রঙিলা নটিবাড়ি সোহাগগঞ্জ বাজারের শেষ মাথায়। মাছের আড়ত পার হয়েও আট-দশ মিনিট হাঁটতে হয়। রাস্তার দু’পাশে আপনাতে গজিয়ে ওঠা বেশকিছু শিমুলগাছ। যে-কেউ দেখে ভাববে কোনো এক বৃক্ষপ্রেমী চিন্তাভাবনা করে শিমুলের সারি লাগিয়েছেন। চৈত্রমাসে শিমুলের টকটকে লাল ফুল ফোটে। দেখতে ভালো লাগে। মনে হয়। চৈত্রের তীব্ৰ উত্তাপে গাছের মাথায় আগুন লেগে গেছে।
মূল বাড়ি কাঠের। উপরে টিন। মূল বাড়ি ঘিরে এক রুমের বেশ কিছু ছোট ছোট ঘর। কাঠের মূল বাড়িটা দর্শনীয়। উচ্চতায় প্রায় দোতলা বাড়ির সমান। দরজা এবং পাল্লায় ফুল লতাপাতা আঁকা। টিনের চৌচালাতেও নকশা কাটা। লখনৌ-এর বাইজি আংগুরি অনেক টাকা-পয়সা খরচ করে মূল বাড়ি তৈরি করে। এই বাড়িতে তার একটা কন্যাসন্তান হয়। তার নাম বেদানা। তিন বছর বয়সে বেদানা পানিতে ড়ুবে মারা যায়। বেদানার মৃত্যুর পর আংগুরির আর কোনো খোজ পাওয়া যায় নি। কেউ বলে আংগুরিও মেয়ের মতো পানিতে ড়ুবে গেছে। আবার কারো কারো মতে আংগুরি দেশান্তরী হয়েছে।
‘দেশান্তরী’ শব্দটা এলাকার মানুষের অতি প্ৰিয়। স্ত্রীর সঙ্গে ঝগড়া হলেই স্বামীরা বলে, দেশান্তরী হবো, আসাম চলে যাব। দেশান্তরী হয়ে আসাম চলে যাবার বাসনার কারণ— আসাম খুব দূরের দেশ না। বন-জঙ্গল পাহাড়-পর্বতের অঞ্চল। সেখানেই আছে কামরূপ কামাক্ষ্যা। জাদুবিদ্যার দেশ। কামরূপ কামাক্ষ্যার অতি রূপবতী নারীরা পুরুষদের বশ করে চিরদিনের জন্যে রেখে দিতে পছন্দ করে। দেশান্তরী হয়ে আসাম চলে গেলে ফেরা হয় না। সেই কারণেই।
জুলেখা রঙিলা নটিবাড়িতে আনন্দে আছে। জায়গাটা তার পছন্দ হয়েছে। অনেক উঁচু, প্রায় টিলার মতো। বর্ষাকালে সোহাগগঞ্জ বাজারের অনেকটা ড়ুবে যায়। রঙিলা বাড়ি শুধু ভেসে থাকে। দূর থেকে দেখা যায় পানির উপর নকশা কাটা কাঠের একটা বাড়ি ভাসছে। বাড়ির চারদিকে টিনের ছোট ছোট ঘরের চাল থেকে সূর্যকিরণ প্রতিফলিত হয়ে ঝলমল করে। সন্ধ্যাবেলা হারমোনিয়াম এবং সারেঙ্গির শব্দ ভেসে আসে। বড়ই রহস্যময় লাগে। বর্ষাকালে এই রহস্যময় জায়গায় লোকজনকে আসতে হয় নৌকায়। বেশিরভাগ খদের ভাটি অঞ্চলের পয়সাওয়ালা শৌখিনদার। হাওরের মাছ বিক্রির কাঁচা টাকা নিয়ে এরা আসে। কোমরে টাকার থলি বাধা থাকে। একটু নড়াচড়া করলেই ঝন ঝন শব্দ হয়। নটি মেয়েদের কাঁচা রূপার টাকা নজরানা দেয়া দস্তুর। ময়লা কাগুজে নোটে শৌখিনদারি প্রকাশ পায় না। রঙিলা বাড়ির ঘাটে যখন নৌকা ভিড়ে তখন তারা চারদিকে তাকিয়ে বোকার মতো হাসে। তাদের বড়ই অস্থির মনে হয়। পরিচিত কেউ দেখে ফেলল। কি-না এই চিন্তাতেই তারা অস্থির।
অতিরিক্ত পয়সাওয়ালা শরিফ আদমিদের মধ্যে অস্থিরতা থাকে না। তারা বজরা নিয়ে আসে। বজরা থেকে নামে না। তাদের সঙ্গে মাহফিল করতে রঙিলা
ব্যাপারে সাবধানি। হিসাব ছাড়া খরচ করে ভাটি অঞ্চলের বেকুবরা। এরা সব টাকা শেষ করে নিঃস্ব অবস্থায় দেশে ফিরে যায়। তখনও তাদের মধ্যে হাসি থাকে। সেই হাসি অন্যরকম। যেন তারা একটা কাজের কাজ করেছে।
জুলেখা রঙিলা বাড়িতে ভর্তি হয়ে নতুন নাম নিয়েছে চান বিবি। নতুন নাম নেয়াই দস্তুর। অতীত পেছনে ফেলে আসতে হবে। যা গেছে তা গেছে। অতীত নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। এও এক ধরনের সংসার। প্রতিরাতে স্বামী বদলের সংসার। এটাই মন্দ কী?
চান বিবি একটা টিনের ঘর পেয়েছে। ঘরটা তার বড়ই পছন্দের। সামনেই বড়গাঙ। ঘরের বারান্দায় বসে থাকলে বড়গাঙ ছাড়িয়ে দৃষ্টি অনেক দূরে চলে যায়। তখন খুব উদাস লাগে। ঘরের সামনেই বিশাল এক কামরাঙা গাছ। এই গাছে সারা বছরই কামরাঙা হয়। ভয়ঙ্কর টক, কাক দেশান্তরী জাতের কামরাঙা (কাক দেশান্তরী : যে টক ফল খেলে কাক দেশান্তরে পালিয়ে যায়)। এই গাছটাও চান বিবির পছন্দ। গাছের নিচে বসলে চিড়ল চিড়ল পাতার ফাঁক দিয়ে সূর্যের আলো এসে গায়ে পড়ে। এত ভালো লাগে। চান বিবি ঠিক করেছে, তার যদি কিছু টাকা-পয়সা হয় তাহলে সে কামরাঙা গাছের তলাটা নিজ খরচে বঁধিয়ে দেবে। বাধানো ঘাটে শীতলপাটি বিছানো থাকবে। শীতলপাটির উপরে পরিষ্কার ফুলতোলা বালিশ। কখনো সে বালিশে শুয়ে আকাশ দেখবে। আবার কখনো গাছে হেলান দিয়ে অতি দূরের গ্রামের সীমানা দেখবে।
চান বিবির ফুট ফরমাস খাটার জন্যে তাকে সাত-আট বছরের একটা মেয়ে দেয়া হয়েছে। মেয়েটার নাম হাছুন। চান বিবি হাছুনকে নিজের মেয়ের মতো যত্ন করে। মাথায় তেল দিয়ে চুল বেঁধে দেয়। সপ্তাহে একদিন জলেভাসা সাবান দিয়ে তার গা ডলে দেয়। হাছুন চান বিবিকে মা ডাকে। সারাদিনই সে ঘর পরিষ্কার করে। সন্ধ্যাবেলা কার্তিকের মূর্তিতে প্ৰদীপ জ্বেলে দেয়। ধূপদানে ধূপ জ্বলে। রঙিলা বাড়ির প্রতিটি ঘরেই কার্তিকের মূর্তি আছে। কাৰ্তিক পতিতাদের দেবতা। পতিতা হিন্দু হোক মুসলমান হোক, তার ঘরে কার্তিকের মূর্তি থাকবেই।
রঙিলা বাড়ির মালেকাইন হিন্দুস্থানি। নাম সরাজুবালা। এই হিন্দুস্থানি মালেকাইনকেও চান বিবির পছন্দ। বয়স পঞ্চাশের উপরে। গায়ের রঙ পাকা ডালিমের মতো। সন্ধ্যাবেলা। তিনি যখন চোখে কাজল দিয়ে সারেঙ্গি নিয়ে বসেন তখন তাকে দেখলে চান বিবির অদ্ভুত লাগে। তার কাছে মনে হয় এই মহিলা পৃথিবীর কেউ না। অন্য কোনো জগতের। তার গানের গলাও চমৎকার। মীরার ভজন গাওয়ার সময় সরাজুবালার চোখ দিয়ে টপটপ করে পানি পড়ে। এই দৃশ্য দেখেও চান বিবি মুগ্ধ।
রঙিলা বাড়িতে প্রথম ঢোকার পর মালেকাইন তাকে সামনে বসিয়ে গায়ে হাত রেখে যে কথাগুলি বলেন, সে কথাগুলি চান বিবির মনে গেথে আছে। তিনি কথা বলেন বাংলা এবং হিন্দুস্থানি মিশিয়ে। সেই কথাও চান বিবির গানের মতো লাগে।
শোন জুলেখা, তুমি রূপ নিয়ে দুনিয়াতে আসছি। গরিব ঘরের মেয়ে। এইটাই তোমার পাপ। যে নিজেই পাপ তার কপালে পাপ ছাড়া আর কী থাকবে? সে তো পাপের বাড়িতেই ঢুকবে। এই বাড়িতে পাপ কাটার ব্যবস্থা কিন্তু আছে। যে পুরুষ তোমার কাছে আসবে, সে যদি তোমার সেবায় সন্তুষ্ট হয় তাহলে তোমার কিছু পাপ কাটা যাবে। কারণ মানুষ ভগবান। মানুষকে তুষ্ট করা ভগবানকে তুষ্ট করা একই জিনিস।
তোমার রূপ আছে। সেই রূপ ধরে রাখতে হয়। রূপ ধরে রাখার নিয়মকানুন আছে। আমি তোমাকে শেখাব। তোমার যদি গানের গলা থাকে আমি তোমাকে গান শেখাব। নাচ শেখােব। যদি তোমার কপালে থাকে, তুমি বহু টাকা উপার্জন করবে। যারা তোমার কাছে আসবে, তাদের মধ্যে কারো সঙ্গে যদি আশনাই হয় তাকে বিবাহ করতে পাের। আমার কোনো অসুবিধা নাই। খাওয়া খাদ্যের মধ্যে নিরামিষ খাবে। নিরামিষ শরীর ঠিক রাখবে। শরীরই আমাদের সম্পদ- এটা মাথায় রাখবে।
ড্যান্স মাস্টার তোমাকে নাচ শেখাবে। শরীরের ভেতরে যদি নাচ থাকে। তাহলে নাচ শিখতে পারবে। যদি না থাকে, তাহলে শিখতে পারবে না। তারপরেও ড্যান্স মাষ্টার তোমাকে নাচ শেখাবে। নাচ করলে শরীর ঠিক থাকবে। ঠিকমতো নাচ করলে মন ঠিক থাকে। সেবাদাসীরা মন্দিরে দেবতার সামনে নাচ করে শরীর এবং মন দুটাই ঠিক রাখে।
আমাদের এই বাড়িটাও মন্দির। যেসব পুরুষ এই বাড়িতে আনন্দের খোজে আসে তারা দেবতা।
কখনো নিলাজ হবে না। পুরুষমানুষ। নটি বেটির কাছেও লজ্জা আশা করে। কোনো যক্ষ্মারোগীকে ঘরে নিবে না। যত টাকাই সে দিক তাকে ঘিরে নেয়া যাবে না। যক্ষ্মীরোগী চেনার উপায় আছে। আমি তোমাকে শিখায়ে দেব। তোমার স্বামী, স্বামীর দিকের আত্মীয় কাউকে ঘরে নিবে না। স্বামীকে কোনো অবস্থাতেই না। খদেরদের কারো কারো স্ত্রীরা তোমার সঙ্গে দেখা করতে আসবে। তাদের সঙ্গে কখনো কোনো অবস্থায় দেখা করবে না। খদের আমাদের দেবতা। খন্দেরের স্ত্রীরা উপদেবতা। উপদেবতারা ভয়ঙ্কর। তাদের কাছ থেকে দূরে থাকতে হয়।
যদি কখনো মনে কর এই জায়গা, এই জীবন তোমার পছন্দ না, তুমি চলে যেতে চাও, তাহলে চলে যাবে। কেউ তোমাকে আটকাবে না। আমি জেলখানা খুলে বসি নাই। দুঃখী মানুষের জন্যে আনন্দ-ফুর্তির ব্যবস্থা করেছি। মানুষকে আনন্দ দেয়ার মধ্যে পুণ্য আছে। তুমি নিজেও আনন্দে থাকার চেষ্টা করবে।
চান বিবি আনন্দে থাকার চেষ্টা ছাড়াই আনন্দে আছে। নতুন জীবনের শুরুতে প্রথম পুরুষটিকে তার বেশ পছন্দ হয়েছে। ভাটি অঞ্চলের বোকাসোকা চেহারার একজন মধ্যবয়স্ক মানুষ। ফর্সা, লম্বা। চোখেমুখে দিশাহারা ভাব। সে খুব ভয়ে ভয়ে বিছানায় পেতে রাখা শীতলপাটিতে বসল। পকেট থেকে ফুলতোলা ময়লা রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছল। বিড়বিড় করে বলল, পানি খাব ।
চান বিবি ঝকঝকে কাসার গ্রাসে পানি এনে দিল। লোকটা এক চুমুক পানি খেয়েই গ্রাস নামিয়ে রাখতে রাখতে মাটির দিকে তাকিয়ে বলল, খুবই গরম।
চান বিবি বলল, বাতাস করব?
না, বাতাস লাগবে না।
দরজার আড়ালে হাছুন উকিঝুকি দিচ্ছিল। চান বিবি তাকে ইশারা করতেই সে তালপাতার পাখা দিয়ে বাতাস শুরু করল। লোকটি বিস্মিত হয়ে বলল, আপনার মেয়ে?
চান বিবি বলল, আমার মেয়ে না। তবে মেয়ের মতোই। আমাকে আপনি আপনি বলতেছেন কী কারণে? আমি বয়সে আপনার ছোট।
লোকটি চট করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, যাই।
চান বিবি বলল, চলে যাবেন? কিছুক্ষণ জিরান। বাতাস খান। শরীর ঠাণ্ড। করেন। মন ঠাণ্ডা করেন। আসেন, গল্প করি।
লোকটা সঙ্গে সঙ্গে বসল। আবার পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের ঘাম মুছল। তবে এবার রুমালটা পকেটে ঢুকাল না। হাতে নিয়ে বসে রইল। চান বিবি বলল, রুমালে সুন্দর ফুলের কাজ। কে করেছে? আপনার স্ত্রী?
হুঁ।
আপনার ছেলেমেয়ে আছে?
দুই মেয়ে।
তারা দেখতে সুন্দর?
হুঁ।
আপনার স্ত্রীর চেহারা কেমন? সুন্দর?
হুঁ।
আমার চেয়েও সুন্দর?
না
আপনি কি কিছু খাবেন? শরবত বানায়ে দিব?
না।
ঘরে মিষ্টি আছে। মিষ্টি দিব? বেগমগঞ্জের লাড্ডু।
না।
আপনার স্ত্রীর নাম কী? বলতে না চাইলে বলতে হবে না। বলতে ইচ্ছা করলে বলেন।
তার নাম বলব না।
মেয়ে দুটার নাম কী? বলতে না চাইলে বলতে হবে না। বলতে ইচ্ছা করলে বলেন।
বড় মেয়ের নাম শরিফা। ছোট মেয়ের নাম তুলা।
তুলা নাম রেখেছেন কেন? জন্মের সময় খুব হালকা ছিল?
হুঁ। সাত মাসে হয়েছে। বাঁচার আশা ছিল না। হালিমা তাকে শিমুল তুলার বস্তায় ভরে বাঁচায়ে রেখেছিল। এখন তুলার স্বাস্থ্য খুবই ভালো। সারাদিন মারামারি করে। কামড় দেয়া শিখেছে। কামড় দিয়ে রক্ত বের করে দেয়।
আপনার স্ত্রীর নাম হালিমা?
হুঁ।
নাম বলে ফেলেছেন, এখন কি আপনার খারাপ লাগছে?
লোকটা চুপ করে রইল। প্রসঙ্গ পাল্টে জুলেখা বলল, আপনার মেয়ে তুলা আপনাকে কামড়ায়?
অনেকবার। আমার সারা গায়ে তার কামড়ের দাগ। সে শুধু তার মারে কামড়ায় না।
চান বিবি বলল, আপনার মেয়েটাকে দেখতে ইচ্ছা করছে।
লোকটা সঙ্গে সঙ্গে গুটিয়ে গেল। কয়েকবার টোক গিলে পাঞ্জাবির পকেট থেকে কালো কাপড়ের ছোট্ট থলি বের করে পাশে রাখতে রাখতে বলল, এখানে দশটা রুপার টাকা আছে। টাকার পরিমাণ কি ঠিক আছে?
চান বিবি হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল। লোকটা উঠে দাঁড়াল। চান বিবি বলল, চলে যাবেন?
হুঁ।
বিশ্রাম করেন। রাতটা থাকেন, সকালে যান।
न।
তাহলে আরেকদিন আসেন। সেদিন টাকা ছাড়াই আসেন।
আমি আর আসব না।
আমার উপর কোনো কারণে কি আপনি নারাজ হয়েছেন?
না। তুমি ভালো মেয়ে।
আপনার স্ত্রীর চেয়েও কি ভালো?
লোকটার চেহারা সামান্যক্ষণের জন্যে কঠিন হয়ে গেল। চান বিবি আগ্ৰহ নিয়ে তাকিয়ে আছে। কঠিন মুখভঙ্গি সহজ হলো। লোকটা ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, না।
রুপার টাকার থলেটা চান বিবি সরাজুবালার কাছে পাঠিয়ে দিল। এটাই নিয়ম। সরাজুবালা সেখান থেকে নিজের অংশ রেখে ফেরত পাঠাবেন। চান বিবির পুরো টাকাই সরাজুবালা ফেরত পাঠালেন। প্রথম রোজগারে ভাগ বসালেন না। চান বিবি প্রথম রোজগারের টাকায় তার ছেলে জহিরের জন্যে জামা, জুতা কিনল। বান্ধবপুর জুম্মা মসজিদের ইমাম সাহেবের জন্যে একটা তুর্কি ফেজ টুপি কিনল। শশী মাস্টারের জন্যে কিনল নকশি করা সিলেটের শীতলপাটি। জিনিসগুলি হাতে নিয়ে সে কিছুক্ষণ কাঁদল।
ভদ্রঘরের একটি মেয়ের স্থান হয়েছে। রঙিলা বাড়িতে— এই ঘটনা বান্ধবপুরে কোনো আলোড়ন তুলল না। অনেক দিন এই বিষয়টা কেউ জানলও না। সুলেমান সবাইকে বলল, স্ত্রীকে সে তালাক দিয়েছে। স্ত্রী চলে গেছে তার বাপ ভাইয়ের কাছে। মুসলমান সমাজে স্ত্রীকে তালাক দেয়া এবং স্ত্রীর বাপ-ভাইয়ের কাছে চলে যাওয়া অতি স্বাভাবিক ঘটনা। এক স্ত্রী চলে যাবে অন্য স্ত্রী আসবে। স্ত্রী একা আসবে না, সঙ্গে দাসী নিয়ে আসবে। স্ত্রীর গর্ভে যেমন সন্তান হবে, দাসীর গর্ভেও হবে। স্ত্রীর গর্ভের সন্তানরা সম্পত্তির ভাগ পাবে। বান্দির গর্ভের সন্তানরা পাবে না। তারা কামলা খাটবে। তাদের বিয়েশাদি হবে তাদের মতোই বান্দি বংশের লোকজনদের সঙ্গে। সহজ হিসাব।
তখনকার ব্যবস্থায় রঙিলা বাড়ি এমন কিছু খারাপ জায়গা না। পুরুষ মানুষদের আমোদ-ফুর্তির অধিকার আছে। তারা খাটাখাটনি করে অর্থ উপার্জন করে। সেই অর্থের খানিকটা যদি নিজের আনন্দের জন্যে ব্যয় করে, তাতে ক্ষতি কী? পুরুষ মানুষ দিনরাত স্ত্রীর আঁচলে বাধা থাকলে ধরতে হবে সে পুরুষ মানুষই না। তার কোনো সমস্যা আছে। ক্ষমতাবান পুরুষদের হতে হবে শৌখিনদার। তারা বন্দুক দিয়ে পাখি শিকার করবে। রঙিলা বাড়িতে যাবে। কিছুদিনের জন্যে বাড়িতে ঘাটুগানের ছেলে নিয়ে আসবে। ঘাটুগানের এইসব ছেলে নৃত্যবিদ্যা এবং সঙ্গীতে পারদশী। শৌখিনদার পুরুষের নানান আবদার (!) এরা মিটাবে। এইসব কর্মকাণ্ডে স্ত্রীদের মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার কিছু নাই। ঘাটুছেলেরা তাদের সতিন না। এরা কিছুদিনের জন্যে এসেছে। সতিনের মতো চিরস্থায়ী সত্ত্ব নিয়ে আসে নি।
বান্ধবপুর সেই সময় অতি বর্ধিষ্ণু অঞ্চল। রমরমা পাটের ব্যবসা। লবণের ব্যবসা। মাছের ব্যবসা। নতুন লঞ্চঘাট হয়েছে। দিনরাত লঞ্চের ভোঁ শোনা যায়। বরফকল বসেছে। প্যাটরায় বরফ ভর্তি হয়ে দৈত্যকৃতির মাছ চলে যায় নারায়ণগঞ্জ, কোলকাতায়। জলমহাল নিয়ে মারামারি খুনখুনি হয়। সাহেব পুলিশ অফিসার হাতিতে করে তদন্তে আসেন। তদন্ত শেষে পাখি শিকার করেন। সন্ধ্যার পর তাঁবুতে রঙিলা উৎসব হয়। নর্তকীরা নাচ-গান করে। ঘাটছেলেরা বুকে নারিকেলের মালা বেঁধে ঠোঁটে রঙ দিয়ে অশ্লীল ভঙ্গিমায় অতি নোংরা গান ধরে। সাহেবরা ঘনঘন মাথা নেড়ে বলেন, Not bad, Not bad at all.
এই বিপুল কর্মকাণ্ডে আমাদের জুলেখা অতি নগণ্য একজন। আপাতত তার কথা থাকুক। আমরা চলে যাই হরিচরণের স্কুলে। স্কুলের ছাত্র সংখ্যা নয়। নয়জনের মধ্যে একজন মাত্র মুসলমান। তার নাম জহির। এই ছেলেটা পড়াশোনায় ভালো। শুধু ভালো বললে কম বলা হবে। অতিরিক্ত ভালো। স্মরণশক্তি অসাধারণ। একবার কিছু পড়লেই তার মনে থাকে। শশী মাস্টার তার এই ছাত্রটিকে কোনো এক বিচিত্র কারণে সহ্য করতে পারেন না।
ব্রিটিশ সরকার সে সময়ে একটি বৃত্তি চালু করেছিলেন। সমগ্ৰ ভারতে ক্লাস টুর ছাত্রছাত্রীদের মধ্যে প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষায় এই বৃত্তি দেয়া হতো। মাসিক দুটাকা হারে এক বৎসরের জন্যে বৃত্তি। সুলেমানের ছেলে জহির এই বৃত্তি পেয়ে সবাইকে চমকে দিল। জেলা শিক্ষা অফিসার আলহাজ রমিজউদ্দিন সাহেব বৃত্তির খবর নিয়ে বান্ধবপুরে উপস্থিত হলেন। জহিরের মাথায় হাত রেখে চোখ বন্ধ করে দোয়া করলেন। তারপর জহিরকে কাছে টেনে গলা নামিয়ে বললেন, তোমার মা নাকি তোমাদের সঙ্গে থাকে না। এটা কি সত্য?
জহির বলল, সত্য।
সে থাকে কোথায়?
জহির চুপ করে রইল। জবাব দিল না।
কোথায় থাকে জানো না?
জহির এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না। আলহাজ রমিজউদ্দিন গলা আরো খাদে নামিয়ে বললেন, লোকমুখে শুনলাম তোমার মা রঙিলা নটিবাড়িতে থাকে, এটা কি সত্য?
সত্য।
ঠিক আছে। ঠিক আছে। যা হয় সবই আল্লাহ পাকের হুকুমেই হয়। উনার হুকুম বিনা কিছু হয় না। তুমি নিজের মতো লেখাপড়া চালিয়ে যাবে। তোমার মা কোথায় থাকে কী সমাচার তা নিয়া মাথা ঘামাবে না। ঠিক আছে?
হুঁ।
ছি না, বলো জি আচ্ছা, জনাব। এইসব সাহি আদব। শুধু লেখাপড়া শিখলে হবে না। আদবও শিখতে হবে। বিলো, জি আচ্ছা, জনাব।
জি আচ্ছা, জনাব।
আলহাজ্বরমিজউদ্দিন জহিরকে একটা ফাউন্টেনপেন উপহার হিসেবে দিয়ে গেলেন। ফাউন্টেনপেনের নাম রাইটার।
শশী মাস্টারের কাছে জুলেখার শীতলপাটি পৌঁছেছে। যে নিয়ে এসেছে তার নাম সামছু সদাগর। মিশাখালি বাজারে তার পাটের আড়ত। শশী মাস্টার বললেন, পাটি কে দিয়েছে?
সামছু সদাগর বললেন, রঙিলা নটিবাড়ির এক নটি দিয়েছে। রাখলে রাখেন, না রাখলে ফেলে দেন। নটির নাম চান বিবি।
চান বিবি নামে কাউকে আমি চিনি না।
আপনি মাস্টার মানুষ। আপনার না চেনাই ভালো। তার আরেক নাম জুলেখা।
জুলেখা? সামছু সদাগর বললেন, এখন কি চিনেছেন?
হ্যাঁ চিনেছি।
পরিচয় ছিল আপনার সাথে?
ছিল।
চাইপা যান। কাউরে কবেন না। মাস্টার সাব, উঠি?
শশী মাস্টার সারা দুপুর ঝিম ধরে বসে রইলেন। সন্ধ্যার পর কলের গান ছেড়ে জামগাছের নিচে গভীর রাত পর্যন্ত বসে রইলেন।
মাওলানা ইদরিসের কাছে জুলেখার পাঠানো তুর্কি টুপি পৌঁছেছে। সামছু সদাগরই নিয়ে গেছে।
মাওলানা বললেন, আপনারে তো চিনলাম না।
সামছু সদাগর বললেন, আমারে চেনার প্রয়োজন নাই। আপনার কাছে একটা জিনিস পৌঁছায়ে দেওয়ার কথা। দিলাম।
জিনিসটা দিয়েছে কে?
চান বিবি দিয়েছে।
চান বিবিকে তো চিনি না!
সামছু সদাগর উদাস গলায় বললেন, এখন তারে না চেনাই ভালো। সময়ে চেনা সময়ে না-চেনা বুদ্ধিমান মানুষের লক্ষণ। আপনি বুদ্ধিমান।
মাওলানা ইদরিস বললেন, একজন এত সুন্দর একটা টুপি পাঠায়েছে, তারে চিনিব না- এটা কেমন কথা?
সামছু বলল, চিনতে হইলে রঙিলা নটি বাড়িতে যান। ঐ মেয়ে রঙিলা বাড়ির নটি।
মাওলানা হতভম্ব গলায় বললেন, এইটা কী কথা?
সত্য কথা। নটি বেটি আপনারে টুপি পাঠায়েছে। বড়ই সৌন্দর্য মেয়ে। বেহেশতের হুর বরাবর সুন্দর। তার টুপি আপনি মাথায় দিয়ে জুম্মার নামাজ। না গাঙের পানিতে ফেলবেন— এটা আপনার বিবেচনা। আমি উঠলাম।
তুর্কি ফেজ টুপিটা টিনের ট্রাঙ্কের উপর রাখা। টুপিটা কোথেকে এসেছে মাওলানা এখন বুঝতে পারছেন। এই টুপি মাথায় দেয়ার প্রশ্নই আসে না। গাঙের পানিতে ফেলে দিয়ে আসতে হবে। টুপির মতো পবিত্র একটি বস্তু পানিতে ফেলে দেওয়া কি ঠিক? এই বিষয়ে হাদিস কোরানের পরিষ্কার ব্যাখ্যা কী তাও তিনি জানেন না। কাউকে যে জিজ্ঞেস করবেন তাও সম্ভব হচ্ছে না। হাদিস কোরান জানা লোক আশেপাশে কেউ নেই। তাঁর খুবই ইচ্ছা দেওবন্দ মাদ্রাসায় যাওয়া। তার মনে অনেক প্রশ্ন আছে। তিনি হাতির ছবি আঁকা একটা দু’নম্বরি খাতায় প্রশ্নগুলি লিখে রেখেছেন। যেমন, রোজার সময় ধূমপান করলে কি রোজা ভাঙে? চিংড়ি মাছ খাওয়া মাকরুহ। কাকড়া খাওয়াও কি মাকরুহ? মাওলানা টুপি বিষয়ক একটি প্রশ্ন খাতায় লিখলেন–
কোনো ব্যক্তি (পুরুষ বা মহিলা) যদি অসৎপথে উপার্জন করা অর্থের বিনিময়ে কাউকে টুপি, তসবিহ কিংবা জয়নামাজ দেয়। তখন সেই টুপি, তসবিহ, জয়নামাজ ব্যবহার করা কি জায়েজ আছে?
টুপিটা ঘরে আসার পর থেকে মাওলানা ভালো সমস্যায় আছেন। প্রায়ই রাতে জুলেখাকে স্বপ্নে দেখছেন। স্বপ্নের ধরন দেখে তিনি নিশ্চিত স্বপ্নগুলি ইবলিশ শয়তান দেখাচ্ছে। একটি স্বপ্নে তিনি দেখলেন জুলেখা তার স্ত্রী (নাউজুবিল্লাহ)। সে তার বাড়িতেই থাকে। ঘরদুয়ার ঠিকঠাক রাখে। রান্না করে। রাতে সব কাজকর্ম শেষ করে বানানো পান হাতে নিয়ে তাঁর সঙ্গে ঘুমাতে আসে (নাউজুবিল্লাহ)।
এরচেয়েও খারাপ স্বপ্ন একবার দেখলেন। এমন স্বপ্ন যা কাউকে বলা যাবে। না। তার অত্যন্ত মনখারাপ হলো। ইবলিশ শয়তান কোনো এক জটিল খেলা শুরু করেছে, এই বিষয়ে তিনি নিশ্চিত। তাঁর মতো নাদান মানুষ কীভাবে শয়তানের হাত থেকে বাঁচবেন? তার কতটুকই বা ক্ষমতা? হযরত আদমের মতো মানুষ শয়তানের ধোঁকা থেকে বাঁচতে পারেন নাই। এমনকি একবার আমাদের নবিজিকেও শয়তান ধোঁকা দিয়েছিল। নবিজির মুখ দিয়ে ওহি হিসেবে মিথ্যা আয়াত বলিয়েছিল। (Satanic Verses)
গভীর রাতে ইবলিশ শয়তান কিংবা তার সাঙ্গাপাঙ্গ যে তার বাড়ির চারপাশে ঘোরাঘুরি করে, গাছের ডাল নড়ায়, এটা তিনি পরিষ্কার বুঝতে পারেন। বাতাস নেই কিছু নেই, গাছের ডাল নড়ছে। একবার রাতে তসবি পড়ছিলেন, হঠাৎ পেছনের জানালা আপনাআপনি বন্ধ হয়ে গেল। আবার খুলল। আরেক রাতে তাহজ্জুতের নামাজ পড়বেন, অজু করার জন্যে বারান্দায় রাখা জলচৌকিতে বসেছেন। অজুর দোয়া পড়ে শেষ করলেন। দোয়ার অর্থ—
নাপাকি দূর করিবার, নামাজ শুদ্ধভাবে পড়িবার এবং আল্লাহ তালার নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে আমি অজু করিতেছি।
অজুর দোয়া শেষ করামাত্র তাঁর মনে হলো কেউ একজন তার ঘাড়ে ফুঁ দিয়েছে। গরম বাতাস। তিনি প্ৰচণ্ড ভয় পেলেও পেছন ফিরে তাকালেন না। অজু শেষ করলেন। তখন কেউ একজন পেছন থেকে হেসে উঠল। মেয়ে মানুষের গলা। তিনি চমকে পেছনে ফিরলেন, কাউকে দেখলেন না, তবে তাঁর হাতের ধাক্কা লেগে পিতলের বদনা জলচৌকি থেকে নিচে পড়ে গেল। বদনা উঠাতে গিয়ে দেখেন বদনার ভেতর একটা ইঁদুরের বাচ্চা মরে পড়ে আছে। ইবলিশ শয়তান অজু নিষ্ট করার জন্যে একটা ইদুরের বাচ্চা বদনার পানিতে রেখে দিয়েছিল।
এশার নামাজ শেষ করে মাওলানা বাড়িতে ফিরে রান্না বসিয়েছেন। চালডালের খিচুড়ি। এক চামচ ঘি দিয়েছেন, সুন্দর গন্ধ ছেড়েছে। এমন সময় হঠাৎ তাঁর কাছে মনে হলো শুকনা পাতায় খসখসে শব্দে কেউ একজন আসছে। মাওলানা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। শয়তানার উপদ্রব। আবার শুরু হয়েছে। মাওলানা আয়াতুল কুরসি পাঠ করে হাততালি দিলেন। তখন মনে হলো উঠানে কে একজন কাশছে। মাওলানা ভীত গলায় বললেন, কে কে?
আমি।
আমি কে? আমি কে?
মাওলানা হারিকেন হাতে বের হয়ে এলেন। চাদর গায়ে হরিচরণ দাড়িয়ে আছেন। একহাতে বেতের একটা লাঠি। অন্য হাতে হারিকেন। সঙ্গে আর কেউ নেই।
কেমন আছেন মাওলানা সাহেব?
জি জনাব, ভালো। আপনি এত রাতে!
রাত তো বেশি হয় নাই। আপনি কি আমাকে দেখে ভয় পেয়েছেন?
মাওলানা বললেন, সামান্য ভয় পেয়েছি। আমার কাছে কোনো কারণে কি এসেছেন?
হরিচরণ বললেন, ছোট্ট একটা কারণ আছে। শুনেছি আপনি পুরো কোরান শরীফ মুখস্থ করেছেন, এটা কি সত্য?
মাওলানা হঁহা-সূচক মাথা নাড়লেন। লজ্জিত গলায় বললেন, হাফেজ টাইটেল এখনো পাই নাই। কোনো বড় মাদ্রাসায় গিয়ে পরীক্ষা দিতে হবে। যেমন ধরেন দেওবন্দ মাদ্রাসা।
পরীক্ষা দিতে যান না কেন?
খরচপাতি আছে। আমি দরিদ্র মানুষ। অর্থের সংস্থান নাই।
হরিচরণ বললেন, আমি খরচ দিলে কি যাবেন?
মাওলানা চুপ করে রইলেন। হরিচরণ বললেন, আপনাদের ধর্মে কি আছে যে অমুসলমানের সাহায্য নেয়া যাবে না?
এরকম কিছু নাই।
তাহলে আমার সাহায্য নিন। দেওবন্দ থেকে ঘুরে আসুন।
জি আচ্ছা। বহুত শুকরিয়া।
হরিচরণ সামান্য ইতস্তত করে বললেন, যদি কিছু মনে না করেন একটা অনুরোধ কি করতে পারি?
মাওলানা বললেন, অবশ্যই।
আপনার মুখস্থবিদ্যার একটা নমুনা কি আমাকে শোনাবেন?
মাওলানা বললেন, অবশ্যই। অজু করে আসি।
অজু করতে হবে?
জি। নাপাক অবস্থায় কোরান মজিদ আবৃত্তি করা ঠিক না।
হরিচরণ অবাক হয়ে তাকিয়ে আছেন। মাওলানা ইদরিস জায়নামাজে বসে কোরান আবৃত্তি করছেন। তাঁর চোখ দিয়ে টপ টপ করে পানি পড়ছে।
একসময় কোরান পাঠ শেষ হলো। মাওলানা বললেন, খিচুড়ি পাক করেছি। আপনি কি আমার সঙ্গে খানা খাবেন?
অমুসলিমকে খানা খাওয়াতে আপনাদের কোনো সমস্যা নাই?
জি-না। সমস্যা কী জন্যে থাকবে?
আপনাদের ধর্মের এই জিনিসটা ভালো। আমি আগ্রহের সঙ্গেই খানা খাব। একজনের জন্যে রোধেছেন। দুইজনের কি হবে?
বেশি করে রোধেছি। যেটা বাঁচে সেটা দিয়ে সকালে নাশতা করি।
হরিচরণ তৃপ্তির সঙ্গে খেলেন। হাত ধুতে ধুতে বললেন, আরাম করে খেয়েছি। ধন্যবাদ।
মাওলানা বললেন, ধন্যবাদ কেন? আপনার তো আজ রাতে আমার এখানেই খাওয়ার কথা। সব আগে থেকে ঠিক করা।
হরিচরণ বিস্মিত হয়ে বললেন, কে ঠিক করেছে?
আল্লাহপাক ঠিক করেছেন। মানুষ পশুপাখি সবার রিজিক আল্লাহপাক নিজে ঠিক করে রাখেন। কে কবে কোথায় খানা খাবে সেটা তার জন্মের সময়ই ঠিক করা।
উঠানের কাঁঠালগাছের ডাল নাড়ছে। টিনের চালে শব্দ হচ্ছে। মাওলানা দুঃখিত গলায় বললেন, একটা শয়তান কিছুদিন ধরে বড়ই ত্যক্ত করছে।
হরিচরণ বললেন, কী বলছেন। এইসব?
হরিচরণের কথা শেষ হবার আগেই বিকট শব্দে জানালার পাল্লা বন্ধ হলো। হরিচরণ চমকে উঠলেন। মাওলানা বললেন, চলুন আপনাকে বাড়িতে দিয়ে আসি। একা যেতে পারবেন না। ভয় পাবেন।
হরিচরণ উঠে দাঁড়ালেন।
মাওলানা হারিকেন হাতে আগে আগে যাচ্ছেন। পেছনে পেছনে হরিচরণ। তিনি বেশ ভয় পাচ্ছেন।
হরিচরণ বললেন, আপনি একা বাস করেন, ভয় পান না?
পাই। তবে দোয়াকালাম আছে। দোয়াকালাম পাঠ করি।
আপনার একা একা থাকা ঠিক না। একটা বিবাহ করেন।
জি, বিবাহ করব। আমাদের ধর্মে সংসার করার নির্দেশ আছে।
কন্যা কি ঠিক করেছেন?
জি-না। আল্লাহপাক ব্যবস্থা করে দিবেন। যথাসময়ে শুভ কাৰ্য সমাধা হবে। রিজিকের মতো বিবাহ উনার নির্দেশে হয়।
হরিচরণ ছোট্ট নিঃশ্বাস ফেলে বললেন, সেই অর্থে সব কিছুই তাঁর নির্দেশ হওয়ার কথা।
মাওলানা বললেন, পাঁচটা বিষয় আলাদা করে বলা আছে— হায়াত, মউত, বিবাহ, রিজিক এবং দৌলত।
হরিচরণ বললেন, আপনাকে আর আসতে হবে না। এখন যেতে পারব। এক কাজ করলে কেমন হয়- এখন আমি আপনাকে এগিয়ে দেই। তারপর আবার আপনি আসবেন। এই করতে করতে রাত কাবার।
মাওলানা হাসছেন। হাসির স্বরগ্রাম বেশ উঁচু। তিনি জানেন এইভাবে উচ্চস্বরে হাসা ঠিক না। নবিয়ে করিম উচ্চস্বরে হাসতেন না। সমস্যা হলো, মানুষের নিজের উপর সবসময় দখল থাকে না।
হরিচরণ বাড়িতে ঢুকলেন। দিঘির বাঁধানো ঘাটে বসে রইলেন। মাওলানার বাড়িতে ভয় ভয় লাগছিল। এখানে লাগছে না। যদিও এই জায়গাটাও নির্জন এবং জঙ্গুলে। দিঘির চারদিকের ঘাস মানুষ সমান উঁচু হয়েছে। মাঝে মাঝে ঝুপড়ি ভাটগাছ। ভাটফুল গন্ধবিহীন হলেও রাতে হালকা নেশা ধরানো গন্ধ ছাড়ে। পাকাবাড়ির সামনে কামিনী ফুলের ঝাড়। কামিনী ফুলের সুবাসও রাতেই পাওয়া যায়। পূজায় ব্যবহারের জন্যে রক্তজবার বেশ কিছু গাছ নানান দিকে লাগানো আছে। জবাফুল গন্ধবিহীন। কিন্তু হরিচরণের মাঝে মাঝে মনে হয়, তিনি জবা ফুলের গন্ধও পান। এটা একধরনের ভ্রান্তি। তিনি জানেন, মানুষকে সারাজীবন নানান ভ্রান্তির ভেতর দিয়ে যেতে হয়। বয়সের সঙ্গে সঙ্গে ভ্রান্তির পরিমাণ বাড়তে থাকে। হরিচরণের মা গোলাপদাসির ক্ষেত্রে এরকম হয়েছিল। শেষ বয়সে তার কাছে মনে হয়েছিল, দিঘিটা গঙ্গার অংশ।
গঙ্গায় তর্পনের ভঙ্গিতে তিনি দিঘিতে প্রায়ই এটা সেটা দিতেন। ফুল, মিষ্টি, দেবতার ভোগ। শেষের দিকে পিতলের হাঁড়ি বাসন, সোনাদানা ফেলতে লাগলেন। হরিচরণের ধারণা, দিঘির জল সেঁচে ফেললে অনেক জিনিসপত্র পাওয়া যাবে। বিশাল দিঘির জল সিঞ্চন সহজ ব্যাপার না। তারপরেও একবার চেষ্টা নেয়া যেতে পারে।
হরিচরণ গায়ের চাদর বিছিয়ে শ্বেতপাথরের ঘাটে শুয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়লেন। ঠাণ্ডা হাওয়ায় তাঁর সুনিদ্রা হলো।
বান্ধবপুরের বর্তমান আলোচনার বিষয় মাওলানা ইদরিসের বাড়িতে হরিচরণ গো-মাংস খেয়েছেন। বিষয়টা নিয়ে হৈচৈ শুরু করেছেন অম্বিকা ভট্টাচাৰ্য। বিভিন্ন দিকে নানা দেনদরবার করছেন। হরিচরণ আগেই জাতিচ্যুত হয়েছেন। গো-মাংস ভক্ষণজনিত গুরুতর অপরাধে নতুন করে কিছু হবার কথা না। তারপরেও অম্বিকা ভট্টাচাৰ্য যথেষ্ট ঘোট পাকিয়ে ফেলেছেন। হরিচরণ এবং মাওলানা ইদরিস দুজনেই গুরুতর অপরাধ করেছে। একজন গো-মাংস খেয়েছে, আরেকজন ধর্ম নষ্ট করার জন্যে খাইয়েছে। এই দুজনকেই অঞ্চল ছেড়ে চলে যাওয়া উচিত।
বান্ধবপুরের সীমান্তে জাগ্রত বটগাছের নিচে যে বটকালি মন্দির সেই মন্দিরের মূর্তি মাথা ভাঙা অবস্থায় পাওয়া গেছে। অম্বিকা ভট্টাচার্য নিশ্চিত, এই ভয়াবহ অন্যায় কার্যের পেছনেও আছে মাওলানা ইদরিস। কারণ কয়েক দিনই তাকে এই রাস্তায় যাতায়াত করতে দেখা গেছে। তাছাড়া মা কালী স্বপ্নে দেখা দিয়ে ইশারায় তাকে বলেছেন, মূর্তি যে ভঙেছে তার মুখভর্তি দাড়ি।
শাল্লার দশআনি মুসলমান জমিদার নেয়ামত হোসেন মাওলানা ইদরিসকে ডেকে বলেছেন, আপনি কী শুরু করেছেন! গো-মাংস রোধে রোধে খাওয়াছেন।
ইদরিস বিনীত ভঙ্গিতে বললেন, গো-মাংস কোথায় পাব বলেন? বান্ধবপুরে গরু জবেহ হয় না।
কথা কম বলেন। লম্বা দাড়ির মানুষ কথা বেশি বলে। আপনার দাড়ি লম্বা। জলে বাস করলে কুমিরের সঙ্গে বিবাদ করা যায় না। বাস করেন হিন্দু অঞ্চলে। হিন্দুরা এখানে কুমির। কিছু বুঝেছেন?
জি, বুঝেছি।
কিছুই বুঝেন নাই। আপনি হিন্দু মুসলিম দাঙ্গা বাধাতে চান— এটা এখন পরিষ্কার। কোন সাহসে আপনি কালীমূর্তি ভাঙলেন?
জনাব এই কাজ আমি করি নাই।
আপনি না করলেও আপনার নির্দেশে হয়েছে। এই বিষয়ে আমার কাছে খবর আছে। রঙিলা বাড়িতেও আপনি কয়েকবার গিয়েছেন। চাদর দিয়ে মুখ ঢেকে গিয়েছেন। এই বিষয়েও আমার কাছে খবর আছে।
মাওলানার চোখ দিয়ে পানি পড়তে লাগল। তিনি পাঞ্জাবির আস্তিনে ঘনঘন চোখ মুছছেন। তাঁর শরীর কেঁপে কেঁপে উঠছে। এই দৃশ্য নেয়ামত হোসেনকে মােটেই স্পর্শ করল না। তিনি কঠিন গলায় বললেন, আপনার মাসিক বৃত্তি আজ থেকে আমার ষ্টেট আর দিবে না। আপনি অন্য কোথাও চলে যান। আপনার কারণে হিন্দু মুসলিম সম্প্রীতি নষ্ট হচ্ছে, এটা বুঝেছেন?
জি, জনাব।
নানান জায়গায় হিন্দু মুসলিম হাঙ্গামা হুজ্জত হচ্ছে। আমি আমার অঞ্চলে এটা হতে দেব না। ম্যাজিষ্ট্রেট সাহেব এই বিষয়ে আমাকে পত্র দিয়েছেন।
জনাব, আমাদের কাঁধের দুই ফেরেশতা কেরামন কাতেমিন সাক্ষী, আমি কিছুই করি নাই।
আপনি দুই ফেরেশতাকে সাক্ষী মেনেছেন। খুবই ভালো কথা। এরা কোর্টে উকিলের জেরার জবাব দিবে না। এটা বোঝার মতো বুদ্ধি কি আপনার আছে? আমার তো মনে হয় নাই। আচ্ছা এখন বিদায় হন, অনেক কথা বলে ফেলেছি।
মসজিদের কাজ কি তাহলে আর করব না?
না। তবে যদি সব অপরাধ স্বীকার করে সবার কাছে ক্ষমা চান, তাহলে বিবেচনা করে দেখব।
যে অপরাধ করি নাই সেই অপরাধ কীভাবে স্বীকার করব?
আপনি বুরবাক। এখন বিদায় হন। বুরবাকের সাথে কথা বলতে নাই। বুরবাকের সঙ্গে কথা বললে আয়ুক্ষয় হয়।
অনেকদিন এই অঞ্চলে আছি, একটা মায়া পড়ে গেছে।
আপনার অন্তরভর্তি মায়া। এত মায়া নিয়া এক জায়গায় থাকা ঠিক না। বিভিন্ন জায়গায় যান। মায়া দিতে থাকেন। মায়ার চাষ করেন।
মাওলানা চলে এলেন। বাড়িতে না গিয়ে মসজিদের দিকে রওনা হলেন। আজ সারাদিন এবাদত বন্দেগি করবেন। তার ধারণা, নিজের অজান্তে তিনি কোনো একটা অপরাধ করেছেন বলেই আল্লাহপাক তাকে এই শাস্তি দিচ্ছেন। শরীরকে শুদ্ধ রাখার জন্যে কয়েকটা নফল রোজা রাখতে হবে। রোজা শরীর শুদ্ধ রাখার মহৌষধ। শরীর শুদ্ধ হলেই মন শুদ্ধ হবে। নেয়ামত হোসেনের কথা শুনে মন অশান্তও হয়েছে। মনকে শান্ত করতে হবে। রিজিক নিয়ে তিনি বেশি। চিন্তা করছেন আল্লাহপাকের উপর ভরসা করছেন না,- এটা একটা নাফরমানি। তিনি যে ব্যবস্থা করে রেখেছেন তাই হবে। তাঁর সমস্ত সিদ্ধান্তই মেনে নিতে হবে। এর নাম ঈমান।
মসজিদের বারান্দায় সুলেমানের ছেলেটা বসে আছে। তার চোখেমুখে দিশাহারা ভাব। দূর থেকে দেখেই মনে হচ্ছে, সে বড় কোনো সমস্যায় পড়েছে।
মাওলানা বললেন, তোর কী হয়েছে?
ছেলে জবাব দিল না। অন্যদিকে তাকিয়ে বসে রইল। তার চোখমুখ কঠিন।
মাওলানা বললেন, আমারে কিছু বলবি?
জহির উঠে চলে গেল। ছেলেটা অল্প সময়ে কয়েকটা বেআদবি করে ফেলেছে। মুরুব্বি মানুষকে দেখেও সালাম দেয় নাই। প্রশ্নের জবাব না দিয়ে উঠে চলে গেছে। মাওলানার উচিত রাগ করা, তিনি রাগ করতে পারছেন না। মানসিক কষ্টের সময় মানুষ ভুলভ্রান্তি করে। সেই ভুলভ্রাত্তি ক্ষমার চোখে দেখতে হয়। সুলেমান দ্বিতীয়বার বিবাহ করেছে। সেই কারণেই হয়তো ছেলেটা কষ্টে আছে।
মাগরেব এবং এশার নামাজ শেষ করে মাওলানা বাড়ি ফিরে গেলেন। সঙ্গে টর্চ ছিল না, তাতে সমস্যা হলো না। ফকফকা চান্নি। জঙ্গলের মাথার উপর বিশাল চাদ। পূর্ণিমার রাতে জিন ভুত থাকে না। ওদের কর্মকাণ্ড অমাবশ্যায়। চাঁদের হিসাবে তাদের চলাচল। তারপরেও মাওলানা আয়াতুল কুরাসি পড়তে পড়তে এগুচ্ছেন। বেতঝোপের পাশে তাঁর গা ছমছম করতে লাগল। এই জায়গাটা সবচে’ খারাপ। এখান থেকে নদীর পাড়ের শ্মশানঘাট দেখা যায়। শ্মশানঘাটে প্রতিদিনই একটা দুটা মারা পোড়ানো হয়। মাংসপোড়া গন্ধ এবং কাঠকয়লার গন্ধে বাতাস ভারী হয়ে থাকে, শরীর গুলায়। আজও মরা পোড়ানো হচ্ছে। তবে মরা পোড়ানোর গন্ধ আসছে না। উত্ত্বরে বাতাস বইতে শুরু করেছে। গন্ধ ভেসে যাচ্ছে দক্ষিণে।
মাওলানা বাড়ি ফিরে অবাক হলেন। উঠানে জহির বসে আছে। তার সঙ্গে টিনের ট্রাংক। সে বসে আছে ট্রাংকের উপর। তার গায়ে চাঁদের আলো পড়েছে। টিনের ট্রাংকটা নতুন। চাঁদের আলোতে ট্রাংক ঝলমল করছে। মাওলানা বললেন, তোর ঘটনা কী?
জহির অন্যদিকে তাকিয়ে বলল, আইজ থাইক্যা আপনার লগে থাকব।
মাওলানা বললেন, তুই যে এইখানে তোর বাপ জানে?
জহির হ্যাঁ-সূচক মাথা নাড়ল।
দুপুরে খাওয়া দাওয়া হইছে?
জহির জবাব দিল না।
মাওলানা বললেন, আয় খাওয়া খাদ্যের ব্যবস্থা করি। বেগুন পুড়া, ডাইল ভাত চলিব?
হুঁ।
ঘরে ডিমের সালুন আছে। ডিমের সালুন খাইতে চাস?
হুঁ।
মাওলানা রাঁধতে বসলেন। জহির তার সামনে বসে আছে। তার বসে থাকার ভঙ্গিতেই মনে হচ্ছে সে ক্ষুধায় কাতর। রান্না শেষ না হওয়া পর্যন্ত গল্পগুজব করে ছেলেটাকে ভুলিয়ে রাখতে হবে।
নতুন মা’র নাম কী?
হালিমা।
বড়ই ভালো নাম। নেক নাম। বিবি হালিমার নাম শুনছস?
না।
কস কিরে পুলা? বিবি হালিমা নবিজির দুধমা। হারিস হইল। উনার দুধ পিতা। স্মরণে রাখিস।
হুঁ।
তোর নতুন মা তোরে কষ্ট দেয় না-কি রে?
না।
মারধোর করে?
না।
তাইলে তুই আমার কাছে থাকতে আসছস, ঘটনা কী?
জহির জবাব দিল না। মাওলানা বললেন, আমার এই বাড়ি খারাপ। জিনের আনাগোনা। আপনাআপনি জানালা বন্ধ হয়, জানালা খুলে। গাছের ডাল নড়ে। তুই ভয়ে মইরা যাবি।
জহির মাথা নিচু করে হাসছে।
মাওলানা অবাক হয়ে বললেন, হাসছ কেন?
জহির বলল, আপনের বাড়িত বান্দর আছে। বান্দরে ত্যক্ত করে।
তুই জানস ক্যামনে?
আমি দেখছি। বান্দরে জানালা টানাটানি করে। দুইটা বান্দর।
মাওলানা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। বাড়িতে জিন ভূতের এত সহজ ব্যাখ্যা তার মাথায় আসে নি।
পুলা, তোর বুদ্ধি তো ভালো।
জহির মাথা নিচু করে হাসল।
হাত-মুখ ধুইয়া আয়। খানা হইছে।
জহির অতি দ্রুত খাচ্ছে। মাওলানা খাওয়া বন্ধ করে তাকিয়ে আছেন। ক্ষুধার্ত একটি শিশু আগ্রহ করে খাচ্ছে, এরচে’ সুন্দর দৃশ্য পৃথিবীতে কি আছে?
হরিচরণের বাড়িতেও একজন খেতে বসেছেন। তিনিও খুব আগ্রহ নিয়ে খাচ্ছেন। তার নাম শশাংক পাল। এই অঞ্চলের প্রাক্তন জমিদার। আজ তার হতদৈন্য দশা। গায়ের কাশ্মীরি শালটা অবশ্যি দামি। শালের নিচে রুপার থালা দুটো দামি। তিনি এসেছেন। থালা দুটা হরিচরণকে দিয়ে কিছু টাকা নিতে। খুব বেশি না, পঞ্চাশটা রুপার টাকা। হরিচরণ থালা রাখেন নি, তবে পঞ্চাশ টাকা দিয়েছেন।
শশাংক পাল বললেন, তোমার ব্যবহারে সন্তুষ্ট হয়েছি। হাতি গর্তে পড়লে সবাই খারাপ ব্যবহার করে, তুমি তা করো নি। মানুষ হিসেবে তুমি উত্তম।
হরিচরণ বললেন, আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে ক্ষুধার্তা। আপনি কি আমার এখানে খান খাবেন?
শশাংক পাল বললেন, খাব। পোলাও খেতে ইচ্ছা করছে। পোলাও খাব। মুরগির মাংস খাব। ঝাল দিয়ে রাঁধতে বলো। ইদানীং ঝাল ছাড়া মুখে কিছু রুচে না। শরীর পুরোপুরি গেছে। রুচি নষ্ট হয়ে গেছে। একদিক দিয়ে ভালো। খাওয়া জুটে না।
কলিকাতা চলে যান না কেন? শুনেছি সেখানে আপনার বড় বড় আত্মীয়স্বজন আছে।
ঠিকই শুনেছ। যাই না, ওদের মুখ দেখােব কীভাবে?
আপনার যে অবস্থা, এত কিছু ভাবেন কেন?
তাও ঠিক। মুরগির মাংসের সঙ্গে ডিমের ভুনা করতে বলো। বেশি করে পিয়াজ দিতে বলবে। যখন কষা কষা হবে তখন চায়ের চামচে আধা চামচ চিনি দিবে। ত্রিপুরার মহারাজার পূণ্যার সময় একবার উনার নিমন্ত্রণে ত্রিপুরা গিয়েছি। নীরমহলে দুইরাত থেকেছিলাম। তখন ডিমের এই রান্না খেয়েছি।
আপনার যখন ভালো কিছু খেতে ইচ্ছা করে আমাকে জানাবেন, আমি ব্যবস্থা করব।
বললেই তো ব্যবস্থা করতে পারবে না। ময়ুরের মাংস খেতে ইচ্ছা করে। গৌরীপুরের মহারাজার বাড়িতে খেয়েছিলাম। তিনি ময়ুর আনিয়েছিলেন রাজস্থান থেকে। বাবুর্চিও রাজস্থান থেকে এসেছিল। ময়ূরের মাংস খেয়ে এত আনন্দ পেয়েছিলাম যে বাবুর্চিকে বিশটা রুপার টাকা দিয়েছিলাম।
ময়ূরের মাংস খাওয়াতে পারব না।
পারবা না জানি। কী আর করা। ঘটনা শুনেছি?
কী ঘটনা?
মসজিদের যে মাওলানা তার পাছায় লাথি দিয়ে তাকে অঞ্চল ছাড়ার ব্যবস্থা করেছেন।
কে করেছেন?
তারই স্বজাতি। শাল্লার জমিদার। মাওলানা ধরা খেয়েছে তার স্বজাতির
কাছে।
আপনি মনে হয় খুশি।
শশাংক পাল হাই তুলতে তুলতে বললেন, অবশ্যই আমি খুশি। কাউকে বিপদে পড়তে দেখলে আমার খুশি লাগে।
হরিচরণ বললেন, মাওলানা ভালো মানুষ। আমি তাকে বিপদে পড়তে দেব না।
শশাংক পাল বললেন, একমাত্ৰ তুমিই এখন তাকে রক্ষা করতে পারবে। তোমার ক্ষমতা আছে। এই দুনিয়ায় ক্ষমতাই সব। জমিদারি কেমন চলছে?
ভালো। আপনার পুরনো কর্মচারীরাই কাজকর্ম দেখছে। তাদের সঙ্গে আছে শশী মাষ্টার।
শশী মাস্টার নাকি পাগল?
ভাবের মধ্যে থাকে, তবে পাগল না।
ভাবের পাগল কিন্তু বড় পাগল, এটা খেয়াল রাখবা।
আচ্ছা খেয়াল রাখব।
খাওয়া শেষ করে শশাংক পাল হরিচরণের বৈঠকখানাতে শুয়ে পড়লেন। তার হাঁপানির টান উঠেছে। এই অবস্থায় হেঁটে কোথাও যাওয়া সম্ভব না।
শশাংক পাল আধশোয়া হয়ে পালংকে বসে আছেন। তাঁর মুখভর্তি পান। ঠোঁট বেয়ে পানের রস গড়াচ্ছে। এদিকে তার খেয়াল নেই। হরিচরণ তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আছেন।
শশাংক পাল বললেন, তুমি কি জোড়াসাঁকোর রবি ঠাকুরের নাম শুনেছ?
শুনেছি।
গান লেখে, গান গায়। তার গান জোড়াসাঁকোর বাড়িতে শুনেছি, মধুর গলা।
তার কথা হঠাৎ উঠল। কেন?
উনি বিরাট পুরস্কার পেয়েছেন। নোবেল পুরস্কার। তার অবস্থা দেখ। আর আমার অবস্থা দেখ। গান-কবিতা আমিও লিখতাম। ট্রাংকভর্তি লেখা ছিল। সবই নিয়তি।
সময় ১৯১৩ সন। ঔপন্যাসিক টমাস হার্ডি সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পাবেন এই বিষয়ে সবাই যখন নিশ্চিত তখন হঠাৎ নোবেল কমিটি মত পাল্টালেন। বাংলাভাষী এক কবিকে এই পুরস্কার দিয়ে দিলেন।