৫
রশিদ মোল্লার বয়স পঞ্চাশের কাছাকাছি।
মোটাসোটা মানুষ। শরীরের তুলনায় মাথা ছোট। ধূর্ত চোখ। চোখ দেখেই মনে হয়—পৃথিবীর কাউকে তিনি বিশ্বাস করেন না। সম্ভবত নিজেকেও করেন না। কলিংবেল টেপার পর ভদ্রলোক নিজেই দরজা খুলে দিলেন। তবে হাত দিয়ে দরজা ধরে থাকলেন। মনে হচ্ছে তিনি চান না ঘরে কেউ ঢুকুক।
মিসির আলি বললেন, আপনি কি রশিদ মোল্লা?
‘জি।’
‘একটু কথা ছিল আপনার সঙ্গে।
‘বলুন।’
‘দরজায় দাঁড়িয়ে তো কথা বলা যাবে না। বসতে হবে। মিনিট দশেক সময় আমি নেব।’
‘এখন আমি নাতনিকে পড়াচ্ছি। ওর এস.এস.সি পরীক্ষা।’
‘আমি না হয় অপেক্ষা করি। নাতনির পড়া শেষ করে আসুন।
রশিদ মোল্লা বিরস মুখে দরজা ছেড়ে সরে দাঁড়ালেন। বসার ঘর ছোট হলেও সুন্দর করে সাজানো। সবচেয়ে যা আশ্চর্যের ব্যাপার তা হচ্ছে—ফুলদানি ভর্তি টাটকা গোলাপ। মনে হচ্ছে এইমাত্র গাছ থেকে ছিঁড়ে আনা হয়েছে।
রশিদ মোল্লা বিরক্ত গলায় বললেন, কী বলবেন বলুন। আপনার নাম কী? কোত্থেকে এসেছেন?
‘আমার নাম মিসির আলি।’
রশিদ মোল্লা চমকাল না। এই নাম আগে শুনেছে তেমন কোনো লক্ষণও দেখাল না। অথচ তাঁর নাম এই লোক শুনেছে। তাঁর খবর দিয়ে এসেছে মুশফেকুর রহমানের মার কাছে।
রশিদ মোল্লা কঠিন গলায় বলল, আমার কাছে কী ব্যাপার?
‘কয়েকটা ব্যাপার জানতে চাচ্ছিলাম। ইচ্ছা হলে জবাব দেবেন। ইচ্ছা না হলে জবাব দেবেন না।’
‘আপনি কে, কেন প্রশ্ন করছেন তা তো বলবেন! আপনি কি পুলিশের লোক?’
‘জি না।’
‘প্রশ্নটা কী?
‘মুশফেকুর রহমানের ম্যানেজার হিসেবে আপনি কতদিন ধরে কাজ করছেন?’
‘তা দিয়ে আপনার দরকার কী?’
‘আমার জানা দরকার।’
‘আপনার দরকার কেন?’
‘আমি একটা বিষয় নিয়ে অনুসন্ধান করছি।’
‘কী বিষয়?’
‘মুশফেকুর রহমান প্রতি মাসে আপনাকে পাঁচ হাজার টাকা দেন তাঁর মাকে দেওয়ার জন্যে। তাঁর মা দু হাজার টাকা রাখেন। আমার ধারণা—বাকি তিন হাজার টাকা তিনি জমা রাখেন আপনার কাছে। বছরে হয় ছয়ত্রিশ হাজার টাকা। দশ বছরে হবে তিন লক্ষ ষাট হাজার টাকা। আপনি কতদিন ধরে টাকা দিচ্ছেন?’
‘আপনাকে কে পাঠিয়েছে?’
‘কেউ পাঠায় নি। নিজেই এসেছি। আমি যে আপনার কাছে একেবারেই অপরিচিত, তাও কিন্তু না। আপনার স্যার নিশ্চয়ই আমার কথা আপনাকে বলেছেন। কতদিন ধরে আপনি টাকা দিচ্ছেন?’
‘আমার মনে নাই।’
‘আপনি তো রসিদ রাখেন। পুরোনো রসিদ কি আপনার কাছে আছে, নাকি অফিসে জমা দিয়েছেন।?’
রশিদ মোল্লা ক্লান্ত গলায় বললেন, স্যার, আপনি বসুন।
মিসির আলি বসলেন। রশিদ মোল্লা বললেন, ‘চায়ের কথা বলে আসি। আপনি চা খান তো?’
‘খাই।’
ভদ্রলোক চায়ের কথা বলে মিসির আলির সামনে বসলেন। তাঁর চোখে ভীত ভাব। মনে হচ্ছে অসম্ভব ভয় পেয়েছেন। এতটা ভয় পাবার কারণও মিসির আলির কাছে স্পষ্ট নয়।
‘রশিদ সাহেব!’
‘জি।’
‘ঐ মহিলার কত টাকা আপনার কাছে আছে তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা নেই। আমি অন্য কিছু আপনার কাছ থেকে জানতে চাই। যা জানতে চাই দয়া করে বলবেন। মিথ্যা বলার চেষ্টা করবেন না। কারণ…থাক, কারণটা এখন আপনাকে না বললেও চলবে।’
‘কী জানতে চান, স্যার?’
‘মুশফেকুর রহমান সাহেব সম্পর্কে বলুন।’
‘কী বলব?’
‘যা জানেন বলুন। উনি লোক কেমন?’
‘খুবই ভালো লোক। এটা আমার একার কথা না—যাকে ইচ্ছা আপনি জিজ্ঞেস করুন। যাকে জিজ্ঞেস করবেন সেই বলবে। উনার জিহ্বার একটা সমস্যা আছে। তাঁকে নিয়ে এই জন্যে লোকজন নানা আজেবাজে কথা ছড়ায়।’
‘কী ধরনের আজেবাজে কথা?’
‘যেমন ধরেন উনার মাথা খারাপ—এইসব আর কি?’
‘আপনার ধারণা উনার মাথা ঠিক আছে?’
‘অবশ্যই ঠিক আছে।’
‘আমি তো শুনেছি—উনি বিরাট এক বাড়িতে একা থাকেন।’
‘একা থাকলেই তো মানুষ পাগল হয়ে যায় না, স্যার। বিয়ের আগে আমিও একা থাকতাম।’
‘উনি শুধু যে একা থাকেন তাই না, নটা ভয়ংকর কুকুর পোষেন। এটা কি ঠিক?’
‘জি ঠিক। উনার বাবা পুষতেন, এইজন্যে উনিও পুষেন। কুকুর পোষা তো স্যার অপরাধ না।’
‘বাড়িতে দারোয়ান, মালি, কাজের লোক কেউই নেই?’
‘জি না।’
‘উনি কি নিজেই রেঁধে খান?’
‘জানি না, স্যার। কখনো জিজ্ঞেস করি নি।’
‘আপনি কি ঐ বাড়িতে কোনো মহিলা দেখেছেন?’
‘আমি ঐ বাড়িতে কখনো যাই নি।’
মিসির আলি খানিকক্ষণ চুপচাপ থেকে আন্দাজে ঢিল ছুড়লেন, স্বাভাবিক গলায় বললেন—রূপবতী একটি মেয়ে যে মুশফেকুর রহমান সাহেবের কাছে মাঝে মধ্যে আসে তার নাম কী?
রশিদ মোল্লা দৃঢ় গলায় বলল, উনার কাছে কোনো মহিলা কখনো আসে না, স্যার।
‘আপনি কি নিশ্চিত?’
‘জি স্যার।’
মিসির আলি বললেন, আগের ম্যানেজার সাহেবের মেয়ের নাম কী?
‘স্যার আমি জানি না।’
‘মেয়েটি দেখতে কেমন?’
‘উনাকে আমি কোনোদিন দেখি নাই। কী করে বলব দেখতে কেমন?’
‘কোনোদিন দেখেন নি, তা হলে মুশফেকুর রহমানের মাকে কী করে বললেন খুব সুন্দর মেয়ে?’
রশিদ মোল্লা হতভম্ব গলায় বলল, স্যার, আপনি কি আই.বি.-র লোক?
মিসির আলি হাসলেন। হ্যাঁ-না কিছু বললেন না। লক্ষ করলেন রশিদ মোল্লা তীব্র ভয়ে অস্থির হয়ে গেছে। চা এসেছে। সে চায়ে চুমুক দিতে গিয়ে মুখ পুড়িয়ে ফেলেছে। কিছুটা চা ছলকে তার শার্টে পড়েছে।
‘আগের ম্যানেজার সাহেব কোথায় থাকেন আপনি জানেন?’
‘জি না, স্যার, জানি না। বিশ্বাস করুন জানি না। আমার কথা বিশ্বাস না করলে আমি কোরান শরিফে হাত দিয়ে বলতে পারি।’
‘আপনার কথা বিশ্বাস করছি। আপনি এত ভয় পাচ্ছেন কেন?’
‘ভয় পাচ্ছি না তো। কেন শুধু শুধু ভয় পাব! আমি কোনো পাপ করলে ভয় পেতাম। আমি কোনো পাপ করি নি।’
‘কোনো পাপ করেন নি?’
‘ছোটখাটো পাপ করেছি। সে তো স্যার সবাই করে। মানুষ মাত্রই পাপ করে।’
মিসির আলি সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, মেয়েটার সঙ্গে শেষ কবে আপনার কথা হয়?
রশিদ মোল্লা ভয়ংকর চমকে উঠে বলল, আমার সঙ্গে কোনো কথা হয় নি।
মিসির আলি কিছু বললেন না। নিঃশব্দে সিগারেট টানতে লাগলেন। রশিদ মোল্লা রীতিমতো ঘামতে শুরু করল।
‘রশিদ সাহেব!’
‘জি স্যার।’
‘আপনার ভয়ের কোনো কারণ নেই। আপনি সত্য গোপন করে ভয়ের কারণ ঘটাতে পারেন। কী কথা হল তার সঙ্গে?’
‘আমার সঙ্গে স্যার কোনো কথা হয় নি। একবারই আমি উনাকে দেখেছি। তাও বছরখানেক আগে। অফিসে আসলেন। পরিচয় দিলেন। আমি খাতির করে বসালাম। তখন লক্ষ করলাম খুবই সুন্দর মেয়ে। উনি বললেন, স্যারের সঙ্গে কথা বলতে এসেছেন।’
আমি বললাম, স্যারের সঙ্গে কথা হবে না। উনি কারোর সঙ্গে কথা বলেন না। যা বলার আমাকে বলতে হবে। উনি তখন স্যারের একটা চিঠি দেখালেন। স্যার চিঠি লিখে উনাকে ডেকে পাঠিয়েছেন।
আমি এই কথা স্যারকে বললাম। স্যার খুবই অবাক হলেন। স্যার বললেন, চিঠিটা নিয়ে এস, মেয়েটাকে বল চলে যেতে।
‘আপনি তাই করলেন?’
‘তাই করলাম। তবে মেয়ে স্যার চিঠি দিল না। চিঠি নিয়েই চলে গেল। খুব কাঁদছিল। আমার স্যার এমন মায়া লাগল!
মিসির আলি উঠে দাঁড়ালেন। হালকা গলায় বললেন, উঠি। রশিদ মোল্লা তাঁকে বাড়ির গেট পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এলেন। মিসির আলি বললেন, আমি আপনাকে আর কোনো প্রশ্ন করব না। আপনি নিজ থেকে যদি কিছু বলতে চান—বলতে পারেন।
রশিদ মোল্লা প্রায় কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, আমি আপনাকে যা বললাম, এর বেশি আমি কিছুই জানি না। বিশ্বাস করুন। কোরান শরিফে হাত দিয়ে বলতে বললে আমি কোরান শরিফে হাত দিয়ে বলব।
‘আপনি তা হলে আর কিছু বলতে চান না?’
‘জি না।’
‘আর একটিমাত্র প্রশ্ন—আপনার বসার ঘরে টাটকা গোলাপ ফুল দেখলাম—আপনার গাছের গোলাপ?’
‘জি স্যার। আমার মেয়ের টবে হয়েছে। এই গোলাপগুলোর নাম তাজমহল। স্যার দাঁড়ান, আপনার জন্যে কয়েকটা ফুল নিয়ে আসি।
মিসির আলি গোলাপের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগলেন।
Website ta oshadharon but ektay problem, spelling mistake onekh beshi.spelling mistake nah thakle khub e oshadharon hoto