০৫. মাথা আর চিন্তা আর দূরদৃষ্টি

০৫.

শঙ্কর সারাভাইয়ের মাথা আর চিন্তা আর দূরদৃষ্টির ওপর কারো যদি বিশেষ আস্থা থেকে থাকে–সেটা ছিল তার মেসো মহাদেব সারাভাইয়ের।

কিন্তু মগজের ওপর আস্থা যত ছিল, তার চাল-চালন কাজকর্মের প্রতি বিশ্বাস ততো ছিল না। নইলে এতবড় কষ্ট চেম্বারের সে সুপারিনটেনডেন্ট, কত লোককে এখানে কোল, কতজনের সংস্থান করে দিল, কতজনকে ওপরে তুলল, ঠিক নেই। মানুষ করতে পারল না শুধু স্ত্রীর আদরের বোনপোটিকে। তার মতো বি. এসসি. পাস করে সাত বছর ধরে ছোকরা ভ্যারেণ্ডা ভাজছে। তার অফিসে চাকরি করার জন্য কতদিন সাধাসাধি করেছে, কিন্তু এখনো হতভাগা আকাশ কুসুম কল্পনা নিয়ে আছে। চিন্তা করলে কাজের চিন্তা করতে পারে সেটা তার থেকে বেশি আর বোধহয় কেউ জানে না। কিন্তু সেদিকে মাথা না মন।

বাপের যা ছিল কুড়িয়ে কাঁচিয়ে ব্যবসায় ঢেলেছে। সেও শহরে নয়, এখান থেকে চল্লিশ মাইল দূরে মেলায় গিয়ে। ব্যবসা বলতে ভাঙাচোরা মেশিন একটা, নিত্য অচল হয়, আর গোটাকতক তাত। বিধবা বড়বোনকে নিয়ে সেখানেই থাকে–হাঁড়িতে জল ফোটে, দোকানে চাল। তবু ব্যবসা করার গো যায় না। ওদিকে মূলধনের অভাবে মাসের মধ্যে দশদিন ফ্যাক্টরি বন্ধ। চলুক না চলুক গাল-ভর। নাম না হলে মন ওঠে না–চাল নেই চুলো নেই, তবু ফ্যাক্টরি। আজ যন্ত্র বিগড়ল, কাল সুতোয় টান পড়ল–এমনি একটা না একটা লেগেই আছে।

মেসো নিঃসন্তান। অতএব বোনপোর প্রতি স্ত্রীর স্নেহ ঠেকাবে কি করে। টাকার দরকার হয়ে পড়লে মাসি-অন্ত প্রাণ ছেলের। মাসিও টাকা চেনে না এমন নয়। কিন্তু একবার যদি হুকুম হয়ে গেল, দাও, তো দাই। কম করে দু-তিন হাজার টাকা এ পর্যন্ত তাকেও শ্ৰীমানের ওই ব্যবসায় ঢালতে হয়েছে। সেই টাকা সব জলে গেছে। বার কয়েক ঘা খেয়ে তবে স্ত্রীর একটু টনক নড়েছে। ভদ্রলোকের রোজগার ভাল, খরচ কম। তাই হাতে আছেও কিছু। কিন্তু কৃপণতার ধাত। শঙ্করকে মনে মনে পছন্দ করে, কিন্তু তাকে দেখলে অস্বস্তি বোধ করে। ভয়, এই বুঝি খসাতে এলো কিছু।

কিন্তু তবু এই ছেলেটাকে পছন্দ করারও একটা কারণ আছে। ভদ্রলোকের টাকার ওপর লোভ খুব। আগে আগে এই লোভে শঙ্কর ভালই ইন্ধন যুগিয়ে এসেছে। যে বিশ্বাসের ফলে টাকার মুখ দেখা যায়, সেই বিশ্বাসটাকে সকলেই আঁকড়ে ধরতে চায়। ম্যাজিকের মতো হাতে-নাতে সেই ফল দেখিয়ে ভদ্রলোককে ঘায়েল করেছে সে। তাই তার ওপর ক্ষোভও যেমন তলায় তলায় আশাও তেমন।

ব্যবসায় দুর্বুদ্ধি মাথায় চাপার আগে কিছুকাল শেয়ারবাজারে ঘোরাঘুরি করেছিল আর সেখানে থাকতে ছোকরার মাথাও ভালো খুলেছিল। সেখানকার কিছু মাথাওয়ালা লোকের সঙ্গে খাতিরও হয়ে গিয়েছিল। তাদের পরামর্শের সঙ্গে নিজের বুদ্ধি খাঁটিয়ে বেশ দু’পয়সা বাড়তি রোজগারের সহায়তা করেছিল মেসোর। দুশো টাকা হাতে নিয়ে পনেরো-বিশ দিনের মধ্যে চার পাঁচশো টাকা এনে দিয়েছে–এমন বার কতক হয়েছে। এ ব্যাপারে বিশ্বাস বাড়তে বাড়তে মেসো এক-একবার হাজার দু-হাজার টাকাও তুলে দিয়েছে শঙ্করের হাতে। দেবার সময় তার হাত অবশ্যই কেঁপেছে আর সে টাকা ফিরে না আসা পর্যন্ত রাতে ভালো ঘুম হয় নি। তারপর আবার যে পরিমাণ টাকা ফিরেছে, তাতেও ঘুম হয় নি। শঙ্করকে এই নিয়েই থাকতে বলেছে সে, দিন-কাল সম্পর্কে অনেক গুরুগম্ভীর উপদেশ দিয়েছে। এমন কি উদার চিত্তে তার আর তার দিদির ভারও নিতে চেয়েছে। কিন্তু সুবুদ্ধি থাকলে তার এই দশা হবে কেন, তাহলে তো তার অফিসে চাকরিই করত একটা। মাথা দিয়ে কাজ করলে উন্নতিও যে সহজেই করতে পারত কোন সন্দেহ নেই। তার ওপর আপনার জন যখন আগেই মাথার ওপর। চাকরিটা করলে মেসোর দুর্ভাবনা থাকত না, হাতের মুঠোতেই রাখা যেত ওকে। আর মন দিয়ে তখন বাড়তি রোজগারের চেষ্টায়ও লাগা যেত। লাভ তাতে দু’জনেরই হত। কিন্তু চাকরির নাম মেসো আর মুখেও আনবে না। কারণ খোদ মালিককে বলে সেবারে চাকরি একটা ঠিক করেই ফেলেছিল। যেদিন জয়েন করার কথা সেদিন থেকে দু’মাসের মধ্যে আর তার টিকির দেখা নেই। তারপর তার অনুপস্থিতিতে লুকিয়ে লুকিয়ে মাসির কাছে আসা হয়েছে।

তার আগে মাসির ছটফটানি, বাউণ্ডুলেটা কোথায় উবে গেল, মৌলায় চিঠি দিয়েও জবাব পায় না। শেষে একদিন চুপি চুপি এসে নালিশ, চাকরি নেয় নি বলে মেসো আর মুখ দেখবে না ধরে নিয়ে আসা বন্ধ করেছে।

আর যায় কোথায়, আপিস থেকে মেসো বাড়ি ফিরে দম ফেলতে না ফেলতে মাসি মারমূর্তি।–নিজে তো গোলম হয়েইছে এখন সক্কলকে ধরে ধরে গোলামি না করাতে পারলে আর মুখ দেখবেন না। ব্যবসা করে ছেলেটা যা-হোক নিজের পায়ে দাঁড়াতে চেষ্টা করছে, কোথায় উৎসাহ দেবে তা না, ছেলেটার বাড়ি আসা বন্ধ করেছে। এরকম লোকের নিজেরই মুখ দেখাতে লজ্জা করা উচিত, ইত্যাদি, ইত্যাদি।

অথচ, আপিসে বোনপোর একটা ভাল চাকরি হোক দু’দিন আগেও স্ত্রীটির সেই আগ্রহ তার থেকে একটুও কম ছিল না।

শঙ্করের হাতে টাকা দিয়ে জীবনে প্রথম মার খেয়েছিল মহাদেব সারাভাই মাস ছয়েক আগে। ভালো একটা ফাটকার টিপ আছে শুনে মাত্র চারশো টাকা দিয়েছিল। কিন্তু সেই টাকা ছেলে হারিয়ে বসল। টাকার খাম কি করে নাকি পকেট থেকে পড়ে গেল জানে না। চারশো টাকা কি করে হারায় মহাদেব সারাভাইয়ের ধারণা নেই। টাকার খাম পকেট থেকে পড়ে গেলে জানতে পারে না কি করে তাও ভাবতে পারে না। বিশ্বাস করবে কি করবে না সেটা পরের কথা। নির্লিপ্ত মুখ করে যেভাবে চারশো টাকা খোয়ানোর খবরটা দিল, চার লক্ষ টাকা থাকলেও সে-রকম পারা যায় কিনা জানে না। শুনে তার রাগ করতেও ভুল হয়ে গেছে, মাথায় হাত দিতেও। হাঁ করে খানিকক্ষণ পর্যন্ত ওই মুখখানাই দেখতে হয়েছিল।

-কি বললি, চারশো টাকা হারিয়ে গেছে?

 –হ্যাঁ, সতের ধাঁধায় থাকি, কখন যে….

পকেট থেকে পড়ে গেছে?

-হ্যাঁ, কিছু ভেব না, চারশোর বদলে চৌদ্দশো পুরিয়ে দেব’খন শিগগীরই।

ব্যস, ওটুকুতেই সব আক্ষেপ সব খেদ শেষ ছোকরার।….চারশোর বদলে হাজার টাকা অর্থাৎ ছাঁকা ছ’শো টাকা ঘরে তোলার লোভে টাকাটা বার করেছিল ভদ্রলোক।

শঙ্কর তখনো শেয়ারবাজারের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছে শুনেই খুশি হয়ে হাতে যা ছিল চাওয়ামাত্র দিয়েছিল। যে হারে টাকা ফিরবে বলে তাকে নিশ্চিন্ত করা হয়েছিল, সে-তুলনায় চারশো টাকায় চারগুণ বেশি দেওয়ার লোভই হয়েছিল। স্ত্রী সদয় থাকলে হয়তো তার থেকেও বেশি দিত। কারণ তখন আর অবিশ্বাসের প্রশ্ন নেই। অনেকবারই দিয়েছে আর অনেকবারই তার অনেক বেশি ফিরেছে। কিন্তু স্ত্রীটি বাড়তি রোজগার হলে হাত বাড়িয়ে সেটা আদায় করে নিতে যেমন পটু, টাকা বার করে দেবার বেলায় তেমনি নির্মম। বিশেষ করে জুয়াখেলায় টাকা খাটানো হবে শুনলে। ফাটকা বাজারে টাকা খাটানো আর জুয়াখেলার মধ্যে একটুও তফাত দেখে না রমণীটি। তার ওপর বোনপো নিজের ব্যবসা নিয়ে সরে দাঁড়াতে এরই মধ্যে ভদ্রলোক নিজের বুদ্ধিতে ফাটকাবাজী করে কিছু টাকা খুইয়েছে। সেই থেকে স্বামীর ওপর খড়গহস্ত মহিলা। তারপর থেকে টাকার কন্ট্রোল গোটাগুটি তার হাতে। হাত-খরচের টাকাও সেই থেকে ভদ্রলোককে হাত পেতে স্ত্রীর হাত থেকে নিতে হয়।

এই দুরবস্থার সময় শঙ্কর এসে মেসোকে সরাসরি বলেছিল, দু’শো পাঁচশো যদি পারো চটপট বার করো, ভালো খবর আছে একটা অন্যের লাভ যুগিয়েই গেলাম।

অনেক দিন বাদে ভদ্রলোকের নির্জীব রক্ত চনমনিয়ে উঠেছিল। কিন্তু হাত শূন্য। অতএব গেল বারের চারশো টাকা মেসো শঙ্করের হাতে দিয়েছিল অ্যাকাউন্টস বিভাগ থেকে ধার করে। আর সেই টাকা খোয়া গেছে। পকেট থেকে চারশো টাকা গলে গেল আর লাটসাহেব তা টেরও পেল না। স্ত্রীর অগোচরে সে টাকা যে কি ভাবে শোধ হয়েছে, তা শুধু সে-ই জানে। শোধ করার পর মনে মনে স্থির করেছিল, এই ছোঁকর সঙ্গে আর কোন দিন কোন সম্পর্কই রাখা চলবে না, স্ত্রীর সঙ্গে সম্পর্ক থাকে থাক।

মাস ছয় বাদে সেদিন দুপুরে সম্পর্কচ্যুত এই শঙ্কর আবার এসে হাজির তার কাছে। বাড়িতে নয়, একেবারে তার অফিস-ঘরে।

এসেই মেসোর পাশে চেয়ার টেনে বসল। হাব-ভাবে কোন রকম সঙ্কোচের লেশমাত্র নেই, দুনিয়ায় যেন বিব্রত বোধ করার মতে কোন ত্রুটি-বিচ্যুতি কখনো ঘটে নি। তাকে দেখে মহাদেব সারাভাই ছ’মাস আগের চারশো টাকা লোকসানের জ্বলাটা নতুন করে অনুভব করল। কাজের ফাইলে চোখ রেখে বক্রদৃষ্টিতে তাকে দেখে নিয়ে জিজ্ঞাসা করল, কি খবর?

ভণিতা বাদ দিয়ে শঙ্কর জিজ্ঞাসা করল, মোটা কিছু টাকা রোজগার করার ইচ্ছে আছে?

সঙ্গে সঙ্গে রাগে মুখ লাল মেসোর। ফিরে জিজ্ঞাসা করল, গেলবারের মতো?

পকেট থেকে কিছু কাগজপত্র বার করে পরীক্ষা করতে করতে শঙ্কর জবাব দিল, পকেট থেকে সেবারে তোমার টাকার খামটা পড়েই গেল তার আর কি করা যাবে সেটা ভুলতে ক’বছর লাগবে তোমার? নিজের কাছে থাকলে কিছু না জানিয়ে ওটা দিয়েই দিতাম।

দেখা গেল তার এই কাগজপত্রের সঙ্গেও একশো টাকার তিনখানা নোট বেরিয়ে এসেছে। মেসো কাজ ভুলে আর বিগত টাকার শোক ভুলে রেগে গিয়ে বলে উঠল, এই টাকাও তো যাবে দেখছি, বাজে কাগজের সঙ্গে না মিশিয়ে টাকাটা আলাদা রাখা যায় না? টাকার ওপর কোন দরদ আছে তোর!

কাগজে লেখা কি হিজিবিজি হিসেব দেখতে দেখতে শঙ্কর জবাব দিল, যাবে না, ঘণ্টাখানেকের মধ্যে এটা একজনের কাছে চালান হয়ে যাবে। এই তিনশো টাকায় কম করে ছশো টাকা ঘরে আসবে একেবারে ঘোড়ার মুখের খবর। রোদে ঘোরাঘুরি করে আর পা চলছিল না। তোমার এখানে একটু বিশ্রাম করে আবার বেরুব।

মেসো মুখ গোঁজ করে বলল, তা বেটে, কিন্তু তোমার হাতে আর এক পয়সাও দিচ্ছি না আমি।

–দিও না। মুখে আগ্রহের চিহ্ন মাত্র নেই, হিসেবের ওপর চোখ–কিন্তু পরে যেন আবার বলো না আগে বললি না কেন। চা আনতে বলো।

বেল বাজিয়ে মেসো বেয়ারাকে চায়ের হুকুম করল। কিন্তু ভিতরটা উসখুস করছে কেমন। মুখ দেখে মনে হল না আর সাধবে বা কি ব্যাপার খোলসা করে বলবে। চারশো টাকা খুইয়েছে বলে, কিন্তু এ-যাবৎ দিয়েছে যা সেটা মনে পড়লে চেষ্টা করে রাগ করে থাকা যায় না। মেসো লক্ষ্য করছে ছোকরা মনোযোগ দিয়ে কি একটা অঙ্ক কষছে এখন। একশো টাকার নোট তিনখানা টেবিলের কাগজপত্রের সঙ্গে দেখা যাচ্ছে তখনো। কৌতূহল দমন করতে না পেরে জিজ্ঞাসা করল, ওই টাকা কার?

–আমার। যা ছিল কুড়িয়ে-বাড়িয়ে নিয়ে এসেছি।

–তুই নিজে ফাটকায় খাটাবি?

মুখ তুলে তাকানো বা ভালো করে বুঝিয়ে জবাব দেবারও ফুরসত নেই যেন।-হ্যাঁ, কপাল ভালো থাকলে এক সপ্তাহের মধ্যে ওর ডবল ঘরে ফিরবে। তা না হলে পনেরো দিনের মধ্যে।

নিজের টাকা খাটাতে যাচ্ছে শুনে ভদ্রলোকের লোভ যত অস্বস্তিও ততে। জিজ্ঞাসা করল, ডবল না ফিরে উন্টে তোর এই সামান্য টাকা যদি সব যায়?

–যাবে না। গম্ভীর মুখে নিতান্ত আত্মীয় বলেই যেন আর এক বার প্রস্তাবটা বিবেচনা করে দেখার কথা বলাটা কর্তব্য বোধ করল। –যদি পারো হাজার দুই বার কর! যাবে মনে হলে নিজের যথাসর্বস্ব নিয়ে আমি মৌলা থেকে ছুটে আসি?

অকাট্য যুক্তি। ফলে দুর্বার প্রলোভন। কিন্তু দু’হাজার শুনে। মেসোর চোখ কপালে। আবার দু’হাজার শুনেছে বলেই লোভটাও প্রবল। ‘সে-রকম খবর কিছু না থাকলে দু’পাঁচ শো চাইত। বলল, দু’হাজার টাকা কোথায় পাব আমি। ব্যাঙ্কের পাস-বই তো তোর মাসির হাতে।

শঙ্কর নির্লিপ্ত।–থাক তাহলে।

কিন্তু থাক বললেই ছেড়ে দেওয়া যায় না। নিশ্চিত লাভের উৎসটা কোথায় সে সম্বন্ধে মেসো খোঁজ-খবর করতে লাগল। ফলে মেসোর প্যাড টেনে নিয়ে শঙ্কর হাতে-কলমে তাকে বোঝাতে বসল। গাছের ফলের মতো কোথায় কোন রহস্যের ডালে টাকা ঝুলছে, কাগজ-কলম হাতে পেলে শঙ্কর সেটা যত পরিষ্কার করে বোঝাতে পারে মুখে ততো না। মেসোর তখন মনে হয় ওই কাগজ কলম যেন ছেলেটার হাতে টাকার ফল পাবার একখানা আঁকশি।

কিন্তু বাধা পড়ল। এক ভদ্রলোক ঘরে ঢুকে প্রায় চোখ রাঙিয়েই গেল মেসোকে। তার বক্তব্য দু’দিন ধরে ওমুক দরকারী ফাইল আটকে বসে থাকলে কাজ চলে? তিন দিন ধরে ফাইল খুঁজে খুঁজে হয়রান সকলে, শেষে জানা গেল ফাইল এখানে ঘুমুচ্ছে।

অনুযোগ শুনে মেসোর বিড়ম্বিত মুখ। আমতা-আমতা করে আগন্তুককে নিশ্চিন্ত করতে চেষ্টা করল–পরদিনের মধ্যেই ফাইল পাঠাচ্ছে সে। একসঙ্গে অনেক ফাইল জমে গেছল বলে পেরে ওঠেনি।

লোকটি চলে যেতে শঙ্কর জিজ্ঞাসা করল, তোমার অফিসার নাকি?

মেসো তেমন খেয়াল না করে জবাব দিল না, আমার আণ্ডারে কাজ করে। তারপর বলো–

আণ্ডারের লোকের দাপট দেখে মুচকি হেসে শঙ্কর আবার প্যাডের হিসেব বিশ্লেষণে মন দিল। লাভের রহস্যটা যখন প্রায় বেরিয়ে আসার মুখে ঠিক তক্ষুনি আবার ব্যাঘাত। ঘরের হাফ দরজা ঠেলে আর একটি সুদর্শন মাঝবয়সী লোকের আবির্ভাব।

এসেই ভারিক্কি চালে বলল, আপনি কি অফিস লাটে তুলে দেবেন নাকি? একসঙ্গে চারজন ক্লার্ককে হুট করে ছুটি দিয়ে বসলেন, ডিপার্টমেন্ট চালাবে কে?

বিব্রত মুখে মেসো কৈফিয়ত দিল, কেন, ওরা তো কাজ মোটামুটি করে রেখে গেছে শুনলাম, তা ছাড়া খুব দরকার বলল যে–

ভদ্রলোকের মুখে এবং গলার স্বরেও রাজ্যের বিরক্তি।দরকার তবে আর কি, গোটা অফিসটাই ক্লোজ করে দিন তাহলে। এক্ষুনি রিজার্ভের লোক পাঠিয়ে দিন, ছুটি যারা নেয় তারা কাজ সেরে রেখে ছুটি নেয় না।

লোকটি দরজা ঠেলে বেরিয়ে যেতে শঙ্কর আবার জিজ্ঞাসা করল, ইনি বুঝি তোমার অফিসার?

মেসো বিরক্ত।–অফিসার হতে যাবে কেন, আমার আণ্ডারে ক্লিয়ারেন্স ডিপার্টমেন্টের ইনচার্জ

শঙ্কর হেসে উঠল, বলল, সব থেকে নিচের কেরানী হওয়া উচিত ছিল তোমার। নিচের লোককে এই রকম আশকারা দাও তুমি! তোমার অধীনের লোকেরা ওপরওলার মতো এসে মেজাজ দেখিয়ে যায়, লজ্জাও করে না তোমার?

ক্ষুব্ধ মুখে মেসো বলল, এই রকমই পার্টিনেন্ট হয়েছে সব আজকাল। সেদিনের ছেলে সব, রাগ করলেও পরোয়া করতে চায় না, উল্টে তর্ক করতে আসে।

শঙ্কর অভিজ্ঞ ওপরওলার মতোই পরামর্শ দিল, দরজা ঠেলে হুট হুট করে এভাবে ঢুকতেই দাও কেন সকলকে, এই জন্যই তো এত প্রশ্রয় পায়! বেয়ারাকে দিয়ে খবর পাঠালে তবে ঢুকতে দবে। তা না, যে খুশি এসে চোখ রাঙিয়ে যাচ্ছে।

মর্যাদা বজায় রাখার জন্য মেসো তক্ষুনি তার কথায় সায় দিয়ে বলল, সব ঢিট করে দেব একদিন–আমি রাগলে সাঘাতিক অবস্থা। তারপর এদিকের কি ব্যাপার তুই বল ভালো করে।

ব্যাপার প্রায় শেষ করেই এনেছিল শঙ্কর সারাভাই। শেষ লাভের অঙ্কটা যা ছক কেটে দেখাতে বাকি। চৌকোস মাস্টারের সহজ করে দুরুহ আঁকের ফল দেখানোর মতো শঙ্কর তাও দেখিয়ে দিল। এটুকু শেষ হতে মহাদেব সারাভাই এক ধরনের যাতনা বোধ করতে লাগল যেন। লাভের যাতনা। বলল, কিন্তু টাকা পাই কোথায়? ।

শঙ্কর চুপ। এ সমস্যার সমাধান তার হাতে নেই। মেলো আর কোন পথ না পেয়ে শেষে তারই শরণাপন্ন যেন।–তুই-ই না হয় তোর মাসিকে যা-হোক কিছু বলে দেখ না চেকবইটা বার করতে পারিস কি মা। তোকে তো ছেলের মতোই দেখে, মাথা থেকে একটা কারণ-টারণ যদি বার করতে পারিস, দিলে দিতেও পারে। আমি বললে কানেও তুলবে না।

চেক-বই কি করে বার করা যায় সেই চিন্তা শঙ্কর সারাভাই করেই এসেছে। তবু ধীরে-সুস্থেই উপায় বাতলালো সে। বলল, এমনিতে চেকবই চাইতে গেলে মাসি আমাকেও ছেড়ে কথা কইবে নাকি–সতের রকমের জেরা করে শেষে ডাণ্ডা নিয়ে তাড়া করবে। ….এক কাজ করা যায়, আমার ফ্যাক্টরির খুব একটা বড় অর্ডার। পেয়েছি বলা যেতে পারে। মোটা টাকা লাভের আশা আছে জানিয়ে যদি তাকে বুঝিয়ে বলি দিন সাতেকের জন্য হাজার খানেক টাকা দরকার–পার্টির পেমেন্ট পেলেই টাকাটা দিয়ে দেব, আর লাভের অংশও দেব-তাহলে?

মেসোর চোখে-মুখে সমস্যা সমাধানের উদ্দীপনা। স্ত্রীর চোখে এত সহজে ধুলে দেবার রাস্তাও আছে কল্পনা করতে পারে নি। শুধু ধূলো দেওয়া নয়, একেবারে নিজেকে বাঁচিয়ে ধূলো দেওয়া। কিন্তু সমর্থনসূচক আনন্দটা ব্যক্ত করার মুখেই আবার বাধা। সামনের হাফ-দরজার ওধারে দুটো পা দেখা গেল—দরজা ঠেলে কেউ প্রবেশোত। শঙ্করের আগের কথায় তোক বা টাকা পাওয়ার সম্ভাবনার গরমে হোক, মেসো দরজার দিকে চেয়ে হঠাৎ হুঙ্কার দিয়ে উঠল।-হু ইজ দেয়ার সময় নেই অসময় নেই যতসব-বেয়ারা।

গর্জনটা যে এমন জোরালো হয়ে উঠবে শঙ্কর ছেড়ে মহাদেব সারাভাই নিজেও ভাবে নি বোধকরি। আচমকা হুঙ্কারে ঘরের বাতাসসুদ্ধ ভারি হয়ে গেল বুঝি। কিন্তু হাফ-দরজা খুলেই গেল তবু। আর ঘরে এসে যে দাঁড়াল তাকে দেখামাত্র ভূত দেখার মতো আঁতকে উঠল মেসো। তারপরেই বিবর্ণ পাণ্ডুর সমস্ত মুখ। কাঁপতে কাঁপতে উঠে দাঁড়িয়ে অস্ফুট গোঁ-গোঁ শব্দে বলতে চেষ্টা করল, সা-সা-সা-সার।

ঘরে ঢুকেছে চেম্বারের চেয়ারম্যান চন্দ্রশেখর পাঠক। কিন্তু শর তাকে চেনে না। মেসোর আর্ত মুখভাব দেখে সে-ও বিমূঢ় নেত্রে চেয়ে রইল শুধু।

চন্দ্রশেখর পাঠক সামনে এগিয়ে এলো। মন্থর গতি। হাত দুটো প্যান্টের পকেটে। চোখের কোণ দিয়ে একবার সামনের লোককে অর্থাৎ শঙ্করকে দেখে নিল। তারপর টেবিলের এধারে মেসোর মুখোমুখি দাঁড়িয়ে মৃদু গম্ভীর স্বরে বলল, এত গরম কিসের, ভেরি বিজই?

আবারও শুধু সা-সা ভিন্ন আর কোনো আওয়াজ বেরুলো না মেসোর গলা দিয়ে। যাবার পথে অফিস-সংক্রান্ত কিছু একটা কাজের কথা বলার জন্যই ঘরে ঢুকে পড়েছিল চন্দ্রশেখর পাঠক। বাইরের লোক দেখে তা আর বলা গেল না। প্যান্টের হাত দুটো কোমরে উঠল, আবার ফিরে দেখলেন একবার। তবে উপস্থিতিতে এভাবে চেয়ারে বসে থাকার লোক বেশি দেখে নি।–হু ইজ হি?

শঙ্করকে চেয়ারে আরাম করে বসে থাকতে দেখে মেসোর দ্বিগুণ অস্বস্তি। বলল, আমার….মানে আমার ওয়াইফের….মানে আমার শালীর ছেলে সার।

বলা বাহুল্য, শালীর ছেলে দেখে বড়কর্তা আদৌ মুগ্ধ হল না। উল্টে তার চোখ পড়ল প্যাডের হিজিবিজি ছটার ওপর–শেয়ারের দাম ফেলে আঁক কষে শঙ্কর যা এতক্ষণ ধরে বুঝিয়েছে মেসোকে। তুঘোড় বুদ্ধিমান মানুষ বড়সাহেব, তার কেরামতিতে শেয়ারবাজার ওঠে নামে–এক পলক তাকিয়েই কিছু যেন বুঝে নিল। মহাদেব সারাভাইয়ের মুখের দিকে চেয়ে মৃদু অথচ বক্র শ্লেষে জিজ্ঞাসা করল, ডিড, আই ডিসটার্ব ইউ?

মহাদেবের মুখ পাংশু, তার পিছনের একটা হাত ক্রমাগত শঙ্করকে ইশারা করছে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতে। কিন্তু হাঁ করে শঙ্কর অভিব্যক্তিসম্পন্ন আগন্তুকটিকেই দেখছে। আগন্তুক অফিসের হোমরা চোমরা একজন বুঝেছ, কিন্তু কে-যে ঠিক ধরে উঠতে পারছে না। শুকনো জিভে করে শুকনো ঠোঁট ঘষে মহাদেব সভয়ে জোরে জোরে মাথা নাড়ল শুধু। অর্থাৎ একটুও ডিসটার্ব করা হয় নি। বড়সাহেবের মেজাজ জানে, কাগজে কি হিসেব হচ্ছিল যদি আঁচ করে থাকে, অর্থাৎ কোন্ তন্ময়তা ভঙ্গের ফলে সুপারিনটেনডেন্টের ক্ষণকাল আগের ওই গর্জন সেটা যদি টের পেয়ে থাকে, তাহলে মাথার ওপর আকাশ ভেঙে পড়াও বিচিত্র নয়। বড়সাহেবের রোষাগ্নিতে সত্যি সত্যি কাউকে পড়তে হয় নি কিন্তু পড়লে কি হবে সেই-ত্রাসে শঙ্কিত সকলে।

বড়সাহেব আর এক নজর শঙ্করকে দেখে নেবার আগেই টেবিলের টেলিফোন বেজে উঠল। এই টেলিফোন যে মুশকিল আসান, জানে না। তাড়াতাড়ি রিসিভার তুলে মহাদেব শুকনো গলায় সাড়া দিল। পরক্ষণে শশব্যস্তে বড়সাহেবের দিকে বাড়িয়ে দিল ফোন।

–আপনার সার….

 হাত বাড়িয়ে রিসিভার নিয়ে এবারে বড়সাহেব সাড়া দিল। পরক্ষণে দুই ভুরু কুঁচকে যেতে দেখা গেল তার। অপ্রত্যাশিত কিছু যেন শুনল। তারপরেই ব্যস্ত হয়ে ওধারের রমণীর উদ্দেশে বলল, আচ্ছা, আমি এক্ষুনি যাচ্ছি। রমণী . কারণ মহাদেব বামাকণ্ঠই শুনেছিল মনে হল। ঝপ করে রিসিভার নামিয়ে রেখে দ্রুত ঘর ছেড়ে প্রস্থান করল বড়সাহেব। শঙ্কর সারাভাইয়ের মনে হল, ভদ্রলোক যেন অত্যন্ত বিচলিত হয়ে চলে গেল।

কিন্তু মহাদেব সারাভাইয়ের কিছুই লক্ষ্য করার ফুরসত হয় নি। ভালো করে কাঁপুনিই থামছে না তার। ঘামে সমস্ত মুখ ছেড়ে জামা পর্যন্ত ভিজে গেছে। বড়সাহেব ঘর ছেলে চলে যেতে আর তারপর তার ভারি পায়ের শব্দও নিঃসংশয়ে মিলিয়ে যেতে অবসন্নের মতো ধুপ করে নিজের চেয়ারে বসে পড়ল। তার অবস্থা দেখে শঙ্কর কি করবে বা কি বলবে ভেবে না পেয়ে উঠে রেগুলেটার ঘুরিয়ে পাখার স্পীড বাড়িয়ে দিল।

এই মুহূর্তে তার ওপরেই তিক্ত বিরক্ত মহাদেব সারাভাই। এই ছোঁড়া না এলে তো আজ এরকম বিভ্রাটে পড়তে হত না তাকে। আর এভাবে তাতিয়ে না দিলে অমন স্বভাববিরুদ্ধ গর্জনও করে উঠত না। তারপরেও নবাবপুত্তরের মতো চেয়ারে বসে থেকে এই সামান্য সময়টুকুর মধ্যে কম নাজেহাল করেছে তাকে! মুখবিকৃত করে বলে উঠল, বড়সাহেবকে দেখেও চেয়ারটা ছেড়ে একবার উঠে দাঁড়ালি না পর্যন্ত, বোকার মতো হাঁ করে বসেই রইলি।

মেসোর অবস্থা দেখে সন্দেহ আগেই হয়েছিল, তবু খোদ বড় সাহেবই যে মেসোর ঘরে এসে হাজির হয়েছে সেটা ধরে নেওয়া কঠিন। নিঃসংশয় হওয়া গেল। নাম-ডাকের মতোই রাশভারী চাল-চলন বটে। তবু নির্লিপ্ত মুখেই জবাব দিল, কে তোমার বড় সাহেব আর কে তোমার নিচের, কি করে বুঝব বলে–সকলেরই তো সমান হম্বিতম্বি তোমার ওপর। ….যাকগে, কি আর হয়েছে।

কি হয়েছে! যথার্থ অসহায় বোধ করছে মহাদেব সারাভাই, কাগজের এসব লেখা দেখে গেল না! আড়ে আড়ে ক’বার ও প্যাডটার দিকে তাকিয়েছে তুই লক্ষ্য করেছিস? কি মুশকিলেই যে ফেললি আমাকে–

কেউ দেখে গেল বলে নয়, মনে মনে অন্য কারণে শঙ্কা বোধ করছে শঙ্কর সারাভাই। তার আসার উদ্দেশ্যটাই ব্যর্থ হয়ে গেল কিনা বুঝছে না। আপাতত মেসোকেই আগে ঠাণ্ডা করা দরকার। বলল, দেখে গিয়ে থাকলে তোমাকে এরপর খাতিরই করবে দেখো, এ-সব ব্যাপারে তারও লক্ষ লক্ষ টাকা খাটছে।

বিস্ময় সত্ত্বেও একটু যেন জোর পেল মেসো। তারও লক্ষ লক্ষ টাকা খাটছে! এই সব ফাটকা-টাটকার ব্যাপারে। আঃ, এদিকে তাকা না! তোকে কে বলল?

এ লাইনে যারা ঘোরে সকলেই জানে, অম্লানবদনে মিথ্যা আশ্রয় নিল শঙ্কর, আজকের এই মওকার খবরও তার জানা আছে ভাবো নাকি। আমার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিলে না কেন, তোমায় সামনেই জিজ্ঞাসা করতাম এই ডিলটার প্রসপেক্ট কি-রকম।

যাক, মেসো অন্ধকারে যেন আলো দেখল একটু, মহাজনগত পন্থা অনুসরণের ব্যাপারটা ধরা যদি পড়েও থাকে–ফলাফল অকরুণ না হবারই কথা। বলল, যা হবার হয়েছে, এখন চল, দেখি কি করা যায়।

.

শঙ্কর সারাভাইয়ের ভিতরটা চঞ্চল হয়ে আছে। মেসোকে হাত করা গেছে যখন, মাসির কাছ থেকে টাকা বার করতে খুব বেগ পেতে হবে না হয়তো। নিঃসন্তান মাসি তাকে ভালইবাসে। তবু টাকা হাতে না আসা পর্যন্ত স্বস্তি বোধ করার কথা নয়। তা ছাড়া একটা নৈতিক অধঃপতনের সঙ্গে বিলক্ষণ যুঝতে হয়েছে। যা বলা হবে সেটা সত্যি কথাই। কিন্তু মেসোর বেলায় গোটাগুটি মিথ্যের আশ্রয়ই নিতে হল তাকে। ….আশ্চর্য পরিস্থিতি, সত্যি যা মাসি তাই জানবে অথচ মেসে সেটা ছলনা ভাববে। ছলনা ভাববে বলেই সায় দেবে তার কথায়। সত্যি জানলে বাড়িতে ঢুকতে দিতে চাইত না।

কিন্তু এই অস্বস্তির ফাঁকে ফাঁকেও চেম্বারের বড়সাহেব চন্দ্রশেখর পাঠকের মুখখানা চোখে ভাসছে তার। ভদ্রলোককে দেখার ইচ্ছে ছিল, আজ দেখা হয়ে গেল। ব্যবসায়ী জীবনে তার একাগ্ৰ নিষ্ঠা আর সহিষ্ণুতার গল্প কত শুনেছে ঠিক নেই। শঙ্করের মতো সংগ্রামী জীবন যাদের, তাদের চোখে বিরাট সফল মানুষ চন্দ্রশেখর পাঠক। নিজের চেষ্টায় এত বড় হয়েছে, নিজের বুদ্ধির বলে আজ দেশের একটা প্রধান শিল্পের উপর তার অপ্রতিহত প্রতাপ।

ভদ্রলোকের কীর্তির সব থেকে বড় নজির সম্ভবত বর্তমানের এই কটু চেম্বার। ভিন্ন নামে মিল-মালিকদের এ ধরনের প্রতিষ্ঠান আরও আছে। কটু চেম্বারের পাশে সে-সব নিষ্প্রভ এখন। চন্দ্রশেখর পাঠক নিজে এই চেম্বারের স্রষ্টা, ফলে নিজেই সর্বেসর্বা। এখন সব থেকে বড় বড় মিলগুলো এই চেম্বারের আওতার মধ্যে এসে গেছে। নতুন মিল মালিকেরা স্বপ্ন দেখে কবে ওই চেম্বারের সভ্য হবে। তাই চন্দ্রশেখর পাঠকের শুধু নিজের ব্যবসায় নয়, সমস্ত দেশের বস্ত্র শিল্পের ব্যবসার নীতি এই চেম্বারের দখলে।

প্রতিষ্ঠানটিকে জনপ্রিয় করে তোলার ফন্দি-ফিকিরও ভদ্রলোক কম জানে না। এখানকার সমস্ত ব্যবসায়-মহলে সাড়া জাগিয়ে মহা সমারোহে চেম্বারের বাৎসরিক অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়। সেই অনুষ্ঠানের প্রধান লক্ষ্য যেন ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের উৎসাহ উদ্দীপনা আর প্রেরণা যোগানো, কিন্তু আসলে এটাই বোধহয় চেম্বারের সব থেকে বড় প্রচারানুষ্ঠান। সেই প্রচারই বড় প্রচার যে দেশের সর্বসাধারণের চোখ টানে। ছোট ঘোট ব্যবসায়ীদের তৈরি সেরা কাপড়ের স্যাম্পল নিয়ে মস্ত একজিবিশন হয় প্রতিবার। সেই সব স্যাম্পল নিয়ে এক্সপার্টরা বিচার বসে।–কার কাপড় সব থেকে ভালো। কাপড় বলতে সবই অবশ্য শাড়ি। পাড় নক্সা ফিনিশিং ইত্যাদির বিচারে যে শাড়ি প্রথম হবে, সেই শাড়ির নির্মাতার ভাগ্যে এক লক্ষ টাকা পুরস্কার। এইভাবে জাকজমক করে আর মর্যাদা দিয়ে ছোট ব্যবসায়ীকে নিজের পায়ে দাঁড়াবার প্রেরণা যুগিয়ে থাকে চেম্বার।

শঙ্কর সারাভাইয়ের জীবনের একমাত্র স্বপ্ন, তার খেলনার মতো কাপড়ের ব্যবসাও একদিন মস্ত বড় হবে, এই সব মিল-মালিকদের মতো নিজস্ব মিল হবে তারও। শঙ্কর সারাভাইয়ের এমন অনেক নাম মুখস্থ, যারা তার মতোই নগণ্য ছিল একদিন–যারা ছোট থেকে বড় হয়েছে। ওই চন্দ্রশেখর পাঠকের জীবনেই কি কম ঝড়-ঝাপটা গেছে। অতএব একটা আশার আলো সামনে রেখেই এগোতে চেষ্টা করছে। শঙ্কর। কিন্তু তার আশায় আলোটা জোনাকির আলো। ক্ষণে ক্ষণে জ্বলে আর নেভে। এই আশা নিজের কাছেই শূন্যে প্রাসাদ গড়ে তোলার মতো অবাস্তব মনে হয় এক-একসময়। তবু এই আশা নিয়েই বেঁচে আছে। এটুকু আশা গেলে পায়ের নিচে মাটিও সরে যাবে জানে বলেই চোখ-কান বুজে একেই আঁকড়ে আছে।

কিন্তু তা সত্ত্বেও কটন চেম্বারের এক লক্ষ টাকার প্রাইজের সিকেটা কোনদিন তার ভাগ্যে ছিঁড়বে এমন আশা সে কখনো করে না। তার প্রথম কারণ, মৌলা থেকে ট্রেন ভাড়া গুণে এখানে এসে একজিবিশনের কাপড় সে প্রতিবারই পরখ করে দেখে থাকে। কোনো একটা কাপড়ও দৃষ্টি এড়ায় না, সব খুঁটিয়ে দেখে। এই সব কাপড় যারা পাঠায় তারা অতি ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী হলেও তার তুলনায় অনেক বড়। তাদের সরঞ্জাম আছে, যন্ত্রপাতি আছে। সেকেণ্ডহ্যাণ্ড কি থার্ডহ্যাণ্ডে কেনা শঙ্করের একটা মাত্ৰ ছোট ভাঙা কল মাসে কম করে দশদিন অকেজো হয়ে পড়ে থাকে। আর এটা-ওটা বদলে নিজের হাতে মেরামত করে যে কাপড় তৈরি হয় সেটার সাহায্যে, তার মান কোন স্তরের সেটা নিজেই সে খুব ভালো জানে। যে শস্তার কাপড় বা শাড়ি সে নিজের হাতে তৈরি করে, তার খদ্দের তারই মতো অবস্থার লোক। বিশ-ত্রিশখানা করে এই কাপড় তৈরি করার উপকরণও সব মাসে হাতে থাকে না। কাপড় ছেড়ে তখন শুধু গামছাই তৈরি করতে হয়। আর মেশিন বিগড়ালে তো তাও হয়ে গেল। অতএব, একজিবিশনে স্যাম্পল পাঠানোর চিন্তাটাই তার কাছে হাস্যকর।

কিন্তু পাঠাবার মতো হলেও শঙ্কর সারাভাই তা পাঠাত না নিশ্চয়। কারণ তার ধারণা, চেম্বারের বিচারকদের মান যাচাইয়ের পর্বটা প্রহসন মাত্র। এ যাবত অনেকবার সে একজিবিশনে গিয়ে স্বচক্ষে সব স্যাম্পল পরখ করে এসেছে। তার বিবেচনায় যে কাপড়ের পুরস্কার পাওয়া উচিত, তা একবারও পায়নি। অতএব তার বিশ্বাস ধরপাকড় তদবির-তদারক আর সুপারিশের জোর যার বেশি পুরস্কার শুধু সে-ই পেয়ে থাকে। আর, চেম্বারের দিক থেকে ওই ঘটা করে পুরস্কার দেওয়ার একমাত্র লক্ষ্য শুধু যে আত্মপ্রচার, একজিবিশন এলাকার মধ্যে দাঁড়িয়েই সে অনেক সময় নির্দ্বিধায় সেই মতামত ব্যক্ত করেছে। সমস্ত কাগজে বড় বড় হরপে প্রতিষ্ঠানের উৎসবের বিজ্ঞপ্তি বেয়োয়, অনুষ্ঠানের বিবরণ ছাপা হয় ক’দিন ধরে, পুরস্কার-সভার বড় বড় ছবি বেরোয়, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ের প্রতি চেম্বারের দরদের কথা ফলাও করে লেখা হয়। এই প্রচার-গত সুনামের মূল্য এক লক্ষ টাকার পুরস্কার মূল্যের অনেক গুণ বেশি।

এই কারণেই শঙ্করের নিস্পৃহতা। কিন্তু তা হলেও প্রতিষ্ঠানের নিয়ামকটির অর্থাৎ চন্দ্রশেখর পাঠকের শক্তির বুদ্ধির আর বিচক্ষণতার প্রশংসা না করে পারে না সে। মানুষটি ব্যবসার ধারা আমূল বদলে। দিয়েছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। আর সামান্য অবস্থা থেকে শিল্পপতিদের মধ্যে ভলোক আজ সর্বাগ্রগণ্য যে তাতেও ভুল নেই। আজ তাকেই দেখল।

অনেকক্ষণ অন্যমনস্ক ছিল শঙ্কর। সমস্ত পথ মেসো কি বলল আর কি উপদেশ দিল কানেও ঢোকেনি ভালো করে। মনটা মাঝে মাঝে বিষণ্ণ হয়ে পড়ছিল। দুই একবার মনে হয়েছে, থাক্‌ কাজ নেই মাসির বাড়ি গিয়ে, মেসোকে যা-হোক দুই এক কথা বলে এখান থেকেই চলে গেলে হয়। কিন্তু অদৃশ্য একটা টানে এসেই গেল শেষ পর্যন্ত। মৌলার বাড়ি থেকে বেরুবারে আগে পর্যন্ত অনেক ভেবেছে, সমস্ত পথ ট্রেনে নিজের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে করতে এসেছে। এখন এফরাও শক্ত। না, ফিরতে সে চায় না। ফ্যাক্টরীর কথা মনে হলেই অটুট সঙ্কল্পে চোয়াল দুটো শক্ত হয়ে যায় তার, এক একটা সঙ্কটে সমস্ত নীতিবোধ আর বিবেকের যাতনা দু’হাতে ঠেলে সরিয়েই সে যেন সামনের দিকে এগিয়ে যেতে চায়। ব্যবসাটা তার চোখে যেন বিকলাঙ্গ অপুষ্ট শিশু একটা। সরঞ্জাম যোগাতে পারলে আর পুষ্টির ব্যবস্থা করলে সেটা শক্ত সমর্থ পরিণত রূপ ফিরে পেতে পারে।

শঙ্কর সারাভাই কোনো ব্যবস্থাই করতে পারছে না। চোখের সামনে ওই শিশুর তিলে তিলে ক্ষয় দেখছে সে। এই পরিতাপের শেষ নেই। তাই আজ সে বিবেক নামে বস্তুটার একেবারে বিপরীত দিকে মুখ করে মেলা থেকে রওনা হয়ে পড়েছে।

তাকে দেখামাত্র মাসি অনুযোগ করল একপ্রস্থ। দু’মাসের মধ্যে দেখা নেই এমন আপনার জন এলেই বাকি না এলেই বা কি, ইত্যাদি ইত্যাদি।

শেষে বোনপোর প্রস্তাব শুনে মাসির দু চোখ কপালে। এক হাজার টাকা চাই। এ আবার কি সাতিক কথা। এক হাজার টাকা কি দুই একশ টাকা নাকি সে চাইলেই বার করে দিতে পারবে।

মাসি মহিলাটি বাইরে রুক্ষ ভিতরে নরম। একটা ব্যাপারে তার খটকা লাগতে পারত, কিন্তু লাগল না। বোনপো সাধারণত টাকা গয়না চাইতে হলে মেসোর আড়ালে চায়। কিন্তু আজ দেখা যাচ্ছে দু’জনে একসঙ্গে এসেছে আর হাজার টাকা চাওয়া সত্ত্বেও ঘরের লোকটার মুখ বিকৃত হল না। টাকার অঙ্কটা বড় বলে মাসির নিজেরও একটু ধাক্কা লেগে থাকবে হয়তো, তাই মেসো মুখ ভার বা মনোভাবের প্রতি তক্ষুনি সচেতন হতে পারেনি। শঙ্কর বলল, টাকা না দিলে এবারে মরেই যাব মাসি-মস্ত একটা বায়না নিয়েছি, কাজ শেষ হলেই এই প্রথম মোটা কিছু ঘরে আসবে–ব্যবসা দাঁড় করানোর ধকলও কিছুটা সামলে যেতে পারব হয়তো। মাত্র সাত দিনের মতো চাই, লাভের চার আনা অংশও না হয় আসলের সঙ্গে ফেরত দিয়ে যাব–কিন্তু টাকাটা না দিলেই নয়।

মাসি তক্ষুনি রেগে গিয়ে জবাব দিল, তোর লাভের টাকা তুইই ধুয়ে জল খাস, আমাকে আর লোভ দেখাতে হবে না। কিন্তু আমি টাকা পাব কোথায়, বড় জোর পঞ্চাশ ষাট টাকা দিতে পারি।

মাসির মনে মনে ধারণা এই করে বড় জোর একশ টাকার মধ্যে রফা করে ফেলবে। কিন্তু ধারণাটা গণ্ডগোলের দিকে টেনে নিয়ে গেল ঘরের লোকটাই।

ঈষৎ সহানুভূতির সুরে মহাদেব বলল, মুশকিল হয়েছে এটাকে এক রকমের বিপদও বলা যেতে পারে আবার সুদিনের আশাও বলা যেতে পারে। অর্ডার ক্যানসেল করতে হলে বিপদ, সাপ্লাই করতে পারলে আশা।….দিন রাত ফ্যাক্টরীটাকে নিয়ে এত খাটছে এত পরিশ্রম করছে, হাজার খানেক টাকায় দিন যদি ফেরে….দিলে হত।

এবারে অবশ্য একটু অবাক হবারই পালা মাসির। কিন্তু সেই সঙ্গে একটা উল্টো ধারণা জন্মালে আবার। হাজার টাকারই দরকার তাহলে, আর সেটা এমনই দরকার যে ঘরের লোক পর্যন্ত সদয়। বিড়ম্বনার মধ্যে পড়ে মহিলা বলে উঠল, কিন্তু অত টাকা আমি পাব কোথায়, ঘরে থাকে নাকি?

মাথা চুলকে মেসো জবাব দিল, তাই তো ঘরে আর এত টাকা কোথায়।

চকিত ইশারাটা শঙ্করের বুঝে নিতে একটুও বেগ পেতে হল না। বলল, ঠিক আছে, মেসো চেক্ দিক একটা, কাল প্রথম দিকেই ভাঙিয়ে নিয়ে কাজ সারব।

মাসি কিছু বলার আগে মেসো মন্তব্য করল, তাতে যদি হয় তোর সে ব্যবস্থা অবশ্য করা যেতে পারে নইলে ঘরে কার আর অত টাকা মজুত থাকে….

মেসোর এত উদারতায় পাছে মাসির সন্দেহ হয় সেই ভয়ে শঙ্কর তাড়াতাড়ি বলে উঠল, ঠিক আছে। এবার আমাকে শিগগীর কিছু খেতে দাও মাসি, সকাল থেকে এখন পর্যন্ত কিছু খাওয়াই হয় নি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *