০৫. মা আর দুই মেয়ে

পঞ্চম পরিচ্ছেদ

ওসিআর ভার্সন। ভুল সংশোধন করা হয়নি।

মা আর দুই মেয়ে। বেকার ছোকরাদের ভয়

একটা গোটা দোতলা বাড়ির মধ্যে মাত্র তিনটি প্রাণী ওরা শ্যামার খোকা ত শিশু। আর অবশ্য একটি ঝি আছে। পাড়ার থাকা সত্ত্বেও চাকর রাখতে আর ভরসা হয় না রাসমণির প্রথমত রূপসী ও তরুণী মেয়েরা রয়েছে বাড়িতে, দ্বিতীয়ত অসহায় তিনটি মেয়েছেলে, চাকর যে কেমন হবে তা কে জানে! খুন ক’রে সর্বস্ব নিয়ে যাওয়ার ইতিহাসও ত বিরল নয়!

কিন্তু সে যাই হোক্ এদের যেন দিন আর কাটে না। কাজ সামান্য, রাসমণিই সেটুকু করেন। তাছাড়া তাঁর নিত্য গঙ্গাস্নান আছে, পূজা-আহ্নিক আছে। ভগবানের কাছে দুঃখ জানিয়ে কেঁদেও অনেকটা সান্ত্বনা পান। কিশোরী দুটি মেয়েকে সে পরামর্শও কেউ কেউ দেন বৈকি পাড়াপড়শী যারা আসেন, কিন্তু রাসমণি সে চেষ্টা করেন না। তিনি জানেন যে তা নিরর্থক। দেহ যে বয়সে পৌঁছলে মন ঈশ্বরাভিমুখী হয়, সে বয়সের এখনও বহু বিলম্ব ওদের। তিনি বলেন, ‘ওটা ভগবানকে নিয়ে ছেলেখেলা করা। ওতে পাপ আরও বাড়ে। ইষ্টের ছবি সামনে রেখে যদি মানুষকে ভাবে, তার মত পাপ আর কি আছে! তার চেয়ে কাঁদুক ওরা। ভগবান ওদের কাঁদতেই পাঠিয়েছেন পৃথিবীতে, নইলে এমন হবে কেন?’

উমার এই সময় একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হয়। কারুর মর্মন্তুদ দুঃখের কাহিনী যে ঈর্ষার বিষয় হ’তে পারে, এ নিজে না অনুভব করলে হয়ত বিশ্বাসই করত না। শ্যামা যখন একের পর এক তার দুর্বিষহ বেদনার কাহিনী বিবৃত করতে থাকে তখন সহানুভূতিতে উমার চোখ ছলছল করতে থাকলেও মনে মনে কেমন একটা অকারণ ঈর্ষাই অনুভব করেও। মনে হয়, তবু শ্যামা এত দুঃখের মধ্যেও জীবনের স্বাদ কিছু পেয়েছে। আঘাত পেয়েছে কিন্তু তাইতেই কি এটা প্রমাণ হয় না যে কিছু পেয়েছে সে স্বামীর কাছ থেকে? আঘাত পাওয়াও পাওয়া। তার স্বামীর মত ত উদাসীন নয় শ্যামার বর! জোর ক’রে দখল প্রমাণ ক’রে, সম্ভোগ করে সে পশুর মত বলপ্রয়োগ ক’রে তবু, তবু তা থেকে আসক্তিরই পরিচয় পাওয়া যায়। আর ওর স্বামী? রূপবান, মিষ্টভাষী

–যে কোন মেয়েরই কামনা করার মত তার কাছে ওর পরিপূর্ণ কৈশোরের সমস্ত কামনা ও অনুরাগের ডালি নিয়ে গিয়ে ফিরে এল, সে কঠোর

ঔদাসীন্য ও অনাসক্তির কপাট এতটুকু টলাতে পারলে না।

এক এক সময় মনে হয়

তার স্বামী অমনি নিষ্ঠুর, অমনি পশু হ’লেও সে নিজের জীবন ধন্য, সার্থক মনে করত। যে সুখের স্বাদ সে কোনদিনই পেলে না, শুধু তার ইঙ্গিত মাত্ৰ পেলে সে সুখের সঙ্গে মিশে যত আঘাতই আসুক না, সানন্দে সহ্য করত সে। আর হয়ত তাই স্বাভাবিক। নইলে শ্যামাও তার দানব স্বামীর জন্য প্রতিটি মুহূর্ত গুনত না

উমা শোনে আর মধ্যে মধ্যে তার বুক চিরে এক একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস পড়ে। শ্যামা মনে করে সেটা তার দুঃখের সমবেদনায় কিন্তু উমা অত্যন্ত লজ্জার সঙ্গে মনে মনে স্বীকার করতে বাধ্য হয় যে তা নয়–যেটা পেয়ে শ্যামার দুঃখ, সেটা না পেয়েই উমার এই দীর্ঘশ্বাস!

এমনই হয় জীবনে। আমার কাছে যা দৈন্য তা হয়ত তোমার কাছে ঐশ্বর্য পৃথিবীর সব অভাবই তাই আপেক্ষিক। যে মানুষ বৃহত্তর বেদনার ছবি দেখে সামনে, সে নিজের বেদনায় সান্ত্বনা পায় সহজে।

সে কথা থাক

শ্যামার প্রসবের সময় এগিয়ে আসে। রাসমণি বিপন্ন বোধ করেন। বড় জামাই ধনী ব্যক্তি,–অর্থসাহায্য করা তার পক্ষে সামান্য কথা। কিন্তু এসব ব্যাপারে অর্থের চেয়ে লোকবলটা বেশি প্রয়োজন। প্রয়োজন একটি পুরুষমানুষের। রাসমণি এক এক সময় আর সহ্য করতে পারেন না– অনুপস্থিত জামাইকে লক্ষ্য ক’রে কটুক্তি করেন, ‘ভাত দেবার ভাতার নয় নাক কাটার গোসাই! এদিক নেই ওদিক আছে। আর তুইও তেমনি বেহায়া মেয়ে।’

ইত্যাদি।

কিন্তু তাতে শ্যামার অশ্রুর পরিমাণই শুধু বেড়ে যায়। এক একদিন সে রাগ ক’রে খায় না। স্বামীর বিরহ যত দীর্ঘতর হয় ততই যেন এক অদ্ভুত নিয়মে তার দোষগুলো মুছে যায় ওর মানস-চিত্র থেকে। এমনও ওর মনে হয় এক এক সময়ে যে, সে এখন এসে পড়লে যেন সব সমস্যার সমাধান হ’ত। যদিও নিজের মনেই সে জানে এ-কথা

কল্পনা করাও হাস্যকর।

রাসমনি অবশেষে অদ্ভুত ভাবে এক আশ্রয় পেয়ে যান।

সেটা এক বর্ষার রাত ওঁরা তিনজনে শুয়েছেন একই ঘরে বাকী গোটা বাড়িটা খালি। এমন সময় শোনা গেল গলির দিকের বারান্দায় কার পায়ের শব্দ!

ভয়ে চেঁচিয়ে ওঠবারই কথা কিন্তু রাসমণি ভিন্ন প্রকৃতির মানুষ। তিনি উঠে জানালার ফাঁক দিয়ে দেখতে গেলেন। তবে যে লোকটিকে নজরে পড়ল তাকে দেখে রাসমণিও মুখ গেল শুকিয়ে। পাড়ার এক বিখ্যাত জমিদার-বাড়ির বেকার ছেলে নিজে গুণ্ডা এবং একটি দুর্ধর্ষ গুণ্ডার দলের প্রতিপালক। ইতিমধ্যেই তার কুকীর্তির ইতিহাসে আকাশবাতাস মুখরিত হয়ে উঠেছে। তবে এতদিন তার স্ত্রীলোক-ঘটিত কুকীর্তিগুলো শহরের দুটি কুখ্যাত বেশ্যাপল্লীতেই আবদ্ধ ছিল। কতকটা সেজন্যও বটে– কতকটা পয়সার জোরেও বটে, পুলিস থাকত উদাসীন। সম্প্রতি কি একটা ব্যাপারে জেল বাঁচানো যায় নি, বছরখানেক জেল খেটে সবে ফিরেছে। এরই মধ্যে যে আবার সে এমন সাহস করবে তা রাসমণির স্বপ্নেরও আগোচর। গ্যাসপোস্ট বেয়ে বারান্দায়

মণির স্বপ্নেরও উঠেছে। লক্ষ্য সম্বন্ধেও কোন সংশয় থাকাবর কারণ নেই।

রাসমণি পাথর হয়ে গেলেন। সে লোকটি রজত তার নাম সেও ও কে দেখেছে। সে বেশ সহজ কণ্ঠেই বললে, ‘ভাল চাও ত দোরটি খুলে দিয়ে সরে পড়ো কাকে-বকেও টের পাবে না। নইলে মিছিমিছি হাঙ্গামা হবে পাড়ায় আর কাল

মুখ দেখাতে পারবে না। আমাকে ত চেনো, যা ধরেছি তা করবই।’

রাসমণি এই প্রথম ভয় পেলেন। ঠক্ ঠক্ ক’রে কাঁপতে লাগল তাঁর হাত-পা। জবাব দেবেন ভেবেই পেলেন না। অসহিষ্ণু রজতেরও তখন অপেক্ষা করার মত মনের অবস্থা নয়। সে সজোরে মারলে একটা লাথি দোরের ওপর। পুরোনো বাড়ির জরাজীর্ণ দোর ঝন্ ঝন্ ক’রে উঠল সে পদাঘাতে।

মেয়েরাও উঠে প’ড়েছিল। তারা এবার ভয়ে চিৎকার ক’রে কেঁদে উঠল। সবাই মিলে দোরটা প্রাণপণে চেপে ধরে চেঁচাতে লাগল। ওদিকে রজতেরও মুখ থেকে কটুক্তি এবং পা থেকে লাথি যেন বন্যার মত বেরিয়ে আসছিল।

সে গোলমালে পাড়ার যে কারুর ঘুম ভাঙে নি তা নয়। জানালাও খুলে গিয়েছিল কয়েকটা আশেপাশে। রাসমণিকে পাড়ায় সবাই শ্রদ্ধা করে। কিন্তু রজতকে এই নাটকের নায়ক দেখে সবাই নিরস্ত রইল। সবাইকার জানালা আবার নিঃশব্দে বন্ধ হয়ে গেল, সকলেই যেন ঘুমে অচেতন।

শুধু বেরিয়ে এলেন শেষ পর্যন্ত একটি মুসলমান পরিবার। সাদিক মিয়া নাম, রাধাবাজার অঞ্চলে কিসের কারবার আছে।সাতটি জোয়ান ছেলে তাঁর তাঁরাই রজতকে ভয় করতেন কম। হৈ-হৈ ক’রে সাতটি ছেলে এবং চাকরবাকরসুদ্ধ সবাই এসে পড়তে রজত ওপরের বারান্দা থেকেই একটা লাফ মেরে নিচে পড়ল এবং ‘আচ্ছা, পরে দেখে নেব!’ বলে শাসিয়ে গলির অপর দিকে নিমেষে অদৃশ্য হয়ে গেল।

তখন অবশ্য অনেকেই বেরিয়ে এলেন। হুমকি-হামকিও বিস্তর বর্ষিত হ’তে লাগল অদৃশ্য রজতের ওপর। কিন্তু বুদ্ধিমতী রাসমণির এদের অবস্থা বুঝে নিতে দেরি হয় নি। তিনি মাথায় কাপড়টা টেনে দোর খুলে বেরিয়ে এসে হাত জোড় ক’রে সাদিককে বললেন, ‘বাবা, আপনার দয়াতেই আমার মেয়েদের ইজ্জৎ প্রাণরক্ষা পেয়েছে। ভগবান আপনার মঙ্গল করুন- কী আর বলব। এ ঋণ শোধ দেবার ত আমার কোন ক্ষমতা নেই।’

সাদিকের চোখ ছলছলিয়ে এল, তিনি বললেন ‘খোদা সাক্ষী রইলেন মা, আমাকে বাবা বলেছ আজ থেকে তুমিও আমার মেয়ে। আমার আর আমার সাত ছেলের গায়ে এক ফোঁটা রক্ত থাকতে কেউ তোমার কোন অনিষ্ট করতে পারবে না কোনদিন। তুমি নির্ভয়ে থাকো।’

সাদিক সত্যি-সত্যিই যেন ওঁকে মেয়ের মত দেখলেন। পরের দিনই সকালে বৃদ্ধ নিজে মিস্ত্রী সঙ্গে ক’রে এনে দরজায় ভারি লোহার ছিট্‌কিনি লাগিয়ে দিয়ে গেলেন, কাঁটা-তার দিয়ে বারান্দা ঘিরে দিলেন। তারপর থেকে প্রত্যহ সন্ধ্যার সময় মেয়ে কি পুত্রবধূ একজনকে পাঠিয়ে দিতেন এদের খবর নিয়ে যেতে। তারা সন্তর্পণে এসে ভেতরের রকে বসত এবং যথেষ্ট সতর্ক থাকত, এঁদের শুচিতা যাতে অক্ষুণ্ণ থাকে। রাসমণিই পরে জোর করে তাদের আপন ক’রে নিলেন। এক সেট পেতেলের বাসন ও করলেন ওদের খাওয়ানোর জন্য। বাসনগুলো একটু আগুন ঠেকিয়ে মেজে নেওয়া হ’ত

এবং পৃথক থাকত কিন্তু অতিথিরা কোন স্বতন্ত্র ব্যবস্থা টের পেতেন না। শ্যামা উমাকে সঙ্গে ক’রে রাসমণিও যেতেন মধ্যে মধ্যে ফিরে এসে কাপড় ছাড়তেন। এটুকু সংস্কারও যে থাকা উচিত নয় তা তিনিও স্বীকার করতেন, তবে বলতেন, ‘কী করব বল্, জন্মাবধি যা সংস্কার হয়ে গেছে সেটা ছাড়া কি সহজ? মানুষ মানুষই– তা জানি, তবু

ক্রমে এ দুটি পরিবারের ঘনিষ্ঠতা বেড়ে গেল। শ্যামা উমা সাদিকের নাতনী রাবেয়া আর নসিবনের সঙ্গে সই পাতিয়ে ফেলল।

দুই

শ্যামার এবার মেয়ে হ’ল। ফুটেফুটে সুন্দর মেয়ে। সাদিক মিয়াদের দৌলতে দাই ডাকা, বাজার-হাট করা কোনটাই আটকায় নি। কিন্তু ওদিকটায় নিশ্চিন্ত হ’লেও, রাসমণির ব্যাপারটা ভাল লাগে না। এ কি দুর্দৈব তাঁর। দুটি বিবাহিতা মেয়ে গলায় পড়ল

একটি আবার ছেলে-মেয়ে সমৃদ্ধ। এদের কি হবে–কি ব্যবস্থা করবেন কিছুই যেন ভেবে পান না। তাঁর ইষ্ট এবং পরকাল এ অভিশপ্ত জীবনের সর্বশেষ সান্ত্বনা, তাও যেন ক্রমে সুদূর হয়ে পড়ে।

মেয়ের নাম রাখা হয় মহাশ্বেতা। মাসী কমলা নাম রাখে। সে নভেল পড়েছে বিস্তর। ছেলের নামও সে-ই রেখেছিল, চিঠিতে লিখে পাঠিয়েছিল হেমচন্দ্ৰ। মহাশ্বেতা নাম শ্যামার খুব পছন্দ হয় নি কিন্তু রাসমণির ভাল লাগল।

কোথায় মনের কোণে শ্যামার যেন আশা ছিল যে অন্তত প্রসবের সময়ে নরেন

এসে পড়বে। এমন ত হঠাৎই আসে সে

এ আশার যে কি কারণ তা সে জানে না। তবু আশা ছিল ঠিকই।

কিন্তু দিন সপ্তাহ মাস

ক্রমে দু’তিন মাস হয়ে গেল, নরেনের কোন খবরই

নেই। নির্জনে চোখের জল ফেলে শ্যামা। একদিন ব’লে ফেলেছিল, ‘হয় ত ওখানে এসে ফিরে গেল মা আর ক-টা দিন দেখে এলে হ’ত।’ মা তাতে গম্ভীর মুখে জবাব দিয়েছিলেন, ‘বেশ ত, ঘর ভাড়া করে দিচ্ছি, সেখানে গিয়েই থাকো। সে ত এ বাড়ি

চেনে না, খবর নেয় ত ওখানেই নেবে।’

তারপর আর সাহস হয় নি কোন দিন শ্যামার সে প্রসঙ্গ তুলতে।

শেষ পর্যন্ত বুঝি ভগবান ওর ডাক শোনেন।

একদিন দুপুরবেলা কমলা এল পাল্কী ভাড়া ক’রে এসেছে তার ওখানে, এদের দেখতে চায়। শ্বশুরবাড়ি কুলোয় নি তাই বড় শালীর কাছে গেছে সুপারিশ ধরতে।

প্রায় ছুটতে ছুটতে। নরেন সোজাসুজি আসতে সাহসে

শ্যামা উৎসুক নেত্রে চায় মার দিকে। রাসমণি শুধু সংক্ষেপে ঘাড় নেড়ে বলেন, ‘না।’ সকলে স্তম্ভিত। শ্যামার মুখ বিবর্ণ হয়ে গেছে, সে মাটির দিকে চোখ নামিয়ে বসল। কমলা কিছুক্ষণ হতবাক্ হয়ে চেয়ে থেকে অতিকষ্টে যেন উচ্চারণ করে, ‘না?’

এবার কিছু কঠোর ও দৃঢ়কণ্ঠেই বলেন রাসমণি, ‘না! থাকবার আশ্রয় ঠিক ক’রে, এদের ভরণ-পোষণের ভার নিয়ে যেদিন নিয়ে যেতে পারবে সেদিন যেন গাড়ি নিয়ে এসে বাইরে দাঁড়ায়, আমি মেয়েকে পাঠিয়ে দেব। জামাইয়ের আর স্থান নেই এ-বাড়িতে।’

ভার নিয়ে

কিছুক্ষণ সকলেই স্তব্ধ। শেষে কমলা বেশ একটু ক্ষুণ্নভাবেই বলে, ‘এ আপনার কিন্তু অন্যায় মা!’

রাসমণি শান্ত স্থির দৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে উত্তর দেন, ‘আমি তোমার পেটে হই নি মা, তুমি আমার পেটে হয়েছ। ন্যায়-অন্যায় বিচার যদি এতদিনে না জন্মে থাকে ত তোমার কথায় আর তা জন্মাবে না। আমি জানি দুই বিধবা মেয়ে পুষছি বাড়িতে।’

শ্যামা রাগ ক’রে উঠে চলে গেল। কমলারও চোখে জল ভরে এসেছিল কিন্তু রাসমণির মুখের চেহারা দেখে আর কথা কইতে সাহস হ’ল না। শ্যামাকে সান্ত্বনা দেবার মত কোন কথা খুঁজে না পেয়ে সেই পাল্কীতেই আবার কমলা ফিরে গেল।

নরেন অবশ্য তখন কমলার দোতলার ঘরে টানাপাখার নিচে আরামে ঘুমোচ্ছে। তার পরনে শত-ছিন্ন কাপড়, খালি পা। সর্বাঙ্গ রুক্ষ। কমলা ওকে দেখামাত্র আনন্দের আতিশয্যে কোনমতে বামুন ঠাকরুণকে ওর খাওয়ার ব্যবস্থা করতে বলেই চলে গিয়েছিল। স্নানের কথা কেউ বলেও নি, সেও আবশ্যক মনে করে নি। মেঝেতে যে ঢালা বিছানার চাদরটা সদ্য পাল্টানো হয়েছে সেটা ইতিমধ্যেই মলিন ও ধুলি-ধূসর হয়ে উঠেছে।

এই পশুকে আত্মীয় বলে স্বীকার করতে লজ্জাই করে! কিন্তু কমলার মন বড় কোমল, তার ওপর শ্যামার কথা ভেবে সত্যিই ওর রাত্রে ঘুম হয় না। কঠিন কথা মুখে এলেও যত্নে দমন করলে। আস্তে আস্তে ওর ঘুম ভাঙিয়ে রাসমণির আদেশ বা নির্দেশ জানালে।

নরেন বললে, ‘তাই ত! মাগীর জেদ্ ত কম নয়। মেয়েটাকে দেখি নি তাই নইলে বোয়ের জন্যে অ ঘুম হচ্ছে না!

দিদি, এবেলা একটু পাটা নুচি খাওয়ান দিকি অনেক দিন ভাল-মন্দ খাই নি।’

যাক্ গে

এই বলে সে বিরাট একটা শব্দ ক’রে হাই তুলে আলস্য ত্যাগ করলে আরামে ও অতি নিশ্চিন্ত ভাবে।

অতিকষ্টে মনোভাব গোপন ক’রে কমলা বললে, ‘আচ্ছা সে ব্যবস্থা হবে তুমি ভাই চান করো দিকি ভাল ক’রে তেল মেখে

‘চান? এই। বেলায়?’

‘তা হোক।’

‘মুশকিল। কাপড়-চোপড়–

‘আচ্ছা সে ব্যবস্থা হবে। তুমি উঠে কলঘরে যাও দিকি। বিছানাটার কি হাল করেছ?’

‘ইস তাই ত! ময়লা হয়ে গেছে, না? আচ্ছা চানই করছি এক বাটি তেল দিতে বলুন তাহলে আপনার ঝিকে। আর অমনি এক ছিলিম তামাক —

কমলা স্বামীর একখানা ধোয়া কাপড় বার ক’রে দিলে। একটা জামাও। নরেন অনেকদিন পরে ভাল ক’রে স্নান করে টেরি কেটে গুনগুন ক’রে আদিরস-ঘেঁষা একটা গান গাইতে গাইতে বেরিয়ে এল কলঘর থেকে। তারপর কাপড়জামা পরে আর একটি ঘুম। আহারাদি ক’রে কিন্তু আর রাত্রে থাকতে রাজী হল না কিছুতেই, বললে, ‘দিদি, অনেকদিন পরে আজ বড্ড আরাম হয়েছে। ওটা পুরো ক’রে ফেলি। এখানে শুলে হবে না কিছুতেই একটা টাকা দিন দিকি। নিদেন আট আনা। আমি ফিরিয়ে দেব ঠিক।

བཌ། ) 1) ( সেজন্যে ভাববেন না!’

৬৩

কমলা একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে টাকাটা বার ক’রে দিলে!

ভালই হল, স্বামী সেদিন তখনও ফেরেন নি, বরানগরে বাগানবাড়ি দেখতে গেছেন কাজকর্ম সেরে। এই আত্মীয় তাঁর সামনে দেখাতে যেন লজ্জায় মাথা কাটা যায়!

এরও দিন-পনরো পরে, ঝিয়ের অসতর্কতার অবসরে দোর খোলা পেয়ে নরেন সটান্ এ-বাড়ির দোতলায় এসে হাজির।

রাসমণি তখন দ্বিপ্রহরের বিশ্রামের পর উঠে সুপুরি কাটছেন। ওকে দেখে শুধু যে বিস্মিতই হলেন তাই নয় এমন একটা অপরিসীম ঘৃণা ওর কণ্ঠ পর্যন্ত ঠেলে উঠল যে কিছুতেই কোন শব্দ উচ্চারণ করতে পারলেন না, নীরবে শুধু তাকিয়েই রইলেন।

কথা কইলে নরেনই। নাটকীয় ভাবে হাত-পা নেড়ে বললে, ‘ব্যবস্থা ক’রেই এসেছি। বার করুন দিকি চটপট আমার ছেলেমেয়ে পরিবার।’ এই বলে রাসমনের উত্তরের অপেক্ষা না ক’রেই বেশ গলা ছেড়ে হাঁক দিলে, কৈ গো, কোথায়! তৈরি হয়ে নাও তাড়াতাড়ি।’

রাসমণি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘তার আগে কি ব্যবস্থা করেছ শুনি?’

‘কেন? সে খবরে আপনার দরকার কি? আমার পরিবার আমি যেখানে খুশি নিয়ে গিয়ে তুলব।’

রাসমণি কী একটা কঠিন জবাব দিতে যাচ্ছিলেন কিন্তু তার আগেই শ্যামা বলে উঠল, ‘কোথায় নিয়ে যাবে না জেনে আমি নড়ব না এক পা-ও। তোমাকে বিশ্বাস নেই, যদি খারাপ পাড়ায় নিয়ে গিয়ে তোলো!’

যদিও সে এতদিন একান্ত মনে স্বামীকেই কামনা করছিল তবু আজ এই মুহূর্তে তার আশঙ্কাই প্রবল হয়ে উঠল আবার। আর দেখা পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে একটা উদ্ধত অভিমানও।

নরেন ধমক দিয়ে উঠল, ‘থাম্‌ থাম– মেলা ফ্যাচ্ ফ্যাচ্ করতে হবে না। ছোট মুখে বড় কথা। হাজার হোক আমার গুরুবংশ’ কানে ফুঁ দিলে আমাদের পয়সা খায়

পদ্মগ্রামের সরকারবাড়ি নিয়ম-সেবার কাজ নিয়েছি। একটা ঘর ছেড়ে দেবে, সেইখানেই নিয়ে গিয়ে তুলব। নাও নাও, চটপট তৈরি হয়ে নাও। এখন হাঁটা দিতে শুরু করলে তবে যদি রাত্তিরে গিয়ে পৌঁছতে পারি!’

কে?

‘হেঁটে যাবেন? এতটা পথ? সে কি?’ উমা প্রশ্ন করে।

হুঁ। নইলে কি নবাব-নন্দিনীর জন্যে গাড়ি পাল্কী করতে হবে নাকি? অত ক্ষ্যামতা আমার নেই।’

,

রাসমণি ততক্ষণে সামলে নিয়েছেন কতকটা। ঘর থেকে বেরিয়ে গিয়ে উমাকে ডেকে বললেন, ‘বেহায়াটাকে বল উমি রাত্তিরে আমি নাতি-নাতনী পাঠাবো না। অত বাহাদুরিতে কাজ নেই, আজ থাক– কাল সকালে যেন যায়। গাড়ি ক’রেই যায় যেন, গাড়িভাড়া আমি দেব।’

মুহূর্তে সব আস্ফালন থেমে গেল। একেবারে নিস্পৃহ নিরাসক্ত কণ্ঠে নরেন বললে, ‘দেখুন আপনাদের যা সুবিধে। মোদ্দা, আমি সেধে থাকতে যাই নি, এরপর যেন আমাকে দুষবেন না।’

གཏོ ། །

৬৪

তারপর বিনা নিমন্ত্রণেই জাঁকিয়ে বসে বললে, উমা, আমার ভাই আবার তামাক খাবার অভ্যেস ঝিটাকে বাজারে পাঠাও দিকি, একটা থেলো হুঁকো আর টিকে

তামাক কিনে আনুক। ‘

রাত্রে শ্যামা প্রশ্ন ক’রে সব জেনে নিলে। ঠাকুরঘরের সঙ্গে লাগাও একখানি পাকা ঘর তারা ছেড়ে দেবে। আর মিলবে আধসের আতপ চালের একখানা ক’রে নৈবেদ্য, রাত্রে শেতলের এক পো দুধ আর ক-খানা বাতাসা। এই ভরসাতে নরেন স্ত্রী-পুত্র-কন্যাকে সেই নিবান্দাপুরীতে নিয়ে যাচ্ছে। জায়গাটা কোথায় সে সম্বন্ধে শ্যামার কোন ধারণাই নেই, শুধু শুনলে যে শিবপুর কোম্পানীর বাগান থেকেও প্রায় দু ক্রোশ দূরে, অজ পাড়াগাঁ।

শ্যামা কিছুক্ষণ স্তম্ভিত আড়ষ্ট হয়ে থেকে বললে, ‘তারপর? চলবে কিসে?’

শাঁকে ফু! পুরুতগিরি করব। ঢের যজমান জুটে যাবে। বাপঠাকুদ্দা ঐ ক’রে অত পয়সা ক’রে রেখে গেছে আমি শুধু সংসারটা চালাতে পারব না?’

‘তাদের পেটের বিদ্যে ছিল। তুমি তো পূজোর মন্তরও জানো না।’ রাগ ক’রে

বলে শ্যামা।

‘আরে

শাঁখ ঘন্টা ত নাড়তে পারব। তাতেই হবে। তাতেই হবে। মন্তর আবার ক. ঠাকুর হাবলা গোবলা ভোগ খাও ঠাকুর খাবলা খাবলা! এই ত!’

নিজের রসিকতায় নিজেই হা-হা ক’রে হেসে ওঠে। পাশের ঘরেই মা শুয়ে আছেন মনে পড়ায় শ্যামা তাড়াতাড়ি ওর মুখের ওপর হাতটা চেপে ধরে।

হাসির ধমকটা সামলে নিয়ে হঠাৎ নরেন বলে, ‘তোমার মা মোদ্দা রাঁধে ভাল। খাওয়াটা বড্ড চাপ হয়েছে।

তারপর কিছুক্ষণ চুপ ক’রে থেকে একসময়ে বলে, ‘উমিটা ত দিব্যি দেখতে হয়েছে। ভায়রাভাইটা নিরেট বোকা! মাইরি!’

শ্যামা অন্ধকারেই শিউরে উঠল। ভয়ে না ঘৃণা

তা নিজেই বুঝল না

সকালে উঠে জলযোগাদি সেরে নরেন শাশুড়ীর উদ্দেশে বলে, ‘তাহলে কিছু বাসন-কোসন বিছানা-টিছানা অমনি গুছিয়ে দেবেন মা। নতুন ক’রে সংসার পাতা, বুঝতেই ত পারছেন।! গাড়ি ক’রেই যখন যাওয়া হবে তখন দিব্যি গাড়ির চালে চাপিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে’খন।’

উত্তর দেবেন না মনে করেও কথা কয়ে ফেলেন রাসমণি, ‘অত যে বাসন ছিল সিন্ধুক ভরা তার কিছু নেই?’

‘যা পেয়েছি তা আর আছে। কবে বেচে মেরে দিয়েছি। আর বাকী সব লোকের বাড়ি জমা ছিল –দিলে না শালারা মেরে দিলে!

বেশ নিশ্চিন্ত ভাবেই জবাব দেয়।

রাসমণি নতুন ক’রে ঘর-বসতের জিনিস সাজিয়ে দেন চোখের জল মুছতে মুছতে। যাবার সময় গাড়িভাড়া ছাড়া পাঁচটা নগদ টাকাও চেয়ে নেয় নরেন, ‘গিয়ে ত বাজার-হাট আছে, বুঝলেন না! আমি ত শুন্যিরেস্ত। আপনি আবার নাতি-নাতনীকে দুধ খাইয়ে খাইয়ে যা নবাব করে তুলেছেন।

དེ་ལ་གཏག་

আলার বই

ਹਰਿ ਨਿਯਤੋ_4

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *