॥ ৫ ॥
বোলপুর থেকে ২৫ মাইল দূরে আড়াই শো বছর আগে বর্ধমানের এক মহারানির তৈরি রাধাবিনোদের টেরা কোটা মন্দির ঘিরে চলেছে কেন্দুলীর বিরাট মেলা। মেলা বলতে যা বোঝায় তার সবই এখানে আছে। দক্ষিণ দিয়ে বয়ে চলেছে অজয় নদী।
আমরা আমাদের গাড়িতেই এসেছি সকলে; সেটা সম্ভব হয়েছে ফেলুদা গাড়ি চালানোর ফলে। আমরা তিনজন সামনে আর পিছনে পিটার, টম ও জগন্নাথ চাটুজ্যে।
মেলার এক পাশে একটা বিরাট বটগাছের তলায় বাউলরা জমায়েত হয়েছে। তাদের মধ্যে একজন আবার একতারা আর ডুগডুগি নিয়ে নেচে নেচে গান গাইছে—
আমি অচল পয়সা হলাম রে ভবের বাজারে
তাই ঘৃণা করে ছোঁয় না আমায় রসিক দোকানদারে⋯
জগন্নাথবাবু এদিকে পিটারকে মন্দিরের গায়ের কারুকার্য বোঝাচ্ছে। আমিও কাছে গিয়ে অবাক হয়ে দেখলাম যে রামায়ণ-মহাভারতের অনেক দৃশ্য মন্দিরের গায়ে খোদাই করা রয়েছে।
টম একটু আগেও আমাদের পাশেই ছিল, এখন জানি না কোথায় চলে গেছে।
একটা সুযোগ পেয়ে ফেলুদা পিটারকে নিজের কাছে ডেকে নিয়ে একটা প্রশ্ন করল, যেটা আমার মাথায়ও ঘুরছিল।
‘তোমাদের দু’জনের বন্ধুত্বে কি একটু চিড় ধরেছে? টমের কথাবার্তা হাবভাব কাল থেকেই আমার ভালো লাগছে না। তুমি ওর উপর কতখানি বিশ্বাস রাখ?’
পিটার বলল, ‘আমরা একই স্কুলে একই কলেজে পড়েছি। ওর সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব বাইশ বছরের। কিন্তু ভারতবর্ষে আসার পর থেকে ওকে যেমন দেখছি তেমন আর আগে কখনো দেখিনি। ওর মধ্যে কতকগুলো পরিবর্তন দেখছি। এক এক সময় মনে হয় ওর ধারণা বৃটিশরা এখনো বুঝি ভারতীয়দের শাসন করে। তাছাড়া ওদেশে থাকতে রুবিটা ভারতবর্ষে ফেরত দেবার ব্যাপারে ও কোনো আপত্তি করেনি। এখন মনে হচ্ছে ওটা বিক্রি করতে পারলে ও আরো খুশি হয়।’
‘ওর কি খুব টাকার দরকার?’
‘ও সারা পৃথিবী ঘুরে ছবি তুলতে চায়—বিশেষ করে যেসব দেশে দারিদ্র্যের চেহারাটা খুব প্রকট। এতে যা খরচ হবে সে টাকা ওর কাছে নেই। তবে রুবিটা বিক্রি করলে যা টাকা পাওয়া যাবে তাতে আমাদের দুজনের খরচ কুলিয়ে যাবে।’
‘ও যদি তোমাকে না জানিয়ে পাথরটা পাচার করে?’
‘সেরকম বিশ্বাসঘাতকতা ও করবে বলে মনে হয় না। আমি ওকে মাঝে মাঝে শাসন করতে শুরু করেছি। মনে হয় তাতে কাজ দেবে।’
ফেলুদা এদিক ওদিক দেখে বলল, ‘ও কোথায় গেছে বলতে পার?’
‘তা ত জানি না। আমাকে বলে যায়নি।’
‘আমার একটা সন্দেহ হচ্ছে।’
‘কী?’
‘দক্ষিণ দিকে নদীর পাড় থেকে ধোঁয়া উঠছে দেখে বুঝতে পারছি ওখানে শ্মশান আছে। ও আবার তার ছবি তুলতে যায়নি ত? একবার গিয়ে দেখা দরকার।’
লালমোহনবাবু কাছেই একটা দোকানের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। আমরা তাঁকে ডেকে নিয়ে ধোঁয়ার দিকে রওনা দিলাম।
বাউলের দল পেরিয়ে নদীর পাড়। সেখান থেকে জমিটা ঢালু হয়ে গিয়ে জলে মিশেছে।
ওই যে শ্মশান। একটা মড়া পুড়ছে, আরেকটা চিতায় শুইয়ে তার উপর কাঠ চাপানো হচ্ছে।
‘ওই ত টম! পিটার চেঁচিয়ে উঠল।
আমিও দেখলাম টমকে। সে ক্যামেরা হাতে যে মড়াটায় কাঠ চাপানো হচ্ছিল তার ছবি তোলার তোড়জোড় করছে।
‘হি ইজ ডুইং সামথিং ভেরি ফুলিশ’, বলল ফেলুদা ।
কথাটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই সেটা যে সত্যি সেটা প্রমাণ হয়ে গেল। মড়ার কাছেই গোটা চারেক মাস্তান টাইপের ছেলে বসেছিল। টম সবে ক্যামেরাটা চোখের সামনে ধরেছে আর সেই সময় একটা মাস্তান টমের দিকে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে ক্যামেরাটায় মারল একটা চাপড়, আর যন্ত্রটা টমের হাত থেকে ছিটকে গিয়ে বালির ওপর পড়ল।
আর টম? সে বিদ্যুদ্বেগে তার ডান হাত দিয়ে মাস্তানের নাকে মারল এক ঘুঁষি। মাস্তানটা হাত দিয়ে মুখ চেপে মাটিতে বসে পড়ল। হাত সরাতে দেখি ওর নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে।
ফেলুদা আর এক মুহুর্ত অপেক্ষা না করে ঊর্ধ্বশ্বাসে গিয়ে মাস্তানদের সামনে হাত তুলে দাঁড়াল, তার পিছনেই টম।
ফেলুদা এবার মুখ খুলল। যতটা সম্ভব নরম করে সে কথাগুলো বলল।
‘আপনারা এইবারের মতো এই সাহেবকে মাপ করে দিন। উনি নতুন এসেছেন, কোথায় কী করতে হয় না-হয় সে বিষয়ে এখনো ধারণা নেই। মৃতদেহের ছবি তুলে উনি খুবই অন্যায় কাজ করেছেন। সেটা আমি ওঁকে বুঝিয়ে বলছি। আপনারা এইবারের মতো ওঁকে মাপ করে দিন।
অবাক হয়ে দেখলাম একজন মাস্তান এগিয়ে এসে ঢিপ করে ফেলুদাকে একটা প্রণাম করে বলল, ‘আপনি স্যার ফেলুদা নন? একেবারে সেই মুখ, সেই ফিগার!’
‘হ্যাঁ। আমি স্বীকার করছি আমি ফেলু মিত্তির। এই সাহেব আমাদের বন্ধু। আপনারা দয়া করে এঁকে রেহাই দিন।
‘ঠিক আছে স্যার, ঠিক আছে’, কেমন যেন মন্ত্রমুগ্ধের মতো বলল মাস্তানের দল। আমি বুঝলাম ফেলুদাকে চিনে ফেললে ফল যে সব সময় খারাপ হয় তা মোটেই না।
কিন্তু যে মাস্তান ঘুঁষি খেয়েছিল সে এ পর্যন্ত কথা বলেনি, এবার বলল—‘আমি এর বদলা নেব, মনে রেখো সাহেব— চাঁদু মল্লিকের কথা নড়চড় হয় না।’
আমরা ফিরতি পথ ধরলাম। বালির উপর পড়াতে টমের ক্যামেরার কোনো ক্ষতি হয়নি। তবে ও দেখলাম বেশ হকচকিয়ে গেছে। আশা করি এবার থেকে ও একটু সাবধান হবে।
আমাদের মেলা দেখার শখ মিটে গিয়েছিল, তাই আমরা বোলপুরমুখো রওনা দিলাম।
বোলপুরে ফিরে লাঞ্চ খেয়ে লাউঞ্জে এসে বসতেই দেখি চৌবে হাজির।
‘আপনাদের খবর নিতে এলাম’, বললেন চৌবে। পুলিশের চোখ, তাই বললেন, ‘দেখে মনে হচ্ছে কোথাও যেন একটা গোলমাল হয়েছে?’
‘বিস্তর গোলমাল’, বলল ফেলুদা। তারপর শ্মশানের ঘটনাটা বর্ণনা করে বলল, ‘চাঁদু মল্লিক নামটা কি চেনা চেনা মনে হচ্ছে?’
‘বিলক্ষণ চেনা’, বললেন চৌবে। হেতমপুরে থাকে, নাম-করা গুণ্ডা। বার তিনেক জেলেও গেছে। ও যদি বদলা নেবার কথা বলে থাকে ত সেটা হেসে উড়িয়ে দেওয়া চলবে না।’
ইতিমধ্যে টম ঘরে চলে গিয়েছিল। পিটার বসেছিল আমাদের সঙ্গে। চৌবে ইংরিজিতে বললেন, শুধু একটিমাত্র লোক এই অবস্থার পরিবর্তন ঘটাতে পারেন। তিনি হলেন পিটার রবার্টসন। মিঃ রবার্টসন— প্লীজ কনট্রোল ইওর ফ্রেন্ড’স টেমপার। ভারতবর্ষ পঁয়তাল্লিশ বছর হল স্বাধীন হয়েছে। তাদের প্রাক্তন মনিবদের কাছ থেকে এরকম ব্যবহার আজ আর কোনো ভারতীয় বরদাস্ত করতে পারবে না।’
‘সেটা তুমিই ওকে বল’, বলল পিটার। ‘আমার মাথায় সমস্ত ওলট-পালট হয়ে গেছে। আমি এই টমকে আর চিনি না। তার সঙ্গে কথা বলতে হয় তুমি বল। বলে যদি কিছু ফল হয় তাহলে আমাদের এখানে আসাটা সার্থক হবে।’
‘ঠিক আছে। আমিই বলছি। কিন্তু পাথরটা কি আপনার বন্ধুর কাছেই থাকবে? সেটা কি আপনার নিজের জিম্মায় রাখা চলে না?’
‘আমার অসম্ভব ভুলো মন, জানেন মিঃ চৌবে। পাথরটা মনে হয় ওর কাছেই নিরাপদে আছে। আর ও যদি পাথরটাকে পাচার করতে চায় তাহলে সেটা ও আমাকে না জানিয়ে করবে বলে মনে হয় না।’
আমরা উঠে পড়লাম। সবাই মিলে গিয়ে ঢুকলাম দশ নম্বর ঘরে।
একটা চেয়ারে মাথা নীচু করে বসে আছে টম ম্যাক্সওয়েল, তার ঠোঁট থেকে ঝুলছে একটা আধ-খাওয়া সিগারেট। ঘরের দরজা খোলাই ছিল, আমরা ঢুকতে সে মুখ তুলে চাইল, কিন্তু উঠে দাঁড়াল না। মিঃ চৌবে গিয়ে তার পাশের চেয়ারটায় বসলেন, আমরা বাকি ক’জন দু’ খাটে ভাগাভাগি করে বসলাম।
‘আর ইউ ট্রাইং টু পুট প্রেশার অন মি?’ জিজ্ঞেস করল টম ম্যাক্সওয়েল।
‘নো’, বললেন চৌবে, ‘উই হ্যাভ নট কাম টু প্লীড উইথ ইউ। তোমাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ জানাতে এসেছি।’
‘কী অনুরোধ?’
‘ভারতীয়দের প্রতি তোমার যতই বিদ্বেষ থাক না কেন, সেটা বাইরে প্রকাশ কোর না।’
‘আমি ত তোমার কথা মতো চলব না। আমার নিজের বিচারবুদ্ধি যা বলে আমি তাই করব। আমি এই দুই দিনেই দেখতে পাচ্ছি তোমাদের দেশ কোথায় পিছিয়ে পড়ে আছে। এই পঁয়তাল্লিশ বছরে তোমরা এক চুলও অগ্রসর হওনি। এখনো তোমরা হাল বলদ দিয়ে চাষ করো, কলকাতার মতো শহরে মানুষ দিয়ে রিকশা টানাও, ফুটপাথে লোকে শুয়ে থাকে সপরিবারে—এসব কি সভ্যতার লক্ষণ? তোমরা এসব গোপন রাখতে চাও বিশ্বের লোকেদের কাছ থেকে। আমি তা মানব না। আমি ছবি তুলে দেখিয়ে দেব স্বাধীন ভারতবর্ষের আসল চেহারা।’
‘শুধু এই ক’টা দিক দেখলে চলবে না, টম ম্যাক্সওয়েল। অন্য কত দিকে আমাদের দেশ এগিয়েছে সেটা তুমি দেখবে না? আমরা মহাকাশে যান পাঠিয়েছি। আমাদের দেশে দৈনিক ব্যবহারের কতরকম জিনিস তৈরি হয়েছে সেটা তুমি নিশ্চয়ই দেখেছ? জামা-কাপড়, ওষুধপত্র, প্রসাধনের জিনিস, ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি—কোনটা না তৈরি হচ্ছে ভারতবর্ষে! শুধু অভাবটাই তুমি দেখবে? তোমাদের দেশে কি নিন্দনীয় কিছু নেই?’
‘দুটোর তুলনা কোর না। ইন্ডিয়ার স্বাধীনতা একটা ভাঁওতা। সেটা আমি আমার ক্যামেরা দিয়ে প্রমাণ করতে চাই। আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে আমাদের পূর্বপুরুষেরা তোমাদের উপর যেমন কর্তৃত্ব করে এসেছে, এখনো সেটার দরকার। না হলে এ দেশের কোনো উন্নতি হবে না। মাই গ্রেট গ্রেট গ্র্যান্ডফাদার ওয়জ রাইট।’
‘মানে?’
‘তিনি ছিলেন নীল কুঠির মালিক। হি কিক্ড ওয়ন অফ হিজ সার্ভেন্টস টু ডেথ।’
‘সে কি!’
‘ইয়েস স্যার! হিজ পাংখা-পুলার। এখন ত তবু শীতকাল, গরমে তোমাদের দেশের আবহাওয়া কী বীভৎস হয় তা আমি শুনেছি। সেই গরমকালে রাত্রে আমার পূর্বপুরুষ রেজিন্যাল্ড ম্যাক্সওয়েল ঘুমোচ্ছিলেন তাঁর বাংলোয়। পাংখাওয়ালা পাংখা টানছিল। টানতে টানতে সে ঘুমিয়ে পড়ে। ঘাম এবং অজস্র মশার কামড়ের চোটে রেজিন্যাল্ড ম্যাক্সওয়েলের ঘুম ভেঙে যায়। তিনি আন্দাজ করেন ব্যাপারটা কী। বাইরে এসে দেখেন পাংখাপুলার মুখ হাঁ করে ঘুমোচ্ছে। রেজিন্যাল্ড প্রচণ্ড রাগে তার চাকরের পেটে ক’ষে লাথি মারতে থাকেন। তাতে চাকরের ঘুম চিরনিদ্রায় পরিণত হয়। এই হচ্ছে রাইট ট্রিটমেন্ট। তোমরা কি বিশ্রীভাবে মড়া পোড়াও আজ তার ছবি তুলতে গিয়েছিলাম। এ দৃশ্য আমাদের দেশে কেউ দেখেনি—আমি তাদের দেখাতে চেয়েছিলাম। তবে স্থানীয় কয়েকজন হুডলামস্ আমাকে শাসাতে আসে। আমি ঘুঁষি মেরে তাদের একজনের নাক ফাটিয়ে দিই। হি ডিজার্ভড্ ইট। এ ব্যাপারে আমার বিন্দুমাত্র আপসোস নেই।’
চৌবে একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, ‘মিস্টার ম্যাক্সওয়েল, আমি শুধু এইটুকুই বলতে চাই যে দ্য সুনার ইউ লীভ আওয়ার কান্ট্রি দ্য বেটার। তুমি থাকলে শুধু দেশের অমঙ্গল নয়, তোমার নিজেরও যে অমঙ্গল হতে পারে সেটা আশা করি বুঝতে পেরেছ।’
‘আমি এ দেশে এসেছি ছবি তুলতে। সে কাজ শেষ করে তবে আমি ফিরব।’
‘তোমাদের আসার আসল উদ্দেশ্য ত হল রবার্টসনের রুবিটা ফেরত দেওয়া।’
‘সেটা পিটারের উদ্দেশ্য—অ্যান্ড আই থিঙ্ক হি ইজ বীইং ভেরি স্টুপিড। ও যদি পাথরটা বেচে দেয় তাহলে আমি আরো অনেক বেশি খুশি হব।’