রাণাঘাট হইতে বাহির হইয়া হাজারি হাঁটাপথে চাকদার দিকে রওনা হইল। প্রথমে ডাকঘর হইতে বাড়ীতে দু’টি টাকা মনিঅর্ডার পাঠাইবার ইচ্ছা ছিল কিন্তু ডাকঘরে গিয়া দেখিল মনিঅর্ডার নেওয়া বন্ধ হইয়া গিয়াছে।
ডাকঘর খোলা না থাকার জন্য পরে হাজারি ভগবানকে ধন্যবাদ দিয়াছিল। চাকদা যাইবার মাঝপথে সেগুন-বাগানের মধ্যে সন্ধ্যার অন্ধকার নামিল। একটা সেগুন গাছের তলায় দু’খানি গরুর গাড়ী দাঁড়াইয়া আছে। লোকজন নামিয়া গাছতলায় রান্না চড়াইয়াছে। হাজারি জিজ্ঞাসা করিয়া জানিল, সম্মুখের পূর্ণিমায় কালীগঞ্জে গঙ্গাস্নানের মেলা উপলক্ষ্যে উহারা মেলায় দোকান করিতে যাইতেছে। হাজারি তাহাদের সঙ্গ লইল।
রাত্রে আহারাদির পরে সবাই গাছতলায় শুইয়া রাত্রি কাটাইল–দোকানের মালিকের নাম প্রিয়নাথ ধর, জাতিতে সুবর্ণ বণিক, মনোহারি দোকান লইয়া ইহারা মেলায় যাইতেছে। হাজারির পরিচয় পাইয়া ধর মহাশয় প্রস্তাব করিল মেলায় কয়দিন তাহারা কেনাবেচা লইয়া ব্যস্ত থাকিবে এই কয়দিন হাজারি যদি রান্না করিয়া সকলকে খাওয়ায়–তবে সে দৈনিক খোরাকি ও মেলা অন্তে কয়দিনের মজুরি স্বরূপ দুই টাকা পাইবে।
প্রিয়নাথ ধরের দোকান তিনখানি–একখানি তার নিজের, অপর দুইখানি তাহার জামাই ও ভ্রাতৃপুত্রের। কম মাহিনায় যে ওস্তাদ রাঁধুনী পাইয়াছে, হাজারির প্রথম দিনের রন্ধনেই তাহা সপ্রমাণ হইয়া গেল। সকলেই খুব খুশি।
মেলায় পৌঁছিয়া কিন্তু হাজারি দেখিল, রান্নার চেয়েও অধিকতর লাভের একটি ব্যবসা এই মেলাতেই তাহার অন্য অপেক্ষা করিয়া আছে। সে জিনিসপত্র কিনিয়া আনিয়া তেলেভাজা কচুরি সিঙ্গাড়ার দোকান খুলিয়া বসিল ধর মহাশয়দের বাসার একপাশে। বিনামূল্যে কচুরি খাইবার লোভে ধর মহাশয় কোন আপত্তি করিলেন না।
কয়দিন দোকানে অসম্ভব রকমের বিক্রি হইল। মূলধন ছিল আগের সেই দুই টাকা– শেষে খরিদ্দারের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়াতে হাজারি ধর মহাশয়ের তহবিল হইতে কয়েকটি টাকা ধার লইল।
চতুর্থ দিনের সন্ধ্যাবেলা দোকানপাট উঠানো হইল। মেলা শেষ হইয়া গিয়াছে। ধর মহাশয়ের তহবিলের দেনা শোধ করিয়া ও সকল প্রকার খরচ বাদ দিয়া হাজারি দেখিল সাড়ে তেরো টাকা লাভ দাঁড়াইয়াছে। ইহার উপর ধর মহাশয়ের রান্নার মজুরি দুই টাকা লইয়া মোট হইল সাড়ে পনের টাকা।
প্রিয়নাথ ধর বলিলেন–ঠাকুর মশায়, আপনার রান্না যে এত চমৎকার, তা যখন আপনাকে সেগুন বাগানে প্রথম কাজে লাগালুম, তখন ভাবি নি। আমি বড়লোক নই, বাড়ীতে মেয়েরাই রাঁধে, না হোলে আপনাকে আমি ছাড়তুম না কিছুতেই।
বাড়ীতে দশটি টাকা পাঠাইয়া দিয়া হাজারির মন খানিকটা সুস্থ হইল। এখন সংসারের ভাবনা সম্বন্ধে মাসখানেকের মত নিশ্চিন্ত থাকিতে পারে সে। এই এক মাসের মধ্যে নতুন কিছু অবশ্যই জুটিয়া যাইবে।
কালীগঞ্জ হইতে যশোর যাইবার পাকা রাস্তা বাহিয়া হাজারি আবার পথ চলিল। এই পথের দুধারে বনজঙ্গল বড় বেশী–পূৰ্বে গ্রাম ছিল, ম্যালেরিয়ার অত্যাচারে বহু গ্রাম জন-শূন্য হইয়া যাওয়াতে অনাবাদী মাঠ ও বিধ্বস্ত পুরাতন গ্রামগুলি বনে-জঙ্গলে ছাইয়া ফেলিয়াছে।
সকালবেলা কালীগঞ্জ হইতে রওনা হইয়াছে, যখন দুপুর উত্তীর্ণ হয়-হয়, তখন একটা প্রাচীন তেঁতুলগাছের ছায়ায় সে আশ্রয় লইল। অল্প দূরে একখানা ক্ষুদ্র চাষাদের গ্রাম। একটি ছোট ছেলে গরু তাড়াইয়া লইয়া যাইতেছে, তাহাকে জিজ্ঞাসা করিয়া জানিল গ্রামখানার নাম নতুন পাড়া। বেশীর ভাগ গোয়ালাদের বাস।
হাজারি গ্রামের মধ্যে ঢুকিয়া প্রথমেই যে খড়ের বড় অটচালা ঘরখানা দেখিল তাহার উঠানে গিয়া দাঁড়াইল।
বাড়ীর মালিক কাহাকেও দেখিল না। একদিকে বড় গোয়াল, অনেকগুলি বলদ গরু বিচালির জাব খাইতেছে।
একটি ছোট মেয়ে বাহির হইয়া উঠানে দাঁড়াইল। হাজারি তাহাকে ডাকিয়া বলিল–খুকী শোনো-বাড়ীতে কে আছে? মেয়েটি ভয় পাইয়া কোনো উত্তর না দিয়াই বাড়ীর ভিতর ঢুকিল।
প্রায় আধঘণ্টা অপেক্ষা করিবার পরে বাড়ীর মালিক আসিল। তাহার নাম শ্রীচরণ ঘোষ। হাজারিকে সে খুব খাতির করিয়া বসাইল, দুপুর গড়াইয়া গিয়াছে–সুতরাং রান্না-খাওয়া করিতে বলিল। বাড়ীর ভিতর হইতে একখানা জলচৌকি ও এক বালতি জল আনিয়া সামনে রাখিয়া দিল।
ইহারাও গোয়ালঘরের একপাশে রান্নার যোগাড় করিয়া দিয়াছিল। সেখানে বসিয়া রাঁধিতে রাঁধিতে হঠাৎ তাহার মনে পড়িল কুসুমের কথা। কুসুমও তাহাকে সেদিন গোইয়ল ঘরেই রাঁধিবার আয়োজন করিয়া দিয়াছিল–কুসুমও গোয়ালার মেয়ে।
বোধ হয় সেই জন্যই–ইহারা গোয়ালা শুনিয়াই–হাজারি ইহাদের বাড়ী আসিয়াছিল–মনের মধ্যে কোন গোপন আকর্ষণ তাহাকে এখানে টানিয়া আনিয়াছিল। হঠাৎ সে আশ্চৰ্য্য হইয়া গোয়ালঘরের দরজার দিকে চাহিল।
একটি অল্পবয়সী বৌ আধঘোমটা দিয়া গোয়ালঘরে ঢুকিয়া এক চুবড়ি শাক লইয়া লাজুক ভাবে দাঁড়াইয়া ইতস্ততঃ করিতেছে। শাকগুলি সদ্য জল হইতে ধুইয়া আনা–চুবড়ি দিয়া জল ঝরিয়া গোয়ালঘরের মাটির মেঝে ভিজাইয়া দিতেছে। হাজারি ব্যস্ত হইয়া বলিল–এস মা এস-–কি ওতে?
বউটি লাজুক মুখে একটু হাসিয়া বলিল–চাঁপানটে শাক। এখানে রাখি?
বউটি কুসুমের অপেক্ষাও বয়সে ছোট। হঠাৎ একটা অকারণ স্নেহে হাজারির মন ভরিয়া উঠিল। সে বলিল–রাখো মা রাখো–
খানিকটা পরে বউটি আবার ঘরের মধ্যে গোটাকতক কাঁঠাল-বীচি লইয়া ঢুকিল। এবার সে যেন অনেকটা নিঃসঙ্কোচ, পিতার বয়সী এই শান্ত, প্রৌঢ় ব্রাহ্মণের নিকট সঙ্কোচ করিতে তাহার বাধিতেছিল হয়তো।
হাজারিকে বলি–কাঁঠাল-বীচি খান?
–খাই মা, কিন্তু ওগুলো কুটে দেবে? আমি ডাল চড়িয়েচি, আবার কুটি কখন?
বউটি এক পাথরের বাটিতে কাঁঠাল-বীচি আনিয়াছিল। বাটিটা নামাইয়া ছুটিয়া গিয়া একখানা বঁটি লইয়া আসিল এবং বীচিগুলি কুটিতে আরম্ভ করিল। হাজারির মন তৃষিত ছিল, ইহারা সবাই মেয়ের মত, সবাই ভালবাসে, সেবা করে, মনের দুঃখ বোঝে।
হাজারি কোন কথা বলিবার আগেই বউটি বলিল–আপনার গাঁয়ে আমি কত গিইচি।
হাজারি অবাক হইয়া বলিল–আমার গাঁ কোথায় তুমি কি করে জানলে? তুমি সেখানে কি করে গেলে?
–-গঙ্গাধর ঘোয আমার পিসেমশাই—
–ওহো–তুমি জীবনের ভাইঝি! তা হলে কুসুমকে তো চেনো–
–কুসুমদিদিকে তার বিয়ের আগে অনেকবার দেখেছি, বিয়ের পরে আর কখনও দেখি নি। সে আজকাল কোথায় থাকে জানেন নাকি?
–সে থাকে রাণাঘাটে শ্বশুরবাড়ীতে। তবে তোমাকে মা বলে খুব ভাল করেচি, কুসুম আমার মেয়ে।
বউটি বীচি কোটা বন্ধ রাখিয়া গলায় আঁচল জড়াইয়া দূর হইতেই প্রণাম করিল।
–এসো মা চিরজীবী হও, সাবিত্রী সমান হও।
বউটি হাসিয়া বলিল–আপনি যখন উঠোনে দাঁড়িয়ে, তখনই আপনাকে দেখে আমি চিনেছি। আমি শাশুড়ীকে গিয়ে বল্লাম আমার পিসিমার গাঁয়ের মানুষ উনি–তখন শাশুড়ী গিয়ে শ্বশুরকে জানালেন।
–বেশ মা বেশ। আসবো যাবো, আমার আর একটি মেয়ে হোল, তার সঙ্গে দেখাশুনা করে যাবে। ভালই হোল।
বউটি সলজ্জভাবে বলিল–আজ কিন্তু আপনাকে যেতে দেবো না–থাকতে হবে এখন এখানে
–না মা, আমার থাকা হবে না।
–না তা হবে না। যান দিকি কেমন করে যাবেন? আমি জোর করতে পারিনে বুঝি?
–অবিশ্যি পারো মা, কিন্তু আমার মনে শান্তি নেই, আবার সুদিন পেলে এসে দু’দিন থেকে যাবো–
বউটি হাজারির মুখের দিকে চাহিয়া বলিল–কেন, কি হয়েছে আপনার?
হাজারির স্বভাবদুৰ্বল মন, সহানুভূতির গন্ধ পাইয়া গলিয়া গেল। সে তাহার চাকুরি যাওয়ার আনুপূর্বিক ইতিহাস সংক্ষেপে বর্ণনা করিয়া গেল–ডাল নামাইয়া চচ্চড়ি রাঁধিবার ফাঁকে ফাঁকে। একটু গর্ব করিবার লোভও সম্বরণ করিতে পারিল না।
–রান্না যা করতে পারি মা, তোমার কাছে গোমর করে বলচি নে, অমন রান্না রাণাঘাটের কোনো হোটেলে কোনো বামুনঠাকুর রাঁধতে পারবে না। হয় না হয় মা এই তোমাদের এখানে এই যে চচ্চড়ি রাঁধচি, তোমাদের সকলকে খাইয়ে দেখাবো; আমি জোর করে বলতে পারি এরকম চচ্চড়ি কখনও খাও নি, আর কখনও খাবে না।
বউটি বিস্ময়ে, সম্ভ্রমে, মুগ্ধ দৃষ্টিতে হাজারির দিকে চাহিয়া কথা শুনিতেছিল। বলিল–তা হোলে আমায় শিখিয়ে দিতে হবে খুড়োমশাই–
–একদিনের কর্ম নয় সে। শেখালেও শিখতে পারা কঠিন হবে–তোমায় ফাঁকি দেওয়া আমার ইচ্ছে নয় মা। এ শেখা এক আধ দিনে হয় কখনো?
–তা আপনি যদি অমন রাঁধুনী, আপনার আবার চাকরির ভাবনা কি? কত বড়লোকের বাড়ী ভাল মাইনে দিয়ে রাখবে
–অদৃষ্ট যখন খারাপ হয় মা, কিছুতেই কিছু হয় না। হাতে টাকা থাকে দু’দিন চেষ্টা চরিত্তি করে বেড়াতে পারি। বেড়াবো কি, রেস্ত ফুরিয়ে এসেচে কি না।
–ক’টাকা লাগবে বলুন।
–কেন, তুমি দেবে নাকি?
–যদি দিই?
–সে আমি নিতে পারি নে। কুসুম দিতে চেয়েছিল, কিন্তু তা আমি নেবো কেন? তোমরা মেয়েমানুষ, ব্যাঙের আধুলি পুঁজি করে রেখেচ, তা থেকে নিয়ে তোমাদের ক্ষতি করতে চাই নে।
–আচ্ছা, আপনাকে যদি টাকা ধার দিই? আপনাকে বলি শুনুন খুড়োমশায়। আমার মার কাছ থেকে কিছু টাকা এনেছিলাম। এখানে রাখবার জো নেই। একটা কথা বলবো?
এদিক ওদিক চাহিয়া সুর নীচু করিয়া বলিল–ননদ আর জা ভাল লোক নয়। এখুনি যদি টের পায় নিয়ে নেবে। আমি আপনাকে টাকা ধার দিচ্ছি, আপনি সুদ দেবেন কত করে বলুন?
এই কুসীদ-লোভী সরলা মেয়েটির প্রতি হাজারির প্রৌঢ় মন করুণায় ও মমতায় গলিয়া গেল। সে আরও খানিক মজা দেখিতে চাহিল।
–এমনি টাকা দেবে মা? আমায় বিশ্বাস কি?
–তা বিশ্বাস না করলে কি এ কারবার চলে? আর আপনি তো চেনা লোক। আপনার গাঁ চিনি, বাড়ী চিনি।
–চিনলেই হোল? একটা লেখাপড়া করে নেবে না? কত টাকা দিতে চাও?
–আমার কাছে আছে আশি টাকা। সবই দিতে পারি আপনি যদি নেন। সুদ কত দেবেন?
–কত করে চাও?
–আপনি যা দেবেন। টাকায় দুপসা করে রেট, আপনি এক পয়সা দেবেন, কেমন তো? আপনার পায়ে পড়ি খুড়োমশায়, টাকাগুলো আলাদা আমার তোরঙ্গতে তোলা আছে। কেউ জানে না। আপনাকে এনে দিই, টাকাগুলো খাঁটিয়ে দিন আমায়। কাকে বিশ্বাস করে দেবো, কে নিয়ে আর দেবে না।
–কই, লেখাপড়ার কথা বল্লে না তো?
–আমি লেখাপড়া জানি নে–কি লেখাপড়া করে নেবো। আপনি চান একটা কিছু লিখে দিয়ে যান। কিন্তু তাতে লোক-জানাজানি হবে। সে কাজের দরকার নেই। আপনি নিয়ে যান। আমি দিচ্চি মিটে গেল। এর আর লেখাপড়া কি?
ইতিমধ্যে রান্নাবান্না শেষ হইয়া গেল। বউটি একঘটি দুধ আনিয়া বলিল–এই উনুনটা পেড়ে দুধটুকু জ্বাল দিয়ে খেতে বসুন–বেলা কি কম হয়েচে?
খাওয়া-দাওয়া মিটিয়া গেল। হাজারির কথা মিথ্যা নয়–গোয়ালাবাড়ীর সকলে একবাক্যে বলিল, এরকম রান্না খাওয়া তো দূরের কথা, সামান্য জিনিস যে খাইতে এমনধারা হয় তাহা শোনেও নাই।
বিকালে বিশ্রাম করিয়া উঠিয়া হাজারি যাইবার জন্য তৈরী হইল। তাহার ইচ্ছা ছিল আর একবার বউটির সঙ্গে দেখা করে। পল্লীগ্রামে মেয়েদের মধ্যে কড়াকড়ি পর্দা নাই সে জানে, বিশেষতঃ ব্রাহ্মণ কায়স্থ ভিন্ন অন্য জাতির মেয়েদের মধ্যে। মেয়েটিকে তাহার ভাল লাগিয়াছিল উহার সরলতার জন্য এবং বোধ হয় টাকাকড়ি সম্বন্ধে কথাটা আর একবার বলিতে তাহার ইচ্ছা হইতেছিল, সে ইতিমধ্যে একটা মতলব মাথায় আনিয়া ফেলিয়াছে। কুসুম এবং এই মেয়েটি যদি তাহাকে টাকা দেয় তবে সে তাহার চিরদিনের স্বপ্নকে সার্থক করিয়া তুলতে পারিবে। ইহাদের টাকা সে নষ্ট করিবে না–বরং অনেক গুণ বাড়াইয়া ইহাদের হাতে তুলিয়া দিতে পারিবে। খাইতে বসিয়া হাজারি এসব কথা ভাবিয়া দেখিয়াছে।
ইহাদের বাড়ী হইতে বাহির হইয়া বড় রাস্তায় পড়িতে হইলে একটা পুকুরের ধার দিয়া যাইতে হয়–একটা বড় তেঁতুল গাছ এবং তাহার চারিপাশে অন্যান্য বন্য গাছের ঝোঁপ জায়গাটাকে এমন ভাবে ঢাকিয়া রাখিয়া দিয়াছে যে বাহির হইতে হঠাৎ সেখানে কেহ থাকিলে তাহাকে দেখা যায় না।
পুকুরের পাড় ছাড়াইয়া হাজারি হঠাৎ দেখিল মেয়েটি তেঁতুলতলার ছায়ায় দাঁড়াইয়া আছে যেন তাহারই অপেক্ষায়।
–চল্লেন খুড়োমশায়?
–হ্যাঁ যাই, তুমি এখানে দাঁড়িয়ে?
–আপনি এই পথ দিয়ে যাবেন জানি, তাই দাঁড়িয়ে আছি। দুটো কথা আপনাকে বলবো। আপনার হাতের রান্না চচ্চড়ি খেয়ে ভাল লেগেছে খুড়োমশায়। আমরাও তো রাঁধি, রান্নার ভাল মন্দ বুঝি। অমন রান্না কখনো খাই নি। আর একটা কথা হচ্ছে আমার টাকাটার কথা মনে আছে তো? কি করলেন তার? জানেন তো মেয়েরা শ্বশুরবাড়ীর লোকদের চেয়ে বাপের বাড়ীর লোকদের বেশী বিশ্বাস করে? এদের হাতে ও টাকা পড়লে দুদিনে উড়ে যাবে।
টাকা তোমার এখুনি নিতে পারবো না। কিন্তু আবার আমি এই পথে আসবো, তোমার সঙ্গে দেখা করবো। তখন হয়তো টাকার দরকার হবে, টাকা তখন হয়তো নিতে হবে।
–কত দিনের মধ্যে আসবেন?
–তা বলতে পারিনে, ধর মাস দুই। পুজোর পরে কার্তিক-অঘ্রাণ মাসের দিকে তোমার সঙ্গে দেখা করবো।
–কথা রইল তা হোলে?
–ঠিক রইল। এসো এসো, লক্ষ্মী ছোট্ট মা আমার–সাবিত্রী সমান হও, আশীর্বাদ করি তোমার বাড়-বাড়ন্ত হোক।
বেলা পড়িয়া আসিয়াছে। হাজারি আবার পথ চলিতে লাগিল। গোয়ালাবাড়ীর সবাই এবেলা থাকিবার জন্য অনুরোধ করিয়াছিল, বউটি তো বিশেষ করিয়া। কিন্তু থাকিবার উপায় নাই, একটা কিছু যোগাড় না করা পর্যন্ত তাহার মনে সুখ নাই।
মেয়েটি খুব আশ্চর্য্য ধরণের বটে। নির্বোধ হয় তো–-কুসুমের মত বুদ্ধিমতী নয় ঠিকই, তবুও বড় ভাল মেয়ে।
পথের দুধারে বনজঙ্গল ক্রমশঃ ঘন হইয়া উঠিতেছে–পথ নদীয়া জেলা হইতে যত যশোর জেলার কাছাকাছি আসিয়া পৌঁছিতেছে এই বন ক্রমশ বাড়িতেছে। স্থানে স্থানে বনজঙ্গল এত ঘন যে হাজারির ভয় করিতে লাগিল দিনমানেই বুঝি বাঘের হাতে পড়িতে হয়। লোকের বসতি এসব স্থানে বেশী নাই, ভয় করিবারই কথা।
সন্ধ্যার পূর্বে বেলের বাজারে আসিয়া পৌঁছিল। আগে যখন রেল হয় নাই, তখন বেলে বাজার খুব বড় ছিল, হাজারি শুনিয়াছে তাহার গ্রামের বৃদ্ধ লোকদের মুখে। এখনও পূর্ব অঞ্চল হইতে চাকদহের গঙ্গায় শবদাহ করিতে আসে বহুলোক–তাহাদের জন্যই বেলের বাজার এখনও টিকিয়া আছে।
হাজারি বেলের বাজার দেখিয়া খুশী হইল ও আগ্রহের সঙ্গে দেখিতে লাগিল। ছেলেবেলা হইতে শুনিয়া আসিয়াছে, কখনও দেখে নাই। চমৎকার জায়গা বটে। এই তাহা হইলে বেলে। তাহার এক মামাতো ভাই যশোর অঞ্চলে বিবাহ করিয়াছিল, তাহার বৃদ্ধা শাশুড়ীর মৃত্যুর পরে শব লইয়া চাকদহে এই পথ বাহিয়া আসিতে অসিতে বেলের বাজারের কাছে ভৌতিক ব্যাপারের সম্মুখীন হয়–এ গল্প উক্ত মামাতো ভাইয়ের মুখেই দু-তিনবার সে শুনিয়াছে।
হাজারি ঘুরিরা ঘুরিয়া বাজারের দোকানগুলি দেখিতে লাগিল। সৰ্বসুদ্ধ নখানা দোকান ইহারই মধ্যে চাল ডাল মুদিখানার দোকান, কাপড়ের দোকান সব। একজন দোকানদারকে বলিল–একটু তামাক খাওয়াতে পারেন মশায়?
–আপনারা?
–ব্রাহ্মণ।
-–পেরণাম হই ঠাকুর মশায়। আসুন, কোথায় যাওয়া হবে?–বন, ওরে বামুনের হুঁকোতে জল ফিরিয়ে নিয়ে আয়।
দোকানখানি কিসের তাহা হাজারি বুঝিতে পারিল না। এক পাশে চিটা গুড়ের ক্যানেস্ত্রা চাল পৰ্য্যন্ত একটার গায়ে একটা উঁচু করিয়া সাজানো আছে–আর এক পাশে বড় বড় বস্তা। দোকানদার বৃদ্ধ, বয়স পয়ষট্টি হইতে সত্তর হইবে, রূগা একহারা চেহারা, গলায় মালা।
–নিন্ ঠাকুর মশায়, তামাক ইচ্ছে করুন। কোথায় যাওয়া হবে?
–যাচ্ছি কাজের চেষ্টায়, রাণাঘাট হোটেলে সাত বছর রেঁধেছি, বেচু চক্কত্তির হোটেলে। নাম শুনেছেন বোধ হয়। ভাল রাঁধুনী বলে নাম আছে–কিন্তু চাকুরিটুকু গিয়েছে–এখন যাই তো একবার এই দিক পানে–যদি কোথাও কিছু জোটে।
দোকানদার পূর্বাপেক্ষা অধিক সম্ভ্রমের চোখে হাজারিকে দেখিল। নিতান্ত গ্রাম্য ঠাকুর পূজারী বামুন নয়–রাণাঘাটের মত শহর বাজারের বড় হোটেলে সাত-আট বছর সুখ্যাতির সঙ্গে রান্নার কাজ করিয়াছে, কত দেখিয়াছে, শুনিয়াছে, কত বড় লোকের সঙ্গে মিশিয়াছে — না, লোকটা সে যাহা ভাবিয়াছিল তাহা নয়।
হাজারি বলিল–রাত হয়ে আসচে, একটু থাকার জায়গার কি হয় বলতে পারেন?
দোকানদার অত্যন্ত খুশী হইয়া বলিল–এইখানেই থাকুন, এর আর কি। আমার এই পেছন দিকে দিব্যি চালা রয়েছে, একখানা তক্তপোশ রয়েচে। চালায় রান্না করুন, তক্তপোশে শুয়ে থাকুন।
কথায় কথায় হাজারি বলিল–আচ্ছা এখানে গঙ্গাযাত্ৰী দিন কত যাতায়াত করে?
–সে দিন আর নেই বেলের বাজারের। আগে আট দশ দল, এক এক দলে দশ-বারো জন করে মানুষ, এ নিত্য যেতো। এখন কোনোদিন মোটেই না, কোনোদিন তিনটে, বড্ড জোর চারটে। আগে লোকের হাতে পয়সা ছিল, মড়া গঙ্গায় দিত–আজকাল হাতে নেই পয়সা–ম’লে নদীর ধারে, খালের ধারে, বিলের ধারে পুড়ায়।
হাজারি ভাবিতেছিল বেলের বাজারে একখানা ছোটখাটো হোটেল চলিতে পারে কিনা। তিন দল গঙ্গাযাত্ৰীতে ত্রিশটি লোক থাকিলে যদি সকলে খায়, তবে ত্রিশজন খরিদ্দার। ত্রিশজন খরিদ্দার রোজ খাইলে মাসে পঞ্চাশ-ষাট টাকা লাভ থাকে খরচ-খরচা বাদে। সেই জায়গায় কুড়ি জন হোক, দশ জন হোক রোজ–তবুও পরের চাকুরির চেয়ে ভাল। পরের চাকুরি করিয়া পাইতেছে সাত টাকা আর অজস্র অপমান বকুনি। সৰ্ব্বদা ভয়ে ভয়ে থাকা–দশ জন খরিদ্দার যে হোটেলে রোজ খায়, সেখানে অন্ততঃ বারো-তেরো টাকা মাসে লাভ থাকে।
পরদিন সকালে উঠিয়া সে গোপালনগরের দিকে রওনা হইল। হাতের পয়সা এখনও যথেষ্ট-–পাঁচ টাকা আছে, কোনো ভাবনা নাই। কাল রাত্রে দোকানদার চাল ডাল হাড়ি কিনিয়া আনিতে চাহিয়াছিল, হাজারি তাহাতে রাজী হয় নাই। নিজে পয়সা খরচ করিয়াছে।
দুপুরের রৌদ্র বড় চড়িল। নির্জন রাস্তা, দুধারে কোথাও ঘন বনজঙ্গল, কোথাও ফাঁকা মাঠ, লোকালয় চোখে পড়ে না, এক-আধখানা চাষাদের গ্রাম ছাড়া। ঘণ্টা দুই হাঁটিবার পরে হাজারির তৃষ্ণা পাইল। কিছুদূরে একটা ছোট পুকুর দেথিয়া তাহার ধারে বসিতে যাইবে এমন সময় একখানা খালি গরুর গাড়ী পুকুরের পাশের মেটে রাস্তা দিয়া নামিতে দেখি। গাড়োয়ানকে ডাকিয়া বলিল–কাছে কোনো গ্রাম আছে বাপু? একটু জল খাবো। ব্রাহ্মণ।
গাড়োয়ান বলিল–আমার সঙ্গে আসুন ঠাকুর মশায়, কাছেই ছিনগর-সিমলে আমি বামুন বাড়ী যাবো। তেনাদের গাড়ী–গাড়ীতে আসুন।
হাজারি শ্রীনগর-সিমলে গ্রামের নাম শুনিয়াছিল, গ্রামের মধ্যে গাড়ী ঢুকিতে দেখিল এ তো গ্রাম নয়–বিজন বন। এতখানি বেলা চড়িয়াছে এখনও গ্রামের মধ্যে সূর্যের আলো প্রবেশ করে নাই; শুধু আম-কাঁটালের প্রাচীন বাগান, বাঁশবন, আগাছার জঙ্গল।
একটা গৃহস্থ-বাড়ীর উঠানে গরুর গাড়ী গিয়া থামিল। গাড়োয়ানের ডাকে বাড়ীর ভিতর হইতে গৃহস্বামী আসিলেন, ম্যালেরিয়া-শীর্ণ চেহারা, মাথার চুল প্রায় উঠিয়া গিয়াছে, বয়স ত্রিশও হইতে পারে পঞ্চাশও হইতে পারে। তিনি বাহিরে আসিয়াই হাজারিকে দেখিতে পাইয়া গাড়োয়ানকে বলিলেন–কে রে সঙ্গে?
গাড়োয়ান বলিল–এজ্ঞে উনি পাকা রাস্তায় মুদির পুকুরের ধারে বসে ছিলেন, বল্লেন একটু জল খাবো– তা বল্লাম চলুন আমার সঙ্গে–আমার মনিবেরা ব্রাহ্মণ–সেখানে জল খাবেন, তাই সঙ্গে করে আনলাম।
গৃহস্বামী আগাইয়া আসিয়া হাজারিকে নমস্কার করিয়া বলিলেন–আসুন, আসুন। বসুন, বিশ্রাম করুন। ওরে চণ্ডীমণ্ডপের তক্তপোশে মাদুরটা পেতে দে–আসুন।
এসব পল্লী অঞ্চলে আতিথ্যের কোনো ত্রুটি হয় না। আধঘণ্টা পরে হাজারি হাত পা ধুইয়া বসিয়া গাছ হইতে সদ্য পাড়া কচি ডাবের জল পান করিয়া সুস্থ ও খোশমেজাজে হুঁকা টানিতে লাগিল।
গৃহস্বামীর নাম বিহারীলাল বাঁড়ুয্যে। চাকুরি জীবনে কখনো করেন নাই, যথেষ্ট ধানের আবাদ আছে, গরু আছে, পুকুরে মাছ আছে, আম-কাঁটালের বাগান আছে। এসব কথা গৃহস্বামীর নিকট হইতেই হাজারি গল্পচ্ছলে শুনিল।
বিহারী বাঁড়ুয্যে বলিতেছিলেন, শ্রীনগর-সিমলে মস্ত গ্রাম ছিল, রাজধানী ছিল কেষ্টনগরের রাজাদের পূর্বপুরুষের। জঙ্গলের মধ্যে রাজার গড়খাই আছে, পুরোনো ইটের গাঁথুনি আছে, দেখাবো এখন ওবেলা। না না, আজ যাবেন কি? ওসব হবে না। দুদিন থাকুন, আমাদের সবই আছে আপনার বাপ-মার আশীর্বাদে, তবে মানুষজনের মুখ দেখতে পাইনে এই যা কষ্ট। ছেলেবেলাতেও দেখেছি গাঁয়ে ত্রিশ-বত্ৰিশ ঘর ব্রাহ্মণের বাস ছিল, এখন দাঁড়িয়েচে সাত বর মোট–তার মধ্যেও দু ঘর আছে বারোমাস বিদেশে। আপনার নিবাস কোথায় বল্লেন?
–আরে, এঁড়োশোলা-গাংনাপুর থেকে নেমে যেতে হয়।
–তবে তো আপনি আমাদের এদেশেরই লোক। আন না আমাদের গাঁয়ে? জায়গা দিচ্ছি, জমি দিচ্ছি, ধান করুন, পাট করুন, বাস করুন এখানে। তবুও এক ঘর লোক বাড়ুক গ্রামে। আসুন না?
হাজারি শিহরিয়া উঠিল। সর্বনাশ! এই ঘন জঙ্গলের মধ্যে সে বাস করিতে আসিবে –সেইটকু অদৃষ্টে বাকী আছে বটে! শহর বাজারে থাকিয়া সে শহরের কল-কোলাহল কৰ্মব্যস্ততাকে পছন্দ করিয়া ফেলিয়াছে–এই বনের মধ্যে সমাধিপ্রাপ্ত হইতে হয় যে বৃদ্ধ বয়সে। ছ’চল্লিশ বৎসর বয়স তার–দিন এখনও যায় নাই, এখনও যথেষ্ট উৎসাহ শক্তি তার মনে ও শরীরে। তা ছাড়া সে বোঝে হোটেলের কাজ, একটা হোটেল খুলিতে পারিলে তাহার বয়স দশ বছর কমিয়া যাইবে–নব যৌবন লাভ করিবে সে। চাষবাসের সে কি জানে?
হোটেলের কথা হাজারি এখানে বলিল না। সে জানে হোটেলওয়ালা বামুন বলিলে অনেকে ঘৃণার চক্ষে দেখে–বিশেষত এই সব পাড়াগাঁয়ে।
শ্রীনগরে হাজারির মোটেই মন টিকিতেছিল না–এত বনজঙ্গলের ন্ধকার ও নির্জনতার মধ্যে তাহার যেন দম বন্ধ হইয়া আসিতেছিল। সুতরাং বৈকালের দিকেই সে গ্রামের বাহিরে আসিয়া পথে উঠিয়া হাঁপ ছাড়িয়া বাঁচিল। ভাবিল–বাপরে! কুড়ি বিঘে ধানের জমি দিলেও এ গাঁয়ে নয় রে বাবা! মানুষ থাকে এখানে? মানুষজনের মুখ দেখার যো নেই, কাজ নেই, কৰ্ম্ম নেই-–কুঁড়ের মতো বসে থাকে। আর গোলার ধানের ভাত খাও– সর্বনাশ!…আর কি জঙ্গল রে বাবা!…
রাস্তার ধারে একটা লোক কাঠ ভাঙিতেছিল। হাজারি তাহাকে বলিল–সামনে কি বাজার আছে বাপু?
লোকটা একবার হাজারির দিকে নীরবে চাহিয়া দেখিল। পরে বলিল–আপনি কি আলেন সিমলে ত্থে?
–হ্যাঁ।
–এখানে আপনাদের এত্ম্য-কুটুম্ব আছেন বুঝি? আপনারা?
–ব্রাহ্মণ।
–পেরণাম হই। কোথায় যাবেন আপনি?
হাজারি জানে পল্লীগ্রাম-অঞ্চলে এই সব শ্রেণীর লোক তাহাকে অকারণে হাজার প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়া বিরক্ত করিয়া মারিবে। ইহাই ইহাদের স্বভাব। হাজারিও পূর্বে এই রকম ছিল–কিন্তু রাণাঘাট শহরে এতকাল থাকিয়া বুঝিয়াছে অপরিচিত লোককে এসব প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিতে নাই বা করিলে লোকে চটে। হাজারি বর্তমান প্রশ্নকর্তার হাত এড়াই বার জন্য সংক্ষেপে দু-একটি কথার উত্তর দিয়া তাহাকে আবার জিজ্ঞাসা করিল–সামনে কি বাজার পড়বে বাপু?
–এজ্ঞে যান, গোপালনগরের বড় বাজার পড়বে–কোশ দুই আর আছেন।
গোপালনগরের নাম হাজারির কাছে অত্যন্ত পরিচিত। এদিকের বড় গঞ্জ গোপালনগর, সকলেই নাম জানে।
মধ্যাহ্নভোজনটা একটু বেশী হইয়া গিয়াছিল, রাতে খাইবার আবশ্যক নাই। একটু আশ্রয় পাইলেই হইল। সুতরাং হাজারির মন সম্পূর্ণ নিশ্চিন্ত ছিল। এ কয়দিন সে যেন নূতন জীবন যাপন করিতেছে–সকালে উঠিবার তাড়া নাই, পদ্মঝিয়ের মুথনাড়া নাই–বেচু চক্কত্তির কাছে বাজারের হিসাব দিতে যাওয়া নাই–দশ সের কয়লাজ্বলা অগ্নিকুণ্ডের তাতে বসিয়া সকাল হইতে বেলা একটা এবং ওদিকে সন্ধ্যা হইতে রাত বারোটা পর্যন্ত হাতাখুন্তি নাড়া নাই, বাঁচিয়াছে সে।
পথের ধারে একটা গাছতলায় পাকা বেল পড়িয়া রহিয়াছে দেখিয়া হাজারি সেটা সংগ্রহ করিয়া লইল। কাল সকালে খাওয়া চলিবে।
সব ভাল–কিন্তু তবু হাজারির মনে হয়, এ ধরণের ভবঘুরে জীবন তাহার পছন্দসই নয়। বৃথা ঘুরিয়া বেড়াইয়া কি হইবে? চাকুরি জোটে তো ভাল। নতুবা এ ধরণের জীবন সে কতকাল কাটাতে পারে?…একমাসও নয়। সে চায় কাজ, পরিশ্রম করিতে সে ভয় পায় না, সে চায় কর্মব্যস্ততা, দু-পয়সা উপার্জন, নাম, উন্নতি। ইহার উহার বাড়ী খাইয়া বেড়াইয়া, পথে পথে সময় নষ্ট করিয়া লাভ নাই।
গোপালনগর বাজারে পৌঁছিতে বেলা গেল। বেশ বড় বাজার, অনেকগুলি ছোট দোকান, ভাল ব্যবসার জায়গা বটে। হাজারি একটা বড় কাপড়ের দোকানের সামনের টিউবওয়েলে হাতমুখ ধুইয়া লইল। নিকটে একটা কালীমন্দির–মন্দিরের রোয়াকে বসিয়া সম্ভবত মন্দিরের পূজারী ব্রাহ্মণ হুঁকা টানিতেছে দেখিয়া হাজারি তামাক খাইবার জন্য কাছে গিয়া দাঁড়াইয়া বলিল–একবার তামাক খাওয়াবেন?
–আপনারা?
–ব্রাহ্মণ।
–বসুন, এই নিন।
–আপনি কি মন্দিরে মায়ের পূজা করেন?
–আজ্ঞে হাঁ। আপনার কোথা থেকে আসা হচ্চে?
–আমার বাড়ী গাংনাপুরের সন্নিকট এঁডোশোলা। রাঁধুনীর কাজ করি–চাকুরির চেষ্টায় বেরিয়েছি। এখানে কেউ রাঁধুনী রাখবে বলতে পারেন?
–একবার এই বড় কাপড়ের দোকানে গিয়ে খোঁজ করুন। ওঁরা বড়লোক, রাঁধুনী ওঁদের বাড়ীতে থাকেই–বাবুর ছোট ভাইয়ের বিয়ে আছে, যদি এ সময় নতুন লোকের দরকার টরকার পড়ে–ওঁ জাতে তিলি, বাজারের সেরা ব্যবসাদার, ধনী লোক।
হাজারি কাপড়ের দোকানে ঢুকিয়া দেখিল একজন শ্যামবর্ণ দোহারা চেহারার লোক গদির উপর বসিয়া আছে। সেই লোকটিই যে দোকানের মালিক, ইহা কেহ বলিয়া না দিলেও বোঝা যায়। হাজারিকে ঢুকিতে দেখিয়া লোকটি বলিল–আসুন, কি চাই? ওদিকে যান–ওহে, দেখ ইনি কি নেবেন–
বলিয়া লোকটি দোকানের অন্য যে অংশে অনেকগুলি কর্মচারী কাজ-কর্ম ও কেনাবেচা করিতেছে সে দিকটা দেখাইয়া দিল।
হাজারি বলিল–বাবু, দরকার আপনার কাছে। আমি রান্না করি, ব্রাহ্মণ–শুনলাম আপনার বাড়ীতে রাঁধুনী রাখবেন—তাই–
–ও। আপনি রান্না করবেন? রাঁধতে জানেন ভাল? কোথায় ছিলেন এর আগে?
–আজ্ঞে রাণাঘাট হোটেলে ছিলাম সাত বছর।
–হোটেলে? হোটেলের কাজ আর বাড়ীর কাজ এক নয়। এ খুব ভাল রান্না চাই। আপনি কি তা পারবেন? কলকাতা থেকে কুটুম্ব আসে প্রায়ই—
হাজারি হাসিয়া ভাবিল–তুমি আর কি রান্না খেয়েছ জীবনে, কাপড়ের দোকান করেই মরেছ বই তো নয়। তেমন রান্না কখনো চোখেও দেখনি।
মুখে বলিল–বাবু, একদিনের জন্যে রেখে দেখুন না হয়। রান্না ভাল না হয়, এমনি চলে যাব। কিছু দিতে হবে না।
দোকানের মালিক পাকা ব্যবসাদার, লোক চেনে। হাজাবির কথার ধরণ দেখিয়া বুঝিল এ বাজে কথা বলিতেছে না। বলিল–আচ্ছা আপনি আমাদের বাড়ী যান। এই সামনের রাস্তা দিয়ে বরাবর গিয়ে বাঁ-দিকে দেখবেন বড় বাড়ী–ওরে নিতাই, তুই বাপু এক বার যা তো, ঠাকুর মশায়কে বাড়ীতে শশধরের হাতে তুলে দিয়ে আয়। বলগে, ইনি এ থেকে রাঁধবেন। বুঝলি? নিয়ে যা–মাইনে-টাইনে কিন্তু, ঠাকুর মশায়, পরে কাজ দেখে ধাৰ্য্য হবে। হ্যাঁ–সে দু-চারদিন পরে তবে–নিয়ে যা।
প্রথম দিনের কাজেই হাজারি নাম কিনিয়া ফেলিল। বাড়ীর কর্তা দশ টাকা বেতন ধার্য করিয়া দিলেন। তাঁহার গৃহিণী অসুস্থ প্রায় বারোমাস, উঠিতে বসিতে পারলেও সংসারের কাজকর্ম বড় একটা দেখেন না–দুটি মেয়ের বিবাহ হইয়া গিয়াছে, তাহারা থাকে শ্বশুরবাড়ী একটি ষোল-সতের বছরের ছেলে স্কুলে পড়ে, আর একটি আট বছরের ছোট মেয়ে।
বাড়ীর সকলেই ভাল লোক–এতদিন চাকুরি করিয়া হাজারির যে খারাপ ধারণা হইয়াছিল পরের চাকুরি সম্বন্ধে, এখানে আসিয়া তাহা চলিয়া গেল। ইহারা জাতিতে গন্ধবণিক, বাড়ীর সকলেই ব্রাহ্মণকে খাতির করিয়া চলে–হাজারির মৃদু স্বভাবের জন্যও সে অল্পদিনের মধ্যে বাড়ীর সকলের বিশেষ প্রিয়পাত্র হইয়া উঠিল।
মাসখানেক কাজ করিবার পর হাজারি প্রথম মাসের বেতন পাইয়াই বাড়ী যাইবার ছুটি চাহিল।
অনেকদিন বাড়ী যাওয়া হয় নাই–টেঁপিকে কত কাল দেখে নাই। দোকানের মালিক ছুটিও দিলেন।
.
গোপালনগর স্টেশনে ট্রেনে চড়িয়া বাড়ী আসিতে প্রায় তিন আনা ট্রেন ভাড়া লাগে। মিছামিছি তিন আনা পয়সা খরচ করিয়া লাভ নাই। হাঁটাপথে মাত্র সাত-আট ক্রোশ হাজারিদের গ্রাম–হাঁটিয়া যাওয়াই ভাল।
বাড়ী পৌঁছিতে সন্ধ্যা হইয়া গেল। টেঁপি ছুটিয়া আসিয়া বলিল–বাবা, এসো, এসো। কোত্থেকে এলে এখন?
তারপর সে ঘরের ভিতর হইতে পাখা আনিয়া বাতাস করিতে বসিয়া গেল। হাজারির মনে হইল তার সারা দেহ-মন জুড়াইয়া গেল টেঁপির হাতের পাখার বাতাসে। টেঁপির জন্য খাটিয়া সুখ–যত কষ্ট যত দুঃখ রানাঘাট হোটেলের–সব সে সহ্য করিয়াছে টেঁপির জন্য। ভবিষ্যতে আরও করিবে।
যদি বংশীধর ঠাকুরের ভাগিনেয় সেই ছেলেটির সঙ্গে—
যাক সে সব কথা।
টেঁপি বলিল–বাবা, অতসীদিদি একদিন তোমার কথা বলচিল–
–আমার কথা? হরিচরণবাবুর মেয়ে?
–হ্যাঁ বাবা, বলচিল তুমি অনেকদিন আসো নি। চল না আজ, যাবে? ওখানে গিয়ে চা খাবে এখন। কলের গান শুনবে।
এই সময় টেঁপির মা ঘাট হইতে গা ধুইয়া বাড়ী ফিরিল। হাসিমুখে বলিল–কখন এলে?
হাজারি–এই তো খানিকক্ষণ। ভাল তো সব? টাকা পেয়েছিলে?
–হ্যাঁ। ভাল কথা, ওদের বাড়ীর সতীশ বলচিল রাণাঘাট থেকে পাঠানো নয় টাকা। তুমি এর মধ্যে কোথাও গিয়েছিলে নাকি?
–রাণাঘাটের চাকরি করিনে তো। এখন আছি গোপালনগরে। বেশ ভাল জায়গায় আছি, বুঝলে? গন্ধবণিকের বাড়ী, ব্রাহ্মণ বলে ভক্তিছেদ্দা খুব। খাওয়া-দাওয়া ভাল। কাপড়ের মস্ত দোকান, দিব্যি জলখাবার দেয় সকালে বিকেলে।
টেঁপি বলিল–কি জলখাবার দেয় বাবা!
–এই ধরো কোন দিন মুড়ি নারকেল, কোন দিন হালুয়া।
টেঁপির মা বলিল–বোসো, জিরোও; চা নেই, তা হলে করে দিতাম। টেঁপি, যাবি মা, সতীশদের বাড়ী চা আছে—(এই কথা বলিবার সময় টেঁপির মা ভুরু দুটি উপরের দিকে তুলিয়া এমন একটি ভঙ্গি করিল, যাহা শুধু নির্বোধ মেয়েরা করিয়া থাকে)–দুটো চেয়ে নিয়ে আয়।
টেঁপি বলিল–দরকার কি মা–আমি নিয়ে যাই না কেন বাবাকে অতসী দিদিদের বাড়ী? সেখানে চা হবে এখন –জলখাবার হবে এখন–
দু-দু’বার টেঁপি অতসীদের বাড়ী যাইবার কথা বলিয়াছে সুতরাং হাজারি মেয়ের মতে মত না দিয়া থাকিতে পারিল না। টেঁপির ইচ্ছা তাহার নিকট অনেকের হুকুমের অপেক্ষ শক্তিমান।
হরিচরণবাবু বৈঠকখানায় বসিয়া ছিলেন–হাজারিকে যত্ন করিয়া চেয়ারে বসাইলেন।
এসো এসো হাজারি, কবে এলে? ও টেঁপি, যা তো অতসীদিদিকে বলগে আমাদের চা দিয়ে যেতে। আমিও এখনো চা খাই নি–
–বাবু, ভাল আছেন?
–হ্যাঁ। তুমি ভাল ছিলে? তোমার সেই হোটেলের কি হল? রাণাঘাটেই আছ তো?
হাজারি সংক্ষেপে রাণাঘাটের চাকুরি যাওয়া হইতে গোপালনগরে পুনরায় চাকুরি পাওয়া পৰ্যন্ত বর্ণনা করিল।
এক সময় অতসী ও টেঁপি ঘরের মধ্যে ঢুকিয়া তাহাদের সামনের ছোট গোল টেবিলটাতে চা ও খাবার রাখিল। খাবার মাত্র এক ডিশ–শুধু হাজারির জন্য, হরিচরণবাবু এখন কিছু খাইবেন না।
হাজারি বলিল–বাবু, আপনার খাবার?
–ও তুমি খাও, তুমি খাও। আমার এখন খেলে অম্বল হয়, আমি শুধু চা খাবো।
হাজারি ভাবিল–এত বড়লোক, এত ভাল জিনিস ঘরে কিন্তু খাইলে অম্বল হয় বলিয়া খাইবার জো নাই এই বা কেমন দুর্ভাগ্য। বয়স ছচল্লিশ হইলে কি হয়, অম্বল কাহাকে বলে সে কখনো জানে না। ভুতের মত খাটুনির কাছে অম্বল-টম্বল দাঁড়াইতে পারে না। তবে খাবার জোটে না এই যা দুঃখ।
অতসী কিন্তু বেশ বড় রেকাবি সাজাইয়া খাবার আনিয়াছে–ঘি দিয়া চিঁড়া ভাজা, নারকেল-কোরা, দুখানা গরম গরম বাড়ীর তৈরী কচুরী ও খানিকটা হালুয়া, বড় পেয়ালার এক পেয়ালা চা। অতসী এটুকু জানে যে টেঁপির বাবা তাহার বাবার মত অল্পভোজী প্রাণী নয়, খাইতে পারে এবং খাইতে ভালবাসে। অবস্থাও উহাদের যে খুব ভাল, তাহাও নয়। সুতরাং টেঁপির বাবাকে ভাল করিয়াই খাওয়াইতে হইবে।
হরিচরণবাবু বলিলেন–তোমার হাজারিকাকাকে প্রণাম করেছ অতসী।
হাজারি ব্যস্ত ও সঙ্কুচিত হইয়া পড়িল। অতসী তাহার পায়ের ধূলা লইয়া প্রণাম করিতে সে চিঁড়াভাজা চিবাইতে চিবাইতে কি বলিল ভালো বোঝা গেল না। অতসী কিন্তু চলিয়া গেল না, সে হাজারির সামনে কিছু দূরে দাঁড়াইয়া তাহাকে ভাল করিয়া দেখিতেছিল। টেঁপি গল্প করিয়াছে তাহার বাবা একজন পাকা রাঁধুনী, অতসীর কৌতূহলের ইহাই প্রধান কারণ।
হরিচরণবাবু বলিলেন–এখন ক’দিন বাড়ীতে আছ?
–আজ্ঞে, পরশু যাবো। পরের চাকরি, থাকলে তো চলে না।
–তোমার সেই হোটেল খোলার কি হোল?
–এখনও কিছু করতে পারি নি বাবু। টাকার যোগাড় না করতে পারলে তো–বুঝতেই পারছেন
–তা হোলে ইচ্ছে আছে এখনও?
–ইচ্ছে আছে খুব। শীতকালের মধ্যে যা হয় করে ফেলবো।
অতসী বলিল–কাকা গান শুনবেন?
হরিচরণবাবু ব্যপ্ত হইয়া বলিলেন—হাঁ হাঁ–আমি ভুলে গিয়েছি একদম। শোন না হাজারি, অনেক নতুন রেকর্ড আনিয়েছি। নিয়ে এসো তো অতসী–শুনিয়ে দাও তোমার হাজারিকাকাকে।
হাজারি ভাবিল, বেশ আছে ইহারা। তাহার মত খাটিয়া খাইতে হয় না, শুধু গান আর খাওয়া-দাওয়া। সন্ধ্যা হইয়াছে, এ সময় উনুনে আঁচ দিয়া ধোঁয়ার মধ্যে ছোট রান্নাঘরে বসিয়া মনিব-গৃহিণীর ফর্দ মত তরকারি কুটিতেছে সে অন্য অন্য দিন। বারো মাসই তাহার এই কাজ। ঘরের মধ্যে আবদ্ধ হইয়া থাকিতে হয় বারো মাস বলিয়াই পথে বাহির হইলেই তাহার আনন্দ হয়। আর আনন্দ হইতেছে আজ, এমন চমৎকার সাজানো বৈঠকখানা, বড় আয়না, বেতমোড়া কেদারায় সে বসিয়া চা খাইতেছে, পাশে টেঁপি, টেঁপির বন্ধু কিশোরী মেয়েটি, কলের গান…যেন সব স্বপ্ন।
কতদিন কুসুমের সঙ্গে দেখা হয় নাই। আজ রাণাঘাট ছাড়িয়াছে প্রায় চারি মাসের উপর, এই চারি মাস কুসুমকে সে দেখে নাই। টেঁপি মেয়ে, কুসুমও মেয়ে।
আর নতুন পাড়ার সেই বউটি! সে-ও আর এক মেয়ে। আজ কলের গানের সুমধুর সুরের ভাবুকতায় তাহার মন সকলের প্রতি দরদ ও সহানুভূতিতে ভরিয়া গিয়াছে।
অনেকক্ষণ ধরিয়া কলের গান বাজিল। হরিচরণবাবু মধ্যে একবার বাড়ীর ভিতর কি কাজে উঠিয়া গেলেন, তখন রহিল অতসী আর টেঁপি। বাবার সামনে বোধ হয় অতসী বলিতে সাহস করিতেছিল না, হরিচরণবাবু বাড়ীর মধ্যে চলিয়া গেলে হাজারিকে বলিল কাকাবাবু, আমাকে রান্না শিখিয়ে দেবেন?
হাজারি ব্যস্ত হইয়া বলিল–তা কেন দেব না মা? কিন্তু তুমি রান্না জানো নিশ্চয়। কি কি রাঁধতে পারো?
অতসী বুদ্ধিমতী মেয়ে, সে বুঝিল যাহার সহিত কথা বলিতেছে, রান্নার সম্বন্ধে সে একজন ওস্তাদ শিল্পী। সঙ্গীতের তরুণী ছাত্রী যেমন সঙ্কোচের সহিত তাহার যশস্বী সঙ্গীত শিক্ষকের সহিত রাগরাগিণী সম্বন্ধে কথা বলে-–তেমনি সঙ্কোচে বলিল–তা পারি সব, শুক্তুনি, চচ্চড়ি, ডাল, মাছের ঝোল–মা তো বড় একটা রান্নাঘরে যেতে পারেন না, তার মন খারাপ, আমাকেই সব করতে হয়। টেঁপি বলচিল আপনি নিরিমিষ রান্না বড় চমৎকার করেন, আমায় দেবেন শিখিয়ে কাকাবাবু?
–টেঁপি বুঝি এই সব বলে তোমার কাছে? পাগলী মেয়ে কোথাকার, ওর কথা বাদ দাও
–না কাকাবাবু, আমি অন্য জায়গাতেও শুনেছি আপনার রান্নার সুখ্যাতি। সবাই তো বলে।
পরে আবারের স্বরে বলিল–আমাকে শেখাতে হবে কাকাবাবু–আমি ছাড়চি নে, আমি টেঁপিকে প্রায়ই জিজ্ঞেস করি, আপনি কবে আসবেন আমি খোঁজ নিই–ও বলেনি আপনাকে? না কাকাবাবু, আমায় শেখান আপনি। আমার বড় শখ ভাল রান্না শিখি।
হাজারি বলিল–ভাল রান্না শেখা একদিনে হয় না মা। মুখে বলে দিলেও হয় না। তোমার পেছনে আমায় লেগে থাকতে হবে অন্ততঃ ঝাড়া দু’মাস তিন মাস। হাত ধরে বলে দিতে হবে–তুমি রাঁধবে। আমি কাছে দাঁড়িয়ে তোমার ভুল ধরে দেবো, এ না হলে শিক্ষা হয় না। তুমি আমার টেঁপির মত, তোমাকে ছেঁদো কথা বলে ফাঁকি দেবো না মা, ছেলেমানুষ, শিখতে চাই শিখিয়ে দিতে আমার অসাধ নয়। কিন্তু কি করে সময় পাবো যে তোমায় শেখাবো মা!
অতসী সপ্রশংস দৃষ্টিতে হাজারির মুখের দিকে চাহিয়া তাহার কথা শুনিতেছিল। বিশেষজ্ঞ ওস্তাদের মুখের কথা। গুরুত্বপূর্ণ কথা–বাজে ছেঁদো কথা নয়, অনভিজ্ঞ, আনাড়ির কথাও নয়। তাহার চোখে হাজারি দরিদ্র রাঁধুনী বামুন পিতা নয়–যে ব্যবসায় সে ধরিয়াছে, সেই ব্যবসায়ে একজন অভিজ্ঞ, ওস্তাদ, পাকা শিল্পী।
হাজারির প্রতি তাহার মন সম্ভ্রমে পূর্ণ হইয়া উঠিল।
.
পরদিন হাজারি ঘুম হইতে উঠিয়া তামাক টানিতেছে, এমন সময় হঠাৎ অতসীকে তাহাদের বাড়ীর মধ্যে ঢুকিতে দেখিয়া সে রীতিমত বিস্মিত হইল। বড়মানুষের মেয়ে অতসী, অসময়ে কি মনে করিয়া তাহার মত গরীব মানুষের বাড়ী আসিল?
টেঁপি বাড়ী ছিল না, টেঁপির মা-ও অতসীকে আসিতে দেখিয়া খুব অবাক হইয়াছিল, সে ছুটিয়া গিয়া তাহার বুদ্ধিতে যতটুকু আসে, সেই ভাবে জমিদার-বাটীর মেয়ের অভ্যর্থনা করিল।
অতসী বলিল–কাকাবাবু বাড়ী নেই খুড়ীমা?
টেঁপির মা বলিল –হ্যাঁ মা, এসো আমার সঙ্গে, ঐ কোণের দাওয়ায় বসে তামাক খাচ্ছে।
–টেঁপি কোথায়?
–সে মূলোর বীজ আনতে গিয়েছে সদগোপ-বাড়ীতে। এল বলে, বসো, বসো। দাঁড়াও আসনখানা পেতে–
অতসী টেঁপির মার হাত হইতে আসনখানা ক্ষিপ্র ও চমৎকার ভঙ্গিতে কাড়িয়া লইয়া কেমন একটা সুন্দর ভাবে হাসিয়া বলিল–রাখুন আসন খুড়ীমা, ভারি আমি একেবারে গুরুঠাকুর এলুম কিনা– তা আবার যত্ন করে আসন পেতে দিতে হবে—
এই হাসি ও এই ভঙ্গিতে সুন্দরী মেয়ে অতসীকে কি সুন্দরই দেখাইল!–টেঁপির মা মুগ্ধ দৃষ্টিতে চাহিয়া রহিল অতসীর দিকে। ইতিমধ্যে হাজারি সে স্থানে আসিয়া বলিল–কি মনে করে সকালে লক্ষ্মী-মা?
অতসী হাজারির কাছে গিয়া বলিল–আপনার সঙ্গে একটা কথা আছে।
–কি কথা মা?
–চলুন ওদিকে, একটু আড়ালে বলব।
হাজারি ভাবিয়াই পাইল না, এমন কি গোপনীয় কথা অতসী তাহাকে আড়ালে বলিতে আসিয়াছে এই সকালবেলায়। দাওয়ায় ছাঁচতলার দিকে গিয়া বলিল–কি কথা মা?
অতসী বলিল–কাকাবাবু, আপনি যদি কাউকে না বলেন, তবে বলি—
হাজারি বিস্মিত মুখে বলিল–বলবো না মা, বলো তুমি।
–আপনি হোটেল খুলবেন বলে বাবার কাছে টাকা ধার চেয়েছিলেন?
–হ্যাঁ, কিন্তু সে তো এবার নয়, সেবার। তোমায় কে বললে এসব কথা?
–সে সব কিছু বলব না। আমি আপনাকে টাকা দেবো, আপনি হোটেল খুলুন—
–তুমি কোথায় পাবে?
অতসী হাসিয়া বলিল–আমার কাছে আছে। দুশো টাকা দিতে পারি–আমি জমিয়ে জমিয়ে করেছি। লুকিয়ে দোবো কিন্তু, বাবা যেন জানতে না পারেন। কেউ জানতে না পারে।
হাজারির চোখে জল আসিল।
এ পর্যন্ত তিনটি মেয়ে তাহার জীবনে আসিল, যাহারা সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে তাহাকে তাহার উচ্চাশার পথে ঠেলিয়া দিতে চাহিয়াছে — তিনজনেই সমান সরলা, তিনজনেই অনাত্মীয়া–তবে অতসী জমিদারবাড়ীর সুন্দরী, শিক্ষিত মেয়ে, সে যে এতখানি টান টানিবে ইহা সম্পূর্ণ অপ্রত্যাশিত ধরণের আশ্চর্য ঘটনা!
হাজারি বলিল–কিন্তু তুমি একথা শুনলে কোথায় বলতে হবে মা।
অতসী হাসিয়া বলিল–সে কথা বলবো না বলেছি তো।
–তা হোলে টাকাও নেবো না। আগে বলো কে বলেছে?
–আচ্ছা, নাম করলে তাকে কি বলবেন না বলুন–
–কাকে কি বলবো বুঝতে পারছি নে তো? বলাবলি কথা কি আছে এর মধ্যে? আচ্ছা, বলবো না। বলো তুমি।
–টেঁপি বলেছিল, বাবার ইচ্ছে একটা হোটেল খোলেন, আমার বাবার কাছে নাকি টাকা চেয়েছিলেন ধার–তা বাবা দিতে পারেন নি। দেখুন কাকাবাবু, দাদা মারা যাওয়ার পরে বাবার মন খুব খারাপ। ওঁকে বলা না বলা দুই সমান। আমি ভাবলাম আমার হাতে তো টাকা আছে–কাকাবাবুকে দিই গে–ওঁদের উপকার হবে। আমার কাছে তো এমনি পড়েই আছে। আপনার হোটেল নিশ্চয়ই খুব ভাল চলবে, আপনারা বড়লোক হয়ে যাবেন। টেঁপিকে আমি বড় ভালবাসি, ওর মনে যদি আহ্লাদ হয় আমার তাতে তৃপ্তি। টাকা বাক্সে তুলে রেখে কি হবে?
–মা, তোমার টাকা তোমার বাবাকে না জানিয়ে আমি নিতে পারি নে।
অতসী যেন বড় দমিয়া গেল। হাজারির সঙ্গে সে অনেকক্ষণ ছেলেমানুষী তর্ক করিল, বাবাকে না জানাইয়া টাকা লইলে দোষ কি!
শেষে বলিল–আমি টেঁপিকে এ টাকা দিচ্ছি।
–তা তুমি দিতে পারো না। তুমি ছেলেমানুষ, টাকা দেওয়ার অধিকার তোমার নেই মা। তুমি তো লেখাপড়া জানো, ভেবে দেখ।
–আচ্ছা, আমায় লাভের অংশ দেবেন তা হোলে?
হাজারির হাসি পাইল। কুসুম, গোয়ালা-বাড়ীর সেই বউটি, অতসী–সবাই এক কথা বলে। ইহারা সকলেই মহাজন হইয়া টাকা ব্যবসায়ে খাটাইতে চায়। মজার ব্যাপার বটে!
–না মা, সে হয় না। তুমি বড় হও, শ্বশুরবাড়ী যাও, আশীর্বাদ করি রাজরাণী হও, তখন তোমার এই বুড়ো কাকাবাবুকে যা খুশি দিও, এখন না।
অতসী দুঃখিত হইয়া চলিয়া গেল।
হাজারির ইচ্ছা হইল টেঁপিকে ডাকিয়া বকিয়া দেয়। এসব কথা অতসীর কাছে বলিবার তাহার কোনো দরকার ছিল না, কিন্তু অতসীর নিকট প্রতিজ্ঞাবদ্ধ আছে, টেঁপিকে ইহা লইয়া কিছু বলিলেই অতসীর কানে গিয়া পৌঁছাইবে ভাবিয়া চুপ করিয়া গেল।
.
সেদিন বিকালে গোয়ালপাড়ায় বেড়াইতে গিয়া কুসুমের বাপের বাড়ীতে শুনিল রাণাঘাটে কুসুমের অত্যন্ত অসুখ হইয়াছিল, কোনোরূপে এযাত্রা সামলাইয়া গিয়াছে। সে কিছুই জিজ্ঞাসা করে নাই, কথায় কথায় কুসুমের কাকা ঘনশ্যাম ঘোষ বলিল–মধ্যে রানাঘাটে পনেরো দিন ছেলাম দাদাঠাকুর, ছানার কাজ এ মাসটা বড্ড মন্দা।
হাজারি বলিল–পনেরো দিন ছিলে? কেন হঠাৎ এ সময়—
তারপরেই ঘনশ্যাম কুসুমের কথাটা বলিল।
হাজারির কেবল মনে হইতে লাগিল কুসুমের সঙ্গে কতদিন দেখা হয় নাই–একবার তাহার সহিত দেখা করিতে গেলে কেমন হয়? মনটা অস্থির হইয়া উঠিয়াছে তাহার অসুখের খবর শুনিয়া। জীবনে ওই একটি মেয়ের উপর তাহার অসীম স্নেহ ও শ্রদ্ধা।
ইচ্ছা হইল কুসুমের সম্বন্ধে ঘনশ্যামকে সে অনেক কিছু জিজ্ঞাসা করে। কিন্তু তাহা করা চলিবে না। সে মনের আকুল আগ্রহ মনেই চাপিয়া শুধু কেবল উদাসীন ভাবে জিজ্ঞাসা করিল
–এখন সে আছে কেমন?
–তা এখন আপনার বাপ-মায়ের আশীর্বাদে সেরে উঠেছে–তবে বড় কষ্ট যাচ্ছে সংসারের, দুধ-দই বেচে তো চালাতো, আজ মাসখানেকের ওপর শয্যাগত অবস্থা। ইদিকি আমার সংসারের কাণ্ড তো দেখতেই পাচ্চেন–কোত্থেকে কি করি দাদাঠাকুর–
হাজারি এ সম্বন্ধে আর কিছু বলিল না। যেন কুসুমের সম্বন্ধে তাহার সকল আগ্রহ ফুরাইয়া গেল।
বাড়ী ফিরিবার পথে হাজারি ভাবিল রাণাঘাটে তাহাকে যাইতেই হইবে। কুসুমের অসুখ শুনিয়া সে চুপ করিয়া থাকিতে পারিবে না। কালই একবার সে রাণাঘাট যাইবে।
পথে অতসীর পিতা হরিবাবুর সঙ্গে দেখা।
তিনি মোটা লাঠি হাতে করিয়া বেড়াইতে বাহির হইয়াছিলেন। হাজারিকে দেখিয়া বলিলেন–এই যে হাজারি, কোথা থেকে ফিরচো? তা এসো আমার এখানে, চলো চা খাবে।
বৈঠকখানায় হাজারিকে বসাইয়া হরিবাবু বলিলেন–বসো, আমি বাড়ীর ভেতর থেকে আসছি। তারপর দুজনে একসঙ্গে চা খাওয়া যাবে যতদিন বাড়ী আছ, আসা-যাওয়া একটু করো হে, কেউ আসে না, একলাটি সারাদিন বসে বসে আর সময় কাটে না। দাঁড়াও আসছি–
হরিবাবু বাড়ীর মধ্যে চলিয়া যাইবার কিছুক্ষণ পরে অতসী একখানা রেকাবিতে খানকতক লুচি, বেগুনভাজা এবং একটু আখের গুড় লইয়া আসিল। হাজারির সামনের টেবিলে রেকাবি রাখিয়া বলিল–আপনি ততক্ষণ খান কাকাবাবু, চা দিয়ে যাচ্ছি।
হাজারি বলিল–বাবু আসুন আগে
–বাবা তো খাবার খাবেন না, তিনি খাবেন শুধু চা। আপনি খাবারটা ততক্ষণ খেয়ে নিন। চা একসঙ্গে দেবো—
অতসী চলিয়া গেল না, কাছেই দাঁড়াইয়া রহিল। হাজারি একটু অস্বস্তি বোধ করিতে লাগিল, বলিবার কিছু খুলিয়া না পাইয়া বলিল–টেঁপি আজ আসে নি মা?
–না, এ বেলা তো আসে নি।
হাজারি আর কিছু কথা না পাইয়া নীরবে খাইতে লাগিল। খাইতে খাইতে একবার চোখ তুলিয়া দেখিল অতসী একদৃষ্টে তাহার দিকে চাহিয়া আছে। অতসী সুন্দরী মেয়ে, টেঁপির বন্ধু হইলেও বয়সে টেঁপির অপেক্ষা চার-পাঁচ বছরের বড়–এ বয়সের সুন্দরী মেয়ের সহিত নির্জন ঘরে অল্পক্ষণ কাটাইবার অভিজ্ঞতাও হাজারির নাই–সে রীতিমত অস্বস্তি বোধ করিতে লাগিল।
অতলী হঠাৎ বলিল–কাকাবাবু আপনি আমার ওপর রাগ করেন নি?
হাজারি থতমত খাইয়া বলিল–রাগ? রাগ কিসের মা–
–ওবেলার ব্যাপার নিয়ে?
–না না, এতে আমার রাগ হবার কিছু নেই, বরং তোমারই–
–না শুনুন কাকাবাবু, আমি তারপর ভেবে দেখলাম আপনি আমার টাকা নিলে খুব ভাল করতেন। জানেন, আমার দাদা মারা যাওয়ার পর আমি কেবলই ভাবি দাদা বেঁচে থাকলে বাবার বিষয় আমি পেতাম না, এখন কিন্তু আমি পাবো। কিন্তু ভগবান জানেন কাকাবাবু, আমি এক পয়সা চাইনে বিষয়ের। দাদা বিষয় ভোগ করতো তো করতো–নয় তো বাবা বিষয় যা খুশি করে যান, উড়িয়ে যান, পুড়িয়ে যান, দান করুন–আমার যেন এ না মনে হয় আজ দাদা থাকলে এ বিষয় আমি পেতাম না দাদাই পেতো। বিষয়ের জন্যে যেন দাদার ওপর কোনোদিন–আমার নিজের হাতে যা আছে তাও উড়িয়ে দেবো।
অতসীর চোখ জলে টলটল করিয়া আসিল, সে চুপ করিল।
হাজারি সান্ত্বনার সুরে বলিল–না মা, ও সব কথা কিছু ভেবো না। তোমার বাবা মাকে তুমিই বুঝিয়ে রাখবে, তুমিই ওঁদের একমাত্র বাঁধন–তুমি ওরকম হোলে কি চলে? ছি—মা–
হাজারি সত্যই অবাক হইয়া গেল, ভাবিল–এইটুকু মেয়ে, কি উঁচু মন দ্যাখো একবার। বড় বংশ নইলে আর বলেছে কাকে? এ কি আর বেচুবাবুর হোটেলের পদ্মঝি?
হাজারি বলিল–আচ্ছা মা আমাকে টাকা দেবার তোমার ঝোঁক কেন হোল বল তো? তোমরা মেয়েরা যদি ভাল হও তো খুবই ভাল, আর মন্দ হও তো খুবই মন্দ।–আমায় তুমি বিশ্বাস কর মা?
–আপনি বুঝে দেখুন। না হোলে আপনাকে টাকা দিতে চাইব কেন?
–তোমার বাবাকে না জানিয়ে দেবে?
–বাবাকে জানালে দিতে দেবেন না। অথচ আমার টাকা পড়ে রয়েছে, আপনার উপকার হবে, আমি জানি আপনাদের সংসারের কষ্ট। টেঁপির বিয়ে দিতে হবে। কোথায় পাবেন টাকা, কোথায় পাবেন কি! আপনার রান্নার যেমন সুখ্যাতি, আপনার হোটেল খুব ভাল চলবে। ছ-বছরের মধ্যে আমার টাকা আপনি আমায় ফেরত দিয়ে দেবেন।
হাজারি মুগ্ধ হইয়া গেল অতসীর হৃদয়ের পরিচয় পাইয়া। বলিল–আচ্ছা তুমি দিও টাকা, আমি নেবো। হোটেল এই মাসেই আমি খুলবো–তোমার মুখ দিয়ে ভগবান এ কথা বলেছেন মা, তোমরা নিষ্পাপ ছেলেমানুষ, তোমাদের মুখেই ভগবান কথা কন।
অতলী হাসিয়া বলিল–তা হোলে নেবেন ঠিক?
–ঠিক বলচি। এবার ঘুরে জায়গা দেখে আসি। রাণাঘাট যাচ্ছি কাল সকালেই, হয় সেখানে, নয় তো গোয়াড়ির বাজারে জায়গা দেখবো। খবর পাবে তুমি, আবার ঘুরে আসচি তিন-চার দিনের মধ্যেই।
অতসী বলিল–বাবার আহ্নিক করা হয়ে গিয়েছে, বাবা আসবেন, আপনি বসুন, আমি আপনাদের চা নিয়ে আসি। শুনুন কাকাবাবু, আপনি যেদিন বাবার কাছে হোটেলের জন্যে টাকা চান, আমি সেদিন বাইরে দাঁড়িয়ে সব শুনেছিলাম। সেই থেকে আমি ঠিক করে রেখেছি আমার যা টাকা জমানো আছে আপনাকে তা দেবে।
–আচ্ছা বল তো মা একটা সত্যি কথা–আমার ওপর তোমার এত দয়া হোল কেন?
–বলবো কাকাবাবু? আপনার দিকে চেয়ে দেখে আমার মনে হোত আপনি খুব সরল লোক আর ভালো লোক। আমার মনে বড় কষ্ট হয় আপনাকে দেখলে সত্যি বলচি–তবে দয়া বলছেন কেন? আমি আপনার মেয়ের মত না?
বলিয়াই অতসী এক প্রকার কুণ্ঠা ও লজ্জা মিশ্রিত হাসি হাসিল।
হাজারি বলিল–তুমি আর জন্মে আমার মা ছিলে তাই দয়ার কথা বলচি। নইলে কি সন্তানের ওপর এত মমতা হয়? তুমি সুখে থাকো, রাজরাণী হও–এই আশীর্বাদ করচি। আমি তোমার গরীব কাকা, এর বেশী আর কি করতে পারি।
অতসী আগাইয়া আসিয়া হঠাৎ নীচু হইয়া হাজারির পায়ের ধূলা লইয়া প্রণাম করিল এবং আর একটুও না দাঁড়াইয়া তৎক্ষণাৎ বাড়ীর মধ্যে চলিয়া গেল।