০৫. মাইক্রোবাস যাচ্ছে

মাইক্রোবাস যাচ্ছে, কিন্তু যাচ্ছেটা কোথায়? আমার কাছে কোনো ঠিকানা নেই। নলিনী বাবুর কাছ থেকে জানি তার স্কুলের নাম নীলগঞ্জ গার্লস হাই স্কুল। তাঁর বাবী শ্রীকান্ত ভট্টাচার্য ময়মনসিংহ থেকে নীলগঞ্জ আসতেন কাজেই জায়গাটা ময়মনসিংহ জেলায়।

আমি মিসির আলির মতো মাথা খাটালাম। ময়মনসিংহ জেলা শিক্ষা অফিসারের কাছে জানতে চাইলাম নীলগঞ্জ গার্লস হাই স্কুল কোথায়? তিনি সঙ্গে সঙ্গে ঠিকানা দিলেন।

সালেহ চৌধুরী বললেন, তোমার ভালো বুদ্ধি। এইভাবে ঠিকানা বের করার কথা আমার মাথায় আসে নাই।

আমি বললাম, আমার বুদ্ধি মিসির আলির চেয়েও বেশি।

সালেহ চৌধুরী বললেন, না হবে না। মিসির আলি সাহেবের এ্যানালাইটিক্যাল রিজনিং অসাধারণ।

আমি এই ভেবে আনন্দ পেলাম যে সালেহ চৌধুরী মিসির আলিকে উপন্যাসের চরিত্র হিসেবে দেখছেন না। অতি বুদ্ধিমান মানুষও মাঝে মাঝে বাস্তব-অবাস্তব সীমারেখা মনে রাখতে পারেন না।

নীলগঞ্জ গার্লস হাই স্কুলে উপস্থিত হলাম ঠিকই কিন্তু নলিনী বাবুকে পেলাম না। তিনি অসুস্থ। কোনো এক মানসিক রোগীদের ক্লিনিকে চিকিৎসাধীন। ক্লিনিকটা কোথায় পরিষ্কার করে কেউ বলতে পারল না। হেডমাস্টার সাহেব বললেন, খুব সম্ভব চিটাগাংয়ে। নলিনী বাবুর এক আত্মীয় ডাক্তার। তিনি থাকেন চিটাগাংয়ে। নলিনী বাবু অসুস্থ হলে তিনিই চিকিৎসার ব্যবস্থা করেন।

নীলগঞ্জ হাইস্কুলের ধর্মশিক্ষক বললেন, ক্লিনিকটা ঢাকায়। তিনি নাকি একবার কথায় কথায় জেনেছেন। হেডমাস্টার সাহেবের সঙ্গে কথাবার্তা যা হলো, তা এ রকম–

আমি : নলিনী বাবুর বাবা সম্পর্কে কি জানেন? শ্রীকান্ত ভট্টাচার্য।

হেডমাস্টার : উনি মারা গেছেন।

আমি : মানুষ কেমন ছিলেন?

হেডমাস্টার : মৃত ব্যক্তির দোষ-ত্রুটি নিয়ে আলাপ শোভন না। উনার কিছু দোষ-ত্রুটি ছিল। তবে নলিনী বাবু সর্বদোষমুক্ত মানুষ।

আমি : নলিনী বাবু সম্পর্কে বলুন।

হেডমাস্টার : বললাম না, উনি সর্বদোষমুক্ত মানুষ।

আমি : উনার অসুখ বিষয়ে বলুন।

হেডমাস্টার : মৃগী রোগ ছিল। মাথা খারাপের কিছু লক্ষণও ছিল।

আমি : নলিনী বাবুর বিশেষ কোনো কিছু কি আপনার চোখে পড়েছে?

হেডমাস্টার : না।

আমি : মাথা খারাপের কি লক্ষণ ছিল?

হেড মাস্টার : স্মরণে আসতেছে না।

আমি : তিনি অদ্ভুত কিছু দেখেন এইসব কখনো বলতেন?

হেড মাস্টার : শিক্ষার বাইরে অন্য আলাপ আমার স্কুলে নিষিদ্ধ। কারণ শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। আমাদের নবিজি বলেছেন, শিক্ষার প্রয়োজনে সুদূর চীন দেশে যাও।

গ্রামের মানুষরা এমনিতে প্রচুর কথা বলে। বিপত্তি তখনই হয় যখন কথাবার্তার সময় একটা রেকর্ডিং ডিভাইস সামনে থাকে। হেডমাস্টার সাহেবের চোখ-মুখ শক্ত। তিনি একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন তার সামনে রাখা ক্যাসেট রেকর্ডারের দিকে। আমি ক্যাসেট রেকর্ডার সরিয়ে দিলাম, তাতেও লাভ হলো না।

আমি তাঁকে আশ্বস্ত করার জন্য তাঁর হাত ধরে কোমল গলায় বললাম, হেড মাস্টার সাহেব, আপনার কাছে নলিনী বাবুর কোনো অস্বাভাবিকতা ধরা পড়েনি?

জি না।

হেকিম নামে কোনো কাঠমিস্ত্রিকে চেনেন? নলিনী বাবু বলেছিলেন সে খুব ভালো কাঠমিস্ত্রি। নলিনী বাবু তাকে দিয়ে আমার জন্যে একটা ইজি চেয়ার বানিয়ে দিতে চেয়েছিলেন।

হেকিম নামে আমি কাউকে চিনি না। আপনি ছোট বাজারে খোঁজ নেন।

ছোট বাজার বড় বাজার সব বাজারেই গেলাম। হেকিম নামে কোনো কাঠমিস্ত্রির সন্ধান পাওয়া গেল না। সন্ধান পেলে তার কাছ থেকে কিছু জানা যেত।

সুলতানা বেগম নামে দশম শ্রেণী খ শাখা বিজ্ঞান বিভাগের ছাত্রীটির খোঁজ করার চেষ্টা করলাম সে নীলগঞ্জে নেই। তার বিয়ে হয়ে গেছে। সে স্বামীর সঙ্গে আছে। স্বামী খুলনার মংলা পোর্টে আছে।

সুলতানার ছোট বোনের নাম আফসানা। আমি তার কাছেও গেলাম। আমাকে দেখে কোনো কারণ ছাড়াই ভয়ে অস্থির হয়ে গেল। আমি বললাম, আফসানা তুমি কি আমাকে চেনো?

আফসানা বলল, আমি আপনাকে চিনি না। আমি গল্পের বই পড়ি না।

আমি বললাম, তুমি যে আমাকে চেনো না বললে এটা ঠিক না। তুমি বলেছ তুমি গল্পের বই পড়ে না। যে আমাকে চেনে না তার জানার কথা না যে আমি গল্প লিখি। এখন বলো তুমি কি নলিনী বাবুকে চেনো? নাকি তাকেও চিনো না?

আফসানা মুখ শক্ত করে দাঁড়িয়ে রইল। আমি বললাম, নলিনী বাবু কি তোমাদের বাড়িতে কখনো এসেছেন। তোমার বড় আপার কাছ থেকে গল্পের বই নিতে বা বই ফিরত দিতে।

আফসানী বলল, কোনোদিন আসেন নাই। কেউ যদি এই কথা বলে সে শত্রুতা করে বলেছে।

আফসানার সঙ্গে আর কথা বলা বৃথা আমি দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে উঠে দাঁড়ালাম।

 

নলিনী বাবু বিষয়ে আমি কোনো নতুন তথ্যই পেলাম না। তার বাড়ি দেখতে গেলাম। বাড়ি একজন কেয়ারটেকার দেখাশোনা করে, তার নাম রামচন্দ্র। সে খুব আগ্রহ নিয়ে তালা খুলে বাড়িঘর দেখাল। তার অতিরিক্ত আগ্রহের কারণ আমার কাছে স্পষ্ট হলো না। একটু পরপর বলছে, রাতে একটু সেবা নিবেন। সেবা নেওয়ার অর্থ যে রাতে ডিনার করতে হবে তা বুঝতেও অনেক সময় লাগল।

নলিনী বাবুর বাড়িতে রাতে সেবা নিলাম। সেবা না নিলেই ভালো হতো। তার প্রতিটি খাবারই অখাদ্য। মুরগি রান্না করেছে। লবণ যতটুকু প্রয়োজন তার তিনগুণ দিয়েছে। অতিরিক্ত লবণ সে পুষিয়ে দিয়েছে ডাল এবং সবজিতে। সেখানে একেবারেই লবণ নেই।

রাতেই ঢাকায় ফিরে যেতে চাচ্ছিলাম, মাইক্রোবাসের ড্রাইভার বলল, গাড়ির চাকা পাংচার হয়েছে। স্পেয়ার চাকায় হাওয়া নাই। নেত্রকোনা থেকে চাকা ঠিক করিয়ে আনতে হবে।

বাধ্য হয়ে নলিনী বাবুর বাড়িতেই রাত্রি যাপনের সিদ্ধান্ত নিলাম। রামচন্দ্রকে খুবই আহ্লাদিত মনে হলো।

রামচন্দ্র পান নিয়ে এসেছে। আমি পান চিবাচ্ছি, সিগারেট টানছি। রাতের কুৎসিত খাবারের দুঃখ ভুলার চেষ্টা করছি তখন রামচন্দ্র ভয়ঙ্কর এক গল্প ফাঁদল। আমার শরীর কেঁপে উঠল। একবার নলিনী বাবুর বাবা তার শিশুপুত্রকে শায়েস্তা করার জন্য কুয়ার ভেতর ফেলে দিয়েছিলেন। অনেক ঝামেলা করে তাকে কুয়া থেকে উদ্ধার করা হয়।

আমি বললাম, তখন নলিনী বাবুর বয়স কত?

চার-পাঁচ বছর।

এরপরই তার মধ্যে মৃগী রোগের লক্ষণ দেখা যায়।

তুমি কতদিন এই বাড়িতে আছ?

দিনের হিসাব তো করি নাই। মেলা দিন ধইরা আছি। ত্রিশ-চল্লিশ বছর হইতে পারে। আমার স্ত্রী-পরিবার সব ইন্ডিয়াতে চলে গেছে। আমি পইরে আছি।

কেন?

বাড়িটার উপরে মায়া চইলা আসছে এইজন্যে। মায়া কঠিন জিনিস। এই বাড়ির কুয়াতে ভূত আছে। ভুতের জন্যে মায়া।

সালেহ চৌধুরী বললেন, ভূতের জন্য মায়া মানে কী?

রামচন্দ্র জানালা দীর্ঘদিন কোনো পশু-পাখির সঙ্গে বাস করলে তার জন্যে মায়া জন্মে। একইভাবে দীর্ঘদিন কোনো ভূতের সঙ্গে বাস করলে ভূতের প্রতি মায়া জন্মে।

আমি বললাম, ভূতটা কুয়ায় বাস করে?

রামচন্দ্র বলল, হুঁ। স্যারের স্ত্রী কুয়াতে ঝাঁপ দিয়া পইড়া মারা গেছিলেন। তারপর থাইকা ভূত হইয়া কুয়ায় বাস করেন।

আমি বললাম, নলিনী বা আমাকে বলেছিলেন, তার মা ফাঁস নিয়ে মারা যান।

রামচন্দ্র বলল, ছোট স্যার পেরায়ই উল্টাপাল্টা কথা বলেন। আমারে পেরায়ই ডাকেন বড় মামা। আমি তো উনার মামা না। আপনারা কি ভূতের আলামত কিছু দেখতে চান?

কী আলামত দেখাবে?

কুয়াতলায় বইসা থাকবেন, রাইত গভীর হইলে শুনবেন, কুয়ার ভিতরে কেউ সাঁতার কাটতাছে। ভাগ্য ভালো থাকলে তার কথা শুনবেন।

তুমি শুনেছ?

অনেকবার শুনেছি। ছোট স্যার যখন চিকিৎসার জন্যে ঢাকা যায়, তখন কুয়ার পাড়ে আমি যতবার বসছি, ততবারই উনার কথা শুনেছি।

কী কথা?

উনি বলেন, ও চন্দ্র! আমার ছেলে কই? তাকে একলা কেন ছাড়লি। তুই কেন সাথে গেলি না?

তোমাকে চন্দ্র ডাকে? রামচন্দ্র ডাকে না? ভূত মুখে রামনাম নিতে পারে না। এই জন্য চন্দ্র ডাকে।

এক সমস্যা জানতে এসে আমরা ভূত সমস্যায় জড়িয়ে পড়লাম। কুয়ার পাড়ে বসে ভূতের কথা শোনার অভিজ্ঞতা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করার অর্থ হয় না। সঙ্গে ক্যাসেট রেকর্ডার আছে। রেকর্ডার চালু থাকবে। ভূত কোনো কথা বললে রেকর্ড হয়ে যাবে। বন্ধু-বান্ধবদের ভূত্রে গল্প শোনানোর সময় ভূতের কণ্ঠস্বর শুনিয়ে দেব।

কুয়াতলাটা সুন্দর। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। একটু দূরে প্রকাণ্ড কাঁঠাল গাছ। গাছের ডালপালা কুয়ার ওপর পর্যন্ত চলে এসেছে। আমি এবং সালেহ চৌধুরী কুয়ায় হেলান দিয়ে বসেছি। পঞ্চমীর চাঁদের আলো কাঁঠাল গাছের পাতা ভেদ করে আমাদের গায়ে পড়ে অদ্ভুত সব নকশা তৈরি করছে। দূরে কোথাও কামিনী ফুলের ঝাক আছে। বাতাসে মাঝে মাঝে ফুলের সৌরভ ভেসে আসছে। সারাক্ষণ এই গন্ধ নাকে লাগলে ভালো লাগত না। মাঝে মাঝে গন্ধ পাচ্ছি বলে ভালো লাগছে।

আমরা কেউ কোনো কথা বলছি না। কারণ, ক্যাসেট প্লেয়ার চালু আছে। ভূতের কণ্ঠস্বর রেকর্ড করা হবে।

সালেহ চৌধুরীর সমস্যা হচ্ছে (আমি তাকে নানাজি ডাকি), তিনি বেশিক্ষণ কথা না বলে থাকতে পারেন না। কোনো না কোনো প্রসঙ্গে তার কথা বলতেই হবে। পাঁচ মিনিট পার হওয়ার আগেই তিনি বললেন, টিউবওয়েল আসার পর কুয়া উঠে গেছে। কুয়াতলা সুন্দর একটা জায়গা। টিউবওয়েলতলা বলে কিছু নেই।

আমি বললাম, নানাজি চুপ করে থাকুন। ভৌতিক কণ্ঠস্বর রেকর্ড হবে।

তিনি মিনিট দুই চুপ করে থেকে বললেন, কুয়াতে বালতি পড়ে গেলে আঁকশি নামের এক বস্তু দিয়ে তোলা হতো। তুমি আঁকশি দেখেছ?

আমি বললাম, আঁকশি দেখেছি। আপনি চুপচাপ বসে সিগারেট খান।

তিনি সিগারেট ধরালেন। সিগারেট শেষ হওয়া পর্যন্ত চুপ করে থেকে নিজেই এক জ্বিন নামানোর গল্প শুরু করলেন। এই গল্প থেকে তাকে আর আটকানো গেল না। নানান শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে গল্প চলতেই থাকল। জিন থেকে কিভাবে কিভাবে মুক্তিযুদ্ধের গল্পে চলে এলেন। যুদ্ধ করতে গিয়ে কি বিপদে পড়েছেন, মিলিটারির তাড়া খেয়ে কিভাবে ঝাঁপ দিয়ে নদীতে পড়েছেন। এইসব গল্প শুরু হয়ে গেল। আমি জানি এখন আর তাঁকে থামানো যাবে না। হতাশ হয়ে ক্যাসেট প্লেয়ার বন্ধ করে দিলাম।

নীলগঞ্জ থেকে খালি হাতেই ফেরার কথা ছিল। খালি হাতে ফিরলাম। হলুদ প্লাস্টিকের মলাট দেয়া একটা ডায়েরি নিয়ে ফিরলাম। ডায়েরি পাবার গল্প করা যেতে পারে।

রাতে আমাদের দুজনের থাকার জায়গা হলো দোতলা ঘরে। প্রাচীন আমলের বড় কালো রঙের খাটে দুজনের শোবার ব্যবস্থা। রামচন্দ্র সব গুছিয়ে রেখেছে। ধোয়া চাদর, পরিষ্কার বালিশ, কোল বালিশ। নানাজি বললেন, ভালো ব্যবস্থা। আরাম করে ঘুম দেয়া যাবে। কিন্তু তিনি ঘুমের দিকে মোটেই গেলেন না। আয়োজন করে মুক্তিযুদ্ধের এক অপারেশনের গল্প শুরু করলেন। এই গল্প আগেও কয়েকবার শুনেছি। একবার যখন শুরু হয়েছে আবারও শুনতে হবে। উদ্ধার পাবার পথ দেখছি না। নানাজি যখন গল্পের এক ফাকে রামচন্দ্রকে বললেন, ফ্লাস্কে করে চা দেয়া যাবে? তখন আমি পুরোপুরি হতাশ হয়ে গেলাম। পরিষ্কার বুঝতে পারছি নানাজি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনায় যাচ্ছেন।

আমাকে উদ্ধার করল রামচন্দ্র। সে ফ্লাস্ক ভর্তি চা নিয়ে এসে বলল, আমি যে ঘরে আগে ঘুমাইতাম সেইখানে একটা পেততুনি থাকে। এই কারণে দোতলায় আর থাকি না।

আমি নামাজিকে বললাম, পেততুনি যে ঘরে থাকে সেই ঘরটা একটু দেখে আসি। তারপর আপনার গল্পের বাকিটা শুনব।

নানাজি বললেন, পেততুনির ঘর দেখার কি আছে?

আমি বললাম, যাব আর আসব। আপনি সিগারেট ধরান। আপনার সিগারেট শেষ হবার আগেই আমি উদয় হব।

পেততুনির ঘর দোতলার শেষ মাথায়। গুদাম ঘর টাইপ। দুনিয়ার জিনিসপত্রে ঠাসা। কোনোমতে একটা চৌকি বসানো। চৌকির উপর পাটি বিছানো। পাটির উপর ঢাকনা দেয়া মটকি। সেখান থেকে মিষ্টি গন্ধ আসছে। বেশ বড়সড় আলমারি আছে। যার বেশিরভাগ কাচই ভাঙা। ভাঙা কাচের ভেতর দিয়ে কিছু বইপত্র দেখা যাচ্ছে। পঞ্জিকা, রামায়ণ, গীতাভাষ্য ধরনের বই। একটি বাড়িতে কি ধরনের বই পাঠ করা হয় তা থেকে বাড়ির বাসিন্দাদের মানসিকতা আঁচ করা যায়। আমি হারিকেন হাতে বইয়ের সংগ্রহের দিকে এগিয়ে গেলাম। রামচন্দ্র ধারা বর্ণনার মতো পেততুনি বিষয়ে বলে যেতে লাগল।

স্যার পেততুনি কি জানেন?

না।

অল্পবয়েসি মেয়ে ভূত। মেয়ে ছেলের যত বদমাইশি থাকে এরারও তাই থাকে। এই যে মুটকি দেখতেছেন, এর ভিতরে আছে রসা। রসা বুঝেন স্যার? খেজুর গুড়ের রস। পেততুনিটা রেজি রাইতে আইসা রসা খায়। খায় আর খিকখিক কইরা হাসে।

রামচন্দ্র বকরবকর করে যাচ্ছে আর আমি বই ঘাটছি। তখনই হলুদ মলাটের একটা ডায়েরি পাওয়া গেল। পুরোটাই ইংরেজিতে লেখা। মাঝে মাঝে বাংলায় নোট। ডায়েরির প্রথম পাতায় বড় বড় করে লেখা–Dream Analogy. লেখক N. Vattachary,

এই N. Vattacharyaই কি আমাদের নলিনী বাবু? আমি রামচন্দ্র এই ডায়েরিটা কি নলিনী বাবুর?

জানি না স্যার। তারপর শুনেন ঘটনা, এক রাইতের ঘটনা শুনেন। আমি শুইয়া আছি, হঠাৎ বুঝলাম কেউ একজন আমার পায়ে হাত দিছে। ঠাণ্ডা হত। চিকন আঙ্গুল। আমি তো চমকায় উঠলাম। বুঝছি পেততুনির খেলা। এখন করব কি ভাইবা পাইতাছি না। ঝাপটায়া ধরব? ঝাপটায়া ধরলে পেতৃতুনি কি করে তাও জানি না। স্যার আমার বিপদ বুঝতেছেন?

আমি রামচন্দ্রের বিপদ বুঝতে না পারলেও নিজের বিপদ পরিষ্কার বুঝতে পারছি। নানাজির সঙ্গে থাকলে সারারাত মুক্তিযুদ্ধের বিভিন্ন অপারেশনের গল্প শুনতে হবে। আর রামচন্দ্রের সঙ্গে থাকলে শুনতে হবে পেতনির গল্প। আমাকে ঠিক করতে হবে আমি কি শুনতে চাই।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *