রুবিনার বিয়ের দিন আমরা কেউ ও-বাড়িতে গেলাম না। নীলুর জন্যেই যাওয়া হল না। সে কিছুতেই যাবে না এবং আমাকেও যেতে দেবে না।
তুই না গেলে না যাবি। আমি যাই।
না বললাম তো যেতে পারবি না।
কেন অসুবিধেটা কি?
ওরা আজেবাজে কথা বলছিল, তোকে বলতে চাই না।
বলতে চাস না কেন?
কারণ শুনলে তোর খারাপ লাগবে।
লাগুক খারাপ
নীলু মৃদু স্বরে বলল, ওরা বলছিল সেতারার চেহারার সঙ্গে নাকি ঐ লোকটির খুব মিল। আর সেতারা গান-বাজনাও ঐ লোকটির মত জানে।
কখন বলছিল?
রুবিনার খালা বলছিল, আমি পাশের ঘরে ছিলাম।
আমি চুপ করে রইলাম।
নীলু বলল, তোর মন খারাপ লাগবে বলেছিলাম না। তবুও তো শোনা চাই।
আমি সে রাতে ঘুমোতে পারলাম না। বাবা ফিরলেন অনেক রাতে। সিঁড়িতে ধুপধ্যাপ শব্দ হতে লাগল। রমজান ভাইয়ের গলা শোনা গেল, ছিঃ, আপনের শরম করে না?
চুপ থাক।
আপনে চুপ থাকেন।
ধুপ করে একটা শব্দ হল। বাবার গলা।
ঘাড় ধরে বাড়ি থেকে বের করে দেব। শুয়োরের বাচ্চা। বেশি সাহস হয়েছে।
মেয়েরা বড় হইছে না? হায়া-শরাম নাই?
চুপ থাক।
আপনে চুপ থাকেন।
পানি ঢালার শব্দ। আকবরের মা উঠে গেল। নবান করে কি যেন পড়ল। আবার পানি ঢালা হচ্ছে। কি হচ্ছে এসব?
বাবা আজকাল বড্ড ঝামেলা করছেন। আবার একটা বিয়ে করলে তার জন্যে ভালই হত। নজমুল চাচা যাকে বাসায় নিয়ে এসেছিলেন সেই মহিলাটিকে আমার বেশ পছন্দ হয়েছিল। ছোটখাটো মানুষ, লম্বা চুল। কথা বলেন টেনে টেনে। আমাদের সঙ্গে বেশ আগ্রহ করে কথা বললেন। নীলু যখন বলল, আচ্ছ। আপনি কি আমাদের দু’জনকে আলাদা করতে পারবেন? আমার নাম নীলু ওর নাম বিলু। কিছুক্ষণ পর যদি আমরা দু’জন এক রকম কাপড় পরে আসি তাহলে কি বলতে পারবেন। কে বিলু কে নীলু?
তিনি হাসিমুখে বললেন, আরে এ মেয়ে তো দেখি খুব পাগলী!
আমাদের দু’জনারই ভদ্রমহিলাকে খুব পছন্দ হল। শুধু সেতারা মুখ গোজ করে দূরে দাঁড়িয়ে রইল। তিনি ডাকলেন, এই কি যেন নাম তোমার?
সে উঠে চলে গেল। আমরা তাকে বাগান দেখাবার জন্যে নিয়ে গেলাম। সেতারা কিছুতেই যাবে না। আমরা সেতারাকে ছাড়াই বাগানে বেড়াতে গেলাম। বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া তেঁতুল গাছ দুটি দেখে তিনি খুব অবাক হলেন। আশ্চর্য হয়ে বললেন, বসতবাড়ির কাছে কেউ তেঁতুল গাছ লাগায় নাকি?
নীলু বলল, লাগালে কি হয়?
বুদ্ধি কমে যায়। তেঁতুল খেলেও বুদ্ধি কমে।
এটা কিন্তু ঠিক না। রকিব ভাই খুব তেঁতুল খান। কিন্তু তার খুব বুদ্ধি।
রকিব ভাই কে? নীলু চুপ করে গেল। তিনিও আর কিছু জিজ্ঞেস করলেন না। একবার শুধু বললেন, এত বড় বাড়িতে থাক, ভয় লাগে না?
আমরা কিছু বললাম না। ভদ্রমহিলা যাবার আগে নীলুকে জড়িয়ে ধরে আদর করলেন এবং অত্যন্ত মৃদুস্বরে বললেন, তোমাদের মোর সঙ্গে কি তোমাদের যোগাযোগ আছে?
নীলু বলল, না নেই।
তোমরা চিঠি লিখেলেই পার। তোমরা কেন লিখবে না? তোমরা লিখবে।
আমাদের খুব আশা ছিল ভদ্রমহিলার সঙ্গে বাবার বিয়ে হবে কিন্তু বিয়ে হয়নি। বাবা কিছুতেই রাজি হলেন না। নজমুল চাচার ওপর রেগে গিয়ে আজেবাজে কথা বলতে লাগলেন, তোমরা পেয়েছিটা কি? আমাকে না বলে এই সব কি শুরু করেছ?
নজমুল চাচাও কি সব যেন বললেন। তুমুল ঝগড়া বেঁধে গেল।
এক পর্যায়ে বাবা বললেন, যাও তুমি আমার বাড়ি থেকে এক্ষুণি বিদেয় হও। নজমুল চাচাও চোঁচাতে লাগলেন, আমি তোমার দয়ার ওপর আছি নাকি? নগদ ভাড়া দিয়ে থাকি।
সে এক বিশ্ৰী অবস্থা। নজমুল চাচা সেই রাতেই ঠেলা গাড়ি নিয়ে এলেন। মালপত্র পাঠানো হতে লাগল। আমরা বসে বসে দেখলাম। ঠেলা গাড়ি এসেছে দুটি। নজমুল চাচার জিনিসপত্র তেমন কিছু নেই। ঘণ্টাখানেকের মধ্যে সব তোলা হয়ে গেল। আমরা দেখলাম। বাবা দাঁড়িয়ে আছেন সিঁড়ির কাছে আর নজমুল চাচা একটা বেতের ঝুড়ি হাতে নিয়ে নেমে যাচ্ছেন।
নীলু তখন ছুটে গিয়ে সিঁড়ির মাথায় তাকে ঝাপ্টে ধরল।
নজমুল চাচা বললেন, আরে মা, কি করিস তুই ছাড় ছাড়া।
নীলু ছাড়ল না।
নজমুল চাচা বললেন, এতো বড় মুসিবন্ত হল দেখছি। আরে বেটি কি করিস।
তার হাত থেকে বেতের ঝুড়ি ছিটকে পড়ে গেল।
নজমুল চাচা ভারী গলায় বললেন, এই মালপত্র সব তুলে রাখা। সাবধানে তুলিস।
নজমুল চাচা আমাদের কোন আত্মীয় নন। দোতলার তিনটি কামড়া ভাড়া নিয়ে আমাদের সঙ্গে আছেন। পনের বছরের মতো। তাঁর স্ত্রী মারা গিয়েছেন ষোল-সতের বছর আগে। একটিমাত্র মেয়ে, অল্প বয়সে বিয়ে দিয়েছিলেন। সেই মেয়ে নেদারল্যান্ড না কোথায় যেন থাকে। বছরে দুতিনটি চিঠি দেয়। চিঠিতে খুব স্বাস্থ্যবান কিছু ছেলেমেয়ের ছবি থাকে। নজমুল চাচা সেই চিঠি পড়ে গম্ভীর হয়ে বলেন, উফ এ্যারন বাংলাটা এখনো শেখে নাই। খুব খারাপ খুব খারাপ।
এ্যারন তাঁর নাতনী।
নীলু অনেক কিছুই করতে পারে যা আমি পারি না। নজমুল চাচা যখন চলে যাচ্ছিলেন আমার খুব ইচ্ছে হচ্ছিল ছুটে গিয়ে তাকে ফেরাই। কিন্তু আমি গোলাম না, ছুটে গেল নীলু। আমরা দুজনে দেখতে অবিকল এক রকম, কিন্তু দু’জন সম্পূর্ণ আলাদা মানুষ হয়ে উঠছি। আমরা এ রকম কেন?
কাল রাতে আমি চমৎকার একটি স্বপ্ন দেখেছি। এমন চমৎকার স্বপ্ন যে ঘুম ভেঙে খানিকক্ষণ কাদলাম। একবার ইচ্ছে হল নীলুকে ডেকে তুলি। স্বপ্নের কথাটা বলি ওকে। কিন্তু শেষপর্যন্ত কিছুই করলাম না। গলা পর্যন্ত চাদর টেনে চুপচাপ শুয়ে শুয়ে স্বপ্নটার কথা ভাবলাম। ঘুমের মধ্যে যে স্বপ্লটিকে অর্থবহ মনে হচ্ছিল জেগে থেকে তা আর মনে হল না। আমি দেখেছিলাম একটি নদী। নদীর চারপাশে ঘন বন। কিন্তু কিছুক্ষণ পর বন অদৃশ্য হয়ে গেল। দেখলাম শুধুই নদী। সেই নদীতে বালি চিকচিক করছে। কোথাও কেউ নেই। আমার একটু ভয় ভয় করছে। তবু আমি নদীতে নামতেই নদীটি আমাদের নানার বাড়ির পুকুর হয়ে গেল। সে পুকুরে ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কুমীর কুমীর খেলছে। স্বপ্নে নদীর পুকুর হয়ে যাওয়াটা খুবই স্বাভাবিক মনে হচ্ছিল। আমি একটুও অবাক না হয়ে ছেলেমেয়েগুলির সঙ্গে কুমীর কুমীর খেলতে লাগলাম। একটি পাঁজি ছেলে ডুব সাতার দিয়ে কেবলই আমার পা জড়িয়ে গভীর জলের দিকে টেনে নিতে চাচ্ছিল। আমার রাগ লাগছিল। কিন্তু কিছুই বলছিলাম না। কারণ স্বপ্নের মধ্যে মনে হচ্ছিল এই ছেলেটি যেন আমার স্বামী। এক সময় ছেলেটি আমাকে মাঝপুকুরে নিয়ে গিয়ে চেঁচিয়ে বলল, এই সুশী তোমাকে এখন ছেড়ে দেই?
কেন মানুষ এমন অদ্ভুত সব স্বপ্ন দেখে? আমি জেগে এই ছেলেটির মুখ খুব মনে করবার চেষ্টা করলাম, কিছুতেই মনে পড়ল না। শুধু মনে পড়ল ছেলেটির চোখগুলো মেয়েদের চোখের মত টানা টানা। আর ওর হাত দুটি লম্বা এবং খুব ফরসা! কে জানে এ রকম একটি ছেলে সঙ্গেই হয়ত আমার বিয়ে হবে। সে আমাকে আদর করে ডাকবে সুশী। কী আশ্চর্য এরকম একটা অদ্ভুত নাম এল কোথেকে? ভাবতে ভাবতে আবার আমার চোখ ভিজে উঠল। বাকি রাত এক ফোঁটা ঘুম এল না।
এত ভোরে কখনো আমি আগে উঠিনি। অদ্ভুত লাগছিল আমার। আলোটাই অন্য রকম। কেমন মায়া মায়া আলো, স্বপ্নের মধ্যে যে রকম আলো দেখা যায়। সে রকম। আমি নিচে বাগানে নেমে গেলাম। কদম গাছের নিচটায়। তখনো খুব অন্ধকার। আমার একটু ভয় ভয় করছিল। কিন্তু গাছের নিচের এসে দাঁড়ানো মাত্র দেখলাম নীলু। জেগে উঠেছে। টুথব্রাশ নিয়ে ঘুম ঘুম চোখে সিঁড়ি দিয়ে নামছে। নীলু সব সময় খুব ভোরে ওঠে। কিন্তু সে যে এ রকম অন্ধকার ভোর তা জানা ছিল না। আমি ডাকলাম, এ্যাই নীলু।
নীলু আমাকে দেখতে পেল না। সে অবাক হয়ে চারদিকে তাকাতে লাগল। তারপর একটি কাণ্ড করল, মা এসেছে মা এসেছে বলে ছুটে গেল গেটের দিকে।
আমি এগিয়ে এসে বললাম, এ্যাই নীলু কি হয়েছে রে?
নীলু। খুব অবাক হল। বেশ কিছুক্ষণ কথা বলতে পারল না। এক সময় থেমে থেমে বলল, আমি ভাবলাম মা বুঝি। গলার স্বর অবিকল সে রকম লাগল।
নীলুর কি কিছুটা আশাভঙ্গ হয়েছে? কী জানি হয়ত হয়েছে। মার কথা সে হয়তো সারাক্ষণই ভাবে। মুখে বলে না।
আজ এত সকালে উঠেছিস যে?
দেখলাম একদিন উঠে কেমন লাগে।
কেমন লাগে?
ভালই তো।
নীলু চুপচাপ দাঁত ঘষতে লাগল। আমি বললাম, তুই কি মার কথা খুব ভাবিস?
নাহ।
তাহলে আজ এ রকম ছুটে গেলি যে?
আমার ইচ্ছে হয়েছে গিয়েছি। তোর তাতে কি?
রাগ করছিস কেন?
নীলু জবাব না দিয়ে সামনে এগিয়ে গেল। তখন মনে পড়ল। নীলুর সঙ্গে আমার ঝগড়া চলছে। গত এক সপ্তাহ ধরে কথাবার্তা বন্ধ। ঝগড়ার কারণটি অতি তুচ্ছ। আমি নীলুর একটি চিঠি খুলে পড়ে ফেলেছি। কিছুই নেই সে চিঠিতে। ছয় লাইনের একটা চিঠি। নীলুর পরিচিত প্রফেসরটি লিখেছেন। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদার যে বইটি নীলু। পড়তে চেয়েছে সেটি তিনি দোকানে খুঁজে পান নি। পেলেই পাঠাবেন।
এমন কী আছে সেই চিঠিতে যে নীলু রাগ করল? কিন্তু সে এমন ভাব করতে লাগল যেন আমি তার কাছে লেখা খুব গোপন একটি প্রেমপত্র পড়ে ফেলেছি। আমি যখন বললাম, কি আছে এই চিঠিতে যে তুই এ রকম করছিস?
যাই থাকুক, কেন আমার চিঠি পড়বি?
বেশ আর পড়ব না।
পড়বি না। শুধু না, তুই আমার ঘরেও কোনোদিন ঢুকবি না।
বেশ ঢুকব না।
আর আমার সঙ্গে কথাও বলবি না।
ঠিক আছে বলব না।
ব্যাপারটা এখানেই শেষ হল না। সন্ধ্যাবেল বাবা প্রেস থেকে ফেরার সঙ্গে সঙ্গে সে নালিশ করল, বাবা বিলু আমার সব চিঠিপত্র পড়ে ফেলে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। তুমি ওকে ডেকে নিষেধ করে দাও।
ঠিক আছে করব।
না এখনই কর।
বাবা আমাকে ডেকে পাঠালেন। শান্তস্বরে বললেন, একজনের কাছে লেখা চিঠি অন্যের পড়াটা ঠিক না মা। আমি লজ্জায় বাঁচি না। নীলুটা এমন হচ্ছে কেন কে জানে। আগে এ রকম ছিল না। তার কাছে চিঠি এলেই আমাকে সে চিঠি পড়তে হত। একবার সে পেনফ্রেন্ডশিপ করল বুলগেরিয়ার কি একটা ছেলের সঙ্গে। সেই ছেলেটা সবুজ রঙের কাগজে লম্বা লম্বা চিঠি লিখিত ভুল ইংরেজিতে। চিঠির শেষে একটা ঠোঁটের ছবি একে লিখিত Kiss। নীলু আমাকে সেই চিঠি পড়তে দিয়ে বলত, মা গো কি অসভ্য! নীলুর সেই সব চিঠির জবাবও লিখে দিতাম। আমি। একদিন সে লজ্জায় লাল হয়ে বলল, বিলু চিঠির শেষে তুইও লিখে দে Kuss। ঐ বাঁদরটার সাথে তো আর দেখা হচ্ছে না। কি বলিস? আমি লিখলাম Kiss। নীলু বহু যত্নে একটা ঠোঁটের ছবিও আঁকল। তারপর ঐ ছেলে তার ছবি পাঠাল। মাথায় চুল নেই একটিও। গালে এত বড় একটা আঁচিল। হাতির কানের মত বড় বড় কান। ছবি দেখে দারুণ রেগে গেল নীলু। ছেলেটি লিখেছিল সুযোগ পেলেই সে তার বাংলাদেশী পেনফ্রেন্ড নীলুর সঙ্গে দেখা করতে আসবে। নীলু বলল, লিখে দে হাঁদারাম তুমি বাংলাদেশে এলে তোমার ঠ্যাং ভেঙে দেব। বাঁদর কোথাকার।
নীলু চিঠি লেখা বন্ধ করে দিলেও আমি চালিয়ে যেতে লাগলাম। মজাই লাগত। আমার। বানিয়ে বানিয়ে কত কিছু যে লিখছি। যেমন একবার লিখলাম, কাল আমরা সমুদ্রে নৌকা নিয়ে বেড়াতে গিয়েছিলাম। কি যে সুন্দর সমুদ্র আমাদের। খুব মজা হয়েছে। একবার সে লিখল, তোমার কি কোনো ছেলেবন্ধু আছে? আমি লিখলাম, হ্যাঁ আছে। আমার ছেলে-বন্ধুটি একজন কবি। সে আমাকে নিয়ে কবিতা লিখেছে।
ছেলেটা সত্যি সত্যি হাঁদারাম। যা লিখতাম তাই বিশ্বাস করত। তারপর একদিন সে হঠাৎ লিখে বসিল, আসছে সামারে আমি বাংলাদেশে আসব। কী সর্বনাশ! ভয়ে আমি এবং নীলু দু’জনই অস্থির। একি ঝামেলা হল। কি যে ভয়ে ভয়ে কেটেছে সেই সময়টা। রাতে ভাল ঘুম পর্যন্ত হত না। নীলু অবশ্যি খুব একটা ভয় পায়নি। ও বলত, খামোকা ভয় পাচ্ছিস, আসবে-টাসবে না। আর যদি এসেও পড়ে তাহলে বলব নীলু নামের মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে।
ছেলেটি অবশ্যি আসেনি। এবং চিঠিপত্রও দেয়নি। আর। হয়তো অন্য কোনো দেশের কোনো মেয়ে পেনফ্রেন্ডশিপ করেছে।
নীলুর যন্ত্রণায় আরো সব চিঠি লিখতে হয়েছে আমাকে। একবার সে বলল, খুব ভাষা-টাষা দিয়ে একটা চিঠি লিখে দে তো বিলু। কার কাছে, কী–কিছুই বলবে না। লিখলাম একটা চিঠি। সেটা তার পছন্দ হল না। আবার একটা লিখলাম। কত কাণ্ড হল সে চিঠি নিয়ে। ক্লাসের মেয়েরা সেই চিঠির লাইন বলে বলে নীলুকে খ্যাপাতে লাগল। কোথায় পেয়েছে তারা সেই চিঠি কে জানে! নীলু। যে ছেলেকে লিখেছিল সে-ই হয়ত বলে দিয়েছে। নীলু বাসায় এসে কেঁদে-টেদে অস্থির। সেই সময় নীলুর সঙ্গে খুব ভাব ছিল আমার। নীলু হঠাৎ করেই অন্য রকম হয়ে গেল। আমার কোনো বন্ধুটন্ধু নেই। নীলু দূরে সরে যেতেই আমি একা হয়ে গেলাম। এরকম একটি অদ্ভুত সুন্দর সকালে একা থাকতে ইচ্ছে করে না। আমি নীলুর খোজে বাগানের পেছনের দিকে এসে দেখি নীলু কাঁদছে। কী আশ্চর্য! আমি বললাম, কি হয়েছে রে?
কিছু হয়নি।
কাঁদছিস কেন?
তোর কাছে সব কিছু বলতে হবে নাকি?
বললে দোষ কি?
নীলু। কোনো জবাব না দিয়ে গম্ভীর মুখে বাগান ছেড়ে চলে গেল। সকালটা হঠাৎ করেই অন্য রকম হয়ে যাচ্ছে। লোকজন সবাই জেগে উঠেছে। রমজান ভাই ঘটং ঘটং করে টিউবওয়েলের পানি তুলছে। আকবরের মা ময়লা থালা-বাসন এনে জমা করছে টিউবওয়েলের পাশে। এক সময় ঝগড়া লেগে গেল দুজনের মধ্যে। এরা দু’জন দু’জনকে সহ্যই করতে পারে না। তবু কেমন করে থাকে এক সঙ্গে? এদের চেঁচামেচিতেই বোধ হয় বাবার ঘুম ভাঙল। বাবা বারান্দায় এসে দাঁড়াতেই চারদিক আবার চুপচাপ। বাবা বললেন, আমাকে চা দাও এক কাপ। এরা দুজনে কেউ কোনো উত্তর করল না। আকবরের মা বেড়ালের মতো ফ্যাসফ্যাস করে কি বলতেই আবার বেঁধে গোল রমজান ভাইয়ের সঙ্গে। বাবা দাঁড়িয়ে রইলেন চুপচাপ। আজকাল কেউ আর বাবাকে তেমন গ্রাহ্য করে না। আমি এগিয়ে এসে বললাম, আমি বানিয়ে আনছি। বাবা।
তুই আবার চা বানাতেও জানিস নাকি?
জানিব না কেন?
বাবা অবাক হয়ে বললেন, কার কাছে শিখলি?
কী আশ্চর্য কাণ্ড, চা বানানো আবার শিখতে হয় নাকি? বাবা এরকম ভান করতে লাগলেন
যেন খুব অবাক হয়েছেন।
আর কি জানিস, রান্নাবান্না করতে পারিস? ভাত-মাছ এইসব?
নাহ।
এইগুলিও শিখে ফেল। একদিন বিয়েটিয়ে হবে। রান্নাবান্না না জানলে বিয়ে দেয়াই যাবে না, হা হা হা।
অনেক দিন পর বাবা হাসলেন। মানুষের হাসির মতো সুন্দর কি কিছু আছে? বাবার হাসির সঙ্গে সঙ্গে চারদিকে রোদ ঝলমল করে উঠল।
মা একটা কথা সব সময় বলতেন, মানুষ যখন হাসে তখন তার সঙ্গে সমস্ত পৃথিবী হাসে। কিন্তু সে যখন কাঁদে, তার সঙ্গে আর কেউ কাঁদে না। কাঁদতে হয় একা একা।
চা বানাতে বানাতেই শুনলাম সেতারা গলা সাধা শুরু করেছে। নিসা গামা পামা গামা। গামা পামা গারে সা। গান-টান কিছু না, সামান্য সারে গামা, কিন্তু কি যে ভাল লাগছে শুনতে।
বাবাকে চা নিয়ে দিতেই বাবা বললেন, ভাবছি তোদের নিয়ে কোথাও ঘুরেটুরে আসব। যাবি নাকি?
কোথায়?
গারো পাহাড়ে গেলে কেমন হয়? জাড়িয়া জঞ্জাইল লাইনে বেশি দূর হবে না। ছয়-সাত ঘণ্টা লাগবে ট্রেনে। বন বিভাগের একটা রেস্ট হাউস আছে। যাবি নাকি?
যাব বাবা।
জায়গাটা সুন্দর। রাতের বেলা একটু ভয় ভয় লাগে।
কেন?
বন্য হাতির শব্দটব্দ পাওয়া যায়। এখন বোধ হয়। আর সে রকম নেই। তোরা যদি যেতে চাস তাহলে একটা প্রোগ্রাম করি।
যাবে কবে?
দুই দিনের মাত্র ব্যাপার, একটা তারিখ করলেই হয়। তুই নীলুকে জিজ্ঞেস করে আয় ও যাবে কি-না।
নীলু সব শুনে লাফিয়ে উঠল। বেড়ানোর ব্যাপারে নীলুর মতো উৎসাহী আর কেউ নেই। গারো পাহাড় দেখতে যাওয়া হবে শুনেই তার সব রাগ পড়ে গেল। নানান রকম পরিকল্পনা করে ফেললাম আমরা। যেমন শম্পাদের ক্যামেরাটা নিয়ে যাব এবং খুব ছবি তুলব। সেখানে আমরা দুজনেই শাড়ি পরব। এবং এই উপলক্ষে বাবাকে বলব দুটি শাড়ি কিনে দিতে। বন বিভাগের রেস্ট হাউসে রাতের খাবার-টাবার হয়ে যাবার পর বাবাকে বলব। গল্প বলার জন্যে। বাবা অবশ্যি গল্পটল্প তেমন বলতে পারে না। কিন্তু তাতে কিছু যায় আসে না। অনেক রাত পর্যন্ত আমরা হারিকেন জ্বলিয়ে বসে। থাকব। হারিকেনের আলো কী যে ভাল লাগে আমার।
একেকটা দিন এমন অন্যরকম হয়। মনে হয় দুঃখ-টুঃখ সব বানানো ব্যাপার। চারদিকে শুধু সুখ এবং সুখ। সন্ধ্যাবেলা আমরা দুবোন শাড়ি পরে বারান্দায় হাঁটছি, নজমুল চাচা ডেকে পাঠালেন।
কিরে বেটিরা শুনলাম দল বেঁধে নাকি পাহাড়ে যাচ্ছিস?
জি চাচা।
তা আমাকে একবার জিজ্ঞেস পর্যন্ত করিল না? আমারও তো পাহাড়-টাহাড়ে যেতে ইচ্ছে করে।
সত্যি সত্যি যাবেন আমাদের সাথে?
এরকম পরীর মতো মেয়েদের পাহারা দিয়ে রাখার জন্যেও তো লোকজন দরকার।
পরের কয়েকটি দিন আমাদের দারুণ উত্তেজনার মধ্যে কাটল। একদিন শুনলাম বন বিভাগের ডাকবাংলোটা পাওয়া গেছে। তারপর দিন-ক্ষণ ঠিক হল। নতারিখে ভোরের ট্রেনে যাব, পৌঁছব বিকাল নাগাদ। নজমুল চাচা যাবেন। রমজান যাবে। বাবার প্রেসের একজন কম্পোজিটর মাখন মিয়া সেও যাবে। কারণ মাখন মিয়ার বাড়ি ঐ অঞ্চলে, সে সব খুব ভাল চেনে।
আট তারিখ রাতে বাবা বাড়ি ফিরলেন না। রাত একটায় নজমুল চাচা খোঁজ নিতে গেলেন। আমরা তিন বোন বসার ঘরে বসে রইলাম চুপচাপ। নজমুল চাচা ফিরলেন দুটার দিকে এবং হালকা গলায় বললেন, কাজে আটকা পড়ে গেছে, সকাল বেলাতেই চলে আসবে। ঘুমিয়ে পড়! নীলু, শান্ত স্বরে বলল, বাবার কি হয়েছে বলেন?
কি আবার হবে। কাজ থেকে না মানুষের?
নজমুল চাচা রেগে গেলেন। নীলুও রেগে গেল।
বাবার কি হয়েছে বলেন।
কাল সকালে আসবে, তখন জিজ্ঞেস করিস। কিছু হয়নি, ভালই আছে।
নীলু তেজী গলায় বলল, আপনাকে এখন বলতে হবে।
এরকম করে তুই আমার সঙ্গে কথা বলছিস কেন?
নীলু কেঁদে ফেলল। বাবা ফিরলেন। পরদিন দুপুরে। কোর্ট থেকে জামিনে ছাড়া পেয়ে। তার রাত কেটেছিল থানা হাজতে। মদ খেয়ে খুব নাকি হৈচৈ করছিলেন বা এই জাতীয় কিছু। খুবই কেলেংকারি ব্যাপার। আমরা সপ্তাহখানেক কেউ স্কুলে গেলাম না। ঠিক করলাম বাবার সঙ্গে কেউ কোনো কথা বলব না। ডাকলেও সাড়া দেব না। এমন ভাব করব যেন শুনতে পাইনি। কোনো লাভ অবশ্যি তাতে হল না। বাবা আমাদের ডাকাডাকি বন্ধ করে দিলেন। যতক্ষণ বাসায় থাকেন। চুপ করে থাকেন।
একদিন দেখি একটি টেলিভিশন কিনে আনলেন। সেতারার খুব সখ ছিল টিভির। কথা ছিল সেতারা আগামী জন্মদিনে ঢাকা থেকে এটি কিনে আনা হবে এবং সেই উপলক্ষে আমরা সবাই দল বেঁধে ঢাকা যাব। তিনি বোধ হয় আমাদের সঙ্গে ভাব করবার জন্যেই আগে-ভাগে কিনে ফেললেন। সন্ধ্যাবেল টিভি চালু হল। আমরা কেউ দেখতে গেলাম না। আকবরের মা এবং রমজান ভাই মোড়া পেতে টিভির সামনে রাত এগারটা পর্যন্ত বসে রইল।
বাবার কাছ থেকে অনেক দূরে সরে গেলাম আমরা। সেই সময় বড় মামার চিঠিতে জানলাম মার একটি ছেলে হয়েছে। ছেলের নাম কাজল।
মায়ের শরীর খুব খারাপ। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে আছেন। কি যে কষ্ট হল আমার। কত লক্ষ বার যে বললাম–মা ভালো হয়ে যাক। মাকে ভাল করে দাও। রোজ রাতে তাকে স্বপ্নে দেখতাম। রক্তশূন্য একটি লম্বাটে ফরসা মুখ। চাদর দিয়ে গলা পর্যন্ত ঢাকা। স্বপ্ন দেখে রোজ রাতেই কান্দতাম। আমরা তিন বোনই নিশ্চিত ছিলাম মা মারা যাবেন। কিন্তু তিনি সুস্থ হয়ে উঠলেন। চিঠি লিখল মা নীলুকে। নীলু তার কোনো চিঠি আমাকে পড়তে দেয় না। কী লেখা ছিল সে চিঠিতে তা জানলাম না। নীলু শুধু বলল, কাজল খুব বিরক্ত করে রাতে মাকে মাতে দেয় না।