ভগবানে বিশ্বাস বা ভক্তি থাকুক বা নাই থাকুক পূজার প্যান্ডেলে দেবী মূর্তি দেখতে বেশ লাগে। একটু আনন্দের ছোঁয়া, একটু পূর্ণতার স্পর্শ নতুনত্বের স্বাদ সবাই পায়। বসন্ত দূরে থাক, কাছে থাক, মনে মনে রঙ লাগে। তারপর হঠাৎ যখন প্যান্ডেলটা খালি হয়, দেবীর বেদী শূন্য তখন বিষণ্ণতার করুণ সুর মনের মধ্যে বেজে ওঠে।
দেবব্রত আর রঞ্জনা ব্যাঙ্গালোরে চলে যাবার সপ্তাহখানেক পরে ডক্টর চৌধুরী আমাকে ঠিক এই কথাগুলোই বলছিলেন।
সকালবেলাতেই ওঁর টেলিফোন এলো, আমি দেবতোষ চৌধুরী কথা বলছি।
বলুন, কেমন আছেন?
আছি ভালোই তবে মনটা বিশেষ সুবিধের নয়।
কেন, কি হলো?
দেবু আর রঞ্জনা চলে যাবার পর কোনো কাজেই ঠিক মন দিতে পারছি না।
আমি বললাম, বাড়ির নতুন বউ চলে গেলে বড় ফাঁকা ফাঁকা লাগে।
আজ সন্ধ্যার দিকে আপনি আসবেন?
আজ?
হ্যাঁ আজই। একটু গল্পগুজব করে একসঙ্গে খাওয়া-দাওয়া করা যাবে।
ডক্টর চৌধুরীর ব্যর্থতার জন্য গিয়েছিলাম, না যেয়ে পারিনি। অনেক গল্প হলো। ঘণ্টার পর ঘন্টা।
তাসখন্দ এয়ারপোর্টে ওকে দেখেই আমার ভালো লেগেছিল। কথাবার্তা বলার পর আবো ভালো লাগল।
আমি ডক্টর চৌধুরীকে সমর্থন জানাই, রঞ্জনা ভালো লাগার মতোই মেয়ে।
আজকালকার ছেলেমেয়েদের মধ্যে শিক্ষা আর আধুনিকতার যত বেশি প্রসার হচ্ছে, মাধুর্য তত বেশি হারাচ্ছে, কিন্তু রঞ্জনা রিয়েলি একটা একসেপসন।
তা ঠিক।
এই কদিনের মধ্যেই ও যে কি ভাবে আমাদের আপন করে নিয়েছে তা কি বলব।
সন্ধ্যার পর পরই অফিস থেকে সোজা গিয়েছিলাম। আশা করেছিলাম গিয়েই এক কাপ চা পাব কিন্তু ডক্টর চৌধুরী আমাদের রমা, ওদের রঞ্জনার প্রশংসায় এমনই ভেসে গেলেন যে চাকরটাকে চা দেবার কথা বলতেও পারলেন না।
হাজার হোক সুভাষবাবু একজন সিনিয়র ডিপ্লোম্যাট। তার একমাত্র সন্তান নিশ্চয়ই খুব আদরে মানুষ হয়েছে কিন্তু তবুও এই মেয়েটি কিভাবে এত কাজের হলো, ভাবতে অবাক লাগে।
অনেক দিন হোস্টেলে কাটিয়েছে তো?
হোস্টেলে থেকে তো ছেলেমেয়েরা আরো বেশি আরামপ্রিয় হয়। এক কাপ চা পর্যন্ত তৈরি করে খেতে হয় না।
তা ঠিক।
সুভাষবাবু যদি এখানেই বরাবর থাকতেন তাহলে ছুটিতে বাড়ি এসেও রঞ্জনাকে সংসারের কিছু কাজকর্ম করতে হতো বা ছোট ভাইবোন থাকলে নিশ্চয়ই কিছু দায়দায়িত্ব নিতে হতো কিন্তু এর তো সে সব কিছুই করতে হয়নি…
আমি আবার সমর্থন জানাই ডক্টর চৌধুরীকে, না, সেসব ঝামেলা ওকে কোনোদিনই সহ্য করতে হয়নি।
ইনস্পাইট অব দ্যাট ও সংসারের সব রকম কাজ করতে পারে আর ছোটখাট খুঁটিনাটি কোনো কিছুই ওর দৃষ্টি এড়িয়ে যাবে না।
নো ডাউট সী ইজ এ নাইস গার্ল।
আমার মন্তব্য ওর কানেই পৌঁছল না। উড ইউ বিলিভ ইট ইফ আই সে যে ও রোজ আমার দুটো ফাউন্টেন পেনে কালি ভরে দিতে পর্যন্ত ভুলে যায় না।
খাওয়ার সময়ও অনেক কথা হলো। শেষে বললেন, আপনার সঙ্গে তো রঞ্জনা বা ওর বাবা মার খুব ঘনিষ্ঠতা। সুতরাং ইউ আর অলসোপার্ট অব আওয়ার বিগার ফ্যামিলী।
আমি হাসলাম।
না, না, হাসি নয়। আপনি নিয়মিত আসবেন। না এলে দুঃখ পাব।
আসব।
রেগুলার আসবেন আর এখানে এলেই খাওয়া-দাওয়া করে যাবেন।
আসব ঠিকই তবে সব সময় খাওয়া-দাওয়া করা বোধহয় সম্ভব হবে না।
ডক্টর চৌধুরী সঙ্গে সঙ্গে আপত্তি জানালেন, সম্ভব হবে না কেন? আপনি তো এখানে একাই থাকেন?
একাই থাকি তবে চাকর আছে।
উনি যেন আমার কথাটা শুনতেই পেলেন না, এইতো সেদিন রঞ্জনা বলছিল ও রান্না না করলে আপনার খাওয়াই হতো না।
ডক্টর চৌধুরী বললেও নানারকম কাজকর্মের ঝামেলায় ওঁর ওখানে যেতে পারলাম না অনেকদিন। এর মধ্যে দু তিনদিন ওঁকে টেলিফোন করেছি। পাইনি। প্ল্যানিং কমিশনের অ্যাডভাইসার বলে ওঁকে সারা দেশ ঘুরে বেড়াতে হয়। মাস তিনেক পরে হঠাৎ রঞ্জনার একটা চিঠি পেলাম, তিন তারিখে আমরা দুজনেই মাদ্রাজ যাচ্ছি। একদিন ওখানে থাকব। তারপর পাঁচই ডিলক্স। এক্সপ্রেসে আমি দিল্লি রওনা হচ্ছি। মাসখানেক দাদার কাছে থাকব। আপনি নিশ্চয়ই যোগাযোগ করবেন।
সাত তারিখ সকালে দু তিনবার নয়া দিল্লি স্টেশনে ফোন করে মাদ্রাজ ডিলক্সের খবর নিলাম। ভাবলাম স্টেশনে যাই কিন্তু গেলাম না। মনে হলো রঞ্জনা সম্পর্কে আমার অতটা উৎসাহ বা আগ্রহ। থাকা ঠিক নয়। অন্যায়। তাড়াতাড়ি খাওয়া-দাওয়া করে বেরুবার সময় রাধাকিষণকে বললাম, কেউ আমার খোঁজ করলে বলল আমি এখানে ছিলাম না। আজ দুপুরেই এসেছি।
জী সাব।
যদি খুব দরকারি টেলিফোন আসে তাহলে অফিসে টেলিফোন করতে বলল।
কোন কারণ নেই, যুক্তি নেই, দাবি নেই কিন্তু তবুও একটা প্রত্যাশায় সারাটা দিন কাটালাম। সন্ধ্যা, রাত্রিও। এলো না। কয়েকবার টেলিফোনের রিসিভার তুলে ডায়াল ঘুরাতে গিয়েও পিছিয়ে এসেছি। করিনি। পরের দিন সকালে মার্শাল টিটো দিল্লি এলেন। সারাটা দিন আমি অত্যন্ত ব্যস্ততার মধ্যে কাটালাম। যুগোশ্লাভ অ্যাম্বাসেডরের রিসেপসন অ্যাটেন্ড করে, নিউজ ডেসপ্যাঁচ করে বাড়ি ফিরতে অনেক রাত হলো। তার পরের দিনও ব্যস্ত রইলাম। তবে রাষ্ট্রপতি ভবনে ডক্টর চৌধুরীর সঙ্গে দেখা হলো কিন্তু কোনো কথা হলো না। প্ল্যানিং মিনিস্টার, প্ল্যানিং কমিশনের মেম্বার ও অ্যাডভাইসাররা প্রেসিডেন্ট টিটোর সঙ্গে আলোচনা করতে গিয়েছিলেন। তখন ডক্টর চৌধুরীর কথা বলার অবকাশ ছিল না। আমাকে দেখে শুধু একটু হাসলেন। সন্ধ্যার পর বাড়ি ফিরে চা খাচ্ছি এমন সময় টেলিফোন এলো। আমি হ্যালো বলতেই ওদিক থেকে রঞ্জনার গলা শুনতে পেলাম আপনার কি ব্যাপার বলুন তো?
কেন কি হলো?
আমার চিঠি পাননি?
পেয়েছি।
তবে কি?
একটা টেলিফোনও করলেন না?
কি দারুণ ব্যস্ততার মধ্যে দিন কাটছে তা তুমি ভাবতে পারবে না।
তাই বলে একবার টেলিফোনও করা যায় না?
ওসব কথা ছাড়ো। তুমি কেমন আছ?
ভালোই; তবে একলা একলা হাঁপিয়ে উঠছি।
কেন? দাদা বাড়ি নেই?
না। টিটো এসেছেন বলে কদিনই খুব ব্যস্ত।
আজই ওঁর সঙ্গে রাষ্ট্রপতি ভবনে দেখা হলো।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
কিছু বললেন?
না। কথা বলার সময় ছিল না। দেবব্রতর কি খবর?
ভালোই।
ব্যাঙ্গালোরে কেমন লাগছে?
ওখানেও তো সারাদিন একলা কাটাতে হয়।
আমি হাসলাম, তুমি কি আশা করেছিলে বিয়ের পর স্বামী তোমার কাছে সারাদিন কাটাবে?
আমি বুঝি তাই বললাম?
আমি তো সেই রকমই বুঝলাম।
আপনি সারা জীবনই আমাকে ভুল বুঝবেন। ওর গলার স্বরটা একটু অন্য রকম মনে হলো।
বোধহয় কথাটা শুনতে ভালোই লাগল, কি বললে রঞ্জনা?
কিছু না।
বল না কি বললে?
বললাম আপনি সব সময়ই আমাকে ভুল বোঝেন।
তার মানে? কবে আবার তোমাকে ভুল বুঝলাম?
যাক গে ওসব কথা। আপনি কেমন আছেন?
যেমন ছিলাম তেমনি আছি।
খাওয়া হয়েছে?
না। এক্ষুনি বাড়ি এলাম।
স্নান করেছেন?
তোমার টেলিফোন আসার এক মিনিট আগেই এসেছি।
তাহলে আর আপনাকে বিরক্ত করব না।
না, না, বিরক্ত হবার কি আছে! বরং এতদিন পরে তোমার সঙ্গে কথা বলতে আমার ভালোই লাগছে।
বাজে বকবেন না। কথা বলতে ভালো লাগলে আপনিই আগে টেলিফোন করতেন।
ভালো না লাগলে কেউ এতক্ষণ ধরে কথা বলে?
সত্যি আপনাকে অনেকক্ষণ আটকে রেখেছি। স্নান করতে যান।
ব্যস্ত হবার কিছু নেই!
না থাক। আপনি এবার স্নান করে কিছু খাওয়া-দাওয়া করুন। কাল আবার কথা হবে।
রঞ্জনা টেলিফোন ছেড়ে দিল। আমিও আস্তে আস্তে রিসিভার নামিয়ে রাখলাম কিন্তু স্নান করতে গেলাম না। বসে রইলাম। ভাবছিলাম রঞ্জনার কথা। আমার সম্পর্কে ওর মনের মধ্যে একটু অভিমান জমা আছে বুঝতে পারি, কিন্তু কেন? আমি কি অন্যায় করেছি? ভুল করেছি? ওর মনে কি কোনো দুঃখ, আঘাত দিয়েছি? কোনো প্রত্যাশা পূর্ণ করিনি? অনেকক্ষণ ধরে ভাবলাম কিন্তু কিছুতেই কোনো কূল-কিনারা পেলাম না।
রঞ্জনা যখন রমা ছিল তখনকার সমস্ত স্মৃতির খাতা খুলে হিসাব করতে বসলাম। সম্পর্ক দীর্ঘ দিনের নয় কিন্তু লেনদেন যথেষ্ট হয়েছে। যখন তখন সব জমা-খরচের কথা মনে পড়ে না। মনে পড়তে পারে না। তবু চুপ করে বসে বসে মনে করার চেষ্টা করলাম। প্রথম থেকেই খুব সহজভাবে আমরা মিশেছি। পোড়া গরু সিঁদুর মেঘ দেখলে ভয় পায়। আমিও পেতাম বলে কোনো মেয়ের সঙ্গেই প্রাণ খুলে মিশতে পারিনি, পারব না কিন্তু ওর সঙ্গে মিশেছি। প্রাণ খুলে মিশেছি। ভালো লেগেছে। মনের অনেক ছোটখাট ক্ষত ঠিক হয়ে গেছে ওর সান্নিধ্যে, সংস্পর্শে। আরো কিছুদিন ওকে কাছে পেলে সব ক্ষত সেরে যেতো কিনা বলতে পারব না। তবে সম্ভাবনা ছিল না, একথা জোর করে বলার ক্ষমতা আমার নেই। হাজার হোক আমি রক্ত-মাংসের মানুষ, আমার হৃৎপিণ্ড ওঠানামা করে, সৌন্দর্য দেখতে ভালো লাগে, প্রিয়জনের সান্নিধ্যে আনন্দ পাই। পাথরের মতো আমি জড় পদার্থ হলে এসব অনুভূতি আমার থাকত না। রমার মতো শত সহস্ৰজনের সারা জীবনের সাধনাতেও আমার কোনো পরিবর্তন হতো না।
আমি জানি না রমার জন্য আমার কি পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু একথা ঠিক ওর অভাব অনুভব করি। ওর সঙ্গে আলাপ হবার পর থেকেই ওর উপর কিছু দাবি করার স্বাধীনতা আমার হয়। এ অধিকার আমি অর্জন করেছিলাম নাকি ও স্বেচ্ছায় আমাকে দিয়েছিল তা মনে নেই। বলতে পারব না।
.
হ্যালো!
কি ব্যাপার? এই সাত সকালে টেলিফোন করছ? টেলিফোনে আমার গলা শুনেই জয়ন্তী বৌদি জিজ্ঞাসা করলেন।
আজ রমাকে আমার সংসার সামলাতে হবে।
তোমার আবার সংসার?
হঠাৎ আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধব এলে সংসার না করে কি উপায় আছে?
কেউ এসেছেন নাকি?
আমার দিদির কলেজ জীবনের দুই বান্ধবী আজ বিকেলের দিকে আগ্রা থেকে আসছেন কিন্তু এদিকে রাধা গিন্নী জ্বরে বেহুঁশ।…
একটু ধর। রমাকে ডেকে দিচ্ছি।
রমা টেলিফোন তুলেই বললো, কি ব্যাপার? এত সকালে আমাকে মনে পড়ল?
সব সময়ই তোমাকে মনে পড়ে কিন্তু জানাই না।
বাজে বকবেন না। বলুন কি ব্যাপার।
আজ বিকেলের দিকে আমার দিদির দুই বান্ধবী আগ্রা থেকে আসছে। কাল ভোরের বাসেই সিমলা চলে যাবেন। কিন্তু কাল থেকে রাধাকিষণের ভীষণ জ্বর।…
আমি আসব?
সেইজন্যেই তোমাকে টেলিফোন করছি।
আপনি এসে নিয়ে যাবেন নাকি বাবাকে বলব?
তুমি কতক্ষণে রেডি হবে বল; আমিই তোমাকে নিয়ে আসব।
আটটা নাগাদ আসুন।
ঠিক আছে।
আমি গাড়ি থেকে নামতেই সুভাষদা জিজ্ঞাসা করলেন, তোমার দিদির দুই বন্ধু আসছে?
আমি গাড়ি লক করতে করতে বললাম, হ্যাঁ।
ওরা তো আমার এখানেও থাকতে পারেন।
আমার ওখানে থাকার তো কোনো অসুবিধে নেই, শুধু রাধাকিষণের জ্বর হয়েই মুশকিল বাধিয়েছে।
রমা যখন যাচ্ছে তখন ও সব ব্যবস্থা করে দেবে। তোমায় কিছু ভাবতে হবে না।
তা জানি।
রমা তৈরিই ছিল। আমি এক কাপ চা খেয়েই ওকে নিয়ে রওনা হলাম। রওনা হবার আগে সুভাষদা আর বৌদিকে বললাম, রমার ফিরতে রাত হলে চিন্তা করবেন না ওদের খাওয়া-দাওয়া হবার পরই আমি ওকে ফিরিয়ে দিয়ে যাব।
বৌদি বললেন, তোমার অসুবিধে হলে টেলিফোন করো, ওকে পাঠিয়ে দেব।
না, না, দাদাকে আর কষ্ট করতে হবে না।
গাড়ি স্টার্ট করে শান্তি পথ ধরতেই বললাম, এই পথেই বাজার করে নিয়ে যাই, কি বল।
হ্যাঁ, সেই ভালো।
মাছ না মাংস কিনব বল তো।
ওঁরা কি পছন্দ করবেন তা আমি কি করে বলি বলুন।
দুরকম মাছ কেনার চাইতে মাছ-মাংস দুইই কেনা ভালো, তাই না?
তা তো বটেই।
একটু পরে রমা জিজ্ঞাসা করল, যারা আসছেন তারা আপনার দিদির সঙ্গে পড়তেন বুঝি?
হ্যাঁ। তাছাড়া আমাদের বাড়িতে খুব আসা-যাওয়া ছিল।
খুব ঘনিষ্ঠতা না থাকলে নিশ্চয়ই আপনার এখানে উঠতেন না।
এক কালে খুবই ঘনিষ্ঠতা ছিল তবে ইদানীং বেশ কয়েক বছর দেখাশুনা নেই।
দুই বন্ধুই শুধু আসছেন?
ওঁরা কেউই বিয়ে করেননি…
তাই নাকি?
হ্যাঁ। তাছাড়া দুজনেই একই কলেজে লেকচারার।
তাই দুই বন্ধু বেড়াতে বেরিয়েছেন।
ওঁরা খুব ঘুরে বেড়ান।
খুব স্বাভাবিক। সংসারধর্ম না করলে কিছু নিয়ে তো থাকতে হবে।
আমিও তো বিয়ে করিনি; আমি কি নিয়ে আছি? প্রশ্ন করেই রমার দিকে তাকালাম।
আপনার বিয়ে করার সময় তো চলে যায়নি।
চলে যায়নি?
না।
দেড়টা-দুটোর মধ্যে সমস্ত রান্না শেষ করার পর আমি আর রমা একসঙ্গে খেতে বসলাম। খেতে খেতে ও জিজ্ঞাসা করল, আমি যদি এখন দিল্লিতে না থাকতাম তাহলে কাকে দিয়ে রান্না বান্না করাতেন?
আমি হাসলাম। বললাম, ভয় নেই। অন্য কোনো সুন্দরী যুবতী এখানে আসে না, আনিও না।
রমা আর কোনো কথা বলল না। চুপ করে রইল।
আমি বললাম, তোমাকে ছাড়া আর কাউকেই এভাবে বিরক্ত করার অধিকার আমি পাইনি।
মুখ নিচু করেই বললো, আমিও আর কারুর হুকুম তামিল করি না।
তা আমি জানি।
কিন্তু এ অধিকার আমি কেমন করে পেলাম?রমা দিল কেন?রমাইবা কোনো অধিকারে আমাকে টেলিফোন করে বলতো, ওয়েস্টনগর থেকে আমার দুই বন্ধু দুপুরে আমাদের এখানে আসবে, খাবে। তারপর আমরা তিনজনে প্লাজায় সিনেমা দেখব। আপনাকে ওদের পৌঁছে দিতে হবে।
আমার সঙ্গে দুটি সুন্দরী মেয়েকে ছেড়ে দেওয়া কি ঠিক হবে?
ছেড়ে দিলেও আপনার দ্বারা কিছু হবে না, তা আমি জানি।
জান?
নিশ্চয়ই জানি। তবে আজ তো আমিও সঙ্গে থাকব। সিনেমা দেখে আমি কি একলা বাড়ি ফিরব?
আমি শুধু ড্রাইভারী করব নাকি আমারও একটা টিকিট কাটবে?
ওদের সঙ্গে আপনার সিনেমায় যেতে হবে না। পরে আমি আর আপনি একদিন দেখব।
সিনেমায় অনেকবারই আমরা গেছি। অনেক সময় জয়ন্তী বৌদি আমাদের সঙ্গে গিয়েছেন। সিনেমা দেখে বেরুবার সময় গাড়ির ল খুলতে গেলেই ও বলতো, এখনই বাড়ি যাবেন? একটু কফি-টফি খাওয়াবেন না?
জয়ন্তী বৌদি আমাদের সঙ্গে থাকলে সঙ্গে সঙ্গে বলতেন, ও সিনেমা দেখাল, আবার কফি খাওয়াবে কেন? বরং আমিই…
তুমি ক্ষেপেছ মা? উনি থাকতে তোমার পয়সায় কফি খাব?
আমি হাসি। জিজ্ঞাসা করি, এই রকম হ্যাংলামি করে কফি খেতে তোমার লজ্জা করে না?
ঠোঁট উল্টে, মাথা নাড়তে নাড়তে রমা বলতো, আপনার কাছে চাইতে আবার লজ্জা কিসের?
.
প্রত্যেক মাসেই সুভাষদা বাড়িতে দুটো-একটা পার্টি দিতেন।
প্রায় সব পার্টিতে আমি যেতাম। রমা দিল্লিতে থাকলে আমাকে সকালের দিকে টেলিফোন করে বলতো, আজ আপনি সেই সিল্কের পাঞ্জাবি আর ধুতি পরে আসবেন তো?
ধুতি-পাঞ্জাবি পরে আসব কেন? বরযাত্রী যাব নাকি?
ইয়ার্কি না, সত্যি ধুতি-পাঞ্জাবি পরে আসবেন।
কেন?
বাবাদের ফরেন সার্ভিসের দুই বাঙালি সাহেব আসবেন…
তাতে কি হলো?
ওদের সাহেবীয়ানা দেখলে আমার গা জ্বলে যায়। তাইতো ওরা এলেই বাবাকে ধুতি-পাঞ্জাবি আর মাকে লাল পেড়ে গরদের শাড়ি পরাই।
আর তুমি?
আর আমিও খুব সাধারণ তাঁতের শাড়ি পরি।
সত্যি ধুতি-পাঞ্জাবি পরে আসব?
অব কোর্স!
.
বসে বসে আরো কত কি মনে পড়ল। এতকাল অনেকগুলো টুকরো টুকরো ঘটনা একসঙ্গে দেখতে গিয়ে, বিচার করে মনের মধ্যে সন্দেহ দেখা দিচ্ছে। সন্দেহ হচ্ছে ও হয়তো সত্যই আমাকে ভালোবাসত, আমাকে চাইত, আমাকে নিয়ে আগামী দিনের মিষ্টি-মধুর স্বপ্ন দেখে। কিন্তু এতো আমার শুধু সন্দেহ। অনুমান। আবছা ধারণা। ও কি প্রত্যাশা করেছিল আমি নিজেই এগিয়ে যাব? অনুরোধ করব বা দাবি করব, রমা, তুমি আমার। আর কাউকে বিলিয়ে দিও না, দেবে না।
রাধাকিষণের তাগিদে আর বসে বসে ভাবতে পারলাম না। উঠে পড়লাম।
পরের দিন সকালেই প্রেসিডেন্ট টিটো চলে গেলেন। কাজকর্ম শেষ করে দুপুরের দিকেই আমি বাড়ি এলাম। খেলাম। মুলকরাজ আনন্দের কুলিপড়তে পড়তে ঘুমিয়ে পড়লাম।কদিন খুব পরিশ্রম গেছে বলে রাধাকিষণ আমাকে ডাকেনি, চাও দেয়নি। ঘুম ভাঙলো সন্ধ্যা ঘুরে যাবার পর। তখন প্রায় সাড়ে সাতটা বাজে। চা খেতে খেতে রাধাকিষণকে জিজ্ঞাসা করলাম, এ বেলায় কি রান্না করছ?
এ বেলায় রান্না করিনি।
বেশ বিরক্ত হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন?
তিন মূর্তি লেনের মেমসাব টেলিফোন করে বললেন, আপনি ওখানে খানা খাবেন…
তোমাকে বললেই আমি খেতে যাব?
উনি দুবার টেলিফোন করেছেন…
আমাকে ডাকলে না কেন?
আমি ডাকতে চেয়েছিলাম কিন্তু ঘুম ভাঙাতে মানা করলেন।
আমি বিছানার উপরেই চুপ করে বসে রইলাম। রাধাকিষণও পাশে দাঁড়িয়ে। কিছুক্ষণ পরে ও জিজ্ঞাসা করল, সাব খানা বানাব?
ওর কথার সোজাসুজি জবাব না দিয়ে বললাম, ও ঘর থেকে টেলিফোনটা নিয়ে এসো।
রাধাকিষণ টেলিফোন আনতেই ডায়াল ঘুরালাম। ডক্টর চৌধুরী বা রঞ্জনা নয় ওদের চাকরই টেলিফোনটা ধরল। জিজ্ঞাসা করলাম, সাব হ্যায়?
হায় মাগার বাথরুম গ্যয়া।
নায়া মেমসাহেব কাহা?
আপ হোল্ড কিজিয়ে।
দুএক মিনিট পরে রঞ্জনা টেলিফোন ধরতেই জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি টেলিফোন করেছিলে?
একবার নয় দুবার?
কি ব্যাপার?
আজ রাত্রে আপনি আমাদের এখানে খাবেন।
হঠাৎ কি ব্যাপার?
কি আবার ব্যাপার?আমি এসেছি, তাই দাদা বললেন আপনাকে যেন আজ রাত্রে খেতে বলি।
কিন্তু।
ওসব কিন্তু ছাড়ুন। এক্ষুনি ঘুম থেকে উঠলেন?
হ্যাঁ।
তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে চলে আসুন।
শুধু সেদিন রাত্রে নয় পাঁচ-সাত দিন পর পরই ওদের ওখানে নেমন্তন্ন খেতে যেতাম। যেতেই হতো। রঞ্জনা তত বলতই, তাছাড়া ডক্টর চৌধুরী নিজেও অনুরোধ করতেন, আজ কিন্তু তাড়াতাড়ি আসবেন।
আমি একটু সঙ্কোচ বোধ করতাম, এইতো সেদিন গিয়ে খেয়ে এলাম। আজ আবার…
আপনি মশাই বড় লাজুক। খাওয়া-দাওয়া ব্যাপারে ব্যাচেলারের লজ্জা করলে চলে?
আমি একটু হাসলাম, লজ্জার কিছু নয় তবে।
ওসব তবে টবে ছাড়ুন। সাতটার মধ্যে নিশ্চয়ই আসছেন।
আচ্ছা।
আমাকে যেতেই হতো, না গিয়ে পারতাম না। আর ওখানে যাওয়া মানেই রঞ্জনার প্রশংসা শোনা।
ডক্টর চৌধুরী হাসতে হাসতে বললেন, রঞ্জনা কি ডেঞ্জারাস মেয়ে তা আপনি জানেন?
আমি হাসি।
আমার মতো ঘুম কাতুরে লোককে পর্যন্ত ও ভোর পাঁচটায় উঠিয়ে দেয়।
কেন?
মর্নিং ওয়াক করতে পাঠায়।
আমি বলি, মর্নিং ওয়াক করা সত্যি ভালো।
ভালো তো বুঝি কিন্তু আপনি করেন?
দুকাপ কফি নিয়ে রঞ্জনা ড্রইংরুমে ঢুকেই বললো, কি দাদা! আমার প্রশংসা করতে শুরু করেছে?
ডক্টর চৌধুরী ডান হাত বাড়িয়ে কফির পেয়ালা নিতে নিতে বললেন, প্রশংসা নয়, নিন্দা করছি। সারা জীবনে যে সাড়ে সাতটা-আটটার আগে ঘুম থেকে ওঠেনি, আর তাকে তুমি পাঁচটার সময় মর্নিং ওয়াকএ পাঠাচ্ছ আর আমি তোমার নিন্দা করব না?
রঞ্জনা গম্ভীর গলায় বললো, দাদা ডোন্ট ফরগেট ইউ আর অ্যাবোভ ফিফটি।
রঞ্জনা চলে যেতেই ডক্টর চৌধুরী আবার প্রশংসা করতে শুরু করেন, মেয়েটা এসে আমার লাইফের প্যাটার্নই পাল্টে দিয়েছে।
…রঞ্জনার ঘরেই টাইম পিস থাকে। অ্যালার্ম বাজলেই ও উঠে ডক্টর চৌধুরীর ঘরে যায়। দু একবার পাশে দাঁড়িয়ে ডাক দেয়, দাদা! দাদা।
একটু চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
আবার ডাকে, দাদা। উঠুন। পাঁচটা বাজে।
তবুও ঘুম ভাঙে না ডক্টর চৌধুরীর। রঞ্জনা আরো একটু এগিয়ে যায়, একটু ঝুঁকে পড়ে ওঁর মাথায় হাত দিতে দিতে ডাকে, দাদা, উঠবেন না? অনেকক্ষণ অ্যালার্ম বেজে গেছে।
ডক্টর চৌধুরী একবার এক মুহূর্তের জন্য চোখ মেলেই চমকে ওঠেন, অ্যালার্ম বেজে গেছে?
হ্যাঁ দাদা।
ডক্টর চৌধুরী একটু পাশ ফিরে শুতে শুতেই জিজ্ঞাসা করেন, তুমি অনেকক্ষণ ডাকছ?
না, বেশিক্ষণ না।
উনি ওপাশ ফিরে আবার একটু ঘুমুতে চেষ্টা করেন কিন্তু রঞ্জনা ওঁর মাথায় কপালে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে আবার ডাকে, দাদা, আর দেরি করবেন না।
একে রঞ্জনার ডাকাডাকি তার উপর চোখের উপর এমন আলো পড়ে যে ওঁকে উঠতেই হয়। উনি বাথরুমে ঢুকলেই রঞ্জনা আবার নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়ে। ঘুমোয়। ডক্টর চৌধুরী বেরুবার সময় চাকরকে ডেকে দেন। ও দরজা বন্ধ করে দিয়েই দিনের কাজ শুরু করে। সাড়ে ছটা-পৌনে সাতটায় উনি মর্নিং ওয়াক করে ফিরে এসেই আবার বাথরুমে যান। স্নান সেরে বেরুতে না বেরুতেই চা হয়। রঞ্জনাও উঠে পড়ে।
চা খেতে খেতে খবরের কাগজ পড়তে পড়তে দুজনের গল্প হয়।
চৌধুরী বাড়ির গল্প, দেবব্রতর ছেলেবেলার গল্প, দিল্লির গল্প। কখনও কখনও বেনারসের গল্প, ওয়াশিংটনের গল্প, কায়রো মস্কোর গল্প।
আচ্ছা দাদা, আপনার এখানে বড় দাদুর ছবি দেখি, কিন্তু আপনার নিজের দাদুর কোনো ছবি তো দেখি না।
আমার দাদু বিশেষ সুবিধার লোক ছিলেন না। আমার দাদুর চাইতে বড় দাদুই আমাকে বেশি ভালোবাসতেন, আমিও ওঁকেই বেশি ভালোবাসতাম…
তাই নাকি?
হ্যাঁ। তাছাড়া ওঁর জন্যই আমি একটু লেখাপড়া শিখতে পেরেছি। আমার নিজের দাদুর কাছে থাকলে আমার কিছুই হতো না।
লেখাপড়ার প্রতি বুঝি ওঁর বিশেষ আগ্রহ ছিল না?
বিন্দুমাত্র না।
আপনারা আর আহিরীটোলায় যান না?
আমি দু তিনবার গিয়েছি। একবার কি দুবার দেবুকেও নিয়ে গেছি।
ওসব সম্পত্তি তো আপনাদেরই?
ঠিক জানি না। আমার মনে হয় দাদু সব কিছু বেচে দেন।
এখন ওখানে কারা থাকে?
খুব দূরসম্পর্কের কিছু আত্মীয় আর কিছু ভাড়াটে।
ডক্টর চৌধুরী যখন দেবব্রতর ছেলেবেলার গল্প করেন তখনই ভারি মজা হয়।
তখনও আমরা সিমলায়। দেবু খুব ছোট। বড় জোর পাঁচ-ছ বছরের হবে। পাশের বাড়ির একটা পাহাড়ি মেয়ের সঙ্গে ওর খুব ভাব ছিল। কিছুকাল পরে ওরা সিমলা থেকে চলে গেলে দেবুর কি কান্না।…
কেন?
ডক্টর চৌধুরী হাসেন, কেন আবার? ও ঐ মেয়েটিকে বিয়ে করবে বলে পাগল।
রঞ্জনাও হাসে। বলে, ঐ রকম একটা পাহাড়ি মেয়ের সঙ্গে বিয়ে হলেই ভালো হতো।
ডক্টর চৌধুরী হাসতে হাসতে একটু আনমনা হয়ে কি যেন ভাবেন। আমাদের আহিরীটোলার বাড়িতে এক বুড়ি থাকতেন। আমি তাকে বুড়ি পিসিমা বলে ডাকতাম। প্রথম যখন দেবুকে নিয়ে আহিরীটোলার বাড়িতে যাই উনি ওকে দেখে বলেছিলেন ওর সুন্দরী শিক্ষিতা ও বিদেশিনীর সঙ্গে বিয়ে হবে।
রঞ্জনা বললো, কই বিদেশিনীর সঙ্গে তো বিয়ে হলো না?
জ্যোতিষ আমি বিশ্বাস না করলেও মাঝে মাঝে বুড়ি পিসিমার কথাটা মনে হতো। বিশেষ করে ওকে লন্ডনে পাঠাবার পর একটু বেশি মনে হতো…।
রঞ্জনা হাসতে হাসতে প্রশ্ন করে, আপনার ভাই ওখানে কাউকে বিয়ে করে রেখে আসেনি তো?
ডক্টর চৌধুরী বেশ গর্বের সঙ্গেই জবাব দেন, ভুলে যেও না ও দেবব্রত চৌধুরী।
একটু নীরবতা।
জান রঞ্জনা, বুড়ি পিসিমা ঠিকই বলেছিলেন। একদিক দিয়ে তুমিও তো বিদেশিনী।
আমি বিদেশিনী হবে কেন?
যখন তোমার বিয়ে হলো তখন তো তুমি মস্কোর বাসিন্দা।
রঞ্জনা চুপ করে থাকে।
শুনেছি আমাকে নিয়েও আলোচনা হতো। কোনো না কোনো প্রসঙ্গে হয়তো আমার কথা উঠত। আচ্ছা রঞ্জনা, রিপোর্টার সাহেবের সঙ্গে তোমাদের আলাপ কি অনেক দিনের?
উনি যখন ডক্টর রাধাকৃষ্ণণের সঙ্গে আমেরিকায় যান তখনই বাবা-মার সঙ্গে ওঁর প্রথম আলাপ।
তাহলে তো খুব বেশি দিনের আলাপ নয়।
না, খুব বেশি দিনের না হলেও খুব ঘনিষ্ঠতা হয়ে গেছে বাবা-মার সঙ্গে।
তোমার বাবা-মা ওঁকে খুব ভালোবাসেন।
উনিও বাবা-মাকে যথেষ্ট শ্রদ্ধা করেন।
কোনো কোনো দিন আলোচনা আরো এগিয়ে যায়।
রিপোর্টার সাহেব আর দেবুর মধ্যেও দারুণ ভাব তা জান?
রঞ্জনা একটু হাসে, জানি।
লন্ডনে দেবুর সঙ্গে প্রথম আলাপ হবার পর আমার কাছে ওর খুব প্রশংসা করেছিলেন। তুমি। তো জান যে কেউ দেবুর প্রশংসা করুক তাকে আমার ভালো লাগে।
এটা ঠিক বললেন না দাদা।
কেন?
আপনার ভাইয়ের প্রশংসা করলেই ভালো আর প্রশংসা না করলেই ভালো নয়?
আমি ঠিক তা বলিনি।
আপনার কথা শুনে মনে হলো উনি আপনার ভাইয়ের প্রশংসা করেছিলেন বলেই ওকে আপনার ভালো লেগেছে।
ডক্টর চৌধুরী একটু জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে রঞ্জনার দিকে তাকিয়ে বললেন, ভদ্রলোককে এমনি আমার ভালো লেগেছে। দেখতে-শুনতে আলাপেব্যবহারে বেশ সুন্দর তবে…
তবে ভাইয়ের প্রশংসা করায় আরো ভালো লেগেছে তাই তো।
ডক্টর হাসতে হাসতে বললেন, তা ঠিক।
এরপর আপনার ভাইয়ের সঙ্গে যদি আমার কোনদিন একটু মতবিরোধ বা তর্ক হয় তাহলেই তো আপনি বলবেন, রঞ্জনা মেয়েটা ভালো না।
না, তা বলব কেন? তবে তোমাদের মধ্যে তর্ক ঝগড়া হবেই না।
সংসারের অভিজ্ঞতা প্রায় না থাকলেও রঞ্জনা ওঁর কথায় হাসল। দাদা, আপনি চিরকাল ল্যাবরেটারিতে কাটিয়ে মানুষকে বড় সহজ সরল মনে করেন।
পরে টেলিফোনে ও আমাকে সব কথা জানাত। আমি শুনে হাসতাম।
ডক্টর চৌধুরী আগে সকালে কিছুই খেতেন না। এখনও বিশেষ কিছু খান না। রঞ্জনার অনুরোধে সামান্য একটু ফল খান। সাড়ে নটাতেই ভাত খেয়ে প্ল্যানিং কমিশনে চলে যান। বিকেলের দিকে এক কাপ চা। তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরলে রঞ্জনার চাপে কিছু খেতেই হয় কিন্তু অধিকাংশ দিনই দেরি করে ফেরেন। সাতটা-সাড়ে সাতটা-আটটা বেজে যায়। মিটিং কনফারেন্স ডেলিগেশনের ঝামেলা থাকলে আরো রাত হয়। অফিস থেকে মাঝে মাঝে বাড়িতে টেলিফোন করে রঞ্জনার খবর নেন। কাজের চাপ বেশি থাকলে তাও ভুলে যান। রঞ্জনা অবশ্য রোজই দু তিনবার ফোন করে বলে, দাদা, বাবার চিঠি এসেছে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। আপনারও চিঠি আছে।
ওরা কেমন আছেন?
ভালোই, তবে আপনাকে একবার যেতে লিখেছেন।
ডক্টর চৌধুরী হাসেন মস্কো যদি বিহার মধ্যপ্রদেশের মধ্যে হতো তাহলে হয়তো একবার চেষ্টা করতাম, কিন্তু…
কেন আপনি কি মস্কো যেতে পারেন না?
সরকার পাঠালেই যেতে পারি।
বাবার তো রিটায়ার করার টাইম হয়ে এলো।
সে এখনও অনেক দেরি।
তিন মূর্তি লেন থেকে বাজার অনেক দূরে। সময় কাটাবার জন্য রঞ্জনা আরো দূরের মার্কেটে যায়। কোনদিন আই-এন-এ মার্কেট, কোনোদিন গোল মার্কেট। বেশ খানিকটা সময় লাগে, কিন্তু তবু সারাটা দিন কাটতে চায় না। পারে না। অসহ্য মনে হয়। বরাবর হোস্টেলে থেকে লেখাপড়া করে একলা থাকার অভ্যাস নেই।
হ্যালো, আমি রঞ্জনা।
বলো কেমন আছো?
একবার টেলিফোনও করেন না কেন বলুন তো?
হঠাৎ টেলিফোন করেই টপ্পা-ঠুংরী গাইতে শুরু করলে কেন?
সব সময়ই আপনার ঠাট্টা। সত্যি বলুন তো আপনি টেলিফোন করেন না কেন?
কে টেলিফোন করল তাতে কি আসে যায়? কথা তো হচ্ছে রেগুলারই।
টেলিফোন করলে কথা না বলে কি করবেন? বাধ্য হয়েই বলতে হয়।
তোমার মেজাজটা খারাপ কেন বলো তো?
মেজাজটা খারাপ হবে কেন। তবে সারাটা দিন একলা থাকতে বিশ্রী লাগে।
আমি কি করতে পারি বল?
কি আবার করবেন?
তবে আর এসব কথা বলে লাভ কি?
ঠিক আছে বলব না। ঝপাং করে টেলিফোনের রিসিভার নামিয়ে রাখল রঞ্জনা।
মনে হলো একবার টেলিফোন করি, কিন্তু করলাম না। কিছুক্ষণ পরে মাথায় একটু দুষ্ট বুদ্ধি এলো। ডক্টর চৌধুরীকে প্ল্যানিং কমিশনে টেলিফোন করলাম, কেমন আছেন?
ভালোই। আপনার খবর ভালো তো?
আমার শরীরটা বিশেষ ভালো নেই।
স্নেহপ্রবণ ডক্টর চৌধুরী একটু উৎকণ্ঠার সঙ্গে বললেন, কেন, কি হলো? জ্বর নাকি?
জ্বর হয়নি। গাড়ির দরজা বন্ধ করতে গিয়ে ডান পায়ে দারুণ লেগেছে…
তাই নাকি?
হ্যাঁ। একেবারে শয্যাশায়ী।
তাহলে তো খুবই মুশকিল।
চাকরটা না থাকায় আরো বিপদে পড়েছি।
সেকি? খাওয়া-দাওয়ার কি হচ্ছে?
সুন্দর নগর মার্কেটের একটা দোকানে টেলিফোন করলে ওরা কিছু পাঠিয়ে দেয়।
মাই গড! ইউ আর রিয়েলি ইন ট্রাবল!
রঞ্জনা ভালো আছে?
হ্যাঁ, ভালোই আছে, কিন্তু আপনিই তো ভাবিয়ে তুললেন।
আপনি চিন্তা করবেন না। দুএকদিনের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে।
.
রাধাকিষণ দুদিনের ছুটি নিয়ে গড়মুক্তেশ্বরের মেলা দেখতে গেছে। আজই ভোরে গেছে। পরশু সন্ধ্যার পর ফিরবে। সকালে ডিম রুটি খেয়ে অফিসে গিয়েছিলাম, আবার বিকেলে খাবো। ফরেন অফিসের ব্রিফিং আছে। দুপুরবেলায় খাওয়া-দাওয়া করে একটা ঘুম দেব ভাবছিলাম, কিন্তু বাড়ি ফিরে রাধাকিষণকে না দেখতে পেয়েই মেজাজ বিগড়ে গেল। তারপর রঞ্জনার টেলিফোন। প্রথমে ভেবেছিলাম রাত্রে খেতে বলবে। নেমন্তন্ন তো করলই না উপরন্তু রাগ করে কথাবার্তা বললো। হঠাৎ বাতিক চাপল ওর হাতের রান্না খেতেই হবে। সেই জন্যই ডক্টর চৌধুরীকে টেলিফোন করে ঐসব মিথ্যে কথা বললাম। আশা করেছিলাম উনি সঙ্গে সঙ্গে রঞ্জনাকে টেলিফোন করবেন। আর তারপরই আমার টেলিফোন বেজে উঠবে।
পাঁচ, দশ, পনের মিনিট। আধঘণ্টা। একঘণ্টাও পার হয়ে গেল। কিন্তু আমার টেলিফোন বেজে উঠল না। আরো আধঘণ্টা হয়ে গেল তবু টেলিফোন এলো না। হঠাৎ কলিং বেল বাজতেই চমকে উঠলাম। ভাবলাম নিশ্চয়ই পিয়ন এসেছে কোনো রেজিস্টার্ড বুক-পোস্ট ডেলিভেরী দিতে। দরজা খুলে দেখি রঞ্জনা। মিটমিট করে হাসছে। হাতে টিফিন কেরিয়ার।
এসো। আমারও হাসি পাচ্ছিল, কিন্তু অনেক কষ্টে হাসি চেপে স্বাভাবিকভাবে ওকে ডাকলাম।
ও ধীর পদক্ষেপে ড্রইংরুমে ঢুকে সেন্টার টেবিলের ওপর টিফিন কেরিয়ার রেখে একটা সোফায় বসল। মিটমিট করে হাসতে হাসতেই আমার দিকে তাকিয়ে রইল। মুখে কোন কথা নেই।
অমন করে কি দেখছ?
ঠিক একই রকম ভাবে আমার দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে আস্তে আস্তে বললো, দেখে মনেই হয় না ভিতরে ভিতরে এত দুষ্ট বুদ্ধি।
ন্যাকামি করে জিজ্ঞাসা করলাম, কেন? আমি কি করেছি?
ও মাথা দোলাতে দোলাতে বললো, কিচ্ছু না।
কথার মোড় ঘোরাবার জন্য জিজ্ঞাসা করলাম, টিফিন কেরিয়ার খালি না ভর্তি?
রাধাকিষণ কোথায়?
ছুটিতে।
আবার ছুটিতে?
দুদিনের জন্য গড়মুক্তেশ্বরের মেলা দেখতে গেছে।
কবে গেছে?
আজই ভোরে।
তাহলে খাওয়া হয়নি?
খাওয়া হয়নি বলেই গাড়ির দরজায় পাটা এমন বিচ্ছিরিভাবে জখম হলো।
ও টিফিন কেরিয়ারটা হাতে ভিতরের দিকে যেতে যেতে আপন মনে বললো, এই না হলে জার্নালিস্ট।
আমি চুপ করে বসে রইলাম।
একটু পরে ডাইনিং টেবিলে খাবার-দাবার সাজিয়ে রঞ্জনা ডাকল, আসুন!
ডাইনিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তুমি খেয়ে এসেছ?
হ্যাঁ।
সত্যি বলছ?
আপনার মতো সাজিয়ে-গুছিয়ে মিথ্যে বলার মতো ক্ষমতা আমার নেই।
তুমি রাগ করেছ?
ভাত ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে।
বসলাম। ভাতে হাত দিতেই অবাক হলাম, ভাত তো দারুণ গরম, তুমি কি এক্ষুনি রান্না করে নিয়ে এলে?
আমি রান্না করিনি। রান্না করিয়ে নিয়ে এলাম।
এত গরম ভাত আনার কি দরকার ছিল?
আমি জানি আপনি ঠাণ্ডা ভাত খেতে পারেন না।
কিন্তু…
খেয়ে নিন তো! আর বকবক করতে হবে না।
আমি আর একটি কথা না বলে মুখ বুজে খেয়ে নিলাম। ডাইনিং টেবিলে বসেই মুখ নিচু করে বললাম, তোমাকে কষ্ট দিলাম ঠিকই, কিন্তু খুব ভালো লাগল।
এভাবে কতদিন চলবে?
তুমি যতদিন চালাবে।
আরো কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে রঞ্জনা উঠল, যাচ্ছি। রাত্রে ড্রাইভারকে দিয়ে খাবার পাঠিয়ে দেব।
আমি হাসলাম, তোমার কি মাথা খারাপ হয়েছে?
রঞ্জনা হাসতে হাসতে বললো, পায়ের ব্যথা না সারা পর্যন্ত তো দেখাশুনা করতে হবে।
অনেক হয়েছে। আর না।
দাদার হুকুম।