মমিন ট্রেন থেকে নামল ঘোর বৃষ্টিতে। তার হাতে একটা সুটকেস, ট্রেনে দুটা প্রকান্ড বোচকা পড়ে আছে–নামাতে হবে। তার একার পক্ষে নামানো সম্ভব না। সে নেমেছে কুলীর সন্ধানে। নেমেই সে তার বোকামী টের পেল। এইসব গ্রামের মায়ে খেদানো, বাপে তাড়ানো টাইপ ষ্টেশনে কুলী থাকার কোন কারণ নেই। কুলী কুলী বলে চেঁচামেচি করতে করতে ট্রেন ছেড়ে দেবে। গার্ড সাহেব জানালা দিয়ে মাথা বের করে ফেলেছেন।
মমিন সুটকেস প্লাটফরমে নামিয়ে আবার ট্রেনে উঠল। মন পড়ে রইল প্লটফরমে। স্যুটকেস কেউ নিয়ে পালিয়ে যাবে নাতো। কাপড় চোপড় যা আছে সবই স্যুটকেসে।
আমি জীবনকৃষ্ণ মেমোরিয়াল হাই স্কুলের হেড মাষ্টার। ফজলুল করিম। আপনার জিনিসপত্র কি আছে দিন।
মমিন এক ঝলক তাকিয়ে দেখল। সৌজন্য আলাপ পড়ে হবে আগে মালপত্র নামানো যাক। মমিন বলল, স্যার এই পুটলিটা একটু ধরুন।
বেঞ্চের নীচ থেকে পুটলি টেনে বের করা যাচ্ছে না। এমন ওজন।
ফজলুল করিম সাহেব বিস্মিত হয়ে বললেন, কি আছে এর মধ্যে?
স্যার বই।
ফজলুল করিম সাহেব সঙ্গে সঙ্গে তৃপ্তির হাসি হাসলেন। যে শিক্ষকের এত বই সে ভাল শিক্ষক না হয়েই যায় না। তিনি মনে মনেই বললেন–গুড, ভেরী গুড।
মমিন বলল, ট্রেন কি ছেড়ে দিচ্ছে স্যার?
ছাড়লেও নামতে পারবেন। গ্রামের ষ্টেশন চলন্ত ট্রেনেই লোকজন ওঠানামা করে।
একটা পুটলি বের হয়েছে। মমিন দ্বিতীয় পুটলি ধরে টানাটানি করছে। ফজলুল করিম বললেন, এর মধ্যেও কি বই?
জ্বি স্যার।
ফজলুল করিম সাহেব আবারো মনে মনে বললেন, গুড ভেরী গুড। ছেলেটি লম্বা, অতিরিক্ত রকমের রোগা, ভাবভঙ্গি দেখে মনে হয় রাগী হবে। হোক। রাগী শিক্ষকই ভাল। ছাত্ররা ভয় পাবে। ভয়ের সঙ্গে শিক্ষার সম্পর্ক আছে। অদির করে কোলে বসিয়ে শিক্ষা হয় না। প্রাচীন কালে গুরুগৃহে কঠিন শাসন ছিল।
স্কুল স্টেশন থেকে কতদূর?
আছে সামান্য দূর। পাঁচ মাইলের কম।
যাব কি ভাবে?
আগে রিকশায় যাওয়া যেত। বর্ষা শুরু হওয়ায় রিক্সা বন্ধ। হেঁটেই যাতায়াত করতে হয়।
বলেন কি?
রোজ রোজতো আর স্টেশনে আসা হয় না।
ট্রেন ছেড়ে দিয়েছে। বাইরে ঝুম বৃষ্টি। ফজলুল করিম নতুন সায়েন্স টিচারকে নিয়ে স্টেশনের পাশের টি স্টলে চা খেতে ঢুকেছেন। বৃষ্টি না ধরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। একটা মাত্র ছাতা। দুজন এই ছাতায় কুলুবে না। ফজলুল করিম সাহেব লক্ষ্য করলেন নতুন টিচার বেশ আগ্রহ নিয়ে বৃষ্টি দেখছে। নিশ্চয়ই শহুরে ছেলে। গ্রামের বর্ষা দেখেনি। শহুরে ছেলে হলেই ভাল। এরা গ্রাম পছন্দ করে। হয়ত স্কুলে টিকে যাবে। গ্রামের শিক্ষিত ছেলেপুলেদের গ্রাম বেশী অপছন্দ। তারা শুধু খুঁজে শহর।
ফজলুল করিম ঝুঁকে এসে বসলেন, আপনি কি গ্রামে ছিলেন কখনো?
জ্বি-না।
তাহলে ভাল লাগবে। পল্লীগ্রামের বর্ষা সুন্দর।
স্কুলটা কেমন?
স্কুলটাও সুন্দর। প্রাচীন স্কুল।
সেই সুন্দর জানতে চাচ্ছি না। বেতন টেন রেগুলার পাওয়া যাবে? শুনেছি গ্রামের স্কুলের বেতন খুবই অনিশ্চিত ব্যাপার?
ফজলুল করিম সাহেব জবাব দিলেন না। চা খাবার ব্যাপারে অতিরিক্ত মনোযোগী হয়ে পড়লেন। স্কুলের অবস্থা শুধু যে ভাল না, তাই না–স্কুলের অবস্থা শোচনীয়। এই খবর দিয়ে শুরুতেই ভড়কে দেবার দরকার কি?
স্যার কিছু বলছেন না যে স্কুলের অবস্থা কেমন?
আছে মোটামুটি। তবে ইনশাআল্লাহ্ অবস্থা ভাল হবে।
কি ভাবে ভাল হবে?
স্কুলের নাম ডাক ছড়ালেই ছাত্র আসতে থাকবে।
মমিন বিস্মিত হয়ে বলল, ছাত্র সব চলে গেছে নাকি?
না না তা না। আসুন বৃষ্টি কমেছে, রওনা দেয়া যাক। জিনিস পত্র থাকুক, পরে নোর ব্যবস্থা করব।
আমার থাকার ব্যবস্থা কোথায় হয়েছে?
আপাতত ইরতাজউদ্দিন সাহেবের সঙ্গে থাকবেন। অতি সজ্জন। আরবী এবং ইসলামিয়াতের শিক্ষক। খাওয়া দাওয়া উনার এখানে থাকা খাওয়ার কোন খরচ নাই।
কেন?
পল্লীগ্রামতো–এখানে শিক্ষকদের খুব মর্যাদা। সভ্রান্ত ব্যক্তিরা নিজেদের বাড়িতে শিক্ষকদের রাখেন। আদর যত্ন করেন।
জায়গীর? বিনিময়ে প্রাইভেট টিউশনি?
অনেকটা সে রকমই। তবে আপনাকে ছাত্র পড়াতে হবে না।
মামুন হতাশ গলায় বলল, কিছু মনে করবেন না স্যার অবস্থাতো আমার কাছে মোটেই সুবিধার মনে হচ্ছে না। মনে তো হচ্ছে পেটে ভাতে চাকরি।
সরকারী ডি এ আছে। ছাত্রদের কাছ থেকে কিছু কালেকশন হয়। বাজার কমিটির চাঁদা…. তাছাড়া পল্লীগ্রাম খরচও তো তেমন নেই।
আবার ঝেঁপে বৃষ্টি এসেছে। একটা ছাতায় বৃষ্টি মানছে না। মামুন বলল, ছাতা বন্ধ করে ফেলুন স্যার। আধাভেজা হয়ে যাবার চেয়ে পুরোপুরি ভিজে যাওয়াই ভাল। আমারতো বৃষ্টিতে ভিজতে ভালই লাগছে।
ফজলুল করিম সাহেব স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। নতুন সায়েন্স টিচার টিকে যাবে বলে মনে হচ্ছে। এমন ঘন বর্ষণে ভিজতে যার খারাপ লাগছে না তার হয়ত কোন কিছুতেই খারাপ লাগবে না। কোন সায়েন্স টিচারই এই স্কুলে টিকে না। গত একবছরে তিনজন চলে গেল।
মামুন সাহেব।
জ্বি স্যার।
আপনার রেজাল্টতো খুব ভাল। এমএসসিতে ফার্স্ট ক্লাশ। গ্রামের স্কুলে আসতে রাজি হলেন ব্যাপারটা কি?
ইচ্ছা করেই রাজি হয়েছি। গ্রামের দিকে থাকব নিরিবিলিতে পড়াশোনা করব। আমি বি সি এস দিচ্ছি। বই পত্র নিয়ে এসেছি।
ও আচ্ছা। বি সি এস পাশ করলে চলে যাবেন।
অবশ্যই। তবে যে কদিন আমি থাকব–ঠিকমতই থাকব। আমি ভাল শিক্ষক।
করিম সাহেবের মন খারাপ হয়ে গেল। এও থাকবে না। ভাল স্কুলের পূর্ব শর্ত হল ভাল শিক্ষক। দালান কোঠায় স্কুল হয় না। স্কুল হয় শিক্ষকে। মামুন বলল, ঠাণ্ডায় কাহিল হয়ে পড়েছি। স্যার যদি অনুমতি দেন একটা সিগারেট ধরাই।
অবশ্যই অবশ্যই সিগারেট ধরাবেন এতে কি। আপনি আমার সহকর্মী।
সহকর্মী হলেও আপনি বয়োজৈষ্ঠ। স্যার কি ধুমপান করেন?
জ্বি–না আগে করতাম। হঠাৎ এক সময় মনে হল ছাত্ররাই শিক্ষকদের দেখে শিখবে। আমাকে দেখে যদি সিগারেট খাওয়া শিখে সেটা ঠিক হবে না। ছেড়ে দিলাম।
বলেন কি?
মাঝে মধ্যে খাই না যে তা না–হঠাৎ হঠাৎ খাই।
স্যার, এখন কি একটা খাবেন। আশে পাশে ছাত্র নেই–কেউ দেখবে না।
না না। ইচ্ছা করছে না।
ইচ্ছা করলেও পারবেন না। এই বৃষ্টির মধ্যে সিগারেট না ভিজিয়ে খাওয়া সহজ কর্ম না। শুধু প্রফেশনালরা পারবে। হা হা হা হা।
করিম সাহেব বিস্মিত হয়ে নতুন সায়েন্স টিচারের হাসি শুনছেন। এমন প্রবল হাসি হাসার মত কি ঘটনা ঘটেছে তাও তিনি বুঝতে পারছেন না।
মামুন সাহেব।
জ্বি স্যার।
ব্যাঙের ডাকের ইংরেজী জানেন না-কি?
মামুন বিস্মিত হয়ে বলল জ্বি–না জানি না। ব্যাঙের ডাকের ইংরেজী দরকার কি?
মামুন এই প্রথম হেডমাষ্টার সাহেবকে ভালমত লক্ষ্য করল। পাঁচ মাইল হেঁটে ইনি তাকে নিতে এসেছেন। এতক্ষণ ব্যাপারটা তার কাছে গুরুত্বপূর্ণ মনে হয় নি, এখন মনে হচ্ছে। স্কুলের দপ্তরীকেও তো উনি পাঠাতে পারতেন। বৃদ্ধ বয়স্ক একজন মানুষ ঝড় বৃষ্টির দিনে এতটা কষ্ট করবেন কেন? স্বার্থ ছাড়া মানুষ সচরাচর কষ্ট করতে রাজি হয় না। এই মানুষটার স্বার্থ কি?
মামুন বলল, আর আপনি নিজে আমাকে নিতে এসেছেন কেন? কোন দরকার ছিল না।
করিম সাহেব কিছু বললেন না। তাঁর মাথায় ব্যাঙের ডাকের ইংরেজী কি সেটাই ঘুরছে। বয়সের লক্ষণ। বেশী বয়সে মাথায় কিছু ঢুকে গেলে সেটা বেরুতে চায় না। প্যাচ কেটে যাওয়া রেকর্ডের মত এক জায়গায় বাজতে থাকে।
স্যার আপনার স্কুলের ছাত্র কতজন?
একশ তেইশ। আগামী কাল একজন ভর্তি হবে–একশ চব্বিশ হবে।
স্যার কিছু মনে করবেন না–ব্যক্তিগত কৌতুহল থেকে প্রশ্নটা করছি আপনি কি এই একশ চব্বিশ জন ছাত্রের নাম জানেন?
ফজলুল করিম সাহেব তৎক্ষণাৎ বললেন, জানি।
মামুন সিগারেট ফেলে দিতে দিতে বলল, আমিও এ রকমই অনুমান করেছিলাম।