পঞ্চম পরিচ্ছেদঃ খিজিরপুর প্রাসাদে
যথাসময়ে শ্রীমতী স্বর্ণময়ীর পত্র বহন করিয়া শিবনাথ কৈবর্ত খিজিরপুর রাজধানীতে উপস্থিত হইল। সূর্য তখন নীল আকাশের গায়ে নানা বর্ণের, নানা রকমের মনোহর মেঘের পট আঁকিয়া পশ্চিম-সাগরে ডুবু ডুবু প্রায়। এক রাত্রির জন্য বিদায় লইতেও সূর্যের মন যেন সরিতেছে না; তাই সবিতৃদের ডুবিতে ডুবিতেও সতৃষ্ণনয়নে পৃথিবী-সুন্দরীকে সহস্র কিরণ-বাহু প্রসারিত করিয়া আলিঙ্গন করিতেছেন। খিজিরপুরের নবাব বাটীর বহির্বাটীর তোরণ অতিক্রম করিয়াই শিবনাথ দেখিতে পাইল, অন্যূন এক মাইল লম্বা উত্তর-দক্ষিণ বিস্তারিত প্রকাণ্ড রাজবাটী। দেখিলেই মনে হয় যেন শ্যামল তৃণতলে রাজহংসের ডিম্ব-শ্রেণী শোভা পাইতেছে। অসংখ্য চূড়া, গুম্বজ ও মিনারের রৌপ্যকলস ও ছত্রে চওড়া এবং দেড় মাইল লম্বা এক স্বচ্ছ-তোয়া দীঘি। সুবিশাল স্বচ্ছ জলরাশিতে অসংখ্য প্রকারের জলজ কুসুমরাশি প্রস্ফুটিত হইয়া মৃদু মারুত-হিল্লোল-উত্থিত তরঙ্গরাজির সহিত তালে তালে দুলিতেছে। দূর দূরান্তর ব্যাপিয়া সে এক চমৎকার শোভা। সূর্যের হৈমাভা পড়িয়া পড়িয়া সরোবরের সৌন্দর্য যেন উথলিয়া পড়িতেছে। সরোবরে মধ্যস্থলে এক লৌহ-সেতু দ্বারা উভয় তীর সংযুক্ত। সেতু পার হইয়া আসিয়া সরোবরের তুল্য এক বিরাট রমণীয় পুস্পোদ্যানে প্রবেশ করিতে হয়। এই সুবিশাল উদ্যানে পৃথিবীর সকল দেশের নানা প্রকার পুস্পের বৃক্ষ, লতাগুল্ম সংগৃহীত হইয়াছিল। বাগানে সহস্র সহস্র পুস্পস্তবক ফুটিয়া সৌন্দর্যে দিগন্ত আলোকিত এবং সৌরভে গগন পবন আমোদিত করিত। তিনশত ভৃত্য বাগানের মালীর কার্যে নিযুক্ত ছিল। এই বাগানের শোভা দেখিয়া সকলেই মুগ্ধ ও লুব্ধ হইয়া পড়িত। মুসলমানের স্বাভাবিক সৌন্দর্য ও পুস্প-প্রিয়তা ঈসা খাঁতে বেশ স্ফূর্তিলাভ করিয়াছিল। নানা জাতীয় সুকণ্ঠ ও সুন্দর বিহঙ্গ এই চির বসন্ত সেবিত উদ্যানে বিরাজ করিত। এই উদ্যানের মধ্যেই ষাট গুম্বজী বিরাট মসজিদ। উহা আগাগোড়া রক্তপ্রস্তরে নির্মিত। কেবল জমি সবুজ মর্মরের। ভূতল হইতে গুম্বজের শীর্ষ এক শত ফিট উচ্চ। প্রত্যেক গুম্বজের মস্তকে সুবর্ণ-কলস শোভা পাইতেছে। মসজিদের চারি পার্শ্বে স্বেতপ্রস্তরের চারিটি মিনার। প্রত্যেকটির উচ্চতা একশত পঁচিশ ফিট। মসজিদের চত্বর ভূমি হইতে পাঁচ হাত উচ্চ। চারিদিকে প্রশস্ত সোপান-শ্রেণীতে পরিবেষ্টিত। সোপান-শ্রেণীর উপরে সুন্দর টবে ঋতু-পুস্পজাল ফুটিয়া অপূর্ব বাহার খুলিয়াছে। মধ্যে মধ্যে নানা প্রকারের উৎস নানা ভঙ্গিমায় নির্মল জলধারার উদ্গার করিতেছে। শিবনাথ যাহা দেখিতেছে, তাহা হইতেই আর সহসা আঁখি ফিরাইতে পারিতেছে না। সে পূর্বে কেদার রায়ের বাড়ীকেই পরশ রমণীয় ও সুবৃহৎ বলিয়া মনে করিত; কিন্তু এক্ষণে ঈসা খাঁর উদ্যান ও প্রাসাদ দেখিয়া কেদার রায়ের শ্রীপুরের বাটী তাঁহার নিকট শ্রীহীন বলিয়া মনে হইতে লাগিল। শিবনাথ দেখিল, মসজিদে অন্যূন তিন হাজার লোক মগরেবের নামাজ পড়িতেছে। সে সেই বিরাট সমজিদের দ্বারের সম্মুখে ভক্তিভরে সেজদা করিল।” বাগান পার হইয়া পুনরায় সিংহদ্বার। শিবনাথকে ঈসা খাঁর সামীয় পত্রবাহক দেখিয়া প্রহরী বলিল, “এখানেই দাঁড়াও, নবাব সাহেব নামাজ পড়তে গিয়েছেন, এখনই আসবেন।” এখানে আমরা আমাদের পাঠকগণকে জানাইয়া রাখি যে, ঈসা খাঁকে পূর্ব-বাঙ্গালার সকল লোকেই বারভূঞার নবাব বলিয়া আহবান করিত। বস্তুতঃপক্ষে তিনি একজন নবাবের তুল্য লোকই ছিলেন। তাঁহার বার্ষিক আয় পঞ্চান্ন লক্ষের উপর ছিল আজকার হিসাবে পাঁচ কোটিরও বেশী। ঈসা খাঁর সাত হাজার অশ্বারোহী, বিশ হাজার পদাতিক, দুইশত রণতরী এবং দেড়শত তোপ ছিল। অশ্বশালায় সাত হাজার অশ্ব এবং হস্তিশালায় পাঁচশত হস্তী সর্বদা মৌজুদ থাকিত। প্রত্যহ পাঁচশত ছাত্র তাঁহার প্রসাদ হইতে আহার পাইত। একশত পঁচানব্বই জন জমিদার তাঁহার অধীনে ছিল। তিনি দশ বৎসর কাল অরাজকতার জন্য বাঙ্গালার নবাব সরকারের রাজস্ব দিয়াছিলেন না। তাহাতে প্রায় আড়াই কোটি টাকা তাঁহার রাজকোষে সঞ্চিত হইয়াছিল। তিনি তাঁহার রাজ্যে দুই হাজার পুস্করিণী, তিন হাজার ইদারা, দুইশত পান্থশালা এবং ষাটটি মাদ্রাসা স্থাপন করিয়াছিল। বলা বাহুল্য যে, মুসলমানদের চিরন্তন প্রথানুসারে এই সমস্ত মাদ্রাসা অবৈতনকি ছিল। এতদ্ব্যতীত হিন্দুদের পঞ্চাশটি টোলের অধ্যাপকগণের প্রত্যেকে বার্ষিক একশত টাকা করিয়া সাহায্য পাইতেন। সেকালের এই একশত টাকা সাহায্য এ-কালের হাজার টাকা তুল্য। তিনি তাঁহার রাজ্যের নানা স্থানে তিনশত মাইলের উপর রাস্তা নির্মাণ করিয়াছিলেন। এতদ্ব্যতীত বহু শিল্পদ্রব্যের কারখানা প্রতিষ্ঠিত করিয়াছিলেন। তাঁহারা কারখানায় প্রস্তুত তোপ, বন্দুক, তলোয়ার, ঘোড়ার জিন এবং কাচের দ্রব্য দিল্লীর বাদশাহী কারখানায় প্রস্তত ঐ সমস্ত দ্রব্য হইতে নিকৃষ্ট হইত না।
ঈসা খাঁ নামাজ পড়িয়া মসজিদ হইতে ফিরিতেই শিবনাথ কুর্ণিশ করিয়া পত্র দিল। ঈসা খাঁ রুমাল খুলিয়াই বুঝিতে পারিলেন, স্বর্ণময়ীর পত্র। পত্রখানি হাতে করিতেই ঈসা খাঁর আপাদমস্তকে কি যেন এক বিদ্যুৎ-তরঙ্গ প্রবাহিত হইল। ঈসা খাঁ সহসা শিহরিয়া উঠিলেন। পত্র খুলিয়া উপরের স্তরের লেখা পড়িয়াই বাটীতে প্রবেশ করিলেন। শিবনাথের খাইবার থাকিবার ভালো বন্দোবস্ত করিয়া দিতে হিন্দু-অতিথিশালার দারগাকে আদেশ করিয়া গেলেন। শিবনাথ বিস্ময়-বিস্ফোরিত নেত্রে রাস্তার দুই পার্শ্বে স্থাপিত বীর-পুরুষদের অশ্বারূঢ় প্রস্তর-মূর্তি দেখিতে দেখিতে অতিথিশালায় যাইয়া উপস্থিত হইল।
রাত্রি এক প্রহর। ঈসা খাঁ হস্তীদন্ত-নির্মিত একখানি আরাম-কুর্সীতে বসিয়া ভাবিতেছেন। গৃহের মধ্যে একশত ডালবিশিষ্ট ঝাড় জ্বলিতেছে। প্রকান্ড কক্ষ, কক্ষের ছাদ স্বর্ণ ও রৌপ্যের লতাপাতায় সুশোভিত। ছাদের কড়ি, বরগা কিছুই দৃষ্ট হইতেছে না। বলা বাহুল্য যে, প্রস্তুরের কড়ি বরগা ছাদের সহিত অদ্ভুত কৌশলে মিশাইয়া দেওয়া হইয়াছে। দেওয়ালে সুবৃহৎ দর্পণ, প্রস্তুরের নানা বর্ণের ফুল এবং বহুমূল্য চিত্ররাজি শোভা পাইতেছে। সম্রাজ্ঞী রাজিয়ার কৃপাণপাণি অশ্বারূঢ়া বীর্যবতী মূর্তিখানি অতি চমৎকার শোভা পাইতেছে। রাজিয়া যেমন অতুলনীয়া সুন্দরী তেমনি অসাধারণ সাহসিনী ও তেজস্বিনী। তাঁহার মুখ-চোখ হইতে প্রতিভার আলো যেন ঠিকরিয়া পড়িতেছে। আর একটি চিত্রে মহাবীর রোস্তম তরবারি আঘাতে এক ভীষণ আজদাহা সর্পকে বিনাশ করিতেছেন। রোস্তমের অসাধারণ বীরত্ব ও তেজ ছবিতে চমৎকার রূপে ফুটিয়াছে। আর একটি চিত্রে উদ্যান মধ্যে বসিয়া ‘মজনু’ বীণা বাদন করিতেছেন; দুঃখিনী প্রেমোন্মাদিনী ‘লায়লা’ সেই মধুর বীণাধ্বনি শ্রবণ করিতেছেন। লায়লার দুই চক্ষু বহিয়া তরল মুক্তাধারার ন্যায় অশ্রুধারা নির্গত হইতেছে। উদ্যানের ফুল ও পক্ষীগুলি মুগ্ধ হইয়া রহিয়াছে। আর একখানি চিত্রে ফরহাদ প্রেমোন্মত্ত চিত্রে পাহাড় কাটিতেছেন। অনবরত দৈহিক পরিশ্রমে ফরহাদের সুকুমার তনু ক্ষীণ ও মলিন হইয়া পড়িয়াছে। শিরী বিষন্ন চিত্তে করুণনেত্রে দূরস্থ প্রাসাদের ছাদ হইতে তাহাই দর্শন করিতেছেন। তাঁহার চক্ষু হইতে প্রিয়তমের প্রতি প্রেম ও সহানুভূতির কি ভুবমোহন জ্যোতিঃ নির্গত হইতেছে।
একখানি চিত্রে একজন দরবেশ স্থানীয় লোকদিগকে ইসলাম গ্রহণ এবং তাঁহার সহায়তা করিতে আহবান করিতেছেন। সমবেত লোকগণ সকলেই নীরব ও নিস্তব্ধ। কিন্তু ষোড়শবর্ষ বয়স্ক এক যুবক স্বর্গীয় দীপ্তিঝলসিত তেজোময়ী মূর্তিতে দণ্ডায়মান হইয়া বিশ্বাসের কলেমা পাঠ করতঃ অসি উত্তোলনপূর্বক আনুগত্য জ্ঞাপন করিতেছেন। আর একখানি চিত্রে বালক রোস্তম, এক মত্ত শ্বেতহস্তীকে পদাঘাতে বধ করিতেছেন। একখানি চিত্রে রাজ্যচ্যুত ছদ্মবেশী ইরাণেশ্বর জামশেদ, জাবলস্থানের উদ্যানে শিলাসনে উপবিষ্ট। সম্মুখে জাবলস্তানের অপূর্ব সৌন্দর্যশালিনী রাজকুমারী তাঁহাকেই স্বর্কীয় আকাঙ্খিত প্রেমাস্পদ জামসেদ জ্ঞানে সন্দেহ নিরাকরণার্থ সম্রাট জামশেদের একখানি চিত্র লইয়া পরম কৌতূহল এবং প্রেমানুরাগ-ফুল্ল-নয়নে আড়াল হইতে আকৃতির সহিত মিলাইয়া দেখিতেছেন। চিত্রে কুমারীর এক পার্শ্বে একটি নৃত্যশীল ময়ূর এবং অন্য পার্শ্বে একটি মনোরম মৃগ শোভা পাইতেছে। আর একখানি চিত্রে হপ্তখানার সুসজ্জিত নিভৃত কক্ষে প্রেম-উম্মাদিনী জোলেখা সুন্দরী পিপাসাতুর চিত্তে ইউসফের নিকট প্রেম যাচ্ঞা করিতেছেন-আর ধর্মপ্রাণ ইউসফ উর্ধ্বে অঙ্গুলী নির্দেশ করিয়া পরমেশ্বরের ক্রোধের কথা জোলেখাকে জ্ঞাপন করিতেছেন। উভয়ের মুখে স্বর্গ ও নরকের চিত্র। একখানি চিত্রে মরুনির্বাসিতা হাজেরা বিবি শিশুপুত্র ইসমাইলকে শায়িত রাখিয়া জলের জন্য চতুর্দিকে ছুটাছুটি করিতেছেন। এদিকে ইসমাইলের পদাঘাতে ভূমি হইতে এক নির্মল উৎসধারা বহির্গত হইতেছে। একজন স্বর্গীয় হুরী ইসমাইলের চিত্তবিনোদনের জন্য তাহার চোখে দৃষ্টি স্থাপন করিয়া হাস্যমুখে দাঁড়াইয়া আছেন। শিশু তাহার মুখপানে অনিমেষ আঁখিতে এমন সরল উদার অথচ কৌতূহলপূর্ণ মধুর দৃষ্টিতে চাহিয়া আছে যে, সমস্ত পৃথিবী যেন অমৃত-ধারায় বসিয়া আছেন। সুন্দরীকুল-ললাম ‘সাবা’র রাজ্ঞী বিলকিস রূপের ছটায় দশদিক আলো করিয়া আগমন করতঃ কাচনির্মিত মেঝে সরোবর জ্ঞানে একটু বিচলিত হইয়া পার হইবার জন্য পরিধেয় বাস ঈষৎ টানিয়া ধরিয়াছেন। হযরত সোলেমান এবং অন্যান্য পারিষদমন্ডলী রাজ্ঞীর বুদ্ধিবিভ্রম দেখিয়া স্মিত হাস্য করিতেছেন। লজ্জার সহিত সৌন্দর্য ও অভিমান-গরিমা মিশিয়া রাজ্ঞী বিলকিসকে এক ভুবনমোহন সৌন্দর্য প্রদান করিতেছে। এই প্রকারের অসংখ্য কবি-চিত্ত-বিনোদন তসবীরে চতুর্দিকে প্রাচীরগাত্রে বেহেশতের শোভা বিকাশ করিতেছে।
গৃহের মধ্যে আতর গোলাপের গন্ধ ভুর ভুর করিতেছে। মেঝের উপর রাশি রাশি গোলাপ শোভা পাইতেছে। এক পার্শ্বে পালঙ্কের উপর বিছানা পাতা রহিয়াছে। বিছানার উপরে শ্বেত রেশমের মূল্যবান চাদরখানি ঝলমল করিতেছে। তিন পার্শ্বে কিঙ্খাপের বহুমূল্য তাকিয়া। জরীর কার্য করা সবুজ মখমলে তাহা ঢাকা। বিছানার এক পার্শ্বে শাহ্নামা, সেকেন্দারনামা এবং কয়েকখানি বহুমূল্য ইতিহাস শোভা পাইতেছে। পুস্তকগুলি সমস্তই মণিখচিত করিয়া পুবর্ণের পুরু পাতে বাঁধা। মণিগুলি দীপালোকে ঝক্ ঝক্ করিয়া জ্বলিতেছে।
এই প্রকারের সুরম্য গৃহতলে বসিয়া একমনে ঈসা খা কি চিন্তা করিতেছেন। ঈসা খাঁর প্রিয়তমা ভগ্নী ফাতেমা অনেকক্ষণ হইল ঘরে প্রবেশ করিয়া বিছানার নিকট দাঁড়াইয়া বহিগুলি নাড়াচাড়া করিতেছে, তবুও ঈসা খাঁর চমক নাই। ফাতেমা আর কখনও তাহার ভ্রাতার এই প্রকার অন্যমস্কতা দেখে নাই। অন্যান্য দিবস ফাতেমা আসিতেই ঈসা খাঁ তাহাকে কত প্রকার প্রশ্ন করেন। উভয়ের মধ্যে প্রগাঢ় সম্প্রীতি ও গভীর ভালবাসা। প্রত্যেক দিন রাত্রেই ঈসা খাঁর পরিশ্রান্ত মস্তিস্ক ও হৃদয়ের শান্তি ও প্রীতি সঞ্চারের জন্য ফাতেমাকে সেতার বাজাইয়া গান গাহিতে হয়। ফাতেমা অতি সুন্দররূপে গাহিতে এবং বাজাইতে শিখিয়াছে। আহমদনগরের প্রসিদ্ধ সঙ্গীতাচার্য করতলব খাঁ তিন বৎসর পর্যন্ত ফাতেমাকে গীতবাদ্য শিক্ষা দিয়াছেন। ফাতেমার ধর্ম ও শান্তি-রসাশ্রিত গান শুনিলে পাষাণ হৃদয়ও বিগলিত হয়। ফাতেমা এত দ্রুত যাদুবশে নাচিয়া কাঁপিয়া কাঁপিয়া অতৃপ্ত মদিরাবেশময় ঝঙ্কার দিতে থাকে। ফাতেমা এত দ্রুত অঙ্গুলী চালনায় অভ্যস্ত যে, মনে হয় তাহার অঙ্গুলী স্থির রহিয়াছে। সেতার আপনা আপনি বাজিতেছে। তারপর সেতারের ঝঙ্কার ও মধুবর্ষিণী মূচ্ছনার সহিত যখন তার সুধাকণ্ঠ গাহিয়া উঠে, তখন মনে হয় স্বর্গরাজ্য তরল হইয়া ধরাতলে বহিয়া যাইতেছে। কিন্তু আজ অনেকক্ষণ হইল ফাতেমা আসিয়া দাঁড়াইয়া আছে। ভ্রাতার ইঙ্গিত না পাইলে সে কোনও দিন বসে না। বসে না যে, সে শুধু ঈসা খাঁর সুমধুর সম্ভাষণের জন্য ঈসা খাঁ তাহাকে আদর করিয়া সস্নেহে বসিতে বলিবে বলিয়া। ফাতেমা যখন দেখিল যে, ঈসা খাঁ জানালার দিক হইতে মুখ ফিরাইতেছেন না, তখন একখানি পুস্তকের দ্বারা আর একখানি পুস্তকে আঘাত করিল। আঘাতের শব্দে ঈসা খাঁ চমক ভাঙ্গিয়া গেল। নক্ষত্র খচিত নীলাকাশের প্রান্ত-বদ্ধ-দৃষ্টি ফিরাইয়া গৃহমধ্যে চাহিলেন। দেখিলেন, সমস্ত ঘর ঝাড়ের আলোকে উজ্জ্বল হইয়া শোভা পাইতেছে। আর সেই গৃহের কার্পেটমন্ডিত মেঝেতে দাঁড়াইয়া ফাতেমা ঈষৎ বঙ্কিম অবস্থায় তাঁহার শুভ্র শয্যার পার্শ্বে পুস্তক লইরা ক্রীড়া করিতেছে। তাহার অলকাবলী বিমুক্ত। তাহার বদনমণ্ডল পুণ্যের জ্যোতিঃতে স্নিগ্ধ। দেখিয়া মনে হয় যেন জ্যোৎস্নার রাজ্যে মূর্তিমতী বালিকা প্রতিমা শান্ত ভঙ্গিমায় দাঁড়াইয়া আছে। ফাতেমার বয়স সবে দ্বাদশ হইলেও এবং এখনও তাহার যৌবনপ্রাপ্তির বিলম্ব থাকিলেও তাহার মুখমণ্ডল বেশ ভাবুকাতাপূর্ণ। সে ভাব অতি নির্মল-অতি পবিত্র-বুঝিবা স্বর্গরাজ্যের ঊর্ধ্বের। ঈসা খাঁ মুখ তুলিয়া মধুর স্বরে বলিলেন, “কি গুল, কখন এসেছিস?” পাঠক জানিয়া রাখিবেন, ঈসা খাঁ আদর করিয়া ফাতেমাকে গুল অর্থাৎ ফুল বলিয়া ডাকিতেন।
ফাতেমাঃ হাঁ মিঞা ভাইজান! আপনি আজ একমনে কি ভাবছিলেন? আমি অনেকক্ষণ এসেছি।
ঈসা খাঁ:তা আমাকে ডাকিস নাই কেন? আমি না বল্লে কি বসতেও নেই? আকাশের দিকে চেয়ে মনটা যেন কোন দেশে চলে গিয়েছিল। তুই এইবার সেতার নিয়ে বসে যা’। আজ খুব ভালো বাজাবি। মনটা বড় অস্থির।
ফাতেমা তখন সেতার লইয়া একখানি মখমলমণ্ডিত রূপার কুর্সীতে চম্পক বিনিন্দিত আঙ্গুলে মেজরাফ পরিয়া সেতারের বক্ষ স্পর্শ করিল। সে ললিত-কোমল করপল্লবের ইঙ্গিতে সেতারের সুপ্ত তন্ত্রী নাচিয়া উঠিয়া বাজিতে লাগিল। সেতারের মধুর ঝঙ্কারে আলোক-উজ্জ্বল গৃহ যেন চঞ্চল হইয়া উঠিল। ঝাড়ের কর্পূর-মিশ্রিত শত মোমবাতির শুভ্র শিখা মৃদু কম্পনে কাঁপিতে লাগিল। সেতারের মনোমদ মধুর তরল ঝঙ্কারে ঈসা খাঁর এক আত্মীয় রমণী এবং আয়েশা খানম সাহেবা ও অন্যান্য অন্তঃপুরিকাব্য আসিয়া উপস্থিত হইলেন। প্রত্যহই এইরূপ হইত। ফাতেমার হাতে সেতার বাজিলে কেহই স্থির থাকিতে পারিত না। বিশেষতঃ ফাতেমার ধর্ম ও ঐশী-প্রেম সম্পর্কীয় গজল শুনিয়া পুণ্য সঞ্চয়ের আশায় আয়েশা খানম সেতার ঝঙ্কার দিলেই আসিতেন। ঈসা খাঁ আয়েশাকে দেখিয়া উঠিয়া দাঁড়াইয়া চরণ চুম্বন করিলেন এবং একখানি স্বর্ণ-বিমণ্ডিত দ্বিরদ-রদ-রচিত বিচিত্র আসনে আম্মাজান’কে বসিবার জন্য মুখমলের মসনদ পাতিয়া দিলেন। আয়েশা খানম তাঁহার প্রীতিপ্রফুল্লতা-মন্ডিত শান্ত অথচ গম্ভীর সৌন্দর্যে গৃহ আলোকিত করিয়া রাজরাজেশ্বরীর ন্যায় আসন গ্রহণ করিলেন। অন্যান্য রমণীরাও যথাযোগ্য আসন পরিগ্রহ করিলেন। সুবিশাল পুরী নীরব ও নিঃশব্দ। কেবল আসাদ-মঞ্জিলে (সিংহ-প্রাসাদে) সেতারের মধুর নিক্কণ কাঁপিয়া কাঁপিয়া চতুর্দিকে অমৃত-বৃষ্টি ঝরিতেছে। এক গৎ বাজাইবার পর ফাতেমা গজল ধরিল। সে পীযুষ-বর্ষিণী পারস্য ভাষার গজলের বঙ্গানুবাদ দেওয়া হইল। বলা বাহুল্য, পারস্য ভাষার অমৃতত্ত্ব ও ছন্দ-ঝঙ্কার বঙ্গানুবাদ কেহ অনুসন্ধান করিবেন না।
সঙ্গীত
“হে শিব সুন্দর! চির মনোহর পরম পুরুষ পরাৎপর!
হে নিখিলশরণ ভুবনঞ্জন পতিতপাবন ত্রিগুণাকর!
গগনে গগনে পবনে পবনে তোমারি মহিমা ভাসে,
কাননে কাননে কুসুমে কুসুমে তোমারী মাধুরী হাসে।
নদ নদী জল বহে কল কল ঢালিয়া অমিয়-ধারা,
কুঞ্জু কাননে তোমার গায়নে বিহগ আপনা-হারা।
নীল আকাশে তারকা প্রকাশে তোমারী মহিমা রটে,
সবারি মাঝে তুমিই ফুটিছ তুমিই হাসিছ বটে!
(শুধু) আমারি হৃদয় র’বে কি আঁধার? তাও কি কখনো হয়,
এই যে গো তুমি হৃদয়ের মাঝে, জয় জয় তব জয়।”
ফাতেমা ভাবাবেশে তন্ময় চিত্তে গগন-পবন সুধা-প্লাবিত করিয়া সঙ্গীতটি গাহিল। সে যখন শেষের চরণ ঝঙ্কার দিয়া নিমীলিত নেত্রে গাহিল, “এই যে গো তুমি হৃদয়ের মাঝে, জয় জয় তব জয়,” তখন তাহার মুখের দৃশ্যে এবং ভাবের আকুলতায় সকলেই কাঁদিয়া ফেলিল। তারপর কিছুক্ষণ থামিয়া বালিকা বিশ্রাম করিল। ঘরের ভিতর টানা পাখা চলিলেও তাহার ললাটে স্বেদবিন্দু দেখা দিল। পাখার বাতাসে তাহার মুক্ত অলকাবলী উড়িয়া উড়িয়া দোল খাইতেছে। অথবা উহার সঙ্গীতরসে মাতোয়ারা হইয়া নৃত্য করিতেছে। বালিকা আবার গাহিল-
আজি, প্রভাতে-
বহিয়া কুসুম গন্ধ
সমীর বহিছে মন্দ
প্রাণের কুঞ্জে মূরজ মন্দ্রে
বাজিছে অযুত ছন্দ।
আজি, কার দরশন আশে
পুলকে হৃদয় ভাসে,
কার প্রেমের বাণী অমিয় ঢালিয়া
মরমে মরমে পশে!
কার ভুবনতুলান ছবি,
যেন প্রভাতের রবি
মেঘের আড়ালে লুকিয়ে লুকিয়ে
দেখা দিয়ে যায় ডুবি।
কার অই বাঁশীর স্বরে
পরাণ আকুল করে!
হৃদয়-কুঞ্জে কুসুমপুঞ্জে
কে ডাকিছে মোরে!
আমি চিনেছি ওরে এখন
ও যে জীবনের জীবন
হৃদয়ের ধন নয়নমণি
প্রাণবল্লভ রতন
ফাতেমা ৩০ মিনিটে তিনবার গাহিয়া এ-সঙ্গীত শেষ করিল। শেষের পদ গাহিবার সময় ঐশী প্রেমের তীব্র উদাসে সকলের বুক ফুলিয়া উঠিতে লাগিল। আয়েশা খানম বেএখতেয়ার হইয়া অশ্রুজলে বুক ভাসাইতে লাগিলেন। ফাতেমা যখন গাহিতেছিল তখন মনে হইতেছিল, কোটি স্বর্গ এই বালিকার পুণ্য চরণতলে চুরমার হইয়া যাইতেছে। সকলের মুখমণ্ডল পুণ্যের মহিমায় কি সুন্দর! কি উজ্জ্বল! স্বর্গরাজ্যের এক অমৃত-ঝরণা সকলের হৃদয়ে প্রবাহিত হইতেছে! আশেয়া খানম বলিলেন, “ফাতেমা! আর একটি ক্ষুদ্র মোনাজাত (প্রার্থনা) গেয়ে ক্ষান্ত হ’। বড় পরিশ্রম হচ্ছে।”
ফাতেমা বলিল, “না মা! কিছুই পরিশ্রম হয় নাই। আপনি যতক্ষণ বসবেন, আমি ততক্ষণ শুনাব।” বালিকার কণ্ঠে আবার বাজিল-
কুঞ্জু সাজিয়ে তোমারি আশে বসিয়ে আছি হে প্রাণধন!
তোমারি চরণ করিয়া শরণ সঁপিয়া দিয়েছি এ দেহ মন।
তোমারী তরে ভক্তি-কুসুমে গেঁথেছি আমি শোভন মালা,
হৃদি-সিংহাসনে বসহ বঁধুয়া আঁধার মানস করিয়ে আলা।
মরমে মরমে হৃদয়ে হৃদয়ে জেগেছে তোমার প্রেমের তৃষা,
(আমি) পারি না যে আর এমন করিয়া জাগিতে হে নাথ! বিরহ-নিশা।
ফাতেমা যখন কিন্নরীকণ্ঠে গাহিল, “আমি পারি না যে আর এমন করিয়া জাগিতে হে নাথ! বিরহ-নিশা” তখন সকলেই কাঁদিয়া উঠিলেন। ফাতেমা এমনি করিয়া সমস্ত প্রাণের ব্যাকুলতা-জড়িত ব্যাকুল স্বরে এমন চমৎকার সুরে অপূর্ব ভঙ্গিমার সহিত “আমি পারি না যে আর এমন করিয়া জাগিতে হে নাথ! বিরহ-নিশা” গাহিল যে, সকলে এক সঙ্গে ঐশী প্রেমে উন্মত্ত হইয়া পড়িলেন। সকলেই প্রাণের ভিতরে সেই পরম সুন্দর পরম-পুরুষের তীব্র তৃষ্ণা অনুভব করিতে লাগিলেন। সঙ্গীত থামিবার অর্ধঘন্টা পরে সকলের প্রেমোচ্ছ্বাস মন্দীভূত হইল। কিন্তু তখনও মনে হইতেছিল যেন, সমস্ত বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ড সঙ্গীতের অমৃতায়মান স্বরে বোমবর্ত্মে স্থির ধীর হইয়া রহিয়াছে। ঈসা খাঁ নীরবতা ভঙ্গ করিয়া বলিলেন, “আম্মাজান! ফাতেমা কি চমৎকার গায়! আর আজকার সঙ্গীতের বাছাই বা কি মনোহর! ও যখন গায়, তখন আমার মনে হয়, যেন সাক্ষাৎ দেবী-কুলেশ্বরী জগজ্জননী ফাতেমা জোহরা-ই মর্তো আসিয়া বালিকা মূর্তিতে গাহিতেছেন!”
আয়েশাঃ আহা! আজ যদি তোমার কেবলা সাহেব বেঁচে থাকতেন, তা হ’লে তিনি কি আনন্দই না উপভোগ করতেন! তবুও আমার বিশ্বাস, ও যখন গায়, তখন তাঁর আত্মা এসে সঙ্গীত-সুধা পান করতে থাকে। ফাতেমা যতদিন আছে, ততদিন আমি এই স্বর্গসুখ অনুভব করছি। কিন্তু তারপর এ সুখ ও পুণ্য ভোগের ভাগ্য হবে না।
ঈসাঃ কেন মা!
আয়েশাঃ কেন আর কি? ফাতেমাকে ত আর চিরকাল এখানে রাখতে পারব না। তুমিও ত বিবাহ করবে না যে, বৌমাকে কিছু শিক্ষা দিতে পারবে।
ফাতেমাঃ কেন মা! আমি চিরকালই আপনার কাছে থাকব?
আয়েশাঃ (হাস্য করিয়া) হাঁ বাছা! ঐ রকম সকলেই ভাবে বটে! কিন্তু এ জগতে যা ভাবা যায়, তাই ঠিক রাখতে পারা যায় না। তুমি ছেলে মানুষ, সৎসার-চক্রের এখনও কিছু জান না।
ফাতেমাঃ যা হ’ক মা, মিঞাভাইয়ের শাদীর আয়োজন কর।
ঈসা খাঁ ফাতেমার কথায় লজ্জিত হইয়া জননীর অসাক্ষাতে মুঠি তুলিয়া স্মিত মুখে ঈঙ্গিতে ফাতেমাকে বলিলেন, “চুপ”।
আয়েশাঃ হাঁ মা! আমি শীঘ্রই উপযুক্ত পাত্রীর সন্ধানে লোক পাঠাচ্ছি।
ফাতেমাঃ হাঁ আম্মাজান! কেদার রায়ের কন্যা স্বর্ণময়ী নাকি খুব সুন্দরী?
আয়েশাঃ থাকুক সুন্দরী, তাতে কি হবে?
ফাতেমাঃ কেন আম্মাজান?
আয়েশাঃ হিন্দুর মেয়ের আবার সৌন্দর্য!
ফাতেমাঃ না মা! সে নাকি পাঠানীর মত সুন্দরী!
আয়েশাঃ হাজার হউক, সে হিন্দুর মেয়ে।
ফাতেমাঃ সে ত আর হিন্দু থাকছে না, শাদী হলে সে সত্য ধর্ম গ্রহণ ক’রে মুসলমান হবে।
আয়েশাঃ তা’ হউক বাছা। তাই বলে আমি প্রতিমাপূজক কাফেরের কোনও কন্যাকে কদাপি ঘরে এন বংশ কলুষিত করবো না।
ফাতেমাঃ “কেন মা! আজকাল ত অনেক মুসলমানই হিন্দুর মেয়ে বিয়ে করছে।” হিন্দুর মেয়ের অসভ্য হলেও, মুসলমান-পরিবারে এসে আদব, কায়দা, লেহাজ, তমিজ, তহ্জিব, আখ্লাক সমস্তই শিখে সভ্য হয়ে যায়।
আয়েশাঃ তা বটে মা! কিন্তু এতে গুরুতর জাতীয় অনিষ্ট হচ্ছে। হিন্দুর নিস্তেজ রক্ত মুসলমানের রক্তে মিশ্রিত হ’য়ে মুসলমানকে ক্রমশঃ হিন্দুর ন্যায় ভীরু, কাপুরুষ, ঐক্যবিহীন, জড়োপাসক নিবীর্য নগণ্য জাতিতে পরিণত করবে।
জননীর বাক্যে ঈসা খাঁর যেন কাঁপিয়া উঠিল। সহসা কুসুমমাল্য-পরিধানোদ্যত ব্যক্তি মাল্যে সর্পের অবস্থিতি দর্শনে যেমন চমকিত হইয়া উঠে, ঈসা কাঁ তেমনি চমকিয়া উঠিলেন। তিনি স্বর্ণময়ীকে মানসপ্রতিমা সাজাইবার জন্য যে কল্পনা করিতেছিলেন, তাহা জননী-মুখ হইতে নির্গত বাক্যের বজ্র-নির্ঘাতে যেন চুরমার হইয়া গেল। ঈসা খাঁ একটু স্থির হইয়া বলিলেন, “আম্মাজান! বাস্তবিকই হিন্দু কন্যার পাণিপীড়ন দোষে ভবিষ্যতে মুসলমানদিগকে অধঃপাতে যেতে হবে মনে হয়।”
আয়েশাঃ বাছা! এতে মুসলমানের এমন অধঃপতন হবে যে, কালে মুসলমান হিন্দুর ন্যায় কাপুরুষ ও ‘গোলামের জাতি’তে পরিণত হবে।
ঈসা খাঁ:তবে কথাটা কেউ তলিয়ে দেখছে না কেন?
আয়েশাঃ দেখবে কে? স্বয়ং বাদশাহ আকবর পর্যন্ত এই পাপে লিপ্ত। হিন্দুকে সন্তুষ্ট করবার জন্য তিনিই এই প্রথা বিশেষরূপে প্রবর্তন করেছেন। তিনি ভাবছেন, এতে হিন্দুরা প্রীত ও মুগ্ধ হ’য়ে বাধিত থাকবে। ফলে কিন্তু বিপরীত ঘাটবে। এতে স্পষ্টই ভারত-সম্রাটের সিংহাসনের উপর হিন্দুদের মাতুলত্বের দাবী প্রতিষ্ঠিত হবে। হিন্দুর সাহস স্পর্ধা দিন দিন বেড়ে যাবে। ভাগিনের সম্রাট হ’লে হিন্দুদের উচ্চ উচ্চ পদ প্রাপ্তি সহজ ও সুলভ হ’য়ে উঠবে। এইরূপে দেশের রাজদন্ড পরিচালনায় হিন্দুর হস্তও নিযুক্ত হবে। অন্যদিকে বংশধরেরা মাতৃরক্তের হীনতাবশতঃ কাপুরুষ, বিলাসী এবং চরিত্রহীন হয়ে পড়বে। আমার মনে হয়, উত্তরকালে এ জন্য ভারতীয় মুসলমানকে বিশেষ কেশ ও লাঞ্জনা ভোগ করতে হবে। এরা ভারতের রাজপতাকা স্বহস্তে রক্ষা করতে পারবে না।
ঈসা খাঁ অনেকক্ষণ দাঁড়াইয়া নীরব রহিলেন। জননীর হিন্দু-কন্যা বিবাহের অনিষ্টকারী মত বিদ্যুৎতের ন্যায় তাঁহার হৃদয়কে স্পর্শ করিল। তিনি মনে মনে বিশেষ সঙ্কট গণিলেন।
ফাতেমাঃ আম্মাজান! তবে আমরা কখনো হিন্দু বউ আনবো না।
আয়েশাঃ কখনও না, ছিঃ!
এই বলিয়া আয়েশা খানম গৃহ হইতে বাহির হইলেন এবং তাঁহার সঙ্গে ফাতেমাও বাহির হইয়া গেল। ঈসা খাঁ একাকী বসিয়া ব্যথিতচিত্তে স্বর্ণময়ীর পত্রের কি উত্তর দিবেন, তাহাই চিন্তা করিতে লাগিলেন। ঈসা খাঁ অর্ধ রাত্রি পর্যন্ত অনেক ভাবিলেন-অনেক চিন্তা করিলেন; কিন্তু সে-ভাবনা, সে-চিন্তা অনন্ত সমুদ্রবক্ষে দিকহারা নৌকার ন্যায় ঘুরিতে লাগিল। স্বর্ণময়ীর প্রেমপত্রখানি শত বারেরও অধিক পড়িলেন। যৌবনে বিদ্যুদ্দীপ্ত-সৌন্দর্য তাঁহার হৃদয়-আকাশে সৌদামিনীর মত চমকাইতে লাগিল। স্বর্ণময়ীর হৃদয়ের প্রবল অনুরাধ ও সম্পূর্ণ আত্মসমর্পণের কথা স্মরণ করিয়া ঈসা খাঁ বড়ই কাতর ও মর্মাহত হইয়া পড়িলেন। তিনি স্পষ্টই বুঝিলেন যে, স্বর্ণকে তিনি প্রেমের বাহুতে জড়াইয়া না ধরিলে, স্বর্ণের জীবন ভস্মে পরিণত হইবে। রায়-নন্দিনীর পরিণাম ভাবিয়া তাহার হৃদয়খানি নিজের হৃদয়ে তুলিয়া লইয়া দেখিলেন, তিনি ব্যতীত স্বর্ণের আর কেহ নাই-কিছু নাই। তিনি ব্যতীত স্বর্ণ বসিয়া, শুইয়া, দাঁড়াইয়া চিন্তা করিলেন-কিন্তু সমস্যার কিছুই মীমাংসা করিতে পারিলেন না। ঈসা খাঁ রায়-নন্দিনীকে যখন মন্দিরে দর্শন করিয়াছিলেন-যখন তাহার সহিত আলাপ করিয়াছিলেন-তখনও স্বর্ণের সৌন্দর্য ও ভাষা তাঁহাকে আনন্দ দান করিয়াছিল। কিন্তু সে আনন্দ তাঁহার হৃদয়ের আকাঙ্খা স্পর্শ করিতে পারে নাই। তিনি ইচ্ছা করিলেই স্বর্ণকে অনায়াসেই বিবাহ করিতে পারিতেন-বারভূঁইয়ার প্রধান ঈসা খাঁ মসনদ আলীকে, কেদার রায় যে পরম আগ্রহে কন্যাদান করিয়া জামাতৃপদে বরণ করিতে কৃতার্থতা জ্ঞান করিবেন, তাহা তিনি বেশ জানিতেন; কিন্তু তখন তাঁহার মানসিক অবস্থা অন্যরূপ ছিল। প্রথমতঃ ঈসা খাঁ নিজের বিবাহ সম্বন্ধে স্থিরসংকল্প হইয়াছিল না; তাহার পর তাঁহার ইচ্ছা ছিল যে, বিবাহ করিলে কোন বীর্যবতী, বীরাঙ্গনাকেই বিবাহ করিবেন! বীরাঙ্গনা বিবাহের খেয়াল ছিল বলিয়াই, স্বর্ণময়ীকে পরম রুপবতী এবং ফুটন্ত-যৌবনা দর্শন করিলেও কদাপি তাঁহাকে বিবাহ করিবার কল্পনাও তাঁহার মস্তিস্কে উদয় হয় নাই। কারণ, হিন্দু-কন্যাতে বীরত্বের আশা নিম্ববৃক্ষে আম্র ফলের আশা সদৃশ। এজন্য স্বর্ণময়ী তাঁহার নেত্রে গগন-শোভন চিত্ত-বিনোদন তারকার ন্যায় ফুটিয়াছিল, হাসিয়াছিল এবং কিরণ বিতরণও করিয়াছিল; কিন্তু তাহাতে তাঁহার চিত্ত-বিকার জন্মাইতে সমর্থ হয় নাই। তারার সৌন্দর্য দেখিয়াই তৃপ্ত হইতে হয়। ছিঁড়িয়া গলে পরিবার কাহারও আকাঙ্খা হয় না। কিন্তু স্বর্ণের প্রাণ দিয়া লেখা প্রাণ-ঢালা প্রেমের সৌন্দর্য-মাখা, আত্মোৎসর্গের অটল বিশ্বাস ও অচল নিষ্ঠাপূর্ণ পত্র পাঠে স্বর্ণময়ীর নাক্ষত্রিক সৌন্দর্য তাঁহার নিকট হইতে ক্রমশঃ লোপ পাইতে লাগিল। তিনি যতই পুনঃ পুনঃ সেই হৃদয়ের লিপি পাঠ করিতে এবং নিজের হৃদয়-মুকরে স্বর্ণের হৃদয়ের ছবি দেখিতে লাগিলেন ততই স্বর্ণময়ী তাঁহার নিকট তারকার পরিবর্তে গোলাপে পরিবর্তিত হইতে লাগিল। অবশেষে স্বর্ণ তাঁহার সম্মুখে মনপ্রাণ-প্রীণন সুরভিপূর্ণ শিশির-সিক্ত, ঊষালোক-প্রস্ফুটিত অতি মনোরম গরিমাপূর্ণ রক্তাভ লোভনীয় বসরাই গোলাপের ন্যায় প্রতিভাত হইল। তখন তিনিও উহাকে আদর করিয়া বুকে তুলিয়া লইতে প্রস্তুত হইলেন। কিন্ত হায়! ঠিক এমন সময়েই তাঁহার জননী উদ্যানের প্রবেশদ্বার বন্ধ করিয়া দিলেন। তিনি ইচ্ছা করিলে, সামান্য বল প্রয়োগেই এ-দ্বার উন্মোচন করিতে পারিতেন। কিন্তু জননীর হিন্দু রমণী বিবাহের যুক্তির সারবত্তায় এবং বচনের ওজস্বিতায় ঈসা খাঁর উদ্দাম হৃদয়ের প্রেম-প্রবাহ, হযরত দায়ুদের সঙ্গীত শ্রবণে তরঙ্গময়ী স্রোতস্বিনীয় ন্যায় স্তম্ভিত হইয়া পড়িল।
ঈসা খাঁ চিন্তা করিয়া দেখিলেন, রায়-নন্দিনীর প্রেমের নিমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করাও যা, আর স্বর্ণময়ীর কোমল তরল প্রেমপূরিত-বক্ষে শাণিত বিষদগ্ধ ছুরিকা প্রবিষ্ট করিয়া হৃৎপিণ্ড খণ্ড খণ্ড করাও তাই। সুতরাং ঈসা খাঁ স্বর্ণের হৃদয়-দানের প্রত্যাখ্যানের কল্পনা করিতেও শিহরিয়া উঠিতেছিলেন। তাঁহার বীর-হৃদয়ও এমনি করিয়া প্রেমের নিকটে কুণ্ঠিত এবং লুণ্ঠিত হইয়া পড়ে। প্রেমের কি অপরাজেয় বিশ্ব-বিজয়িনী শক্তি! ক্ষুদ্র কীট হইতে বিশ্বস্রষ্টা অনন্তপুরুষ পর্যন্ত প্রেমের বন্ধনে আবদ্ধ। প্রেমের শাসন কি কঠিন শাসন! প্রেমের আকর্ষণ কি মোহনীয়! আজি যুবতী-প্রেমের মদিরাকর্ষণে ঈসা খাঁ প্রশান্ত চিত্তও নিশাপতি সুধাংশুর কৌমুদী-আকর্ষণে সমুদ্রের ন্যায় উচ্ছ্বসিত হইয়া উঠিয়াছ। অন্যদিকে জননী-প্রেমের কঠিন শাসনে সেই উচ্ছ্বসিত সিন্ধু উদ্বেলিত হইয়াও, আকাঙ্খিত ক্ষেত্রে তরঙ্গ-বাহু বিস্তার করিতে পারিতেছে না। বেলাভূমি অতিক্রম করিবার সাধ্য নাই, উহা জননী-প্রেমের কঠিন ও অভঙ্গুর পর্বতপ্রাচীরে পরিবেষ্টিত। ঈসা খাঁ অনেক গবেষণার পর বুঝিতে পারিলেন যে, জননীকে অবশেষে নিখিল-শরণ মঙ্গল-কারল বিশ্ব-বিধাতার বিপদভঞ্জন চরণে আশ্রয় লইয়া চঞ্চল চিত্ত কতকটা স্থির করিলেন। তৎপর স্বর্ণ-খচিত ‘খাস-কাগজে’ কস্তুরী-গন্ধ-বাসিত স্বর্ণ-কালিতে স্বর্ণময়ীকে লিখিলেনঃ
প্রিয়তমে!
আমার অনন্ত স্নেহাশীর্বাদ, প্রগাঢ় প্রেমানুরাগ এবং মঙ্গল-কামনা জানিবে। তোমার প্রাণ-ঢালা পত্র পাঠে তোমার হৃদয় করামলকবৎ প্রত্যক্ষ করিতেছি। হে মানসসুন্দরী! বিশ্ব প্রহলাদিনী পুস্প-কুন্তলা হৈম-কিরীটিনী ঊষা যেন তাহার গোলাপী করের বিচিত্র তুলিকায় অম্বরমন্ডল বিচিত্র বর্ণানুরঞ্জিত জলদকদম্বে বিভূষিত এবং সমুজ্জ্বল করে, তেমনি, হে আমার হৃদয়-সরোবরের স্বর্ণ-সরোজিনি! তোমার নির্মল স্বর্গীয় প্রেমের বিশ্ব-বিনোদন-কিরণে এ-হৃদয় সুশোভিত এবং পুলকিত হইয়াছে। তোমার বীণা-বাণী-নিন্দিত প্রেম-গুঞ্জরণে হৃদয়-কুসুম-যাহা মুকুলিত ছিল, তাহা প্রস্ফুটিত হইয়াছে।
প্রিয়তমা স্বর্ণময়ী!
অনেকদিন হইতেই তোমাকে স্বর্ণময়ী মূর্তির ন্যায় ভালোবেসেছিলাম। আজ সে স্বর্ণময়ী মূর্তি জীবন্ত ও সরস প্রেমময়ী, প্রীতিময়ী, কল্যাণময়ী অমৃত প্রতিমায় পরিণত। সুতরাং সে মূর্তিকে ধারণ করিয়া হৃদয়ে তুলিয়া লইতে যে আনন্দ ও উল্লাস, তাহা কেবল অনুমেয়। আমি অযোগ্য হইলেও, তুমি যে হৃদয় দান করিয়াছ তাহা সম্পূর্ণ হৃদয়ের সহিত ধারণ করিয়া পরমানন্দ লাভ করিলাম। অয়ি মনোরমে! যে হৃদয় শীতের তুষার সস্পাতে সঙ্কুচিত এবং আপনার মধ্যে আপনি লুক্কায়িত ছিল, তাহা আজ তোমার মৃত-সঞ্জীবনী প্রেম-মলয়া-স্পর্শে প্রসূনপুঞ্জ-মণ্ডিত, কোকিল-কুঞ্জন-কুহরিত, নবশস্পদল শোভিত স্বর্গ-শ্রী-বিমণ্ডিত বাসন্তী-উদ্যানে পরিণত হইয়াছে।
অয়ি হৃদয়ময়ী!
আজ হৃদয়ের প্রতি চক্ষু তোমার মোহিনী মূর্তি ধ্যানে নিমিলিত। প্রতি কর্ণ তোমার অমৃত-নিস্যন্দিনী জীবন-সঞ্চারিণী বাণী শ্রবণে উৎকর্ণ। প্রতি নাসারন্ধ তোমার কস্তুরী বিনিন্দিত সুরভি গ্রহণে প্রমোদিত। প্রতি চরণ তোমার প্রেমের কুসুমাস্তৃত-পথে প্রধাবিত। প্রতি বাহুলতিকা তোমার প্রেমালিঙ্গনে প্রসারিত। প্রতি অণুপরমাণু তোমার দিকে উন্মুখ।
অয়ি কল্যাণী!
এক্ষণে কল্যাণ প্রভু পরমেশ্বরের কল্যাণ-বারির জন্য প্রতীক্ষা কর। বসন্ত উপস্থিত হইলেও কল্যাণ-বারি বর্ষণ হয় না। বারি-বর্ষণের জন্য, কষ্টকর হইলেও কিঞ্চিৎ নিদাঘ-জ্বালা সহ্য করিতে হয়। হে সুন্দরী! নৌকা সম্পূর্ণরূপে প্রস্তুত ও সজ্জিত হইলেই ‘মরকত দ্বীপে’ অভিযান করিতে পারে না। অনুকূল বায়ু-প্রবাহের জন্য অপো করিতে হয়। হে মানসি! উপস্থিত তোমাকে সম্পূর্ণ হৃদয়ের সহিত গ্রহণ করিলাম, প্রকাশ্যে অভ্যর্থনা অভিনন্দন করিতে কিঞ্চিৎ বাধা আছে। সে-বাধা করুণাময়ের আর্শীবাদে শীঘ্রই দূরীভূত হইবে বলিয়া আশা করি। তজ্জন্য আমাদের অধীর বা নিরাশ হইবার কিছুই নাই। পিপাসা বাড়িতে থাকুক, শেষে উহা অমৃতপানে পরশ তৃপ্তিলাভ করিবে।
সম্মুখে মহররমোৎসবে তোমার সহিত দেখা করিবার জন্য ব্যগ্র রহিলাম।
ইতি-
তোমারই
ঈসা
খিজিরপুর-আসাদ-মঞ্জিল।
পত্র শেষ করিয়া ঈসা খাঁ পুনরায় পত্রের এক কোণে বিশেষ করিয়া লিখিলেনঃ
“হে প্রেমময়ি! ব্যায়াম-চর্চা এবং অস্ত্র-সঞ্চালনে পটুতা লাভ করিতে বিশেষ যত্ন করিবে, ঐ পটুতাই সেই বাধা দূরীকরণে বিশেষ সহায় হইবে।”
অনন্তর পত্রখানি একটি বহুমূল্য আতরের শিশির সহিত ক্ষুদ্র রৌপ্যবাক্সে বন্ধ করিয়া রেশমী রুমালে বাঁধিয়া শিবনাথের হস্তে সমর্পণ করিলেন। শিবনাথকে এক জোড়া উৎকৃষ্ট ধুতি, চাদর এবং একটি সুবর্ণ মুদ্রা বখশিস দিলেন।