‘তুমি ভিক্টোরিয়ার কথাটা জিজ্ঞেস করলে না কেন?’ আমি ফেলুদাকে জিজ্ঞেস করলাম গাড়িতে চৌরঙ্গির দিকে যেতে যেতে। আজ লালমোহনবাবু ধরেছেন ব্লু ফক্সে গিয়েই চা-স্যান্ডউইচ খাওয়াবেন। কে জানত যে এই ব্লু ফক্সে গিয়েই ঘটনার মোড় ঘুরে যাবে!
ফেলুদা বলল, ‘তার ব্যাগের কাগজপত্র আমি ঘাঁটাঘাঁটি করেছি সেটা জানলে কি ভদ্রলোক খুব খুশি হতেন? আর লেখাটা সাংকেতিক না হোক, সংক্ষিপ্ত ভাষায় তো বটেই। যদি কোনও গোপনীয় ব্যাপার হয়ে থাকে?’
‘তা বটে।’
লালমোহনবাবুকে একটু ভাবুক বলে মনে হচ্ছিল। ফেলুদাও সেটা লক্ষ করেছে। বলল, ‘আপনার চোখে উদাস দৃষ্টি কেন?’
ভদ্রলোক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘পুলক ছোকরার জন্য একটা ভাল প্লট ফেঁদেছিলুম। নির্ঘাত আবার হিট হত—তা সে আজ লিখেছে হিন্দি ছবিতে নাকি থ্রিল আর ফাইটিং-এর বাজারে মন্দা। সবাই নাকি ভক্তিমূলক ছবি চায়। জয় সন্তোষী মা সুপারহিট হবার ফলে নাকি এই হাল। ভেবে দেখুন!’
‘তা আপনার মুশকিলটা কোথায়! ভক্তিভাব জাগছে না মনে?’
লালমোহনবাবু কথাটার উত্তর দেবারও প্রয়োজন বোধ করলেন না। কেবল ভীষণ একটা অভক্তির ভাব করে দুবার ‘হেল’ ‘হেল’ বলে চুপ করে গেলেন। হেল বলার কারণ অবিশ্যি পুলক ঘোষালের চিঠি নয়। আমরা বিড়লা প্লানেটেরিয়াম ছাড়িয়ে চৌরঙ্গিতে পড়েছি; বাঁয়ে মাটির পাহাড় ময়দানটাকে আড়াল করে দিয়েছে। লালমোহনবাবু কিছুদিন থেকে পাতাল রেল না বলে হেল রেল বলছেন।
গাড়ি ক্রমাগত গাড্ডায় পড়ছে আর লালমোহনবাবু শিউরে শিউরে উঠছেন। বললেন, ‘স্প্রিং যতটা খারাপ ভাবছেন ততটা নয়। চলুন রেড রোড দিয়ে, দেখবেন গাড়ির কোনও দোষ নেই।’
‘তাও তো এখন রাস্তা পাকা,’ বলল ফেলুদা, ‘দুশো বছর আগে এ রাস্তা ছিল গেঁয়ো কাঁচা। কল্পনা করে দেখুন।’
‘তখন তো আর অ্যাম্বাসাডর চলত না। আর এত ভিড়ও ছিল না।’
‘ভিড় ছিল, তবে সে মানুষের নয়, হাড়গিলের।’
‘হাড়গিলে?’
‘সাড়ে চার ফুট লম্বা পাখি। রাস্তায় ময়লা খুঁটে খুঁটে খেত। এখন যেমন দেখছেন কাক চড়ুই, তখন ছিল হাড়গিলে। গঙ্গার জলে মড়া ভেসে যেত, তার উপর চেপে দিব্যি নৌসফর করত।’
‘জংলি জায়গা ছিল বলুন! বীভৎস। ভয়াবহ।’
‘তারই মধ্যে ছিল লাটের বাড়ি, সেন্ট জনস চার্চ, পার্ক স্ট্রিটের গোরস্থান, থিয়েটার রোডের থিয়েটার, আর আরও কত সাহেব-সুবোদের বাড়ি। এ অঞ্চলটাকে বলত হোয়াইট টাউন—এদিকে নেটিভদের নো-পাত্তা, আর উত্তর কলকাতা ছিল ব্ল্যাক টাউন।’
‘গায়ের রক্ত গরম হয়ে যাচ্ছে মশাই।’
পার্ক স্ট্রিটে এসে মোড় ঘুরে ব্লু ফক্সের আগেই ফেলুদা গাড়ি থামাতে বলল।— ‘একবার বইয়ের দোকানে ঢুঁ মারতে হবে।’
অক্সফোর্ড বুক কোম্পানি সম্পর্কে লালমোহনবাবুর কোনও উৎসাহ নেই, কারণ এখানে রহস্য রোমাঞ্চ সিরিজের বই বিক্রি হয় না। বললেন, ‘আমাদের কলেজ স্ট্রিট আর বালিগঞ্জের ব্ল্যাকবুকশপ বেঁচে থাকুক।’
ফেলুদা দোকানে ঢুকে এদিক-ওদিক ঘুরে একটা কাউন্টারের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। সামনে থরে থরে সাজানো রয়েছে নীল আর লাল খাতা, ফাইল, ডাইরি, এনগেজমেন্ট প্যাড। একটা নীল খাতা হাতে তুলে দামটা দেখে নিল। বারো-পঞ্চাশ। ঠিক এ-রকম খাতা ছিল নরেন বিশ্বাসের টেবিলে।
‘ইয়েস?’
দোকানের একজন লোক এগিয়ে এসেছে ফেলুদার দিকে।
‘কুইন ভিক্টোরিয়ার কোনও চিঠির কালেকশন আছে আপনাদের এখানে?’
‘কুইন ভিক্টোরিয়া? নো স্যার। তবে আপনি প্রকাশকের নাম বলতে পারলে আমরা আনিয়ে দিতে পারি। যদি ম্যাকমিলন বা অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি হয় তা হলে ওদের কলকাতার আপিসে খোঁজ করে দেখতে পারি।’
ফেলুদা কী যেন ভাবল। তারপর বলল, ‘ঠিক আছে। আমি খোঁজ করে আপনাদের জানাব।’
আমরা পার্ক স্ট্রিটে বেরিয়ে এলাম। গাড়িটা এগিয়ে ব্লু ফক্সের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে, আমরা হেঁটে এগোতে লাগলাম।
‘একটু দাঁড়া!’—ফেলুদা পকেট থেকে তার খাতাটা বার করেছে।—‘ভিড়ের মধ্যে হাঁটতে হাঁটতে পড়া যায় না।’
কয়েক সেকেন্ড খাতায় চোখ বুলিয়েই ফেলুদা আবার হাঁটতে শুরু করল। ‘কিছু পেলে?’ আমি জিজ্ঞেস করলাম। জবাব এল: ‘আগে ব্লু ফক্সে গিয়ে বসি।’
রেস্টোরান্টে বসে জানা গেল ব্লু ফক্স নামটা ভাল লাগে বলেই লালমোহনবাবু আমাদের এখানে এনেছেন। নিজে এর আগে কখনও আসেননি। এমনকী পার্ক স্ট্রিটের কোনও রেস্টোরান্টেই আসেননি।—‘থাকি সেই গড়পারে। পাবলিশার কলেজ স্ট্রিট পাড়ায়, এ তল্লাটে খেতে আসার মওকাই বা কোথায় আর দরকারই বা কী?’
চা আর স্যান্ডউইচ অর্ডার দেবার পর ফেলুদা খাতাটা আবার বার করে টেবিলের উপর রাখল। তারপর সেই পাতাটা খুলে বলল, ‘প্রথম লাইনটা এখনও রহস্যাবৃত। দ্বিতীয়টা কবজা করে ফেলেছি। এগুলো সব বিদেশি প্রকাশকের নাম।’
‘কোনগুলো?’ জিজ্ঞেস করলাম আমি।
‘MM, OU, GAA, SJ আর WN হল যথাক্রমে ম্যাকমিলন, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস, জর্জ অ্যালেন অ্যান্ড আনউইন, সিজিক অ্যান্ড জ্যাকসন, ওয়াইডেনফেলড অ্যান্ড নিকলসন।’
‘বাপরে বাপ’, বললেন জটায়ু, ‘আপনার জিহ্বার জয় হোক। এতগুলো ইংরিজি নাম হোঁচট না খেয়ে একধারসে আউড়ে গেলেন কী করে মশাই?’
‘বোঝাই যাচ্ছে ভদ্রলোক এইসব পাবলিশারদের চিঠি লিখতেন বা লিখছেন, ভিক্টোরিয়ার চিঠির সংকলন সম্বন্ধে খোঁজ করে। অথচ মজা এই যে, এত না করে ব্রিটিশ কাউনসিল বা ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে গিয়ে ভিক্টোরিয়ার চিঠি পড়ে আসা ঢের সহজ ছিল।’
‘এ যেন মাথার পিছন দিক দিয়ে হাত ঘুরিয়ে নাক দেখানো’, মন্তব্য করলেন জটায়ু।
ফেলুদা খাতাটা পকেটে পুরে স্যান্ডউইচের জায়গা করে দিয়ে একটা চারমিনার ধরাল। লালমোহনবাবু টেবিলের উপর তাল ঠুকে একটা বিলিতি ধাঁচের সুরের এক লাইন গুন গুন করে বললেন, ‘চলুন কোথাও বেরিয়ে পড়ি শহরের বাইরে। বাইরে গেলেই দেখিচি আপনার কেসও জোটে, আমার গল্পও জোটে। কোথায় যাওয়া যায় বলুন তো? বেশ রুক্ষ জায়গা হওয়া চাই। সমতল শস্যশ্যামলা আয়েশি ভেতো মিনমিনে পরিবেশ হলে চলবে না। বেশ একটা—’
স্যান্ডউইচের প্লেট এসে পড়ায় আর কথা এগোল না। আমাদের তিনজনেরই খিদে পেয়েছিল বেশ জবর। একসঙ্গে দু জোড়া স্যান্ডউইচে একটা বিশাল কামড় দিয়ে তিনবার চোয়াল খেলিয়েই লালমোহনবাবু কেন জানি থমকে গেলেন। তারপর গোল গোল চোখ করে দুবার পর পর ‘ঈশ্বরের জয়…ঈশ্বরের জয়’ বললেন, যার ফলে মুখ থেকে কয়েকটা রুটির টুকরো ছিটকে বেরিয়ে টেবিলের ওপর পড়ল।
ব্যাপারটা হল এই—আমি আর ফেলুদা রাস্তার দিকে মুখ করে বসে ছিলাম, আর লালমোহনবাবুর মুখ ছিল রেস্টোরান্টের পিছন দিকটায়। ঘরের শেষ মাথায় একটা নিচু প্ল্যাটফর্ম, দেখেই বোঝা যায় সেখানে রাত্রে বাজনা বাজে। সেখানে একটা সাইনবোর্ড দেখেই জটায়ুর এই দশা। তাতে রয়েছে এই বাজনার দলের নাম, আর নামের ঠিক তলায় লেখা—‘গিটার—ক্রিস গডউইন।’
ফেলুদা হাত থেকে স্যান্ডউইচ নামিয়ে একটা বেয়ারাকে তুড়ি দিয়ে কাছে ডাকল।
‘এখানে ডিনারের সময় বাজনা বাজে?’
‘হাঁ বাবু, বাজতা হ্যায়।’
‘তোমাদের ম্যানেজারের সঙ্গে একটু কথা বলতে পারি?’
ক্রিস গডউইনের ঠিকানা জোগাড় করাই ফেলুদার উদ্দেশ্য, আর তার জন্য একটা জুতসই অজুহাতও রেডি করে রেখেছিল। ম্যানেজার আসতে বলল, ‘বালিগঞ্জ পার্কের মিস্টার মানসুখানির বাড়িতে বিয়ের জন্য একটা ভাল বাজিয়ে গ্রুপ চাই। আপনাদের এখানের দলটার খুব নাম শুনেছি—তারা কি বিয়েতে ভাড়া খাটবে?’
‘হোয়াই নট? এটাই তো তাদের পেশা।’
‘ওই যে গডউইন নামটা দেখছি, ওই বোধহয় লিডার? ওর ঠিকানাটা যদি…’
ম্যানেজার একটা স্লিপে ঠিকানাটা লিখে ফেলুদাকে এনে দিলেন। দেখলাম লেখা আছে—১৪/১ রিপন লেন।
অন্য দিন হলে গল্প-টল্প করে চা-স্যান্ডউইচ খেতে যতটা সময় লাগত, আজ অবিশ্যি তার চেয়ে অনেক কম লাগল। ফেলুদার খিদে মিটে গেছে; সে একটার বেশি খেল না। লালমোহনবাবু অসম্ভব স্পিডে আর এনার্জির সঙ্গে ফেলুদার দুটো আর নিজের তিনটে খেয়ে ফেলে বললেন, ‘পয়সা যখন পুরো দেব তখন খাবার ফেলা যায় কেন মশাই?’
* * *
ফোর্টিন বাই ওয়ান রিপন লেনের বাইরেটা দেখে মনটা দমে যাওয়া স্বাভাবিক—কারণ সাদত আলির নবাবির কথা এখনও ভুলতে পারিনি। কিন্তু ফেলুদা বলল, এতে আশ্চর্য হবার কিছু নেই। চার-পাঁচ পুরুষের ব্যবধানে একটা পরিবার যে কোথা থেকে কোথায় নামতে পারে তার কোনও লিমিট নেই। অবিশ্যি বাড়িগুলো যে খুব ছোট তা নয়, সবই তিনতলা চারতলা, কিন্তু কোনওটারই বাইরেটা দেখে ভিতরে ঢুকতে ইচ্ছে করে না। লালমোহনবাবু বললেন যে, বোঝাই যাচ্ছে এর প্রত্যেকটাই হানাবাড়ি। যাই হোক, ঢোকার আগে পাশেই একটা পান-বিড়িওয়ালাকে ফেলুদা জিজ্ঞেস করে নিল।
‘ইয়ে কোঠিমে গডউইন সাহাব বোলকে কোই রহতা হ্যায়?’
‘গুডিন সাহাব? জো বাজা বাজাতা হ্যায়?’
‘সে ছাড়া আরও আছে নাকি?’
‘বুঢঢা সাহাব ভি হ্যায়। মার্কিস সাহাব। মার্কিস গুডিন।’
‘কোন তলায় থাকেন সাহেব?’
‘দো তল্লা। তিন তল্লামে আর্কিস সাহাব।’
‘আর্কিস-মার্কিস দুই ভাই নাকি বাবা?’ প্রশ্ন করলেন লালমোহনবাবু।
‘নেহি বাবু। আর্কিস সাহাব আর্কিস সাহাব, মার্কিস সাহাব গুডিন সাহাব—দো তল্লামে মার্কিস সাহাব, তিন তল্লামে…’
ফেলুদা আর্কিস-মার্কিসের ঝামেলা ছেড়ে ইতিমধ্যে চোদ্দ বাই একে ঢুকে পড়েছে। আমরাও দুগ্গা বলে তার পিছন পিছন ঢুকলাম।
যা ভেবেছিলাম তাই। ভিতরে বাইরে কোনও তফাত নেই। জুন মাসের দিন বড় বলে এই সাড়ে ছ’টার সময়ও বাইরে আলো রয়েছে, কিন্তু ভিতরে সিঁড়ির কাছটায় একেবারে মিশমিশে অন্ধকার। ফেলুদার একটা অদ্ভুত ক্ষমতা আছে— হয়তো ওর চোখটাই ওইভাবে তৈরি—অন্ধকারে সাধারণ লোকের চেয়ে ও অনেক বেশি দেখতে পায়। ওর তরতরিয়ে সিঁড়ি ওঠা দেখে লালমোহনবাবু রেলিংটাকে খামচে ধরে কোনওরকমে উঠতে উঠতে বললেন, ‘ক্যাট-বার্গলার হয় জানতুম মশাই, ক্যাট-গোয়েন্দা এই প্রথম দেখলুম।’
দোতলা থমথমে। একটা ক্ষীণ বাজনার শব্দ শোনা যাচ্ছে, বোধ হয় কোনও রেডিও থেকে আসছে। সিঁড়ির মুখে একটা দরজা, তার পিছনে বারান্দা, তাতে আলো না জ্বললেও বাইরেটা খোলা বলে খানিকটা দিনের আলো এসে পড়ে বারান্দার ভাঙা-কাচের টুকরো বসানো মেঝেটাকে বুঝিয়ে দিচ্ছে। আমাদের বাঁয়ের দরজা দিয়ে যে ঘরটা দেখা যাচ্ছে তাতে কেউ নেই, কারণ বাতি জ্বলছে না। ভিতরে বারান্দার বাঁ দিকে একটা ঘর আছে বুঝতে পারছি, কারণ সেই ঘর থেকেই এক চিলতে আলো এসে বারান্দার একটা কোণে পড়েছে। একটা কালো বেড়াল সেই আলোয় কুণ্ডলী পাকিয়ে বসে একদৃষ্টে আমাদের দেখছে। তিনতলা থেকে পুরুষের গলার শব্দ পাচ্ছি মাঝে মাঝে। একবার যেন একটা ঘংঘঙে কাশির শব্দও পেলাম।
‘বাড়ি চলুন’, বললেন জটায়ু। ‘এ হল রিপন লেনের গোরস্থান।’
ফেলুদা বারান্দার দরজার দিকে এগিয়ে গেল।
‘কোই হ্যায়?’
কয়েক সেকেন্ড কোনও শব্দ নেই, তারপর উত্তর এল—‘কৌন হ্যায়?’
ফেলুদা ইতস্তত করছে, এমন সময় আবার কথা এল, এবার বেশ কড়া স্বরে।
‘অন্দর আইয়ে!—আই কান্ট কাম আউট।’
‘ভেতরে যাবেন, না বাড়ি যাবেন?’
ফেলুদা লালমোহনবাবুর প্রশ্ন অগ্রাহ্য করে চৌকাঠ পেরিয়ে এগিয়ে গেল। ও ঘুড়ি, আমরা ল্যাজ; এঁকেবেঁকে এগোলাম দুজনে পিছন পিছন।
‘কাম ইন,’ হুকুম এল বাঁয়ে ঘরের ভিতর থেকে।