রাজকীয় ব্যাপার। প্রায় শখানেক মানুষ আমাকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে। আমি হাতলওয়ালা চেয়ারে বসে আছি। আমার মাথার উপর শুটিং এর বিশাল রঙ বেরঙের ছাতা। আমি মেকাপ নিচ্ছি। মেকাপম্যান সুবীরদা আমার মুখে প্যানকেক ঘষছেন। মেকাপের দীর্ঘ প্রক্রিয়ার এই হল শুরু। কেউ যদি জিজ্ঞেস করে শুটিং এর সবচে খারাপ অংশ কোনটি? আমি বলব, মেকাপ নেয়া। ক্লান্তিকর, বিরক্তিকর এবং মাঝেমধ্যে গ্লানিকরও। একজন পুরুষ মানুষ মুখে হাত ঘষছে—ব্যাপারটা কেমন না?
তবে সুবীরদার কাছে মেকাপ নিতে কোন গ্লানিবোধ হয় না। তিনি শুরুই করেন মা ডেকে। মেকাপের পুরো সময়টা টুকটুক করে গল্প করেন। যখন মেকাপ শেষ হয়ে যায় তখন মনে হয়—আহা এত তাড়াতাড়ি শেষ হয়ে গেল কেন? আরও খানিকক্ষণ থাকলে কী হত! মজার মজার গল্প শোনা যেত।
আমি মেকাপ নিচ্ছি গাছতলায়। ঘরের ভেতর নেয়া যাচ্ছে না— ঘর অন্ধকার। ইলেকট্রিসিটি আপাতত নেই। যখন আসে তখন বাল্বগুলি এমন মিটিমিটি করে জ্বলে যে মনে হয় ইলেকট্রিসিটি থাকাটাই ভাল ছিল।
গাছের নীচে রাণী রাণী ভাব ধরে মেকাপ নিতে আমার ভালই লাগছে। সুবীরদা মাথার উপর ছাতা দিয়ে ভাল করেছেন। পাখিরা এখন আর মাথায় বাথরুম করতে পারবে না। পরশু বিকেলে পাপিয়া ম্যাডাম গাছের নীচে বসে কফি খাচ্ছিলেন হঠাৎ তার মাথায় পাখি বাথরুম করে দিল। আমি খুব দ্র ভাষা ব্যবহার করলাম। আসলে আমার বলা উচিত— পাখি গু করে দিল। তিনি পাখিদের কাণ্ডে হতভম্ভ হয়ে গেলেন। কফি খাওয়া তাঁর মাথায় উঠলসাবান শ্যাম্পু নিয়ে ছোটাছুটি পরে গেল। মাথা ধোয়া হল কয়েকবার। মাথায় আয়না ধরা হলো। পাপিয়া ম্যাডাম বললেন–এখনো পরিস্কার হয় নি।
ম্যাডামের শুচিবায়ুর মতো আছে। যতবার ধোয়া হচ্ছে ততবারই বলছেন–পরিষ্কার হয় নিতো এখনো দুর্গন্ধ আসছে। আমার বমি এসে যাচ্ছে।
পাপিয়া ম্যাডামের কাণ্ডকারখানা দেখে সবাই ভাবল এটা আর কিছুই না-নায়িকার নখরা। বড় নায়িকা হলেই নখরামি করতে হয়। তিনি খানিকটা করছেন—এর বেশি কিছু না। কিন্তু আমি জানি উনার এটা নখরামি না। কিছু কিছু মানুষ এরকম থাকে।
আমি নিজেওতো এরকম। শুয়োপোকা দেখলে আমার মাথার ঠিক থাকে না। আমার সবচে ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন হচ্ছে গায়ের উপর দিয়ে শুয়োপোকা হেঁটে যাচেছ। গোঁফওয়ালা পুরুষ মানুষ এই কারণেই আমার অপছন্দ। গোফটাকে আমার শুয়োপোকার মতো মনে হয়। নাকের নীচে একটা শুয়োপোকা নিয়ে একজন পুরুষের মুখ আমার মুখের দিকে এগিয়ে আসছে। ভাবতেই আমার শরীর যেন কেমন করতে থাকে।
সমস্যা হচ্ছে আমাদের এই ছবির যিনি জামিল হয়েছেন তার পুরুষ্টু গোঁফ আছে। আমাকে এই গোঁফো মানুষটার প্রেমে পড়তে হবে। আমি জানি তিনি কাছাকাছি এলেই আমার চোখমুখ শক্ত হয়ে আসবে। সহজ স্বাভাবিক অভিনয় আমার পক্ষে করা সম্ভব হবে না। আজ যদি আমার পাপিয়া ম্যাডামের মতো ক্ষমতা থাকতো আমি বলতাম—গোঁফ আছে এমন কারোর সঙ্গে প্রেমের অভিনয় করা আমার পক্ষে সম্ভব না। হয় উনাকে গোঁফ ফেলে দিতে হবে কিংবা গোফ নেই এমন অভিনেতা আমার জন্যে আনতে হবে। আমার মার ধারণা একদিন এরকম ক্ষমতা আমার হবে। অটোগ্রাফের জন্যে পাগল হয়ে লোকজন আমার পেছনে পেছনে ছুটবে। আমাকে নিউ মার্কেটে কিছু কিনতে গেলে বোরকা পরে যেতে হবে। মা আনন্দে ঝলমল করতে করতে বললেন—বুঝলি বকু, আমরা দুটা সৌদি বোরকা কিনে ফেলব। তোর জন্যে একটা, আমার জন্যে একটা। সারা শরীর ঢাকা, শুধু চোখ বের হয়ে আছে। চোখ দেখেতো আর আমাদের চিনতে পারবে না। বোরকার জন্যে আমরা পার পেয়ে যাব। মজা করে শপিং করব।
আমি বললাম, তোমার বোরকার দরকার কী মা? তোমাকেতো কেউ চিনবে না।
চিনবে না কেন? তোকে চিনলেই আমাকে চিনবে। তোর ইন্টারভুর পাশাপাশি আমার ইন্টারভুও ছাপা হবে।
আমার সুন্দর শান্তির সংসার হোক এটা তুমি চাও না মা?
চাব না কেন? অবশ্যই চাই। আমার সংসার হলো না বলে তোরও হবে, এটা কেমন কথা! তোর বাবুগুলিকে কে মানুষ করবে? আমিই করব। তুই তোর মত অভিনয় করে যাবি আমি দেখব তোর সংসার…।
আমি দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে বললাম, ও আচ্ছা।
সুবীরদা মেকাপের প্রাথমিক কাজ শেষ করে ফেলেছেন। এখন যে কাজটা তিনি করবেন সেটা আমার খুব পছন্দের। একটা ভেজা টাওয়েল আমার মুখের উপর দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলবেন। ফাউন্ডেশন বসার ব্যবস্থা। আমাকে ভেজা টাওয়েলের আড়ালে রেখে সুবীরদ এক কাপ চা খাবেন। সিগারেট খাবেন। দশ মিনিট এই ভাবে যাবে তারপর শুরু হবে ফিনিশিং কাজ। সুবীরদার মেকাপের হাত অসাধারণ। তিনি যখন কাজ শেষ করে আমার হাতে আয়না ধরিয়ে দিয়ে বলবেন মা দেখতো। তখন আয়নার দিকে তাকিয়ে আমি চমকে উঠব। কারণ, আয়নাতে যে বসে আছে তাকে আমি চিনি না। সে অন্য কোন মেয়ে। পৃথিবীর সব রূপ নিয়ে সে রাঙ্গা রাজকন্যাদের মত বসে আছে।
বকুল।
জ্বি সুবীরদা।
আমি তোমাকে মা ডাকি আর তুমি আমাকে সুবীরদা ডাক এটা কেমন কথা মা?
আর ডাকব না। এখন থেকে আপনাকে চাচা ডাকব।
মা তোমার যা ইচ্ছা ডাকবে। আমার তোমাকে মা ডাকতে ইচ্ছে করে আমি মাই ডাকব।
আমি আকাশের দিকে মুখ করে বসে আছি। আমার মুখের উপর ভেজা টাওয়েল। মুখটা ঠান্ডা হয়ে আছে। সুবীরদা শব্দ করে চা খাচ্ছেন। শব্দ শুনে মনে হচ্ছে চা-টা খুব মজা হয়েছে। আমার নিজেরো চা খেতে ইচ্ছে করছে। যদিও আমার এত চায়ের তৃষ্ণা নেই। কাউকে মজা করে কিছু খেতে দেখলে আমারো খেতে ইচ্ছে করে। কাউকে পান খেতে দেখলে আমার পান খেতে ইচ্ছে করে।
চোখ বন্ধ করেই টের পেলাম পাপিয়া ম্যাডাম এসেছেন। সুবীরদা চা খাওয়া বন্ধ করে উঠে দাঁড়িয়েছেন। আমি মিষ্টি সুবাস পাচ্ছি। পাপিয়া ম্যাডামের গা থেকে এই সুগন্ধ আসছে। তিনি নিশ্চয়ই খুব দামী কোন পারফিউম ব্যবহার করেন।
বকুল!
জ্বি।
তুমি কি ঘটনা শুনেছ?
আমি শংকিত গলায় বললাম, কোন ঘটনার কথা বলছেন?
আমাদের ডিরেক্টর সাহেব রাস্তার একটা ছেলেকে এত বড় রোলে দাঁড়া করিয়ে দিচ্ছেন।
উনি যা করছেন–নিশ্চয়ই ভেবে চিন্তে করছেন।
না। ও সব কিছু ভেবে চিন্তে করে না। ঝোঁকের মাথায় হুট-হাট করে করে। ও এখন যা করছে রাগের মাথায় করছে। ফরহাদ আসেনি রাগে ডিরেক্টর সাহেবের ব্রহ্মতালু জ্বলে যাচ্ছে। কাজেই হাতের পাশে রাম-শ্যাম-যদু-মধু-কদু যা পেয়েছে পঁাড়া করিয়ে দিয়েছে। সবাই অভিনয় জানলেতো কাজই হত!
উনি নিশ্চয়ই অভিনয় আদায় করে নেবেন।
কাচকলা আদায় করে নেবে।
সুবীরদা আমার মুখের উপর থেকে ভেজা তোয়ালে সরিয়ে দিলেন। পাপিয়া ম্যাডাম সুবীরদার দিকে তাকিয়ে বললেন—সুবীরদা আপনি একটু যানতো আমি বকুলের সঙ্গে দুটা কথা বলব। সুবীরদা সঙ্গে সঙ্গে চলে গেলেন। আমি চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, আপনি বসুন।
পাপিয়া ম্যাডাম বিরক্ত গলায় বললেন, আমি বসব না। যা বলার বলে যাচ্ছি। তুমি মন দিয়ে শোন।
আমি ভীত গলায় বললাম, বলুন। পাপিয়া ম্যাডামের ভাব ভঙ্গি দেখে আমার কেন জানি ভয় ভয় লাগছে। রাগে উনার শরীর কাঁপছে। উনাকে এত রাগতে আমি কখনো দেখি নি।
শোন বকুল–রাস্তার একজন মানুষের সঙ্গে আমি অভিনয় করব না। আমার বাছ বিচার আছে। ও ক্যামেরা ওপেন করছে করুক। আমি কিছু বলছি না। আজ বিকেলে নাকি ঐ গাধাটার সঙ্গে আমার কাজ হবে। সেই কাজ আমি করব না। আমি বিকেলে চলে যাব। আমার গাড়ির চাকা লিক হয়েছে। ড্রাইভারকে চাকা সারিয়ে আনতে বলেছি।
ডিরেক্টর সাহেবকে বলেছেন?
না বলি নি। বলার দরকার দেখছি না।
আগে থেকে উনাকে বলে রাখলে উনি হয়ত শুটিং বন্ধ রেখে বিকল্প ব্যবস্থা করবেন। নয়ত শুধু শুধু ফিল্ম নষ্ট হবে।
হোক ফিল্ম নষ্ট।
আপনি যদি অনুমতি দেন তাহলে আমিও উনাকে বলতে পারি। তোমাকে বলতে হবে কেন? কথা বলার জন্যে আমার পীর ধরার দরকার নেই।
পাপিয়া ম্যাডাম হনহন করে চলে গেলেন। এবং সঙ্গে সঙ্গেই ফিরে এলেন। তাঁর রাগ কমে নি। তিনি আমার কাছে এসেছিলেন রাগ কমানোর জন্যে রাগ না কমিয়েই চলে যাচ্ছিলেন— আবার এসেছেন। আমি কি তার রাগ কমানোর চেষ্টা করব না আরো রাগ বাড়িয়ে দেব? দুটা কাজই আমি পারি। ভালভাবেই পারি। মার সঙ্গে থেকে শিখেছি— কী করে কত দ্রুত কাউকে রাগানো যায়। কিংবা রাগ কমানো যায়। আমি ঠিক করলাম পাপিয়া ম্যাডামের রাগ বাড়িয়ে দেব।
বকুল!
জ্বি।
ইডিওটিক কাজ আমার পছন্দ না। একটা কাজ হবে তার পেছনে কোন প্ল্যানিং থাকবে না, হোয়াট ইজ দিস?
আমি কি উনার পক্ষ হয়ে একটা কথা বলব?
পাপিয়া ম্যাডাম তীক্ষ্ণ চোখে আমার দিকে তাকালেন। আমি বুঝতে পারছি তার চোখে দপ করে আগুন জ্বলে উঠেছে। মনে মনে খানিকটা ভয়ও পাচ্ছি। আমি যার পক্ষ হয়ে কথা বলব তার উপরের রাগের ভাগটা আমাকেই নিতে হবে।
মঈনের পক্ষ হয়ে তুমি কথা বলবে?
জ্বি।
কী কথা?
নতুনদের যদি ছবিতে না নেয়া হয় তাহলে তারা সুযোগ পাবে কীভাবে? এখন যারা অভিনয় করছেন তারা সবাইতো এক সময় নতুন ছিলেন।
নতুনদের নেয়ার ব্যাপারে আমার কোন আপত্তি নেই। তাই বলে তুমি একটা প্রোডাকশান বয়কে ছবির নায়ক বানিয়ে দেবে? হাউ কাম! সেলিম বলে যে ছেলেটাকে নেয়া হয়েছে— তুমি কি জান সে একজন প্রোডাকশান বয়।
ও।
সে সেদিন পর্যন্ত ফুট ফরমাশ খেটেছে— আমাকে চা এনে দিয়েছে তার সঙ্গে হঠাৎ করে প্রেমের ডায়ালগ আমি বলব কী করে? আমরা কেউ রোবট না যে ডিরেক্টর সাহেব যা বলবেন তাই করে যাব। অভিনয় পেশা হিসেবে নিয়েছি বলেই অভিনয়ের স্বার্থে আমার বাসার কাজের ছেলেটিকে আমি জড়িয়ে ধরে চুমু খাব না-কি?
আমি অবাক হয়ে একটা ব্যাপার লক্ষ্য করলাম— পাপিয়া ম্যাডামকে আমি রাগাতে চাচ্ছিলাম— এখন দেখি উল্টোটা হচ্ছে, তার রাগ পড়ে যাচ্ছে। মাকে দিয়ে সবাইকে বিচার করলে হবে না, একেকজন মানুষ একেক রকম।
বকুল!
জ্বি।
সরি তোমার অনেক সময় নষ্ট করলাম। তুমি মেকাপ শেষ কর। আমি যাচ্ছি।
আপনার মেয়েকে লেখা চিঠি কি পোস্ট করা হয়েছে?
হ্যাঁ হয়েছে।
ওর নাম কী?
ওর ডাক নাম খুব ইন্টারেস্টিং এক অক্ষরের নাম–নি। আমি ইচ্ছা করে রেখেছি যেন আর কেউ এই নাম রাখতে না পারে। আমি চাচ্ছি যেন পৃথিবীর কেউ আমার মেয়ের নামে তার নাম না রাখে।
নি নাম আর কেউ রাখবে বলে মনে হয় না।
পাপিয়া ম্যাডাম শান্ত গলায় বললেন, এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ যেমন আলাদা, তাদের নামও সে রকম আলাদা হওয়া উচিত।
এত নাম পাওয়াওতো মুশকিল।
কোন মুশকিল না, ইচ্ছা থাকলেই হয়। কম্পিউটারে সব নাম ঢুকানো থাকবে। কেউ তার ছেলেমেয়ের নাম রাখার আগে কম্পিউটার সার্চের ব্যবস্থা করবে।
আমি অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, পাপিয়া ম্যাডামের চোখে মুখে রাগ, বিরক্তি কিছুই নেই। শান্ত মা মা একটা ভাব। মেয়ের প্রসঙ্গ আসতেই তাঁর মুখ বদলে গেছে। একজন মায়ের কাছে তার মেয়ে কি এত প্রিয়?
বকুল, আমি যাচ্ছি। ডিরেক্টর সাহেবের নতুন অভিনেতার শর্ট নেবার সময় আমি উপস্থিত থাকব। দেখব নতুন অভিনেতার কাণ্ড কারখানা।
ম্যাডাম চলে গেলেন। সুবীরদা আবার মেকাপ শুরু করেছেন। আর কতক্ষণ লাগবে কে জানে। আমি চাচ্ছিদ্রুত শেষ হোক। সেলিম ভাইয়ের প্রথম শটের সময় আমি উপস্থিত থাকতে চাই।
সেলিম ভাইয়ের শট নেয়া হচ্ছে। তার জীবনের প্রথম শট। কে জানে হয়তোবা শেষ শটও। তিনি যেমন নার্ভাস, ডিরেক্টর সাহেবও নার্ভাস। আমি পাপিয়া ম্যাডামের সঙ্গে ঝাকড়া পাতাওয়ালা একটা গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছি। গাছটা হল কাঠবাদামের গাছ। আমি একজনকে নাম জিজ্ঞেস করে জেনে নিয়েছি। এই কাঠবাদাম কিন্তু খাওয়া যায় না।
পাপিয়া ম্যাডাম মাথায় স্কার্ফ বেঁধে নিয়েছেন যেন মাথায় পাখি গু করতে না পারে। ডিরেক্টর সাহেবও গাছের নীচেই আছেন। এতক্ষণ ছিলেন না, এই মাত্র এসেছেন। আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, কী খবর? কাকে বললেন, আমাকে না পাপিয়া ম্যাডামকে বোঝা যাচ্ছে না। মনে হয় কাউকেই না। জিজ্ঞেস করার জন্যে জিজ্ঞেস করা। প্রচন্ড টেনশনে তাঁর ভুবন ছোট হয়ে গেছে। তিনি হাত ইশারা করে সেলিম ভাইকে ডাকলেন।
সেলিম ভাইকে একটা কথা জিজ্ঞেস করতে হবে। কাঠবাদামের বাদাম খাওয়া যায় না কেন? এই বাদাম গাছটার পাতা এমন ঘন যে সূর্যের আলোর ছিটেফোঁটাও নীচে আসছে না। পিন পিন শব্দে মশা উড়ছে। খুব ছোট মশ—চোখে দেখা যায় না এমন। ছোট হলেও এরা কামড়াতে ওস্তাদ। কামড় দেবার সঙ্গে সঙ্গে জায়গাটা ফুলে যায়। আমি একটু শংকিত বোধ করছি। মশার কামড়ের ভয়ে শংকিত না। মশা যদি মুখে কামড়ায়— মুখ ফুলে উঠবে। ক্যামেরায় তা ধরা পড়বে। ডিসকনটিনিউটি হয়ে যাবে। দেখা যাবে একই দৃশ্যে একবার থুতনির কাছটা মশার কামড়ে ফুলে আছে—আরেকবার ফুলে নেই।
সেলিম ভাইকে দেখে মায়া লাগছে। মনে হচ্ছে উনি পুরোপুরি দিশা হারিয়ে ফেলছেন। নৌকায় করে শান্ত হ্রদ পার হচ্ছিলেন। হঠাৎ তাকে ধাক্কা দিয়ে হ্রদে ফেলে দিয়ে নৌকা উধাও হয়ে গেছে। ভদ্রলোক সাঁতার জানেন না, তারপরেও প্রাণপনে চেষ্টা করছেন ভেসে থাকতে। ভেসে থাকার চেষ্টা করছেন ঠিকই কিন্তু মনে মনে ভাবছেন— ভেসে থাকার দরকার কী ডুবে গেলেই হয়। সেলিম ভাইয়ের গেটাপ খুব ভাল হয়েছে। জিনসের প্যান্ট। প্যান্টের উপর স্ট্রাইপ দেয়া হাফ হাওয়াই সার্ট। সার্টে বেমানান সাইজের দুটা প্রকান্ড পকেট। পকেট ভর্তি জিনিস পত্র। কাঁধে ক্যামেরার ব্যাগ। পায়ে কাপড়ের জুতা। কোমড়ে চামড়ার বেল্টে একটা হালকা নীল রঙের ফেস টাওয়েল গুঁজে দেয়া হয়েছে। তার চুলগুলিকে কিছু একটা করা হয়েছে—ফুলে ফেঁপে আছে। প্রাম করা হয়েছে কি? সুবীরদাকে জিজ্ঞেস করতে হবে। চুলের এই কায়দাটা দরকার ছিল। সুবীরদা আরেকটা খুব ভাল কাজ করেছেন— সেলিম ভাইয়ের গালে নীলচে আভা নিয়ে এসেছেন। যাদের মুখ ভর্তি ঘন দাড়ি তারা শেভ করলে মুখে নীলচে আভা দেখা যায়। পুরুষের ফরসা মুখ থেকে নীলচে জ্যোতি বের হয়ে আসছে–এই দৃশ্যটা আমার খুব ভাল লাগে।
ডিরেক্টর সাহেব সেলিম ভাইয়ের সঙ্গে কথা বলছেন। দৃশ্য বুঝিয়ে দেবেন। বুঝিয়ে দেবার এই কাজটি ভদ্রলোক ভাল করেন। শুধু ভাল না, খুব ভাল। মুগ্ধ হয়ে শুনতে হয়। ডিরেক্টর সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন— কেমন আছ সেলিম?
জ্বি স্যার ভাল।
জ্বি স্যার ভাল — এমন মিন মিন করে বলছ কেন? শক্ত করে বল। এমন ভাবে বল যেন ইউনিটের সবাই শুনতে পায়।
সেলিম ভাই আবারো বললেন–জ্বি স্যার ভাল।
এবার আগের চেয়েও নিচু গলায়।
হয় নি। আরো ফোর্সফুলি বলতে হবে। তুমি এক কাজ কর নাও মাইক্রোফোনটা হাতে নিয়ে বল—জ্বি স্যার ভাল।
তিনি সেলিম ভাইয়ের হাতে ডিরেক্টরের হ্যান্ড মাইক্রোফোন ধরিয়ে দিলেন।
সেলিম বটগাছটার দিকে তাকাও। বটগাছে কয়েকটা হরিয়াল পাখি বসে আছে দেখতে পাচ্ছ? তুমি হ্যান্ড মাইক্রোফোনটা পাখিদের দিকে তাক করে বলবে জ্বি স্যার ভাল। তোমার কথা শুনে যদি একটা পাখিও আকাশে ওড়ে তাহলে তুমি পাশ।
সেলিম ভাই বটগাছের দিকে হ্যান্ড মাইক্রোফোন তাক করলেন। উপস্থিত সবার মধ্যে চাপা কৌতূহল এবং উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ল। সবাই আগ্রহ নিয়ে বটগাছের দিকে তাকিয়ে আছে। পাখি উড়বে কি উড়বে না? সেলিম ভাই তার বাক্য শেষ করতেই এক সঙ্গে চারটা পাখি গাছ ছেড়ে আকাশে উড়ে গেল। আমরা সবাই হাততালি দিতে শুরু করলাম। শুধু পাপিয়া ম্যাডাম হাততালি দিচ্ছেন না। তার হাতে কফির মগ। তিনি কফিতে চুমুক দিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, বকুল একটা ব্যাপার লক্ষ্য করছ। আমাদের ডিরেক্টর সাহেব মানুষ হিসেবে অসম্ভব শার্প। তিনি কী সহজ উপায়ে এই ছেলেটার ইনহিবিশন কাটিয়ে দিয়েছেন দেখলে। এখন সে পুরোপুরি ফ্রী। অভিনয় ভাল করবে। আমি কিছু বললাম না। আমি কান পেতে আছি ডিরেক্টর সাহেব দৃশ্যটা কীভাবে বুঝান তা শোনার জন্যে।
সেলিম দৃশ্যটা তোমাকে বুঝিয়ে দিচ্ছি— তুমি মন দিয়ে শোন। তুমি কে তা-কি তুমি জান?
সেলিম ভাই প্রায় বিড় বিড় করে বললেন, আমি একজন ফটোগ্রাফার। দেশের বাইরেই জীবনের বেশির ভাগ সময় কেটেছে। এখন কিছুদিনের জন্যে দেশে এসেছি। আবার চলে যাব।
দ্যাটস রাইট। তুমি দিলু-নিশাতের ফ্যামিলির সঙ্গে সুসং দুর্গাপুরে বেড়াতে এসেছ। এই পরিবারটির সঙ্গে তোমার তেমন কোন পরিচয় নেই। তারাই তোমাকে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে এসেছে। কেন বলতো? না লজ্জার কিছু নেই বল।
তারা চাচ্ছে এই পরিবারের বড় মেয়েটিকে আমি যেন পছন্দ করি।
ভেরী গুড। বড় মেয়েটি কে? আমাদের পাপিয়া ম্যাডাম।
দ্যাটস রাইট। পছন্দ করলে তারা মেয়েটিকে বিয়ে দিতে পারেন। নিশাতের স্বামী রোড একসিডেন্টে মারা গেছে। তাদের ছোট্ট একটা বাচ্চা আছে। নিশাত যদি অতীত ভুলে গিয়ে আবার বিয়ে করে তাহলে তার জীবন আবার নতুন করে শুরু হতে পারে। সেই শুরুটা আমেরিকার মত বিশাল দেশে হওয়াই বাঞ্ছনীয়। বুঝতে পারছ?
জ্বি স্যার?
তুমি একজন ফটোগ্রাফার। সামান্য কোন ফটোগ্রাফার না। তুমি আমেরিকার মত দেশে নামকরা ফটোগ্রাফার। তোমার তোলা ছবি দিয়ে দুটা ফটোগ্রাফীর বই প্রকাশিত হয়েছে, একজন লেখক এবং একজন ফটোগ্রাফারের মধ্যে পার্থক্য কী জান?
জ্বি না।
একজন লেখক সৌন্দর্য আবিষ্কার করেন এবং সেই সৌন্দর্য ব্যাখ্যা করেন। একজন ফটোগ্রাফারও সৌন্দর্য আবিষ্কার করেন কিন্তু ব্যাখ্যা করেন না। ক্যামেরায় বন্দি করে ফেলার চেষ্টা করেন। বেশির ভাগ সময়ই তারা তা পারেন না। কারণ সৌন্দর্য কখনো বন্দি করা যায় না। ফটোগ্রাফাররা এই তথ্য জানেন না বলে ক্রমাগত ছবি তুলে তুলে এক সময় হতাশাগ্রস্থ হয়ে পড়েন। একজন লেখক বা একজন কবি কখনো হতাশাগ্রস্থ হন না, কারণ তাঁরা কখনো সৌন্দর্য বন্দি করতে চান না। তাদের আগ্রহ ব্যাখ্যায়। আমার বক্তৃতা কেমন লাগছে সেলিম?
সেলিম ভাই কিছু বলার আগেই পাপিয়া ম্যাডাম বললেন, তোমার বক্তৃতা খুব ভাল হচ্ছে। I am impressed.
ডিরেক্টর সাহেব গম্ভীর গলায় বললেন, শোন পাপিয়া, ইচ্ছা করলেই আমি যে কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে নন্দন তত্ত্বের শিক্ষক হতে পারতাম। পৃথিবীর সেরা পাঁচজন ডিরেক্টরের একজন হতে পারতাম, ঔপন্যাসিক হতে পরতাম। কবি হতে পারতাম। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কী হয়েছি— হাতির লাদ। হাতির বিশাল বড় বিষ্ঠা। সাইজে যত বড়ই হোক— শিট ইজ শিট! আচ্ছা ঠিক আছে–সেলিম এসো, মূল দৃশ্যটি তোমাকে বুঝিয়ে দি। কাছে আস।
সেলিম ভাই কাছে এগিয়ে গেলেন। ডিরেক্টর সাহেব তাঁর বাঁ হাতটা তুলে দিলেন সেলিম ভাইয়ের কাঁধে হাত কাঁধে তুলে দিয়ে তিনি আসলে নিঃশব্দে বলার চেষ্টা করছেন— ভয় পেও না, আমি আছি তোমার সঙ্গে। আমি তোমাকে যেভাবে খেলাব— তুমি সেই ভাবে খেলবে। আর কিছু লাগবে না। সেলিম ভাই কি না বলা কথাগুলি বুঝতে পারছেন?
সেলিম!
জ্বি স্যার।
তুমি ক্যামেরা হাতে ঘুরতে বের হয়েছ। হঠাৎ তোমার চোখে পড়ল বটগাছটা। বিশাল গাছ ঝুড়ি নামিয়ে দিয়েছে। দেখে তোমার ভাল লাগল। একবার ভাবলে দৃশ্যটার ছবি তুলবে, তারপর ঠিক করলে–না। ছবি তোলার দরকার নেই। আবার মত পরিবর্তন করলে–ছবি তোলার জন্যে এগুলে। কোন এংগেলে ছবিটা তুলবে, একটু ভাবলে। সূর্যের দিকে তাকিয়ে সূর্যের পজিশন চট করে দেখে নিলে। তারপর ছবিটা তুললে। ছবি তোলার আগমুহূর্ত পর্যন্ত দৃশ্যটির প্রতি তোমার ছিল সীমাহীন মমতা। যেই ছবিটা তোলা হয়ে গেল, ওমি তোমার সমস্ত আগ্রহের অবসান হল। তুমি চলে যাচ্ছ। যে অপূর্ব দৃশ্যটির ছবি তুমি তুললে তার প্রতি এখন তোমার আর কোন মমতা নেই। বুঝতে পারছ?
জ্বি।
তোমাকে আরো সহজ ব্যাখ্যা করি–মনে কর যে দৃশ্যটি তুমি দেখছিলে সেটা আসলে কোন দৃশ্য না। রক্ত মাংসের একজন মানুষ। ধরা যাক অপূর্ব রূপবতী কোন তরুণী। মেয়েটি তোমাকে পাত্তাই দিচ্ছে না। তোমার দিকে ফিরেও তাকাচ্ছে না। সে আছে আপন মনে। তুমি প্রচন্ড অস্থিরতায় ভুগছ। তুমি ভেবে পাচ্ছ না, কেন সে তোমার দিকে তাকাচ্ছে না। দুঃখে কষ্টে তোমার মরে যেতে ইচ্ছা করছে। এমন সময় ম্যাজিক্যাল একটা ব্যাপার ঘটল। মেয়েটি গভীর আবেগ এবং গভীর ভালবাসায় তোমার দিকে তাকাল। সঙ্গে সঙ্গে তোমার সব আগ্রহ শেষ হয়ে গেল। তুমি হেঁটে চলে এলে। মেয়েটির দিকে দ্বিতীয়বার ফিরে তাকানোর ইচ্ছা পর্যন্ত হল না।
সেলিম ভাই কিছু বলছেন না, এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমি তাকালাম পাপিয়া ম্যাডামের দিকে। তিনি চাপা গলায় বললেন, রুমালী, তুমি আমাদের ডিরেক্টর সাহেবের সব কথা বিশ্বাস করবে না। ভালবাসার দৃষ্টি অগ্রাহ্য করে এগিয়ে যাবার ক্ষমতা কোন পুরুষকে দেয়া হয় নি। সে তখনি যেতে পারে যখন তাকে যেতে দেয়া হয়। মেয়েরা তাদের চলে যেতে দেয় বলেই তারা যেতে পারে অথচ পুরুষরা ভাবে নিজের ইচ্ছায় চলে এসেছি। এতে তারা এক ধরনের আত্মপ্রসাদ লাভ করে। আমরা তাদের সেই আত্মপ্রসাদ লাভ করতে দেই।
ডিরেক্টর সাহেব সেলিম ভাইকে নিয়ে চলে যাচ্ছেন। তার একটা হাত এখনো সেলিম ভাইয়ের কাঁধে। তিনি কী বলছেন— আমি শুনতে পাচ্ছি, আমার কান খুব তীক্ষ।
সেলিম শোন–তুমি কোথায় দাঁড়াবে, কোন জায়গা থেকে কোন জায়গায় যাবে সব মার্ক করা আছে। কখন তুমি সূর্যের দিকে তাকিয়ে সূর্যের পজিশন দেখবে–সব বলে দেয়া হবে। একটা ফুল রিহার্সেল হবে। তারপর হবে ক্যামেরা রিহার্সেল। আমরা ট্ৰলী এবং জুম লেন্স ব্যবহার করছি। শট কাটব না। নার্ভাস বোধ করছ নাতো? নার্ভাস বোধ করার কিছু নেই।
সোহরাব চাচা ছুটতে ছুটতে আসছেন। ভদ্রলোক সাধারণ ভাবে হাঁটতে পারেন না। যেখানে যাবেন দৌড়ে যাবেন। তাঁর দৌড়ে আসার ভঙ্গি দেখে মনে হতে পারে ভয়ংকর কিছু ঘটেছে। আমি নিশ্চিত আসলে কিছু ঘটে নি।
মিস রুমাল।
জি চাচা।
আজ তোমার শট হবে না। স্যার তোমাকে মেকাপ তুলে ফেলতে বলেছেন।
জ্বি আচ্ছা।
পাপিয়া ম্যাডাম কঠিন গলায় বললেন, প্ল্যানিং গুলি ঠিকঠাক মত করলে হয়? দুঘন্টা নষ্ট করে মেকাপ নেবার পর বলা হল শট হবে না!
সোহরাব চাচা অমায়িক ভঙ্গিতে হাসলেন। ভাবটা এ রকম যেন মজার একটা গল্প হচ্ছে। আনন্দময় পরিবেশে আনন্দময় গল্প। গল্প শুনে তৃপ্তির হাসি হাসছেন।
ম্যাডাম তরমুজের সরবত খাবেন?
না।
একটু খেয়ে দেখুন, আমার ধারণা খুব ভাল হয়েছে। এক চুমুক খেয়ে দেখুন ভাল না লাগলে ফেলে দেবেন। আমি নিয়ে আসছি।
সোহরাব চাচা আবার ছুটতে ছুটতে চলে যাচ্ছেন। পাপিয়া ম্যাডাম এখন বটগাছটার দিকে তাকিয়ে আছেন। তার ভুরু কুঁচকানো। কে জানে তিনি কী ভাবছেন। আজ বিকেলে তাঁর ঢাকা চলে যাবার কথা। সেই পরিকল্পনা কি এখনো আছে? তার গাড়ির চাকার লিক কি সারানো হয়েছে?
বকুল!
জ্বি আপা।
তোমার মাকে দেখছি না কেন? তুমি আছ অথচ তোমার মা নেই এটাতো ভাবা যায় না।
মার শরীর ভাল না। শুয়ে আছেন।
শরীর ভাল না কেন? কী হয়েছে?
কাল রাতে এক ফোঁটা ঘুমান নি–সকালে শরীর খারাপ করেছে। তাঁর হাঁপানির মত আছে। অনিয়ম করলেই হাঁপানী বাড়ে।
তুমি যাও মেকাপ তুলে মার কাছে গিয়ে বস। ও শোন, তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি, মেকাপম্যান সুবীর বোধহয় তোমাকে খুব পছন্দ করে তাই না?
জ্বি আমাকে মা ডাকেন।
সে যে তোমাকে খুব পছন্দ করে এটা তোমাকে দেখে বোঝা যাচ্ছে। সে তোমাকে যত্ন করে মেকাপ দিয়েছে। তোমাকে সুন্দর লাগছে।
থ্যাংক য়্যু।
সব মানুষের চেহারায় লুকানো সৌন্দর্য থাকে। মেকাপ ম্যানের প্রধান দায়িত্ব সেই সৌন্দর্য বের করে আনা। সবাই তা পারে না। সুবীর পারে। তোমাকে সত্যি সত্যি অপূর্ব লাগছে।
আমার লজ্জা লাগছে। কী বলব বুঝতে পারছি না। পাপিয়া ম্যাডাম বললেন, ও আচ্ছা তোমাকে দেখানোর জন্যে আমি আমার মেয়ের ছবি এনেছি। এই দেখ ছবি। তার ফিফথ বার্থডের ছবি।
আমি আগ্রহ নিয়ে ছবিটা নিলাম। এবং ছবিটার দিকে মন খারাপ করে তাকিয়ে রইলাম। কী বিশ্রী চেহারা মেয়েটির। উঁচু কপাল, পুতিপুতি চোখ, গায়ের রঙ মিশমিশে কাল। সব বাচ্চাদের চোখে মুখে বুদ্ধির ঝঙ্ক থাকে–এই মেয়েটার চেহারার ভেতরও হাবা হাবা ভাব। মাথাভর্তি নিগ্রোদের মত কোকড়ানো চুল। মোটা মোটা ঠোঁট।
পাপিয়া ম্যাডাম ক্ষীণ গলায় বললেন, আমার মা দেখতে ভাল হয় নি কিন্তু ওর খুব বুদ্ধি। তোমাকে একদিন তার বুদ্ধির গল্প বলব।
এখনি বলুন।
না এখন না। অন্য একদিন। এখন আমি তোমাকে একটা ইন্টারেস্টিং অবজারভেশনের কথা বলি। মঈন যখন দৃশ্য বুঝাচ্ছিল তুমি অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে ছিলে। একবারও তুমি সেলিমের দিকে তাকাও নি। তুমি মঈনের দিকে তাকিয়ে ছিলে। আমি দেখলাম তোমার ঠোঁট এবং হাতের আঙ্গুল কাঁপছে। ব্যাপারটা কী?
আমি চুপ করে আছি। পাপিয়া ম্যাডাম বললেন, ঠিক করে বলতো তুমি কি এই মানুষটির প্রেমে পড়েছ?
আমি হকচকিয়ে বললাম, জ্বি না। জ্বি না।
মাটির দিকে তাকিয়ে জ্বি না জ্বি না করছ কেন? আমার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে অসুবিধা কোথায়? তাকাও আমার দিকে।
আমি তাকালাম, এবং দীর্ঘ কিছু সময় দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে রইলাম। উনিও কিছু বললেন না, আমিও না।
সোহরাব চাচা জগ এবং গ্লাস নিয়ে ছুটতে ছুটতে আসছেন। এই সব কাজ প্রোডাকশন বয়দের করার কথা। সোহরাব চাচার তা নিয়ে কোন মাথা ব্যথা নেই। জগে গাঢ় লাল রঙের সরবত দেখতে এত সুন্দর লাগছে।
সোহরাব চাচা একটা মাত্র গ্লাস এনেছেন। তরমুজের সরবত আমার জন্যে আসে নি শুধু ম্যাডামের জন্যে। মা থাকলে তার ভুরু কুঁচকে যেত। উনি ম্যাডামের সামনে কিছু বলতেন না, কিন্তু সোহরাব চাচাকে ঠিকই ধরতেন— আমার মেয়ে বৃষ্টির ফোঁটার সঙ্গে আকাশ থেকে পড়ে নি। সে ফেলনা না। সে এই ছবির দুই নম্বর নায়িকা। তার জন্যেও তরমুজের সরবত লাগবে।
পাপিয়া ম্যাডাম সরবতের গ্লাসে চুমুক দিয়ে বললেন–বাহ ভাল হয়েছেতো। লেবু লেবু গন্ধ আসছে কেন?
সামান্য লেবু দেয়া হয়েছে।
ভাল। বেশ ভাল। আমি আরেক গ্লাস খাব।
জ্বি ম্যাডাম–এই জগটা আপনার জন্যে।
থ্যাংক য়্যু।
সোহরাব চাচা নিচু গলায় বললেন, একটা প্রবলেম হয়েছে?
পাপিয়া ম্যাডাম বললেন, কী প্রবলেম? ফরহাদ সাহেব এসে পৌঁছেছেন?
সোহরাব চাচা হ্যাঁ সূচক মাথা নাড়লেন। আমি পাপিয়া ম্যাডামের অনুমান শক্তি দেখে মুগ্ধ হলাম। সোহরাব চাচা যেই বললেন, একটা প্রবলেম হয়েছে উনি সঙ্গে সঙ্গে প্রবলেম ধরে ফেললেন। আমি কখনো পারতাম না।
শুটিং কি হচ্ছে না বন্ধ?
ক্যামেরা এখনো ওপেন হয় নি।
ডিরেক্টর সাহেব কী জানেন যে ফরহাদ সাহেব এসেছেন?
জ্বি জানেন। আমি আসামাত্র খবর দিয়েছি।
ডিরেক্টর সাহেব এখন কি করবেন? সেলিমকে নিয়ে কাজ করবেন, না ফরহাদ সাহেবকে নিয়ে?
আমি জানি না ম্যাডাম আমি হলাম আদার ব্যাপারি। এসব বড় বড় ব্যাপার।
পাপিয়া ম্যাডামের গ্লাস শেষ হয়ে গেছে। তিনি খালি গ্লাস বাড়িয়ে দিয়ে বললেন, দেখি আরেকটু দিন।
সোহরাব চাচা গ্লাস ভর্তি করে দিলেন।
ম্যাডাম শান্ত গলায় বললেন, আমি আর খাব না। জগের সরবত অন্য কাউকে দিয়ে দিন।
জ্বি আচ্ছা।
ম্যাডাম গ্লাস হাতে এগিয়ে যাচ্ছেন। একটু আগে যে মগ দিয়ে কফি খাচ্ছিলেন সেই মগটা গাছের নীচে পড়ে আছে। সেই দিকে ফিরেও তাকালেন না। মগটা খুব সুন্দর। নিশ্চয়ই বিদেশ থেকে আনানো। ধবধবে শাদা মগে টকটকে লাল অক্ষরে লেখা— KISS ME.
আমি মগটা তুলে সোহরাব চাচার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বললাম, চাচা একটু সরবত দিয়ে মগটা ধুয়ে আমাকে দিনতো। আমার খুব লোভ লাগছে।
তোমার খাওয়ার দরকার নেই।
দরকার নেই কেন?
এটা প্লেইন সরবত না। এখানে ভদকা মেশানো আছে।
ভদকা মেশানো সরবতই খেয়ে দেখি কেমন লাগে। বেশি না— সামান্য।
সোহরাব চাচা বললেন, না।
তাকে খুবই চিন্তিত মনে হচ্ছে। ফরহাদ সাহেব হঠাৎ এসে পড়ায় তিনি মনে হয় দারুণ চিন্তায় পড়ে গেছেন। এতটা চিন্তিত হবার মত কিছু ঘটেছে কি?
মিস রুমাল!
জি চাচা?
শুধু শুধু গাছের নীচে দাঁড়িয়ে আছ কেন? ঘরে চলে যাও। মেকাপ উঠিয়ে বিশ্রাম কর। তোমার মা তোমার খোঁজ করছিলেন। তাঁর জ্বরতো ভাল বেড়েছে। একশ তিন। মাথায় পানি দিয়ে জ্বর কমাতে বলেছি। সিটামল খাওয়ানো হয়েছে। একজন ডাক্তার খবর দিয়েছি সন্ধ্যাবেলা আসবেন।
ভাল। আপনি কাজকর্ম ফেলে আমার সঙ্গে চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছেন কেন? কিছু বলবেন?
উপদেশ?
উপদেশ না— আদেশ! তুমি ফরহাদ সাহেবের কাছ থেকে সব সময় একশ হাত দূরে থাকবে।
কেন উনি কি ঘাতক ট্রাক?
কেন টেনো না, তোমাকে দূরে থাকতে বলছি— তুমি দূরে থাকবে।
আচ্ছা–জামিল আহমেদের ভূমিকায় যিনি অভিনয় করছেন, মিজানুর রহমান। উনার কাছ থেকে কত হাত দূরে থাকব?
উনার কাছ থেকে দূরে থাকার দরকার নেই। উনি দিন রাত মদ খান। এইটাই তার একমাত্র দোষ। মদ খাওয়ার দোষটা না থাকলে তাকে ফেরেশতা বলা যেত। আল্লাহপাকতো মানুষকে ফেরেশতা বানিয়ে পাঠান না–দোষ ত্রুটি দিয়েই পৃথিবীতে পাঠান। মিজান সাহেবকে নেশারু বানিয়ে পাঠিয়েছেন।
একজন মদ খাচ্ছে সেই দোষও আল্লাহর ঘাড়ে গিয়ে পড়ল। আল্লাহ্ নেশারু বানিয়ে পাঠিয়েছেন বলে নেশা করছে!
আচ্ছা বাবা যাও আল্লাহ্ বানিয়ে পাঠায় নি। সে নিজে নিজে হয়েছে।
আমি হাই তুলতে তুলতে বললাম, আমাদের ডিরেক্টর সাহেব সম্পর্কে বলুন, উনার কাছ থেকে কত হাত দূরে থাকতে হবে তাতো বললেন না। মজার ব্যাপার কী জানেন চাচা–উনার কাছ থেকে কত হাত দূরে থাকতে হবে তা আপনি জানেন। তার ভেতরে মন্দ কী আছে তাও আপনি খুব ভাল জানেন। জানলেও আপনি কোনদিন মুখ ফুটে কাউকে বলতে পারবেন না। কারণ আপনার সেই ক্ষমতা নেই।
সোহরাব চাচা বিস্মিত হয়ে বললেন–ব্যাপারটা কী? হড়বড় করে এত কথা বলছ কেন? এত তর্ক কোথায় শিখলে?
আমি তর্ক শিখেছি আমার মার কাছে। মা যে কথাই বলেন আমি তার উল্টোটা বলি। উল্টো যুক্তি দাঁড়া করাই। এমনও হয়েছে যে শেষটায় এসে হাল ছেড়ে দিয়ে মা কাঁদতে বসেছেন। তাই বলে আমি কথা থামাই নি। আমি আমার কথা বলেই গিয়েছি।
আমার হঠাৎ আক্রমণে সোহরাব চাচা হকচকিয়ে গিয়েছেন। কেঁদে ফেলার আগমুহূর্তে মাকে যেমন দেখায় তাকে এখন তেমনই দেখাচ্ছে। কাজেই আমি থাকলাম না। আমি আমার কথা বলেই যেতে লাগলাম–
সোহরাব চাচা শুনুন। আপনি আমাকে তরমুজের সরবত খেতে দিলেন না। কারণ এখানে ভদকা মিশানো। আপনি পিতৃসুলভ একটা ভাব ধরলেন। আপনাদের ডিরেক্টর সাহেব যদি এখন একটা গ্লাসে এই সরবত ঢেলে আমার দিকে এগিয়ে বলেন–বকুল নাও খাও? আর তখন যদি আপনি সামনে থাকেন। আপনি কি বলতে পারবেন, মিস রুমাল সরবত খেও না। এর মধ্যে ভদকা মেশানো আছে।
স্যার এই জাতীয় কথা কখনো বলবেন না।
কখনো বলবেন না?
না কখনো বলবেন না। তুমি তাকে কতদিন ধরে দেখছ? এই অল্প কিছু দিন। আমি বৎসরের পর বৎসর তাঁর সঙ্গে কাজ করেছি। আমি তাকে চিনি।
আপনার ধারণা তিনি একজন মহাপুরুষ?
আমার কাছে অবশ্যই মহাপুরুষ।
সোহরাব চাচা শুনুন। মহাপুরুষ টুরুষ কিছু না, উনি একজন প্রতিভাবান মানুষ, তবে নিম্ন শ্রেণীর মানুষ। মাঝে মাঝে খুব নিম্নশ্রেণীর মানুষও অসাধারণ প্রতিভা নিয়ে জন্মায়। উনার ক্ষেত্রেও তাই ঘটেছে।
এইসব কী বলছ?
সত্যি কথা বলছি।
আমার কাছে বলছ ভাল কথা, আর কারো কাছে এই জাতীয় কথা ভুলেও বলবে না।
বললে কী হবে? ডিরেক্টর সাহেব আমাকে শাস্তি দেবেন? নীল-ডাউন করে রাখবেন? কানে ধরে সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকতে হবে?
তোমার হয়েছেটা কী বলতো?
আমার খুব খারাপ লাগছে।
কেন খারাপ লাগছে?
আমি নিঃশ্বাস ফেলে সহজ ভঙ্গিতে প্রায় হাসি হাসি মুখে বললাম, ফরহাদ সাহেব এসে পড়েছেন এই জন্যেই আমার খারাপ লাগছে।
তোমার খারাপ লাগার কী আছে?
যেহেতু বিখ্যাত অভিনেতা মেগাস্টার, গ্যালাক্সিস্টার মিস্টার ফরহাদ চলে এসেছেন সেহেতু সেলিম নামের মানুষটি এখন বাদ পড়ে যাবে। আপনার মহাপুরুষ ডিরেক্টর সাহেবের এত ক্ষমতা নেই যে ফরহাদ সাহেবকে বাদ দিয়ে পথের মানুষকে দিয়ে অভিনয় করাবেন। যদিও ইচ্ছা করলেই তিনি তা পারেন। সেলিম নামের এই পথের ছেলেটিকে মেগাস্টার, গ্যালাক্সিস্টার বানানো তাঁর কাছে কোন ব্যাপারই না।
সোহরাব চাচা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে বললেন–ও আচ্ছা এই ব্যাপার। যেন তার বুক থেকে পাষান ভার নেমে গেছে। আমি বললাম, সোহরাব চাচা শুনুন সেলিম নামের মানুষটাকে উনি বাদ দিয়ে দেবেন। বেচারা এম্নিতেই ছোট হয়ে থাকে— এখন আরো ছোট হয়ে আমাদের সঙ্গেই থাকবে–আমাদের সঙ্গেই ঘুরবে। ভাবতেই খারাপ লাগছে!
খারাপ লাগার কিছু নেই মা। সবই ভাগ্য। ভাগ্য ব্যাপারটা যে কী তা ছবির লাইনের লোক ছাড়া কেউ বুঝবে না। দুশ টাকা শিফটের এক্সট্রা মেয়েকে আমি নিজে কোটিপতি হতে দেখেছি। আবার দেখেছি কোটিপতি থেকে দুশ টাকা দামের এক্সট্রা হয়েছে। সবই ভাগ্য। সেলিমের ভাগ্যে যে জিনিস নাই সে জিনিস তার হবে না।
সবই ভাগ্য?
অবশ্যই ভাগ্য। তোমার নিজের কথাই ধর। দিলু চরিত্র তোমার করার কথা ছিল না। অন্য একজনকে সাইনিং মানি দেয়া হয়েছিল। হঠাৎ স্যার একদিন কোন এক ম্যাগাজিনে তোমার ছবি দেখলেন। আমাকে বললেন, তোমাকে খবর দেয়ার জন্যে। আমি তোমাকে খবর দিলাম। স্যারের পছন্দ হল না। তোমরা চলে গেলে। যেদিন দুর্গাপুর রওনা হব তার একদিন আগে বললেন, বকুল মেয়েটাকে খবর দাও। এটা ভাগ্য না?
আমি চুপ করে রইলাম। সোহরাব চাচা গম্ভীর গলায় বললেন, আমরা নিজের মনে খেলে যাচ্ছি। খুব আনন্দ, ভাল খেলা হচ্ছে। সুতা কিন্তু অন্যের হাতে।
আমি ঘরের দিকে রওনা হলাম। সোহরাব চাচা আমার পেছনে পেছনে আসছেন। হঠাৎ আমার মনে হল–সোহরাব নামের এই মানুষটা সম্পর্কে আমি কিছুই জানি না। তার ছেলেমেয়ে কয়জন। কার কী নাম–কিছুই জানা নেই। অথচ কর ঘনিষ্ট ভাবে মিশছি। ছবি শেষ হয়ে যাবে আর তার সঙ্গে কোণ যোগাযোগ থাকবে না।
সোহরাব চাচা?
মা বল।
যে গাছটার নীচে আমি দাঁড়িয়েছিলাম সেই গাছটার নাম কী?
ছাতিম গাছ। গাছের নাম দিয়ে কী হবে?
এম্নি। জানতে ইচ্ছে করল। একজন অবশ্যি বলেছে–কাঠবাদাম গাছ। আপনারটা ঠিক, না তারটা ঠিক কে জানে।
সোহরাব চাচা গাছ প্রসঙ্গে কিছু বললেন না, চিন্তিত গলায় বললেন— রোদের মধ্যে হেঁটে যেও না। আমি তোক দিয়ে দিচ্ছি। মাথার উপর ছাতি ধরবে।
কিচ্ছু ধরতে হবে না।
আমি সোহরাব চাচাকে পেছনে ফেলে দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছি। হাঁটার গতি আরো বাড়ালাম। আমাকে এই ভাবেই দৌড়ে পুকুর ঘাটে যেতে হবে। তারপর হঠাৎ পুকুরের পানিতে নিজের ছায়া দেখে চমকে যেতে হবে। শাড়ি পরে দৌড়ানো মুশকিল। দৌড়টা ভাল হচ্ছেতো? নকল দৌড় মনে হচ্ছে নাতো? স্যান্ডেল পায়ে দৌড়ানো যাচ্ছে না। খালি পায়ে দৌড়াতে হবে। খালি পা হব কী ভাবে? পা থেকে স্যান্ডেল ফেলে দেয়ার পেছনে কী যুক্তি দাঁড় করাব?
আশ্চর্য, ফরহাদ সাহেব মেকাপে বসেছেন। সুবিদা গম্ভীর মুখে কাজ করে যাচ্ছেন। ফরহাদ সাহেব টেবিলে পা তুলে প্রায় আধশোয়া হয়ে আছেন। তার চোখ বন্ধ। টেবিলের উপর বিয়ারের ক্যান। ক্যানের উপর মাছি উড়ছে। বিয়ার খেতে কি মিষ্টি? মিষ্টি না হলে মাছি উড়বে কেন? সেলিম ভাইকে তাহলে বাদ দেয়া হয়েছে। সাব্বিরের চরিত্র করছেন— মেগাস্টার ফরহাদ খান। যার যা ইচ্ছা করুক। আমাদের খেলার কথা আমরা খেলছি। কেউ ভাল খেলছি, কেউ মন্দ খেলছি। সুতাতো আমাদের হাতে নেই।
মা শরীর এলিয়ে পড়ে আছেন। তার চোখ বন্ধ, মাথার চুল ভেজা। মাথায় পানি ঢালা মনে হয় কিছুক্ষণ আগে শেষ হয়েছে। আমি পাশে দাঁড়াতেই চোখ মেললেন। মার প্রথম বাক্যটা হল— ঠোঁটের লিপস্টিক ভাল হয় নিতো।
আমি বললাম, তোমার শরীর এখন কেমন?
মা বললেন, শরীর কেমন সেটা পরের কথা। মেকাপ কেমন হল তুই আমাকে দেখিয়ে যাবি না? মেকাপ শেষ হল আর তুই চলে গেলি?
আমি এসেছিলাম, তুমি ঘুমুচ্ছিলে বলে জাগাই নি।
আবার মিথ্যা কথা। মিথ্যা কথা বলতে তোর মুখে একটু আটকাল না— ফাজিল মেয়ে—
মা উঠে বসলেন এবং আমি কিছু বোঝার আগেই প্রচন্ড চড় বসালেন। চড়ের জন্যে প্রস্তুত ছিলাম না বলে বিছানায় কাত হয়ে পড়ে গেলাম। সঙ্গে সঙ্গেই উঠে বসলাম। কিছুই হয় নি এমন ভঙ্গিতে বললাম, সকালে কিছু খেয়েছ মা?
না। তুই কি আয়না দিয়ে দেখেছিস তোকে কেমন বিশ্রী মেকাপ দিয়েছে? নাকটা মোটা লাগছে।
মোটা নাকতো মা মেকাপ দিয়ে চিকন করা যাবে না। ব্লেড দিয়ে কেটে ঠিক করতে হবে।
আমার কাছে জ্ঞান ফলাবি না। নাকে শেড দিয়ে মোটা নাকও চিকন করা যায়। তুই এক নম্বর নায়িকা হলে ঠিকই করত। দুই নম্বর নায়িকাতো, নাক মোটা থাকলেই বা কী, চিকন থাকলেই বা কী? কী ব্যাপার তুই যাচ্ছিস কোথায়?
মেকাপ তুলতে যাই।
শট হবে না?
না।
আমি জানতাম আজ তোর শট হবে না।
কীভাবে জানতে?
আজ মঙ্গলবার না? মঙ্গলবার তোর জন্যে অশুভ। আমি সব সময় দেখেছি
তোমার জন্যে কোনবারটা অশুভ মা?
তোর জন্যে যে বার অশুভ, আমার জন্যেও সে বার অশুভ। তুই আর আমি–-আমরাতো আলাদা না।
আমি বাথরুমে ঢুকে গেলাম। মেকাপ দেয়া যেমন কষ্টের মেকাপ তোলাও তেমন কষ্টের। খুবই বিরক্তিকর ব্যাপার। গ্লিসারিণ দিয়ে ঘষে ঘষে তুলতে হয়। জোরে ঘষা লাগলে চামড়া উঠে যায়–যন্ত্রণা হয়। সবচে কষ্ট চোখের মেকাপ তোলা। চোখ জ্বালা করে।
মেকাপ তোলার পর আয়নায় নিজেকে দেখলাম। বাহ সুন্দর লাগছেতো। মিষ্টি একটা মুখ। সহজ সুন্দর এবং সরল। এই মুখের দিকে তাকিয়ে কারোর কি কোন দিন বলতে ইচ্ছে করবে–
আমি এনে দেব
তোমার উঠোনে সাতটি অমরাবতী।
ডান গাল লাল হয়ে আছে। মার চড় গালে বসে গেছে। আগে ব্যথা করে নি এখন চিনচিনে ব্যথা হচ্ছে। ব্যথাটা কিছুক্ষণের মধ্যেই মাথায় উঠে যাবে।
আমি খুব শিগগিরই একদিন কঠিন গলায় মাকে বলব— মা তুমি আর কখনো আমার গালে হাত দেবে না। কখনো না। সেই শিগগিরটা কবে?
বকু! বকু?
আমি বাথরুম থেকেই মিষ্টি গলায় বললাম, কী হয়েছে মা?
তুই নিজে নিজে মেকাপ তুলছিস কেন? সুবীরকে বল। তুই দুই নম্বর নায়িকা হয়েছিস বলেই সব কাজ নিজে নিজে করবি?
সুবীরদা ব্যস্ত। ফরহাদ সাহেবকে মেকাপ দিচ্ছেন।
ও আচ্ছা ভুলেই গেছি ফরহাদ সাহেবতে চলে এসেছেন। সেলিম গাধাটা গালে জুতার বাড়ি খেয়েছে। উচিত শিক্ষা হয়েছে। পিপিলিকার পাখা উঠলে যা
মা এইসব তুমি কী বলছ?
ঠিকই বলছি। যে চামড়া দিয়ে জুতার শুকতলা বানানো হয়—সেই চামড়া দিয়ে কখনো মানিব্যাগ হয় না।
আমি বাথরুম থেকে বের হলাম। মার দিকে তাকিয়ে হাসলাম। মিষ্টি করে হাসলাম। ক্যামেরায় ছবি তোলার সময় দেখি হাসতো বললে যে ভঙ্গিতে দাঁত বের না করে মুখ টিপে হাসা হয়, সেই ভঙ্গির হাসি। তারপর মাকে কিছু না বলে ঘর থেকে বের হয়ে এলাম।
জালালের মা আমাকে দেখতে পেয়ে এগিয়ে আসছে। তার এগিয়ে আসার মধ্যে কেমন ভিজে বিড়াল ভিজে বিড়াল ভাব। গোপন কোন ঘটনা সে বোধ হয় জেনে ফেলেছে। গোপন ঘটনায় নতুন কিছু ডালপালা লাগিয়ে সে এখন বলবে।
বকুল আপা!
হুঁ।
সরবত খাবেন?
কিসের সরবত?
তরমুজের সরবত।
হ্যাঁ খাব।
এর মধ্যে একটু ইয়ে দেওয়া আছে। সরবত মিজান ভাই বানিয়েছেন। উনি আবার ইয়ে ছাড়া কিছু বানাতে পারেন না।
ইয়ে টা কী?
ভদকা। খুবই সামান্য দিয়েছেন যাতে মেয়েরাও খেতে পারে। নেশা হবে। খাবেন আপা?
হুঁ খাব।
ভদকার মজাটা কী জানেন আপা?
না জানি না–কী মজা?
খেলে মুখে গন্ধ হয় না।
তাহলেতো খুবই ভাল। চলুন যাই ভদকা খাই।
ছিঃ ছিঃ ভদকা না। সরবত। পাঞ্চ। সামান্য ইয়ে দেওয়া।
চলুন আজ মজা করে সামান্য ইয়ে মেশানো সরবত খাব। মা জানবে নাতো?
পাগল হয়েছেন আপা? কাকপক্ষী জানব না। আপনি পুকুর ঘাটে যান আমি আসতেছি।
আমি পুকুরঘাটের দিকে রওনা হলাম। পুকুরটা বিশাল। তবে পুকুরের পানির দিকে তাকালে মন খারাপ হয়ে যায়। ময়লা পানি। নানান জায়গায় বাঁশ পোতা হয়েছে। মাছের চাষ করলে নাকি সারা পুকুরে বাঁশ পুততে হয়। একটা ঘাট আছে—সেই ঘাটও ভাঙ্গা। তবে পুকুরের চারদিকে গাছ পালা। পুকুরের মালিক আসলাম খাঁ। পীর মানুষ। তাঁর কথা পরে বলব। তিনি খুব আনন্দিত গলায় অদ্ভুত ধরনের শুদ্ধ ভাষায় বলেছিলেন–আপা দেখেন এমন কোন গাছ নাই যাহা আমি রুপন করি নাই। যেখানে যত বৃক্ষ পেয়েছি রুপন করিয়াছি।
আমি বললাম, কী কী গাছ রুপন করেছেন একটু বলুনতো। ভদ্রলোক গড়গড় করে পড়া মুখস্ত করার মত বললেন—কাঁঠাল, আম, জলফই, জামরুল, জাম্বুরা, কৎবেল, আতা, লেচু। বসতবাড়িতে লেচু গাছ রুপন করা ঠিক না। নির্বংশ হয়, তারপরেও শখ করে লাগিয়েছি। লেচু যখন পাকে তখন খুবই বাদুরের উৎপাত হয়।
লিচু কখন পাকে?
জ্যৈষ্ঠমাসের আগে এখন ফুল ফুটেছে এই দেখেন ফুল।
আমি মুগ্ধ চোখে লিচু গাছের ফুল দেখলাম। সবুজ ফুল। গাছ ছেয়ে আছে বুজ রঙের ফুলে। আমের মুকুলও সবুজ হয় কিন্তু সবুজের মধ্যেও হলুদ ভাব থাকে। লিচু ফুলে সেই হলুদ ভাব নেই।
আমি লিচু গাছের নীচে বসলাম। বসার জায়গাটা সুন্দর। ঘাস আছে। গাছে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসা যায়। পুকুরের পানি আরো পরিষ্কার হলে বসে থাকতে খুব ভাল লাগত। জালালের মা টিনের একটা জগ এবং দুটা চায়ের কাপ নিয়ে উপস্থিত হল। তার চোখ চকচক করছে। কথা বলার ধরনও পাল্টে গেছে। ফিস ফিস করে কথা বলছে। আমি এক চুমুকে গ্লাস শেষ করলাম। তিতকুট একটা ভাব আছে কিন্তু খেতে ভাল।
আফা কেমন লাগছে?
খুব ভাল। নেশা হচ্ছে।
কী যে কন আফা এক কাপে কী হইব।
দাও আরেক কাপ দাও।
জালালের মা খুব আগ্রহ করে আরেক কাপ দিল। তারপর আরেক কাপ, আবার আরেক কাপ।
আফা আর খাইয়েন না।
কেন আর পাবো না কেন?
আচ্ছা মনে চাইলে খান। সিগারেট খাবেন? মদের উপরে সিগারেটের ধোয়া পড়লে নিশা ভাল হয়।
সিগারেট? হুঁ খাব।
শাড়ির আঁচলের ভাঁজ থেকে ফাইভ ফিফটি ফাইভের প্যাকেট বের হল। দেয়াশলাই বের হল। আমি সিগারেট ধরিয়ে আরেক কাপ সরবত নিলাম। মাথা সামান্য ঝিম ঝিম করছে। এর বেশিতো কিছু হচ্ছে না। এই ঝিম ঝিমটা সিগারেটের ধোয়ার জন্যেও হতে পারে। আমি পুরোপুরি মাতাল হতে চাচ্ছি। মাতাল হলে কেমন লাগে দেখতে চাই। মাতাল কি হব?
আফা!
হুঁ।
কাল রাতের ঘটনা কিছু শুনেছেন?
না, কী ঘটনা?
খুব লইজ্জার ব্যাপার।
জালালের মা এম্নিতে শুদ্ধ ভাষায় কথা বলে। এখন ভদকার ঝেকেই হয়ত গেরাইম্যা ভাষা বের হচ্ছে। লজ্জাকে বলছে–লইজ্জা। আমি বললাম লইজ্জার ব্যাপারটা কী?
বাদ দেন। সব শোনা ভাল না।
তাহলে বাদই থাক।
আমি মনে মনে হাসছি। জালালের মা লইজ্জার ব্যাপারটা বলার জন্যে মরে যাচ্ছে। আমি বাদ দিতে বললেও সে বাদ দেবে না।
ফিলিম লাইনে সুখ নাই আফা।
কোন লাইনে সুখ?
সব লাইনে সুখ–ফিলিম লাইন বাদ। কাল রাতে যে লইজ্জার ঘটনা ঘটেছে এই ঘটনা ফিলিম লাইন ছাড়া ঘটে না। আপনের বয়স অল্প আপনেরে বলা ঠিক না।
থাক তাহলে বলবেন না।
ঘটনা ঘটেছে রাত তিনটায়।
থাক থাক বলবেন না।
জালালের মার মনটা খারাপ হয়ে গেল। জগের সরবত শেষ হয়ে গেছে। সে আরো সরবত আনতে গেছে। আমার ঘুম পাচ্ছে। ভদকার নেশায় কি ঘুম পায়? শরীরও কেমন অবশ অবশ লাগছে। ভ্যাপসা গরমটাও আরামদায়ক মনে হচ্ছে। দূরের গারো পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকতে ভাল লাগছে। পাহাড় খুব উঁচু না–তারপরও মনে হচ্ছে শাদা শাদা মেঘ পাহাড়ের গায়ে লেগে আছে। নজরুলের একটা গান আছে না? পাহাড়ে হেলান দিয়ে আকাশ ঘুমায় ঐ। গানটা ঠিক হয় নি। পাহাড়ের গায়ে হেলান দিয়ে আকাশ ঘুমুচ্ছে না–আসলে আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে পাহাড় ঘুমুচ্ছে। জালালের মা আসছে না। আমি কুণ্ডুলী পাকিয়ে শুয়ে পড়েছি। রোদ আমার গায়ে পড়ছে। আমার নড়তে ইচ্ছে করছে না। রোদটাও ভাল লাগছে। ভদকা খেলে কি সবই ভাল লাগে? আমি গভীর ঘুমে তলিয়ে গেলাম। ঘুমিয়ে পড়ার আগে আমার কেন জানি মনে হল–ঘুম থেকে জেগে উঠে দেখব আমি অন্য এক মানুষ। আমার নাম রুমালী নাঅন্য কিছু। আমি দুর্গাপুরের এক গন্ডগ্রামে লিচু গাছের নীচে শুয়ে নেই। আমি শুয়ে আছি ঝাউ গাছের নীচে–একটু দূরেই সমুদ্র। সমুদ্র খুব অশান্ত। বড় বড় ঢেউ উঠছে। আমার চারপাশে কেউ নেই। সমুদ্রে প্রবল জোয়ার এসেছে। পানি বাড়ছে। পানি এগিয়ে আসছে আমার দিকে। যে কোন মুহূর্তে প্রবল একটা ঢেউ এসে আমাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে। যাক ভাসিয়ে নিয়ে যাক। আমি কেয়ার করি না। I dont care.