আমার রবি ঠাকুরের মন ঠিক শরৎকালের আকাশের মতো।
এই মেঘ। এই রোদ্দু।
এই হালকা। এই গম্ভীর।
সেদিন আমরা ছিলেম জোড়াসাঁকোর বাড়িতে। ও বসেছিল দক্ষিণের বারান্দায়, আরাম কেদারায়। আমি বসেছিলেম মেঝেতে, ওর পায়ের কাছে। আমি তখন ক’মাসের পোয়াতি। ও বেশ হালকা মেজাজেই। সারাদিন লেখার মধ্যে ডুবে কেটেছে।
বিকেলবেলা কী মনে হয়েছে, বারান্দায় এসে বসে বলল, ছোটবউ, ওই যে তুমি একটা গজার মতো মিষ্টি তৈরি করো, ভারি ভালোলাগে আমার, কী যেন নাম ওটার?
আমি বললেম, এলোঝেলো। কবে খেতে চাও বলো, করে দেব।
আমার বর বলল, এলোঝেলো! অমন সুন্দর মিষ্টির এমন বিশ্রী নাম?
আমি বললেম, তুমি একটা জুতসই নাম দাও, এবার থেকে এলোঝেলোকে ওই নামেই ডাকব তাহলে।
রবি ঠাকুর তৎক্ষণাৎ আমাকে চমকে দিয়ে বললে, ‘পরিবন্ধ।’
কোথায় এলোঝেলো। কোথায় ‘পরিবন্ধ’। ’পরিবন্ধ’ মানে কী? উনি একটু হেসে বললেন নতুন বউঠানকে একদিন বলেছিলেম, সে যখন চুলবেঁধে এসে দাঁড়াল, তখন বলেছিলেম বেঁধেছ কবরী তুমি নানা পরিবন্ধে—পরিবন্ধ মানে বৈচিত্র্যের বাঁধুনি, যেমন তোমার এলোঝেলো—কত রকমের গজার মিশ্রণ!
মোটেই পছন্দ হয়নি আমার নামটা। কিন্তু স্বয়ং রবি ঠাকুর নাম দিয়েছে—চুপ করে মেনে নিলেম।
শুধু রান্নার নাম নয়, রান্না নিয়েও অনেক এক্সপেরিমেন্ট করতে ভালোবাসে আমার বর।
যশোরের মেয়ে আমি। যশোরের বেশ নামডাক আছে নিরামিষ রান্নার জন্যে। আমি নানারকম নিরামিষ রান্না জানি।
আমার ঢাকাই রান্না শেখারও খুব শখ। কেউ আমাকে ঢাকার রান্না শেখালে আমি তাকে যশোরের রান্না শিখিয়ে দিই।
আমার বর আমার হাতের নিরামিষ রান্নার তারিফ করেছে। বলেছেন, এই একটি ব্যাপারে আমি নাকি অদ্বিতীয়।
বিশেষ করে আমার হাতে তৈরি মিষ্টি খেতে ও বড় ভালোবাসে।
এইখানে আমি জিতেছি। নতুন বউঠান নাকি খুব ভালো মিষ্টি বানাতেন।
আমার বর বলেছে, আমি তাঁর চেয়েও ভালো এই ব্যাপারে।
শান্তিনিকেতনে নিজেদের বাসের জন্য আলাদা বাড়ি তখন ছিল না।
আমরা থাকতেম আশ্রমের অতিথিশালার দোতলায়। রান্নাবাড়িটা ছিল দূরে।
রবি ঠাকুর বললে, পৃথক কোনও রান্নঘর নেই, ওই বাইরের বারান্দার এক কোণে উনুন পেতে তুমি রান্না করবে।
আমি তাই করতেম। ছুটির দিনে আমি নানারকম মিষ্টি তৈরি করতুম। তারপর সেগুলিকে একটা জালের আলমারিতে রেখে দিতুম। রথী জালের আলমারি চুপিচুপি খুলে মিষ্টি খেত। আমি আড়াল থেকে দেখে ভারি মজা পেতুম।
একদিন আপনাদের রবি ঠাকুর মজা করে বললে, ছোটবউ তোমার জালের আলমারিটি দেখছি মিষ্টান্নের অক্ষয় ভাণ্ডার—লোভনীয় জিনিসে সদাই ভরতি। দেখেছি রথী তার সহপাঠীদের নিয়ে এসে তোমার ওই মিষ্টির ভাণ্ডার প্রায়ই লুট করে।
এই মিষ্টির ভাণ্ডারের পিছনে আমার বরের নানারকম চাহিদার দানও কিছু কম নয়।
কতরকমের নতুন-নতুন মিষ্টির জন্যে তার আবদার। আমাকে সেইসব আবদার মেটাতে হয়।
একদিন রান্না করছি, হঠাৎ চৌকিটা টেনে পিছনে বসে বললে, মানকচুর জিলিপি করে খাওয়াও তো দেখি। ঠিক-ঠিক করতে পারলে ভালোই হবে। আর বাঙালিরা ঘরে ঘরে তোমার জয়গান করবে।
মানকচুর জিলিপি! কী পাগলের মতো বলছ বলো তো? তোমার এই আবদার আমি রাখতে পারব না।
আবদার নয় ছোটবউ, বলতে পারো ফরমাশ। তোমাকে করতেই হবে মানকচুর জিলিপি। দেখলাম, রবি ঠাকুরের মুখে মৃদু হাসি।
সেই হাসি আমাকে উৎসাহ দিল। সত্যিই সারা দুপুর ধরে তৈরি করলেম মানকচুর জিলিপি।
রথী, খেয়ে দ্যাখ তো কেমন হয়েছে। ওকে দেওয়ার আগে ছেলেকেই দিলুম।
রথী বলল, মা, তুমি যে সাধারণ জিলিপি করো, তার চেয়েও ভালো।
সন্ধেবেলা আপনাদের রবি ঠাকুর কী যেন লিখছেন। একেবারে মগ্ন হয়ে আছেন। আমি লেখার সময় ওকে বিরক্ত করি না। ডাকলেও অনেক সময় সাড়া পাওয়া যায় না। লেখার ঝোঁক চাপলে ও খাওয়াদাওয়া ছেড়েই দেয়।
আমি প্রথম প্রথম রাগারাগি করতেম। কোনও ফল হয় না। এখন আর রাগারাগি করি না। এই প্রসঙ্গে একটা কথা বলি। ’ভারতী’ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন বেরিয়ে গেছে, পরের মাস থেকে সেই কাগজে রবি ঠাকুরের লেখা নিয়মিত বেরোবে। এদিকে আমার বরকে বলাই হয়নি এমন একটা বিজ্ঞাপন দেওয়া হয়েছে। বিজ্ঞাপন বেরোবার পর সে জানল। এবার কী হবে?
রবি ঠাকুর তো লিখতে বসে গেল। খাওয়াদাওয়া ভুলে দিনরাত একটানা লিখে চলেছে। আমার হল বিপদ। মানুষটাকে খাওয়াব কী করে? আমার সাহসই হচ্ছে না ওকে খাওয়ার কথা বলতে। বলেই দিয়েছে আমি লিখতে যাচ্ছি, খাওয়ার জন্যে আমাকে ডাকাডাকি কোরো না। খেতে গেলে নাকি সময় নষ্ট হয়। তা ছাড়া, খাওয়ার পরে পরিশ্রম করার ক্ষমতাও নাকি কমে যায়, বিশ্রাম নিতে ইচ্ছে করে।
লেখকদের যতদূর সম্ভব না খেয়ে থাকাই ভালো—এইটেই মনে হয় আপনাদের রবি ঠাকুরের মত।
দিনের পর দিন না খেয়েই কাটাচ্ছে আমার বর। বেশ বুঝতে পারছি, ও অসুস্থ হয়ে পড়ল বলে। ও যখন এইভাবে একটানা লেখে, কেমন যেন পাগল-পাগল হয়ে যায়। তখন মনে হয়, ও আমাদের কেউ নয়। ও আমাদের কথা বুঝবে না।
আমি শুধু ওর লেখার টেবিলে কখনও একটু ফলের রস, কখনও শরবত দিয়ে আসছি— ব্যস। সবই নীরবে। ওর সঙ্গে আমার দিনের পর দিন কোনও কথা নেই।
এইভাবে দিনরাত একটানা লিখে ও একটা নাটক শেষ করলে ‘ভারতী’ পত্রিকায় ধারাবাহিক বেরোবে বলে।
নাটকটির নাম, ‘চিরকুমার সভা’। কী মজার লেখা! অথচ খালিপেটে লেখা।
লেখাটা শেষ করেই সেটা নিয়ে ও কলকাতায় চলে গেল। পরের দিনই আমার কাছে খবর এল, জোড়াসাঁকোর বাড়ির তেতলার ঘরে উঠতে সিঁড়িতেই ও অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেছে—দিনের পর দিন না খেয়ে একটানা লিখতে লিখতে ওর শরীর এতটাই দুর্বল হয়ে গিয়েছে। এবার আত্মীয়স্বজনের চিঠি আসতে লাগল আমার কাছে–
আমি কেন ওকে ঠিকমতো দেখাশোনা করছি না!
আমিও স্পষ্ট জানিয়ে দিলুম, তোমরা তো ওকে চেনো না। খাওয়ার কথা যত বলেছি জেদ ততই বেড়েছে। কিছুতেই খাবে না। না খেয়ে দুর্বল হয়ে সিঁড়িতে মাথা ঘুরে পড়েছে। এবার হয়তো নিজেই শিখবে। কারও শেখানো কথা শোনবার মানুষ তো ও নয়।
তবে কোনও ব্যাপারেই আমার বরের উপর জোর খাটাতে পারিনি এমন অপদার্থ বউ আমি নই। মাঝেমধ্যে ও আমাকে একটু-একটু ভয়ও পেয়েছে।
আমরা তখন শান্তিনিকেতনে। খবর এল, আমাদের জোড়াসাঁকোর বাড়িতে দুজন মেথরের প্লেগ হয়েছে। সেই সময়ে ওর বন্ধু প্রিয়নাথ সেন ওকে কলকাতায় যাওয়ার জন্যে বললেন— কোনও বিশেষ দরকার ছিল বোধহয়।
আমি বললেম, কলকাতায় এখন প্লেগ হচ্ছে, আমাদের বাড়িতেও দু’জনের হয়েছে, তুমি কিছুতেই কলকাতায় যেতে পারবে না।
ও বললে, বিশেষ প্রয়োজন, যেতেই হবে।
আমি বললেম, যাও তো দেখি কেমন যেতে পারো।
উনি খানিকক্ষণ বিস্মিত হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে থাকলেন। তারপর বন্ধুকে চিঠি লিখে জানালেন, তুমি তো আমাকে কলকাতায় যাওয়ার জন্যে লিখেছ—আমিও অনেকদিন থেকে যাব যাব করছি কিন্তু প্লেগের ভয়ে গৃহিণী যেতে দিচ্ছেন না। এ অবস্থায় কোনও জরুরি কাজের ওজর দেখিয়ে যে আমি ছুটি পাব এমন আশমাত্র নেই। চেষ্টা করে অবশেষে ক্ষান্ত দিয়েছি। বেলা হল। এখন বরং নাইতে খেতে যাওয়া যাক। নইলে নির্দোষী নিরপরাধী তুমি সুদ্ধ গৃহিণীর বিদ্বেষের ভাগী হবে।
কে বলে রবি ঠাকুর বউকে ভয় পায় না? কি, আসল সত্যিটা হল, তিনি নিজেই প্লেগের ভয়ে কলকাতায় গেলেন না?
একটা ব্যাপারে ওর সঙ্গে আমার নিত্য খটাখটি। ব্যাপারটা আপাতভাবে তুচ্ছ হলেও আমার কাছে তুচ্ছ নয়।
যদি কোনওদিন আমার এই আত্মজীবনী কোনও প্রকাশকের হাতে সত্যিই পড়ে এবং সত্যিই ছাপা হয়, তাহলে মেয়েরা অন্তত আমার মনের এই কষ্টটা বুঝবে। এবং রবি ঠাকুরকে অন্তত এ ব্যাপারে দোষ দেবে।
ও সংসার করে সন্ন্যাসীর মতো। অনেক ব্যাপারেই ও সন্ন্যাসী নয়। কিন্তু এ-ব্যাপারে ওর কোনও চাহিদাই নেই।
সংসার করতে গেলে তো নানারকম সরঞ্জাম-উপকরণ লাগে। আমি কোনওরকম বিলাসিতার কথা বলছি না। প্রয়োজনীয় সরঞ্জামের কথা বলছি। সেগুলিকে ও অপ্রয়োজনীয় জঞ্জাল বলে ভাবে। আর আমার তো সংসার যাযাবরের সংসার। আজ শান্তিনিকেতনে তো কাল কলকাতায়। গাজিপুরে কিছুদিন নিভৃতে সংসার করেছিলুম, সেই যা। তারপর কিছুদিন ও আমাকে নিয়ে থাকল শিলাইদহের কুঠিবাড়িতে। তারপর শান্তিনিকেতনের অতিথি আবাসে। বাইরের বারান্দায় দিনের-পর-দিন রান্না করেছি। ও আবার পাশে মোড়া নিয়ে বসে নতুন-নতুন রান্নার ফরমাশ করে যাচ্ছে। তারপর রান্নাটা যখন আমি করে ফেললুম, তখন ও বললে, দেখলে তো তোমাদেরই কাজ তোমাদেরই কেমন একটা শিখিয়ে দিলুম।
আমি এই সবই হাসি মুখে মেনে নিয়েছি। মানতে পারিনি একটি জিনিস।
আপনাদের রবি ঠাকুর যখন গৃহস্থালির জিনিসপত্র দেখে বিরক্ত হয়ে মেজাজ খারাপ করেন, তখন আমার খুব রাগ হয়, অভিমান হয়, ভাবি এইমানুষের সঙ্গে ঘর করা যায় না।
এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় সংসার পাততে গেলে সংসারের সরঞ্জাম তো বয়ে বেড়াতে হবেই।
হয়তো কখনও কখনও একটু বেশি জিনিসপত্তরই নিয়ে গিয়েছি। সব মেয়েরই ঝোঁক থাকে সেই দিকে।
ও যেখানেই যায়, অতিথি সমাগম হবেই। ব্যস, অতিথি এলেই তাদের খাওয়াদাওয়ার ব্যবস্থা আমাকেই তো করতে হয়।
তখন আনো মালপো, আনো মিঠাই, ভাজো শিঙাড়া, ভাজো নিমকি-কচুরি।
আমার কবি-বরের আবার কিছু কম হলে চলবে না।
পাত্র বোঝাই প্রচুর হওয়া চাই।
কিন্তু বাসনপত্তর, সরঞ্জাম না হলে এসব তৈরি করব কী করে? রাখব কোথায়? পরিবেশনই বা করব কী করে?
কিন্তু সংসারের সরঞ্জাম দেখলেই ও এমন করতে থাকে! কে বোঝাবে ওকে?
এই খাওয়াদাওয়া, অতিথিসেবা প্রসঙ্গে একটা ঘটনার কথা বলি। তাতে ঠাকুরবাড়ির ভিতরের ব্যাপারটা বেশ স্পষ্ট হয়ে উঠবে। আমিও হয়তো একটু বাহবা পাব।
ওর এক কাকিমা আছেন। ছোট কাকিমা। নগেন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্ত্রী ত্রিপুরাসুন্দরী।
ইনি জোড়াসাঁকোর বাড়িতে জলগ্রহণ করতেন না। কেন তিনি আমাদের বাড়ি কিছু খান না?
কারণ, তাঁর বদ্ধমূল ধারণা, এ-বাড়িতে তাঁর খাবারে বিষ মিশিয়ে তাঁকে হত্যা করা হতে পারে।
কেন হত্যা করা হবে তাঁকে?
বাবামশায় তাঁকে মাসে এক হাজার টাকা হাত খরচা দিতেন।
ছোটকাকিমা ভাবলেন, বাবামশায় তাঁর খাবারে বিষ দিয়ে মাসে ওই হাজার টাকা খরচের হাত থেকে রেহাই পেতে পারেন। যাইহোক, ছোটকাকিমা আমাকে খুব ভালোবাসতেন।
একদিন আমি নিজের হাতে মিষ্টি বানিয়ে ওঁকে খাবার জন্যে অনুরোধ করলেম।
ছোটকাকিমা তো কিছুতেই খাবেন না।
আমিও ছাড়ব না।
অগত্যা শেষ পর্যন্ত উনি সেই মিষ্টি মুখে দিলেন। জলও খেলেন। এবং দিব্য বেঁচে রইলেন।
এরপর আমার উপর কাকিমার আস্থা বাড়ল। একমাত্র আমার তৈরি মিষ্টি উনি মাঝেমধ্যে খেতেন। প্রায় সারাজীবন সর্বক্ষেত্রে আমি হেরে গিয়েছি। এই একটি জায়গায় আমি জিতেছিলুম।
তবে আমার রান্না খেয়ে বিশেষ করে আমার হাতের চিঁড়ের পুলি, আমের মিঠাই, দইয়ের মালপো খেয়ে নাটোরের মহারাজা জগদীন্দ্রনাথ রায় যে কী প্রশংসা করেছিলেন কী বলব! এটাও তো একরকমের জিত, তাই না?
রান্না করতে গেলে তো রান্নার সরঞ্জাম লাগবেই, উপকরণ লাগবে। সুতরাং খরচ তো আছেই।
এই খরচের ব্যাপারেই আমার বর বেশ খিটখিট করে কোনও কোনও সময়ে। একদিন বলল, নীচে বসে লিখতে লিখতে রোজ শুনি, চাই ঘি, চাই সুজি, চিনি, চিড়ে, ময়দা; মিষ্টি তৈরি করতে হবে। যত চাচ্ছ তত পাচ্ছ। মজা হয়েছে খুব।
তোমার মতো গিন্নি হলেই হয়েছে আর কী, দু-দিনে ফতুর। আমি উত্তরে বলেছিলুম, তুমি সংসার বোঝো না, তোমার এদিকে নজর দেয়া কেন?
ও খুব গম্ভীর হয়ে গেল। সারাদিন আর কথাই বলল না। আমার মনে খুব কষ্ট হল। কিন্তু সেই কষ্টের কথা কাকে বলব?
আমার মনের আরও একটা বড় কষ্ট হল, আমাকে দেখতে বেশ খারাপ। কিন্তু ভগবান আমাকে যেভাবে গড়েছেন, তার উপর তো আমার কোনও হাত নেই।
আমার রাগ আমার ভাগ্যের উপর।
আমার এত সুন্দর বর হল কেন?
ওর পাশে আমাকে আরও খারাপ দেখায়, একদম মানায় না। তখন আমি সবে নতুন বউ। ভাবলুম, বাড়িতে বেশ সেজেগুজে থাকব। তাহলে আমাকে আমার অত সুন্দর বরের পাশে খানিকটা অন্তত মানানসই মনে হবে।
একদিন একটু সেজেগুজে মুখে একটু রংটং লাগিয়ে ঘরের মধ্যেই রয়েছি।
মেয়েরা আরও দু-একজন আছেন ঘরের মধ্যে।
হঠাৎ আপনাদের রবি ঠাকুর এলেন ঘরে। সবাই তাকাল ওঁর দিকে।
গায়ে একখানা লাল শাল। কী সুন্দর যে দেখাচ্ছে!
আমি কানে পরেছিলাম দুটি দুলঝোলানো বীরবৌলি।
আপনাদের রবি ঠাকুর একবার শুধু দেখলেন আমার দিকে। আমি সঙ্গে-সঙ্গে হাত দিয়ে কান চাপা দিলুম।
উনি বললেন, অসভ্য দেশের মানুষরাই মুখচিত্তির করে। তুমি কি মুখে রং মেখে অসভ্য দেশের মানুষ সাজতে চাও?
সেই থেকে আর কখনও সাজিনি। নিতান্ত সাদাসিধেভাবেই জীবনের আঠাশটা বছর কাটিয়ে দিলুম।
ভালো কথা, ইচ্ছে করলে গয়না পরবই বা কী করে?
আমার তো আর কোনও গয়নাই নেই।
আমার বিখ্যাত বর শান্তিনিকেতনে বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করল।
আমি তো শুধু তার সহধর্মিণী নই।
তার সহকর্মিণীও হয়ে ওঠবার চেষ্টা করলুম।
ছাত্রদের খাওয়াদাওয়া দেখা-শোনার ভার সব আমার।
ওরা ঘর ছেড়ে, মা-বোন ছেড়ে সব আশ্রমে এসে উঠেছে। ওরা যাতে আমার কাছে মাতৃস্নেহ পায়, অসুখে সেবাযত্ন পায়, দুঃখেকষ্টে সহানুভূতি পায়, সেইদিকে নজর ছিল আমার।
জোড়াসাঁকোর পরিবার ছেড়ে, সেখানকার গোছানো সংসার ছেড়ে শান্তিনিকেতনে এসে থাকাটা আমার খুব সুখের হয়নি।
আমার একমাত্র আনন্দ ছিল ছাত্রদের সেবাযত্ন করা। এইভাবে আমি আপনাদের রবি ঠাকুরের বিদ্যালয়ের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেলুম।
আর যখনই বিদ্যালয়ে অর্থাভাব হত, যখনই ও চাইত, আমি আমার গয়না একটি একটি করে খুলে বিক্রির জন্যে ওকে দিয়ে দিতুম।
গয়না তো কিছু কম ছিল না আমার। শাশুড়ির প্রাচীন আমলের ভারী-ভারী গয়না। বিয়ের যৌতুক হিসেবেও পেয়েছিলেম অনেক গয়না।
সবই একে-একে বিক্রি হয়ে গেল শান্তিনিকেতনের বিদ্যালয়ের খরচ চালাতে। থেকে গেছে শুধু গলার এই চেনটা, যেটা পরে আছি আর হাতে ক’গাছা চুড়ি।
আমাদের আত্মীয়েরা আমাকে প্রচুর তিরস্কার করেছেন গয়না বিক্রি করতে রাজি হয়েছিলুম বলে।
আমার স্বামীকে তো ওঁরা কাণ্ডজ্ঞানহীন মনে করতেন। আমাদের দুজনকেই বিদ্যালয়ের বিষয়ে অনেক বিদ্রূপ সহ্য করতে হয়েছে। একটা কথা, গয়নার জন্যে আমার কোনও কষ্ট বা অনুশোচনা নেই। আমার গয়নাগুলো যে ওর কোনও কাজে লেগেছে, তাতে আমি খুশি।
যে-বিদ্যালয় আপনাদের রবি ঠাকুর প্রতিষ্ঠা করলেন সেটা তো তাঁর সাময়িক শখের জিনিস নয়।
বহুদিন ধরে তাঁর মনের মধ্যে শিক্ষার একটি আদর্শ গড়ে উঠেছিল। সেই আদর্শকেই আপনাদের রবীন্দ্রনাথ রূপ দিতে চেয়েছিলেন বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করে। তাঁর তৃপ্তির জন্যে আমি তাঁর স্ত্রী হিসেবে সামান্য ত্যাগ স্বীকার করেছি মাত্র!
আমার একটাই কষ্ট—তাঁর জন্যে আরও বেশি কিছু, বড় কিছু করতে পারলুম না। তাঁর কাজের, তাঁর জীবনের প্রেরণা হতে পারলুম না।
দেখুন তো, কোথা থেকে কোথায় চলে এসেছি।
এতবড় একজন লেখকের বউ আমি, নিজের কথাটুকুও গুছিয়ে লিখতে পারছি না।
খালি খেই হারিয়ে যাচ্ছে।
মনে আছে তো, আমি ওঁর আবদার মেটাতে মানকচুর জিলিপি তৈরি করেছিলুম একদিন।
প্রথমে ছেলে রথীকে বললুম, একটু চেখে দ্যাখ তো বাবা কেমন হয়েছে। ও তো বলল, মা, খুব ভালো হয়েছে, সাধারণত আমি যে জিলিপি করি, তার চেয়েও ভালো।
এবার সাহস করে মানকচুর জিলিপি নিয়ে গেলুম ওর লেখার ঘরে। আমি যে ঘরে ঢুকলুম, ও টের পেল না।
একমনে লিখেই চলেছে।
আমি ধীরে-ধীরে প্লেটটা রাখলুম ওর টেবিলে।
ও আমার দিকে একটুক্ষণ তাকাল। তারপর প্লেটটির দিকে একবার তাকিয়েই জিলিপি তুলে মুখে দিল।
মুখ দেখেই বুঝলাম, ভালোলেগেছে, বেশ ভালো। শুধু বললে, মানকচুর জিলিপি পর্যন্ত উতরে দিলে ছুটকি।
ব্যস, আর কিছুনয়। শুধু ওইটুকু।
কী যে ভালোলাগল আমার। কত আনন্দ হল বোঝাই কেমন করে?