০৫. মির্জা সাহেব ঘড়ি দেখলেন

মির্জা সাহেব ঘড়ি দেখলেন।

দুটা চল্লিশ। তিনি খানিকক্ষণ ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে রইলেন। দুটা চল্লিশ হবে কেন? ঘড়ির সময় কি বদলানো হয় নি? এ রকমতো কখনো হয় না। তিনি ঘড়ির ব্যাপারে খুব সজাগ। আজ নিশ্চয়ই পলিনের কারণে সব এলোমললা হয়ে গেছে। তাঁর সমস্ত ইন্দ্ৰিয় জুড়ে আছে মেয়েটি।

মির্জা সাহেব চারদিকে তাকালেন, কাউকে পেলে সময় জিজ্ঞেস করা যেত। রাত বেশি হলে হোটেলে ফিরে যাবেন। মেয়েটা একা আছে, ফিরে যাওয়াই উচিত অথচ ফিরে যেতে ইচ্ছা করছে না। এমন অদ্ভুত চাঁদের আলো তিনি অনেকদিন দেখেন নি। কেমন যেন নেশার মতো লাগছে। অস্থির লাগছে আবার এক ধরনের প্রশান্তিও বোধ করছেন।

কে একজন এগিয়ে আসছে। মির্জা সাহেব বললেন, কটা বাজে বলতে পারবেন?

লোকটি অপ্ৰস্তুত গলায় বলল, সাথে ঘড়ি নাই। আন্দাজ এগারটা।

আপনাকে ধন্যবাদ।

লোকটি অবাক হয়ে তাকাচ্ছে। মির্জা সাহেবের মনে পড়ল, কথায়-কথায় ধন্যবাদ দেয়ার রেওয়াজ বাংলাদেশে নেই। এটি পশ্চিমী ব্যাপার। বাংলাদেশে কেউ কোনো ধন্যবাদের কাজ করলে তার দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে আসা হয়। এই হাসিতেই ধন্যবাদ লুকানো থাকে।

মির্জা সাহেব অন্যমনস্ক হয়ে পড়লেন। অন্যমনস্ক না হলে লক্ষ করতেন তিনটি যুবক তার দিকে এগিয়ে আসছে। তিন জনের হাতেই জ্বলন্ত সিগারেট, তিন জনই কী নিয়ে যেন হাসাহাসি করছিল। হঠাৎ এক সঙ্গে তাদের হাসি থেমে গেল। হাসি এবং কান্না এমন জিনিস যে হঠাৎ করে থেমে গেলে অন্যমনস্ক মানুষের কানেও একটা ধাক্কা লাগে, ইন্দ্ৰিয় সজাগ হয়ে ওঠে। মির্জা সাহেব সচকিত হলেন। লক্ষ করলেন, তিন যুবকের মধ্যে এক জন বেশ খাটো। সে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটছে এবং তার এক পায়ে স্যাভেল অন্য পায়ে কিছু নেই।

ছেলেটি তার হাতের সিগারেট অনেক দূরে ছুঁড়ে ফেলল। সঙ্গে-সঙ্গে অন্য দুই জনও একই ভঙ্গিতে সিগারেট খুঁড়ে ফেলল। দৃশ্যটি অস্বাভাবিক। সিগারেটের জ্বলন্ত অংশ আমরা আশে পাশেই ফেলি, এত দূরে ফেলি না। এক জন যে জায়গায় যে ভাবে সিগারেট ফেলবে অন্য দুই জনও ঠিক তাই করবে এটাই বা কেমন? এই তিন জনের মনে কিছু একটা আছে। সেই কিছুটা কী?

বেঁটে যুবকটি তার দিকে এগিয়ে আসছে। অন্যেরা দাঁড়িয়ে পড়েছে। বেঁটে যুবকটির হাতে লম্বা কোনো একটা জিনিস যা সে গোপন করতে চেষ্টা করছে। আশে পাশে কোনো স্ট্রিট ল্যাম্প নেই বলেই যুবকটির মুখের ভাব ধরা যাচ্ছে না। চাঁদের আলো যত তীব্রই হোক মানুষের মুখের ভাব তাতে ধরা পড়ে না। বেঁটে যুবকটি মেয়েদের মতো রিনরিনে গলায় বলল, আছেন কেন?

মির্জা সাহেব বিস্মিত গলায় বললেন, আমাকে জিজ্ঞেস করছ?

জ্বি না। আফনেরে না। আফনের কান্ধে যে দুই ফিরিস্তা আছে তাহারে জিগাই।

আমি কিছু বুঝতে পারছি না।

সব কিছু কি বোঝা যায় চাচামিয়া? কিছু বোঝা যায়, কিছু যায় না। এই হইল জগতের নিয়ম।

মির্জা সাহেবের বিস্ময় আরো বাড়ল তবে তিনি তা প্রকাশ করলেন না। এই যুবকরা আসলে কী চায় তা তিনি বুঝতে চেষ্টা করছেন। বেঁটে যুবকটি তার সঙ্গে রসিকতা করার চেষ্টা করছে। নেশা করে আসে নি তো? এলকোহলের তিনি কোনো গন্ধ পাচ্ছেন না। এলকোহল ছাড়াও আরো সব নেশার জিনিস আছে। তেমন কিছু না তো? এমিটোফিন জাতীয় কোনো ড্রাগ। ঢাকা শহরে এসব কি চলে এসেছে?

তিনি সহজ স্বরে বললেন, কী ব্যাপার বলতো?

বেঁটে যুবকটি বলল, য়ভ য়পা না খিদে লাহা।

তিনি ভ্রূ কুঞ্চিত করলেন। এই যুবকটি কি কোন সাংকেতিক ভাষা ব্যবহার করছে?

বাকি দুজন যুবকও এবার এগিয়ে আসছে। মির্জা সাহেব বললেন, তোমরা কারা?

স্বাস্থ্যবান যুবকটি বলল, তুমি তুমি করছেন কেন? আপনার কি ধারণা আমরা কচি খোকা।

অবশ্যই তোমরা কচি খোকা নও। আমার বয়স অনেক বেশি সেই কারণেই তুমি বলছি।

আপনি কথা বেশি বলেন। নো টক।

আমি কিছুই বুঝতে পারছি না।

বেঁটে যুবকটি বলল, পেটের ভিতর যখন ক্ষুর হান্দাইব তখন বুঝবি বিষয় কি? হালা তুমি তুমি করে। হালার কত বড় সাহস।

লম্বামতো জিনিসটা যে একটা ক্ষুর তিনি তা আন্দাজে বুঝে নিলেন। সামান্য একটা ক্ষুর হাতে এই তিন যুবক তাঁকে ঘিরে ধরে আছে। এরা মাগার। পথচারীর টাকা-পয়সা ছিনিয়ে নেয়। অস্ত্রপাতির বল তেমন নেই। ক্ষুরের মতো সামান্য জিনিস নিয়ে পথে নেমেছে।

এটা কি ঢাকা শহরের স্বাভাবিক কোনো দৃশ্য? তাঁর কাছে রাতের নিউইয়র্ক বলে মনে হচ্ছে। তিনি নিউইয়র্কে দুবার মাগারদের হাতে পড়েছেন। দুবারই ওদের হাতে ছিল আট ইঞ্চি হোরা। প্রথমবার দুজন কালো ছেলে এসে পথ আটকে দাঁড়াল। এক জন নেশার কারণে দাঁড়াতে পারছিল না। ঢলে পড়ে যাচ্ছিল। দ্বিতীয় জন নেশা করে নি। সে শীতল গলায় বলল, একটা ডলার দিতে পার। খুবই প্রয়োজন।

তিনি ওয়ালেট বের করলেন এবং নিশ্চিন্ত হলেন ছেলেটি ওয়ালেট ছিনিয়ে নিয়ে দৌড়ে পালাবে। তা সে করল না। শান্ত ভঙ্গিতে ডলারের জন্যে অপেক্ষা করতে লাগল। মির্জা সাহেব ডলার বের করে দিলেন। ছেলেটি বলল, ধন্যবাদ। আমার এই বন্ধুকে কি তুমি এক শ ডলার দিতে পার? ওর এক শ ডলারের খব প্রয়োজন।

তিনি বললেন, এক শ ডলার আমার সঙ্গে নেই। সে এই ওয়ালেটটি নিতে পারে।

ধন্যবাদ। ঘড়িটা খুলে দাও।

তিনি ঘড়ি খুলে দিলেন। তখনি ছেলেছি প্রচণ্ড একটা ঘুষি তার পেটে বসিয়ে দিল। তিনি ছিটকে রাস্তায় পড়ে গেলেন। ছেলেটি ফিরেও কাল না। যেন কিছুই হয় নি এমন ভঙ্গিতে শিস দিতে দিতে এগিয়ে গেল। একবার পিছনে ফিরে তাকাল না। ভয়ংকর যে খুনী সেও অন্তত একবার তার খুনক মৃত দেহটির দিকে তাকায়।

এরাও কি সেই কালো ছেলেটির মতো? মনে হচ্ছে না। এদের চেহারা ভদ্র। অবশ্যি ঐ কালো ছেলেটির চেহারাও ভদ্র ছিল। কি সুন্দর করে কথা বলছিল।

মির্জা সাহেবকে চমকে দিয়ে বেঁটে ছেলেটি বলল, কিরে হালা কতা কচ না ক্যান?

বেঁটে জন বা হাতটায় একটা ঝাঁকি দিতেই খচ করে শব্দ হল। ক্ষুরের ফলা খুলে গেল। মির্জা সাহেব এই প্রথম বুঝলেন ক্ষুর একটা ভয়াবহ অস্ত্ৰ।

তোর পকেটে কী আছে?

ট্রাভেলার্স চেক। তোমরা এই চেক ভাঙাতে পারবে না।

মির্জা সাহেবের পেছনে দাঁড়ানো ছেলেছি বলল, চাচামিয়া তাইলে ফরেন মাল। আবুধাবি? না কি কুয়েত?

বেঁটে ছেলেটি খিকখিক শব্দ করছে। হায়োর হাসির সাথে এই শব্দের একটা মিল আছে। মির্জা সাহেব শান্ত স্বরে বললেন, তোমরা আমার ঘড়িটা নিতে পার। দামি ঘড়ি বিক্রি করলে কিছু পাবে।

তাঁর নিজের শান্ত গলার স্বরে তিনি নিজেই চমকে গেলেন। তিনি যেন বেশ মজা পাচ্ছেন কথা বলতে চাঁদের আলোয় এই তিন যুবককে কেন জানি মোটেই ভয়াবহ মনে হচ্ছে না। একটা খালি রিকশাকে এই সময় আসতে দেখা গেল। বুড়ো রিকশাওয়ালা, তাদের পাশ দিয়ে যাবার সময় হঠাৎ রিকশার গতি দুত করে দিল। এ রকম দৃশ্য সে মনে হয় আরো দেখেছে। এবং সে জানে এই সব ঘটনাকে পাশে রেখে দুত এগিয়ে যাওয়াই নিয়ম। পেছনের ছেলেটি মির্জা সাহেবের কাঁধে হাত রাখল। আগের মতো মেয়েলি গলায় বলল, চাচা মিয়া, চলেন এট্টু সামনে। আপনের লগে একখান কতা আচে।

কী কথা?

কথাটা হইল ব্যাঙের মাথা। কী ব্যাঙ? সোনা ব্যাঙ। কী সোনা…..

ছেলেটির কথা শেষ হল না। হাসতে হাসতে তার প্রায় গড়িয়ে পড়ার উপক্রম হল। যেন এ রকম মজার দৃশ্য অনেক দিন সে দেখে নি। মির্জা সাহেব বললেন, চল যাওয়া যাক।

এই কথায় যুবকদের মধ্যে একটু দ্বিধার ভাব দেখা গেল। বেঁটে যুবকটি বলল, তবসিমু লইহ।

আবার সেই সাংকেতিক ভাষা। মির্জা সাহেব আবার বললেন, চল কোথায় যাবে?

স্বাস্থ্যবান যুবকটি ধমকে উঠল, আবার তুমি?

তোমরা বয়সে আমার অনেক ছোট এই জন্যেই তুমি বলছি। অন্য কিছু নয়। তবে তোমাদের যদি অপমান বোধ হয় তাহলে আর বলব না।

বেঁটে যুবকটি চাপা গলায় বলল, নো টক। হাঁট। কুইক মার্চ। লেফট রাইট। লেফট।

যুবকরা দ্রুত পা ফেলছে। তিনিও প্রায় সমান তালে পা ফেলছেন। এই সব ক্ষেত্রে আচার-আচরণ খুব স্বাভাবিক রাখতে হয়। কথাবার্তা বলে টেনশন কমিয়ে দিতে হয়। তাই নিয়ম। এই তিনটি যুবকের মানসিকতা তিনি জানেন না। এরা কী পরিমাণ নিষ্ঠুর হতে পারে তাও জানা নেই। দীর্ঘ দিন পর দেশে ফিরেছেন। এই দীর্ঘ সময়ে অনেক কিছুই ঘটে গেছে। এখন হয়ত এ রকম দলছুট তরুণেরা চাঁদের আলোয় অকারণেই মানুষের পেটে ক্ষুর বসিয়ে দেয়।

পলিনের জন্যে তিনি তেমন কোনো দুশ্চিন্তা বোধ করছেন না। পলিন কী করবে তিনি জানেন। মার সঙ্গে কথা শেষ করে বাথরুমে ঢুকে খানিকক্ষণ কাঁদবে। তারপর চোখ মুছে ডায়েরি লিখবে। ডায়েরি লিখতে অনেক সময় নেবে যদিও লেখা হবে একটা কি দুটো লাইন। সেই লাইনগুলোও তিনি জানেন মা মণি তুমি এত ভালো। বাবাও এত ভাল। অথচ দুজন একসঙ্গে থাকতে পারলে না কেন? এই লাইন কটি লিখে সে আবার কিছুক্ষণ কাঁদবে। তারপর চোখ মুছে কিছুক্ষণের মধ্যেই ঘুমিয়ে পড়বে। এখন সম্ভবত সে ঘুমুচ্ছে।

মির্জা সাহেব বললেন, আমরা কোথায় যাচ্ছি?

বেঁটে যুবকটি সঙ্গে-সঙ্গে বলল, শ্বশুর বাড়ি। বলেই খিকখিক করে হাসতে লাগল। তার হাতে এখন ক্ষুর নেই। অস্ত্ৰটা সে তার প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে ফেলেছে।

বাইশ বছর পর দেশের কী হয়েছে তিনি দেখতে এসেছেন। ভালো সুযোগ পাওয়া গেল প্রথম রাতেই। তবে তিনটি যুবককে দিয়ে পুরো দেশ সম্পর্কে আঁচ করা যায় না। এই তিনটি যুবক হচ্ছে র্যান্ডম স্যামপ্লিংয়ের একটি স্যাম্পল। বাইশ বছর আগেও এরকম যুবকরা চাঁদের আলোয় শহরের পথে পথে ঘুরত। হাতে অবশ্যি ক্ষুর থাকত না। তিনি নিজেই কত রাতে বন্ধুদের সঙ্গে হেঁটে হেঁটে আনন্দ করেছেন। এরা যা করছে তাও এক অর্থে আনন্দ। তাঁদের রাতে হাঁটা বাতিক হয়েছিল ইউনিভার্সিটিতে ঢাকার পর। এগারটার সময় চা খেতে যাওয়া হত নীলক্ষেতে। সামান্য এক কাপ চা খেতে লগত এক ঘন্টা। চা শেষ করার পর কেউ-না-কেউ বলতখানিকক্ষণ হাঁটাহাঁটি করলে কেমন হয়? দুটো দল হয়ে যেত সঙ্গে-সঙ্গে। এক দল ফিরে গিয়ে পড়াশোনা করতে চায়। অন্যদল হাঁটতে যেতে চায়। শেষ পর্যন্ত সবাই মিলেই হাঁটতে যেত। এক সময় ক্লান্ত হয়ে রেসকোর্সের মাঠে লম্বা হয়ে শুয়ে থাকা। শুয়ে থাকতে থাকতে ঘুম এসে যেত। বদরুল একবার পুরোপুরি ঘুমিয়ে পড়ল। মজা করবার জন্যে তাকে ফেলে রেখে সবাই চলে এসেছিল।

এখনকার ছেলেরা কি এরকম করে? তিনি জানেন না। দেশের সঙ্গে তাঁর প্রায় কোনো যোগাযোগ নেই। মামাদের সংসারে মানুষ হয়েছিলেন। তিন মামার কেউই তাঁকে সহ্য করতে পারতেন না। স্কুলের বেতন, নতুন বই-খাতা, পরীক্ষার ফিস, এইসব যোগাড় করবার জন্যে একেক মামার কাছে তিনবার চারবার করে যেতে হত। পরীক্ষার ফিস হয়ত তিরিশ টাকা। এক সময় বড় মামা বিশ টাকার একটা নোট ফেলে দিয়ে বলতেন, যা-যা আর বিরক্ত করি না। টাকার দরকার হলেই বড় মামা। মামা কি আর নেই নাকি? আরেকবার আমার কাছে আসলে টান দিয়ে কান ছিঁড়ে ফেলব হারামজাদা। বাকি দশটা টাকার তখনও যোগাড় হয় নি। কী ভাবে হবে বা শেষ পর্যন্ত হবে কি-না কে জানে। ছেলেবেলার জীবনটা তাঁর অসম্ভব দুঃখ-কষ্টে কেটেছে। তবে মামারা তাকে পুরোপুরি ত্যাগ করেন নি। আমেরিকা যাবার ভাড়া এগার হাজার টাকা তাঁরাই যোগাড় করলেন। সেই জন্যে মেজো মামীর কানের দুল বিক্রি করতে হল। বড় মামী তার বাবার কাছ থেকে ছহাজার টাকা ধার আনলেন। যাবার দিন তিন মামাই এয়ারপোর্টে এলেন। বড় মামা এক ফাঁকে তাকে আড়ালে ডেকে নিয়ে বললেন, মনের মধ্যে কিছু পুষে রাখিস না। অনেক যন্ত্রণা দিয়েছি। সুখে থাকিস। এই বলেই ভীষণ কান্নাকাটি করতে লাগলেন। দরিদ্র মামাদের ঋণ মির্জা সাহেব শোধ করতে পারেন নি। সব কিছু কেমন এলোমেলো হয়ে গেল। চিঠি দিলে মামারা কেউ জবাব দেন না। বিদেশে চিঠি পাঠানোর বাড়তি খরচটা কেউ করতে চান না বোধ হয়। এক সময় তাঁরা তাঁদের ঝিকাতলার বাড়ি বিক্রি করে ফেললেন। টাকা ভাগাভাগি করে আলাদা হয়ে পড়লেন। মির্জা সাহেবও কয়েকবার ঠিকানা বদল করলেন। যোগাযোগ কিছুই রইল না। দেশ থেকে আসা এক জনের কাছে শুনলেন মেজো মামী মারা গেছেন। মেজো মামার মাথার দোষ হয়েছে। আমাদের এই সংসার জলে ভেসে যাচ্ছে। বড় দুই ছেলে গুণ্ডামি মাস্তানি করে। তাদের পড়াশোনা কিছুই হয় নি।

মির্জা সাহেব সাহায্য করবার জন্যে প্রস্তুত ছিলেন কিন্তু তাঁর সঙ্গতি ছিল না। নিজেরই তখন ঘোর দুৰ্দিন। পাশ করে বসে আছেন। চাকরি জোটাতে পারছেন না। গ্রিন কার্ড নেই। বিদেশিদের চাকরি দেবার ব্যাপারে খুব কড়াকড়ি। ভিসার মেয়াদও গেছে। শেষ হয়ে। লুকিয়ে লুকিয়ে থাকতে হয়। এই বন্ধুর বাড়িতে কিছু দিন ঐ বন্ধুর বাড়িতে কিছু দিন। সেই সময় কেরোলিনের সঙ্গে পরিচয়। পরিচয় থেকে বিয়ে। আমেরিকার অর্থনৈতিক মন্দার সময় তখন। গ্রিন কার্ড পাওয়ার পরও চাকরি হয় না। গুছিয়ে উঠতে উঠতে অনেক সময় চলে গেল। দেশের কে কোথায় তা নিয়ে ভাববার অবকাশই হল না।

এখন ভাববেন। কাল ভোরেই তিনি আমাদের খোঁজে বের হবেন। খুঁজে বের করা খুব একটা জটিল সমস্যা হবে না।

মির্জা সাহেব বললেন, আমরা কোথায় যাচ্ছি? বেঁটে যুবকটি বলল, নো কট। সঙ্গে-সঙ্গে তিনি সাংকেতিক ভাষার অর্থ উদ্ধার করলেন। ছেলেটি উল্টো করে বলছে। নো কট হচ্ছে—নো টক। বেঁটে ছেলেটির নামও তিনি জেনেছেন। তার নাম মজিদ। লম্বা ছেলেটি আলম। অন্যজনের নাম তিনি এখনো জানেন না।

নাম না জানা ছেলেটি বলল, সিগারেট দরকার। সিগারেট শেষ হয়ে গেছে।

মজিদ মির্জা সাহেবকে বলল, আপনার কাছে সিগ্রেট আছে?

না।

ধূমপান করেন না?

এককালে করতাম। এখন করি না।

ক্যানসারের ভয়ে?

হ্যাঁ।

এত বেঁচে থাকার শখ?

মির্জা সাহেব দুটি ব্যাপার লক্ষ করলেন, ছেলেটা কথার ধরন বদলেছে। ভদ্র স্বর বের করেছে। তাই হয়ে থাকে। পাশাপাশি কিছু সময় থাকা মানেই পরিচয়। নিতান্ত অপরিচিত এক জনের সঙ্গে খুব খারাপ ব্যবহার করা যায় কিন্তু পরিচিত কারোর সঙ্গে করা যায় না। সাইকোলজিস্টরা যে কারণে বলেন, খারাপ প্রকৃতির মানুষের হাতে। পড়লে মাথা ঠাণ্ডা রাখতে হবে। তারা যা বলে তাতেই রাজি হতে হবে। এবং চেষ্টা করতে হবে কথা বার্তা বলার। তাদের কেউ যদি বলে, আমরা এখন তোমাকে গুলি করে মারব, তখন ভয়ে অস্থির হওয়া চলবে না। ভয় খুব সংক্রামক। তোমার ভয় দেখে সেও ভয় পাবে। একজন ভীতু মানুষ ভয়ংকর কাণ্ড করে। পৃথিবীতে হত্যার স্টেটিসটিকস নিলে দেখা যাবে যে বেশিরভাগ খুনগুলো করেছে ভীতু মানুষেরা। কাজেই কেউ তোমাকে হত্যা করতে চাইলে তুমি সময় চাইবে। যাকে বলে কালক্ষেপণ। শুধু কথা বলবে। তুমি যদি নন স্মোকারও হও তবু বলবে, আমাকে মেরে ফেলতে চান, আমার কিছু করার নেই। দয়া করে আমাকে একটা সিগারেট দিন। একটা সিগারেট হাতে পাওয়া মানে পাঁচ মিনিট সময় বেশি পাওয়া। খেয়াল রাখবে, পাঁচ মিনিট অনেক সময়। এই সময়টা কাজে লাগাবে। এমন ধরনের কথা বলবে যার জন্যে হত্যাকারী প্রস্তুত নয়। যেমন, তুমি তার শার্টের দিকে তাকিয়ে বলতে পারআপনার এই হাওয়াই শার্টের রঙটা চমৎকার। আমার অবিকল এরকম একটা ছিল। এক লোকের হাতের জ্বলন্ত সিগারেটে শার্টটা ফুটো হয়ে গেছে। তোমার কথায় লোকটা হকচকিয়ে যাবে। তার শার্টের মতো তোমারও একটা শার্ট ছিল এটা শোনার পর তার সঙ্গে তোমার একটি সূক্ষ্ম বন্ধন তৈরী হবে। তোমার শার্টটি নষ্ট হয়ে গেছে। এতে সে তোমার প্রতি খানিকটা সহানুভূতি বোধ করবে। এই সহানুভূতি খুবই সূক্ষ্ম। তবে সূক্ষ্ম হলেও কাজের।

মির্জা সাহেব বললেন, একটা দোকান খোলা দেখা যাচ্ছে। ওখানে কি সিগারেট পাওয়া যাবে?

তারা জবাব দিল না কিন্তু খোলা দোকানটির দিকে হাঁটতে লাগল। দোকানের নাম। রূপা স্টোর। সাড়ে বত্রিশ ভাজা ধরনের দোকান। বিদেশি কসমেটিকস থেকে আইসক্রিম পর্যন্ত আছে। সঙ্গে কনফেকশনারি। দুজন কর্মচারী। এরা দুজনই দোকান বন্ধ করায় ব্যস্ত। তারা ঢাকা মাত্র বিরক্ত গলায় বলল, দোকান বন্ধ।

মাহিন বলল, পুরোপুরি বন্ধত এখনো হয় নাই ভাই। এক প্যাকেট সিগারেট নিব। ফাইভ-ফাইভ আছে।

আছে বিক্রি হবে না।

কেন হবে না?

একবার বললাম শুনলেন না, দোকান বন্ধ করে দিয়েছি।

মজিদ তীব্র চোখে তাকিয়ে রইল। কিছু বলল না। আলম বলল, ভাই রাত হয়ে গেছে সিগারেট পাওয়া যাবে না। আপনার কাছে আছে দিয়ে দেন চলে যাই।

সারাদিন বেচাকেনা করে কর্মচারী দুজনেরই মেজাজ খুব খারাপ। রোগা হাড় জিজিড়ে যে জন, সে-ই কটকট করছে। অন্যজন বেশ বলশালী। সে এতক্ষণ কথা বলে নি। এখন বলল, মালিক ক্যাশ নিয়ে দোকান বন্ধ করতে বলে দিয়েছে। আপনারা সিগারেটের দাম দিবেন আমি ভাংতি দিতে পারব না।

মাহিন বলল, যা দাম হবে তাই দিব ভাংতি দিতে হবে না।

মোটা কর্মচারী এক প্যাকেট সিগারেট বের করে বলল, পঞ্চাশ টাকা দেন।

মাহিন বলল, বাজারেত পঁয়তাল্লিশ টাকা, আপনি পঞ্চাশ চাচ্ছেন কেন?

বাজারে পয়তাল্লিশ হলে বাজার থেকে নেন।

সে প্যাকেট ঢুকিয়ে রাখল। আলম বলল, প্যাকেটটা ঢুকিয়ে রাখলেন কেন ভাই সাহেব? কিনব না এমন তো বলি নাই। হয়তো পঞ্চাশ টাকা দিয়েই কিনব।

আলম পঞ্চাশ টাকার নোটটা এগিয়ে দিল।

রোগা কর্মচারীটি সঙ্গে-সঙ্গে বলল, নোটটা বদলে দেন ছেড়া আছে।

কোথায় ছেড়া?

এই যে দেখেন স্কচ টেপ মারা।

মির্জা সাহেব এক দৃষ্টিতে আলমের দিকে তাকিয়ে আছেন। তিনি খুব অস্বস্তি নিয়ে লক্ষ করলেন, ছেলেটির ফর্সা মুখ লাল হয়ে উঠছে। যতদূর মনে হচ্ছে এর কাছে এই পঞ্চাশ টাকার নোটটা ছাড়া আর কিছু নেই। সম্ভবত তার বন্ধুদের কাছেও নেই। মির্জা সাহেব পরিষ্কার বুঝলেন ঘটনা এখন অন্যদিকে মোড় নেবে। তিনি কি কিছু করতে পারেন? তার কাছে বাংলাদেশি টাকা নেই। টাকা থাকলে চকচকে একটা পঞ্চাশ টাকার নোট কাউন্টারে রেখে দিতেন। এতে অবশ্যই কাজ হত।

আলম বলল, এই নোট রাখবেন না?

বলতে গিয়ে তার গলা কেঁপে গেল। মোটা কর্মচারীটি বলল, রেখে দেরে লিটু। ঝামেলা শেষ কর।

তার কথা শেষ হবার আগেই লিটু উলটে পড়ে গেল। আলম প্রচণ্ড একটা ঘুসি বসিয়ে দিয়েছে। ব্যাপারটা এত দ্রুত ঘটেছে যে আলম নিজেও ঠিক বুঝতে পারল না, কী ঘটে গেল। সে তাকিয়ে দেখল লিটু নামের লোকটা দুহাতে তার নাক চেপে ধরে আছে। তার আঙুলের ফাঁক দিয়ে গল গল করে রক্ত পড়ছে।

মোটা লোকটা বলল, এইটা কী করলেন?

মজিদ ভাঙ্গা ভাঙ্গা গলায় বলল, হারামজাদা তুই কানে ধর।

কী কন আপনে?

হারামী কানে ধর।

খুট করে শব্দ হল। মজিদ খাপ থেকে তার ক্ষুর বের করে ফেলেছে। মোটা লোকটি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে আছে। মজিদ হিসহিস করে বলল, কানে ধর কানে ধর।

মোটা কর্মচারীটির চোখে ভয় ঘনিয়ে এল। ভয় ঘনিয়ে আসাই স্বাভাবিক। মজিদের পুরো চেহারা পাল্টে গেছে। তার চোখে উন্মাদ দৃষ্টি। এই দৃষ্টি চিনতে কারোর ভুল হবার কথা নয়।

আলম লিটুর দিকে এখনো তাকিয়ে আছে। হাতের আঙুলের ফাঁক দিয়ে রক্ত পড়ছে। এই দৃশ্য তাকিয়ে দেখা যাচ্ছে না আবার দৃষ্টিও ফিরিয়ে নেয়া যাচ্ছে না। লিটু বিড়বিড় করে কি যেন বলল, মজিদ তার দিকে তাকিয়ে ক্রুদ্ধ গলায় বলল, নখু, রেক বলফে।

লিট্‌ কিছুই বুঝল না। কিন্তু মির্জা সাহেবের গায়ের রক্ত হিম হয়ে গেল। মাহিন কাউন্টারের এক পাশে রাখা ক্রিকেট ব্যাটের স্তুপের দিকে এগিয়ে গেল। প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই বিকট শব্দ হল। সে ব্যাট দিয়ে বাড়ি মেরে কাউন্টারের কাচের দেরাজ গুড়িয়ে ফেলেছে। ঘরময় কাচের টুকরা।

মোটা কর্মচারীটি প্রায় ফিসফিস করে বলল, মাফ করে দেন ভাইজান। মাফ চাই। মাফ…

মজিদ চাপা গলায় বলল, নখু রেক বলফে। মোটা কর্মচারী আবার বলল, ভাইজান মাফ করে দেন। ও লিটু ভাইজানের পায়ে ধরে মাফ চা।

লিটু সঙ্গে-সঙ্গেই রক্তমাখা হাতে মজিদের প্যান্ট চেপে ধরল। মজিদ প্রচণ্ড লাথি। দিয়ে তাকে কাচের টুকরোর উপর ফেলে দিল। আবার একটি শব্দ হল। মাহিন কাচের আরেকটি দেরাজ ভেঙ্গেছে।

মোটা কর্মচারীটি ভীতু গলায় বলল, লা-ইলাহা ইল্লা আন সোবাহানাকা ইনি কুন্তু মিনাজজুয়ালেমিন। লাই লাহা ইল্লা আনতা সোবাহানাকা ইন্নি কুন্তু মিনাজজুয়ালেমিন।

মজিদ চড়া গলায় বলল, নখু রেক বলফে।

ভাইজান মাফ করে দেন। ভাইজান মাফ করে দেন।

নখু রেক বলফে।

জানে মাইরেন না ভাইজান। আমার ছোট-ছোট দুইটা বাচ্চা।

মোটা কর্মচারীটি কেঁদে ফেলল। মির্জা সাহেবের আত্মা কেঁপে উঠল। লোকটি ভয় পাচ্ছে। অসম্ভব ভয় পাচ্ছে। এই ভয় সংক্রামক। এই ভয় ঢুকে যাবে মজিদের ভেতর তখন ভয়ংকর কিছু হয়ে যাবে।

মাফ করে দেন ভাইজান। মাফ করে দেন।

আর কোনো দিন কাস্টমারের সাথে খারাপ ব্যবহার করবি?

না ভাইজান না।

এরপর থেকে কাস্টমাররে বাপ ডাকবি?

জ্বি ভাইজান ডাকব।

আর মেয়ে কাস্টমার হইলে মা ডাকবি?

জ্বি ভাইজন ডাকমু।

ওরা বেরিয়ে এল। মির্জা সাহেব পেছনে পেছনে বেরিয়ে এলেন, যদিও তাঁর ধারণা তার কথা এখন আর তাদের মনে নেই। তারা কিছু দূর এগিয়ে একটা লাইট পোস্টের নিচে দাঁড়াল। এখন বেশিরভাগ লাইট পোস্টেই সোডিয়াম ল্যাম্প। এইটির তা নয়। সাদা টিউব লাইট জ্বলছে।

আলম বলল, মজিদ তোর সারা গায়ে রক্ত। এত রক্ত এল কোত্থেকে?

মজিদ তাকিয়ে দেখল, সত্যি রক্তে প্রায় মাখামাখি। সে শীতল গলায় বলল, দেখি সিগারেট দে।

আলম বলল, সিগারেটের প্যাকেটতো আনা হয় নি। আসল জিনিসই রয়ে গেছে। আবার যাবি?

মজিদ জবাব দিল না।

মির্জা সাহেব বললেন, আবার যাওয়া ঠিক হবে না। এতক্ষণে খবর হয়ে গেছে। লোজন চলে এসেছে।

মজিদ তীব্র গলায় বলল, আসুক না। ভয় পাই না-কি। আবদুল মজিদ কোনো শালাকে ভয় পায় না। উল্টো সব শাল আবদুল মজিদকে ভয় পায়।

আলম বলল, ক্ষুরটা খাপে ঢুকিয়ে রাখ মজিদ। দেখে ভয় ভয় লাগছে।

লাগুক ভয়। এই ক্ষুর দিয়ে আজ কোনো এক শালাকে আমি কাটব। না কাটলে মনে শান্তি হবে না। এই যে চাচা মিয়া আপনার নাম কি?

আমার নাম মির্জা।

তোমাকে আমি কাটব। কাটাকুটি খেলা হবে।

আমি অপরাধটা করেছি কী?

তুই শালা গরমের মধ্যে কোট পরেছিস। শালা ফুটানি দেখাচ্ছিস।

তোমরা যদি বল তাহলে কোট খুলে ফেলি।

শালা আবার তুমি করে বলে। মজিদ আচমকা এক চড় বসিয়ে দিল।

মির্জা সাহেব প্রথমবারের মতো সত্যিকার অর্থে ভয় পেলেন। তাঁর মনে হল দোকানে ঢুকবার আগে এরা যা ছিল এখন তা নেই। এখন তার সামনে অন্য একদল ছেলে দাঁড়িয়ে আছে। এরা যে কোনো মুহূর্তে ভয়ংকর কিছু করতে পারে।

মজিদ বলল, চল করিমের ওখানে যাই।

আলম বলল, করিমের ওখানে কেন?

ঐখানে গিয়ে এই চাচামিয়াকে কোরবাণী দিয়ে দিব। চাচা মিয়া কোট পরে ফুটানি দেখাচ্ছে।

আলম জবাব দিল না।

দলটি হাঁটতে শুরু করল। মীর্জা সাহেব লক্ষ করলেন মজিদ ছেলেটি এখন আর খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাটছে না। অর্থাৎ সে এই মুহূর্তে কোনো শারীরিক ব্যথা-বেদনা অনুভব করছে না। তিনি ঘড়ি দেখলেন। তাঁর ঘড়িতে এখন তিনটা বাজে। অর্থাৎ মাত্র আধা ঘন্টা সময় পার হয়েছে। এদের সঙ্গে যখন দেখা হয় তখন বেজে ছিল আড়াইটা। বাংলাদেশ সময় এখন কত? আলম ছেলেটির হাতে ঘড়ি আছে। তাকে কি সময় জিজ্ঞেস করবেন? জিজ্ঞেস করাটা কি ঠিক হবে?

মির্জা সাহেব আলমের দিকে তাকিয়ে বললেন, কটা বাজে?

উত্তর দিল মজিদ। চাপা গলায় বলল, চুপ।

মির্জা সাহেব নিঃশব্দে হাঁটতে লাগলেন। আকাশের চাঁদ জোছনার ফিনকি ছড়াচ্ছে। চারদিকে দিনের মতো আলো।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *