মফিজুদ্দিনের গোয়ার্তুমির ওপর চন্দ্রভানের হস্তক্ষেপ-ক্ষমতা সম্পর্কে সুহাসিনীর লোকেরা প্রথম জানতে পারে দুলালির মৃত্যুর পর এবং এতে তাদের একধরনের বিস্ময় ও আরাম বোধ হয়, তারা বলে যে, চন্দ্রভান আর মাত্র একবার, পূর্ণিমা রাতে তাদের মৃত্যুর কিছু দিন আগে, এই ক্ষমতা প্রয়োগ করে। গ্রামের কৃষকেরা এই এলাকার ভাষায় বলে যে, সুহাসিনীতে ধূসর দিন এবং অন্ধকারময় রাতের ভেতর, গ্রামের চার কোনায় লাগানো চারটি তালগাছের দীর্ঘ ছায়ার মতো মফিজুদ্দিনের অস্তিত্ব টিকে থাকে; কিন্তু তারা বলে, তাইলেও দিন তো বইস্যা থাহে না বাপু, দিন বদলায়া যায়, মানুষও বদলায়া যায়, যদিও মনে হয় যে কিছুই বদলায় নাই। তারা বলে যে, মফিজুদ্দিনের অজর অস্তিত্ব সত্ত্বেও পরিবর্তন এসেছিল, সময় পাল্টে গিয়েছিল বোধহয়; কারণ, পরবর্তী সময়ে তারা যখন এই সময়ের দিকে তাকায়, তারা দেখতে পায় যে, সুরধ্বনি গ্রামের খায়েরা তাদের জীবনের আকাঙক্ষার বিষয়ে ক্রমান্বয়ে সুনির্দিষ্ট হয়ে ওঠে, এবং তারা মফিজুদ্দিন মিয়ার সঙ্গে তাদের সম্পর্কের ক্ষেত্রেও পূর্বেকার দ্বিধা এবং একধরনের ভয়ের প্রবণতার বাইরে এসে দাঁড়ায়। সুহাসিনীর লোকেরা এইসব পরিবর্তন নীরবে অবলোকন করে, মফিজুদ্দিন এবং তার পরিবারের সদস্যরা যে দিন নিহত হয় তার কিছুদিন আগে রায়গঞ্জকে উপজেলায় রূপান্তর করার হয় এবং গ্রামের লোকেরা জানতে পারে যে, উপজেলা পরিষদে একজন নির্বাচিত চেয়ারম্যান অধিষ্ঠিত হবে এবং সেই চেয়ারম্যান অন্যান্য ক্ষমতা ও অধিকারের ভেতর সেই জিপটির দখল পাবে, যে জিপে চড়ে পরবর্তী সময়ে একদিন উপজেলার নির্বাহী অফিসারের কন্যা জান্নাত আরা ধানঘড়া স্কুলের ছাত্রদের সামনে ধুলো উড়িয়ে চলে যায়। সে সময়, যখন উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচন এবং মফিজুদ্দিনের এই চেয়ারম্যান হওয়ার আকাক্ষার কথা গ্রামের লোকেরা শোনে, তারা বুঝতে পারে যে, মফিজুদ্দিনই চেয়ারম্যান হবে; তখন জিনিসটি জটিল হয়ে ওঠে এবং তারা যখন এই খবরটি ক্রমাগতভাবে জানতে পারে যে, খাঁ বাড়ির ইদ্রিস খাও এই নির্বাচনে দাঁড়াবে, তারা এই সমস্যাটির সমাধান বুঝতে পারে না; তবে তারা এ রকম ভাবে যে, ইদ্রিস যার ব্যাপারে মফিজুদ্দিন একটা বিহিত নিশ্চয়ই করবে। সুহাসিনীর লোকেরা বলে যে, সময়ের বদলের বিষয়ে সচেতন হলেও, মফিজুদ্দিন বদলাতে পারে, এ কথা তারা কখনো ভাবতে পারে নাই। উপজেলা পরিষদের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে খাদের পুরনো জড়তা কেটে যাওয়ার ঘটনা নীরবে অবলোকন করার সময় তারা একধরনের প্রতীক্ষার ভেতর ছিল; তারা ভেবেছিল যে, মফিজুদ্দিনকে পুনরায় পুরনো চেহারায় দেখা যাবে এবং সময়ের পরিবর্তন সত্ত্বেও অনেক বছর আগের সেই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটবে, যখন সত্তর দশকের প্রথম দিকে গ্রামের লোকেরা একবার শুনতে পেয়েছিল যে, সুরধ্বনি গ্রামের আফজাল খা, ব্রহ্মগাছা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হতে চায় এবং তখন একদিন পরিচিত পুরনো মফিজুদ্দিন মিয়া প্রকাশিত হয়; বিকেলের আলোয় গ্রামের লোকেরা তাকে লুঙ্গির ওপর সাদা পাঞ্জাবি পরে, লাঠি হাতে সুরধ্বনি গ্রামের দিকে যেতে দেখে। সেদিন মফিজুদ্দিন কিছুদূর যাওয়ার পর যখন বুঝতে পারে যে, তার নাতি ফৈজুদ্দিন তার পেছনে আসছে, সে খেপে গিয়ে প্রথমে ফৈজুদ্দিনকে তাড়া করে বিতাড়ন করে তারপর একা খাদের ভিটায় গিয়ে ওঠে। সুহাসিনীর লোকেরা এই সব বিবরণ পরে বিস্তারিত জানতে পারে; তারা বলে যে, মফিজুদ্দিন যখন আফজাল খার বাড়িতে যায়, তাকে দেখে আফজাল খাঁ খুবই বিচলিত হয়ে পড়ে এবং তাকে এই বলে আশ্বস্ত করে যে, সে তার বাপের বন্ধু, তার এবং গ্রামের সকলের সম্মানের পাত্র, সে বেঁচে থাকতে তার ব্রহ্মগাছা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হওয়ার কোনো চিন্তাই হয় না, সে মেম্বার হয়েই খুশি। তারপর সেদিন মফিজুদ্দিন যখন সুরধ্বনি থেকে ফেরে তখন রাত নেমে যায় এবং সে সময় সুহাসিনীতে যারা তাদের বাড়ির প্রাঙ্গণে এবং পথের ধারে ছিল তারা দেখেছিল যে, হারিকেন হাতে আলো দেখিয়ে জরাজীর্ণ মফিজুদ্দিন মিয়াকে আফজাল খাঁ মিয়াবাড়ির ভিটার গোড়া পর্যন্ত পৌঁছে দেয়। সে রাতে সুহাসিনীর এই প্রত্যক্ষদর্শী কৃষকেরা দীর্ঘক্ষণ জেগে থেকে থেলো হুঁকোয় তামাক সেবন করে এবং তাদের গল্পের ভেতর এ রকম বলতে থাকে যে, এই ভূখণ্ডে কেউ ব্ৰহ্মগাছা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হতে চাইলে তাকে মফিজুদ্দিনের বয়স এক শ এগার বছর না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে; শালার ব্যাটার যে খাই, আর যে জিদ, তারা বলে, এবং তারা এই সব আচরণ দর্শনে বিহ্বল হয়ে থাকে। পরবর্তী সময়ে সুহাসিনীর কৃষকেরা পুনরায় যখন একধরনের অপেক্ষার ভেতর দিন কাটাচ্ছিল তখন তারা একসময় এ রকম মনে করতে থাকে যে, মফিজুদ্দিনের বদল হোক বা না হোক, সময়ের বদল হয়েছে; এবং তারা দেখে যে আফজার খার ক্ষেত্রে মফিজুদ্দিন যা করেছিল, ইদ্রিস খার ক্ষেত্রে সে তা করতে পারে না। মফিজুদ্দিন এই কথা ঘোষণা করে যে, সে উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচনে প্রার্থী হবে এবং সে এই কথা বলে যে, সে বিশ্বাস করে সে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছাড়াই নির্বাচিত হবে; কিন্তু এবার সে বহু বছর পূর্বের মতো লাঠি হাতে সুরধ্বনির খাঁ বাড়ির দিকে তাড়া করে যায় না; গ্রামের লোকেরা বলে যে, মফিজুদ্দিন তার প্রতিক্রিয়ার পদ্ধতি পরিবর্তন করলেও তার মূল প্রকৃতি একই থেকে যায়, সে এবার আফজাল খাঁর এবং তার ছেলে ইদ্রিস খাঁর সঙ্গে বৈঠকে বসে। গ্রামের লোকেরা বলে যে, মফিজুদ্দিন না বদলালেও আসলে হয়তো বদলে ছিল, কারণ, লাঠি হাতে তাড়া করে যাওয়ার বদলে বৈঠকে বসা একটি পৃথক জিনিস ছিল; তখন গ্রামের লোকেরা মিয়াবাড়ি এবং বাড়ির বৈঠকখানায় আলোচনা হতে দেখে, কিন্তু গ্রামের লোকেরা বলে যে, কথাবার্তা বলতে চাওয়ার দ্বারা মফিজুদ্দিন মূলত নিজের কথাটিই পরিষ্কার করে জানিয়ে দিতে চেয়েছিল, ফলে তা প্রায় একতরফা হয়ে যায়; এইসব বৈঠকের সময় সে তার একরোখামি ধরে রাখে এবং ইদ্রিস খাকে বলে যে, সে উপজেলা চেয়ারম্যান হবেই, এবং ইদ্রিস খা চাইলে পরে এমপি হতে পারে, আমি বাপু উপজেলা চিয়্যারম্যান হমুই, সে বলে, তুমি নমিনেশন দিয়ো না, দিলে শান্তি পাইব্যা না; এবং সে একই সঙ্গে নয়নতারা হাটের পুরনো কড়ইগাছ তলায় গিয়ে দাঁড়ায় এবং চারদিকের লোকদের প্রতি হাত প্রসারিত করে দিয়ে তার দিকে ডেকে আনে এবং বলে, আমি কি এই গেরাম আর এই রায়গঞ্জের নেইগা আমার সারাটা জীবন খরচ করি নাই? সুহাসিনীর লোকেরা বুঝতে পারে যে, উত্তর পাওয়ার জন্য মফিজুদ্দিন তাদেরকে এই প্রশ্ন করে না, তারা বুঝতে পারে যে, এই প্রশ্নের উত্তর তাদের জানাও নাই; তখন তাদের ফাঁকা দৃষ্টির দিকে তাকিয়ে মফিজুদ্দিন বলে, সারা জীবন তোমাগোরে সঙ্গে আছি, সারা জীবনই থাকমু। কিন্তু আফজাল খাঁর ছেলে ইদ্রিস খা, পিতার মতো দ্রুত আত্মসমর্পণ করে না, বস্তুত সে কখনোই আত্মসমর্পণ করে না এবং গ্রামের লোকেরা বলে যে, মফিজুদ্দিন মিয়াই পরিশেষে হার মানে তাও না, পূর্ণিমার রাতে হয়তো কোনো রকম অনুতাপ ছাড়াই সে ধ্বংস হয়ে যায়। নির্বাচনের বিষয়টি যখন খুব উত্তপ্ত হয়ে ওঠে তখন ইদ্রিস খাঁর পরিবার মফিজুদ্দিনের নিরক্ষরতার বিষয়টিকে বড় করে তোলে, মফিজুদ্দিন তখন তার ছেলেদের তলব করে ডেকে বাড়ির ভেতর পরামর্শ সভায় বসে এবং সুহাসিনীর লোকেরা জানতে পারে যে, নিজের ছেলে এবং নাতিদের সঙ্গে এই পরামর্শের সময় মফিজুদ্দিন জায়গা ছেড়ে দেয়ার মৌলিক প্রশ্নটির মুখোমুখি হয়; কারণ, সময় বদলের বিষয়টি তার নিজের পরিবারের ভেতর থেকে তখন তার সামনে আসে। সুহাসিনীর লোকেরা বলে যে, মফিজুদ্দিন মিয়ার পরিবারের ভেতর, তার দশ নম্বর ছেলে আব্দুল আজিজ তার উত্তরসূরি হওয়ার আকাঙক্ষায় ক্রমাগতভাবে বিকশিত হয়েছিল এবং উপজেলা পরিষদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে সুরধ্বনির খাঁদের সঙ্গে যখন সংকট দানা বাঁধে এবং মফিজুদ্দিনের নিরক্ষরতার বিষয়টি নির্বাচনী প্রসঙ্গ হয়ে ওঠে, তখন বাপের সঙ্গে পরামর্শ সভায় বসে, চান্দাইকোনা কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের শিক্ষক আব্দুল আজিজের মনে হয় যে, মফিজুদ্দিনের বয়স এক শ এগারো বছর না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করার মানে হয় না। সে তখন এই প্রস্তাব করে যে, তার পিতার উচিত এই নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানো এবং তার বদলে পরিবার থেকে এমন একজনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা উচিত যে হবে ইদ্রিস খাঁর সমকক্ষ অথবা তার চাইতে যোগ্য। আব্দুল আজিজ নিজের নাম নিজে না বললেও ব্যাপারটা বুঝতে পার যায় এবং এই প্রস্তাবে মফিজুদ্দিন ভয়ানক ক্ষিপ্ত এবং তার ছেলেরা বিভ্রান্ত ও বিভক্ত হয়ে পড়ে। মিয়াবাড়ির অভ্যন্তরীণ বিভেদ ক্রমাগতভাবে প্রলম্বিত হলে চন্দ্রভানের সবচাইতে বেশি সংকট হয় এবং এই বিপদের নবম দিনে মিয়াবাড়ির ভেতর যখন একাধিক রান্নাঘর তৈরি শুরু হয় তখন চন্দ্রভান শাঁখের করাতের দুধারি টানে দ্বিখণ্ডিত হতে থাকে, তার কথা তার স্বামী এবং সন্তানেরা শোনে না; সে সারা দিন যখন না খেয়ে থাকে তাতেও কেউ বিচলিত হয় না, তখন অভুক্ত এবং মর্মপীড়িত চন্দ্রভানের অস্তিত্ব পুরাতন বিভ্রান্তিতে ফিরে যায়। পরদিন সকালে খালের কিনারায় যখন অজ্ঞান এবং নগ্নাবস্থায় উপুড় হয়ে পড়ে থাকা চন্দ্রভানকে আবিষ্কার করা হয় তখন মফিজুদ্দিন তার ছেলেদের পুনরায় ডেকে জড়ো করে এবং গ্রামের লোকেরা এই বিষয়টি জানতে পারে যে, মফিজুদ্দিন মিয়া পুত্রের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। এই ঘটনার দুদিন পর মিয়াবাড়ির বৈঠকখানায় পুনরায় এক সভা হয়, আফজাল খ এবং তার ছেলে ইদ্রিস খাঁ সেদিন রাতে মফিজুদ্দিন এবং তার ছেলেদের সঙ্গে খাবার গ্রহণ করে এবং তারপর তারা এক আলোচনায় বসে; এই আলোচনার সময় মফিজুদ্দিন মিয়া আফজাল খাকে বলে যে, সে তাদের এই দাবি মেনে নিচ্ছে যে, সে উপজেলা চেয়ারম্যান হওয়ার জন্য দাঁড়াবে না; এবং এরপর সে দুটো প্রস্তাব দেয়, এক, তার ছেলে আব্দুল আজিজ উপজেলা চেয়ারম্যান হবে, এবং দুই, এই এলাকার এমপি নির্বাচন যখন আসবে তখন ইদ্রিস খা এমপি হবে। আফজাল খাঁ এবং ইদ্রিস খা এই প্রস্তাব বিবেচনা করার কথা বলে শেষ পানের খিলি মুখে পুরে চলে যায়। কিন্তু তাদের উত্তর দেয়ার কোনো খবর সুহাসিনীর লোকেরা শুনতে পায় না, তারা যখন রুদ্ধশ্বাস হয়ে অপেক্ষা করে এবং বলে যে, ইদ্রিস খার আর কিছু করার নেই, মফিজুদ্দিন মিয়ার কথা এবার তাকে শুনতেই হবে, তখন, মনোনয়নপত্র দাখিলের দিনের এক সপ্তাহ আগে মফিজুদ্দিন এবং তার পরিবারের সকলে অজ্ঞাত আততায়ীদের হাতে নিহত হলে সুহাসিনীর লোকেরা বলে যে, এবার সম্ভবত তারা ভোট দিতে পারবে। কিন্তু কালক্রমে তারা দেখতে পায় যে, সুহাসিনীতে এবং রায়গঞ্জে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতার নির্বাচন অব্যাহত থাকে, ইদ্রিস খা উপজেলা চেয়ারম্যান হয় এবং তার বৃদ্ধ পিতা আফজাল খা হয় ব্রহ্মগাছা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান। তারপর তারা সুহাসিনীর প্রাইমারি স্কুলের মাঠে একদিন বিরাট সভা করে, সুহাসিনীর লোকেরা বলে যে, গ্রামের ভেতর এ রকম কাণ্ড তারা এর আগে আর হতে দেখে নাই; এই সভায়, বড় আকারের চৌকির ওপর ছোটো চৌকি পেতে উঁচু করে মঞ্চ বানানো হয় এবং এই মঞ্চের ওপর চড়ে বসে বৃদ্ধ আফজাল খাঁ এবং তার দুই ছেলে ইদ্রিস খা এবং রংপুর ক্যান্টনমেন্টের ব্রিগেডিয়ার ইলিয়াস খা। সুহাসিনীর যারা তামাশা দেখার জন্য সেদিন বিছানার চাদর দিয়ে ঢাকা মঞ্চের সামনে বসেছিল তারা বলে যে, আফজাল খাঁ এবং তার দুই ছেলে ক্রমাগতভাবে খালি মফিজুদ্দিনের কথাই বলে; তারা গ্রামের লোকদের এই কথা বলে যে, মফিজুদ্দিনের অত্যাচারের দিন এখন শেষ হয়ে গেছে এবং এখন সুহাসিনীতে, ব্রহ্মগাছায় এবং রায়গঞ্জে শুরু হয়েছে নূতন যুগের। সুহাসিনীর লোকদের তখন সিরাজগঞ্জ জেল থেকে বের হওয়ার পর ইদ্রিস খাঁ যখন প্রথম সুহাসিনীতে আসে সেই দিনটির কথা মনে পড়ে, সেদিন নয়নতারা হাটের কড়ইগাছ তলায় দাঁড়িয়ে ইদ্রিস খাঁ একই কথা বলেছিল; সেদিন সে ক্রমাগতভাবে বলেছিল যে, পুরনো দিন এখন আর নাই এখন নূতন সময়ের শুরু হবে, এবং সে ক্রমাগত মফিজুদ্দিনের অনাচারের বর্ণনা দেয় এবং বলে যে, নয়নতারা হাটের নাম হবে রসুলপুরের হাট; কিন্তু আশপাশের কোনো গায়ের নাম রসুলপুর না হওয়ায় তাকে ঘিরে দাঁড়ানো গ্রামের লোকদের বিভ্রান্তি হয় এবং হাটের নাম নয়নতারার হাটই থেকে যায়। কিন্তু গ্রামের লোকেরা বলে যে, ইদ্রিস খাঁ নয়নতারা হাটের কথা ভোলে না, পরবর্তী সময়ে সুহাসিনীর প্রাইমারি স্কুলের মাঠে পিতা এবং দুই পুত্র যেদিন সভা করে, সেদিন এই হাটের নামের প্রসঙ্গটি পুনরায় আসে, ইদ্রিস খাঁ পুনরায় বলে যে, একটি গণিকার নামে হাটের নামকরণ ছিল মফিজুদ্দিনের কুরুচির একটি নমুনা; সে বলে যে, এই হাটের নাম হবে রসুলপুরের হাট এবং সুহাসিনীর হাটের নাম রসুলপুরের হাট হতে না পারলে, সুহসিনীর নাম হবে রসুলপুল; তখন গ্রামের লোকেরা অনুভব করে যে একটা অচেনা অদেখা মেয়ের নাম কেমন করে একটি গ্রামের অন্তর্গত প্রসঙ্গের সঙ্গে জড়িয়ে যায়। তাদের এই গল্পের কথা মনে পড়ে যে, মফিজুদ্দিন এই হাটের নামকরণের পর বলেছিল, নয়নতারা আমার পীরের নাম, সে আমাক কইছিল, তুমি মুসলমান, না হিন্দু? ভয় পায়ো না, আল্লাহ্ নবির নাম নেও, ভয় পায়ো না ভগবানের নাম নেও; এবং এই কথা মফিজুদ্দিনের মুখে সুহাসিনীর লোকেরা বহুভাবে শুনতে পায়।
একাত্তর সনের মার্চ মাসে জনতা এবং সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালি সেনাদের আক্রমণের মুখে বগুড়া এবং সিরাজগঞ্জে পাকিস্তান বাহিনীর প্রাথমিক পতনের পর, এপ্রিলে মাঝামাঝি সময়ে তারা পুনরায় সংগঠিত হয় এবং নিজের শক্তি বৃদ্ধি করে রংপুর ক্যান্টনমেন্ট থেকে ক্রমাগতভাবে দক্ষিণ দিকে নেমে আসতে থাকে; এপ্রিলের ২২ তারিখে অগ্রসরমাণ এই বাহিনীর কাছে বগুড়া শহরের পতনের খবর যখন সুহাসিনীতে প্রচারিত হয়, সুহাসিনীর লোকেরা নির্বাক উত্তেজনায় স্তব্ধ হয়ে থাকে। মফিজুদ্দিনের তিন ছেলেসহ গ্রামের ১৮ জন যুবক তখন লুঙ্গি মালকোঁচা মেরে কাঁধের ওপর রাইফেলের মতো একটুকরো বাঁশ নিয়ে প্রাইমারি স্কুলের মাঠে কুচকাওয়াজ করে এবং এই সমূহ হুমকির মুখে তখনো গ্রামের চার কোনার তালগাছের মাথায় লাল সূর্যের ভেতর সোনালি মানচিত্র খচিত সবুজ রঙের পতাকা ওড়ে। বগুড়া থেকে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী সব প্রতিরোধ ভেঙে অদ্রুিত এগিয়ে আসে এবং এপ্রিলের ২৬ তারিখে তারা ধানঘড়ার উল্টোদিকে করতোয়া নদীর পশ্চিম তীরে ঘাঁটি গাড়ে। তখন সুহাসিনীর লোকেরা মোটামুটি কাছ থেকে দেখে এই যুদ্ধের প্রকৃতিটা বুঝতে পারে, তারা বুঝতে পারে যে, এই যুদ্ধ খালি হাত এবং বাঁশের লাঠির যুদ্ধ ছিল না। ধানঘড়ার এই ঘাঁটি থেকে পাকিস্তানি বাহিনী সারা দিন এবং সারা রাত সিরাজগঞ্জ শহরের দিকে ভারি কামানের গোলা বর্ষণ করতে থাকে। সেদিন নিক্ষিপ্ত প্রথম গোলাটি যখন সুহাসিনীর ওপর দিয়ে একটি অশুভ শক্তির মতো শিস দিয়ে উড়ে গিয়ে মাটিতে পড়ে, তখন সুহাসিনীর লোকেরা মাটি কাটার কোদালের কোপের মতো একটি ভেতা শব্দ শোনে, তাদের পায়ের তলার মাটি কেঁপে ওঠে এবং মাচার ওপর রাখা বাসন-কোসন ঝন ঝন শব্দ করে। জীবনে এই প্রথম পায়ের নিচের নিশ্চিত মাটি কেঁপে উঠলে গ্রামের লোকেরা দিশেহারা হয়ে পড়ে, তারা ছোটাছুটি করে ঘরের বাইরে ক্ষেতের ওপর নেমে আসে, তারপর যখন ক্ষেত এবং প্রান্তরের মাটিও একইভাবে কাঁপতে থাকে, তখন তারা পুনরায় গিয়ে তাদের ছনের ঘরে ঢোকে; কিন্তু ঘর এবং বার কোথাও নিরাপত্তার সন্ধান করতে না পেরে সারা দিন ক্রমাগত গোলাবর্ষণের শব্দ এবং ঝাঁকানিতে দিশেহার লোকেরা সেই মঙ্গলবার সন্ধ্যার আঘো-অন্ধকারের ভেতর মিয়াবাড়ির ভিটায় এসে জড়ো হয়; তখন মফিজুদ্দিন সাদা পাঞ্জাবি গায় দিয়ে বাড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে আসে, তার পাঞ্জাবির খুঁট সন্ধ্যার অস্থির বাতাসে কাঁপে, এবং বিচলিত গ্রামের লোকেরা যখন তাকে ভয় পাওয়া শিশুর মতো ঘিরে ধরে বলে, এহন কি হবি ম্যাসাব, তখন সে কোনো কথা খুঁজে পায় না; সে সন্ধ্যার অন্ধকারের ভেতর ডুবে দীর্ঘক্ষণ চুপ করে থাকে, তারপর বলে, ভয় পায়ো না, আল্লা-নবির নাম নেও, ভগবানের নাম নেও। তার এই কথা শুনে গ্রামের লোকদের নয়নতারার কথা মনে পড়ে, তাদের নয়নতারা হাটের কথা এবং গ্রামের চার কোনায় লাগানো তালগাছের কথা মনে পড়ে, এবং তাদের তখন প্রবল আতঙ্কের সঙ্গে মনে পড়ে, এই তালগাছের মাথায় ওড়ানো স্বাধীনতার পতাকার কথা। তখন বাঁশের লাঠি হাতে প্রাইমারি স্কুলের মাঠে কুচকাওয়াজকারী ১৮ জন যুবকের ভেতর থেকে ৮ জনকে পাঠানো হয় পতাকাগুলো নামিয়ে আনার জন্য; এক ঘণ্টা পর তারা যখন চারটে পতাকা নিয়ে ফেরে তখনো তারা মিয়াবাড়ির উঠোনে গ্রামের নারী, পুরুষ এবং শিশুদের ভিড় করে বসে থাকতে দেখে। পতাকা চারটি নামিয়ে আনার পর এগুলো কোথায় রাখা হবে সে সমস্যা দেখা দেয়; তখন, যখন এ রকম কথা হতে থাকে যে, পতাকাগুলো এই সময় ঘরে রাখা বিপজ্জনক হতে পারে, এগুলো আপতত পুড়িয়ে ফেলা যাক, মফিজুদ্দিনের চিত্রকর ছেলে, আবুবকর সিদ্দিক বাড়ির ভেতর থেকে একটি পলিথিনের ব্যাগ এবং একটি কোদাল নিয়ে আসে এবং অবিরাম গোলা-বর্ষণের শব্দের ভেতর প্রাইমারি স্কুলের দিকে রওয়ানা হয় এবং লাঠি হাতে কুচকাওয়াজকারী ১৮ জন যুবক নীরব মিছিলের মতো তাকে অনুসরণ করে। সেদিন আবুবকর সিদ্দিক এবং অন্য যুবকেরা পলিথিনের ব্যাগে চারটি পতাকা পুরে প্রাইমারি স্কুলের সামনের কৃষ্ণচূড়া গাছের গোড়ায় মাটি খুঁড়ে পুঁতে ফেলে। সুহাসিনীর লোকদের আট মাস পর ডিসেম্বর মাসের একুশ তারিখের এক হিমেল মঙ্গলবারের কথা মনে পড়ে; সেদিন সুহাসিনীর ১৬ জন যুবক কাধে রাইফেল আর স্টেনগান নিয়ে গ্রাম ফিরে আসে, এদের সঙ্গে মফিজুদ্দিন মিয়ার ছেলে ফরিদ হোসেন এবং আব্দুল আজিজ ফেরে, ফেরে না শুধু চিত্রকর আবুবকর সিদ্দিক এবং সে ফিরে না আসা পর্যন্ত গ্রামের লোকেরা পলিথিনের ব্যাগের ভেতর মাটিতে পুঁতে রাখা পতাকার কথা ভুলে থাকে। গ্রামের লোকেরা বলে যে, সুহাসিনী গ্রামে প্রথম স্বাধীনতার পতাকা ওড়ানোয় আবুবকর সিদ্দিকের ওপর মফিজুদ্দিন অবশেষে খুশি হলেও, বহু বছর পূর্বে সে তার পিতাকে একাধিকবার হতাশ এবং রাগান্বিত করে তোলে। প্রথমে, তার পায়ের পাতা একসঙ্গে করে দাঁড়ালে দুই হাঁটু লেগে না যাওয়ার সুবিধে থাকা সত্ত্বেও সে সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়া সম্পর্কিত তার পিতার ইচ্ছা পূরণ করে না, পরবর্তী সময়ে সে ইঞ্জিনিয়ার, ডাক্তার এসব কিছু হওয়ার চেষ্টা না করে ঢাকায় গিয়ে ছবি আঁকার কলেজে ভর্তি হয়। আবুবকর সিদ্দিক সুহাসিনী ত্যাগ করে ঢাকা চলে যাওয়ার পর দুবছর গাঁয়ের লোকেরা তার সম্পর্কে আর কিছু জানতে পারে না, তার কথা তারা প্রায় ভুলে যায়; এবং গ্রামের লোকেরা বলে যে, তখন একদিন, হেমন্তের কোনো এক বিকেলে তারা যখন মাঠে ধান কাটায় ব্যস্ত ছিল, তাদের কেউ কেউ লক্ষ্মীকোলার ভেতর দিয়ে চারজন শুশ্রুমণ্ডিত যুবককে সুহাসিনীর দিকে হেঁটে আসতে দেখে তাদের প্রত্যেকের কাঁধ থেকে লম্বা ব্যাগ ঝুলে ছিল এবং হাতে ছিল কতগুলো লাঠির একটি করে বোঝা। আবুবকর সিদ্দিক গ্রামে ফিরে, তার তিন সহপাঠী বন্ধুকে নিয়ে মিয়াবাড়ির কাচারিঘরে আড্ডা দিয়ে এবং ছবি একে কাটায় এবং মফিজুদ্দিন তার ক্রোধ তিনটি শহুরে মেহমানের দিকে তাকিয়ে সংবরণ করে রাখার চেষ্টা করে, যদিও পরিণতিতে সে ব্যর্থ হয়। যদিও গ্রামের লোকেরা বুঝতে পারে না যে, ছবি একে লাভ কি, তারা আবুবকর সিদ্দিক এবং তার বন্ধুদের আঁকা ছবি দেখে চমকৃত হয়; তারা এমন কিছু নাই যার ছবি আঁকে না, সুহাসিনীর প্রান্তর, বৃক্ষরাজি, বিল ও হোগলার বন, আকাশ শস্য এবং মানুষের ছবি এঁকে মিয়াবাড়ির কাচারিঘর ভরে তুলতে থাকে। তারা ১৩ জন কৃষক এবং ৯ জন ঘোমটা দেয়া কৃষাণীর মুখ আঁকে; গ্রামের লোকেরা বলে যে, এই কাজে শহরের ছেলেগুলো খুব মজা পেয়ে যায়, কারণ, গ্রামের কৃষকেরা এই আঁকিয়েদের দাওয়াত করে খাওয়াতে শুরু করে। এই সময় গ্রামের দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তের হিন্দুপাড়ার লোকদের অনুরোধে তারা দশ বাহুধারী দুর্গার ছবি আঁকে, তারপর মিয়াবাড়ির কাচারিঘরে বসে একটি গাছের গুড়ি খোদাই করে চার হাত ওয়ালা, জিভ বের করা কালী মূর্তি গড়ে, এবং সুহাসিনীর লোকেরা কাঁচা মাটি দিয়ে আরো একটি অল্পবয়স্ক নারীর আবক্ষমূর্তি নির্মাণের কথা জানতে পারে। তারা বলে যে, আবুবকর সিদ্দিক এবং তার বন্ধুরা ভালোই ছিল, তখন একদিন মফিজুদ্দিন ঘরের ভেতর জোহরের নামাজ পড়া শেষে যখন, আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমতুল্লাহ, বলে বা দিকে মুখ ঘুরিয়ে কাঁধের ওপর দিয়ে সালাম ফেরায়, টিনের বেড়ার সঙ্গে দড়ি দিয়ে ঝোলানো তাকের ওপর ধূসর মাটির তৈরি একটি আবক্ষ মূর্তির মুখের ওপর তার চোখ পড়ে। গ্রামের লোকেরা বলে যে, এই মূর্তিটি আবুবকর সিদ্দিক নিজে তৈরি করেছিল, এটা ছিল মোল্লা নাসিরউদ্দিনের মৃত প্রেমিকা দুলালির; চন্দ্রভান একদিন যখন আবুবকর সিদ্দিক এবং তার বন্ধুদের অনুপস্থিতিতে কাচারিঘরে আসে, সে মূর্তিটির বিষণ্ণ চোখ দুটো চিনতে পারে এবং সেটা নিজের ঘরে নিয়ে গিয়ে রাখে। তারপর নামাজ পড়ার সময় এই নারীমূর্তির ওপর চোখ পড়ায় মফিজুদ্দিন ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে, সে একটি কাপড় দিয়ে মূর্তিটি ঢেকে পুনরায় সালাম ফেরায় এবং মোনাজাত শেষে যখন চিৎকার করতে থাকে, তখন চন্দ্রভান এসে বলে যে, এটা সে ঘরে এনেছে। মফিজুদ্দিন তখন তার কাচারিঘরে গিয়ে ছবির স্তৃপ এবং মূর্তির লাইন দেখে; সে চার হাত ছড়ানো এবং লম্বা জিভ বের করা কালীমূর্তিটিকে চিনতে পারে এবং সে যখন শোনে যে, এই কালীমূর্তিটি গ্রামের হিন্দুদের জন্য বানানো হয়েছে, সে তার একজন চাকরকে পাঠায় তাদেরকে ডেকে আনার জন্য, তারপর সে এই মূর্তিটা ছাড়া ঘরের অন্য মূর্তিগুলোসহ দুলালির মূর্তিটা চাকর দিয়ে বাড়ির পুকুরে ফেলে দেয়। আবুবকর সিদ্দিক এবং তার বন্ধুরা যখন ফেরে তারা দেখে যে, শূন্য কাচারিঘরে শুধু ছবির স্তৃপ পড়ে আছে, তখন তারা সব জানতে পারে এবং তারা এমন ক্ষুব্ধ ও অপমানিত বোধ করে যে, তারা তাদের সব চিত্রকর্ম বের করে মিয়াবাড়ির প্রাঙ্গণের ওপর ফেলে দেশলাইয়ের কাঠি দিয়ে আগুন জ্বালিয়ে দেয়। সে দিনের এই বহূৎসব থেকে একটিমাত্র চিত্রকর্ম রক্ষা পায়, যেটা অন্যান্য ছবির সঙ্গে ছিল না, ছিল নয়নতারা হাটের পাশে আইজ্জল প্রামাণিকের বাড়িতে; এবং গ্রামের লোকেরা বলে যে, এই ছবিটার কারণে একাত্তর সনে আইজ্জল প্রামাণিকের পরিবারে দুর্গতি নেমে আসে। গ্রামের লোকেরা যখন মফিজুদ্দিনের এই সন্তানদের নিয়ে কথা বলে, তারা বলে যে, তাদের এরকম স্বপ্নচারী না হয়ে উপায় ছিল না; কারণ, তাদের বাপ জন্মের প্রথম রাতেই ভাংয়ের নির্যাস খেয়েছিল, আর তাদের মা ছিল নিশিগ্রস্ত; তারা বলে যে, মূর্তি পুকুরে ফেলে দেয়ার জন্য নিজেদের আঁকা ছবি পুড়িয়ে তারা যে প্রতিবাদ করে তাতে মফিজুদ্দিনের কিছুই হয় না; সে হয় বিষয়টা বোঝেই না, না হয়, বুঝলেও তা অগ্রাহ্য করে। এই ঘটনার পর চন্দ্রভানের সব অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করে আবুবকর সিদ্দিক এবং তার বন্ধুরা বাড়ি ত্যাগ করে, তারপর দীর্ঘদিন গ্রামের লোকেরা আবুবকর সিদ্দিকের কথা জানতে পারে না। একাত্তর সনের মার্চ মাসে দেশে যখন রাজনৈতিক সংকট শুরু হয়, গ্রামের লোকেরা সন্ধের সময় রেডিওতে খবর শোনার জন্য মিয়াবাড়ির কাচারিঘরে এসে জড়ো হতে থাকে। পঁচিশ তারিখে রাত থেকে পাকিস্তানি বাহিনীর আক্রমণ শুরু হওয়ার পর টুকরো টুকরো খবর সুহাসিনীতে এসে পৌঁছাতে শুরু করে, তখন বহু বছর পর, কত বছর পর তা গ্রামের মানুষেরা বলতে পারে না, এক বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায়, এপ্রিল মাসের এক তারিখে কাঁধেঝোলানি ব্যাগ নিয়ে আবুবকর সিদ্দিককে সিরাজগঞ্জের দিক থেকে ব্যাঙনাই গ্রামের ভেতর দিয়ে তারা হেঁটে আসতে দেখে। তাকে দেখে গ্রামের লোকেরা তাকে ঘিরে ধরে এবং বলে, ক্যা বাপু, ঢাহার খবর কি, এবং আবুবকর সিদ্দিক শুধু বলে, ভালো না, তারপর গ্রামের পথ বেয়ে সে যখন মিয়াবাড়ির ভিটায় এসে ওঠে, গ্রামের লোকেরা যারা তাকে দেখতে পেয়েছিল তারাও তার পেছনে আসে এবং পুনরায় বলে, ঢাহার ব্যাবাক মাইনষেক মাইরা ফালাইছে নাহি? তুমি আইসল্যা কেমন হইর্যা? সেদিন গভীর রাত পর্যন্ত তারা বিবিসির খবর শোনে, তারপর আবুবকর সিদ্দিককে জিজ্ঞেস করে, এহন কি হইব বাপু কও। আবুকর সিদ্দিক ঢাকায় পাকিস্তানি বাহিনীর হত্যা এবং ধ্বংসযজ্ঞের বর্ণনা দেয় এবং বলে, যুদ্ধ শুরু হয়্যা গেছে। তারা যে একটা যুদ্ধের সময়ের ভেতর বাস করছে, গ্রামের লোকেরা তা বুঝতে পারে পরদিন যখন তারা দেখে যে, সুহাসিনী এবং সুরধ্বনি গ্রামের ১৮ জন যুবক ও তরুণ বাশঝাড় থেকে বাঁশের লাঠি কেটে এনে কাঁধের ওপর রাইফেলের মতো ফেলে সুহাসিনীর প্রাইমারি স্কুলের মাঠে কুচকাওয়াজ করে; সে সময় তারা যখন তাদেরকে দেখে, তাদের মনে এক ধরনের আশা ফিরে আসে। তখন আবুবকর সিদ্দিক সুহাসিনীতে প্রথম স্বাধীনতার পতাকা ওড়ানোর ব্যবস্থা করে, সে গ্রামের দুজন ছেলেকে সঙ্গে নিয়ে ধানঘড়া যায় এবং লাল গোলকের মাঝখানে সোনালি মানচিত্র আঁকা সবুজ রঙের চারটি পতাকা বানিয়ে আনে। গ্রামের তরুণেরা যখন চারটি পতাকা গায়ের চার কোনার তালগাছের মাথায় বাঁশের লাঠির সঙ্গে বেঁধে উড়িয়ে দেয়, তখন সুহাসিনীর লোকেরা, যে যেখানে ছিল সেখান থেকে, গাছের মাথায় বাতাসে কম্পমান এই পতাকা দেখতে পায়, এবং তারা বলে, দ্যাশ স্বাধীন হয়্যা গেছে, বাপু; কিন্তু তারপর পাকিস্তানি বাহিনী রংপুরের দিক থেকে বগুড়া হয়ে নেমে আসে এবং এপ্রিলের ২৬ তারিখে ধানঘড়ায় ঘাঁটি গেড়ে কামানের গোলা বর্ষণ শুরু করে, সেদিন গ্রামের লোকদের সঙ্গে প্রাইমারি স্কুলের মাঠে লাঠি হাতে কুচকাওয়াজরত তরুণেরা এই যুদ্ধের চেহারাটা সামনাসামনি দেখতে পায়; যদিও তার প্রকৃতি তারা তখনো হয়তো পরিষ্কার বুঝতে পারে নাই। সুহাসিনীর লোকেরা যারা গোলাবর্ষণের আতঙ্কে একবার ঘরে একবার বাইরে দৌড়াদৌড়ি করছিল, তাদের ভেতর যারা খেয়াল করে, তারা দেখে যে, গ্রামের এই তরুণেরা মাঠের ওপর শুয়ে পড়ে বাঁশের লাঠি দুহাতের মাঝখানে বাগিয়ে ধরে হামাগুড়ি দিয়ে নয়নতারা হাটের পাশে জেলা বোর্ডের রাস্তার দিকে অগ্রসর হয়। এই তরুণেরা নয়নতারা হাটের ঠিক পশ্চিম পাশে, রাস্তার ভাঙা অংশে পানি পার হওয়ার জন্য কলাগাছের যে তুরা ছিল তা ভেঙে সরিয়ে ফেলে, তারপর তারা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। সেদিন সন্ধ্যায় গ্রামের লোকেরা মফিজুদ্দিনের কাছে যখন আসে গ্রামের সব লোকের মতোই সে ভয় পায় এবং বুঝতে পারে যে, সুহাসিনী গ্রামে বাঁশের লাঠি ব্যর্থ হওয়ার পর আল্লাহ্ ছাড়া আপাতত আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না; তার তখন অর্ধশতাব্দী পূর্বে যমুনার বুকে এক নারীর মুখে শোনা কথাগুলো মনে পড়ে এবং সে গ্রামের লোকদের দিকে অন্ধকারের ভেতর তাকিয়ে একইভাবে বলে, ভয় পায়ো না; তার মনে হয় যেন, সেই নারীই তার মুখ গহ্বরের ভেতর থেকে এই বরাভয় সুহাসিনীর লোকদের শোনায়। তার কথা শোনার পর গ্রামের লোকেরা, পালানোর জায়গা না থাকায়, পুনরায় নিজেদের ভিটায় ফেরে; এবং ক্রমাগত গোলাবর্ষণের শব্দের ভেতর সারা রাত কাটানোর পর প্রত্যুষে তারা মিলিটারির পরবর্তী তৎপরতার কথা জানতে পারে। তারা জানতে পারে যে, আগের দিন সারা দিন এবং সারা রাত ধরে গোলাবর্ষণের পর শেষ রাতের দিকে পাকিস্তানি মিলিটারি ধানঘড়া থেকে পুরনো জেলা বোর্ডের রাস্তা ধরে পূর্ব দিকে, সিরাজগঞ্জের দিকে অগ্রসর হয় এবং ফজরের নামাজের একটু আগ দিয়ে সুহাসিনীর উত্তর সীমানায় নয়নতারা হাটের পাশ দিয়ে বৈকুণ্ঠপুর গ্রামের দিকে যায়; এই সময় কামানের গোলাবর্ষণের ভারি আওয়াজের ভেতর বন্দুকের গুলির বিচ্ছিন্ন ফট ফট শব্দ শোনা যেতে থাকে। গ্রামের লোকেরা পুরো সময়টা যে যার ঘরে বসে কাটায়, তারপর দিনের আলো ক্রমান্বয়ে প্রকাশিত হতে থাকার পর এই ভয়ের ভেতরও গ্রামে হাঁটাচলা শুরু হয় এবং তখন গ্রামের পাশ দিয়ে মিলিটারি চলে যাওয়ার বিবিধ বর্ণনা তারা শুনতে পায়। তারা জানতে পারে যে, খাকি পোশাক এবং ইস্পাতের টুপি পড়া মিলিটারি, পাঁচ/ছ জনের ছোটো ছোটো দলে, রাইফেল বাগিয়ে ধরে ধীর এবং সন্তর্পণে চারিদিকে লক্ষ করতে করতে এগোয়; তারা বলে যে, কোনো জন্তুর গমনপথ যেমন তার পরিত্যাক্ত বিষ্ঠা দেখে চেনা যায়, পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সেদিন এই পথ দিয়ে যাওয়ার চিহ্ন রেখে যায়। মিলিটারিরা অগ্রসর হয়ে লক্ষ্মীকোলা গ্রামের কাছে এসে রাস্তার দুই ধার দিয়ে লাগানো কলাগাছের ঝোপ দেখে ভয় পেয়ে যায়, তারপর তারা যখন বুঝতে পারে যে, ঝোপ জঙ্গলের ভেতর কোনো বিপদ নাই, তখন তাদের দৃষ্টি স্বাভাবিক হয়ে আসে এবং এই সব গাছ থেকে কলার ছড়ি ঝুলে থাকতে দেখে। গ্রামের লোকেরা জানতে পারে যে, মিলিটারিরা এগোতে এগোতে তখন এই কলার ছড়া থেকে পাকা কলা খুঁজে বার করে খায়; এবং এভাবে তখন মিলিটারিদের প্রথম দলটি সুহাসিনীর উত্তরে, নয়নতারা হাটের নিকট জেলা বোর্ডের পুরনো রাস্তার ভাঙা অংশটির কাছে এসে দাঁড়ায়। সড়কের এই ভাঙা অংশের পানি বিস্তৃত হয়ে, দক্ষিণ দিকে রৌহার বিল এবং উত্তরে, রাস্তার ধার দিয়ে বয়ে আসা খালের সঙ্গে মিশে ছিল, ফলে মিলিটারি এখানে এসে আটকা পড়ে যায় এবং এই পানি পার হওয়ার ভুরা আগের দিন বিকেলে লাঠি নিয়ে কুচকাওয়াজ করা যুবকেরা ধ্বংস করে দেয়ায় মিলিটারি রাস্তার এই ভাঙার নিকটে গ্রামে প্রবেশ করে। গ্রামের লোকেরা প্রথমে এই কথা শুনতে পায় যে, পাকিস্তানি মিলিটারি রাস্তার পাশেই গাছপালায় ঘেরা আইজ্জল প্রামাণিকের বাড়ির ভিটায় এসে ওঠে এবং বাহির বাড়ির কাচারিঘরে রাত্রি যাপনকারী দুজন কামলাকে ডেকে ওঠায়, অথবা তারা জেগেই ছিল, মিলিটারি তাদের শুধু ডেকে বার করে। বিজাতীয় চিৎকার শুনে দরজা খুলে বের হলে তারা মিলিটারিদের একেবারে সামনে পড়ে যায় ফলে দৌড় দেয়ার সকল ইচ্ছে থাকলেও দৌড় দিতে পারে না, এবং গ্রামের লোকেরা বলে যে, এর ফলে তাদের জীবন রক্ষা হয়; কারণ, দৌড় দিলেই তারা গুলি খেত। আইজ্জল প্রামাণিকের এই দুজন কামলা শেষ রাতের আবছা অন্ধকারের ভেতর দাঁড়িয়ে কাঁপতে থাকে, মিলিটারিরা যখন ভাঙা ভাষায় পানি পার এবং নৌকোর কথা বলে তখন তারা তা বুঝতে পারে এবং, নৌকা ওই দিহে, বলে হাত দিয়ে এক দিকে ইশারা করে দেখায় এবং মিলিটারিদের বাড়ির দক্ষিণ দিকে রৌহার ধারে নৌকোর ঘাটের দিকে নিয়ে যেতে থাকে। পাকিস্তানি মিলিটারিদের তখন সম্ভবত এই অন্ধকারময় ঝোপঝাড়ের ভেতর অগ্রসর না হয়ে উপায় ছিল না, তারা আইজ্জল প্রামাণিকের কামলা দুজনের পেছনে ধীরে এবং সতর্কতার সঙ্গে অগ্রসর হয়। তখন একসময় কামলা দুজন হঠাৎ করে দ্রুত অগ্রসর হয় এবং তাদের পেছনে আসা মিলিটারিরা কিছু বুঝে ওঠার আগেই নল খাগড়ার জঙ্গল ঠেলে রৌহার কালো পানিতে ঝাপিয়ে পড়ে অদৃশ্য হয়ে যায়। পাকিস্তানি মিলিটারিরা যখন ব্যাপারটা বুঝতে পারে, তারা আবছা অন্ধকার ঝোপঝাড়ের ওপর এক ঝাক গুলি ছুড়ে প্রাঙ্গণে ফিরে এসে পুনরায় হাঁকডাক শুরু করে। গ্রামের লোকেরা বলে যে, আইজ্জল প্রামাণিক মনে হয় যেন তৈরি হয়েই ছিল; মিলিটারির, কৌন হায়, ডাক শুনে সে লুঙ্গির ওপর পুরনো পাঞ্জাবি এবং মাথায় গোল টুপি পরে, দোয়া ইউনুস পড়তে পড়তে বাড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে আসে। তারপর সেদিন পুরোটা শেষ রাত জুড়ে মাথায় সাদা টুপি পরা শাশ্রুমণ্ডিত আইজ্জল প্রামাণিক লগি ঠেলে তার নৌকোয় করে, সিরাজগঞ্জ পুনর্দখলের জন্য অগ্রসরমাণ পাকিস্তানি মিলিটারিকে নয়নতারা হাটের পাশে পানি পার করে। সুহাসিনীর লোকেরা, যারা মিলিটারির এই এলাকা নীরবে পার হয়ে যাওয়ার খবরে অবাক হয় এবং একটু স্বস্তি বোধ করে, তারা লগি হাতে আইজ্জল প্রামাণিকের নৌকো পারাপারের কথা শোনে এবং সে দিন দুপুরের পর থেকে পূর্ব দিকের আকাশ লালচে আভাময় হয়ে ওঠা দেখে তারা বুঝতে পারে যে, পাকিস্তানি মিলিটারি সিরাজগঞ্জ শহরে পৌঁছে শহর পোড়াতে শুরু করেছে। তারপর সেদিন বিকেলে গ্রামের লোকেরা জানতে পারে যে, আইজ্জল প্রামাণিকের ভাগ্যের বিড়ম্বনা শুধু লগি ঠেলে মিলিটারিদের পানি পার করার ভেতর সীমাবদ্ধ ছিল না; তারা বলে যে, প্রয়োজনগত কারণে পাকিস্তানি মিলিটারি যত দ্রুত সম্ভব গ্রামের ভেতর দিয়ে পার হয়ে গেলেও, তারা তাদর অস্তিত্বের চিহ্ন একেবারে না রেখে যায় নাই; তারা চলে যাওয়ার পর লক্ষ্মীকোলার রাস্তা জুড়ে পড়ে থাকে ভক্ষিত কলার খোসা এবং সুহাসিনীতে এক নারীর দগ্ধ জীবন। গ্রামের লোকেরা যখন আইজ্জল প্রামাণিকের মেয়ে আলেকজানের বিষয়ে কথা বলে, তখন তারা জানতে পারে যে, আলেকজানের জীবনের ওপর এই দুর্গতি একটি ছবিকে কেন্দ্র করে নেমে আসে; কার্টিস কাগজের ওপর ছবিটি আবুবকর সিদ্দিক এঁকেছিল এবং এই ছবিটি আলেকজান রেখে দেয়। গ্রামের লোকদের তখন অনেক বছর আগে এক ফসল কাটার মৌসুমের কথা মনে পড়ে, যখন চিত্রকর আবুবকর সিদ্দিক তিনজন শহুরে বন্ধুকে সঙ্গে নিয়ে গ্রামে এসে হাজির হয় এবং মানুষ ও নিসর্গের ছবি আঁকতে শুরু করে। আবুবকর সিদ্দিক একটি খাতায় কাঠকয়লা দিয়ে বাইশ জন নারীপুরুষের মুখের স্কেচ আঁকে, গ্রামের লোকেরা বলে যে, এর ভেতর ছিল ভাঙা চোয়ালের হাড় জেগে থাকা ভূমিহীন বর্গাচাষী একাব্বর আলি, নিরীহ চেহারার কিন্তু কাজলটানা ডাগর চোখের হোমিওপ্যাথি ডাক্তার রব্বেল, গুটু শেখের অশীতিপর মা, ফরিদ হোসেনের মফস্বল শহরের স্ত্রী এবং আরো অনেকের মুখের ছবি; কিন্তু আবুবকর সিদ্দিক এই খাতায় এক মাসে বাইশটি স্কেচ আঁকলেও এই খাতায় শেষ পর্যন্ত ছবি ছিল একুশটি। একদিন যখন আবুবকর সিদ্দিক এবং তার বন্ধুরা মফিজুদ্দিনের ওপর ক্রুদ্ধ হয়ে তাদের আঁকা যাবতীয় ছবি আগুনে পুড়িয়ে ফেলার পর গ্রাম ত্যাগ করে, তাদের এই ক্রোধের আগুনের হাত থেকে দুটো শিল্পকর্ম রক্ষা পায়, এর একটি ছিল কাঁঠাল কাঠের গুঁড়ি কুঁদে নির্মিত ছিন্ন নরমুণ্ডের মালা গলায় চতুর্ভুজা কালীর মুর্তি এবং অপরটি, আবুবকর সিদ্দিকের স্কেচ খাতার পাতায় কয়লা দিয়ে আঁকা আইজ্জল প্রামাণিকের এগারো বছর বয়সী বালিকা কন্যা আলেকজানের মুখ; এবং গ্রামের লোকেরা বলে যে, পরবর্তী সময়ে তারা দেখতে পায়, এই ছবি কেমন করে আলেকজানের এবং হয়তোবা আবুবকর সিদ্দিকেরও জীবন এক পরিণতির দিকে নিয়ে যায়। সে সময় আবুবকর সিদ্দিক যখন তার স্কেচ বইয়ের পাতা ভরে তুলতে থাকে তখন একদিন সে বালিকা আলেকজানকে দেখতে পায়; সেদিন বিকেলে সুহাসিনীর প্রাথমিক স্কুলের মাঠের পাশে সদ্য কেটে নেয়া আমন ধানের ক্ষেতের ফাঁকে ফাঁকে সরষের ক্ষেত হলুদ ফুলে ছেয়ে ছিল, দূরে গ্রামের সীমা ঘেঁষে আকাশে মনে হয় ছিল হালকা সাদা মেঘ আর নীরব প্রান্তরের ওপর দিয়ে বয়ে যাচ্ছিল মৃদু হিমেল বাতাস। তখন, এই স্কুলের মাঠের একপাশে দাঁড়িয়ে আবুবকর সিদ্দিকের এক বন্ধু যখন উজ্জ্বল জলরঙে আকাশ, প্রান্তর এবং দূরের গ্রামের নিসর্গের ছবি আঁকছিল, তখন সে গ্রামের জীবনের এত নিকটে টিকে থাকা নীরবতার ভেতর বসেছিল; সেই সময় এই উপভোগ্য নীরবতা ছিন্ন করে প্রান্তরের ওপর জীবনের কলধ্বনি বিকশিত হয়, একেবারে শূন্যতার ভেতর থেকে একটি বালক এবং একটি বালিকা হেমন্তের সোনালি রোদে হলুদ সরষে ক্ষেতের ভেতর দিয়ে ছুটে যেতে থাকে। আবুবকর সিদ্দিক এবং তার বন্ধু, খালি গা এবং লুঙ্গি উঁচিয়ে ধরা বালক এবং শাড়ির আঁচল হাতে লুটিয়ে থাকা বালিকার ছুটন্ত অবয়ব দেখে এবং এই বিরল নীরব মুহূর্তে তাদের কলহাস্য, দুই বন্ধুর কাছে প্রকৃতির অবয়বে এক বিশেষ মাত্রা যোগ করে। তারা তখন প্রকৃতি অবলোকন ত্যাগ করে গরুর তরুণ বাছুরের মতো নেচে নেচে ছুটে যাওয়া বালিকা আলেকজান এবং তার ভাই আমির হোসেনের দিকে তাকিয়ে থাকে; তারা দেখে যে, দূরে মাঠের ভেতর তখনো কিছু জায়গায় পাকা ধান নুয়ে আছে এবং কালো বিন্দুর মতো কৃষকেরা তা কাটে, এবং প্রান্তরের নীরবতা ভেঙে বালক-বালিকা দুটো প্রজাপতির মতো উড়ে উড়ে সেই দিকে যায়। গ্রামের লোকেরা বলে যে, সেই বিকেলে স্কেচ আঁকার জন্য মুখের সন্ধানরত চিত্রকর আবুবকর সিদ্দিক একটি কণ্ঠের ধ্বনি খুঁজে পায় এবং সে তার বন্ধুকে স্কুলের মাঠে রেখে সেই ধ্বনি অনুসরণ করে তার পরিণতির দিকে এগোয়। মাঠের মধ্যে কৃষকদের কাছে পৌঁছে সে কামলাদের কাজ তদারকিরত আইজ্জল প্রামাণিককে দেখে এবং ক্ষেতের আলের ওপর বসে আইজ্জল প্ৰামণিকের সঙ্গে কথা বলে, কলকি বাগিয়ে ধরে তামাক টানে এবং তাদেরকে ঘিরে ছুটোছুটি করতে থাকা আলেকজান এবং আমির হোসেনের হাসির ধ্বনি শোনে; সে সময় প্রকৃতির বিন্যাসে অনির্বচনীয় এমন কিছু হয়তো ছিল, অথবা ঠিক সেই মুহূর্তে তার মনের ভেতর এমন কিছু ঘটে যে, তার মনে হয় এমন আনন্দ সে তার জীবনে দেখে নাই। কিছুক্ষণ পর ক্লান্ত হয়ে আলেকজান এবং আমির হোসেন কেটে রাখা ধানের আঁটির ওপর জিরনোর জন্য বসে, তখন মাটিতে আঁচল ফেলে রাখা উধ্বাঙ্গ উন্মুক্ত বালিকার ফর্সা মুখের সুষমা দেখে তার মনে হয়, এই মুখটি আঁকা যায়। কিন্তু পরদিন সে তার ভুল বুঝতে পারে, সেদিন সকালে আইজ্জল প্রামাণিকের বাহির বাড়ির উঠোনে, কলাগাছের ঝোপের কাছে একটি নিচু টুলে আলেকজানকে বসিয়ে সে যখন তার স্কেচবই খুলে ধরে কয়লার টুকরো তুলে নিয়ে আঁকতে থাকে, তখন গম্ভীর এবং শক্ত হয়ে বসে থাকা বালিকার মুখের দিকে তাকিয়ে সে বুঝতে পারে যে, এই আলেকজানকে সে মাঠের পারে দেখে নাই; তার মনে হয় যে, এই মুখ সুন্দর কিন্তু বৈশিষ্ট্যহীন। কিন্তু গ্রামের লোকেরা বলে যে, আলেকজানের সৌন্দর্য সম্পর্কে আবুবকর সিদ্দিকের মতামত পুনরায় পরিবর্তিত হয়; অনেক বছর পর একাত্তর সনের এপ্রিল মাসে সুহাসিনীর পাশ দিয়ে পাকিস্তানি মিলিটারি চলে যাওয়ার পর সে যখন যুবতী এবং বিষণ্ণ আলেকজানের মুখের দিকে তাকায়, সে সেই চরম দুর্যোগের ভেতরও আলেকজানের সৌন্দর্যের বিষয়ে সচেতন হয় এবং তার মনে হয় যে, এই মুখ সুন্দরের চাইতেও বেশি কিছু। সুহাসিনীর উত্তর প্রান্ত ছুয়ে এগিয়ে যাওয়া পুরনো জেলা বোর্ডের রাস্তা ধরে পাকিস্তানি মিলিটারিরা চলে যাওয়ার পর গ্রামের লোকদের ভেতর কিঞ্চিৎ স্বস্তি ফিরে আসে এবং সেদিন বিকেলে গ্রামের লোকেরা আলেকজানের কথা জানতে পারে। তারা বলে যে, আইজ্জল প্রামাণিকের দ্র ব্যবহার এবং মাথার টুপি দেখে মিলিটারিরা তার ওপর খুশিই হয়; ছোটো ছোটো দলে এগিয়ে আসা মিলিটারিদের নৌকোর লগি ঠেলে পার করার পর, শেষ দলটি আসে। সেই দলের চারজন মিলিটারি রাস্তার ভাঙা জায়গাটায় এসে তৃষ্ণার্ত বোধ করে এবং পানি পান করতে চায় এবং গ্রামের লোকেরা যখন এই কথা বলে, তারা এই বিষয়টি নিয়ে আফসোস করতে কখনো ভোলে না যে, কেমন অল্পের জন্য আইজ্জল প্রামাণিকের সেদিন ক্ষতি হয়ে যায়। মিলিটারির শেষ দলটি যখন পানি খেতে চায়, সে হাতের লগি মাটিতে পুঁতে তার সঙ্গে নৌকো বাঁধে এবং পানি আনার জন্য বাড়ির দিকে রওনা হয়, তখন পানির কাছে দাঁড়িয়ে না থেকে মিলিটারি চারজন তার পেছন পেছন আসে। আইজ্জল প্রামাণিক বুঝতে পারে নাই যে, মিলিটারিরা তাকে অনুসরণ করে তার বাড়িতে এসে উঠেছে, সে যখন অ্যালুমিনিয়ামের জগে করে পানি এবং একটি কাচের গ্লাস নিয়ে বাড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে আসে, তখন তার বাইরের উঠোনে ভূত দেখার মতো মিলিটারি দেখতে পায়; দু’জন মিলিটারি তার উঠোনের ওপর দুদিকে মুখ করে দাঁড়িয়েছিল এবং সে যখন পানির জগ নিয়ে এগিয়ে আসে তখন কাচারিঘরের ভেতর থেকে অন্য দুজন মিলিটারি বের হয়। তারা চারজন তখন গ্লাসে করে আইজ্জল প্রামাণিকের ঢেলে দেয়া পানি খায়, তারপর যে দুজন মিলিটারি টিনের চৌচালা কাচারিঘরে প্রবেশ করেছিল তারা কোনো এক ভাষায়, গ্রামের লোকেরা বলতে পারে না কোন ভাষায় তবে তারা বলে যে, সেটা বাঙলা ছিল না কিন্তু আইজ্জল প্রামাণিক সেই ভাষা বুঝতে পেরেছিল, তার কাচারিঘরে টিনের বেড়ার সঙ্গে ঝোলানো ছবির কথা জানতে চায়। মিলিটারির কথা শুনে তার প্রথমে মনে হয় যে, তারা বোধ হয় তার মৃত ছেলে আওলাদ হোসেনের এনলার্জ করানো ছবিটির কথা বলছে, কিন্তু মিলিটারিরা বলে যে, তারা তার ছেলের কথা বলছে না এবং আইজ্জল প্রামাণিকও তখন বুঝতে পারে না যে তারা কোন ছবির কথা বলে; গ্রামের লোকেরা যখন এ কথা বলে, তখন তারা এই সন্দেহ প্রকাশ করে যে, আইজ্জল প্রামাণিকের প্রথমেই বুঝতে পারার কথা, মিলিটারি কোন ছবিটির কথা বলে; কিন্তু তার পক্ষে ভান করা ছাড়া তখন আর কিছুই করার ছিল না; কিন্তু ভান করে শেষ রক্ষা হয় না, মিলিটারিরা যখন দেখে তারা তাকে বোঝাতে পারছে না, তখন তারা পুনরায় কাচারিঘরের ভেতর প্রবেশ করে এবং সেদিন আইজ্জল প্রামাণিককে চরম মাশুল গুনতে হয় তিনটি পুরনো ভুলের জন্য। এগুলো হচ্ছে, রাস্তার ওপর বাড়ি বানানো, সুন্দরী মেয়ে বিয়ে দিয়েও ঘরে রেখে দেয়া এবং পরিবারের মেয়েদের ছবি কাচারিঘরে টাঙিয়ে রাখা; গ্রামের লোকেরা বলে যে, আইজ্জল প্রামাণিকের উচিত হয় নাই রাস্তার ওপর বাড়ি বানানো, কারণ, এর ফলে রাস্তার যেকোনো অচেনা পথিকও বুঝে ওঠার আগেই তার বাড়িতে ঢুকে পড়তে পারে; তার উচিত হয় নাই লুর রহমানকে ঘরজামাই বানিয়ে মেয়েকে ঘরে রেখে দেয়া, তা না করলে যে দিন মিলিটারি বাড়িতে প্রবেশ করে সেদিন আলেকজান হয়তো এখানে থাকত না; এবং সবশেষে, তার উচিত হয় নাই তার কাচারিঘরে আবুবকর সিদ্দিকের কয়লা দিয়ে আঁকা স্কেচটি বাঁধিয়ে টাঙিয়ে রাখা, কারণ, তারা বলে যে, এই ছবিটি ছিল চোখে পড়ার মতো; তারা এ রকম স্মরণ করতে পারে যে, আইজ্জল প্রামাণিকের কাচারিঘরে টাঙানো এই ছবি দেখে, তাদের বহুদিন মনে হয়েছে যে, এটা আলেকজানের ছবি নয় এবং তাদের ইচ্ছে হয়েছে যে বলে, এই ম্যায়াডো কেডা বাপু? সুহাসিনীর লোকেরা বলে যে, সেদিন মিলিটারি পানি খাওয়ার পরে আইজ্জল প্রামাণিককে সঙ্গে নিয়ে তার কাচারিঘরে প্রবেশ করে কাঠকয়লায় আঁকা থুতনি উঁচিয়ে রাখা বালিকা আলেকজানের ছবিটির দিকে নির্দেশ করে, এটা কার ছবি জানতে চায়। তখন আইজ্জল প্রামাণিক, অনেক বছর আগে সুহাসিনীতে চিত্রকর আবুবকর সিদ্দিকের আঁকা শেষ ছবিটি সংরক্ষণ করার ভুল বুঝতে পারে, কিন্তু কোনো এক কারণে সেদিন মিলিটারি আলেকজানের জীবন বিপর্যয়ে ঢেকে দিয়ে প্রস্থান করার পরেও আইজ্জল প্রামাণিক ছবিটি ধ্বংস করে দেয় না। আগুনের শিখায় লাল হয়ে থাকা বিধ্বস্ত সিরাজগঞ্জের আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখতে দেখতে, গ্রামের লোকেরা সেদিন সুহাসিনীতে সংঘটিত ঘটনা এবং আইজ্জল প্রামাণিক ও তার মেয়ের বিপর্যয় ও বিষণ্ণতাকে বর্ণনা করার মতো তথ্য সন্ধের ভেতর মোটামুটিভাবে পেয়ে যায়। তারা বলে যে, কাচারিঘরের ভেতর মিলিটারিরা যখন আলেকজানের কথা জিজ্ঞেস করে তখন আইজ্জল প্রামাণিকের ভয় বাস্তব হয়ে ওঠে, তার কোনো উপায় থাকে না এবং সে যখন বলে যে, ছবিটি তার মেয়ের তখন মিলিটারিরা আলেকজানকে দেখতে চায়; তারপর কি হয় তা গ্রামের লোকেরা বলতে পারে না, অথবা তারা তা বলে না; তবে গ্রামের যেসব লোক এই দৃশ্য দেখেছিল তা তারও পরের ঘটনার কথা বলে, তারা বলে যে, তারা আইজ্জল প্রামাণিকের কুয়োতলায়, যেখানে ভালোমতো ঘেরা দেয়া নেই, এই মিলিটারিদের একে একে ন্যাংটো হয়ে গোসল করতে দেখে; সেই প্রত্যুষে তারা দেখে যে, দড়ি বাঁধা বালতি হাতে বিস্তবসনা আলেকজান কুয়ো থেকে পানি তুলে দেয় এবং নগ্ন মিলিটারিরা তারা গায়ে ঢলে। এভাবে পালাক্রমে চারজনের গোসল করা শেষ হলে এই মিলিটারিরা আইজ্জল প্রামাণিকের বাড়ি ত্যাগ করে যায় এবং তখন কুয়োতলার পানি এবং কাদার ভেতর বসে, কুয়োর ওপরের বাঁশের বেড়া আঁকড়ে ধরে আলেকজান বুকচাপা হুম হুম কান্নায় ভেঙে পড়ে এবং তখন মলিন পাঞ্জাবি এবং সাদা গোল টুপি পরা আইজ্জল প্রামাণিক তার কাচারিঘরের বারান্দায় দুহাতের করতলের ভেতর মাথা রেখে একটি নিচু টুলের ওপর বসে থাকে। আইজ্জল প্রামাণিক কতক্ষণ এভাবে বসে থাকে তা কেউ বলতে পারে না, তবে গ্রামের লোকেরা বলে যে, একসময় কাঠকয়লায় আঁকা ছবিটির কথা তার অবধারিতরূপে মনে পড়ে এবং তখন সে উঠে কাচারিঘরের ভেতরে প্রবেশ করে সকালের সেই নরম আলোয় আলেকজানের ছবিটির দিকে তাকায়, তখন তার চোখ পানিতে ভরে যায়, সাদা দাড়ি বেয়ে অশ্রুর ধারা গড়ায় এবং সে অস্ফুটে মা’ ধ্বনি উচ্চারণ করতে থাকে; গ্রামের লোকেরা বলে যে, আইজ্জল প্রামাণিকের চোখের পানিতে হৃদয় প্লাবিত হওয়ার কারণে, আবুবকর সিদ্দিকের আঁকা এই ছবিটি দ্বিতীয় বারের মতো রক্ষা পায়। অনেক বছর পর পূর্ণিমা রাতে মফিজুদ্দিন মিয়া সপরিবারে নিহত হওয়ার পরদিন গ্রামের লোকেরা দগ্ধ এবং ভস্মীভূত মিয়াবাড়ির ধ্বংসস্তুপের ভেতর লাশ খুঁজে বার করার সময় চন্দ্রভানকে জিনের এনে দেওয়া লাল শাড়িটির সন্ধান করে, কিন্তু তারা সেটা খুঁজে পায় না; তখন, তারা যখন আগুনে পুড়ে যাওয়া সিদ্দিক মাষ্টার, তার স্ত্রী এবং পুত্রের লাশ পায়, তাদের মনে পড়ে কাঠকয়লা দিয়ে আঁকা চিত্রকর্মটির কথা। তারা যখন সেটা খুঁজে পায়, তারা দেখে যে, এক কোনা ছাড়া ছবিটার বাকি অংশ পুড়ে গেছে, আলেকজানের কপালের একটা অংশ কেবল মাত্র দেখা যায় এবং তারা যখন ঘরের মেঝের ওপর সিদ্দিক মাষ্টারের বাহুর ভেতর মৃত আলেকজানের দিকে তাকায়, তারা দেখে যে, তার চিবুক এবং ডানদিকের গালের একটা অংশও পোড়া; কিন্তু তার পরও, এই মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে সেই বিভ্রান্তিকর বিপর্যয়ের ভেতরও তাদের ভালো লাগে, তারা বুঝতে পারে কি পরিমাণ রূপ ছিল মেয়েটির! অনেক বছর আগে আলেকজানের এই চেহারার স্কেচ করার সময় চিত্রকর আবুবকর সিদ্দিকের মনে হয়েছিল যে, এই মুখ বৈশিষ্ট্যহীনভাবে শুধুই সুন্দর, ফলে খাতায় আঁকা ছবিটার বিষয়ে তার খুব আগ্রহ থাকে না; তখন ছবিটা আঁকা হয়ে গেলে আলেকজান এমন খুশি হয়ে ওঠে যে, তার হাস্যোজ্জ্বল মুখের দিকে তাকিয়ে সে বলে, তুই নিবি ছবিটা? এবং খাতার পাতা ছিঁড়ে ছবিটা তাকে দিয়ে দেয়, এভাবে এই ছবিটা অন্যান্য ছবির সঙ্গে ধ্বংস হওয়া থেকে প্রথমবারের মতো রক্ষা পায়। পরবর্তী সময়ে একাত্তর সনের এপ্রিল মাসে গ্রামের পাশ দিয়ে পাকিস্তানি মিলিটারি চলে যাওয়ার পর সে যখন পুনরায় আলেকজানকে দেখে, তার মনে হয় যে, সুন্দরের চাইতেও বেশি কিছু আছে এই মুখে; এবং সেদিন সন্ধ্যার পর এবং রাতে সুহাসিনীর লোকেরা যখন আলেকজানের জীবনের বিপর্যয় নিয়ে কথা বলে, তারা জানতে পারে যে, এই বিপর্যয়ের সঙ্গে জড়িয়ে ছিল আবুবকর সিদ্দিকের আঁকা ছবিটি। সুহাসিনীর লোকেরা পরে বলে যে, এই কাহিনী গ্রামে প্রচারিত হলে তা আবুবকর সিদ্দিকের কানেও যায়, তখন অনেক বছর পর তার আলেকজানের কথা মনে পড়ে এবং সে খুবই বিচলিত বোধ করে, রাত্রিটি তার অল্প দ্রিা অথবা দ্রিাহীনতায় কাটে এবং পরদিন প্রত্যুষে সে আইজ্জল প্রামাণিকের বাড়িতে যায়। গ্রামের লোকেরা বলে যে, আগের দিন সকালে উঠে আইজ্জল প্রামাণিক দেখে যে, তার প্রাঙ্গণে বন্দুক হাতে মিলিটারি খাড়া, পরদিন মিলিটারির জায়গায় আসে আবুবকর সিদ্দিক। সে আইজ্জল প্রামাণিকের বাড়িতে আসার পর সকলের সঙ্গে তার দেখা হয়, আইজ্জল প্রামাণিক, আমির হোসেন, আলেকজান এবং তার স্বামী লুত্যর রহমানের সঙ্গে কথা হয়; কিন্তু তাদেরকে সে জিজ্ঞেস করতে পারে না গ্রামের লোকেরা যা বলে তা সত্য কি না; তবে তার মনে হয় যে, গ্রামের লোকেরা যেমন বলে, আইজ্জল প্রামাণিকের বাড়ির সর্বত্র যেন এক নীরব বিষণ্ণতা ছড়িয়ে আছে; তখন উঠানে দাঁড়িয়ে আমির হোসেনের সঙ্গে কথা বলার সময়, ঘরের দরজার চৌকাঠ ধরে দাঁড়ানো নতদৃষ্টি আলেকজানের মুখের দিকে তাকিয়ে সে বেদনা দেখতে পায়; তার অন্তরের ভেতরটা মোচড় খায় এবং তার মনে হয় যে, এই মুখটার মতো মুখ জীবনে সে দেখে নাই। গ্রামের লোকেরা সেদিনের ঘটনা সম্পর্কে বিশদ জানতে পারে, তারা বলে যে, আইজ্জল প্রামাণিকের বাড়ির লোকদের সঙ্গে কথাবার্তা বলার পর বাড়ির ভেতর থেকে বের হয়ে ফিরে আসার সময় আবুবকর সিদ্দিক কাচারিঘরে ঢুকে আলেকজানের ছবিটার সামনে দাঁড়ায় এবং সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়ানোর পর আলেকজানকে সে এই ঘরে প্রবেশ করতে দেখে। আবুবকর সিদ্দিকের একধরনের অপরাধবোধ এবং অনুশোচনা হয়তোবা হয়, কারণ, সে তখন এই ছবিটি ফিরিয়ে নিয়ে যেতে চায়, কিন্তু আলেকজান সম্মত হয় না; তখন আবুবকর সিদ্দিক এই যুবতী নারীর দিকে তাকিয়ে মেঘাচ্ছন্ন চাঁদের মতো এক সৌন্দর্য দেখে এবং তার মুখের আর-একটি স্কেচ আঁকার ইচ্ছে ব্যক্ত করে, তখন আলেকজান পুনরায় নীরবে আবুবকর সিদ্দিকের দিকে তাকায়, এবং সেই দৃষ্টিতে ক্রোধ, না ভৎসনা ছিল, নাকি ছিল শুধুই বিষণ্ণতা, গ্রামের লোকেরা তা বলতে পারে না; তারা শুধু বলে যে, আলেকজানের চেহারায় এমন একটা কিছু ফুটে ওঠে, যা দেখে আবুবকর সিদ্দিক পুনরায় বিপর্যস্ত বোধ করে এবং আর একটি কথাও না বলে আইজ্জল প্রামাণিকের বাড়ি ত্যাগ করে আসে।
এসব ঘটনার কারণে, অনেক বছর পর মফিজুদ্দিন মিয়া যে দিন সপরিবারে নিহত হয়, সেদিন অন্য সকলের সঙ্গে আলেকজানের নিহত হওয়ার বিষয়টি নির্ধারিত হয়ে যায়; সুহাসিনীর লোকেরা বলে যে, কেবল মাত্র দুলালি এই হত্যাকাণ্ডের হাত থেকে রক্ষা পায়, কারণ, দুলালি তার আগেই মরে। গ্রামের লোকেরা বলে যে, মৃত দুলালির আঁচলে বাধা চিরকুটটা পড়ে তার বাপ মোবারক আলি তার লাশ দাফন করতে দেয় না এবং তার মৃত্যুর পর তৃতীয় দিনের অপরাহ্নে চন্দ্রভান মোবারক আলির ভিটায় আসে এবং তার একটু পর, সেই সন্ধ্যায় আবুবকর সিদ্দিক ঢাকা রওনা হয়। সুহাসিনীর যেসব লোক গ্রামে এই সব ঘটনা ঘটতে দেখেছিল, তারা বলে যে, আবুবকর সিদ্দিক একদিন মোল্লা নাসিরউদ্দিনকে সঙ্গে করে গ্রামে ফিরে আসে এবং তখন তারা সবকিছু জানতে পারে; সেদিন রাতটা সিরাজগঞ্জ শহরে আত্মীয়বাড়িতে কাটিয়ে সকালবেলা ট্রেনে চেপে আবুবকর সিদ্দিক সন্ধ্যার পর ঢাকা গিয়ে পৌছে রেলস্টেশন থেকে রিকশায় চেপে প্রকৌশল কলেজের হোস্টেল যায় এবং মোল্লা নাসিরউদ্দিনকে পাওয়ার পর তাকে প্রথমে বিভ্রান্ত করার জন্য বলে যে, সে বেড়াতে এসেছে; তারপর রাতের খাবার খাওয়া হলে সে দুলালির মৃত্যুর খবরটি দেয় এবং বলে যে, সে না গেলে এই মেয়ের লাশ দাফন করা যাচ্ছে না। তখন আবুবকর সিদ্দিক দুলালির মৃত্যুর পর আঁচলের খুঁটে বাঁধা অবস্থায় পাওয়া চিরকুটটা তার পকেট থেকে বের করে দেয় এবং সেটা পড়ে মোল্লা নাসিরউদ্দিনের চেহার আরো গম্ভীর হয়ে ওঠে। সে রাতে হোস্টেলের চাপা চৌকিতে দুভাই পাশাপাশি লম্বা হয়ে শোয়, তারপর মোল্লা নাসির যখন নিশ্চিত হয় যে, আবুবকর সিদ্দিক ঘুমিয়েছে, বিছানা ত্যাগ করে উঠে গিয়ে সে বাইরে বারান্দায় দাঁড়ায়। তারপর সে ঘরে ফিরে চৌকির তলা থেকে তার তোরঙ্গটি টেনে বার করে আনে, এই টিনের তোরঙ্গের ভেতর একটি পকেটে রাখা ছিল দুলালির লেখা একুশটি চিরকুট। মোল্লা নাসিরউদ্দিনের জানা ছিল যে, এই সব চিরকুটের সবগুলোই সে পড়েছে এবং সে জানে এগুলোতে কি লেখা আছে। কিন্তু গ্রামের লোকেরা বলে যে, একটি চিরকুট মোল্লা নাসিরের প্রকৃতপক্ষে পড়া ছিল না; কারণ, একের পর এক তুমি কেমন আছ’ লেখা চিরকুট পড়ে সে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল, তখন সে একদিন একটি চিরকুট আর খুলে না পড়ে ঘরে নিয়ে গিয়ে অন্য চিরকুটের সঙ্গে রেখে দেয় এবং তারপর থেকে দুলালি যখন ক্রমাগতভাবে ১৪টি চিরকুটে লেখে তুমি কিছু কও না কেন তখন মোল্লা নাসিরউদ্দিন বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে, সে তার অর্থ বুঝতে পারে না এবং দীর্ঘদিন পর তার কলেজ হোস্টেলে ঘুমন্ত আবুবকর সিদ্দিকের পাশে চৌকির ওপর বসে চিরকুটগুলো সে যখন পুনরায় পড়ে তখনই কেবল তার এই বিভ্রান্তি দূর হয়; সে বুঝতে পারে, দুলালি আসলে কি জানতে চেয়েছিল; কারণ, তখনই কেবল সেই অপঠিত কাগজের টুকরোটিতে লেখা বাণী প্রকাশিত হয়। পরপর দুটি চিরকুটে ‘তুমি কেমন আছ’ লেখার পর দুলালি বোধ হয় আর পারে না, সপ্তম চিরকুটে সে লেখে, তুমি আমাক বিয়া কইরবা?’ লজ্জা এবং আকাভক্ষার এই বাক্যটি কতদিন চাপা পড়ে থাকে গ্রামের লোকেরা তা বলতে পারে না, তারা শুধু বলে যে, শেষে মোল্লা নাসিরউদ্দিন যখন সেটা পড়ে, সেদিন রাতে তার আর ঘুম আসে না, আবুবকর সিদ্দিকের পাশে শুয়ে দ্রিাহীন রাত কাঠানোর পর ফজরের নামাজ পড়ার সময় রুকুতে গিয়ে সে ভেঙে পড়ে, উবু থেকে সোজা না হয়ে, সেজদায় চলে যায় এবং ‘সোবহানা রাব্বল আলা পড়তে পড়তে, অন্ধকারাচ্ছন্ন গ্রাম সুহাসিনীর কালো রঙের বালিকা দুলালির জন্য ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। কোনো এক সময় অস্পষ্ট আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেলে আবুবকর সিদ্দিক মেঝেতে বিছানো জায়নামাজের ওপর পশ্চিম মুখে লুটিয়ে থাকা অতি নিম্নস্বরে ক্রন্দনরত মোল্লা নাসিরউদ্দিনকে দেখতে পায় এবং সেদিনের কথা সে কোনোদিন ভুলতে পারে না। কয়েক বছর পর আবুবকর সিদ্দিক ঢাকা গিয়ে আর্ট কলেজে ভর্তি হয় এবং একবার বন্ধুদের সঙ্গে নিয়ে সুহাসিনীতে গিয়ে যখন এক মাস থাকে তখন তারা কতগুলো ছবি আঁকে এবং কতগুলো আবক্ষমূর্তি নির্মাণ করে, কিন্তু এই সব ছবি এবং মূর্তির সবগুলো চরিত্র ছিল জীবিত মানুষের, কেবল দুলালিরটি ছাড়া। আবুবকর সিদ্দিক কেন বড় ভাইয়ের মৃত প্রেমিকার আবক্ষমূর্তি গড়ে তা গ্রামের লোকেরা বুঝতে পারে না, তাদের শুধু মনে হয় যে, মিয়াবাড়িতে দুলালির প্রতিষ্ঠা হলো। কিন্তু একদিন তারা ক্রুদ্ধ মফিজুদ্দিন কর্তৃক এই প্রতিমা বিসর্জন দেয়ার খবর শুনতে পায় এবং সেদিন এই ঘটনার পর আবুবকর সিদ্দিক এবং তার বন্ধুরা তাদের সব শিল্পকর্ম ধ্বংস করে সুহাসিনী ত্যাগ করে যায়, শুধুমাত্র হিন্দুপাড়ায় কালীমূর্তি এবং আইজ্জল প্রামাণিকের বাড়িতে বালিকা আলেকজানের মুখের স্কেচটি থাকে।
আলেকজানের যে স্কেচটি আবুবকর সিদ্দিকের পছন্দ হয় নাই, সেই ছবিটাই টিকে থাকে এবং একাত্তর সনে বাড়ির পাশ দিয়ে মিলিটারি চলে যাওয়ার পর একদিন সকালে যুবতী রমণী আলেকজানের সোনার প্রতিমার মতো মুখের ওপর বেদনার ম্লান ছায়ার। দিকে তাকিয়ে যে ছবিটি তার আঁকতে ইচ্ছে করে, তা আর কখনোই আঁকা হয় না। সেদিন আইজ্জল প্রামাণিকের বাড়ি ত্যাগ করে আসার পর গ্রামের লোকেরা তাকে আর মিয়াবাড়ির বাইরে দেখতে পায় না, তারা বলে যে, সারা দিন সে তাদের বাড়ির ভেতর শুয়ে থেকে কাটিয়ে দেয়। এর কিছু দিন পর গ্রামের লোকেরা ক্রমাগতভাবে গ্রামের ছেলেদের মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়ার জন্য গ্রাম ছেড়ে যাওয়ার খবর পেতে থাকে, খড়ের বেণির আগুনে কলকি সাজিয়ে তারা তামাক খায় এবং আউসের মাঠে নিরানি দিতে দিতে যুদ্ধের কথা বলে এবং এভাবে তারা খবর পায়, গ্রামের কে কে যুদ্ধে গেল। গ্রামের লোকেরা যেসব ছেলের কথা বলে, তাদের মোট সংখ্যা তারা কখনো গুনে দেখে না, এই প্রসঙ্গে যখন কথা হয় তখন তারা বলে যে, গ্রাম থেকে হয়তো এক কুড়ি ছেলে যুদ্ধে গেছে, কিংবা হয়তো দুই কুড়ি। সে সময় একদিন আলেকজানের স্বামী লুত্যর রহমানের যুদ্ধে যাওয়ার খবর পাওয়া যায় এবং তারপর একদিন গ্রামের লোকেরা জানতে পারে রাতের বেলা এক নৌকো বোঝাই তরুণের নিরুদ্দিষ্ট হয়ে যাওয়ার কথা; তারা জানতে পারে যে, এই নৌকোয় অনেক লোকের ভেতর ছিল সুরধ্বনি গ্রামের ইদ্রিস খ এবং মফিজুদ্দিন মিয়ার চার ছেলে, শাহজাহান আলি, ফরিদ হোসেন, আব্দুল আজিজ ও আবুবকর সিদ্দিক। গ্রামের লোকেরা তখন বলে যে, একটি নারীর জন্য দু জন যুদ্ধে যায়, এদের একজন লুত্যর রহমান এবং অপরজন আবুবকর সিদ্দিক এবং এদের একজন শহীদ হয়, অন্যজন গাজি হয়ে ফিরে আসে; তারা বলে যে, ঢাকা থেকে সুহাসিনীতে ফিরে স্বাধীনতার পতাকা ওড়ানো, ইত্যাদি কর্মকাণ্ডের কথা বিবেচনা করলে বলা যায় যে, আবুকর সিদ্দিক মুক্তিযুদ্ধে যেত, অথবা সে হয়তো যুদ্ধে যেত না, কারণ, মানুষ কি করবে তা সব সময় সঠিকভাবে বুঝে ওঠা কঠিন; কিন্তু তখন সুহাসিনীর পাশ দিয়ে পাকিস্তানি মিলিটারি চলে যাওয়ার পর আলেকজানের মুখের দিকে তাকিয়ে সে যখন আর-একটি ছবি আঁকতে চায় কিন্তু আলেকজান সম্মত হয় না, তখন নীরব আলেকজানের মুখ এবং সেই মুখের বেদনা তার জন্য অন্য একটি পথই খোলা রাখে, তা হলো মুক্তিযুদ্ধে যাওয়া। গ্রামের লোকেরা বলে যে, সেদিন সকালে আলেকজান যখন তার দিকে তাকায়, সে বুঝতে পারে না মেয়েটির দৃষ্টি কি বলে, কিন্তু সে সেই দৃষ্টির কথা ভুলতে পারে না; সে নিজেদের বাড়িতে গিয়ে ঘরের ভেতর শুয়ে থাকে এবং একদিন গভীর রাতে গ্রামের অন্যান্য ছেলের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেয়ার জন্য গ্রাম ত্যাগ করে। সাত মাস পর ডিসেম্বরের হিমেল দিনে এই তরুণেরা যুদ্ধ শেষে ফিরে আসতে থাকে, তখন একদিন চারজন মুক্তিযোদ্ধা ফিরে আসে এবং তাদের কাছ থেকে লুত্যর রহমানের নিহত হওয়ার খবর পাওয়া যায়; হাঁটু পর্যন্ত লুঙ্গি গোটানো সেই নগ্নপদ তরুণেরা লক্ষ্মীকোলার ভেতর দিয়ে হেঁটে আসে, সুহাসিনীতে পৌছে তারা প্রথমে আইজ্জল প্রামাণিকের বাড়ির প্রাঙ্গণে গিয়ে দাঁড়ায় এবং আলেকজানের স্বামী লুর রহমানের মৃত্যু সংবাদ দেয়, তারা বলে যে, রাজশাহীর কাছে পাকিস্তানি মিলিটারির সঙ্গে এক খণ্ড-যুদ্ধের সময় সে নিহত হয়। গ্রামের লোকেরা বলে যে, আবুবকর সিদ্দিকের আঁকা একটি ছবির জন্য আইজ্জল প্রামাণিকের দুর্ভাগ্য একের পর এক সংযোজিত হয়; যুদ্ধে প্রিয় কন্যার জামাতার মৃত্যুর খবর শুনে তার চোখ থেকে অশ্রু নেমে আসে, আলেকজানের দুর্ভাগ্যে তার হৃদয় বিদীর্ণ হয়; কিন্তু এই খবর শুনে আলেকজান কেমন আচরণ করে তা গ্রামের লোকেরা বলতে পারে না, তবে তারা বলে যে, আলেকজান লুৎফর রহমানের মৃত্যুর খবর বিশ্বাস করতে পারে না। এরপর এইসব গ্রামে যখন ক্রমাগতভাবে মুক্তিযোদ্ধা ছেলেদের প্রত্যাবর্তনের খবর পাওয়া যেতে থাকে, গ্রামের লোকেরা খবর জানা এবং গল্প শোনার জন্য তাদের বাড়িতে গিয়ে ভিড় করে, এবং এই জনতার ভেতর চার বছরের শিশুকন্যা জয়তুনের হাত ধরে ঘোমটা টানা আলেকজানকে দেখা যায়; সে লুত্যর রহমানের খবর জানার চেষ্টা করে, আমাগোরে জয়তুনের বাপের কোনো খবর জানেন নাহি, সে জিজ্ঞেস করে, এবং দেখা যায় যে, তারা কেউ আলেকজানকে লুঙ্কর রহমানের বিষয়ে কোনো নূতন খবর দিতে পারে না। তখন একদিন মুক্তিযোদ্ধাদের আর-একটি বড় দল ফিরে আসে, এই দলের সঙ্গে মফিজুদ্দিন মিয়ার দুই ছেলে, ফরিদ হোসেন এবং আব্দুল আজিজ ফেরে এবং তারা তাদের অপর ভাই শাহজাহান আলির মারা যাওয়ার খবর দেয়, কিন্তু আবুবকর সিদ্দিক সম্পর্কে তারা কিছু বলতে পারে না, তখন, তারপর মফিজুদ্দিন মিয়ার বাড়িতে মৃত পুত্রের জন্য শোক এবং নিখোঁজ পুত্রের জন্য প্রতীক্ষা শুরু হয়। গ্রামের লোকেরা বলে যে, ডিসেম্বরের বিশ তারিখের পর একটি একটি করে দিন যেতে থাকে কিন্তু আর কেউ গ্রামে ফেরে না, তখন ডিসেম্বরের ত্রিশ তারিখে বুধবার সকালের একটু পর লক্ষ্মীকোলার রাস্তার পাশের শীর্ণ খাল বেয়ে একটি ছৈ-তোলা মাঝারি আকারের নৌকো এগিয়ে এসে রৌহার বিলের ভেতর পড়ে এবং মিয়াবাড়ির পেছনের ঘাটের দিকে এগোয়। বস্তুত লক্ষ্মীকোলার কাছে থাকতেই নৌকোটি গ্রামের লোকদের দৃষ্টিগোচর হয় এবং খবরটি গ্রামের ভেতর দ্রুত প্রচারিত হয়ে যায়, মুক্তিযোদ্ধাগোরে নৌকা আইসত্যাছে; গ্রামের লোকেরা তখন খালের পাড় দিয়ে চিষ্কার করে দৌড়াতে থাকে। নৌকোটি যখন ধীরে ধীরে এগিয়ে গিয়ে মিয়াবাড়ির ঘাটে ভেড়ে তখন সেখানে নারী, পুরুষ এবং শিশুর একটি ভিড় গড়ে ওঠে এবং এই ভিড়ের ভেতর, ঘাটের সবচাইতে নিকটে দুটি নারীকে দেখা যায়, এদের একজন চন্দ্রভান এবং অপরজন আইজ্জল প্রামাণিকের মেয়ে আলেকজান। এই নৌকোয় করে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার আবুবকর সিদ্দিক এবং আশপাশের গ্রামের অন্য ছয়জন মুক্তিযোদ্ধা ছেলে ফেরে; তারা যখন নৌকো থেকে ঘাটের কাছে মাটির ওপর নেমে আসে, জনতা তাদেরকে ঘিরে ধরে এবং আবুবকর সিদ্দিক এই জনতার ভেতর আলেকজানকে তার শিশুকন্যার হাত ধরে দাঁড়ানো দেখে, তখন তার এমন আনন্দ হয় যে, সে আলেকজানের মুখের বিষণ্ণ উৎকণ্ঠা লক্ষ করে না। সে তার কাঁধের বন্দুক ঝাকি দিয়ে ঠিক করে, এলোমেলো শশ্রুমণ্ডিত মুখটা গাছপালার মাথার দিকে উখিত করে হেসে ওঠে এবং আলেকজানের দিকে ডান হাত প্রসারিত করে দিয়ে চিৎকার করে, ভালো আছিস তুই, আলেকজান? গ্রামের লোকেরা বলে যে, আবুবকর সিদ্দিকের চিৎকার শুনে তারা আলেকজানের উপস্থিতির বিষয়ে সচেতন হয় এবং মাথার ঘোমটা পড়ে যাওয়া তার মলিন মুখের দিকে তাকিয়ে তারা তার চোখে বর্ষার পুকুরের মতো অশ্রু উপচে পড়তে দেখে। তারা এই কথাটি বুঝতে পারে না যে, মিয়াবাড়ির ঘাটে দাঁড়িয়ে আলেকজান কি শুধু লুঙ্কর রহমান না ফেরার হতাশায় কাঁদে, নাকি আবুবকর সিদ্দিকের প্রত্যাবর্তনের আনন্দেও তার কান্না আসে? আলেকজানের এই অশ্রুর সঙ্গে কতটুকু আনন্দ এবং বেদনা নির্গত হয় তার হিসেবে গ্রামের লোকেরা করতে পারে না; তাদের মনে পড়ে, সেই ক্ষণটি তখন বিষাদ মলিন হয়ে ওঠে, কারণ চন্দ্রভান যুদ্ধে নিহত শাহজাহান আলির জন্য বিলাপ করতে থাকে। আলেকজানের চোখের পানির কারণ আবুবকর সিদ্দিক তাৎক্ষণিকভাবে বুঝতে পারে না; সুহাসিনীতে যখন তাদের নৌকো প্রথম প্রবেশ করে তখন ছৈয়ের ওপর উড়তে থাকা পতাকার দিকে তাকিয়ে তার মনে পড়েছিল যে, প্রাইমারি স্কুলের মাঠে কৃষ্ণচূড়া গাছের নিচে তারা একদিন প্রাণের ভয়ে স্বাধীনতার পতাকা পুঁতে ফেলেছিল, তারপর মিয়াবাড়ির ঘাটে নৌকো ভেড়ার পর পাড়ে নেমে আলেকজানকে দেখে তার মনে পড়ে আটমাস আগে গ্রামের পাশ দিয়ে মিলিটারি চলে যাওয়ার পর একদিন সকালে আলেকজানের চেহারায় যে ভাষার প্রকাশ ঘটেছিল, যা দেখে, সে আলেকজানের মুখের আর একটি ছবি আঁকার ইচ্ছে ত্যাগ করে আইজ্জল প্রামাণিকের ভিটা ত্যাগ করে আসে। নৌকো থেকে নামার পর তার মা যখন তার প্রত্যাবর্তনের আনন্দে এবং তার ভাইয়ের মৃত্যুর বেদনায় তাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদে, তখন সে তার মাকে ধরে রেখে পুনরায় আলেকজানের মুখের দিকে তাকায় এবং তার চোখে সে অশ্রু টলমল করতে দেখে। সুহাসিনীর লোকেরা বলে যে, আলেকজানের দিকে তাকিয়ে তখন আবুবকর সিদ্দিক কিছুই বুঝতে পারে না, কিন্তু পরে যখন সে সব জানতে পারে তখনো মনে হয় যেন সে গ্রামের লোকদের মতোই জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত, বুঝে উঠতে পারে না, সেদিন মিয়াবাড়ির পেছনের ঘাটের কাছে দাঁড়িয়ে আলেকজান কেন কেঁদেছিল, সে কি শুধুই বেদনায়? সেদিন চন্দ্রভানকে জড়িয়ে ধরে রেখে বাড়ির ভেতর প্রবেশ করার পর সে তাকে অনুসরণ করে আসা গ্রামবাসীদেরকে প্রাইমারি স্কুলের মাঠে পুঁতে রাখা পতাকার কথা জিজ্ঞেস করে, পতাকাগুলান খুঁইড়া বাইর কইরছ না? তার কথা শোনার পর গ্রামের লোকদের সেই পতাকার কথা মনে পড়ে এবং তারা যখন বলে যে, তাদের পতাকার কথা মনে ছিল না, তখন পিঠে রাইফেল এবং স্টেনগান ঝোলানো সাত জন মুক্তিযোদ্ধার পেছনে কোদাল হাতে একদল গ্রামবাসী সুহাসিনীর প্রাইমারি স্কুলের মাঠের দিকে যায়। তারা এই মাঠের কৃষ্ণচূড়া গাছের তলায় এক জায়গায় খুঁড়ে পলিথিনে ব্যাগে জড়ানো পতাকাগুলো বার করে, তারপর সেদিন কিছুক্ষণ পর গ্রামের চার কোনার তালগাছের মাথার ওপর শীতের নরম রোদের ভেতর পতাকাগুলো পুনরায় উড়তে থাকে এবং তখন মিয়াবাড়ির ভেতর আবুবকর সিদ্দিকের পুনরায় মনে পড়ে তার যুদ্ধে যাওয়ার আগে আলেকজানের মুখের আর-একটি ছবি আঁকার আকাক্ষার কথা; তখন সে খুঁজে কিছু সাদা কাগজ বের করে এবং চুলা থেকে সগ্রহ করে কাঠ কয়লা, এভাবে প্রস্তুত হওয়ার পর দুপুরে পুকুরে গোসল করতে গিয়ে সে শুনতে পায় আলেকজানের বিধবা হওয়ার খবর। গ্রামের লোকেরা বলে যে, এই খবর পাওয়ার পর খরায় ফেটে যাওয়া ফসলের জমির মতো আবুবকর সিদ্দিকের হৃদয় চূর্ণ হয়ে যায়, সে গোসল শেষে চুপচাপ ভাত খেয়ে সারা বিকেল কাচারিঘরের টিনের চালের দিকে তাকিয়ে পাটিবিছানো চৌকির ওপর পড়ে থাকে; মুক্তিযুদ্ধ তার কাছে অর্থহীন হয়ে যায়, কারণ, গ্রামের লোকেরা বলে যে, আবুবকর সিদ্দিকের মনে হয় যুদ্ধ জয়ের পরেও বেদনা থেকে আলেকজানের মুক্তি আসে না; এক বেদনার ভেতর এই নারীকে রেখে সে যুদ্ধে যায়, ফিরে এসে তাকে সে পায় আর এক বেদনার ভেতর। পরদিন সকালে সে আইজ্জল প্রামাণিকের বাড়িতে গিয়ে কাচারিঘরে তার আঁকা ছবিটির সামনে পুনরায় যখন দাঁড়ায়, তখন একসময় অবধারিতরূপে আলেকজান আসে, কিন্তু এই দিনও আলেকজানের সঙ্গে তার একটিও কথা হয় না, বিষণ্ণ নির্লিপ্ত এই রমণীর দিকে সে নীরবে তাকায়, তারপর সেই ঘর এবং প্রাঙ্গণ ত্যাগ করে আসে। সুহাসিনীর লোকেরা বলে যে, এই সময় হয়তো সে তার জীবনের চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটা নেয়; আইজ্জল প্রামাণিকের কাচারিঘর থেকে বের হয়ে আসার পর সে ঢাকা ফিরে না গিয়ে গ্রামে থেকে যায়। এরপর একটি বছর সে এই নারীকে দেখে না; সে তার দাড়ি কেটে ফেলে, ঝোলার ভেতর থেকে রঙতুলি বের করে ফেলে দেয় এবং সুহাসিনীর প্রাইমারি স্কুলে মাষ্টারি শুরু করে। চিত্রকর আবুবকর সিদ্দিক যখন গ্রামের সিদ্দিক মাষ্টার হয়ে ওঠে তখন, এক বছর পর আর-এক হেমন্তের ফসল কাটার মৌসুমে, পাকা ফসলের মাটে কাঁচি হাতে নুয়ে থাকা কৃষকেরা একদিন বিকেলে গায়ে চাদর জড়ানো ঘোমটা দেয়া চন্দ্রভানকে, নাতি ফৈজুদ্দিনকে সঙ্গে নিয়ে বহুদিন পর পুনরায় মিয়াবাড়ির ভিটা থেকে নেমে আসতে দেখে, এবং গ্রামের লোকেরা একটি কথাও জিজ্ঞেস না করে বুঝতে পারে, চন্দ্রভান কোথায় যায়।