ভীষ্ম: চিন্তার সংঘাত
আঠারো দিনের যুদ্ধের প্রথম দশ দিনের সেনাপতি ভীষ্ম। বয়সে প্রৌঢ়ত্ব ছাড়িয়ে বার্ধক্যে পৌঁছেছেন, আশির ওপরে বয়স, কিন্তু সেনাপতির ভূমিকায় যুদ্ধ করছেন তরুণের মতো।[১] দিনের পর দিন পাণ্ডব কৌরব দু’পক্ষে প্রচুর লোকক্ষয় হচ্ছে, নিপুণ সেনাপতির যুদ্ধকুশলতায় কৌরবদের পরাজয়ের লক্ষণ নেই, জয়েরও না। পাণ্ডবরা, বিশেষ করে যুধিষ্ঠির, কোনও কিনারা দেখতে পাচ্ছেন না; বিপর্যস্ত বোধ করা ছাড়া। শেষ পর্যন্ত তাঁরা একদিন যুদ্ধ শেষে ভীষ্মেরই দ্বারস্থ হলেন। তাঁরা তো জানতেন যে পিতাকে সুখী করবার জন্য তিনি চিরকৌমার্য স্বীকার করবার পরে পিতা তাঁকে ইচ্ছামৃত্যুর বর দিয়েছিলেন; কাজেই ভীষ্ম নিজে মৃত্যুবরণ করতে না চাইলে, নেই তাঁকে বধ করার আর কোনও পথই। তা ছাড়া যুধিষ্ঠিরকে তিনি কথা দিয়েছিলেন যে, কৌরবপক্ষে যুদ্ধ করলেও পাণ্ডবদের মঙ্গলের জন্য তিনি পরামর্শ দেবেন। কাজেই পরামর্শ চাইতে গেলে তিনি বললেন, এ রকম ক্রমাগত লোকক্ষয়ে তিনিও ক্লান্ত ও বিচলিত। এমনিতে যুদ্ধে তাঁকে পরাজিত করবার সাধ্য কারওরই নেই। কিন্তু, তিনি যুদ্ধে বিমুখ, রুগ্ন, ভীষণ ভাবে আহত, নিরস্ত্র সৈন্য বা নারীর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করবেন না— এ তাঁর দীর্ঘকালের সংকল্প। পাণ্ডবদের চেষ্টা হবে যাতে তিনি অস্ত্র ত্যাগ করেন, যাতে অর্জুন অনায়াসেই তাঁকে পরাজিত করতে পারবেন।
দীর্ঘকাল পূর্বে যখন ভীষ্ম বিচিত্রবীর্যের জন্য বধূসংগ্রহ করতে গিয়ে কাশীর তিন রাজকন্যা অম্বা, অম্বিকা ও অম্বালিকাকে হরণ করে আনেন, তখন অম্বা তাঁকে জানান যে তিনি মনে মনে শাল্বরাজের বাগদত্তা। শুনে ভীষ্ম নিজে তাঁকে শাল্বরাজের কাছে দিয়ে আসেন। কিন্তু অম্বা পরপুরুষের জন্যে নীত হয়েছিলেন বলে, শাল্বরাজ তাঁকে গ্রহণ করলেন না। এই প্রত্যাখ্যান অপমানিত, ক্রুদ্ধ, নিষ্প্রতিকার এই অবস্থার জন্য ভীষ্মকেই দায়ী করে অম্বা তপস্যায় দেহত্যাগ করলেন; সংকল্প নিলেন, তিনি যেন জন্মান্তরে ভীষ্মের মৃত্যুর নিমিত্ত হন। বিদর্ভরাজ পুত্রের জন্য সাধনা করলে অম্বা কন্যা হয়ে তাঁর ঘরে জন্মালেন, যদিও শিব বলেছিলেন পরে এ কন্যা পুত্রত্ব লাভ করবেন। পরে তিনি স্থূণাকর্ণ যক্ষের পুরুষত্ব লাভ করেন, বিনিময়ে সেই যক্ষ নারীত্ব প্রাপ্ত হয়।[২] সেই অম্বাই বিদর্ভরাজকন্যা শিখণ্ডী, আপাতত ধার করা পুরুষত্বে পুরুষ। কিন্তু ভীষ্ম তো জানেন বাস্তবিকপক্ষে শিখণ্ডী নারীই, কাজেই পূর্ব সংকল্প অনুসারে তার বিরুদ্ধে ভীষ্ম অস্ত্রধারণ করবেন না। এখন অর্জুন যদি তাঁর রথের সামনের দিকে শিখণ্ডীকে বসিয়ে যুদ্ধ করেন তা হলে তাঁর অস্ত্র ভীষ্মকে স্পর্শ করবে। কিন্তু সামনে শিখণ্ডী থাকায় ভীষ্ম নারীবধের আশঙ্কায় অস্ত্রমোচন করতে পারবেন না। এই ভাবেই, একমাত্র এই ভাবেই, পাণ্ডবরা ভীষ্মকে পরাস্ত করতে পারবেন; অন্যথা ভীষ্ম নিজে এত শক্তিমান, সুশিক্ষিত, অভিজ্ঞ যোদ্ধা যে, সম্মুখ সমরে তাঁকে পরাজিত করবার সাধ্য আর কোনও বীরেরই নেই।
পরদিন তাই হল; অর্জুন শিখণ্ডীকে রথের সামনের দিকে বসিয়ে যুদ্ধ করতে লাগলেন। শিখণ্ডী তখন পুরুষ, যোদ্ধাও, তিনি শরনিক্ষেপ করছেন ভীষ্মের বিরুদ্ধে। তাঁর সমস্ত ক্ষোভ গ্লানি, অপমান মোচনের সুযোগ এসেছে— ভীষ্মকে বধ করে এ বার সে সবের প্রতিশোধ নিতে পারবেন। তাঁর থেকে অর্জুনের বাণ নিক্ষেপের পার্থক্য ভীষ্ম ভাল করেই বুঝতে পারছেন, বলছেন এ বাণ শিখণ্ডীর নয়, অর্জুনের। কিন্তু যুদ্ধ করতে গেলেই শিখণ্ডী আহত হবে আর ভীষ্ম জানেন শিখণ্ডী প্রকৃতপক্ষে অর্থাৎ জন্মসূত্রে নারী, তাই তিনি অস্ত্রসংবরণ করলেন। তার পরের যুদ্ধটা একতরফা। শিখণ্ডী যথাসাধ্য অস্ত্রমোচন করছেন, কিন্তু অর্জুন যথার্থ সুশিক্ষিত নৈপুণ্যে মরিয়া হয়ে যুদ্ধ করছেন। মহাভারত বলছে: গ্রীষ্মের প্রচণ্ড দাবদাহের পর যে দিন প্রথম বৃষ্টি নামে, মানুষ যেমন বাইরে বেরিয়ে শরীর পেতে দিয়ে সে বৃষ্টিধারা গ্রহণ করে তেমনই করে ভীষ্ম সারা শরীরে অর্জুনের বাণ-বর্ষণ গ্রহণ করতে লাগলেন। এক সময়ে জরা, ক্লান্তি ও অজস্র তীক্ষ্ণ শরে বিদ্ধ হওয়ার দরুণ রক্তপাতে ও যন্ত্রণায় দগ্ধ হয়ে ভীষ্ম রথ থেকে পড়ে গেলেন। নিপুণ ধনুর্ধর অর্জুন সুকৌশলে বাণে বাণে তাঁর জন্য একটা শরশয্যা নির্মাণ করলেন। ভীষ্মের দেহ ভূমি স্পর্শ করল না, ওই শরশয্যায় শায়িত রইল দীর্ঘকাল, পরে তাঁর অভীষ্ট তিথিতে তিনি স্বেচ্ছামৃত্যুর বরে মৃত্যুবরণ করলেন।
এ পর্যন্ত কাহিনি। এর জটিল গ্রন্থনার মধ্যে কয়েকটি দিক দৃষ্টি আকর্ষণ করে। ভীষ্মের স্বেচ্ছামৃত্যু-বরের সুযোগ না নিতে পারলে ভীষ্মের সেনাপতিত্বে যুদ্ধ অনির্দিষ্টকাল চলত, যে পর্যন্ত না অষ্টাদশ অক্ষৌহিণী ও পুরো পাণ্ডব সৈন্যদল নিশ্চিহ্ন হত। যুদ্ধে সেনাপতির ভূমিকায় থেকে ভীষ্ম যত ক্লান্তই হোন না কেন, এমনিতে স্বেচ্ছামৃত্যু-বরের সুযোগ নিতে পারতেন না— ক্ষত্রিয়ধর্মে এবং সেনাপতিধর্মে বাধত। অর্জুনের সঙ্গে যুদ্ধে অস্ত্রত্যাগ করার কথাই ওঠে না। তাঁর প্রতিজ্ঞা, স্ত্রী-বধ করবেন না, তাই অর্জুন রথের পুরোভাগে এক নারীকে স্থাপন করলে তবেই ভীষ্ম অস্ত্রত্যাগ করবেন। রথে শিখণ্ডীকে বসবার বুদ্ধিটা ভীষ্মই দিয়েছিলেন এবং তাঁর পরামর্শ যথার্থই কার্যকর হল।
মুশকিল থেকে যায় অনেক। শিখণ্ডী যখন স্থূণাকর্ণের পুরুষত্ব ধার করলেন তখন তিনি প্রকৃত প্রস্তাবেই পুরুষ হলেন; প্রমাণ, স্থূণাকর্ণ নারীতে পরিণত হল এবং সে বেচারি এ লজ্জায় মনিব কুবেরের সামনে বেরোতেই পারেনি। কাজেই রথারূঢ় শিখণ্ডী পুরুষই, এবং জন্মক্ষণে তার নারীত্ব যতটা সত্য ছিল, যুদ্ধক্ষণে অর্জুনের রথে তাঁর পুরুষধর্ম ঠিক ততটাই সত্য। কাজেই ভীষ্মের পক্ষে তাঁকে নারী ধরে নিয়ে স্ত্রীবধের ভয়ে অস্ত্র ত্যাগ করার মধ্যে গোলমাল থেকেই গেল। শিখণ্ডী যে পরে পুরুষ হবে, দেবতার এ বর সর্বান্তঃকরণে বিশ্বাস করতেন বলেই শিখণ্ডীর পিতা এক নারীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ দিয়েছিলেন, কারণ দেবতার বর মিথ্যা হওয়ার নয়। কাজেই যখন শিখণ্ডী পুরুষ হলেন তখন তাঁর সে পুরুষতা যথার্থই; তাকে সন্দেহ করলে দেবতার প্রতিশ্রুতি মিথ্যা হয়ে যায়। ভীষ্ম যখন শিখণ্ডীর জন্মবৃত্তান্ত, তপস্যা, বরলাভ পুরুষ হওয়া এত সবই জানতেন তখন অর্জুনের রথে আসীন শিখণ্ডী যে দেবতার বরেই আজ প্রকৃত প্রস্তাবে পুরুষ, এটাও তাঁর জানার কথা। কাজেই সেই সময়কার পুরুষ শিখণ্ডীর বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করলেও তাঁর পূর্ব প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করা হত না। তা ছাড়া এ ব্যাপারটা অর্জুনের বীরখ্যাতিকেও স্পর্শ করল, প্রায় লুকোচুরি ও প্রতারণার দ্বারা তিনি প্রতিপক্ষকে অস্ত্রত্যাগ করিয়ে তবে তাঁকে পরাস্ত করতে পারলেন। অর্জুনের শ্রেষ্ঠ ধনুর্ধর খ্যাতিতে এ কলঙ্ক লেগে রইল। যে-অর্জুনকে অপ্রতিদ্বন্দ্বী অপরাজেয় ধনুর্ধর খ্যাতিতে অচল রাখবার জন্য একদা নিরপরাধ একলব্যকে মর্মান্তিক গুরুদক্ষিণা দিতে হয়েছিল, সেই অর্জুন আজ আত্মগোপন করে প্রতিপক্ষকে অস্ত্রত্যাগ করাতে সম্মত হলেন। এতে বীরের কর্ম— শত্রুজয়— সিদ্ধ হল বটে, কিন্তু বীরের ধর্ম?
শিখণ্ডী চেয়েছিলেন ভীষ্ম-বধ তিনিই করবেন। নিমিত্ত হয়ে তিনি সে উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারলেন বটে, কিন্তু এতে পুরুষ শিখণ্ডীর মর্যাদা হয়তো পুরো বাঁচল না। রথের সামনে বসাটা এমনই এক নিষ্ক্রিয় ভূমিকা, যাতে অত প্রবল বিক্ষোভ, অপমান, গ্লানির সঙ্গে সামঞ্জস্য হয়তো রইল না। শিখণ্ডীর সংকল্প সিদ্ধ হল, কিন্তু সে-ও যেন এক চোরা পথে।
কিন্তু শেষ পর্যন্ত যে প্রশ্নটি থেকে যায় তা হল, এই সমস্ত ব্যাপারটা ঘটতে পারল শুধুমাত্র এই কারণেই যে, একদা শাল্বরাজের প্রতি আসক্ত অম্বাকে ভীষ্ম হরণ করেছিলেন সৎ-ভাই বিচিত্রবীর্যের বধূ হওয়ার জন্য। অম্বিকা অম্বালিকাকে নিয়ে কোনও গোলমাল ছিল না। ভীষ্ম কেমন করে জানবেন, অম্বা মনে মনে বাগদত্তা? এবং, যথাস্থানে পৌঁছে দেওয়ার পর কাপুরুষ শাল্বরাজ যে বাগদত্তা কন্যাকে প্রত্যাখ্যান করবেন সেটাই বা তিনি জানবেন কী করে? এই ব্যাপারে ভীষ্ম সম্পূর্ণ নির্দোষ। রাজকন্যাদের হরণ করার পূর্বে তাঁর কী করে মনে আসবে এদের কেউ অন্যের প্রতি আসক্ত? যখনই জানতে পারলেন তখনই নিজে অম্বাকে সঙ্গে নিয়ে শাল্বরাজের কাছে পৌঁছে দিলেন। অর্থাৎ ক্ষত্রিয় বীরের ধর্মে যা করণীয় তাই করলেন। শাল্বরাজের কাপুরুষোচিত অমানবিক প্রত্যাখ্যানই অম্বার জীবনে ব্যর্থতার কারণ; এ অপমানের প্রতিবাদের ক্রোধটা বর্ষিত হওয়া উচিত ছিল তারই ওপরে। তা না হয়ে সমস্ত রাগটা গিয়ে পড়ল ভীষ্মের ওপরে। এত তার তীব্রতা যে, এখান থেকে গৃহীত হল ভীষ্মের প্রাণহানির শপথ, তার জন্য সাধনা ও পরে তার সিদ্ধিতে জ্বালার উপশম।
মহাভারতের পাঠক শ্রোতার এই অংশে কী রকম প্রতিক্রিয়া হওয়া সম্ভব? অম্বা লাঞ্ছিত, কিন্তু তার দায়িত্ব তো তার পূর্বরাগের আধার শাল্বরাজের। অথচ ভীষ্মকে বধ করার কঠোর সংকল্প, নিজের পুরুষবেশী নারী-জীবনে অপর এক নারীর সঙ্গে বিবাহ প্রহসন, তারই পরিণতিতে পিতৃরাজ্য আক্রান্ত হওয়া, বনে গিয়ে স্বর্ণাকর্ণের সঙ্গে লিঙ্গ বিনিময়, পরে অর্জুনের রথারূঢ় হয়ে শুধু মাত্র নিমিত্তরূপে ভীষ্মের ওপরে সেই তীব্র ক্রোধের উদ্গীরণ— পাঠক এর পৌর্বাপর্য ও অমোঘ ঘটনাগতি বুঝলেও তার বিবেক কি সায় দেয় এ সমস্ত ব্যাপারটায়? মনে কি হয় ভীষ্ম, অর্জুন, অম্বা-শিখণ্ডীর আচরণ অমোঘ এবং যথার্থ? ভীষ্ম অবধ্য, অজেয়, স্বেচ্ছামৃত্যু-বরপ্রাপ্ত, সেই ভীষ্মকে পরাজিত ও বধ করার জন্য দু-জন্মে অম্বার প্রচেষ্টা, অর্জুনের একটা স্পষ্ট প্রতারণায় লিপ্ত হয়ে— হোক না তা ভীষ্মেরই পরামর্শে— ক্ষাত্রধর্ম ও বীরোচিত আচরণের নীতি থেকে ভ্রষ্ট হওয়া, এটা তো রয়ে গেল। এবং যে ছলনাটুকু স্বয়ং ভীষ্মই বলে দিয়েছিলেন তার মধ্যে যে ফাঁকটা, অর্থাৎ অর্জুনের রথারূঢ় পুরুষটিতে তার পূর্বজন্মের নারীত্ব আরোপ করে স্ত্রীবধের আশঙ্কায় ভীষ্মের অস্ত্রত্যাগ, এটা পাঠক কী ভাবে নেবে? তার প্রতিক্রিয়া সংশয়িত হতে বাধ্য। নির্দোষ অম্বার লাঞ্ছনা যেমন সত্য ও মর্মান্তিক, তেমনই নির্দোষ ভীষ্মের মিথ্যা নারীবধের আশঙ্কায় মৃত্যুবরণও সমান হৃদয়বিদারক। শাল্বরাজ মহাভারতে অপরিচিত-প্রায়; সে দোষী, কিন্তু কোনও শাস্তি পেল না; নিদারুণ শাস্তি দিল শুধু অম্বাকে— এটিও পাঠককে পীড়িত করে। অর্জুন আড়ালে থেকে যুদ্ধ করে প্রতিপক্ষকে প্রথমে পরাস্ত ও পরে নিহত করার ব্যবস্থা করলেন— এটিও ক্ষত্রিয়ের অনুচিত, সে অস্বস্তিও থেকে যায়, যেমন আড়াল থেকে রামের বালিবধের ব্যবস্থা। রামায়ণ ওই ঘটনাটায় স্বস্তিবোধ করেনি। মহাকাব্যের নায়কের এ আচরণকে উপলক্ষ্য করে বিস্তর বাদানুবাদের অবতারণা করেছে। এখানেও সেই দ্বিধা থাকে। পাঠকের সহানুভূতি, সমর্থন সরলরেখার কোনও পথ খুঁজে পায় না— বারে বারে সামনে প্রতিকূল নৈতিকতায় নানা ভাবে ব্যাহত হয়। রামায়ণের মতো জনপ্রিয়তা যে মহাভারতের সে ভাবে হল না, তার কারণ এই ধরনের বহুধা-প্রবাহিত সংবেদনের আঘাতে পাঠক বিমূঢ় বোধ করে। তার প্রতিক্রিয়া আবেগ বা নৈতিকতার কোনও সোজা পথ খুঁজে পায় না। এ ব্যাপারে আরও একটা গুরুত্বের দিক হল, ভীষ্ম প্রথম ও প্রধান সেনাপতি; দশ দিনের যুদ্ধে দু’পক্ষে বিস্তর সৈন্যক্ষয় হল বটে, কিন্তু ভীষ্মবধের কোনও লক্ষণ দেখা গেল না। পাণ্ডবদের যুদ্ধজয়ের পথে এ এক নিদারুণ সমস্যা। এই গুরু সমস্যার সমাধান এল একরাশ ফাঁক ও ফাঁকির মধ্যে দিয়ে। নিষ্পাপ ভীষ্মের ওপরে (অপরাধী শাল্বরাজের ওপরে নয়) অম্বার দুর্জয় ক্রোধ, বিদর্ভরাজকন্যার নারীকে বিবাহ করে উপহাসিতা হওয়া; দেবতার বরে— প্রত্যক্ষত নয়— কিন্তু যক্ষ স্থূণাকর্ণের বদান্যতায় পুরুষত্বলাভ; সর্বজ্ঞ ভীষ্মের এ কথা জেনেও তাকে নারী রূপে গ্রহণ করা এবং ক্ষত্রিয়বীর অর্জুনের ছলনাকে আশ্রয় করে কৌরবপক্ষের শ্রেষ্ঠ সেনাপতিকে পরাস্ত করা— এ সবই পাঠককে একটা গোলকধাঁধার মধ্যে ঠেলে দেয়।
অথচ জীবনে তো এমনই ঘটে। ঘটনাও সরল নয়, তার মূলও সহজ নয়। ফলে তার আবেদনও বহুমুখী এবং মানুষকে প্রায়ই পরস্পর-বিরুদ্ধ আবেদনের সম্মুখীন হতে হয়। জীবনকে মানুষ যে ভাবে মেনে নেয়, বোঝবার চেষ্টা করে, জর্জরিত বোধ করে, তেমনই মহাভারতের কাহিনিতে সাড়া দিতে গিয়েও মানুষ বিপর্যস্ত, বিভ্রান্ত বোধ করে। যে রচনায় এই বিভ্রান্তি আসে তার জনপ্রিয়তা ঘটে না; সাধারণ মানুষ চায় সংবেদনে বিশ্রান্তি।
***
১. ভীষ্মপর্ব (১১১:১); দ্রোণপর্ব (১:৩৩)
২. ‘অর্জুনস্য ইমে বাণাঃ শিখণ্ডিন’; ভীষ্মপর্ব (৬৮:৩০)