মহাপুরুষের স্পর্শ মহাপুরুষের সঙ্গেই চলে যায়। অন্তত বস্তুজগতে থাকে না। বস্তুজগতের ধরে রাখবার শক্তি নেই, থাকলে মিশরের ফারাওদের মমিদের কল্যাণেই পুরনো মিশর বেঁচে থাকত। বুদ্ধের অস্থির উপর স্থূপের কল্যাণে ভারতবর্ষের সকল দুঃখ দূরে যেত। ঈশ্বরের পুত্রের। আবির্ভাবের পর প্রতিবেশীতে প্রতিবেশীতে মিলে ইয়োরোপ জুড়ে এক অপরূপ প্রেমের রাজ্য গড়ে উঠত। এমনভাবে ইয়োরোপই বিশ্বযুদ্ধের কেন্দ্র হয়ে উঠত না।
থাকে মহাপুরুষের স্মৃতি আর বাণী। মানুষের মনে মনে বয়ে চলে,নদীর মত। কিন্তু মনে। যখন সংশয়ের ঝড় ওঠে—কোথা কোন্ দূর দিগন্ত থেকে বালি এসে জমা হয়, বা প্রখরতম গ্ৰীষ্ম জেগে ওঠে—মরুভূমি হয়ে ওঠে মন, তখন সে নদীর স্রোতও শুকিয়ে যায়। শুষে গিয়ে, উত্তপ্ত বালুর চড়ার মত হা-হা করে।
ঠিক তেমনিভাবে কৃষ্ণস্বামীর মন প্রখর তৃষ্ণায় হাহাকার করছে। কোনোক্রমেই তিনি রিনা ব্রাউনের কথা ভুলতে পারছেন না। কী করে পারবেন? এই রিনা দেখে সেই রিনাকে ভুলবেন কী করে? মরুভূমির মধ্যে যে নদীটি আগে বইত—তার স্মৃতি কি ভোলা যায়?
বিষ্ণুপুরের লাল বাঁধের ধারে পাথরখানিকে ছুঁয়ে বসেই ভাবছিলেন কৃষ্ণস্বামী।
মনে পড়ছে রিনার সেই মূর্তিমতী সান্ত্বনার মত মূর্তি। দীর্ঘ কৃষ্ণপক্ষের ঘেরের মধ্যে জলভরা বড় বড় দুটি চোখ। সজল চোখে কৃষ্ণেন্দুর দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ইউ আর হার্টলেস, ইউ আর হার্টলেস কৃষ্ণেন্দু। আই ডিড নট নো। নেভার থট ইট ঈভন! কথাটা রিনা বলেছিল কৃষ্ণের মাতৃবিয়োগের পর। ছবিটা জ্বলজ্বল করছে।
মা হঠাৎ হার্টফেল করে মারা গিয়েছিলেন। কৃষ্ণেন্দু টেলিগ্রাম পেয়ে গিয়ে তাঁকে দেখতে পায় নি; পনের-কুড়ি দিন পর শ্রাদ্ধশান্তি সেরে কামানো মাথা নিয়ে কলকাতায় ফিরেছিল। বন্ধুরা জানত। কিন্তু রিনাকে বলে যাবার কথা মনে হয় নি। কারণ এর মধ্যে কয়েক মাসেই খানিকটা দূরে চলে এসেছিল সে। বৈজ্ঞানিক পন্থায় মনোজগতে রিনার কাছ থেকে দূরে সরেছিল সে। সুকৌশলে। ডাক্তার সে। একালের ডাক্তারিতে মানসত্ত্বও পড়তে হয়। একনাগাড়ে নব্বই দিন। মনকে বেঁধে রাখলে, দূরে সরিয়ে রাখলে মনের আকর্ষণের সূত্র ক্ষীণজীৰ্ণ হয়। বন্ধুর বধূ সম্পর্কে আসক্তিহীন হবার জন্যই সে সংকল্প করে তাই-ই করেছিল। রিনা ক্লেটনের মনোনীতা। তারও বাবা-মা আছেন। হাসপাতালে পলি ব্রাউনের সঙ্গে দেখা হত, তার সঙ্গে কথা বলত। কিন্তু তাও যথাসাধ্য কম, রিনার কথা তুলতই না। মাতৃশ্ৰাদ্ধ সেরে ফেরার পর তার কামানো মাথা দেখে পলি ব্রাউন সবিস্ময়ে প্রশ্ন করেছিল, কী হয়েছে কৃষ্ণেন্দু? এনি মিস্যাপ?
আমার মা–
মারা গেছেন? বাবা-মা মারা গেলে তোমরা মাথা কামাও?
হ্যাঁ, মিসেস ব্রাউন। আমার মা হঠাৎ হার্টফেল করে মারা গেছেন। আমি দেখতে পাই নি।
পলি ব্রাউন পরমাত্মীয়ার মতই সান্ত্বনা দিতে চেষ্টা করেছিল। অন্তর থেকে ধন্যবাদ জানিয়েছিল কৃষ্ণেন্দু। সন্ধ্যায় সে ধর্মতলায় বন্ধুর চেম্বারে বসে আছে, এমন সময় এল রিনা। চোখে জল নিয়ে সে তাকে তিরস্কার করে অনুযোগ জানালে, তুমি হৃদয়হীন কৃষ্ণেন্দু। আমি জানতাম না। ভাবি নি কখনও।
বোসো রিনা।
না। এই কটা কথাই বলতে এসেছিলাম। তোমার মায়ের মৃত্যুসংবাদ পেয়ে সেদিন একটা খবরও দাও নি? এত পর ভেবেছ?
তার হাত ধরে তাকে আটকে কৃষ্ণেন্দু বলেছিল, আমার অপরাধ আমি স্বীকার করছি।
তখন বসেছিল রিনা। সেদিন শুধু তার মায়ের কথাই জিজ্ঞাসা করেছিল এবং কৃষ্ণেন্দু সত্য সত্যই কেঁদেছিল, আজকের কথা আমার মনে অক্ষয় হয়ে রইল রিনা। তোমার পবিত্র হৃদয় স্বর্গের মত। তার স্পর্শে আমার মন জুড়িয়ে গেল।
একটুখানি হাসি ফুটে উঠেছিল রিনার মুখে। বেদনায় স্নান, কিন্তু শান্ত। বলেছিল, সত্যি, মায়ের স্নেহ আমি কখনও পাই নি কৃষ্ণে। মামি পলি আমাকে ভালবাসে, কিন্তু তার চেয়েও গাঢ় ভালবাসার স্বাদ পাই আমি কুন্তীর কাছে। ভাবি, ও শুধু আমাকে মানুষ করেছে। আমার আয়া। তা হলে গর্ভধারিণী মায়ের স্নেহের স্বাদ কেমন?
রিনা চলে গেলে কিছুক্ষণ অভিভূত হয়ে বসে ছিল কৃষ্ণেন্দু। এই ঘটনা থেকেই আবার রিনার সঙ্গে যোগসূত্র নতুন হয়ে উঠল। সূত্রটা সুত ছিল না, কালের সঙ্গে মাত্র কয়েক মাসেই জীর্ণ হয়ে যাবার মত উপাদানে তৈরি ছিল না। ওটা ছিল সোনার মত ধাতু থেকে গড়া। হাজার বছর পরেও মাটির তলা থেকে ওঠা সোনার আভরণের মত হাজার বছর আগের দুটি হৃদয়ের যোগাযোগের সাক্ষ্য দেবে।
খাঁটি সোনা। কোনো খাদ ছিল না।
আবার হঠাৎ একদিন। সেদিন হাসপাতাল কম্পাউন্ডে ঢুকেছে, কুন্তী—রিনার আয় ছুটে এসে তাকে বললে, ডাক্তারবাবু!
অদ্ভুত তার চোখের দৃষ্টি। সে-দৃষ্টি এমন যে যেন কথা কইত। বুকের ভিতরে রাগ হোক, হিংসা হোক, ভয় হোক, আতঙ্ক থোক, সে যেন আপনার রূপ নিয়ে স্পষ্ট ফুটে বের হত। কুন্তীর চোখে সেদিন ছিল আতঙ্ক আর আকুতি। দৃষ্টি থেকেই সে বুঝলে কছু ঘটেছে।
কৃষ্ণেন্দু তখন সদ্য পাস করেছে। হাউস-সার্জন হয়ে রয়েছে। তার কল্পনা—সে বিলেত। যাবে। বছর দুয়েকের মধ্যেই টাকা সে সংগ্রহ করতে পারবে। টাকা তার কিছু আছে। মা তাঁর। মৃত্যুকালে গহনাগুলি তাকে দিয়ে গেছেন। শ্রাদ্ধের পর তার বাবা তার হাতে সেগুলি দিয়ে বলেছেন—তুমি নিয়ে যাও। রাখ। আমার খরচের হাত। পাস করে তুমি ডিসপেন্ডারি করবে বলেই সে দিয়ে গেছে। তা ছাড়াও কলেরার চিকিৎসায় স্যালাইন ইনকেজশনে এরই মধ্যে তার খ্যাতি যথেষ্ট হয়েছে এবং সাহস তার অপার। সেদিকে তার উপার্জনের পথ প্রশস্ত। পাস যতদিন করে নি, ততদিন অন্য ডাক্তারের পিছনে তাকে যেতে হত। এবার সে একলা যাবার অধিকার। অর্জন করেছে। এবং এ-দেশের বড়লোকের বাড়িতে দুষ্ট খাবারের প্রবেশাধিকার আজও অবধি এবং তাদের গাণ্ডেপিণ্ডে খাবার প্রবৃত্তিও প্ৰচণ্ড। কলকাতা শহরে মাছিরও অভাব নেই। ভ্যাকসিনও। এরা নেয় না। ওদের বাড়িতে মোটা টাকা উপার্জনের পথ তার অবারিত। ধর্মতলার চেম্বার ছাড়াও চিৎপুর অঞ্চলে একটা চেম্বার করেছে। সালভারসন ইনজেকশনে নাম সব থেকে বেশি। ধর্মতলায় অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানরা লজ্জা না করে চিকিৎসা করায়। চিৎপুর অঞ্চলে, যারা লজ্জা করে সংগোপনে চিকিৎসা করাতে চায়, তাদের জন্য চেম্বার। এখানে চার টাকার জায়গায় আট টাকা ফি। রিনার কথা গোপন অন্তরে আছে কিন্তু তার খবর রাখে না। বিদেশে চলে যেতে চায়।
কুন্তী সভয়ে চোখ বড় বড় করে বলেছিল, রিনা কাঁদছে ডাক্তারবাবু।
কাঁদছে?
ফুলে ফুলে কাঁদছে। সকাল থেকে।
কেন? কী হয়েছে?
জানি না, জনি সাহেবের বাবার কাছ থেকে কী চিঠি এসেছে সাহেবের কাছে। আমি জানি না, ওরা বলছে।
কৃষ্ণেন্দু না গিয়ে পারে নি। রিনা সত্যই পড়ে পড়ে কাঁদছিল। কৃষ্ণেন্দু যেতেই সে একখানা চিঠি ফেলে দিয়ে বলেছিল, আমি কী করব কৃষ্ণেন্দুঃ এবং আবার সে ফুলে ফুলে কেঁদে চলেছিল।
জনির বাবা চার্লস ক্লেটন চিঠি লিখেছে ব্রাউন সাহেবকে। আপনার চিঠি জন পেয়েছে। অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। আপনি সত্যকারের একজন ইংরেজ এবং ক্রিস্টান; আমিও তাই। জনিও ক্রিস্টানের ছেলে ক্রিস্টান। রিনাকে বিবাহ করা নিয়ে সে যখন অপনাকে একখানা চিঠি লিখতে উদ্যত হয়েছিল, তখনই আপনার চিঠি সে পায়। জন যে কথা আপনাদের জানাতে চেয়েছিল, সে কথা আমি জানাই। যাচাই না হলে প্রেমের ঠিক মূল্য বোঝা যায় না। ভগবানকে ধন্যবাদ যে, রিনার সঙ্গে মেলামেশার স্বরূপকে সে অল্পদিনেই বুঝতে পেরেছে। বন্ধুত্বকেই সে। প্রেম বলে ভুল করেছিল। জন এখানে এসে চাকরি নিয়ে বৃহত্তর সমাজে প্রবেশ করে তার প্রকৃত ভালবাসার পাত্রীর সন্ধান পেয়েছে। কর্নেল রেমন্ড আমার পুরনো বন্ধু। পলি তাকে জানে। তার মেয়ে এমিলি। এমিলি রেমন্ড অত্যন্ত ভাল এবং সুন্দরী মেয়ে। তারা দুজনেই দুজনকে ভালবেসেছে এবং শীঘ্রই তারা স্বামী-স্ত্রীতে পরিণত হবে। এ পুয়োর গাৰ্ল ইন ডিসট্রেস ইজ এ সেক্রেড থিং; রিনা দুঃখ পেলে তার জন্য আমার গভীর সহানুভূতি রইল। সময়ে সবই সেরে যাবে। রিনার সম্পর্কে যে সত্য আপনি তাকে জানিয়েছেন তার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ। আপনি একজন খাঁটি ক্রিস্টান।
স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল কৃষ্ণেন্দু। ক্লেটন সম্পর্কে মনে একটা আঘাত পেয়েছিল। একটা দুরন্ত ক্ষোভ জেগে উঠেছিল তার। সে আজ এখানে থাকলে—হুঁ। কৃষ্ণেন্দু খোলা জানালা দিয়ে কলকাতার বাড়িগুলোর মাথার উপরে আকাশের দিকে তাকিয়ে ছিল। ক্লেটন এমন পাষণ্ড!
আই গেভ হিম মাই এভরিথিং কৃষ্ণেন্দু! রিনা বালিশে মুখ খুঁজে কাঁদতে লাগল এবার।
রিনা! কেঁদো না। রিনা! লুক অ্যাট মি, ইন মাই ফেস্–রিনা!
রিনা তার দিকে ফিরে তাকিয়েছিল। মৃদু বিষণ্ণ হেসে বলেছিল, তুমি যদি আজ আমাকে ওথেলোর মত গলা টিপে মেরে ফেলতে পার কৃষ্ণেন্দু!
এক মুহূর্তে কী হয়ে গিয়েছিল। একটা প্ৰকাণ্ড উঁচু বাঁধকে টলতে টলতে হেলে ঢলে সশব্দে ভেঙে ভূমিসাৎ হতে কেউ দেখেছে? ঠিক তেমনিভাবে বাঁধ ভেঙে পড়ল আর উন্মত্ত জলস্রোত কাঁপিয়ে পড়ার মত জীবনের সকল আবেগ যেন মুহূর্তে মুক্তিলাভ করল। রিনারিনা—আমি তোমাকে ভালবাসি, কথা কটি তার মুখ থেকে বেরিয়ে এসেছিল। অবশ্য সে উন্মাদের মত রিনার বুকের উপর পড়ে তাকে জড়িয়ে ধরেছিল।
রিনা, আই লাভ ইউ, আমি তোমাকে ভালবাসি, রিনা! রিনা! মাই লাভ। আমার সব। রিনা! আমি তোমাকে ভালবাসি।
মৃদু অস্ফুট কণ্ঠে রিনা শুধু বলেছিল, কৃষ্ণেন্দু! মাই কৃষ্ণেন্দু!
আমি তোমাকে ভালবাসি, রিনা!
সে শুধু বলেছিল—কৃষ্ণেন্দুমাই কৃষ্ণেন্দু! মাই কৃষ্ণেন্দু!
তারপর মুখের উপর মুখ রেখে দীর্ঘক্ষণ তারা স্তব্ধ হয়ে গিয়েছিল। দীর্ঘক্ষণ পর কৃষ্ণেন্দু বলেছিল, আমি আর দেরি করতে চাই না। যত শিগগির হয় বিয়ে করতে চাই। কাল এসে আমি তোমার বাবা-মাকে বলব।
পরের দিন কৃষ্ণেন্দু গিয়ে বলেছিল ব্রাউন সাহেবকে।
ব্রাউন তার মুখের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, ইউ সি মিস্টার গুপ্টা, আ িএকজন ইংরেজ। তার চেয়েও বেশি, আমি একজন ক্রিস্টান। আমার মেয়ে রিনা অবশ্য একজন অ্যাংলোইন্ডিয়ান, তার মধ্যে কিছুটা এদেশের রক্ত আছে, কিন্তু সে আমার মেয়ে। আজকালকার দিনের মত তিন আইনে রেজেস্ট্রি করে বিয়েতে আমি রাজি নই। সেও হবে না। সে আমার চেয়ে বেশি ক্রিস্টান ধর্মে অনুরাগী। তোমাকে আমি জানি। তুমি কৃতী মানুষ। সাহসী এবং সৎ লোক।
বিয়েতে আমার অমত নেই, কিন্তু তোমাকে ক্রিান হতে হবে।
ক্রিস্টান হতে হবে। স্তম্ভিত হয়ে গেল কৃষ্ণেন্দু। এতটা ভাবে নি সে। ধর্ম সে মানে না। সেখানে ধর্মান্তরের কথা হয়ত কিছুই নয়। তবু একটা যেন প্ৰচণ্ড আঘাত অনুভব করলে।
ভেবে দেখো, ইয়ং ম্যান! কাল এসে উত্তর দিয়ে। কাল না পার, কয়েকদিন পর।
কৃষ্ণেন্দু মাথা হেঁট করে ভাবতে ভাবতে ফিরছিল। রিনার ঘরের দোরে থমকে দাঁড়িয়েছিল। রিনার দরজা বন্ধ। সে ডেকেছিল, রিনা!
ক্রন্দনরুদ্ধ কণ্ঠে উত্তর দিয়েছিল, তুমি যাও, তুমি যাও। আমি ভাবি নি। আমি একথা ভাবি নি। গো ব্যাক কৃষ্ণেন্দু, গো ব্যাক।
রিনা!
না! না! না! ফরগেট মি। গো ব্যাক।
সে চলে এসেছিল। সিঁড়ির বাঁকে দাঁড়িয়ে কুন্তী। সে কাঁদছিল। কৃষ্ণেন্দুকে দেখে বলেছিল, রিনা মরে যাবেক—ডাক্তার বাবা—রিনা মরে যাবে।
পৃথিবী ঘুরছিল। আকাশ-মাটি, ঘর-বাড়ি, মানুষ—সব যেন পাক খেয়ে মিলিয়ে যাচ্ছিল। একটা অসীম শূন্যতায় ভরে যাচ্ছিল তার মন। সব শূন্য, সব শূন্য। রিনা ছাড়া আজ আর সে। পৃথিবীতে বাঁচবার কল্পনা করতে পারে না। ধর্ম? ধর্ম তো সে মানে না। সত্যই মানে না। ঈশ্বরও মানে না। সে মানে নূতন কালের নূতন সত্যকে। ঈশ্বর নেই, এই সত্যই তার কাছে আজ একমাত্র সত্য। টুথ ইজ গডসত্য যদি ভগবান হয়, তা হলে সব ধর্মই আজ সমান মিথ্যা তার কাছে। তবু একটাকে অবলম্বন করে থাকতে হয়েছে তাকে। সে মানে না, তবু তাকে লোকে বলে হিন্দু বৈদ্য। তাকে কাগজে লিখতে হয়, ফৰ্ম পূর্ণ করতে হয়। কিন্তু আজ রিনা তার জীবনের শ্ৰেষ্ঠ সত্য। তার জন্য সে হবে, ক্রিস্টানই হবে। তার বাবা!
সঙ্গে সঙ্গে বুকের ভিতরটা তার হাহাকার করে উঠল।
বাবা! তার বাবা! বাবা কি এটা প্ৰসন্ন মনে গ্রহণ করতে পারবেন? কিন্তু ক্রিস্টান হয়েও কি সে তার সন্তান থাকতে পারবে না? তাঁর ধর্ম নিয়ে তিনি থাকবেন। তার আচার-আচরণ সমস্ত কিছুকে সে আজ শ্রদ্ধা করে, তেমনি করবে। সে তো কোনো ধর্মের আচরণের মধ্যে নিজের জীবন-সত্যকে সন্ধান করবে না, সে সন্ধান করবে তার ধর্ম এই চিকিৎসাবিজ্ঞানের মধ্য দিয়ে চিকিৎসক-জীবনের আচার-আচরণের মধ্য দিয়ে। তবে কিসের বিরোধ, কিসের সংঘর্ষ হবে সে ক্রিস্টান শুধু নামে রিনার জন্য! দূরান্তরেই সে থাকে, বাবা থাকেন গ্রামে। তিনি বৃদ্ধ হয়েছেন। তাকে তার প্রয়োজন কতটুকু? সেবার? সেবা সে করবে। তিনি ছোঁবেন না? তাকে ছেবেন না, রিনাকে ছেবেন না? কেন ছেবেন না? কেন?
অর্ধোন্মাদের মত সে বেরিয়ে এল। তার অন্তর থেকে দেহের অণু-পরমাণু চিৎকার করছিল, রিনারিনারিনা! রিনাকে ভিন্ন সে বাঁচতে পারে না। এ তার দেহলালসা নয়। সে বার বার পরীক্ষা করেছে। তার চেয়ে বেশি কিছু। অনেক অনেক বেশি।
হাসপাতাল থেকে শরীর অসুস্থ বলে সে চলে এল। ছোট একটা ব্যাগে সামান্য কটা জিনিস নিয়ে হাওড়ায় ট্রেনে চেপে বসল। বাড়ি পৌঁছে দাঁড়াল বাবার সামনে
তুমি হঠাৎ! বাবা চমকে উঠলেন। এ কী চেহারা?
আপনার কাছে এসেছি। অনুমতি চাইতে এসেছি। আমি একটি ক্রিস্টান অ্যাংলো-ইন্ডিয়ান মেয়েকে বিয়ে করতে চাই।
বাবা চমকে উঠলেন না। চিৎকার করলেন না। তার মুখের দিকে চেয়ে অভ্যাসমত শান্তভাবেই বললেন, এ আমি জানতাম।
বাবার পা দুটো ধরে উপুড় হয়ে পড়ে কৃষ্ণেন্দু উন্মাদের মত বলেছিল, আপনি বলুন।
বাবা বলেছিলেন, তুমি উন্মাদ। নইলে আমার পায়ে ধরে লজ্জাহীন হয়ে এ-কথা বলতে পারতে না যে একটি ক্রিস্টান মেয়ের জন্য আমার ধর্ম তুমি ত্যাগ করবে!
তাকে ভিন্ন আমি বাঁচব না।
তুমি মরে গেলে আমি আত্মহত্যা করব, এ কথা আমি বললে মিথ্যা বলা হবে কৃষ্ণেন্দু। আত্মহত্যা আমি করব না, কষ্ট নিশ্চয়ই হবে, কিন্তু বাঁচব, ভগবানের নাম করে বাঁচব। আমার ধর্মে আত্মহত্যা অধৰ্ম।
সে চিৎকার করে উঠেছিল, বাবা।
বাবা শান্ত স্বরে বলেছিলেন, উত্তর আমি দিয়েছি কৃষ্ণেন্দু। ওই মেয়েকে বিয়ে করলেও আমার কাছে তুমি মৃত, মেয়েটিকে না পেয়ে মরে গেলেও তাই। আমি তোমাকে বলেছিলাম, আর এগিয়ো না। তুমি শোন নি। তার সঙ্গে জীবনের অগ্নিসাক্ষী করে সাত পা যদি হেঁটে থাক, তাহলে তোমার উপায় কী?
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে হেসে তিনি গোবিন্দ স্মরণ করেছিলেন। আর কথা বলেন নি, উঠে চলে। গিয়েছিলেন। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে কৃষ্ণেন্দু যেমন উন্মাদের মত গিয়েছিল তেমনি উন্মাদের মতই ফিরে চলে এসেছিল। একেবারে স্টেশনে। বাবা তার একবার ফিরেও ডাকেন নি। কলকাতার পথে মাঝখানে নেমে পড়েছিল। সারাটা রাত বসে ছিল প্ল্যাটফর্মের উপর। ভোররাত্রে আবার ট্রেন ধরে কলকাতায় ফিরেছিল।
এসে রিনার চিঠি পেয়েছিল, নানা-না। এ তুমি কোরো না। কৃষ্ণেন্দু, আমি মিনতি করছি। এই আমার শেষ কথা কৃষ্ণেন্দু। আমি আসানসোল যাচ্ছি। যাচ্ছি রেভারেন্ড আরনেস্টের কাছে। তার কাছে শান্তি আছে। শান্তির জন্যে যাচ্ছি আমি।–রিনা।
কিন্তু কৃষ্ণেন্দু তখন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। মন স্থির করেছে।
রিনাকে তাকে পেতেই হবে। জীবনের যে-কোনো মূল্যে রিনাকে তার চাই। ধৰ্ম-জাতি-প্রতিষ্ঠা—সব, সব দিতে পারে সে। রিনা জানে না, রেভারেন্ড আরনেস্ট তাকে শান্তি দিতে পারবেন না। পারেন না। তাঁর ধর্মও পারে না। শান্তি-সুখ-আনন্দ-তৃপ্তি সব আছে তার তাকে পাওয়ার মধ্যে। জীবনের সুখ, জীবনের শান্তি যেমন ভোগের মধ্যে বস্তুর মধ্যে নেই—তেমনি জীবনকে ছেড়ে দিয়ে আদর্শবাদের বা ধর্মের আচার আচরণ মন্ত্ৰ জপ ত্যাগ বা কৃচ্ছ্বসাধনের মধ্যেও নেই। শুধু কায়ার মধ্যেও নেই আবার কায়া বাদ দিয়ে মায়ার মধ্যেও নেই। কায়া-মায়া মাখামাখি এই জীবন। জীবনের কাম্য যদি কোথাও থাকে তবে সে জীবনের মধ্যেই আছে। রিনা, তুমি যা চাও তা আমার মধ্যে, আমি যা চাই তা তোমার মধ্যে। রূপ রস বৰ্ণ গন্ধ স্বাদ মন মাধুর্য স্নেহ প্রেম সান্ত্বনা, এই তো জীবনের কামনা। এ আছে জীবনের মধ্যেই। আর কোথাও নেই—আর কোথাও নেই।
সে বেরিয়ে পড়েছিল আবার। আর দেরি নয়। একবার গিয়েছিল সে ব্রাউনের কাছে, পলির কাছে। আমি ক্রিস্টান হওয়া ঠিক করেছি, মিস্টার ব্রাউন!।
ব্রাউন কয়েক মুহূর্ত স্থিরভাবে তার মুখের দিকে তাকিয়ে ছিল। তারপর উঠে এসে তার হাত ধরে বলেছিল, তোমাকে অভিনন্দন জানাচ্ছি, গুপ্টা!
কৃষ্ণেন্দু বলেছিল, আশা করি রিনার সঙ্গে বিয়েতে কোনো অমত থাকবে না আপনার?
নিশ্চয়ই না। অত্যন্ত আনন্দের সঙ্গে সম্মতি দেব। রিনা আঘাতে মর্মাহত হয়ে আসানসোল গেছে। সে থাকলে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠত।
আজই আমি যাচ্ছি চার্চে।
আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারি, যদি বল।
ব্রাউনের সাহায্যে তার ধর্মান্তর গ্ৰহণ অত্যন্ত সহজ হয়ে গিয়েছিল। ধৰ্মান্তর গ্রহণের পর ব্রাউন বলেছিল, ইউ রান আপ টু রিনা। ব্রিং হার ব্যাক।
পলি বলেছিল, সে কাঁদতে কাঁদতে গেছে। আসুক সে হাসিমুখে।
কৃষ্ণেন্দু বলেছিল, কাল যাব।
ফিরে গিয়েছিল তার বাসায়। তার আগের দিন সে নতুন বাসা করেছে ধর্মতলায়। রিনাকে নিয়ে সংসার পিতবার মত বাসা। যেখানে ছিল, ক্রিস্টান হবার পর আর সেখানে থাকতে চায় নি। নিষ্ঠুরভাবে আঘাত দেবে প্রতিবেশীরা। মনে একটা প্রশ্ন জেগেছিল। ধর্ম যদি ঈশ্বর দেয়, তবে এমন অনুদার কেন? প্রেমহীন করে কেন মানুষকে? এক মুহূর্তে এতকালের প্রতি স্নেহ সব মুছে গেল? সব মুছে গেল? ঈশ্বর কি প্রেমহীন, প্রীতিহীন, স্নেহহীন? সে কি বিদ্বেষপরায়ণ? সে আঘাত করে? মনটা কেমন হয়ে গিয়েছিল। ধর্ম সে মানে না। ঈশ্বরকে সে নেই বলেই ধ্রুব জানে। তবু হিন্দু ধর্ম ছেড়ে ক্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করে কেমন যেন হয়ে গেল মনটা।
সারাটা রাত বারান্দায় ডেক-চেয়ারে বসে রইল। নিউ টেস্টামেন্টখানা নিয়ে পড়বার চেষ্টা করল। মন লাগল না। রিনার ছবি নিয়ে তার দিকে তাকিয়ে বসে রইল। মন তখন আবার উৎসাহে ভরে উঠেছে। সারা রাত রিনার সঙ্গে বিয়ের স্বপ্ন দেখেছে। সে উঠল। আসানসোল আসানসোলে যাবে সে। রিনা। সকালের রোদ যেন সোনার ঝলক বলে মনে হচ্ছে।
পৃথিবী মাটির। পৃথিবী কঠিন। সূর্যের আলো সোনা নয়, বড় উত্তপ্ত। মানুষের সবচেয়ে বড় সর্বনাশ তার আত্মপ্রবঞ্চনায়। নিজেকে সে যত বঞ্চনা করেছে তার চেয়ে বেশি বঞ্চনা আর কেউ করে নি। অলীককে সত্য বলে ধারণা করে তার পিছনে ঘুরে ঘুরে ক্লান্ত হয়ে একদিন সে মুখ থুবড়ে পড়ে হাহাকার করে মরে। সেই অলীকের মোহে সোনাকে বলে মাটি। মুখের খাদ্য ঠেলে দিয়ে উপবাসে নিজেকে পীড়িত করে।
রিনার যে দৃষ্টি, সেই স্তম্ভিত-বিস্ময়ে-ভরা মুখ আজও তার মনে পড়ে।
সে আসানসোলে মিশনে এসে রিকে সামনেই পেয়েছিল। রেভারেন্ড আরনেস্টের বাঙলোর সামনে উদাস দৃষ্টিতে আকাশের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল।
কৃষ্ণেন্দু উল্লাসে উচ্ছ্বসিত হয়ে তাকে ডেকেছিল দূর থেকে, রিনা! রিনা!
রিনা চমকে উঠেছিল। অস্ফুট স্বরে বলেছিল, কৃষ্ণেন্দু?
হ্যাঁ, রিনা। আমি কাল ব্যাপাটাইড্ৰড হয়েছি। আমি তোমাকে নিতে এসেছি। আর কোনো বাধা নেই। তুমি আমার। ইউ আর মাইন।
রিনার বিচিত্র রূপান্তর ঘটতে লাগল। কৃষ্ণেন্দু তার হাত ধরতে গিয়ে থমকে গেল। রিনা যেন কেমন হয়ে যাচ্ছে।
নিষ্পলক দৃষ্টি স্থির হয়ে গেছে, তার মুখের উপরেই নিবদ্ধ, তবু যেন সে তাকে দেখছে না, যৌবনমাধুর্যে অপরূপ তার মুখখানিতে কী লেখা যেন ফুটছে; কপালে, তে, দুটি ঠোঁটে ক্ষীণ রেখায় স্তম্ভিত বিস্ময়ের সঙ্গে আরও দুর্বোধ্য কিছু যেন ফুটে উঠেছে সমস্ত কিছুতে। তার মধ্যে আশ্চর্য দৃঢ়তা এবং আশ্চর্য আরও কিছু। মহিমাঃ হ্যাঁ, তাই।
ধীরে ধীরে রিনা বলেছিল, ক্রিস্টান হয়েছ? আমার জন্য?
হ্যাঁ, রিনা।
তোমার ধর্ম, তোমার ঈশ্বর ত্যাগ করেছ? ছি! ছি!
রিনা, কী বলছ?
তুমি বুঝতে পারছ না? কী ভয়ানক!
রিনা! আমি তোমার জন্য জীবন দিতে পারি! রিনা!
লাইফ ইজ মর্ট্যাল! জীবন নশ্বর। একদিন তা যাবেই। অসংখ্য জীবন অহরহ যাচ্ছে। কৃষ্ণেন্দু, ইচ্ছে করে মানুষ মরছে, বিষ খাচ্ছে, গলায় দড়ি দিচ্ছে। মানুষ মানুষকে মেরে নিজে মরছে। কৃষ্ণেন্দু, সেদিন এখান থেকে কিছু দূরে হাজারিবাগে একজন বাঘ মারতে গিয়ে বাঘের হাতে মরেছে! জন ক্লেটনও হয়ত কোনো যুদ্ধে গুলির সামনে দাঁড়িয়ে প্রাণ দেবে। বাধ্য হয়ে দেবে। এমন জীবন দেওয়াটা নেশার ধর্ম কৃষ্ণেন্দু। আমার প্রভু জীবন দিয়েছিলেন, ঈশ্বরের জন্য, ধর্মের জন্য। তুমি আমার জন্যে তোমার সেই ধৰ্ম, তোমার বিশ্বাসের ঈশ্বরকে ত্যাগ করলে কৃষ্ণেন্দু! ফর এ গার্ল? ফর দিস আইজ অব মাইন হুইচ ইউ সো অ্যাডোর–
কৃষ্ণেন্দু প্রথমটায় বিচলিত হয়ে গিয়েছিল রিনার এই আকস্মিক আক্রমণে। এ রিকে সে এই প্রথম দেখছে। ধৰ্মান্ধতায় উগ্র উন্মাদ! সে নিজেকে সংবরণ করে এবার বাধা দিয়ে বলেছিল, ডোন্ট বি সিলি, রিনা।
সিলি? প্ৰদীপ্ত হয়ে উঠেছিল রিনা।
দৃঢ়স্বরে কৃষ্ণেন্দুও বলেছিল, ইয়েস, সিলি! কারণ কোনো একটা ধর্মকে মানুষ অবলম্বন করে, রিনা, ওই ধর্মকে অতিক্রম করে সর্বজনীন মানবন্দুধর্মে উপনীত হবার জন্য। এই ধর্মের গোঁড়ামি আর বন্ধনের মধ্যে বন্দির মত বাধা থাকবার জন্য নয়।
ইয়েস। মানি। শুনেছি। কিন্তু বুঝতে পারি না। না পারি, এটুকু বলতে পারি যে, যারা ওখানে পৌঁছুতে চেষ্টা করে, তারা একটি মানুষকে পাবার জন্য সে তপস্যা করে না। তপস্যা করে সব মানুষকে আপন-জন বলে পেতে। একটি নারীর কাছে নিজেকে সমর্পণ করে না। কৃষ্ণেন্দু, সকল জনের কাছে নিজেকে বিলিয়ে দেয়, ঢেলে দেয়। ঈশ্বর বড় পবিত্র; বড় মূল্যবান। তাকে তুমি ত্যাগ করলে কৃষ্ণে? আমার জন্যে? না। না।
কী বলছ তুমি রিনা?
রিনা আবার স্থিরদৃষ্টিতে তার দিকে তাকিয়ে রইল।
রিনা!
রিনা বললে, না, আমার জন্যে নয়। যে সৌন্দর্য তুমি ভালবাস সেই সৌন্দর্যময় একটি নারীর জন্য। কণ্ঠস্বর তার রুদ্ধ হয়ে আসছিল। চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে এল এবার।
ব্যাকুল হয়ে কৃষ্ণেন্দু তার হাত ধরে বললে, রিনা—
ছেড়ে দাও! লিভ মি। ডোন্ট টাচ মি। প্লিজ–প্লিজ।
রিনা!
নিরুচ্ছ্বাস কান্না কাঁদতে কাঁদতে রিনা বললে, তুমি ভয়ংকর, কৃষ্ণেন্দু, তুমি ভয়ংকর। একটি নারীর জন্য তুমি তোমার ঈশ্বরকে ছাড়তে পার। কৃষ্ণেন্দু, আমার চেয়ে সুন্দরী নারী অনেক আছে। তা হলে তাদের কাউকে যখন দেখবে, সংস্পর্শে আসবে, সেদিন আমাকেও তুমি ছুঁড়ে ফেলে দেবে তুচ্ছ বস্তুর মত। তোমার যে ঈশ্বরকে তোমার একান্ত আপনার বলে এতদিন জেনে এসেছ, ভালবেসেছবিপদে ডেকেছ,অভয় পেয়েছ। ওঃ! তুমি যাও! আমি তোমাকে ভালবাসি। কিন্তু না। বিবাহ করতে আমি পারব না। তুমি ভয়ংকর!
কৃষ্ণেন্দু স্তম্ভিত হয়ে বিস্ময়ে তার দিকে তাকিয়েছিল। প্রতিটি কথা তাকে যেন বিদ্ধ করছিল। সুচের মত। একটু থেমে রিনা আবার বললে, তোমার বাবা যদি আমায় বলেন—তোমার জন্য আমাকে আমার ধর্মের সঙ্গে আমার ঈশ্বরকে ত্যাগ করতে হবে তবে আমি তা পারি? না–না—না। তুমি যাও—তুমি যাও— বলেই সে যেন ছুটে পালিয়ে গেল। একটা আতঙ্ক যেন। তাকে তাড়িয়ে নিয়ে গেল।
পাথর হয়ে গেল কৃষ্ণেন্দু। স্থির স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। পৃথিবী শূন্য হয়ে গেছে, হয়ে গেছে অর্থহীন। তার কেউ নেই। কিছুই তার নেই। কী করবে সে? বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিলেন বৃদ্ধ পাদরী। তিনি বোধহয় দুজনের কথার মধ্যে আসতে চান নি। তিনি এবার এগিয়ে এলেন।
ইয়ং ম্যান!
গুড মর্নিং ফাদার। সে সচেতন হয়ে উঠল এতক্ষণে।
গুড মর্নিং। বসবে? বিশ্রাম করবে?
থ্যাঙ্ক ইউ ফাদার। অনেক ধন্যবাদ। তার প্রয়োজন নেই। আমি নেক্সট ট্রেন ধরতে চাই।
ফাদার বললেন, কোথায় যাবে তুমি? তোমার মনের অবস্থা আমি জানি।
সে বলেছিল, জানেন না ফাদার। আমিও জানি না। আমি ভেবে দেখব। লেট মি থিঙ্ক ফাদার।
My son—
কৃষ্ণেন্দু বলেছিল, আমি কথা দিচ্ছি ফাদার-আমি মরব না।
সে চলে এসেছিল।
***
সেই রিনা ব্রাউন। যে এরপর বুকে ঝুলিয়ে নেবে ক্রশ আর একমাত্র পাঠ্য হবে হোলি বাইবেল, ভেবেছিল কৃষ্ণেন্দু। যে রিনা ব্রাউন সারা জীবন অবিবাহিত থাকবে ভেবেছিল, সেই রিনা ব্রাউন। সে উন্মাদিনীর মত মদ আর ব্যভিচারে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েছে। আমেরিকান অফিসারের জীবনের সাধ-মিটিয়ে-নেওয়া উচ্ছল উল্লাসের মধ্যে আত্মসমর্পণ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে, ভেসে বেড়াচ্ছে। স্মৃতিও বোধহয় নষ্ট হয়ে গেছে।
ওথেলোর কথাও তার মন থেকে মুছে গেছে। বললেও মনে পড়ে না, ঐ কুঁচকে তাকিয়ে থাকে, অন্তরের অন্তস্তল থেকে সহ্য করতে না পারার ইঙ্গিত ফুটে ওঠে তিক্ত দৃষ্টির মধ্যে।
আর কৃষ্ণেন্দু? সে কৃষ্ণস্বামী হয়ে এই অরণ্য অঞ্চলে রোগীর চিকিৎসা এবং কুষ্ঠরোগীর সেবার মধ্যে নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছে; রিনা বলেছিল, বিশেষ ধর্মকে অতিক্রম করে মানুষ নির্বিশেষে মানবধর্মে পৌঁছেছে। মানুষ একজনের জন্য নয়, একটি নারীকে বা একটি পুরুষকে পাবার জন্য নয়, সকল মানুষকে আপনার বলে পাবার জন্য।
শুধু রেভারেন্ড কৃষ্ণেন্দু গুপ্ত সে নয়। সে ক্রিস্টান, সে ভারতীয় সন্ন্যাসী। রেভারেন্ড কৃষ্ণস্বামী। যে ঈশ্বরকে উপেক্ষা করার জন্য রিনা তাকে ভয় করেছিল, সে ঈশ্বরকে তাকে পেতে হবে। তাকে খুঁজেছে। তার সন্ধান সে পেয়েছে।
মানুষের বস্তুময় দেহের মধ্যে তাকে তপস্যারত দেখেছে।
চিদ্বিভ্রান্তিকর মহাসত্তা। বিরাট মহাসত্তায় উপনীত হবে মানুষ। শুদ্ধ পবিত্র মমতায় কোমল, সত্যে নিৰ্মল, প্ৰেমে পরিশুদ্ধ অহিংস। এই যুদ্ধের মধ্যেও সে তপস্যাকে ড়ুবিয়ে নিঃশেষ করতে পারে নি। তামসীর মত সে তাকে গ্রাস করতে গিয়েও পারছে না।
বিচিত্র বিস্ময় এই যে, তাকে সেই ঈশ্বরসন্ধানী দেখেই সেই রিনা আজ ভয় পেল; সঙ্কুচিত হয়ে গেল, হিংস্র হয়ে উঠল মানুষ দেখে সরীসৃপের মত।
আশ্চর্য, সেই নির্মল আলোকসন্ধানী রিনা, আজ ওই যুদ্ধের মধ্যে যে উন্মাদিনী তামসী। নিজেকে প্রকট করেছে, সে গ্রাস করতে চায় সমস্ত তপস্যাকে, হত্যা করতে চায় ঈশ্বরকে, সেই তামসীর সে ক্রীতদাসী, ক্রীড়াসঙ্গিনী, প্রেতিনী। হয়ত বা তারই প্রতীক। হে ভগবান! ওহ্ গড!
রিনা হঠাৎ জিপের গর্জনে তাঁর চিন্তাসূত্র ছিন্ন হয়ে গেল! জিপ! তিনি ত্রস্ত হয়ে পড়লেন। জিপের সঙ্গে রিনার অস্তিত্ব যেন মনের মধ্যে জড়িয়ে গিয়েছে। বিদ্যুৎ চমকের সঙ্গে মেঘগর্জনের মত। তিনি উঠে পড়লেন। হঠাৎ নজরে পড়ল জোড়-বাংলা মন্দিরের মাথায় মিলিটারি পোশাক পরা কারা ঘুরছে, দেখছে বাইনোকুলার দিয়ে। প্রমোদভ্রমণ আর উল্লাস, উচ্ছৃঙ্খলতা আর উন্মত্ততা। তামসী রিনা সঙ্গে আছে। নিশ্চয়। ভয়ার্কের মত কৃষ্ণস্বামী উঠলেন। পাকা রাস্তায় নয়। মাঠে মাঠে এসে বনের পথ ধরে।
হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন।
রিনা তার ঈশ্বর তাকে দিয়ে নিজের জীবনে নিঃস্ব হয়ে গেল কি–তার অবিশ্বাস—তার রিক্ততার তিক্ততায় হাহাকারে–ভয়ঙ্করতায়?