দু-তিন দিন পর মাল্যবান বললে, তোমার মেজদারা তো থাকবেন অনেক দিন।
হ্যাঁ।
বছর খানেক?
না, মাস দুয়েক।
একটা কথা আমার মনে হয়, মাল্যবান বললে, এ-বাড়িটা ছেড়ে দিয়ে একটা নতুন বাড়ি দেখলে মন্দ হয় না। দোতলা কিংবা তেতলায় বড়ো বড়ো কয়েকখানা ঘর থাকবে।
শুনে উৎপলা নাকে-চোখে খুব খুশি হয়ে বললে, তাহলে তো খুব ভালো হয়। গুনগুন করে গাইতে গাইতে বললে, তুমি সে রকম বাড়ি দেখেছ কোথাও?
না।
পাওয়া বড্ড শক্ত।
আমি খুঁজছি।
পঞ্চাশ টাকা ভাড়ার মধ্যে পেতে হবে তো?
ধরো, গোটা দশেক বেশিই না হয় দিলাম।
কয়েকদিন পরে মাল্যবান এসে বললে, একটা বাড়ির খোঁজ পেয়েছি।
কোথা?
পাথুরেঘাটার দিকে।
বাবা, অদ্দূরে গেলে?
কিন্তু বাড়িটা বেশ।
কটা ঘর আছে?
পাঁচটা। দোতলার চারটে, তিনতলার একটা। বেশ বড়ো?
হ্যাঁ।
কত চায়?
পঞ্চাশ।
তা পঞ্চাশ টাকা বড্ড বেশি।
কিন্তু পাঁচটা ঘর।
তা বুঝলাম–
ঠোঁটে পানের রং শুকিয়ে ভারি সুন্দর দেখাচ্ছিল উৎপলার ঠোঁট। ঠোঁট নেড়ে সে বললে, কিন্তু মেজদার কাছ থেকে কিছু তো চাওয়া যায় না।
তা আমি জানি।
এমন-কি সেধেও যদি কিছু দেন, তাহলেও তা নিতে পারি না আমরা।
সে বিষয়ে মাল্যবানের খানিকটা মতভেদ ছিল।
একটা হাই তুলে মাল্যবান বললে, তাই তো, আড়াই শো টাকায় চলে কী করে পঞ্চাশ টাকাই যদি বাড়ি ভাড়ায় দিয়ে ফেলি–
উৎপলা চাপা গলায় ভরসা দিয়ে বললে, চালাতে পারি আমি অবিশ্যি—
নাঃ, সে আর তুমি কী করে পার! লোকও তো কম নয়—
তোমার সোনার ঘড়িটা যদি বিক্রি করে ফেল, তাহলে টেনে মেনে এক রকম চলে—
আমার সোনার ঘড়িটা বিক্রি করে ফেলব! মাল্যবান দম ছাড়বার আগে দম ছাড়তেই পারবে না যেন সে আর এম্নি ভাবে নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
ঐ বিয়ের সময় যেটা পেয়েছিলে–মাল্যবানের মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে উৎপলা।
কিন্তু মাল্যবানের আরেক রকম—কেমন যেন পাট ভেঙে গেছে, এই ছিল এই এখুনি ইস্ত্রি লাট হয়ে গেছে এরকম মুখের দিকে তাকিয়ে বিশ্রী লাগল উৎপলার-বিরক্তি বোধ করল সে।
বাবা তিন শো টাকা দিয়ে তোমাকে ওটা কিনে দিয়েছিলেন। সেই বাপের জন্য আমি তোমাকে বিক্রি করতে বলছি আমার ভাইয়ের সুবিধের জন্য। এ না করে এ-ঘড়ি দিয়ে কাঁচাপাকা টিপ পরবে তুমি!
আয় রোদুর হেনে ছাগল দেব মেনে-র মতো বিলোড়িত মন্ত্রে যেন উৎপলার চোখ রৌদ্রের মতো হেনে পড়ল মাল্যবানের চোখে; কথা বলতে বলতে এগোতে এগোতে মাল্যবানের মুখের ওপর প্রায় পড়ল গিয়ে উৎপলা।
আস্তে আস্তে নিচে নেমে গেল, পুরোটা চা খাবার জন্যও ওপরে ফিরে এল না আর মাল্যবান।
খানিকক্ষণ পরে মনু নিচের থেকে ফিরে এসে বললে, বাবা বেরিয়ে গেছেন, মা।
চা না খেয়েই গেল যে। বলে চায়ের বাটিটা একটু কাৎ করে চাটুকু ছাদের এক কিনারে ঢেলে দিল।
মনুকে বললে, পরোটা খাবি?
এতটুকু বয়সেই তোদের অম্বল হয় শুনলেও হাসি পায়। পরোটা দুটো ছাদের ওপরে গোটা তিনেক কাকের উদ্দেশ্যে ছুঁড়ে ফেলে দিল উৎপলা। মনুর দিকে ফিরে তাকিয়ে বললে অম্বল! কথাটা শেখানো কে তোকে—
বুক জ্বলে যে।
তাকে অম্বল বলে তা ঠিক। কিন্তু কার কাছে শুনলে?
কেন, তোমরাই তো অনেক সময় বলো।
আমি বলেছি?
মনুর দিকে চোখ শানিয়ে তাকিয়ে উৎপাল বললে, আমার বাপের বাড়ি কারু কোনো দিন অম্বল হয়েছে যে বলব।
মনু চুপ করে রইল।
ঠিক করে বল তো কোথায় শুনেছিস কথাটা?
ধ্বেৎ, আমার অত মনে নেই
মনে নেই! এলি গেলি বাপের বিদ্যেয় বর্তালি, মনে নেই। যেমন দেখতে, তেমন লিখতে, কী যে বাপের গোঁই পেয়েছ, বাছা।
মাল্যবান যতই অভিমান করুক না কেন, যাতে খাবার সময় ঠিক হাজির হল। উৎপলা তিন জনের ভাত সাজাতে সাজাতে বললে, তোমার বড্ড ক্ষুদে মন—ক্ষুদিরামের মতন—ফাঁসির ক্ষুদিরাম নয়—ভারি নচ্ছাড় মন তোমার–
আমার?
চা না খেয়ে বেরিয়ে গেলে যে বড়ো?
ওঃ—চা–মাল্যবানের নাকের ভেতর দিয়ে খানিকটা হাসল—যেন কিছুই হয় নি; চায়ের কথাটা কিছুই মনে ছিল না যেন তার।
চা পরোটা পড়ে রইল—শেষে কুকুর-বেড়ালে খায়, গতর খায় গতরখেকোর রাগ।
না, না, রাগ নয়—খাবারের ওপর মানুষে আবার রাগ করে না-কি—অত আহাম্মক আমি নই? বলে মাল্যবান বুদ্ধিমান নীরাগীর মত ভাব দেখিয়ে পাঞ্জাবীর আস্তিন খানিকটা গুটিয়ে বললে, দেখি ভাতের থালাটা—
উৎপলা ছুরি দিয়ে একটা লেবু কাটতে কাটতে বললে, অহাম্মক হবার বাকিও রাখনি কিছু
মনুর মাথায় একটা চাটি মেরে উৎপলা বললে, ট্যালার মতো এই খাবারের জিনিসগুলোর কাছে থুবড়ি খেয়ে পড়ে আছিস যে! হাভাতে মেয়ে, বোস গিয়ে—ট্যাক-ট্যাক করে তাকিয়ে আছে। গুষ্টির খাই এখন থেকেই দমকে দমকে চাড় দিয়ে উঠছে পেটে।
মাল্যবানের ইচ্ছা হচ্ছিল এবারও সে উঠে যায়। কিন্তু তাতে কারু শিক্ষা হবে না। যে যা হবে না, তাকে তা করা যাবে না। মাঝখান থেকে না খেয়ে উঠে গেলে ক্ষিধের পেটে নিজেরও কোনো লাভ হবে না। মাল্যবানের সঙ্গে উৎপলা যদি টিকে থাকে মাল্যবানের মৃত্যু পর্যন্ত—এই রকম ভাবেই টিকে থাকবে; কোনো সংশোধনী বিজ্ঞানী বিদ্যে নেই এসব স্ত্রীলোকদের শোধরাবে—আমেরিকা বা রাশিয়ার হাতেও; কোনো লক্ষ কোটি অব্যয় কাল নেই ব্যক্তি মানুষের হাতে কয়লাকে যা হীরে করে দিতে পারে।
মনু চেয়ারে এসে বসল বাপের মুখোমুখি। মাল্যবান তাকে সান্ত্বনা দেবার কোনো ভরসা পাচ্ছিল না। মেয়েটির দিকে তাকাতে গেল না সে। মেয়েটির পাশে বসে আছে—কেমন কানাভাঙা খখানা খেমটা উত্তেজের অবসাদে মাল্যবানের মন ভারী হয়ে উঠতে লাগল। নিজে সে বাপ হয়েছিল বিয়ে করেছিল—হীন কুৎসিৎ উছুণ্ডে জীবনবীজ ছড়িয়েছিল ভাবতে ভাবতে মন তার চড় চড় করে উঠল। একটা পাখি সৃষ্টি করে তাকে যদি দারার অন্ধকারে ফেলে দেওয়া হয়—কেমন ছটফট করে উঠ লাগল মাল্যবানের ভেতরটা। মাল্যবান ভাবছিল উচিত ছিল তার একা থা.., খবরের কাগজ পড়ত, অফিসে যেত, গোলদীঘিতে বেড়াত, সভা সমিতিতে সামনের বেঞ্চে গিয়ে বসত, বেশি করে যেত থিওজফির সভায়, ফ্রীম্যাসনও হত, রাত জেগে ডিটেকটিভ উপন্যাসের থেকে কলকাতা ইউনিভার্সিটির মিনিট, নানা রকম কমিশনের রিপোর্ট, ব্ল বুক হাতের কাছে যা-কিছু আসত, তাই পড়ত, ভাবত, উপলব্ধি করত—কেমন চমৎকার হত জীবন তাহলে।
জীবনের সঙ্গে একজন স্ত্রীলোককে জড়িয়ে নিয়ে—এ-জড়িয়ে-নেওয়ার সমস্ত নিহিতার্থের ছোব পোচড় গায়ে মেখে দধিতে কাদায় মুখতায় ওগরানো অম্বলে আগুনে
অতৃপ্তিতে মণ্ডিত হয়ে কী হল সে।
খানিকক্ষণ থালায় বাটিতে চুপচাপ ভাত ডাল তরকারী সাজিয়ে উৎপলা পরে বললে, ছোটবেলায় বাপ-মা তোমাকে শিক্ষাদীক্ষা দিয়েছিল বেশ
কেন, কী হয়েছে, কী দেখলে তুমি?
না হলে এ-রকম হ্যাংলামো কেউ করে?
হ্যাংলামো? ভাতের থালাটা উৎপলার গায়ে ছুঁড়ে মারতে গিয়ে কোন্ বৈষ্ণবী শক্তির জোরে যে বিরত হল মাল্যবান দু-এক মিনিট খুন চাপা রক্ত চড়া মাথায় কিছুই বুঝতে পারল না সে।
আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা হচ্ছিল তার মন।
তা নয়তো কী—উৎপলা বললে।
কী করেছি আমি?
খুব যে আস্তিন টেনে ভাতের থালা কিলিয়ে পাকাচ্ছিলে—দেখছিলেই তো ভাত ডাল তরকারি মাছের বাটি তখনো তৈরি হয়নি। ঘাড়ের রোঁ সাদাটে মেরে গেল, এখনও নালা কুকুরের মতো খুব যে গুই গাঁই—খুব যে-ই গাই।
মাল্যবানের এক রাশি কথা বলবার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু খুব অল্পে সেরে দিয়ে সে বললে, আমার ক্ষিধে পেয়েছিল, থালাটা চেয়েছিলাম তাই।
ক্ষিধে তো ঘোড়ারও পায়; তাই বলে মানুষের টেবিলটাকে আস্তাবল করে তুলতে হবে। ভাতের থালাটা মাল্যবানের দিকে ঠেলে দিয়ে উৎপলা বললে, কুড়ি-পঁচিশ পেরিয়ে গেলেই সব কাপ্তেনী ফুরিয়ে যায়—ব্যাটাচ্ছেলেরা দিব্যি পুরুষ মানুষ হয়ে ওঠে—দিব্যি। সতেরো আঠারো বছর বয়সেই মেয়েরা স্ত্রীলোক হয়—কিন্তু বেয়াল্লিশ বছর বয়সেও ঢেস্কেলে কী থাকবে আর চেঁকি ছাড়া।
মাল্যবান ঘাড় ঝুঁকিয়ে খানিকটা দক্ষিণায়নে রেখে যাচ্ছিল।
উৎপলা এক গেরাস মুখে তুলে বললে, কপালে যদি হবার নয় লেখা থাকে তাহলে সে-লেখা কপালের ঘামে মুছে যাবার নয় তো ও-সব লেখা ঘামে রক্তে মোছে না।
মনু বুঝছিল না বিশেষ কিছু; মাল্যবান বলছিল না কথা কিছু খাবার ঘরে নিস্তব্ধতা খানিকক্ষণ; যে যার মনে নুন মাখিয়ে, লেবু টিপে, জলের গেলাস মুখে তুলে, তরকারীর বাটি কাৎ করে খেয়ে যাচ্ছিস।
কিন্তু অফিস থেকে এসে কী হয়েছিল শুনি? বললে উৎপলা; গায়ের ঝালটা কিছুতেই মরছিল না যেন তার।
মাল্যবান খাওয়ার ধরণ-ধারণ খানিকটা বদলে ফেলে একটু ভদ্রভাবে খেতে খেতে বললে, কিছু হয়নি।
ঝপ করে ওম্নি মিথ্যে কথা!
কী হবে আবার।
চা না খেয়ে চলে যাওয়া হয়েছিল যে।
চা আমি বাইরে খেয়েছিলাম।
কোথায়?
দোকানে।
কে খাওয়াল?
কে খাওয়াবে আবার—
গাঁটের পয়সা ভেঙে খেলে তো?
সেই রকম খেতেই আমি ভালোবাসি–
তোমার বন্ধুদেরও আশান হয়। কে আবার ট্যাঁকের পয়সা খরচ করে ডিমের বড়া খাওয়াবে ধরা গণেশকে। উৎপলা বললে, পয়সা খরচ করে তারা—খুব খরচ করে কিন্তু মানুষ বুঝে-মুখের দিকে ভালো করে তাকিয়ে দেখো।
উৎপলা কঠিন নিঃশব্দ দৃষ্টিতে মাল্যবানের আপদমস্তক কিছুক্ষণ প্রদক্ষিণ করে। দেখল।
এক পেয়ালা চা নিয়ে সাধে না; কেন, ঘরের বাইরে জলচল নেই তোমার?
চা নিয়ে সাধে না বাবাকে, মনু বললে, দই মিষ্টি?
মাল্যবান নিঃশব্দে একটা আলু টিপছিল।
আহ্বান যা আসে তাও শ্বশুরবাড়ির থেকে। লোচনা ডোমেরও জামাইষষ্ঠী হয়—সেইরকম আর কি। বেয়াল্লিশটা বছর বসে এত বড়ো পৃথিবীর ভেতরে থেকে মানুষসমাজে মানুষটা কানা—একেবারে ছুঁচো চামচিকের পারা উৎপলা খানিকটা জলে গলা ভিজিয়ে নিল, বললে, কোথাও ডাক নেই, কেউ পোঁছে না, হৈ-হল্লা নেই, ঘরে আড্ডা-মজলিশ নেই—খোল করতাল কেত্তন মুজরোর বালাই নেই—কোনো মানুষই আসে না—ডাকলেও আসে না। কিন্তু বয়ড়াকে কানে শোনাবে কে? ড্যাবড়াকে ডান হাত দেখিয়ে দিলে লাভ আছে।
মাল্যবান খাচ্ছিল। মনু শুনছিল, হাসছিল, ভুলে যাচ্ছিল, মানে বুঝছিল না, ফেলাছড়া করে অরুচি মুখে মাঝে মাঝে আদা খুঁটছিল খাচ্ছিল—
সেই বিয়ের পর থেকেই দেখছি কেরানীবাবুর নিচের তলার ঘরটিতে দুটো চেয়ার; একটাতে তিনি নিজে বসেন, আর একটাতেও তিনি নিজে বসেন। হাফ অখড়াই কে যেন আসতে মাঝে মাঝে-ওঃ, অভিরাম সারখেল; হামলা হচ্ছে বলে তাকে তাড়িয়ে দেওয়া হল।
একটা ঘোলা নিশ্বাস ফেলল উৎপলা। কিন্তু ব্যথাটা লাগল মাল্যবানের বুকে গিয়ে বেশি-বন্ধুবান্ধব নেই বলে নয়—মাল্যবানের জীবনের নিঃশব্দতার খানিকটা যে সূক্ষ্ম মানে আছে, তার ওপর এরকম খিঁচুনি খোঁচা এসে পড়ল বলে। অথচ উৎপলা মেজাজে থাকে না যখন আর, স্থির হয়—তখন আজীবন যেসব বিচিত্র বেচাল কথা বকে গেছে সে সবের বেকুবি তাকে নিঃশব্দ করে রাখে—এমনই নিঃশব্দ, মনে হয় যেন সমুদ্রের ওপারে পৃথিবীর পারে সকলের নাগালের বাইরে অন্তহীন হচ্ছি হব পেরিয়ে কেমন শাশ্বত হয়েছির নিবিড়তার ভেতর বসে আছে সে। কিন্তু এখন অন্যরকম উৎপলার : দুঃখের বিষয়, এইটেই তার আটপৌঁরে রকম।
একটা কাচের রেকাবী থেকে এক টুকরো লেবু নিয়ে ডালের সঙ্গে টিপতে টিপতে অসাধ অসফলতার বাহনের মতো কেমন একটা নিঃশ্বাস ফেলল উৎপলা; নিঃশ্বাসটা নিজের নিয়মে ঠিক—এত নিরাভরণ ভাবে ঠিক, যে মনে হয় অনেক অতল থেকে উঠে এসে নিজেকে মোটা ব্যবহারে খরচ করবার আগেই মিলিয়ে যায় সে; শুনলে মানুষের প্রাণ কেঁপে ওঠে।
পাতের কিনারে কাঁচালঙ্কাটা ফোঁড়ে ঘষে ডালের স্বাদ বাড়াবার চেষ্টা করতে গেল মাল্যবান আর। খাওয়া এখন অপ্রাসঙ্গিক। এই নারীটিকে নিয়ে কী সে করবে! উৎপলার এই সব ফাড়ন শূন্যতা দীর্ঘ নিঃশ্বাস, আড়াআড়ি মাল্যবানের নিস্ফলতা ও অব্যয় নিঃশ্বাস (মাল্যবানেরটা মারাত্মক কফের মতো বুকের ভেতর বসে গেছে, বাইরে তার প্রকাশ নেই, উৎপলা কোনো সময়ও টের পায় না) ঘরদোরের নিশ্ৰুপ বাতাসে ঘাই মেরে ফিরছে। কী হবে এই বাতাস ঘরদোর দিয়ে। এই নারী নিয়ে কী করবে সে।
যে-দু-চার জন লোক তোমার কাছে আসে, তাদের মুখের দিকে তাকাতে পারা যায় না।
কেন?
দেখতে তারা খুব খারাপ নয়, কিন্তু চুনো গন্ধ আসে রক্তের ভেতর থেকে। কোনো বিহিত-টিহিত নেই?
জানি না।
আমি তাদের সঙ্গে কথা বলি না তাই।
মানকচুর পাতার আড়ালে বসে আমার সঙ্গে কথা বলে ওরা। তোমাকে কোনো দিন দেখেছে বলে মনে হয় না।
উৎপলা বললে, মানকচুর পাতার আড়ালেই বর্ষাকালটা তোমার জমে বেশ দু-চারটে ক্যাকড়া চড়িয়ে। ওদেরি মত তুমি। নিজের স্ত্রী ছাড়া অন্য কোনো মেয়ের সঙ্গে তোমার আলাপন আছে?
কী হবে আলাপ করে?
আমি তা জানতাম। তোমার বন্ধুদের সম্পর্কে আমি যা ভাবি, পরের স্ত্রীরাও হয়তো তোমার সম্বন্ধে সেই কথাই ভাবে। বলে উৎপলা এঁটো হাত দিয়ে জলের গেলাসটা ঘাঁটতে-ঘাঁটতে বললে, ছি, কী ঘেন্না!
না, এমন ঘেন্নার কিছু নয়—আমাদের দুজনের জীবন দুই রকম, এই যা।
এত বড়ো পৃথিবীতে একজন মেয়েলোকও তোমার সঙ্গে খাতির করা দরকার মনে করল না, না ভলোবাসা, না স্নেহশ্রদ্ধা, না মমতা-সহানুভূমি-কোনো কিছু কেরানীবাবুটিকে দেবার মতো নেই কারু। ওঃ, আমার একারই বুঝি দিতে হবে সব। লক্ষ্মীর ঝাঁপি উৎপলা বলে; বলতে বলতে বলার মাথায় উৎপলা গলা চড়িয়ে দিয়ে বললে, একজন বেশ্যার সঙ্গেও যদি সমাভাগে তোমার সম্পর্কে আমর দায়িত্ব ভাগ করে নিতে পারতাম, তাহলে এতটা দম আটকে আসত না আমার—
শুনে মাল্যবান চমকে উঠল না, হেসেও উঠল না; ক্ষিধে ছিল; মাল্যবানকে খেতে দিতে চায় না উৎপলা; কিন্তু অবস্থা তো এইরকম। টেবিলে যা জিনিস আছে, তাকে চার-পাঁচটি জনে খেতে পারে, কিন্তু মনু নিজেরটুকুই খেয়ে উঠতে পারছে না; আর দু-জনের তো খাওয়া বন্ধ; চমৎকার কবিয়ালী লড়াই শুরু করেছে সময় বুঝে তারা।
টেবিলে মাথা রেখে মনু ঘুমিয়ে পড়ছিল। মাল্যবান একটা লেবুর খোসা নিয়ে আঁক কাটছিল থালার ওপর চুপচাপ।
আমি হিন্দুঘরের মেয়ে, বাধ্য হয়ে অনেক কথা আমাকে বিশ্বাস করতে হয়—
মাল্যবান লেবুর খোসা দিয়ে থালার ওপর স্বস্তিকা আঁকছিল—একটা-দুটোতিনটে—কোনো কথা বললে না।
বিশ্বাস-অবিশ্বাসের ব্যাপার সব মানুষই স্বাধীন—কিন্তু এমন পাকা ঘরে জন্মে বেটপকা ঘরে পড়েছি যে সে স্বাধীনতা হারিয়ে ফেলেছি–
বাধ্য হয়ে কী বিশ্বাস করতে হয় তোমাকে?
এ বিয়ে আমার হত, কিছুতেই ঠেকাতে পারতাম না, এই বিশ্বাস
ওঃ এই বিশ্বাস থালার স্বস্তিকাগুলো মুছে ফেলে জেঙ্গিস খাঁর নিশানের বারোটা পুচ্ছ—ইয়াকের উদ্যত পুচ্ছ আঁকবার চেষ্টা করেছিল মাল্যবান।
কিন্তু এটা সংস্কার, উৎপলা বললে, সত্য নয়। কিছুতেই সত্য নয়।
যেন গ্যালিলিও বলছে, আমি কিছুতেই বিশ্বাস করি না পৃথিবীটা চৌকো, আমি কিছুতেই বিশ্বাস করি না পৃথিবীটা স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। জেঙ্গিসের ইয়াকের লেজ আঁকতে আঁকতে একবার মুখ তুলে অনবনমিত গ্যালিলিওর দিকে তাকিয়ে চমৎকৃত লাগল মাল্যবানের—কেমন-একটা আভা যেন উৎপলাকে ঘিরে—বিজ্ঞানের পরা সত্যের জন্য তপস্যা করছে সে–সংগ্রাম করছে।
তোমাকে আমি না বিয়ে করেও পারতাম। সেইটেই সত্য। উৎপলা বললে
আমারও তো তাই মনে হয়। পাখিটাকে ফাঁদে ফেলে সেই ফঁদটাকে সত্য বলে নির্দেশ দেবার কোনো অর্থ হয় না। আকাশ সত্য নীড় সত্য পাখির কাছে।
উৎপলা এবার ভাত-তরকারীর দিকে মন দিয়ে বললে, আমি তাই বলছিলাম—
দু-এক গ্রাস খেয়ে সে বললে, অনুপম মহলানবীশকে তো বিয়ে করতে পারতাম আমি—
লেবুর ধোসা দিয়ে নখ দিয়ে জেঙ্গিসের ইয়াক-লাঙ্গুল-লাঞ্ছিত নিশান এঁকে ফেলেছে মাল্যবান—বারোটা লেজই এঁকেছে—থালার ওপর; চোখ তুলে তাকিয়ে বললে, কে অনুপম মহলানবীশ?
ঐ রকম একজন লোককেই বিয়ে করার কথা আমার। সেইটেই সত্য হত। কিন্তু পৃথিবীতে সত্যের মুখ দেখতে পাওয়া কঠিন।
থালার ওপর জেঙ্গিসের লাঙ্গুলের দিকে তাকিয়ে মাল্যবান বললে, ও, হ্যাঁ, অনুপম মহলানবীশ; মহানবীশের কথা শুনেছি আমি। অনুপম মহলানবীশ, ধীরেন ঘোষাল, নসু চৌধুরী—যেন বালেশ্বর যুদ্ধের, মেছোবাজার বোমার, কাকোরি মামলার, চাটগাঁ আরমারি রেডের শহীদ সব; কিন্তু তা নয়, এরা অন্য লোক, বিষয়ী লোক—এদের কথা আমাকে অনেক বার বলেছ তুমি। এদের কারুর সঙ্গে তোমার বিয়ে হলে ঠিক হত, দাঁড়িয়ে যেত। কিন্তু তা হয়নি। কিন্তু তাই বলে, তুমি হিন্দুঘরের মেয়ে বলে যা হল না সেটা সংস্কার, যা হয়েছে সেটা সত্য—এটা তুমি না মেনে পারছ বলছ।
খাবার থালার থেকে মুখ তুলে উৎপলার দিকে তাকিয়ে মাল্যবান বললে, না মেনে পারছ না বলছ। কিন্তু সত্যিই মানছ না। তোমার রক্তের ব্যাধিবীজাণুগুলো হয়তো মানছে, কিন্তু শ্বেতকণিকাগুলো না, তোমার আত্মা মানছে না।
উৎপলা একটা ভালো নিঃশ্বাস ছেড়ে বলতে বলতে গিয়ে বললে না কিছু। মাল্যবান পার্শে মাছের ঝোল দিয়ে ভাত চটকে লেবুর রস নিংড়ে নিচ্ছিল, লেবুর খোসাটা ফেলে দিয়ে বললে, হিন্দু বৌদের বোঝাবে কে যে এর চেয়ে স্থির বৈজ্ঞানিক সত্য নেই কিছু আর। এক হাজার বছর কেটে গেলেও বুঝবে কি তারা?
মীমাংসাটা ভালো লাগল উৎপলার, বললে, টেররিস্ট বলত সবাই অনুপম মহলানবীশকে। ডাকগাড়ি রেলগাড়ি লুট, ব্যাঙ্ক লুট, আর্মারি লুট, কত কী করেছে। অনুপম-কত জেলে পচেছে দেশকে স্বাধীন করতে; একবার ফাঁসির হুকুম হয়ে গিয়েছিল অনুপমের, কিন্তু কী করে তা বাতিল হল টেররিস্টদের দলে থেকে আমিও তা টের পেলাম না।
জেঙ্গিস খুব বড়ো খাঁ ছিল, ভাবছিল মাল্যবান, দুর্দান্ত লোক ছিল মঙ্গোলগুলো, কিন্তু কারণকর্দমের ভেতর মৃণালের মতো ছিল কুবলাই খাঁ।
কৈ, কখনো বলোনি তো আমাকে তুমি সন্ত্রাসষড়যন্ত্রের ভেতরে ছিলে।
বলে কী হবে, উৎপলা বললে, এখন তো আর নেই। ছিলাম অনেক আগে।
ফাঁসি বাতিল হয়ে গেল অনুপমবাবুর? আন্দামান হল?
না।
তাও হল না? তা কী করে হয়?
তা ইণ্ডিয়া-সেক্রেটারি বলতে পারেন। জেলও তো হল না।
জেলও হল না? থালার ওপর থেকে সমস্ত লাঞ্ছনা মুছে ফেলে পার্শে মাছের ঝোল ভাত খেয়ে খেয়ে শেষ করে এনেছিল প্রায় মাল্যবান; থালাটা আবার পরিষ্কার হয়ে এসেছে প্রায়; আবার ছবি আঁকা যাবে—আর একজন বড়ো খাঁর ছবি আঁকবে সে-কুবলাইয়ের ছবি।
আমি জানি না।
জেলও হলো না, অ্যাপ্রুভার হয়েছিল বোধহয় অনুপমবাবু?
আমি জানি না—
কিন্তু অ্যাপ্রুভার হয়েছিল বলে তার জন্য টান কমেনি তোমার?
উৎপলা ঘাড় বাঁকিয়ে ছুরি দিয়ে একটা লেবু কাটতে-কাটতে বললে, টেররিস্টরা বলেছে অনুপম স্পাই ছিল। হয়তো ছিল। হয়তো ফাঁসি হল না বলে ঐ কথা বলেছে।
স্পাই? মাল্যবান একটু বিলোড়িত হয়ে বললে, সে তো অ্যাপ্রুভারের চেয়েও খারাপ না কি অ্যাপ্রুভার স্পাইয়ে চেয়ে খারাপ স্পাই?
অনুপম স্বদেশী করছে, না স্বদেশীতের লাটের কিস্তিতে চড়াচ্ছে, সে সব ভেবে তাকে ভালোবাসিনি আমি। সে স্পাই বুঝি? উৎপলা নিজের দৃষ্টির ভেতর থেকে কুয়াশা সরিয়ে নিয়ে পরিষ্কার চোখে মাল্যবানের দিকে তাকিয়েই চোখ ফিরিয়ে নিয়ে একটু ঠাট্টা, বিষণ্ণতা ছিটিয়ে হেসে বললে, হবে স্পাই। অ্যাপ্রুভার হলে হবে। আমার তাতে কিছু এসে যায় না। মানুষের সঙ্গে সম্বন্ধ পাতানোর নিয়ম আমার আর এক রকম। জল নিয়ে কথা নয়, পুকুর নদী সাগরে ঢাউস জল তো আছে; কিন্তু সেই জল কি আছে—ফটিক জল?
না, তা নেই। অনুপম অ্যাপ্রুভার বলে নয়, অনুপম বলেই মেঘজল। মাল্যবান মাথার ওপরে খুব বেশি পাওয়ারের আলোটার দিকে একবার তাকিয়ে চোখ ধাঁধিয়ে ভাবছিল, বাঙালী হিন্দু পরিবারে উৎপলা আর সে রয়েছিল বলে; দু-জনের এই দাম্পত্য সম্পর্ক টিকল বারো বছর। এই বরোটা বছর উৎপলার অনিচ্ছা অরুচির বঁইচি-কাঁটা চাদা-কাটা বেত-কাটার ঠ্যাসবুনোনো জঙ্গলে নিজের কাজকামনাকে অন্ধ পাখির মতো নাকে দমে উড়িয়েছে মাল্যবান। কত যে সজারুর ধাষ্টামো, কাকাতুয়ার নষ্টামি, ভোদরের কাতরতা, বেড়ালের ভেংচি, কেউটের ছোবল আর বাঘিনীর নখ এই নারীটির। কিন্তু সে খাবার সামনে হরিণ বা বনগোরু না হয়ে রায়বাঘের মতো রুখে দাঁড়ালে ময়ূরীর মতো উড়ে যায় ডাল থেকে ডালৈ অদৃশ্যলোকের ঘনপাতার ভেতর কোন এক জাদুর জঙ্গলে এই মেয়েটি; না হলে ময়নার মতো পায়ের কাছে মরে পড়ে থাকে-হলুদ ঠ্যাং দুটো আকাশের দিকে। জীবনটা আমার যা চেয়েছিলাম তা হল না, যা ভয় করেছিলাম তার চেয়ে বেশি ভয়ে, বেশি শোকে গড়িয়ে পড়ল—ভাবছিল মাল্যবান। কিন্তু আমি—ভেবে-চিন্তে—আমি পুরুষমানুষ একটা পথ কেটে নিতে পারি, কিন্তু একটা দার্শনিক প্রস্থানে আমি পৌঁছতে পারি বলেই নয়—এম্নিই, উৎপলার জীবনের বিতিকিচ্ছিরি নিস্ফলতা, ব্যথা আমি পাইনি।
মনু ও উৎপলা খেয়ে মুখ ধুয়ে টেবিল পরিষ্কার করে চলে গেল। মাল্যবান একটা চুরুট জ্বালাল। খাবার ঘর ছেড়ে হাঁটতে হাঁটতে-ছাদের ওপর দু-মুহূর্ত দাঁড়িয়ে শীত রাতের আকাশের আগ্নেয় গুড়িগুলোকে এক নজরে একটা সুপরিসর চিলদৃষ্টির ভেতর কবলিত করে—উৎপলার ঘরে গিয়ে ঢুকল। টানতে টানতে চুরুটটা যখন বেশ জ্বলে উঠেছে, খুব ধোঁয়া উড়ছে, রাশি রাশি ধোঁয়া বেরুচ্ছে মাল্যাবেনর নাকমুখের ভেতর থেকে—মাল্যবানের মন কোথায় যেন চলে গিয়েছিল, এখন আবার অবহিত হয়ে উঠল। দেখল স্ত্রীর ঘরের বাতি নিভে গেছে—চারদিক অন্ধকার; মশারী টাঙিয়ে উৎপলা শুয়ে পড়েছে, ঘুমিয়ে পড়েছেও হয়ত। উৎপলার মশারীর ভেতর লেপের ভেতর শুয়ে পড়তে ইচ্ছা করছিল মাল্যবানের। কিন্তু এ-ঘরের চমৎকার শীত ও অন্ধকার ছেড়ে নিচেই যেতে হবে তাকে।
চুরুটের মুখে ছাই জমেছে, টোকা দিয়ে ঝেড়ে নিচে নেমে গেল।
পরদিন সকালে টেবিলে চা খাওয়ার সময় উৎপলা মাল্যবানকে বললে, কাল চায়ের দোকানে কী খেলে?
চা আর বিস্কুট।
আর কিছু না?
না।
বাবা যে সোনার ঘড়িটা তোমাকে দিয়েছিলেন, তার দাম তিন শো নয়—চার শো টাকা, আমার নোটবুকে লেখা ছিল দামটা, দেখছিলাম। আজকাল সোনার দাম বেড়ে গেছে—হয়তো দুশো টাকায় বিকোবে। টাকাগুলো হাতে থাকলে—মেজদাদারা আসছেন—সুবিধে হত তাদেরও, আমাদেরও। কিন্তু তবুও তুমি তো নিজের চেঁকি ছাড়া পাড় দেবে না।
উৎপলা এতক্ষণ চায় চুমুক দেয়নি। এবার চার-পাঁচটা চুমুকে আধ পেয়ালা চা শেষ করে পেয়ালাটা একটু সরিয়ে রেখে বললে, শুধু কি তাই, ঘড়িটা তোমাকে বেচে দিতে বলেছিলাম, তাই রাগ করে চায়ের দোকানে গিয়ে খেলে। এ আবার কী রকম—হিগলে পিগলে—হিগলে পিগলে–মেয়েমানুষের মতো নোলা ছব ছব করছে ঘড়িটা বিক্রি করার কথা পেড়েছিলাম বলে—এ আবার পুরুষ? কী রকম পুরুষ তাহলে। এসব পুরুষমানুষের ভরার মেয়ে মেয়ে বিয়ে করা উচিত।
ঠাণ্ডা শান্ত করুণ ভাবে কথা বলছিল উৎপলা। একটা চাপা ঝঝ যে না ছিল তা নয়। মাল্যবানের চোখে ভাব এল; উৎপলার হৃদয়টা বাস্তবিকই বেশ, ভাইয়ের জন্য এই সুচিন্তাটুকু আগাগোড়াই সৎ; আমার বদলে অন্য কোনো মানুষকে—উৎপলার সাদা রক্তকণিকা যাকে চায়, তাকে যদি পেত সে তাহলে নারীটির মনের প্রাণের স্পষ্ট প্রবণতাগুলো শত পথে খুলে যেত যেন—সফতলায়, সফলতায়–
ভাবতে ভাবতে মাল্যবান চোখ বুজে কেমন এক শামকল পাখির মতো মুখে নিগূঢ় হয়ে বসে রইল অনেক মন্ত্রগুপ্তি রয়েছে যার, সোনার ঘড়িটা কিছুতেই হাতছাড়া করবে না সে। নিজেকে যে এই রকম দেখাচ্ছে, তাও টের পেল মাল্যবান।
আমার সোনার নেকলেসটাই বিক্তি করতে হবে। বাপের বাড়ির মানুষদের আমাদের রকম এই যে, দশ জনের কাজে লাগলে কোনো জিনিসকেই পুঁজি করে রাখি না আমরা : ছড়িয়ে দিই চারিয়ে দিই। কিন্তু অন্য রকম হয়ে যাচ্ছি। বারো বছর বাপের ঘর ছাড়া। গোরুর মূত লেগেছে দুধে—কেন কাটবে না?
মাল্যবানের ভাবপ্রাধান্য—যা তাকে আবেশ দিয়েছিল-সময় মতো ভাটার টানে সেটা পড়ে যাচ্ছিল আবার; উৎপলা যা বলছিল, কিছু তার কানে ঢুকছিল শব্দ তরঙ্গের মতো; মন উৎকর্ণ হয়েছিল—উৎপলা নয়, মাল্যবান নিজেও নয়,—কিন্তু মাল্যবানের মনের অবচেতনা নিঝুমের দিকে : কী বলছে সে? ঘড়িটা বিক্রি করো না, ঘড়িটা বিক্রি করো, কোরো না বিক্রি করে দাও। কোরো না, করে দাও করে দাও। ঘড়িটা কি আজ বিক্রি করেছে সে? প্রায় তিন বছর আগে উৎপলারই একটা টাকার খাই মেটাবার জন্য বিক্রি করতে হয়েছিল ঘড়িটাকে। উৎপলা খুব ভালো করেই জানে তা। কিন্তু তবুও না জানবার ভান করে—সোনার দর বাড়লেই সেই সোনার ঘড়িটাকে বিক্রি করবার জন্য তোলপাড় করে তোলে, অন্য কোনো মানিকজোড়ের থেকে বিচ্ছিন্ন পাখিনীর মতো এমনই বিজোড় এই মেয়েমানুষটি মাল্যবানের জীবনে।
হাতে আর-একটা ঘড়ি আছে বটে মাল্যবানের, সেটা সোনার নয়। সেটা বিক্রি করতে হবে? না, তা ঠিক নয়। শ্বশুর যে সোনার ঘড়ি দিয়েছিল জামাইকে, সেইটাই বারবার বিক্তি করে শ্বশুরের ছেলে পরিবারকে একটু তরিবতে রাখতে হবে মাল্যবানের বাড়িতে, শ্বশুরের মেয়ের বাপের টাকাতেই যে সব হচ্ছে, সে উপলব্ধি নির্বিশেষে ভোগ করতে দিতে হবে শ্বশুরের মেয়েকে।
ব্যাপারটা এই রকম তো? একে কী বলে? পিতৃগ্রন্থি? না কি জোড়ভাঙা পাখি কূল পাচ্ছে না অথই শূন্যের ভেতর, তাই সামাজিক সাক্ষীগোপালটির চেয়ে ভাইকে নিকট মনে হয়—পিতৃগ্রন্থি সক্রিয় হয়ে ওঠে? না : তা ঠিক নয়, মাল্যবান ভাবছিল; কোনো বিজ্ঞানের ছকে ধরা যায় না, উৎপলা বিজ্ঞানাতীত।