৫
মহির কোনো খবর পেলে বৌমা?”
ছায়ারাণীর এমন প্রশ্নের জবাবে পালাবার পথ খোঁজেন অঞ্জলি। পালাবার পথ খোঁজেন চারুর জিজ্ঞাসু, সজল চোখের দৃষ্টি থেকেও। কিন্তু নিজের কাছ থেকে তিনি পালাবেন কী করে? জীবন মানুষকে নানারকম যন্ত্রণা দেয়। সেই সব যন্ত্রণার ওজন মাপতে সময়ের বাটখারায় চোখ রাখতে হয়। কারণ একমাত্র সময়ই জানে, কোন
পুড়ে যাওয়া দাগ কত গভীর। কোন ক্ষত কতটুকু যন্ত্রণাময়। কিন্তু যে মা তার সন্তান। হারিয়েছেন তার যন্ত্রণা সময় মাপবে কী করে! এইখানে সময়ের বাটখারাটি বড় অক্ষম। অথর্ব।
অঞ্জলির মাঝেমাঝে মনে হয়, তিনি নিঃশ্বাস নিতে পারছেন না। তার বুকের কাছে আস্ত একটা পাথর আটকে আছে। ওই পাথর মুহূর্তের জন্যও সরে না। এতটুকু নিস্তার দেয় না তাকে। সারাক্ষণ তীব্র যন্ত্রণার দমবন্ধ এক অনুভব নিয়ে তিনি বেঁচে আছেন। এই বাঁচা মৃত্যুর চেয়েও ভয়ংকর। তারপরও বুকের ভেতর, অনিশ্চিত আশার এক চিলতে সলতে জ্বালিয়ে তিনি বেঁচে আছেন। তাঁর মনে হয়, ওই বুঝি মহিতোষ এলেন। সঙ্গে করে নিয়ে এলেন পারুকে। তারপর হাসিমুখে বললেন, ‘অনেক দুঃখ দিয়েছেন ভগবান। এবার আমাদের আনন্দের দিন। আমরা এবার আনন্দ করব। আমাদের বেঁচে থাকা পৃথিবীর নাম হবে আনন্দভুবন। তখন কী করবেন অঞ্জলি?
যতবার ঘরের দরজায় কারো হাত পড়ে। করা নাড়ে কেউ। সামান্য হাওয়ায় কেঁপে ওঠে কাঠের পাল্লাটা। ততবার বুকের ভেতর যেন রক্ত ছলকে ওঠে অঞ্জলির। তিনি পাগলের মতো ছুটে যান। রুদ্ধশ্বাসে জিজ্ঞেস করেন, কে ওখানে? কে?
কিন্তু ওখানে কেউ থাকে না। থাকলেও তাকে দেখা হয় না অঞ্জলির। তাঁর চোখজোড়া যেন কেবল মহিতোষ আর পারুকে দেখার জন্যই অপেক্ষায় থাকে। তাই অন্য কারুকে আর নজরে পড়ে না তার। চারু স্কুলে ভর্তি হয়েছে। সেদিন তার ফিরতে খানিক দেরি হয়েছে। অঞ্জলি থম মেরে বসেছিলেন মেঝেতে বিছানো মাদুরের ওপর। তার চোখ নিবদ্ধ জানালায়। জানালার বাইরে একটা জবা ফুলের গাছ। তার ওপারে আকাশ। আকাশে শুভ্র মেঘ। মেঘের ফাঁকে বরফের মতো সূর্য। সেই সূর্যের দিকে তিনি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। এই মুহূর্তে দরজায় কড়া নাড়ল কেউ। অঞ্জলি ঝট করে উঠে দাঁড়ালেন। তবে সঙ্গে সঙ্গেই আবার থমকে গেলেন। নিবৃত করলেন নিজেকে। ভুল শোনেননি তো তিনি? আজকাল প্রায়ই এমন হয়। হঠাৎ হঠাৎ মনে হয়, দরজার ওপাশে কেউ দাঁড়িয়ে। ওই বুঝি কেউ কড়া নাড়ল। রাতদুপুরেও এমন হয়। কতবার যে এসব ভেবে দরজা খুলেছেন তিনি! তারপর দেখেছেন, কোথাও কেউ নেই। কেবল খাঁখা অন্ধকার। রাতের হিমেল হাওয়া তখন ঝটকা মেরে ছুঁয়ে যায় তাঁকে। বুকের ভেতরটা ভরিয়ে দিয়ে যায় সীমাহীন হাহাকারে। অঞ্জলি কি পাগল হয়ে যাচ্ছেন? মাঝে মাঝে এমনও মনে হয় তার। কিন্তু তিনি কার কাছে এসব বলবেন? কে আছে তার বলার? চারু মাঝরাতে তাকে জড়িয়ে ধরে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। ছায়ারাণী দিনের মধ্যে অসংখ্যবার এসে এ কথা ও কথা জিজ্ঞেস করেন।
অঞ্জলি কার কাছে কী বলবেন? এই যে এখন ওভাবে দরজার কড়া নাড়ল কেউ, এ কি তার মনের ভুল? বিভ্রম? নাকি সত্যি? অঞ্জলি আলাদা করতে পারেন না। তবে কান খাড়া করে দাঁড়িয়ে থাকেন। নিজেকে বুঝতে চেষ্টা করেন। বুঝতে চেষ্টা করেন তার মনোজগতের এই সত্যি-মিথ্যার ধাঁধাটাকে। আর তখুনি আরো একবার কড়া নাড়ল দরজায়। তারপরও আরো একবার। তিনি গিয়ে দরজা খুলে দিলেন। তারপর অদ্ভুত ঘোর লাগা চোখে তাকিয়ে রইলেন কিছুক্ষণ। তারপর আচমকা ঝড়ের মতো ছুটে গিয়ে জড়িয়ে ধরলেন চারুকে। চারু অবাক চোখে তাকিয়ে রইল মায়ের দিকে। মা এমন করছে কেন? অঞ্জলি অবশ্য সেসব খেয়াল করলেন না। তিনি হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলেন। চারুকে পাগলের মতো চুমু খেতে লাগলেন। শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বুকের সঙ্গে মিশিয়ে ফেলতে চাইলেন। আর তারপর জড়ানো গলায় বলতে লাগলেন, তুই কই ছিলি? কই ছিলি তুই? এমন করে মাকে ছেড়ে থাকতে তোর কষ্ট হলো না? এতটুকু কষ্ট হলো না মাকে ছেড়ে থাকতে? হ্যাঁ? তুই আমার মেয়ে না? তোকে আমি পেটে ধরি নাই? তোর জন্য আমার কষ্ট হয় নাই? এই তুই কই ছিলি আমাকে ছেড়ে? কই ছিলি? কার কাছে ছিলি?
চারু মায়ের বুকের ভেতর থেকে তার মুখ সরাবার চেষ্টা করছে। তার দম আটকে আসছে। কিন্তু অঞ্জলির সেসব খেয়াল নেই। তিনি পাগলের মতো চারুকে চুমু খেতে লাগলেন। আর চোখের জল, নাকের জল এক করে কতকিছু যে বলে যেতে লাগলেন।
‘তোর বাবা কই? তাকে আবার কোথায় রেখে এসেছিস? তোকে খুঁজতে গিয়ে তার কী দশা হয়েছে তুই জানিস? জানিস তুই? ও পারু, কথা বলছিস না কেন? বল, তুই কই ছিলি এতদিন? কার কাছে ছিলি? মার জন্য তোর এতটুকু কষ্ট হয়নি? বাবার জন্য? চারুর জন্য? ঠাকুমার জন্য?
অঞ্জলি কাঁদছেন। চারু ঠায় দাঁড়িয়ে রইল। মা কি তবে ধীরে ধীরে পাগল হয়ে যাচ্ছে? এই এতদিন মায়ের এত কাছে থেকেও সে এসব কিছুই বোঝেনি। বরং যখনই দিদির জন্য, বাবার জন্য তার মন খারাপ লেগেছে। ভুবন ডাঙার জন্য, বাড়ির জন্য কান্না পেয়েছে, তখনই সে মায়ের কাছে আশ্রয় নিয়েছে। মাঝরাতে দুঃস্বপ্ন দেখে মায়ের বুকের ভেতর মুখ লুকিয়ে কেঁদেছে। মা তাকে আগলে রেখেছে পরম মমতায়। কিন্তু সে কি কখনো মায়ের ওই উষ্ণ বুকের ভেতর কী বয়ে যাচ্ছে, তা দেখেছে? অনুভব করেছে মা কেমন করে অমন বরফের নদী হয়ে গেল? ওপরে কঠিন, নিষ্প্রাণ এক আস্তরণ তার। আর ভেতরে হিমশীতল জলের প্রবাহ।
.
সেদিনের পর থেকে অঞ্জলি কেমন অন্যরকম হয়ে গেলেন। কারো সঙ্গে কথা বলেন না। কোথাও যান না। কেবল নির্জীব চোখ মেলে শূন্যে তাকিয়ে থাকেন। তার সেই চোখের ভাষা পড়া যায় না। তবে চারুর মাঝেমাঝে খুব ভয় হয়। মনে হয় এই মানুষটা বড় অচেনা। তার এতদিনকার সেই চিরচেনা মা এই মানুষটি নন। এ যেন অবিকল অঞ্জলির মতোই দেখতে অন্য কেউ। সেদিন থেকে চারুর বয়সও যেন আচমকা বেড়ে গেল। সে হঠাৎই আবিষ্কার করল, তার মা সেই আগের মানুষটি আর নেই। তার বয়স বেড়ে গেছে। চোখের সামনে চট করে এক দিনের ব্যবধানে বুড়ো হয়ে গেছেন তিনি। কিংবা ঘুণেধরা কোনো বৃক্ষ বা খুঁটির মতো ভেতরে ভেতরে ফাপা, শূন্য হয়ে গেছেন। কোন ফাঁকে রোজ একটু একটু করে মরে গেছেন। কিন্তু এতদিনেও বাইরে থেকে দেখে তা একটুও বোঝা যায়নি।
কী করবে এখন চারু? এতদিনকার সেই ছোট্ট, খেয়ালি, আদুরে চারু নিজেকে হঠাৎ অচেনা এক পৃথিবীতে আবিষ্কার করল। এই পৃথিবীতে তার মাথার ওপর বাবার ছায়া নেই, মায়ের আঁচলের আড়াল নেই। এখানে সে প্রখর দহন দিনে বিরাণ মরুভূমিতে দাঁড়ানো একা এক বৃক্ষ। এই বৃক্ষকেই এখন ক্রমশই ছায়াদায়ী হয়ে উঠতে হবে। আগলে রাখতে হবে মা, ঠাকুমাকে। আর বাবা, পারুদি? তাদের কী হবে? কোথায় আছে তারা?
এই প্রশ্নের উত্তর চারু জানে না। তবে মাকে সে নানা সময়ই এটা-সেটা জিজ্ঞেস করে। বাংলাদেশ থেকে আর কোনো খবর এসেছে কি না? অরবিন্দু দাদুকে আর কোনো চিঠি লিখেছেন কি না অঞ্জলি। কিন্তু অঞ্জলি সেসব কিছুরই ঠিকঠাক উত্তর দেন না। মাঝেমধ্যে কেবল হা-হুঁ করেন। তবে তার বেশির ভাগই অর্থহীন। আচ্ছা, মা কি তবে পুরোপুরি অসংলগ্ন হয়ে যাচ্ছেন? এই নিয়ে চারুর খুব ভয় হয়। রাতে সে মাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমায়। তবে এই ঘুমানোর মধ্যে পার্থক্য আছে। আগে সে মায়ের বুকের ভেতর মুখ লুকিয়ে আশ্রয় খুঁজত। যেন এ জগতে এই আশ্রয়টুকু ছাড়া আর কিছু তার নেই। এখানেই জগতের সকল শান্তি, সকল স্বস্তি। আর এখন সে নিজের ছোট্ট বুকের ভেতর মায়ের মুখটা আগলে ধরে রাখে। তারপর রাতভর মায়ের মাথায় হাত বোলাতে থাকে। যেন সে জানে, এই কঠিন পৃথিবীতে সে ছাড়া মায়ের আর কেউ নেই। কোনো আশ্রয় নেই।
অরবিন্দু বাবু ঢাকা থেকে প্রায় নিয়মিতোই চিঠি লিখে যোগাযোগ রক্ষা করার চেষ্টা করেছেন। সেই চিঠি অঞ্জলি যত্ন করে তাঁর ট্রাংকে রেখে দিয়েছিলেন। চারু একদিন সেসব খুলে দেখল। একটা একটা করে পড়ল। পড়তে গিয়ে তার অকস্মাৎ মনে হলো, তাদের জীবন থেকে বাবা বুঝি চিরতরে হারিয়ে গেলেন। হারিয়ে গেল পারুও। এই জীবনে তাদের সঙ্গে আর কখনো দেখা হবে না তাদের।
.
অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, এই একই অনুভব ধীরে ধীরে গ্রাস করে ফেলতে লাগল ফরিদকেও। এতদিনে তার একবারও মনে হয়নি যে পারু চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেছে। তাকে আর কখনোই পাওয়া যাবে না। বরং সে নিশ্চিত ছিল, পারু কোথাও না কোথাও আছেই। তাকে কেবল অপেক্ষায় থাকতে হবে। আজ হোক, কাল হোক পারুর খবর সে পাবেই। কিংবা পারু ফিরে আসবে তার কাছে। পারু না হয়। ফরিদের বাসার ঠিকানা জানে না, কিন্তু ওই মেলার মাঠের কথা তো সে জানে। ওই মাঠ চেনে না এমন লোক পাওয়া কঠিন। সেদিনের ওই ভিড়ে, নদীর ওই খাড়া ঢাল থেকে ছিটকে গিয়ে যদি পারু কোনো নৌকার ওপরও পড়ে গিয়ে থাকে, তবুও তার বেঁচে থাকার কথা। তা ছাড়া তার লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি। এসব কারণেই ফরিদ আশাবাদী। তার দৃঢ় বিশ্বাস, পারু বেঁচে আছেই। সে ফিরে আসবেই। সেই সম্ভাবনার আশায়ই রোজ এই মাঠের কোনায়, নদীর ধারের বটগাছটার তলায় এসে বসে থাকে ফরিদ। পারু যদি ওই অন্ধকার রাতে, ওই ভিড়ের মধ্যে কোনো। নৌকায় বা কারো সঙ্গে চলে গিয়েও থাকে, তাহলেও সে এখানে ফিরে আসবেই। ফরিদ তাই দিনমান অপেক্ষায় থাকে। পারু যেন এখানে এলেই তাকে পায়।
কিন্তু ফরিদের এই ভাবনায় প্রথম বড় ধাক্কাটা এলো দিন দশেক বাদে। একটা পচা গলা লাশ পাওয়া গেছে নদীতে। মূলত জেলেদের জালে উঠে এসেছে লাশটা। খবর পেয়েই ছুটে গিয়েছিল সে। লাশ দেখে তখন আর চেনার উপায় নেই। তবে পোশাক-আশাক দেখে জেলেরা নিশ্চিত করেছে লাশটা একজন পুরুষের। কথাটা শুনে তাৎক্ষণিকভাবে খানিক নির্ভার অনুভব করেছিল ফরিদ। তবে সময় যত গড়িয়েছে, ততই তার মনে শঙ্কার কালো মেঘ জমে উঠতে শুরু করেছে। তার মানে সেদিন নদীতে আরো অনেক লাশ ভেসে গেছে! তাদের মধ্যে অনেককেই হয়তো আর কখনো খুঁজে পাওয়া যাবে না। পারুও কি তেমনই একজন হয়ে। থাকবে?
ফরিদ জানে না। তার মাথায় রাজ্যের চিন্তা কাজ করে। তাতে আশা-নিরাশার দোলাচল। সারাক্ষণ কত কত চিন্তায় যে আচ্ছন্ন হয়ে থাকে সে, তার ইয়ত্তা নেই। তবে সেদিন একটা ঘটনা ঘটল। সে নদীর ধারে বসেছিল একা একা। এই মুহূর্তে ছোটখাটো একটা জমায়েত চোখে পড়ল তার। আট-দশজনের একটা দল নদীর ধারে এসে দাঁড়িয়েছে। তাদের পরনে পাঞ্জাবি। মাথায় টুপি। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে, তারা এখানে নামাজ পড়বে। কিন্তু এটা তো নামাজের সময় নয়! তাহলে?
ফরিদ কৌতূহল নিয়ে উঠল। তারপর ধীর পায়ে দলটার কাছে গিয়ে দাঁড়াল। তাকে দেখে অবশ্য কেউ কিছু বলল না। তবে ফরিদ চুপচাপ দাঁড়িয়ে তাদের কথোপকথন শোনার চেষ্টা করল। সেই কথোপকথন থেকে সে যা বুঝল, এই দলটার একজনের স্ত্রী সেদিন নিখোঁজ হয়েছেন। লোকটি তার স্ত্রীকে নিয়ে এই নদীতেই ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন। কিন্তু তারপর আর তাকে খুঁজে পাননি। এ কদিনে। আশপাশে বহু জায়গায় তিনি তাকে খুঁজে বেড়িয়েছেন, কিন্তু লাভ হয়নি। কোথাও হদিস মেলেনি তার। অবশেষে তারা ধরেই নিয়েছেন যে তার স্ত্রী নদীতে ডুবে মারা গেছেন। এবং তার লাশ ভেসে গেছে জলে। এ কারণেই স্ত্রীর উদ্দেশ্যে গায়েবানা জানাজা পড়তে চান তিনি। তার বিশেষ ইচ্ছে সেই জানাজা হবে এখানেই। লোকটা এখনো কাঁদছে। তাকে সান্ত্বনা দেয়ার চেষ্টা করছে অন্যরা। লোকটির দুটি সন্তান রয়েছে। ছোট সন্তানটির বয়স মাত্র দেড় বছর। ঘটনার দিন তাদের বৃদ্ধ দাদির কাছে রেখে আসা হয়েছিল। মা হারা ওই সন্তান দুটি এখন বাঁচবে কী করে!
লোকটার কান্না দেখে ফরিদ আর স্থির থাকতে পারল না। তা ছাড়া, এতদিন। তার মনে যে দৃঢ় আশা ছিল, সেই আশার প্রদীপটা যেন আচমকা এক দমকা হাওয়ায় প্রায় নিভে যাওয়ার উপক্রম হলো। পারুরও কি তবে এমন কিছুই হয়েছে?
সেই রাতে এক পলকের জন্যও ঘুমাতে পারল না ফরিদ। অসংখ্য এলোমেলো চিন্তা তাকে পাগল করে দিতে লাগল। মনে হলো, একটা মিথ্যে আশা সে এতদিন বুকে পুষে রেখেছিল। একটা অসম্ভব কল্পনার জগতে ডুবে ছিল। যদি সত্যি সত্যিই যুক্তি-বুদ্ধি দিয়ে সে পুরো বিষয়টি চিন্তা করে, তবে পারুর আসলে বেঁচে থাকার কথা নয়। সেদিন রাতে পারু যদি জলে পড়ে গিয়ে থাকে, তবে ওই অসংখ্য আতঙ্কিত মানুষের ভিড়ে তার পক্ষে ভেসে থাকা সম্ভব ছিল না। তা ছাড়া সে তখন এতটাই আহত-অসুস্থ হয়ে পড়েছিল যে ঠিকমতো দাঁড়াতেই পারছিল না। সেক্ষেত্রে হয় সে অন্য মানুষের পদতলে চাপা পড়েছে, নতুবা ভেসে গেছে জলে। আর কোনো অলৌকিক উপায়ে যদি সে বেঁচেও থাকে, তবে এতদিনে এই বালুর মাঠে তার একবারের জন্য হলেও ফিরে আসার কথা ছিল। খোঁজ করার কথা ছিল ফরিদের।
পরদিন ভোর হলো। আলো ফুটল পশ্চিমাকাশে। কিন্তু ফরিদ উঠল না। সে শুয়ে রইল যেমন ছিল, তেমনই। একবারের জন্যও বিছানা ছেড়ে উঠল না। কিছু খেল না। বালুর মাঠের উদ্দেশ্যেও ছুটল না। বেলা বাড়তে লাগল। দুপুর গড়াল। বিকেলের ম্লান আলো পেরিয়ে নেমে এলো সন্ধ্যা। কিন্তু ফরিদ তার ঘরে একা নিষ্প্রাণ এক মানুষের মতো নিস্তেজ পড়ে রইল। তার মনে হলো, পারু ছাড়া এই জীবনের আর কোনো অর্থ নেই। এই জীবন সে কাটাবে কী করে! এই অবিশ্বাস্য নারকীয় যন্ত্রণার ভয়ানক নিঃসঙ্গ জীবন। বাঁচবে কী করে সে! কী করে বয়ে বেড়াবে তার শরীর আর মনজুড়ে লেগে থাকা পারুর অনিমিখ অম্লান স্মৃতির গন্ধ? সে তা কী করে বয়ে বেড়াবে? কিংবা মুছে ফেলবে?
৬
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া ভুবনডাঙায় ফিরে এসেছেন। তবে তাঁর এই ফিরে আসা না ফেরার মতোই নিঃশব্দ, নিষ্প্রভ। যেন সবকিছু হারানো নিঃস্ব এক মানুষ তিনি। যে ঝলমলে আলোর উৎস দেখে দিগবিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে শুরু করেছিলেন, সেই আলোর আড়ালে যে এমন গাঢ় অন্ধকার ওত পেতে লুকিয়ে আছে তা তিনি ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেননি। এমনকি কামাল যখন তাঁকে চিঠি পাঠিয়ে জানিয়েছিল যে ঢাকায় পারুদের খোঁজ পাওয়া গেছে, তখন সেই চিঠি পড়েও তাঁর মনে হয়েছিল–এই বুঝি তার দুর্ভাগ্যের রাত্রি ফুরাল। কিন্তু ওই রাত্রি আর পোহায় না। বরং রাত যত গম্ভীর হয়, তার প্রভাত যেন ততই দূরবর্তী হতে থাকে। আর নিকটবর্তী হতে থাকে গভীর অন্ধকার। না হলে পারু, ফরিদ, মহিতোষ সবার অত কাছে গিয়েও কেন এমন শূন্য হাতেই ফিরে আসতে হবে তাকে?
পারুকে নিয়ে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার বিশেষ কোনো আগ্রহ নেই। তার আগ্রহ মহিতোষ মাস্টারকে নিয়ে। কিন্তু সেই মহিতোষ মাস্টারকে একদম হাতছোঁয়া দূরত্বের নাগালে পেয়েও তিনি কিছুই করতে পারলেন না। একটা কথা অবধি জিজ্ঞেস করতে পারলেন না। বরং তাকেই পালিয়ে চলে আসতে হলো ঢাকা ছেড়ে। সেদিন রাতে পুলিশের তাড়া খাওয়ার পর আর কামালের বাসায় ফিরে যাননি তিনি। তীব্র হতাশা আর আতঙ্ক নিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন গায়ে। কে জানে, যদি কামালের সহযোগী হিসেবে পুলিশ তাঁকেও সন্দেহ করে বসে!
কিন্তু গাঁয়ে ফিরেও ওই আতঙ্ক যেন আর কিছুতেই পিছু ছাড়তে চাইছিল না তাঁর। কেবল বারবার মনে হচ্ছিল, এই বুঝি পুলিশ তার খোঁজে ভুবনডাঙায় চলে এলো। তারপর ধরে নিয়ে গেল জেলখানায়। এই চাপা আতঙ্কেই জড়সড় হয়ে রইলেন তিনি। দিন কাটাতে লাগলেন গৃহবন্দির মতো। কারো সঙ্গে কথা বলেন না। ঘর থেকে বের হন না। সারাক্ষণ চুপচাপ দরজা বন্ধ করে বসে থাকেন। মাথার ভেতর এলোমেলো হাজারটা চিন্তা যেন ঘুণপোকার মতো কুটকুট করে খেয়ে যেতে থাকে মস্তিষ্ক। তবে ঘরে বসে থাকা এই অসহায়, আতঙ্কিত সময়টাতেও কখনো হাল ছেড়ে দেয়ার কথা ভাবেননি জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। বরং বুকের ভেতর একটা তীব্র আক্রোশ যেন ক্রমশই দানা বেঁধে উঠতে লাগল। এত সহজেই হেরে যাবেন তিনি?
এই হেরে যাওয়ার ভাবনাতেই নড়েচড়ে বসেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তার আচমকা মনে হতে থাকে, অদৃশ্য এক শত্রুর সামনে তিনি পুরোপুরি দৃশ্যমান, অরক্ষিত। এই শত্রু তার পরাজয় নিশ্চিত করার জন্য ব্যস্ত হয়ে ওঠেনি। বরং ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করছে। আড়াল থেকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে উপভোগ করছে তার পরাজয়। কিন্তু কে সেই শত্রু?
আশরাফ খাঁর মুখখানা ঠিক এখানেই দেখতে পান তিনি। এই মানুষটার সঙ্গে তার পুরনো কিছু হিসেব বাকি আছে। সেই হিসেবে তার হয়তো তেমন কোনো দেনা নেই, কিন্তু পাওনা আছে। আশরাফ খাঁ কি তবে সেই পাওনাটাই মিটিয়ে দিতে চাইছেন? এতদিনেও তিনি সেই পুরনো ঘটনা ভুলতে পারেননি? ভোলার অবশ্য কথাও নয়। ডান পায়ে যখন তিনি খানিক খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটেন, তখন নিশ্চয়ই সেই পুরনো দিনের হিসেবের কথা তার মনে পড়ে যায়। যে আঘাত করে, সে সহসাই তা ভুলে যায়। কিন্তু যে আঘাতপ্রাপ্ত হয়, সে সারাজীবনেও সেই আঘাতের কথা, যন্ত্রণার কথা ভুলতে পারে না। চেতনে-অবচেতনে সারাক্ষণ সে তা বুকে পুষে রাখে। আশরাফ খাঁ-ও হয়তো রেখেছিলেন। তবে যুদ্ধ-পরবর্তী দেশে মাত্র কয়েক বছরের মধ্যেই নানা পালাবদল, সৎভাইদের সঙ্গে আশরাফ খাঁর প্রবল দ্বন্দ্ব, শারীরিক-মানসিক ও আর্থিকভাবে ভঙ্গুর অবস্থা ধীরে ধীরে তাকে হতাশ ও মিয়মাণ করে ফেলেছিল। দিনে দিনে তিনি হয়ে গিয়েছিলেন নীরব দর্শক। ফলে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া ভেবেছিলেন, অতীতের সব ঘটনা বুঝি তিনি বিস্মৃত হয়েছেন। কিন্তু এখন মনে হচ্ছে, এতদিন একটি সুযোগের অপেক্ষায় ছিলেন আশরাফ খাঁ। এবং সেটি পাওয়া মাত্রই কাজে লাগিয়েছেন। মহিতোষের কাছ থেকে তার জমি, বসতভিটা কিনে নিয়েছেন। আসলে এই জমির চেয়েও তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ ছিল জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার ওপর প্রতিশোধ নেয়া। তাঁকে বঞ্চিত, অপদস্থ করা। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তাহলে এতদিনেও কেন এই জমি দখল নিতে আসছেন না তিনি?
অনেক ভেবেও এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে পেলেন না জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। আবার আশরাফ খাঁর বিষয়ে পুরোপুরি নিশ্চিতও হতে পারলেন না। কারণ এতবছরে আশরাফ খাঁ ছাড়াও তার আশপাশে কম শত্রুও তৈরি হয়নি। ফলে তাঁকে বিপদে ফেলা লোকেরও অভাব নেই। সেক্ষেত্রে আশরাফ খাঁ মূল সন্দেহভাজন হলেও অন্যদের ব্যাপারেও তিনি নিঃসন্দেহ হতে পারছেন না। বিষয়টা নিয়ে রীতিমতো দ্বিধার সমুদ্রে হাবুডুবু খেতে লাগলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তবে তাঁকে এই দ্বিধা থেকে উত্তরণের দারুণ এক পথ বাতলে দিল এছাহাক। বিগত দিনে নানা কারণে এছাহাকের ওপর তিনি ত্যক্ত-বিরক্ত। তবে একথাও তো সত্য যে এ গাঁয়ে তিনি যদি কারো ওপর চোখ বন্ধ করে ভরসা করতে পারেন, তবে তা একমাত্র ওই এছাহাকই। বছরের পর বছর সে তার সকল কাজের সার্বক্ষণিক সহচর। অন্ধের মতো তাঁকে অনুসরণ করেছে। ফলে তারপক্ষে এই মুহূর্তে এছাহাক ছাড়া আর কারো ওপর নির্ভর করাও সম্ভব নয়। এসব ভেবেই শেষ অবধি একদিন এছাহাককে ডাকলেন তিনি।
এছাহাক কাঁচুমাচু ভঙ্গিতে বলল, আপনের শরীলখান ভালো ভূঁইয়া সাব।
হুম। গম্ভীর মুখে জবাব দিলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তিনি সহসাই আর আগের মতো সহজ হতে চান না। একটা দূরত্বের দেয়াল দৃঢ় রেখেই তিনি সবার সঙ্গে কথা বলতে চান। এতদিনে তিনি একটা জিনিস বুঝেছেন, কাউকে বেশি কাছে আসতে দিলে তার কাছে গুরুত্ব কমে যায়।
এছাহাক বলল, কোনো কারণে আপনের মন মেজাজ খারাপ?
মন মেজাজ খারাপ হবে কেন?
না মানে এই যে সারাদিন ঘর বন্ধ কইরা বসে থাকেন। কারো সঙ্গে কোনো কথা বলেন না। দেখা-সাক্ষাৎ পর্যন্ত দেন না!’
সবসময় তো মানুষ একরকম থাকে না। থাকে?
না, তা থাকে না। মানুষের মেজাজ-মর্জি খারাপ হয়। ভালো-সময় মন্দ সময় যায়। এখন যাইতেছে আপনের মন্দ সময়।
আমার মন্দ সময় যাইতেছে, এইটা তোমারে কে বলল?
না, কেউ বলে নাই। এইটা আমার অনুমান। আপনের সঙ্গে এতবছর থাকি, আর এইটুক বুঝব না? ঢাকায় থেকে আসনের পর থেকেই আপনে একদম চুপচাপ। অথচ গেলেন কত আশা কইরা। ঢাকায় কী হইলো ভূইয়া সাব? কারো কোনো খোঁজ-খবর পাইছেন?
আমি কারো খোঁজ-খবরের জন্য যাই নাই। গেছি অন্য কাজে। যেই কাজে গেছি, তা হইছে।
এছাহাক এবার খানিক গলা নামিয়ে এদিক-সেদিক তাকিয়ে বলল, “শুনলাম, কামাল ভাই নাকি পুলিশের হাতে ধরা পড়ছে!
এছাহাকের কথা শুনে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া ধাক্কার মতো খেলেন। এতদিন কারো। সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ না করার কারণে আশপাশের অনেক ঘটনাই তিনি জানেন না। তিনি ঢাকা থেকে এসেছেন মাস পেরিয়ে গেছে। এর মধ্যে আরো কত কী হয়েছে কে জানে! খানিক সময় নিয়ে নিজেকে সামলে নেয়ার চেষ্টা করলেন তিনি। তারপর গলা নামিয়ে বললেন, কামাল কেন পুলিশের হাতে ধরা পড়বে? আর তুমি জানলা কেমনে?
‘এই কথা তো সকলেই জানে ভূঁইয়া সাব। পত্রিকাতেও আসছে। জেলা শহর থেকে ওই পাড়ার মইনুদ্দি শুইনা আসছে। জানেনই তো, দুঃসংবাদ বাতাসের আগে ছোটে। আর সে তো কামাল ভাইরে চিনত। কামাল ভাইর ছবিও নাকি ছাপা। হইছে। তার নামে নাকি অনেকগুলা মামলাও আছে। মার্ডার কেসও।
এই কথায় জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া চুপসে গেলেন। তিনি বুঝতে পারছেন না এখন তাঁর কী করা উচিত। কামালের গ্রেফতার নিয়ে যে তাঁর খুব দুশ্চিন্তা হচ্ছে তা নয়। তিনি বরং চিন্তিত তার নিজেকে নিয়ে। এমন যদি হয় যে কামাল তার কোনো অপকর্মের সঙ্গে তাঁর নামও যুক্ত করে দেয়! কিংবা পুলিশের কাছে বলে যে সে এখানে বেশ কিছুদিন লুকিয়ে ছিল! কথাটা ভাবতেই তীব্র একটা ভয় বুকের ভেতর দলা পাকাতে লাগল জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার। তিনি খানিক দম নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এই ঘটনা এতদিন দেও নাই কেন আমারে? কামাল গ্রেফতার হইছে কতদিন?
‘তা তো আর জানি না। তবে পত্রিকায় তো আসছে আপনে ঢাকা থেকে আসনের কয়েকদিন পরেই। আমি আরো ভাবছি, আপনে সব জানেন। এইজন্যই আপনের মন-মেজাজ খারাপ। পত্রিকায় তো ঘটনা ঘটার দুই-এক দিন পরেই আসে।’
হুম।’ বলে গম্ভীর হয়ে গেলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। পুরো বিষয়টাকে আবার প্রথম থেকে ভাবতে লাগলেন। তিনি ঢাকা থেকে এসেছেন মাস পেরিয়ে গেছে। এর মধ্যে পুলিশ তার খোঁজে আসেনি। কামাল যদি সত্যি সত্যিই পুলিশকে কিছু বলে থাকত, তবে এতদিনে তাদের এখানেও চলে আসার কথা ছিল। বিষয়টা ভেবে মনে মনে খানিক স্বস্তি অনুভব করলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তার মানে অযথাই এত দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। তবে আরো কয়েকটা দিন তিনি ধৈর্য ধরতে চান। আশপাশের পরিস্থিতি বুঝতে চান। তারপর মহিতোষের জমির ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। তা সেদিনের পর থেকে আবার ঘর থেকে বের হতে শুরু করলেন তিনি। নিয়ম করে মসজিদে নামাজ পড়তে গেলেন। লোকজনের সঙ্গে আবার মিশতে লাগলেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, সপ্তাহখানেক যেতে না যেতেই এই কদিনের ভয়টাকে স্রেফ অমূলক মনে হতে লাগল। নিজেকে মনে হতে লাগল আত্মবিশ্বাসী।
সেদিন কৌতূহল বশতই হঠাৎ এছাহাককে বললেন, তা মাস্টারের বাড়ির খবর কী?
এছাহাক যেন চট করে ধরতে পারল না। সে বলল, ‘কোন মাস্টার?
‘কোন মাস্টার মানে কী? আমি মাত্র কয়টা দিন ছিলাম না, এর মধ্যেই সব গিলে খেয়ে ফেলছো? মহিতোষ মাস্টারের বাড়ির খবর কী? নাকি আমি ছিলাম না বলে আর ওইদিকের কোনো খোঁজ খবরই নাই?
এছাহাক তটস্থ গলায় বলল, না না ভূঁইয়া সাব। সব ঠিক আছে। একটা কাক-পক্ষিও এই দিকে আসে নাই।’
হুম।
বলে আবারও গম্ভীর হয়ে গেলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তিনি বিষয়টা নিয়ে চিন্তিত। এছাহাককে নিয়ে সেই বিকেলে অনেকদিন বাদে আবার মহিতোষ মাস্টারের ভিটার দিকে গেলেন তিনি। সবকিছু আগের মতোই আছে। কেউ কোনো কিছুতে হাত দেয়নি। তবে মহিতোষ মাস্টারের ঘরখানা কেমন খাখা করছে। মনে হচ্ছে এক বিরান প্রান্তর। আসলে ইট-কাঠ-পাথরের তৈরি কাঠামো যত সুন্দরই হোক না কেন, তাতে যদি মানুষ না থাকে, তবে তা কখনোই ঘর হয়ে ওঠে না। এই ঘরখানা সেই অর্থে তেমন বিলাসবহুল বা দৃষ্টিনন্দন কিছু নয়। বরং খুব সাদাসিধে দেখতে একখানা আটপৌরে টিনের ঘর। অথচ তারপরও দূর থেকে সেই ঘরখানাকে দেখলেই মনে হতো জীবন্ত। যেন এরও প্রাণ আছে। ওই টিনের বেড়া, লোহার জানালা, কাঠের দরজা, দরজার চৌকাঠ এসকলই যেন প্রাণ-প্রাচুর্যে ভরপুর ছিল। অথচ আজ সেই ঘরখানাকেই মনে হচ্ছে ইট, কাঠ, টিনের জঞ্জাল। নিস্তরঙ্গ, নির্জীব, প্রাণহীন এক কঙ্কাল।
.
তারা হেঁটে বাড়ির পেছন দিকটায় গেলেন। শীতকাল ফুরিয়ে এসেছে। গাছে গাছে ফুল-পাখিদের আনাগোনা। চারপাশজুড়ে একটা অদ্ভুত রঙিন, সুবাসিত জগৎ। নিজের অজান্তেই মনটা কেমন ফুরফুরে হয়ে যায়। তবে এমন অবস্থা বেশিদিন থাকবে না। আর কিছুদিনের মধ্যেই বৃষ্টি-বাদলা শুরু হবে। তখন এই বিরাট বাড়িতে লোকজনের বসবাস না থাকলে বিপদ। রাজ্যের বুনো আগাছা, লতা-গুল্ম এসে ওই ঝকঝকে উঠান দখল করে নেবে। পোকা-মাকড়, সাপখোপের ঘরবসতি হবে এই বাড়ি। এই বাগানে পা ফেলার জো থাকবে না। কে জানে, হয়তো মহিতোষের ওই পরিত্যক্ত বাড়িখানাও হয়ে উঠবে পশু-পাখিদের অভয়াশ্রম। তার আগেই এসবের একটা চূড়ান্ত সমাধান করতে হবে।
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া আনমনেই কথাটা বললেন, তা এখন কী করব বল তো এছাহাক?”
‘কোন বিষয়ে ভূঁইয়া সাব?’
‘এই বাড়ির বিষয়ে। এ তো এখন আমার কাছে গলার কাঁটার মতো হয়ে গেল। না উগড়াতে পারছি, না গিলতে পারছি।
এছাহাক সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিল না। দীর্ঘ সময় চুপ করে রইল। তারপর বলল, আপনে অভয় দিলে একখান কথা বলতাম ভূঁইয়া সাব।
এছাহাকের এই ধরনের ন্যাকামো জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার পছন্দ না। তিনি আগেও দেখেছেন, এই ধরনের ভনিতা করে যখন সে কোনো কথা বলে, তখনই সবচেয়ে আজগুবি, অনর্থক কথাখানা বলে। তবে আজ তিনি রাগলেন না। গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, কী কথা?
না মানে, ধরেন আপনে যদি এইখানে একখান পাকা দালান তোলেন, তাহলে কেমন হয়?
‘পাকা দালান তুলব মানে? এই জমির কাগজপত্র কিছু আছে আমার কাছে? কার না কার নামে এই জমি লিখে দিয়ে গেছে মহিতোষ মাস্টার। আর সেই জমিতে আমি দালান তুলে বসে থাকব? আর তারপর সে পুলিশ নিয়ে এসে আমারে তুলে দেবে। আমার জমিও যাবে। ওপরোন্ত দালান করার টাকা যাবে ফাও।’
না ভূঁইয়া সাব। আপনার দালান করার টাকা যাবে না।
‘কেন?’
কারণ, আপনে যখন দালান করা শুরু করবেন, আমি নিশ্চিত তখনই জমির মালিক এসে উদয় হবে। কারণ কারো জমিতে আপনে পাকা ঘর-দোর তুলে বসে থাকবেন, আর সে কিছু বলবে না। এটাও তো স্বাভাবিক বিষয় না। কী বলেন?
এছাহাকের কথার উত্তর দিতে গিয়েও জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া চুপ করে গেলেন। তাঁর অকস্মাৎ মনে হলো, এছাহাক কথাটা খারাপ বলেনি। এই কথা যে এর আগে দু একবার তিনি ভাবেননি। বা আলোচনা করেননি, তা নয়। কিন্তু আজ কেন যেন কথাখানা তার কাছে খুব জুতসই বলে মনে হলো। তা ছাড়া এতদিনে সময়ও অনেক গড়িয়েছে। যদি এখুনি এমন কিছু না করা যায়, তবে এই সমস্যা কিংবা অস্বস্তি কেবল বয়েই বেড়ানো হবে। কোনো সমাধান হবে না। তারচেয়ে এবার না হয় এর সমাধান হোক।
এছাহাক ভয়ে ভয়ে বলল, কথাখান কি খারাপ বললাম ভূঁইয়া সাব?
‘না, তা বলোনি। কিন্তু একটু ভাবার বিষয় তো আছেই।
‘এইখানে আর ভাবার বিষয় কী?
‘ভাবার কী আর কোনো শেষ আছে এছাহাক? ভাবার কোনো শেষ নেই। যত ভাববে তত বুদ্ধি খেলবে মাথায়।
বলতে বলতেই এছাহকের কাছ থেকে বেশ খানিকটা সামনে এগিয়ে গেলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তারপর একখানা শুকনো নিচু গাছের ডাল ভেঙে নিতে নিতে বললেন, ‘আমার মাথায় একখান বুদ্ধি আসছে এছাহাক।’
কী বুদ্ধি?
‘আমরা একটা কাজ করব। ঘর করার আগে একটা ঘর ভাঙব।
তাতো ভাঙতেই হবে। মহিতোষ মাস্টারের পুরনো ঘরখানা ভাঙতে হবে না?
না, ওইখানা না।’
‘তাহলে? এই বাড়িতে কি আর কোনো ঘর আছে না কি?
আছে।
কই?
জাহাঙ্গীর ভূইয়া ততক্ষণে আরো সামনে চলে গেছেন। সেখানে এখনো ঘন জঙ্গল। লতাপাতা আর গাছপালায় ঢাকা জায়গাটা অন্ধকার হয়ে আছে। সেই অন্ধকারের ভেতর যেন সেধিয়ে গেলেন তিনি। তারপর হাতের লাঠিখানা দিয়ে সামনের ঘন ঝোঁপটা সরাতে সরাতে বললেন, এইখানে যে এই ঘরখানা আছে, তাতো আগে দেখিনি।
এছাহাক কৌতূহল নিয়ে এগিয়ে গেল। তারপর কিছুটা থমকে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল, কী ঘর?’
‘এই যে দেখো। এত বহুবছর আগের।
এছাহাক এবার কাঠামোটা দেখতে পেল। কত বছর আগের কে জানে, একখানা অতি পুরনো মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ। দীর্ঘদিন থেকে এদিকটায় কেউ আসে
বলেই জায়গাটা যেমন অগম্য হয়েছিল, তেমনি দৃষ্টির আড়াল হয়েছিল এই প্রাচীন মন্দিরের ধ্বংসস্তূপও। সে এবার সতর্ক পায়ে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াকে অতিক্রম করে গিয়ে ধ্বংসস্তূপটার একদম গা ঘেঁষে দাঁড়াল। তারপর হাত দিয়েই লতাপাতাগুলো সরাতে লাগল। ধীরে মাটি থেকে হাত দুয়েক ওপরে মন্দিরটার একটা ভগ্ন কাঠামো স্পষ্ট হয়ে উঠল। কত বছর আগের এই মন্দির কে জানে! তবে বছরের পর বছর সেটি মাটির তলায় প্রায় চাপা পড়ে গেছে। তার কিছু ভাঙা অংশ এখনো বেরিয়ে আছে বাইরে। সেটুকু দেখেই বোঝা যাচ্ছে, এ বহু প্রাচীন আমলের স্থাপনা। এছাহাক বলল, “এইখানে ঘর করবেন? রাস্তার ধারের ওইরকম সোনার জায়গা ছাইড়া এই জঙ্গলের ভেতরে?
হুম। তবে তার আগে লোকজনরে একটা জানান দিতে হইব।’
‘লোকজনরে?’ ভারি অবাক হলো এছাহাক।
হুম।
কী জানান দিতে হইব?
‘এই যে এইখানে তো এখন আর মহিতোষ মাস্টাররা থাকে না। তাইলে আর এত পুরনো মন্দির রাইখা কী লাভ? যেই মন্দিরে একসময় মূর্তিপূজা হইত! আমি তাই এইটা এইখান থেকে উঠাই ফেলতে চাই।’
তাইলে লাভ?
মুসল্লিরা সবাই আমার ওপর একটু খুশি হইল আর কী! শোনো এছাহাক, জনমত খুব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। জনমত যদি তোমার পক্ষে থাকে, তাইলে তুমি অনেক বড় বড় অন্যায় করেও পার পেয়ে যাবা। তাই জনমত নিজের পক্ষে আনার সুযোগ কখনো ছাড়তে নাই। এইটা একটা সুযোগ আমার জন্য বুঝলা?’
এছাহাক মাথা নাড়ল। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া কথাটা মন্দ বলেননি। সে আরো খানিক উদ্যম নিয়েই জায়গাটা পরিষ্কার করতে লাগল। খালি পায়ে নেমে গেল পেছনের ঢালু জায়গাটাতে। আর ঠিক সেই মুহূর্তে সে শব্দটা শুনতে পেল। ফোঁসফোঁস শব্দে কিছু একটা অস্বস্তি তৈরি করছে তার শরীরে। তার কেন যেন মনে হচ্ছে, পেছনে তাকালেই একটা ভয়াবহ দৃশ্য দেখতে পাবে সে। ওই দৃশ্যটা দেখার সঙ্গে সঙ্গেই সে আতঙ্কে জ্ঞান হারাবে। এ কারণে সে কিছুতেই পেছন ফিরে তাকাতে চাইছে না। নড়তেও চাইছে না জায়গা ছেড়ে। তার ধারণা সে সামান্য নড়লেই তার পেছনে থাকা এক ফণা তোলা গোখরা সাপ তাকে বিদ্যুৎ বেগে ছোবল মারবে। অসহনীয় যন্ত্রণায় ছটফট করতে করতে বিষে নীল হয়ে মৃত্যু ঘটবে তার। কিন্তু এতকিছু ভেবেও নিজেকে সংবরণ করতে পারল না সে। তীব্র আতঙ্ক নিয়েই ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল সে। আর সঙ্গে সঙ্গেই তার বুকের ভেতর থেকে যেন ছিটকে বেরিয়ে এলো তার হৃৎপিণ্ড। একটি নয়, দুটি নয়, চার চারটি গোখরা পরস্পরের সঙ্গে জড়াজাড়ি করে ফণা তুলে তাকিয়ে আছে তার দিকে। আর মাত্র মুহূর্তের অপেক্ষা। তারপরই অবিশ্বাস্য তীব্র গতিতে ওই গোখরা সাপের ফণাগুলো একে একে ছুটে আসতে থাকবে তার দিকে। তারপর মুহূর্মুহূ ছোবল বসাতে থাকবে তার শরীরে। এছাহাকের হঠাৎ মনে হলো, সে ওই সাপের ছোবলের আগেই মারা যাবে। তার মৃত্যু ঘটবে ভয়াবহ আতঙ্কে।
৭
এ বাড়ির গৃহকর্তার নাম কাশেম। সে প্রায় দুই মাস ধরে পলাতক। তার স্ত্রী রাজিয়াও স্বামীর খবর কিছু জানে না। তবে মাঝেমধ্যে গভীর রাতে সে জানালার ধারে ঠকঠক শব্দ করে। রাজিয়া কেরোসিনের কুপি জ্বালানোর আগে বিছানার তলা থেকে রামদা বের করে। তারপর দাখানা হাতের মুঠোয় শক্ত করে ধরে ফাঁসফেঁসে গলায় বলে, কে ওইখানে? কে ওইখানে? কোন হারামজাদা?
জানালার ওপাশে আবারও শব্দ হয়। কেউ একজন গলা নামিয়ে ফিসফিস করে কিছু বলে। রাজিয়া তা শুনতে পায় না। সে এবার গলায় চড়ায়, কোন গোলামের পুত গোলামে ওইখানে? ওই কথা কস না কেন? মুখে কী ঠুলি পড়ছস? এই দা দেখছস? রামদা? এক কোপে কল্লা দুই ভাগ কইরা ফেলব। তখন আর কথা বলার ঝামেলা থাকব না।’
‘আমি কাশেম। কাশেম মিয়া। জানলাটা খোলো।’
রাজিয়া জানে বেড়ার ওপাশে তার স্বামী কাশেম। তারপরও সে ইচ্ছে করেই এমন করে। ওই কথাগুলো বলে। মানুষটার প্রতি তার বেশুমার রাগ। কিন্তু সেই রাগ সে সামনাসামনি ঝাড়তে পারে না। কোনো এক অদ্ভুত কারণে লোকটার সামনে গেলেই তার সবকিছু গোলমাল হয়ে যায়। তখন চেষ্টা করেও খারাপ কথা বলতে পারে না সে। বড়জোর মুখ ঝামটা মারতে পারে। কাটাকাটা কিছু উত্তর দিতে পারে। কিন্তু এখন যেসব অশ্রাব্য ভাষায় গালাগাল করছে, তা পারে না। ফলে এই অন্ধকারে, যখন সে নিজের মুখখানাই দেখতে পারছে না, তখন বেড়ার ওপারে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার ওপর তার জমানো রাগ ও বিষের থলিটা সে উগড়ে দিতে থাকে।
কাশেম ফিসফিস করে বলে, কই? জানলাটা খোলো?
আমি জানলা খুলব কেন? ওই মাগির কাছে যান। যেই মাগি কাপুড় খুইলা পেট বাজাইছে, তার কাছে যান।
‘আস্তাগফিরুল্লাহ। তওবা, তওবা।’ কাশেম অন্ধকারেই বেড়ার ওপাশ থেকে জিভ কাটে। তারপর বলে, তুমি এইগুলান কী বলতেছো রাজিয়া? ওই মাইয়ারে আমি ভূঁইয়াও দেখি নাই।
‘হ, এমনে এমনেই তার পেট বাজছে! আপনে ফুঁ দিলেই আইজকাল মাইয়া মাইনষের পেট বাজে। আর আমারেই কিছু করতে পারলেন না। আমার মতো কপালপোড়া আর কে আছে!’ ঝামটা দিয়ে কথাটা বললেও পরক্ষণেই যেন খানিক নিষ্প্রভ হয়ে যায় রাজিয়া। আপনের আর দোষ কী! আপনে ঠিকই করছেন। আমারে এতবছর ধইরা বিয়া করছেন, একটা পোলা-মাইয়ার মুখ দেখাইতে পারলাম না। বাজা মাইয়া মানুষরে যে এতদিন ঘর করতে দিছেন, এইটাই অনেক। দোষ আমার পোড়া কপালের। এই কপাল নিয়া কেন জন্মাইছিলাম কে জানে? ও আল্লাহ, আল্লাহ গো!
.
রাজিয়া কাঁদতে থাকে। রাতের অন্ধকার চিরে টিনের বেড়ার ওপারে দাঁড়ানো কাশেমের বুকের ভেতর গিয়ে সেই কান্না বেঁধে। কিন্তু সে কী করবে? সে তো কম চেষ্টা করেনি রাজিয়াকে একটা সন্তান দিতে। গত সাত-আট বছরে সে যত পয়সা হরোজগার করেছে, তার প্রায় সবই খরচ করেছে রাজিয়ার পেছনে। কিন্তু লাভ হয়নি। রাজিয়া মা হতে পারেনি। কাশেম অবশ্য তাতে হাল ছাড়েনি। এখনো সে চেষ্টার ওপরই আছে। এমনকি রাজিয়ার মানসিক শান্তির জন্য একটি মেয়েও দত্তক এনেছে সে। মেয়ের নাম রাহিমা। বয়স ছয়। তবে সেই মেয়েকে রাজিয়া হঠাৎ যদি ভালোবাসে, তো পরক্ষণেই গালমন্দ করে। মাঝেমধ্যে রাগ উঠে গেলে মারধরও করে। রাজিয়ার মাথা গরম, মেজাজ উগ্র। আচার-আচরণ খারাপ। দেখে মনে হয় না, তার মধ্যে মানুষের জন্য মায়া-মমতা কিছু আছে। কথায় কথায় মুখ খারাপ করে সে। বেশ খানিকটা ঈর্ষাপরায়ণও। একথা গায়ের সবাই জানে। তা বাজা মেয়ে-ছেলেদের এমন হয়েই থাকে। অন্যের কোলজুড়ে যখন চাঁদের মতো শিশুর হাসি বাঁধ ভাঙে, তখন তাদের কোলজুড়ে সীমাহীন শূন্যতা। অমাবস্যার ঘোর অন্ধকার। তো তারা তো ঈর্ষাকাতর হবেই। রাজিয়াও হয়। তবে কাশেম তাতে কিছু মনে করে না।
সে বরং স্ত্রীর ডাক্তার-কবিরাজের পেছনে গুচ্ছের পয়সা খরচ করে বেড়ায়। এতদিনে তার সঙ্গের সবাই পয়সা জমিয়ে নিজেরা ট্রলার-ভ্যান কিনেছে। লোক রেখেছে। অথচ সে কিছুই করতে পারেনি। একখানা ভালো ঘরও না। এখনো বাপের রেখে যাওয়া পুরনো টিনের ঘরখানাই তার সম্বল। সঙ্গে হাড় জিড়জিড়ে একখানা নাও। মাঝেমধ্যে অন্যের ট্রলারের ভাড়ায় চালক হিসেবে সে যায়। এতে বাড়তি কটা পয়সা রোজগার হয়।
তুমি কান্দন থামাও। তোমারে আল্লাহর দোহাই লাগে। কাশেম মরিয়া হয়ে বলে। ওই মাইয়ার লগে আমার কিছু হয় নাই। তারে আমি বিয়াও করি নাই।’
রাজিয়া ফোড়ন কাটে, তাইলে কী করছেন? আসমান থেইকা টুপ কইরা আইসা আপনের কোলে পড়ছে?
‘এই কথা তোমারে আমি এক শ বার বলছি রাজিয়া। কিন্তু তুমি তো আমার কথা বিশ্বাস করবা না। বালুর মাঠের মেলায় লাগছে আগুন। মানুষ পিঁপড়ার মতো আগুনে পুইড়া মরতেছে। কঁপাই পড়তেছে নদীতে। সেও ঝাঁপ দিছিল। পড়ছে আমার ট্রলারের ছাদে। আমি তো আর দেখি নাই। অর্ধেক পথ আসনের পর দেখি এই ঘটনা। ছাদে অজ্ঞান পইড়া আছে।’
‘সে পরনের শাড়ি-কাপুড় ছাড়াই মেলায় আইছিল? খালি লাল ব্লাউজ আর ছায়া ফিন্দা?’ বলে হা হা করে হাসে রাজিয়া। আমার পোলা-মাইয়া হয় না বইলা দুনিয়ার ভাব-চক্করও কিছুই বুঝি না আমি ভাবছেন? আসমানে চান আছিল, গাঙ্গে জোয়ার, ফুরফুইরা বাতাসে ট্রলারের ছাদে, আহারে, রসের লীলা খেলার জন্য আর কী লাগে? কিন্তু এইজন্য শাড়ি খুইলা গাঙ্গে ফালাই দেবেন? এইটা কোনো কথা?
রাগে কাশেমের শরীর জ্বলে যাচ্ছে। কিন্তু সে কিছু বলতে পারছে না। পাশের ঘরেই মেয়েটা ঘুমাচ্ছে। সে অসুস্থ। কে জানে, হয়তো জেগেই আছে এখনো। জেগে জেগে তাদের সব কথাই শুনছে। ভাবতেই লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে যায় কাশেম। রাজিয়া বলে, ‘বিয়া করলে করছেন। সত্য কথা কন। ব্যাটা-মাইনসের মতো সত্য কথা কন। মিছা কথা কন কেন?
কাশেম এবার শেষ চেষ্টাটা করল। বলল, তুমি সেইদিন তার কপালে সিঁন্দুর দেখো নাই? সে হইলো হিন্দু, আর আমি হইলাম মুসলমান। আমি তারে বিয়া করব কেমনে?
রাজিয়া দমল না। সে শ্লেষাত্মক কণ্ঠে বলল, ‘পোলা মাইনসের না হয় লুঙ্গি খুইলা মোসলমানি দেইখা হিন্দু-মুসলমান বোঝা যায়। মাইয়া মানুষের তো আর সেইরকম কিছু নাই যে কাপুড় খুইলা দেখব। খালি কপালে সিন্দুর থাকলেই হইব? কপালে সিঁন্দুর মাখলেই কি আমি হিন্দু হইয়া যাব?
‘তোমার লগে এত যুক্তি-তর্ক দেওনের সময় আমার নাই রাজিয়া। তুমি জানলা খোলো। আমি কিছু টোটকা আনছি ফতেহপুরের মাজারের খাদেম নুর ফতেহ আলীর কাছ থেইকা। তুমি প্রত্যেকদিন ঘুম থেইকা উইঠা আর ঘুমাইতে যাওনের আগে, খালি পেটে এই জিনিস খাইবা। তোমার মাসিকের পর পর তিনদিন। বুঝলা? আল্লাহ চাইলে এইবার আমাগো একটা না একটা কিছু হইবোই।’
রাজিয়া এবার আর কথা বলল না। সে জানলা খুলে কাশেমের হাত থেকে কাপড়ের পোঁটলাটা নিল। তারপর যত্ন করে রেখে দিল জানলার ওপরের তাকে। অন্ধকারে তার কম্পিত হাত দেখা গেল না। কাশেম বলল, “শোনো, তুমি এত চিন্তা কইর না। দেইখো, সব ঠিক হইয়া যাইব। আল্লাহয় আমাগো পরীক্ষা করতেছে, বুঝলা?’
‘আমি এত কিছু বুঝি না। আপনে তারে বাড়ি থেকে বাইর করেন। আমি সতিন লইয়া ঘর করব না। কোন দিন আইসা দেখবেন তারে আমি খুন কইরা ফেলছি। আমি কিন্তু মাইয়া ভালো না।’
‘চুপ। একদম চুপ। এবার খানিক ধমকে ওঠে কাশেম। তারপর সঙ্গে সঙ্গেই আবার গলা নামিয়ে বলে, এইটা কী ধরনের কথা? তুমি মাথা ঠাণ্ডা করো রাজিয়া। তোমার এই গরম মাথাই একদিন তোমারে ডুবাইব।’
আর কী ডুবাইব? ডুবানোর বাকি আছে কী? সন্তানাদি হয় না। জামাই এইজন্য আরেক বেটিরে বিয়া কইরা পেট বাজাইয়া বাড়ি নিয়াসছে। আমার আর ডোবার কী বাকি আছে?”
রাজিয়া! এবার উচ্চ স্বরেই ধমকায় কাশেম। তুমি কি পাগল হইয়া গেছো? তুমি জানো না, আমি কী বিপদের মধ্যে আছি? জানো না তুমি? এখন কি তোমার মাথা গরমের সময়?
‘কী বিপদে আছেন আপনে? আপনের এইগুলা সব ঢং। আপনে ভং ধরছেন। আপনের কী ধারণা আপনের এই সব রংঢং আমি বুঝি না?
কী বোঝো তুমি?
‘আপনে ওই মাইয়ারে হয় বিয়া করছেন, না হইলে বিয়ার আগেই পেট বাঁধাইছেন। এখন লোক-লজ্জার ভয়ে তারে নিয়াসছেন বাড়ি। কিন্তু আমার ডরে বাড়ির বাইরে বাইরে ঘুরতেছেন। কিন্তু আপনেরে একখান কথা কই, ওই মাইয়ার পোলাপান এই ঘরে হইতে পারব না। আমারে আপনে চেনেন। আমি কোপ দিয়া কল্লা ফালাই দেওয়া মাইয়া।
কাশেম হতাশ ভঙ্গিতে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। তারপর বলে, আমি বিরাট বিপদে পড়ছি বউ। তুমি একটু মাথা ঠাণ্ডা করো। এই বিপদ থেকে রক্ষা পাইলেই দেখবা সব ঠিক হইয়া যাইব। তুমি মাথা গরম কইরো না। মাথা গরম কইরা উল্টাপাল্টা কিছু কইরো না।
কী বিপদ আপনের? বিপদ হইলে আপনে আমার কাছে কন না কেন?
এই প্রশ্নের জবাবে চট করে কিছু বলে না কাশেম। চুপ করে থাকে। আজ দু মাসেরও বেশি বাড়ির বাইরে বাইরে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে তাকে। রাজিয়াকে তার ইচ্ছের বাইরে কিছু বিশ্বাস করানো কঠিন। তারপরও কী ভেবে সে হঠাৎ বলে, বালুর মাঠের জমিদার মনোহর রঞ্জন রায়ের নাতি বিভুরঞ্জন রায় খুন হইছে। যারা তারে খুন করছে, তারা আমারে সঙ্গে কইরা নিয়া গেছিল। আমি ছিলাম তাদের ট্রলার ড্রাইভার। আমি তো আর জানতাম না যে তারা এই কাজ করবে। পুলিশ এখন তাদের সঙ্গে আমারেও খুঁজতেছে। এইজন্য আমি বাইরে বাইরে থাকি।
কাশেমের কথা রাজিয়া বিশ্বাস করল কি না বোঝা গেল না। তবে সে সশব্দে জানালা বন্ধ করে দিল। কাশেম ফিসফিস করে দীর্ঘ সময় তাকে ডাকল। কিন্তু সে আর সাড়া দিল না। গাঢ় অন্ধকারের বুকের ভেতর মুখ লুকিয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে লাগল। তার এই কান্না দৃশ্যমান নারী ও অদৃশ্য মায়ের।
.
পারু বসে আছে একটা বাঁশের মাচায়। তার সামনে দিগন্ত বিস্তৃত মাঠ। মাঠের পাশে নদী। এই নদীতে কাশেমের ট্রলারে ভেসেই সে মাস দুয়েক আগে এক ভোররাতে এখানে এসেছে। তার পেছনে ছোট্ট একখানা টিনের ঘর। ঘরের পরে উঠান। উঠানের একদিকে আদিগন্ত ফসলের মাঠ। অন্যদিকে নদী। বাড়িটা ছবির মতো সুন্দর। এমন সুন্দর বাড়ি ক্যালেন্ডারে বা বইয়ের পাতায় দেখা যায়। শিল্পীরা ছবিতে আঁকেন। কিন্তু বাস্তবেই যে এমন বাড়ি আছে, তা পারু নিজ চোখে না। দেখলে বিশ্বাস করত না। সমস্যা হচ্ছে, এই সুন্দর বাড়িও তাকে এক মুহূর্তের জন্য স্বস্তি দিতে পারছে না। সে সারাক্ষণ এই নদীর ধারের বাঁশের মাচার ওপর বসে। থাকে। তার চুল আলুথালু। পরনের কাপড় মলিন। কণ্ঠার হাড় উঁচু হয়ে আছে। চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে দীর্ঘদিনের অনাহারে অর্ধাহারে ক্লিষ্ট এক নারী। যে পুষ্টিহীনতায় ভুগছে। সম্ভবত এ কারণেই এই জীর্ণ রোগা শরীরেও তার ঈষৎ স্ফীত উদর আলাদা করে দৃশ্যমান হয়ে উঠছে। গত দু মাসেরও বেশি সময় ধরে সে যেন এক ঘোরের মধ্যে আছে। এই ঘোরগ্রস্ততার পুরোটা সময় জুড়েই কেবল কান্না। পারুর ধারণা, একজীবনে একজন মানুষের যদি কান্নার কোনো নির্দিষ্ট কোটা থাকে, তবে তা সে এরই মধ্যে পূরণ করে ফেলেছে। ফলে এখন আর তার চোখে জল নেই। সম্ভবত এই কারণেই আজকাল কাঁদতে গেলে প্রায়ই তার চোখ জোড়া রক্তজবার মতো টকটকে লাল হয়ে যায়। সেই চোখে আর জল ঝরে না।
আজকাল কথা বলতেও ভালো লাগে না পারুর। বিশেষ করে রাজিয়ার সঙ্গে তো নয়ই। সে তার জীবনে এমন মুখরা মেয়ে মানুষ আর দেখেনি। দিনমান রাজিয়ার মুখ চলতেই থাকে। সেই মুখে যে অশ্রাব্য ভাষা, তা এই জনমে আর কখনো শোনেনি পারু। তার মাঝেমধ্যে মনে হয়, সামনের এই নদীর জলে ডুবে মরে যেতে। এই ভয়ংকর অভিশপ্ত জীবন বয়ে বেড়ানোর কোনো মানে হয় না। এখানে কেবল যন্ত্রণা আর যন্ত্রণা। তীব্র আতঙ্কের দুঃস্বপ্নের মতো জীবন। এই জীবনের চেয়ে মৃত্যু ঢের বেশি আরাধ্য। কিন্তু রাত হলেই সে আর মৃত্যুর কথা ভাবতে পারে না। বরং তার ঈষৎ স্ফীত উদরের ভেতরে বেড়ে ওঠা অস্তিত্বটাকে যেন সে অনুভব করতে পারে। হাত দিয়ে স্পর্শও করতে পারে। তার সঙ্গে কথা বলতে পারে। এই কথা বলতে বলতেই পারুর মনে হয়, ভগবান কি আসলেই এতটা নির্দয়? যতটা নির্দয় তার প্রতি? না হলে বারবার কেন এমন হবে তার সঙ্গে? মানুষ যত অন্যায়ই করুক না কেন, স্রষ্টা নিশ্চয়ই তার সৃষ্টির প্রতি এতটা রুষ্ট হতে পারেন না। তবে তার প্রতি কেন এমন? এমন নিদারুণ যন্ত্রণার জীবন কেন তার?
এই প্রশ্নের উত্তরও মাঝেমধ্যে নিজেকেই নিজে দেয় সে। এই যে তার পেটের ভেতর বেড়ে উঠছে একটি শিশু, তার শরীর ও মনের অবিচ্ছেদ্য অংশ, তাকে তো কখনো দেখেনি সে। সে কখনো তাকে মা বলে ডাকেওনি। তার হাসিমাখা মুখ, কান্না ক্লান্ত চোখ কিংবা আধো আধো বোলের মায়া মাখা কথাও কখনো শোনেনি। তাহলে সারাক্ষণ কেন তার জন্য মন কেমন করে, ছটফট করে বুকের ভেতর? কেমন একটা আলতো নরম আলোর মতো অনুভব ছড়িয়ে থাকে শরীরজুড়ে। মুহূর্তের জন্য তার অনুপস্থিতির কথা ভাবলেই কেন দমবন্ধ হয়ে আসে? কলিজা ভেঁড়ার যন্ত্রণা হয়? আচ্ছা, এই সন্তান যদি কখনো তাকে ছেড়ে দূরে চলে যায়? যদি অন্য কারো জন্য চিরদিনের তরে হারিয়ে যায় অজানা কোথাও? তখন কী করবে সে? কেমন লাগবে তার?
.
পারু আর ভাবতে পারে না। তার হাঁসফাঁস লাগে। বুক শুকিয়ে আসে। বাবা আর মায়ের কথা মনে হয়। তাদেরও তাহলে তার জন্য এমনই লেগেছিল? যখন সে ওভাবে রাতের অন্ধকারে চলে এসেছিল ফরিদের জন্য? যখন তারা প্রথম জানল যে পারু নেই? সে চলে গেছে অন্য কারো সঙ্গে, অন্য কোথাও? সে আর কখনো তাদের কাছে ফিরে আসবে না। তখন এমন কষ্ট তাদেরও হয়েছিল? কিংবা এরচেয়েও বেশি? পারুর অকস্মাৎ মনে হলো, সে যে পাপ করেছে, তাতে তার সঙ্গে এমনই হওয়া উচিত ছিল। এই-ই হওয়া উচিত ছিল তার প্রায়শ্চিত্য। ভগবান তার সঙ্গে অন্যায় কিছু করেননি। বরং তার যা প্রাপ্য ছিল, ভগবান তা-ই তাকে বুঝিয়ে দিচ্ছেন কড়ায়-গণ্ডায়। কে জানে, বাকিটা জীবনজুড়ে আর কী অপেক্ষা করছে তার জন্য!
.
এ বাড়িতে সে আছে রাজিয়ার চোখের বালি হয়ে। রাজিয়া তাকে দুই চোখে দেখতে পারে না। সারাক্ষণ গালমন্দ করে। খেতে ডাকে না। ভালো-মন্দ জিজ্ঞেস করে না। তোতা পাখির মতো তার ওই এক কথা, পারুর সঙ্গে কাশেমের পরিচয় কী করে? তাদের বিয়ে হলো কীভাবে? পারুর পেটের সন্তান কবে, কীভাবে এলো? বিয়ের আগে না পরে? এরপর শুরু হয় ভয়ানক অশ্লীল সব কথা। অশ্রাব্য গালিগালাজ। পারু সেসব কথা শুনতে পারে না। তার কান ঝা ঝা করে। কান্না পায়। কিন্তু উপায় নেই। এসব তাকে শুনতেই হবে। এই তার ভাগ্য। রাজিয়াকে প্রথম প্রথম বোঝানোর চেষ্টা করেছে সে। ঘটনা খুলে বলতে চেয়েছে। কিন্তু তার কিছুই রাজিয়া বিশ্বাস করে না। শুনতে চায় না। সে কেবল তা-ই শুনতে চায়, যা সে বিশ্বাস করে। এই কারণে আজকাল আর কিছু বলে না সে। রাজিয়া যা বলে সব চুপচাপ শোনে। কিংবা শোনে না। ডুবে থাকে অদ্ভুত এক ঘোরের জগতে। সেই জগতে কেবল ফিনফিনে কাফনের কাপড়ের মতো সাদা কুয়াশা। ওই কুয়াশা সে। সরাতে পারে না। যতই সরাতে চায়, ততই ডুবে যায় আরো।
.
তবে কাশেম লোকটা ভালো। পারু যতটুকু দেখার সুযোগ পেয়েছে, তাতে তাকে মন্দ লোক বলে মনে হয়নি। সেই রাতে কী হয়েছিল, কীভাবে পারু ছিটকে পড়েছিল ওই ট্রলারের ছাদে, তার কিছুই আর স্পষ্ট মনে করতে পারেনি সে। একটা ভাসা ভাসা অস্পষ্ট ছবি কেবল মনে গেঁথে ছিল। সেই ছবি থেকেই সে বুঝতে পেরেছে, ফরিদ তাকে কাঁধে করে নদীতে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। কিন্তু পারু কোনো জলের স্পর্শ পায়নি। সে শক্ত কিছুর ওপর আছড়ে পড়ে জ্ঞান হারিয়েছিল। তারপর যখন তার জ্ঞান ফিরল, তখন হুহু করে শীতল হাওয়া বইছে। মাথার ওপর ঝকঝকে আকাশ। আকাশে মস্ত চাঁদ। সেই চাঁদের চারধারে শ্বেত ভলুকের মতো মেঘ। মেঘগুলো ধীরে ধীরে চাঁদটাকে ফেলে রেখে এগিয়ে যাচ্ছে সামনে কোথাও। সে সেই চাঁদের দিকে তাকিয়ে প্রথমে কিছুই বুঝতে পারল না। সে কি স্বপ্ন দেখছে? নাকি অন্যকিছু? নাকি এসবই বিভ্রম?
কিন্তু এই বিভ্রম সে কাটাবে কী করে? পারু উঠে বসার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। তার মাথা, কোমরে তীব্র ব্যথা। বুকের কাছটা ভারী হয়ে আছে। হাতের তালু, কনুই ছিলে রক্ত ঝরছে। সে বাঁ দিকে তাকাতেই যেন জলের ঝাঁপটার শব্দটা শুনতে পেল। তারপর নিজেকে আবিষ্কার করল একটা বড় নৌকার ছাদে। কিন্তু নৌকাটায় ইঞ্জিন লাগানো। ইঞ্জিনের শব্দে কানে তালা লাগার দশা। সম্ভবত এ কারণেই প্রথমে জলের শব্দ টের পায়নি। কিন্তু এখানে কেন সে? ফরিদ কোথায়? ফরিদ?
.
পারু ঝট করে উঠে বসল। এদিক-সেদিক তাকাল। ফরিদ কোথাও নেই। সে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করল। একটা লোকের ছায়ামূর্তি দেখা যাচ্ছে ট্রলারের গলুইয়ে। লোকটা কি ফরিদ? পারু টলতে টলতে কয়েক কদম সামনে এগিয়ে গেল। এখন হাওয়ার দমক আরো বেড়েছে। তীব্র শীতে থরথর করে কাঁপছে শরীর। সে দু হাত বুকের কাছে ভাঁজ করে নিজের বক্ষযুগলকে আড়াল করার চেষ্টা করল। সঙ্গে যেন শীত থেকেও বাঁচতে চাইল খানিক। কিন্তু ওখানে ওই লোকটা কে? তাকে দেখে তো ফরিদের মতো মনে হচ্ছে না। পারু চিৎকার করে লোকটাকে ডাকল। কিন্তু লোকটা শুনল কি না বোঝা গেল না। কিংবা পারুর মুখ থেকে স্পষ্ট কোনো শব্দই বের হলো না। বের হলো অদ্ভুত জান্তব এক চিৎকার। কিন্তু লোকটা ফিরে তাকাল। ভয়ংকর ব্যাপার হচ্ছে, সে পারুকে দেখে আচমকা ভয় পেয়ে গেল। উদ্ভট স্বরে চেঁচাতে লাগল। তারপর অকস্মাৎ কিছু একটা ছুঁড়ে মারতে চাইল তার দিকে। কিন্তু সেই সুযোগ আর হলো না। তার আগেই আবারও মেঝেতে লুটিয়ে পড়ল পারু।
পারুর ঘুম ভাঙল পরদিন ভোরে। ততক্ষণে সূর্য উঠে গেছে অনেকটা দূর। চারধারে আলো ফুটে গেছে। একটা শক্ত বিছানায় শুয়ে আছে সে। তার গায়ে একটা মোটা কাঁথা। তীব্র যন্ত্রণা শরীরে। মাথার ওপর পুরনো টিনের চাল। চট করে ভুবনডাঙার নিজেদের বাড়ির কথা মনে হলো তার। সে কি তবে অলৌকিক কোনো উপায়ে বাড়ি ফিরে এসেছে?
.
পারু দু হাতে চোখ রগড়ে তাকাল। তারপর ঘাড় ঘুরিয়ে আশপাশটা দেখার চেষ্টা করল। জানালার বাইরে একখানা উঠান। উঠানে কতগুলো হাঁস। দুটো মুরগিও। তারা কিছু একটা খুঁটে খুঁটে খাচ্ছে মাটি থেকে। মুরগির বাচ্চাগুলো মায়ের পিছু পিছু ছুটছে। উঠানের দু প্রান্তে পুঁতে রাখা বাঁশের সঙ্গে আড়াআড়ি দড়ি টানানো। সেই দড়িতে শুকাতে দেয়া কাপড় ঝুলছে। পাশেই রান্নাঘর। রান্নাঘরে মাটির চুলায় কিছু রান্না হচ্ছে। তবে সেই রান্না ঠিকঠাক হচ্ছে না। সম্ভবত আগুন ধরাতে খানিক সমস্যা হচ্ছে। এ কারণে ধোয়ার কুণ্ডলী ছুটে আসছে সেখান থেকে। সেই ধোয়ায় পারুর চোখ জ্বালা করে উঠল। সে অনেক কষ্টে দেয়ালে ভর দিয়ে উঠল। তারপর বসল হেলান দিয়ে। এ কোথায় সে? ফরিদ কোথায়?
.
তার প্রশ্নের উত্তর মিলল কাশেম আসার পরে। কিন্তু জগতের সকল প্রশ্নের উত্তর মিলে যেতে নেই। তাতে বরং দ্বিধার চেয়ে দুঃখ বেশি। অনিশ্চয়তার চেয়ে আর্তনাদ বেশি। পারুরও তা-ই হলো। তার চোখের সামনের দৃশ্যমান জগৎটা নিমেষেই যেন অদৃশ্য হয়ে গেল। প্রগাঢ় অন্ধকারে ঢেকে গেল দিনের আলো। ঝলমলে সূর্য।
কাশেমের সঙ্গে সে খুব একটা কথা বলার সুযোগ পায়নি। কোনো এক অজানা আশঙ্কায় ভীত-সন্ত্রস্ত কাশেম ছোটাছুটি করছিল এখানে-সেখানে। তাকে বাড়িতে পাওয়াই যাচ্ছিল না। তবে যতটুকু সময় সে বাড়িতে থাকত, পারুর খোঁজখবর নিত। ওই সময়েই কাশেমকে যতটা সম্ভব ঘটনা খুলে বলেছিল পারু। কাশেম। তাকে কথাও দিয়েছিল ফরিদকে খুঁজে বের করার। কিন্তু ফরিদকে কোথায় পাবে সে? পারুর কাছে তো তার কোনো ঠিকানা নেই। কিছু চেনেও না সে। শেষ অবধি কথা হলো, পারুকে আবার বালুর মাঠের কাছে নিয়ে যাবে কাশেম। হয়তো ফরিদ সেখানে অপেক্ষা করছে তার জন্য। খুঁজছে তাকে। কিন্তু সেই সুযোগ আর হলো না।
.
কাশেমের অজানা আতঙ্ক দিন কয়েকের মধ্যেই প্রকাশ্য হলো। মেলার আগুন ও বিভুরঞ্জনের মৃত্যুর ঘটনা গড়াল বহুদূর। পুলিশ ততদিনে আবিষ্কার করে ফেলেছে ওই ঘটনার কারণ। ফলে তারা হন্যে হয়ে উঠল অপরাধীদের খুঁজতে। চট করে গা-ঢাকা দিতে হলো কাশেমকেও। কিন্তু পারুর জীবন হয়ে উঠল নরক যন্ত্রণারও অধিক। এই জীবনে তার বেঁচে থাকবার একমাত্র অবলম্বন হয়ে উঠল তার পেটের ভেতর ক্রমশই বেড়ে উঠতে থাকা এক মানবশিশুর জ্বণ। যেই জ্বণ এক আশ্চর্য মায়াময় সম্মোহনে পারুকে বাঁচিয়ে রাখতে লাগল মৃত্যুর সম্মোহন থেকে।
.
পারু কতক্ষণ বসে আছে জানে না। তার খিদে পেয়েছে। কিন্তু রাজিয়ার রান্না এখনো শেষ হয়নি। গত দুদিন হয় তার মা এসেছে। সারাক্ষণ মায়ের সঙ্গে গুটুর গুটুর করে রাজিয়া। পারুকে দেখলেই থমকে যায়। পারুর অবশ্য এসব নিয়ে আগ্রহ নেই। সে তার মায়ের সঙ্গে যা ইচ্ছে বলুক, তাতে তার কী! সে একটু শান্তিতে থাকলেই বাঁচে। তা এ দুদিন যেন একটু শান্তি মিলছেও। কারণে-অকারণে আর সারাক্ষণ তাকে গালমন্দ করছে না রাজিয়া। খানিক যেন চুপচাপই হয়ে গেছে। সে। কে জানে, হয়তো তার মা তাকে কিছু বুঝিয়েছে। পারু অবশ্য এসব নিয়ে ভাবে না। তার ভাবনাজুড়ে ফরিদ। তার ভাবনাজুড়ে তার জীবন। এই জীবন থেকে তার মুক্তি মিলবে কবে?
এ বাড়িতে গাছপালা তেমন নেই বলে রোদ বাড়তে থাকলেই চড়চড় করে বাড়তে থাকে গরমও। তবে একটা সুবিধা হলো নদীর হাওয়া। সারাক্ষণ তিরতির করে বয়ে যেতে থাকে। ফলে গরমটা তেমন অনুভূত হয় না। এখান থেকে বালুর মাঠ কত দূর? সে কি একা কোনোভাবে চলে যেতে পারবে? কিন্তু কীভাবে যাবে? তা ছাড়া সেখানে গেলেই যে ফরিদকে পাবে, তার নিশ্চয়তাও তো নেই। তাহলে তখন কী করবে সে? সেই রাতে এখানে আসতে তাদের দীর্ঘ সময় লেগেছিল। প্রায় সারারাত। তাও আবার ইঞ্জিনচালিত নৌকায়। তার মানে দূরত্ব কম নয়। এই দূরত্ব পেরিয়ে সে একা কী করে যাবে? এমন কত কত ভাবনা যে পারুর মাথায় সারাক্ষণ কিলবিল করতে থাকে তার ইয়ত্তা নেই। তবে সেই ভাবনায় ছেদ ঘটাল কেউ। পারু তার গা-ঘেঁষে দাঁড়ানো কারো উপস্থিতি টের পেয়ে ঝট করে মাথা ঘুরিয়ে তাকাল। রাজিয়া দাঁড়িয়ে আছে তার পেছনে। আচম্বিতে ঝটকা মেরে সরে যাওয়ার চেষ্টা করল পারু। মেয়েটাকে যমের মতো ভয় পায় সে। তা ছাড়া, রাজিয়ার তো এভাবে তার গা-ঘেঁষে দাঁড়ানোর কথা নয়। পারু সরে যেতেই রাজিয়া হাসল। তবে তার এই হাসি রোজকার সেই বিভৎস, কুৎসিত শ্লেষপূর্ণ হাসি নয়। এই হাসির কোথায় যেন অন্য এক রাজিয়াকে টের পেল পারু। তবে পুরোপুরি ধরতে পারল না।
রাজিয়া তার পাশে মাচার ওপর বসল। তারপর পারুর হাতখানা তার হাতের মুঠোয় নিতে নিতে বলল, আমার ওপর তোমার অনেক রাগ, না বইন?
পারু জবাব দিল না। রাজিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, রাগ রাইখো না আমার ওপরে। আমি এক কপালপোড়া জনমদুঃখী, বুঝলা বইন। এই জন্মে আমার কোনো শান্তি নাই। এইজন্য মন থাকে অশান্ত। সারাক্ষণ মাথার ভেতরে খারাপ চিন্তা আসে। এমনিতে মানুষ কিন্তু আমি খারাপ না।
পারু তার হাতটা ছাড়িয়ে নেয়ার চেষ্টা করল। কিন্তু পারল না। রাজিয়া শক্ত করে ধরে রেখেছে। সে বলল, মাইয়া মানুষ দুনিয়াতে একটা মাত্র জিনিসের ভাগ কাউরে দিতে চায় না। দুনিয়ার সবচাইতে দামি কিছুর বদলেও না। সেই জিনিসটা কী, তুমি জানো?
পারু কথা না বললেও রাজিয়ার এমন সদ্ভাব, সদয় আচরণে ভারি অবাক হয়েছে। রাজিয়া বলল, “স্বামী। মাইয়া মানুষ তার স্বামীরে কারো লগে ভাগ করতে পারে না। আমিও পারি নাই। এই জন্য মাথা উল্টাপাল্টা হইয়া গেছে। তোমারে আ-কথা, কু-কথা বলছি। কিন্তু অনেক ভাইবা দেখছি, দোষ তো আমারই। আমি যদি মা হইতে পারতাম, তাইলে কি আর সে তোমার কাছে যাই তো? যাই তো না। তারে আমি চিনি। সে লোক ভালো। আমারে ভালোও পায়। কিন্তু একটা সন্তানের আশা তো তারও আছে। আমারও তো এইটা বুঝতে হইব। এখন তোমার পেটে হইলেও সেইটা তো তারই সন্তান। আর তার সন্তান মানে তো আমারও সন্তান। তাই না?
পারু কথা বলল না। এই কথাগুলো সে নিতে পারে না। তার সারা শরীর ঝিমঝিম করতে থাকে। মনে হয় এখুনি নিজেকে নিঃশেষ করে দেয় সে। তবে আজ তেমন কিছু হলো না। বরং ধীরে ধীরে রাজিয়ার উদ্দেশ্য বোঝার জন্য উৎসুক হয়ে উঠল। রাজিয়া বলল, তুমি আমারে মাফ করে দাও বইন। আমি হিংসায় বেপাগল হইয়া গেছিলাম। এই জন্য ওইরকম করছি। কিন্তু আল্লায় আমারে এতদিনে বুঝ দিছে। তোমারে আমি নিজের আপন বইনের মতো দেখভাল করব। এই সময়ে তোমার যত্ন-আত্মির দরকার আছে। তুমি আয়নার সামনে দাঁড়াই দেখছ, তোমার চেহারার অবস্থা? যখন আসছিলা, সোনার পুতলার মতন মুখ আছিল। আর এখন? সেই মুখ হইছে পোড়া মাটির মতন। তুমি আর কিছু নিয়া চিন্তা করবা না বইন। এহন থেকে তোমার, তোমার পেটের সন্তানের সব দায়িত্ব আমার।
পারু এবার মুখ ঘুরিয়ে রাজিয়ার দিকে তাকাল। রাজিয়ার চোখ ছলছল। সে ভেজা গলায় বলল, “আমি কত বড় বোকা চিন্তা করো। অন্যের মাইয়া পালতে আনছি। তারে আদর-যত্ন কইরা নিজের মাইয়ার মতো বড় করতেছি। কিন্তু নিজের স্বামীর সন্তানরে আমি নিজের সন্তান ভাবতে পারি নাই। আমার মতো খারাপ, আমার মতো জঘন্য মানুষ আর দুনিয়াতে আছে?
পারু কথা বলল না। তবে রাজিয়ার ক্রন্দনরত কম্পিত শরীরের স্পন্দন যেন তাকেও স্পর্শ করে গেল। তারও হঠাৎ মনে হলো, এই মেয়েটির যন্ত্রণা তো সেও বুঝতে পারেনি। একজন নারী জীবনভর তার ভেতর সবচেয়ে দৃঢ়ভাবে যা লালন করে, তা হলো তার মাতৃসত্তা। সেই সত্তা বঞ্চিত একটি মেয়ে কী করে তাকে এই পরিস্থিতিতে এত সহজে মেনে নেবে? বিশ্বাস করবে? বরং সে এতদিন যা করেছে, তা-ই তো স্বাভাবিক ছিল। রাজিয়ার জায়গায় যদি সে থাকত, তাহলে সে কী করত?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে রাজিয়ার প্রতি যেন খানিক সহানুভূতিই অনুভব করতে লাগল পারু। মুখে কিছু না বললেও সে তার কষ্টটা স্পর্শ করতে পারল। তার হঠাৎ মনে হতে লাগল, জগতে দুঃখের মতো সার্বজনীন আর কোনো অনুভূতি নেই। দুঃখই মানুষের সবচেয়ে বড় অসুখের নাম। পৃথিবীর এমন কোনো মানুষ নেই যাকে সে স্পর্শ করেনি। অথচ সকলেই ভাবে, কেবল তার দুঃখটাই বড়, তীব্র। তার মতো করে আর কাউকে সে আক্রান্ত করেনি। ফলে জগতের মানুষেরা কেউ কারো দুঃখ স্পর্শ করতে পারে না। তারা সকলেই কেবল পুঁদ হয়ে থাকে নিজেদের দুঃখ ও দহনে।
৮
এছাহাক শেষ মুহূর্তে লাফিয়ে সরে গেল। সে জানে না, কাজটা সে কীভাবে করল। আর ওখানে অমন আজদাহা গোখরা সাপগুলোই বা কী করে এলো। সে শুনেছে, এমন পুরনো, বহু বছরের পরিত্যক্ত ধ্বংসস্তূপই সাপখোপের অভয়াশ্রমে পরিণত হয়। কিন্তু তাই বলে দু জোড়া অমন ভীমদর্শন কালকেউটে এ বাড়ির সীমানার মধ্যে রাজত্ব করে বেড়াচ্ছে! জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া এছাহাকের চিৎকার শুনে এগিয়ে এলেন। তারপর নিচে উঁকি দিয়ে বললেন, কী হয়েছে এছাহাক?
এছাহাক তার দিকে তাকাল না। সে এখনো তাকিয়ে আছে খানিক আগে যে জায়গাটিতে সে দাঁড়িয়েছিল সেখানে। সাপগুলোকে এখান থেকে দেখা যাচ্ছে না। ঝোঁপ আর মাটির ঢিবির আড়াল পড়ে গেছে। তারা কি এখনো ফণা তুলে ফোঁসফাঁস করছে?
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া ঘটনা কিছু একটা আঁচ করতে পেরেছেন। এছাহাকের মুখ পাংশুবর্ণ। তার হাত দুখানা কাঁপছে। চোখে আতঙ্কিত দৃষ্টি। তিনি আবারও ডাকলেন, কী হয়েছে এছাহাক? তুমি এইরকম করতেছ কেন?
এছাহাক এবার চোখ তুলে তাকাল। তারপর কাঁপা গলায় বলল, এই বাড়িতে যম আছে। সাক্ষাৎ যম। মহিতোষ মাস্টার এই বাড়ি এমনে এমনে ছাইড়া যায়। নাই। যমের ডরে ছাড়ছে।
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া এছাহাকের কথা কিছুই বুঝতে পারলেন না। তবে সেদিন বাড়ি ফেরার পর রাতে তিনি এছাহাকের সঙ্গে কথা বললেন। ঘটনা শুনে কপাল কুঞ্চিত হলো জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার। বাস্তু সাপের কথা তিনিও শুনেছেন। তাই বলে। এতগুলো? তাও আবার গোখরা? তাহলে তো এই বাড়িতে আরো এমন সাপ আছে! নাকি ভুল কিছু দেখেছে এছাহাক?
পরদিন জনাদশেক লোক নিয়ে মহিতোষের বাড়ির আনাচে-কানাচে অভিযান চালানো হলো। ভয়ে এছাহাক আর ও-মুখো হলো না। তার পরিবর্তে কাজের লোকদের দেখভালের দায়িত্ব পেল মতি মিয়া। সারাদিন তারা তন্নতন্ন করে সাপ খুঁজে বেড়াল। কিন্তু কোথাও কোনো সাপ দেখা গেল না। শেষে মতি মিয়া বলল, ভূঁইয়া সাব, একখান কাজ করলে কেমন হয়?
কী কাজ?
‘মোহর আলী ওঝারে নিয়াসি?
‘তারে কেন?
‘সে হইল সাপের যম। বাতাসেও সাপের গন্ধ পায়। হাতের চুটকি মাইরা সে সাপ বাইর কইরা নিয়াসবো।’
মোহর আলী ওঝা এলেন দিন দুই বাদে। তিনি বাড়িজুড়ে মন্ত্র পড়া ধূপ ছিটিয়ে দিলেন। নানা কর্মযজ্ঞের আয়োজন করলেন। দিনের শেষ ভাগে পেছনের জঙ্গল থেকে দু খানা সাপও ধরলেন। কিন্তু সেই সাপ দেখে এছাহাকের আতঙ্ক কাটল না। তার কেন যেন মনে হলো এই সাপ মোহর আলী ওঝা সঙ্গে করেই নিয়ে এসেছেন। তার সাগরেদরা সুযোগ বুঝে তাদের জঙ্গলে ছেড়ে দিয়েছিল। এটা তার। কৌশল। না খাইয়ে তারা সাপগুলোকে দুর্বল করে তোলে। তারপর বাড়ির আশপাশে ছেড়ে দেয়। অতি দুর্বলতায় তারা পড়ে থাকে সেখানেই। তারপর সুযোগ বুঝে সেখান থেকে তুলে এনে লোকজনকে দেখানো হয় সাপ ধরা হয়েছে! এগুলোও তেমন। ম্যাড়মেড়ে, নির্জীব। তাদের চলার শক্তি নেই, ফণা তোলার তেজ নেই। ভেজা দড়ির মতো নেতিয়ে আছে। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া অবশ্য অতকিছু ভাবলেন না। তিনি সাড়ম্বরে মন্দিরের ধ্বংসস্তূপ ভাঙার আয়োজন করতে লাগলেন। আগে লোকজন দিয়ে ঝোঁপঝাড় পরিষ্কার করতে হবে। তারপর মন্দির। তবে পুরো বিষয়টি তিনি খুব হইচই করে করতে চান। যাতে গায়ের লোকজন বিষয়টা দেখতে পায়। এটি একটা স্পষ্ট বার্তা। তিনি চান এই বার্তা সকলে গ্রহণ করুক। তার প্রতি লোকের সমর্থন বাড়ক।
মোহর আলী ওঝা মন্ত্র পড়ে বাড়ি বন্ধন করে দিয়েছেন। এখন আর এ বাড়িতে ভূত-প্রেতের আসরেরও কোনো সম্ভাবনা নেই। নেই সাপখোপের ভয়ও। দু-একটা বাস্তু সাপ থাকলেও থাকতে পারে। তবে তাতে কারো কোনো ক্ষতির আশঙ্কা নেই। সেই সাপের মুখও মন্ত্র পড়ে বেঁধে দেওয়া হয়েছে। তার কিছুতেই কাউকে ছোবল মারতে পারবে না। সেই রাতে বহুদিন পর জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার ভালো ঘুম হলো। সুন্দর একটা স্বপ্নও দেখলেন তিনি। ভোরবেলা ঘুম ভেঙে তার মনে হলো এতদিন তিনি শুধু শুধুই অদৃশ্য কারো ভয়ে ন্যূজ হয়ে ছিলেন। এ তল্লাটে কার এমন সাহস যে তার মুখের সামনে থেকে এই জমি কেড়ে নেয়? তা ছাড়া এতকিছুর পরও যখন কেউ বাড়ির দাবি নিয়ে আসেনি, তখন আর চিন্তা নেই।
তারপরও জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া সময় নিলেন। এই যে ধীরে ধীরে তিনি জমি দখল নিয়ে নিচ্ছেন, এটিও নিশ্চয়ই আড়ালে বসে কেউ নজর করে দেখছে। তার প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে? হুটহাট কিছু না করে তাই ধীরতালেই একটার পর একটা পদক্ষেপ নিতে লাগলেন তিনি। আজ এটা তো সপ্তাহখানেক বা দিন পনের পরে ওটা। এভাবেই বিভিন্ন কাজ ঢিমেতালে চলতে থাকল। এলাকায় এখনো কিছু হিন্দু পরিবার রয়েছে। যদিও তারা তেমন প্রভাবশালী নয়। তারপরও তাদের কী প্রতিক্রিয়া হয়, সেটিও দেখার বিষয়। এ কারণেই মন্দিরের ধ্বংসাবশেষ উচ্ছেদের ব্যাপারটা তিনি ধীরে-সুস্থেই করতে চান। নিজের ঘর তোলার জন্যও জিনিসপত্রের জোগাড়-যন্তর করতে হবে। এসব করতে করতেই বেশ কয়েক মাস চলে গেল। বৃষ্টি, ঝড়-বাদলার সময়ও চলে এলো। সমস্যা হচ্ছে সময়ে অসময়ে বৃষ্টি নামে। ফলে কাজের খুব সমস্যা। তারপরও দীর্ঘদিন অপেক্ষার পর অবশেষে এক রোদ ঝলমলে দিন দেখে তিনি মন্দির ভাঙার কাজে হাত দিলেন।
পরদিন শুক্রবার। জুমার নামাজে অনেক লোকের সমাগম হবে। ঠিক তার আগের দিন এমন একটা কাজ করার অর্থ হচ্ছে পরদিন তিনি এই নিয়ে মুসল্লিদের কাছে উপস্থিত হতে পারবেন। তাদের কাছে নিজের একটা আলাদা প্রতিচ্ছবি দাঁড় করাতে পারবেন। যা তার ভবিষ্যতের জন্যও ভালো। এর মধ্যে বাড়ির সামনের অংশে ইট এনে জড় করা হয়েছে। রাজমিস্ত্রিরা ঘর তৈরির মাপজোখ করছে। বাড়ির উত্তর দিকে বর্ষার পানি পেয়ে লকলক করে বেড়ে ওঠা জঙ্গল অনেকটাই সাফ-সুতরো করা হয়েছে। মোহর আলী ওঝার মন্ত্রপুত বন্ধনের পরও লোকজনের মধ্যে সাপের ভয়টা ছিল। কিন্তু ঘাস, লতাপাতা পরিষ্কারের কাজ করার পরও যখন আর সাপ দেখা গেল না, তখন সকলে বেশ খানিকটা নির্ভার বোধ করতে লাগল।
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াও খুব আনন্দ নিয়েই দিনভর বাড়ির আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ালেন।
মন্দিরের ধ্বংসস্তূপের চারধারে গভীর করে খাদ তৈরি করা হয়েছে। চেষ্টা করা হচ্ছে মাটির নিচ থেকে দেয়ালের ভগ্নাংশগুলো তুলে ফেলার। কাজটা কঠিন। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে নানা নির্দেশনা দিচ্ছেন। মতি মিয়াসহ আরো চারজন এখানে কাজ করছে। অন্যরা বাড়ির বাকি অংশে। তখন প্রায় সন্ধ্যা ঘনিয়ে এসেছে। এ জায়গাটায় বড় বড় গাছ থাকায় আগেভাগেই অন্ধকার নেমে এসেছে। প্রচুর মশার কারণে ধূপ জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছে ভেতরে। সব মিলিয়ে জায়গাটা দেখতে কেমন কুয়াশাচ্ছন্ন আর গা-ছমছমে মনে হচ্ছে। সেই ছমছমে অন্ধকার কুয়াশাচ্ছন্ন মন্দিরের ধ্বংসস্তূপের ভেতর থেকে হঠাৎ উভ্রান্তের মতো ছুটে এলো মতি মিয়া। সে-ই এখন সবকিছু দেখাশোনা করছে। তার কাজে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া খুব সন্তুষ্ট। এতদিনে এসে তার মনে হচ্ছে, এছাহাক একটা অকর্মার ঢেঁকি। তা ছাড়া আজকাল সে একটু অসুস্থও থাকে। ফলে গুরুত্বপূর্ণ সব কাজ থেকে ইচ্ছে করেই তাকে দূরে দূরে রাখেন তিনি। এছাহাক মনে মনে কষ্ট পেলেও জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াকে কিছু বলার সাহস তার নেই। সে আজকাল তাই বাড়ির কাজ করে। ফুটফরমায়েশ খাটে। শরীরটাও খুব একটা ভালো নেই বলে এদিক-সেদিকও কম যাওয়া হয়।
এই ফাঁকে মতি মিয়া নিজের গুরুত্ব প্রমাণ করেছে। সে সাহসী চটপটে। আলসেমি বলে কোনো ব্যাপার তার মধ্যে নেই। কিন্তু হঠাৎ হলো কী তার? মতি মিয়ার চোখে কেমন ঘোর লাগা দৃষ্টি। কথা বলতে গিয়ে কয়েকবার ঢোক গিলল সে। জাহাঙ্গীর ভূইয়া খানিক অবাক চোখে তাকালেন। তারপর বললেন, ‘কী রে মতি, কী হইছে?
মতি ফ্যাসফেসে গলায় বলল, ভূঁইয়া সাব, মন্দিরের ভেতরে জানি কী আছে।’
কী আছে? ভূঁইয়ার কণ্ঠে খানিক ভয়।
‘আমি এহনো জানি না। তবে কী জানি একটা আছে। বিরাট বড়।
‘বিরাট বড়!’ যুগপৎ বিস্ময় ও দ্বিধা মিশ্রিত কণ্ঠে বললেন তিনি। সাপ-টাপ কিছু দেখোনি তো মতি মিয়া? এবার সাপ দেখলে বিপদ। আর কোনো লোকই কাজ করতে চাইবে না এখানে। তখন সবকিছু খুব কঠিন হয়ে যাবে। তিনি বললেন, ‘কী? সাপ?
না ভূঁইয়া সাব। মাটির নিচ থেকে মাথা বাইর হইয়া আসছে… পুরাটা এখনো বাইর হয় নাই। এই জিনিসের কথা আমি ময়মুরব্বিগো কাছে শুনছি। কিন্তু বাস্তবে যে কখনো দেখব, ভাবি নাই। এই দেখেন আমার গায়ের পশম দাঁড়াই গেছে। শইল কাঁপতেছে।
কথা সত্য। মতি মিয়ার শরীর কাঁপছে। তার কথাও জড়ানো। ভূত-প্রেত কিছু নয় তো? জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া চকিতে একবার চারপাশটা দেখে নিলেন। সবকিছু কেমন। চুপচাপ, নিঃশব্দ। একটা শান্ত কিন্তু ভীতিকর অন্ধকারাচ্ছন্ন সন্ধ্যা। সেই সন্ধ্যা যেন কোনো গা-হিম করা ভয়াল অশুভ কিছুর আভাস দিচ্ছে। তিনি অস্থির গলায় বললেন, কী হইছে, খুইলা বল। কী দেখছস? কী বাইর হইয়া আছে মাটির নিচ থেকে?
মতি মিয়া কিছু বলতে গিয়েও আচমকা থেমে গেল। তারপর সতর্ক চোখে একবার চারপাশটা দেখে নিয়ে বলল, আপনে এইদিকে আসেন। আমার লগে আসেন।
বলেই আবার মন্দিরের দিকে হাঁটতে শুরু করল সে। দ্বিধান্বিত জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া মতিকে অনুসরণ করলেন। ভেতরে কী এমন দেখেছে সে যে এমন ঘাবড়ে গেছে। তিনি আর কৌতূহল দমন করতে পারলেন না। মতির পেছন পেছন ভেতরে ঢুকলেন। বাইরে থেকে সেভাবে বোঝা না গেলেও ভেতরে ঢুকে বোঝা গেল, মন্দিরটা নেহাত ছোট নয়। তিনি মাথা নিচু করে ভাঙা দেয়াল ভেদ করে বের হয়ে আসা লোহা-লক্কড় ও বিপজ্জনক ইটের স্তূপ এড়ালেন। তারপর এগিয়ে গেলেন সামনে।
মতি মিয়া দাঁড়িয়ে আছে একটা ঘরের মাঝখানে। এ দিকটাতে তার সঙ্গে মাটি খোঁড়ার কাজ করছে দেলু। সে তখনো বুক সমান গর্তের ভেতর দাঁড়িয়ে আছে। তার চোখে ফ্যালফ্যালে দৃষ্টি। যেন সে কিছুতেই বুঝতে পারছে না কী করবে!
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া একবার মতি মিয়ার দিকে তাকালেন। আরেকবার তাকালেন গর্তের ভেতর দাঁড়ানো দেলুর দিকে। তারপর মতিকে বললেন, ‘ঘটনা কী মতি?
মতি হাত ইশারা করে খানিক ঝুঁকে গর্তের তলায় কিছু একটা দেখাল। তারপর নিচু গলায় বলল, “এইখানে মাটির নিচে বড় কলসি বা ধামার মতো কিছু একটা আছে।’
কী! কী আছে এইখানে? যেন বিস্ফারিত হলো জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার কণ্ঠ। তবে সঙ্গে সঙ্গেই নিজেকে সামলে নিলেন তিনি। তারপর নিচু গলায় বললেন, কলসি? কীসের কলসি?’ তার গলায় হঠাৎ চাপা উত্তেজনা ঝলমল করে উঠল, তুই দেখছস জিনিসটা কী?
‘দেখছি ভূঁইয়া সাব। প্রথমে তো বুঝি নাই। আমরা তো আর এইখানে মাটি খুঁড়ি নাই। খুঁড়তেছিলাম ওই যে দেয়ালের দিকে। হঠাৎ ঠং কইরা শব্দ হইলো। শাবলে শক্ত কিছু একটা লাগল। আচমকা বুঝি নাই। দেলু আবার কোপ দিল। আবার বাজল। শব্দটাও বেশি হইল। নিচে তো অন্ধকার। তখন ও আমারে ডাকল। আমি গিয়া দেখি মাটির নিচ থেকে একটা ছোট গোল মুখের মতো বাইর হইছে। পিতলের। তারপর আস্তে আস্তে হাত দিয়া মাটি সরাইতে লাগলাম। তখন দেখি, এইটা একটা গোল মুখ। তয় ওইটার চাইরপাশের মাটি সরাইতে গিয়া মনে হইল, নিচে কলসিও হইতে পারে, আবার পেট মোটা ধামার মতোও কিছু হইতে পারে। না খুঁড়লে বোঝন যাইব না।’
মুখ বন্ধ, না খোলা?’ এবার সতর্ক হলেন জাহাঙ্গীর ভূইয়া। যেন ঘটনা আঁচ। করতে পেরেছেন তিনি। গর্তের ভেতর ওটা যদি তিনি যা ভাবছেন, তা-ই হয়, তাহলে এখুনি তাকে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিতে হবে। না হলে বিপদ। এই জীবনে এত বড় সুযোগ আর কখনো আসবে না। শুধু শুধু মহিতোষ মাস্টারের এই সব দুই পয়সার জমি নিয়ে এত দেন-দরবার, মানসিক অশান্তি, দিন-রাত অজানা আশঙ্কার লুকোচুরি আর তাকে করতে হবে না। ভাগ্য কি তবে শেষ অবধি তার প্রতি সদয় হলো?
মতি মিয়া বলল, পিতলের ঢাকনা আছিল। সহজেই খুইলা গেছে। আমি খুইলা দেখছি।
‘কী? কী আছে ভেতরে? নিজেকে আর সামলাতে পারলেন না জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। ত্বড়িৎ রুদ্ধশ্বাস কণ্ঠে কথাটা বললেন তিনি।
মতি মিয়া চোখের ইশারায় দেলুকে কিছু বলল। সে গর্তের ভেতর থেকেই হাতটা উঁচু করে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার দিকে বাড়িয়ে দিল। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া জিনিসটা নিলেন। এক জোড়া মোটা সোনার বালা। বালা দু খানা দেখতে একই রকম। এই আধো অন্ধকারেও যেন তার হাতে তারার ফুলের মতো জ্বলজ্বল করে ফুটে আছে বালা জোড়া।
মতি মিয়া কি তবে গুপ্তধনের সন্ধান পেয়ে গেল!
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার পায়ের আঙুল থেকে মাথার চুল অবধি শিরশির করে উঠল। মনে হচ্ছিল, তিনি এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারছেন না। উত্তেজনায় যেকোনো সময় গর্তের ভেতর পড়ে যাবেন। অবশ্য তার খুব ইচ্ছেও করছে একবার গর্তে নেমে বিষয়টা ভালোভাবে দেখার। অন্তত একবার ছুঁয়ে দেখতে চান তিনি। কিন্তু এই মুহূর্তে বিষয়টা বেশ বিপজ্জনকও। তিনি চান না, এই তিনজনের বাইরে আর কেউ এই ঘটনা জানুক। যেকোনো সময় যে কেউ এখানে এসে পড়তে পারে। এর মধ্যেই বাইরে থেকে দুয়েকবার মতিকে ডেকেছে পরান। সেও কাজ করছে মাটি খোঁড়ার। হাতের বালা জোড়া আরো বেশ কিছুক্ষণ উল্টেপাল্টে দেখলেন তিনি। তারপর মতি মিয়ার দিকে তাকিয়ে প্রায় ফিসফিস করে বললেন, ‘ভেতরে সব এই জিনিস? না আরো কিছু আছে?
‘আমি অত দেখতে পারি নাই। তয় মনে হইল আরো জিনিস আছে।
কী আছে?
‘গলার হার আছে। বাজু আছে, বিছা আছে। মুখ ছোট হওনের কারণে টাইনা বাইর করন যায় নাই। ভেতরটা তো ভর্তি। আর সাইজও অনেক বড়।’ বলল মতি মিয়া।
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার মনে হচ্ছে আনন্দে, উত্তেজনায় তিনি পাগল হয়ে যাচ্ছেন। নানাভাবে চেষ্টা করছেন, নিজেকে শান্ত রাখতে। কিন্তু পারছেন না। তার বুকের ভেতর ঢিবঢিব শব্দ হচ্ছে। শ্বাস-প্রশ্বাস দ্রুতলয়ের হয়ে যাচ্ছে। কানের দু পাশ দিয়ে ঘাম নামছে। তিনি হাতের উল্টো পিঠে সেই ঘাম মুছতে মুছতে বললেন, জিনিস সোনার তো?’
‘এক শ ভাগ ভূঁইয়া সাব। খাঁটি সোনা।
হুম। বলে গম্ভীর হয়ে গেলেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। তারপর বালা জোড়া পাঞ্জাবির পকেটে রাখতে রাখতে বললেন, ‘এক কাজ কর।
কী কাজ?
‘আজ কাজ বন্ধ বইলা দে সবাইরে। আর বল যে কাইলও কাজ বন্ধ থাকব। পরে আবার কবে কাজ শুরু হইব, সেইটা আমরা জানাই দেব।
কী বলেন ভূঁইয়া সাব?’
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া মতির কথার জবাব দিলেন না। তবে দেলুকে লক্ষ করে বললেন “ওই দেলু, ওইখানে দাঁড়াই আছস কেন? ওপরে উইঠা আয়।’
দেলু একবার মতি মিয়ার দিকে তাকাল। একবার তার দিকে। তারপর উঠে এলো ওপরে। মতি মিয়া বলল, এখন?
জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া সঙ্গে সঙ্গেই জবাব দিলেন না। বেশ খানিক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, মাটি দিয়া জিনিসটা ঢাইকা ফেল।
কী? যেন আঁতকে উঠল মতি মিয়া।
হুম।
‘কেন?
কারণ…।’ বলে একটু থামলেন ভূঁইয়া। ঢোক গিললেন। তারপর এদিক সেদিক তাকিয়ে গলা নিচু করে বললেন, আইজ আর এইখানে থাকন যাইব না। কাজও চালান যাইব না। বাইরে সবাই কাজ করতেছে। যেকোনো সময় আইসা পড়তে পারে। একটা বিষয় খুব সাবধান, এই কথা যেন বাইরে না যায়। কাক পক্ষীও যেন টের না পায়। ঠিক আছে?
মতি মিয়া মাথা নাড়ল। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া বললেন, তোরা দুইজন তোদের ভাগ পাবি। কিন্তু যদি এই ঘটনা এই তিনজনের বাইরে গেছে, তাইলে…।’ কথাটা শেষ করতে গিয়েও শেষ করলেন না তিনি। মাঝপথেই থেমে গেলেন। তবে তাতে তার কথার বাকিটুকু বুঝতে অসুবিধা হলো না কারোই। এরা সকলেই তাকে চেনে। যমের মতো ভয়ও পায়। সুতরাং তার মুখের না বলা ভাষা বুঝতেও তাদের কারোই কোনো অসুবিধা হলো না। জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া শীতল গলায় বললেন, কী বলছি, বুঝছস তো? কথা ক্লিয়ার? …
‘জে।
কী করতে হইব আমি বলব। কিন্তু নিজ থেকে তাড়াহুড়া করন যাইব না। একদম না। সাবধান।
সেই রাতে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া একফোঁটা ঘুমাতে পারলেন না। সারারাত তীব্র অস্থিরতায় ছটফট করতে লাগলেন। মাঝরাতে তার হঠাৎ মনে হলো, মতি মিয়া আর দেলু যদি উল্টাপাল্টা কিছু করে বসে? তারা যদি এই কথা অন্য কাউকে বলে দেয়? কিংবা নিজেরা নিজেরাই যদি তুলে নিয়ে পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে? বিষয়টা তিনি মাথা থেকে তাড়াতে পারলেন না। তবে ভোররাতের দিকে তার হঠাৎ মনে হলো, এই কাজ তারা কখনোই করবে না। এর কারণও আছে। প্রথমত, তারা জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াকে খুব ভালো করেই চেনে। তারওপর তারা জানে, এই মাল তারা নিজেরা নিয়ে কখনো ভোগ করতে পারবে না। এ গায়ে তাদের বউ বাচ্চা আছে। বাপ-মা আছে। তারা দুজন ছাড়া এই মালের ঘটনা আর কেউ জানে না। সুতরাং ওই জিনিসের যদি সামান্যও কোনো তসরুপ হয়, তবে তিনি তাদের নির্বংশ করে ছাড়বেন। এই কথা তাদের অজানা থাকার কথা নয়।
.
ভোর হতেই মতি মিয়া আর দেলুকে ডাকলেন তিনি। তাদের সঙ্গে ঘরবন্ধ করে দীর্ঘ সময় নানা শলা-পরামর্শ করলেন। আজ সন্ধ্যা বা রাতেই তারা মন্দিরের ভেতর থেকে ওই কলস তুলবেন। তারপর চুপচাপ লুকিয়ে রাখবেন গোপন কোথাও। এত পুরনো দিনের স্বর্ণালংকার সব চট করে একসঙ্গে বিক্রিও করা যাবে না। মানুষের সন্দেহ বেড়ে যাবে। সবকিছু করতে হবে ধীরে সুস্থে। সাবধানে। তবে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বেশি আত্মবিশ্বাসী। অবশেষে ভাগ্য তার দিকে মুখ তুলে তাকিয়েছে। ভাগ্য যদি কারো সহায় হয়, তা হলে আর কী দরকার মানুষের?
.
তবে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার ভাগ্য তাকে সাহায্য করল না। দুপুরে জুমার নামাজের সময় মসজিদে ঘটে গেল অন্য এক ঘটনা। যে ঘটনার আশঙ্কায় তিনি গত কয়েক মাস রাতের পর রাত ঘুমাতে পারেননি। দিনের পর দিন দুশ্চিন্তায় অস্থির হয়েছিলেন। সেই ঘটনা অবশেষে ঘটল। তিনি জুমার নামাজের আগে আগে গায়ের কয়েকজনের মুরব্বির সঙ্গে কথা বললেন। গাঁয়ের ভালো-মন্দ বিষয়ে নানা পরিকল্পনার কথা জানালেন। মহিতোষ মাস্টারের বাড়ি, সেখানে তার ঘর-দোর তোলার বিষয়েও কথা হলো। সঙ্গে পরিত্যক্ত ওই মন্দির উচ্ছেদের কথাও। শুধু তা-ই নয়, তিনি এলাকার দরিদ্র ছেলেদের জন্য একটি এতিমখানা করার কথাও বললেন। শুনে তারা খুবই খুশি হলেন। এতদিনে যেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়াকে সত্যিকারের নেতা মনে হতে লাগল তাদের। নামাজ শেষে উপস্থিত সাধারণ মুসল্লিদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দেবেন জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া। সেই বক্তৃতায় তিনি তার বিস্তারিত পরিকল্পনা খুলে বলবেন।
সবকিছু শুনে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার প্রতি সকলেই তাদের সন্তুষ্টির কথা জানালেন। কিন্তু সেই সন্তুষ্টি খানিক্ষণের মধ্যেই রূপ নিল সন্তাপে। নামাজ শুরুর ঠিক আগে আগে মসজিদের বাইরে একটা ভিড় দেখা গেল। সেই ভিড় কেন্দ্র করে একটু হৈ হট্টগোলও হলো। মসজিদ থেকে বের হয়ে একজন ঘটনা জানার চেষ্টা করল। সে এসে জানাল, পাশের গা থেকে আশরাফ খাঁ এসেছেন। তিনি আজ এখানে জুমার নামাজ আদায় করবেন। সঙ্গে তার লোকজনও এসেছে। তাদের দেখতেই অনেকে কৌতূহলী হয়ে এগিয়ে গিয়েছিল। তাই সামান্য হইচই।
উপস্থিত মুরব্বিরা অবশ্য আশরাফ খাঁর এই হঠাৎ আগমনে খানিক চিন্তিত বোধ করতে লাগলেন। বহু বছর কেউ তাকে বাড়ির বাইরেই বের হতে দেখেনি। সেই আশরাফ খাঁ কেবল জুমার নামাজ পড়তে অতদূর থেকে হেঁটে এখানে এসেছেন, এ কথা যেন তাদের বিশ্বাসই হতে চাইল না। তা ছাড়া, তিনি একটু অসুস্থও। তার পায়ে সমস্যা। হাঁটতেও হয় খুঁড়িয়ে। এই অবস্থায় তার এতদূর ভুবনডাঙার মসজিদে নামাজ পড়তে আসার ঘটনা স্বাভাবিক না। নিশ্চয়ই এর পেছনে বড় কোনো কারণ আছে। সেই কারণটি কী?
বিষয়টা সকলের কপালেই চিন্তার ভাঁজ ফেলে দিল। সবচেয়ে বড় ভাজটি ফেলল জাহাঙ্গীর ভূঁইয়ার কপালে। ততক্ষণে নামাজের সময় হয়ে গেছে। তিনি নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন। সম্ভবত তার পেছনের কাতারেই এসে দাঁড়িয়েছেন আশরাফ খাঁ। তারা দুজন কাছাকাছি কাতারে দাঁড়িয়ে নামাজ শেষ করলেন। তবে নামাজের এই সময়টুকুতে জাহাঙ্গীর ভূঁইয়া মুহূর্তের জন্যও নামাজে মন বসাতে পারলেন না। তীব্র অস্থিরতা নিয়ে নামাজ শেষ করলেন তিনি। আশরাফ খাঁ কি মহিতোষের জমির বিষয়ে এখানে এসেছেন? নাকি অন্য কোনো কারণে? শুধু মহিতোষের জমিসংক্রান্ত বিষয়ে হলে তো আগে-পরেও তিনি আসতে পারতেন?
কিন্তু তা না করে একদম আজই কেন? আজই তিনি এই জমির ব্যাপারে জনসম্মুখে তার বিশেষ পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করবেন! বসতবাড়ি স্থাপনের সকল জোগাড়যন্ত্রও প্রায় সম্পন্ন। তারপরও গতকাল সন্ধ্যায়ই তিনি সন্ধান পেয়েছে মহামূল্যবান এক গুপ্তধনের! অথচ ঠিক আজই কি না এভাবে সদলবলে এখানে এসে হাজির হলেন আশরাফ খাঁ। যিনি এর আগে বহু বছর এ গাঁয়ের পথই মাড়াননি। তাহলে? এ কোনো অশনিসংকেত নয় তো?
৯
দৃশ্যটা স্বাভাবিক নয়। তারপরও দেখতে ভালো লাগছে। বিকেলের ফুরফুরে হাওয়ায় পারুর শাড়ির আঁচল উড়ছে। এই শাড়ি তাকে দিয়েছে রাজিয়া। সে এখন নদীর ধারের সেই বাঁশের মাচাটিতে বসে আছে পারুর সঙ্গে। দূরে ঘরের দাওয়ায় দাঁড়িয়ে দৃশ্যটা দেখছেন রাজিয়ার মা সাহেরা বানু। তিনি দীর্ঘদিন পর মেয়ের বাড়িতে এসেছেন। লোকমুখে শুনেছেন, তার মেয়ের জামাই দ্বিতীয় বিয়ে করেছে। সেই বউ পোয়াতি। পোয়াতি বউকে সে বাড়িতে এনে তুলেছে। এখন বউ-জামাই মিলে তার মেয়েকে খুব অত্যাচার-নির্যাতন করছে। যেকোনো সময় জামাই তাকে তালাকও দিয়ে দিতে পারে। এতকিছু ঘটে গেলেও মেয়ে তাকে কিছুই জানায়নি। কোনো খবর পাঠায়নি। কিন্তু মায়ের মন তো! সন্তানের খারাপ কিছু ঘটলে নাকি তা আগেভাগেই টের পেয়ে যান। তা সাহেরা বানুরও সেই অবস্থা। বেশ কিছু দিন থেকে তিনি ঘুমাতে পারছিলেন না। বুকটা কেমন ছটফট করছিল। চোখ বন্ধ করলেই নানা দুঃস্বপ্ন। বাঁ দিকের চোখটাও কেমন লাফাচ্ছে। এসব নানা কারণেই তিনি বুঝতে পারছিলেন, বড়সড় কোনো বিপদ ধেয়ে আসছে তার দিকে। কিন্তু সেই বিপদ যে কাশেমের দিক থেকে আসতে পারে, এটা তার দূরতম কল্পনাতেও ছিল না। কাশেম সোনার টুকরা ছেলে। সে রাজিয়াকে যেমন ভালোবাসে, তেমনি তার খেয়াল রাখে। আদর-যত্ন করে। এমন ছেলে আজকাল দেখা যায় না। অথচ সেই কাশেমই কি না শেষ পর্যন্ত কাউকে কিছু না জানিয়ে বিয়ে করে পোয়াতি বউ নিয়ে বাড়ি এসেছে!
দেরিতে খবর পেলেও সঙ্গে সঙ্গেই ছুটে এসেছেন তিনি। মেয়ের ভবিষ্যৎ চিন্তায় সাহেরা বানু ভীষণ শঙ্কিত। দুদিন বাদে যখন রাজিয়ার সতিন ওই মেয়েটার সন্তান হবে, তখন সে অবশ্যই রাজিয়াকে লাথি মেরে ঘর থেকে বের করে দেবে। এই সংসারের রানি হবে তখন সে। আর রাজিয়া হবে চাকরানি। এই চাকরানি মেয়েকে নিয়ে তখন তিনি কই যাবেন?
এমন নানা দুশ্চিন্তায় দিশেহারা সাহেরা বানু গত কয়েক দিন ধরে রাজিয়াকে কী বুঝিয়েছেন, কে জানে। তবে রাজিয়া এখন অনেকটাই শান্ত, চুপচাপ। গত দু দিন ধরে সে পারুকে গালমন্দ করে না। অকারণে চিৎকার-চেঁচামেচি করে না। বরং নিজ থেকে সেধে সেধে তার সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা করে। তাকে নরম গলায় খেতে ডাকে। যত্ন করে তার চুল বেঁধে দেয়। নিজের তুলে রাখা শাড়ি-কাপড় পরতে দেয়। বিষয়টাতে ভারি অবাক পারু। কিন্তু সে কিছু বলে না। বরং এখানকার রুক্ষ, রুঢ় অভিজ্ঞতায় অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া পারু রাজিয়ার হঠাৎ এমন বদলে যাওয়া আচরণে ভারি অস্বস্তি অনুভব করে।
বাতাসের ঝাঁপটায় হঠাৎ পারুর চুল উড়ে এলো রাজিয়ার মুখে। সে বিরক্ত হলো কি না বোঝা গেল না। তবে চুলগুলো আলতো হাতে সরাতে সরাতে বলল, ‘তোমার বয়সে আমারও এইরম মাথাভর্তি চুল আছিল। গায়ের রং আছিল ধবধবে সাদা। সেই আমি এহন দেখতে হইছি শাকচুন্নীর মতন। বুঝলা বইন, জীবন কখন যে কারে কই লইয়া যায় কেউ জানে না!’
রাজিয়ার এই কথায় পারু যেন একটা তীব্র দীর্ঘশ্বাস গোপন করে। তার চেয়ে আর কে বেশি জানে এই যন্ত্রণা! জীবন তার সর্বপ্লাবী জলোচ্ছ্বাসে অজানা কোন দেশে ভাসিয়ে নিয়ে যায় মানুষ। এই যে সে, ভুবনডাঙার পারু, মহিতোষ মাস্টার আর অঞ্জলির আমোদে-আহ্লাদে বেড়ে ওঠা আদুরে ফুলের মতো কোমল এক। মেয়ে। সে আজ কোথায়? তার সেই বাবা, মা আর বোন? কিংবা ফরিদ? জীবন তার সর্বগ্রাসী বানের জলে কাকে কোথায় ভাসিয়ে নিয়ে গেছে কে জানে! তবে তার আজকাল এও মনে হয়, নিজের অজান্তেই ভেতরে ভেতরে বোধহয় একটু একটু করে বদলে যাচ্ছে সে। হয়ে যাচ্ছে অন্য কোনো মানুষ। লতানো ফুলের আদল ছেড়ে সে যেন ক্রমশই হয়ে উঠছে শুষ্ক কাঠের মতো রুক্ষ ও কঠিন। যেন আজকাল আর কোনো কিছুতেই কিছু এসে যায় না তার। জীবন যখন অকূল জলে ভাসাবে বলেই মনস্থির করেছে, তখন সাঁতারটুকুও যে শিখে নেওয়াই উচিত।
রাজিয়া বলল, সে যখন প্রথম আমারে দেখল, ওই একবারই দেখা। সেই এক দেখাতেই পাগল হইয়া গেল। আমারে বিয়া করার জন্য এমন কোনো পাগলামি নাই যে সে করে নাই। তারপর রাজরানির মতো রাখছে। কিন্তু রানিও চাকরানি হয়, যদি সে রানিমা হইতে না পারে। আমি তো পারলাম না। কিন্তু তারপরও সে আমারে কোনোদিন অযত্ন করে নাই।
বলে দীর্ঘশ্বাস ফেলল সে। তারপর আবার বলল, তোমারে বিয়া কইরা। আননের পর থেইকা সে বাড়ির বাইরে বাইরে। আমার জন্যই। আমারে সে। ডরায়ও। ভাবে, আমি কী না কী কইরা বসি। আসলে আমার মেজাজটা একটু গরম, বুঝলা বইন? কিন্তু আমি মানুষ খারাপ না। অনেক চিন্তাভাবনা কইরা দেখলাম, জামাইরে বাড়ির বাইরে বাইরে রাখলে কী হইবো? তার মন তো আর আমি আটকাইতে পারব না। তার চাইতে ভালোয় ভালোয় আল্লাহয় তোমারে একটা পোলা দেউক। দুই বইনে তারে আদর-যত্ন কইরা মানুষ করব। কী বইন, দেবা না তোমার পোলারে আমার কাছে?
এই কথার কী উত্তর দেবে পারু? তার গায়ে এসব কথা হুলের মতো ফোটে। অস্বস্তিতে আড়ষ্ট হয়ে যায় সে। মনে হয় তার শরীরজুড়ে অজস্র কাঠপিঁপড়া পিলপিল করে ঘুরে বেড়াচ্ছে। কিন্তু রাজিয়াকে কিছু বলতেও পারে না সে। চূড়ান্ত অসহ্য হয়ে যতবারই বলতে গেছে, হয় সে রেগেমেগে তুলকালাম কাণ্ড ঘটিয়েছে। অথবা মুখ ঝামটা মেরে উড়িয়ে দিয়েছে। আজকাল অবশ্য নরম গলায় হেসে বলে, ভয়ের কিছু নাই বইন। তুমি আমারে এত ভয় পাও কেন? আমি তোমার লগে আর উল্টাপাল্টা কিছু করব না। তুমি নিশ্চিন্ত থাকো। দুনিয়াতে কত পুরুষ দুইটা বিয়া করছে। সে করলে দোষ কী? আর সে তো রং-ফুর্তির জন্য করে নাই, করছে প্রয়োজনে। আমারে তালাকও দেয় নাই। অযত্নও করে নাই। মায়ের পেটের দুই বইন এক লগে থাকে না? থাকে। আমরাও তেমনই থাকব।’
পারু চুপ করে থাকে। তবে এ বাড়িতে তার হঠাৎ করেই যে আদর-যত্ন বেড়ে গেছে, তাতে সে খুব একটা স্বস্তি বোধ করে না। নিজেকে কেমন নির্লজ্জ, অথর্ব, আত্মসম্মানহীন মনে হতে থাকে। এ কেমন বিদঘুঁটে এক জীবন তার?
এখান থেকে পালিয়ে যাওয়ার কোনো উপায়ও খুঁজে পায় না সে। কাশেম সেই যে গেল, তারপর থেকে আর কোনো খবর নেই তার। অন্য কারো সঙ্গে এই বিষয় নিয়ে কথা বলার কিংবা শলা-পরামর্শেরও সুযোগ নেই। এ বাড়িতে বাইরের লোকজনও তেমন আসে না। লোকালয় থেকে খানিক বিচ্ছিন্ন নদীর পাড়ে একা এক বাড়ি। আর কালেভদ্রে কেউ এলেও পারুর সঙ্গে কাউকে কথা বলতে দেয় না রাজিয়া। ফয়জুল নামে এক লোক অবশ্য প্রায়ই আসে। সম্পর্কে সে কাশেমের ফুপাতো ভাই। তবে সে এ বাড়িতে এলে কেবল রাজিয়ার সঙ্গেই কথা বলে। সম্ভবত কাশেম যে তার আগের বউ রেখে দ্বিতীয় বিয়ে করেছে, এই খবর শুনে তারা বিরক্ত। ফলে পারুর সঙ্গেও কেউ কোনো কথা বলে না। কাশেমের অবর্তমানে ফয়জুলই এ বাড়ির নানা কাজকর্ম করে দেয়। বিশেষ করে যেসব কাজ মেয়েদের পক্ষে করা একটু কঠিন সেসব। যেমন, হাট-বাজার করা, চুলার জ্বালানির জন্য চেরাই কাঠ সংগ্রহ, দূরের গঞ্জ থেকে ওষুধপত্র এনে দেওয়া ইত্যাদি। পারুর মাঝে মাঝে ফয়জুলের সঙ্গে আগ বাড়িয়ে কথা বলতে ইচ্ছে হয়। সে যদি তাকে বালুর মাঠ নিয়ে যাওয়ার কোনো উপায় বলে দিতে পারে। বা নিজেই সাহায্য করে। কিন্তু রাজিয়ার ভয়ে সাহস হয়নি। তা ছাড়া ফয়জুলও তাকে এড়িয়েই চলে। ফলে কারো সঙ্গেই কথা বলা হয়ে ওঠে না তার। ওই এক রাজিয়াই তার ভয় ভীতি, গাল-মন্দ কিংবা প্রীতির সঙ্গী।
তবে সেদিন একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটল। কাশেমের গ্রামসম্পর্কিত এক বৃদ্ধ দাদি এলেন বাড়িতে। এ বাড়িতে কাশেমের আর কোনো আত্মীয়-স্বজনকে পারু দেখেনি। তার বাবা-মাও সম্ভবত বেঁচে নেই। সবকিছু থেকে একপ্রকার বিচ্ছিন্নই তারা। এর মধ্যে হঠাৎ এই বৃদ্ধাকে দেখে পারু একটু অবাকই হলো। বৃদ্ধার চামড়ায় ভাঁজ পড়ে গেছে। ফোকলা দাঁত। হাঁটেন কুঁজো হয়ে। তিনি এসে দেখেন। পারু খোলা চুলে বসে আছে বাইরে। সঙ্গে সঙ্গে হইহই করে ছুটে এলেন তিনি। তারপর খনখনে গলায় বলল, ‘এ কী নাতবউ, তুমি এই সময়ে এইহানে বইসা আছো কেন? তাও আবার চুল খোলা, মাথায় কাপুড় নাই। এইটা কোনো কথা? তোমারে কি বাপ-মায় কিছু শিখায় নাই? কেমুন ঘরে বড় হইছ তুমি?
বলে একটু থামলেন বৃদ্ধা। তারপর পারুর পাশে বসতে বসতে বললেন, ‘কাশেইম্মা ছ্যামড়াডা না হয় আরেকটা বিয়া করছে, তা আগের বউর পোলা মাইয়া হইলে কী করব! বুঝলাম, রাজিয়ার ডরে সে কাউরে কিছু জানায়ও নাই। কিন্তু তাই বইলা এত সোন্দর পোয়াতি বউ রাইখা সে বাড়িঘর ছাইড়া উধাও হইয়া যাইব? তার খোঁজখবর রাখব না? তা তোমার বড় সতিনে তোমার ভালো-মন্দ দেহে তো? নাকি সারাদিন আগুনে মরিচ পোড়া দিয়া রাহে?’
আগুনে মরিচ পোড়া দিয়ে রাখার অর্থ না জানলেও অনুমান করে নিল পারু। সম্ভবত রাজিয়া তাকে খুব যন্ত্রণা দিচ্ছে কি না, সেটা জিজ্ঞেস করছেন বৃদ্ধা। পারু অবশ্য জবাব দিল না। আজকাল ধীরে ধীরে সবকিছু সহ্য করে নেওয়ার চেষ্টা করছে সে। তবে সবসময় পারে না। বেশির ভাগ সময়ই কেউ যখন তাকে এবং তার পেটের অনাগত সন্তানের সঙ্গে কাশেমকে জড়িয়ে কিছু বলে, তখন তার গা গুলিয়ে ওঠে। মনে হয় যেকোনো সময় পেট উগড়ে বমি হয়ে যাবে। তবে হয় না। নিজেকে সংবরণ করে সে। এবারও করল।
বৃদ্ধা হঠাৎ উঠে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, ‘গাঙ্গের পাড়ের বাড়ি কিন্তু ভালো না। তারপরও ওই দেহো, উত্তর ধারেই একখান তেঁতুলগাছ। তেঁতুলগাছে নানা আজেবাজে জিনিস থাহে। তুমি একটু সাবধানে থাকবা নাতবউ। মাথায় কাপুড় ছাড়া থাকবা না। চুল খোলা রাখবা না। বুঝলা? আর এই যে আমি তোমার আঁচলে শুকনা মরিচ, ম্যাচের কাঠি আর লোহার টুকরা বাইন্ধা দিতেছি। খবরদার, এইগুলা কোনো সময় খুলবা না। এই সময়ে ভূত-প্রেতের আসর হইলে খুব খারাপ। পোলা-মাইয়া কানা-লুলা হয়।
পারুর বুকটা অকস্মাৎ ছ্যাৎ করে উঠল। সে জানে, কথাগুলো সত্য নয়। গর্ভবতী মেয়েদের নিয়ে এমন নানা কুসংস্কারই গ্রামবাংলায় প্রচলিত। তারপরও কেন যেন বুকটা কেঁপে উঠল তার। মা হলে এমন হয়? সন্তানের সামান্যতম অনিষ্টের ভাবনাও তাকে এভাবে সমূলে নাড়িয়ে দেয়?
বৃদ্ধা তার শাড়ির আঁচলে বাধা ছোট্ট একটা কাপড়ের পোঁটলা বের করলেন। পারু অবাক হয়ে লক্ষ করল সেই পোটলার ভেতরে নানারকম এটা-সেটা জিনিস। তিনি সেগুলো থেকে কিছু কিছু আঙুলের ডগায় খুঁটে খুঁটে তুললেন। তারপর যত্ন করে বেঁধে দিতে লাগলেন পারুর আঁচলে। তার চোখ বন্ধ। পান খাওয়া লাল ঠোঁট জোড়া তিরতির করে কাঁপছে। সম্ভবত কোনো দোয়া-দরুদ পড়ছেন তিনি। পারুর আচমকা মনে হলো, এই বৃদ্ধাকে সে আগে কোথাও দেখেছে। অবিকল না হলেও প্রায় এমনই কাউকে। এমন কোঁচকানো মুখ। পান খাওয়া লাল ঠোঁট। ফোকলা দাঁতের মুখভর্তি মায়া। এই মায়া আদি ও অকৃত্রিম।
বৃদ্ধা এবার উঠে গিয়ে পারুর পেছনে বসলেন। তারপর গজগজ করতে করতে বললেন, ‘কী সোন্দর চুল। কিন্তু এই চুলে তেল-পানি-সাবান পড়ে না কতদিন? ও বড়বউ, বড়বউ?
তিনি ঘরের দিকে মুখ করে রাজিয়াকে ডাকতে লাগলেন। কয়েকবার ডাকার পড়ে ভেতর থেকে সাড়া দিল রাজিয়া, বুজানে আইছেন নি? কহন আইলেন?
‘এতক্ষণে কহন আইলেন জিগাইলে হইব? বৃদ্ধার গলা খানিক রুঢ়। ময় মুরব্বির খোঁজখবর রাখন লাগে, বুঝলা বউ? আর ছোটগো আদর করন লাগে। তা তুমি কি তোমার ছোট সতিনের কোনো যত্ন-আত্মি করো না? পোয়াতি মাইয়ার চেহারা-ছবি থাহে এইরম?
রাজিয়া এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। বৃদ্ধা বললেন, কই দেহি, তোমার তেলের ডিব্বাটা এইদিকে লইয়া আহো তো। এই মাইয়ার মাথায় একটু তেল-পানি দিয়া দিই। কী সোন্দর মুখটা কী রকম হইয়া আছে!
পারু ভেবেছিল এখুনি আবার তুলকালাম কিছু একটা ঘটে যাবে। তেলে বেগুনে জ্বলে উঠবে রাজিয়া। কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। সে বরং ঘর থেকে তার তেলের কৌটাটা এনে বৃদ্ধার পাশে রাখতে রাখতে বলল, ভাবছিলাম আমিই আইজ দিয়া দেব। কিন্তু সংসারে কাম কাজের তো শেষ নাই বু জান। সময়ই করতে পারি নাই।
বৃদ্ধা জবাব দিলেন না। তবে তিনি নানা বিষয়ে অস্ফুটে গজগজ করতে লাগলেন। সঙ্গে তার কঠিন রুক্ষ হাতে পারুর মাথার চুলে বিলি কেটে দিতে লাগলেন। তারপর সেখানে আঙুলের ডগায় ঘষে ঘষে তেল মেখে দিতে থাকলেন। পারুর আবারও মনে হলো, এই যে তার পেছনে বসা মানুষটি, যাকে সে এর আগে কখনো দেখেনি। এর আগে কখনো তার স্পর্শ পায়নি, আঁচলের ঘ্রাণ নেয়নি। এই মানুষটিকে সে চেনে। এই মানুষটি কি তার ঠাকুমা ছায়ারাণীর মতো?
হ্যাঁ, অবিকল ছায়ারাণীই যেন তাকে তার সামনে বসিয়ে চুলে তেল মেখে দিচ্ছেন। আর মুখে ভর্ৎসনা করছেন। পারুর স্পষ্ট মনে আছে, ছোটবেলায় সে যখন দিনমান বন-বাদাড়ে ঘুরে বেড়াত। ধুলোয় ধূসরিত চেহারা, চুল নিয়ে বাড়িতে ফিরত। তখন রাতের বেলা ছায়ারাণী এভাবে তাকে সামনে বসিয়ে গালমন্দ করতে করতে মাথার চুল আঁচড়ে, চুলে বিলি কেটে তেল মাখিয়ে দিতেন। পারু জানে না কেন, তার বুকের ভেতর হঠাৎ তীব্র এক হাহাকারের ওলট-পালট করা উথাল পাথাল ঢেউ বয়ে যেতে লাগল। এ সময়ে তার মা যদি তার সঙ্গে থাকতেন কিংবা ঠাকুমা, তাহলে কী করতেন তারা? তারাও নিশ্চয়ই তাকে এমনভাবে নানা বিধিনিষেধে যত্ন করে আগলে রাখতেন। তার ও তার সন্তানের চিন্তায় অস্থির হয়ে থাকতেন।
বৃদ্ধা সেদিনের মতো চলে গেলেন। যাওয়ার আগে বললেন, যাইগো পারুল। পারুল না তোমার নাম?
‘পারু…। ও হুম পারুল। যেন খানিক দ্বিধাগ্রস্ত স্বরেই উত্তর দিল পারু। বৃদ্ধা হয়তো কারো কাছ থেকে তার নাম শুনে থাকবেন। হয়তো পারুকেই পারুল বলে মনে হয়েছে তার। যদিও এমন নানা নামেই তাকে তার কাছের মানুষরা ডাকত। তবে বহুকাল কেউ আর তাকে পারুল বা পারুলতা বলে ডাকে না। তারপরও বৃদ্ধার মুখে শুনতে ভালোই লাগল পারুর। তবে তারচেয়েও বেশি ভালো লাগল তার হাতের স্পর্শটুকু। ওই স্পর্শজুড়ে কী যেন কী লেগে রইল। কী যে মায়া! এই মায়ার জন্যই মানুষ জীবনভর ছুটে বেড়ায়। আমৃত্যু তৃষ্ণার্ত হয়ে থাকে। পারুও হয়তো। তবে তাকে সত্যি সত্যি চমকে দিতে লাগল রাজিয়া। আজকাল তাকে সবটুকু দিয়ে আগলে রাখতে চায় সে। ঠিক চারুকে যেভাবে আগলে রাখত চাইত পারু, তেমন। বড় বোনের মতো আদরে, শাসনে। সে তাকে যত্ন করে খাওয়ায়, ঘুমাতে পাঠায়। এটা-সেটা শিখিয়ে দেয়। পারুর পেট আরো খানিক ভারী হতে থাকে। এতকিছুর পরও সে মুহূর্তের জন্য স্বস্তি পায় না। ফরিদের জন্য সারাক্ষণ অস্থির হয়ে থাকে। কেমন আছে ফরিদ? কী করছে সে? ওই দিন সে ঠিকঠাক ফিরতে পেরেছিল তো? এখন নিশ্চয়ই তাকে খুঁজতে খুঁজতে পাগলপ্রায় সে।
এ এমন এক চিন্তা, যার ডালপালা অসংখ্য। ফলে ভেবে আর শেষ করা যায় না। মাথা এলোমেলো হয়ে যায়। এতকিছুর মধ্যেও যে এ বাড়িতে খানিক নির্ঝঞ্ঝাট জীবন মিলেছে, এ-ই বা কম কীসে? পারু এটুকু নিয়েই যতটা সম্ভব সুস্থির থাকার চেষ্টা করে। কিন্তু তার সেই সুস্থিরতা বেশিদিন থাকে না। এক গভীর রাতে প্রচণ্ড শরীর খারাপ হতে থাকে তার। ভোর বেলা বমি করে বিছানা ভাসিয়ে দেয়। তলপেটে অসহ্য যন্ত্রণা। সেই যন্ত্রণায় যেন নাড়ি-ভূঁড়ি সব বেরিয়ে আসতে চায়। পারুর আতঙ্কে গলা শুকিয়ে আসে। কী হয়েছে তার? খুব খারাপ কিছু? তার পেটের সন্তানের কোনো ক্ষতি হবে না তো?
রাজিয়া আর তার মা পারুর যত্নের ত্রুটি রাখে না। দু-চারজন ফকির কবিরাজও আনে। পানি পড়া, তাবিজ এটা-সেটা দেয়। কিন্তু কাছাকাছি কোথাও হাসপাতাল-ডাক্তার নেই বলে তারা নিয়েও যেতে পারে না। তা ছাড়া, বাড়িতে পুরুষ মানুষের অভাব। অতদূরের থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে তারা পারুকে নিয়ে যাবে কী করে? পারু অবশ্য সেরে ওঠে দিন দুই বাদে। কিন্তু খুব কাহিল হয়ে পড়েছে সে। রাজিয়া উদ্বিগ্ন কণ্ঠে জিজ্ঞেস করে, “এখন সব ঠিক তো বইন?
পারু মাথা নাড়ে। সে ভালো বোধ করছে। রাজিয়া বলে, রক্ত-টক্ত কিছু যায় নাই তো? বা অন্য কিছু?
না।’
‘পেটে আর ব্যথা-বেদনা নাই তো?
না।’ আর কোনো সমস্যা? বড় ধরনের কিছু? আমার কাছে লুকাইও না।’
না।’
সেই রাতে পারু বীভৎস এক সত্য আবিষ্কার করে। রাত তখন কত সে জানে। অকস্মাৎ ঘুম ভেঙে গেল তার। পাশের ঘরেই চাপা কিন্তু উত্তেজিত কণ্ঠে কথা বলছে কেউ। পারু নিঃশব্দে কান পেতে শুনতে লাগল। সাহেরা বানুর গলা শোনা যাচ্ছে। তিনি তার মেয়েকে ধমকাচ্ছেন, নিজের কপাল নিজে পোড়লে আমি কী করব? তোর কপাল তুই পুড়বি। আমি যতই পানি ঢালতে চাই, লাভ কী? লাভ নাই।’
‘কী করব আমি? অন্ধকারে খেঁকিয়ে ওঠে রাজিয়া। আমি কি কম চেষ্টা করছি? আমার তো মন চায় গলা টিইপ্যা মাইরা ফালাই। কিন্তু তোমার কথায় দাঁতে দাঁত চাইপা সব সহ্য করতেছি মা। ভালো ভালো কথা বলতেছি। আদর-যত্ন করতেছি। কিন্তু আমার শরীল জ্বইলা যায়।
কপাল না জ্বললেই হইল। কিন্তু কপালটাই তো জ্বালাই দিলি। ওইটুকু ওষুধই পুরাটা খাওয়াইতে পারলি না। আমি কম কষ্ট কইরা জোগাড় কইরা আনছিলাম? কবিরাজ কইছিল, পর পর তিন দিন খাওয়াইতে পারলেই বাচ্চা নষ্ট হইব।’
‘আমি তো তিনদিনই খাওয়াইছিলাম। অতখানি শরবতের মতন ওষুধ কাউরে গোপনে খাওয়ান যায়? তাও তো কম চেষ্টা করি নাই। ভাত-তরকারির লগে মিশাইয়া খাওয়াইছি।’
‘ওরে কপালপুড়ি, কবিরাজ তো কইছিলই। ভাত-তরাকারির লগে না খাওয়াইয়া ডাইরেক খাওয়াইতে।’
ডাইরেক আমি কেমনে খাওয়ামু? আমি কইলেই সে খাইব? যদি কিছু সন্দেহ করে?
সন্দেহ যাতে না করে, সেইজন্যই তো এতকিছু করলি। এত খাতির-যত্ন করলি। এরপরও যদি না পারস, তাইলে মনে রাখিস, এই বাড়ির ভাত তোর কপালে নাই। একবার যদি ওই মাইয়া মা হয়, তোরে লাথি দিয়া এই বাড়ির তন বাইর কইরা দেবে।’
রাজিয়া কিছু বলতে গিয়েও চুপ করে থাকে। তারপর হঠাৎ গুনগুন করে কাঁদতে থাকে। বেড়ার এপাশে অন্ধকারে বিস্মিত, হতভম্ব, আতঙ্কিত পারু জড়সড় হয়ে শুয়ে থাকে। রাজিয়া তাহলে এই কারণে তার সঙ্গে এত ভালো ব্যবহার করেছে। তার যে হঠাৎ শরীর খারাপ হলো, তা রাজিয়ার ওই গোপনে খাওয়ানো ওষুধের কারণে? সে তাকে খাবারের সঙ্গে মিশিয়ে কিছু খাইয়েছিল?
পারুর শরীরটা হঠাৎ তীব্র ভয়ে হিম হয়ে আসে। সে আলতো করে তার পেটে হাত রাখে। কিন্তু কিছু টের পায় না। আচ্ছা, সবকিছু ঠিক আছে তো? সে তার সন্তানটিকে বাঁচিয়ে রাখতে পারবে তো? না কি সে…। পারু আর ভাবতে পারে না। কাঁদবে না ভেবেও অনেকদিন পর সে আবার বুক ভাসিয়ে কাঁদতে থাকে। সে এই সন্তানটিকে কী করে বাঁচাবে? এই যে অন্ধকার, এই যে টিনের বেড়া, তার ঠিক ওইপাড়ে দুজন হিংস্র, জঘন্য মানুষ নখর বাগিয়ে অপেক্ষা করছে। তারা তার পেটের সন্তানটিকে খুন করে ফেলতে চায়। তাদের কাছ থেকে সে কী করে রক্ষা করবে তাকে?
সাহেরা বানুর গলা আবার ভেসে আসে। তিনি তার মেয়েকে সান্ত্বনা দেয়ার ভঙ্গিতে বলেন, এহন আর কান্দিস না। দুনিয়াতে কাইন্দা কিছু আদায় করন যায় না। আমি কাইল আবার যামু কবিরাজের কাছে। আইতে কিছুদিন লাগব। এইবার ওষুধ আনলে যেমনেই হোউক খাওয়াইতেই হইব। মনে থাকব?
রাজিয়া কথা বলে না। তবে তার কান্না থামে। কেবল কান্না থামে না পারুর। সে জানে না কী করবে? এই গভীর অন্ধকারের গহ্বর থেকে তার মুক্তি কীসে? নাকি ক্রমশই আরো অন্ধকারে ডুবে যাবে সে। হারিয়ে যাবে অসীম অন্ধকারের অতলান্তিক গভীরে।