দ্বিতীয় পৰ্ব – মৌলবাদ
৫. যুদ্ধরেখা (১৯৭০-১৯০০)
উনবিংশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ এটা স্পষ্ট হয়ে যায় যে, পশ্চিমে অবশেষে পূর্ণভাবে বিকশিত নতুন সমাজ আসলে যেমনটা অনেকে কল্পনা করেছিল সেরকম সর্বরোগের মহৌষধ জাতীয় কিছু নয়। হেগেলের দর্শনকে অনুপ্রাণিত করা গতিশীল আশাবাদ বিভ্রান্তিকর সন্দেহ ও অস্থিরতার পথ খুলে দিয়েছিল। একদিকে ক্রমশঃ শক্তিশালী থেকে শক্তিশালী হয়ে উঠছিল ইংল্যান্ড; শিল্প বিপ্লব কোনও কোনও জাতি রাষ্ট্রকে তাদের অতীতের যেকোনও সময়ে অর্জিত সম্পদ ও শক্তি থেকে অনেক বেশি কিছু এনে দেওয়ায় এক ধরনের আস্থা ও প্রভুত্বমূলক ভাব এনে দিয়েছিল। কিন্তু চার্লস বদলেয়ারের লে ফ্লিইয়ার্স দু মাল (১৮৫৭)-এ অনুসন্ধান করা বিচ্ছিন্নতা, বিষাদ ও নির্লিপ্ততা, আলফ্রেড টেনিসনের ইন মেমোয়িামে-র (১৮৫০) তুলে ধরা সন্দেহ ও ফ্লবেয়ারের মাদাম বোভারি (১৮৫৬) উপন্যাসের কেন্দ্রিয় চরিত্রের বিধ্বংসী নিস্পৃহতা ও অসেন্তাষের মতোই ছিল এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। সাধারণ মানুষকে অস্পষ্টভাবে ভীত করে তুলছিল। এখন থেকে একই সময়ে আধুনিক সমাজের সাফল্য উদযাপন করার পাশাপাশি নারী-পুরুষ এক ধরনের শূন্যতা, এক ধরনের অস্তিত্বহীনতার বোধে আক্রান্ত হয়, এর ফলে জীবন হয়ে পড়ে অর্থহীন; আধুনিকতার বিভ্রান্তির ভেতর অনেকেই নিশ্চয়তার জন্যে আকুতি বোধ করেছে; কেউ কেউ কাল্পনিক প্রতিপক্ষ ও সর্বজনীন ষড়ড়ন্ত্রের স্বপ্নের ভেতর দিয়ে তাদের এইসব ভীতিকে প্রকাশ করেছে।
আধুনিক সংস্কৃতির পাশাপাশি গড়ে ওঠা তিনটি একেশ্বরবাদী ধর্মের সব কটিতে আমরা মৌলবাদী আন্দোলনে এই সমস্ত উপাদানই আবিষ্কার করব। বিপরীত দিকে হতাশাজনক প্রমাণ লক্ষ করার পরেও মানবজাতি জীবনের একটা পরম মূল্য ও অর্থ আছে, এমন একটা ধারণা ছাড়া বেঁচে থাকা অসম্ভব বলে আবিষ্কার করে। প্রাচীন বিশ্বে মিথলজি ও আচার জনগণকে ঠিক মহান শিল্পকর্মগুলোর মতোই শূন্যতা থেকে রক্ষাকারী এক ধরনের পবিত্র তাৎপর্যের অনুভূতি সৃষ্টি করতে সাহায্য করেছে। কিন্তু পাশ্চাত্য ক্ষমতা ও সাফল্যের উৎস বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ মিথকে বাতিল করে কেবল যুক্তিই সত্যের দিকে নিয়ে যেতে পারে বলে ঘোষণা দিয়েছে। কিন্তু তারপরেও যুক্তি পরম প্রশ্নগুলোর কোনও উত্তর দিতে পারেনি; কখনওই তা লোগেসের এখতিয়ারের ছিল না। ফলে ক্রমবর্ধমান সংখ্যক পাশ্চাত্য নারী-পুরুষের পক্ষে প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস পালন করা আর সম্ভব ছিল না।
অস্ট্রিয় মনস্তাত্ত্বিক সিগমান্ড ফ্রয়েড (১৮৫৬-১৯৩৯) আবিষ্কার করবেন যে মানব সন্তানরা জোরালভাবে মৃত্যু-আকাঙ্ক্ষার পাশাপাশি কামনা ও প্রজননের ইচ্ছাতেও তাড়িত হয়। এমবর্ধমান হারে আধুনিক সংস্কৃতিতে নিশ্চিহ্নতার এক ধরনের আকাঙ্ক্ষা (আর এর ভীতি) জেগে উঠবে। সাধারণ মানুষ নিজেদের তৈরি আধুনিকতা থেকেই মুখ ফিরিয়ে নিতে শুরু করার পাশাপাশি একই সময়ে এর সন্দেহাতীত সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করে চলবে। আধুনিক বিজ্ঞানের কল্যাণেই পশ্চিমের বেশির ভাগ মানুষ স্বাস্থ্যবান হয়ে উঠেছিল, পেয়েছিল দীর্ঘ আয়ু; অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের অর্থ ছিল জীবন অধিকতর ন্যায়সঙ্গত। আমেরিকান ও ইউরোপিয়রা তাদের সাফল্য নিয়ে সঠিকভাবেই গর্বিত ছিল। কিন্তু আলোকনের চিন্তকদের টিকিয়ে রাখা সর্বজনীন ভ্রাতৃত্ববোধের স্বপ্ন অলীক কল্পনা বলে প্রমাণিত হতে চলেছিল। ফ্রাংকো-প্রুশিয়ান যুদ্ধ (১৯৭০-৭১) আধুনিক মারণাস্ত্রের ভয়ঙ্কর প্রভাব তুলে ধরেছিল এবং এক ধরনের উপলব্ধির বিস্তার ঘটছিল যে বিজ্ঞানের হয়তো ক্ষতিকর মাত্রাও থাকতে পারে। এক ধরনের অ্যান্টিক্লাইমেক্সের বোধ জেগে উঠেছিল। উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে বিপ্লবী বছরগুলোয় এক নতুন ও উন্নত বিশ্ব যেন মানবজাতির হাতে ধরা দিয়েছে বলে মনে হয়েছিল। কিন্তু এই আশা কোনওদিনই পূরণ হয়নি। তার বদলে শিল্প বিপ্লব নতুন নতুন সব সমস্যা হাজির করেছে, এনেছে নতুন অবিচার ও শোষণ। হার্ড টাইমস (১৮৫৪)-এ চার্লস ডিকেন্স শিল্প নগরীকে নরক হিসাবে তুলে ধরে আধুনিক বাস্তববাদী যুক্তিবাদ নৈতিকতা ও ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদের পক্ষে বিধ্বংসী প্রমাণিত হতে পারে বলে দেখিয়েছেন। নতুন মেগাসিটিগুলো বিপুল দ্ব্যর্থবোধকতার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। ‘অন্ধকার অশুভ কলকারখানাকে’ প্রত্যাখ্যানকারী রোমান্টিক কবিরা শহুরে জীবন থেকে পালিয়ে গেছেন, আবার সমানভাবে তাঁরা অক্ষত পল্লী এলাকার জন্যে ইতিবাচক আকঙ্ক্ষায় অনুপ্রাণিত হয়েছেন। ব্রিটিশ সমালোচক জর্জ স্টেইনার ১৮৩০-র দশকে বিকাশ লাভ করা চিত্রকলা এক অদ্ভুত ধরনের কৌশলের উল্লেখ করেছেন, যাকে ‘আধুনিকতার প্রতি-স্বপ্ন’ হিসেবে দেখা যেতে পারে। মহান পাশ্চাত্য সাফল্যকে প্রতীকায়িত করে তোলা আধুনিক শহরগুলোকে-লন্ডন, প্যারিস ও বার্লিন-অকল্পনীয় কোনও বিপর্যয়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ার বর্ণনা দেওয়া হয়েছে।৺ লোকজন সভ্যতার বিনাশ নিয়ে জল্পনা কল্পনা শুরু করেছিল; সেই সাথে তার বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাস্তব পদক্ষেপও নিতে চেয়েছে।
ফ্রাংকো-প্রুশিয়ান যুদ্ধের পর ইউরোপের জাতিগুলো এক উন্মত্ত অস্ত্র প্রতিযোগিতায় মেতে ওঠে, ফলে অনিবার্যভাবে এগিয়ে যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের দিকে। যুদ্ধকে তারা ডারউনিয় প্রয়োজনীয়তা হিসাবে দেখতে শুরু করেছিল, যেখানে কেবল যোগ্যতমই টিকে থাকবে। আধুনিক কোনও দেশের অবশ্যই সবচেয়ে বৃহৎ সেনাদল আর বিজ্ঞানের কাছ থেকে পাওয়া সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অস্ত্রশস্ত্র থাকতে হবে। ইউরোপিয়রা মর্মবিদীর্ণ করা দেবত্ব আরোপের ভেতর দিয়ে জাতির আত্মাকে শুদ্ধ করে তোলার যুদ্ধের স্বপ্ন দেখেছে। ব্রিটিশ লেখক আই.এফ. ক্লার্ক দেখিয়েছেন, ১৮৭১ থেকে ১৯১৪ সালের মধ্যে কোনও উপন্যাস বা ছোট গল্পে ইউরোপিয় কোনও কোনও দেশে ভয়ঙ্কর ভবিষ্যতের যুদ্ধের বর্ণনা দেওয়া হয়নি এমন একটিও বছর খুঁজে পাওয়া অস্বাভাবিক ছিল। ‘আগামী মহাযুদ্ধ’-কে ভয়ঙ্কর কিন্তু অনিবার্য বিপদ হিসাবে কল্পনা করা হয়েছে: ধ্বংসের ভেতর দিয়ে জাতি আবার এক নতুন ও বর্ধিত জীবনে উন্নীত হবে। ঊনবিংশ শতাব্দীর একেবারে শেষের দিকে বিটিশ উপন্যাসিক এইচ.জি. ওয়েলস দ্য ওয়ার অভ দ্য ওয়ার্ল্ডস (১৮৯৮) উপন্যাসে এই ইউটোপিয় স্বপ্নকে ফুটো করে দেন, সেটা কোন দিকে যাচ্ছে তাও দেখিয়ে দেন তিনি। বিজাণু অস্ত্রে লন্ডনের জনমানব শূন্য হয়ে যাওয়ার ভীতিকর সব ছবি ফুটে উঠেছিল, ইংল্যান্ডের পথঘাট শরণার্থীতে গিজগিজ করছে। খাঁটি বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে টেনে আনা সামরিক প্রযুক্তিবিদ্যার বিপদ বুঝতে পেরেছিলেন তিনি। ঠিকই করেছিলেন। এই অস্ত্র প্রতিযোগিতা সোম-এর দিকে টেনে নিয়ে গেছে। ১৯১৪ সালে যুদ্ধ শুরু হলে ইউরোপের জনগণ-যারা চল্লিশ বছর ধরে সব যুদ্ধের অবসান ঘটানো যুদ্ধের অপেক্ষা করে আসছিল-সোৎসাহে যোগ দিয়েছিল এই বিরোধে। একে ইউরোপের সমবেত আত্মহত্যা হিসাবে দেখা যেতে পারে। আধুনিকতার সাফল্য সত্ত্বেও সর্বস্ববিধ্বংসী মৃত্যু-ইচ্ছারও অস্তিত্ব ছিল, ইউরোপের জাতিগুলো আত্মধ্বংসের এক বিকৃত ফ্যান্টাসি লালন করছিল।
আমেরিকায় অধিকতর রক্ষণশীল প্রটেস্ট্যান্টরা একই রকম দৃষ্টিভঙ্গির অংশীদার ছিল, তবে তাদের দুঃস্বপ্নের দৃশ্যপট ধর্মীয় চেহারা নিয়েছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও এক ভয়ঙ্কর বিরোধে আক্রান্ত হয়েছিল, ক্লাইমেক্সসুলভ এক পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল তাতে। উত্তর ও দক্ষিণের রাজ্যগুলোর ভেতরের গৃহযুদ্ধকে (১৮৬১–৬৫) প্রলয়বাদী আলোকে দেখছিল আমেরিকানরা। উত্তরবাসীদের বিশ্বাস ছিল বিরোধের ফলে জাতি শুদ্ধ হয়ে উঠবে; সৈন্যরা ‘গ্লোরি অভ দ্য কামিং অভ দ্য লর্ড,’৫ গেয়েছে। যাজকগণ আলো ও অন্ধকারের শক্তির, মুক্তি ও দাসত্বের যুদ্ধের আরমাগেদনের কথা বলেছেন। তাঁরা এই আগুনের মতো বিপদ থেকে অনেকটা ফিনিক্স পাখির মতো নতুন পুরুষ ও নতুন কালপর্বের আবির্ভাবের প্রত্যাশা করেছেন।৺ কিন্তু আমেরিকাতেও কোনও বেপরোয়া সাহসী জগতের অস্তিত্ব ছিল না। তার বদলে যুদ্ধের শেষ নাগাদ গোটা শহর ধ্বংস হয়ে গেছে, পরিবারগুলো ভেঙে টুকরো টুকরো হয়েছে, এবং শুরু হয়েছিল শ্বেতাঙ্গ দক্ষিণী পাল্টা হামলা। ইউটোপিয়ার বদলে উত্তরের রাজ্যগুলো কৃষিভিত্তিক সমাজ থেকে শিল্পায়িত সমাজে দ্রুত গতির পরিবর্তনের অভিজ্ঞতা লাভ করেছে। নতুন নতুন শহর গড়ে তোলা হয়েছে, পুরোনো শহরগুলো আকারের দিক থেকে বিস্ফোরিত হয়েছে। দক্ষিণ ও পূর্ব ইউরোপ থেকে দলে দলে অভিবাসীরা এসে ভীড় করেছে দেশে। লোহা, তেল ও ইস্পাত শিল্প থেকে পুঁজিবাদীরা দারুণ লাভ হাতিয়ে নিয়েছে; অন্যদিকে শ্রমিকরা ন্যূনতম চাহিদা স্তরের নিচে বাস করেছে। কলেকারখানায় নারী ও শিশুদের শোষণ করা হচ্ছিল: ১৮৯০ সাল নাগাদ প্রতি পাঁচজন শিশুর ভেতর একজন কাজে নিয়োজিত ছিল। কাজের পরিবেশ ছিল খুবই খারাপ, কর্মঘণ্টা দীর্ঘ, যন্ত্রপাতি নিরাপত্তাহীন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিশাল অংশ, বিশেষ করে দক্ষিণ কৃষি নির্ভর রয়ে গিয়েছিল বলে শহর ও পল্লী এলাকার ভেতরও সাগরসম বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছিল। ইউরোপের সমৃদ্ধির আড়ালে এক শূন্যতার অবস্থান থেকে থাকলে ভেতরের সারবস্তু ছাড়াই একটি দেশে পরিণত হতে চলেছিল আমেরিকা।
ইউরোপের মানুষকে এমন মুগ্ধ করে রাখা সেক্যুলার ‘ভবিষ্যৎ যুদ্ধের’ ঘরানা অধিকতর ধার্মিক আমেরিকানদের আকৃষ্ট করতে পারেনি। তার বদলে কেউ কেউ ঈশ্বর ও শয়তানের মাঝে এক চূড়ান্ত লড়াইয়ের কল্পনা করে এই অশুভ সমাজকে উপযুক্ত পরিসমাপ্তির দিকে নিয়ে যাওয়া পরকালতত্ত্বে আরও গভীরতর আগ্রহ সৃষ্টি করে নিয়েছিল। উনবিংশ শতাব্দীতে আমেরিকায় শেকড় গেড়ে বসা নতুন প্রলয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গির নাম ছিল প্রি-মিলেনিয়াম, কারণ এখানে হাজার বছরের শাসনকাল সূচিত হওয়ার আগেই ক্রাইস্টের প্রত্যাবর্তন ঘটার কল্পনা করা হয়েছে (তখনও উদার প্রটেস্ট্যান্টদের হাতে চর্চা অব্যাহত থাকা আলোকনের প্রাচীন ও আধিকতর আশাবাদী পোস্টমিলেনিয়ানিজম মানবজাতি আপন প্রয়াসেই ঈশ্বরের রাজ্য উদ্বোধন ঘটানোর কল্পনা করেছিল, কেবল মিলেনিয়াম প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পরেই পৃথিবীতে ফিরে আসবেন ক্রাইস্ট)। ইংরেজ জন নেলসন ডারবি (১৮০০-৮২) নতুন প্রি-মিলেনিয়াম প্রচার করেছিলেন; ব্রিটেনে অল্প সংখ্যক অনুসারী পেলেও ১৮৫৯ থেকে ১৮৭৭ সালের ভেতর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরের সময় দারুণ প্রশংসিত হন তিনি। তাঁর চোখে আধুনিক বিশ্বে মঙ্গলময় কিছুই ছিল না। ধ্বংসের দিকে ছুটে যাচ্ছে এটা। আলোকনের চিন্তকরা যেমন আশা করেছিলেন তেমনি আরও বেশি করে গুণবান হওয়ার বদলে মাবনাজাতি এতটাই নৈতিকভাবে কলুষিত হয়ে পড়েছে যে ঈশ্বর অচিরেই হস্তক্ষেপ করতে বাধ্য হবেন এবং মানবজাতির উপর অবর্ণনীয় দুর্ভোগ চাপিয়ে দিয়ে তাদের সমাজকে ধ্বংস করে দেবেন। কিন্তু এই অগ্নিময় বিপদের ভেতর থেকে বিশ্বাসী ক্রিশ্চানরা বিজয়ীর বেশে বের হয়ে আসবে, ক্রাইস্টের চূড়ান্ত বিজয় ও মহান রাজ্যেকে উপভোগ করবে।
বাইবেলে অতীন্দ্রিয় অর্থের সন্ধান করেননি ডারবি একে আক্ষরিক অর্থ উল্লেখকারী দলিল হিসাবে বিবেচনা করেছেন। পয়গম্বর ও বুক অভ রেভেলেশনের লেখকগণ প্রতীকী ভাষায় কথা বলছিলেন না, বরং নিখুঁত পূর্বাভাস দিচ্ছিলেন যা ঠিক তাঁদের ভাষ্যমতোই অচিরে ঘটবে। প্রাচীন মিথসমূহকে এখন অনেক আধুনিক পশ্চিমা ব্যক্তির শনাক্তযোগ্য সত্যের একমাত্র রূপ বাস্তব লোগোই মনে করা হচ্ছিল। ডারবি নিস্তারের গোটা ইতিহাসকে ঐশীগ্রন্থের সযত্ন পাঠ থেকে প্রাপ্ত প্রকল্প সাতটি কাল বা ‘ডিসপেনশনে’ ভাগ করেন। তিনি ব্যাখ্যা করেন, মানবজাতি যখন এতটাই খারাপ হয়ে ওঠে যে ঈশ্বর তাদের শস্তি দিতে গেলে প্রতিটি ডিসপেনশন সমাপ্তির মুখ দেখে। এর আগের ডিসপেনশনগুলো পতন, প্লাবন ও ক্রাইস্টের ক্রুসিফিক্সনের ভেতর দিয়ে শেষ হয়েছে। মানবজাতি এখন ষষ্ঠ বা পেনাল্টিমেট ডিসপেনশনে বাস করছে, অচিরেই এক নজীরবিহীন বিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে ঈশ্বর এর অবসান ঘটাবেন। শেষের আগে সেইন্ট পল যে মিথ্যা উদ্ধারকারীর আবির্ভাবের পূর্বাভাস দিয়ে গেছেন সেই অ্যান্টিক্রাইস্ট” মিথ্যা প্রলোভনে বিশ্বকে প্রতারিত করবে, সবাইকে আয়ত্তে নেবে এবং তারপর মানবজাতির উপর ভোগান্তির একটা কাল অবতীর্ণ করবে। সাত বছর ধরে অ্যান্টিক্রাইস্ট যুদ্ধ চালিয়ে যাবে, অপরিমেয় মানুষকে হত্যা করবে, সকল বিরোধীকে নির্যাতন করবে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত ক্রাইস্ট পৃথিবীতে নেমে আসবেন, অ্যান্টিক্রাইস্টকে পরাস্ত করবেন, জেরুজালেমের বাইরে আরমাগেদনের প্রান্তরে শয়তানের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত যুদ্ধে লিপ্ত হবেন তিনি, উদ্বোধন ঘটাবেন সপ্তম ডিসপেনশনের। শেষ বিচারের দিন ইতিহাসের অবসান ঘটানোর আগে হাজার বছর শাসন করবেন তিনি। এটা ছিল ইউরোপের ফিউচার ওয়ার ফ্যান্টাসিরই ধর্মীয় রূপ। সত্যিকারের প্রগতিকে এখানে বিরোধ ও প্রায় সামগ্রিক বিনাশ হিসাবে দেখা হয়েছে। স্বর্গীয় নিস্তারের স্বপ্ন সত্ত্বেও এটা ছিল আধুনিক মৃত্যু আকাঙ্ক্ষা তুলে ধরা বিনাশী দৃষ্টিভঙ্গি। ক্রিশ্চানরা আধুনিক সমাজের চূড়ান্ত অবলুপ্তি কল্পনা করেছে বিকৃত বিস্তারে ও অসুস্থভাবে এর আকাঙ্ক্ষা করেছে।
তবে একটা গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য ছিল। ইউরোপিয়রা যেখানে সবাই আসন্ন সংঘাতের ভোগান্তি ভোগ করার কথা কল্পনা করেছে, ডারবি সেখানে মনোনীতদের উদ্ধারের পথ দেখিয়েছেন। ক্রাইস্টের দ্বিতীয় আগমনের সময় জীবিত ক্রিশ্চানদের ‘মেঘের উপর তুলে নিয়ে যাওয়া হবে..শূন্যে প্রভুর সাথে সাক্ষাতের জন্যে, বিশ্বাসের অধিকারী সেইন্ট পলের চকিত মন্তব্যের ভিত্তিতে তিনি উল্লেখ করেন যে, ভোগান্তি শুরু হওয়ার ঠিক অব্যবহিত আগে এক ‘তুরীয় আনন্দের’ ঘটনা ঘটবে, নবজন্মলাভকারী ক্রিশ্চানদের উর্ধ্বে টেনে নিয়ে যাওয়া হবে, যাদের স্বর্গে তুলে নিয়ে যাওয়া হবে, এভাবে শেষ বিচারের ভয়ঙ্কর কষ্টের হাত থেকে তারা রক্ষা পাবে। প্রিমিলেনিয়ানিস্টরা তুরীয় আনন্দকে নিরেট আক্ষরিক বিস্তারে কল্পনা করেছে। তাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল যে, নবজন্মলাভকারী পাইলট ও ড্রাইভাররা হাওয়ায় উড়ে যাওয়ায় বাহনগুলো নিয়ন্ত্রণ হারানোয় সহসা এয়ার প্লেন, গাড়ি ও ট্রেইন ধ্বংস হয়ে যাবে। স্টক মার্কেট ধসে পড়বে, সরকারের পতন ঘটবে। অবশিষ্টরা বুঝতে পারবে যে তারা অভিশপ্ত, সত্যিকারের বিশ্বাসীরা সব সময়ই ঠিক ছিল। এই অসুখী মানুষগুলো কেবল কষ্টই সহ্য করবে না, তাদের জন্যে চিরন্তন অভিশাপের নিয়তি অপেক্ষা করে থাকার ব্যাপারটা বুঝতে পারবে। প্রিমিলেনিয়ালিজম ছিল প্রতিশোধের ফ্যান্টাসি: মনোনীতরা স্বর্গ থেকে যারা তাদের বিশ্বাসের প্রতি পরিহাস করেছে, উপেক্ষা করেছে, ঠাট্টা করেছে, তাদের ধর্মবিশ্বাসকে প্রান্তিকায়িত করেছে, আর এখন আর ভুল বোঝার আর সময় নেই যাদের, তাদের দিকে তাকানোর কথা কল্পনা করেছে। আজকের দিনে বহু প্রটেস্ট্যান্ট মৌলবাদীর ঘরে যে জনপ্রিয় ছবিটি চোখে পড়ে সেখানে দেখা যায় বাড়ির সামনে ঘাস কাটার সময় এক লোক দোতলার জানালা দিয়ে তার নবজন্মলাভকারী তুরীয় আনন্দের অধিকারী স্ত্রীর দিকে মহাবিস্ময়ে তাকিয়ে আছে। পৌরাণিক ঘটনার বহু নিরেট বর্ণনার মতো দৃশ্যটিকে খানিকটা অসম্ভব ঠেকে, কিন্তু বর্তমানে এর তুলে ধরা বাস্তবতা নিষ্ঠুর, বিভাজনকারী ও করুণ।
বৈপরীত্যমূলকভাবে সত্যিকারের ধর্মীয় মিথলজির চেয়ে প্রিমিলেনিয়াজিমের বরং এর অপছন্দের সেক্যুলার দর্শনের সাথেই বেশি মিল ছিল। হেগেল, মার্ক্স, ও ডারউইন, এঁরা প্রত্যেকেই বিশ্বাস করতেন যে উন্নতি বিরোধেরই ফল। মার্ক্স আবার ইতিহাসকে এক ইউটোপিয়ায় পর্যবসিত হওয়া ভিন্ন ভিন্ন যুগে ভাগ করেছিলেন। ভূতাত্ত্বিকগণ পাহাড় ও ক্লিফে ফসিলায়িত গাছপালার বিভিন্ন স্তরে পৃথিবীর বিকাশের উপর্যুপরি কালপর্ব আবিষ্কার করেছেন। কারও কারও ধারণা প্রতিটি কালের অবসান ঘটেছে বিপর্যয়ের ভেতর দিয়ে। প্রিমিলেনিয়াল কর্মসূচি যেমন অদ্ভুতই শোনাক না কেন তা উনবিংশ শতাব্দীর বৈজ্ঞানিক ভাবনার একই ধারায় ছিল। অক্ষরবাদীতা ও গণতন্ত্রের দিক থেকেও তা আধুনিক ছিল। কেবল অতীন্দ্রিয় অভিজাত গোষ্ঠীর বোধগম্য কোনও গোপন বা প্রতীকী অর্থের বালাই ছিল না। শিক্ষা যত সামান্যই হোক, প্রতিটি ক্রিশ্চান সত্য আবিষ্কার করতে পারে, সকলের দেখার মতো করেই বাইবেলে তাকে প্রকাশ করা হয়েছে। ঐশীগ্রন্থ যা বলেছে ঠিক তাই বুঝিয়েছে: মিলেনিয়ামের মানে দশ শতাব্দী; ৪৮৫ বছর মানে অতগুলো বছরই; পয়গম্বরগণ ‘ইসরায়েল’ সম্পর্কে কথা বলে থাকলে তাঁরা চার্চের কথা বোঝাননি, বুঝিয়েছেন ইহুদিদের কথাই; রেভেলেশনের লেখকগণ যখন জেরুজালেমের বাইরে আরমাগেদনের প্রান্তরে জেসাস ও শয়তানের যুদ্ধের ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন, ঠিক সেভাবেই ব্যাপারটা ঘটবে।১১ নিমেষে বেস্টসেলারে পরিণত হওয়া বাইবেলের প্রিমিলেনিয়াল পাঠ দ্য স্কোফিল্ড রেফারেন্স বাইবেল (১৯০৯) প্রকাশিত হওয়ার পর গড়পড়তা ক্রিশ্চানের পক্ষে অনেক সহজতর হয়ে উঠেছিল। সি. আই. স্কোফিল্ড বাইবেলিয় টেক্সটের সাথে বিস্তারিত টীকাটিপ্পনী দিয়ে নিস্তারের ইতিহাসের এই ডিসপেনশনাল দৃষ্টিভঙ্গি ব্যাখ্যা করেছেন, এইসব টীকা বহু মৌলবাদীর কাছে খোদ টেক্সটের মতোই কর্তৃত্বমূলক হয়ে দাঁড়িয়েছিল।
ইচ্ছা করেই প্রশ্নের দ্বার উন্মুক্ত রেখে পরম সত্যের সম্ভাবনাকে অস্বীকারকারী আধুনিকতার প্রতি এক ধরনের সাড়া প্রিমিলেনিয়ালিজম নিশ্চয়তার জন্যে লালসার প্রকাশ ঘটায়। আমেরিকান প্রটেস্ট্যান্টরা দীর্ঘদিন ধরে আধুনিক সমাজ কীভাবে কাজ করে তা উপলব্ধি করার যোগ্য বলে বিবেচিত অভিজ্ঞদের প্রতি বৈরী ভাবাপন্ন ছিল। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে দৃশ্যতঃ কোনও কিছুই আর যেমন মনে হত তেমন ছিল না। এই সময়ে আমেরিকান অর্থনীতি ভয়ঙ্কর উত্থান-পতনের শিকার হয়েছিল, কৃষি জীবনে অভ্যস্ত সাধারণ মানুষের চোখে তা ছিল বিস্ময়কর। চাঙা বাজারের পরপরই দেখা দেওয়া মন্দায় রাতারাতি বিপুল অঙ্কের অর্থ লোকসান হত; সমাজ যেন অদৃশ্য রহস্যময় ‘বাজার শক্তি’তে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে বলে মনে হচ্ছিল। সমাজবিদরা আরও যুক্তি দেখিয়েছেন যে, অদক্ষ পর্যবেক্ষকের চোখে ধরা পড়া সম্ভব ছিল না এমন এক এক অর্থনৈতিক গতিশীলতায় নিয়ন্ত্রিত হচ্ছিল মানুষের জীবন। ডারউইনবাদীরা মানুষকে বুঝিয়েছিল, অস্তিত্ব খালি চোখে অদৃশ্য জীববিজ্ঞানীয় সংগ্রামের অধীন। মনস্তাত্ত্বিকরা গোপন, অবচেতন মনের কথা বলেছেন। হাইয়ার ক্রিটিকরা জোর দিয়েছেন যে, এমনকি খোদ বাইবেল যেমনটা দাবি করা হয়ে এসেছে তেমন কিছু নয়, দৃশ্যতঃ সাধারণ টেক্সট আসলে বিস্ময়কর বিভিন্ন সংখ্যক উৎস থেকে গড়ে তোলা হয়েছে ও কেউ কোনওদিন যাঁদের নাম শোনেনি এমন সব লেখকগণ তা লিখেছেন। যেসব প্রটেস্ট্যান্ট তাদের বিশ্বাস নিরাপত্তা যোগাবে বলে আশা করেছিল, এমনি জটিল এক জগতে মানসিক ঘূর্ণীপাকের শিকারে পরিণত হয় তারা। তারা সবার বোধগম্য সাধারণ ভাষার এক ধর্মবিশ্বাসের আকাঙ্ক্ষা করেছিল।
কিন্তু উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদই সময়ের মূল কথা হওয়ায় গুরুত্বের সাথে নিতে হলে ধর্মেরও যৌক্তিক হওয়ার প্রয়োজন ছিল। কোনও কোনও প্রটেস্ট্যান্ট তাদের ধর্মবিশ্বাসকে যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিকভাবে সঠিক করে তুলতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিল। অন্যান্য লোগোসের মতোই একে স্পষ্ট, প্রকাশযোগ্য ও বস্তুনিষ্ঠ হতে হবে। কিন্তু সামগ্রিক নিশ্চয়তার সন্ধানকারীদের অনেকের কাছেই আধুনিক বিজ্ঞান ছিল বড় বেশি পিচ্ছিল। ডারউইন ও ফ্রয়েডের আবিষ্কার এসেছিল অপ্রমাণিত হাইপথেসিস থেকে, এগুলোকে অধিকতর প্রথাগত প্রটেস্ট্যান্টের কাছে ‘অবৈজ্ঞানিক’ মনে হয়েছে। পরিবর্তে তারা ফ্রান্সিস বেকনের আদি বৈজ্ঞানিক দৃষ্টিভঙ্গির শরণ নিয়েছে, এমনি আঁচ অনুমানের কোনও ফুরসত যাঁর ছিল না। বেকন বিশ্বাস করতেন, আমরা আমাদের ইন্দ্রিয়গুলোকে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করতে পারি, কারণ এগুলোই আমাদের সঠিক তথ্য যোগাতে সক্ষম। তিনি নিশ্চিত ছিলেন যে, সর্বজ্ঞ ঈশ্বরের যৌক্তিক নীতিমালায় বিশ্বকে সংগঠিত করা হয়েছে। কোনও আজগুবী ধারণা তৈরি নয়, বিজ্ঞানের কাজ হচ্ছে বিভিন্ন ঘটনাকে শ্রেণীবদ্ধ করা ও সবার কাছে স্পষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে আবিষ্কারকে তত্ত্বে রূপান্তরিত করা। কান্টের বস্তুনিষ্ঠ জ্ঞান তত্ত্বের বিরোধী অষ্টম শতাব্দীর স্কটিশ আলোকনের দর্শনের প্রতিও আকৃষ্ট হয়েছিল প্রটেস্ট্যান্টরা, এবং দাবি করেছে যে সত্য বাস্তব এবং ‘সাধারণ কাণ্ডজ্ঞান[১২] আছে এমন যেকোনও আন্তরিক মানবসন্তানের কাছে তা পাওয়া যাবে। নিশ্চয়তার এই কামনা ছিল আধুনিক অভিজ্ঞতার একেবারে মূলে ওৎ পেতে থাকা শূন্যতাকে-সম্পূর্ণ যৌক্তিক মানুষের চেতনায় ঈশ্বর-সম গহ্বর-পূরণ করার প্রয়াস। আমেরিকান প্রটেস্ট্যান্ট আর্থার পিয়ারসন বাইবেলকে ‘সত্যিকারের বৈজ্ঞানিক ও নিরপেক্ষ চেতনায়’ পরখ করতে চেয়েছিলেন। তাঁর বইয়ের শিরোনামই-ম্যানি ইনফ্যালিবল প্রুফস (১৮৯৫)-ধর্ম থেকে তিনি কী ধরনের নিশ্চয়তার সন্ধান করছিলেন তা দেখিয়ে দেয়:
আমি…কোনও প্রকল্প দিয়ে শুরু হয়ে তারপর তথ্য ও দর্শনকে আমাদের ডগমার সাথে খাপ খাওয়ার জন্যে সাজায় না, বরং প্রথমে ঈশ্বরের বাণীর শিক্ষাকে একত্রিত করে তারপর তথ্যমালাকে সাজানোর মতো কিছু সাধারণ বিধানের সন্ধানকারী বেকনিয় ব্যবস্থার বাইবেলিয় সেইসব ধর্মতত্ত্ব পছন্দ করি।১৩
বোধগম্য ইচ্ছা ছিল এটা, কিন্তু বাইবেলের মিথোই পিয়ারসনর প্রত্যাশা অনুযায়ী কোনও দিনই তথ্যভিত্তিক হওয়ার ভান করেনি। অতীন্দ্রিয় ভাষাকে কখনওই এর রেইজন দ’এতরে—মূল সত্তা-না খুইয়ে যুক্তিভিত্তিক ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব নয়। কবিতার মতো তা এমন সব অর্থ ধারণ করে যাকে অন্য যেকোনওভাবে প্রকাশ করার পক্ষে অধরাই রয়ে যায়। ধর্মতত্ত্ব যখনই বিজ্ঞানে পরিণত হওয়ার চেষ্টা করে, তখন তা কেবল যৌক্তিক ডিসকোর্সের একটা ক্যারিকেচারের জন্ম দিতে পারে, কারণ এইসব সত্যি বৈজ্ঞানিক প্রদর্শনীর পক্ষে মানানসই নয়।১৪ এই মিথ্যা ধৰ্মীয় লোগোস অনিবার্যভাবে ধর্মকে আরও কুখ্যাতি এনে দেবে।
নিউ জার্সির প্রিন্সটনের নিউ লাইটস প্রেসবিটারিয়ান সেমিনারি এই বৈজ্ঞানিক প্রটেস্ট্যান্ট মতবাদের শক্তঘাঁটিতে পরিণত হয়েছিল। ‘শক্তঘাঁটি’ কথাটা মানানসই, কারণ যৌক্তিক ক্রিশ্চান ধর্মের প্রচারণা অনেক সময় উগ্র ইমেজারি ব্যবহার করেছে, একে বরাবরই আত্মরক্ষামূলক মনে হয়েছে। ১৮৭৩ সালে প্রিন্সটনের ধর্মতত্ত্বের চেয়ারের অধিকারী চার্লস হজ তাঁর দুই খণ্ডের রচনা সিস্টেমেটিক থিওলজি’র প্রথম খণ্ড প্রকাশ করেন। আবারও, শিরোনাম এর বৈজ্ঞানিক পক্ষপাত তুলে ধরছে। শব্দের অতীত কোনও অর্থের সন্ধান করা ধর্মবেত্তার কাজ নয়, জোরের সাথে বলেছেন হজ, বরং তাঁকে স্রেফ ঐশীগ্রন্থের স্পষ্ট শিক্ষাকে সাধারণ সত্যের একটা ব্যবস্থায় বিন্যস্ত করতে হবে। বাইবেলের প্রতিটি শব্দ ঐশী অনুপ্রাণিত, একে অবশ্যই গুরুত্বের সাথে নিতে হবে; একে কোনওভাবেই উপমাগত বা প্রতীকী ব্যাখ্যা দিয়ে বিকৃত করা চলবে না। ১৮৭৮ সালে পিতার আসনের উত্তরাধিকারী হওয়া চার্লসের ছেলে আর্চিবল্ড এ. হজ বাইবেলের আক্ষরিক সত্যের পক্ষে অবস্থান নিয়ে তরুণ সহকর্মী বেনজামিন ওয়ারফিল্ডের সাথে দ্য প্রিন্সটন রিভিউ প্ৰকাশ করেন। নিবন্ধটি ধ্রুপদী হয়ে ওঠে। বাইবেলের সমস্ত কাহিনী ও বিবৃতি ‘চরমভাবে ভ্রান্তিহীন এবং বিশ্বাস ও পরিপালনের জন্যে বাধ্যতামূলক।’ বাইবেল কিছু যা বলেছে তার সবই ‘তথ্যের পরম সত্যি।’ বাইবেল অনুপ্রাণিত হয়ে থাকলে অবশ্যই অনুপ্রাণিত,১৬ একটি প্যাচানো যুক্তি যা আর যাই হোক বৈজ্ঞানিক নয়। এমন দৃষ্টিভঙ্গির কোনও যৌক্তিক বাস্তবতা নেই, যেকোনও বিকল্পের পক্ষে রুদ্ধ ও কেবল নিজের ক্ষেত্রেই সামঞ্জস্যপূর্ণ। কেবল যুক্তির উপর প্রিন্সটনের আস্থা একে আধুনিকতার সারিতে দাঁড় করিয়েছে বটে, কিন্তু এর দাবি ছিল তথ্য থেকে দুরস্ত। “ক্রিশ্চান ধর্ম সঠিক যুক্তির সাহায্যে এর আবেদন সৃষ্টি করেছে,’ পরের এক নিবন্ধে উল্লেখ করেছেন ওয়ারফিল্ড। ‘কেবল যুক্তির উপর ভর করেই প্রাধান্যের পথে এতদূর এগিয়ে এসেছে এবং কেবল যুক্তির মাধ্যমেই তা সব শত্রুকে পদদলিত করবে।’১৭ ক্রিশ্চান ইতিহাসে চোখ বোলালে আমরা দেখতে পাই যে, প্রাক আধুনিক সকল ধর্মের মতো যুক্তি কেবল পৌরাণিক প্রেক্ষাপটেই অনুশীলন করা হয়েছে। ক্রিশ্চান ধর্ম ‘সঠিক যুক্তি’র-যা কখনওই ক্রিশ্চান ধর্ম বিশ্বাসের ‘একক’ আবেদন ছিল না-চেয়ে বরং অতীন্দ্রিয়বাদ, স্বজ্ঞা ও লিটার্জির উপর নির্ভর করেছে। ওয়ারফিল্ডের উগ্র ইমেজারি, বিশ্বাসের ‘প্রতিপক্ষ’কে যা যুক্তি দিয়ে বিভ্রান্ত করার আশা করে, সম্ভবত এক গোপন নিরাপত্তাহীনতা তুলে ধরে। ক্রিশ্চান বিশ্বাস আদতেই এমন স্পষ্ট ও স্ব-প্রকাশিত হয়ে থাকলে এত মানুষ কেন তবে একে গ্রহণে অস্বীকৃতি জানাচ্ছে?
প্রিন্সটন ধর্মতত্ত্বে হতাশার ছাপ রয়েছে। ‘ধর্মকে জীবন রক্ষার জন্যে বৈজ্ঞানিক মানুষের এক বিশাল শ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়াই করতে হচ্ছে,’ ১৮৭৪ সালে ঘোষণা করেছিলেন চার্লস হজ।১৮ বৈজ্ঞানিক যুক্তির পক্ষে অবস্থান গ্রহণকারী ক্রিশ্চানদের কাছে নিশ্চয়ই প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের বিভিন্ন তত্ত্ব বাইবেলের আক্ষরিক অর্থের বিরোধী মনে হতে শুরু করায় উদ্বেগজনক বোধ হয়েছিল। বেকনবাদী হজের কাছে ডারউইনবাদ ছিল স্রেফ বাজে বিজ্ঞান। তিনি যত্নের সাথে অরিজিন পাঠ করেছেন, কিন্তু ঈশ্বরের উপর কোনও রকম নির্ভরশীলতা ছাড়াই আকস্মিকভাবে প্রকৃতির জটিল নকশা আবির্ভূত হওয়ার ডারউইনীয় প্রস্তাব গুরুত্বের সাথে নিতে পারেননি। এভাবে তিনি আসন্ন প্রটেস্ট্যান্ট মৌলবাদের রুদ্ধ মানসিক অবস্থাকে প্রকাশ করেছেন: হজ তাঁর বিশ্বাস থেকে ভিন্ন কোনও বিশ্বাসকেই স্রেফ বৈধ মেনে নিতে পারেননি। ‘যেকোনও সাধারণভাবে গঠিত মানুষের পক্ষে,’ জোরের সাথে বলেছেন তিনি, ‘চোখ কোনও পরিকল্পনার অংশ নয়, বিশ্বাস করা কঠিন।১৯ মানুষের ‘সুপ্রতিষ্ঠিত সত্যের সাথে বিরোধপূর্ণ সব ধরনের দর্শনীয় প্রকল্প ও তত্ত্বের বিরোধিতা করার দায়িত্ব রয়েছে—যেমন ডারউনিবাদ।’ এটা ছিল ‘কাণ্ডজ্ঞানে’র কাছে আবেদন; ঈশ্বর মানুষের মনকে ‘এমন প্রবৃত্তি দান করেছেন যা অব্যর্থ,’ ডারউইন এর বিরোধিতা করলে, তাঁর প্রকল্প অগ্রহণযোগ্য এবং অবশ্যই তাকে বাতিল করতে হবে।২° প্রিন্সটনে আবির্ভূত বৈজ্ঞানিক ক্রিশ্চান ধর্ম দুই নৌকায় পা দিয়ে বসেছিল। হজ প্রাচীন রক্ষণশীল কায়দায় আধুনিকতার বৈশিষ্ট্য যুক্তির পথে বাধা খাড়া করানোর প্রয়াস পাচ্ছিলেন, একে স্বাধীনভাবে কাজ করতে দিতে চাননি। কিন্তু সব পৌরাণিক সত্যকে লোগোইয়ের পর্যায়ে নামিয়ে এনে প্রাচীন বিশ্বের আধ্যাত্মিকতার উপর আঘাত হেনেছেন তিনি। তাঁর ধর্মতত্ত্ব ছিল বাজে বিজ্ঞান ও অপর্যাপ্ত ধর্ম।
কিন্তু প্রিন্সটন টিপিক্যাল ছিল না। হজ ও ওয়ারফিল্ড যেখানে ধর্মবিশ্বাসকে সঠিক বিশ্বাস হিসাবে সংজ্ঞায়িত করতে শুরু করে মতবাদগত সমরূপতার উপর বিপুল গুরুত্ব আরোপ করছিলেন, সেখানে পোড়খাওয়া উচ্ছেদবাদী হেনরি ওয়ার্ড বীচার (১৮১৩-৮৭)-এর মতো অন্য প্রটেস্ট্যান্টরা আরও উদার অবস্থান গ্রহণ করছিলেন।২১ বীচারের চোখে ডগমা ছিল গৌণ পর্যায়ের গুরুত্বপূর্ণ, ভিন্ন ধর্মতত্ত্বীয় দৃষ্টিভঙ্গি ধারণ করার দায়ে কাউকে শান্তি দান অক্রিশ্চান সুলভ। উদারবাদীরা ডারউইনবাদ বা বাইবেলের হাইয়ার ক্রিটিসিজমের মতো আধুনিক জ্ঞানিক উদ্যোগের প্রতি উদার ছিল। বীচারের চোখে ঈশ্বর কোনও দূরবর্তী, বিচ্ছিন্ন বাস্তবতা নন, বরং এই মর্ত্যেরই প্রাকৃতিক বিভিন্ন প্রক্রিয়ায় উপস্থিত আছেন, সুতরাং, বিবর্তনকে সৃষ্টির প্রতি ঈশ্বরের অবিরাম উদ্বেগ হিসাবে দেখা যেতে পারে। মতবাদগত সমরূপতার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে ক্রিশ্চান ভালোবাসার চর্চা। উদার প্রটেস্ট্যান্টরা বস্তি ও শহরে সামাজিক কর্মকাণ্ডের গুরুত্বর উপর জোর দিচ্ছিল, তাদের বিশ্বাস ছিল নিবেদিত প্রাণ বদান্যতার ভেতর দিয়ে তারা এই বিশ্বে ঈশ্বরের ন্যায়-রাজ্য প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হবে। আশাবাদী ধর্মতত্ত্ব ছিল এটা, আধুনিকতার সুফল ভোগ করতে শুরু করা মধ্যবিত্ত সমাজের কাছে আবেদন সৃষ্টি করেছিল। ১৮৮০-র দশক নাগাদ উত্তরের অনেক রাজ্যের প্রধান প্রটেস্ট্যান্ট স্কুলে এই নতুন ধর্মতত্ত্ব পাঠ করানো শুরু হয়েছিল। ইভোলিউশন অ্যান্ড রিলিজিয়নে (১৮৯৭) জন বিস্কন ও থ্রু নেচার টু গড-এ (১৮৯৯) জন ফিস্ক-এর মতো ধর্মবেত্তাগণ বিশ্বাস করেছিলেন যে, বিজ্ঞান ও ধর্মের মাঝে কোনও বৈরিতা থাকতে পারে না। দুজনই পৃথিবীর বুকে ঈশ্বরের আবির্ভাব আসন্ন বলেছেন; মহাবিশ্বের প্রতিটি হৃদস্পন্দন ঈশ্বরের উপস্থিতি তুলে ধরে। গোটা ইতিহাস জুড়ে মানুষের আধ্যাত্মিক ধারণা বিবর্তিত হয়ে আসছে, এবং এখন মানুষ এক নতুন বিশ্বের দ্বারপ্রান্তে এসে পৌঁছেছে, যেখানে নারী-পুরুষ সম্পূর্ণভাবে উপলব্ধি করবে যে তথাকথিত ‘অতিপ্রাকৃত’ ও লৌকিকের ভেতর কোনও পার্থক্য নেই। ঈশ্বরের সাথে গভীর একাত্মতা উপলব্ধি করবে তারা, পরস্পরের সাথে শান্তিতে বসবাস করবে।
সব মিলেনিয়াল দর্শনের মতোই উদার ধর্মতত্ত্ব হতাশ হতে বাধ্য ছিল। বৃহত্তর ছন্দ অর্জন নয়, বরং গভীরভাবে বেকায়দায় পড়ে গেছে বলে আবিষ্কার করেছিল আমেরিকান প্রটেস্ট্যান্টরা। মতপার্থক্য গোটা গোষ্ঠীকেই ছিন্নভিন্ন করে দেওয়ার হুমকি সৃষ্টি করেছিল। বিবর্তন নয়, উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে বিরোধের মুল কারণ ছিল হাইয়ার ক্রিটিসিজম। উদারপন্থীদের বিশ্বাস ছিল, বাইবেল সংক্রান্ত নতুন তত্ত্বগুলো কোনও কোনও প্রাচীন বিশ্বাসকে খাট করে দিতে পারে, কিন্তু দীর্ঘমেয়াদে সেগুলো ঐশীগ্রন্থের আরও গভীর উপলব্ধির দিকে নিয়ে যাবে। কিন্তু ঐতিহ্যবাদীদের কাছে ‘হাইয়ার ক্রিটিসিজম’ ছিল ভীতিকর পরিভাষা। প্রাচীন নিশ্চয়তাকে ভাসিয়ে নিয়ে চলা আধুনিক শিল্পায়িত সমাজের যা কিছু ভুল তার মূর্ত প্রতীক মনে হয়েছে একে। এই সময় নাগাদ পপুলারাইজাররা নতুন ধারণাকে সাধারণ মানুষের কাছে নিয়ে এসেছিল। বেশ ভালোরকম বিভ্রান্তির ভেতর ক্রিশ্চানরা আবিষ্কার করেছিল যে, পেন্টাটিউক আসলে মোজেসের রচনা নয়, আবার সালমও ডেভিড লিখেননি; জেসাসের কুমারী মায়ের গর্ভে জন্মলাভ নেহাতই কথার কথা, এবং মিশরের দশটি প্লেগ ছিল সম্ভব পরে অলৌকিক কাণ্ড হিসাবে ব্যাখ্যা করা প্রাকৃতিক বিপর্যয়।২২ ১৮৮৮ সালে ব্রিটিশ ঔপন্যাসিক হাফ্রে ওয়ার্ড রবার্ট এলসমেয়ার প্রকাশ করেন, যেখানে হাইয়ার ক্রিটিসিজমের কারণে বিশ্বাস দুর্বল হয়ে যাওয়ায় ব্রত থেকে ইস্তফা দিয়ে লন্ডনের ইস্ট এন্ডে সমাজ সেবায় নিয়োজিত এক তরুণ যাজকের কাহিনী বর্ণনা করা হয়েছে। উপন্যাসটি বেস্ট সেলারে পরিণত হয়ে, যা অনেককেই নায়কের সন্দেহের সাথে নিজেকে একাত্ম করতে পারার ইঙ্গিত দেয়। রবার্টের স্ত্রী যেমন বলেছে, ‘গস্পেল ইতিহাসের মতো সত্যি না হলে তা কীভাবে সত্যি হতে পারে বা তার কোনও মূল্য থাকতে পারে, আমার মাথায় আসে না।’২৩
আধুনিক বিশ্বের যৌক্তিক পক্ষপাত এই সময় পাশ্চাত্য ক্রিশ্চানদের অনেকের কাছে মিথের গুরুত্ব উপলব্ধি অসম্ভব করে তুলেছিল। বিশ্বাসকে যৌক্তিক হতে হবে, মিথোসকে হতে হবে লোগোস। সত্য-কে এখন তথ্যভিত্তিক বা যৌক্তিক ছাড়া অন্য কিছু ভাবা বেশ কঠিন হয়ে উঠেছিল। এইসব নতুন বাইবেলিয় তত্ত্ব ক্রিশ্চান ধর্মের মৌল কাঠামোকেই ধ্বংস করে দিয়ে কিছুই আর অবশিষ্ট রাখবে না বলে এক ধরনের ভীতি সৃষ্টি হয়েছিল। আবারও এক শূন্যতা এসে হাজির হয়েছিল। ‘আমাদের সামনে কোনও অব্যর্থ মানদণ্ড না থাকলে,’ যুক্তি দেখিয়েছেন আমেরিকান মেথডিস্ট যাজক আলেক্সান্ডার ম্যাকঅ্যালিস্টার, ‘বলতে হবে আমাদের সামনে মানদণ্ড বলতে আসলে কিছুই নেই।২৪ একটি অলৌকিক ঘটনাকে বাদ দিন, সামঞ্জস্যতা দাবি করবে আপনাকে সবগুলোকেই বাদ দিতে হবে। জোনাহ আদতেই তিমির পেটে তিন দিন তিন রাত না কাটিয়ে থাকলে তবে কি ক্রাইস্ট আদৌ সমাধি থেকে উত্থিত হয়েছিলেন? প্রশ্ন তুলেছেন লুথারান প্যাস্টর জেমস রেমেস্নাইডার।২৫ বাইবেলিয় সত্যসমূহকে এভাবে উন্মুক্ত করে তোলা হলে শোভন মূল্যবোধ মিলিয়ে যাবে। মেথডিস্ট যাজক লিয়েন্ডার ডব্লু. মিচেলের চোখে হাইয়ার ক্রিটিসিজমই ব্যাপক বিস্তৃত অন্ধকার, অবিশ্বস্ততা ও সংশয়বাদের জন্যে দায়ী। ২৬ প্রেসবিটারিয়ান এম. বি. ল্যাম্বডিন একে তালাক, দুর্নীতি, চুরি, অপরাধ ও হত্যাকাণ্ডের হার বৃদ্ধির জন্যে দায়ী করেছেন। ২৭
মৌল ভীতি সৃষ্টি করায় যৌক্তিকভাবে হাইয়ার ক্রিটিসিজমের আর আলোচনা করা সম্ভব হচ্ছিল না। ১৮৯১ সালে ধর্মদ্রোহীতার অভিযোগ এনে হাইয়ার ক্রিটিসিজমের পক্ষে প্রকাশ্যে সমর্থন দানের জন্যে উদারপন্থী প্রেসবিটারিয়ান চার্লস ব্রিগসকে নিউ ইয়র্ক প্রেসবিটারিতে বিচারের সম্মুখীন করা হলে সেই খবর নিউ ইয়র্ক টাইমস-এর প্রথম পাতায় শিরোনাম আকারে আবির্ভূত হয়েছিল। তিনি খালাস পাওয়ার পর একে হাইয়ার ক্রিটিসিজমের বিজয় হিসাবে প্রশংসা করে নিউ ইয়র্ক টাইমস, কিন্তু গোষ্ঠীর সাধারণ সভা এই রায়কে বাতিল করে গির্জা থেকে ব্রিগসকে সাময়িক বরখাস্ত করে। বিচার ছিল তিক্ত ও উগ্র; এমনি হট্টগোল গোটা গোষ্ঠীকেই সরাসরি দুই ভাগ করে দিয়েছিল। পরে দুইশো প্রেসবিটারির ভেতর ভোটাভুটি হলে নব্বই ভাগই ব্রিগসের মতের বিরোধিতা করে। এটা ছিল এই সময়ের অসংখ্য ধর্মদ্রোহীতার বেশি প্রচারণা লাভকারী একটিমাত্র, তখন একের পর এক উদারপন্থীকে গোষ্ঠী থেকে বের করে দেওয়া হয়েছিল।
১৯০০ সাল নাগাদ গোলমাল থিতিয়ে এসেছে বলে মনে হয়েছিল। হাইয়ার ক্রিটিসিজমের ধ্যারণা যেন সব জায়গায় প্রাধান্য বিস্তার করছিল, উদারবাদীরা তখনও গোষ্ঠীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদ অধিকার করেছিলেন, আর রক্ষণশীলরা যেন স্তব্ধ ও নিশ্চুপ হয়েছিল। কিন্তু এই আপাত শন্তি ছিল প্রতারণামূলক। এই সময়ের পর্যবেক্ষকরা সচেতন ছিলেন যে, প্রায় সমস্ত গোষ্ঠীর অভ্যন্তরেই-প্রেসবিটারিয়ান, মেথডিস্ট, ডিসাইপলস, এপিস্কোলিয়ান, ব্যাপ্টিস্ট—দুটো ভিন্ন ‘চার্চ’ আবির্ভূত হয়েছিল, ‘পুরোনো’ ও ‘নতুন’ দৃষ্টিভঙ্গিতে বাইবেল পর্যবেক্ষণ তুলে ধরছিল এগুলো।২৮
কোনও কোনও ক্রিশ্চান আসন্ন সংগ্রামের জন্যে এরই মধ্যে সংগঠিত হতে শুরু করেছিল। ১৮৮৬ সালে হাইয়ার ক্রিটিসিজমের শিক্ষার বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে পুনর্জাগরণবাদী ডিউইট মুডি (১৮৩৭-৯৯) শিকাগোয় মুডি বাইবেল ইন্সটিটিউট স্থাপন করেন। তাঁর লক্ষ্য ছিল ‘গ্যাপ-ম্যান’-দের একটা ক্যাডার তৈরি করা যারা যাজক ও সাধারণ মানুষের মাঝখানে অবস্থান নিয়ে তাঁর বিশ্বাস মতে জাতিকে ধ্বংসের মুখে নিয়ে আসা মিথ্যা ধারণার বিরুদ্ধে লড়াই করতে পারবে। মুডিকে আমেরিকান মৌলবাদের জনক অভিহিত করা হয়েছে। প্রিন্সটনের মতো তাঁর বাইবেল ইন্সটিটিউট রক্ষণশীল ক্রিশ্চান ধর্মের ঘাঁটিতে পরিণত হবে। কিন্তু হজ বা ওয়ারফিল্ডদের চেয়ে ডগমার বিষয়ে কম আগ্রহী ছিলেন মুডি। তাঁর বাণী ছিল সহজ ও প্রাথমিকভাবে আবেগঘন: পাপপূর্ণ জগৎ ক্রাইস্ট কর্তৃক রক্ষা পেতে পারে। মুডির অগ্রাধিকার ছিল আত্মার মুক্তি, তাঁর বিশ্বাস যাই হোক না কেন পাপীদের রক্ষা করার কাজে যেকোনও ক্রিশ্চানের সাথে সহযোগিতা করতে প্রস্তুত ছিলেন তিনি সামাজিক সংস্কারের বেলায় তিনি উদারপন্থীদের সাথে একমত ছিলেন: তাঁর ইন্সটিটিউটের স্নাতকদের দরিদ্রদের পক্ষে মিশনারিতে পরিণত হতে হত। কিন্তু মুডি ছিলেন প্রিমিলেনিয়ালিস্ট, যুগের ঈশ্বরবিহীন ধ্যানধারণা বিশ্বের ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে বলে বিশ্বাস করতেন। উদারপন্থীদের বিশ্বাস মতো পরিস্থিতির মোটেই উন্নতি ঘটছে না; বরং প্রতিটি দিনই অবনতি ঘটছে। ২৯ ১৮৮৬ সালে তাঁর বাইবেল ইন্সটিটিউট প্রতিষ্ঠার বছরে, শিকাগোর হেমার্কেট স্কয়ারে গোটা জাতিকে স্তব্ধ করে দেওয়া এক করুণ ঘটনা ঘটে। ট্রেড ইউনিয়নের র্যালি অনুষ্ঠানের সময় মিছিলকারীরা পুলিসের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হলে বোমা বিস্ফোরণে সাত জন পুলিস প্রাণ হারায়, আহত হয় সত্তর জন। হেমার্কেট দাঙ্গা যেন শিল্পায়িত সমাজের সমস্ত অশুভকে ধারণ করেছিল। মুডি একে কেবল প্রলয়বাদী দৃষ্টিভঙ্গিতেই লক্ষ করতে পেরেছিলেন। ‘এইসব মানুষকে ইভাঞ্জোলাইজ করতে হবে,’ ভবিষ্যদ্বাণী করেন তিনি, ‘নইলে কমিউনিজম ও ধর্মহীনতার প্রভাব ব্যাপক বিস্তৃতি লাভ করে এই দেশে সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করবে যা এর আগে কখনও দেখা যায়নি।
বাইবেল ইন্সটিটিউট একটি গুরুত্বপূর্ণ মৌলবাদী সংগঠনে পরিণত হবে। ফোলোঝিন ইয়েশিভার মতো এটা এক ঈশ্বরহীন পৃথিবীতে আধুনিক সমাজের বিরুদ্ধে ভবিষ্যৎ যুদ্ধের লক্ষ্যে একটি ক্যাডার গঠন করার নিরাপদ ও পবিত্র অনক্লেভ তুলে ধরেছে। আসন্ন মৌলবাদী আন্দোলনে নেতৃত্বস্থানীয় ভূমিকা পালন করতে চলা রক্ষণশীল প্রটেস্ট্যান্টরা মুডিকে অনুসরণ করেছে। ১৯০২ সালে উইলিয়াম বেল রাইলি নর্থওয়েস্টার্ন বাইবেল স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন এবং ১৯০৭ সালে তেল ব্যবসায়ী লিম্যান স্টুয়ার্ট বাইবেল ইন্সটিটিউট অভ লস অ্যাঞ্জেলিস স্থাপন করেন। মূলধারার বিভিন্ন গোষ্ঠীতে উদারবাদীদের কাছে নিজেদের যারা কোণঠাসা মনে করেছে একজোট হতে শুরু করেছিল তারা। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকের বছরে প্রথম প্রফিসি অ্যান্ড বাইবেল কনফারেন্সগুলো অনুষ্ঠিত হয়েছিল। রক্ষণশীল প্রটেস্ট্যান্টরা আক্ষরিক, সাধারণ বুদ্ধি দিয়ে বাইবেল পাঠ করার জন্যে একত্রিত হতে পারত, হাইয়ার ক্রিটিসিজম থেকে মনকে পরিষ্কার করে নিত ও নিজেদের প্রিমিলেনিয়াল ধারণা নিয়ে আলোচনা করত। একটি ভিন্ন পরিচয় গড়ে তুলতে চলেছিল তারা এবং ক্রমবর্ধিতহারে জনাকীর্ণ হয়ে ওঠা সম্মেলনগুলো চলার সময় স্বাধীন শক্তি হিসাবে আভির্ভূত হওয়ার সম্ভাবনা সম্পর্কে সজাগ হয়ে উঠেছিল তারা।
বিশেষ অনন্য পরিচয় সৃষ্টি ছিল আধুনিক অভিজ্ঞতার প্রতি স্বাভাবিক সাড়া। সদ্য শিল্পায়িত উত্তরাঞ্চলীয় শহরগুলো ছিল মেল্টিং পট। ১৮৯০ সাল নাগাদ প্রতি পাঁচজন নিউ ইয়র্কবাসীর ভেতর চারজনই হয় নতুন অভিবাসী বা অভিবাসীর সন্তান ছিল। বিপ্লবের সময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ব্যাপকভাবে প্রটেস্ট্যান্ট জাতি ছিল। এখন ডব্লুএএসপি পরিচয় যেন ‘পাপিস্ট’ প্লাবনে ধুয়ে মুছে যাবে বলে মনে হচ্ছিল। দূর্ভাগ্যজনকভাবে ভিন্ন পরিচয়ের অনুসন্ধান অনেক সময় মানুষ যার বিপরীতে নিজেকে পরিমাপ করে সেই স্টেরিওটাইপ ‘অপর’-এর বিকাশের সাথে হাত ধরাধরি করে অগ্রসর হয়। আধুনিকায়নের উত্থান-পতনের প্রতি সাড়াকে ষড়যন্ত্রের এক বিকৃত ভীতি বৈশিষ্ট্যায়িত করে চলবে এবং ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিমদের গড়ে তোলা মৌলবাদী আন্দোলনসূহে তা বিশেষভাবে উপস্থিত থাকবে, যাদের প্রত্যেকে তাদের প্রতিপক্ষের বিকৃত এবং প্রায়শঃই ক্ষতিকর ইমেজ গড়ে তুলবে, অনেক সময় যাদের শয়তানসুলভ অশুভ হিসাবে তুলে ধরা হয়েছে। আমেরিকান প্রটেস্ট্যান্টরা দীর্ঘদিন ধরে রোমান ক্যাথলিকদের ঘৃণা করে এসেছে, ডেইস্ট, ফিম্যাসন ও মরমনদের ষড়যন্ত্রের ভয়ও করেছে তারা; এদের প্রত্যেকে এক সময় বা এক সময় সমাজের ক্রিশ্চান বুনন নষ্ট করে দিচ্ছে বলে মনে হয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের দিকে এইসব উদ্বেগ ফের চড়া হয়ে ওঠে। ১৮৮৭ সালে প্রটেক্টিভ অ্যাসোসিয়েশন গঠন করা হয়, ২,২৫০,০০০ পর্যন্ত পৌঁছে যাওয়া সদস্য সংখ্যা নিয়ে জাতির বৃহত্তম ক্যাথলিক বিরোধী সংস্থায় পরিণত হয় এটি। সংস্থাটি দলের লোকদের উদ্দেশে সব প্রটেস্ট্যান্টকে হত্যা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ধর্মবিরোধী সরকার উৎখাতের আহবান জানানো আমেরিকান ক্যাথলিক বিশপদের কথিত ‘প্যাস্টরাল চিঠি’ জাল করে। ১৮৮৫ সালে জোসিয়া স্ট্রং আওয়ার কন্ট্রি: ইটস পসিবল ফিউচার অ্যান্ড ইটস প্রেজেন্ট ক্রাইসিস প্রকাশ করেন, এতে ‘ক্যাথলিক হুমকিকে’ জাতির মোকবিলা করা সবচেয়ে ভয়ঙ্কর বিপদ হিসাবে উল্লেখ করা হয়। ক্যাথলিকদের ভোট দেওয়ার মানে হবে আমেরিকাকে শয়তানি প্রভাবের কাছে উন্মুক্ত করে দেওয়া; ইতিমধ্যে আমেরিকা গথ ও ভ্যান্ডালদের চেয়ে দ্বিগুন সংখ্যক রোমান্টিস্টদের স্রোতের মোকাবিলা করেছে, পঞ্চম শতাব্দীতে এরাই রোমান সাম্রাজ্যের পতন ডেকে এনেছিল। আমেরিকানরা সর্বনাশের এক ফ্যান্টাসিকে লালন করছিল; বিকৃত ষড়যন্ত্র তত্ত্ব তাদের নিরেট প্রতিপক্ষের উপর নামহীন ও আকারহীন ভীতি রোপনে সক্ষম করে তুলে একে এভাবে সামালযোগ্য করে তুলতে সাহায্য করেছে।৩২
*
ইউরোপে ভিন্ন পরিচয় গড়ে তোলার সাথে সম্পর্কিত হয়ে ষড়যন্ত্র ভীতি ‘বৈজ্ঞানিক’ বর্ণবাদের রূপ নিয়েছিল, যা ১৯২০-র দশকের আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছবে না। ব্যাপকভাবে ইহুদি জনগণের উপর কেন্দ্রিভূত ছিল তা, এটা ছিল ইউরোপিয়দের নজীরবিহীন দক্ষতার সাথে তাদের পরিবেশকে নিয়ন্ত্রণে সক্ষম করে তোলা আধুনিক বৈজ্ঞানিক সংস্কৃতির অবদান। চিকিৎসা বিজ্ঞান বা ল্যান্ডস্কেপে উদ্যান চর্চার মতো আধুনিক তৎপরতা মানুষকে ক্ষতিকর, অনভিজাত বা অপ্রয়োজনীয় সব জিনিস মুছে ফেলতে শিখিয়েছিল। জাতীয়তাবাদ ইউরোপিয় রাষ্ট্রসমূহের প্রধান আদর্শে পরিণত হচ্ছে, এমন একটা সময়ে ইহুদিদের উত্তরাধিকার সূত্রে ও নিরাময়অযোগ্যভাবে কসমোপলিটান মনে হয়েছে। জনতার অত্যাবশ্যকীয় জীববৈজ্ঞানিক ও জেনেরিক বৈশিষ্ট্যাদি সংজ্ঞায়িত করার জন্যে তাদের গড়ে তোলা বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক তত্ত্ব ইহুদিদের অন্তর্ভুক্ত করার পক্ষে নেহাতই সংকীর্ণ ছিল। নতুন জাতিগুলো নিজেদের সংজ্ঞায়িত করার সময় আপন নতুন সত্তাকে নির্ধারণ করার জন্যে ‘অপর’-কে প্রয়োজন হয়েছে তাদের; সুবিধাজনকভাবে, হাতের কাছেই ছিল ‘ইহুদি’রা। মালি যেভাবে বাগান থেকে আগাছা উপড়ে ফেলে বা শল্যচিকিৎসক কেটে ফেলে দেন ক্যান্সার তেমনিভাবে সমাজ থেকে ইহুদিদের উচ্ছেদ করতে চাওয়া আধুনিক এই বর্ণবাদ মানুষকে উন্নত বা নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না, এমন এক দৃঢ় বিশ্বাস থেকে উদ্ভুত এক ধরনের সামাজিক এঞ্জিনিয়ারিং ছিল। শত শত বছরের ক্রিশ্চান কুসংস্কারের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছিল এটা এবং একে একটা বৈজ্ঞানিক যৌক্তিকতা দিয়েছিল।
অবশ্য, একই সময়ে ‘ইহুদি’রা একটা প্রতীকেও পরিণত হয়েছিল যার উপর লোকে আধুনিকায়নের সামাজিক গোলমালের ভীতি ও সংস্কারকে স্থান দিতে পারছিল। ইহুদিরা ঘেটো থেকে বের হয়ে ক্রিশ্চান মহল্লায় আবির্ভূত হয়ে পুঁজিবাদী অর্থনীতিতে অসাধারণ সাফল্য অর্জন শুরু করায় তারা যেন পুরোনো ব্যবস্থার বিনাশই প্রতীকায়িত করে তুলেছিল। ইউরোপিয়রা আধুনিকতাকে ভীতিকর ‘মেল্টিং পট’ হিসাবেও অনুভব করেছে। নতুন শিল্পোন্নত বিশ্ব প্রাচীন সব বাধা ভেঙে ফেলছিল, অনেকে এখন একে পরিষ্কার সীমারেখাহীন আকার বিহীন সমাজ হিসাবে ধরে নিয়েছিল, অরাজক ও নিশ্চিহ্নকারী অবস্থা। মূলধারায় মিশে যাওয়া ইহুদিদেরই বেশি অস্বস্তিকর মনে হয়েছে। তারা কি ‘অ-ইহুদি’-তে পরিণত হয়ে এখনও অনতিক্রম্য মনে হওয়া বিভাজন রেখা অতিক্রম করতে পেরেছে? আধুনিক অ্যান্টি-সেমিটিজম আধুনিকায়ন ও সামাজিক বিভ্রান্তির ভীতিকর মাত্রার গোলমালে বিব্রত বোধকারীদের হতাশা ও অসন্তোষ প্রকাশের একটা লক্ষ্য তৈরি করে দিয়েছিল। ‘সংজ্ঞায়িত’ করার মানে ছিল এইসব ভীতিকর পরিবর্তনের উপর সীমা আরোপ করা; কোনও কোনও প্রটেস্ট্যান্ট যেমন কঠোরতর মতদবাদগত সংজ্ঞার ভেতর নিশ্চয়তার সন্ধান করেছে, অন্যরা নতুন করে পুরোনো সামাজিক সীমারেখা গড়ে তুলে শূন্যতাকে দূরে ঠেলে রাখার চেষ্টা করেছে।
১৮৮০-র দশক নাগাদ আলোকনের সহিষ্ণুতা করুণভাবে অগভীর প্রমাণিত হয়ে পড়ে। আততায়ীর হাতে রাশিয়ায় উদারনৈতিক জার দ্বিতীয় আলেক্সান্দার নিহত হওয়ার পর বিভিন্ন পেশায় ইহুদিদের নতুন করে অংশ নেওয়ার উপর নতুন করে বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়। ১৮৯১ সালে দশ হাজারেরও বেশি ইহুদিকে মস্কো থেকে বহিষ্কার করা হয় ও ১৮৯৩ থেকে ১৮৯৫ সাল মেয়াদে এই অঞ্চলে ব্যাপক মাত্রায় বিতাড়নের ঘটনা ঘটে। অভ্যন্তরীণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক মার্জনা পাওয়া বা এমনকি তাদের হাতেই ঘটা হত্যাকাণ্ডের ব্যাপারও ছিল। এসব ঘটনায় অবশেষে কিশিনেভের (১৯০৫) হত্যাকাণ্ডে পর্যবসিত ইহুদিদের বিরুদ্ধে ডাকাতি ও হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে, এখানে পঞ্চাশ জন ইহুদিকে হত্যা করা হয়, আহত হয় পাঁচ শো। বছরে মোটামুটি পঞ্চাশ হাজার ইহুদি পশ্চিমে পালিয়ে যেতে শুরু করেছিল, পশ্চিম ইউরোপ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও প্যালেস্তাইনে বসতি গড়তে শুরু করে তারা। কিন্তু বিচিত্র পোশাক-আশাক ও ভিনদেশী রীতিনীতি নিয়ে এই পূর্বাঞ্চলীয় ইহুদিদের পশ্চিম ইউরোপে আগমন পুরোনো সংস্কারকে ফের চাঙা করে তোলে। ১৮৮৬ সালে জার্মানি সরকারীভাবে অ্যান্টি-সেমিটিক প্ল্যাটফর্ম থেকে প্রথম পার্লামেন্টারি ডেপুটি নির্বাচিত করে; ১৮৯৩ সাল নাগাদ এর সংখ্যা দাঁড়ায় ষোল। অস্ট্রিয়ায় ক্রিশ্চান সমাজতন্ত্রী কার্ল ল্যুগার (১৮৪৪-১৯১০) এক শক্তিশালী অ্যান্টি- সেমিটিক আন্দোলন গড়ে তোলেন এবং ১৮৯৫ এর দিকে তিনি ভিয়েনার মেয়র নির্বাচিত হন। নতুন অ্যান্টি-সেমিটিজম এমনকি ফ্রান্সেও আঘাত হানে, ইহুদিদের মুক্তিদানকারী প্রথম ইউরোপিয় জাতি ছিল এরা। ৫ই জানুয়ারি, ১৮৯৫ জেনারেল স্টাফের একমাত্র ইহুদি অফিসার ক্যাপ্টেন আলফ্রেড দ্রেফাস বানোয়াট প্রমাণের ভিত্তিতে জার্মানদের কাছে গোপন তথ্য পাচারের দায়ে দোষী সব্যস্ত করা হয়; এই সময় উত্তেজিত মব চিৎকার করে বলছিল, ‘দ্রেফাসের মৃত্যু চাই! ইহুদিদের মৃত্যু চাই!’
কোনও কোনও ইহুদি ক্রিশ্চান ধর্ম গ্রহণ বা সম্পূর্ণ সেক্যুলার জীবন যাপন করার মাধ্যমে মূলধারায় মিশে যাওয়া অব্যাহত রাখে। কেউ কেউ রাজনীতিতে যোগ দিয়ে রাশিয়া ও অন্যান্য পূর্ব ইউরোপিয় দেশে বিপ্লবী সমাজতন্ত্রী নেতায় পরিণত হতে শুরু করে বা ট্রেড ইউনিয়নের নেতৃস্থানীয় সদস্য হয়ে ওঠে। অন্যরা ধরে নেয় যে জেন্টাইল সমাজে ইহুদিদের জায়গা নেই; তাদের অবশ্যই পবিত্র ভূমি যায়নে ফিরে যেতে হবে, সেখানে নতুন ইহুদি রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হবে। অন্যরা সংস্কার, রক্ষণশীল বা নিও-অর্থডক্স ইহুদিবাদের মতো একটি আধুনিকায়নের ধর্মীয় সমাধান পছন্দ করেছে। কেউ কেউ আধুনিক সমাজ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে প্রথাগত অর্থডক্সিকে আঁকড়ে থেকেছে। এই হারেদিমরা (‘কম্পিত জন’) নতুন বিশ্বে ইহুদিবাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবিত ছিল, মরিয়াভাবে প্রাচীন বিশ্বকে আবার গড়ে তোলার চেষ্টা করবে তারা। এমনকি রাশিয়া বা পোল্যান্ডে ওদের পিতৃপুরুষের মতো পশ্চিম ইউরোপ বা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ফারের টুপি, কালো নিকার ও কাফতান পরা অব্যাহত রেখেছিল তারা। এক বৈরী বিশ্বে বেশিরভাগই ইহুদি পরিচয় ধরে রাখার চেষ্টা করছিল, নিশ্চিহ্নতাকে দূরে ঠেলে রাখতে সংগ্রাম করছিল তারা; এবং কোনও ধরনের পরম নিরাপত্তা ও নিশ্চয়তার সন্ধান করছিল।
এই মনোভাবটি মূর্ত হয়ে উঠেছিল রাশিয়ার লুবাভিচ ভিত্তিক র্যাবাই শেয়ুর যালমানের উত্তরসুরিদের বংশধারার হাতে নিয়ন্ত্রিত হাবাদ হাসিদিজমে। ১৮৯৩ সালে এই উপাধী ধারণকারী পঞ্চম রেব্বে আর. শালোম দোভ (১৮৬০-১৯২০) ইহুদিবাদের ভবিষ্যৎ নিয়ে গভীরভাবে উদ্বিগ্ন ছিলেন। বিভিন্ন জায়গায় ব্যাপক সফর করেছেন তিনি, লিথুয়ানিয়ার মিসনাগদিমের সাথে যোগাযোগ বজায় রেখেছিলেন, ধর্মীয় অনুসরণের অধঃগতি দেখতে পাচ্ছিলেন। ১৮৯৭ সালে ফলোঝিন, স্লোবোদকা ও মিরের মিসনাগদিক ইয়েশিভোতের আদলে হাবাদ ইয়েশিভা স্থাপন করেন তিনি। তিনিও ‘প্রভুর শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে’ তরুণদের একটা ক্যাডার গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। ‘এই শত্রুরা’ জার ও তাঁর কর্মকর্তারা ছিলেন না; এই ধরনের আন্দোলনের স্বাভাবিক ধারায় স্বধর্মীদের বিরুদ্ধে অভিযান হিসাবে সূচিত লুবাভিচ হাসিদিজম মৌলবাদী আন্দোলনে পরিণত হচ্ছিল। পঞ্চম রেব্বের চোখে অন্য ইহুদিরাই-মাসকিলিম, যায়নিস্ট, সমাজতন্ত্রী ইহুদি ও মিসনাগদিম- ঈশ্বরের শত্রু। তাঁর দৃষ্টিতে এরা ধর্মবিশ্বাসকে মারাত্মকভাবে বিপদাপন্ন করে তুলছিল। তাঁর ইয়েশিভার ছাত্রদের বলা হত তামিমিম: ‘খাঁটিজন’। ‘রেব্বের সেনাদলের সদস্য হওয়ার’ কথা ছিল তাদের, ইহুদিবাদের টিকে থাকা নিশ্চিত করতে যারা ‘কোনও রকম আপোস বা ছাড় ছাড়াই’ যুদ্ধ করবে। মেসায়াহর আগমনের পথ তৈরি করবে তাদের সংগ্রাম
প্যালেস্তাইনে একটি ইহুদি স্বদেশ ভূমি সৃষ্টির আন্দোলন যায়নিজম আধুনিকতার প্রতি এইসব ইহুদি সাড়ার ভেতর সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী ও কল্পনা নির্ভর। এটা কোনও একরৈখিক আন্দোলন ছিল না। যায়নিস্ট নেতারা নানা রকম আধুনিক ধ্যান-ধারণা থেকে গ্রহণ করেছেন: জাতীয়তাবাদ, পাশ্চাত্য আধিপত্যবাদ, সমাজতন্ত্র ও ইহুদি আলোকনের সেক্যুলারিজম। প্যালেস্তাইনে একটি সমাজতন্ত্রী সম্প্রদায় প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে লিপ্ত ডেভিড বেন গুরিওনের (১৮৮৬-১৯৭৩) লেবর যায়নিজম প্রধান যায়নিস্ট আদর্শ হিসাবে আবির্ভূত হলেও যায়নিস্ট উদ্যোগ পুঁজিবাদের উপরও দারুণভাবে নির্ভর করেছে। ১৮৮০ থেকে ১৯১৭ সালের ভেতর ইহুদি ব্যবসায়ীরা প্যালেস্তাইনে অনুপস্থিত আরব ও তুর্কি জমির মালিকদের কাছ থেকে মিলিয়ন মিলিয়ন ডলার বিনোয়োগ করে জমি ক্রয় করেছে। থিওদর হার্যেল (১৮৬০-১৯০৪) ও চেইম ওয়েইম্যান (১৮৭৪-১৯৫৩)-এর মতো অন্যরা পরিণত হয়েছেন রাজনৈতিক লবিস্টে। ভবিষ্যতের ইহুদিরাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্যে ইউরোপিয় কলোনি হিসাবে কল্পনা করেছেন হালে। অনেকে আবার জাতি রাষ্ট্র চায়নি। বরং নতুন স্বদেশভূমিকে ইহুদিদের পক্ষে একটা সাংস্কৃতিক কেন্দ্র ভেবেছে। অনেকেই আসন্ন অ্যান্টি-সেমিটক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করেছে; নিশ্চিহ্নতার কবল থেকে ইহুদি জাতিকে রক্ষা করতে তাদের অবশ্যই একটা নিরাপদ আশ্রয় ও শরণ তৈরি করতে হবে। তাদের নিশ্চিহ্নতার ভীতি কোনও নৈতিক বা মনস্তাত্ত্বিক শূন্যতা ছিল না, বরং তা ছিল আধুনিকতার খুনে সম্ভাবনার বাস্তবভিত্তিক মূল্যায়ন।
যায়নবাদের সবগুলো ধরনেই ভীত বোধ করেছে অর্থডক্সরা। উনবিংশ শতাব্দীতে ধর্মীয় ধরনের যায়নবাদ সৃষ্টির অন্তত দুটি প্রয়াস চলেছিল, কিন্তু কোনওটাই তেমন একটা সমর্থন পায়নি। ১৮৪৫ সালে সারায়েভোর সেফারদিক ইহুদি ইয়েহুদা হাই আলকালাই (১৭৯৮-১৮৭৮) যায়নে প্রত্যাবর্তনের প্রাচীন মেসিয়ানিক মিথকে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের কর্মসূচিতে পরিণত করার প্রয়াস পেয়েছিলেন। মেসায়াহ কোনও ব্যক্তি নন, বরং একটা প্রক্রিয়া ‘খোদ ইহুদিদের প্রচেষ্টার ভেতর দিয়েই এর সূচনা ঘটবে, তাদের অবশ্যই সংগঠিত ও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে, নেতা নির্বাচন করতে হবে এবং নির্বাসনের দেশ ত্যাগ করতে হবে।’৩৭ বিশ বছর পরে পোলিশ ইহুদি ভি হার্শ কালিশার (১৭৯৫-১৮৭৪) তাঁর দেভিশাত যায়নে (‘যায়নের আশা’, ১৮৬২) ঠিক এই বিষয়টিই তুলে ধরেন। প্রাচীন মিথলজিকে যৌক্তিক করার চেষ্টা করছিলেন আলকালাই ও কালিশার, একে ধরায় নামিয়ে এনে সেকুলারাইজ করছিলেন। কিন্তু ধর্মপ্রাণ, ধার্মিক বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ ইহুদির কাছে এ জাতীয় যেকোনও ধারণাই মারাত্মক ছিল। উনবিংশ শতাব্দীর শেষের বছরগুলোয় যায়নিস্ট আন্দোলন গতি অর্জন ও সুইট্যারল্যান্ডের বাসেলে অনুষ্ঠিত বিশাল যায়নিস্ট সম্মেলনে আন্তর্জাতিক পরিচয় পেলে অর্থডক্সরা একে চরম ভাষায় নিন্দা জানিয়েছিল।” প্রাক আধুনিক বিশ্বে মিথের সম্পূর্ণতই লোগোসের এখতিয়ারে থাকা বাস্তব ভিত্তিক কর্মকাণ্ডের নীল-নকশা হওয়ার কথা ছিল না। মিথের কাজ ছিল এই ধরনের কর্মকাণ্ডকে অর্থ ও আধ্যাত্মিক ভিত্তি দান করা। শাব্বেতাই যেভি ঘটনা মনের অদৃশ্য বলয়ের কাহিনী ও ইমেজকে রাজনীতির বলয়ে প্রয়োগ করায় কী বিপদ হতে পারে সেটা দেখিয়েছিল। সেই প্রয়াসের ব্যর্থতার ধাক্কার পর থেকে মিথোসকে লোগোস-এর মতো বাস্তবভিত্তিক প্রয়োগযোগ্যতা থাকার মতো করে ব্যবহার করার বিরুদ্ধে পুরোনো সংস্কার ইহুদি কল্পনায় টাবুর শক্তি লাভ করেছিল। নিষ্কৃতি অর্জনের যে কোনও মানবীয় প্রয়াস বা পবিত্রভূমিতে রাজ্য প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্যে বাস্তবভিত্তিক পদক্ষেপ গ্রহণ করে ‘সমাপ্তিকে ত্বরান্বিত’ করা ছিল ঘৃণিত। ইহুদিদের এমনকি যায়নে ফিরে যেতে বেশি প্রার্থনা করার উপরও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছিল। একমাত্র নিষ্কৃতি দানের অধিকারী ঈশ্বরের বিরুদ্ধে এমন যেকোনও উদ্যোগ গ্রহণ বিদ্রোহের শামিল; যেকেউ এমন কিছু করলে সে ‘অন্যপক্ষে’, দানবীয় বিশ্বে যোগ দেবে। ইহুদিদের অবশ্যই রাজনৈতিকভাবে নিষ্ক্রিয় থাকতে হবে। এটা নির্বাসনের অস্তিত্বমূলক অবস্থার একটা শর্ত।৩৯ মোটামুটি শিয়া মুসলিমদের মতোই ইহুদিরা রাজনৈতিক সক্রিয়তা নিষিদ্ধ করেছিল, ইহুদি ইতিহাস থেকে ভালো করেই জানা ছিল তাদের ইতিহাসে মিথকে মূর্ত করে তোলা কতখানি মারাত্মক হয়ে দাঁড়াতে পারে।
আজও যায়নিজম ও এই আন্দোলনের ফলে সৃষ্ট ইহুদি রাষ্ট্র ইহুদি বিশ্বে খোদ অধুনিকতার চেয়ে ঢের বেশি বিভাজক হয়ে আছে। যায়নিজম ও ইসরায়েল রাষ্ট্রের পক্ষে বা বিপক্ষে সাড়া ইহুদি মৌলবাদের সব ধরনের ক্ষেত্রে মূল প্রেরণাদায়ী শক্তিতে পরিণত হবে।° যায়নিজমের মাধ্যমেই মূলত সেক্যুলার আধুনিকতা ইহুদি জীবনে প্রবেশ করেছে; চিরকালের মতো একে বদলে দিয়েছে। এর কারণ প্রথমত, যায়নবাদীরা ইহুদিবাদের অন্যতম পবিত্র প্রতীক ইসরায়েল দেশকে যৌক্তিক, জাগতিক ও প্রায়োগিক বাস্তবতায় পরিণত করতে দারুণভাবে সফল হয়েছিল। একে অতীন্দ্রিয় বা হালাখিয়ভাবে ধ্যান করার বদলে যায়নবাদীরা শারীরিকভাবে, কৌশলগতভাবে ও সামরিকভাবে এই দেশে বাস করেছে। বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠ অর্থডক্সদের কাছে গোড়ার দিকের এই বছরগুলোতে এর মানে ছিল পবিত্র বাস্তবতাকে মাড়িয়ে যাওয়া ধর্মদ্রোহীর মতো। এটা ছিল শত শত বছরের ধর্মীয় ঐতিহ্যকে উপেক্ষা করে যাওয়া অশ্লীলতার পরিকল্পিত কাজ।
কারণ সেকুল্যার যায়নবাদীরা ধর্ম প্রত্যাখ্যান করার বেলায় ছিল সোজাসাপ্টা। তাদের আন্দোলন প্রকৃতপক্ষেই ইহুদিবাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ছিল। এদের অনেকেই ছিল নাস্তিক, সমাজতন্ত্রী, মার্ক্সিস্ট। খুব অল্প জনই তোরাহর বিভিন্ন নির্দেশনা পালন করত। কেউ কেউ ইতিবাচকভাবে ধর্মকে ঘৃণা করেছে, তাদের মতে এই ধর্ম ইহুদি জনসাধারণকে নিষ্ক্রিয় বসে থেকে মেসায়াহর অপেক্ষায় থাকতে উৎসাহিত করে ব্যর্থ করে দিয়েছে। নির্যাতন ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে সংগ্রামে সাহায্য করার বদলে ধর্ম ইহুদিদের জগৎ থেকে অদ্ভুত অতীন্দ্রিয় অনুশীলন বা প্রাচীন টেক্সট পাঠে অনুপ্রাণিত করেছে। প্রাচীন মন্দিরের শেষ রেলিক্স জেরুজালেমের পশ্চিম প্রাচীর আঁকড়ে ধরে ইহুদিদের কান্নার দৃশ্য বহু যায়নবাদীকে হতাশায় ভরে তুলেছে। অতিপ্রাকৃতের উপর আপাত অসহায় নির্ভরতা তারা যা কিছু অর্জনের প্রয়াস পাচ্ছিল তার সম্পূর্ণ বিরুদ্ধে ছিল। যায়নবাদীরা ঘেটোর অস্বাস্থ্যকর, সীমিত জীবন থেকে মুক্ত এক নতুন আত্মপরিচয় গড়ে তুলতে চাইছিল-নতুন ইহুদি। নতুন ইহুদি হবে স্বায়ত্তশাসিত, নিজ দেশে নিজের ভাগ্যের নিয়ন্তা। কিন্তু শেকড় ও আত্মসম্মানের এই সন্ধান ছিল ইহুদি ধর্ম থেকে স্বাধীনতা ঘোষণার শামিল।
সবার উপরে যায়নবাদীরা ছিল বাস্তববাদী। এটা আধুনিক কালের মানুষে পরিণত করেছিল তাদের। কিন্তু তারপরেও তারা গভীরভাবে ভূমির প্রতীকের বিস্ফোরণমূলক ‘শক্তি’ সম্পর্কে সজাগ ছিল। ইহুদিবাদের পৌরাণিক বিশ্বে ভূমি ছিল দুটি পবিত্রতম বাস্তবতা হতে অবিচ্ছেদ্য: ঈশ্বর ও তোরাহ। কাব্বালাহর অতীন্দ্রিয় যাত্রায় সত্তার অভ্যন্তরে অবতরণের শেষ পর্যায়ের সাথে প্রতীকীভাবে সম্পর্কিত ছিল, এবং কাব্বালিস্টের আপন সত্তার গভীরে আবিষ্কৃত স্বর্গীয় সত্তার মতো একই রূপের। ভূমি ছিল ইহুদি পরিচয়ের ক্ষেত্রে মৌল বিষয়। যায়নবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গি যত বাস্তববাদীই হয়ে থাকুক, তারা বুঝতে পেরেছিল, অন্য কোনও দেশই আসলে ইহুদিদের ‘রক্ষা’ করতে পারবে না; মনস্তাত্ত্বিক উপশম এনে দেবে না। রাব্বিনিক প্রতিষ্ঠানের প্রবল বিরোধী পেরেযত্ স্মোলেনকিন (১৮৪২-৯৫) বিশ্বাস করতেন, একমাত্র প্যালেস্তাইনই ইহুদি রাষ্ট্রের সম্ভাব্য স্থান হতে পারে। লিও পিন্সকার (১৮২১-৯১) অনেক পরে নিজ বিবেচনা বোধের বিরুদ্ধে গিয়ে ধীরে ধীরে এই মতবাদে সমর্থন দিয়েছিলেন, তবে শেষ পর্যন্ত স্বীকার করতে বাধ্য হন যে প্যালেস্ত াইনেই ইহুদি রাষ্ট্র হতে হবে। বাসেলে দ্বিতীয় যায়নিস্ট সম্মেলনে (১৮৯৮) উগান্দায় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার কথা বলে থিওদর হালে আরেকটু হলেই নেতৃত্ব খোয়াতে যাচ্ছিলেন। তিনি প্রতিনিধিদের সামনে উঠে হাত তুলে সামিস্টের এই কথাগুলো উচ্চারণ করতে বাধ্য হন: ‘জেরুজালেম, তোমাকে ভুলে গেলে আমার ডান হাত যেন খসে পড়ে!’ যায়নবাদীরা তাদের সম্পূর্ণ সেক্যুলার এমনকি ঈশ্বরবিহীন অভিযানকে বাস্তব পৃথিবীতে একটি বাস্তবায়নযোগ্য বাস্তবতায় পরিণত করতে মিথোসের শক্তি কাজে লাগাতে প্রস্তুত ছিল। সাফল্যই ছিল তাদের বিজয়। কিন্তু পৌরাণিক, পবিত্র ভূগোলকে সমর্থন দান একে কাঠিন বাস্তবে রূপান্তরিত করার প্রয়াস পাওয়ার সময় বরাবরের মতোই সমস্যাসঙ্কুল হয়ে উঠবে। প্রথম দিকের যায়নবাদীদের পূর্ববর্তী দুই হাজার বছরের প্যালেস্তাইনের আঞ্চলিক ইতিহাস সম্পর্কে তেমন একটা ধারণা ছিল না; তাদের শ্লোগান: ‘জনহীন এক দেশের জন্যে দেশহীন এক জাতি!’ দেশটি যে নিজস্ব দেশের জন্যে নিজস্ব আকাঙ্ক্ষা লালনকারী প্যালেস্তাইনি আরবদের অধিবাস থাকার সত্যির প্রতি যারপরনাই উপেক্ষাই তুলে ধরেছিল। যায়নবাদ এর সীমিত, বাস্তব ভিত্তিক ও আধুনিক লক্ষ্যে সফল হয়ে থাকলেও তা ইসরায়েলের জনগণকে এমন এক বিরোধে জড়িয়ে দিয়েছিল এই বইটি লেখার মুহূর্তেও যা প্রশমিত হওয়ার তেমন একটা লক্ষণ দেখাচ্ছে না।
*
মিশর ও ইরানের মুসলিমরা, আমরা যেমন দেখেছি, প্রথমে আধুনিকতাকে আগ্রাসী, আক্রমণাত্মক ও শোষণমুলক আবিষ্কার করেছিল। আজকাল পাশ্চাত্যের জনগণ মুসলিম মৌলবাদীদের পক্ষ থেকে তাদের সংস্কৃতির বিরুদ্ধে আক্রমণ পরিচালনা, তাদের নীতিমালাকে শয়তানসুলভ হিসাবে প্রত্যাখ্যান ও সেক্যুলারিজম, গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের মতো মূল্যবোধের প্রতি কটাক্ষ করার কথা শুনে অভ্যস্ত। এমন একটা ধারণা রয়েছে যে ‘ইসলাম’ ও পাশ্চাত্য সম্পূর্ণ বেমানান; তাদের আদর্শ সম্পূর্ণ বিপরীত, পশ্চিম যা কিছুর পক্ষে ‘ইসলাম’ তারই বিরোধিতা করে থাকে। সুতরাং, এটা উপলব্ধি করা জরুরি যে, আসল ব্যাপার তা নয়। দ্বিতীয় অধ্যায়ে আমরা যেমন দেখেছি, মুসলিমরা তাদের নিজস্ব আধ্যাত্মিক শক্তিতেই অনেক ধারণা ও মূল্যবোধ অর্জন করেছিল। তারা ধর্ম ও রাজনীতিকে বিচ্ছিন্ন করার উপলব্ধির বিকাশ ঘটিয়েছিল ও ব্যক্তির বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতার দর্শন গড়ে তুলেছিল; যৌক্তিক চিন্তা-ভাবনার প্রয়োজনীয়তা বুঝতে পেরেছিল। ন্যায়বিচার ও সাম্যের প্রতি কোরানিক জোর আধুনিক পাশ্চাত্য রীতির মতোই পবিত্র। সুতরাং, বহু মুসলিম চিন্ত াবিদের পাশ্চাত্যের প্রতি আকৃষ্ট হওয়া বিস্ময়কর নয়। তাঁরা বুঝতে পেরেছিলেন, ইউরোপিয় ও মুসলিমরা একই মূল্যবোধ ধারণ করে, যদিও ইউরোপের জনগণ নিশ্চিতভাবেই আরও দক্ষ, গতিশীল ও সৃজনশীল সমাজ নির্মাণে অগ্রসর হয়েছে, যাকে তাঁরা নিজেদের দেশে নতুন করে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন।
উনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় ভাগে ইরানে বুদ্ধিবৃত্তিক চিন্তক, রাজনীতিক ও লেখকদের একটা দল ইউরোপিয় সংস্কৃতির সমীহের ক্ষেত্রে বেশ আবেগপ্রবণ হয়ে উঠেছিলেন। ফাতাদি আখুন্দযাদা (১৮১২-৭৮), মালকুম খান (১৮৩৩–১৯০৮), আব্দুল রহিম তারিবজাদা (১৮৩৪-১৯১১) এবং মির্যা আকা খান কিরমানি (১৮৫৩-৯৬) কোনও কোনও ক্ষেত্রে যায়নবাদীদের মতোই বিদ্রোহী ছিলেন। লাগাতার উলেমাদের বিরুদ্ধে লেগে থাকতেন তাঁরা, সম্পূর্ণ সেক্যুলার রাজনীতির পত্তন করতে চেয়েছেন, ধর্মকে মৌলিক পরিবর্তনের পক্ষে ব্যবহার করার প্রয়াস পেয়েছেন। যায়নবাদীদের মতোই তাঁদের বিশ্বাস ছিল যে, প্রথাগত ধর্মবিশ্বাস—তাঁদের বেলায় ইসলাম-মানুষকে পশ্চাদপদ করে রেখেছে, প্রগতির পথে বাধা সৃষ্টি করেছে, ও মুক্ত আলোচনায় বাদ সেধেছে যা কিনা মহান পাশ্চাত্য পরিবর্তনের ক্ষেত্রে যারপরনাই গুরুত্বপূর্ণ ছিল। কিরমানি বিশেষ করে স্পষ্টভাষী ছিলেন। ধর্ম বাস্তবভিত্তিক না হলে, তাঁর চোখে, এর কোনও প্রয়োজন নেই। হুসেইনের জন্যে কেঁদে হবে কী, যদি গরীবের জন্যে সত্যিকারের ন্যায়বিচারের অস্তিত্ব না থাকে?
ইউরোপিয় জ্ঞানী ব্যক্তিরা যখন গণিত, বিজ্ঞান, রাজনীতি ও অর্থনীতি নিয়ে পড়াশোনা করছে ও মানুষের অধিকারের পক্ষে লড়ছে, সেক্যুলারিজমের এই যুগে দরিদ্র জনসাধারণের ভাগ্য উন্নয়নের জন্যে সংগ্রাম করছে, সেখানে ইরানি উলেমা পবিত্রতার সমস্যা আর পয়গম্বরের স্বর্গে উর্ধ্বারোহণ নিয়ে আলোচনায় মেতে আছেন।৪২
কিরমানি জোরের সাথে বলেছেন, সত্যিকারের ধর্ম মানে যৌক্তিক আলোকন ও সমান অধিকার। এর মানে উঁচু দালানকোঠা, শিল্প উদ্ভাবন, কলকারাখানা, যোগাযোগের উপায়ের প্রসারণ, জ্ঞানের বিকাশ, সাধারণ মানুষের কল্যাণ ন্যায়বিচার ভিত্তিক আইনের বাস্তবায়ন।৪৩ অবশ্যই কিরমানির ভুল হয়েছিল। ধর্ম এসবের কোনওটাই করেনি; বরং লোগোস অর্থাৎ, যৌক্তিক ভাবনা এইসব বাস্তব প্রকল্পে নিজেকে নিয়োজিত করেছে। ধর্মের কাজ ছিল এইসব বাস্তবভিত্তিক কর্মকাণ্ডকে পরম মূল্য দান করা। একদিক থেকে অবশ্য কিরমানি ঠিক ছিলেন, যখন তিনি শিয়া মতবাদকে প্রগতির পথে বাধা দেওয়ার জন্যে অভিযুক্ত করেছেন। জনমানুষকে সমাজের সহজাত সীমাবদ্ধতাগুলোকে মেনে নিতে সাহায্য করা ছিল রক্ষণশীল প্রাক আধুনিক ধর্মের অন্যতম কাজ; ইরানিরা প্রগতির প্রতি নিবেদিত আধুনিক বিশ্বে পূর্ণ অংশ গ্রহণ করতে চাইলে ধর্মকে আর তেমন কিছু করতে দেওয়া যাবে না। ইসলামকে পরিবর্তিত হতে হবে। কিন্তু কীভাবে?
বহু আধুনিক সেক্যুলারিস্টের মতো কিরমানি এবং তাঁর বন্ধুরা জাতির বিশঙ্খলার জন্যে ধর্মকে দুষেছেন। তাঁরা বিশ্বাস করেছেন যে, আরবরা ক্ষতি করার জন্যে ইসলামকে ইরানের জনগণের উপর চাপিয়ে দিয়েছে, তো প্রাক ইসলামি ইরানের ক্ষীণ জ্ঞানের ভরসায় তাঁরা পার্সিয়ান পরিচয় গড়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। ইউরোপিয় গ্রন্থের অপদ্ধতিগত পাঠের উপর নির্ভরশীল পাশ্চাত্য সম্পর্কে তাঁদের দৃষ্টিভঙ্গিও সমানভাবে অপর্যাপ্ত ও আনাড়ী ছিল। এই সংস্কারকগণ পাশ্চাত্য আধুনিকতার জটিল প্রকৃতি সম্পূর্ণ উপলব্ধি করতে পারেননি, তাঁরা এর প্রতিষ্ঠানসমূহকে (উনবিংশ শতাব্দীর প্রগতি, বিজ্ঞান ও ক্ষমতার প্রতীক) অনেকটা ‘মেশিন’ মনে করেছেন যা নির্ভুল ও যান্ত্রিকভাবে গোটা ইউরোপিয় অভিজ্ঞতাকে তৈরি করে দিতে পারবে। ইরানিরা পাশ্চাত্য সেক্যুলার আইনি কাঠামো (শরীয়ার বদলে) অর্জন বা ইউরোপিয় কায়দার শিক্ষা করতে পারলে তারাও আধুনিক ও প্রগতিশীল হয়ে উঠতে পারবে। শিল্পায়ন ও আধুনিক অর্থনীতির গুরুত্ব বুঝতে পারেননি তাঁরা। ইউরোপিয় শিক্ষা নিশ্চিতভাবেই তরুণ ইরানিদের পক্ষে নতুন দরজা খুলে দিত, কিন্তু তাদের সমাজের অবকাঠামো অপরিবর্তিত রয়ে গেলে শিক্ষা দিয়ে তেমন কিছু করার থাকবে না তাদের। আধুনিকায়ন তখনও এমনকি শিশু অবস্থায়ও পৌঁছেনি; ইরানিদের তাদের কৃষিভিত্তিক সমাজকে শিল্পায়িত ও প্রযুক্তিয়ায়িত সমাজে পরিবর্তনের কষ্টকর ও হতাশব্যঞ্জক প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যাওয়ার প্রয়োজন ছিল। কেবল সেটাই যেখানে সবাই ভাবতে পারবে, লিখতে পারবে, এবং পছন্দমতো ধারণা নিয়ে কাজ করতে পারবে, সংস্কারকদের কাঙিক্ষত সেই উদার সভ্যতা সম্ভবপর করে তুলতে পারত, যেখানে কৃষিভিত্তিক সমাজের পক্ষে এই ধরনের স্বাধীনতাকে ধারণ করা সম্ভব নয়। পাশ্চাত্য প্রতিষ্ঠানগুলো উপকারী হতে পারে, কিন্তু সেগুলো নিজে থেকে তখনও রক্ষণশীল কালে রয়ে যাওয়া দিগন্তধারী কোনও জাতির মানসিকতাকে পরিবর্তন করতে পারত না।
প্রকৃতপক্ষেই খোদ সংস্কারকদেরই এক পা তখনও প্রাচীন বিশ্বে রয়ে গিয়েছিল। আধুনিক সমাজে তাঁদের প্রাথমিক পদচারণাকে বিবেচানায় রাখলে এটা তেমন বিস্ময়কর কিছু নয়। ইস্ফাহানের অতীন্দ্রিয় মতবাদ বাবিবাদ, সুফিবাদ ও সেই সাথে পাশ্চাত্যের বইপুস্তক পাঠ করার ভেতর দিয়ে প্রগতিশীল ধারণায় উপনীত হয়েছিলেন তাঁরা। শিয়া আধ্যাত্মিকতা তাঁদের প্রাচীন বাধা ছুঁড়ে ফেলার মুক্তি ও সাহস যুগিয়েছিল, কিন্তু সেটা একেবারেই রক্ষণশীল উপায়ে। কিরমানি নিজেকে সম্পূর্ণ যুক্তিবাদী দাবি করতেন: ‘যুক্তি ও বৈজ্ঞানিক প্রমাণই আমার বক্তব্যের উৎস ও আমার কর্মকাণ্ডের ভিত্তি,’৪৫ জোরের সাথে বলেছেন তিনি। কিন্তু তাঁর যুক্তিবাদ সম্পূর্ণ পৌরাণিক ও অতীন্দ্রিয় দৃষ্টিভঙ্গিতে সীমাবদ্ধ ছিল। ইতিহাস সম্পর্কে তাঁর বিপ্লবী দৃষ্টিভঙ্গি ছিল, কিন্তু তিনি ডারউইনবাদকে মোল্লা সদ্রার সম্পূর্ণতার দিকে সকল সত্তার প্রগতিশীল উন্নয়নের সাথে এক করে দেখেছেন। মালকুম খানও তাই। তাঁরা স্রেফ ইলম-এর (‘আবশ্যক জ্ঞান’) প্রাচীন মুসলিম ধারণাকে পাশ্চাত্য বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদকে স্থান করে দিতে প্রসারিত করছিলেন। সংস্কারকগণ আধুনিক দার্শনিকদের চেয়ে বরং মধ্যযুগের ফায়লাসুফদের মতো যুক্তি তর্ক দেখাতে চাইতেন। তাঁরা সকলেই শাহদের ক্ষমতাকে সীমিতকারী সাংবিধানিক সরকারের ধারণাকে সমর্থন করেছেন; ইরানে এই বিতর্ক শুরু করার ভেতর দিয়ে তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। নিশ্চিতভাবেই তাঁরা সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল কোনও সরকারের কথা কল্পনা করেননি। মালকুম খানের দৃষ্টিভঙ্গি অনেকটাই দার্শনিক রাজার অজ্ঞ জনসাধারণকে পথ নির্দেশ করার পুরোনো ফালসাফাহ আদর্শের কাছাকাছি ছিল, আধুনিক রাজনৈতিক বিজ্ঞানীর মতো নয়। তালিবজাদা বহুদলীয় ব্যবস্থার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে পারেননি; তাঁর দৃষ্টিতে বিরোধী দলের ভূমিকা স্রেফ সরকারী দলের সমালোচনা করা ও কোনও সংকটের সময় ক্ষমতা দখলের জন্যে তৈরি থাকা।৪৬ গণতান্ত্রিক আদর্শ গড়ে তুলতে পাশ্চাত্য জনগণের কয়েক শো বছরের অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিবর্তনের প্রয়োজন হয়েছিল; তো আবারও বলতে হয়, সংস্কারকগণের একে পুরোপুরি বুঝে উঠতে না পারায় বিস্ময়ের কিছু নেই। তাঁরা ছিলেন-এছাড়া আর কিছু হওয়ার উপায়ও ছিল না-ক্রান্তিকালের মানুষ, জাতিকে পরিবর্তনের দিক নির্দেশ দিয়েছেন, কিন্তু আধুনিকতাকে সম্পূর্ণভাবে ভাষা দিতে পারেননি।
কিরমানি ও মালকুম খানের মতো বুদ্ধিজীবীগণ ইরানের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন অব্যাহত রাখবেন, নিজেদের প্রায়শঃই উলেমাদের সাথে বিরোধে লিপ্ত অবস্থায় আবিষ্কার করবেন। কিন্তু শতাব্দীর শেষের দিকে যাজকরা দেখিয়ে দিয়েছিলেন, সব সময় প্রাচীন বয়ানে ডুবে ছিলেন ন তারা, বরং শাহগণ জনগণের জীবনকে বিপদাপন্ন করে বসলে হস্তক্ষেপে প্রস্তুত ছিলেন। ১৮৯১ সালে নাসির আদ-দিন শাহ (১৮২৯-৯৬) একটি ব্রিটিশ কোম্পানিকে ইরানে তামাক উৎপাদন ও বিক্রির একচেটিয়া অধিকার দান করেন। কাজার শাহরা বহু বছর ধরে এই ধরনের কনসেশন দিয়ে আসছিলেন, কিন্তু এপর্যন্ত কেবল সেইসব এলাকায় যেখানে ইরানিরা সংশ্লিষ্ট ছিল না। কিন্তু তামাক ইরানের জনপ্রিয় ফসল ছিল, হাজার হাজার জমি মালিক, দোকানি ও রপ্তানিকারকের আয়ের প্রধান উৎস। দেশময় বাজারি ও উলেমাদের নেতৃত্বে ব্যাপক প্রতিবাদ অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু ডিসেম্বর মাসে নাজাফের নেতৃস্থানীয় মুজতাহিদ হাজ মির্যা হাসান শিরাজি এক ফতওয়া জারি করে ইরানে তামাক নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। দুর্দান্ত সিদ্ধান্ত ছিল এটা। সবাই, এমনকি অমুসলিম ইরানি ও শাহর স্ত্রীরা পর্যন্ত ধুমপান বন্ধ করে দেন। সরকার নতি স্বীকার করতে ও কননেশন প্রত্যাহারে বাধ্য হয়।৪৭ এটা ছিল পূর্বাভাসমূলক একটা সময়, ইরানি উলেমাদের সম্ভাব্য শক্তি দেখিয়ে দিয়েছিল, গোপন ইমামের একক মুখপাত্র হিসাবে তাঁরা এমনকি শাহর আনুগত্যও দাবি করতে পারতেন। ফতওয়াহটি ছিল যৌক্তিক, বাস্তবভিত্তিক ও কার্যকর, কিন্তু কেবল প্রাচীন পৌরাণিক প্রেক্ষাপটে ইমামের কর্তৃত্ব থেকে উদ্ভুত হয়েই তা অর্থপূর্ণ হয়ে ওঠে।
১৮৭০-র দশকে মিশরেও আধুনিক ইউরোপকে উত্তেজনাকর ও অনুপ্রেরণামূলক হিসাবে দেখা হয়েছে, আধুনিকতার সমস্যা ও যন্ত্রণা সত্ত্বেও ইসলামিক চেতনার পক্ষেও একে অনুকূল বিবেচনা করা হয়েছে। এই উৎসাহ স্পষ্টভাবে মিশরিয় লেখক রিফাহ আল-তাহতাওয়ির (১৮০১-৭৩)৪৮ রচনায় প্রতিফলিত হয়েছে। মুহাম্মদ আলির ভক্ত ছিলেন তিনি, আযহারে পড়াশোনা করেছেন, নতুন মিশরিয় সেনাবাহিনীতে ইমামের দায়িত্ব পালন করেছেন, এই প্রতিষ্ঠানের জন্যে তাহতাওয়ির দারুণ সমীহ ছিল। কিন্তু ১৮২৬ সালে তাহতাওয়ি মুহাম্মদ আলি প্যারিসে পাঠানো প্রথম ছাত্রদের একজন হয়েছিলেন। এটা ছিল তাঁর কাছে এক উন্মোচন। পাঁচ বছর ধরে তিনি ফরাসি, প্রাচীন ইতিহাস, গ্রিক মিথলজি, ভূগোল, গণিত ও যুক্তিবিদ্যার উপর পড়াশোনা করেন। বিশেষভাবে ইউরোপিয় আলোকনের ধারণায় রোমাঞ্চিত ছিলেন তিনি, এর যৌক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর কাছে অনেকটাই ফালসাফার মতো মনে হয়েছে।৪৯ দেশে ফেরার আগে তাহতাওয়ি তাঁর
। ডায়েরি প্রকাশ করেন, যা একজন বহিরাগতের চোখে আধুনিক পশ্চিম সম্পর্কে মূল্যবান প্রাথমিক ধারণা দেয় আমাদের। তাহতাওয়ির নিজস্ব সংস্কার ছিল। ধর্ম সম্পর্কে ইউরোপিয় দৃষ্টিভঙ্গি তাঁর কাছে অবমূল্যায়নকর ও ফরাসি চিন্তাবিদদের পয়গম্বরদের অতীন্দ্রিয় অনুপ্রেরণার চেয়ে তাঁদের যৌক্তিক অন্তর্দৃষ্টিকে উন্নত ভাববার ক্ষেত্রে উদ্ধত মনে হয়েছে। তবে তাহতাওয়ির কাছে প্যারিসের সমস্ত কিছু ঠিকভাবে কাজ করা আর আলস্যকে অপছন্দ করা ভালো লেগেছিল। তিনি ফরাসি সংস্কৃতির সূক্ষ্মতা ও নৈপূণ্যকে সমীহ করেছেন; উল্লেখ করেছেন প্যারিসবাসীরা ট্র্যাডিশনে বন্দি নয়, তবে সব সময় সবকিছুর আদি জানতে চায় ও তার প্রমাণ চায়।’ এমনকি সাধারণ মানুষও পড়ালেখা জানে দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন তিনি, ‘আর প্রত্যেকে যে যার ক্ষমতা অনুযায়ী গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে পারে।’ আধুনিকতার অত্যাবশ্যকীয় উপাদান উদ্ভাবনের প্রতি আবেগ দেখেও মুগ্ধ হয়েছেন তিনি। মানুষকে পরিবর্তনযোগ্য ও ভ্রান্তিময় করে তুলতে পারে তা, কিন্তু তাই বলে রাজনীতির মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে নয়। ‘কোনও একটা কাজে দক্ষ প্রত্যেকে এমন কিছু আবিষ্কার করতে চায় যার কথা আগে কেউ জানত না। কিংবা একটা কিছু শেষ করতে চায় যা এরই মধ্যে আবিষ্কৃত হয়েছে।৫০
মিশরে ফিরে নতুন ব্যুরো অভ ট্রান্সলেশনের পরিচালক হওয়ার পর- মিশরিয়দের কাছে ইউরোপিয় বিভিন্ন রচনা সুলভ করে তুলেছিল এই ব্যুরো-তাহতাওয়ি মিশরের লোকজনকে পশ্চিমের কাছে শিক্ষা নেওয়ার উপর জোর দিয়েছিলেন। ‘ইজতিহাদের দরজা (“স্বাধীন যুক্তিপ্রয়োগ’) অবশ্যই খুলে দিতে হবে, উলেমাদের অবশ্যই সময়ের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হবে, শরীয়াহকে আধুনিক কালের সাথে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। ডাক্তার, এঞ্জিনিয়ার, ও বিজ্ঞানীদের মুসলিম ধর্মীয় পণ্ডিতদের মতো একই মর্যাদা থাকতে হবে। আধুনিক বিজ্ঞান ইসলামের ক্ষতি করতে পারে না; ইউরোপিয়া মূলত স্পেনের কাছ থেকে বিজ্ঞান শিখেছিল, তো পাশ্চাত্য বিজ্ঞান পড়ার সময়ে আরবরা আসলে তাদের আদি জ্ঞানই ফিরিয়ে নিচ্ছে। সরকার অবশ্যই প্রগতি ও উদ্ভাবনের পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করতে পারবে না, বরং এগিয়ে চলার পথ দেখাতে হবে, কারণ পরিবর্তনই জীবনের ধারা। শিক্ষাই এর চাবিকাঠি; ফ্রান্সের মতো সাধারণ মানুষকে শিক্ষা দিতে হবে, মেয়েদেরও ছেলেদের মতো সমান মর্যাদা থাকতে হবে। তাহতাওয়ি বিশ্বাস করতেন, মিশর এক মহান ভবিষ্যতের উপান্তে এসে দাঁড়িয়েছে। আধুনিকতার প্রতিশ্রুতিতে আচ্ছন্ন ছিলেন তিনি; স্টিম এঞ্জিনের গুণ গেয়ে কবিতা লিখেছেন, স্যুয়েয ক্যানেল ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ট্রান্সন্যাশনাল রেলওয়েকে দূর দূরান্তের মানুষকে ভ্রাতৃত্ব ও শান্তির বন্ধনে কাছাকাছি নিয়ে আসা এঞ্জিনিয়ারিং কৃতিত্ব হিসাবে দেখেছেন। ফরাসি ও ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের মিশরের এসে বাস করতে দেওয়া হোক! তাহলেই কেবল প্রগতির ধারা বেগবান হবে।৫২
১৮৭০-র দশকে এক দল নতুন লেখক বর্তমানের লেবানন ও সিরিয়া থেকে কায়রোয় এসে বসতি করেন।৫৩ এদের বেশিরভাগই ছিলেন ক্রিশ্চান, ফরাসি ও আমেরিকান মিশনারি স্কুলে পড়াশোনা করেছিলেন তাঁরা, এবং তাঁদের এভাবে পাশ্চাত্য সংস্কৃতিতে প্রবেশাধিকার ছিল। এঁরা ছিলেন নতুন সাংবাদিকতার চর্চাকারী, অটোমান অঞ্চল থেকে খেদিভ ইসমাইলের কায়রোতে বেশি স্বাধীনতা আছে বলে আবিষ্কার করেন তাঁরা। নতুন নতুন সাময়িকী প্রকাশ করেন এরা, যেখানে লব্ধজ্ঞান, দর্শন, রাজনীতি, ভূগোল, ইতিহাস, শিল্পকারখানা, কৃষিখাত, নৈতিকতা আর সমাজবিজ্ঞান সম্পর্কে বিভিন্ন নিবন্ধ প্রকাশিত হয়, সাধারণ আরব পাঠকের কাছে গুরুত্ব পূর্ণ আধুনিক ধ্যান ধারণা পৌঁছে দেয়। এঁদের প্রভাব ছিল বিপুল। বিশেষ করে এই ক্রিশ্চান আরবরা মুসলিম রাষ্ট্রগুলোর সেক্যুলার হয়ে ওঠার ব্যাপারে খুবই আগ্রহী ছিলেন; তাই ধর্ম নয় কেবল বিজ্ঞানই সভ্যতার ভিত্তি হতে পারে জোর দিয়েছেন। তাহতাওয়ির মতো পাশ্চাত্যের প্রেমে পড়েছিলেন তাঁরা, মিশরের জনগণের কাছে এই উৎসাহ পৌছে দিয়েছিলেন।
পরবর্তী কালে গড়ে ওঠার বৈরিতার আলোকে এই প্রাথমিক সমীহের কথা চিন্তা করা বেশ করুণই বলা চলে। তাহতাওয়ি ও সিরিয় সাংবাদিগণ প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের এক সংক্ষিপ্ত মধুচন্দ্রমার কাল অতিবাহিত করছিলেন। ইসলামের প্রতি প্রাচীন ক্রুসেডিয় ঘৃণা যেন মুছে গেছে বলে মনে হয়েছিল, তাহতাওয়ি স্পষ্টতই ব্রিটেন ও ফ্রান্সকে কোনও রকম রাজনৈতিক হুমকি মনে করতে পারেননি। যদিও তাঁর প্যারিস সফরের সাথে ফরাসিদের হাতে আলজেরিয়ার নিষ্ঠুর উপনিবেশিকরণের ঘটনা মিলে গিয়েছিল। তাহতাওয়ির কাছে ব্রিটিশ ও ফ্রান্স ছিল স্রেফ প্রগতির ধারক। কিন্তু ১৮৭১ সালে এক ইরানি আবির্ভূত হন কায়রোয়, তিনি পাশ্চাত্যকে ভয় করতে শিখেছিলেন, তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, পশ্চিমা বিশ্ব আধিপত্য অর্জনের পথে এগিয়ে চলেছে। ইরানি ও শিয়া হলেও জামাল আল-দিন (১৮৩৯-৯৭) নিজেকে ‘আল-আফগানি’ (দ্য আফগান) বলে অভিহিত করতেন, সম্ভবত নিজেকে সুন্নি হিসাবে তুলে ধরে ইসলামি বিশ্বে বৃহত্তর শ্রোতাকে আকৃষ্ট করতে চেয়েছিলেন।৪ প্রচলিত মাদ্রাসা শিক্ষা লাভ করেছিলেন তিনি, এখানে ফিকহ (জুরিসপ্রুডেন্স) এবং ফালসাফা ও অতীন্দ্রিয়বাদের (ইরফান)-এর নিগূঢ় অনুশীলন অন্তর্ভুক্ত ছিল, তারপরেও বিট্রিশ ভারতে এক সফরের সময় তিনি বিশ্বাস করেছিলেন, আধুনিক বিজ্ঞান ও গণিতই ভবিষ্যতের চাবিকাঠি। অবশ্য, প্যারিসাবসীদের দেখে মুগ্ধ হয়ে তাহতাওয়ির মতো আফগানি পশ্চিমের প্রেমে আচ্ছন্ন হয়ে যাননি। উপমহাদেশে এক দীর্ঘস্থায়ী তিক্ততা রেখে যাওয়া ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে ভারতীয় বিদ্রোহের (১৮৫৭) সাথে তাঁর সফর কাল মিলে গিয়েছিল। আরব, তুরস্ক, রাশিয়া ও ইউরোপ সফর করেন আফগানি, পাশ্চাত্যের সর্বব্যাপিতা ও মুক্তি দেখে দারুণভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠেন। পশ্চিম ইসলামকে মাড়িয়ে যাবে বলে স্থির নিশ্চিত হয়ে গিয়েছিলেন। ১৮৭১ সালে কায়রো পৌঁছানোর মুহূর্তে একটা মিশন ছিল তাঁর হাতে। মুসলিম বিশ্বকে ইসলামের পতাকা তলে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার শিক্ষা দিতে পাশ্চাত্য সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে পাল্টা আক্রমণ শানাতে ধর্মকে ব্যবহারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলেন তিনি।
আফগানি ছিলেন আবেগপ্রবণ, বাগ্মী, বেপরোয়া ও রগচটা মানুষ। অনেক সময় খারাপ ভাবমূর্তি সৃষ্টি করেছেন তিনি, কিন্তু সন্দেহাতীত ক্যারিশমা ছিল তাঁর। কায়রোয় অল্প দিনেই তিনি এক দল শিষ্য সংগ্রহ করেন ও তাদের তাঁর প্যান- ইসলামিক ধারণা প্রচারে উৎসাহিত করেন। এই সময় আধুনিক মিশরের ভবিষ্যৎ রূপ নিয়ে বেশ আলাপ আলোচনা চলছিল। সিরিয় সাংবাদিকরা সেক্যুলার রাষ্ট্রের ধারণাকে সমর্থন করেছেন, তাহতাওয়ির বিশ্বাস ছিল মিশরিয়দের উচিত হবে পাশ্চাত্য কায়দার জাতীয়তাবাদের চর্চা করা। আফগানি এসবের কোনওটার পক্ষেই ছিলেন না। তাঁর চোখে, ধর্ম দুর্বল হয়ে গিয়ে থাকলে মুসলিম সমাজ অবশ্যই নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। কেবল ইসলামকে সংস্কার করে ও নিজস্ব অনন্য সংস্কৃতি ও ধর্মীয় ঐতিহ্যকে আঁকড়ে থেকেই মুসলিম দেশগুলো আবার শক্তিশালী হয়ে উঠতে ও জ্ঞানিক আধুনিকতার নিজস্ব ভাষ্য নির্মাণ করতে পারে। তিনি বিশ্বাস করতেন, মুসলিমরা কঠোর পদক্ষেপ না নিলে ইসলামি সম্প্রদায় (উম্মাহ) অচিরইে অস্তিত্ব হারাবে। সময় কম। ইউরোপিয় সাম্রাজ্যবাদীরা প্রতিদিনই শক্তিশালী হয়ে উঠছে, খুবই অল্প দিনের ভেতর ইসলামি বিশ্ব পাশ্চাত্য সংস্কৃতির পায়ে দলিত হবে।
সুতরাং, আফগানির ধর্মীয় দৃষ্টিভঙ্গি আমাদের প্রত্যক্ষ করা আধুনিকতার সমস্যাগুলোর প্রতি সাধারণ সাড়া নিশ্চিহ্নতার ভীতি থেকে উৎসারিত ছিল। তিনি বিশ্বাস করেছেন যে, আধুনিক হওয়ার জন্যে ইউরোপিয় জীবনধারা বেছে নেওয়ার কোনও প্রয়োজন নেই। মুসলিমরা নিজেদের মতো করেই সেটা করতে পারবে। স্রেফ ব্রিটিশ ও ফরাসিদের অনুকরণ করলে, নিজেদের ঐতিহ্যের উপর পাশ্চাত্য মূল্যবোধ চাপিয়ে দিলে, নিজেদেরই হারিয়ে ফেলবে তারা। স্রেফ বাজে নকলে পরিণত হবে তারা, না ঘরকা না ঘাটকা; এভাবে নিজেদেরই দুর্বলতাকে আরও প্রকট করে তুলবে।৫৫ ওদের আধুনিক বিজ্ঞানের প্রয়োজন রয়েছে, সেটা ইউরোপের কাছ থেকেই শিখতে হবে; কিন্তু এটাই, যুক্তি দেখিয়েছেন তিনি, ‘আমাদের হীনতার ও পতনের’ প্রমাণ। ‘ইউরোপিয়দের অনুকরণ করে নিজেদের সভ্য করে তুলছি আমরা।’৫৬ একটা প্রধান সমস্যা অনুভব করেছিলেন আফগানি। পাশ্চাত্য আধুনিকতা যেখানে বিশালাংশে উদ্ভাবন ও মৌলিকতার চর্চা করে সফল হয়েছিল, মুসলিমরা কেবল অনুকরণের ভেতর দিয়েই তাদের সমাজকে আধুনিক করে তুলতে পারে। আধুনিকায়ন কর্মসূচির একটি সহজাত ও অনিবার্য ঘাটতি রয়েছে।
আবারও, আফগানি একটি বাস্তব সমস্যা উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন। কিন্তু তাঁর সামাধান, আকর্ষণীয় শোনালেও, বাস্তবায়নযোগ্য ছিল না, কারণ ধর্মের কাছে এর প্রত্যাশা ছিল অনেক বেশি। দুর্বলতা, অস্থিরতা ও উন্মূলতার ফলে সাংস্কৃতিক পরিচয় হারানোর শংকা তাঁর ঠিকই ছিল। এইসব রেডিক্যালভাবে নতুন ধারণার সাথে সৃজনশীলতার সাথে সামাল দিয়ে উঠতে ইসলামকে পরিবর্তিত হবার কথা বলে ঠিক যুক্তিই দিয়েছিলেন তিনি। কিন্তু খোদ ধর্মীয় সংস্কারের পক্ষে কোনও দেশকে আধুনিক করে পাশ্চাত্য হুমকি থেকে রক্ষা করা সম্ভব ছিল না। মিশর শিল্পায়িত হতে না পারলে, একটি সজীব আধুনিক অর্থনীতি গড়ে তুলতে না পারলে ও কৃষিভিত্তিক সমাজের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে যেতে না পারলে, কোনও আদর্শই দেশটিকে ইউরোপের সমপর্যায়ে নিয়ে যেতে পারবে না। পশ্চিমে আমাদের স্বায়ত্তশাসন, গণতন্ত্র, বুদ্ধিবৃত্তিক স্বাধীনতা ও সহিষ্ণুতার আধুনিক আদর্শগুলো একাধারে অর্থনীতি ও দার্শনিক ও রাজনীতি বিজ্ঞানীদের অবদান। ঘটনাপ্রবাহ অচিরেই প্রমাণ করবে যে, মিশরিয়রা নিজেদের যত মুক্ত ও আধুনিকই ভাবুক না কেন, অর্থনৈতিক দুর্বলতা তাদের রাজনৈতিকভাবে ভঙ্গুর ও পশ্চিমের উপর নির্ভরশীল করে তুলবে, এবং এই অমর্যাদাকর দাসত্ব তাদের পক্ষে সত্যিকারের আধুনিক চেতনার চর্চা আরও কঠিন করে তুলবে।
কিন্তু আধুনিকতার জন্যে এই আকুতি সত্ত্বেও যেসব ইরানি বুদ্ধিজীবীদের সংস্পর্শে ছিলেন তাঁদের মতোই আফগানি তখনও অনেক দিক থেকেই প্রাচীন বিশ্বের মানুষ ছিলেন। ব্যক্তিগতভাবে ধর্মপ্রাণ মুসলিম ছিলেন তিনি, প্রার্থনা করতেন, ইসলামি আচার পালন করতেন ও ইসলামি বিধিবিধান মেনে জীবন যাপন করতেন।৫৭ মোল্লা সদ্রার অতীন্দ্রিয়াবাদের চর্চা করতেন, তাঁর বিবর্তনমূলক পরিবর্তনের দৃষ্টিভঙ্গি তাঁকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করেছিল। তিনি শিষ্যদের ফালসাফাহর নিগূঢ় লোকবিদ্যার শিক্ষা দিতেন ও প্রায়শঃই মধ্যযুগের দার্শনিকের মতো যুক্তিতর্ক করতেন। অন্যান্য ধর্মীয় চিন্তাবিদের মতো নিজের বিশ্বাসকে যৌক্তিক ও বৈজ্ঞানিক প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন। তিনি যুক্তি তুলে ধরেছিলেন যে, কোরান মুসলিমদের অন্ধবিশ্বাসে কোনও কিছু মেনে না নেওয়ার শিক্ষা দিয়েছে, প্রমাণ দাবি করার নির্দেশ দিয়েছে; সুতরাং, সমীহজনকভাবে তা আধুনিক বিশ্বের সাথে মানানসই। প্রকৃতপক্ষেই, আফগানি এপর্যন্তও বলেছিলেন যে, ইসলাম আধুনিক বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদেরই অনুরূপ, পয়গম্বর যে আইন গ্রহণ করেছিলেন সেটা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানের মতোই ও ইসলামের সব মতবাদকেই যুক্তি ও প্রাকৃতিক প্রদর্শনী দিয়ে প্রমাণ করা সম্ভব।৫৮ একেবারেই ভুল ছিল এটা। যেকোনও প্রথাগত ধর্মের মতো লোগোসের সীমার বাইরে গিয়ে পয়গম্বরিয় ও অতীন্দ্রিয় অন্তর্দৃষ্টির উপর নির্ভর করেছে ইসলাম, এবং প্রকৃতপক্ষে আফগানি স্বয়ং এভাবেই ধর্মকে প্রত্যক্ষ করেছেন। ভিন্ন মানসিক অবস্থায় তিনি একই রকম স্বচ্ছন্দে বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতা তুলে ধরতে পারতেন, যা ‘যত সুন্দরই হোক না কেন…মানবজাতিকে সম্পূর্ণ সন্তুষ্ট করতে পারেনি, মানুষ আদর্শের জন্যে পিপাসার্ত থাকে, যা অন্ধকারে ও দূরে অবস্থান করে ও দার্শনিক ও পণ্ডিতগণ একে না ধারণা করতে পারেন না অনুসন্ধান করতে পারেন।৫৯ ইরানি বুদ্ধিজীবীদের মতো আফগানির তখনও এক পা ছিল প্রাচীন বিশ্বে, আবার একই সময়ে তিনি নতুন বিশ্বের আকাঙ্ক্ষা করেছেন। নিজের বিশ্বাসকে সম্পূর্ণ যৌক্তিক দেখতে চেয়েছেন তিনি, কিন্তু রক্ষণশীল কালের যেকোনও অতীন্দ্রিয়বাদীর মতোই জানতেন, তাঁর ধর্মের মিথোস মানবজাতিকে এমন এক অন্তর্দৃষ্টি দিয়েছে বিজ্ঞান যা পারেনি।
এই সামঞ্জস্যহীনতা সম্ভবত অনিবার্য ছিল, কারণ আফগানি ছিলেন ক্রান্তি কালের মানুষ। তবে তাঁর উদ্বেগ থেকেও এর উদ্ভব হয়েছিল। সময় দ্রুত ফুরিয়ে যাচ্ছিল, আফগানি নিজের ভাবনার সমস্ত স্ববিরোধিতা মুছে ফেলতে পারছিলেন না। মুসলিমদের অবশ্যই নিজেদের আরও যৌক্তিক করে তুলতে হবে। এটাই তাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার হতে হবে। তারা প্রাকৃতিক বিজ্ঞানকে অবহেলা করে আসার ফলে ইউরোপের পেছনে পড়ে গেছে। তাদের ‘ইজতিহাদের দরজা’ বন্ধ করে দিতে বলা হয়েছিল, বলা হয়েছিল অতীতের উলেমা ও সাধুদের সিদ্ধান্ত মেনে নিতে। আফগানি জোরের সাথে বলেছেন, এর সাথে প্রকৃত ইসলামের কোনও সম্পর্ক নেই। এটা এক ধরনের দাসত্বকে উৎসাহিত করে যা কেবল আধুনিক চেতনা বিরোধীই নয়, বরং মুসলিম বিশ্বাসের ‘অত্যাবশ্যক বৈশিষ্ট্য’ ‘প্রাধান্য ও শ্রেষ্ঠত্ব’-কে অগ্রাহ্য করে। এখন যেমন দাঁড়িয়েছে, পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের ‘কর্তৃত্ব’ পেয়েছে, মুসলিমরা দুর্বল ও নাজুক হয়ে পড়েছে।৬১ আফগানি বুঝতে পারছিলেন ইজতিহাদের দ্বার রুদ্ধ করার ভেতর দিয়ে প্রতীকায়িত প্রাচীন রক্ষণশীল রীতিনীতি মুসলিমদের পিছু টেনে রেখেছে। কিন্তু ধর্মের মিথোসকে লোগোসের মতো উপস্থাপিত করার প্রয়াসী যেকোনও সংস্কারকের মতো তিনি একদিকে যেমন অপর্যাপ্ত ধর্মীয় ডিসকোর্সের সৃষ্টির ঝুঁকি নিয়েছিলেন তেমনি অন্য দিকে ভ্রান্ত বিজ্ঞানের।
তাঁর অ্যাক্টিভিজম সম্পর্কেও একই কথা বলা যেতে পারে। আফগানি সঠিকভাবেই তুলে ধরেছিলেন ইসলাম কর্মের মাধ্যমে নিজেকে তুলে ধরা একটি ধর্ম। কোরানের ‘আল্লাহ অবশ্যই কোনও সম্প্রদায়ের অবস্থার পরিবর্তন করেন না যতক্ষণ না তারা নিজেদের অবস্থা নিজেরা পরিবর্তন করে’৬২ এই পঙক্তিটি উদ্ধৃত করতে ভালোবাসতেন তিনি। মাদ্রাসায় আশ্রয় নেওয়ার বদলে ইসলামকে রক্ষা করতে হলে মুসলিমদের রাজনীতির বিশ্বে সংশ্লিষ্ট হতে হবে। আধুনিক বিশ্বে সত্যি বাস্তবভিত্তিক; একে অবশ্যই ভৌত ও অভিজ্ঞতার বলয়ে তৎপরতা দেখাতে হবে। আফগানি প্রমাণ করতে চেয়েছিলেন, ইসলামের সত্যি তাঁর কালের বিশ্বে ঠিক পাশ্চাত্য আদর্শের মতোই কার্যকর। ইউরোপ অচিরেই দুনিয়া শাসন করতে যাচ্ছে উপলাব্ধি করে তাঁর কালের মুসলিম শাসকদের বিপদ সম্পর্কে সজাগ করে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। কিন্তু আফগানির বিপ্লবী প্রকল্পগুলো ছিল প্রায়শঃই স্বয়ং-ধ্বংসী ও নৈতিকভাবে সন্দেহপূর্ণ। কোনওটাই কোনও ফল বয়ে আনেনি। স্রেফ তাঁর তৎপরতার আনুষ্ঠানিক সীমাবদ্ধতা ডেকে এনেছে মাত্র। ১৮৭৯ সালে সরকার বিরোধী কর্মকাণ্ডের দায়ে মিশর থেকে ও ১৮৯১ সালে ইরান থেকে বহিষ্কার করা হয় তাঁকে, এবং পরে ইস্তাম্বুলে বাস করার অনুমতি দেওয়া হলেও অটোমান কর্তৃপক্ষের নিবিড় নজরদারিতে রাখা হয়। ধর্মীয় সত্যকে রাজনৈতিক কর্মসূচিতে রূপান্তরিত করার তাঁর প্রয়াস নিশ্চিহ্নতা ও বিপর্যয়ের ঝুঁকিপূর্ণ, আফগানি নিজেকে তাঁর ভ্রান্তিপূর্ণ বিপ্লবী কর্মতৎপরতার লক্ষ্যে ইসলামকে ‘ব্যবহার’ করার অভিযোগের শিকারে পরিণত করেছিলেন।৬৩ তিনি স্পষ্টতই ধর্মীয় ঔচিত্যবোধকে তাঁর রাজনীতির সাথে যথেষ্ট গভীরতায় সমন্বিত করতে পারেননি। ১৮৯৬ সালে তাঁর এক শিষ্য তাঁরই তাগিদে নাসির আদ-দিন শাহকে হত্যা করে, সকল ধর্মের অন্যতম মূলনীতি লঙ্ঘন করেছিলেন আফগানি: মানুষের জীবনের পরম মূল্যের প্রতি সম্মান। ইসলামকে তিনি কেবল অদক্ষ ও অদ্ভুতই করে তোলেননি, সেই সাথে অনৈতিকও।
তাঁর ভাবনার স্পষ্ট ঘাটতির সৃষ্টি হয়েছিল হতাশা থেকে। আফগানি বিশ্বাস করেছিলেন যে, সাম্রাজ্যবাদী পাশ্চাত্যের কাছে ইসলামি বিশ্ব নিশ্চিহ্ন হতে চলেছে। ১৮৮০-র দশকে প্যারিসে বাস করার সময় তিনি ভাষাবিজ্ঞানী আর্নস্ট রেনানের (১৮২৩-৯২) রচনায় বৈজ্ঞানিক বর্ণবাদের দেখা পান; তাঁরা আধুনিক বিশ্বে ইসলামের অবস্থান নিয়ে বিতর্ক করেছিলেন। রেনানের বিশ্বাস ছিল সেমেটিক ভাষা হিব্রু ও আরবী দূষিত, এগুলো রুদ্ধ বিকাশের নজীর। এগুলোর ‘আর্য’ভাষা ব্যবস্থার মতো সহজাত বিকাশের গ্রহণের ঘাটতি রয়েছে, নিজেদের নতুন করে সৃষ্টি করতে পারেনি। একইভাবে সেমিটিক জাতিগুলো কোনও রকম শিল্পকলা, ব্যবসা বা সভ্যতার জন্ম দিতে পারেনি। বিশেষ করে ইসলাম আধুনিকতার সাথে পাল্লা দিতে অক্ষম, মুসলিম দেশগুলোর স্পষ্ট হীনতা, তাদের সরকারের অযোগ্যতা এবং খোদ মুসলিমদের ‘বুদ্ধিবৃত্তিক শূন্য’তা থেকে যার প্রমাণ মেলে। আফ্রিকার মানুষের মতো ইসলামি বিশ্বের জনগণ মানসিকভাবে বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদ উপলব্ধি করতে অক্ষম, একটা মৌলিক ধারণাও গঠন করার যোগ্যতা রাখে না। ইউরোপিয় বিজ্ঞানের অগ্রগতির সাথে সাথে, আস্থার সাথে ভবিষ্যদ্বাণী করেছেন রেনান, ইসলাম হারিয়ে যাবে এবং অদূর ভবিষ্যতে এর অস্তিত্বই থাকবে না। এখানে বিস্ময়ের কিছু নেই যে আফগানি ইসলামের টিকে থাকা নিয়ে ভীত ছিলেন, নইলে ইসলামের বৈজ্ঞানিক যুক্তিবাদকে এমন বাড়তি গুরুত্ব দিতে যেতেন না। সত্যিকারের হুমকীর প্রতি সাড়া হিসাবে মুসলিম চিন্তাভাবনায় এক নতুন আত্মরক্ষামূলক চেতনা অনুপ্রবেশ করেছিল। রেনানের মতো চিন্তকদের রচনায় ইসলামের স্টেরিওটিপিক্যাল ও অযথার্থ দৃষ্টিভঙ্গি ইসলামি দেশগুলোয় ঔপনিবেশিক আগ্রাসনকে ন্যায্য প্রতিপন্ন করবে।
ইউরোপের বৃদ্ধিশীল পুঁজিবাদী অর্থনীতির প্রয়োজন থেকেই উপনিবেশবাদের সৃষ্টি। হেগেল যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে, একটি শিল্পায়িত সমাজ ‘এর বাইরের অন্য জাতির মাঝে…ভোক্তার সন্ধান করতে ও এর মাধ্যমে টিকে থাকার প্রয়োজনীয় উপাদান সংগ্রহ করার’ জন্যে প্রসারিত হতে বাধ্য। নতুন বাজারের অনুসন্ধান ‘উপনিবেশের জন্যে জমিরও ব্যবস্থা করবে যেখানে সম্পূর্ণ বিকশিত বুর্জোয়াগোষ্ঠীকে ঠেলে দেওয়া হবে।’ শতাব্দীর শেষের দিকে মধ্যপ্রাচ্যের উপনিবেশিকরণ বেশ ভালোভাবেই এগিয়ে চলছিল। ১৮৩০ সালে ফ্রান্স আলজেরিয়া দখল করে নিয়েছিল, নয় বছর পরে আদেন দখল করে ব্রিটেন। ১৮৮১ সালে অধিকৃত হয় তিউনিসিয়া, ১৮৮৯ সালে সুদান এবং লিবিয়া ও মরোক্কো ১৯১২ সালে। ১৯১৫ সালে সাইক্স-পিকো চুক্তি প্রথম বিশ্বযুদ্ধে বিজয়ের প্রত্যাশায় মুমূর্ষু অটোমান সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অঞ্চলকে ফ্রান্স ও ইংল্যান্ডের ভেতর বিলি করে দেয়। এই ঔপনিবেশিক অনুপ্রবেশ ছিল প্রবল ধাক্কার মতো, কার্যত এর মানে ছিল ওই সব দেশের প্রথাগত জীবনযাত্রার অবসান, অবিলম্বে গৌণ পর্যায়ে পর্যবসিত হয়েছিল সেগুলো।
উপেনিবেশকৃত দেশ রপ্তানির জন্যে পণ্যের সরবরাহ করেছে, ইউরোপিয় শিল্পায়নের প্রক্রিয়ার পরে সেগুলোকে ব্যবহার করা হয়েছে। এর বিনিময়ে তা সস্তা পাশ্চাত্য উৎপাদিত পণ্য লাভ করেছে, যার মানে ছিল স্থানীয় বাজারের মার খেয়ে যাওয়া। নতুন উপনিবেশগুলোর আধুনিক প্রযুক্তিকৃত সমাজের সাথে খাপ খাওয়া নিশ্চিত করার জন্যে পুলিস ও সামরিক বাহিনীকে ইউরোপিয় ধারায় নতুন করে সংগঠিত করার প্রয়োজন ছিল; আর্থিক, বাণিজ্যিক ও অর্থনীতির উৎপাদনশীল দিকেরও অভিযোজনের প্রয়োজন হয়েছে, ‘আনাড়ী’দের আধুনিক ধ্যানধারণার সাথে কিছুটা পরিচিত হতে হয়েছে। প্রজা জনসাধারণের কাছে এই আধুনিকতাকে অনুপ্রবেশকারী, নির্যাতনমূলক ও গভীরভাবে অস্থিতিশীল মনে হয়েছে। আফগানি চেয়েছিলেন মুসলিমরা যাতে নিজে থেকেই আধুনিক হয়ে দেশের ইউরোপের এমনি দুর্বল অনুরূপ হওয়ার হাত থেকে বাঁচতে পারে। ঔপনিবেশবাদ একে অসম্ভব করে তুলেছিল। পাশ্চাত্য আধিপত্যের অধীনে আগত দেশগুলো আর নিজেদের মতো উন্নত হতে পারছিল না। একটি জীবন্ত সভ্যতাকে উপনিবেশবাদীরা নির্ভরশীল ব্লকে রূপান্তরিত করেছিল, স্বায়ত্তশাসনের এই ঘাটতি গভীরভাবে আধুনিক চেতনার বিরোধী দাসত্বের প্রবণতা ও অভ্যাস সৃষ্টি করেছিল। অনিবার্যভাবে তাহতাওয়ি ও অন্যান্য সংস্কারকদের মূর্ত করে তোলা ইউরোপের প্রতি আগের ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা তিক্ত হয়ে উঠেছিল ও অসন্তোষের সৃষ্টি করেছিল।
কায়রোয় আফগানির অবস্থানের সময় মিশর ক্রমে উপনিবেশের জালের দিকে এগিয়ে চলছিল, যদিও কখনওই তা সম্পূর্ণ উপনিবেশে পরিণত হয়নি। খেদিভ ইসমাইলের ব্যয়বহুল সংস্কার ও আধুনিকায়নের প্রকল্পসমূহ দেশকে দেউলিয়া করে দিয়েছিল, ইউরোপিয় ঋণের উপর পুরোপুরি নির্ভরশীল হয়ে পড়েছিল তা। ১৮৭৫ সালে খেদিভ ব্রিটিশের কাছে স্যুয়েয খাল বিক্রি করতে বাধ্য হন, এবং ১৯৭৬ সালে, আমরা যেমন দেখেছি, ইউরোপিয় শেয়ারহোল্ডাররা মিশরের অর্থনীতির নিয়ন্ত্রণ হাতে তুলে নিয়েছিল। ইসমাইল নিজেকে মুক্ত করার প্রয়াস পেলে অটোমান সুলতানের সাথে যোগসাজশে ব্রিটিশ তাঁকে উৎখাত করে। খেদিভাত তাঁর ছেলে তেওফিকের হাতে বর্তায়। ১৮৮১ সালে মিশরিয় সামরিক বাহিনীর কিছু অফিসার আহমাদ বে উরুবির নেতৃত্বে এক অভ্যুত্থান সংগঠিত করেন। আফগানির কিছু অনুসারী ও মিশরে আধুনিক সাংবিধানিক শাসনের আকাঙ্ক্ষী কিছু লোক যোগ দেয় তাঁদের সাথে। উরুবি নতুন খেদিভের উপর নিজের সরকারকে কায়েম করতে সক্ষম হন, এই বিজয়ের পর এক গণঅভ্যুত্থান ঘটে; বিট্রিশ সরকার শেয়ারহোল্ডারদের স্বার্থ রক্ষায় হস্তক্ষেপের সিদ্ধান্ত নেয়। ১১ই জুলাই, ১৮৮২, ব্রিটিশ নৌবাহিনী আলেকজান্দ্রিয়ায় আক্রমণ চালায় ও ১৩ই সেপ্টেম্বরে তেল এল- কেবিরে উরুবিকে পরাস্ত করে। এরপর ব্রিটিশ মিশরে তাদের নিজস্ব সামরিক দখল প্রতিষ্ঠিত করে, যদিও খেদিভ তেওফিক সরকারীভাবে পুনর্বহাল হয়েছিলেন। এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে, মিশরের আসল শাসক হচ্ছেন ব্রিটিশ প্রোকনসাল, ইভেলিন ব্যারিং, লর্ড ক্রোমার।
লর্ড ক্রোমার ছিলেন টিপিক্যাল ঔপনিবেশিক। তাঁর চোখে মিশরিয়রা ছিল সহজাতভাবে পশ্চাদপদ জাতি, তাদের নিজেদের ভালোর জন্যেই উপনিবিশের অধীনে আনতে হয়েছে। রেনানের মতো আপন জাতির সাথে মুসলিমদের তুলনা করতে গিয়ে ধরে নিয়েছিলেন ইউরোপ বরাবরই প্রগতির সম্মুখ কাতারে ছিল। তিনি বুঝতে পারেননি, ব্রিটেন ও ফ্রান্সের মতো ইউরোপিয় দেশগুলো এককালে মধ্যপ্রাচ্যের মতোই ‘পশ্চাদপদ’ ছিল, তিনি স্রেফ একটি অসম্পূর্ণভাবে আধুনিকায়িত দেশের দিকে চোখ ফেরাচ্ছেন। খোদ ‘অরিয়েন্টাল’দের সহজাতভাবে, উত্তারিকারসূত্রে ভ্রান্তিময় মনে করেছেন। মিশরে ক্রোমারের সাফল্য ছিল উল্লেখ করার মতো। অর্থনীতিকে স্থিতিশীল করে তুলেছিলেন তিনি, দেশের সেঁচ ব্যবস্থাকে উন্নত করেছেন ও তুলার উৎপাদন বৃদ্ধি করেছেন। তিনি বাধ্যতামূলক শ্রমের প্রাচীন ব্যবস্থা কোভেই বাতিল ও একটি উপযুক্ত বিচার ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তবে এই প্রগতির জন্যে মূল্য দিতে হয়েছে। খেদিভ নামমাত্র দেশের দায়িত্বে থাকলেও প্রত্যেক মন্ত্রণালয়ে একজন করে ইংরেজ ‘উপদেষ্টা’ ছিলেন, সবক্ষেত্রে তাঁর মতই চলত। এর প্রয়োজন রয়েছে মনে করেছেন ক্রোমার। তিনি ধরে নিয়েছিলেন, ইউরোপিয়রা সব সময়ই যৌক্তিক, দক্ষ ও আধুনিক ছিল, অন্যদিকে অরিয়েন্টালরা প্রকৃতিগতভাবেই যুক্তিহীন, অবিশ্বস্ত ও দুর্নীতিগ্রস্ত।৬৭ একইভাবে ইসলাম ‘সামাজিক ব্যবস্থা হিসাবে সম্পূর্ণ ব্যর্থ,’ এবং সংস্কার বা উন্নয়নে অক্ষম। ‘সত্যিই মারা যায়নি এমন একটা দেহকে’ নতুন করে বাঁচানো আসলেই অসম্ভব, শত শত বছর ধরে এভাবেই চলতে পারে তা, কিন্তু তারপরেও তা রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে মুমূর্ষু, আধুনিক নিরাময় দিয়ে তা ঠেকানো যাবে না।৮ তিনি স্পষ্ট করে দিয়েছিলেন, এই মারাত্মক রুদ্ধ দেশটির কিছুদিনের জন্যে ব্রিটিশ সমর্থনের প্রয়োজন হবে।
ব্রিটিশ দখলদারি মিশরের সমাজে নতুন বিভাজন সৃষ্টি করেছিল। উলেমাগণ শিক্ষক ও জ্ঞানের প্রধান অভিভাবকের আসন হারিয়েছিলেন, পাশ্চাত্য শিক্ষায় শিক্ষিতরা তাঁদের স্থান দখল করেছিলেন। শরীয়া আদালতগুলো লর্ড ক্রোমার প্রতিষ্ঠিত ইউরোপিয় সিভিল কোর্টের কারণে প্রতিস্থাপিত হয়। কারুশিল্পী ও ক্ষুদ্র ব্যবাসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল। পাশ্চাত্যকৃত সিভিল সার্ভেন্ট ও বুদ্ধিজীবীরা এক নতুন অভিজাত গোষ্ঠীর সৃষ্টি করেছিল, বিশাল জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন ছিলেন তাঁরা। কিন্তু সম্ভবত খোদ মিশরিয়দেরই তাদের সম্পর্কে উপনিবেশবাদীদের নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গিকে আত্মস্থ করে নেওয়া সবচেয়ে ক্ষতিকর ছিল। এভাবে আফগানির এক শিষ্য মুহাম্মদ আব্দুহ (১৮৪৯-১৯০৫) ব্রিটিশ দখলদারিতে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছিলেন। আধুনিক কালকে তিনি ‘বিজ্ঞানের প্রবলধারা’ হিসাবে বর্ণনা করেছিলেন, ধর্মের প্রথাগত মানুষদের ডুবিয়ে দিচ্ছে:
এ এমন এক কাল যা আমাদের সাথে সভ্য জাতিসমূহের সম্পর্ক স্থাপন করে তাদের অসাধারণ অবস্থা সম্পর্কে সজাগ করে তুলছে…সেই সাথে আমাদের মাঝারি দশা: এভাবে ওদের সম্পদ আর আমাদের দারিদ্র্য, ওদের গর্ব আর আমাদের অবনতি, ওদের শক্তি আর আমাদের দুর্বলতা, ওদের বিজয় আর আমাদের পরাজয়। ৬৯
এমনি ক্ষয়কারী হীনম্মন্যতা উপনিবেশবাসীদের ধর্মীয় জীবনে অনুপ্রবেশ করে আব্দুহর মতো সংস্কারকদের ঔপনিবশকারীদের অভিযোগের জবাব দিতে ও ইসলাম পাশ্চাত্যের মতোই ন্যায্য ও যৌক্তিক প্রমাণে বাধ্য করেছে। প্রথমবারের মতো মুসলিমরা বিজয়ীদের তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক এজেন্ডা স্থির করে দিতে বাধ্য হয়েছিল।
উরুবি বিদ্রোহে জড়িত ছিলেন আব্দুহ, ব্রিটিশ বিজয়ের পর তাঁকে বহিষ্কার করা হয়েছিল। প্যারিসে আফগানির সাথে মিলিত হন তিনি। দুজনের ভেতর অনেক বিষয়েই মিল ছিল। আফগানির অতীন্দ্রিয়াবাদী (ইরফান) ধর্মের প্রতি ভালোবাসার কারণে প্রথম দিকে তিনি তাঁর গোষ্ঠীর প্রতি আকৃষ্ট হন যাকে তিনি ‘সুখের চাবিকাঠি’৭১ বলতে পছন্দ করতেন। কিন্তু আফগানি আব্দুহকে পাশ্চাত্য বিজ্ঞানের সাথেও পরিচিত করিয়ে দেন, পরে আব্দুহ গিযো, তলস্তয়, রেনান, স্ত্রাউস এবং হার্বার্ট স্পেন্সারের পড়েন। ইউরোপে বেশ ভালোই স্বস্তি বোধ করতেন আব্দুহ, ইউরোপিয়দের সঙ্গ তাঁর ভালো লাগত। আফগানির মতো তিনিও বিশ্বাস করতেন ইসলাম আধুনিকতার সাথে মানানসই, তিনি যুক্তি দেখিয়েছেন যে এটা বিশেষভাবে যৌক্তিক ধর্মবিশ্বাস, এবং তাকলিদের অভ্যাস আসলে দুর্নীতিগ্রস্ত ও ভ্রান্তপূর্ণ। তবে আফগানির মতোই অতীন্দ্রিয় প্রেক্ষাপটে যৌক্তিক চিন্তাভাবনার প্রতি অঙ্গীকারাবদ্ধ ছিলেন আব্দুহ। তখনও প্রাচীন বিশ্বের আধ্যাত্মিকতা থেকে মুক্ত হতে পারেনি তা। শেষ পর্যন্ত আব্দুহ রাজনীতি নিয়ে আফগানির সাথে কলহে লিপ্ত হন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে, মিশরের বিপ্লবের চেয়ে বরং সংস্কারই বেশি প্রয়োজন। গুরুর তুলনায় গভীর চিন্তাবিদ ছিলেন তিনি, বুঝতে পেরেছিলেন আধুনিকায়ন ও স্বাধীনতার সংক্ষিপ্ত কোনও পথ নেই। আফগানির সাথে বিপজ্জনক অর্থহীন প্রকল্পে যোগ দেওয়ার পরিবর্তে শিক্ষার মাধ্যমে মিশরের কিছু বড় বড় সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিলেন। ১৮৮৮ সালে তাঁকে দেশে ফিরে আসতে দেওয়া হয়। দেশের অন্যতম জনপ্রিয় ব্যক্তিত্বে পরিণত হন তিনি, মিশরিয় ও ব্রিটিশদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় থাকে, লর্ড ক্রোমার ও খেদিভের ব্যক্তিগত বন্ধুতে পরিণত হন।
ইতিমধ্যে দেশে বেশ লক্ষণীয় হতাশা সৃষ্টি হয়েছিল। প্রথমে বহু শিক্ষিত মিশরিয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিল যে, ব্রিটিশ দখলদারি অবাঞ্ছিত হলেও লর্ড ক্রোমার দেশকে খেদিভ ইসমাইলের চেয়ে ঢের ভালো চালিয়েছেন। কিন্তু ১৮৯০-র দশক নাগাদ ব্রিটিশের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটে। ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের প্রায়শঃই আগের চেয়ে কম মেধাবী হতে দেখা গেছে, মিশরিয়দের সাথে সম্পর্ক উন্নত করার বেলায় তাদের তেমন একটা প্রয়াস ছিল না। গেযিরা অঞ্চলে নিজস্ব অভিজাত মহল্লা গড়ে তুলেছিল তারা। মিশরিয় সরকারী কর্মকর্তারা আবিষ্কার করেন যে, তরুণ বিট্রনদের কারণে তাদের পদোন্নতি আটকা পড়ে যাচ্ছে, ক্যাপিটুলেশন কর্তৃক ব্রিটিশ ও অন্য বিদেশীদের দেওয়া বাড়তি সুবিধার কারণে অসন্তোষ দেখা দিয়েছিল, এইসব সুবিধা দেশের আইন-কানুন থেকে রেহাই দিয়েছিল তাদের। ক্রমেই বেশি সংখ্যক মানুষ জাতীয়তাবাদী মুস্তাফা কামালের (১৮৭৪-১৯০৮) জ্বালাময়ী ভাষণ শুনতে আগ্রহী হয়ে উঠছিল। ব্রিটিশদের অবিলম্বে প্রত্যাহারের আহ্বান জানিয়েছিলেন তিনি। আব্দুহ কামালকে শূন্যগর্ভ বক্তৃতাবাজ মনে করতেন। তিনি বুঝতে পারছিলেন যে, একটি স্বাধীন আধুনিক রাষ্ট্র পরিচালনা করার আগে মিশরিয়দের দখলদারির কারণে বহুগুণে বেড়ে ওঠা কিছু মারাত্মক সামাজিক সমস্যার মোকাবিলা করতে হবে।
আব্দুহ’র দৃষ্টিতে এক গভীরভাবে ধার্মিক দেশে সেক্যুলারিস্ট ধারণা ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান অনেক দ্রুত সূচিত হচ্ছিল। ইউরোপের রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানসমূহকে বেশ শ্রদ্ধা করতেন আব্দুহ। তবে সেগুলোকে মিশরে রোপন করা যাবে বলে মনে করেননি। বিপুল জনসংখ্যা নতুন আইনি ব্যবস্থার কিছুই বুঝতে পারেনি; এর চেতনা ও আওতা স্রেফ অজানা ছিল ওদের কাছে। এর ফলে মিশর কার্যত আইন বিহীন দেশে পরিণত হচ্ছিল।৭৩ তো আধুনিক পরিস্থিতির সাথে খাপ খাওয়াতে ইসলামি আইনের ব্যাপক পর্যালোচনার পরিকল্পনা করেন তিনি। তাঁর পরলোকগমনের পর ১৯২০-র দশকে এই কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছিল। আজও তা মিশরে চালু রয়েছে। আব্দুহ বুঝতে পেরেছিলেন, মিশরের সমাজ ভেঙে পড়ছে; তাই প্রথাগত ইসলামি রীতিনীতির আধুনিক আইনি ও সাংবিধানিক বিকাশ সংযুক্ত করার প্রয়োজন ছিল; নইলে পাশ্চাত্য ধ্যান-ধারণার প্রতি যথেষ্ট উন্মুক্ত মিশরের বিশাল সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ নতুন প্রতিষ্ঠানসমূহের কোনও অর্থই করতে পারবে না। উদাহরণ স্বরূপ, শুরাহর (‘পরামর্শ’) নীতিমালাকে গণতন্ত্রের সাথে মানানসই হিসাবে দেখা যেতে পারে; এবং ইজমাহ (সম্প্রদায়ের ‘ঐকমত্য’, ইসলামি আইনের অধীনে কোনও মুসলিম মতবাদ বা রেওয়াজকে যা স্বীকৃতি দেয়) এখন জনগণকে সাংবিধানিক নিয়মকানুন বুঝতে সাহায্য করতে পারে, এভাবে জনমত শাসকের ক্ষমতাকে সীমিত করতে পারবে।৭৪
শিক্ষাক্ষেত্রে জরুরি সংস্কারের প্রয়োজন ছিল। বর্তমানে, উল্লেখ করেছেন আব্দুহ, সম্পূর্ণ ভিন্ন লক্ষ্যে পরিচালিত তিনটি সম্পূর্ণ ভিন্ন ভিন্ন শিক্ষা ব্যবস্থা চালু রয়েছে; সমাজে তা অনতিক্রম্য বৈষম্য সৃষ্টি করছিল। এখনও রক্ষণশীল রীতিনীতিতে পরিচালিত ধর্মীয় স্কুল ও মাদ্রাসায় তরুণ মুসলিমরা স্বাধীন চিন্তাভাবনা থেকে নিরুৎসাহিত হচ্ছে; ঔপনিবেশিক উদ্যোগের সমর্থক ক্রিশ্চান মিশনারি স্কুলগুলোতে তরুণ মুসলিমরা দেশ ও ধর্ম থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছে। সরকারী স্কুলগুলোর অবস্থা সবচেয়ে খারাপ: এগুলো ইউরোপিয় স্কুলের অক্ষম অনুকরণ, এখানে কোনও ধর্মীয় শিক্ষা দেওয়া হয় না। উলেমাদের কাছে শিক্ষাপ্রাপ্তরা সব ধরনের পরিবর্তনের পথে বাদ সাধছিল, অন্যদিকে পাশ্চাত্য শিক্ষিত তরুণরা যেকোনও পরিবর্তনই গ্রহণ করছিল, পাশ্চাত্য সংস্কৃতির সাাথে ভাসা ভাসা পরিচিত ছিল তারা, আবার নিজ সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ছিল।৭৫
১৮৯৯ সালে মিশরের মুফতি পরিণত হন আব্দুহ, ইসলামি আইনের ক্ষেত্রে দেশের প্রধান পরামর্শক। প্রথাগত ধর্মীয় শিক্ষার সংস্কারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ ছিলেন তিনি। তাঁর বিশ্বাস ছিল, মাদ্রাসার ছাত্রদের আধুনিক সমাজের অংশ হয়ে ওঠার জন্যে বিজ্ঞান পড়তে হবে। এই সময় আব্দুহর দৃষ্টিতে আযহার ছিল ইসলামের যত ভ্রান্তির জ্বলন্ত নজীর: আধুনিক বিশ্বের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়ে আত্মরক্ষামূলক কালপ্রমাদে পরিণত হয়েছে। কিন্তু উলেমারা আব্দুহ’র সংস্কার প্রয়াসে বাধা দেন। মুহাম্মদ আলির আমল থেকেই আধুনিকতাকে রাজনীতি, আইন-কানুন, শিক্ষা ও অর্থনীতিতে ঈশ্বরের প্রভাব হ্রাসকারী বিধ্বংসী আক্রমণ হিসাবে দেখে এসেছিলেন তাঁরা। তাঁদের জোর করে আধুনিক বিশ্বে ঠেলে দেওয়ার যোকানও প্রয়াসই তাঁরা প্রতিহত করবেন। ইরানি উলেমাদের বিপরীতে তাঁরা মাদ্রাসার বাইরের জীবনে মারাত্মকভাবে অস্বস্তি বোধ করতেন। এদের বেলায় আব্দুহ তেমন একটা সাফল্য লাভ করতে পারেননি। আযহারের প্রশাসনকে আধুনিকায়িত করতে পেরেছিলেন তিনি, শিক্ষকদের বেতন ও কাজের পরিবেশও উন্নত করেছিলেন। কিন্তু উলেমা ও ছাত্ররা একইভাবে পাঠ্যক্রমে আধুনিক সেক্যুলার বিষয়বস্তুর অন্তর্ভুক্তির যেকোনও প্রয়াসের বিরোধিতা করেছেন।৭৬ এমনি বিরোধিতার মুখে হতাশ হয়ে পড়েন আব্দুহ। ১৯০৫ সালে মুফতি পদে ইস্তফা দেন এবং এর অল্পদিন পরেই মারা যান।
আফগানি ও আব্দুহর সংগ্রাম দেখায় রক্ষণশীল কালে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠা কোনও ধর্মবিশ্বাসকে আধুনিক বিশ্বের ভিন্ন রীতির সাথে খাপ খাওয়ানো কতটা কঠিন ছিল। তাঁরা উভয়েই দ্রুত সেক্যুলারাইজেশনের বিপদ সম্পর্কে সজাগ ছিলেন-এবং সঠিকভাবেই। স্থানচ্যুতকারী পরিবর্তনের একটা কালে ইসলাম খুবই কাঙ্ক্ষিত ধারাবাহিকতার যোগান দেবে। মিশরিয়রা পরস্পরের কাছে আগন্তুক হয়ে উঠছিল, পাশ্চাত্যকৃতরা প্রায়শঃই তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন ছিল। প্ৰাচ্য বা পাশ্চাত্য, কোথাওই তারা স্বস্তি পাচ্ছিল না এবং এককালে জীবনকে অর্থদানকারী পৌরাণিক ও প্রার্থনার অনুশীলন বিহীন আধুনিক অভিজ্ঞতার মূলে অবস্থিত এক শূন্যতার দিকে নেমে যাচ্ছিল তারা। প্রাচীন প্রতিষ্ঠানগুলো ধ্বংস করে ফেলা হচ্ছিল, কিন্তু নতুনগুলো ছিল অচেনা, ঠিকভাবে তাদের উপলব্ধি করা যাচ্ছিল না। ব্যক্তিগতভাবে আফগানি ও আব্দুহ তখনও প্রাচীন আধ্যাত্মিকতায় পুষ্ট হচ্ছিলেন। ধর্মকে অবশ্যই যৌক্তিক হতে হবে বলে জোর দেওয়ার সময় ধর্মীয়ভাবে অর্জিত সমস্ত সত্যিকে পরিত্যাগকারী ইউরোপিয় যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানীদের চেয়ে বরং মোল্লাহ সদ্রার অনেক কাছাকাছি ছিলেন তাঁরা। যুক্তিই সব সত্যির ফয়সালাকারী ও সকল মতবাদকে যৌক্তিক প্রমাণের অধীন হওয়ার উপযুক্ত হতে হবে বলার সময় অনুশীলনকারী অতীন্দ্রিয়বাদীর মতোই কথা বলেছেন তাঁরা। কিন্তু পাশ্চাত্য যুক্তিবাদের চেতনায় আরও গভীরভাবে মগ্ন পরের প্রজন্মগুলো আবিষ্কার করবে যে কেবল যুক্তিই এক ধরনের পবিত্রতার বোধ জাগাতে সক্ষম নয়। দুয়ে অর্থের এই বিনাশকে পাশ্চাত্যের মতো মুক্তি ও স্বাধীনতার সুবিধা দিয়ে ভারসাম্য প্রদান করা হয়নি তার কারণ ক্রমবর্ধমানহারে পাশ্চাত্যই এজেন্ডা স্থির করে দিচ্ছিল-এমনকি ধর্মীয় বিষয়েও।
ব্যাপারটা কতখানি বিভ্রান্তিকর ও ক্ষতিকর হয়ে উঠতে পারে তারই একটা নজীর সৃষ্টি হয়েছিল ১৮৯৯ সালে কাসিম আমিন (১৮৬৫-১৯০৮) তাহরির আল- মারা (‘দ্য লিবারেশন অভ উইমেন’) প্রকাশ করার পর। এখানে যুক্তি দেখানো হয়েছিল যে, নারীদের অধঃপতিত অবস্থা-বিশেষ করে পর্দা প্রথা-মিশরের পশ্চাদপদতার জন্যে দায়ী। পর্দা ‘নারী ও তার উন্নতির পথে বিরাট বাধা, এবং পরিণামে জাতি ও এর অগ্রগতির পথে প্রতিবন্ধক।’৭৭ বইটির কারণে দারুণ শোরগোল পড়ে যায়, সেটা এখানে নতুন কিছু বলার কারণে নয়, বরং মিশরিয় লেখক একটা উপনিবেশবাদী সংস্কারকে আত্মস্থ ও গ্রহণ করায়। বছরে পর বছর মিশরের নারী-পুরুষ নারীদের অবস্থানের মৌলিক পরিবর্তনের জন্যে বিক্ষোভ করে আসছিল। খোদ আব্দুহ যুক্তি দেখিয়েছেন যে, কোরান আল্লাহ’র চোখে নারী- পুরুষকে সমান হিসাবে উপস্থাপন করেছে, তালাক বা বহুগামীতা সংক্রান্ত প্রথাগত বিধি ইসলামের ক্ষেত্রে আবশ্যক নয়: এগুলো পরিবর্তন করা সম্ভব, করতে হবে। ৮ নারীদের অবস্থার উন্নতি হয়েছিল। মুহাম্মদ ইসমাইল স্কুল প্রতিষ্ঠা করে সেখানে মেয়েদের প্রাথমিক চিকিৎসা পদ্ধতি সম্পর্কে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন; ১৮৭৫ সাল নাগাদ প্রায় তিন হাজার মিশরিয় মেয়ে মিশন স্কুলে পড়াশোনা করে ও ১৮৭৩ সালে সরকার মেয়েদের জন্যে প্রথম রাষ্ট্রীয় প্রাথমিক স্কুল ও পরের বছর একটি মাধ্যমিক স্কুল স্থাপন করে। অতিথিরা মন্তব্য করেছেন, মেয়েদের ঘনঘন প্রকাশ্যে দেখা গেছে; কেউ কেউ পর্দা ফেলে দিচ্ছিল: শতাব্দীর শেষ নাগাদ মহিলারা পত্রপত্রিকায় নিবন্ধ প্রকাশ করছিলেন এবং ডাক্তার ও শিক্ষকে পরিণত হচ্ছিলেন। ব্রিটিশদের আবির্ভাবের সময়ই পরিবর্তন সূচিত হয়েছিল, যদিও অনেক পথ বাকি ছিল, তবে যাত্রা শুরু হয়েছিল।
পর্দা প্রথা ইসলামে মৌলিক বা মৌল অনুশীলনের কোনওটাই নয়। কোরান সকল নারীকে মাথা আবৃত করার নির্দেশ দেয়নি, পয়গম্বরের পরলোকগমনের অন্তত তিন প্রজন্ম পার হয়ে যাবার আগে ইসলামি বিশ্বে মেয়েদের আবৃত করে হেরেমে বিচ্ছিন্ন রাখার প্রথাটির আবির্ভাব ঘটেনি; এই সময় মুসলিমরা বাইযান্তি য়ামের ক্রিশ্চান ও পারসিয়ার যরোস্ত্রিয়দের অনুসরণ শুরু করেছিল, যারা নারীদের দীর্ঘদিন ধরে এভাবে রেখে এসেছিল। কিন্তু সব মহিলাই বোরখা পরত না; এটা ছিল মর্যাদার প্রতীক; কৃষক সমাজ নয়, বরং উঁচু সমাজের নারীরা বোরখা পরত। কাসিম আমিনের গ্রন্থ অবশ্য পর্দার প্রান্তিক অনুশীলনকে পুরোপুরি আধুনিকায়ন বিতর্কের প্রাণকেন্দ্রে নিয়ে আসে। তিনি জোরের সাথে বলেন যে, যতক্ষণ না পর্দাপ্রথার অবলুপ্তি ঘটানো হচ্ছে, মুসলিম বিশ্ব অপমানকর অবস্থায় পড়ে থাকবে। অংশত তাহরির আল-মারার কারণে সৃষ্ট শোরগোলের ফলেই পর্দা বহু মুসলিমের কাছে ইসলামি শুদ্ধতার প্রতীকে পরিণত হয়, অথচ বহু পশ্চিমার চোখে পর্দাপ্রথা ছিল ইসলামের দুরারোগ্য নারীবিদ্বেষের ‘প্রমাণ’।
পর্দাকেই ইসলামের সকল ভ্রান্তির মূল কারণ হিসাবে প্রত্যক্ষকারী আমিনই প্রথম ব্যক্তি নন। ব্রিটিশদের আগমন ঘটলে এই রেওয়াজ দেখে ভীতবিহ্বল হয়ে গিয়েছিল তারা, যদিও পাশ্চাত্য পুরুষরা তখনও নারীবাদের প্রতি পরিহাসপ্রবণ ছিল, স্ত্রীরা ঘরের ভেতরেই অবস্থান করুক, এমনটাই চাইত তারা, নারী-শিক্ষা ও নারীর ক্ষমতায়নের বিরোধী ছিল। লর্ড ক্রোমার এই দিক থেকে ছিলেন টিপিক্যাল : নারীর ভোটাধিকারের বিরোধিতা করার জন্যে লন্ডনের মেন’স লীগ গঠন করেছিলেন তিনি, অথচ তিনিই আবার মিশরের উপর রচিত তাঁর বিশাল গ্রন্থে মুসলিম নারীদের অবস্থার জন্যে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন।৭৯ তাদের দমিত অবস্থা ক্ষয়রোগের মতো, একেবারে গোড়াতেই বিধ্বংসী কাজ শুরু করে দিয়েছে, শিশু অবস্থায় মায়েদের নিপীড়ন প্রত্যক্ষ করেছে এবং ইসলামের গোটা ব্যবস্থাকেই কুরে কুরে খেয়েছে। পর্দা প্রথা ‘মারাত্মক প্রতিবন্ধক যা মিশরিয়দের ‘পাশ্চাত্য সভ্যতার সূচনার সাথে সংশ্লিষ্ট চিন্তা ও চরিত্রের বিকাশকে’ আয়ত্ত করার পথ রুদ্ধ করেছে। মিশনারিরাও পর্দা প্রথার বিপর্যয়কর প্রভাবের কথা উল্লেখ করে বিলাপ করেছেন, তাদের ধারণা ছিল এই প্রথা নারীকে জীবন্ত কবর দিয়েছে ও তাকে বন্দি বা দাসীর পর্যায়ে নামিয়ে এনেছে। এ থেকেই বোঝা যায় মিশরের জনগণের কত ব্যাপকভাবে পাশ্চাত্য উপনিবেশবাদের তত্ত্বাবধানের প্রয়োজন। ৮১
আমিন পর্দা প্রথার এই পশ্চিমা পরিহাসসুলভ মূল্যায়ন নির্বিচারে মেনে নিয়েছিলেন। তাহির আল-মারায় নারীবাদী কিছু ছিল না। মিশরিয় নারীদের নোংরা ও অজ্ঞ হিসাবে তুলে ধরেছেন আমিন; এমন মায়েদের নিয়ে মিশর পশ্চাদপদ, অলস জাতি ছাড়া আর কীই বা হতে পারে? মিশরিয়রা কি কল্পনা করে দেখেছে যে
ইউরোপের মানুষ, যারা বাষ্প ও বিদ্যুতের শক্তি আবিষ্কার করার মতো সম্পূর্ণতা ও বুদ্ধিবৃত্তি অর্জন করেছে…যারা প্রতিদিন জ্ঞানের অনুসন্ধানে জীবনের ঝুঁকি নেয় ও জীবনের আনন্দকে সম্মান দেয়…এই বুদ্ধিমত্তা ও প্রাণ, আমরা যাদের এত সম্মান করি…এর ভেতর ভালো কিছু থাকলে এত দিন চৰ্চা করার পর তাকে ছুঁড়ে ফেলে দিত? ৮২
এটা বিস্ময়কর নয় যে, এমনি তোষামুদি পাল্টা প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছিল। আরব লেখকগণ তাঁদের সমাজের এমনি মূল্যায়ন মেনে নিতে অস্বীকার করেন, এই উত্তপ্ত বিতর্কের ধারায় পর্দাপ্রথা উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে প্রতিরোধের প্রতীকে পরিণত হয়। এবং সেভাবেই আছে। অনেক মুসলিমই এখন পর্দাকে সকল নারীর জন্যে শোভনতার প্রতীক ও প্রকৃত ইসলামের চিহ্ন মনে করে। নারীবাদী যুক্তি প্ৰয়োগ করে, যার জন্যে অনেকেরই তেমন একটা বা আদৌ কোনও সহানুভূতি নেই, প্রচারণার অংশ হিসাবে উপনিবেশবাদীরা মুসলিম বিশ্বে নারীবাদের লক্ষ্যকে রঞ্জিত করেছে ও ধর্মবিশ্বাসকে এর আগে অনুপস্থিত ভারসাম্যহীনতা যোগ করে বিকৃত করেছে।
আধুনিক রীতিনীতি ধর্মকে পাল্টে দিচ্ছিল। উনবিংশ শতাব্দীর শেষ নাগাদ ইহুদি, ক্রিশ্চান ও মুসলিমদের ভেতর এমনও ছিল যারা বিশ্বাস করতে শুরু করেছিল যে তাদের ধর্ম বিনাশের ঝুঁকির ভেতর রয়েছে। ধর্মবিশ্বাসকে রক্ষা করার জন্যে বেশ কিছু কৌশলগত পদক্ষেপ গ্রহণ করে তারা। কেউ কেউ আধুনিক সমাজ থেকে নিজেদের সম্পূর্ণ প্রত্যাহার করে পবিত্র ঘাঁটি ও আশ্রয় হিসাবে নিজস্ব উগ্র প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলে; কেউ পাল্টা আক্রমণের পরিকল্পনা করছিল, অন্যরা আধুনিকতার সেক্যুলার পক্ষপাতিত্বের বিরুদ্ধে নিজস্ব চ্যালেঞ্জ সৃষ্টির লক্ষ্যে প্রতি- সংস্কৃতি ও ডিসকোর্স গড়ে তুলতে শুরু করেছিল। ধর্মকে বিজ্ঞানের মতোই যৌক্তিক হয়ে ওঠার একটা বিশ্বাস জেগে উঠছিল। বিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকের বছরগুলোয় এক নতুন ধরনের আত্মরক্ষামূলক ব্যবস্থা আমরা এখন যাকে মৌলবাদ বলছি সেই যুদ্ধংদেহী ধার্মিকতার স্পষ্ট প্রকাশের দিকে টেনে নিয়ে যাবে।