০৫. যামিনী কবিরাজের বউ সেনদিদি

যামিনী কবিরাজের বউ বাঁচিয়া উঠিয়াছে। ভগবানের দয়া, যামিনী কবিরাজের বউ-এর কপাল, শশীর গৌরব।

গোপাল ছেলের সঙ্গে আজকাল প্রায় কথা বন্ধ করিয়া দিয়াছে। যামিনী কবিরাজের বউ বাঁচিয়া উঠিয়াছে বলিয়া নয়, অন্য কারণে। অন্য সাধারণ মানুষের তাই ধরিয়ালওয়া উচিত। ব্যাপারটা হইয়াছিল এই। শশীর বেশ পসার হইয়াছে। বাজিতপুরের সরকারি ডাক্তারকে ডাকিতে খরচ অনেক। অনেকে শশীকেই ডাকে। যামিনী কবিরাজের বেএর চিকিৎসার জন্য কয়েকদিন শশী দূরে কোথাও যাওয়া তো বন্ধ রাখিয়াছেই, তিন মাইল দূরের নন্দনপুরের কল পর্যন্ত ফিরাইয়া দিয়াছে। এই সময়টা যামিনী কবিরাজের বউ মরিতে বসিয়াছিল। গোপালের উস্কানিতে যামিনী ঝগড়া করিয়া অপমান করিয়া শশীর আসা-যাওয়া বন্ধ করিবার চেষ্টা করিয়া সফল হয় নাই। দূর গ্রামে রোগী দেখিতে পাঠাইতে না পারিয়া ছেলের উপর গোপাল খেপিয়া গিয়াছে। অথচ বাড়াবাড়ি করিবার সাহস তাহদের ছিল না। শশীকে তাহারা দুজনেই ভয় করিতে শুরু করিয়া দিয়াছিল। মনে পাপ থাকার এই একটা লক্ষণ। মনে হয়, সকলে বুঝি সব জানে। সাপ উঠিয়া পড়ার আশঙ্কায় কেচো খুঁড়িবার চেষ্টাতেও মানুষ ইতস্তত। আকশে চাঁদ উঠে, সূর্য ওঠে। পৃথিবীটা চিরকাল ঈশ্বরের রাজ্য। মানুষের এই বদ্ধমূল সংস্কার সহজে যাইবার নয়। হাজার পাপ করিলেও নয়।

এমনি করে তুমি, গোপাল বলিয়াছিল, পসার রাখবে? লোকে ডাকতে এলে যাবে না? মক্কেল ফিরিয়ে দেব?

বলিয়াছিল, যামিনী খুড়ো কোনোদিন এতটুকু উপকার করবে যে ওর জন্য এত কছ? নিজের সর্বনাশ করে পরের উপকার করে বেড়ানো কোন দেশী বুদ্ধির পরিচয় বাপু?

আমার মার যদি ওমনি অসুখ হত?-শশী বলিয়াছিল। কেন বলিয়াছিল কে জানে!

তোমার মা তো বাপু বেঁচে নেই। কপাল ভালো, তাই আগে আগে ভেগেছেন। তোমার যা সব কীর্তি—যে কীতি সব তোমার; তুই উচ্ছন্ন যাবি শশী।

যামিনী কবিরাজের বউ বাঁচিয়া উঠিবার পর বিপজ্জনক গাম্ভীর্যের সঙ্গে গোপাল বলে, এইবার কাজকর্মে মন দাও শশী। যামিনী খুড়োর ইচ্ছে নয় তুমি ওদের বাড়ি যাও।

ঠাকুর্দাকে পুলিশে দেওয়া উচিত।

সর্বনাশ! শশী এসব বলে কী!

তোমার ইচ্ছেটা কী শুনি? হ্যা রে বাপু, মনের বাসনাটা তোমার কী? সব ছেড়েছুড়ে আমি কাশী চলে গেলে তমি বোধহয় খুশি হও? গুরুদেব তাই বলছিলেন। বলছিলেন, আর কেন গোপাল, এইবার চলে এসো। আমি ভাবছিলাম, শশীর একটু স্থিতি করে দিয়ে যাই, হঠাৎসব ছেড়ে চলে গেল ও কোনদিক সামলাৰে। কিন্তু তুমি এরকম আরম্ভ করলে আর একটা দিনও আমি থাকি কী করে?

গোপাল করিবে সংসার ত্যাগ, গোপাল যাইবে কাশী সম্মুখযুদ্ধ ত্যগ করিয়া পিছন হইতে গোপালের এই ধরনের আকস্মিক আক্রমণ শশীর অভ্যাস হইয়া গিয়াছে। সে এতটুকু টলে না।

কী অন্যায় কাজটা করেছি আমি, তাই বলুন না।

কী করেছ? মুখে চুনকালি মেখেছ। সবাই কী বলছে তোমার কানে যায় না-আমার কানে আসে। যামিনী খুড়োর বউ-এর অসুখে তোমার এত দরদ কেন? ডাক্তার মানুষ তুমি, একবার গেলে, ওষুধ দিলে, চলে এলে। দিনরাত রোগীর কাছে পড়ে থাকলে বলবে না লোকে যে আগে থাকতে কিছু না থাকলে।

এসব আপনার বানানো কথা।

এ অভিযোগ সত্য বলিয়া গোপালের রাগ বাড়িয়া যায়। গোপাল ছেলের সঙ্গে কথা বলে না।

একটি কথা নয়। বাহিরের ঘরে ফরাশের উপর খাতাপত্র ছড়াইয়া বসিয়া গোপাল হিসাব দেখে,-খাতক, ঋণপ্রার্থী, পরামর্শপ্রার্থী ও অনুগ্রহপ্রার্থীদের সঙ্গে কথা বলে। শশী ঘরের ভিতর দিয়া পার হইয়া যাইবার সময় গোপাল হঠাৎ কথা বন্ধ করিয়া আড়চোখে ছেলের দিকে তাকায়। কথা বলিবে না, না বলুক, ছেলেকে গলার আওয়াজও সে শুনাইবে না কি? তা-নয়। শশীকে দেখলে গোপালের ডাকিতে ইচ্ছ হয়, শশী শোন। এই ইচ্ছাটা দমন করিবার সময় গলা দিয়া গোপালের আওয়াজ বাহির হয় না। গোপাল বাক্যহারা হইয়া থাকে।

শশী বাহির হইয়া গেলে অনুগ্রহপ্রার্থীকে বলে, শুধিয়ে এসো তো যাচ্ছে কোথায়?

সে যদি আসিয়া বলে,-যামিনী কবিরাজের বাড়ি-গোপাল একদম খেপিয়া যায়।

ইয়ারকি? ইয়ারকি হচ্ছে আমার সঙ্গে?

অনুগ্রহপ্রার্থীর চোখে আর পলক পড়ে না।

যামিনী কবিরাজের বউ-এর গুটিগুলি শুকাইয়া ঝরিয়া পড়িতে কাতিক মাস কাবার হইয়া অগ্রহায়ণেরও কয়েক দিন গিয়াছে। তাহকে দেখিলে এখন ভয় করে, করুণা হয়। সর্বাঙ্গের ছোট ছোট ক্ষতগুলি এখনো লালচে রঙের কদর্য কতকগুলি গর্ত। সময়ে বারকয়েক চুমটি পড়িয়া পড়িয়া ক্ষতের কতক দাগ অনেকটা মিলিয়া আসিবে, কতক থাকিবে। কিন্তু যামিনী কবিরাজের বউ-এর রূপের খ্যাতি আর রহিল না। রূপই গেল নষ্ট হইয়া, রূপের খ্যাতি!

একটা চোখও তার নষ্ট হইয়া গিয়াছে।

এই ক্ষতিটাই যামিনী কবিরাজের বউকে কাবু করিয়াছে সবচেয়ে বেশি। শুধু ক্ষতচিহ্নে ভরিয়া রূপনষ্ট হওয়াটাও তাহার কাছে সহজ ব্যাপার নয়। রূপ তাহার তেত্রিশ বছরের আত্নীয়, তেত্রিশ বছরের আভ্যাস। একগোছা চুল কাটিতে মেয়েরা কাতর হয়, এ তো তাহার সর্বাঙ্গণ সৌন্দর্য, আসল সম্পত্তি। তবু এটা তার সহ্য হইত। মনকে সে এই বলিয়া বুঝাইতে পারিত যে আর কী তাহার ছেলেখেলার বয়স আছে? ছেলে-ভুলানো রূপ দিয়ে এখন সে করিবে কী? কিন্তু চোখ কানা হইয়া যাওয়া! এ তো রূপ নষ্ট হওয়া নয়, এ যে কুৎসিত হওয়া, কদর্য হওয়া! তাহাকে দেখিলে এবার যে লোকের হাসি পাইবে? তাহার অমন ডাগর চোখ!

চোখ নষ্ট হয়ে গেল শশী! আমি কানা হয়ে গেলাম।

কী আর করবেন সেনদিদি? বেঁচে যে উঠেছেন—শশী সান্ত্বনা দেয়।

এর চেয়ে আমার মরাই ভালো ছিল শশী, যামিনী কবিরাজের বউ বলে।

বলে, দেখলে ঘেন্না হয় না?

না না, ঘেন্না হবে কেন? ঘেন্না হয় না।

যামিনী কবিরাজের বউকে দেখিলে শশীর দুঃখ হয়, ঘেন্না হয়তো হয় না। না, ঘেন্না হয় না।

শশী সেরকম নয়।

কিন্তু সেনদিদির দাম যে কমিয়াছে তাতে সন্দেহ নই। শশী অবশ্য বুঝিতে পারে না, সেনদিদির আকর্ষণ যতখানি কমিয়াছে সহানুভূতি দিয়া তাহার ক্ষতিপূরণ হইয়াছে। সেনদিদির হাসি আর দেখিবার মতো নয়, তাহার একটি চোখে এখন আর গভীর স্নেহ রূপ নেয় না, তাহার মুখের দিকে অবাক হইয়া চাহিয়া থাকিবার সাধ্য এখন আর কাহারও নাই। সেনদিদির মুখের কথা, তাহার মেহর ও পক্ষপাতিত্ব আজ আর অমূল্য নয়। তাহার জন্য শশীর দুঃখ হয় কিন্তু শশীকে সে আর তেমনিভাবে টানিতে পারে না।

প্রতিদিন সেনদিদিকে দেখিতে আসার সময় শশী আজকাল পায় না। আসিলেও, বেশিক্ষণ বসিবার তাহার উপায় নাই। যামিনী কবিরাজের বউকে ভালো করিয়া শশীর পসার কয়েক দিনেই বাড়িয়া গিয়াছে। রোগীকে সে আর ফিরাইয়া দেয় না, দেখিতে যায়, পকেটে টাকা লইয়া বাড়ি ফেরে। একটা রাত্রি সে তো নন্দপুরেই কাটাইয়া আসিল। যাতায়াতের খরচ আর দশ টাকা ভিজিট। গ্রামে দশটা রোগী দেখিলে দশ টাকা, এক রাত্রে দশ-দশটা টাকা পাওয়া সহজ কথা নয়।

যামিনী কবিরাজের বউ বলে, সেনদিদিকে ত্যাগ করলে না কি শশী?

না সেনদিদি। রোগীর বড় ভিড়। আসবার সময় পাই না।

আঃ বেঁচে থকো বাবা, তাই হোক। আরও রোগী হোক, লক্ষপতি হও। ভগবানের কাছে দিনরাত এই প্রার্থনা করছি।-যামিনী কবিরাজের বউ যেন কাদিয়া ফেলিবে। রোগা শরীর, আবেগে কান্নাই চলিয়া আসে।-বিয়ে করে সংসারী হও, দেশজুড়ে তোমার নাম হোক, তাই দেখে যেন মরতে পারি।

এক চোখের কোটরে ঢুকানো তাহার একটিমমাত্র ডাগর চোখের নিরতিশয় মোহাচ্ছন্ন সজল দৃষ্টিতে শশীকে সে দেখিতে থাকে। যামিনীর চেলারা ওদিকে হামাদিস্তায় ঠকাঠক শব্দে গুল্ম গুড়া করে। যামিনী খায় তামাক। কাশে আর ভাবে। স্ত্রীর ঘরের চৌকাটও সে ডিঙায় না। শশীর সঙ্গে কথা বলে না। ভাবনার তাহার অম্ভ নাই। থাকার কথাও নয়। এই বয়সে,-বয়স তাহার ষাটের উপর গিয়াছে, মানুষের আর কত সহ্য হয়? কাণ্ড দ্যাখো, এতদিনের রূপসী বউটা এমন কুৎসিত হইয়াই বাঁচিয়া উঠিল যে, চোখে দেখিলে মাথা ঘোরে। ভালো এক আপদ আসিয়া জুটিয়াছিল,–শশী। মানুষকে ও মরিতেও দিবে না?

গ্রামবাসী কিন্তু যামিনীর মুখে অন্য কথা শোনে।

শশীর চিকিৎসা চিকিৎসাই বটে। অমনি চিকিৎসা হলে রুগীকে আর শিগগির শিগগির স্বর্গে যাবার ভাবনা ভাবতে হয় না। মেরেই ফেলেছিল। বসম্ভের চিকিৎসা ও কী জানে? কত ওষুধপত্র দিয়ে আমিই শেষে…

বলে, চোখটা গেল কি সাধে? ওই লক্ষ্মীছাড়ার দু দাগ ওষুধ খেয়ে!

এসব কথা গোপালের কানে যায়। গ্রামের অনেকে গোপালের কাছে গিয়া বলে যে যামিনী কবিরাজ আচ্ছা নিমকহারাম, গোপালের ছেলের নিন্দা করিয়া বেড়াইতেছে। সংবাদটা বলিবার সময় অনেকে মনে মনে হাসে। গ্রামের লোকের অনুমানশক্তি প্রখর। সকালে আকাশের দিকে চাহিয়া তাহারা বলিতে পারে বিকালে বৃষ্টি হইবে। বিকালে যদি নেহাত বৃষ্টি না-ই হয় সে অপরাধ অবশ্য আকাশের। গোপাল যামিনী কবিরাজের বউ আনিয়া দিবার পর গ্রামের লোক চার-পাঁচ বছর ধরিয়া যাহা অনুমান করিয়াছিল তাহা যদি মিথ্যা হয় তবে পৃথিবীই মিথ্যা। অর্থাৎ সে অপরাধ গ্রামের লোকের অনুমানশক্তি ছাড়া জগতের আর সমস্ত কিছুর। তাই, যামিনী কবিরাজ সংক্রান্ত কোনো সংবাদ দিবার সময় গম্ভীর মুখে গোপালের দিকে চাহিয়া মনে মনে তাহারা হাসে।

গোপালের রাগ হয়। সে যামিনীকে বলে, কী শুনছি খুড়ো? ছেলের নিন্দে কেন?

কার নিন্দে? শশীর? যামিনী আশ্চর্য হইয়া যায়, আমি শশীর নিন্দে করব। একথা তোর বিশ্বাস হয় গোপাল?

ঘরে নিন্দে কর, আমার কাছে নিন্দে করো, কথা নেই। কিন্তু খবৰ্দার বাইরে যেন নিন্দে কোরো না খুড়ো।

কিন্তু যামিনী নিজেকে মিলাইতে পারে না। তাহার অসহ্য জ্বালা। সে ফের শশীর নিন্দা করিয়া বসে।

বলে, গীটাকে ও ছোড়া উচ্ছন্ন দেবে। ছোড়ার চুল ছাঁটার কায়দা দেখেছিস!

মাঝে মাঝে শশীকেও সে অপমান করে, শশী গায়ে মাখে না। আগে শশী কারো অপমান সহ্য করিত না, আজকাল তাহার একপ্রকার অদ্ভুত ধৈর্য আসিয়াছে। যামিনীর কথায় তাহার একেবারেই রাগ হয় না। সেনদিদির অসুখ উপলক্ষে ওর যে পরিচয় সে পাইয়াছে তাহাতে বুঝিতে তাহার বাকি থাকে নাই যে, সংসারের বন্ধ পাগল ছাড়াও কমবেশি অনেক পাগল আছে। এক-এক বিষয়ে মাথায় যাহাদের অত্যাশ্চর্য বিকার থাকে। যামিনীও তাহাদেরই একজন। ওর অর্থহীন অপমানে রাগ করিলে নিজে সে এমনি পাগলের দলে গিয়া পড়িবে।

তা ছাড়া, আর-এক দিক দিয়া শশীর মন শাস্ত হইয়া স্থিতিলাভ করিয়াছিল। তাহার ইনটেলেকচুয়াল রোমান্সের পিপাসা। যাহা চায়ের ধোয়ার মতো, জলীয় বাষ্প ছাড়া আর কিছু নয়, চা-ও নয়। জীবনকে দেখিতে শিখিয়া, অত্যন্ত অসম্পূর্ণ ভাসা-ভাসা ভাবে জীবনকে দেখিতে শিখিয়া, সে অবাক হইয়া দেখিয়াছে যে এইখানে, এই ডোবা আর জঙ্গল আর মশাভরা গ্রামে জীবন কম গভীর নয়, কম জটিল নয়। একান্ত অনিচ্ছার সঙ্গে গ্রামে ডাক্তারি শুরু করিয়া ক্রমে ক্রমে এ জীবন শশীর যে ভালো লাগিতেছে, ইহাই তাহার প্রথম ও প্রধান কারণ। তারপর যাত্ৰাদলের অভিনেতা সাজিয়া কুমুদের আবির্ভাব। মোনালিসার কুমুদ, ভেনাস ও কিউপিডের কুমুদ, শেলি-বায়রন-হুইটম্যানের কুমুদ, পেগ খাওয়া waltz-foxrot-নাচা কুমুদ, নীলাক্ষীর প্রেমিক কুমুদ, তার চেয়ে বয়সে জ্ঞানে বিদ্যায় বুদ্ধিতে শ্রেষ্ঠ কুমুদ; যাত্ৰাদলের অভিনেতা সাজিয়া তাহার আবির্ভাব! এ কি ব্যর্থ যায়! শশীর মন শাস্ত হইয়াছে, স্থিতিলাভ করিয়াছে। কেমন করিয়া হঠাৎ সে বুঝিতে পারিয়াছে কিডস্কিনের জুতাটা, আশ্চর্য শাড়িটা, বিস্ময়কর ব্লাউজটাই আসল। আর আসল তখনকার কুমুদের টাকাটা। তারপর তোমার চেহারা তো আছেই! সেটাও একটু দরকার আর দরকার বিশ্বজগৎকে একটু ডোন্ট কেয়ার করার ভাব। জমিল রোমান্স।

শশী এটা বুঝিয়াছে। কিন্তু হিসাব তো কম নয়? অতগুলি সমস্বয় তো তুচ্ছ নয়? এটাও শশী স্বীকার করে। স্বীকার করে যে ব্যাপারটা মন্দ নয়। মানুষের সভ্যতার খুবই অগ্রগতির পরিচয়, চমৎকার উপভোগ। লোভ করিবার মতো। পাইলে সে লাভবানই হইত। কিন্ত বঞ্চিত হইয়াছে বলিয়া মনের মধ্যে অসন্তোষ পুষিয়া রাখিবার মতোও কিছু নয়।

শশী ইহাও বুঝিয়াছে যে, জীবনকে শ্রদ্ধা না করিলে জীবন আনন্দ দেয় না। শ্রদ্ধার সঙ্গে আনন্দের বিনিময়, জীবনদেবতার এই রীতি।

শশী তাই প্রাণপণে জীবনকে শ্রদ্ধা করে। সংকীর্ণ জীবন, মলিন জীবন, দুর্বল পঙ্গু জীবন- সমস্ত জীবনকে। নিজের জীবনকে সে শ্রদ্ধা করে সকলের চেয়ে বেশি।

কুসুমের সঙ্গে কিন্তু শশীর আর একদিন ঝগড়া ইহয়া গিয়াছে।

রাত্রে একদিন হঠাৎ কুসুমের পেটের ব্যথা ধরিয়াছিল। অসহ্য প্রাণঘাতী ব্যথা। শশীকে না ডাকিয়া উপায় ছিল না। রাত্রে, বিশেষত শীতের রাত্রে, ঘুম ভাঙিয়া বিছানা ছাড়িয়া উঠিয়া গিয়া ডাক্তারি করাটা শশীর এখনো ভালোরকম অভ্যাস হয় নাই। প্রথমে সে একটু বিরক্তই হইয়াছিল। পেটে ব্যথা পেটে ব্যথার জন্য হারু ঘোষের বংশে কবে ডাক্তার ডাকিয়াছে? একটু গরম তেল মালিশ করিয়া দিলেই হইত। কিন্তু কুসুমের ব্যথার প্রতাপ দেখিয়া শশীর বিরক্তি টেকে নাই।

কলিক? কে জানে?

কী খেয়েছিলে পরাণের বউ?

জবাব দিয়াছিল মতি।

বে আজ কিছু খায়নি ছোটোবাবু। দাদার সঙ্গে ঝগড়া করে সারাদিন উপোস করেছে। একাদশীর দিনে এয়োস্ত্রী মানুষ করল উপোস,–হবে না?

কথাটা সাংঘাতিক। একাদশীর দিন এই উপবাস করার কথাটা। এমন কাজ করিবার মতো বুকের পাট কুসুম ছাড়া আর কারো হইত কি না সন্দেহ।

কিছু খাওনি পরাণের বউ?

খেয়েছি। খাব না কেন? একটা মাছের আঁশ খেয়েছি। কুসুম ধুঁকিতে ধুঁকিতে বলিয়াছিল।

তাহা হইলে একাদশীর দিন উপবাস করে নাই। ঝগড়ার কথাটাই সত্য, একাদশীর উল্লেখট মতি অনর্থক করিয়াছে। শশীর হঠাৎ রাগ হইয়া গিয়াছিল। কেন, কী বৃত্তান্ত না জানিয়ে মতি অমন যা-তা মন্তব্য করে কেন? কিন্তু কুসুমের কী হইয়াছে? কলিক? পেটের ব্যথাটা বড় রহস্যময় অসুখ। পরীক্ষা করিয়া দেখিবার উপায় নাই, সত্য কি মিথ্যা বুঝিবার উপায় নাই, থার্মেমিটার স্টেথোস্কোপ কোনোটাই কাজে লাগে নাই। রোগী যা বলে তা-ই সই। ব্যথাটা ডানদিকে বলিলে ডানদিকে, ঝিলিক দেওয়া ব্যথা বলিলে ঝিলিক-দেওয়া ব্যথা, চনচনে একটানা ব্যথা বলিলে চনচনে একটানা ব্যথা। সন্দেহ করিবার যো নাই। কুসমের বর্ণনা শুনিয়া শশী কিছুই বুঝিতে পারে নাই। পরাণকে সে আড়ালে ডাকিয়া লইয়া গিয়াছিল।

খানিক পরে বাড়ি গিয়া পাঠাইয়া দিয়াছিল ওষুধ। নিজে আর ফিরিয়া যায় নাই।

এই হইল তাহার অপরাধ। পরদিন খবর লইতে গিয়া দেখে কুসুম আগুন হইয়া আছে।

মরিনি। এই আপনার টাকা।

কুসুম সত্য সত্যই আঁচলে বাধা দুটি টাকা শশীর সামনে রাখিল। শশীর বুঝিতে বাকি রহিল না এই উদ্দেশ্যেই সে আচলে টাকা বাঁধিয়া ঘরের কাজ করিতেছিল।

মতি বলিল, তোর কী আস্পর্ধা বউ!

বুঁচি নাই। বুঁচি অনেকদিন আগে শ্বশুরবাড়ি চলিয়া গিয়াছে। সে থাকিলে অন্য কিছু বলিত। আরও কড়া, আরও ঝাঁজালো কিছু।

কুসুম শান্তভাবে বলিল, মা একলা গোয়াল সাফ করছে, যা তো মতি লক্ষ্মটি, হাত লাগবি যা। সুদেবের সঙ্গে তোর বিয়ের পরামর্শটা ছোটোবাবুর সঙ্গে করে নি। মা যেন গোয়াল ফেলে ছুটে আসে না বাপু। কাজ সেরে একেবারে চান করে আসবি। ছোটোবাবু বসবে।

কুসুম হুকুম দিতেও জানে। কেন জানিবে না? সকলে মিলিয়া তোষামোদ করিয়া গোরু কেনার জন্য তাহার অনম্ভজোড়া বাগাইয়া লয় নাই? সেও ছাড়িবে কেন? মাঝে মাঝে ভয়ানক দরকারের সময়, শশীর সঙ্গে এখন সে যে কলহ করিবে এমনি দরকারের সময়, হুকুম তাহার সকলকে মানিতে হইবে।

মতি চলিয়া গেলে শশী বলিল, ওষুধ খেয়ে কাল তোমার পেটব্যথা কমেনি নাকি বউ?

ও ভারি ওষুধ! কটা এইটুকু-টুকু সাদা বড়ি-ওষুধ না ছাই। নিজে একবার আসতে পারেননি? বড়ি খেয়ে ব্যথা যদি না কমত!

এর নাম অকৃতজ্ঞতা। ব্যথা তাহা হইলে কমিয়াছিল? রাত্রে একবার উঠিয়া আসিয়া দেখিয়া গিয়া ওষুধ দিল,ওষুধ খাইয়া ব্যথাও কমিল, তবু কুসুমের মন ওঠে নাই। শশী বিরক্তি বোধ করিল। তোমার সব বিষয়েই একটু বাড়াবাড়ি আছে বউ।

কী আছে? বাড়াবাড়ি? হ্যাগো ছোটোবাবু, আছেই তো। তা যাই বলেন, এক ঘণ্টা ধরে বুক পরীক্ষা ম্যালেরিয়া জ্বর হলে, আমি করি না।

সে বুক পরীক্ষা করিবে, সে কি ডাক্তার? কুসুমের মনটা শশীর বোধগম্য হয় না। পেটব্যথার জন্য কাল এক ঘণ্টা স্টেথোস্কোপটা ওর বুকে লাগাইয়া হৃদস্পন্দন শুনিলে ও কি সুখী হইত? কুসুমের মাথাধরার চিকিৎসা বোধ হয় পাটেপা। সে ডাক্তার মানুষ, এসব পাগলামিকে প্রশ্রয় দিলে তাহার চলিবে কেন?

টাকা পেলে কোথায় পরাণের বউ?

যেখান থেকেই পাই, আপনার ভিজিট দিয়েছি, নিয়ে যান।

কোথা থেকে পেয়েছ না বললে নিতে পারি না, বউ।

কেন, চুরি করেছি ভাবেন নাকি?

শশী ভাবিল, এই বেশ সুযোগ পাওয়া গিয়াছে। কুসুমের এই কথাটাকে পরিহাসে দাঁড় করাইয়া দিলেই সে হাসিয়া ঠাণ্ডা হইয়া যাইবে।

তা আশ্চর্য কী? চুরি না করলে টাকা তুমি পাবে কোথায়? রোজগার করো?

কুসুম বলিল, আমার বাপ ঢের রোজগার করে। তাই বলে আমরা কি আপনার তুল্যি? লোকের গলায় ছুরি দেওয়া পয়সায় আমরা বড়লোক হইনি, তাই আপনারা গরিব বলেন গরিব, চোর বলেন চোর!

শশী মুখ কালো করিয়া বাড়ি ফিরিল।

সারাদিন তাহার মন খারাপ হইয়া রহিল। নিজের চারিদিকে সে যে শিক্ষা ও সভ্যতার খোলটি সযত্নে বজায় রাখিয়াছিল, কুসুম তাহাতে ফাটল ধরাইয়া দিয়াছে। কুসুমের কথা মিথ্যে নয়। হারু ঘোষের চেয়ে তাহার বাবা কি একদিন গরিব ছিল না? লোকের গলায় ছুরি দিয়াই গোপাল যে পয়সা করিয়াছে একথারও প্রতিবাদ চলিবে না। গোপালের চেয়ে কুসুমের বাবা ঢের বেশি ভদ্রলোক। কুসুমকে তাহার বাবা মধ্যে মধ্যে পত্র লেখে গোপালের সাধ্য নাই অমন সুন্দর হস্তাক্ষরে ওরকম চিঠি লিখিতে পারে। ঠিকানায় কুসুমের নামটা বাঙলায় লিখিয়া কুসুমের বাবা বাকিটা লেখে ইংরেজিতে। গোপাল এবিসিডি-ও চেনে না। অপমানটা করিবার সময় কুসুম হয়তো এইসব কথাও মনে রাখিয়াছিল।

গ্রামের লোকেরা তাহাকে যে ছোটোবাবু বলিয়া ডাকে ইহাতে শশীর গৌরব কিছু নাই। এটা উপাধি মাত্র, শুধু নাম। সম্মান নয়। গোপালের মক্কেলরা শিশুকালে আদর করিয়া তাহাকে ছোটোবাবু বলিয়া ডাকিত, ডাকটা কী করিয়া গ্রামে ছড়াইয়া পড়িয়াছে এবং টিকিয়া আছে। এসব ভুলিয়া গিয়া সে কি অহঙ্কারী হইয়া উঠিতেছিল? সকলের সঙ্গে ছোটোবাবুটির মতো ব্যবহার শুরু করিয়া দিয়াছিল?

শশীর আত্বসম্মান অত্যস্ত আহত হইয়া রহিল। সে ভাবিল, আমার রকমসকম দেখে কুসুম হয়তো মনে মনে হাসে। কুসুম হয়তো ভাবে, আঙুল ফুলে কলাগাছ হলে এমনই করে মানুষ বাপের চুরি-চামারির পয়সায় লেখাপড়া শিখে এত কেন?

কুসুম ক্ষমা চাহিতে আসিল দিন-চারেক পরে। দুপুরবেলা চুপিচুপি, চোরের মতো!

শশীর ঘরের পিছনে বাগান। বাগানে লিচু হয়, আম হয়, কাঠাল হয়, কপি হয়, নটেশাক হয়, তীব্রগন্ধী কাঁঠালি চাঁপা, লালবোঁটা শিউলিফুল ফোটে। বাগান দিয়া আসিয়া ঘরের জানালার ফাঁকে ফিসফিস করিয়া কুসুম ডাকিল, ছোটোবাবু শুনুন।

শশী ঘুরিয়া বাগানে গিয়া দ্যাখে জানালার নিচে তাহার অত সাধের গোলাপচারাটি কুসুম দুই পায়ে মাড়াইয়া মাটিতে পুতিয়া দিয়াছে।

গাছটা মাড়ালে কেন বউ? কিসে দাঁড়াচ্ছ দেখে দাঁড়াতে হয়!

শশীর সাধের ফুলের চারাকে হত্যা করিয়া শুরু করিলেও কুসুমের কাজ হইল। শশী তাহাকে ক্ষমা করিয়া ফেলিল; সমস্ত অপরাধ। আজ পর্যন্ত কুসুম তাহার কাছে যত অপরাধ করিয়াছে সব। কুসুম বলিল, চার রাত সে ভালো করিয়া ঘুমায় নাই। কথাটা শশী বিশ্বাস করিল। কুসুম মানবদনে মিথ্যা বলে জানিয়াও বিশ্বাস করিল। কারণ, কুসুমের মুখে কথাটার প্রমাণ ছিল এবং চোখে ছিল জল। কুসুম আরও বলিল, কয়েক দিনের মধ্যেই সে বাপের বাড়ি চলিয়া যাইবে। তার বাবা ভুবনেশ্বর পত্ৰ দিয়াছে। ছোটোবাবুকে রাগাইয়া চলিয়া যাইবার কথাটা ভাবিতে তাহার এমন খারাপ লাগিতেছিল! তাই ক্ষমা চাহিতে আসিয়াছে।

আমার এই স্বভাবের জন্য কেউ আমাকে দুচেখে দেখতে পারে না। মুখের আমার আটক নেই!

শশী জিজ্ঞাসা করিল, সেদিন রাত্রে তোমার কী হয়েছিল বলো তো? সত্যি বলো!

পেট ব্যথা করেছিল।

জিভ দেখি?

কুসুম সলজ্জভাবে জিভ দেখাইল।

জিভ তো পরিষ্কার।

জিভ পরিষ্কার হবে না কেন ছোটোবাবু?

না, জিভ অপরিস্কার থাকিবার কোনো কারণ নাই। কুসুমের স্বাস্থ্য বাহিরের ফাঁকি নয়, ভিতরেও সে খুব মজবুত। কুসুমকে শশীর এইজন্যই ভালো লাগে। দশ বছরে একবার এক রাত্রে শুধু পেটে ব্যাথায় কষ্ট পায়, আর কোনো রোগ বালাই নাই। এই তো চাই। সব বাঙালি ঘরের মেয়ের এরকম স্বাস্থ্য হইলে জাতটা আজ ডুবিতে বসিত না, শশী একথাও ভাবে।

জানালা দিয়া উৎসুক দৃষ্টিতে ঘরের ভিতর চহিয়া কুসুম বলিল, আপনার ঘরটা একটু দেখে যাব ছোটোবাবু?

চলো না, সিন্ধু ওদের কাউকে ডাকি, অ্যাঁ?

না। আমি একাই দেখে যাই।

কুসুম একাই শশীর ঘর দেখিল। শশী জানিত এটা উচিত নয়। কিন্তু বারণও সে করিল না। ভাবিল ওর যদি বদনামের ভয় না থাকে আমার বয়ে গেল। আমি তো ডাকিনি।

শশীর ঘর দেখিয়া কুসুম বলিয়াছিল, বেশ সাজানো ঘর। কিন্তু জাদুঘর মিউজিয়ামের মতো মানুষের শোবার ঘরে কী আর দেখিবার থাকে? বড়ো আলমারি দুটির পাঁচটি তাক। একটা আলমারিতে ঠাসিয়া বই ভরিয়াও কুলায় নাই, মাথার উপর উঁচু করিয়া সাজাইয়া রাখা হইয়াছে। অপরটির উপরে তাক তিনটিতেও ডাক্তারি বই সাজানো, নিচের তাকে চকচকে ডাক্তারি যন্ত্রপাতি। কোনটা কী কাজে লাগে? কুসুম জিজ্ঞাসা করিল। কুসুমের যেন তাড়াতাড়ি নেই, যতক্ষণ খুশি শশীর ঘরে থকিতে পারে। দেয়ালে কয়েকটা ছবি আর ফটো টাঙানো আছে, কুসুম অন্যমনস্কের মতো সেগুলি দেখিল। ফটোগুলি অধিকাংশই শশীর বাড়ির স্ত্রী-পুরুষের, কোনো মন্তব্য নিম্প্রয়োজন। কুমুদের ফটোটা দেখিয়া কুসুম বলিল, সেই লোকটা না? গতবৎসর শশী দেয়ালে একগোছা ধানের শিষ টাঙ্গাইয়া দিয়াছিল। দেখিয়া কুসুম ভারি খুশি। কাঠের বাক্সে কী আছে? ওষুধ? দেখি। ওই ছোট আলমারিতে ওষুধ রাখিয়াছে, আবার বাক্সে কেন?

এ ঘরে আপনি একা শোন ছোটোবাবু?

একাই শুই।

তা, বউ আসতে আর দেরি কত! শিগগির বাপের বাড়ি চলে যাব ছোটোবাবু। আর আসব না।

আসবে না? সে কী! শশী অবাক হইয়া গেল।

কুসুম একটু ভাবিল আসব, অনেক দেরি করে আসব। হয়তো ও-বছর নয়তো পরের বছর, ঠিক কিছু নেই। আচ্ছা, যাই ছোটোবাবু।

শশী বলিল, কী করে যাবে? বাবা ওদিকে দাওয়ায় এসে বসেছেন। ঘুমিয়ে উঠলেন।

তবে? কুসুম জিজ্ঞাসা করিল। সে যে বিশেষ ভয় পাইয়াছে মনে হয় না। বিপদে কুসুম শান্তই থাকে। বিচলিত হয় না, দিশেহারা হয় না।

শশী বলিল, একটু বোসো। বাবা এখুনি বাইরের ঘরে চলে যাবেন।

তবে দরজা বন্ধ করে দিন। দেখিতে পান যদি?

কে জনিত নিয়তি আজ গোপাল ঘুম ভাঙিয়া ওদিকের দাওয়ায় বসিবে, আজ সাত বছর পরে।

 

পূজার পর গাওদিয়ার স্বাস্থ্য ক্রমে ক্রমে ভালো হয়। ম্যালেরিয়া কমিয়া আসে, কলেরা বন্ধ হয়, লোকের ক্ষুধা বাড়ে, মাছ দুধ সস্তা হয়। নিমুনিয়া ও ইনফ্লুয়েঞ্জায় কেবল দুই-দশজন যা মারা যায়—সে কিছু নয়। অগ্রহায়ণ-পোষ মাসে খালের জল অনেক কমিয়া আসে। মাঘের শেষাশেষি ডোবা শুকাইয়া যায়। চৈত্র মাসে অনেক পুকুরে দু-এক হাত জল থাকে মাত্র। বৈশাখে বৃষ্টি না হইলে অধিকাংশ পুকুর শুকাইয়া ওঠে। তখন গ্রামে বড় জলের কষ্ট। শীতলবাবুর বাড়ির সামনের বড় দিঘিটার জল খাইয়া গাওদিয়া, সাতগাঁ আর উখারার লোক প্রাণধারণ করে। বাবুর দিঘিতে বাবুদের বাড়ির লোক ছাড়া কাহারো দেহ ভুবানো নিষেধ। দারোয়ান লাঠি ঘাড়ে পুকুর পাহারা দেয়, শীতলবাবুর ছেলেরা ভাগনেরা আর কম বয়সি মেয়েরা দিঘি তোলপাড় করিয়া স্নান আরম্ভ করিলে লাঠিতে ভর দিয়া সে একগাল হাসে। ঘাট ছাড়া গ্রামের লোকের অন্য কোথাও কলসি ডুবানো বারণ। শীতলবাবুর বাড়ির ছেলেমেয়েরা স্নান করিয়া গেলে দু-তিন ঘণ্টা ঘাটের কাছে জল কাদা হইয়া থাকে।

জল হইতে আসিয়া কেহ বলে ; খোকাবাবুদের একটু সাবধানে স্নান করতে বলতে পারো না দারোয়ানজি?

দারোয়ান বলে ; দিঘি কিসকো? তুমারা?

তা বটে, দিঘিটা বাবুদের বটে।

কিন্তু বৈশাখ মাস আসিতে এখনো দেরি আছে, বৈশাখ মাসে এ বছর খুব ঝড়বৃষ্টি হইতে কিনা এখন হইতে তাই বা কে বলিতে পারে। শীতকালটা গ্রামের লোক সুখে কাটায়। কই, মাগুর, শোলমাছ প্রচুর পাওয়া যায়। যাদের ডোবা আছে, ডোবা শুকাইয়া আসিলে জল ছেঁচিয়া ঝুড়িখানেক মাছ পায়। তার মধ্যে খলসে আর ল্যাঠা মাছই বেশি।

এই খাল আর খালের চিকরি-কাটা দেশে ভালো রাস্তা নাই কিন্তু শীতকালটা দেশে কাটাইবেন সংকল্প করিয়া বিমলবাবু সপরিবারে একটা মোটরগাড়ি সঙ্গে করিয়া গ্রামে আসিলেন।

বাজিতপুরে মোটরগাড়ি আছে। কিন্তু গাওদিয়ায় মোটরগাড়ি!

কুসুম শশীকে বলে, সেবার কলকাতায় মোটরগাড়ি চড়েছি। বিয়ের আগে যেবার কলকাতায় গিয়েছিলাম বাবার সঙ্গে।

শশী বলে, তোমার সে কথা মনে আছে?

কুসুম অবাক হইয়া বলে, বাহু, মনে থাকবে না? কতদিন আর হল? আট বছর কি ন বছর। আমার বয়স কত ভাবেন? পচিশ?

দূর! বাইশ বছর।

সুদেবের সঙ্গে মতির বিবাহের প্রস্তাব ভাঙিয়া গিয়াছে। কুসুম ইদানীং আর ও-কথা উত্থাপনও করিত না। মতির বিবাহ হোক বা না হোক তাহার যেন কিছুই আসিয়া যায় না। পরাণ যদি বা রাত্রে কোনোদিন কথাটা তুলিত, কুসুম হাই তুলিয়া বলিত, তাহার কোনো মতামত নাই। কোনোদিন কিছু না বলিয়াই সে ঘুমাইয়া পড়িত। এদিকে নিতাই তাগাদা দিতেছিল। এত বেশি তাগাদা দিতেছিল যেন বিবাহটা সুদেবের নয়, তাহার নিজের। শশীর সঙ্গে আর একবার পরামর্শ করিয়া শেষে পরাণকে বলিতে হইয়াছে— না, সুদেবের সঙ্গে মতির সে বিবাহ দিবে না। নিতাই শান্তভাবে কথাটা গ্রহণ করিতে পারে নাই। লোভ দেখাইয়াছে, সদুপদেশ দিয়াছে, মেজাজ গরম করিয়াছে, কিন্তু না, পরাণ রাজি নয়।

ছোটোবাবু বারণ করে দিয়েছে, অ্যাঁ? হারুদা মরলে তাকে কে পুড়িয়েছিল পরাণ? কাঁধ দিয়েছিল কে? ছোটোবাবু? ছোটোবাবু যখন বারণ করছে, ব্যাস, তার আর কি, ছোটোবাবুর কথা বেদবাক্যি, বটে?

আমার নিজের বুদ্ধি নেই? মতির বিয়ে আমি শহরে দেব–ভদ্রঘরে।

এ কথাটা পরাণ না বলিলেও পারিত।

যাই হোক, তারপর সুদেব নিতাইয়ের নামে বাজিতপুরের মামলা রুজু করিয়াছে। অভিযোগ গুরুতর, গচ্ছিত ধন অপহরণ, বেআইন আটক, আর মারপিট। গারের জ্বালায় সুদেব নালিশ করিয়াছে বটে কিন্তু কিছু প্রমাণ করিতে পারবে কিনা সন্দেহ নিতাই বিচক্ষণ সংযমী মানুষ। হঠাৎ কিছু করিয়া বসিবার লোক সে নয়, প্রমাণ রাখিয়া অপকর্ম সে কখনও করিবে না।

একদিন বাজিতপুর-ফেরত নিতাইয়ের সঙ্গে শশীর রাস্তায় দেখা হইল। এই মামলার ব্যাপারে নিতাইকে অপরাধী সন্দেহ করিয়াও শশীর রাগ হইয়াছে সুদেবের উপর। নিতাই সুদেবের মামা, নিজের মামা। একেবারে মামলা না করিয়া আর কিছু তো করিতে পারিত? কোর্টে এখন মতির নামটি উঠিয়া পড়িবে। পরাণকে সাক্ষ্য দিতে যাইতে হইবে। সে এক কেলেঙ্কারি ব্যাপার।

কিন্তু নিতায়ের সঙ্গে মামলার কথা শশী আলোচনা করিল না।

বলিল, তোমার কাছে কিছু টাকা পাওনা আছে নিতাই।

দেব ছোটোবাবু, মাঘ মাসটা গেলেই শোধ করে দেব।

শশী চিন্তিত হইয়া বলিল, মাঘ মাস? আচ্ছা, তাই দিও। কিন্তু লালীর বাছুরটা তুমি পরাণকে দিলে না যে? লালী দুধ বন্ধ করেছে শুনলাম?

লালীর বাছুর পরাণকে দেব কেন ছোটোবাবু?

কেন লালীকে বেচবার সময় কথা হয়নি প্রথম বাছুরটা পরাণ পাবে?

না ছোটোবাবু, এমন কথা হয়নি, পরাণ মিছে বলেছে। লালীকে আমি কিনেছি হারুদার ঠেয়ে, পরাণ কি জানে?

শশী উদাসভাবে বলিল, যাক, কথা না হয়ে থাকলে আর কী কথা? পরশু সের ছয়েক দুধ পাঠিও নিতাই। বাড়িতে কী সব করবে বলেছিল।

শশী চলিয়া যায়,–নিতাই ডাকিয়া বলিল, ছোটোবাবু, শোনেন। বাজিতপুরে জামাইবাবুকে দেখলাম। কাল বিয়ানে এ গাঁয়ে আসবেন।

কোন জামাইবাবু?

মেজো।

এ খবর শশী জানিত না। তাদের কোনো সংবাদ না দিয়া নন্দলাল গায়ে আসিতেছে ইহাতে আশ্চর্যও সে হইল না। বিবাহের পরেই নন্দলাল শ্বশুরবাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক তুলিয়া দিয়াছে। কখনও চিঠি লেখে না, চিঠির জাবাব দেয় না। বিন্দু প্রথম প্রথম চিঠি লিখিত, স্বামীর আদেশের বিরুদ্ধে তাকাইয়া। নন্দলাল টের পাইবার পর বাপের বাড়ির সঙ্গে চিঠি লেখার সম্পৰ্কটুকু তাহাকে তুলিয়া দিতে হইয়াছে। একবার সে যে দু-চার দিনের জন্য বাপের বাড়ি আসিয়াছিল তাও স্বামীকে লুকাইয়া। ব্যবসা উপলক্ষে নন্দলাল দিন পনেরো বোম্বে গিয়েছিল, সেই সময়। এমন ব্যাপার বেশিদিন গোপন থাকিবার নয়। বোম্বে হইতে ফিরিয়া একদিন নন্দলাল স্ত্রীকে বলিয়াছিল, গাওদিয়া গিয়েছিলে?

বিন্দু ভয়ে কাঁপিয়া একটু হাসিয়া ব্যাপারটা উড়াইয়া দিবার চেষ্টা করিয়া বলিয়াছিল, একদিনের তরে গিয়াছিলাম, মোটে একদিন। বাবার যা অসুখের কথা শুনলাম! –রাগ করেছ?

রাগ করেছ?–ভ্যাঙাইয়া–ছোটলোকের বাচ্চা!

গছাইয়া-দেওয়া বউ, প্রাণভয়ে-গ্রহণ করা বউ, লেখাপড়া-নাচ-গান-কিছু না-জানা বউ, জীবনের অপূরণীয় ক্ষতি।

বিন্দুকে নন্দলাল ত্যাগ করে নাই কেন, কে বলিবে! হয়তো কর্তব্যজ্ঞান, হয়তো খেয়াল, হয়তো নির্বিবাদে ওকে লইয়া যা-খুশি তাই করা যায় বলিয়া নন্দলালের কাছে বিন্দুর একধরনের দাম আছে,-কে বলিবে! বিন্দুকে নন্দলাল অত গয়না-কাপড় দেয় কেন, সে আর এক রহস্য। বিন্দু কি ধার-করা গহনা গায়ে দিয়া বাপের বাড়ি আসিয়াছিল? যাহা পায় নাই তাহাই পাইয়াছে এই অভিনয়টুকু করিয়া যাওয়ার জন্য? কে বলিবে! জীবনের অজ্ঞাত রহস্য গাওদিয়ার বিন্দুকে গ্রাস করিয়াছে, কলিকাতার অনামি রহস্য। কলিকাতায় থাকিয়া পড়িবার সময়ও শশী যাহা ভেদ করিতে পারে নাই। নন্দলাল একপ্রকার অপমানই করিত, কিন্তু শশী যাইতে ছাড়িত না। ভাইফোঁটার দিন ক-বার বিন্দু তাহাকে ফোঁটা দিয়াছে। বিন্দুর গা-ভরা গহনা সে দেখিতে পাইত না? না। অন্তঃপুরের দৈনন্দিন সাদাসিধে জীবনে গহনার বোঝা বহিয়া বেড়াইতে বিন্দু ভালোবাসে না-চোখের আবিষ্কার কানে শোনা এই কৈফিয়ত শশীর কাছে মিথ্যা হইয়া যাইত। শশী ভাবিত, বিন্দু তবে সুখেই আছে! একটা ব্যাপার সে বুঝিত না। বাহিরের লোকের বুঝিবার মতো ব্যাপারও সেটা নয়। নন্দলাল ভিন্ন বড়িতে বিন্দুকে রাখিয়াছে, বিন্দুকে একা। নন্দলালের পরিবার যে-বাড়িতে পচিশ বৎসর বাস করিতেছে, বিন্দু সেখানে কতদিন বধূজীবন যাপন করিয়াছিল জিজ্ঞাসা করিলে বিন্দু সে প্রশ্ন এড়াইয়া যায়, নূতন বাড়িতে কতদিন সে গৃহিণী হইয়া বাস করিতেছে তাও বলে না। ঝগড়াকাটি হতে লাগল, তাই চলে এসেছি। —বিন্দু শুধু ওই কৈফিয়ত দেয়। বলে, বেশ আছি স্বাধীনভাবে। ওখানে এমন ঝগড়া করে এবং বলিয়া এমনভাবে হাসে যে মনে হয় যেন সত্য সত্যই বেশ আছে, স্বাধীনভাবে। ঝি-চাকরের অভাব নাই, সদরে একটা দারোয়ানও আছে। ঘরগুলি দামি আসবাবে ভরতি, বাড়াবাড়ি রকমে ভরতি। বিন্দুর জন্য নন্দলাল বিলাসিতার চূড়ান্ত ব্যবস্থা করিয়া দিয়াছে। সারা বাড়িতে এসেন্সের গন্ধ!

নন্দলাল তাহা হইলে বিন্দুকে ভালোবাসে? বিন্দুর বাড়িতে গিয়া কতদিন শশী দেখিয়াছে, বিন্দুর ভাব অমায়িক, বিন্দু সাদাসিধে। জিজ্ঞাসা করিয়া জানিয়াছে, নন্দলাল সে বেলা আসিবে না। আবার কতদিন গিয়া দেখিয়াছে বিন্দু অমায়িক নয়, রহস্যময়ী। বিন্দু মহাসমারোহের সঙ্গে প্রসাধনে ব্যাপৃত হইয়া আছে, কথা বলার সময় নাই! একঘণ্টার মধ্যে নন্দলাল আসিবে।

জীবনের অজ্ঞাত রহস্য বিন্দুকে গ্রাস করিয়াছে বইকী।

পরদিন শশী খালের ঘাটে গেল—যে ঘাটে হারুর মৃতদেহের সঙ্গে এক নৌকায় সে একটি সন্ধ্যা অতিবাহিত করিয়াছিল। সকালবেলা।

নন্দলাল আসিতেছে—বাড়িতে শশী একথা প্রকাশ করে নাই। নন্দলাল কখনও তাহাদের বাড়ি যাইবে না। কিন্তু শশী অনেকদিন বিন্দুর কোনো খবর পায় নাই। নন্দলালের কাছে বিন্দুর খবরটা জানিবার জন্যই সে খালের ঘাটে আসিয়াছে। গ্রামের মধ্যে একান্ত পর উদ্ধত ভগিনীপতিটির সঙ্গে আলাপ করা অসম্ভব।

শশীর মনে আর একটা ইচ্ছা ছিল। সে এক অসম্ভব কল্পনা। বিন্দুর বিবাহের ব্যাপারটা শশী জানে। কিন্তু সে তো আজকের কথা নয়, প্রায় ইতিহাসে দাঁড়াইয়া গিয়াছে। এতকাল নন্দলাল রাগ করিয়া ছিল, ভালো কথা, তাহার দোষ নাই। কিন্তু চিরজীবন অতীত ঘটনার জবাব কাটিয়া চলিয়া লাভ কী? নন্দলাল তো আজ অনায়াসে গোপালকে ক্ষমা করিয়া ফেলিতে পারে। মনে করিতে পারে যে জোর-জবরদস্তি নয়, সে নিজেই দেখিয়া পছন্দ করিয়া বিন্দুকে বিবাহ করিয়াছিল! গোপালের অপরাধে রাগ করিয়া আছে নন্দলাল আর মাঝে পড়িয়া শাস্তি পাইতেছে বিন্দু, এটা উচিত নয়।

বাপের বাড়ির সঙ্গে সম্পর্ক তুলিয়া দেওয়াটা বিন্দুর শাস্তি, শশী এইরকম মনে করে। নন্দলালকে সে আজ তাহদের বাড়ি গিয়া উঠিতে অনুরোধ করিবে। আভাসে ইঙ্গিতে বুঝাইয়া দিবে গোপাল আজ সাত বছর অনুতপ্ত হইয়া আছে, আর কেন ভাই, এবার মিটাইয়া ফেল।

তারপর নন্দলাল আসিল! সে আরও বুড়া হইয়াছে, আরও বাবু হইয়াছে। অবস্থার অনুপাতে হিসাব করিলে সঙ্গের চাকরটি কিন্তু তাহার চেয়েও বাবু। এইটুকু খাল বাহিয়া আসিতে দুজনের জন্য নন্দলাল নৌকা ভাড়া করিয়াছে দশজনের। হয়তো তাহার ডুবিয়া মরার ভয়,–কলকাতার বাবু!

খবর না-দেওয়ার জন্য শশী কোনো অনুযোগ করিল না। বলিল, কলকাতা থেকে বেরিয়েছ কবে?

বিন্দু শশীর এক বছরের ছোট। সেই হিসাবে নন্দলালের সে গুরুজন।

পরশু।

বিন্দু ভালো আছে?

ভালো থাকবে না কেন?

কী জবাব! নন্দলালকে সামনে দেখিয়া, তাহার কথা শুনিয়া, শশীর কল্পনা নিভিয়া আসিতেছে। রাগ, প্রতিহিংসা এইসব যে মানুষের অবলম্বন, সহজে ওসব সে ছাড়িতে চায় না। ছাড়িয়া বাঁচিবে কী লইয়া?

খবর পেলাম, আজ সকালে তুমি পৌছবে। বাবা বললেন, ঘাটে যা শশী, বাবুদের গাড়িটা নিয়ে যা, সঙ্গে করে নিয়ে আসবি। নিজেও আসতেন, আমি বারণ করলাম। বাতে কষ্ট পাচ্ছেন, কতক্ষণ ঘাটে অপেক্ষা করতে হবে তারও কিছু ঠিক নেই। তুমি আসছ শুনে বাড়িতে হৈচৈ পড়ে গেছে নন্দ।

নন্দলাল বলিল হুঁ, মোটরটা কার?

নন্দলাল বলিল শীতলবাবুর ভাই বিমলবাবুর। ওরাই জমিদার।

শীতলবাবু লোক কেমন?

প্রশ্ন শুনিয়া শশী একটু বিস্মিত হইল।

বেশ লোক। খুব ধর্মচর্চা করেন। এখানে দাঁড়িয়ে কী হবে? তোমার চাকরকে বলো, জিনিস গাড়িতে তুলুক। নৌকা ছেড়ে দাও, আমাদের নৌকায় ফিরে যাবে।

নন্দলাল মাথা নাড়িল,–আমি এ বেলাই ফিরব শশী। আর কাজ শেষ করে তোমাদের বাড়ি যাওয়ার সুবিধে হবে কি না-মানে, হয়তো সময় পাব না। না, হয়তো কেন, সময় পাব না।

শশী এ অপমানও হজম করিল।

আজ তোমাকে ফিরতে দিচ্ছে কে? সবাই আশা করে আছে নন্দ।

আমাকে ফিরতেই হবে। বাজিতপুরে কাজ ফেলে এসেছি। শীতলবাবুর সঙ্গে দেখা করেই আবার নৌকা খুলব।

শীতলবাবুর কাছে তাহার কী প্রয়োজন জিজ্ঞাসা করিতে নন্দলাল একটা ভাসাভাসা জবাব দিল যে বাজিতপুরে শীতলবাবুর কিছু জমি কিনিবে। কথা কহিতেও নন্দলালের যেন কষ্ট হইতেছিল। কেন, কী বৃত্তান্ত শশী তাহ কিছুই জিজ্ঞাসা করিল না। নিজেকে তাহার গোমস্তা মনে হইতেছিল নন্দলালের।

বেশ, কাজ থাকলে তোমায় আটকাব না। এ বেলাটা থেকে খাওয়াদাওয়া করে বিকেলে রওনা দিও। বলিয়া শশী যোগ দিল, বাবা নিজে আসতেন নন্দ। আমি বারণ করলাম।

কিন্তু নন্দর সুবিধা হইবে না। সময় নাই।

তখন শশী বলিল, ও আচ্ছা।

তাহার রাগ হইতেছিল, মনে জ্বালা ধরিয়া গিয়াছিল। টিনের চালাটার একধারে চন্ডী ছোকরা কেরোসিন কাঠের উপর রেকাবি-ভরা পান সাজাইয়া রাখিয়াছে, আর কয়েক প্যাকেট লাল-নীল-কাগজে-মোড়া বিড়ি। চণ্ডী নিজে কাছে গিয়া হা করিয়া বাবুদের গাড়িটি দেখিতেছে। গাওদিয়ায় মোটরগাড়ি নন্দ থাকিয়া থাকিয়া গাড়িটার দিকে চাহিতেছিল। কিন্তু শশীর সঙ্গে এইমাত্র সে সম্পর্ক চুকাইয়া দিয়াছে, গাড়িটা আনিয়াছে শশী। নন্দলাল তাই বলিল, শীতলবাবুর বাড়িটা কতদূর?

গাঁয়ের শেষে।

তবে তো কম দূর নয়! ঘোড়ার গাড়ি-ট্যাক্সি পাওয়া যায়? চাকরটাকে পাঠিয়ে দিই, ডেকে আনুক।

ঘোড়ার গাড়ি পাওয়া যায়। এই গাড়ি বাবুদের বাড়ি ফিরে যাচ্ছে, তুমি ইচ্ছে করলে যেতে পারো। রসিকবাবুর বাগানের একটা গাছের দিকে শশী দৃষ্টি নিবদ্ধ রাখিয়াছিল, এবার সে আবার চণ্ডীর দোকানের দিকে চাহিল।

নন্দ কী ভাবিল বলা যায় না, বলিল, সময় থাকলে তোমাদের বাড়ি যেতাম শশী।

সময় না থাকলে আর কথা কি?

সেইখানেই ইতি। নৌকায় গিয়া সুটকেস হইতে আয়না-চিরুনি বাহির করিয়া নন্দ চুলটা ঠিক করিয়া লইল। পানের কৌটা হইতে খানিকটা জর্দা মুখে দিল। গায়ের দামি আলোয়ানটা খুলিয়া রাখিয়া একটা তার চেয়ে দামি শাল গায়ে দিয়া মোটরে উঠিল।

এসো শশী। আমার একটু তাড়াতাড়ি আছে।

সেই যেন এতক্ষণে মোটরের মালিকানা-স্বত্ব পাইয়াছে। তা, সেটা আশ্চর্য নয়। মোটরে চড়ার অভ্যাস নন্দলালের আছে, শশী তো চাপে গোরুর গাড়ি।

শশী বলিল, তুমি যাও। আমার এদিকে কাজ আছে!

কলিকাতা শহর! মোটরে চাপিয়া কলিকাতা শহর গাওদিয়ার দিকে চলিয়া গেল। করিয়া দিয়াছে। বিন্দুর বাড়ি যে-পাড়ায়, সে পাড়াটাও ভালো নয়। নন্দ কি পাগল? পাগল হোক আর যাই হোক, ওকে তো সে অনায়াসে মারিতে পারিত। বৃষ্টিধারার মতো কিল চড় ঘুসি। কতক্ষণ আর সহিতে পারিত? পাঁচ মিনিট। পাঁচ মিনিটের মধ্যে নন্দ পায়ের কাছে গড়াগড়ি দিত। অজ্ঞান অচৈতন্য নন্দ।

তবু, নন্দ হয়তো বিন্দুকে ভালোবাসে।

 

শীত জমিয়া আসে। পৌষ-পার্বণ আসিয়া পড়িতে আর দেরি নাই। গ্রামে অবিরত টেকি পাড় দিবার শব্দ শোনা যায়। আকাশে রবির তেজ কমিয়াছে। মাঠে রবিশস্য সতেজ। মানুষের গা ফাটিতে আরম্ভ করিয়াছে। গায়ে যাহার মাটি বেশি, ঘষা লাগিলেই খড়ি উঠিয়া যায়। লেপ-কাথা খোলা হইয়াছে, বেড়ার ফাঁক গুলিতে ন্যাকড়া ও কাগজ গোজা হইতেছে। মতি একবার জুরে পড়ি পড়ি করিয়া পড়ে নাই। কুসুমের আর একবার পেটব্যথা হইয়া গিয়াছে। পরাণ একদফা গুড় চালান দিয়াছে। এবার তাহার কিছু পাটালি গুড় করিবার ইচ্ছা। শশীর কাছে টাকা ধার করিয়া সে আরও প্রায় চল্লিশটা খেজুরগাছ লইয়াছে। লালীর বাছুরটা নিতাই একদিন যাচিয়া পরাণকে ফেরত দিয়া গিয়াছে।

ছোটোবাবুর জন্যে। নইলে বাছুর তুমি কখনও ফেরত পেতে না। এই কথা বলিয়াছে কুসুম। খেজুরগাছ কিনার জন্য শশীর কাছে পরাণকে টাকা ধার করিতে দিতে কুসুমের নিতান্ত অনিচ্ছা দেখা গিয়াছিল। সবসময় তাহার ইচ্ছা ও অনিচ্ছাকে মর্যাদা দিলে সংসার চলে না, এই যুক্তিতে পরাণ তাহার কথা গ্রাহ্য করে নাই। মোক্ষদার শরীরের অবস্থাটা কিছুদিন হইতে ভালো যাইতেছে না। শশীর বাড়িতে একটি আশ্রিতা মেয়ে, শশীর সে কী সম্পর্ক ভাই-কি হয়, ছেলে হওয়ার সময় ঠাণ্ডা লাগিয়া নিমুনিয়া হইয়া মরিয়া গিয়াছে।

এই ব্যাপারটিতে শশী বড় ধাক্কা খাইয়াছিল! বাড়ির উঠানে সাময়িকভাবে অতি কম খরচে কাঁচা বাঁশের সস্তা বেড়ার একটি ঘর তুলিয়া আতুড়ঘর করা হয় চাল টিনের। ব্যাপার চুকিলে টিনের চালটি ছাড়া ঘরটিকে বিসর্জন দেওয়া হয়। মৃতা মেয়েটির বেলাতেও এই ব্যবস্থাই হইয়াছিল।

এখন, শশীর বাড়িতে এ প্রথা চিরন্তন। শশী নিজেও এমনি একটি কুটিরে জন্মগ্রহণ করিয়াছে, মনে নাই। শশী পৃথিবীতে আসিয়াছিল উলঙ্গ সন্ন্যাসী হইয়া, এখন সে ডাক্তার। পসারওয়ালা ডাক্তার, এমন ব্যাপারও সে ঘটিতে দিল কেন?

সে কি শুধু টাকার জন্য ডাক্তারি শিখিয়াছে? যেখানে যতটুকু কাজে লাগাইলে টাকা মেলে আপনার শিক্ষাকে সেখানে ঠিক ততটুকুই কাজে লাগাইবে? সমস্ত গ্রামকে স্বাস্থ্যতত্ত্ব শিখাইতে যাওয়া বৃহৎ ব্যাপার, ওটা নাহয় সে বাদ দিল, কিন্তু নিজের গৃহে?

না, সে ডাক্তার নয়। ব্যবসাদার। বাহিরে সে টাকা কুড়াইয়া বেড়ায়, বাহিরে সে মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করিবার ভাড়া-করা সৈনিক গৃহে তাহার অস্বাস্থ্যকর আবহাওয়া, মৃত্যুর আধিপত্য।

তারপর কয়েক দিন শশী বাড়িতে স্বাস্থ্যনীতি প্রবর্তনের চেষ্টায় সকলকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তুলিল।

কী দিয়ে দাঁত মাজছিস?

কয়লা দিয়ে।

নিমের দাঁতন দিয়ে মাজ।

তেতো যে! কয়লায় দাঁত কত সাদা হয়!

যে কয়লা দিয়ে দাঁত মাজিত সে কিছুঁতেই নিমের দাতন ব্যবহার করিতে রাজি হইল না।

শশী কি খেপিয়া গিয়াছে? দাঁত মাজিবে, তার মধ্যে এত কাণ্ড কেন!

মাটিতে ওকে মুড়ি দিলে যে কুন্দ? বাটি নেই!

বাটতে দিলে এক খাবলায় সব খেয়ে ফেলবে যে! তখন ফের চেঁচাতে আরম্ভ করবে। ছড়িয়ে দিলাম, খুঁটে খুটে অনেকক্ষণ খাবে।

কুন্দ সগর্বে ছেলেকে নিরীক্ষণ করে। নধর শিশু শশীর চোখে লাগিয়াছে। একটু কোলে নিক না? শশী তাহাকে বোঝায়, বলে, মুড়ির সঙ্গে ছেলে তোর জার্ম খাচ্ছে জানিস? পেটে কৃমি হবে, আমাশা হবে, কলেরা হবে–

কী সব অমঙ্গুলে কথা! কুন্দ বলে, বালাই ষাট ভাবে, ওসব কিছু যদি হয় তো তোমার মুখের দোষে হয়েছে জানব। ডাক্তার হয়েছ বলেই তুমি যা-তা বলবে নাকি? বাছার তুমি গুরুজন, ওর কপালে কথা তোমার ফলেও যেতে পারে, এ খেয়াল তোমার নেই!

কুন্দর ছেলে হামা দিয়া মাটি হইতে খুঁটিয়া খুঁটিয়া মুড়ি খাইতে থাকে দুবেলা। শশীর কথা কুন্দ বিশ্বাস করে না। দু আঙুলে একটি একটি মুড়ি মুখে দিবার সময় ছেলেকে তাহার কী সুন্দর দেখায়।

শশী রাগ করিয়া ধমক দিলে কুন্দ বলে, চুপ করুন শশীদা। ছেলে আপনার নয়। মামা চোখ বুজলে আপনি বাড়ি থেকে খেদিয়ে দেবেন তা জানি।

বাড়ি হইতে তাড়াইয়া দিবার কথাটা কোথা হইতে আসে শশী বুঝিতে পারে না। তবে অবান্তর শোনায় না। কারণ, শশীর মতে বড়ি হইতে খেদাইয়া দেওয়ার উপযুক্ত কুন্দ ছাড়া আর কে আছে?

শশী বলে, পিসি কথা শোনো, ছেলেকে তোমার অত দুধ খাইও না। ওর সিকি দুধ হজম করবার ক্ষমতাও যে ওর নেই।

পিসি ভাবে, হায়রে কপাল! বাড়িতে এত দুধের ছড়াছড়ি, আমার ছেলে একটু দুধ খায়, এ কারো সয় না। কতটুকু দুধই বা ও খায়!

কী জানি কবে ছেলের দুধের বরাদ্দ কমিয়া যায় এই ভয়ে পিসি ছেলেকে আরও একটু বেশি দুধ খাওয়াইতে আরম্ভ করে। দুপুরবেলা শশী ঘরে ঘরে বলিয়া যায় ; ওঠো, উঠে পড়ো সবাই, ঘুমোতে হবে না। শীতকালের দুপুরে ঘুম কিসের?

সকলে একদিন দুইদিন সহ্য করে, হাসিমুখে উঠিয়া বসিয়া হাই তুলিয়া বলাবলি করে ; শশীর হয়েছে কী? এবার বাপু ওর বিয়ে দেওয়া দরকার। কিন্তু কয়েকদিনের মধ্যেই তাহারা বিদ্রোহ করে। যাদের বয়স কম ও স্বামী আছে তারা ভাবে ; আমাদের মতো রাত জাগতে হলে দুপুরে ঘুমোই কেন বুঝতে! যাদের স্বামী নাই, তারা ভাবে : দুপুরবেলা না ঘুমিয়ে করব কী? সময় কাটবে কী করে? শশী বলে, পাগল, স্বাস্থ্য দিয়ে আমাদের কী হবে। গিনীরা, যাদের বয়স হইয়াছে, তারা ভাবে কথাটা বোধ হয় মিথ্যে নয়। দুপুরে না ঘুমুলে অম্বলের জ্বালা বোধ হয় একটু কমে। কিন্তু পেটে ভাতটি পড়লেই চোখ জড়িয়ে আসে, তার কী হবে?

গোপাল শুনিয়া বলে, ও কি শেষে বাড়িতেই ডাক্তারি বিদ্যে ফলাতে আরম্ভ করল নাকি?

সন্ধ্যার পর ঘরে ঘরে শশী একবার বেড়াইয়া আসে। পাকা ঘরের অধিবাসীদের বলে, তোমাদের কান্ডখানা কী! দম আটকে মরবে যে সবাই। সব জানালা বন্ধ, বাতাস আসবে কোথা দিয়ে?

তাহারা হাসে ; জানালা খুলিলে ঠাণ্ডা লাগিবে না? একঘর বাতাস আগে এই কটি প্রাণী নিশ্বাস নিক, দম তো আটকাইবে তবে?

বেড়ার-ঘরের অধিবাসীদের শশী বলে : বেড়ার ফাঁক পর্যন্ত কাগজ দিয়ে বন্ধ করেছ। এর মধ্যে বাতাস দুর্গন্ধ হয়ে উঠেছে। একটা জানালা অন্তত খুলে দাও। কাল নইলে আমি সিলিং কাটিয়া দেব, চাল আর বেড়ার মধ্যে যে ফাঁক আছে তাই দিয়ে পচা বাতাসটা বেরিয়ে যাবে!

কুন্দ বলে, খেমির মতো আমাদেরও নিমুনিয়া করিয়া মারবেন নাকি শশীদাদা? কচি ছেলে নিয়ে কাঁচা ঘরে আছি, কত সাবধানে থাকতে হয় আপনি তার কী বুঝবেন? এ তো দালান নয়, পাকা ঘর তো আমাদেরও ভাগ্যে নেই যে–

প্রত্যেক কথায় কুন্দ এমনি নালিশ টানিয়া আনে। এই তাহার স্বভাব। বাড়ির লোকের স্বাস্থ্য ভালো করার চেষ্টা শশী ত্যাগ করিয়াছে। প্রথমটা ভয়ানক রাগ হইয়াছিল, ক্রমে ক্রমে সে করিয়াছে জ্ঞানলাভ। সে বুঝিয়াছে, তার স্বাস্থানীতি পালন করিতে গেলে জীবনের সঙ্গতি ওদের একেবারে নষ্ট হইয়া যাইবে, অসুখী হইবে ওরা। রোগে ভুগিয়া অকারণে মরিয়া ওরা বড় আনন্দে থাকে। স্ফূর্তি নয়আনন্দ, শান্ত স্তিমিত একটা সুখ স্বাস্থ্যের সঙ্গে, প্রচুর জীবনীশক্তির সঙ্গে ওদের জীবনের একান্ত অসামঞ্জস্য। ওরা প্রত্যেকে রুশৃণ অনুভূতির আড়ত, সংকীর্ণ সীমার মধ্যে ওদের মনের বিস্ময়কর ভাঙা-গড়া চলে, পৃথিবীতে ওরা অস্বাস্থ্যকর জলাভূমির কবিতা : ভাপসা গন্ধ, আবছা কুয়াশা, শ্যামল শৈবাল, বিষাক্ত ব্যাঙের ছাতা, কলমি ফুল। সতেজ উত্তপ্ত জীবন ওদের সহিবে না।

শশী ভাবে। ভাবিয়া অবাক হয় শশী। কুমুদ একদিন এই ধরনের একটা লেকচার ঝাড়িয়াছিল, পৃথিবীসুদ্ধ লোক যে কত বোকা এই কথাটা প্রমাণ করিবার জন্য। কাপড়মাপা গজ দিয়া আমরা নাকি আকাশের রঙ মাপি, জীবনের অবস্থা হিসাবে স্থির করি মনের সুখ-দুঃখ বলি মানুষ দুঃখী, আর রাগে গরগর করি। মিথ্যা তো বলে নাই কুমুদ, শশী ভাবে। চিন্তার জগতে সত্য সত্যই আমাদের স্তর-বিভাগ নাই। বস্তু আর বস্তুর অস্তি ত্ব এক হইয়া আছে আমাদের মনে। কখনও কি ভাবিয়া দেখি মানুষের সঙ্গে মানুষের বাঁচিয়া থাকিবার কোনো সম্পর্ক নাই? মানুষটা যখন হাসে অথবা কাঁদে তখন হাসিকান্নার সঙ্গে জড়াইয়া ফেলি মানুষটাকে মনে মনে মানুষটার গায়ে একটা লেবেল আটিয়া দিই—সুখী অথবা দুঃখী। লেবেল আটা দোষের নয়। সব জিনিসেরই একটা সংজ্ঞা থাকা দরকার। কে হাসে আর কে কাঁদে এটা বোঝানোর জন্য দু-দশটা শব্দ ব্যবহার করা সুবিধাজনক বটে। তার বেশি আগাই কেন? কেন পরিবর্তন চাই? নিঃশব্দে অশ্রু মুছিয়া আনিতে চাই কেন সশব্দ উল্লাস? রোগ শোক দুঃখ বেদনা বিষাদের বদলে শুধু স্বাস্থ্য বিস্মৃতি সুখ আনন্দ উৎসব থাকিলে লাভ কিসের?

আরও মজা আছে। লাভ না থাক, ক্ষতিই বা কী?

ভাবিতে ভাবিতে রীতিমতো বিহবল হইয়া যায় বইকী শশী! সে রোগ সারায়, অসুস্থকে সুস্থ করে। অথচ একেবারে চরম হিসাব ধরিলে শুধু এই সত্যটা পাওয়া যায় রোগে ভোগা, সুস্থ হওয়া, রোগ সারানো, রোগ না-সারানো সমান— রোগীর পক্ষেও শশীর পক্ষেও। এসব ভাবিতে ভাবিতে কত অতীন্দ্রিয় অনুভূতি যে শশীর জাগে! রহস্যানুভূতির এ প্রক্রিয়া শশীর মৌলিক নয় ; সব মানুষের মধ্যে একটি খোকা থাকে, যে মনের কবিত্ব, মনের কল্পনা, মনের সৃষ্টিছাড়া অবাস্তবতা, মনের পাগলামিকে লইয়া সময়ে অসময়ে এমনিভাবে খেলা করিতে ভালোবাসে।

একদিন শশী হারু ঘোষের বাড়ির অদূরে তালবনের ধারে মাটির টিলাটিতে উঠিয়াছিল। বর্ষার পর টিলাটি জঙ্গলে ঢাকিয়া যায়। জঙ্গল ভেদ করিয়া ঢিলার উপর উঠিবার কী দরকার ছিল শশীর? সূর্যাস্ত দেখিবে। দিগন্তের কোলে তরুশ্রেণী যে বাঁকা রেখাটি রচনা করিয়াছে তাহারই আড়াল হইতে দেখিবে সূর্যকে।

কী ছেলেমানুষি শখ নিজের কাছে ছেলেমানুষ হইতে শশীর লজ্জা ছিল না। কেবল শখটি মিটাইতে গিয়া যে মূল্য তাহাকে দিতে হইল আগে জানিলে তাহাতে শশী রাজি হইত না। টিলার উপরে উঠিয়া পশ্চিমদিকে মুখ করিয়া সে যখন দাঁড়াইল তখন তাহার মন শাস্তিতে ভরিয়া আছে। আগামী জীবনের যত ভালো মন্দ কাজ তাহাকে করিতে হইবে তাহা সম্পন্ন করিবার শক্তিতে সহজ বিশ্বাস আছে, সাহস আছে। কিন্তু সূর্য ডুবিবার আগে শশী ভীত হইয়া পড়িল। ছেলেবেলা মাঝরাতে ঘুম ভাঙিয়া এক একদিন তাহার কেমন ভয় করিত, তেমনি ভয়। শশীর সর্বাঙ্গ শিহরিয়া কাঁপিয়া উঠিল। তাহার মনে হইল, কয়েক মিনিটের ভবিষ্যতেও তাহার আর অবশিষ্ট নাই, সে এমনি অসহায়, এমনি ভঙ্গুর। পৃথিবীর বহু উর্ধ্বে, স্তরে স্তরে সাজানো ভয়ের তলে প্রোথিত পৃথিবীর উর্ধ্বে, একটা জঙ্গলাকীর্ণ মাটির টিলার শীর্ষে শশী হঠাৎ হারাইয়া গিয়াছে। সামনে রূপ-ধরা অনন্ত সীমাহীন ধারণাতীত কী যে তাহার চারিদিকে ঘনীভূত হইয়া সীমাবদ্ধ হইয়া আসিয়াছে শশী জানে না; কিন্তু আর কখনও নিশ্বাস সে লইতে পরিবে না।

তারপর কয়েকদিন শশী খুব চিন্তিত ও বিষন্ন হইয়া রহিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *