দু হাজার আই-সি-এস. সৈন্যবাহিনীর দশ হাজার ইংরেজ অফিসার, ষাট হাজার সৈন্য ও দু লক্ষ ভারতীয় সৈন্য নিয়ে যিনি ইংল্যাণ্ডেশ্বরের প্রতিনিধি হয়ে এই উপমহাদেশ শাসন করতেন, তিনি ছিলেন ভাইসরয় বড়লাট। বড়লাট কোন সম্রাট ছিলেন না কিন্তু তিনি যে বৈভবের মধ্যে জীবন কাটাতেন, তা বোধ হয় স্বয়ং ইংল্যাণ্ডেশ্বরও উপভোগ করতেন না। বড়লাটের বাসস্থানই ভাইসরয় হাউস; আরব্য উপন্যাসের ও অবিশ্বাস্য মনে হলেও এ কথা সত্য যে এই একটি মানুষের সেবা ও স্বাচ্ছন্দ্যর জন্য ভাইসরয় হাউসে পাঁচ হাজার কর্মচারী ছিলেন। বিলাস-ব্যসনের জন্য পৃথিবীর ইতিহাসের পাতায় যে চতুর্দশ লুই ও জার সম্রাটের নাম চিরকালের জন্য লেখা থাকবে, তাদের সেবার জন্যও প্রত্যক্ষভাবে এত কর্মচারী ছিল না। ফরাসী সম্রাটের ভার্সাই প্রাসাদ বা জারের পিটারহফ, প্রাসাদের মতই ভাইসরয় হাউসও একটি বিরাট প্রাসাদ এবং আমাদের এই ভাইসরয় হাউসের পর পৃথিবীর কোন দেশে এমন বিশাল প্রাসাদ আর কোথাও তৈরি হয়নি। দিল্লীর ভাইসরয় হাউসই পৃথিবীর সর্বশেষ প্রাসাদ। আর সেদিনের সেই ভাইসরয় হাউসই স্বাধীন ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবন।
এই রাষ্ট্রপতি ভবন নিয়ে নিঃসন্দেহে হাজার পাতার ইতিহাস বই লেখা যায়। এ প্রাসাদে ৩৭টি অভ্যর্থনা কক্ষ আছে। ঘরের সংখ্যা ৩৪। মুঘল গার্ডেনে মালী ছিল ৪১৮ জন। ৫০ জন ছোকরা শুধু এই বাগান থেকে পাখি তাড়াত। চেম্বারলিন, খিদমতগার, স্টয়ার্ট, কুক, খানসাম, অর্ডালী ইত্যাদির সংখ্যা ছিল কম-বেশি দু হাজার। এর ওপর বডিগার্ডস, ঘোড়সওয়ার, সেক্রেটারিয়েট ও মিলিটারী সেক্রেটারির এলাহি দপ্তর। লর্ড মাউন্টব্যাটনের সময় এই চেহারাই ছিল ভাইসরয় হাউসের। সাইনবোর্ড বদলে রাষ্ট্রপতি ভবন হলে কিছু রদবদল হয়েছে ঠিকই কিন্তু এমন কিছু হয়নি, যা বিস্ময়কর বা বৈপ্লবিক।
যা বদলেছে তা হচ্ছে এই প্রাসাদের মুখ্য বাসিন্দার জীবনধারণ। রাজাগোপালাচারী ও রাজেন্দ্রপ্রসাদের মত সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণও অত্যন্ত অনাড়ম্বর জীবন যাপনে বিশ্বাসী ছিলেন। রাজাজী যখন গভর্ণর জেনারেল ছিলেন তখনও পুরোদমে সাহেবী আমলের মত এই প্রাসাদের রক্ষণাবেক্ষণ হত। রাজেন্দ্রপ্রসাদের মত গান্ধীবাদী রাষ্ট্রপতি ভবনের মুখ্য বাসিন্দা হবার পর হাওয়া বদলে গেল। রাজেন্দ্রপ্রসাদ নিজের লেখাপড়া ও কাজকর্ম নিয়েই ব্যস্ত থাকতেন। রাষ্ট্রপতি ভবনের কোন ব্যাপারেই উনি মাথা ঘামাতেন না। এ সব ব্যাপারে রাষ্ট্রপতির মিলিটারী সেক্রেটারিই সর্বময় কর্তা ছিলেন।
রাষ্ট্রপতি ভবনে এমন অসংখ্য জিনিস আছে যা বহু মিউজিয়ামেও নেই। ভারত ও ইংল্যাণ্ড ছাড়া পৃথিবীর নানা দেশের বহু বিখ্যাত শিল্পীর বহু অমূল্য পেন্টিং ও ভাস্কর্যও রাষ্ট্রপতি ভবনের সংগ্রহে আছে কিন্তু দুঃখের বিষয় রুচিহীন মিলিটারী সেক্রেটারির ও ঐসব অমূল্য সম্পদের তদারকী ভারপ্রাপ্ত শিল্পীদের ঔদাসীন্য ও গাফিলতিতে বহু পেন্টিং ও ভাস্কর্য মাটির নীচের সেলারের অন্ধকার গুদামে স্থান পেয়েছিল। রাধাকৃষ্ণণ রাষ্ট্রপতি ভবনে আসার কয়েকদিন পরেই ঐসব অমূল্য সম্পদ অন্ধকার সেলার থেকে উদ্ধার করাবার পর গম্ভীর হয়ে অফিসারদের বললেন, ইউ উইল গেট মেনি মোর প্রেসিডেন্টস কিন্তু এই সব অমূল্য পেন্টিং বা ভাস্কর্য আর পাওয়া যাবে না। কয়েকজন বিশিষ্ট শিল্পীর সাহায্যে এই সব পেটিং ও ভাস্কর্যের নিদর্শনগুলিকে পুরনো মর্যাদায় ফিরিয়ে আনা হয় এবং রাধাকৃষ্ণণের নির্দেশে ও তাঁর পুত্রবধূর (ভঃ গোপালের স্ত্রী) ব্যক্তিগত তত্ত্বাবধানে সেগুলি আবার যথাযথ স্থানে রাখা হয়।
পৃথিবীর নানা দেশের রাষ্ট্রনায়করা ভারত সফরে এলেই রাষ্ট্রপতি ভবনে রাষ্ট্রীয় ভোজে আপ্যায়ণ করা হয়। প্রটোকল অনুযায়ী সে ভোজের উদ্যোক্তা কখনও স্বয়ং রাষ্ট্রপতি, কখনও প্রধানমন্ত্রী। কখনও আবার দুজনেই দুদিন রাষ্ট্রীয় ভোজে আপ্যায়ণ করেন সম্মানিত অতিথিকে। এ সব রাষ্ট্রীয় ভোজসভার পর কিছুক্ষণের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয় সম্মানিত অতিথিদের সম্মানে। এই সব সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ভারতবর্ষের নানা প্রান্তের বিখ্যাত শিল্পীদের আমণ জানানো হয়। তবে গানের চাইতে সেতার, সরোদ, বাঁশী বাজিয়ে শোনানোই হয় বেশি এবং তার কারণ গানের চাইতে এই সব বাজনাই সম্মানিত অতিথিরা বেশি উপভোগ করেন। এই সঙ্গে প্রায় সব সময়ই নাচের ব্যবস্থা থাকে। বলা বাহুল্য, ভারত বিখ্যাত নৃত্যশিল্পীরাই শুধু আমন্ত্রণ পান এই ভিভিআইপি সমাবেশে নাচ দেখাবার। শিল্পীদের নির্বাচন করার দায়িত্ব পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এবং শিল্পীরা পারিশ্রমিক পান ঐ মন্ত্রণালয় থেকে। সমালোচনার ভয়ে পররাষ্ট মন্ত্রণালয় সব সময়ই শুধু অতি-খ্যাত ও প্রবীণ শিল্পীদের নির্বাচন করেন। এই চিরাচরিত প্রথার ব্যতিক্রম ঘটালেন সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ। তিনি পররাষ্ট্র সচিব ও তাঁর নিজস্ব মিলিটারী সেক্রেটারিকে বললেন, তরুণ শিল্পীদের উৎসাহ দেওয়া কী আমাদের কর্তব্য নয়? গুদের উৎসাহ না দিলে বহু প্রতিভাই হয়তো নষ্ট হয়ে যাবে। তাছাড়া প্রবীণ শিল্পীরা কী চিরকাল বেঁচে থাকবেন? উই মাস্ট এনকারেজ ইয়াং ট্যালেন্ট।
ব্যস! সেই থেকে শুরু হল রাষ্ট্রপতি ভবনের রাষ্ট্রীয় অনুষ্ঠানে তরুণ শিল্পীদের আত্মপ্রকাশ। অনেক শিল্পীর কথাই এই প্রসঙ্গে মনে পড়ছে কিন্তু বিশেষ করে মনে পড়ছে আজকের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্না ভারতনাট্যম শিল্পী শ্ৰীমতী যামিনী কৃষ্ণমূর্তির কথা।
বিশ-বাইশ বছর আগে কে চিনত যামিনী কৃষ্ণমূর্তিকে।
আমি যামিনীকে প্রথম দেখি উপরাষ্ট্রপতি রাধাকৃষ্ণণের বাড়িতে। আমি ঘরে ঢুকতেই যামিনীকে দেখিয়ে রাধাকৃষ্ণণ আমাকে বললেন, যামিনী ইজ এ ভেরি গুড ডালার। তোমাদের উইকলি কাগজে তো নানা রকমের লোকজনকে নিয়ে ফিচার লিখছ। হোয়াই নট রাইট অন যামিনী?
দু-একদিন পর আমি আমাদের পত্রিকার ফটোগ্রাফার সুদর্শন। খোসলকে নিয়ে এক সকালবেলায় হাজির হলাম যামিনীর আস্তানায়। কনট প্লেসে একটা দোকানের ওপরের একখানা ঘরে যামিনী তাঁর বাবা পণ্ডিত কৃষ্ণমূর্তি ও ছোট বোন যমুনাকে নিয়ে থাকে। বেশ মনে আছে ঘরের মধ্যে কোন আসবাবপত্র ছিল না। মেঝেতে সতরঞ্চি বিছিয়ে যমুনা আমাদের বসতে দিল। ঘরের পাশের একফালি বারান্দা থেকে ভারত নাট্যমের সাজে সেজে আসার পর যামিনীর নানা ভঙ্গিমায় ছবি তোলা হল ঘণ্টাখানেক ধরে। দু-এক সপ্তাহ পরেই যামিনীর দশ-বাবোখানা ছবি ছাপা হল আমাদের পত্রিকায়। পত্রিকাটি দেখে রাধাকৃষ্ণণ মহা খুশি হয়েছিলেন এবং যত দূর মনে পড়ে সেই প্রথম যামিনীর ছবি ছাপা হয়।
আজ থেকে ঠিক তেইশ বছর আগেকার ঘটনা। তারপর গঙ্গা যমুনা দিয়ে কত জল গড়িয়ে গেছে। নিত্যনতুন সম্মানের স্মৃতিতে যামিনী হয়তো সেদিনের কথা ভুলে গেছেন কিন্তু আমি ভুলিনি রাধাকৃষ্ণণ ওর জন্য কি করেছিলেন। জানি না যমুনা কোথায় আছে। যমুনাও খুব ভাল শিল্পী ছিল। বোধ হয় দিদির খ্যাতির পথে প্রতিদ্বন্দিনী না হবার জন্য যমুনা নাচ ছেড়ে দেয়। ওকে দেখলেই আমার অন্নপূর্ণাদেবীর কথা মনে হত। সেন্ট্রাল ভিস্তা এয়ারফোর্স মেসের সেই সুন্দর অফিসারটির সঙ্গেই বোধ হয় যমুনার বিয়ে হয়েছে।
সে যাই হোক মৌলানা আবুল কালাম আজাদের জন্যই যেমন ইন্দ্রানী রহমানের খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে দেশে-বিদেশে, সেই রকম সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণের জন্যই যামিনী কৃষ্ণমূর্তির খ্যাতি হয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস।
এই প্রসঙ্গে এক বাঙালী শিল্পীর কথা মনে পড়ছে। শিল্পী। হিসাবে রাধাকৃষ্ণণ তাঁকে খুবই পছন্দ করতেন এবং তাঁর জন্য কিছু করতে পারলে রাষ্ট্রপতি রাধাকৃষ্ণণ অত্যন্ত খুশি হতেন কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় শিল্পী তাঁকে সে সুযোগ দেননি।
.
সেটা ১৯৬৫ সাল। বছর খানেক আগে প্রধানমন্ত্রী নেহরু মারা গিয়েছেন। নতুন প্রধানমন্ত্রী হলেন লালবাহাদুর শাস্ত্রী। কংগ্রেস সভাপতি কামরাজ, সঞ্জীব রেড্ডি, অতুল্য ঘোষ, নিজলিঙ্গাপ্পা এবং আনো কয়েকজন দুরদর্শিতাহীন কংগ্রেস নেতারা ঢাক-ঢোল পিটিয়ে প্রচার শুরু করলেন–লালবাহাদুরের প্রধানমন্ত্রী হবার কোন মুরোদ নেই কিন্তু লোকটি মোটামুটি ভাবে জনপ্রিয় বলেই ওরা ওকে প্রধান মন্ত্রী করেছেন এই সর্তে যে ওদের পরামর্শ মতই উনি দেশ চালাবেন। এই সব প্রাদেশিক কংগ্রেসী জায়গীরদাররা দিল্লীতে পাকাঁপাকি ভাবে বসে অত্যন্ত সুপরিকল্পিত ভাবে কিছু কিছু বহুল প্রচারিত সবাদপত্রের স্নেহভাজন সাংবাদিকদের মাধ্যমে লালবাহাদুর শাস্ত্রীকে হেয় প্রতিপন্ন করার প্রচার চালাতে লাগলেন। আস্তে আস্তে দেশের সাধারণ মানুষও বিশ্বাস করতে শুরু করলেন, সিণ্ডিকেটের (কংগ্রেস) নেতারাই ব্যাক-সিট ড্রাইভিং করে দেশ চালাচ্ছেন। দ্বিতীয় অঙ্কের প্রথম দৃশ্যে আবিভূত হলেন এক মার্কিন সংবাদপত্রের দিল্লী সংবাদদাতা।
এই সংবাদদাতা সম্পর্কে একটু আলাদা করে বলা প্রয়োজন। ইনি ভারতীয়। জন্মস্থান পশ্চিম পাকিস্তানে। আসানসোল, রাণীগঞ্জ, ঝরিয়া অঞ্চলে কিছু কাল শ্রমিক আন্দোলন করেছেন। পরবর্তীকালে অজ্ঞাত কারণে মার্কিন দেশে কাটিয়েছেন বেশ কয়েক বছর। তারপর অকস্মাৎ দিল্লীতে আবির্ভাব এক মার্কিন সংবাদপত্রের সংবাদদাতারূপে। সিণ্ডিকেটের প্রায় প্রত্যেকটি নেতার সঙ্গে এর অত্যন্ত অন্তরঙ্গ সম্পর্ক ছিল। নেতাদের বাড়ির অন্দরমহলে এর অবাধ যাতায়াত ছিল। এরই অনুপ্রেরণায় কংগ্রেসের কিছু নেতা মার্কিন দেশের আধুনিক ইংরেজি সাহিত্য নিয়ে গভীর ভাবে পড়াশুনা শুরু করেন। বলা বাহুল্য এই সাংবাদিক-এর সুপারিশে মার্কিন দূতাবাস থেকে হাজার হাজার টাকার বই পৌঁছে যেত বিভিন্ন কংগ্রেসী নেতাদের বাংলোয়। মজার কথা, যেসব নেতারা এই সব বইপত্র উপহার পেতেন, পাণ্ডিত্যের জন্য তাদের কারুরই খ্যাতি ছিল না। বইপত্র ছাড়াও মাকিন দূতাবাস থেকে মাঝে মাঝে বাক্স ভর্তি সিগারেট-টিগারেটও কিছু নেতার বাড়ি যেত। শুধু তাই নয়, এই সাংবাদিক নিজে কিছু কিছু কংগ্রেসী নেতাকে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের আস্তানায় নিয়ে গেছেন।
এই সাংবাদিকের প্রতিপত্তির আরো একটা নজীর দিই। পার্লামন্টের সেন্ট্রাল হলে কোন বিদেশী সংবাদপত্রের সংবাদদাতার প্রবেশাধিকার নেই কিন্তু কোন অনুমতিপত্র ছাড়াই মার্কিন সংবাদ পত্রের এই সংবাদদাতা নিয়মিত সেন্টলি হলে যেতেন এবং সব রাজনৈতিক দলের নেতাদের সঙ্গেই নিয়মিত আড্ডা দিতেন। অজ্ঞাত রহস্যজনক কারণে কংগ্রেস-কমিউনিষ্ট-সোস্যালিস্ট-জনসজ্ঞ দলের কোন এম-পিই এই সাংবাদিকের সেন্ট্রাল হলে নিয়মিত আড্ডা দেবার ব্যাপারে কোন আপত্তি জানাননি।
খানিকটা প্রসঙ্গান্তরে চলে গেলাম এইটুকু বলার জন্য যে এই বিখ্যাত সাংবাদিকের অতি উৎসাহের ফলেই বিদেশের মানুষকে জানানো হয়–লালবাহাদুর শাস্ত্রী সাক্ষীগোপাল মাত্র : আসল কলকাঠি নাড়ছেন সিণ্ডিকেটের কয়েকজন নেতা। ভারতের প্রধানমন্ত্রীর এমন অসহায় অবস্থার খবর জানতে পেরে মহা খুশি হলেন পাকিস্তানের জঙ্গী শাসক আয়ুব খান।
আয়ুব খান নেহরুহীন ভারতের মহাদুর্দিনে ভারতকে শিক্ষা দেবার জন্য খুব বেশি সময় নষ্ট করলেন না। অমুল্য তৈল সম্পদে সমৃদ্ধ রাণ অব কচ্ছে, আয়ুব খানের তাঁবেদারী সৈন্যবাহিনী মার্কিন ট্যাঙ্ক নিয়ে এগিয়ে এলো বেশ কিছুটা। গর্জে উঠলেন লালবাহাদুর। হুসিয়ার করে দিলেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার প্রেসিঙেট জনসনকে। বহু বাধা অতিক্রম করে ভারতীয় সেনাবাহিনী এগিয়ে গেল রাণ অব কচ্ছের দিকে।
থমকে গেলেন আয়ুব খান কিন্তু দুর্বল ভারত সরকারকে শিক্ষা দেবার লোভ সম্বল করতে পারলেন না। সাতচল্লিশ সালের নভেম্বর মাসে জিন্না সাহেব যেমন রাজাকার পাঠিয়ে কাশ্মীর ছিনিয়ে নেবার ব্যর্থ চেষ্টা করেছিলেন, আয়ুব খান ঠিক অনুরূপ প্রচেষ্টা করুতেই দুর্বল প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী বিন্দুমাত্র দ্বিধা না করে সেনাবাহিনীকে পরিস্থিতি মোকাবেলা করার পূর্ণ স্বাধীনতা দিলেন। শাস্ত্রীজির জয় জওয়ান, জয় কিষাণ মন্ত্রে ষাট কোটি ভারতবাসী উদ্দীপ্ত হয়ে উঠল।
এর পরের কাহিনী সবার জানা আছে। যা জানা নেই তা হচ্ছে এই যে, ঐ সাক্ষীগোপাল ও দুর্বল লালবাহাদুরের দুর্জয় সঙ্কল্প ও অভাবনীয় নেতৃত্বের পরিচয় পেয়ে শুধু আয়ুব খান না, সিণ্ডিকেটের কেষ্ট-বিধুরাও ঘাবড়ে গেলেন। দিল্লীতে বসে ফোপর দালালী করার সুযোগ নেই দেখে অনেক নেতাই দীর্ঘ কয়েক মাস পর স্ব স্ব রাজ্যে ফিরে গেলেন। শুরু করলেন দেশরক্ষা তহবিলের জন্য অর্থ ও জিনিসপত্র সংগ্রহ। কংগ্রেস নেতাদের সে কী উৎসাহ! খরা, বন্যা, নির্বাচন আর যুদ্ধের সময় অনেক নেতাই এমন জনদরদী ও কাজপাগল হয়ে ওঠেন, যা দেখে বিস্মিত হতে হয়। এমন মওকায় নেতারা কেন দেশ ও দশের সেবায় পাগল হয়ে ওঠেন, তা কে না জানে?
.
যাই হোক, যুদ্ধ বিরতি হবার কদিন পরই শাস্ত্রীজি একদিন আমাকে বললেন, তোমার সঙ্গে তো অনেক গায়কের পরিচয় ও বন্ধুত্ব আছে। তুমি ওদের এনে একটা অনুষ্ঠান করে কিছু টাকা তুলছ না কেন?
শাস্ত্রীজির অনুপ্রেরণাতেই ঐতিহাসিক বিজ্ঞান ভবনে দুদিনের বাংলা সঙ্গীত সম্মেলন করলাম। (এর আগে বিজ্ঞান ভবনে কোন সঙ্গীতানুষ্ঠান হয়নি।) প্রায় সমস্ত বিখ্যাত গায়ক-গায়িকা বিন পারিশ্রমিকে এই সম্মেম্বনে যোগ দিলেন এবং স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী এই সম্মেলনের উদ্বোধন করলেন। তদানীন্তন কেন্দ্রীয় তথ্য ও বেতার মন্ত্রী প্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীকে অনুরোধ করতেই উনি এই সম্মেলনের গান রেডিও থেকে সাত ঘণ্টা প্রচার করার ব্যবস্থা করলেন। শিল্পীদের ব্যক্তিগতভাবে নিজ নিজ বাসভবনে আপ্যায়িত করলেন প্রধানমন্ত্রী, শ্ৰীমতী গান্ধী, কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী মিঃ চাগলা, দেশরক্ষা মন্ত্রী চ্যবন ও আরো অনেকে। সর্বোপরি শিল্পীদের সম্বর্ধনা হল রাষ্ট্রপতি ভবনে। সেই কাহিনী বলতে গিয়েই কত কি মনে পড়ল। খানিকটা অপ্রাসঙ্গিক হলেও তাই এই সব না লিখে পারলাম না।
যাই হোক, একদিন রাষ্ট্রপতি ভবনে গিয়ে ডক্টর রাধাকৃষ্ণণকে সম্মেলনের বিষয়ে সবকিছু জানার পর বললাম, একসঙ্গে এত গুণী বাঙালী শিল্পীর সমাবেশ কখনও দিল্লীতে হয়নি। সুতরাং আপনার এখানে একটা কিছু অনুষ্ঠান হওয়া উচিত বলে মনে হয়।
বিছানায় আধশোয়া অবস্থায় হাসতে হাসতে উনি বললেন, তোমার মাথায় যখন ঢুকেছে তখন কিছু তো না করে উপায় নেই।
সঙ্গে সঙ্গে মিলিটারী সেক্রেটারি মেজর জেনারেল সিংকে ডেকে বললেন, মুন, নিমাই কি বলছে।
আমি আমার বক্তব্য বলতেই মেজর জেনারেল সিং রাষ্ট্রপতিকে বললেন, স্যার, অত শিল্পীর গান শোনার সময় কী আপনার হবে।
ডক্টর রাধাকৃষ্ণণ হাসতে হাসতে বললেন, একে নিমাই-এর ব্যাপার, তার ওপর এতজন গুণী শিল্পী আসবেন। সময় আমাকে দিতেই হবে।
দিনক্ষণের ব্যাপারে কথাবার্তা বলার পর মেজর জেনারেল সিং রাষ্ট্রপতিকে বললেন, স্যার, শিল্পীদের লীডারকে শ পাঁচেক টাকার তোড় দিলেই হবে তো?
ফর দ্যাট কনসাল্ট নিমাই।
মেজর জেনরেল সিং আমার দিকে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকাতেই আমি বললাম, না, তা হতে পারে না। ওরা প্রত্যেকেই গুণী শিল্পী। জনাবিশেক শিল্পীকে কী ঐ টাকা ভাগ করে দেয়া যায়?
মোট হাজারখানেক দিলে তো হবে?
না, তাও হবে না। আমি আরো বললাম, শিল্পীরা রাস্ট্রপতির আশীর্বাদ পেলেই ধন্য হবে। তাঁদের আর কিছু চাই না।
মেজর জেনারেল সিং কলেন, কিন্তু প্রেসিডেন্ট তো ফ্রি সার্ভিস নেন না।
আমি ডঃ রাধাকৃষ্ণণের সামনেই বললাম, কিন্তু তাই বলে তো তারা এখানে অপমানিত হতে আসবে না। তাদের প্রত্যেককে শপাঁচেক করে দিতে পারেন না?
তাহলে তো হাজার দশেক টাকার দরকার। না, না, অত টাকা দেয়া সম্ভব নয়।
তাহলে অল্প কিছু দিন। আমি বেশ জোরের সঙ্গে বললাম, যাই দেওয়া হোক, তা প্রত্যেকটি গায়ক ও তবলচীকে দিতে হবে।
হোয়াই তবলচী? ফোঁস করে উঠলেন মেজর জেনারেল। আমি একটু মৃদু হেসে বললাম, তারাও গুণী শিল্পী।
অনেক তর্ক-বিতর্কের পর ঠিক হল, রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত মোহরাঙ্কিত ফ্রেমে রাষ্ট্রপতির স্বাক্ষর করা ছবি দেওয়া হবে প্রত্যেকটি শিল্পীকে এবং এই সিদ্ধান্ত হল স্বয়ং ডক্টর রাধাকৃষ্ণণের সুপারিশে। মেজর জেনারেল সিং প্রস্তাবটি মেনে নিলেও আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আমরা এই উপহার বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধান ও ভারতস্থ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূতদের দিয়ে থাকি।
আমি সঙ্গে সঙ্গে ওকে বললাম, জেনারেল, আর্টিস্ট লাইক পঙ্কজ মল্লিক এ্যাণ্ড আদার্স আর নো লেস রেসপেকটেবল দ্যান দেম।
ডক্টর রাধাকৃষ্ণণ সঙ্গে সঙ্গে বললেন, দ্যাটস রাইট। পঙ্কজ ইজ পঙ্কজ।
আর একটি শব্দ উচ্চারণ না করে মেজর জেনারেল সিং রাষ্ট্রপতিকে স্যলুট করে গম্ভীর মুখে বেরিয়ে গেলেন।
উনি বেরিয়ে যাবার পর পরই ভক্টর রাধাকৃষ্ণণ একজন শিল্পীর নাম করে জিজ্ঞেস করলেন, ও আসছে তো?
হ্যাঁ, উনিও আসছেন।
ও আমাকে গান শোনাবে তো?
আমি হেসে বললাম, নিশ্চয়ই শোনাবেন।
এবার ডক্টর রাধাকৃষ্ণণ নিজে থেকেই বললেন, ও সত্যি অত্যন্ত উঁচুদরের শিল্পী।
আমি বললাম, হ্যাঁ, সে বিষয়ে কোন সন্দেহ নেই।
এবার রাষ্ট্রপতি বললেন, মাঝে মাঝে ভাবি ইউনেস্কো সেক্রেটারি জেনারেলকে বলব, প্যারিস হেডকোয়ার্টার্সে ওর একটা প্রোগ্রামের ব্যবস্থা করতে।
শুনে এত আনন্দ হল যে তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না কিন্তু আমার সে আনন্দ দীর্ঘস্থায়ী হল না। মেজাজ ভাল নেই বলে ঐ শিল্পী রাষ্ট্রপতি ভবনের সম্বর্ধনা সভায় গেলেন না। আমি মনে মনে বুঝলাম, গ্রামে-গঞ্জে প্যাণ্ডেলে গান গেয়ে মোটা টাকা পেয়ে পেয়ে ওদের রুচিটাই নষ্ট হয়ে গেছে। অনুষ্ঠানের প্রাক্কালে আমি ডক্টর রাধাকৃষ্ণণকে বললাম, হঠাৎ ওর শরীর খারাপ হয়ে পড়ায় উনি আসতে পারলেন না।
পরে একদিন ভক্টর রাধাকৃষ্ণণ আমাকে বলেছিলেন, বাঙালী শিল্পীরা যদি বোম্বে-মাদ্রাজের শিল্পীদের মত ইংরেজিতে কথা বলতে পারতেন ও পাঁচজনের সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন, তাহলে তাঁদের অনেকের খ্যাতিই বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়ত বাট নাইকার দে উইল বী সোস্যাল নর দে লাইক টু লার্ণ ইংলিশ।