০৫. মোরাঙ মানেই গ্রামের প্রতিষ্ঠা

০৫.

এই মোরাঙ। মোরাঙ মানেই গ্রামের প্রতিষ্ঠা, গ্রামের মর্যাদা, গ্রামের কৌলীন্য।

কেলুরি গ্রামে তিনটে মোরাঙ। সেগুলোর মধ্যে এই মোরাঙটাই সবচেয়ে বড়, সবচেয়ে কুলীন। সামনের দিকে অর্ধবৃত্তের আকারে বাঁশের দরজা। দরজার দুধারে প্রকাণ্ড দুটো মোষের মাথা বর্শার ফলায় গাঁথা রয়েছে। ওপরে সোনালি খড়ের নতুন চাল। চালের দু’পাশে খড়ের গুচ্ছ দুলছে। দেওয়ালে দেওয়ালে অজস্র আঁকিবুকিতে মোষের রক্তের মাঙ্গলিক চিহ্ন। পৃথিবীর আদিমতম শিল্প।

দু’পাশে হাতে তিরিশেক লম্বা পাহাড়ী বাঁশের দেওয়াল। দেওয়ালের গায়ে বর্শায় ফোঁড়া রয়েছে বাঘের মুণ্ডু, সম্বরের লেজ, মানুষের করোটি, হরিণ আর মোষের ছাল।

দরজা দিয়ে ঢুকেই বসার ঘর। তারপরেই চওড়া পথ চলে গিয়েছে শেষ প্রান্ত পর্যন্ত। সে পথের দুধারে সারি সারি বাঁশের মাচান। গ্রামের অবিবাহিত ছেলেদের রাত্রির বিছানা এই মাচানগুলোর ওপর পাতা হয়। মাচানগুলোর নিচে রাশি রাশি বর্শা, তীর-ধনুক, ঢাল, মেরিকেতসু। নানা আকারের, নানা নামের ভয়াল সব অস্ত্রশস্ত্র। শত্রুর বর্শা থেকে গ্রামরক্ষার সুনিপুণ আয়োজন, ত্রুটিহীন বন্দোবস্ত।

মোরাঙের বসার ঘরে একখানা বাদামি পাথরের আসনে বসে রয়েছে বুড়ো খাপেগা। তার পাশে সেঙাই, ওঙলে, পিঙলেই। সামনের দিকে গ্রামের জন-পনেরো মানুষ।

সেঙাইরা শিকারে বেরিয়েছিল সকালবেলা। নিশ্চয়ই তারা বল্লমের মাথায় পাহাড়ী জানোয়ার কুঁড়ে নিয়ে আসবে। সেই আশায় আশায় বিকেল থেকে গ্রামের লোকেরা মোরাঙে জমায়েত হতে শুরু করেছিল। কিন্তু কয়েক খণ্ড মাংসের প্রত্যাশা তাদের নির্মমভাবে ব্যর্থ হয়েছে।

শীতের রাত এই পাহাড়ের ওপর গহন হয়েছে, গম্ভীর হয়েছে। মাংসলোভীরা অনেকেই উঠে চলে গিয়েছে যার যার ঘরের উষ্ণ শয্যায়। কার্পাস তুলোর দড়িপাকানো লেপের তলায় স্ত্রীর বুকের উত্তাপ নিয়ে রাতটাকে মোহময় করে তোলার কামনায় অনেকে ব্যগ্র হয়ে উঠেছিল।

বাকি যারা, তাদের মাংসের চেয়েও বড় নেশা আছে। সে নেশা গল্পের নেশা। সে নেশা খাটসঙ কাঠের অগ্নিকুণ্ড জ্বালিয়ে তার চারপাশে নিবিড় হয়ে বসে আড্ডা জমাবার নেশা। আড্ডা আর গল্পের আমেজে এক অপরূপ মৌতাত খুঁজে পায় পাহাড়ী মানুষেরা। সেই মৌতাত আরেলা ফুরেলা মতো রঙদার হয়ে ওঠে দুএক চুমুক রোহী মধু পেলে।

মা গি কাঠির পাথরে চকমকি ঠুকে আগুন জ্বালিয়েছে বুড়ো খাপেগা। তারপর দুটো পেন্য গাছের ডালে সেই আগুন দিয়ে মশাল তৈরি করেছে। সমস্ত মোরাঙটা আলোয় ভরে গিয়েছে। পেন্যু গাছের শাখায় স্নেহরস আছে। তাই তার আলো উগ্র নয়। সে আলো আশ্চর্য স্নিগ্ধ, আর নরম।

পেন্যু গাছের মশাল দু’টির চারপাশে বৃত্তাকারে বসেছে অনেকগুলো পাহাড়ী মানুষ। সকলের সামনেই বাঁশের চোঙায় রোহি মধু। মাঝে মাঝে তরিবত করে সেই পানপাত্রে চুক চুক করে চুমুক দিচ্ছে কেউ কেউ। মশালের এই মনোরম আলো, মাঝখানে খাটসঙের অগ্নিকুণ্ড থেকে মধুর উত্তাপ আর রোহি মধুর আস্বাদ–সব মিলিয়ে শীতের রাত্রিটা বড় উপভোগ্য হয়ে উঠেছে।

একজন দুজন করে খাওয়ার পালা চুকিয়ে অবিবাহিত ছেলেরা মোরাঙে ফিরে আসতে। শুরু করেছে। বাইরে শীতের রাত্রি নির্মম হয়ে উঠেছে।

বাদামি পাথরের রাজাসন থেকে খাপেগা বলল, আজ রাতে বরফ পড়বে মনে হচ্ছে।

সকলে মাথা নেড়ে সায় দিল, হু-হু, ঠিক।

খাপেগা বলতে লাগল, আজ শিকার করে কিছুই আনলি না যে সেঙাই? মানুষগুলো এতক্ষণ মাংসের আশায় বসে ছিল। এর শোধ কিন্তু ওরা অন্যভাবে তুলবে। বিয়ের পর তোর প্রথম আওশে ভোজে একটার বদলে তিনটে সম্বর বলি দিতে হবে। একটু থামল খাপেগা। তারপর আবার শুরু করল, তোরা আজকালকার ছেলেরা হলি কী? শিকারে বেরিয়ে খালি হাতে ফিরে আসিস! থুঃ-থু-থুঃ।

অপরাধীর মতো মুখ করে সেঙাই বলল, কী করব বল। বর্শা দিয়ে কুঁড়তে পারলাম না একটা জানোয়ারও। চেষ্টা তো কম করিনি। জুতমতো একটা হরিণও যদি বাগে পেতাম! হুই শয়তান রেঙকিলানটার জন্যে যদি শিকার করা যায়! একটা ভীতু কুত্তা কোথাকার!

বুঝেছি, বুঝেছি। থুঃ থুঃ থুঃ–মাঝখানের অগ্নিকুণ্ডটার ওপর কয়েক দলা থুতু ছিটিয়ে দিল বুড়ো খাপেগা, তোদের একালের জোয়ানদের মুরোদ জানতে আর বাকি নেই। শিকারে গিয়ে খালি হাতে ফিরে আসিস। আমাদের কাল হলে মোরাঙে শুধু হাতে ফিরলে সদ্দারই আমাদের বর্শা দিয়ে ফুঁড়ে ফেলত। তাই তো ভাবি, সেসব দিন গেল কোথায়।

স্মৃতির মধ্যে দিয়ে ধূসর অতীতের দিকে একবার তাকাল বুড়ো খাপেগা। সেই অপরূপ দুঃসাহসী জীবনের অধ্যায়। আজও সেই যৌবনের দিনগুলো পরিষ্কার দেখতে পায় খাপেগা। গভীর রাতে অতিকায় বর্শা নিয়ে শত্রুপক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া। তারপর ধারাল অস্ত্রের ফলা। দিয়ে মুণ্ডু কেটে মোরাঙে নিয়ে আসা। শত্রুর রক্ত দিয়ে দেওয়ালে চিত্তির করা। নাগা পাহাড়ের সেই আশ্চর্য উত্তেজক দিনগুলি খাপেগার বুকের মধ্যে হাহাশ্বাস করে বেড়ায়। একটা বিরাট দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে।

কিছুক্ষণ চুপচাপ। একসময় খাপেগাই বলতে শুরু করল, মোরাঙের দেওয়ালে কী ঝুলিয়ে রেখেছিস তোরা?

সকলে সমস্বরে বলল, কেন, মোষের মাথা, সম্বরের ছাল, বাঘের মুণ্ডু–

ওয়াক থুঃ-থুঃ-থুঃ–অগ্নিকুণ্ডটার দিকে আবার একদলা থুতু ছুঁড়ে দিল খাপেগা। ঘৃণায় তার জীর্ণ মুখখানা কুঁচকে গিয়েছে। এই মুহূর্তে খাপেগাকে ভারি কদর্য দেখাচ্ছে। অতীতের জন্য ব্যগ্র মমতা আর বর্তমান কালকে অক্ষম ঘৃণা–এই দুইয়ের মাঝে খাপেগা অসহায় নিরালম্বের মতো ঝুলছে। বিস্বাদ গলায় সে বলল, জানিস, আগে আমরা জানোয়ার শিকারে যেতাম না। মানুষ শিকারে যেতাম। তারপর সেই মানুষের মুণ্ডু এই মোরাঙের দেওয়ালে দেওয়ালে বর্শায় গেঁথে রাখতাম। আজ যেখানে তোরা মোষের মুণ্ডু রাখিস, সেখানে আমরা রাখতাম শত্রুর মুণ্ডু।

আজ আমিও মানুষ শিকার করেছি। উত্তেজিত ভঙ্গিতে ঘোষণা করল সেঙাই।

হতেই পারে না। অসম্ভব। হু-হু, তোরা করবি মানুষ শিকার! আরে থুঃ-থু-থুঃ–আবার থুতু ছিটাল খাপেগা, এ আমি বিশ্বাসই করি না।

অতীতের সেই গৌরবময় বীরত্বের সঙ্গে বর্তমান পাল্লা দিচ্ছে। এ অসম্ভব। অসম্ভবই নয় শুধু, একেবারেই অবাস্তব। বুড়ো খাপেগার মুখখানা ভয়ানক হয়ে উঠল। তার নিশ্বাস দ্রুত তালে বইছে। ঘোলাটে চোখের ওপর মশালের আলো প্রতিফলিত হয়ে হিংস্র দেখাচ্ছে। মনে হল, খাপেগা এখন হত্যা পর্যন্ত করতে পারে। বার বার মাথা দুলিয়ে সে বলল, অসম্ভব,

অসম্ভব। এ হতে পারে না।

ইতিমধ্যে রাতের খাওয়া চুকিয়ে সব অবিবাহিত ছেলে মোরাঙে ফিরে এসেছে। তারা এবার আগুনের কুণ্ডটার চারপাশে শোরগোল করে উঠল। এতগুলি জোয়ান গলার সম্মিলিত প্রতিবাদে মোরাঙ উচ্চকিত হয়ে ওঠে, কেন অসম্ভব শুনি।

আচমকা সেই চিৎকারকে থামিয়ে দিয়ে গর্জন করে উঠল সেঙাই, আমার কথাটা আগে শোন সদ্দার। তারপর কথা বলিস।

হু-হু, তোর কথা বল। অনেকগুলো জোয়ান সমস্বরে সায় দিল।

অনিচ্ছার সুরে খাপেগা বলল, বল শুনি।

সেঙাই বলতে শুরু করল, আজ দুপুরে একটা সম্বরের তল্লাশে সালুয়ালাঙ বস্তিতে চলে গিয়েছিলাম। সেখানে বর্শা নিয়ে পোকরি বংশের খোনকেকে ফুঁড়ে এসেছি…।

শিকারে যাওয়ার পর সমস্ত ঘটনা বলে গেল সেঙাই। এমনকি তার কাহিনি থেকে মেহেলীও বাদ গেল না।

মোরাঙ কাঁপিয়ে উল্লসিত শব্দ করে উঠল জোয়ান ছেলেরা, হু-হু, অনেকদিন পর জোহেরি বংশের অপমানের শোধ তুলতে পেরেছি।

হো-ও-ও-ও–ও–শীতের রাত চমকে ওঠে। নাগা পাহাড়ের হৃৎপিণ্ড বুঝি শিউরে উঠতে থাকে সে চিৎকারে। ।

একসময় উল্লাসের রেশ ঝিমিয়ে এল।

এতক্ষণ বাদামি পাথরের ওপর বসে বসে একালের জোয়ান ছেলেদের ভাবগতিক লক্ষ করছিল বুড়ো খাপেগা। মস্ত একটা গুটসুঙ পাখির মতো গলা বাড়িয়ে সেঙাইর কথা শুনছিল

সে। এবার বলল, শত্রুকে মারলি তো বুঝলাম। কিন্তু খোনকের মাথা কোথায়?

মাথা আনতে পারি নি। সালুয়ালাঙের অতগুলো মানুষ। মাথা আনতে গেলে মাথা রেখে আসতে হত। ধীরে ধীরে বলল সেঙাই।

এ গল্প আমি বিশ্বাস করি না রে টেফঙের বাচ্চা। আশ্চর্য হিমাক্ত শোনাল খাপেগার কণ্ঠ। এত শীতল সে-স্বর যে জোয়ান ছেলেরা এক নিমেষে একেবারে মিইয়ে গেল কিছুক্ষণের জন্য।

বিব্রত গলায় সেঙাই বলল, বিশ্বাস না হয় রেঙকিলানকে জিগ্যেস করিস। রেঙকিলান আমার পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল।

কোথায় রেঙকিলান? চারিদিকে তাকাতে লাগল বুড়ো খাপেগা।

তার বউর সঙ্গে পাহাড় থেকে বস্তিতে ফিরে এসেছে। সে মোরাঙে আসেনি। খাপেগার পাশ থেকে বলে উঠল ওঙলে।

খাপেগা বলল, বেশ তো, কালকেই জিগ্যেস করব রেঙকিলানকে। অনেক রাত্তির হয়েছে। এখন বোধহয় মাঝরাত পার হয়ে গেছে। যা শয়তানেরা, শুয়ে পড়।

হাতের থাবায় এক মুঠো কাঁচা তামাকপাতা ছিল। সরাসরি মুখের মধ্যে চালান করে উঠে দাঁড়াল খাপেগা। তারপর ফিসফিস করে বলল, এ ব্যাপারটা নিয়ে বেশি চেঁচামেচি করিস না। সায়েবরা আজকাল এদিকে ঘোরাফেরা করছে। সেদিন নাকি সেনুকাঙ বস্তি থেকে মানুষ মারার

জন্যে দুজনকে ধরে নিয়ে গেছে। ওদের কাছে কী সব অস্তর আছে, দূর থেকে তাক করে মানুষ। মারতে পারে। দিনকাল কী যে পড়ল! হতাশায় বিরাট দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল খাপেগার।

অনেকগুলো গোঁয়ার মাথা খাড়া হয়ে উঠল অগ্নিকুণ্ডটার চারপাশে, হুই সব এ গাঁয়ে চলবে, সিধে কথা। আমাদের বস্তিতে সায়েব ঢুকতে দেব না। হু-হু, এদিকে এলে মোরাঙে মাথা রেখে যেতে হবে তাদের।

একজন সরস টিপ্পনী কাটল, কি গো সদ্দার, আমাদের ভীতু বল। এইবার? ভয়টা কাকে ধরেছে শুনি?

মোরাঙ কাঁপিয়ে অনেকগুলো জোয়ানের গলা থেকে অট্টহাসি উঠে আসে।

সাঁ করে ঘুরে দাঁড়াল বুড়ো খাপেগা, ভয় পেয়েছে কে–আমি? কক্ষনো না। খালি সায়েবদের কথাটা মনে করিয়ে দিয়েছিলাম রে টেফঙের বাচ্চারা।

ভারি আপোশ হচ্ছে। অসতর্ক মুহূর্তে কথাটা বেরিয়ে এসে অতীতের পরাজয়কে যেন চিহ্নিত করে গিয়েছে। নিশ্চল দাঁড়িয়ে রইল খাপেগা।

সারি সারি বাঁশের মাচানে অনেকগুলো বিছানা। একটু পর দড়ির লেপের নিচে মধুর উত্তাপে ডুবে গেল জোয়ানেরা। একটি নিটোল, পরিতৃপ্ত ঘুমের ভেতর রাতটুকু কাটিয়ে দেবার সংকল্পে সকলে নিঝুম হয়ে গিয়েছে।

বাঁশের মাচানের তলায় খাটসঙ কাঠের অগ্নিকুণ্ডগুলো এখন নির্জীব হয়ে এসেছে। বাঁশের বেড়ার ফাঁক দিয়ে শীতরাত্রির হিম সাদা ধোঁয়ার আকারে অবিরাম ঢুকছে। আজ নির্ঘাত বরফ পড়বে বাইরের উপত্যকায়।

দড়ির লেপের ভেতর শরীরটা কুণ্ডলী পাকিয়ে গেল সেঙাইর। এখনও ঘুম আসছে না দুচোখের পাতা ভাসিয়ে দিয়ে। শুধু তন্দ্রার মতো লাগছে। আর সেই তন্দ্রা অপরূপ হল একটি নগ্ন নারীতনুর রূপে। সে তন্দ্রা মধুর হল আজ বিকেলের সেই নিঃশব্দ ঝরনার পাশে অনাবৃত এক আদিম সৌন্দর্যের স্বপ্নে। সে স্বপ্নের নাম–মেহেলী। সালুয়ালা গ্রামের মেয়ে সে; তাদের শত্রুপক্ষ। রোজ এ পারের ঝরনার জলে তার কমনীয় শরীর স্নিগ্ধ করে যায় মেয়েটা।

একবার পাশ ফিরল সেঙাই। বাঁশের মাচানটা মচমচ করে ওঠে। তারপর লেপের মধ্য থেকে কচ্ছপের মত মাথাটা বাড়িয়ে দিল সে। বাঁশের দেওয়ালের ফাঁক দিয়ে হিমের রেখা ঘন হয়ে ঢুকছে। আগুনের কুণ্ডগুলো নিভু নিভু। তার স্তিমিত আলোতে বর্শা-গাঁথা মোষের মুণ্ড আর বাঘের মাথাগুলো রহস্যময় মনে হয়। এক ভৌতিক আতঙ্কে চেতনাটা আচ্ছন্ন হয়ে আসে। এর চেয়ে লেপের মধ্যে উষ্ণ অন্ধকারটুকু অনেক বেশি নিরাপদ, অনেক বেশি আরামের। এই অন্ধকারে স্নায়ুতে একটি নগ্ন নারীতনুর স্বপ্নকে সঞ্চারিত করা যায়। তন্দ্রাটা উপভোগ করে তোলা সম্ভব হয়। অতএব মাথার ওপর দিয়ে লেপটাকে আবার টেনে দিল সেঙাই।

মেহেলী! মেহলেী! মেহেলী! ঘুম আসছে না সেঙাইর। শত্রুপক্ষের মেয়ে সে। সালুয়ালাঙের মেয়ে সে। পোকরি বংশের মেয়ে সে। বন্য রক্ত কেমন যেন উদ্বেল হয়ে ওঠে সেঙাই-এর ধমনীতে। এই পোকরি বংশই তার ঠাকুরদার মাথা কেটে নিয়ে গিয়েছে, তারপর বর্শায় গেঁথে ওদের মোরাঙের সামনে ঝুলিয়ে রেখেছে। সেই বংশের মেয়ে মেহলী। তবু কত তফাত, কত ব্যতিক্রম। এর সঙ্গে যেন নিঃসন্দেহে মিতালি পাতানো চলে। মেহেলীর সঙ্গে বর্শার মুখে মুখে কথা বলতে মন সায় দেয় না। নির্জন ঝরনার পাশে তাকে সহচরী হিসেবে পেতে মন ব্যগ্র হয়ে ওঠে।

আঠারো বছরের যৌবনে অনেক অনাবৃত কুমীরদেহ দেখেছে সেঙাই। অহরহ দেখছে। কিন্তু তার পাহাড়ী মনে এমন দোলা আর লাগেনি। এমন মাতালামি আর জাগেনি।

কঠিন পাথরের ওপর শিলালিপি পড়েছে। সে শিলালিপি মেহেলী। অক্ষয় তার দাগ। গভীর তার রেখা। স্মৃতির মধ্যে, চেতনার মধ্যে, তন্দ্রার মধ্যে মেহেলীর উজ্জ্বল দেহ, সোনালি স্তনচূড়া, নিটোল নিতম্ব, মসৃণ উরু চমক দিয়ে দিয়ে উঠছে সেঙাই-এর। এই বিছানাটা মৃত ময়ালের শীতল আলিঙ্গনের মতো মনে হচ্ছে। বুকের ভেতর নিবিড় করে পেতে ইচ্ছা করছে মেহেলীকে।

হঠাৎ শরীরে তীব্র মোচড় দিয়ে বাঁশের মাচানের ওপর উঠে বসল সেঙাই। তারপর দড়ির লেপটা গায়ে জড়িয়ে অতিকায় একটা বর্শা টেনে নিল মোরাঙের দেওয়াল থেকে। এই মুহূর্তে সালুয়ালাঙ গাঁ থেকে সে কি মেহেলীকে ছিনিয়ে নিয়ে আসতে পারে না তার বিছানায়? পারে

এই হিমাক্ত বিছানাকে রমণীয় নারীদেহের উত্তাপে মধুর করে তুলতে?

হ্যাঁ। এই বর্শার মুখে সব বাধা, সব প্রতিরোধ চুরমার করে মেহেলীকে সে নিয়ে আসবে। মোরাঙের দরজার দিকে ছুটে গেল সেঙাই। বাঁশের দরজাটা খোলার সঙ্গে সঙ্গে নিষ্ঠুর আঘাতের মতো আছড়ে পড়ল পাহাড়ী শীতের বাতাস। সঙ্গে সঙ্গে পাল্লাটা বন্ধ করে দিল সে। মুখের ওপর থেকে গুঁড়ো গুঁড়ো বরফ মুছে নিল সে হাতের পাতা দিয়ে।

বাইরের পাহাড়চূড়ায় বরফ পড়তে শুরু করেছে। কোনো উপায় নেই বেরুবার। বুকের মধ্যে, প্রতিটি রক্তকণার মধ্যে কামনার যে আগুন জ্বলছে, তা দিয়ে নাগা পাহাড়ের শীতরাত্রির হিমকে পরাজিত করে পথ করে নেওয়া যাবে না। আজকের রাতটা সেঙাইর বিপক্ষে। সালুয়ালাঙ আজ আকাশের মতো সুদূর। আর একটি সন্ধ্যাতারার মতো মেহেলী ধরাছোঁয়ার অনেক, অনেক বাইরে। আজকের রাত্রিতে মেহেলীর স্বপ্ন নিয়ে একটি আগ্নেয় কামনার মধ্যে। একটু একটু করে দগ্ধ হওয়া ছাড়া আর কোনো উপায়ই নেই সেঙাই-এর।

খ্যাপা একটা বাঘের মতো নিরুপায় ক্রোধে ফুলে ফুলে উঠল সেঙাই। তারপর বর্শাটাকে একদিকে ছুঁড়ে ফেলে বাঁশের মাচানটার দিকে পা বাড়িয়ে দিল।

অনেক কাল আগে পোকরি বংশের মেয়ে নিতিৎসুর জন্য কি তারই মতো তার ঠাকুরদা জেভেথাঙের বুকে এমনি আগুন জ্বলেছিল? চেতনার মধ্যে এমনই মাতামাতি শুরু হয়েছিল?

মাচানের ওপর শুয়ে শুয়ে সেঙাই ভাবতে থাকে, যে পাহাড়ী যুবতী তার আঠারো বছরের যৌবনকে এমন অস্থির করে তুলেছে, তার চোখ থেকে রাত্রির ঘুম ছিনিয়ে নিয়েছে, তাকে পেতে হবে। পেতেই হবে।

অস্ফুট মন, অপরিণত ভাবনা। পেশীময় সবল দেহে চিন্তাগুলি শ্লথ গতিতে ক্রিয়া করে। তবু মেহেলীর ভাবনা উল্কাবেগে ক্রিয়া করছে সেঙাইর মনে। আঠারো বছরের বন্য যৌবনের কাছে রাশি রাশি খাদ্য আর নারীদেহের মতো অমোঘ সত্য আর কী আছে?

ঘুম আসছে না। বাইরের উপত্যকায় গুড়ো গুড়ো বরফ ঝরছে আর মোরাঙের মাচানে তুলোর দড়ির লেপ, খড়ের বিছানা আর আগুনের কুণ্ড রয়েছে। একটি নিটোল ঘুমের এত উপকরণ থাকা সত্ত্বেও আজ রাতে সেঙাইর ঘুম আসবে না।

.

০৬.

পাহাড়ী গ্রামটা একটু একটু করে জেগে উঠছে। অনেক উঁচুতে দক্ষিণ পাহাড়ের শীর্ষে। এখনও শুভ্র তুষারের একটা প্রলেপ পড়ে রয়েছে। তার ওপর কুয়াশা ভেঙে ভেঙে সোনালি সূর্যের দু-একটা জ্যোতির্ময় রেখা এসে পড়েছে। চারিদিকে শুধু মালভূমি আর উপত্যকা, আর তরঙ্গিত পাহাড়ের চড়াই-উতরাই। দিগন্ত ঘিরে সাদা কুয়াশার ঘন স্তর স্থির হয়ে রয়েছে। অপরূপ এই নাগা পাহাড়। অদৃশ্য ঢেউয়ের মতো বয়ে যাচ্ছে বাতাস। সে বাতাসে শীতের হিম মিশে ভয়ানক হয়ে উঠেছে। শরীরের অনাবৃত চামড়ার ওপর কেটে কেটে বসে পাহাড়ী শীতের দাঁত। মেরুদণ্ডের মধ্য দিয়ে অসহ্য তুষারধারা নামতে শুরু করে যেন। হৃৎপিণ্ডের ভেতর। সঞ্চারিত হয়ে যায় একটা তীব্র কনকনানি।

কেলুরি গ্রাম জাগছে। শীতের রাতের সুখনিদ্রার পর সোনালি প্রভাতের ডাক এসেছে। কোখাইরা জেগেছে। যাসেমুদের ঘরে ঘরে ঘুম ভাঙার প্রাথমিক প্রস্তুতি। এর মধ্যেই রোদের প্রার্থনায় ঘরের পেছনে বৃত্তাকার পাথরখানার ওপর এসে বসেছে ফানুসা, ওয়াটেপা। শরীরের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ করে জড়িয়ে নিয়েছে কার্পাস তুলোর দড়ির লেপ।

এলোমেলো ছড়ানো ঘর। নিচু নিচু। সেগুলোর মাথায় নতুন খড়ের চাল। চারপাশে চেরা বাঁশের দেওয়ালে সাঙলিয়া লতা আর বেতের ছিলার কঠিন বাঁধন। বৃষ্টির ছাট থেকে ঘর বাঁচাবার জন্য চালাটাকে সামনের দিকে প্রসারিত করে রাখা হয়েছে।

পাহাড়ের খাঁজে খাঁজে, ওপরে-নিচে ইতস্তত বিক্ষিপ্ত সব ঘর। ঘন অরণ্য ধ্বংস করে। টঘুটুঘোটাঙ ফুলের মতো ফুটে উঠেছে এই নগণ্য পাহাড়ী জনপদ, বন্য মানুষের এই সামান্য উপনিবেশ। গ্রামটি যেন এক টুকরো আদিম কাব্য।

বাড়িগুলোর কোনো প্রত্যক্ষ সীমানা নেই–খেয়াল খুশিমতো যেখানে সেখানে গড়ে উঠেছে।

চারপাশে আবাদের জমি সিঁড়ির মতো ধাপে ধাপে নিচে নেমে গিয়েছে। মাসখানেক আগে ফসল তুলে গোলাঘরে জমা করেছে পাহাড়ীরা। ফসলের জমি তাই এখন রিক্ত, হতশ্রী। শুধু এদিকে সেদিকে এখনও ছড়িয়ে রয়েছে কিছু রাহমু ফল, কিছু পাহাড়ী শসা আর প্রচুর টেরিসা ফল। শীতের মরশুমেও পাহাড়ের প্রাণরস শুষে শুষে উদ্দাম হয়ে উঠেছে বনকলার ঝাড়।

জোহেরি বংশের বাড়িটা পাহাড়ের একটা বড় খাঁজের মধ্যে। গ্রামের মানুষেরা এই বাড়িটাকে বলে জোহেরি কেসুঙ। জোহেরি কেসুঙের ঠিক ওপরেই বিরাট একখানা কপিশ পাথরের চাঙড়। বাঁ দিকে ডালপালাওলা একটা বড় খাসেম গাছ আকাশের দিকে মাথা তুলে দিয়েছে। জোহেরি বংশের বন্য রুচি ফুটে রয়েছে চারপাশের টঘুটুঘোটাঙ আর নানা রঙের আখুশু ফুলে ফুলে। জোহেরি কেসুঙের ওপরে পাহাড়ের উঁচু টিলায় টিলায় জোরি, নিপুরি আর সোচরি বংশের বাড়ি। আর কেলুরি গ্রামের তিন প্রান্তে রয়েছে তিনটে মোরাঙ। ত্রিকোণ গ্রাম–তাই তিনটি কোণে মোরাঙ বসিয়ে গ্রামরক্ষার পাকাপাকি আয়োজন করে রেখেছে কেলুরি গ্রামের মানুষেরা।

কিছুদিন আগে নগদা সু মাসে এদের সবচেয়ে বড় উৎসব নগদা শেষ হয়েছে। সেই উৎসবের ক্লান্তি আর উল্লাসের রেশ এখনও গ্রামখানার স্নায়ুতে স্নায়ুতে জড়িয়ে রয়েছে। আপাতত ফসল তোলার তাগাদা নেই, বীজদানা বোনার ব্যস্ততা নেই। এখন অফুরন্ত অবসর। মধুর আলস্যে দিনগুলো ঢিমে তালে গড়িয়ে গড়িয়ে বয়ে চলেছে এই পাহাড়ী জনপদের ওপর দিয়ে।

অন্য সব বাড়ির মতো জোহেরি কেসুঙেরও ঘুম ভেঙেছে। পেছনে অর্ধবৃত্তাকার পাথরের বেদি। বাইরের দরজা দিয়ে সেই বেদির ওপর এসে বসল বুড়ি বেঙসানু। অনেক বয়স হয়েছে তার। মুখের কুঞ্চন-রেখায় অনিবার্য বার্ধক্য ফুটে বেরিয়েছে। মাথার চুলগুলো শুকনো তামাক পাতার মতো হেজে গিয়েছে। চোখের ওপর পাকা ভ্র দুটো ঝুলে পড়েছে। কানে চাকার মতো বড় বড় পিতলের গয়না; কানের মাঝখান থেকে কেটে নিচে এসে ঝুলছে। হাঁটু পর্যন্ত ময়লা কোন মেনী কাপড়। সারা গায়ে দড়ির লেপ জড়ানো। দুহাতের কবজিতে হরিণের হাড়ের বালা। সমস্ত শরীর থেকে উগ্র আর ভ্যাপসা দুর্গন্ধ উঠে এসে শীতের বাতাসে সঞ্চারিত হয়ে যাচ্ছে।

বেঙসানুর পাশে এসে বসেছে বছর ছয়েকের একটি ছেলে আর বছর তিনেকের একটি মেয়ে। ফাসাও আর নজলি। তার দুই নাতি-নাতনি। বেঙসানু ছেলেমেয়ে দু’টিকে কোলের ভেতর টেনে ঘনিষ্ঠ হয়ে বসল।

ফাসাও বলল, ঠাকুমা, বড় শীত করছে।

হু-হু, আজ বড় শীত। দাঁড়া, এখুনি রোদ উঠবে।

পাহাড়ের চূড়া ঘিরে যে সাদা কুয়াশার স্তর এতক্ষণ গাঢ় হয়ে ছিল, রোদের অবিরাম রাঘাতে এখন তা ছিঁড়ে ছিঁড়ে যাচ্ছে। দক্ষিণ পাহাড়ের শীর্ষে বরফের যে সাদা স্তরটা জমাট বেঁধেছিল, এবার তা একটু একটু করে মুছে যেতে শুরু করেছে। নিবিড় বনের সবুজ ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে।

এতক্ষণ অবিরাম বকর বকর করছিল ফাসাও। কথার পর কথা। সঙ্গতি নেই, একটার সঙ্গে আর একটার সম্বন্ধ নেই। সব এলোমেলো, পারম্পর্যহীন।

শুকনো পাতার মতো ধুসর মাথাটা শুধু নাড়ছিল বুড়ি বেঙসানু। আর মাঝে মাঝে হাতের তালু থেকে কাঁচা তামাক পাকিয়ে জিভের নিচে গুঁজে গুঁজে দিচ্ছিল।

আচমকা ফাসাও বলল, আচ্ছা ঠাকুমা, সূর্য ওঠে কেন?

হু-হু, বল দিকি ঠাকুমা। জোহেরি কেসুঙের চারপাশে আরো কয়েকটি কৌতূহলী কণ্ঠ শোনা গেল।

ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে চারিদিকে একবার তাকাল বুড়ি বেঙসানু। গ্রামের কয়েকটি ছেলেমেয়ে এর মধ্যে ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছে। তারা বেঙসানুর চারপাশে এসে নিবিড় হয়ে বসল।

হু-হু, বল দিকি। বাঁ দিকের পাহাড়ের খাঁজে নিয়ানোদের বাড়ি। সেখান থেকেও দু-একটি গলা বেশ সরব হয়ে উঠেছে।

শীতের সকাল। পাহাড়ী দিগন্ত ঘিরে বিলীয়মান কুয়াশার প্রলেপ। শীতার্ত বাতাস। গালগল্পের মজা দিয়ে, অলস কথার মৌতাত মেখে শীতের সকালটাকে রমণীর করে ভোলার ইচ্ছা সকলের চোখেমুখে, হু-হু, বল দিকি বুড়ি।

আরম্ভ কর সেঙাই-এর ঠাকুমা। কলের গলায় সমান আগ্রহ, সমান তাগাদা, সমান ব্যগ্রতা।

আস্তে আস্তে বলতে শুরু করল বুড়ি বেঙসানু, শোন তবে, সে এক কেচ্ছা। আমি শুনেছি আমার মায়ের কাছে। মা শুনেছে তার ঠাকুরদার কাছে। একটু থামল বেঙসানু। তারপর সকলের মুখের ওপর দিয়ে ঘোলাটে দৃষ্টিটাকে চক্রাকারে পাক দিয়ে আনল। তারও পর যেমন করে মন্ত্র দান করা হয়, ঠিক তেমনই গম্ভীর হয়ে এল তার কণ্ঠস্বর, মন দিয়ে শোন সবাই–

বুড়ি বেঙসানুর গল্প শুরু হল, অনেক কাল আগে, সে কত বছর আগের ব্যাপার তা বলতে পারব না। তবে তখন খুব গরম ছিল। এত গরম যে মানুষেরা একেবারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠল। সূর্য উঠলেই সারা গায়ে জ্বলুনি ধরে, গাছপালা পুড়ে যায়। পাহাড়ের মানুষেরা বলাবলি করলে, নাঃ, এত গরমে একেবারে মরেই যাব। সূর্য আর না উঠলেই বাঁচোয়া। মনের কথা মনে রাখাই ভালো। মুখ ফসকে বেরিয়ে এলেই বিপদ। কিছু লোকজন সে কথা চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে বললে। আর যায় কোথায়? সূর্য ঠিক ঠিক শুনে ফেলেছে।

কিছু সময়ের বিরতি। একমুঠো কাঁচা তামাকপাতা মুখে পুরে বুড়ি বেঙসানু আবার শুরু করল, প্রথম প্রথম যেন এসব কথা শোনেনি, এমন ভাব দেখালে সূর্য। শেষে মানুষের মুখে মুখে এক কথা বার বার শুনতে শুনতে তার ধৈর্য আর রইল না। তার ভারি গোসা হল। হবার তো কথাই। পাহাড়ী মানুষগুলোকে তা জানিস, একটা কথা পেলে তা নিয়ে ছেলেবুড়োর দিনরাত খালি বকর বকর। যাক সে কথা। তারপর হল কি, একদিন সুর্য তো ছয় পাহাড়ের নিচে ডুবে গেল। তার পরদিন সে আর ওঠে না। চারিদিকে অন্ধকার আর অন্ধকার। শীতে মানুষ মরার উপক্রম। সূর্য হল পুরুষ মানুষ, তার তেজ না থাকলে চলে! চাঁদ ওঠে বটে, কিন্তু সে হল মাগী। তার গরম নেই। পাহাড়ের মানুষ যখন শীতে কাঠ হয়ে গেল, তখন সবার টনক নড়ল। জানিস তো, ছটা আকাশ আছে। সেই ছটা আকাশ পেরিয়ে সূর্য ওধারে কোথায় যেন চলে গেছে। অগত্যা সাধ্যসাধনা শুরু হল। মানুষেরা সূর্যকে আনার জন্যে তোক পাঠালে। সূর্য তার কথা শুনল না। জানোয়াররা পাঠাল তাদের রাজা বাঘকে। সূর্যের রাগ তাতেও পড়ল না। পাখির রাজ্য থেকে গেল সবচেয়ে সুন্দর খুগু পাখি। তবুও মন ভিজল না সূর্যের।

এদিকে পাহাড়ের মানুষগুলো শীতে প্রায় সাবাড় হয়ে এসেছে। কোনো উপায় নেই। তখন এক বুড়ো হুন্টসিঙ পাখি বুদ্ধি বাতলে দিল। সে বললে, সূর্য মুরগিকে সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে। তোমরা সব তাকে গিয়ে ধর। সে তাকে ফিরিয়ে আনতে পারবে।

বেঙসানুর চারপাশের ছেলেময়েরা চোখ বড় বড় করে শুনছে। সকলের চোখেমুখে বিস্ময়ের, ভয়ের, কৌতূহলের সাতরঙা রামধনু খেলে খেলে যাচ্ছে।

বুড়ি বেঙসানু খকখক করে কেশে উঠল একবার। তারপর বিরাট শ্বাস টেনে নিল ফুসফুসের মধ্যে। তারও পর আবার আরম্ভ করল, মুরগি অনেক টালবাহানা করে তো রাজি হল। সে বললে, তাকে লাল রঙের মুকুট দিতে হবে। মানুষ, পাখি আর জানোয়ার সব ফাঁপরে পড়েছে। তাই কী আর করে! মুকুট দিতে হল। সেই থেকে মুরগির মাথায় লাল টুপি হয়েছে। যাক, যা বলছিলাম। রাতারাতি ছয় পাহাড় আর ছয় আকাশ ডিঙিয়ে তো সূর্যের বাড়ি এল মুরগি। একেবারে সেই পাতালে। মাঝ পথে ভামবিড়ালের আস্তানা। তাই ভয়ে ভয়ে, চুপিচুপি পার হতে হয়েছে এতটা পথ।

মুরগি সূর্যের হাতে পায়ে ধরে অনেক অনুনয় করলে। কিন্তু সে বড় গোঁয়ার। শত হলেও পুরুষ মানুষ তো। তার মানে লেগেছে। মুরগি বললে, রোজ ছটা আকাশের দরজা ডিঙিয়ে তোমাকে আমাদের পাহাড়ে যেতে হয়। তুমি যখন আসবে, আর এক একটা দরজা পার হবে, সঙ্গে সঙ্গে আমি চিৎকার করে পাহাড়ের লোকজনকে জানিয়ে দেব। সে চিৎকার শুনে তারা তোমায় পুজো করবে। তাহলে খুশি তো? সূর্য তাতেও রাজি নয়।

অগত্যা মুরগিকে পাহাড়ে ফিরতে হবে। কিন্তু পথে সেই ভামবিড়ালের আস্তানা। বড় ভয় করতে লাগল তার। সে বললে, তুমি তো আমার কোনো অনুরোধই রাখলে না সূর্য। কিন্তু একটা কথা তোমাকে রাখতে হবে। আমি এখন পাহাড়ে ফিরে যাব। ছয় আকাশ আর ছয় পাহাড়ের দরজা ডিঙিয়ে আমাকে যেতে হবে। মাঝখানে এক ভামবিড়ালের আস্তানা আছে। সে আমাকে পেলে মেরে ফেলবে। আমার বড় ভয় করছে। সূর্য বললে, আমাকে কী করতে হবে, বল। মুরগি বললে, যখন ভামবিড়ালটা আমার দিকে তেড়ে আসবে, সঙ্গে সঙ্গে আমি ডেকে উঠব। আর তুমি আমাকে বাঁচাতে যাবে। সূর্য বললে, তাই হবে।

মুরগি সূর্যের সেই পাতালবাড়ি থেকে রওনা দিলে। পথে আসতে আসতে এক খাসা বুদ্ধি খেলে গেল তার মাথায়। আকাশের একটা দরজা ডিঙিয়ে সে মিছিমিছি চেঁচিয়ে উঠল। সঙ্গে সঙ্গে সূর্য এসে হাজির। মুরগি বললে, তুমি এখানে দাঁড়াও। তোমাকে দেখে ভামবিড়ালটা পালিয়ে গেল। আমি যাই এবার।

এমন করে আকাশের ছটা দরজায় দাঁড়িয়ে ছবার চেঁচিয়ে উঠল মুরগি। সঙ্গে সঙ্গে সূর্যও তার প্রতিজ্ঞামত এসে হাজির। একসময় পাহাড়ের লোকেরা দেখলে ছয় আকাশ ডিঙিয়ে সূর্য এসে উঠেছে পাহাড়ের ওপর। আলোয় ভরে গিয়েছে চারিদিক। শীত পালিয়েছে। সেই থেকে আজও সেই মুরগিটা আকাশে ছবার করে ডেকে ওঠে। ছয় আকাশের দরজায় দাঁড়িয়ে ছবার ডাকে। বিছানায় শুয়ে শুয়ে আমরা শুনি। তারপর এ পাহাড়ে সূর্য আসে। বুঝেছিস এবার? বুড়ি বেঙসানুর গল্প শেষ হল।

দূর, সাহেবরা তো অন্য কথা বলে। ওপরের জোরি কেসুঙ থেকে বলে ওঠে সারুয়ামারু। বছর পঁচিশেক বয়স। বছরখানেক আগে বিয়ে করে উঁচু টিলার ওপর নতুন ঘর তুলেছে। সেই ঘরের মধ্য থেকে কথাগুলো যেন ছুঁড়ে মারল সে।

ঘোলাটে চোখদুটো ধক করে জ্বলে উঠল বুড়ি বেঙসানুর, কী, কী বললি?

কী আর বলব। কাঁচা তামাক খাস কিনা, নেশার ঘোরে কী যে বলিস, তার ঠিক নেই। সাহেবরা বলে অমন করে সূর্য ওঠে না। শান্ত গলায় বলল সারুয়ামারু।

অমন করে ওঠে না! গর্জন করে উঠল বেঙসানু। তারপরেই তার মুখ থেকে বৃষ্টির মতো কদর্য গালাগালি বেরুতে লাগল, ইজাহান্টসা সালো। নে রিহুগু–

সারুয়ামারুর ভাঁড়ারেও অফুরন্ত গালাগালি মজুদ আছে। সেও বিচিত্র মুখভঙ্গি করে সে সব একটির পর একটি ছুঁড়তে লাগল, আহে ভু টেলো…

অব্যর্থ লক্ষ্য। দুপক্ষই সমান উত্তেজিত। যারা চারপাশে জমায়েত হয়েছিল তারা সকলেই বেঙসানুর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের সমবেত চিৎকার শীতের সকালটাকে কুৎসিত করে তুলেছে। যারা অত্যন্ত উৎসাহী, ঘর থেকে সাঁ করে তারা খারে বর্শা নিয়ে এসেছে। আকস্মিক একটা খণ্ডযুদ্ধের প্রস্তুতি। এর মধ্যে বিস্ময়ের কিছু নেই, হতবাক হবার কারণ নেই। পাহাড়ী গ্রামে বিন্দুমাত্র মতান্তর নিশ্চিত মৃত্যু ডেকে আনে। বর্শার ফলায় ফলায় সমস্ত ঝগড়াঝাটির অবসান হয়।

উত্তেজনায় বেঙসানু উঠে দাঁড়িয়েছিল, কী সব্বনাশ, শয়তানের জন্যে আনিজার রাগ এসে পড়বে বস্তিতে। সূর্য আর উঠবে না। শীতে সবাইকে মরতে হবে। শয়তানের বাচ্চা কোহিমা মোককচঙ গিয়ে লায়েক হয়ে ফিরেছে! ওরে তোরা সব মুরগি নিয়ে আয়, সূর্যের নামে বলি দিতে হবে। সূর্যের রাগ এই বস্তির ওপরে পড়লে আর উপায় নেই।

রুদ্ধশ্বাসে কথাগুলো বলে চলেছে বুড়ি বেঙসানু। একটানা, ছেদহীন। শুধু কথার পর কথা। চেঁচাতে চেঁচাতে গলার স্বর চিরে চিরে যাচ্ছে। সাহেব অন্য কথা বলেছে! ওরে, তোরা শয়তানের বাচ্চাটাকে বর্শা দিয়ে কুঁড়ে ফেল, সাবাড় কর। বস্তির সব্বনাশ হয়ে যাবে ও থাকলে।

এক অপরিসীম আতঙ্কে হঠাৎ মানুষগুলো অসাড় হয়ে গেল। হাতের থাবার মধ্যে বর্শাগুলো থরথর করে কাঁপতে শুরু করেছে। এই মুহূর্তে একটা অনিবার্য সর্বনাশ এসে পড়বে। সূর্যটা হয়তো এখনই আবার নেমে যাবে কোন অদৃশ্য পাতালে। এক ফুকারে হয়তো নিবে। যাবে আলো, মুছে যাবে সমস্ত উত্তাপ। হয়তো এখনই নাগা পাহাড়ের নাভিমূল থেকে কেঁপে কেঁপে উঠবে ভূমিকম্পের তরঙ্গ। প্রচণ্ড গর্জনে এই পাহাড়, এই উপত্যকা উৎক্ষিপ্ত হয়ে যাবে। তারপর খণ্ড খণ্ড হয়ে নীহারিকার মতো ছড়িয়ে পড়বে মহাশূন্যে। আলো নেই, উত্তাপ নেই, শুধু নিঃসীম অন্ধকার। আর সেই অন্ধকারের মধ্যে নিশ্চিত প্রলয়ের প্রহর গুনতে থাকবে এই পাহাড়ের জীবজগৎ। পশু, পাখি, মানুষ–কেউ বাদ যাবে না। কারো নিস্তার নেই সেই অপমৃত্যুর হাত থেকে।

মেরুদণ্ডের মধ্যে শিহরন খেলে যাচ্ছে। মজ্জার ভেতর দিয়ে হিম নামতে শুরু করেছে যেন। পাহাড়ী মানুষগুলো একেবারেই আড়ষ্ট হয়ে গিয়েছে।

একসময় হাউ হাউ করে কেঁদে উঠল বেঙসানু, তোরা এখনও দাঁড়িয়ে আছিস? আগে সূর্যের রাগ কমা, মুরগি নিয়ে আয়। তারপর হুই শয়তানের বাচ্চার মুণ্ডু কাটবি। বস্তিতে এমন লোক থাকলে আর বেঁচে থাকতে হবে না।

প্রচণ্ড একটা ঝাঁকুনি লেগে সমস্ত নিষ্ক্রিয়তা ঝরে গেল মানুষগুলোর। অনিবার্য অপঘাতের কবল থেকে বাঁচার একটা ক্ষীণ আভাস তারা দেখতে পেয়েছে। পলকে বর্শা নামিয়ে রেখে তীরের মতো ছুটে গেল সবাই। এই মুহূর্তে এই উপত্যকা আলোড়িত করে, যেখান থেকে হোক মুরগি সংগ্রহ করে আনতে হবে, আনতেই হবে।

জীর্ণ গলাটা ফুলিয়ে তখনও খেউড় গেয়ে চলেছে বেঙসানু। আর সেই একটানা কণ্ঠসাধনায় তার সঙ্গে সুর মিলিয়েছে তার নাতি আর নাতনি, ফাসাও আর নজলি। অবিরাম সেই কণ্ঠে বাজছে, ইজাহান্টসা সালো–

আর ওপরের টিলায় দাঁড়িয়ে নিরুপায় আক্রোশে একটা খ্যাপা অজগরের মতো ফুলছে সারুয়ামারু। আচ্ছা, সময় এলে সেও দেখে নেবে।

সারুয়ামারুর অপরাধই বা কী? মাঝে মাঝে নুন আনতে অগুনতি পাহাড় আর উপত্যকা ডিঙিয়ে তাকে যেতে হয় মোককচঙ। কখনও বা কোহিমায়। সেখানে একদল বিচিত্র মানুষকে সে দেখেছে। বরফের মতো সাদা গায়ের রং। পরনে হুন্টসিঙ পাখির পালকের মতো ধবধবে পোশাক। সে পোশাক একেবারে গলা থেকে পায়ের পাতায় নেমে এসেছে। চোখের মণি কী আশ্চর্য নীল! কী মনোরম তাদের ব্যবহার! তার মতো আরো অনেক পাহাড়ী মানুষ যায় কোহিমায়। মেলুরি থেকে, টিজু নদীর ওপারের সুদূর উপত্যকা থেকে। রেঙমাপানি আর দোইয়াঙ নদীর পরপারে যে ছোট ছোট জনপদ বিক্ষিপ্ত হয়ে রয়েছে, সেখান থেকেও অনেক মানুষ যায় লবণের জন্য।

বিভিন্ন গ্রাম, বিভিন্ন জাতের সব নাগা। তাদের মধ্যে মনান্তর আছে, মতান্তর আছে। ঝগড়াঝাটিরও অন্ত নেই। তবু মোককচঙে কি কোহিমায় লবণের সন্ধানে যখন আসে তখন তারা খুবই শান্ত, অতিমাত্রায় সংযত।

সেই লবণের খোঁজে কোহিমায় এসে এক বিচিত্র পৃথিবীর সন্ধান পেয়েছিল সারুয়ামারু। এক অপূর্ব জীবনের আস্বাদে চমকে উঠেছিল।

বরফের মতো সাদা সব মানুষ। পরনে ধবধবে, ঢোলা আলখাল্লা। রূপকথার দেশের সংবাদ যেন নিয়ে এসেছে। তাদের পাহাড়ী ভাষা কী চমৎকার করেই না বলতে পারে! এমন একজন বরফসাদা মানুষ তাকে কাছে ডেকে নিয়েছিল। তারপর অন্তরঙ্গ গলায় বলেছে, আমি তোমার শত্রু নই। আমি তোমার আসাহোয়া (বন্ধু)। আমাকে ভয় পেও না। এই নাও।

আচমকা বরফসাদা মানুষটা সারুয়ামারুর গায়ে একটা চাদর জড়িয়ে দিয়েছিল। কচি পাতার মতো রং চাদরটার। শীত ঋতুর দিন। চাদরটা উষ্ণ আমেজের মতো সারা শরীরে লেপটে গিয়েছিল সারুয়ারুমার। চাদরের উত্তাপ প্রচুর আরাম দিচ্ছিল। এমন আচ্ছাদন জীবনে কোনোদিন দেখেনি সারুয়ামারু। তার কোমরের চারপাশে একটা হরিণের ছাল জড়ানো ছিল। তার ওপর কচিপাতা-রং চাদর। ভারি মজা লেগেছিল সারুয়ামারুর।

তবু সংশয় ছিল পাহাড়ী মানুষ সারুয়ামারুর চোখে। শঙ্কিত দৃষ্টিতে এদিক সেদিক তাকাচ্ছিল সে। হাতের মুঠোতে বর্শাটা শক্ত করে ধরা রয়েছে তার।

চারপাশে পাহাড়ী টিলায় ছোট ছোট সব বাড়ি। ঢেউটিনের চাল, প্ল্যাস্টারের দেওয়াল। পাহাড় বেয়ে বেয়ে ময়াল সাপের মতো চড়াই-উতরাই পথ। এই হল কোহিমা শহরের চেহারা। শহরটাকে মনোরম করে তোলার জন্য সর্বত্র ফুলের বাগান।

ডানদিকে লবণের বাজারে রীতিমতো হইচই শুরু হয়েছে তখন। বাঁ দিকে টিনের অসংখ্য ঘর। সেই ঘরগুলোর সামনে বাঁশের মাচা। মাচাগুলোর ওপর বসে রয়েছে অনেকগুলো বরফসাদা মানুষ। সকলেই এক-একজন নাগার সঙ্গে বন্ধুত্ব করে নিচ্ছে। চাদর কি কাপড় জড়িয়ে জড়িয়ে দিচ্ছে তাদের গায়ে।

ইতস্তত ছড়ানো আরো কয়েকজন লোক চোখে পড়ছিল। তাদের গায়ের রং কালো। একই রঙের একই আকারের পোশাকে তাদের দেহ সাজানো রয়েছে। হাতে বিচিত্র ধরনের লাঠি (এর আগে বন্দুক দেখে নি সারুয়ামারু)। সাদা মানুষগুলো মাঝে মাঝে তাদের সঙ্গে কী এক দুর্বোধ্য। ভাষায় কথা বলছিল। বুঝতে পারেনি সারুয়ামারু।

প্রথমে কোনো কথা বলেনি সারুয়ামারু। সাদা মানুষটা মৃদু হেসে জিগ্যেস করেছিল, কেমন লাগছে এই চাদরটা? বেশ আরাম লাগছে তো?

হু-হু। মাথা নেড়েছিল সারুয়ামারু।

এটা তোমাকে দিলাম। খুশি?

লাল লাল অপরিষ্কার দাঁতের পাটি বার করে হেসে উঠেছিল সারুয়ামারু। ভারি খুশি হয়েছে সে।

সাদা মানুষটা আবার জিগ্যেস করেছে, নাম কী তোমার?

আমার নাম সারুয়ামারু।

কোন বস্তিতে থাকো?

কেলুরি বস্তিতে।

বাঃ বাঃ, ভালো। তোমাদের বস্তিতে আমি গেলে সবাই খুশি হবে? দু’টি চোখের নীল মণি সারুয়ামারুর মুখের ওপর স্থির করে জানতে চেয়েছিল সাদা মানুষটা।

এবার সারুয়ামারু বলেছে, আমি কিছু জানি না। আমাদের বস্তির সদ্দার আছে। বস্তিতে ঢুকতে হলে তাকে বলতে হবে। নইলে বর্শা দিয়ে ফুঁড়ে দেবে।

আচ্ছা আচ্ছা, তাই বলে নেব।

কিছুক্ষণ চুপ করে ছিল সাদা মানুষটা। কী একটা গভীর চিন্তায় তলিয়ে যেতে লাগল সে। তারপর ফের বলে উঠল, আমি ফাদার–বুঝলে? আমাকে ফাদার বলে ডাকবে।

সারুয়ামারু মাথা দুলিয়ে রাজি হয়েছিল।

সাদা সাহেব আবারও বলেছে, সাত সমুদ্র তের নদী পেরিয়ে তোমাদের দেশে এসেছি। অনেক, অনেক দূরে আমার দেশ।

কোহিমার পাহাড়শীর্ষ থেকে ধু ধু দিগন্তের দিকে ডান হাতের তর্জনী বাড়িয়ে দিয়েছিল সাহেব। কত দূরে তার বাড়ি? সারুয়ামারু সে দূরত্বের হদিস পায়নি। শুধু দুটো অবোধ চোখে সাহেবের তর্জনীটার দিকে তাকিয়ে ছিল। ছয় আকাশের দরজা ডিঙিয়ে সন্ধ্যার সময় সূর্যটা যে জগতে চলে যায় বিশ্রামের আশায়, হয়তো সেখান থেকে এসেছে এই বরফ-সাদা মানুষটা। বিস্মিত চোখে তাকিয়েই ছিল বন্য মানুষ সারুয়ামারু।

একসময় সাহেবই ফের বলতে শুরু করেছিল, কোহিমায় কী নিতে এসেছ?

নিমক।

নিমকের বদলে কী দেবে?

সম্বরের ছাল, টেরোন্য জানোয়ারের শিং, বাঘের ছাল।

আমি তোমাকে নিমক দেব। একেবারে মাগনা। কোনো কিছুর সঙ্গে বদল করতে হবে না।

আশাতীত খুশিতে জ্বলে উঠেছে সারুয়ামারুর পিঙ্গল চোখ দুটো। সে বলেছে, আমাদের পাহাড়ে নিমকের বড় অভাব। এক কণা নিমক নেই।

নিমক তোমাকে দেব, কিন্তু তার বদলে তোমাকে একটা কাজ করতে হবে।

কী কাজ? চোখেমুখে সংশয় ফুটে বেরিয়েছে সারুয়ামারুর।

কঠিন কিছু না। সব সময় কপালে, বুকে আর দুহাতের জোড়ের ওপর আঙুল ঠেকাতে হবে। বুক, কপাল আর বাহুসন্ধিতে আঙুল ঠেকিয়ে ক্রস আঁকার প্রক্রিয়াটা শিখিয়ে দিয়েছিল পাদ্রী সাহেব। বলেছিল, পারবে?

রীতিমতো উৎসাহিত হয়ে উঠেছিল সারুয়ামারু, হু-হু, খুব পারব। সঙ্গে সঙ্গে ক্রস আঁকার কাজে লেগে গিয়েছিল সে।

পাদ্রী সাহেব বলেছিল, বুক-হাতে-কপালে আঙুল ঠেকাবে আর বলবে যীশু, যীশু।

যীশু?

হ্যাঁ, যীশু। পারবে তো?

খুব পারব।

এবার হুন্টসিঙ পাখির পালকের মতো ধবধবে মুখখানার ওপর তৃপ্তির আর সাফল্যের হাসি ছড়িয়ে পড়েছিল পাদ্রী সাহেবের। পাশের অন্য একটা সাদা মানুষকে ডেকে দুর্বোধ্য ভাষায় অথচ উল্লাসের সুরে কী যেন বলে উঠেছিল সে। সেদিন তা বুঝে উঠতে পারেনি সারুয়ামারু।

একসময় সম্বরের চামড়ায় নুন ঢেলে দিয়েছিল সাদা মানুষটা। অন্তরঙ্গ গলায় বলেছিল, আজ থেকে আমরা হলাম ফ্রেন্ড, মানে তোমাদের ভাষায় যাকে বলে আসাহোয়া (বন্ধু)। কেমন তো? আবার বলছি, আজ থেকে আমাকে তুমি ফাদার বলে ডাকবে।

গোলাকার কামানো মাথাটা দুলিয়ে সম্মতি দিয়েছিল সারুয়ামারু।

পাদ্রী সাহেব আরো বলেছিল, তুমি যা চাও সব পাবে। নিমক পাবে, কাপড় পাবে, জামা পাবে। তবে যা বলেছি তা করতে হবে। আর তোমাদের বস্তি থেকে সবাইকে সঙ্গে করে আনবে। সদ্দারকে নিয়ে আসবে। সকলকে কাপড় দেব, নিমক দেব।

হু-হু। জোরে মাথা ঝাঁকিয়ে, ঘন ঘন ক্রস এঁকে, তারস্বরে চিৎকার করে উঠেছিল সারুয়ামারু, যীশু, যীশু।

এরপর অনেকবার কোহিমায় এসেছে সারুয়ামারু। পাহাড় আর উপত্যকা পাড়ি দিয়ে পাদ্রী সাহেবের কাছে আসতে আসতে তার মনে হয়েছে, একটা রমণীয় নেশার মতো তাকে আকর্ষণ করছে এই শহরটা। বস্তি থেকে অনেককে বহুবার কোহিমায় নিয়ে এসেছে সারুয়ামারু। এমনকি বেঙসানুর ছেলে সিজিটো পর্যন্ত তার সঙ্গে এসেছে। পাদ্রী সাহেব তাদের নিমক দিয়েছে, কাপড় দিয়েছে, চাদর দিয়েছে। আর সকলের কানে কানে এক আলোকমন্ত্র দান করেছে। তা হল যীশুর নামজপ আর ক্রস আঁকার পবিত্র পদ্ধতি।

বিচিত্র সব কাহিনী বলেছে পাদ্রী সাহেব। বিস্ময়কর সব গল্প। সেই গল্প থেকেই সারুয়ামারু জানতে পেরেছিল, সূর্য ওঠার আসল রহস্যটা কী। দিনরাত্রির নেপথ্যে কোন সত্যটা রয়েছে। একটু আগে সেই সত্য ফাঁস করতে গিয়ে রীতিমতো একটা খণ্ডযুদ্ধ আমন্ত্রণ করে এনেছে সে।

.

ইতিমধ্যে পাহাড়ী মানুষগুলো মুরগি নিয়ে এসেছে। প্রত্যেকের হাতের মুঠিতে একটা করে ধরা রয়েছে।

বেঙসানু বলল, আয় তোরা, বাড়ির সামনের দিকে আয়।

জোহেরি কেসুঙটা একটা নিচু দোচালা ঘর। সামনের দিকে খড়ের চাল অনেকটা প্রসারিত। রোদবৃষ্টির হাত থেকে রক্ষার জন্য এই পদ্ধতিতে নাগাদের ঘর তৈরি করতে হয়। দু’দিকে বাঁশের দেওয়াল। সামনের দিকে গোলাকার বাঁশের দরজা। দরজার দু’পাশে লম্বা দুটো বর্শার মাথায় মোষের মুণ্ডু গেঁথে রাখা হয়েছে। ঘরের সামনের চত্বরে মোষ বলির হাড়িকাঠ। খাটসঙ গাছের কাঠ দিয়ে বানানো। পরিষ্কার বোঝা যায়, বাড়ির মালিকেরা জেসেসি ভোজ দিয়ে সমাজকে আর প্রিয়জনদের সন্তুষ্ট করতে পেরেছে।

মোষবলির হাড়িকাঠের ঠিক পাশেই গোলাকার একটা খয়েরি রঙের পাথর। এ পাথর অতি পবিত্র। এ পাথর ঘরের চারপাশ থেকে দুষ্ট প্রেতাত্মাকে হাজার পাহাড় ফারাকে নির্বাসিত করে রাখে। পাহাড়ী মানুষগুলোর তাই বিশ্বাস। এমন পাথর প্রতিটি বাড়ির সামনে সযত্নে রক্ষিত আছে।

সামনের পাথরটার কাছে এসে দাঁড়াল বুড়ি বেঙসানু। ইতিমধ্যে সমস্ত গ্রামটা এসে একেবারে মৌচাকের মতো জোহেরি কেসুঙে ভনভন করতে শুরু করেছে। প্রায় সকলেই অনাবৃত। দু-একজনের দেহে সামান্য আচ্ছাদন। তাদের নানা প্রশ্ন।

কী ব্যাপার?

কী হয়েছে?

আসলে যারা পরে এসেছে তারা কিছুই জানত না। মুরগি আনতে বলার জন্য তারা রীতিমতো চিন্তিত।

কী আবার হবে? কুৎসিত মুখভঙ্গি করে সমস্ত ঘটনাটা বলে গেল বুড়ি বেঙসানু, এবার সব যা। সূর্যের নামে মুরগি বলি দে। সূর্যকে সন্তুষ্ট কর। তা না হলে বস্তি সাবাড় হয়ে যাবে।

যারা পরে এসেছে তারা মুরগির সন্ধানে দিগ্বিদিকে দৌড়ে গেল। যারা মুরগি নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল, তাদের দিকে তাকিয়ে বুড়ি বেঙসানু বলল, তোরা দাঁড়িয়ে রইলি কেন? যার যার বাড়ির সামনে গিয়ে সূর্যের নামে বলি দে।

একে একে সবাই চলে গেল।

খানিকটা পর কতকগুলো নিরীহ পাখির গলা থেকে মরণকাতর চিৎকার বাতাসে ভেসে গেল। আর তাদের উষ্ণ রক্তের রং শীতের প্রভাতের লালিমার সঙ্গে মিশে যেতে থাকে। সেই সঙ্গে অনেকগুলো পাহাড়ী কণ্ঠ থেকে এক করুণ আর্তি, এক শঙ্কিত প্রার্থনা উঠে গেল আকাশের দিকে, সূর্য, তুমি এই বলি নিয়ে সন্তুষ্ট হও। এই বস্তির ওপর তোমার রাগ যেন না পড়ে।

আশ্চর্য! সারুয়ামারুও একটা মুরগি বলি দিয়েছে সূর্যের নামে। আর সকলের সঙ্গে একই প্রার্থনায় গলা মিলিয়েছে, সূর্য, তুমি এই বলি নিয়ে…

সূর্যের উদ্দেশে নিরীহ রক্তের উৎসর্গ শেষ হল।

এতক্ষণে দক্ষিণের পাহাড়চূড়া থেকে সাদা তুষারের আস্তরটা একেবারে মুছে গিয়েছে। একটু একটু করে জ্যোতির্ময় হচ্ছে সূর্য। উপত্যকায় তার উত্তাপ ছড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে। চারপাশের পাহাড়গুলো আরো স্পষ্ট হচ্ছে। নিবিড় অরণ্য পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। অপরূপ রূপময় এই নাগা পাহাড়। মুহূর্তে মুহূর্তে তার রূপবদলের পালা। শীতের সকালের এই নাগা পাহাড়কে আশ্চর্য কমনীয় মনে হয়। তার সব নিষ্ঠুরতা রাত্রির হিমে মুছে একেবারে নির্মল হয়ে গিয়েছে যেন।

মুরগি বলি দিয়ে সকলে আবার ছুটে এসেছে বেঙসানুর কাছে। তাদের হাতে খারে বর্শার ফলা ঝলকাচ্ছে। একটু আগে একটা খণ্ডযুদ্ধের আভাস পেয়েছিল তারা। সারুয়ামারুকে বর্শায় কুঁড়ে ফেলার জন্য পাহাড়ী মানুষগুলো তুমুল শোরগোল শুরু করল। সে শোরগোল বিস্ফোরণের মতো আকাশের দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়তে লাগল।

হো-ও-ও-ও-য়া-আ-আ—

হো-ও-ও-ওয়া-আ-আ—

বেঙসানু আবার নতুন উদ্যমে গালাগালি দিতে শুরু করেছে।

অফুরন্ত উৎসাহ। তার ভঁড়ারে অশ্রাব্য খিস্তির অন্ত নেই।

ওপরে জোরি কেসুঙে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সারুয়ামারু। যেন নিষ্প্রাণ শিলামূর্তি। শুধু তার চোখদুটো অঙ্গারের মতো জ্বলছে। তার থাবাতেও মস্ত এক বর্শা। এই খণ্ডযুদ্ধের সম্ভাবনা তার ধমনীতেও রক্ত ফেনিয়ে তুলেছে। তার চেতনার মধ্যেও গর্জন করে উঠেছে আদিম হিংস্রতা।

সারুয়ামারুর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে তার বউ। নাম জামাতসু। উলঙ্গ তামাটে দেহ। শরীরের মধ্যদেশ অনেকটা স্ফীত হয়েছে। গর্ভধারণের পরিষ্কার ইঙ্গিত ছড়িয়ে রয়েছে চোখের কোলের কালো রেখায়, টসটসে স্তনচূড়ার কৃষ্ণাভায়। একটা লোহার মেরিকেতসু বাগিয়ে স্বামীর পাশে এসে দাঁড়িয়েছে সে।

সারুয়ামারু ও জামাতসু। আদিম মানব আর আদিম মানবী।

জোরি কেসুঙ থেকে মুরগির রক্ত ফোঁটায় ফোঁটায় ঝরছে জোহেরি কেসুঙের ওপর। একটু আগে সূর্যের নামে নির্বিরোধ প্রাণীটাকে উৎসর্গ করেছিল সারুয়ামারু। সেই মুরগির রক্ত। টকটকে লাল। এখনও গোলাকার পাথরের ওপর আতামারী ফুলের মতো পড়ে রয়েছে নিহত পাখিটা।

হো-ও-ও-ও-য়া-য়া—

জোহেরি কেসুঙে শোরগোলটা আরো উদ্দাম হয়ে উঠছে।

কিছু একটা ঘটে যেত নির্ঘাত। তার আগেই ঘটল ঘটনাটা। বুড়ো খাপেগার সঙ্গে জোহেরি কেসুঙে এল সালুনারু। সালুনারু রেঙকিলানের বউ। তার পেছন পেছন এসেছে সেঙাই, ওঙলে, পিঙলেই। তাদের সঙ্গে তিনটে মোরাঙ থেকে অগুনতি অবিবাহিত জোয়ান এসে জোহেরি কেসুঙের চারপাশে গোল হয়ে ভিড় জমাল।

বুড়ো খাপেগা বলল, এখানে তোরা কেউ রেঙকিলানকে দেখেছিস?

না। অনেকে একসঙ্গে বলে উঠল।

সেঙাই বলল, কী তাজ্জবের ব্যাপার, কাল বাইরের পাহাড় থেকে সালুনারুই তো তাকে ডেকে নিয়ে গেল।

আমি! সালুনারুর গলায় বিস্ময় চমক দিয়ে উঠল। সেই সঙ্গে মিশে রয়েছে এক ধরনের বিচিত্র ভয়ের অনুভূতি, আমি তো কাল সারাদিন ঘর থেকে বার হইনি। আমি আবার কখন গেলাম বাইরের পাহাড়ে!

নির্ঘাত তুই। আমরা তিনজনই তোর গলা শুনেছি। হুঙ্কার দিয়ে ওঠে সেঙাই।

ওঙলে বলল, কাল সন্ধের সময় যখন শিকার থেকে আমরা ফিরছিলাম, তখন হুই দক্ষিণের পাহাড়ে আসতে রেঙকিলানকে ডাকল সালুনারু। পিঙলেই, সেঙাই আর আমি সে ডাক শুনেছি। এর মধ্যে কোনো ভুল নেই।

পিঙলেই বলল, কাল রেঙকিলানের কী যেন হয়েছিল। চাল কি রোহি মধু কিছুই খায়নি। এমন যে সম্বরের মাংস, তাও ছোঁয়নি। আমরাই সব খেয়ে ফেলেছিলাম। আর কী জন্যে জানি খুব ভয় পেয়েছিল সে।

বুড়ো খাপেগা চোখের ওপর ঝুলে-আসা ভ্র দুটোকে টেনে তোলার চেষ্টা করল। তার সন্ত্রস্ত গলায় বলল, এ তো বড় তাজ্জবের ব্যাপার। কেলুরি বস্তি থেকে একটা আস্ত মানুষ একেবারে লোপাট হয়ে যাবে রাতারাতি! আমার মনে হচ্ছে, এ কাজ নির্ঘাত হুই সালুয়ালাঙ বস্তির শয়তানদের। তাই যদি হয়, ওদের ছাড়া হবে না। ঘোলাটে চোখ দুটো জ্বলে উঠতে চাইল খাপেগার। ভাঙাচোরা দাঁতগুলো কড়মড় করে উঠল।

ওঙলে বলল, তা হতে পারে। কাল দুপুরে সেঙাই ওদের খোনকেকে বর্শা দিয়ে কুঁড়ে এসেছিল। রেঙকিলানকে মেরে হয়তো তার শোধ তুলেছে।

আচমকা বুড়ো খাপেগা চিৎকার করে ওঠে। একটা দমকা বাতাসের আঘাতে সে যেন ফিরে গেল অনেকগুলো বছরের নেপথ্যে, তার যৌবনকালের বেপরোয়া দিনগুলোতে। তার চিৎকার এই কেলুরি গ্রামটাকে তটস্থ করে তুলল, হো–ও–ও-আ-আ–

হো-ও-ও-ও-য়া-আ-আ–

জোয়ান ছেলেদের গলায় গলায় খাপেগার চিৎকার তীব্র প্রতিধ্বনি তুলল। এমনকি সারুয়ামারুও সে চিৎকারে নিজের গলা মিলিয়েছে। দলপতির এই আদিম আহ্বানে সব পাহাড়ী মানুষই এক, অভিন্ন। এখানে কোনো বিভেদ নেই, মতান্তর নেই। একই হত্যার প্রতিজ্ঞা দিয়ে সকলে গ্রথিত।

আকাশ ফাটিয়ে গর্জে উঠল খাপেগা, সালুয়ালাঙ বস্তির তিনটে মাথা চাই। এই জোয়ানের বাচ্চারা, তিনদিনের মধ্যে আমাদের বস্তির তিনটে মোরাঙে ওদের তিনটে মাথা ঝোলাতেই হবে।

হো-ও-ও-ও-য়া-আ-আ—

এই নগণ্য পাহাড়ী জনপদ থেকে অজস্র কণ্ঠের হুঙ্কার টিজু নদীর দিকে ধেয়ে গেল।

একটু আগে সারুয়ামারুকে বর্শা দিয়ে গাঁথবার জন্য সকলে উত্তেজিত হয়ে ছিল। এই মুহূর্তে নতুন প্রসঙ্গ এসেছে। নতুন সংগ্রামের নির্দেশ এসেছে সর্দারের কাছ থেকে। সারুয়ামারুর কথা ভুলে গিয়েছে সকলে। এমনকি স্বয়ং সারুয়ামারু পর্যন্ত। জোরি কেসুঙ থেকে এবার সে নির্দ্বিধায় নেমে এসেছে নিচে, জোহেরি কেসুঙের পাষাণ চত্বরে। সকলের সঙ্গে নিজেকে মিলিয়ে দিয়েছে সে। এমন একটা ভয়াল মুহূর্তে সেও সবার সঙ্গে একাকার। একই শপথের কঠিন বন্ধনে বাঁধা।

এতক্ষণ বুড়ি বেঙসানু একপাশে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব শুনছিল। একটি কথাও বলেনি। হঠাৎ ভয়ার্ত শব্দ করে উঠল সে, আনিজা! রেজু আনিজা! রাত্তিরে অমন নাম ধরে ডেকে পাহাড়ের খাদে ফেলে দেয় মানুষকে।

আনিজা! চকিত হয়ে সকলে তাকাল বেঙসানুর দিকে।

বুড়ি বেঙসানু। অনেক বছরের অভিজ্ঞতা তার বলিরেখার ভাঁজে ভাঁজে লুকিয়ে রয়েছে। সুপ্রাচীন একটা খাসেম গাছের মতো সে। তার রুক্ষ চুলে বহু ঝড়তুফানের স্বাক্ষর, তার শিরা স্নায়ু-অস্থি-মজ্জায় অনেক কাহিনী, অনেক ইতিহাস লুকিয়ে রয়েছে।

বুড়ি বেঙসানু ফের বলল, যা শুনলুম, তাতে মনে হচ্ছে সালুয়ালাঙের শত্তুরদের কাজ নয়। ছ, এ নির্ঘাত আনিজার কাজ।

আনিজা!

আনিজা!

এতক্ষণ সালুয়ালাঙ গ্রামখানা থেকে তিনটে মাথা কেটে আনার জন্য যারা তুমুল চিৎকার জুড়ে দিয়েছিল, ওই একটি নামের মাহাত্ম্যে তারা একেবারে কুঁকড়ে গিয়েছে। সকলের মুখেচোখে পাণ্ডুর ছায়া নেমে এসেছে। জীবন্ত পাহাড়ী মানুষগুলো মৃত্যুকে অনুভব করছে যেন। এক মারাত্মক শিহরন যেন রক্তের কণায় কণায় সঞ্চারিত হয়ে যাচ্ছে তাদের। আনিজা!

বুড়ো খাপেগা বুড়ি বেঙসানুর কাছাকাছি অনেকটা সরে এসেছে। ফিসফিস করে সে বলল, তা হলে কী করা যায়? তুই কী করতে বলিস বেঙসানু?

তোরা একবার বাইরের পাহাড়টা দেখে আয়। এখন দিনের বেলা, আনিজার ভয় নেই। যদি পেয়ে যাস, তবে মড়াটাকে দেখে আসবি। খবদ্দার হুঁবি না কেউ। ভালো করে খুঁজবি যা।

নীরবে সকলের ভাবগতিক লক্ষ করছিল সালুনারু। উৎকর্ণ হয়ে এতগুলো মানুষের কথা সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে যেন শুষে নিচ্ছিল। আচমকা পাহাড়ী জনপদের এই নিভৃত খাজে জোহেরি কেসুঙকে কাঁপিয়ে কাঁপয়ে আর্তনাদ করে লুটিয়ে পড়ল সে।

.

কিছুক্ষণ পর দক্ষিণ পাহাড়ের খাড়া উতরাই-এর কাছে এসে পড়েছে কেলুরি গ্রামের মানুষগুলো। অনেক নিচে গভীর খাদ। পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে, গাছপালা আর ঝোঁপঝাড়ের জটিল জাল বুনে বুনে সেই খাদের দিকে নেমে গিয়েছে উদ্দাম অরণ্য। ভয়াল অন্ধকার স্তব্ধ হয়ে রয়েছে সেখানে।

উতরাই-এর মাথায় দাঁড়িয়ে সেঙাই বলল, কাল এই দিকেই দৌড়ে এসেছিল রেঙকিলান। রাত্রিবেলা এখান থেকেই একটা গলার শব্দ শুনতে পেয়েছিলাম আমরা। রেঙকিলান বলেছিল, সালুনারু ডাকছে।

বুড়ো খাপেগা বলল, তাই তো, এক কাজ কর। হুই খাদের মধ্যে তারা সবাই খুঁজতে শুরু কর। নিশ্চয়ই আশেপাশে কোথায়ও পড়ে আছে রেঙকিলান।

গ্রাম থেকে শুধু পুরুষরাই এসেছিল। সকলের হাতের থাবায় বিরাট বিরাট বর্শা। সেগুলোর ওপর শীতের সকালের রোদ এসে পড়েছে। ঝিকমিকিয়ে উঠছে ফলাগুলো। পুবের পাহাড়ের চূড়া ছুঁয়ে মালভূমি আর উপত্যকার মধ্য দিয়ে দোল খেতে খেতে সোনালি রোদের ঢল নেমে গিয়েছে পশ্চিম পাহাড়ে। সেখান থেকে আছাড় খেয়ে পড়েছে উত্তর আর দক্ষিণের শৈলশিরে।

কী হবে বল তো সদ্দার?

ও সদ্দার, বড় ভয় করছে।

পাথরপেশী জোয়ান। পাহাড়ের চড়াই-উতরাই থেকে, উদ্দাম জলপ্রপাত থেকে, মালভূমি আর উপত্যকার দিগদিগন্ত থেকে তারা স্বাস্থ্য আহরণ করেছে। এই নিবিড় অরণ্য তাদের দুর্বার সাহস দিয়েছে। চিতার গর্জন থেকে, ডোরাদার বাঘের হুঙ্কার থেকে, ময়াল সাপের ক্রুর দৃষ্টি থেকে তারা পলে পলে সংগ্রামের অধিকার অর্জন করেছে। সর্দারের একটিমাত্র নির্দেশে তারা ছিঁড়ে আনতে পারে শত্রুর মুণ্ডু। বর্শা দিয়ে গেঁথে আনতে পারে দাঁতাল শুয়োরের পালকে। ভিন পাহাড়ের মানুষের হৃৎপিণ্ড ছিঁড়ে আঁজলা আঁজলা রক্ত হিংস্র উল্লাসে ছিটিয়ে দিতে পারে মোরাঙে। সেই রক্ত দিয়ে আঁকতে পারে আদিম পৃথিবীর শিল্পলেখা।

সেই সব জোয়ান পুরুষ, সেই সব পাহাড়ী মানুষ। এই মুহূর্তে তারা ভয় পেয়েছে। শঙ্কাতুর কণ্ঠগুলো তাদের ফিসফিস করছে অস্বাভাবিক আতঙ্কে, কী হবে সর্দার!

এমনকি কেলুরি গ্রামের প্রাচীন মানুষ খাপেগা পর্যন্ত ভয় পেয়েছে। সে বলল, আগে তো রেঙকিলানকে খুঁজে বার কর, তারপর বোঝা যাবে।

জোয়ান পুরুষগুলো দিকে দিকে ছড়িয়ে পড়ল। গাছের ডাল ধরে ঝুলতে ঝুলতে অনেকে নেমে গেল গভীর খাদের মধ্যে। আর চড়াইটার মাথায় দাঁড়িয়ে রইল বুড়ো খাপেগা আর সেঙাই।

অনেকটা সময় কেটে গেল। উপত্যকার ওপর রোদের নরম সোনালি রং একটু একটু করে বদলে যেতে লাগল। এখন বনভূমির দিকে দিকে সবুজ আগুনের মতো সেটা লেলিহান হয়ে জ্বলতে শুরু করেছে।

একসময় অতল খাদ থেকে সারুয়ামারুর গলা ভেসে এল। দু’দিকের পাহাড়ে সে স্বর প্রতিধ্বনিত হতে হতে উঠে আসছে ওপরে, সদ্দার, পেয়েছি। এই তো এইখানে রেঙকিলান, একেবারে মরে কাঠ হয়ে আছে।

হো-ও-ও-ও—

গাছ বেয়ে বেয়ে নিচে নামতে লাগল জোয়ান ছেলেরা।

পাহাড়ী উতরাই-এর মাথা থেকে চিৎকার করে উঠল বুড়ো খাপেগা, খাবার, কেউ মড়া ঘূবি না।

পাশেই দাঁড়িয়ে ছিল সেঙাই। তার দিকে তাকিয়ে খাপেগা বলল, একবার বস্তিতে যা। তোর ঠাকুমা আর সালুনারুকে এক্ষুনি এখানে নিয়ে আসবি। বেঙসানু অনেক কিছু জানে। সে যা বলবে তাই করব। শিগগির যা।

কিছুক্ষণ পর সালুনারু আর বুড়ি বেঙসানুকে সঙ্গে নিয়ে উতরাইয়ে চলে এল সেঙাই। দুজনেই অনাবৃত। রোদ আরো চড়ে উঠছে। প্রকৃতি তাদের উত্তাপ দিচ্ছে। কৃত্রিম আবরণের আর প্রয়োজন নেই।

বুড়ো খাপেগা বলল, রেঙকিলান হুই খাদের মধ্যে মরে পড়ে রয়েছে। এবার কী করতে হবে বেঙসানু?

এ ঠিক আনিজার কাজ। আমি আগেই বলেছিলাম। আমার ছোটবেলায় এই কেলুরি বস্তিতে যখন বউ হয়ে এলাম তখন তিনটে জোয়ানকে রেনজু আনিজা এমন করে সাবাড় করেছিল। হু-হু। বছর খানেক আগে নগুসেরি বংশের বুড়ো হিবুটাক রেঞ্জু আনিজার ডাকে মরেছিল। তোদের মনে নেই? এবার মরল রেঙকিলান। কেন যে আনিজার গোসা হল আমাদের বস্তির ওপর! একটু থামল বেঙসানু। অনেকটা চড়াই-উতরাই উজিয়ে এসেছে সে। শুকনো স্তনের তলায় বুকখানা দ্রুততালে উঠছে, নামছে। ঘন ঘন কয়েকটা নিশ্বাস ফেলে বেঙসানু আবার বলল, রেঞ্জু আনিজা রাত্তিরবেলা মানুষের নাম ধরে ডাকে, তারপর খাদের মধ্যে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়।

আড়ষ্ট চোখে তাকিয়ে ছিল সালুনারু। কিছুই যেন দেখতে পাচ্ছে না সে, কিছুই শুনতে পাচ্ছে না। চেতনা তার নিথর হয়ে গিয়েছে। ঠোঁট দু’টি থরথর করে কাঁপছে।

বুড়ি বেঙসানু বলতে লাগল, নিশ্চয়ই কিছু অন্যায় করেছিল রেঙকিলান। না হলে রেনজু আনিজার রাগ কেন তার ওপর পড়বে! কী করেছিল? কি লো সালুনারু, তুই জানিস?

বুকের ভেতরটা ধুকধুক করে উঠল সালুনারুর। আচমকা সে বলে ফেলল, কাল শিকারে যাবার আগে রাত্তিরে সে মোরাঙে শুতে যায়নি। আমার কাছেই শুয়েছিল। সকালে সেই কাপড়েই শিকারে চলে গেছে।

হা-আ-আ-আ–

জীর্ণ বুকখানার ওপর প্রচণ্ড একটা চাপড় মেরে আর্তনাদ করে উঠল বুড়ি বেঙসানু, কী সব্বনাশ! তুই মাগী এই বস্তিটাকে শেষ করবি। তোর জন্যে আমরা সব সাবাড় হয়ে যাব। মাগী, জানিস না, শিকারে যাওয়ার আগে সোয়ামীর সঙ্গে শুতে নেই? মাগীর ফুর্তি কত! হা-আ-আ-আ—

সদ্দার, ও সদ্দার–অতল খাদ থেকে জটিল বনের মধ্যে দিয়ে ধাক্কা খেতে খেতে ওপরের দিকে উঠে এল শব্দগুলো। খাদের তলা থেকে সারুয়ামারুরা ডাকাডাকি করছে।

দাঁড়া শয়তানের বাচ্চারা। গর্জে উঠল খাপেগা।

খিস্তির কৌটোর ঢাকনা খুলে গিয়েছে বুড়ি বেঙসানুর। বিধ্বস্ত দাঁতগুলো কড়মড় করে উঠেছে তার। ঘোলাটে চোখ দুটো থেকে দু’টি অগ্নিপিণ্ড যেন ছিটকে আসতে চাইছে সালুনারুর দিকে। সমানে চেঁচিয়ে যাচ্ছে বুড়ি বেঙসানু, ইজা হান্টসা সালো। মাগী শয়তানী!

এতক্ষণ চুপচাপ সব শুনছিল সালুনারু। এবার সে ফোঁস করে উঠল, বুড়ি মাগী, চুপ কর। ইজা রামখো! মরেছে, আমার সোয়ামী মরেছে। তোদের কী?

বলে কী সালুনারু! বিশ্বাসঘাতকতা করছে না তো কান দুটো! রেজু আনিজার কাছে এ তো কদর্য অপরাধ। জঘন্য পাপাঁচরণ। দেহমন অশুচি করে শিকারে গিয়ে যে অন্যায় করেছে। রেঙকিলান, তাতে সমস্ত নাগা পাহাড় রেজুর ক্রোধাগ্নিতে ছারখার হয়ে যাবে না? খাপেগা তাকাল বুড়ি বেঙসানুর দিকে। বুড়ি বেঙসানু নির্নিমেষে সালুনারুর দিকেই তাকিয়ে ছিল। হয়তো ভাবছিল কোত্থেকে পাহাড়ী মেয়ে সালুনারু এতখানি দুঃসাহস সঞ্চয় করল! রেজু আনিজা তার স্বামীকে খাদের মধ্যে ফেলে দিয়ে পাপের শাস্তি দিয়েছে। পাহাড়ের টিলায় টিলায় ঘা খেতে খেতে অতলে গিয়ে তিলে তিলে মরেছে রেঙকিলান। তবু সালুনারু এতখানি তেজ পেল কোত্থেকে?

সালুনারুর গলায় নীল শিরাগুলি ফুলে ফুলে উঠছে। পিঙ্গল চোখ দু’টি ধকধক করছে। আর সমানে গালাগাল দিয়ে চলেছে সে।

আচমকা সেঙাই-এর হাত থেকে বর্শাটা কেড়ে নিল বুড়ো খাপেগা। তারপর বিদ্যুৎ ঝিলিকের মতো আকাশের দিকে উঠে গেল তার হাতখানা। গলাটা চাপা হুঙ্কারে গমগম করে উঠল, এই শয়তানী বস্তিতে থাকলে বস্তি জ্বলে পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে। ওর রক্ত দিয়েই রেজু আনিজার রাগ কমাব।

বর্শাটা আকাশের দিকেই রয়ে গেল। বুড়ো খাপেগা সেটা ছোঁড়ার আগেই পাশের খাসেম ঝোপে লাফিয়ে পড়ল সালুনারু। সেখান থেকে দূরন্ত গতিতে একটি উলঙ্গ নারীদেহ উপত্যকার ঘন বনে অদৃশ্য হয়ে গেল।

চিৎকার করে উঠল বুড়ি বেঙসানু, ধর সেঙাই, শয়তানীকে ধর। বর্শা দিয়ে ফোড়। সাবাড় করে ফেল।

নিশ্চল শিলামূর্তির মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে সেঙাই। একেবারেই নিস্পন্দ সে। এতটুকু চাঞ্চল্য নেই তার সারা দেহে। নিথর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। তাকিয়েই আছে উপত্যকার দিকে। ওই। দিকেই ঘন বনের মধ্যে সালুনারুর নগ্ন দেহটা মিলিয়ে গিয়েছে।

বর্শাটা নামিয়ে বুড়ো খাপেগা হুমকে ওঠে, আচ্ছা মাগী, একবার বস্তিতে এসে দেখিস, টুকরো টুকরো করে কাটব।

খাপেগার ঘোলাটে চোখ দু’টি দপদপ জ্বলতে লাগল।

.

০৭.

আর কয়েকদিন পরেই জা কুলি উৎসব শুরু হবে পাহাড়ী জনপদগুলোতে। তারই প্রস্তুতি চলছে কেলুরি গ্রামে। গানবাজনা হবে, মোষ বলি দিয়ে সারা গ্রামের লোক ভোজ খাবে। খুশিতে, হুল্লোড়ে, রোহি মধুর মৌতাতে, নাচগানের মধুর নেশায় পাহাড়ী মানুষগুলো মাতাল হয়ে যাবে। জা কুলি উৎসবের দিনরাত্রি, প্রতিটি মুহূর্ত এই পাহাড় ঝুঁদ হয়ে থাকবে।

কাল রাতে উত্তরের পাহাড়চূড়া ঘিরে বরফ পড়েছিল। ঘন সবুজ চক্ররেখার ওপর তুষারের সাদা একটা স্তর এখনও স্থির হয়ে রয়েছে। তার ওপর এসে পড়েছে সোনালি রোদ।

মোরাঙের বাঁশের মাচানে শুয়ে শুয়ে উত্তরের পাহাড়চূড়া দেখতে দেখতে সেঙাই-এর মনে আমেজ ঘন হয়। জা কুলি মাসে এখন অখণ্ড অবসর। শুয়ে শুয়ে মধুর আলস্যে দিনগুলো এই পাহাড়ী জনপদের ওপর দিয়ে খুশির মিছিল হয়ে মিলিয়ে যাচ্ছে।

উত্তর পাহাড়ের বরফ দেখতে দেখতে মেহেলীর কথা মনে পড়ে সেঙাই-এর। বুকের ভেতরটা তোলপাড় হয়ে যায়। দ্রুত বাঁশের মাচানের ওপর উঠে বসল সেঙাই। মেহেলী তার বন্য পাহাড়ী মনকে দিনরাত উথলপাথল করছে, তার আধফোঁটা চেতনাকে অস্থির করে দিচ্ছে। বার বার।

ইতিমধ্যে পাশের মাচান থেকে উঠে এসেছে ওঙলে। সারা গায়ে দড়ির লেপ জড়ানো। ওঙলে বলল, কিরে সেঙাই, কী করছিস?

মেহেলীর কথা ভাবছি। সালুয়ালাঙের হুই ছুঁড়িটার জন্যে মনটা কেমন জানি করে।

এর আগেই ওঙলেকে মেহেলীর কথা বলেছে সেঙাই।

হু-হু–বুঝতে পেরেছি। ওঙলের মুখখানা গম্ভীর হল, পিরিতে পড়েছিস। কিন্তু মোরাঙে বসে এসব কথা বলা ঠিক নয়। সদ্দারের কানে গেলে মুশকিলে পড়ব।

ঠিক বলেছিস, কিন্তু হুই শয়তানীর জন্যে মনটা বেসামাল হয়ে গেছে। কী করা যায় বল তো? একটা বুদ্ধি বাতলে দে। আরো দু-তিন দিন গেলাম হুই ঝরনাটার কাছে, কিন্তু ছুঁড়িটা আজকাল আর আসে না। মন ভীষণ খারাপ হয়ে রয়েছে ওঙলে। গলাটা ব্যাজার শোনায় সেঙাই-এর।

চল, এখন বাইরে চল। বাঁশ কাটতে যাব নদীর কিনারে। আর কদিন পরেই জা কুলির গেন্না শুরু হবে। খুলি (বাঁশি) বানানো দরকার।

বাঁশের মাচান থেকে নিচে নামল সেঙাই। দড়ির লেপটা সারা গায়ে ভালো করে জড়িয়ে মোরাঙের বাইরে চলে এল।

সূর্যটা পুবের পাহাড়ের ওপর আরো স্পষ্ট হয়েছে। তার সোনালি আলোতে এখন কমলা রঙের আভাস দেখা দিয়েছে। দূরের কেসুঙে কেসুঙে, পাথরের চত্বরে বসে মেয়েরা লেপ বুনছে, জঙগুপি কাপড়ে রং দিচ্ছে, কেউ কেউ হরিণের ছাল ছাড়াচ্ছে ছুরি দিয়ে।

ইতিমধ্যে আরো কয়েকটি জোয়ান ছেলে বেরিয়ে এসেছে মোরাঙ থেকে। তাদের মধ্যে একজন বলল, কি রে সেঙাই, কোথায় যাচ্ছিস?

একটু ঠাকুমার সঙ্গে দেখা করে আসি।

যা। আমরা নদীর কিনারে বাঁশ কাটতে যাচ্ছি। খুলি (বাঁশি) আর খুঙ (দোতারার মতো বাদ্যযন্ত্র বানাতে হবে। আর তো মোটে কয়েকটা দিন, তার পরেই জা কুলির গেন্না শুরু হবে।

তোরা যা। আমি আর ওঙলে একটু পরে যাচ্ছি। সেঙাই বলল।

হো-ও-ও-ও-আ-আ–

হইহই করতে করতে টিজু নদীর দিকে চলে গেল জোয়ান ছেলেরা। তাদের মুঠিতে বর্শা রয়েছে, ঝকঝকে দা রয়েছে, তীরধনুক রয়েছে।

জোহেরি কেসুঙের দিকে আসতে আসতে ওঙলে বলল, কী ব্যাপার রে সেঙাই? ঘরে যাচ্ছিস যে!

হু-হু। গোলাকার কামানো মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে হাসল সেঙাই। লাল লাল অপরিষ্কার দাঁতগুলো বেরিয়ে পড়ল তার, বল তো ওঙলে, কী জন্যে এলাম?

তা আমি কী করে জানব?

চল, দেখলে বুঝতে পারবি।

এখনই বল, নইলে ভালো লাগছে না আমার। আপোটিয়া। বিন্দু বিন্দু বিরক্তি ঝরে পড়ল ওঙলের কণ্ঠ থেকে, যা বলবি, মন সাফ করে বলবি। তা নয়, পরে জানবি! তুই যেন কেমন ধারা হয়ে যাচ্ছিস সেঙাই!

বুড়ি বেঙসানু বাইরের ঘরে বসে বেতের আখুতসা (চাল রাখার পাত্র) বুনছিল। দু’পাশ থেকে দু’টি কাঁকড়ার দাঁড়ার মতো তাকে চেপে ধরেছে ফাসাও আর নজলি। তার নাতি নাতনি।

সেঙাই আর ওঙলে বাইরের ঘরে চলে এল। সেঙাইদের দেখে কল কল করে উঠল ফাসাও আর নজলি। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ওদের ঘাড়ের ওপর।

ফাসাও বলল, দাদা, আমাকে এবার জা কুলি গেন্নার দিনে একটা খুলি (বাঁশি) দিবি?

নজলি বলল, আমাকে কিন্তু খুঙ বানিয়ে দিতে হবে। দিবি তো?

দেব দেব। এবার সরে বোস হুই দিকে।

কাঁধের ওপর থেকে ফাসাওদের ঝেড়ে ফেলল সেঙাই আর ওঙলে।

বুড়ি বেঙসানু বলল, কি রে সেঙাই, তোর পাত্তাই নেই। তোর বাপ সিজিটো শয়তানটা সেই যে কোহিমা গেছে, ঘরে ফেরার আর নাম নেই। ওরে শয়তানের বাচ্চা, ঘরে এক ফোঁটা নিমক নেই। একবার তোকে কোহিমায় যেতে হবে। নইলে নিমক ছাড়া ভাত গিলবি কী করে?

থাম, থাম ঠাকুমা। নিমক আনতে আমি পারব না। চোখেমুখে বিরক্তি ফুটে বেরুল সেঙাইর, হরিণের ছাল, মোষের শিং, বাঘের দাঁত হুই সারুয়ামারুকে দিয়ে দিস। সে নিমক এনে দেবে।

না না, ওর হাতের নিমক খাব না। শয়তানের বাচ্চা সূর্যের নামে যা তা বলেছে সেদিন। বুড়ি বেঙসানু হেজে যাওয়া চুলগুলো ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে বলল, ওকে সেদিন বর্শা দিয়ে কুঁড়লে শান্তি হত। ও হল আস্ত শয়তানের বাচ্চা

বুড়ি বেঙসানুর মুখ থেকে শীতের এই হিমাক্ত সকালে কদর্য গালাগালি বেরিয়ে এল। গর্জন করে উঠল সেঙাই, থাম বলছি বুড়ি মাগী, নইলে গলা টিপে ধরব। আগে খেতে দে। বড় খিদে পেয়েছে।

এখনও থামেনি বুড়ি বেঙসানু। জল তালে সমানে বকবক করে চলেছে। আচমকা বাঁশের দেওয়াল থেকে একটা বর্শা টেনে বার করল সেঙাই, তারপর সমস্ত কেসুঙটাকে কাঁপিয়ে হুমকে উঠল, থামলি, থামলি! নইলে বর্শা দিয়ে তোকে আজ ফালা ফালা করব। থাম শয়তানী।

নিমেষে বুড়ি বেঙসানুর জিভের বাজনা থেমে গেল। দ্রুত শীর্ণ হাতের মুঠি থেকে অসমাপ্ত বেতের আখুতসাখানা নামিয়ে রেখে ভেতর দিকের ঘরে চলে গেল। একটু পরেই একটা কাঠের বাসনে খানিকটা ঝলসানো বুনো মোষের মাংস আর বাঁশের পানপাত্রে খানিকটা রোহি এনে নামিয়ে রাখল সেঙাইদের সামনে। তারপর অস্ফুট গলায় তর্জন করে উঠল, আপোটিয়া, আপোটিয়া (মর-মর)–

পুরোপুরি ঝলসানো নয়, কঁচা কাঁচা সেই অর্ধদগ্ধ মাংস লাল দাঁতের পাটির ফাঁকে ফেলে পরিত্রাহি চিবোতে লাগল সেঙাই আর ওঙলে। মাঝে মাঝে দু-এক চুমুক রোহি মধু গিলে রসনাকে বেশ তরিজুত করে রাখতে লাগল।

মেজাজটা এবার অনেকখানি প্রসন্ন হয়েছে। সেঙাই বলল, তোর সঙ্গে একটা কথা বলতে এলাম ঠাকুমা।

কী কথা রে টেফঙের বাচ্চা? রক্তচোখে তাকাল বুড়ি বেঙসানু।

আমি বিয়ে করব। আমার একটা বউ চাই। না হলে রাত্তিরে মোরাঙে একা একা ঘুম আসে না। বড় বড় গজদাঁতের ফাঁকে একটা মোটা হাড়কে কায়দা করতে করতে বলল সেঙাই।

ইতিমধ্যে আবার বেতের আখুতসাটা হাতের মুঠিতে তুলে নিয়েছে বুড়ি বেঙসানু, বিয়ে করবি, সে তো ভালো কথা। তোর বাপ কোহিমা থেকে আসুক। তারপর তোর শ্বশুরকে টেনেন্যু মিঙ্গেলু (কন্যাগণ) পাঠিয়ে দেব।

আমার বউ কে? শ্বশুর কে?

অনেক ছোটবেলা থেকে তোর বউ ঠিক হয়ে আছে। থেমাকেডিমা বস্তির মেয়ে লেটিনোকটাঙের সঙ্গে তোর বিয়ে হবে। ওদের বংশও বেশ বনেদি। নগুসেরি বংশ। আর তোর শ্বশুরের নাম হল সাঞ্চামবাতা। কি রে, খুশি তো? দু’টি ধূসর চোখের মণিতে কৌতুকের আলো জ্বালিয়ে তাকাল বুড়ি বেঙসানু, বউ এলে আর একা একা থাকতে হবে না। তোর বাপ কোহিমা থেকে ফিরলেই তোর বিয়ে দেব।

আচমকা এই বাইরের ঘরটা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠল সেঙাই, না না, হুই লেনটিনোকটাঙকে আমি বিয়ে করব না। এই বস্তিতে থেমাকেডিমা বস্তির কেউ এলে একেবারে বর্শা দিয়ে কুঁড়ে মারব। খুব সাবধান।

শঙ্কার কয়েকটি রেখা ফুটল বুড়ি বেঙসানুর মুখেচোখে, লেনটিনোকটাঙকে বিয়ে করবি না তো, কাকে বিয়ে করবি?

মেহেলীকে বিয়ে করব।

মেহেলী আবার কে?

ওঙলে বলল, সালুয়ালাঙ বস্তির মেয়ে। ওদের বংশ হল পোকরি।

ধক করে একটা মশালের মতো জ্বলে উঠল বুড়ি বেঙসানু, ও, সেই নিতিৎসুদের বংশ! সেঙাই-এর ঠাকুরদাকে যারা মেরেছে তাদের মেয়ে? কি রে ওঙলে শয়তান?

হু-হু– মাথা নাড়ল ওঙলে।

দেখব কত বড় তাগদ সেঙাই-এর। হুই বংশের মেয়ে কেড়ে আনতে গিয়ে মরেছে আমার সোয়ামী। তার নাতির আবার শখ হয়েছে। নির্ঘাৎ মরবে সেঙাই রামখোটা। বুড়ি বেঙসানু তারস্বর চিৎকারে জোহেরি কেসুঙের সকালটাকে ছত্রখান করে ফেলল।

বর্শার খোঁচা লেগে যেমন করে বুনো মোষ ফুঁসে ওঠে, ঠিক তেমন করেই ফুঁসছিল সেঙাই। লাল লাল দু’পাটি দাঁত তার কড়মড় করে উঠল, তুই দেখিস বুড়ি মাগী, আমি তোর সোয়ামী । জেভেথাঙ না। আমি সেঙাই। হুই পোকরি বংশের মেহেলীকে লড়াই করে এনে আমি বিয়ে করব। হু-হু।

দৌড়ে ঘর থেকে বাইরে বেরিয়ে এল বুড়ি বেঙসানু। চারিদিকে ঘুরে ঘুরে সে চিৎকার করতে লাগল, এই সারুয়ামারু, এই নড্রিলো, এই গ্যিহেনি, এই ইটিভেন, তোরা সব শোন। টেফঙের বাচ্চা হুই সেঙাই পোকরি বংশের মেয়ে মেহেলীকে কেড়ে এনে বিয়ে করবে। শোন তোরা, শয়তানের মদ্দানির কথাটা শোন।

আশেপাশের কেসুঙ থেকে অর্ধ-উলঙ্গ মেয়েপুরুষের মিছিল নেমে এল জোহেরি কেসুঙে। বুড়ি বেঙসানুর চারপাশে অনেকগুলো কৌতূহলী কণ্ঠস্বর শোনা গেল, কি লো, কী হল আবার? সেঙাইর বিয়ে? বেশ তো।

বিয়ের ভোজে সম্বরের মাংস খাওয়াতে হবে কিন্তু।

ওরে শয়তানের বাচ্চারা, ওরে টেফঙের বাচ্চারা, ভোেজ গিলতে এসেছিস? ভাগ, ভাগ। ইজাহান্টসা সালো। বুড়ি বেঙসানু একটানা চিৎকার করে চলল, ভোজ খাবে সব! খাবি খাবি, হুই সেঙাইর মাংস দিয়ে ভোজ খাবি। ওর ঠাকুরদা নিতিৎসুর জন্যে মরেছে। ও আবার যাবে মেহেলীকে আনতে। হুই পোকরি বংশের মাগী! ঠিক মরবে শয়তানটা। তখন ওর মাংস দিয়ে ওর বিয়ের ভোজ খাস।

আচমকা বাইরের ঘর থেকে একটা বর্শা উল্কাবেগে বেরিয়ে এল। আর এসে গেথে গেল বুড়ি বেঙসানুর কোমরের ওপর। আর্তনাদ করে পাথরের ওপর লুটিয়ে পড়ল সে। খানিকটা লাল টকটকে রক্ত ফিনকি দিয়ে কেসুঙটাকে ভিজিয়ে দিল।

বাইরের ঘরে একটি উত্তেজিত কণ্ঠস্বর গর্জন করে চলল সমানে। সেঙাই চেঁচাচ্ছে, দেখিস বুড়ি শয়তানী, হুই মেহেলীকে আমি বিয়ে করতে পারি কিনা। আমি জেভেথাঙের মতো মাগী না, কুত্তা না। দেখিস–

.

০৮.

শীতের মাঝামাঝি জা কুলি উৎসব শেষ হল ছোট্ট পাহাড়ী গ্রাম কেলুরিতে। এই মাসটাকে পাহাড়ী মানুষেরা বলে জা কুলি সু।

শীতের প্রথম দিকে জমিগুলোকে রিক্ত করে ফসল উঠেছিল। সিঁড়ির মতো ধাপে ধাপে নিচের দিকে নেমে গিয়েছে আবাদের খেত। নীরস পাথরের ওপর যেখানেই একটু মাটি রয়েছে সেখান থেকেই ফসলেরা লক্ষ শিকড় বিস্তার করে প্রাণরস শুষে নেয়। শীতের প্রথম দিকে শস্য উঠে যাবার পর খেতগুলো অনাবৃত আকাশের নিচে পড়ে পড়ে রোদ পোহায়। সূর্যের উত্তাপে সোনালি খড় শুকিয়ে বারুদের মতো হয়ে থাকে। জোয়ারের শস্যহীন গোড়াগুলো তীক্ষ্ণধার হয়ে যায়। জমির ফাটলের মুখ থেকে লকলকিয়ে ওঠে পাহাড়ী ঘাসের অঙ্কুর। উঁকি দেয় বুনো লতার আশ্চর্য সবুজ মাথা।

প্রথম শীতের ফসলবতী জমি মাঘের এই হিমাক্ত দুপুরে অদ্ভুত রকমের হতশ্রী। দিকে দিকে তার শ্মশান-শয্যা যেন বিকীর্ণ হয়ে রয়েছে।

দক্ষিণ পাহাড়ের এই উপত্যকা অনেকটা সমতল। জমিগুলো বিশাল একটা ঢেউ-এর মতো দোল খেয়ে খেয়ে দূরের মালভূমিতে গিয়ে মিশেছে।

সামনের ঘন বন ছুঁড়ে ফসলের খেতে এসে দাঁড়াল অনেকগুলো মানুষ। নারী আর পুরুষ, দুই-ই রয়েছে তাদের মধ্যে। কেউ কেউ একেবারেই উলঙ্গ, আর কারো দেহে খুব অল্প আচ্ছাদন।

সামনের দিকে রয়েছে সেঙাই, ওঙলে, পিঙলেই, এমনি আরো কয়েকজন। সকলের মুঠিতে পেন্য কাঠের জ্বলন্ত মশাল। কেউ কেউ বর্শাও নিয়ে এসেছে। এদিকে সেদিকে ঘুরছে পোষা শুয়োর। গোটাকয়েক বিচিত্র রঙের শিকারি কুকুরও এসেছে সেঙাইদের সঙ্গে।

শীতের আকাশ থেকে নরম রোদ নেমে এসেছে। উপত্যকার ওপর দুপুরটা যেন রোহি মধুর নেশার মতো ঝিম মেরে আছে।

সেঙাই বলল, জা কুলির পরবে এবার তেমন আনন্দ হল না।

সকলেই মাথা নেড়ে নেড়ে সায় দিল।

কানের লতিতে চাকার মতো একজোড়া পেতলের এসে দুল নেড়ে একটি মেয়ে বলল, হু-হু, এবার রেঙকিলানটা নেই। বড় ফুর্তিবাজ ছেলে ছিল সে।

সকলেই সমস্বরে সায় দিল, হু-হু, ঠিক কথা। তির্যক চোখে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে ছিল সেঙাই, কি লো হেজালি, রেঙকিলানের জন্যে দেখি পরান উথলপাথল করছে। তলায় তলায়। পিরিত জমিয়েছিলি নাকি?

হেজালি ফোঁস করে উঠল, আমার অমন মরদের দরকার নেই। একটা মাগী তো ছিল রেঙকিলানের। ঘরে যার বউ ছিল, আমি কেন তার সঙ্গে পিরিত করতে যাব? ওই সব মাগী চাখা মরদে আমার চলবে না। আমার টাটকা জোয়ান নাগর চাই।

টাটকা জোয়ান নাগর তোর জন্যে একেবারে আকাশ থেকে লাফিয়ে নামবে! কুৎসিত ভঙ্গি করে বলল সেঙাই।

হেজালি ফণা তুলল যেন, একটা মানুষ ছিল, তার কথা বলেছি। সে তোর আমার, সকলের ছিল লাগোয়া (খেতের সঙ্গী)। ফের হুই পিরিতের কথা যদি বলবি, বর্শা দিয়ে তোর মুখখানা এফোঁড় ওফোঁড় করে দেব।

কী বললি? হুমকে উঠল সেঙাই।

এবার কোনো উত্তর দিল না হেজালি।

পিঙলেই বলল, থাম তোরা। এদিকে মশাল যে নিবে গেল। আয়, খেতে ফসলের গোড়া পুড়িয়ে সাফ করতে হবে। তারপর জোয়ারের দানা পুঁততে হবে। খামোখা ঝগড়া করছিস কেন?

সকলে খেতের মধ্যে নেমে এল। তারপর চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ল। কুকুরগুলো স্বাধীন আনন্দে উপত্যকার ওপর ছোটাছুটি করে বেড়াতে লাগল। ফসল কেটে নেবার পর ধানের যে গোড়াগুলো রয়েছে তার মধ্যে মুখ গুঁজে খুঁজে শুয়োরগুলো দু-এক কণা শস্যের সন্ধানে হন্যে হয়ে ঘুরতে শুরু করেছে।

বাঁশের টুকরো পুঁতে জমির সীমানা ঠিক করা রয়েছে। যে যার সীমানায় নেমে গিয়েছে। যাদের মশাল নিবে গিয়েছিল তারা আবার সঙ্গীদের মশাল থেকে নতুন করে আগুন ধরিয়ে নিয়েছে।

হো-ও-ও-ও–ও–

খুনোর (আবাদী জমি) দিকে দিকে আগুন জ্বলে উঠল। ধান আর জোয়ারের শস্যহীন অংশগুলো শুকিয়ে শুকিয়ে উন্মুখ হয়ে ছিল। মশালের ছোঁয়ায় সেগুলো দাবানল হয়ে জ্বলে উঠল। ফসলের খেতে মধ্যশীতের এই দুপুরে চিতাশয্যা রচিত হল।

হো-ও-ও-ও–ও–

আকাশের দিকে দিকে উঠে যাচ্ছে পাহাড়ী জোয়ান-জোয়ানীর উল্লসিত শোরগোল। উঠে যাচ্ছে লিকলিকে আগুনের শিখা আর রাশি রাশি ধোঁয়া।

হো-ও-ও-ও–ও—

ক্রমশ কোলাহলটা তীব্র হয়ে উঠছে।

হঠাৎ কে যেন গেয়ে উঠল :

আনা এচাঙচো লোচো
সেনা হামবঙ ইসোনিল

সঙ্গে সঙ্গে উপত্যকার দিকে দিকে তার প্রতিধ্বনি হতে লাগল। অজস্র কণ্ঠে সুর জেগে উঠল। আর সেই ছন্দিত আর সুরেলা সঙ্গীত বাতাসে দোল খেতে খেতে উপত্যকার ওপর দিয়ে মালভূমির দিকে চলে গেল। তারপর সেখান থেকে হালকা আমেজের মতো দক্ষিণ পাহাড়ের চূড়ায় ভেসে গেল।

আনা এচাঙচা লোচো,
রেচিঙ হামবঙ ইসোনিল।
আনা এচাঙচো লোচো,
ইজেম হামবঙ ইসোনিল।

ফসলের জমিটা এখন কালো হয়ে গিয়েছে। ধান আর জোয়ারের শস্যহীন অংশগুলোর ছাই বাতাসে উড়ে উড়ে বেড়াতে শুরু করেছে। শীতের এই দুপুর, এই রোদ, পাহাড়ী জমিতে এই আগুনের উৎসব, আর এই গান–সব মিলিয়ে এক বিচিত্র আবহাওয়ার সৃষ্টি হয়েছে এই উপত্যকায়।

একসময় গান থামল। আগুন নিভল। ঝকঝকে রোদ ম্লান হল। আবাদী জমির দিকে দিকে ক্ষতের মতো ফুটে বেরুল কালো কালো চিহ্ন। আজকের মতো কাজ শেষ হল।

খেত থেকে উঠে সকলে আবার বনের প্রান্তে এসে দাঁড়াল। সকলের মুখে কণা কণা ঘাম ফুটে বেরিয়েছে। দু-একজন প্রতিবেশী একটি গ্রামের নাগাদের দেখাদেখি সারা গায়ে উল্কি এঁকেছিল। বুক-পেট, হাত-পিঠ, কপাল-গাল শরীরের প্রতিটি অংশে আদিম কারুকলা ফুটিয়ে তুলতে বিন্দুমাত্র কসুর করেনি। নানারকম ছবি। নরমুণ্ড, বুনো মোষের মাথা, হাতির দাঁত। মনের আনন্দে শিল্পী তার তুলি বুলিয়ে গিয়েছে। সেই উল্কিগুলোর ওপর দর দর করে ঘাম। নেমে আসছে।

কে একজন বলল, আসছে মাসে ফসল পাহারার জন্যে মাঠে মাঠে থে (জমির ঘর) তৈরি করতে হবে। তারপর ঝুম আবাদের জন্যে জঙ্গল পোড়াতে হবে। এবার খালি কাজ আর কাজ। একেবারে সেই নগদা উৎসব পর্যন্ত আর জিরোবার ফাঁক নেই।

ওঙলে বলল, কাজ তো জনমভোর আছেই। যেতে দে ও-সব কথা। বস্তিতে ফিরবি তো। সব? আজ নাচগানের একটা ব্যবস্থা করলে মন্দ হয় না, কী বলিস সেঙাই?

উৎসাহিত হয়ে উঠল সেঙাই, খুব ভালো হবে। চল বস্তিতে। জোরি কেসুঙে নাচগান হবে আজ। রাজি তো? কি রে সারুয়ামারু, তোর বাড়ির উঠোনে?

সারুয়ামারু ভারি ফুর্তিবাজ। খুশির গলায় সায় দিল সে, নিশ্চয়ই।

হো-ও-ও-ও–ও-সবাই হই হই করে উঠল।

ওঙলে বলল, তোর বাড়ির উঠোনে নাচগান হবে। রোহি মধু আর শুয়োরের মাংস খাওয়াতে হবে কিন্তু।

নিশ্চয়ই খাওয়াব।

হো-ও-ও-ও–

উপত্যকার চাষের জমি থেকে নিবিড় বনের মধ্যে ঢুকল সবাই। নাচগান, তার সঙ্গে বাঁশের পানপাত্র ভরে রোহি মধু আর শুয়োরের মাংস। সকলে হল্লা শুরু করে দিয়েছে। তাদের চিৎকারে সন্ত্রস্ত হয়ে উড়ে যাচ্ছে গুটসুঙ পাখির ঝাঁক। আখুশু ঝোঁপের ফাঁকে ফাঁকে হরিণের শিঙ আর ময়ালের মাথা চকিতে দেখা দিয়েই অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। খারিমা পতঙ্গের দল আতঙ্কে ঠকঠক শব্দ করছে।

পৃথিবীর প্রাণশক্তির আদিম সুশ্যাম প্রকাশ এই নিবিড় অরণ্যে। সেই প্রাণশক্তি এই নাগা পাহাড়ে দুর্দম, দুর্বার। যেখানে একটুকু ফাঁক পেয়েছে সেখানেই এক জৈব প্রেরণায় মাথা তুলেছে শ্যামাভ অঙ্কুর। সেই অঙ্কুরই একটু একটু করে শাখা বিস্তার করেছে, পাতার জিভ দিয়ে রোদবৃষ্টির আসব শুষে শুষে একদিন বনস্পতি হয়ে উঠেছে। তারপর নাগা পাহাড়ের ধমনীর ওপর গুরুভার অস্বস্তির মতো চেপে বসেছে। তার তলায় বিছিয়েছে হিমছায়া। সে ছায়ায় হিংস্র শাপদের অবাধ লীলাভূমি এই ভীষণ অরণ্য। তাদের ওপর প্রভুত্বের অধিকারে এসেছে মানুষ। ভয়ঙ্কর আর এক প্রাণশক্তির প্রকাশ। অতিকায় কুড়ালের ফলায় অরণ্য সংহার করে বানিয়েছে জনপদ। বর্শার মুখে মুখে হিংস্র জন্তুদের নির্মূল করে তার অধিকারের সীমানা প্রসারিত করে চলেছে। দূরে দূরে ছোট ছোট গ্রাম নজরে আসে। নিচু নিচু ঘর, খড়ের চাল, বাঁশের দেওয়াল। মোটা মোটা খাটসঙ গাছের ডালেও অনেক ঘর। এই বন থেকে যতটুকু সুবিধা পাওয়া যায়, সবটুকু আদায় করতে বিন্দুমাত্র দ্বিধা করেনি মানুষেরা। মাঝে মাঝে বাঘনখের আঁচড়ের মতো ফালি ফালি পথ। অবিরাম চলতে চলতে পথগুলো আপনা থেকেই তৈরি হয়েছে। এদের পেছনে কোনো সতর্ক অধ্যবসায়ের ইতিহাস নেই।

বনবাদাড় ডলে মুচড়ে দুলতে দুলতে এগিয়ে চলেছে পাহাড়ী মানুষগুলো। চড়াই বেয়ে ওপরের দিকে উঠছে তারা। হাতের মুঠিতে বর্শার ফলাগুলো দোল খেয়ে চলেছে।

হো-ও-ও-ও–ও–

আচমকা দাঁড়িয়ে পড়ল সেঙাই। তার দৃষ্টিটা গিয়ে পড়েছে উত্তর পাহাড়ের চড়াইয়ের দিকে। বিকালের শেষ রোদ ঢলের মতো ছড়িয়ে পড়েছে সেখানে। হঠাৎ কয়েক দিন আগের একটা বিকেল স্মৃতিতে ফুটে উঠল। সেদিন শিকারে বেরিয়েছিল সে আর রেঙকিলান। সেদিন ওই উত্তর পাহাড়ের এক নিঝুম ঝরনার পাশে এক নগ্ন নারীতনুর রেখায় রেখায় এক অনাস্বাদিত পৃথিবীর আমন্ত্রণ সে পেয়েছিল। টিজু নদী পার হয়ে পোকরি বংশের মেয়ে মেহেলী এসেছিল এপারের ঝরনার জলে ধারাস্নানে। মেহেলী পোকরি বংশের মেয়ে, তাদের শত্রুপক্ষ। তার ঠাকুরদা জেভেথাঙের মুণ্ডু ওরা ছিঁড়ে নিয়ে গিয়েছিল অনেক কাল আগে। বুড়ো খাপেগা মোরাঙে বসে সে গল্প তার কাছে বলেছে। কিন্তু মেহেলী! বিকেলের মায়াবী আলোতে নিঃশব্দ ঝরনার পাশে এক নগ্ন নারীতনু। আদিম মানবী। সেঙাই-এর রক্তে রক্তে কেমন একটা বিভ্রান্তি চমক দিয়ে উঠল। সমস্ত স্নায়ুমণ্ডলীতে কামনা বর্শামুখের মতো ঝিলিক দিল।

সেঙাই-এর দেখাদেখি সকলে দাঁড়িয়ে পড়েছিল।

সেঙাই বলল, তোরা সব বস্তিতে ফিরে যা। আমি উত্তরের পাহাড়ে যাব। বস্তিতে ফিরব। কিছুক্ষণ পর।

নাচগানের কী হবে রে শয়তান? ওঙলের গলায় রীতিমতো বিরক্তি।

তোরা ব্যবস্থা কর। নাচগান শুরু হবার আগেই চলে আসব।

আর দাঁড়াল না সেঙাই। পাহাড়ের গা বেয়ে বেয়ে মালভূমির দিকে তর তর করে নামতে লাগল। উত্তরের পাহাড়ে যেতে অনেকটা সময় লাগবে। কেন যেন তার মনে হচ্ছে, হয়তো মেহেলী এসেছে সেই ঝরনার ধারে।

হো-ও-ও-ও–ও—

পাহাড় আর বন কাঁপিয়ে বাকি সকলে গ্রামের দিকে চলে গেল।

দুলতে দুলতে নিচের মালভূমিতে নেমে এল সেঙাই। একদিকে এক নগ্ন নারীতনু। মেহেলী। আর একদিকে তার ঠাকুরদাকে হত্যা করেছে পোকরি বংশ। প্রতিহিংসা আর কামনা। মৃত্যুমুখ। বর্শা আর রমণীয় নারী–আদিম প্রাণের কাছে দু’টিই সত্য। নির্মম সত্য। ভয়ঙ্কর সত্য। এ দুয়ের মধ্যে দোল খেতে খেতে এগিয়ে চলেছে সেঙাই।

একসময় নিঃশব্দ ঝরনাটার পাশে এসে দাঁড়াল সে। চারিদিকে একবার ভালো করে তাকাল। কিন্তু সেদিনের মতো আজ আর কেউ নেই এখানে। সেদিন মেহেলী ছিল। আদিম মানবীর অনাবরণ রূপ দেখতে দেখতে আবিষ্ট হয়ে গিয়েছিল সেঙাই। বর্শা সে তুলে ধরেছিল সত্যি, কিন্তু তার ফলায় হত্যার কোনো ইচ্ছা হয়তো ছিল না। এক নারীর আত্মসমর্পণ, এই নিয়েই সেদিন তৃপ্ত হয়েছিল সেঙাই। কিন্তু আজ? সেদিন সে কি জানত, বর্শার ফলায় শুধু খোনকেকে শিকার করে আসেনি, সে নিজেও শিকার হয়ে গিয়েছিল। কামনার এক বর্শা দিয়ে তাকে শিকার করে গিয়েছিল মেহেলী। লোহার বর্শা দিয়ে একবার আঘাত করা যায়, দুবার আঘাত করা যায়, কিন্তু মেহেলী তার নগ্ন নারীদেহের রূপ দিয়ে, তার নির্বাক আত্মসমর্পণ দিয়ে অহরহ তার দেহমনকে আঘাত দিয়ে চলেছে। আঘাতে আঘাতে মেহেলী হয়তো বিকল করে দিয়ে গিয়েছে সেঙাই-এর অস্ফুট পাহাড়ী চেতনা।

এখানে কয়েক দিন আগে সেই আশ্চর্য বিকেলে একটা অবাস্তব স্বপ্ন দেখেছিল কি সেঙাই? এই পাহাড়ে, এই বনভূমিতে মেহেলী নামে কি কোনো নারীর অস্তিত্বই ছিল না?

তা হতে পারে না। মেহেলী আছে। আর সবচেয়ে যেটা নির্মম সত্য সেটা সেঙাইর স্নায়ুমণ্ডলীতে ঝড়ের মতো তাণ্ডব শুরু করে দিয়েছে এই মুহূর্তে। মেহেলীকে তার চাই। তার প্রতিটি ইন্দ্রিয় দিয়ে, প্রতিটি উদগ্র রক্তকণা দিয়ে সে আস্বাদ নেবে মেহেলীর রমণীয় দেহের। একটা অবরুদ্ধ গোঙানির মতো আওয়াজ সেঙাই-এর গলা বেয়ে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে, গোঁ-ও–ও–ও–ও–

মুখখানা ভয়ানক হয়ে উঠেছে সেঙাইর। ছোট ছোট পিঙ্গল চোখ দুটো জ্বলতে শুরু করেছে।

মাঝখানে কয়েকটা দিন জা কুলি উৎসব নিয়ে মেতে ছিল তাদের ছোট্ট গ্রাম। অতিরিক্ত উল্লাসে আর রোহি মধুর তীব্র মাদক নেশায় আচ্ছন্ন হয়ে ছিল সেঙাই। উত্তর পাহাড়ের মেহেলী নামে এক পাহাড়ী যৌবনের কামনা জা কুলি উৎসবের আমোদ আর রেঙকিলানের অপমৃত্যুর নিচে হারিয়ে গিয়েছিল। আজ ফসলকাটা আবাদী জমি পোড়াতে পোড়াতে আবার নতুন করে মেহেলীর কথা মনে পড়েছে তার।

সেই প্রথম দেখার রাতেই মোরাঙ থেকে মেহেলীর সন্ধানে বেরিয়ে যেতে চেয়েছিল সেঙাই। হিমার্ত রাত্রি সেদিন তাকে বাধা দিয়েছে। কিন্তু আজ? আজ কোনো অসুবিধা নেই, প্রকৃতি আজ তার পক্ষে। আর মানুষের বাধা এলে বর্শার মুখে নির্মূল করে সে মেহেলী নামে এক যুবতীর কাছে পৌঁছুবে। পৌঁছুতেই হবে। আদিম পৃথিবী তার রক্তে রক্তে তুফান তুলেছে।

ঘন ঘন নিশ্বাস পড়ছে সেঙাইর। মোটা মোটা ঠোঁট দুটো ফুলে ফুলে উঠতে শুরু করেছে। প্রচণ্ড আবেগে বুকের পেশীগুলো তরঙ্গিত হয়ে যাচ্ছে। চারিদিকে আবার চনমনে চোখে তাকাল সেঙাই, যদি দেখা হয় মেহেলীর সঙ্গে। মেহেলী তো বলেছিল, সে রোজ এই নিরালা ঝরনার জলে স্নান করে যায়। এই ঝরনা তার বড় ভালো লাগে। তবে কেন সে আজ এল না? হতাশায় মনটা ভরে গেল সেঙাইর।

হঠাৎ কী ভেবে আর দাঁড়াল না সে। বর্শাটাকে হাতের থাবায় চেপে ধরে দুলতে দুলতে টিজু নদীর দিকে এগিয়ে গেল।

.

০৯.

সেদিন টিজু নদী পেরিয়ে একটা সম্বরের সন্ধানে সালুয়ালা গ্রামের সীমানায় চলে এসেছিল সেঙাই আর রেঙকিলান। আজ রেঙকিলান নেই সঙ্গে। সে একাই সালুয়ালাঙের কাছাকাছি চলে এল।

এখনও আকাশে বেলাশেষের খানিকটা ঝাপসা রং লেগে আছে। বনের ঘন ছায়ায় সালুয়ালা গ্রামের দু-একজন পাহাড়ী মানুষ ঘুরে বেড়াচ্ছে। একবার দেখে ফেললে আর রক্ষা থাকবে না। এখানে বন বেশি নিবিড় নয়। আশেপাশে কোনো নিরাপদ ঝোঁপও নেই। সন্ধ্যার অন্ধকার না নামা পর্যন্ত গ্রামে ঢোকাটা বুদ্ধিমানের কাজ হবে না। পাহাড়ী জোয়ান সেঙাই অন্তত এটুকু বোঝে। আর যাই হোক, শত্রুদের বর্শায় হৃৎপিণ্ডটা তার চৌফালা হয়ে যাক এমন ইচ্ছা সেঙাই-এর নেই। সালয়ালা গ্রাম তার মুণ্ড নিয়ে নারকীয় উল্লাসে মেতে উঠবে, তার রক্ত দিয়ে মোরাঙের দেওয়ালে দেওয়ালে বীভৎস শিল্পকলা ফুটিয়ে তুলবে–ভাবতেও ইন্দ্রিয়গুলো অসাড় হয়ে এল তার।

চারিদিকে একবার সন্ধানী দৃষ্টিতে তাকাল সেঙাই। সামনেই একটা জীমবো গাছ। ওটার বিশাল গুঁড়ির আড়াল চলে গেল সে। এখান থেকে সালুয়ালাঙ গ্রামখানা পরিষ্কার নজরে আসে। এ গ্রামে এর আগে কোনোদিনই ঢোকেনি সেঙাই।

পোকরি বংশের গ্রাম। তাদের শত্রুপক্ষের আস্তানা। মনে মনে কথাগুলো একবার ভেবে নিল সেঙাই। কিন্তু আজ প্রতিহিংসার কারণে এ গ্রামে আসেনি সেঙাই। আর এক আদিম প্রবৃত্তির ডাকে এসেছে। সে প্রবৃত্তির বাস্তব প্রকাশ একটি নারীদেহে। তার নাম মেহেলী।

চারিদিক ভালো করে দেখে নিয়ে ধীরে ধীরে ঝাকড়া জীমবো গাছটার মগডালে উঠে গেল সেঙাই। সন্ধে পর্যন্ত এখানেই অপেক্ষা করতে হবে।

একসময় পশ্চিম আকাশ থেকে বিবর্ণ বেলাশেষ মুছে গেল। প্রথমে ছায়া ছায়া, পরে গাঢ় অন্ধকার নেমে এল নাগা পাহাড়ে। এবার জীমবো গাছটা থেকে নিচে নেমে এল সেঙাই। সতর্ক পা ফেলে ফেলে স্নায়ুগুলিকে ধনুকের ছিলার মতো প্রখর করে সালুয়ালা গ্রামের প্রান্তে এসে দাঁড়াল।

এধারেই সালুয়ালা গ্রামের বিশাল মোরাঙ। গাঢ় অন্ধকারে বিশেষ কিছুই নজরে আসছে না। আবছা অতিকায় একটা প্রেতের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে মোরাঙটা।

পাহাড়ের নিচু একটা খাঁজ থেকে ওপরে উঠে এল সেঙাই। সঙ্গে সঙ্গে মোরাঙের বাঁ পাশে একটা মশাল নজরে পড়ল। মশালের শিখাটা এদিকেই এগিয়ে আসছে। বুকের মধ্যে এক ঝলক রক্ত যেন ছলাত করে আছড়ে পড়ল সেঙাই-এর। লাফিয়ে আবার পাহাড়ের খাঁজে নেমে গেল সে। তারপর নিশ্বাসরুদ্ধ করে মড়ার মতো পড়ে রইল।

মশালের শিখাটা ঠিক ওপরের টিলাটা ধরে এগিয়ে যেতে লাগল। একবার মাথা তুলল সেঙাই। চোখে পড়ল, খুব কাছে দড়ির লেপ জড়ানো এক নারীমূর্তি। চকিতে তার মুখখানা দেখে চমকে উঠল সে-সালুনারু। রেঙকিনের বউ তবে কি টিজু নদী ডিঙিয়ে সালুয়ালা গ্রামে আশ্রয় নিয়েছে।

রেঙকিলানের মৃতদেহটা যেদিন দক্ষিণ পাহাড়ের অতল খাদে সারুয়ামারু খুঁজে পেয়েছিল, ঠিক সেদিনই বেয়াদপির জন্য আর রেজু আনিজার নামে অপরাধের কারণে খাপেগা তার দিকে বর্শা তুলে ধরেছিল। ঘন বনের মধ্যে লাফিয়ে পড়ে সেদিন প্রাণ বাঁচিয়েছিল সালুনারু। তারপর থেকে কেলুরি গ্রামে আর তাকে কেউ দেখেনি।

সালুনারু আর তার হাতের মশালটা একসময় দূরের কেসুঙগুলোর দিকে অদৃশ্য হয়ে গেল।

রাত নামার সঙ্গে সঙ্গে হিম ঝরতে শুরু করেছে। সকালে এবং দুপুরে বাঁশের পানপাত্র পূর্ণ করে বার সাতেক রোহি মধু খেয়েছিল সেঙাই। অত্যন্ত উষ্ণ পানীয়। তবু শরীরের জোড়ে জোড়ে কাঁপুনি ধরে গিয়েছে। দাঁতে দাঁতে হি-হি বাজনা শুরু হয়েছে। এ গ্রামেরই একটা পোষা শুয়োর কখন যেন গা ঘেঁষে দাঁড়িয়েছে। জন্তুটার কাঁটাভরা কর্কশ জিভ। সেই জিভ দিয়ে পিঠের ওপরটা চেটে চেটে দিচ্ছে সেঙাই-এর। বর্শার তীক্ষ্ণ ফলা দিয়ে শুয়োরটার পাজরে একটা খোঁচা দিল সেঙাই। কাতর শব্দ করে প্রাণীটা ছুটে পালাল। আর থাবার মধ্যে ভয়াল বর্শাটা চেপে ধরে ওপরের টিলায় উঠে এল সে।

মোরাঙের ঠিক মুখোমুখি একটা বড় ভেরাপাঙ গাছ। তার আড়ালে দেহটাকে যতদূর সম্ভব গুটিয়ে নিয়ে দাঁড়াল সেঙাই। মোরাঙের ভেতর থেকে পে কাঠের মশালের আলো এসে পড়েছে বাইরে। শীতার্ত রাত্রির অন্ধকার বিদীর্ণ করে সে আলো রহস্যময় হয়ে উঠেছে। মোরাঙের দরজার ঠিক ওপরেই বিশাল এক বর্শার মাথায় একটা নরমুণ্ড। আবছা আলো অন্ধকারে বীভৎস দেখাচ্ছে। মুণ্ডটার মাংস ঝরে গিয়েছে, হনু আর কণ্ঠার হাড়ের ওপর আর গলার কাছে কিছু কিছু মাংসের অবশেষ কালো হয়ে ঝুলছে এখনও! চোখের কোটরে মণিদুটো নেই; শুধু বিরাট দুই গর্তে হিমাক্ত রাত্রির অন্ধকার জমা হয়ে রয়েছে।

এই নরমুণ্ড সালুয়ালা গ্রামের বীরত্বের স্মারক। তার পৌরুষের ঘোষণা। শত্রুর মুণ্ড কেটে এনে সালুয়ালাঙ গ্রাম বর্শার ফলায় গেঁথে আকাশের দিকে তুলে ধরেছে, তুলে ধরেছে বিজয়গৌরবে, গর্বিত ঔদ্ধত্যে।

পেশীগুলো আচমকা ঝনঝন করে বেজে উঠল আদিম মানুষ সেঙাইর। হাতের বর্শাটা থাবা থেকে পড়ে গেল পাথরের টিলায়। টং করে একটা ধাতব শব্দ উঠল। এই নরমুণ্ড কি তবে তার ঠাকুরদার? বহুকাল আগে টিজু নদীর খরধারায় পোকরি বংশের বর্শা যাকে নির্মম আঘাতে হত্যা করেছিল? রক্তস্রোতে বিদ্যুৎ বয়ে চলল সেঙাই-এর।

একটা ভয়ঙ্কর মুহূর্ত। তারপরেই বর্শাটা তুলে নিয়ে এক পা, দু পা করে মোরাঙের পাশে এসে দাঁড়াল সেঙাই। এ দিকটা অনেকখানি নিরাপদ। নিচে খাড়া পাহাড়ের ঢাল অতল খাদে নেমে গিয়েছে। চারিদিকে গাঢ় অন্ধকার। শুধু মোরাঙ থেকে বাঁশের দেওয়াল ভেদ করে অগ্নিকুণ্ডের আভা বেরিয়ে আসছে। দেওয়ালের পাশে ওত পেতে দাঁড়াল সেঙাই। তারপর পলকহীন তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল।

মোরাঙের ভেতরটা এবার পরিষ্কার নজরে আসছে। বাঁশের মাচানের ওপর শুয়ে রয়েছে একটি শীর্ণ শরীর। তার চারপাশে অনেকগুলো মানুষ ভিড় করে রয়েছে।

একটা বুড়ো বাঁশের মাচানের মানুষটার ওপর ঝুঁকে পড়ল। অস্পষ্ট আলোয় দেখা যায়, তার কানে পেতলের বিরাট নীয়েঙ গয়না। গলায় ময়াল সাপের হাড়ের মালা। কপালের ওপর তিনটি গাঢ় রক্তের রেখা। গালে অসংখ্য কুঞ্চন। এই গ্রামের সর্দার সে।

বুড়ো মানুষটা চাপা গলায় বলল, কি তামুন্যু (চিকিৎসক), কী মনে হচ্ছে? হু-হু, আমার কিন্তু ভালো ঠেকছে না।

মাচানের আর এক পাশে একটি মানুষ বসে ছিল। সারা দেহ অনাবৃত। বুকের ওপর অসংখ্য উল্কি। গলার চারপাশে মানুষের করোটির মালা। হাতে একখণ্ড বাদামি রঙের হাড়। গম্ভীর গলায় সে বলল, উঁহু, আমারও ভালো ঠেকছে না সদ্দার। ঘায়ে পোকা ধরে গিয়েছে। এই দ্যাখ, কেগোথেনা পাতা বেটে লাগিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু কিছুই হচ্ছে না।

আচমকা ছিলামুক্ত তীরের মতো সাঁ করে মাচানের ওপর উঠে বসল শোয়ানো মানুষটা। মশালের আলোতে তার পিঙ্গল চোখে দুটো কেমন যেন অমানুষিক দেখাচ্ছে। বুকের বাঁ দিকটা বিরাট একটা ফাঁক হয়ে ঝুলে পড়েছে। সেখান থেকে মেটে রঙের এক ডেলা মাংস ঠেলে বেরিয়ে আসতে চাইছে। বোধ হয়, ওটাই মানুষটার হৃৎপিণ্ড। জান্তব গলায় প্রলাপ বকে উঠল মানুষটা, খুন, খুন-খুন করে ফেলব। বর্শা দে…ওরা কে? কে?..হোঃ-হোঃ-হোঃ-ও–ও– ও তীব্র গলায় জান্তব অট্টহাসি হেসে উঠল সে।

মোরাঙের বাইরে দেওয়ালের পাশে চমকে উঠল সেঙাই। বাঁশের মাচানের ওপর উঠে বসে যে মানুষটা প্রলাপ বকছে সে খোনকে। মশালের আলোতে খোনকের কঙ্কালসার দেহটা প্রেতমূর্তির মতো দেখাচ্ছে।

খোনকে মরেনি। সেদিন সেঙাই যে বর্শার ফলা ছুঁড়ে মেরেছিল সেটা তা হলে ব্যর্থ হয়েছে!

মাথাটা টলমল করে দুলে উঠল সেঙাইর। অতল খাদে সে পড়েই যেত, তার আগেই বাঁশের দেওয়ালটা ধরে টাল সামলে নিল।

খোনকেকে লাফিয়ে উঠতে দেখে চারপাশ থেকে জোয়ান ছেলেরা ছত্রভঙ্গ হয়ে সরে দাঁড়াল। সকলেরই চোখেমুখে আতঙ্ক খেলে যাচ্ছে। সালুয়ালা গ্রামের তামুন্যও (চিকিৎসক) রীতিমতো ভয় পেয়েছে। বাঁশের মাচানটা থেকে উঠে সে-ও সরে দাঁড়িয়েছে বেশ একটা নিরাপদ দূরত্বে। তার পাশে এসে দাঁড়িয়েছে বুড়ো সর্দার।

কাঁপা কাঁপা গলায় সর্দার বলল, কী ব্যাপার তামুন্যু?

আনিজা! আনিজা! খারাপ আনিজাতে পেয়েছে খোনকেকে।

কী করতে হবে? কাঁপা গলাটা এবার ফিসফিস শোনাচ্ছে সর্দারের।

হু-হু, কাল রাত্তিরে আমি স্বপ্ন দেখেছিলাম, এমনটি হবে। চটপট একটা শুয়োর বলি দিয়ে রক্ত নিয়ে আয়। টেটসে আনিজার নামে বলি দিবি।

দুটো জোয়ান ছেলে মোরাঙের দরজা দিয়ে শুয়োরের সন্ধানে ছুটে গেল পোকরি কেসুঙে। পোকরি বংশের ছেলে খোনকে। তাদের শুয়োরই উৎসর্গ করা হবে।

এখনও সমানে প্রলাপ বকে চলেছে খোনকে, খুন–খুন–খুন কর! আগুন লাগিয়ে দে। চারদিকে। হো-ও-ও-ও–

অট্টহাসির সঙ্গে মনে হল, বুকের ফাটল দিয়ে হৃৎপিণ্ডটা ছিটকে বেরিয়ে আসবে খোনকের। ভয়ানক দেখাচ্ছে তার বুকের ক্ষতটা।

প্রকাণ্ড মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে আচমকা বাঁশের মাচানটার কাছে চলে এল তামুন্যু। তারপর দু’টি প্রবল থাবায় খোনকের কাধ দুটো ধরে শুইয়ে দিল। তার ওপর একটা বাদামি রঙের চ্যাপ্টা হাড়ে তিনটে ফুঁ দিয়ে বুকে ঠেকাল। চারপাশে একবার চনমন করে তাকিয়ে তামুন্যু তার মুখখানা খোনকের বুকের ওপর রাখল। এবং চুকচুক শব্দ করে ক্ষতমুখ থেকে লালাভ রক্তধারা শুষে নিল। পাহাড়ী চিকিৎসার এক এক বীভৎস পদ্ধতি, এক নারকীয় প্রক্রিয়া।

বাঁশের পাত্রে কিছুটা কেগোথেনা পাতা বাটা ছিল। খোনকের ক্ষতে তার থেকে খানিকটা তুলে মাখিয়ে দিল তামুন্যু। আর বাঁশের মাচানের ওপর নিঃসাড় হয়ে পড়ে রইল খোকে। চোখ দুটো তার অর্ধেক বুজে এসেছে। একটা অদ্ভুত অবসাদ দেহময় ছড়িয়ে পড়েছে। শুধু ঢিমে তালে নিশ্বাসের সঙ্গে বুকের ক্ষতমুখটা চৌফালা করে মেটে রঙের হৃৎপিণ্ডটা ঠেলে বেরিয়ে পড়তে চাইছে।

শীতের রাত্রি আরো হিমার্ত হয়ে উঠেছে। সেঙাই-এর চামড়ায় সেটা যেন সহস্র দাঁত বসাচ্ছে। যন্ত্রণায় শরীরের জোড়গুলো যেন খুলে খুলে আসতে চাইছে। তবু দাঁতে দাঁত চেপে দাঁড়িয়ে রইল সে।

একটু পরেই মোরাঙের দরজার দিকে কতকগুলি পে কাঠের মশাল দেখা দিল। সঙ্গে সঙ্গে চেঁচামেচি শুরু হল।

মোরাঙের এই দেওয়ালের দিকটা নিরাপদ। তবু শরীরটাকে যতখানি সঙ্কুচিত করা যায়, তাই করে দেওয়ালের গায়ে লেপটে রইল সেঙাই।

একটু পরেই একটা কাঠের পাত্রে খানিকটা তাজা রক্ত নিয়ে এল সেই জোয়ান দুটো। খানিক আগে পোকরি কেসুঙে শুয়োর বলির খবর দিতে গিয়েছিল তারা। তাদের সঙ্গে আরো কয়েকটি নানা বয়সের পুরুষও মোরাঙে চলে এসেছে।

একজন কাঠের পাত্রটা এগিয়ে দিতে দিতে বলল, এই নে তামুন্যু, রক্ত এনেছি। আনিজার নামে খোকের বাপ শুয়োর বলি দিয়েছে।

মোরাঙের দরজার বাইরে হইচইটা এবার প্রবল হয়ে উঠছে।

বুড়ো সর্দার বলল, দরজার ওধারে কে ওরা?

খোনকের ছোট বোন মেহেলী আর তার মা এসেছে। বস্তি থেকে আরো কয়েকটা মেয়েও এসেছে। তারা সব জটলা করছে।

সেই জোয়ান ছেলেটা বলল, খোনকের খবর জানতে চায়।

মোরাঙে মেয়েদের প্রবেশ নিষিদ্ধ। তাই তারা দরজা থেকে খানিকটা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। নাগা পাহাড়ের এই প্রথাকে অসম্মান করে কোনো মেয়ের মোরাঙে ঢোকার উপায় নেই। কোনোভাবেই, কোনো কারণেই এই প্রথা ভাঙা চলবে না। মোরাঙ হল অবিবাহিত জোয়ান ছেলেদের নৈতিক জীবনের পীঠভূমি। নারীর কামনা আর রিপুর তাড়না থেকে অনেক, অনেক দূরে এর নিষ্পাপ অস্তিত্ব। এর পবিত্রতা নারীদেহের আসক্তি দিয়ে কলুষিত করে তোলা রীতিমতো অপরাধ। সে অপরাধের শাস্তি নির্মম, নিষ্ঠুর। অনিবার্য মৃত্যু দিয়ে সে অপরাধের প্রায়শ্চিত্ত করতে হয়। তাই মেহেলীরা ভেতরে ঢোকেনি।

মোরাঙের বাঁশের দেওয়ালে শরীরটা হিমে অসাড় হয়ে আসছে সেঙাই-এর। তারই মধ্যে একটা নাম শুনতে পেয়েছে সে। নামটা তার সমস্ত চেতনার ওপর ছড়িয়ে পড়েছে। সে নাম মেহেলী। এই মেহেলীর কামনাই তাকে শীতের হিমে দক্ষিণ পাহাড় থেকে টিজু নদীর এপারে এই সালুয়ালা গ্রামে টেনে এনেছে। ময়াল সাপ যেমন করে তার নিশ্বাসে নিশ্বাসে ছোট্ট হরিণশিশুকে নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে টেনে নিয়ে যায় ঠিক তেমন করেই কি মেহেলী তাকে এই পাহাড়ে নিয়ে এসেছে?

হিম অসহ্য হয়ে উঠেছে। তার দাঁতে দাঁতে শরীরটা যেন ফালা ফালা হয়ে যাবে, মনে হল সেঙাই-এর। এত কাছাকাছি মেহেলী, তবু সামনে যাবার উপায় নেই। ওপাশে গেলেই একটা বর্শার ফলা পাঁজরাটাকে এফোঁড় ওফোঁড় করে ফেলবে। এ একেবারে নিশ্চিত। সেঙাইর মনে। হচ্ছে, মেহেলীর যে সুন্দর নগ্ন শরীরের আকর্ষণে টিজু নদী ডিঙিয়ে এপারে এসেছে সে শরীর যেন কোনো মেয়ের নয়। সেটা একটা সোনালি সাপ, যার স্পর্শে নির্ঘাত মৃত্যু।

শরীরের ডান দিকটা ধরে গিয়েছে সেঙাইর। সেদিকে কোনো সাড় নেই, বোধ নেই। কী করবে ঠিক করে উঠতে পারছে না সে।

হঠাৎই মোরাঙের মধ্যে ঘটে গেল ঘটনাটা। আর চমকে উঠল সে।

বাঁশের মাচানের পাশে দাঁড়িয়ে ছিল তামুন্য (চিকিৎসক), তার মুঠিতে একটা কাঠের পাত্র। সেই পাত্রে টকটকে তাজা অনেকটা রক্ত। একটু আগেই শুয়োর বলি দিয়ে নিয়ে এসেছিল সেই জোয়ান ছেলে দুটো।

এতক্ষণ বাঁশের মাচানে নিঝুম শুয়ে ছিল খোনকে। আর একটু একটু করে তার চারপাশে ঘন হয়ে আসছিল বুড়ো সর্দার আর মোরাঙের জোয়ান ছেলেরা।

তামুনুর মুখে আত্মপ্রসাদের হাসি ফুটে বেরিয়েছে। রাক্ষসের মতো বিকট শব্দ করে হেসে উঠল সে, হোঃ-ও–ও–ও-, হোঃ-ও–ও–ও-, হোঃ-ও–ও–ও-, দেখলি তো সদ্দার, আনিজার–

তার কথা মাঝপথেই থমকে গেল। ফের মাচানের ওপর উঠে বসেছে খোনকে। মৃত্যুযন্ত্রণায় তার মুখখানা ভয়ানক হয়ে উঠেছে। ছোট ছোট চাপা চোখের ভেতর থেকে পিঙ্গল মণি দুটো ঠিকরে আসছে। আর বুকের সেই বিশাল ফাটলে মেটে রঙের হৃৎপিণ্ডটা নিশ্বাসের সঙ্গে।

অনেকখানি বেরিয়ে এসেছে। অস্বাভাবিক গলায় প্রলাপ বকে উঠল খোকে, খুন-খুন হোঃ হোঃ–আমার বর্শা দে—

আনিজা! হু-হু, সহজে আনিজার রাগ পড়বে না। একটা শুয়োরে চলবে না তার। খোকেকে সে চাইছে। খোনকে এই মোরাঙে থাকলে বস্তিতে মড়ক ধরে যাবে। শিগগির ওকে খাদে ফেলে দে সদ্দার। বাঁশের মাচানের পাশ থেকে সরে গেল তামুন্যু। খোনকে সম্বন্ধে শেষ রায় দিয়ে বিশাল মাথা ঝাঁকিয়ে ঝাঁকিয়ে অন্য একটা মাচানে গিয়ে বসল।

জোয়ান ছেলেরা চারপাশে দাঁড়িয়ে ছিল।

বুড়ো সর্দার বলল, এই যাসিমু, এই ফিরাঙ, তোরা খোকেকে ধরে পেছনের খাদে ফেলে দিয়ে আয়।

মোরাঙের দেওয়ালের পাশে একটা অসাড় দেহে শিহরন খেলে গেল। স্নায়ুগুলো ধনুকের ছিলার মতো টান টান হয়ে উঠল। এখনই খোকেকে নিয়ে জোয়ান ছেলেরা এদিকে আসবে। তারপর ছুঁড়ে ফেলে দেবে খাদের অতলে। কঠিন পাথরের ঘা লেগে টুকরো টুকরো হয়ে যাবে খোকের দেহ। কিন্তু এ সব ভাবছে না সেঙাই। তার চিন্তা, এখানে এসে তাকে দেখলে জোয়ান ছেলেরা দাঁতাল শুয়োরের মতো ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলবে। সামনের দিকে যাওয়া অসম্ভব। মোরাঙের দরজার কাছে মশাল নিয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে মেহেলীরা। শত্রুপক্ষের কুমারী যৌবনকে বিন্দুমাত্র ভরসা নেই।

ইতিমধ্যে মোরাঙের ভেতর জোয়ান ছেলেরা খোকেকে কাঁধের ওপর তুলে নিয়েছে। আর ভাবতে পারছে না সেঙাই। অসাড় দেহটাকে কোনোক্রমে টানতে টানতে পাহাড়ের গা বেয়ে খাদের দিকে অনেকটা নেমে গেল সে। চেতনাটা কেমন অসাড় হয়ে আসছে। কিছুই বুঝতে পারছে না সেঙাই। হাতের থাবা দিয়ে পাথরের একটা চাই ধরে আশ্রয় নিয়েছিল। একটু একটু করে থাবাটা শিথিল হয়ে আসছে। পিঠের ওপর, মুখের ওপর কুচি কুচি বরফ জমছে। প্রায় অচেতন দেহটাও যেন চিনচিন করে উঠছে। ভয়ানক একটা অনুভূতি চেতনা আর নিশ্চেতনার মধ্যে দোল খেয়ে যাচ্ছে।

আচমকা ওপর থেকে একটা বিশাল গুরুভার কিছু আছড়ে পড়ল পাশের পাথরের ওপর। ঝপাং করে শব্দ উঠল। সেই সঙ্গে একটা তীব্র আর্তনাদ। আ-উ-উ-উ-। নির্ঘাত খোনকে। পরক্ষণে একেবারেই নিস্তব্ধ হয়ে গেল অন্ধকার পাহাড়ী খাদটা। শুধু নিবিড় অরণ্যের মধ্য দিয়ে পাক খেতে খেতে একটা মানবদেহ নিচের দিকে নেমে যেতে লাগল।

আর কিছুই শুনতে পেল না সেঙাই। শুধু অস্পষ্টভাবে বুঝতে পারল, তার হাতের মুঠি আরো শিথিল হয়ে আসছে। আর পাথরের অবলম্বনটা একেবারে খসে গিয়েছে। কিন্তু হাত বাড়িয়ে আর একটা কিছু ধরার মতো শক্তি সে হারিয়ে ফেলেছে। সীমাহীন শূন্যতায় তার দেহটা ছিটকে পড়ল। কোথাও কোনো আশ্রয় নেই। চারপাশে অথই অন্ধকার হা হা গ্রাস মেলে রয়েছে। একটু আগে খোনকের দেহটা অতল খাদের দিকে নেমে গিয়েছিল। হয়তো তারই প্রেতাত্মা লম্বা একখানা হাত বাড়িয়ে সেঙাইকে নিচের দিকে টেনে নিয়ে চলেছে।

কোথায় মুছে গেল মেহেলী, কোথায় অদৃশ্য হয়ে গেল টিলায় উপত্যকায় মালভূমি আর চড়াই-উতরাইতে দোল-খাওয়া এই নাগা পাহাড়। সেঙাইর সব সাধ, কামনা আর বাসনা নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল। কিছুই ভাবতে পারছে না সেঙাই। অস্ফুট বোধ, অপরিণত বন্য মন। সেই বোধ আর মন এখন একেবারেই ক্রিয়া করছে না। তবু সেঙাইর মনে হল, দেহটা তার আশ্চর্য হালকা হয়ে গিয়েছে। শিরায় স্নায়ুতে, ধমনী আর ইন্দ্রিয়ে, বোধ আর বুদ্ধিতে যে প্রাণ বহমান, সে প্রাণ একটু একটু করে স্তব্ধ হয়ে আসছে।

নিরাশ্রয় শূন্যতায় পাক খেতে খেতে খাদের অতলে নামতে লাগল সেঙাই।

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *