০৫. ব্যাঙের ছাতা আর গমের পরিজ

০৫.

সেই রাত্রে বরিস ব্যাঙের ছাতা আর গমের পরিজ খেয়েছিল। খাওয়ার কিছুক্ষণ পরেই তার বুক-জ্বালা আরম্ভ হল। হঠাৎ তলপেটে তার অসহ্য যন্ত্রণা বোধ হতে লাগল। খানিকক্ষণ পর বমির চোটে যেন তার নাড়িভুড়ি বেরিয়ে আসতে লাগল এবং ভোরের দিকে সে ভবলীলা সংবরণ করল; হুবহু যেরকম গুদামবাড়ির ইঁদুরগুলো মারা যায়। এদেরই উপকারার্থে কাতেরিনা আপন হাতে একরকমের মারাত্মক সাদা গুঁড়ো মাখিয়ে খাবার তৈরি করত– এ গুড়োটা কাতেরিনার হেফাজতেই থাকত।

কাতেরিনা তার আপন সেরগেইকে বুড়োর গুদামঘর থেকে মুক্ত করে নিয়ে সক্কলের চোখের সামনে, কণামাত্র লজ্জা-শরম না মেনে, শৃশুরের চাবকানো থেকে সেরে ওঠার জন্য। তাকে তার স্বামীর বিছানায় আরাম করে শুইয়ে দিল। ওদিকে কালবিলম্ব না করে শ্বশুরকে খ্রিস্টধর্মের আচার-অনুষ্ঠানসহ গোর দেওয়া হল। অবশ্য লক্ষণীয় বলে মনে হতে পারে, কারও মনে কোনও সন্দেহের উদয় হয়নি; বরিস তিমোতেই যদি মরে গিয়ে থাকে তবে, যা, সে নিশ্চয়ই মারা গেছে ব্যাঙের ছাতা খেয়ে আর, ওরকম কত লোক তো ব্যাঙের ছাতা খেয়ে আকছারই মারা যায়। ছেলের জন্য অপেক্ষা না করেই বুড়ো বরিসকে সাত-তাড়াতাড়ি গোর দেওয়া হয়েছিল, কারণ বছরের ওই সময়টার ভাপসা গরম পড়ে*[* ফলে মৃতদেহ খুব তাড়াতাড়ি পচতে আরম্ভ করে। অনুবাদক।] আর যে লোকটা খবর নিয়ে গিয়েছিল সে জিনোভিই বরিসিচকে মিলে পায়নি। ষাট মাইল আরও দূরে সে সস্তা কিছু জঙ্গলা জমির খবর পায় এবং সেটা দেখতে সে ওইদিকে চলে গিয়েছিল। যাবার সময় সে আবার কাউকে পরিষ্কার করে বলে যায়নি ঠিক কোন জায়গায় যাচ্ছে।

সব ব্যবস্থা করে নেবার পর কাতেরিনা একদম বে-লাগাম হয়ে গেল। ভীরু সে কোনও কালেই ছিল না, কিন্তু এখন তার মনের ভিতর কী খেলছে তার কোনও পাত্তাই কেউ পেল না। পুরো পাক্কা হিম্মতভরে সে চলাফেরা করতে লাগল, বাড়ির সর্বপ্রকার কাজকর্মে ঠিকমতো তদারকি করল এবং সেরগেইকে এক লহমার তরে চোখের আড়াল হতে দিত না। বাড়িতে যারা কাজ করত তারা সবাই এসব দেখে তাজ্জব; কিন্তু কাতেরিনা দরাজ হাত দিয়ে প্রত্যেককে বশীভূত করার তত্ত্বটি বিলক্ষণ জানত, সর্ববিস্ময় তৎক্ষণাৎ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেল।

যে যার আপন মনে অনুমান করল, কীঠাকুরানী আর সেরগেইয়ের ভিতর চলছে বেলেল্লাপনা– ওই হল গিয়ে মোদ্দা কথা! এখন তো ওটা তারই শিরঃপীড়া, আমাদের কী, আর জবাবদিহি তো করতে হবে একলা তাকেই।

ইতোমধ্যে সেরগেই তার স্বাস্থ্য, তার নমনীয় মাধুর্য পুনরায় ফিরে পেয়েছে আর বীরদের সেরা বীরের মতো আবার কাতেরিনার উপরে শিকারি পাখির মতো চক্কর খেতে শুরু করেছে। আবার আরম্ভ হয়েছে তাদের আনন্দময় দিন-যামিনী! কিন্তু কালবেগ শুধু ওদের দুজনার তরেই তো আর এগিয়ে যাচ্ছিল না। ওদিকে দীর্ঘ অনুপস্থিতির পর স্বামী হিসেবে বিড়ম্বিত জিনোভিই বরিসি দ্রুতবেগে আপন গৃহমুখে ধাবিত হয়েছে।

.

০৬.

আহারাদি শেষ করা হয়েছে। বাইরে তখনও দুর্দান্ত গরম আর চটপট যেদিক-খুশি সেদিকে মোড় নিতে ওস্তাদ মাছিগুলোর উৎপাত অসহ্য হয়ে উঠেছে। কাতেরিনা তার শোবার ঘরের জানালার খড়খড়িগুলো বন্ধ করে তার উপরে ভিতরের দিকে একখানা ফ্ল্যানেলের পর্দা ঝুলিয়ে দিয়ে বণিক সম্প্রদায়ের সমাদৃত উঁচু খাটে সেরগেইকে নিয়ে বিশ্রামের জন্য শুয়ে পড়েছে। কাতেরিনা ন্দ্রিা জাগরণে আসা-যাওয়া করছে, কিন্তু নিদ্রাই হোক আর জাগরণই হোক, তার মনে হচ্ছিল যেন তার মুখ ঘামে ভেসে যাচ্ছে আর প্রত্যেকটি নিশ্বাস অত্যন্ত গরম আর অতিশয় কষ্টের সঙ্গে ভিতরে যাচ্ছে। স্পষ্ট বুঝতে পারছিল ঘুম থেকে উঠে বাইরের বাগানে বসে চা খাবার বেলা গড়িয়ে যাচ্ছে, কিন্তু আপ্রাণ শত চেষ্টাতেও সে কিছুতেই উঠে বসতে পারছিল না। শেষটায় রাঁধুনী এসে দরজায় টোকা দিল।

প্রচণ্ড পরিশ্রম করে সে পাশ ফিরল, তার পর একটা হুলো বেড়ালকে আদর করতে লাগল। কারণ ইতোমধ্যে একটা খাসা সুন্দর, পুরোবাড়ন্ত, …র মতো মোটাসোটা, খাজনা উশুলের পেয়াদার মতো বিরাট একজোড়া গোঁফওলা বাদামি রঙের বেড়াল এসে তার আর সেরগেইয়ের মাঝখানে গা ঘষতে আরম্ভ করেছে। কাতেরিনা তার ঘন লোমের ভিতর আঙুল চালিয়ে তাকে আদর করতে লাগল আর বেড়ালটাও তার ভোতা মুখ আর বোঁচা নাক দিয়ে কাতেরিনার কঠোর-কোমল বুকে চাপ দিচ্ছিল এবং সঙ্গে সঙ্গে সোহাগের ঘর ঘরর শব্দ ছেড়ে যেন গান গাইছিল– কাতেরিনার প্রেম নিয়ে, অতি কোমল মোলায়েম সুরে।

কাতেরিনা অবাক হয়ে ভাবছিল, এই হোল্কা মোটকা বেড়ালটা ঘরে ঢুকলই-বা কী করে আর এলই-বা কেন? কাতেরিনা আবার আশ্চর্য হয়ে ভাবতে লাগল, আমি খানিকটে সর জানালার চৌকাঠের উপর রেখেছিলুম; এই পাজি হুলোটাকে যদি তাড়া লাগিয়ে খেদিয়ে না দিই তবে সে বেবাক সর চেটে মেরে দেবে। বেড়ালটাকে পাকড়ে ধরে বাইরে ফেলে দেবার সে যতই চেষ্টা করতে লাগল ততই সে যেন ঠিক কুয়াশার মতো তার আঙুলের ভিতর দিয়ে বার বার গলে যেতে লাগল। বোবায় ধরা দুঃস্বপ্নের ভিতরও কাতেরিনা মনে মনে তর্ক করতে লাগল, তা সে যাকগে, কিন্তু এই হুলো বেড়ালটা এখানে আদৌ এল কোত্থেকে? আমাদের শোবার ঘরে তো কস্মিনকালেও কোনও হুলো বেড়াল ছিল না; তবু, দেখ, কীরকম একটা ইয়া লাশ এখানে ঢুকে পড়েছে! আবার কাতেরিনা তাকে পাকড়াবার চেষ্টা করল, আবার বেড়ালটা হাওয়া হয়ে গেল। মনে তার ধোঁকা লাগল, বা রে! এটা তবে কী? দেখি ব্যাপারটা ভালো করে বুঝে- এটা কি আদপেই হুলো বেড়াল নাকি? হঠাৎ এক দারুণ ভয়ের বিভীষিকা যেন তার সর্বাঙ্গ চেপে ধরে কুলে নিদ্রা আর ন্দ্রিালু ভাব খেদিয়ে দিল। কাতেরিনা ঘরের চতুর্দিকে তাকিয়ে দেখে বেড়ালটার নামগন্ধও নেই। শুধু তার সুদর্শন সেরগেই পাশে শুয়ে তার বুকের মাঝখানে আপন গরম মুখটি খুঁজে দিয়েছে।

কাতেরিনা বিছানায় উঠে বসল; চুম্বনে চুম্বনে সে সেরগেইকে আচ্ছন্ন করে দিল। তার আদর সোহাগ যেন শেষ হতেই চায় না। তার পর হাঁসের বুকের নরম পালকের আলুথালু বিছানাটাকে ছিমছাম করে দিয়ে বাগানে চা খেতে চলে গেল। সূর্য তখন অস্তাচলে সম্পূর্ণ লুপ্ত হয়ে গিয়েছে আর উষ্ণগর্ভা পৃথিবীর উপরে নেমে আসছে অপূর্বসুন্দর, সম্মোহনী সন্ধ্যা।

ফুলে ফুলে ঢাকা আপেলগাছের তলায় রাগ-এর উপর বসল কাতেরিনা চা খেতে। আকসিনিয়াকে বলল, বড্ড বেশি ঘুমোতে ঘুমোতে অবেলা হয়ে গেল। তার পর বাসন পোছার কাপড় দিয়ে একটা পিরিচ পুঁছতে পুঁছতে রাঁধুনীকে শুধালো, আচ্ছা, বল তো, এসবের অর্থ কী আকসিনিয়া, সোনা?

কী? কিসের কী অর্থ, মা?

 ওটা কিন্তু নিছক স্বপ্ন ছিল না। কোথাকার কোন এক হুলো বেড়াল বার বার শুধু আমার গা বেয়ে উঠছিল। আর-পাঁচটা বেড়ালের মতো হুবহু জলজ্যান্ত বেড়াল। এর অর্থ কী?

এসব আপনি কী বলছেন?

সত্যি বলছি, একটা বেড়াল আমার গা বেয়ে উঠছিল।

কীভাবে বেড়ালটা তার গা বেয়ে উঠছিল সেসব কথা তখন কাতেরিনা তাকে বলল।

আপনি আবার ওটাকে আদর করতে গেলেন কেন?

তা, বাপু, আমাকে জিগ্যেস করছ কেন? আমি নিজেই জানিনে, ওটাকে আদর করলুম কেন।

সত্যি সত্যি, বড়ড়ই তাজ্জব ব্যাপার এটা!

আমার নিজেরই বিস্ময়ের সীমা নেই। এটাতে নিশ্চয়ই বোঝাচ্ছে কেউ না কেউ আপনার শত্রুতা না করে ছাড়বে না। কিংবা ওই ধরনেরই কিছু একটা হবে।

হ্যা। কিন্তু ঠিক কী?

 ঠিক ঠিক হুবহু কী হবে সেটা কেউই আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারবে না, –ঠিক ঠিক, হুবহু কেউই পারবে না, সোনা মা, শুধু এইটুকু বলা যেতে পারে, একটা না একটা কিছু ঘটবেই ঘটবে।

কাতেরিনা বলল, আমি ঘুমে বার বার শুক্লপক্ষের ফালি চাঁদ দেখছিলুম, আর সেই বেড়ালটা।

ফালি চাঁদ?– তার অর্থ বাচ্চা হবে।

 কাতেরিনার মুখ লাল হয়ে উঠল।

সেরগেইকে কি তোমার কাছে এখানে নিচে পাঠিয়ে দেব, মা-মণি?– কলে-কৌশলে ইঙ্গিত দিলে আকসিনিয়া। আসলে কাতেরিনার বিশ্বাসের পাত্রী হওয়ার জন্যে তার প্রাণ যেন বেরিয়ে আসছিল।

হ্যা, সে-ও তো বেশ কথা! ওকে গিয়ে পাঠিয়ে দাও। আমি তাকে চা দেবখন।

আমিও তাই বলি– এখানে পাঠিয়ে দিই। আকসিনিয়াই প্রস্তাবটার নিষ্পত্তি করে দিল। তার পর পাতিহাঁসের মতো হেলেদুলে বাগানের গেটের দিকে চলল।

কাতেরিনা সেরগেইকেও বেড়ালটার কথা বলল।

সেরগেই বলল, কিছু না, স্রেফ দিবাস্বপ্ন।

 কিন্তু সেরেজা, আমি এর আগে এরকম দিবাস্বপ্ন কখনও দেখিনি কেন, সেইটে বুঝিয়ে বল।

আগে কখনও হয়নি, এই প্রথম হল, এরকম জিনিস তো নিত্যি নিত্যি হচ্ছে। এমন দিনও ছিল যখন আমি শুধু তোমাকে আড়চোখে একটুখানি দেখে নেবার সাহস করতে পারতুম না, আর তোমার জন্য আপন দুঃখে গুমরে মরতুম। আর এখন দেখ, সবকিছু বদলে গিয়েছে। এই যে তোমার শ্বেতশুভ্র দেহ– এর সমস্তটি এখন আমার।

সেরগেই কাতেরিনাকে বুকে ধরে আলিঙ্গন করল, তার পর শূন্যে তুলে ঘুরিয়ে নিয়ে কৌতুকভরে তাকে নরম কম্বলের উপর ফেলে দিল।

কাতেরিনা বলল, ওগো, আমার মাথা ঘুরছে। সেরেজা, এই দিকে এসো। আমার পাশে এসে বস।– সেরগেইকে ডাক দিয়ে কাতেরিনার অলস রভসার মৌন ইঙ্গিত দিয়ে শুয়ে পড়ল।

শুভ্র কুসুমদামে আচ্ছাদিত আপেলগাছের তলায় বেপরোয়া রসের নাগর হামা দিয়ে এসে কাতেরিনার পায়ের কাছে বসল।

আমাকে পাবার জন্য তুমি কাতর হয়েছিলে, না? সেরেজা?

 তুমি যদি শুধু জানতে কতখানি কাতর হয়েছিলুম!

সেটা কীরকম ছিল, আমাকে বুঝিয়ে বল।

সে আমি কী করে বুঝিয়ে বলব? অপূর্ণ আকাক্ষার মর্মবেদনায় তিলে তিলে দগ্ধ হওয়া কি কেউ কখনও বোঝাতে পারে? আমার ছিল সেই।

তা হলে, সেজো, তুমি যে নিজেকে তিলে তিলে মেরে ফেলছিলে সেটা আমি অনুভব করলুম না কেন? লোকে তো বলে সেটা নাকি অনুভব করা যায়।

সেরগেই নীরব থেকে এ প্রশ্নটা এড়িয়ে গেল।

তা হলে তুমি হরদম গান গাইছিলে কী করে, যদি আমার জন্য এতখানি তিলে তিলে দগ্ধ হয়ে মরছিলে? কিছু ভয় নেই। আমি সব জানি। তুমি যে উঁচু বারান্দায় গান গাইতে সে তো আমি শুনতে পেতুম।–কাতেরিনা সেরগেইকে আদর করতে করতে প্রশ্নের পর প্রশ্ন শুধিয়ে যেতে লাগল।

গান গেয়েছিলুম তো কী হয়েছিল? একটা মশা জীবনভর গান গায়– সেটা কি ফুর্তির তোড়ে?– বিরস কণ্ঠে সেরগেই উত্তর দিল।

খানিকক্ষণের জন্য দুজনাই চুপচাপ। সেরগেইয়ের পূর্বরাগকীর্তন শুনে কাতেরিনার হৃদয় পরিপূর্ণ ভাবাবেশে বিহ্বল হয়ে গিয়েছে। কাতেরিনার বাসনা আরও কথা বলে কিন্তু সেরগেই ভুরু কুঁচকে কেমন যেন মৌত অবলম্বন করেছে।

ফুলে ফুলে ভরা আপেলগাছের শাখা-প্রশাখার পর্দার ভিতর দিয়ে স্বচ্ছ নীলাকাশ আর শান্ত প্রশান্ত পূর্ণচন্দ্রের দিকে তাকিয়ে কাতেরিনা আবেশভরা কণ্ঠে বলে উঠল, দেখ দেখ, সেরেজা– এ যে স্বর্গপুরী, স্বর্গপুরীতে যেন মেলা বসেছে।

কাতেরিনা শুয়ে ছিল চিৎ হয়ে চাঁদের আলো আপেলগাছের ফুল আর পাতার ভিতর দিয়ে এসে কাতেরিনার মুখ আর দেহের উপর বিচিত্র শুভ্র আলপনার কম্প্রমান শিহরণ জাগাচ্ছিল; বাতাস স্তব্ধ, শুধু সামান্যতম ক্ষীণ মলয় অর্ধসুপ্ত পত্রাবলিতে ঈষৎ কম্পন জাগিয়ে পূর্ণকুসুমিত তরু আর নব উদাত তুণের মৃদু সৌরভ দূর-দূরান্তে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। বাতাস যেন অলসাবেশে পরিপূর্ণ যেন সে বাতাস এনে দেয় সর্ব কর্মে অরুচি, আত্মার অসংযম, আর মনের ভিতর দুর্বোধ যত কামনারাজি।

কাতেরিনা কোনও সাড়া না পেয়ে আবার চুপ করে গেল, আর তাকিয়ে রইল ফিকে গোলাপি আপেলফুলগুচ্ছের ভিতর দিয়ে আকাশের দিকে। সেরগেইও কথা বলছিল না কিন্তু তার চিত্তকে আকাশ বিমোহিত করেনি। আপন হাঁটু দুটো দু হাত দিয়ে জড়িয়ে ধরে সে তন্ময় হয়ে তাকিয়ে রইল আপন বুট-জোড়ার দিকে।

আহা, যেন স্বর্ণজ্যোতি দিয়ে তৈরি রাত্রিটি। শান্ত, লঘু, সৌরভভরা আর প্রাণদায়িনী ঈষৎ উষ্ণতা! দূরে বহুদূরে, উপত্যকার পিছনে, বাগানের বহুদূরে কে যেন ধরেছে সুরেলা গীত; ঘন চেরি-তরু-ভরা বাগানের বেড়ার কাছে গেয়ে উঠল একটি পাপিয়া শিহরিত উচ্চকণ্ঠে; উঁচু খুঁটিতে ঝোলানো কুয়েইল পাখিটি উত্তেজিত কণ্ঠে গেয়ে চলেছে সুরের প্রলাপ; ওদিকে আস্তাবলের দেয়ালের পিছনে বিরাট একটা অশ্ব তালু হ্রেষারব তুলল, আর বাগানের বাইরে গোচারণ মাঠের উপর দিয়ে একপাল কুকুর দ্রুতবেগে ছুটে চলে গিয়ে অর্ধভগ্ন প্রাচীন নুনের ভাণ্ডারের কালো আবছায়ায় বিলীন হয়ে গেল।

কনুইয়ের উপর ভর করে কাতেরিনা একটুখানি উঠে বাগানের লম্বা লম্বা ঘাসের দিকে তাকাল– উজ্জ্বল চন্দ্রালোক ঘাসের উপর পড়ে ঝিলিমিলি লাগিয়েছে, তারই আভা গাছগুলোর ফুলে পাতায় নেচে নেচে বিচ্ছুরিত হচ্ছে। যেন কল্পলোকের অবর্ণনীয়, অত্যুজ্জ্বল লক্ষ লক্ষ চন্দ্রচূর্ণ দীর্ঘ তৃণরাজিকে স্বর্ণমণ্ডিত করে দিয়েছে; এমনই তাদের নিরবচ্ছিন্ন কম্পন, এমনই তাদের নিরবচ্ছিন্ন স্পন্দন যে মনে হয় এরা বহ্নিশিখার প্রজাপতি কিংবা যেন বৃক্ষ নিম্নের তুণরাজি চন্দ্ররশ্মির জাল-আবরণে বন্দি হয়ে এদিকে-ওদিকে ছুটে বেড়াচ্ছে মুক্তির আকাঙ্ক্ষায়।

কাতেরিনা তাকিয়ে তাকিয়ে মুগ্ধ হয়ে বলল, আহা, সেরেজা, কী মধুর, কী সুন্দর সব সব!

সেরগেই চতুর্দিকের দৃশ্যের দিকে তাচ্ছিল্য নয়নে একবার শুধু তাকাল।

তুমি অমন মনমরা হয়ে আছ কেন, সেরেজা? না, আমার ভালোবাসার প্রতিও তোমার অবসাদ এসে গেছে?

কী আবোল-তাবোল বকছ?– সেরগেই নীরস কণ্ঠে উত্তর দিল; তার পর নিচু হয়ে কাতেরিনাকে অলসভাবে চুমো দিল।

কাতেরিনার হৃদয়ে হিংসা এসেছে; বলল, তুমি প্রতারণা করছ সেরেজা; তোমার প্রেমে স্থিরতা নেই।

সেরগেই শান্তকণ্ঠে উত্তর দিল, তোমার কথাগুলো আমার উদ্দেশে বলেছ একথাই আমি স্বীকার করব না।

তা হলে তুমি আমাকে এভাবে চুমো খেলে কেন?

সেরগেই তাচ্ছিল্যভরে এর কোনও উত্তরই দিল না।

সেরগেইয়ের কোঁকড়া চুল নিয়ে খেলা করতে করতে কাতেরিনা বলে যেতে লাগল, স্বামী-স্ত্রীই তো শুধু একে অন্যকে এরকম চুমো খায়– যেন একে অন্যের ঠোঁট থেকে ঠোনা মেরে ময়লা মুছে দেয়। তুমি আমাকে এমন চুমো খাও, যেন আপেলগাছ উপর থেকে আমাদের উপর সবে-ফোঁটা ফুলের বর্ষণ লাগিয়ে দেয়।

হ্যাঁ, হ্যাঁ, ঠিক এইরকম ঠিক এইরকম, ঠিক এইরকম! চুপি চুপি কানে কানে গুঞ্জন করল কাতেরিনা।- দয়িতকে ঘনতর আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরে সে তখন হৃদয়াবেগে নিজেকে সম্পূর্ণ জলাঞ্জলি দিয়েছে।

কিছুক্ষণ পরে কাতেরিনা বলল, সেরেজা, এবারে যা বলছি, তুমি মন দিয়ে শোন। আচ্ছা বল তো, সবাই কেন একবাক্যে বলে, তোমার প্রেমে স্থিরতা নেই।

আমার সম্বন্ধে কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করে এসব মিথ্যে কথা বলে কে?

সবাই তো এই কথা বলে।

হয়তো যেসব হাড়ে হাড়ে অপদার্থগুলোকে আমি ত্যাগ করেছি, তারাই।

ওরে হাবা, ওসব অপদার্থগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে পড়ার তোমার কী দরকার ছিল? যে মেয়ে সত্যি অপদার্থ তার সঙ্গে তুমি আদপেই প্রেম করতে যাবে কেন?

বল, বলে যাও, বলা বড় সোজা। মানুষ কি সূক্ষ্ম বিচার-বিবেচনা করে প্রেমে পড়ে? এর পিছনে কাজ করে একমাত্র প্রলোভন। ওদের কোনও একটার সঙ্গে বিধিভঙ্গ করলে অতি সোজা, কোনও মতলব না, কিছু না, ব্যস্ হয়ে গেল। তার পর মেয়েটা রইল তোমার গলায় ঝুলে! গুলে খাওগে তার পর সেই প্রেম।

তা হলে, শোন, সেরেজা! আমার পূর্বে কারা সব এসেছিল তাদের সম্বন্ধে আমি কিছুই জানিনে, আর আমি ওদের সম্বন্ধে কোনও কিছু জানতেও চাইনে। শুধু এইটুকু বলার আছে : তুমি নিজে আমাদের এই প্রেমের পথে আমাকে প্রলোভিত করে টেনে এনেছ, এবং তুমি নিজে খুব ভালো করেই জানো, আমি যে এতে পা দিয়েছি তার জন্য তোমার ছলা-কৌশল যতখানি দায়ী আমার নিজের কামনাও ততখানি– আমি তোমায় কথা দিচ্ছি, সেরেজা, তুমি যদি কোনওদিন বেইমানি কর, তুমি যদি অন্য কারওর জন্য তা সে যে-ই হোক না কেন, আমাকে বর্জন কর, আমি তা হলে কস্মিনকালেও– মাফ কর, আমার হৃদয়ের বন্ধু এ-দেহে প্রাণ থাকতে কস্মিনকালেও তোমাকে কিছুতেই ছেড়ে যাব না।

সেরগেই চমকে উঠল।

 এসব কী বলছ, কাতেরিনা লুভরা, আমার চোখের মণি। আমাদের অবস্থাটার দিকে একবার ভালো করে চেয়ে দেখ। তুমি এখুনি লক্ষ করেছ, আমি কীরকম আনমনা হয়ে বসে ছিলুম কিন্তু তুমি একবারও শান্ত হয়ে ভাবো না, এই আনমনা হওয়াটা আমি ঠেকাতে পারি কি না। তুমি তো জানোই না, আমার বুকের ভিতর কীরকম শক্ত শক্ত রক্তের টুকরো জমা হয়ে আছে।

তোমার কী বেদনা, সেরেজা, তোমার বেদনা আমায় বল!

এর আবার বলার কী থাকতে পারে? প্রথম দেখ অল্পদিনের মধ্যেই, ঈশ্বরের আশীর্বাদে তোমার স্বামী এসে উদয় হবেন, আর তুমি বলবে– সেরগেই ফিলেপিচ, দূর দূর বেরো এখান থেকে আর যা তুই ওই পেছনের আঙিনায়, ছোকরারা যেখানে গান-টান গাইছে। আর সেখান থেকে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখ, কাতেরিনা ভার শোবার ঘরে ছোট্ট পিদিমটি জ্বলছে, আর তিনি কীরকম পালকের তুলতুলে বিছানাটি দু-হাত দিয়ে ফুলিয়ে-ফাঁপিয়ে জুৎসই করে তার সাতপাকের সোয়ামীর সঙ্গে শুয়ে আরাম করতে যাচ্ছেন।

অসম্ভব! ওরকমধারা কখনোই হবে না- সোল্লাসে টানা টানা সুরে কাতেরিনা কথাগুলো বলল, আর সঙ্গে সঙ্গে কচি একখানি হাত নাড়িয়ে সেরগেইয়ের কথাগুলো যেন সামনের থেকে সরিয়ে দিল।

কেন হবে না? আমি যতদূর দেখতে পাচ্ছি, এ পরিস্থিতি থেকে বেরোবার জন্যে তোমার তো কোনও পথই নেই। তা সত্ত্বেও, বুঝলে কাতেরিনা ভনা, আমারও একটা আপন হৃদয় আছে, আর নিদারুণ যন্ত্রণাটি আমি অনুভব করতে পারি।

ব্যস্ ব্যস, হয়েছে। তোমার যথেষ্ট বলা হয়ে গিয়েছে।

সেরগেইয়ের এই হিংসের অনুভূতিটা কাতেরিনাকে বড়ই আনন্দ দিল। জোরে হেসে উঠে সে ফের সেরগেইকে চুমোর পর চুমো খেতে লাগল।

অতি সাবধানে কাতেরিনার সম্পূর্ণ অনাচ্ছাদিত বাহুপাশ থেকে নিজের মস্তকটি মুক্ত করতে করতে সেরগেই কথার খেই ধরে বলে যেতে লাগল, দ্বিতীয়ত, সমাজে আমার যে হীনতম অবস্থা সেটাই আমাকে বহুবার বাধ্য করেছে ব্যাপারটা সবদিক দিয়ে বিবেচনা করতে। এই মনে কর, আমি যদি সমাজে, তোমার ধাপের মানুষ হতুম, আমি যদি ভদ্রলোক বা ব্যবসায়ী হতুম, তা হলে এ দেহে যতক্ষণ প্রাণ আছে তোমাকে কিছুতেই ছেড়ে দিতে রাজি হতুম না– কাতেরিনা ভনা। কিন্তু এখন যা পরিস্থিতিটা–তুমি নিজেই বিবেচনা করে দেখ তোমার কাছে দাঁড়ালে আমি কে? অল্প দিনের ভিতরই তোমার স্বামী যখন তোমার কচি সাদা হাতটি ধরে তোমাদের শোবার ঘরে তোমাকে নিয়ে যাবে, আমাকে তখন সেটা নীরব হৃদয়ে সয়ে নিতে হবে, এবং হয়তো সেই কারণেই আমি নিজেকে বাকি জীবন ধরে ঘেন্না করব। কাতেরিনা ভা! বুঝলে আমি তো সে দলের নই যারা যে কোনও একটা রমণীর সঙ্গে ফুর্তি করতে পারলেই অন্য কোনও কিছুর পরোয়া করে না। প্রেম সত্য সত্য কী, সে অনুভূতি আমার আছে, আর সেটা যেন কালনাগিনীর মতো আমার বুকের রক্ত শুষে শুষে খাচ্ছে।

কাতেরিনা বাধা দিয়ে বলল, কিন্তু এসব কথা তুমি আমাকে বার বার বুঝিয়ে বলছ কেন?

কাতেরিনা লভভনা! না বলে করি কী, বল। কী করি বল। হয়তো-বা এতদিনে সবকিছু তোমার স্বামীকে কাগজে-কলমে ভালো করে বুঝিয়ে রিপোর্ট করা হয়ে গিয়েছে, খুব বেশি দূরের কথা নয়, হয়তো-বা আসছে কাল থেকেই এখানে আর সেগেইকে দেখতে পাওয়া যাবে না, তার কণ্ঠস্বর শুনতে পাবে না।

না, না, ও নিয়ে তুমি একটি মাত্র কথা বল না, সেরেজা! এটা কস্মিনকালেও হতে পারে। যা হোক তা হোক, তোমাকে ছেড়ে আমি কিছুতেই থাকতে পারব না। চুম্বনে-আলিঙ্গনে সোহাগ করে কাতেরিনা সেরগেইকে প্রবোধ দিতে লাগল। চূড়ান্ত নিষ্পত্তি যদি একদিন করবার সময়ই আসে, তবে… হয় নিয়তি তাকে ওপারে নিয়ে যাবেন, নয় আমাকে, কিন্তু তুমি আমার সঙ্গে থাকবেই।

সেটা তো সম্ভব নয়, কাতেরিনা ভা!- বিষণ্ণ কণ্ঠে সেরগেই উত্তর দিল। তার পর মাথায় যেন দুঃখের ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, আমি যে এই প্রেম নিয়ে বেঁচে আছি তার জন্যে আমার নিজেরই দুঃখ হয়। সমাজে আমি যে ধাপে আছি সেই ধাপের কাউকে ভালোবাসলে হয়তো আমি সন্তুষ্টই হতুম। এ-ও কি কখনও সম্ভব যে, তুমি চিরকাল আমার সত্য প্রেম হয়ে থাকবে? আর এখন আমার প্রণয়িনী হয়ে থাকাও কি তোমার পক্ষে গৌরবের বিষয়? আমি তো চাই পূত চিরন্তন দেউলের সামনে তোমার স্বামী হতে; তার পর তোমার তুলনায় তখন আমি নিজেকে হীন মনে করলেও আমি সমাজের সামনে বুক চেতিয়ে দেখাতে পারব, আমার স্ত্রী আমাকে কতখানি সম্মানের চোখে দেখেন– কারণ আমি তাকে সম্মান করি

সেরগেইয়ের কথাগুলো কাতেরিনার মাথা ঘুলিয়ে দিয়েছে। তার ঈর্ষা, কাতেরিনাকে বিয়ে করার তার কামনা– এ কামনা মেয়েছেলে মাত্রেরই বড় প্রিয়, তা সে হোক না, বিয়ের পূর্বে তাদের অল্পদিনেরই পরিচয়। কাতেরিনা এখন সেরগেইয়ের জন্যে আগুনের ভিতর দিয়ে যেতে প্রস্তুত, অতলে তলাতে তৈরি, কিংবা ভয়ঙ্কর কারাগারে অথবা ক্রুশবিদ্ধ হয়ে মরতে। সেরগেই তখন কাতেরিনাকে তার প্রেমে এমনই মজিয়েছে যে, সে তার অন্তহীন আত্মসমর্পণ সেগেইয়ের পদপ্রান্তে করে ফেলেছে। আনন্দে সে তখন আত্মহারা, তার রক্তে রিনিঝিনি বাজছে– আর কোনও কথা শোনবার সব শক্তি তার তখন নেই। তাড়াতাড়ি হাতের তেলো দিয়ে সে সেরগেইয়ের মুখ বন্ধ করে দিয়ে তার মাথা আপন বুকে চেপে ধরে বলল, শোন, এখন আমার জানা হয়ে গিয়েছে, তোমাকেও কী করে ব্যবসায়ী করে তোলা যায়, আর তোমার সঙ্গে কীভাবে যথারীতি সসম্মানে বাস করা যায়। যতদিন না আমাদের অবস্থার চরম বোঝাঁপড়ার সময় এসেছে—- ততদিন কোনওকিছু নিয়ে আমাকে আর বেদনা দিও না।

আবার আরম্ভ হল চুম্বন আর আদর-সোহাগ।

নিঃশব্দ নিশীথে, গভীর নিদ্ৰায় মগ্ন থাকা সত্ত্বেও গুদামঘরের চালার ভিতর বুড়ো কেরানি শুনতে পাচ্ছিল ক্ষণে মৃদু আলাপের গুঞ্জন, ক্ষণে চাপা হাসির ইঙ্গিত– যেন কতকগুলি দুবৃত্ত বালক কোনও নির্বীর্য বৃদ্ধকে নিয়ে নিদারুণতম ঘৃণ্য ব্যঙ্গ করার জন্যে ষড়যন্ত্র করছে ক্ষণে আনন্দের উচ্চহাস্য কলরোল– যেমন সরোবরের পরীরা কাউকে নির্মমভাবে সুড়সুড়ি দিচ্ছে। এ-সবের উৎস কাতেরিনা। চাঁদের আলোতে সে যেন সাঁতার কাটছে, নরম কম্বলের উপর গড়াগড়ি দিচ্ছে আর রসকেলি করছে তার স্বামীর ছোকরা কেরানির সঙ্গে। কুসুমাচ্ছাদিত আপেলবৃক্ষের কোমল ফুলদল তাদের উপর ক্ষণে ক্ষণে বর্ষিত হচ্ছিল– অবশেষে সে বর্ষণও ক্ষান্ত হল। ইতোমধ্যে নাতিদীর্ঘ নিদাঘ রজনী প্রবহমান চন্দ্রমা উচ্চ ভাণ্ডারগৃহের চূড়ান্তরালে লুক্কায়িত থেকে পাণ্ড হতে পারতর নয়নে ধরণীর দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করছিল। হঠাৎ রান্নাঘরের ছাতের উপর দুটো বেড়ালের কানফাটানো দ্বৈতকণ্ঠ শোনা গেল। তার পর আরম্ভ হল খামচাখামচি, দাঁত মুখ খিঁচিয়ে তীক্ষ্ণ গোঙরানোর শব্দ এবং সর্বশেষে পা হড়কে মাটিতে গড়িয়ে পড়ল ছাদের সঙ্গে ঠেকনা দেওয়া তক্তার ডাই পিছলে গোটা দু-ত্তিন বেড়াল।

চল শুতে যাই–অতিশয় ক্লান্তির আবেশে রাগ ছেড়ে উঠতে উঠতে বলল কাতেরিনা। শায়িত অবস্থায় সেই সামান্য শেমিজ আর সাদা সায়া তার পরনে ছিল, সেই বেশেই গণ্যমান্য সদাগর-বাড়ির আঙিনার উপর দিয়ে সে চলল। সেখানে তখন মরা-বাড়ির নিশ্চলতা আর নৈস্তব্ধ। সেরগেই রাগ, আর কাতেরিনার খেলা-ভরে ছুঁড়ে-ফেলে-দেওয়া ব্লাউজ নিয়ে পিছনে পিছনে চলল।

.

০৭.

কাপড়-জামার শেষ রত্তিটুকু ছেড়ে ফেলে, মোমবাতি নিভিয়ে দিয়ে পালকের তুলতুলে বিছানাতে শুতে না শুতে কাতেরিনা সুষুপ্তি-গহ্বরে সম্পূর্ণ বিলীন হয়ে গেল। দিনভর ক্রীড়াকৌতুক আর উল্লাসরস এতই আকণ্ঠ পান করেছিল যে, সে এখন এমনই গভীর নিদ্রায় নিমগ্ন হল যে তার পা যেন ঘুমিয়ে পড়ল, হাতও যেন ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু ঘুমের ভিতর দিয়েও সে পরিষ্কার দরজা খোলার শব্দ শুনতে পেল এবং সেই আগের দিনের চেনা বেড়ালটা দুম্ করে তার বিছানায় পড়ল।

বেড়ালটার এখানে আগমনের ব্যাপারটা আসলে তবে কী?– ক্লান্ত কাতেরিনা আপন মনে যুক্তিতর্ক করতে লাগল। আমি দোরের চাবি নিজেই লাগিয়েছি– বেশ ভেবে-চিন্তে বিবেচনা করেই আর জানালাটাও বন্ধ। তবু দেখি সেটা আবার এসে জুটেছে। দাঁড়াও, আমি ওটাকে এই মুহূর্তেই বাইরে ছুঁড়ে ফেলে দেব। কাতেরিনা উঠতে যাচ্ছিল কিন্তু তার হাত-পা যেন তার বশে নেই; ইতোমধ্যে বেড়ালটা তার শরীরের উপর দিয়ে সর্বত্র হাঁটাহাঁটি লাগিয়ে দিয়েছে। এবং তার গলার গরুর গরু, এমনই আশ্চর্য রকমের যে, সে যেন মানুষের গলায় কথা কইছিল। কাতেরিনার মনে হচ্ছিল যেন একপাল ক্ষুদে ক্ষুদে পিঁপড়ে তার সর্বশরীরের উপর দিয়ে ছুটোছুটি লাগিয়েছে।

কাতেরিনা মনস্থির করে বলল, নাহ, কালই আমাকে বিছানার উপর মঙ্গলজল ছিটোতে হবে– এছাড়া আর কোনও গতি নেই যেভাবে বেড়ালটা ভূতের মতো আমার পিছনে লেগেছে তার থেকে স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে এটা তাজ্জব ধরনের বেড়াল।

ওদিকে বেড়ালটার সোহাগের গরুর গরুর একদম তার কান পর্যন্ত পৌঁছে গিয়েছে। বোচা নাকটা তার শরীরের উপর চেপে দিয়ে বেড়ালটা বলে উঠল, আচ্ছা, আমি কোন ধরনের বেড়াল সেই কথাটা ভাবছ না? কিন্তু এ সন্দেহে তুমি এলে কিসের থেকে? সত্যি, তুমি কী অসম্ভব চালাক মেয়ে, কাতেরিনা ভ; ঠিক ঠিক ধরে ফেলেছ আমি আদপেই বেড়াল নই, কারণ আমি আসলে আর কেউ না, আমি হচ্ছি সেই বিখ্যাত সম্মানিত সদাগর বরিস। তিমোতেই। অবশ্য এটা হক কথা যে, ঠিক এই মুহূর্তেই আমি খুব বহাল তবিয়তে নেই– কারণ আমার ছেলের বউ আমাকে যেসব খাসা খানা খাইয়ে আমার সেবা করেছে তারই চোটে আমার নাড়িভুড়ি ফেটে টুকরো টুকরো হয়ে গিয়েছে। তাই হয়েছে কী–বেড়ালটা সোহাগের গরুর গরুর করে যেতে লাগল– আমি বড় কুঁকড়ে-সুকড়ে গিয়ে এখন শুধু হুলো বেড়াল হয়ে, যারা আমাকে সত্যি সত্যি জানে আমি কে, তাদের সামনেই আত্মপ্রকাশ করতে পারি। তা যেন হল; আচ্ছা, আপনি এখন আপন বাড়িতে কীরকম আছেন, কী করছেন, কাতেরিনা লভভূনা? আপ্তবাক্যের সবকটি বিধি*[* অন্যতম বিধি ব্যভিচার করবে না।] আপনি কি ভক্তিভরে পালন করে যাচ্ছেন? আমি সুচিন্তিত উদ্দেশ্য নিয়েই গোরস্তান থেকে এখানে এসেছি সুদ্ধমাত্র দেখতে আপনি আর সেরগেই ফিলিপি আপনার স্বামীর বিছানাটাতে কীরকম ওঁম লাগাচ্ছেন। কিন্তু এখন তো আমি আর কিছু দেখতে পারিনে। আপনি খামোখা অত ভরাচ্ছেন কেন; ব্যাপারটা হয়েছে কী, আপনি যে আমায় ফিস্টিটা খাইয়ে জান্তর করে দিয়েছিলেন তারই ঠেলায় আমার আদরের পুতুল চোখ দুটি কোটর থেকে হামাগুড়ি দিয়ে বেরিয়ে গেছে। আমার চোখদুটোর দিকে সোজাসুজি তাকাও, পরান আমার ভয় পেও না, মাইরি!

কাতেরিনা সত্য সত্যই তাকিয়েছিল– আর সঙ্গে সঙ্গে তারস্বরে চিৎকার করে উঠল। হুলো বেড়ালটা ফের তার আর সেরগেইয়ের মাঝখানে শুয়ে পড়েছে, আর তার মাথাটার জায়গায় বরিস তিমোতেইচের মাথা। ঠিক তারই মাথার মতো বিরাট আকারের মাথা। আর দুটি কোটরে চোখের বদলে আগুনের দুটো চাকা ঘুরছে আর পাক খাচ্ছে, পাক খাচ্ছে আর ঘুরছে– যেদিকে যেমন খুশি!

সেরগেই জেগে উঠল, কাতেরিনাকে শান্ত করে আবার ঘুমিয়ে পড়ল, কিন্তু নিদ্রাদেবী কাতেরিনাকে ত্যাগ করে চলে গেছেন– ভাললাই, এক হিসেবে ভালোই।

বিস্ফারিত নয়নে কাতেরিনা শুয়ে আছে, হঠাৎ তার কানে এল কে যেন গেট বেয়ে উঠে বাড়ির ভিতরের আঙিনার সামনে পৌঁছে গেছে। সে তোক যেই হোক, কুকুরগুলো তার দিকে ধাওয়া করেছে, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গেই তারা শান্ত হয়ে গেল হয়তো-বা তারা নবাগতের পা চাটতে আরম্ভ করেছে। তার পর আরও এক মিনিট গেল। ক্লিক করে নিচের লোহার খিল খুলে গেল এবং দরজা খোলার শব্দ শোনা গেল।

হয় আমি শব্দগুলো কল্পনায় শুনছি, অথবা আমার জিনোভিই বরিসি ফিরে এসেছেন– এবং দরজা খুলেছেন ফালতো চাবিটি দিয়ে–চট করে চিন্তাটা কাতেরিনার মাথায় খেলে গেল এবং সঙ্গে সঙ্গে সেরগেইকে কনুই দিয়ে গুতো দিল।

কান পেতে শোন, সেরেজা, বলে কাতেরিনা কনুইয়ের উপর ভর করে উঠে কানদুটো খাড়া করল।

সত্যই কে যেন ধীর পদক্ষেপে, সাবধানে শরীরের ওজন এক পা থেকে আরেক পায়ে সরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে উপরের চাবিরা শোবার ঘরের দিকে আসছে।

সুদ্ধমাত্র শেমিজ পরা অবস্থাতেই এক লাফ দিয়ে কাতেরিনা খাট ছেড়ে ব্যালকনির জানালা খুলে দিল। সঙ্গে সঙ্গে সেরগেইও খালি পায়ে লাফ দিয়ে ব্যালকনিতে এসে নামবার জন্য তারই খুঁটিতে পা দিয়ে জড়িয়ে ধরল– ওই খুঁটি বেয়েই সে একাধিকবার তার প্রভুপত্নীর শোবার ঘর থেকে নিচে নেমেছে।

কাতেরিনা তার কানে কানে ফিসফিস করে বলল, না, না; দরকার নেই, দরকার নেই। তুমি এইখানে শুয়ে থাকো… এখান থেকে নোড় না। তার পর সেরগেইয়ের জুতো, কোট-পাতলুন তার পিছনে ছুঁড়ে দিয়ে লাফ মেরে কম্বলের তলায় ঢুকে শুয়ে শুয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

সেরগেই কাতেরিনার আদেশ পালন করল; খুঁটি বেয়ে নিচে না নেমে ছোট্ট ব্যালকনিটির কাঠের ছাতার নিচে আরাম করে লুকিয়ে রইল।

ইতোমধ্যে কাতেরিনা শুনতে পেয়েছে, তার স্বামী কীভাবে দরজার কাছে এল, এবং দম বন্ধ করে দাঁড়িয়ে কান পেতে রইল। এমনকি সে তার হিংসাভরা বুকের দ্রুত স্পন্দন পর্যন্ত শুনতে পেল। কিন্তু কাতেরিনার হৃদয়ে করুণার উদয় হল না। বরঞ্চ তাকে যেন ছেয়ে ফেলল পিশাচের অট্টহাস্য।

মনে মনে সে তার স্বামীকে উদ্দেশ করে বলল, যাও, গতকাল খোঁজ গে– মৃদু হেসে সে যতদূর সম্ভব তালে তালে নিষ্পাপ শিশুটির মতো দম ফেলতে লাগল।

প্রায় দশ মিনিট ধরে এই লীলা চলল; অবশেষে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে স্ত্রীর ঘুমনোর শব্দ শোনার জন্য অপেক্ষা করাটা জিনোভিইয়ের কাছে ক্লান্তিজনক হয়ে দাঁড়াল। সে তখন দরজায় টোকা দিল।

কে? কাতেরিনা সাড়া দিল কিন্তু একদম সঙ্গে সঙ্গে না, এবং গলাটা যেন নিদ্রায় জড়ানো।

 জিনোভিই উত্তর দিল, তোমাদেরই একজন।

তুমি নাকি, জিনোভিই বরিসি?

 হ্যাঁ, আমি যেন আমার গলা শুনতে পারছ না।

কাতেরিনা সেই যে শুধু শেমিজ পরে শুয়েছিল সেইভাবেই লাফ দিয়ে উঠে দরজা খুলে দিল, তার পর ফের লাফ দিয়ে গরম বিছানায় ঢুকল।

কম্বল দিয়ে গা জড়াতে জড়াতে বলল, ঠিক ভোরের আগে কেমন যেন শীতটা জমে আসে।

জিনোভিই বরিসি ঘরে ঢুকে চতুর্দিকে তাকাল, তার পর ইকনের সামনে দাঁড়িয়ে প্রার্থনা করল, মোমবাতি জ্বালিয়ে আবার চতুর্দিকে তাকিয়ে দেখল। স্ত্রীকে শুধালো, কীরকম আছ– সব ঠিক চলছে?

কাতেরিনা উত্তর দিল, নালিশ করার মতো তেমন কিছু নয়। তার পর উঠে বসে একটা ঢিলে সুতির ব্লাউজ পরতে লাগল।

শুধল, তোমার জন্য একটা সামোভারে আঁচ দেব কি?

তোমার কিছু করতে হবে না; আকসিনিয়াকে ডাক– সে তৈরি করুক।

কাতেরিনা চটি পরে ছুটে বেরোল এবং ফিরল আধঘণ্টাটাক পরে। এরই ভিতরে সে ছোট্ট সামোভারটিতে কাঠ-কয়লার আগুন ধরিয়ে নিয়েছে এবং অতিশয় সন্তর্পণে বিদ্যুৎবেগে একবার ছুটে গেছে ছোট্ট ব্যালকনিটির নিচে সেরগেইয়ের কাছে।

এইখানে থাক–ফিসফিস করে কাতেরিনা সেরগেইকে বলল।

সেরগেইও ফিসফিস করে প্রশ্ন শুধাল, এখানে বসে থেকে কী লাভ হবে?

ওহ্! তোমার মাথায় কি রত্তিভর মগজ নেই! আমি যতক্ষণ না অন্য ব্যবস্থা করি, তুমি এইখানে থাক।

কাতেরিনা স্বয়ং তাকে আগের জায়গায় বসিয়ে দিয়ে চলে গেল।

সেরগেই বাইরের ছোট্ট ব্যালকনিতে বসে ভিতরে যা-কিছু হচ্ছিল সবই শুনতে পারছিল। কাতেরিনা যে দরজা বন্ধ করে স্বামীর কাছে ফিরে এল সেটাও শুনতে পেল। ঘরের ভিতরকার টু শব্দটিও পরিষ্কার তার কানে আসছিল।

জিনোভিই স্ত্রীকে জিগ্যেস করল, এতক্ষণ ধরে কোথায় আলসেমি করে সময় কাটালে?

শান্তকণ্ঠে উত্তর দিল, আমি সামোভার তৈরি করছিলুম।

কিছুক্ষণ ধরে আর কোনও কথাবার্তা হল না। বাইরের থেকে সেরগেই পরিষ্কার শুনতে পেল, জিনোভিই তার লম্বা কোটটা হ্যাঁঙ্গারে ঝুলিয়ে রাখল। তার পর সে চতুর্দিকে জল ছড়িয়ে-ছিটিয়ে, জোরসে নাক সাফ করে হাতমুখ ধুলো। এইবারে সে একখানা ভোয়ালে চাইল– সেটাও শোনা গেল। আবার কথাবার্তা শুরু হয়েছে।

স্বামী শুধাল, আচ্ছা, বল তো তোমরা ঠিক কীভাবে আমার বাপকে গোর দিলে?

ঠিক যেভাবে হয়ে থাকে–উত্তর দিল তার স্ত্রী। তিনি মারা গেলেন, সবাই মিলে তাকে গোর দিল।

কিন্তু সক্কলের কাছেই এটা অত্যন্ত অপ্রত্যাশিত ঠেকেছে!

ভগবান জানেন শুধু।- কাতেরিনা উত্তর দিয়ে ঠুং-ঠাং করে পেয়ালাগুলো নাড়াচাড়া করতে লাগল।

জিনোভিই বিষণ্ণ মুখে ঘরের ভিতর পাইচারি করতে লাগল।

 তার পর স্ত্রীকে আবার শুধাল, আর এখানে তুমি সময় কাটালে কী করে?

এখানে আমাদের আমোদ-আহ্লাদ কী, সে তো সবাই জানে আমি আর কী বলব; আমরা বল নাচে যাইনে, থিয়েটারও দেখিনে।

আমার তো মনে হল তোমার স্বামীকে দেখে তুমি বিশেষ কোনও আমোদ-আহ্লাদ অনুভব করনি– আমোদ-আহ্লাদ কথাটাই যদি উঠল। আড় নয়নে তাকিয়ে জিনোভিই বলল। এইবারে সে অবতরণিকায় পা দিয়েছে।

তোমাতে-আমাতে তো পরশুদিন বিয়ে হয়নি যে দেখা হওয়ামাত্রই প্রেমে পাগল হয়ে একে অন্যের দিকে ধাওয়া করব। বাড়ির কাজকর্মে ছুটোছুটি করতে করতে আমার পা দু খানি ক্ষয়ে গেল– আর সেসব তোমারই সুখের জন্য। কী করে যে আশা কর তোমাকে দেখামাত্র আমি আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাব?

কাতেরিনা সামোভার আনবার জন্য ছুটে বেরিয়ে গেল আর ধাওয়া করল সেরগেইয়ের দিকে। জামায় টান দিয়ে বলল, হাই তোলা বন্ধ কর! চোখদুটো খোলা রাখ সেরেজা!

শ্রাদ্ধের জল যে কোন দিকে কতখানি গড়াবে সে সম্বন্ধে সেরগেই কোনও স্পষ্ট ধারণা করতে পারেনি, তাই সজাগ হয়ে রইল সে।

কাতেরিনা ফিরে এল। দেখে, জিনোভিই খাটের উপর হাঁটু গেড়ে পুঁতির কেসসুদ্ধ তার ভ্রমণের ঘড়িটা শিয়রের খাড়া তক্তার সঙ্গে ঝোলাচ্ছে।

হঠাৎ সে তার স্ত্রীকে জিগ্যেস করল– কেমন যেন একটু বাঁকা-বাঁকা ভাবে, আচ্ছা, বল তো কাতেরিনা, তুমি তো ছিলে এক্কেবারে একা; তবে ওটা কী করে হল যে, তুমি জোড়া বিছানা সাজিয়ে রেখেছ?

শান্তনয়নে তার দিকে তাকিয়ে কাতেরিনা বলল, কেন, আমি তো সর্বক্ষণ তোমার জন্য অপেক্ষা করছিলুম।

কৃতজ্ঞতার ধন্যবাদ জানাচ্ছি তার জন্য। আচ্ছা, এইবার দেখ, একটা জিনিস; এটা তোমার পালকের বিছানায় প্রবেশপথ পেল কী করে? জিনোভিই বরিসিচু বিছানার চাদরের উপর থেকে উলে বোনা সরু একটি বেল্ট তুলে নিয়ে এক প্রান্ত উপরের দিকে ধরে তার স্ত্রীর চোখের সামনে দোলাতে লাগল। আসলে এটা সেরগেইয়ের।

কাতেরিনা সামান্যতম দ্বিধা না করে বলল, আমি ওটা বাগানে কুড়িয়ে পেয়ে আমার স্কার্ট বাঁধার জন্য কাজে লাগিয়েছি।

বটে! কথাগুলোয় বদখদ জোর দিয়ে জিনোভিই বলল, তোমার ওই যে স্কার্ট, সে সম্বন্ধে আমরাও আরও দু একটা কথা জানতে পেরেছি।

ঠিক কী শুনতে পেয়েছ?

ও! তোমার সব পুণ্যকর্ম!

 সেরকম কিছু হয়নি!

আচ্ছা, আচ্ছা; পরে সেসব দেখা যাবে, পরে সবকিছু দেখা যাবে, খালি পেয়ালাটা ঠেলা মেরে তার স্ত্রীর সামনে ফেলে দিয়ে জিনোভিই উত্তর দিল।

কাতেরিনা একথার উত্তরে কোনও সাড়া দিল না।

অনেকক্ষণ চুপ করে থাকার পর জিনোভিই ভুরু কপালে তুলে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার তাবৎ কীর্তিকলাপ আমরা প্রশস্ত দিবালোকে টেনে বের করব, বুঝলে কাতেরিনা ভভূনা?

কাতেরিনা উত্তর দিল, ভয়ে যারা ইঁদুরের গর্ত খোঁজে তোমার কাতেরিনা সে দলের নয়। সে অত সহজে ভয় পায় না।

কী বললে? কী বললে? জিনোভিই গলা চড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠল।

 যাগগে ও-সব… আমি আমার ফেরির পসরা দু-বার হকিনে। স্ত্রী উত্তর দিল!

বটে! সাবধান! একটু সাবধান হও দিকিনি–বড্ড বেশি বকর বকর করতে শিখে গেছ তুমি, যবে থেকে একলা-একলি থাকছ– কী জানি কী করে?

কাতেরিনা চোপা দিয়ে বলল, বকর বকর করতে আমার যদি প্রাণ চায় তবে তার বিরুদ্ধে কোনও মহামূল্যবান কারণ আছে কি?

দেখ, এখনও নিজের ওপর নজর রাখ।

আমার নিজের ওপর নজর রাখবার মতো কিছুই নেই। কোথাকার কে লম্বা জিভ নাড়িয়ে তোমাকে যা-তা শুনিয়েছে, আর আমাকে বসে বসে হরেক রকমের গালি-গালাজ শুনতে হবে নাকি? এ আবার কী এক নতুন তামাশা আরম্ভ হল!

লম্বা জিভ হোক আর নাই হোক, তোমার ঢলাঢলির কেচ্ছা এখানে বিস্তর লোকই জেনে গিয়েছে।

কাতেরিনা এবারে সত্যি সত্যি ক্ষেপে গিয়ে চেঁচিয়ে উঠল, কী ঢলাঢলি আমার?

আমি জানি কোনটা।

তাই নাকি? যদি জানোই তবে চালাও : সাফ সাফ খুলে বল।

জিনোভিই কোনও উত্তর না দিয়ে খালি পেয়ালাটা আবার ঠেলা মেরে তার স্ত্রীর সামনে ফেলল।

স্বামীকে যেন খোঁচা দেবার জন্যে একটা চামচ তার স্বামীর পিরিচে খটাং করে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে ঘেন্নার সুরে বলল, আসলে পষ্ট বোঝা যাচ্ছে, তেমন কিছু বলবার মতো নেই। না হলে বল না, বল, বল আমাকে, কার সম্বন্ধে তারা তোমাকে বলেছে? কে সে আমার প্রেমিক যাকে আমি তোমার চেয়ে বেশি পছন্দ করি?

জানতে পাবে– অত তাড়া কিসের?

বল না! তবে কি কেউ কুকুরের মতো ঘেউ ঘেউ করে সেরগেইয়ের সম্বন্ধে মিথ্যে মিথ্যে লাগিয়েছে। তাই কি না?

আমরা সব বের করব, আমরা সব বের করব, বাহারে বিবি কাতেরিনা ভভূনা। তোমার ওপর আমাদের যে অধিকার সেটা কেউ কেড়ে নেয়নি, কেউ নিতে পারবেও না… তুমি শায়েস্তা হয়ে নিজের থেকেই নিজের সম্বন্ধে সবকিছু বলবে—

আখ! আমার অসহ্য হয়ে উঠেছে! দাঁত কিড়িমিড়ি খেয়ে কাতেরিনা চিষ্কার করে উঠল– রাগে তার মুখের রঙ সাদা বিছানার চাদরের মতো হয়ে গিয়েছে। হঠাৎ সে লাফ দিয়ে দরজা দিয়ে বেরিয়ে গেল।

কয়েক সেকেন্ড পরে সেরগেইয়ের আস্তিন ধরে ঘরের ভিতর তাকে টেনে এনে কাতেরিনা বলল, এই তো, এখানে সে। ওকে আর আমাকে জিগ্যেস কর, যখন এতসব তোমার জানাই আছে। হয়তো যতখানি জেনে তৃপ্ত হও তার চেয়েও বেশি জানতে পাবে।

আসলে জিনোভিই বরিসিচের মাথা তখন ঘুলিয়ে গিয়েছে। সে প্রথমটায় সেরগেইয়ের দিকে তাকাল– সে তখন দোরের খুঁটিটায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। তার পর তাকাল তার স্ত্রীর দিকে সে ততক্ষণে খাটের বাজুতে বসে বুকের উপর এক হাত দিয়ে আরেক হাতের কনুই ধরে আছে; সমস্ত ব্যাপারটা যে কোন জায়গায় গিয়ে দাঁড়াবে সে সম্বন্ধে জিনোভিই কোনও অনুমানই করতে পারছিল না।

এখানে তুই কী করছিস রে বিচ্ছ? চেয়ার থেকে না উঠেই কোনও গতিকে সে বলল।

বেহায়ার মতো কাতেরিনাই উত্তর দিল, তুমি যা-সব খুব ভালো করে জানো সেগুলো সম্বন্ধে আমাদের জিগ্যেস কর না? তুমি ভেবেছিলে আমাকে ঠ্যাঙাবার ভয় দেখাবে– কাতেরিনা বলে যেতে লাগল; তার চোখে কুমতলব মিটমিট করছে, কিন্তু সেটা আর কখনই হয়ে উঠবে না। আর আমি? আমার যা করার সে আমি তোমার ওই প্রতিজ্ঞাগুলো শোনার পূর্বেই স্থির করে রেখেছি, আর এখন সেগুলো তোমার ওপর খাটাব।

 জিনোভিই সেরগেইয়ের দিকে চেঁচিয়ে উঠল, কী করছিস এখানে? বেরো!

কাতেরিনা তাকে চোপা দিয়ে বলল, বেশ, বেশ, তার পর?

ঝটপট দোরটা নিখুঁতভাবে বন্ধ করে চাবিটা সে পকেটে রাখল, তার পর ঢিলে। ব্লাউজসর্বদা বিছানায় ফের গড়াগড়ি দিতে লাগল।

কেরানিকে হাতছানি দিয়ে ডেকে বলল, এখানে তবে এসো সেরেজেচকা এসো, এখানে এসো, আমার প্রাণের দুলাল।

সেরগেই মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে বাবরি চুল পিছনে ফেরাল; তার পর সাহসীর মতো বাড়ির কত্রীর পাশে এসে বসল।

হে ভগবান, হে প্রভু! এসব কী হচ্ছে? তোরা কী করছিস- ওরে কাফেরের বাচ্চা জিনোভিইয়ের মুখ বেগুনি হয়ে গিয়েছে, আরাম-কেদারা থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে।

বটে? তোমার পছন্দ হচ্ছে না? একবার তাকিয়ে দেখ না, ভালো করে তাকিয়ে দেখ আমার বাজপাখিটির চোখ কীরকম জ্বলজ্বল করে, দেখ না, কী সুন্দরই না সে!

কাতেরিনা অট্টহাস্য করে উঠল এবং স্বামীর সামনে সেরগেইকে আবেগভরে চুম্বন দিতে লাগল।

সঙ্গে সঙ্গে ঠাস করে তার গালে একটা চড় পড়ে যেন সেখানে আগুন ধরিয়ে দিল আর জিনোভিই লাফ দিয়ে ধাওয়া করল ব্যালকনির খোলা জানালার দিকে।

.

০৮.

আহহা! তা হলে এই ব্যবস্থাই হল! বেশ বন্ধু! তোমাকে আমার অনেক ধন্যবাদ জানাই! শুধু এইটের জন্যই আমি অপেক্ষা করছিলুম উঁচু গলায় বলে উঠল কাতেরিনা, বেশ, বেশ, তা হলে পষ্ট দেখা যাচ্ছে, আমারই মর্জি-মাফিক সবকিছু হবে, তোমার মর্জি আর চলবে না।

এক ধাক্কায় সেরগেইকে পাশ থেকে ঠেলে দিয়ে, বিদ্যুৎবেগে সে লাফ দিয়ে গিয়ে পড়ল তার স্বামীর ঘাড়ে; জিনোভিইও লাফ দিয়েছিল ব্যালকনির জানালার দিকে কিন্তু তার পূর্বেই কাতেরিনা তার সরু আঙুল জিনোভিইয়ের গলায় প্রায় ঢুকিয়ে দিয়ে চেপে ধরে তাকে ছুঁড়ে ফেলেছে মেঝের উপর একগুচ্ছ কাটা তাজা শন মানুষ যেরকম অবহেলে ফেলে।

শরীরের সমস্ত ওজন নিয়ে বেগে পড়ার ফলে তার মাথা সজোরে ঠোক্কর খেল মেঝের উপর– আর মাথা গেল ঘুলিয়ে। সমস্ত ব্যাপারটা এত তাড়াতাড়ি তার চরমে পৌঁছে গিয়ে স্বপ্রকাশ হতে পারে তার সম্ভাবনা সে মোটেই আন্দাজ করতে পারেনি। তার ওপর তার স্ত্রীর জীবনে এই প্রথম প্রচণ্ড আক্রমণ থেকে সে বুঝে গেল যে, তার হাত থেকে ছাড়ান পাওয়ার জন্য হেন কর্ম নেই যে তার স্ত্রী করবে না, এবং তার বর্তমান অবস্থা সাতিশয় সঙ্কটময়। মাটিতে পড়ার সঙ্গে সঙ্গেই সে এই সত্যটি হৃদয়ঙ্গম করে ফেলছিল বলে সে আর আর্তনাদ করে ওঠেনি– ভালো করেই সে বুঝে গিয়েছিল যে তার আর্তনাদ কারও কানে পৌঁছবে না, বরঞ্চ তাতে করে তার পরিণাম আরও দ্রুতগতিতে পৌঁছে যাবে। নীরবে সে চোখ ফিরিয়ে নিয়ে অবশেষে তার দৃষ্টি স্ত্রীর ওপর ফেলল। সে দৃষ্টিতে ছিল জিঘাংসা, অভিসম্পাত আর তীব্রতম যন্ত্রণা। ওদিকে তার স্ত্রী সজোরে তার গলা যেন নিংড়ে ফেলছিল।

জিনোভিই আত্মরক্ষার চেষ্টা করল না। তার মুষ্টিবদ্ধ প্রসারিত দুই বাহু আচমকা আচমকা খিচুনি দিয়ে উঠছিল। তার এক বাহু তখনও সম্পূর্ণ মুক্ত; অন্য বাহু কাতেরিনা তার হাঁটু দিয়ে মাটির সঙ্গে জোরে চেপে ধরেছে।

ধরো জোরসে ওকে। বিন্দুমাত্র উত্তেজনার রেশ না দেখিয়ে সে সেরগেইকে ফিসফিস করে আদেশ দিল। তার পর ফের স্বামীর দিকে মনোনিবেশ করল।

সেরগেই তার মুনিবের উপর বসে তার দুটি হাঁটু দিয়ে মুনিবের দুই বাহু চেপে ধরল। তার পর যেই সে কাতেরিনার হাতের নিচে জিনোভিইয়ের টুটি চেপে ধরতে গেছে অমনি সে নিজেই আর্তকণ্ঠে চিৎকার করে উঠল। যে লোকটা তার এমন অন্যায় সর্বনাশ করেছে, তার ওপর চোখ পড়তে, রক্ত দিয়ে রক্তের প্রতিশোধ নেবার দুর্বার কামনা জিনোভিইয়ের অবশিষ্ট সর্বশক্তি উত্তেজিত করে দিল। ভয়াবহ বিক্রম প্রয়োগ করে সে সেরগেইয়ের হাঁটুর চাপ থেকে দুই হাত মুক্ত করে সেরগেইয়ের মিশকালো বাবরি বজ্রমুষ্টিতে ধরে নিয়ে তার গলায় কামড় মেরে বসিয়ে দিল– হুবহু হিংস্র পশুর মতো তার দাঁত। কিন্তু এ আক্রমণ দীর্ঘস্থায়ী হল না। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই জিনোভিই গোঁ গোঁ করে কাতরাতে আরম্ভ করল; মাথা একপাশে হেলে পড়ল।

নিশ্বাস-প্রশ্বাস প্রায় সম্পূর্ণ রুদ্ধ করে, বিবর্ণ কাতেরিনা তার স্বামী ও প্রেমিকের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে; তার ডান হাতে ছাঁচে ঢালাই ভারী একটা মোমবাতিদান– তার ভারী দিকটা নিচের দিকে ঝুলছে। জিনোভিইয়ের রগ আর গাল বেয়ে একটি অতি সূক্ষ্ম সুতোর মতো বয়ে নামছিল চুনি রঙের লাল রক্ত।

পাদ্রি সাহেবকে ডেকে পাঠাও স্তিমিত কণ্ঠে গোঙরে গোঙরে কোনও গতিকে জিনোভিই এ কটি কথা উচ্চারণ করল– তার বুকের উপর সোয়ার সেরগেইয়ের থেকে সে ঘেন্নার সঙ্গে যতখানি পারে তার মাথা ঘুরিয়ে নিয়েছে। আমার অন্তিম অনুষ্ঠান করাতে চাই একটি কথা বেরুল আরও ক্ষীণস্বরে।

সে তখন ক্ষণে ক্ষণে শিউরে উঠছে আর চোখ বাঁকা করে দেখছে, তার চুলের নিচে যেখানটায় গরম রক্ত জমাট বাঁধছে।

তুমি যেরকম আছ, সেই বেশ চলবে। কাতেরিনা ফিসফিস করল, তার পর সেরগেইকে বলল, ব্যস, ওকে নিয়ে আর আমাদের ঝামেলা বাড়াবার প্রয়োজন নেই; উঁটিটা কষে চেপে ধরো।

জিনোভিইয়ের গলা ঘড়ঘড় করে উঠল।

কাতেরিনা উবু হয়ে তার দু হাত দিয়ে সেরগেইয়ের দু হাতে ভর দিয়ে জিনোভিইয়ের টুটি আরও চেপে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে কাতেরিনা জিনোভিইয়ের বুকের উপর কান পেতে শুনতে লাগল। পাঁচ মিনিট পর উঠে দাঁড়িয়ে সে বলল, ব্যস, তার যা প্রাপ্য সে তাই পেয়েছে।

সেরগেইও উঠে দাঁড়িয়ে গভীর নিশ্বাস নিল। জিনোভিই খতম হয়ে গেছে তার শ্বাসনালী থেলে গিয়েছে, তার কপালের রগ ফেটে গিয়েছে। তার মাথার বাঁ দিকের নিচে রক্তের ছোট একটা থ্যাবড়া কিন্তু এতক্ষণে জমাট রক্ত আর চুলে সেঁটে গিয়েছে বলে জখম থেকে আর রক্ত বইছিল না।

সেরগেই বরিসিচকে মাটির নিচের মদের ভাঁড়ারে বয়ে নিয়ে গেল– এ কুঠুরিটা ঠিক সেই পাথরের ছোট ভাড়ারঘরের নিচে যেখানে মাত্র কিছুদিন পূর্বে স্বর্গীয় বরিস তিমোতেই এই সেরগেইকে তালাবদ্ধ করে রেখেছিলেন। তার পর ফের কাতেরিনাদের শোবার ঘরে ফিরে এল। ইতোমধ্যে কাতেরিনা হাতের আস্তিন আর পরনের স্কার্ট গুটিয়ে নিয়ে সাবান আর ঘরপোছার ন্যাকড়া দিয়ে শোবার ঘরের মেঝের উপরকার জিনোভিইয়ের রক্তের দাগ অতিশয় কষ্ট-সহিষ্ণুতার সঙ্গে সাফ করতে লাগল। সামোভারের বিষ-মাখানো যে জল দিয়ে চা বানিয়ে জিনোভিই তার স্বাধিকার-চেতন, ক্ষুদ্র পুণ্যাত্মাটিকে গরম করে তুলছিল, সে জল তখনও ঠাণ্ডা হয়ে যায়নি। তারই কৃপায় রক্তের দাগ নিশ্চিহ্ন অবলুপ্ত হল।

সামোভারের সঙ্গে কাপ ধোবার যে জাম-বাটি থাকে সেইটে এবং সাবান-মাখানো ন্যাকড়া তুলে নিয়ে দরজার দিকে যেতে যেতে কাতেরিনা সেরগেইকে বলল, এসো, আমাকে আলো দেখাবে। দরজার কাছে এসে বলে, আলো নিচু করে ধরো- টুকরো টুকরো তক্তা জোড়া দিয়ে যে মেঝে এবং সিঁড়ির উপর দিয়ে সেরগেই জিনোভিইয়ের মৃতদেহ টেনে টেনে মাটির নিচের মদের ভাড়ার পর্যন্ত নিয়ে গিয়েছিল, কাতেরিনা সেই তক্তার প্রত্যেকটি গভীর মনোযোগর সঙ্গে পরীক্ষা করল।

রঙ করা তক্তাগুলোর উপরে মাত্র দুটি জায়গায় রক্তের দাগ পাওয়া গেল– আকারে কালোজামের চেয়েও বড় নয়। ভেজা ন্যাকড়া দিয়ে কাতেরিনা সেগুলো ঘষা মাত্রই দাগগুলো লোপ পেল।

এইবারে ঠিক হয়েছে যেমন কর্ম তেমন ফল– আপন বউয়ের পিছনে ওরকম গুপ্তচরের মতো তক্কে তক্কে লেগে থেক না– তার ঘাড়ে লাফ দেবার জন্য ওঁৎ পেতে থেক না। কাতেরিনা বলতে বলতে শিরদাঁড়া সোজা করে উঠে দাঁড়িয়ে ঘাড় বাঁকিয়ে শানবাঁধানো যে ছোট্ট কুঠুরিতে সেরগেই বন্দি ছিল সে দিকে তাকাল।

সেরগেই বলল, সবকিছু খতম হল–নিজের গলা শুনে সে শিউরে উঠল।

শোবার ঘরে যখন তারা ফিরে এল তখন সরু গোলাপি রেখার মতো পূর্বাকাশ ছিন্ন করে ঊষার উদয় হচ্ছে– ফুলে ঢাকা আপেলগাছের উপর দিয়ে আলতোভাবে ঢলে পড়ে, দেয়ালের উঁচু বেড়ার রেলিঙের ভিতর দিয়ে কাতেরিনার শোবার ঘরে উষা উঁকি মারলেন।

ঘরের বাইরে উঠোনের উপর দিয়ে যাচ্ছে বুড়ো কেরানি কাঁধের উপর ভেড়ার লোমের কোটটা চড়িয়ে, হাই তুলতে তুলতে, আর ডান হাতের তিন আঙুল দিয়ে গাঁয়ের উপর ক্রুশের প্রতীক আঁকতে আঁকতে বুড়ো চলেছে রান্নাঘরের দিকে।

কাতেরিনা সাবধানে খড়খড়ির ফিতে টেনে সেটাকে বন্ধ করে দিয়ে সেরগেইকে পুঙ্খানুপুঙ্খ দৃষ্টিতে দেখতে লাগল, যেন সে তার অন্তরের আত্মসত্তাটি পর্যন্ত দেখে নিয়ে সেই সত্তাটিকে চিনতে চায়।

সেরগেইয়ের কাঁধের উপর তার শ্বেতশুভ্র হাত দুখানা রেখে বলল, কী গো, এইবারে তুমি তো সদাগরদের একজন হতে চললে।

উত্তরে সেরগেই একটি শব্দমাত্র করল না।

তার ঠোঁট দুটি স্কুরিত হচ্ছিল; কোন যেন এক পীড়া তার দেহে কাঁপন ধরিয়ে দিয়েছে। আর কাতেরিনার কিছুই হয়নি, শুধু তার ঠোঁট দুটিতে যেন শীত-শীত করছিল।

লোহার ডাণ্ডা আর ভারী শাবল ব্যবহার করার ফলে দু-একদিনের ভিতরই সেরগেইয়ের হাতে মোটা মোটা ফোস্কা দেখা দিল। তাতে কী এসে-যায়– জিনোভিই বরিসিচুকে এমনই পরিপাটিরূপে তারই মাটির তলার কুঠুরিতে পুঁতে ফেলা হল যে, তার বিধবা কিংবা বিধবার প্রেমিকের সাহায্য ছাড়া শেষ বিচারের দিন পর্যন্ত কেউ তাকে খুঁজে পাবে না।

.

০৯.

সেরগেই লাল একখানা স্কার্ফ জড়িয়ে চলাফেরা করে। ইতোমধ্যে সেরগেইয়ের গলায় বরিস যে দাঁত বসিয়ে দিয়েছিল তার দাগ শুকোবার পূর্বেই কাতেরিনার স্বামীর অনুপস্থিতি আশঙ্কাভরা জল্পনা-কল্পনার বিষয় হয়ে উঠেছিল। বরিস সম্বন্ধে আর সকলের চেয়ে বেশি কথা বলত সেরগেই নিজে। বিকেলের দিকে কোনও কোনও দিন ছোকরাদের সঙ্গে বেঞ্চিতে বসে সে বলে উঠত, সত্যি, বল তো, ভায়ারা, আমাদের কর্তা এখনও ফিরে এলেন না যে?

তারাও তখন অবাক হয়ে ভাবত ব্যাপারটি কী।

এমন সময় মিল থেকে খবর এল, অনেকদিন হল কর্তা ঘোড়ার গাড়ি ভাড়া করে বাড়ির দিকে রওনা হয়েছেন। যে কোচম্যান গাড়িটি চালিয়েছিল সে বলল, জিনোভিইকে কেমন যেন অপ্রকৃতিস্থ বলে মনে হচ্ছিল এবং কেমন যেন বেখাপ্পাভাবেই সে তাকে বিদায় দিয়েছিল; শহরের মঠের কাছে পৌঁছে সে তার কার্পেট-ব্যাগটি হাতে তুলে নিয়ে গাড়ি থেকে নেমে পড়ে চলে যায়। এ কাহিনী শুনে তাদের মনের ধাঁধা আরও যেন বেড়ে গেল।

জিনোভিই বরিসিচ অন্তর্ধান করেছে; ব্যস, এ সম্বন্ধে আর কারও কিছু বলার নেই। তাকে খুঁজে বের করবার জন্য চেষ্টা ও অনুসন্ধান আরম্ভ হল, কিন্তু তার ফলে কিছুই প্রকাশ পেল না; সে যেন হাওয়ার সঙ্গে গলে গিয়ে মিশে গিয়েছে। কোচম্যানটাকে অবশ্য গ্রেফতার করা হয়েছিল; তার কাছ থেকে মাত্র এইটুকু জানা গেল যে, জিনোভিই তাকে মঠের কাছে ছেড়ে দিয়ে একা চলে যায়। সমস্ত ব্যাপারটা মোটেই পরিষ্কার হল না। ওদিকে বিধবা কাতেরিনা সেরগেইয়ের সঙ্গে শান্তভাবে বেপরোয়া জীবনযাপন করতে লাগল। মাঝে মাঝে গুজব রটত, জিনোভিইকে কখনও এখানে দেখা গিয়েছে, কখনও ওখানে দেখা গিয়েছে কিন্তু শেষ পর্যন্ত সে আর বাড়ি ফিরে এল না। কাতেরিনা আর সকলের চেয়ে ভালো করেই জানত, জিনোভিই আর কখনও ফিরে আসবে না, ফিরে আসতে পারে না।

এক মাস গেল, দু মাস গেল, তিন মাস গেল–কাতেরিনা পেটের বাচ্চার ভার বেশ টের পেতে লাগল।

একদিন সে বলল, সেরেজেশকা, এবারে আমাদের ধন-দৌলত নিরাপদ হল। আমি তোমাকে একটি বংশধর দেব। সঙ্গে সঙ্গে শহরের কর্মকর্তাগণের কাছে দরখাস্ত করে জানাল : তার এবং তার বিষয়সম্পত্তি– অমুক, তমুক এবং সে বুঝতে পেরেছে সন্দেহ নেই, সে অন্তঃসত্ত্বা; ইতোমধ্যে ইসমাইল পরিবারের ব্যবসা-কারবার এক কদম এগোচ্ছে না; তাকে যেন তাবৎ লেনদেনের ওপর সর্ব কর্তৃত্ব এবং স্থাবর সম্পত্তির সর্বত্র অবাধ গতিবিধির অধিকার দেওয়া হয়।

এত বড় একটা কারবার সম্পূর্ণ উচ্ছন্ন যাবে–এ তো কল্পনাতীত। কাতেরিনা তার স্বামীর আইনসঙ্গত স্ত্রী, নোটারকমের কিংবা সন্দেহজনক দেনাও নেই; সুতরাং স্পষ্টই বোঝা গেল দরখাস্ত মঞ্জুর হবে। মঞ্জুর হলও।

অতএব কাতেরিনা জীবনযাপন করতে লাগল– মহারানির মতো চলন-বলন হল এবং তার দেখাদেখি অন্য পাঁচজন আটপৌরে সেরেগাকে পোশাকি সেরগেই ফিলিপিচু, কেষ্টাকে শ্রীকৃষ্ণ নামে সম্মানিত করতে লাগল। এমন সময় বলা-নেই-কওয়া-নেই আসমান থেকে বিনামেঘে বজ্রাঘাত। লিভেন শহর থেকে আমাদের মেয়রের কাছে এই মর্মে চিঠি এল যে, বরিস তিমোতেই যে মূলধন নিয়ে কাজ-কারবার করছিল সেটা তার সম্পূর্ণ নিজস্ব ছিল না : তার অধিকাংশ এসেছিল তার এক নাবালক ভাগ্নের কাছ থেকে তার নাম ফেদোর জাখার লিয়ামিন; এবং আইনত একটা ফয়সালা না করে কারবারটা একা কাতেরিনার হাতে ছেড়ে দেওয়া যেতে পারে না। নোটিশটা এলে পর মেয়র ব্যাপারটা নিয়ে কাতেরিনার সঙ্গে আলোচনা করলেন এবং তার পর এক সপ্তাহ যেতে না যেতে হঠাৎ লিভেন থেকে এসে উপস্থিত হলেন ছোট্টখাটো একটি বৃদ্ধা মহিলা– সঙ্গে একটি ছোট ছেলে।

মহিলাটি বললেন, আমি স্বৰ্গত বরিস তিমোতেইভিচের সম্পর্কে বোন হই আর ইটি আমার ভাইপো ফেদোর লিয়ামিন।

কাতেরিনা তাদের অভ্যর্থনা জানাল।

আঙিনায় দাঁড়িয়ে সেরগেই এদের আগমন এবং নবাগতদের প্রতি কাতেরিনার অভ্যর্থনা জ্ঞাপন দেখে পাদ্রিদের সাদা জোব্বার মতো ফ্যাকাসে হয়ে গেল!

বাড়ির কর্ত্রী কাতেরিনা সেরগেইকে জিগ্যেস করল, এ কী? তোমার কী হয়েছে? সে আঙিনা ছেড়ে অতিথিদের পিছনে পিছনে হলঘর পর্যন্ত এসে তাদের দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়েছিল।

কিসসু না, কিসসুটি না। হলঘর ছেড়ে সদর দরজার কাছে এসে সেরগেই উত্তর দিয়ে বলল, আমার মনে হচ্ছিল এই লিভে গুষ্ঠি বাজি হারার পড়তা, জেতার নয়। তার পর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বেরিয়ে গিয়ে পিছনের সদর দরজা বন্ধ করে দিল।

***

সে রাত্রে সামোভার ঘিরে বসে সেরগেই কাতেরিনাকে শুধল, তা হলে আমরা এখন করি কী? তোমার আমার আমাদের দুজনার– সবকিছু যে ছাইভস্ম হয়ে গেল।

ছাইভস্ম কেন, সেরেজা?

নয় তো কী? এখন তো সবকিছু ভাগাভাগি হয়ে যাবে। আমাদের হিস্যেয় যা পড়বে তা দিয়ে আমরা চালাব কী করে?

কেন, সেরেজা? তোমার কি ভয় হচ্ছে, তুমি যথেষ্ট পাবে না?

আমি নিজের হিস্যের কথা ভাবছিনে। আমার শুধু সন্দেহ হচ্ছে, আমরা কি আর সুখী হতে পারব?

এ দুর্ভাবনা তোমার মনে কেন উদয় হল? আমরা সুখী হতে পারব না কেন?

সেরগেই উত্তর দিল, তার কারণ, তোমার প্রতি আমার যে প্রেম, সে প্রেম চায় তোমাকে সমাজের উচ্চস্থানের মহিলারূপে দেখতে; আগে যেরকম নগণ্য জীবন যাপন করতে, সেরকম নয়। আর এখন সবকিছু ওলট-পালট হয়ে গিয়েছে; আমাদের আমদানি কমে যাওয়ার ফলে এখন আমাদের আরও টানাটানি করে চালাতে হবে।

তাতে করে আমার জীবনে তো কোনও হেরফের হবে না, সেরেজা।

ঠিক সেই কথাই তো হচ্ছে, কাতেরিনা ভনা; তোমার কাছে সবকিছু পছন্দসই বলে মনে হতে পারে, আমার কিন্তু কস্মিনকালেও তা মনে হবে না এবং তার একমাত্র কারণ তোমাকে আমি মাত্রাধিক শ্রদ্ধা করি। তার ওপর দেখ, সমস্তটা ঘটবে যতসব হিংসুটে ছোটলোকদের চোখের সামনে সেসব দেখে আমার বেদনার আর অন্ত থাকবে না। তুমি অবশ্য যা-খুশি তাই করতে পার কিন্তু আমার দৃঢ় বিশ্বাস, এ পরিস্থিতিতে আমি কখনও সুখী হতে পারব না।

আর সেরগেই বার বার একটানা ওই একই রাগিণী কাতেরিনার সম্মুখে গাইতে লাগল; ওই ফেদোর লিয়ামিন ছোঁড়াটার জন্যে তার সর্বনাশ হয়েছে। সে যে আশা করেছিল, একদিন সে বণিকগোষ্ঠীর সর্বোচ্চ সম্মানের আসনে কাতেরিনা ভড়কে বসাবে সে আশা পূরণের সম্ভাবনা থেকে সে বঞ্চিত হল। ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে যে করেই হোক, এ ধরনের আলাপ সেরগেই শেষ পর্যন্ত এই সমাধানেই নিয়ে আসত যে, স্বামীর অন্তর্ধানের ন মাসের ভিতর যদি কাতেরিনা তার পেটের বাচ্চাটিকে প্রসব করে তাবৎ সম্পত্তির অধিকারী হয়, তবে তাদের সুখের আর সীমা-পরিসীমা থাকে না–কিন্তু মাঝখানে এই ফেদোর ছোঁড়াটা উড়ে এসে জুড়ে বসে তাদের সর্বনাশ করেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *