০৫. ভাঙাচোরা স্কুল

০৫. ভাঙাচোরা স্কুল

জয়নব বলল, “ঐ যে আমাদের স্কুল।”

রাশা তাকিয়ে দেখল তারা যে মেঠোপথ দিয়ে হেঁটে আসছে তার শেষ মাথায় একটা বড় ঝাকড়া গাছ, গাছের নিচে কিছু টিনের ঘর। সামনে একটা খোলা মাঠ, সেখানে কিছু ছেলেমেয়ে ছোটাছুটি করে খেলছে।

আজ সকালে রাশা তার গ্রামের ছেলেমেয়েদের সাথে হেঁটে হেঁটে তাদের স্কুলটা দেখতে এসেছে। সে যদি লেখাপড়া করতে চায় তাহলে এখানেই পড়তে হবে। স্কুলটা অনেক দূরে, কমপক্ষে তিন মাইল, হেঁটে আসতে আসতে একঘণ্টা লেগে গেছে।

আরেকটু এগিয়ে গিয়ে স্কুলের সাইনবোর্ডটা চোখে পড়ল, বড় বড় করে স্কুলের নাম লেখা, আহাদ আলী উচ্চ বিদ্যালয়। রাশা জয়নবের দিকে তাকিয়ে বলল, “আহাদ আলী কে?”

“পাশের গ্রামের একজন মাতবর। অনেক টাকা।”

“তুমি বলেছিলে পাশের গ্রামে একজন রাজাকারও ছিল, নাম আহাদ আলী।”

“একই মানুষ।”

“একই মানুষ?” রাশা চমকে উঠল, “একটা রাজাকারের নামে স্কুল?”

জয়নব মুখ কালো করে মাথা নাড়ল। বলল, “এখন সবাই মনে হয় ভুলেই গেছে ব্যাটা রাজাকার ছিল। স্কুল তৈরি করেছে, মাদ্রাসা তৈরি করেছে। অনেক টাকা।”

“কী করে?”

“জানি না। যুদ্ধের সময় হিন্দুদের জমি দখল করেছিল। তখন থেকে বড়লোক।”

রাশা হতভম্ব হয়ে স্কুলের সাইনবোর্ডের দিকে তাকিয়ে রইল। তার নানা মুক্তিযুদ্ধে শহীদ হয়েছিলেন, আর সে রাজাকারের নামে দেয়া একটা স্কুলে পড়বে? ছিঃ!

জয়নব তার ক্লাসে বই-খাতা রাখতে গেল। রাশা তখন তার ক্লাসঘরটা একবার উঁকি দিয়ে দেখে একটা ক্লাসঘর যে এত খারাপ হতে পারে সে নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করত না। সস্তা কাঠ দিয়ে তৈরি বেঞ্চ, দেখে মনে হয় ভেঙে পড়ে যাচ্ছে। জোড়াতালি দিয়ে কোনোভাবে দাঁড় করে রাখা হয়েছে। দেয়াল থেকে ইট বের হয়ে আছে, সামনে রং ওঠা একটা বিবর্ণ ব্ল্যাকবোর্ড। ক্লাসের মেঝে একসময় পাকা করা হয়েছিল, এখন জায়গায় জায়গায় গর্ত। ছেঁড়া কাগজ, গাছের পাতা, ধূলাবালিতে পুরো মেঝেটা নোংরা হয়ে আছে। স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা আসছে, গ্রামের ছেলেমেয়ে বেশিরভাগেরই পায়ে জুতো পর্যন্ত নেই। স্কুলের পোশাক নেই, তাই যার যেটা ইচ্ছে সেটা পরে এসেছে, দেখে স্কুল বলেই মনে হয় না। ছেলেমেয়েগুলোর শুকনো চেহারা দেখেই বোঝা যায় গরিব ঘর থেকে এসেছে।

জয়নব তার বই-খাতা রেখে রাশাকে তাদের হেডমাস্টারের রুমে নিয়ে গেল। এক কোনায় ছোট একটা রুমে একজন বয়স্ক মানুষ একটা খাতার উপর ঝুঁকে কিছু একটা দেখছিলেন, জয়নব বলল, এই মানুষটাই নাকি হেডমাস্টার। রাশা ঘরের দরজায় দাঁড়িয়ে বলল, “আসতে পারি স্যার?”

হেডমাস্টার খাতা থেকে চোখ না তুলে বললেন, “কে?”

রাশা কী বলবে বুঝতে পারল না, ইতস্তত করে বলল, “আমি স্যার একটা জিনিস নিয়ে একটু কথা বলতে এসেছি।”

এবারে হেডমাস্টার মুখ তুলে তাকালেন, রাশাকে দেখে একটু অবাক হয়ে গেলেন, বললেন, “আসো। কী বিষয়?”

“আমি স্যার একটু খোঁজ নিতে এসেছিলাম। আপনাদের স্কুলে ভর্তি হতে হলে কী করতে হয় সেটা জানতে চাচ্ছিলাম।”

হেডমাস্টার একটু অবাক হয়ে রাশার দিকে তাকিয়ে রইলেন, তার জীবনে কখনোই হয়নি যে একটা ছাত্র বা ছাত্রী নিজে নিজে স্কুলে এসে ভর্তি হতে চেয়েছে। সবসময়েই বড় একজন মানুষ ছাত্রছাত্রীদের ভর্তি করতে নিয়ে এসেছে। হেডমাস্টার জিজ্ঞেস করলেন, “তোমার বাবা-মা কই?”

“দেশের বাইরে। “দেশের বাইরে কোনখানে?”

রাশা ভেতরে ভেতরে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলল, এখন তাকে তার পুরো ইতিহাসটা বলতে হবে। বলতেই যখন হবে তখন আর ইতিউতি করে লাভ নেই, সোজাসুজি বলে ফেলাই ভালো। রাশা তাই সোজাসুজি বলে ফেলল, “আমার বাবা কানাডায় আছেন। মা আছেন অস্ট্রেলিয়ায়। আমাকে এখানে গ্রামে নানির কাছে রেখে গেছেন। এখন এখানেই থাকতে হবে সে জন্যে ভর্তি হতে এসেছি।”

হেডমাস্টার কিছুক্ষণ রাশার দিকে তাকিয়ে রইলেন তারপর বললেন, “তোমার নানি ছাড়া আর কোনো গার্জিয়ান নাই?”

“না।”

“কোন ক্লাসে ভর্তি হতে চাও?”

“ক্লাস এইট।”

এই স্কুলে ছাত্রছাত্রীর সেরকম চাপ নেই, তারপরেও হেডমাস্টার সাহেব একটু ভাব দেখালেন, বললেন, “স্কুলে সিটের খুব সমস্যা। বছরের মাঝখানে ভর্তি করলে অনেক ঝামেলা হয়।”

রাশা বলল, “জানি স্যার, কিন্তু আমার কোনো উপায় ছিল না।”

“দেখি কী করা যায়। কিন্তু স্কুলের খরচপাতি আছে, ভর্তি ফি আছে, মাসে মাসে বেতন আছে। টাকা কে দেবে?”

“আমি দেব স্যার। কত টাকা লাগবে বললে আমি নিয়ে আসব।”

হেডমাস্টারের চোখে এবারে হালকা একটা লোভের ছাপ পড়ল। নিচু গলায় বললেন, “আগের মাসের বেতন। ভর্তি ফি। স্পেশাল ফি। কন্টিজেনসি সব মিলিয়ে তিন-চার হাজার পড়বে”।

রাশা ভয়ে ভয়ে একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, “ঠিক আছে স্যার।”

এরকম সময় আরেকজন মানুষ হেডমাস্টারের রুমে এসে ঢুকল, গালে হালকা দাড়ি, শক্ত-সমর্থ শরীর, বয়স খুব বেশি নয়। হেডমাস্টার বললেন, “রাজ্জাক, ভালোই হয়েছে তুমি আসছ। এই মেয়েটা ক্লাস এইটে ভর্তি হতে চাচ্ছে।”

রাজ্জাক নামের মানুষটা একবার চারিদিকে তাকাল, “কার সাথে আসছে?”

“নিজেই আসছে। পারিবারিক সমস্যা আছে।” রাজ্জাক নামের মাস্টারটা এবারে রাশাকে ভালো করে দেখল আর রাশা সাথে সাথে বুঝে গেল মানুষটা তাকে অপছন্দ করে ফেলেছে। মানুষটা হেডমাস্টারের দিকে তাকিয়ে বলল, “আপনি কী বলেছেন?”

“বলেছি ভর্তির টাকা-পয়সা নিয়ে এসে ভর্তি হতে।”

রাজ্জাক নামের মাস্টারটা মাথা নাড়ল, “না স্যার। এইভাবে ভর্তি করা যাবে না।”

হেডমাস্টার দুর্বল গলায় বললেন, “সিট আছে, সমস্যা কোথায়?”

“সমস্যা অন্য জায়গায়।”

“কোন জায়গায়?”

“বাবা-মা ছাড়া একা একা একটা মেয়ে চলে আসছে, আপনি তার আগে-পিছে কিছু জানেন? হয়তো বাড়ি থেকে পালিয়েছে। আপনি ভর্তি করে পুলিশ কেসে পড়বেন। আজকালকার ছেলেমেয়ে কী ডেঞ্জারাস আপনি জানেন?”

রাশা হতবাক হয়ে মানুষটার কথা শুনতে লাগল! কী বলবে বুঝতে পারল না।

রাজ্জাক নামের মানুষটা বলল, “দেখে তো বোঝাই যাচ্ছে। শহরের সব ছেলেমেয়ে এখন ড্রাগের ওপরে আছে। আপনি না জেনেশুনে ভর্তি করবেন, দেখবেন পরের দিন এই গ্রামের স্কুলের অর্ধেক ছেলেমেয়ে ড্রাগ অ্যাডিক্ট! দিনকাল খুব খারাপ স্যার।”

রাশা বলার চেষ্টা করল, “আমি মোটেও ড্রাগ অ্যাডিক্ট না।”

রাজ্জাক নামের মানুষটা রাশার দিকে তাকিয়ে বলল, “আমি আর হেড স্যার কথা বলছি, তুমি তার মাঝে কথা বলার চেষ্টা করছ কেন?”

“আমাকে নিয়ে কথা হচ্ছে তো তাই”

রাজ্জাক নামের মানুষটা চোখ পাকিয়ে একবার রাশার দিকে তাকাল তারপর হেড স্যারের দিকে তাকিয়ে বলল, “দেখেছেন কেমন বেয়াদপ? মুখে মুখে কথা বলে! এই রকম মেয়েকে স্কুলে ভর্তি করবেন? আপনার স্কুলের বারোটা বাজিয়ে ছেড়ে দেবে।”

হেডমাস্টার বললেন, “যাই হোক, স্কুলে যখন সিট আছে ভর্তি করে নিই। এখন কোন নিয়মে ভর্তি করবে বলো?”

“আগের স্কুল থেকে টিসি, পরীক্ষার রেজাল্ট, হেডমাস্টারের টেস্টিমনিয়াল আর ফটো আই. ডি. ছাড়া ভর্তি করা ঠিক হবে না। আপনি পরে বিপদে পড়ে যাবেন স্যার।”

“এই মেয়ের বাবা-মা থাকে দেশের বাইরে। কোনো গার্জিয়ান নাই, বুড়ি নানির সাথে থাকে। সে কোথা থেকে এই সব কাগজপত্র আনবে?”

“সেইটা তো আমাদের চিন্তা না স্যার। সেইটা এই মেয়ের চিন্তা। কাগজপত্র আনবে ভর্তি হবে। কাগজপত্র নাই, ভর্তি নাই।”

হেডমাস্টার রাশার দিকে তাকালেন, দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করে বললেন, “শুনেছ তো? তুমি তোমার আগের স্কুল থেকে টিসি, পরীক্ষার মার্কশিট, টেস্টিমনিয়াল আর ফটো আই, ডি, না আনলে ভর্তি করা যাবে না।”

রাশা মুখ কাঁচুমাচু করে কিছু একটা অনুরোধ করতে যাচ্ছিল কিন্তু রাজ্জাক নামের মানুষটার সামনে তার সেটা করার ইচ্ছে করল না। নিচু

গলায় বলল, “ঠিক আছে স্যার।”

বাইরে উদ্বিগ্ন মুখে জয়নব দাঁড়িয়ে ছিল, জিজ্ঞেস করল, “হয়েছে?” রাশা মাথা নাড়ল, বলল, “না, হয় নাই?”

“কেন?”

“হেডমাস্টার রাজি ছিলেন। কিন্তু রাজ্জাক নামে একজন স্যার এসে সব গোলমাল করে দিলেন। অনেক রকম কাগজপত্রের কথা বললেন।”

“আছে কাগজপত্র?”

“কোথা থেকে থাকবে?”

“তাহলে?” রাশা একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, “দেখি। আমার আগের স্কুলের ম্যাডামের সাথে কথা বলতে হবে।”

“কিভাবে বলবে?”

“চিঠি লিখতে হবে মনে হয়।”

“ফোন নাম্বার নাই?”

“আছে।” রাশাকে জাহানারা ম্যাডাম তার ফোন নাম্বারটা দিয়ে বলেছিলেন দরকার হলে ফোন করতে। নাম্বারটা তার মুখস্থ আছে। অনেকবার সে ভেবেছে ফোন করবে কিন্তু কেন যেন করা হয়নি।

জয়নব বলল, “তাহলে এখনই ফোন করো।”

“কোথা থেকে করব?”

“বাজারে ফোন-ফ্যাক্সের দোকান আছে। চলো তোমাকে নিয়ে যাই।”

“এক্ষুণি তোমার স্কুল শুরু হবে না?”

“হোক, একদিন ক্লাস না করলে কিছু হবে না।”

জয়নব যখন রাশাকে নিয়ে রওনা দিয়েছে তখন জিতুও তাদের সাথে তার ক্লাস থেকে বের হয়ে এলো। তার ক্লাস করতে ভালোই লাগে না যে কোনো সুযোগে সে স্কুল থেকে বের হয়ে আসে।

.

জাহানারা ম্যাডামের ফোনে ডায়াল করে রাশা শুনতে পেল অন্যপাশে ফোন রিং হচ্ছে, খুট করে একটা শব্দ হলো, তারপর জাহানারা ম্যাডামের গলার স্বর শুনতে পেল, “হ্যালো।”

রাশা বলল, “ম্যাডাম, আমি রাশা।”

অন্যপাশে জাহানারা ম্যাডাম হঠাৎ কয়েক সেকেন্ডের জন্যে চুপ করে গেলেল, তারপর ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “রাশা, তুমি কোথায়?”

“আমি আমার নানি বাড়িতে।”

“তোমার নানি বাড়ি কোথায়?”

“আপনি চিনবেন না ম্যাডাম একটা গভীর গ্রামে।”

“কেন গিয়েছ? কত দিন থাকবে?”

“আমার মা আমাকে এখানে রেখে বিয়ে করে অস্ট্রেলিয়া চলে গেছেন।”

অন্যপাশে জাহানারা ম্যাডাম অনেকক্ষণ চুপ করে রইলেন। তারপর বললেন, “তুমি আমাকে কিছু বললে না রাশা?”।

রাশা চোখের পানি আটকে বলল, “বলে কী হবে ম্যাডাম। যার মা তার মেয়েকে এভাবে ফেলে রাখে তাকে অন্যেরা কী করবে?”

জাহানারা ম্যাডাম বললেন, “এখন কেমন আছ? কী করছ?”

“ভালোই আছি। একটা স্কুলে ভর্তি হব তাই কাগজপত্র লাগবে সেই জন্যে ফোন করেছি।”

“কী কাগজপত্র?”

“টিসি, টেস্টিমনিয়াল, মার্কশিট আর ফটো আই. ডি. ফটো আই. ডি. আমার কাছে আছে। অন্যগুলি লাগবে।”

“ঠিক আছে। আশেপাশে ফ্যাক্স-এর দোকান আছে?”

“আমি একটা ফোন-ফ্যাক্স-এর দোকান থেকেই ফোন করছি।”

“গুড়। তুমি ফ্যাক্স নাম্বারটা দাও। আমি আধাঘণ্টার ভিতরে সবকিছু এখানে ফ্যাক্স করে পাঠাব। দুই কপি অরিজিনাল তৈরি করে এক কপি কুরিয়ার করব তোমার স্কুলে, আরেক কপি পাঠাব তোমার নানি বাড়িতে।”

“ঠিক আছে ম্যাডাম।”

“দাও, ফ্যাক্স নাম্বার দাও। ঠিকানাগুলি দাও।”

“দিচ্ছি ম্যাডাম। থ্যাংকু ম্যাডাম।”

“রাশা শোনো। “বলেন ম্যাডাম।”

“তুমি আমার সাথে যোগাযোগ রাখবে। বুঝেছ?”

“রাখব ম্যাডাম। আমার জন্যে দোয়া করবেন ম্যাডাম।”

 জাহানারা ম্যাডাম কোনো কথা বললেন না।

.

আধা ঘণ্টা পরে আহাদ আলী উচ্চ বিদ্যালয়ের হেডমাস্টার অবাক হয়ে দেখলেন তার স্কুলে ভর্তি হতে চাইছে মেয়েটি হাতে কিছু কাগজপত্র নিয়ে চলে এসেছে। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “কী ব্যাপার?”

“আপনি যে কাগজ চেয়েছিলেন। আমার স্কুল থেকে ফ্যাক্স করে দিয়েছে। অরিজিনালগুলো কুরিয়ার করেছে, কাল-পরশু পৌঁছে যাবে।”

হেডমাস্টার কাগজগুলো দেখে জানতে পারলেন এই মেয়েটি অত্যন্ত মেধাবী একটি ছাত্রী। গণিত অলিম্পিয়াডে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছে। খুব ভালো ডিবেট এবং আবৃত্তি করতে পারে। পারিবারিক একটা সমস্যার কারণে এই স্কুল থেকে টিসি নিচ্ছে এবং তাকে সবরকম সাহায্য করার জন্যে অনুরোধ করা যাচ্ছে। স্কুলের হেডমিস্ট্রেস আলাদা একটা চিঠি দিয়ে লিখেছেন এই মেয়ে সম্পর্কে অন্য যে কোনো তথ্যের দরকার হলে যেন তার সাথে যোগাযোগ করা হয়। হেডমিস্ট্রেস লিখেছেন মেয়েটি সোনার টুকরো মেয়ে। বিখ্যাত একটা স্কুলের হেডমিস্ট্রেস, হেডমাস্টার তার নাম শুনেছেন, সবাই তাকে চিনে।

হেডমাস্টার নিজেই এবার উঠে দাঁড়ালেন, রাশার কাগজপত্র আর রাশাকে নিয়ে পাশের ঘরে গেলেন। একটা কেরানি অনেকগুলো ফাইলের মাঝখানে বসে পান চিবুচ্ছে, হেডমাস্টারকে দেখে উঠে দাঁড়াল। হেডমাস্টার ফ্যাক্সে আসা কাগজগুলো তার হাতে ধরিয়ে দিয়ে বললেন, “হরিপদ, তুমি এই মেয়েটাকে ক্লাস এইটে ভর্তি করে দেওয়ার ব্যবস্থা করো।”

“ভর্তির ফি?”

“পরে দিবে। কাল-পরশু নিয়ে আসবে। শুধু যেটা দরকার সেটা দিবে, এক পয়সাও যেন বাড়তি চার্জ না হয়।”

ঠিক এরকম সময় রাজ্জাক মাস্টার সেখানে হাজির হলো। সে কেরানির হাত থেকে কাগজগুলো নিয়ে একবার চোখ বুলিয়ে বলল। “স্যার, এইগুলি তো ফ্যাক্স। ফ্যাক্স এর কোনো ভ্যালু নাই। অরিজিনাল কাগজ ছাড়া তো ভর্তি করা যাবে না। তাছাড়া ভর্তি ফিয়ের একটা ব্যাপার আছে না।”

হেডমাস্টার এই প্রথমবার কঠিন হলেন, মুখ শক্ত করে বললেন, “রাজ্জাক সাহেব আমি কুড়ি বছর থেকে হেডমাস্টারি করি। কোথায় অরিজিনাল কাগজ লাগে আর কোথায় ফ্যাক্স দিয়ে কাজ চলে যায় আমি সেটা জানি। আর এই মেয়ে যদি ভর্তি ফি না দেয় আমি সেটা দিব। বুঝেছেন?”

বাশা দেখল রাজ্জাক মাস্টারের মুখটা অপমানে কালো হয়ে গেল। রাশা ইতস্তত করে বলল, “আমি ভর্তি ফি দিব, আমি কালকেই ফি নিয়ে আসব।”

হেডমাস্টার বললেন, “আমি জানি মা তুমি আনবে। তুমি কাল থেকে ক্লাস শুরু করো। আমাদের গ্রামের স্কুলের অবস্থা খারাপ। স্কুল ভাঙাচোরা মাস্টাররাও ভাঙাচোরা। লেখাপড়া ভালো হয় না, তোমার খুব কষ্ট হবে। কিন্তু লেখাপড়া নিজের ওপর। বিদ্যাসাগর ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে পড়তেন। বুঝেছ?”

“জি স্যার বুঝেছি।”

রাশা চলে না গিয়ে দাঁড়িয়েছিল, তাই হেডমাস্টার জিজ্ঞেস করলেন, “তুমি আর কিছু বলবে?”

“জি স্যার।”

“বলো।”

“আসলে আমরা বেশ কয়েকজন মিলে একসাথে অনেক দূর থেকে হেঁটে এসেছি, আবার একসাথে হেঁটে হেঁটে ফিরে যাব। আমাকে তো অপেক্ষাই করতে হবে। আমি কি আজকেই ক্লাসে বসতে পারি?”

“পারবে না কেন? অবশ্যই পারবে। আসো আমার সাথে।”

রাশা হেড স্যারের পিছু পিছু যেতে থাকে। স্কুল শুরু হয়ে গেছে, কোনো একটা ক্লাসে কোনো একজন স্যার কোনো একজন ছাত্রকে বেত দিয়ে শপাং শপাং করে মারছেন, তার চিৎকার শোনা যাচ্ছে। এটা মনে হয় এখানকার খুব সাধারণ ঘটনা, কারণ হেডমাস্টার সেটা শুনছেন বলেই মনে হলো না।

কোনার দিকে একটা ক্লাসঘরের সামনে গিয়ে হেডমাস্টার দাঁড়ালেন। ভেতরের ছেলেমেয়েরা হেডমাস্টারকে দেখে সবাই দাঁড়িয়ে গেল, মাথায় টাক কালোমতন একজন বোর্ডে কী যেন লিখছিলেন তিনিও বোর্ডে লেখা বন্ধ করে হেডমাস্টারের দিকে তাকালেন। হেডমাস্টার রাশাকে নিয়ে ভিতরে ঢুকে ছাত্রছাত্রীদের বসতে বললেন। তারপর কালোমতন মাথায় টাক স্যারকে বললেন, “মাজাহার সাহেব, এই মেয়েটা ক্লাস এইটে ভর্তি হবে। হরিপদ কাগজপত্র ঠিক করছে, আজ থেকেই ক্লাস করতে শুরু করুক।”

“ঠিক আছে স্যার।”

হেডস্যার ছাত্রছাত্রীদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “তোমাদের ক্লাসে নতুন এসেছে। সে খুব ভালো ছাত্রী! তোমরা সবাই তাকে সাহায্য করো। ঠিক আছে?”

ছাত্রছাত্রীরা কলের পুতুলের মতো মাথা নাড়ল। হেডস্যার চলে যাবার পর মাথায় টাক কালোমতন স্যার সরু চোখে রাশার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলেন, তারপর বললেন, “নাম কী?”

“আমাকে সবাই রাশা নামে ডাকে।”

“রাশা?”

“জি স্যার।”

“রাশ তো মানুষের নাম না, রাশা তো দেশের নাম। রাশিয়াকে ইংরেজিতে বলে রাশা!”

ক্লাসের কয়েকজন ছেলেমেয়ে একটু হেসে উঠে আবার থেমে যায়, রাশা কোনো কথা না বলে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল।

স্যার বললেন, “রাশা না হয়ে তোমার নাম হওয়া উচিত ছিল রাইসা। রাইসা নামের একটা অর্থ আছে। রাশার কোনো অর্থ নাই।”

রাশা এবারেও কোনো কথা বলল না, এরকম সময়ে যত কম কথা বলা যায় ততই ভালো।

স্যার বললেন, “যাও। ৰসো।”

সামনের বেঞ্চের একটা মেয়ে সরে গিয়ে একটু জায়গা করে দিল, ‘রাশা সেখানে গিয়ে বসল। স্যার আবার চক নিয়ে বোর্ডের দিকে এগিয়ে গেলেন। রাশা দেখল স্যার বোর্ডে একটা অঙ্ক করে দিচ্ছেন। মুখে একটি কথা না বলে স্যার পুরো অঙ্কটা করে দিলেন, ছেলেমেয়েরা সেটা তাদের খাতায় টুকে নিল।

অঙ্কটা শেষ করার পর স্যার ক্লাসের দিকে তাকালেন, “সবাই লিখেছিস?”

“জি স্যার।”

স্যার এইবার বোর্ডটা মুছে নূতন একটা অঙ্ক লিখতে শুরু করলেন। রাশা লক্ষ করল, স্যার কিন্তু অঙ্কটা করছেন না, হাতে একটা নোট বই, সেই নোট বই দেখে দেখে অঙ্কটা বোর্ডে তুলছেন। কী আশ্চর্য!

পুরো ক্লাসটা এভাবে কেটে গেল। স্যার একটা একটা অঙ্ক বোর্ডে লিখে দিলেন ছেলেমেয়েরা সেটা তাদের খাতায় টুকে নিচ্ছে। এই তাহলে গণিতের ক্লাস।

এরকম সময় ঘণ্টা পড়ল এবং স্যার তার নোট বই, রেজিস্টার খাতা নিয়ে বের হয়ে গেলেন। ক্লাসের ছেলেমেয়েরা নিচু গলায় কথা বলতে শুরু করে। তার বেঞ্চে বসে থাকা মেয়েরা আড়চোখে তার দিকে তাকাচ্ছে কিন্তু ঠিক কথা বলার সাহস পাচ্ছে না। রাশা নিজেই কথা শুরু করল, তার পাশে যে মেয়েটা বসে ছিল সে পরীর মতো সুন্দরী! রাশা তাকে জিজ্ঞেস করল, “তোমার নাম কী?

“সানজিদা।”

“আমার আগের স্কুলে আমার প্রাণের বন্ধুর নাম ছিল সানজিদা।”

মেয়েটা কোনো কথা না বলে তার দিকে তাকিয়ে রইল। রাশা বলল, “আচ্ছা তোমার কী মনে হয়, আসলেই কী রাশা কারো নাম হতে পারে না?”

সানজিদা নামের মেয়েটা মাথা নাড়ল, বলল, “পারে। না হলে তোমার নাম হলো কেমন করে?”

“আমি তোমাকে একটা কথা বলি?”

সানজিদা মাথা নাড়ল, বলল, “বলো।”

“আগে বলো কাউকে বলবে না।”

“বলব না।”

“খোদার কসম?”

সানজিদা একটু অবাক হয়ে বলল, “খোদার কসম।”

আশেপাশের আরো কয়েকজন এবারে রাশার কাছে এগিয়ে এলো। কাউকে বলা যাবে না সেই গোপন কথাটা শোনার সবারই খুব আগ্রহ। রাশা গলা নামিয়ে বলল, “আসলে আমার নাম ছিল রাইসা। নামটা আমি দুই চোখে দেখতে পারতাম না। সেই জন্যে এটাকে বদলে রাশা করে ফেলেছি।”

মেয়েগুলো একজন আরেকজনের মুখের দিকে তাকাল, নাম পছন্দ না হলে যে সেটা বদলে দেয়া যেতে পারে সেটা কোনোদিন তাদের মাথাতেই আসেনি।

শ্যামলা রঙের একটা মেয়ে জিজ্ঞেস করল, “যদি এখন এই নামটা তোমার পছন্দ না হয় তাহলে এইটাও বদলে ফেলবে?”

রাশ হাসল, বলল, “না আর বদলাব না।”

শ্যামলা রঙের মেয়েটা বলল, “রাইসা নামটা তো ভালোই ছিল, এটা বদলালে কেন?”

“তার একটা কারণ আছে।”

“কী কারণ?”

“আমাদের ক্লাসে একটা পাজি ছেলে ছিল সে আমার নাম নিয়ে একটা কবিতা তৈরি করেছিল।”

“কী কবিতা?”

“আগে বলো সেই কবিতা নিয়ে আমাকে খেপাবে না?”

“খেপাব না।”

“খোদার কসম?”

“খোদার কসম।”

“কবিতাটা ছিল এই রকম :

রাইসা
মাছের কাঁটা খায় বাইছা বাইছা–”

.

মেয়েগুলো এবারে শব্দ করে হেসে ফেলল, তখন অনেকগুলো ছেলে এবারে মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করল কী নিয়ে হাসাহাসি হচ্ছে। রাশা জিজ্ঞেস করল, “তোমাদের ক্লাসে এই রকম পাজি ছেলে নাই?”

মেয়েগুলো নিজেরা মুখ চাওয়াচাওয়ি করল, একজন বলল, “জানি না।”

“জানো না? জানো না কেন?”

“আমরা ছেলেদের সাথে কথা বলি না। ছেলেরা ছেলেদের সাথে থাকে। মেয়েরা মেয়েদের সাথে থাকে।”

রাশা অবাক হয়ে বলল, “কোনোদিন কথা বলো নাই?”

“নাহ।”

“কেন?”

মেয়েরা কোনো কথা বলল না, ক্লাসের কেউ জানে না কেন ছেলেরা আর মেয়েরা একে-অন্যের সঙ্গে কথা বলে না। এভাবেই চলে আসছে।

এরকম সময় ছেলেদের অংশ একটু হট্টগেলি শোনা গেল। দেখা গেল সবাই মিলে একটা ছেলেকে তুলে তাকে সামনের দিকে ঠিলে দিচ্ছে। ছেলেটা সামনে আসতে চাইছে না কিন্তু কেউ তার কথা শুনছে না। রাশা মেয়েদের জিজ্ঞেস করল, “কী হয়েছে?”

“এই ছেলেটা সুন্দর গান গাইতে পারে। মনে হয় তাকে গান গাইতে বলছে?”

“গান গাইবে? এখন ক্লাস হবে না?”

“নাহ্। ইংরেজি স্যার বহুদিন থেকে আসে না।”

“কেন?”

“জানি না। স্যার নাকি লন্ডন চলে গেছে।”

রাশা অবাক হয়ে বলল, “লন্ডন চলে গেছে? তাহলে অন্যেরা ক্লাস নিবে না?”

“অন্য কেউ কি আছে নাকি! কোনো স্যারটার নাই।”

গায়ক ছেলেটি আবার তার সিটে গিয়ে বসে যাচ্ছিল, তখন রাশা গলা উঁচিয়ে ছেলেটির দিকে তাকিয়ে বলল, “প্লিজ, তুমি গান শোনাও আমাদের।”

পুরো ক্লাস হঠাৎ একেবারে চুপ করে গেল, একটা মেয়ে একটা ছেলের সাথে কথা বলছে সেটা আগে কখনো এই ক্লাসে ঘটেনি। কিছুক্ষণ কেউ কোনো কথা বলল না, তারপর একজন বলল, “হ্যাঁ। গাজী, তুই গান শোনা আমাদের।”

অন্যেরাও তখন বলতে থাকে, “হ্যাঁ। শোনা, শোনা।”

ক্লাসে একটা হট্টগোল শুরু হয়ে যাচ্ছিল, তখন একজন বলল, “আস্তে! চেঁচামেচি করবি না তাহলে রাজ্জাক স্যার বেত নিয়ে চলে আসবে।”

হট্টগোলটা একটু কমে এলো তখন গাজী নামের গায়ক ছেলেটা লাজুক মুখে সামনে এগিয়ে এলো। তাকে দেখে মনে হয় সে বুঝি একটু নার্ভাস। সামনে দাঁড়িয়ে সে চোখ বন্ধ করে গান গাইতে শুরু করে। সাথে সাথে পুরো ক্লাস নিস্তব্ধ হয়ে যায়। কী সুন্দর গলা, কী সুন্দর তাল-লয়ের ওপর দখল, রাশা একেবারে হতবাক হয়ে গেল। ছেলেটা চোখ বন্ধ করে গাইছে,

“সময় গেলে সাধন হবে না।
দিন থাকতে দিনের সাধন কেন করলে না”

দেখে মনে হয় সত্যিই বুঝি এই বাচ্চা ছেলেটার কিছু একটা সাধনা করার কথা ছিল, সে সময় থাকতে সেটা করতে পারেনি, তাই তার বুকটা বুঝি ভেঙে যাচ্ছে দুঃখে!

গান শেষ হবার পর সবাই আনন্দে হাততালি দিয়ে উঠল। রাশা উচ্ছ্বসিত হয়ে বলল, “তুমি কি সুন্দর গান গাইতে পারো!”

এর আগে এই ক্লাসে কোনো মেয়ে কোনো ছেলের সাথে কথা বলেনি। যদি কেউ বলে ফেলে তখন কিভাবে তার উত্তর দিতে হয় সেটাও কেউ জানে না। গায়ক ছেলেটা তাই কথা না বলে চুপ করে রইল। রাশা জিজ্ঞেস করল, “তুমি কারো কাছে গান শেখো?”

ছেলেটা মাথা নাড়ল, বলল, “না।”

“তাহলে এত সুন্দর গান কেমন করে শিখেছ?”

“নিজে নিজে।”

“নিজে নিজে! কিভাবে?”

“ঐ তো সুবলের চায়ের দোকানে ক্যাসেট বাজে সেইটা শুনে শুনে শিখেছি।”

“কী আশ্চর্য! তুমি ক্যাসেট শুনে শুনে এত সুন্দর গান গাইতে পারো। তোমার যদি গানের ওস্তাদ থাকত তাহলে না জানি কত সুন্দর গান গাইতে!”

পিছনের দিকে বসে থাকা একজন বলল, “গানের ওস্তাদ! হ্যাঁহ্!” রাশা জিজ্ঞেস করল, “কেন? কী হয়েছে?”

“গাজীর বাপ যদি খালি খবর পায় হে গান গাইছে তাহলে তার শরীরের সবগুলি হাড়ি গুঁড়া করে ফেলবে।”

“কেন?”

“হের বাপ মুসুল্লি।”

রাশা জিজ্ঞেস করল, “মুসুল্লি মানুষ গান শুনতে পারে না?”

পিছনে বসে থাকা ছেলেটা বলল, “হের বাবা শুনে না।”

অন্যান্য ছেলে গাজীকে আরো গান শোনাতে বলল, গাজীর তখন একটু লজ্জা কেটেছে। সে একটা হাসন রাজার গান আরেকটা পল্লীগীতি গেয়ে শোনাল। গান শেষ করে গাজী যখন তার জীয়গায় ফিরে যাচ্ছে তখন রাশা বলল, “তুমি এত সুন্দর গান গাইতে পারো! আমার যদি অনেক টাকা থাকত তাহলে তোমার গলাটা আমি সোনা দিয়ে বাঁধিয়ে দিতাম।”

কথাটা রাশা ঠাট্টা করে বলেনি, কিন্তু সেটা শুনে সবাই হি হি করে হাসতে থাকে। আনন্দে, ঠিক কিসের জন্য আনন্দ কে জানে!

.

ঘণ্টা পড়ার পর তাদের ক্লাসে এসে ঢুকলেন রাজ্জাক স্যার, হাতে লম্বা একটা বেত। রাশা দীর্ঘশ্বাস ফেলে, আহারে না জানি কোন ছেলে বা মেয়েটাকে এই মানুষটা বেত দিয়ে মারবে। কে জানে, তাকেই মেরে বসবেন কিনা!

রাজ্জাক স্যার বেতটা বাতাসে নাড়াতে নাড়াতে প্রথমে ক্লাসের সামনে একটা চক্কর দিলেন। তারপর জানতে চাইলেন সবই পড়া শিখে এসেছে কিনা–ক্লাসের ছেলেমেয়েরা কোনো কথা না বলে নিঃশব্দে বসে রইল। রাজ্জাক সার তখন একপাশ থেকে পড়া ধরতে শুরু করলেন। স্যার একটা প্রশ্ন করেন উত্তর ঠিক হলে স্যার ছেড়ে দেন উত্তর ভুল হলে স্যার হাতের বেতটা দিতে নির্দয়ভাবে মারতে থাকেন। যখন মারেন তখন নিচের ঠোঁটটা একটু বের হয়ে আসে, মুখ দিয়ে একধরনের শব্দ করেন–মনে হয় বুঝি লোল টেনে নিচ্ছে। কী ভয়ঙ্কর ব্যাপার।

কিছুক্ষণের মাঝে রাশা একটা জিনিস আবিষ্কার করল। ঠিক উত্তর দিলে স্যার ছেড়ে দিচ্ছেন আর ভুল উত্তর দিলে নির্দয়ভাবে মারছেন। কিন্তু কোনটা ঠিক উত্তর কোনটা ভুল উত্তর সেটা পুরোপুরি রাজ্জাক স্যারের ওপর নির্ভর করছে। রাশা আবিষ্কার করল পুরোপুরি ভুল উত্তর দিয়ে একটা ছেলে পার পেয়ে গেল কিন্তু তার পাশে বসে থাকা আরেকজন একটা শুদ্ধ উত্তর দিয়েও প্রচণ্ড মার খেল। ক্লাসে বসে কথা বলা বিপজ্জনক জেনেও রাশা পাশে বসে থাকা সানজিদাকে জিজ্ঞেস করল, “ঠিক উত্তর দিলেও স্যার মারছেন। আবার ভুল উত্তর দিয়েও—”

“ভুল-শুদ্ধ কোনো ব্যাপার নাই।” সানজিদা নিচু গলায় বলল, “যারা স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়ে না স্যার তাদের মারেন।”

“প্রাইভেট পড়ে না?”

“হ্যাঁ।”

“তুমি পড়?”

“পড়ি।”

“তাহলে তুমি মার খাবে না?”

“না। কিন্তু শিউলী মার খাবে।”

“শিউলী প্রাইভেট পড়ে না?”

রাশা জিজ্ঞেস করল, “আর আমি?”

“প্রথম দিন এই জন্য মনে হয় তোমাকে ছেড়ে দেবেন।”

সানজিদার কথা সত্যি হলো। তাকে স্যার ছেড়ে দিলেন, শিউলী মার খেল। রাশাকে বললেন, প্রথম দিন বলে ছেড়ে দিচ্ছেন পরেরবার কিন্তু ছাড়বেন না।

গায়ক ছেলেটি প্রচণ্ড মার খেল। রাশা বুঝতে পারল স্যারের হিসেব খুব সোজা। যারা তার কাছে প্রাইভেট পড়বে স্যার তাদের দেখেশুনে রাখবেন। পরীক্ষার আগে প্রশ্ন বলে দেবেন, পরীক্ষায় ভালো নম্বর দেবেন, ক্লাসে পিটাবেন না। যারা প্রাইভেট পড়বে না তাদের পিটিয়ে সোজা করে দেবেন।

রাশা ক্লাসে বসে শীতল চোখে এই দানবটির দিকে তাকিয়ে রইল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *