০৫. মধু এবং গৌর

মধু ঝট করে গায়ের কোটখানা খুলে নিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিল মাটিতে, তারপর দেওয়াল সংলগ্ন একটি কাঠের আলমারির পাল্লা খুলে গৌরকে জিজ্ঞেস করলো, এবার কোন পোশাকটি পরি বল তো?

আলমারিতে অন্তত কুড়ি পঁচিশ রকমের কোট ঝুলছে, বিভিন্ন বর্ণ ও গড়নের। অনেক দোকানেও এক মাপের এত রকমারি কোট দেখা যায় না। আলমারিটা রঙের শোভায় ঝলমল করছে।

বেণী জিজ্ঞেস করলো, এখন আবার কোট পরবি? তুই কি কোথাও যাবি নাকি এক্ষুনি?

মধু বললো, না, কোথাও যাবো না। তোরা এসিচিস তাতেই আমার সুখ হয়েচে।

—তাহলে কোট পরবি কেন?

–তবে কি বর্বরের মতন খালি গায়ে বসে থাকবো?

—নিজেই তো আগের কোট খুলে ফেললি।

—বেশীক্ষণ এক পোশাক পরে থাকা…ডিসগাস্টিং! তোরা কী করে পারিস? রঙ বদলালেই মুড বদলায়, কোনটা পরবো বল, গৌর?

—তোর যেটা খুশী।

—তুই পছন্দ করে দিবি না? এই সোনালীটা? এটা তোর পছন্দ?

যদিও মধু শুধু গৌরেরই মতামত চায়, তবু বেণী মাঝে মাঝে কথা না বলে পারে না। বেণীর সঙ্গে মধুর খানিকটা রেষারেষি আছে, ক্লাসে প্রায়ই টক্কর লেগে যায়। বেণী নিজেও বেশ বড় মানুষের ছেলে, কিন্তু তার বাবার কৃপণ হিসেবে খ্যাতি আছে। মধুর মতন বেণী পয়সা ওড়াবার আরাম পায় না।

বেণী বললো, এই দুপুরবেলা সোনালী কোট? বাবাঃ! কী রুচি তোর, মধু?

মধু বললো, তোর রুচির সঙ্গে আমার রুচি কোনোদিন মিলবে না, বেণী! আই লাভ টু সী দোজ ক্লাউডস্ অব গোল্ডেন ডাই ফ্লোট গ্রেসফুল ওভার ইয়ন ব্লু এক্সপ্যান্স-আকাশের দিকে চোখ চেয়ে দ্যাক—কেমন গোল্ডেন কালার হয়েচে।

বেণী জানলা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বললো, কোতায় বাবা গোল্ডেন কালার? এ তো কোন্নগরের কালো মেঘ আকাশ ছাইচে, বিকেলে ঝড় বৃষ্টি হবে।

বঙ্কু বললো, কবিরা অমন অনেক কিছু দ্যাকে।

কোটটা গায়ে দিয়ে মধু সগর্বে মঞ্চ অভিনেতার মতন পায়চারি করতে লাগলো। নেশার জন্য তার চোখ দুটি অত্যুজ্বল। মুখখানাও চকচক করছে। অন্য দিনের চেয়েও আজ তাকে বেশী অস্থির দেখাচ্ছে।

বেণী বললো, অত ছটফটাচ্ছিস কেন মধু? একটু বোস না স্থির হয়ে!

অভিনেতার ভঙ্গিতেই মধু হাসলো হা হা করে। রিচার্ডসন সাহেব হ্যামলেট পড়বার সময় যেমন থুতনিটা উঁচু করে কথা বলেন, ঠিক সেই রকম মুখ করে মধু বললো, আমি স্থির হতে পারি না, পারি না, পারি না! আই অ্যাম লাইক দা আর্থ, রিভলভিং এভার রাউণ্ড দা সেলফ-সেম সান, বয়—! এই তোরা খাচ্ছিস নি কেন? গেলাস সব ভর্তি। নে, নে, এই বন্ধু, এই ভোলা।

গঙ্গানারায়ণ মধুর পেড়াপোড়িতে ব্র্যাণ্ডি ভর্তি গেলাস হাতে নিয়ে চুপ করে বসে আছে, একবারও ওষ্ঠে ছোঁয়ায়নি। অন্যরা সবাই একটু একটু করে পান করছে।

একজন বাবুর্চি দু প্লেট ভর্তি কাবাব নিয়ে এলো। খুব নরম, এখনো ধোঁয়া বেরুচ্ছে। মধু, দু কাঁধ ঝাঁকিয়ে বললো, আহ মাই ফেভারিট! তোরা এটা টেস্ট করে দ্যাক, কচি বাছুরের মাংস-ওনলি থ্রি

গঙ্গানারায়ণ শিউরে উঠলো। হঠাৎ একটা দৃশ্য মনে পড়ে গেল তার। তাদের বাড়ির পেছনে গোয়াল ঘর আছে। কিছুদিন আগেই সেখানে একটি গাভী প্রসব করেছে। জন্মাবার পরই বাছুরটা তিড়িং তিড়িং করে লাফাতে লাগলো। আর একটু পরেই ছুটে গেল পুকুর ধারে। সে এক আশ্চর্য ব্যাপার। গঙ্গানারায়ণ আগে কখনো এমন দেখেনি। সেই বাছুরটার বয়েস এখন তিন মাস হবে বোধহয়। সাদা ধপধাপে গা, টানা টানা চোখ, গভীর কালো, ঠিক মনে হয় যেন কাজল পরানো, দেখলেই আদর করতে ইচ্ছে করে। সেই রকমই একটা বাছুরের মাংসের কাবাব দেখে মধু আহ্লাদ করছে!

অন্যরা সবাই খানিকটা করে কাবাব তুলে নিল।

বেণী সবচেয়ে প্রথমে অনেকখানি একসঙ্গে পুরে দিল মুখে। আর সঙ্গে সঙ্গে লাফিয়ে উঠলো। আসন থেকে। মুখে হাত চাপা দিয়ে আ-ফু ফু ফু শব্দ করতে লাগলো। অসম্ভব গরম মাংস, সে গিলতেও পারছে না, ফেলতেও পারছে না। সবাই হেসে উঠলো। বেণী সামলে নিয়ে ঢোঁক গিলে বললো, সত্যি ডেলিশাস…কী নরম।

গৌর জিজ্ঞেস করলো, তোর বাবা বাড়িতেই বীফ অ্যালাউ করেন, মধু?

মধু বললো, এ বাড়িতে আমি যা চাইবো তাই চলবে!

বঙ্কু বললো, মধুর বিয়েতে আমরা দারুণ কাণ্ড করবো। বাঈ নোচ লোগাবি তো, মধু?

মধু বললো, বাঈ নাচ দেখতে চাস যেদিন খুশী লাগাতে পারি, কিন্তু সেজন্য বিয়ে করার দরকার কী? বিয়ে আমি এখন কিছুতেই করবো না!

বঙ্কু বললো, আরো রাখা রাখ! ওরকম কথা সবাই বলে! তোর বাবা যখন স্থির করেচেন—

মধু বললো, বললুম না, আমার বাবার বাপের সাধ্য নেই। আমার ওপর জোর করে!

বঙ্কু সে কথাও উড়িয়ে দিয়ে বললো, তোর বাবাকে বলবো, এই শীতেই বিয়েটা লাগিয়ে দিতে! একটা বজরা ভাড়া নিয়ে ফুর্তি করবো কদিন–কমলা বলে একটা মেয়ে চমৎকার নাচে, তাকে আনবো।

কমলার নাম করে বন্ধু আড়াচোখে একবার তাকালো গঙ্গানারায়ণের দিকে। গঙ্গানারায়ণ জানে তার বাবা কমলাসুন্দরী নাম্নী একটি মেয়ের বাড়িতে প্রায়ই যাতায়াত করেন, মেয়েটির বয়স মাত্র সতেরো-আঠারো, পাথর কোঁদা চেহারা। বঙ্কু ইচ্ছে করেই খোঁচা মারলো গঙ্গাকে। গঙ্গা মুখ নীচু করে রইলো।

বেণী বললো, একটা গুড়ের নাগরির মতন মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হলে মধু জব্দ হবে।

মধু ক্রোধে চিৎকার করে বললো, তোরাও আমার বাবার দলে ভিড়তে চাস?

গৌর বললো, মধু, আস্তে।

মধু সঙ্গে সঙ্গে স্তিমিত হয়ে গিয়ে বললো, বন্ধু আর বেণী কেন আমার মনে ব্যথা দিচ্চে? ওরা কি আমার মন বোঝে না?

—তুই বাবাকে কী শাস্তি দিবি, মধু? বাবা মাকে কখনো শাস্তি দেওয়া যায়?

—যায়! আমি এ বাড়ি ছেড়ে চলে যাবো! তখন ঠ্যালা বুঝবে রাজনারায়ণ দত্ত!

বেণী ব্যঙ্গের হাসি হেসে বললো, বাড়ি ছেড়ে চলে যাবি? তখন তোর এত রঙ-বেরঙের পোশাক–, আর বোতল বোতল ব্র্যাণ্ডি আর দিনে পাঁচ রকমের খাবারের খরচ জোগাবে কে? হেঃ হেঃ হেঃ! কবিবর, তখন কি কোপ্ত কাবাবের বদলে আকাশের মেঘ। আর ব্র্যাণ্ডির বদলে হাওয়া খেলেই চলবে?

—আই কেয়ার এ ড্যাম। হ্যাঁ, হাওয়া খেয়েই থাকবো।

গৌর বললো, মধু, পাগলামি করিসনি। আমরা তো দেখিচি, তোর বাবা, তোর মা তোকে কত ভালোবাসেন, তুই তাদের মনে দুঃখ দিস না।

—দিতে হবেই। মহান কবি পোপ কী বলেছেন জানিস? টু ফলো পোয়েট্রি, ওয়ান মাস্ট লীভ বোথ ফাদার অ্যাণ্ড মাদার।

বেণী বললো, পোপ তো বলেছেলেন ও কথা, কিন্তু নিজের জীবনে কি পালন করেছেলেন? কবিরা মুখে অমন বলে, সব কতার কতা।

—দেকিস, দেকিস, আমি পারি কিনা।

গঙ্গানারায়ণ উঠে দাঁড়িয়ে বললো, আমি এবার বাড়ি যাবো।

মধু বললো, কেন? একি গঙ্গা, তুই কিছু খাসনি? গেলাস ফুরোয়নি।

বঙ্কু বললো, ফুরোবে কি, ও তো একটা চুমুকও দেয়নি।

মধু এক লফে গঙ্গানারায়ণের কাছে এসে বললো, আমার বাড়ি থেকে কেউ না খেয়ে যায় না। খা, খা।

গঙ্গা বললো, না, মধু! আজি আমি কিছু খাবো না, আমার প্রবৃত্তি নেই।

—এক চুমুক দে আগে।

—না, আমি সুরা পান করবো না।

মধু জোর করে গেলাসটা গঙ্গার মুখের কাছে আনার চেষ্টা করলো,গঙ্গাও জোর করে ছাড়িয়ে নিতে গেল নিজের হাত, সেই ধাক্কাধাকিতে গেলাস পড়ে গেল মাটিতে। মদে ভিজে গেল মেঝেতে পাতা লাল রঙের পারস্য-গালিচা, গেলাসটা গড়াতে গড়াতে চলে গেল টেবিলের তলায়।

মধু ভ্রূক্ষেপও করলো না, এবার নিজের গেলাসটা তুলে এনে বললো, নে।

গঙ্গানারায়ণ হাত জোড় করে বললো, আমাকে ছেড়ে দে মধু। আমি কিছুতেই মদ খাবো না।

—তবে কাবাব খা খানিকটা…ঠাণ্ডা মেরে গেল যে ছাই।

—আমাদের বাড়িতে একটা বাছুর আছে, আমি তাকে ভালোবাসি, আমি বাছুরের মাংসও খেতে পারবো না।

বেণী বললো, বাছুর বলিস না, শুনতে খারাপ লাগে। বল বীফ!

বঙ্কু বললো, কাবাবটা একটু খেয়ে দেখলে পারতি, গঙ্গা। এমন ভালো কাবাব লাইফ-টাইমে খাইনি।

মধু বললো, এই জন্যই তোদের কিছু হবে না! তোদের হিন্দু ধর্মের ওপর এইজন্য আমার ঘেন্না ধরে যায়। বীফ অ্যাণ্ড ওয়াইন-স্ট্রং পিপলদের সব সময় দরকার। দ্যাক ইংরেজ, ফরাসী, রুশ, যবন সবাই গোমাংস খায়, সবাই ড্রিংক করে–এইজন্যই দে আর মাইটি, দে আর কঙ্কারাস, ওরা ভালো কবিতাও লেকে! শুধু হিন্দুরাই মিনমিনে, নিরামিষ খায় আর ন্যাড়ামুণ্ডি হয়ে বসে থাকে, সেইজন্যই অন্য জাত যখন তখন এসে হিন্দুদের গালে থাপ্পড় মেরে যায়।

বেণী বললো, আমার তো বীফ ছাড়া আর কোনো মীটই ভালো লাগে না।

গঙ্গা বললো, তোরা বীফ খাচ্চিস, ব্র্যাণ্ডি খাচ্চিস, তোরা হিন্দু সমাজকে উদ্ধার করবি, আমি না হয় বাদই রইলুম।

-ফুঃ! কাওয়ার্ড!

—সবাই কি সোসিয়াল রিফর্মার হয়? সবাই সাহসী হয়?

এই গঙ্গাটার মধ্যে কোনো নিউ আইডিয়োজ নেই! তুই কি চিরকাল গোবেচারা ভালো মানুষই থেকে যাবি গঙ্গা?

-কী করবো বল! আমি তোদের মতন ব্ৰাইট নাই! গো-মাংস খেতে আমার রুচি হয় না।

অন্য বন্ধুরা গঙ্গানারায়ণকে কোণঠাসা করছে দেখে মধু হঠাৎ এক সময় হো-হো করে হেসে উঠলো। তারপর গঙ্গানারায়ণের পিঠে এক চাপড় মেরে বললো, ওদের ঠকিয়েচি রে গঙ্গা! তুই-ও ঠিকে গেলি! এ গুলো বীফের কাবাব নয় রে, বিশুদ্ধ খাসীর। বাড়িতে মা রয়েচে না, বাড়িতে কি গো-মাংস ঢোকার জো আচে? আই লাইক বীফ, কিন্তু বাইরে খেতে হয়। এগুলো খাসীর মাংস, ট্রাস্ট মী, রাজনারায়ণ দত্তের ছেলে মিথ্যে বলে না, নে, একটু টেস্ট কর—

গঙ্গানারায়ণকে আর আটকে রাখা গেল না। সে চলে যাবেই। ভোলা আর বন্ধুও আর বেশীক্ষণ অপেক্ষা করবে না। ওরাও যেতে চাইলো গঙ্গার সঙ্গে। সকলেই উঠে দাঁড়ালো।

মধু গৌরের হাত চেপে ধরে বললো, না, তুই যাবি না। তুই থাক।

গৌর বললো, আমি ফিরবো না? সেই কতদূর যেতে হবে।

মধু কাতরভাবে বললো, না, গৌর, তুই যাস না। আমি একা একা থেকে কী করবো? তুইও যদি চলে যাস আমি তবে আরও ড্রিংক করবো।–অ্যানাদার ফুল বট্‌ল।

গৌর বললো, আচ্ছা, আচ্ছা বাবা, আমি থাকচি আর একটু।

বেণী বললো, মধু, আমিও থাকচি। আমি না হয়। পরে গৌরের সঙ্গে ফিরবো। ওরা যাক।

মধুর মুখটা শুকিয়ে গেল সঙ্গে সঙ্গে। অন্যরা চলে যাবার পরও বেণীর বসে থাকা সে পছন্দ করলো না। গৌর আর মধু চুপ করে রইলো, বেণী একাই বক বক করতে লাগলো কিছুক্ষণ।

দেয়ালের পাশে একটি বড় শ্বেত পাথরের টেবিলে মধুর অনেক বই এলোমেলো করে ছড়ানো। এক সময় বেণী উঠে গিয়ে দেখতে লাগলো। সেই সব বই। যদিও বেণী খুব ভালোভাবেই জানে, মধু তার বই ঘাঁটাঘাঁটি একদম পছন্দ করে না।

দুখনো বই বেছে নিয়ে বেণী বললো, মধু, আমি এ দুটো তোর কাছ থেকে বরো করতে পারি?

মধু বললো, টেক অ্যাজ মেনি অ্যাজ ইউ উইশ। শুধু বায়রনস লাইফটা নিস না। ওটা আমি পড়চি।

জানলা দিয়ে নীচে উঁকি মেরে মধু আবার বললো, আমার পালকি বেহারারা এখুনি নাইতে যাবে, বেণী, তুই যদি বাড়ি যেতে চাস, যেতে পারিস, ওরা তোকে পৌঁছে দেবে। নইলে পরে গেলে তোকে পালকি ভাড়া করতে হবে।

বেণী সচকিত হয়ে বললো, না, না, তা হলে আমি এখুনি যাবো। কিন্তু গৌর যাবে না? কি রে, গৌর?

গীরের বদলে মধুই বললো, না, গৌর এখন যাবে না। ও সারাদিন থাকবে আমার সঙ্গে। ইভ্‌ন মে বী সারারাত!

বেণী ভুরু তুলে বললো, সারারাত!

গৌর বললো, মাথা খারাপ নাকি! সারারাত থাকবো কে বললে! তুই এগো বেণী, ও একটু ঠাণ্ডা হলেই আমি তারপর যাবো। এখন ওকে ফেলে গেলে ও আরও মদ খাবে।

বেণী মুচকি হেসে বললো, তুই ছাড়া কেউ ওকে সামলাতে পারবে না। তুই একটু আদর-যত্ন কর-হী রে মধু, তোকে একটা কথা জিজ্ঞেস করবো, তুই রাগ করবি না?

—কী?

—তুই যে অ্যাক্রসটিক কবিতাটা লিখেচিস গৌরকে নিয়ে, সেটাতে গৌরকে তুই হী না বলে শী বলিচিস কেন রে? গৌরের অবশ্য ভারী সুন্দর চেহারা, মেয়ে বলে চালিয়ে দেওয়া যায়।

মধু গম্ভীর স্বরে বললো, ওটা গৌরকে নিয়ে লেখা কে বললো? আমার বেশীর ভাগ কবিতাই তো গৌরকে ডেডিকেট করা, তা বলে কি সবই ওর উদ্দেশে লেখা?

—কিন্তু অ্যাক্রসটিক তো লাইনের প্রথম অক্ষর মিলিয়ে যার নাম হয়, তাকে নিয়েই লেখা হয়! ডি এল আর একদিন বলেচিলেন না? তারপরই তো তুই ওটা লিখলি। আমার মনে আছে এখনো কাঁটা লাইন, গো-ও! সিমপিল লে! অ্যাণ্ড টেল দ্যাট ফেয়ার, ও-হ! টিজ ফর হার, হার লাভার ডাইজ!

—ভালো করে পড়তে শেখ, বেণী! ওভাবে কবিতা পড়ে না! মনে রাখিস, তুই বায়রন কিংবা পোপের মতন একজন মহাকবির লেখা পড়চিস।

—আমার হাতে কবিতা আসে না, নইলে গৌরকে নিয়ে আমারও ওরকম লিখতে ইচ্ছে করে…

—বোহারারা নাইতে চলে গেলে পরে কিন্তু ওদের ডেকে ডেকে আর পাওয়া যাবে না।

—না, না, আমি যাচ্চি, যাচ্চি।

বেণী তাড়াতাড়ি উঠে বেরিয়ে গেল। তাকে সিঁড়ি পর্যন্ত পৌঁছে দিয়ে ফিরে এসে দরজাটা ভেজিয়ে দিল মধু। ভুরু থেকে বিরক্তি উধাও করে সে বললো, কৃপণের ব্যাটা কৃপণ! পাল্কি ভাড়া দিতে হবে শুনেই পালালো। গুড রিভেন্স।

গৌর আরক্ত মুখে নতনেত্র হয়ে বসে আছে।

মধু ছুটে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে ফটাফট চুমো দিতে দিতে বললো, এবার শুধু তুই আর আমি। আমি আর তুই। গৌর আর মধু। মধু আর গৌর। আহ! বড় আনন্দ।

গৌর নিজেকে অতি কষ্টে ছাড়িয়ে নিয়ে বললো, তুই কী পাগলামি করিস, মধু! সকলের সামনে আমায় এমন লজ্জায় ফেলিস!

মধু বললো, কিসের লজ্জা! আই অ্যাম প্যাশানেন্টলি ফণ্ড অফ ইয়োর কম্পানি, অ্যাজ আই অ্যাম অফ ইউ!

—বেণী কি রকম বিশ্ৰীভাবে কথা বলে গেল!

—বেণী বী ড্যামনড।

—না মধু, তুই মাত্রা ছাড়িয়ে যাচ্চিস। আজকাল তুই অন্যের কোনো কথা শুনিস না।

—শুধু তোর কথা শুনি।

–তুই এমন ছেলেমি করলে আমিও আর কখনো আসবো না।

—ওকথা বলিস নি গৌর, ওকথা বলিস নি। তোকে না দেখে আমি থাকতে পারবো না। এইজন্যই কি সম্প্রতি তুই আমাকে অ্যাভয়েড করিস?

—আমাদের আরও কত বন্ধু আচে, তুই আর কারো নামে কবিতা ডেডিকেট করিস না, শুধু তুই আমার নামে করিস কেন?

—বেশ করি! আমার শুধু তোকেই ভালো লাগে। তোর জন্য আমি কী এনে রেখিচি দ্যাক। টেবিলের ঐ টানাটা খোল।

—আবার কী এনিচিস?

মধু নিজেই টেবিলের ড্রয়ার খুলে ফেললো হ্যাঁচকা টানে। তার মধ্যে রয়েছে দুটি সুদৃশ্য প্রসাধন সামগ্ৰীর বোতল। মধু সে দুটি তুলে নিয়ে বললো, এই দ্যাক, সবচেয়ে বড় ফরাসী কম্পানির পমেটম। আর এটা ল্যাভেণ্ডার!

—তুই আবার এসব আনিয়েচিস আমার জন্য?

—তুই সেদিন বলিছিলিস না, তুই ল্যাভেণ্ডার খুব ভালোবাসিস?

–সে তো কতার কতা!

—ল্যাভেণ্ডারটা অতি কষ্টে জোগাড় করিচি-সব সময় পাওয়া যায় না।

—তুই আমার জন্য কত খরচ করবি, মধু? এই তো সেদিন ফরগেট মী নট পাঠালি!

—স্টিল ইউ ফরগেট মী! খরচের কথা কেন বলচিস, গৌর? তোর জন্য আমি সর্বস্ব দিতে পারি। তোর একটা ছবি আমি আমার কাচে রাখতে চাই, সে ছবি গড়াবার জন্য যদি আমার সব জামা-কাপড় বিক্রি করে দিতেও হয়, তাতেও আমি রাজি।

দু হাত ছড়িয়ে চোখ বুজে মধু আবেগের সঙ্গে বললো, অ-ল কাইণ্ড, টু দিজ ফণ্ড আর্মস অব মাইন। কা-মা! অ্যাণ্ড লেট মী নো লঙ্গার সাই!

–বেণী স্টুপিডটা ঠিকই ধরেচে, এই অ্যাক্রসটিকটা তোকে নিয়েই লেকা!

মধু আলিঙ্গনের জন্য এগিয়ে আসতেই গৌর টেবিলের অন্য দিকে চলে গিয়ে প্রসঙ্গ ঘোরাবার চেষ্টা করে বললো, তুই কি আর সত্যিই কলেজে যাবি না মধু!

মধু বললো, রিচার্ডসন যদি আবার পড়াতে আসেন, তখন ভেবে দেখতে পারি।

—পড়াশুনো মানে কি শুধু কাব্য-পাঠ? তুই অঙ্কের ক্লাসে যাস না। অনেকদিন।

—অঙ্ক আমি ঘৃণা করি। অঙ্ক শিখে কী হবে? অঙ্ক তো যে-সে শিখতে পারে, আমি পোয়েট, আমার অঙ্ক নিয়ে মাথা ঘামাবার দরকার নেই। শেক্সপীয়ার ইচ্ছে করলে নিউটন হতে পারতেন। কিন্তু নিউটনের সাধ্য ছিল না শেক্সপীয়ার হওয়ার।

—আর বাংলা ক্লাসে যাওয়া তো একেবারে ছেড়েই দিয়িচিস!

—ঐ চাকর-বাকরদের ল্যাঙ্গোয়েজ শিখে আমি সময় নষ্ট করবো বলতে চাস? ফাই আপঅন ইট।

—আমরা বাড়িতে এখনো বেঙ্গলিতে কথা বলি। শুধু চাকর-বাকিরদের ল্যাঙ্গোয়েজ বলচিস কেন?

—কথা বলার জন্য ল্যাঙ্গোয়েজ শিখতে হয় না। মুটে-মজুরিও কথা বলে।

—হেয়ার সাহেব বলেছিলেন, যারা বেঙ্গলি শিখবে না, তাদের পরীক্ষায় বসতে দেওয়া হবে না।

—আমি পরীক্ষা গ্রাহ্য করি না। আর হেয়ার সাহেব! বাদ দে, বাদ দে! মাগুর মাছের ঝোল আর ঝিঙে-পোস্ত খেয়ে খেয়ে হেয়ার সাহেব তো এখন পুরোপুরি ভেতো হিঁদু হয়ে গেচে।

—হেয়ার সাহেব আমার নমস্য। ওঁর কথাতেই আজকাল আমি বাংলায় মন দিয়েচি।

—ঐ ল্যাঙ্গোয়েজে আর কতটুকু শেখার আচে রে? ওতে আচে কী? যে ভাষায় কবিতা লেখা যায় না, সেটা আবার একটা ভাষা?

—ভারতচন্দ্ৰ তো বেঙ্গলিতেই লিখেচেন। আজকাল ঈশ্বর গুপ্ত লিখচে।

—ভারতচন্দ্র আবার কবি? বায়রন, ওয়ার্ডস্বর্থ-এর পায়ের নখের যোগ্য নয়। আর ঐ ঈশ্বর গুপ্তর মতন পদ্য আমি যখন তখন লিখতে পারি।

—তুই বেঙ্গলিতে কবিতা লিখতে পারিস? লিখে দেকা তো!

—এক্ষুনি লিখে দেখাচ্চি! কাগজ কলম নে।

—আমি লিখবো?

—আমি বলচি, তুই লিখে যা। বেঙ্গলির স্পেলিংটেলিংগুলো আমার মনে থাকে না। ঐ রেফ আর র-ফলা আর যুক্তাক্ষর, বীভৎস ল্যাঙ্গোয়েজ! ঐ ল্যাঙ্গোয়েজ নিজের হাতে লিখতে আমার ঘেন্না হয়! তুই তো একটা মেয়ে, তাই বেঙ্গলি ভালোবাসিস।

-এই মধু!

—আমি বেঙ্গলি ভালোবাসি না, তবু তোকে ভালোবাসি, গৌর! তুই লেখ, আমি বলে যাচ্চি…কী নিয়ে লিখবো বল? পাহাড়? সমুদ্র? সুন্দরী রমণী? বাঙালীদের মধ্যে আবার সুন্দর কোতায়? মেঘ। করেচে, আচ্ছা বর্ষাকাল নিয়ে লেখা যাক।

পেছনে হাত দিয়ে পায়চারি করতে করতে হঠাৎ মুখ তুলে মধু বললো, লেখ, গম্ভীর গর্জন সদা করে জলধর/উদবিল নদ নদী…

গৌর বললে, উদবিল? তার মানে কী?

—মানে নেই বুঝি? তা হলে লেখ, উথলিল। উথলিল নদ নদী ধরণী উপর—মিলেচে? জলধর আর উপর, ঠিক মেলেনি? তোদের বাঙলায় তো আবার মিল ছাড়া পদ্য হয় না। এর পরের লাইন :

রমণী রমণ লয়ে, সুখে কেলি করে

গৌর জিজ্ঞেস করলো, রমণ লয়ে? তার মানে? রমণীরা কার সঙ্গে সুখে কেলি করবে?

—কেন, রমণের সঙ্গে?

—রমণ কে? ওঃ হো! তুই বুঝি ভেবেচিস রমণীর ম্যাসকুলিন রমণ?

—তা নয়? ঠিক আচে, পরের লাইনে মিলিয়ে দিচ্চি!

রমণী রমণ লয়ে সুখে কেলি করে
দানবাদি দেব যক্ষ সুখিত অন্তরে

—সুখিত? সুখিত কথাটা হয়?

—কেন হবে না? আমি মধুসূদন দত্ত বলচি, হয়! দুঃখিত। যদি হয় তাহলে সুখিত হবে না কেন?

—আচ্ছা মানলুম। এখানেই শেষ?

—না, আরো আচে। লেখ…

সমীরণ ঘন ঘন ঝন ঝন রব
বরুণ প্ৰবল দেখি প্ৰবল প্ৰবল প্ৰবল প্ৰতাপ

—মিললো না! —মেলেনি? প্ৰবল, প্ৰবল, আচ্ছা লেখ, প্ৰবল প্রভাব।

—বরুণ প্ৰবল দেখি প্ৰবল প্রভাব?

—হ্যাঁ! তারপর, আচ্ছা, স্বাধীন বানান কি রে?

–দন্তেয় স-এ ব-ফলা আকার…

—ব-ফলা আছে? এই ফলাগুলি নিয়েও আর এক ঝামেলা! শোন, ঐ ব-ফলা দিতে হবে না, শুধু স দিয়ে লেখ।

—সাধীন?

–হ্যাঁ।

—দূর তা আবার হয় নাকি? সাধীন কথাটার কোনো মানে হয় না।

—তুই লেখ না। এখানে ব-ফলা দিলে চলবে না। কারণ আছে। শুধু স দিয়ে লেখ।

সাধীন হইয়া পাছে পরাধীন হয়
কলহ করয়ে কোনো মতে শান্ত নয়।।

–ব্যস, শেষ।

—কবিতার কী মানে হলো?

—মনে হলো না? তোর ঐ ঈশ্বর গুপ্তর চেয়ে ভালো হয়েচে। আমি যা লিখবো, তাই ভালো হবে। কবিতাটা আট লাইন হয়েচে তো ঠিক? এবার তুই সবটা একসঙ্গে পড়। আর প্রত্যেক লাইনের প্ৰথম অক্ষর জুড়ে দ্যাখ কী হয়!

গৌর মাথা নীচু করে কবিতাটা পড়লো। সঙ্গে সঙ্গে তার ফর্সা মুখটা রাঙা হয়ে গেল। মুখ তুলে সে বললো, আবার? তোকে নিয়ে যে আর পারি না!

মধু হাসতে হাসতে বললো, গউরদাস বসাক! ঠিক হয়েচে কি না! বাঙলাতেও আমি একটা অ্যাক্রসটিক লিখে দেখিয়ে দিলুম! বেণীকে বলিস, এটাও অ্যাক্রসটিক, এটারও সব লাইনের প্রথম অক্ষর নিয়ে তোর নাম হয়। কিন্তু এটা তোকে নিয়ে লেখা নয়, বর্ষাকাল নিয়ে লেখা। ইচ্ছে করলে আমি সব পারি, বুঝলি? তবে, তোদের এই ডার্টি ল্যাঙ্গোয়েজের কোনো বই আমার ছুঁতেই ইচ্ছে করে না! স্যাংস্কৃটে বামুন বামুন গন্ধ আর বাঙলায় চাকর-বাকরের গন্ধ!

—এসব কথা তুই কার কাচ থেকে শিখলি রে মধু?

-কার কাচ থেকে আবার শিখবো?

—শুনলুম তুই নাকি আজকাল কেষ্ট বাঁড়ুজ্যের কাচে ঘোরাঘুরি কচ্চিস?

—হ্যাঁ, গেচি। কয়েকবার। কেন?

—ওনার কোনো সুন্দরী মেয়েটেয়ে রয়েচে বুঝি? তার দর্শন লাভের বাসনায় যাস?

—এঃ হে হে! গৌর, তোর হিংসে হয়েচে দেখচি? হ্যাঁ, ঠিক বুঝতে পেরেচি, মুখ রক্তিম বর্ণটি ধারণ করেচে, আমি কোনো উওম্যান-এর কাচে গেলে তোর রাগ হয়, সেটা বলবি তো?

মধু এবার গৌরকে ধরে ফেলে বুকে জড়ালো। চুমো দিতে দিতে বলতে লাগলো, কিন্তু আমি তোকেই সবচেয়ে বেশী ভালোবাসি, গৌর, রাগ করিস নি, রাগ করিস নি।

—আঃ মধু, ছাড়, ছাড়।

ডান দিকের দেয়ালে একটি দরজা, তার ওপাশে মধুর শয়ন কক্ষ। মধু গৌরকে টানতে টানতে। নিয়ে এলো সেখানে। জোর করে তাকে বিছানায় বসিয়ে দিয়ে বললো, দাউ হ্যাস্ট ফরগাটুন দাই প্রমিজ অব অনারিং মাই পুয়োর কট উইথ দা সেক্রেড ডাস্ট অব ইওর ফিট!…আজ সেই প্রমিজ ফুলফিল কর। আমার খাটে একটু তোর পায়ের ধুলো দে।

গৌর বিব্রতভাবে বললো, আমি এবার–যাবো!

—না, না, গৌর, তুই যাবি না। মধু নিজে মাটিতে বসে পড়ে গৌরের উরুর ওপর দুই হাত রেখে বললো, তোর কোল পেতে দে, আমি মাথা রাখবো।

—কী পাগলের মতন কচ্চিস মধু?

—সেদিন আমি তোর কোলের ওপর কাগজ রেখে লিখতে গেসলাম, কিন্তু তুই কাগজ ফেলে দিলি–

আই থট আই শ্যাল বী এব্‌ল্‌
(মেকিং দাই ল্যাপী মাই টেবল)
টু রাইট দ্যাট নোট উইথ ঈজ;—
বাট হা! ইয়োর শেকিং
গেভ মাই পেন আ কোয়েকিং;–
রুডনেস নেভার আই সি লাইক দিস—

–কেন, কেন, কেন, কেন, গৌর? আমি তোকে এত ভালোবাসি, অথচ, তুই কেন আমাকে ভালোবাসিস না? কেন আমাকে ফিরিয়ে দিস তুই? এত কবিতা লিখি তোকে নিয়ে, তবু তোর মন পাই না? আজি তোকে কাচে পেয়েচি অনেকদিন পর।

—মধু, মাতলামি করিস না। ছাড় আমাকে।

–না, না, না।

মধুর বাড়াবাড়িকে প্রশ্রয় না দিয়ে গৌর দু হাত দিয়ে জোর করে ঠেলে দিল তার মাথাটা। ভারসাম্য হারিয়ে মধু মেঝেতে চিৎপাত হয়ে পড়ে গেল, দড়াম করে শব্দ হলো মাথা ঠোকার। গৌর সত্যিকারের কুপিত হয়েছে, সে মধুকে সাহায্য করার জন্য হাত বাড়ালো না।

একটু বাদে মধু উঠে বসে অত্যন্ত নিঃস্ব গলায় বললো, গৌর, তুইও আমায় দূরে ঠেলে দিলি? আমার আর কেউ রইলো না। আমি আর তোকে জ্বালাতন করবো না। দেকিস, একদিন আমি হঠাৎ কোথায় চলে যাবো, তোরা আর আমাকে খুঁজেও পাবি না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *