাম করে বোস না।

আরাম করেই তো বসেছি।

আরো আরাম করে বোস। দেয়ালে হেলান দিয়ে বোস।

মিতু দেয়ালে হেলান দিয়ে বসল। মবিন বলল, তোমার খবর কী বল?

মিতু হাসিমুখে বলল, বলার মতো কোনো খবর নেই। তোমার খবর কী?

আমার দু’টা খবর আছে–একটা ভালো, একটা খারাপ। কোনটা আগে শুনতে চাও?

ভালোটাই আগে শুনি।

আমার ঘরের জানালা লাগানো হচ্ছে, এখন বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমি আকাশ দেখতে পারব।

খারাপ খবরটা কী?

খারাপ খবর হলো–জানালা ফিট করায় ঘরের ভাড়া বেড়ে যাচ্ছে। কত বাড়ছে বলতে পারছি না, তবে বাড়ছে…

মবিন হাসছে। মিতু মুগ্ধ চোখে তাকিয়ে আছে। এভাবে দীর্ঘ সময় কারো দিকে তাকিয়ে থাকতে নেই–এতে যার দিকে তাকিয়ে থাকা হয় তার অমঙ্গল হয়। নজর লেগে যায়। মিতু চোখের দৃষ্টি সরিয়ে নিয়ে বলল, আমি তোমার জন্যে উপহার এনেছি। বল তো কী?

চিরুনি।

কী করে বুঝলে?

শেষবার যখন এসেছিলে তখন আমার চিরুনি দেখে বলে গেছ আমাকে একটা চিরুনি উপহার দেবে। এই আশায় আমি চিরুনি কিনি নি। আঙুল দিয়ে চুল আঁচড়াই।

সত্যি আঙুল দিয়ে চুল আঁচড়াও?

হুঁ।

আমি কিন্তু চিরুনি আনি নি। ভুলে গেছি। আমার মনে হচ্ছিল কী একটা জিনিস যেন ভুলে গেছি। তোমার জন্য একজোড়া স্যান্ডেল এনেছি।

সিগারেট? সিগারেট আন নি?

হুঁ।

দেখি দাও।

মিতু সিগারেটের প্যাকেট বের করে দিল। মবিন প্যাকেট হাতে নিতে নিতে বলল, আমাদের বিয়ের পরেও কি তুমি আমাকে উপহার দেবে?

আমি যতদিন বেঁচে থাকব, দেব।

কীসের শপথ?

সূৰ্য এবং চন্দ্রের শপথ।

সূৰ্য এবং চন্দ্রের নামে তো মানুষ চিরকাল শপথ নিচ্ছে–তুমি নতুন কিছুর নামে নাও।

কার নামে শপথ নিতে হবে তুমি বলে দাও।

শপথ হওয়া উচিত তোমার সবচে’ প্ৰিয় জিনিসের নামে। তোমার সবচে’ প্ৰিয় কী?

তুমিই আমার সবচে’ প্রিয়।

ভালো করে ভেবেচিন্তে বল।

আমি রাতের পর রাত, দিনের পর দিন ভেবেছি। কাজেই আমি এখন শপথ করছি মবিনুর রহমানের নামে–আমি যত দিন বেঁচে থাকব…

শপথ বাক্য শেষ করার আগেই দরজা ঠেলে টিফিন কেরিয়ার হাতে ন’ দশ বছর বয়সী একটা ছেলে ঢুকল। মবিন ছেলেমানুষের মতো চেঁচিয়ে উঠল— খাওয়া চলে এসেছে, খাওয়া। ছেলেটা বিস্মিত চোখে তাকাচ্ছে। মবিন বলল, এই ছেলের নাম বুড্ডা। নাম সুন্দর না?

মিতু কিছু বলল না। মবিন কথা বলার জন্যেই কথা বলছে। আনন্দিত মানুষ অকারণে কথা বলে। অকারণে অজস্র প্রশ্ন করে। সেই সব প্রশ্নের জবাব তারা আশা করে না। মিতুর খারাপ লাগছে সে শপথের অংশটা শেষ করতে পারেনি। শপথটা শেষ করতে পারলে তার নিজের ভালো লাগত। বুড্ডা নামের ছেলেটা কোমরে হাত দিয়ে কেমন অভিভাবক অভিভাবক চোখে তাকাচ্ছে। দেখেই মনে হচ্ছে বাসায় গিয়ে বানিয়ে বানিয়ে অনেক কিছু বলবে। মিতু বলল, তোমার বুড্ডা কি এইভাবে দাঁড়িয়ে থাকবে?

মবিন বলল, হ্যাঁ। খাওয়া শেষ হলে টিফিন কেরিয়ার নিয়ে চলে যাবে।

ওকে চলে যেতে বল, ওর সামনে বসে আমি খাব না।

বুড্ডা তুমি চলে যাও, আমি সন্ধেবোলা টিফিন কেরিয়ার নিয়ে যাব।

আইজ আফনেরে যাইতে নিষেধ করছে। আইজি আফার শইল খারাপ।

আচ্ছা যাব না। তুমি পরে এসে টিফিন কেরিয়ার নিয়ে যাবে।

ছেলেটা নিতান্ত অনিচ্ছায় চলে যাচ্ছে। মিতু বলল, রাতে তোমাকে যেতে নিষেধ করল, রাতে তুমি খাবে কোথায়?

ওরা খাবার পাঠিয়ে দেবে।

মিতু দেখল মবিন খুব আগ্রহ নিয়ে খবরের কাগজ বিছাচ্ছে, টিফিন কেরিয়ারের বাটি সাজাচ্ছে। ঘরে একটাই প্লেট। সেটা মিতুকে দেয়া হলো। মবিন বাটিতে খাবে। আয়োজন অনেক–বেগুন ভাজা, মাছ ভাজা, ঝাল ঝাল করে রান্না করা গরুর গোশত, দু’রকমের ডাল। মবিন খুশি খুশি গলায় বলল, এদের ডাল রান্না অসাধারণ হয়। তোমাকে একদিন ঐ মহিলার কাছে নিয়ে যাব। ডাল রান্না শিখে আসবে। রেসিপি কাগজে-কলমে লিখে আনলে কিছু হয় না, এসব শিখতে হয় হাতে-কলমে। যাবে একদিন আমার সাথে?

যাব।

ডালটা একটু চেখে দেখা—-অসাধারণ কিনা বল।

হুঁ অসাধারণ।

ডাল রান্নার ওপর এই মহিলাকে অনায়াসেই একটা পিএইচ.ডি. ডিগ্রি দিয়ে দেয়া যায়।

এই টিউশ্যানিটা পেয়ে তুমি মনে হয় সুখেই আছ।

খাওয়াদাওয়ার দিক দিয়ে আরামে আছি–তবে ছাত্রী পড়িয়ে কোনো আরাম পাই না।

কেন?

যতক্ষণ পড়াই ততক্ষণ ছাত্রীর মা কাছেই একটা চেয়ারে কঠিন কঠিন চোখ করে বসে থাকেন। মেয়েকে পাহারা দেন। যেদিন তিনি থাকেন না সেদিন অন্য কেউ থাকে। নিজেকে খুব ছোট লাগে।

মিতু হালকা গলায় বলল, তারা জানে না তোমার চরিত্র সাধু-সন্ন্যাসীর মতো। জানলে মেয়ের জন্যে পাহারার ব্যবস্থা করত না।

আমার চরিত্র সাধু-সন্ন্যাসীর মতো! কী যে তুমি বল! সাধু-সন্ন্যাসীদের বেশিরভাগই চরিত্রহীন। তুমি হিন্দু ধর্মগ্রন্থগুলো পড় নি, পড়লে বুঝতে ওদের ঋষিরা কী চীজ-হা-হা-হা।

খাওয়ার সময় এ রকম শব্দ করে হাসবে না। বিষম লাগবে।

ভাতে কি কম পড়বে?

না, কম পড়বে না।

দেখেছি। এরা কেমন চাল খায়৷ এ চালের নাম হচ্ছে কাটারিভোগ। বিয়ের পর আমরা যখন সংসার পাতব তখন এই কাটারিভোগ চালই খাব। দু’জন মানুষ, চাল তো বেশি লগবে না, কী বল?

মিতু জবাব দিল না। মবিন বলল, মাসে পনের কেজি চালের বেশি তো আমাদের লাগবে না। কাটারিভোগের কেজি কত করে তুমি জান?

জানি না। আচ্ছা, খাওয়াদাওয়া ছাড়া অন্য কোনো গল্প করলে কেমন হয়?

খুব ভালো হয়।

বেশ তাহলে অন্য গল্প বল।

অন্য গল্প তুমি বল–আমি শুনি।

আমার তো সব ছবির লাইনের গল্প। এসব গল্প শুনতে তোমার ভালো লাগবে না।

খুব ভালো লাগবে। তুমি যা বল। তাই শুনতে ভালো লাগে। কারণ কি জান?

না।

তোমার গলার স্বর অদ্ভুত সুন্দর। মনে হয় বাজনা বাজছে।

কী বাজনা–ঢোল?

জলতরঙ্গ।

সেটা আবার কী বাজনা?

চিনামাটির বাটিতে পানি ভর্তি করে কাঠি দিয়ে বাজায়। অনেকগুলো বাটি নেয়া হয়। বাটিতে পানির পরিমাণ বাড়িয়ে-কমিয়ে শব্দের ফ্রিকোয়েন্সি ঠিক করা হয়। মন্দ্র সপ্তক থেকে…

উফ! বক বক বন্ধ করা তো।

মবিন হেসে ফেলল। মিতু বলল, তোমার একটাই সমস্যা–কোনো কথা শুরু করলে সেটাকে জ্ঞানের কথায় নিয়ে ফেলবে। জ্ঞানের কথা কি আমার মতো সাধারণ মানুষের ভলো লাগে? হাত কোথায় ধোব? তোমার বাথরুম কোথায়?

বাথরুম নিচে-অনেক দূরে। তুমি বাটির মধ্যে হাত ধোও। পান খাবে? মিষ্টি পান, নিয়ে আসি।

কিছু আনতে হবে না। তুমি চুপ করে বোস আর ক্রমাগত কথা বলে যাও।

জ্ঞানের কথা?

না, মজার মজার কথা।

আমার কোন কথাগুলো তোমার মজা লাগে তাও তো জানি না। বরং তুমি তোমার বিখ্যাত জলতরঙ্গ কণ্ঠে গল্প বল আমি শুনি।

ফিল্ম লাইনের গল্প?

ফিল্ম লাইনের গল্পই তো সবচে’ ইন্টারেস্টিং হওয়ার কথা।

ফিল্ম লাইনের ভয়ংকর সব গল্প আছে, শুনলে তোমার মনটন খারাপ হয়ে যাবে–যেমন ধর, একটা মেয়ের সঙ্গে আমার পরিচয় হয়েছে, টেপী তার নাম। আমার মতোই ছোটখাটো পার্ট করে। তারা তিন বোন…

ফিল্ম লাইনের মেয়ের নাম টেপী, অদ্ভুত তো। এই লাইনে নামের খুব বাহার থাকার কথা–নীলাঞ্জনা চৌধুরী টাইপ।

ও তো নায়িকা না যে নামের বাহার থাকবে। ও হচ্ছে অতি নগণ্য এক্সট্রা মেয়ে। পোস্টারে এদের নাম যায় না, পর্দায় টাইটেলেও নাম যায় না। কাজেই এদের নাম টেপী হোক বা নীলাঞ্জনা চৌধুরী হোক কিছুই যায় আসে না।

তারপর বল।

কী বলব?

টেপী সম্পর্কে কী বলতে চাচ্ছিলে বল।

ও আচ্ছা–ওরা তিন বোন–হ্যাপী টেপী, পেপী। টেপী মেজ। ফিল্মে কাজ করে সে তার সংসার চালায়, মাঝে মাঝে তাকে অন্য কিছুও করতে হয়। অন্য কিছুটা কী তুমি বুঝতে পারছি?

মনে হয় পারছি।

যাক, তোমার বুদ্ধি তাহলে আমার চেয়ে বেশি। আমাকে প্রথম যখন টেপী বলল, মাঝে মাঝে আমি অন্য কিছু করি–তখন আমি বুঝতে পারিনি। আমি জিজ্ঞেস করলাম, অন্য কিছু কী করা? সে তখন দু’হাতে মুখ ঢেকে এমন কান্না শুরু করল!

মেয়েটির সঙ্গে তোমার কি খুব ভাব?

খুব ভাব না। মোটামুটি ভাব। ফিল্ম লাইনে কারো সঙ্গেই খুব ভাব হয় না। আজ হুট করে তোমার এখানে আসার কারণ কী জান? কারণ হলো টেপী।

বুঝলাম না–বুঝিয়ে বল।

আজ মর্নিং শিফটের শুটিং হঠাৎ করে প্যাকআপ হয়ে গেল। টেপী বলল, আপা চল ক্যান্টিনে চা খাই।

তোমাকে আপা ডাকে? বয়সে তোমার ছোট?

সমানই হব। তবু কেন জানি আপা ডাকে। যাই হোক। ওর সঙ্গে চা খেতে গিয়েছি সেখানে হঠাৎ সে এমন কান্না শুরু করল…।

কেন?

জানি না কেন? আমি জিজ্ঞেস করি নি। আমার এত মন খারাপ হলো–ভাবলাম তোমার কাছে এলে হয়তো মন ভালো হবে।

মন ভালো হয়েছে?

প্রথমে হয়েছিল। এখন আবার মন খারাপ লাগছে।

কেন?

মেয়েটার কথা মনে পড়ে গেল। এই জন্যে। আমি একবার ওকে তোমার কাছে নিয়ে আসব।

আমার কাছে কেন?

কোনো কারণ নেই, এমনি আনিব। তোমার টিফিন কেরিয়ার, বাটি এইসব ধুয়ে দিচ্ছি–পানি কোথায় বল তো? নিচে যেতে হবে?

তোমাকে কোথাও যেতে হবে না। তুমি চুপ করে এখানে বসে থাক।

আমি পা তুলে চুপচাপ বসে থাকব। আর তুমি পুরুষ মানুষ হয়ে থালাবাসন ধুবে–ভাবতেও ঘেন্না লাগছে।

ঘেন্না লাগার কিছু নেই–বিশ্বে যা কিছু মহান সৃষ্টি চিরকল্যাণকর; অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধেক তার নর।

থালাবাসন ধোয়া এমন কিছু মহান সৃষ্টি না।

বিশ্বে যা কিছু সাধারণ সৃষ্টি চিরকল্যাণকর; থ্রি-ফোর্থ তার করিয়াছে নারী ওয়ানফোর্থ তার নর।

মবিন হো-হো করে হাসছে। তার সারা শরীরে আনন্দ ঝলমল করছে। মিতুর চোখ ভিজে উঠছে। কেন ভিজে উঠছে সে নিজেও জানে না। মবিনকে এই চোখের পানি দেখতে দেয়া যাবে না। তাকে মুখ ঘুরিয়ে বসতে হবে। এই ঘরের কোনো জানালা নেই, জানালা থাকলে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ানো যেত। ভেজা চোখ নিয়ে আকাশ দেখতে ভালো লাগে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *