বৈশ্য
মনু উপদেশ করেছেন, শূদ্র সমর্থ হলেও ধনসঞ্চয় করবে না। কেননা বহু ধনের গর্বে সে হয়তো ব্ৰাহ্মণকেও পীড়া দিতে আরম্ভ করবে। অথচ এই ভৃগুসংহিতা যে-সমাজের ধর্মশাস্ত্র তার ধনসৃষ্টি ও ধনসঞ্চায়ের কাজটি ছিল বৈশ্যের হাতে। এ বর্ণটি সম্বন্ধে যে শাস্ত্রকারের এমন আশঙ্কা হয়নি, সম্ভব তার কারণ বৈশ্য ছিল আৰ্য সভ্যতার ভিতরের লোক-দ্বিজ। শাস্ত্রের শাসন ছাড়াও তার মনে এই সভ্যতার বাঁধন ছিল, যার টানে কেবল ধনের জোরে বিদ্যা ও বুদ্ধিকে ছাড়িয়ে চলার কল্পনা তার পক্ষে অসম্ভব ছিল।
বিংশ শতাব্দীর বৈশ্যের অবশ্য কোনও ধর্মশাস্ত্রের বালাই নেই; সভ্যতার বাঁধনকেও সে একরকম কাটিয়ে উঠেছে। কেননা বৈশ্য আজ সভ্যতার মাথায় চড়ে ব্ৰাহ্মণকে ডেকে বলছে, তোমার কাজ হল আমার কারখানার কল-কবজা গড়া, কাঁচামালকে কেমন করে সস্তায় ও সহজে তৈরি মাল করা যায় তার ফন্দি বাতলানাে; না হয় আমার খবরের কাগজে আমার – মতলবমতো প্ৰবন্ধ জোগানো। শূদ্রকে বলছে, এসো বাপু ! তোমার স্ত্রী-পুত্ৰ-কন্যা নিয়ে, লেগে যাও আমার কলের কাজে; পেট-ভাতার অভাব হবে না। আর জেনো এই হচ্ছে সভ্যতা, এতে অসূয়া করা মানে দেশদ্রোহ, একেবারে সমাজের ভিত ধরে নাড়া দেওয়া। ক্ষত্রিয়কে বলছে, হুঁশিয়ার থেকে যেন এই যে ব্ৰাহ্মণ-শূদ্রের তৈরি আমার কলের মাল দিকে দিকে ছুটিল, জলে স্থলে এর গতিকে অবাধ রাখতে হবে, তোমার কামান, বন্দুক, জাহাজ, এরোপ্লেন যেন ঠিক থাকে। বিদেশের বৈশ্য যদি এই বণিকপথের প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে, নিজে গুডো হয়ে তাকে গুড়ো করতে হবে। তাতে দেশের জন্য প্ৰাণ দিয়ে তোমারও অক্ষয় কীর্তি লাভ হবে, আমারও গোলাগুলি, রসদ, হাতিয়ারের কারখানার মুনাফা বেড়ে যাবে। আর ঘরেও তোমার কাজের একেবারে অভাব নেই। আমার কলের মজুরেরা অতিরিক্ত বেয়াড় হয়ে উঠলে তাদের উপর গুলি চালাতেও মাঝে মাঝে তোমার ডাক পড়বে।
এই যে বৈশ্যপ্রভুর ব্যবস্থা, যার বর্ণ ধর্ম কথনের প্রথম কথা হচ্ছে ব্ৰাহ্মণ, ক্ষত্ৰিয়, শূদ্র এই তিন বর্ণের এক ধর্ম, চতুর্থ বৰ্ণ বৈশ্যের শুশ্রীষা, এরই নাম “কাপিটালিজম’ বা মহাজন-তন্ত্র। এর নাগপাশ গত একশো বছর ধরে ইউরোপীয় সভ্যতাব প্রতি অঙ্গে পাকে পাকে নিজেকে জড়িয়ে এসেছে এবং আজ তার চাপে সে সভ্যতার দম বন্ধ হবার উপক্রম। গত যুদ্ধের কামানের শব্দে ট্রেঞ্চের মধ্যে জেগে উঠে ইউরোপের সভ্যতা এ বজর্বাধন থেকে নিজেকে মুক্ত করবার যে ব্যাকুল চেষ্টা করছে তারই নাম কোনও দেশে ‘সোভিয়েট’, কোনও দেশে “ন্যাশন্যালিজেশন’।
২
আধুনিক ইউরোপের সমাজ-ব্যবস্থায় যে করে বৈশ্য-প্ৰভুত্বের প্রতিষ্ঠা হয়েছে তার ইতিহাস বিস্ময়কর কিন্তু জটিল নয়। এর মূল ভিত্তি হল। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষভাগ থেকে ইউরোপীয় জাতিগুলির মধ্যে জড়-বিজ্ঞানের আশ্চর্য উন্নতি, প্রকৃতির সকল কাজের শক্তি ও নিয়মের জ্ঞানের অচিন্তিতপূর্ব প্রসার এবং সে জ্ঞানকে মানুষের ঘরকন্নার কাজে লাগাবার চেষ্টার অপূর্ব সাফল্য। এর ফলে ইউরোপীয় সভ্যতার স্থূলদেহ উনবিংশ শতাব্দীর মধ্যে দেখতে দেখতে একেবারে নবী কলেবর নিয়েছে। সে চেহারা ইউরোপের ও ইউরোপের বাইরের পূর্ব পূর্ব যুগের সমস্ত সভ্যতার চেহারা থেকে একেবারে ভিন্ন রকমের। বাষ্প আর বিদ্যুৎ এই দুই শক্তিকে লোহার বাঁধনে বেঁধে ইউরোপ যে শিল্প, কারু, কৃষি, বার্তা, ব্যাবসা, বাণিজ্য গড়ে তুলেছে তার কাজের ভঙ্গি ও সামর্থ্যের সঙ্গে কোনও যুগের কোনও সভ্যতার সে দিক দিয়ে তুলনা করাই চলে না। যেমন ফরাসি অধ্যাপক সেনোবো লিখেছেন–এদিকে অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরোপের সঙ্গে আজকার ইউরোপের যে তফাত, অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরোপের সঙ্গে প্রাচীন মিশরের তফাত তার চেয়ে অনেক কম। বলা বাহুল্য এ তফাত কলকারখানা, রেল স্টিমার, টেলিগ্রাফ টেলিফোনে মূর্তিমান হয়ে রয়েছে। এবং আশা করা যায়, অল্পদিনেই মোটর, এরোপ্লেন সে মুর্তির অদল-বদল ঘটিয়ে এ তফাতকে আরও বাড়িয়ে তুলবে। কিন্তু এই যে ইউরোপ কারখানায় কলে শিল্পসামগ্ৰী তৈরি করছে, রেলে স্টিমারে তার পণ্য পৃথিবীময় ছড়িয়ে দিচ্ছে, টেলিগ্রাফ টেলিফোনে দাম দস্তুর বেচাকেন। চালাচ্ছে, এর ভিতরের লক্ষ্য কিছুই নুতন নয়। সেটি অতি প্রাচীন, মানুষের সভ্যতার সঙ্গে একবয়সি। সে লক্ষ্য হল–কী করে মানুষের জীবনধারণের ও সে জীবনের শোভা সম্পদ বিধানের সামগ্ৰীগুলিকে যথেষ্ট পরিমাণে জোগান দেওয়া যায়। পশুপালন, কৃষি, শিল্প, বাণিজ্য সবই এই প্রশ্নেরই উত্তর। কেবল উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর ইউরোপ তার শিল্প-বাণিজ্যের কৌশলে ও ব্যবস্থায় এ সমস্যার যে সমাধান করেছে, জিনিসের জোগান হিসাবে তা তুলনারহিত। যা মানুষের অসাধ্য ছিল তা সুসাধ্য হয়েছে; যা বহুদিন, বহুজন ও বহু আয়াসসাধ্য ছিল সামান্য লোকের নামমাত্র পরিশ্রমে তা মুহূর্তের মধ্যে সাধিত হচ্ছে। বিশেষজ্ঞেরা হিসাব করেছেন, আজ কলের তাঁতে একজনে যে কাপড় বোনে সেটা হাতের তাঁতের ত্ৰিশজন তাঁতির কাজ; হাতের চরকার এগারোশো জনের সুতো আজ কলের চরকায় একজন কেটে নামাচ্ছে।
কিন্তু এ নব শিল্প-বাণিজ্যের এই যে অদ্ভুত কৰ্মসমর্থ্য, একে চালনা করতে হলে গুটিকতক উপায় অপরিহার্য। তার মধ্যে প্রধান হল বিপুল আয়তনের উপাদানকে একই জায়গায় একসঙ্গে বিপুল পরিমাণ শিল্প-সামগ্ৰীতে পরিণত করা এবং তার জন্যে চাই বহু লোককে একত্র জড়ো করে তাদের নানারকম মজুরির সাহায্য। আধুনিক কলের দৈত্য, উপকথার দৈত্যর মতোই নিমেষে পর্বতপ্রমাণ কাজ করে ওঠে, কিন্তু সত্যিকার দৈত্য হওয়াতে সে চায় কাজের পরিমাণ মালের জোগান, আর মানুষের হাতের সাহায্য। সুতরাং শিল্প-বাণিজ্যের এই নূতন কৌশলকে কাজে লাগাতে হলে, চাই দেশ-বিদেশ থেকে কাঁচামাল সংগ্রহ করে জমা করা, কল গড়ে কারখানা বসানো, আর সে কল-কারখানা চালাবার জন্য নানারকম বহু মজুর একত্র করা। এবং এ-সবারই জন্য চাই টাকা, অর্থাৎপূর্বসঞ্চিত ধন। যাতে মাল কেনা চলবে, কল-কারখানা তৈরি হবে, মজুরের মজুরি জোগাবে। এবং সে টাকা অল্পস্বল্প হলে চলবে না, একসঙ্গে চাই বহু টাকা। কেননা এ ব্যাপারের মূল কথাই হচ্ছে, যা পূর্বে নানালোকে নানা জায়গাতে অল্পেীস্বল্পে এবং অল্পস্বল্প তৈরি করত, তাই করতে হবে এক জায়গায়, এক তত্ত্বাবধানে, বিদ্যুৎগতিতে আর হাজার গুণ বেশি পরিমাণে। ফলে ইউরোপ জুড়ে কল-কারখানা তারাই বসিয়েছে হাতে যাদের ছিল জমানো টাকা এবং কলের চাকার পাকে পাকে নামতার আর্যার মতো সে টাকা বেড়ে উঠেছে। আর টাকা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে কলও বেড়েছে। কারখানাও বড় হয়েছে। অর্থাৎটাকার অঙ্কটাও আর বেড়ে চলেছে। আর এও অতি স্পষ্ট যে এই কলের তৈরি মালের রাশিকে দেশ-বিদেশে কাটাতে হলে চাই বড় মূলধনী ব্যবসায়ী, যাঁরা একদমে একে নিঃশেষ করে কিনে নিতে পারবে। ছোট ছোট ব্যবসামীর হাত দিয়ে ধীরে-সুস্থে এ মাল কাটানোর চেষ্টা করা এ-সব কারখানার মালিকদের পক্ষে একেবারেই সম্ভব নয়। এমনি করে আজকার ইউরোপের যে বিরাট ধনসম্পদ তার একটা প্ৰকাণ্ড অংশ এসে জমেছে সংখ্যায় অতি অল্প একটি শ্রেণিবিশেষের হাতে–যাঁরা কারখানার মালিক বা সেই কারখানার মালের ব্যবসায়ী। হিসাবে দেখা গেছে যে আমেরিকার যুক্তরাজ্যে (যা ইউরোপের একখণ্ড ‘ছিট’ মাত্র) দেশের সমুদয় ধনের এক পঞ্চমাংশেরও বেশি রয়েছে লোক সংখ্যার ত্ৰিশ হাজার ভাগের এক ভাগের হাতে। ধনের গৌরব সব দেশে, সব কালেই ছিল ও থাকবে। সুতরাং এই অতি-ধনী বৈশ্য শ্রেণিটি যে ইউরোপের সমাজ ও রাষ্ট্রে প্রতিপত্তিশালী হবে এতে আশ্চর্যের কিছুই নেই।
৩
কিন্তু এই মহাজন সম্প্রদায়টির ইউরোপে যা প্রভাব ও প্রতিপত্তি ধন গৌরবের উপর তার সামান্য অংশই নির্ভর করছে। যার টাকা নেই। সে যার টাকা আছে তাকে দূরে থেকেই নমস্কার করতে পারে যদি না জীবিকার জন্য তার দরজায় দাড়াতে হয়। এইজন্য ইউরোপের পক্ষে তার মহাজন শ্রেণিটিকে কেবল টাকার খাতির দিয়ে দূরে রাখা সম্ভব নয়। কেননা এই শ্রেণিটিই হয়ে দাঁড়িয়েছে ইউরোপের অন্নদাতা। আর তা দু’রকমে। নূতন শিল্প ব্যবস্থায় দেশজুড়ে ধনসৃষ্টির যেসব ছোটখাটো ব্যবস্থা ছিল তা লোপ পেয়েছে। একমাত্র কৃষি ছাড়া ইউরোপের সমস্ত ধন প্রকৃতপক্ষে উৎপন্ন হচ্ছে এই মহাজনদের বড় বড় কারখানায়। এবং কৃষি জিনিসটিও আজ ইউরোপের চোখে অতি অপ্রধান শিল্প। কারণ পশ্চিম ইউরোপ আবিষ্কার করেছে নিজের অন্ন দেশে জন্মানোর চাইতে কলের তৈরি শিল্প-সামগ্ৰী দিয়ে বিদেশ থেকে তা কিনে আনাই তার পক্ষে বেশি সহজ ও সুবিধার। এবং সে শিল্পের জন্য যে কৃষিলভ্য কাঁচামালের দরকার তার সম্বন্ধেও সেই কথা। ফলে পশ্চিম ইউরোপের অধিকাংশ লোকের জীবিকার উপায় হচ্ছে মহাজনদের এই বড় বড় কারখানাগুলিতে ও তাদের অফিসে হাতে বা কলমে মজুরগিরি করা। অর্থাৎ— এই মহাশ্রেষ্ঠী সম্প্রদায়টি সাক্ষাৎ সম্বন্ধেই এদের মনিব ও অন্নদাতা। আর পরোক্ষে ইউরোপের সবারই অন্নবস্ত্র এরাই জোগাচ্ছে। জীবনযাত্রার যা কিছু উপকরণ তা হয়ে আসছে এদের কারখানা থেকে, নয় তো এদেরই কারখানার কলে তৈরি মালের বিনিময়ে। যাদের হাতে জীবন-মরণের কাঠি রয়েছে তাঁরা যে সর্বময় হয়ে উঠবে এতে আর বিস্ময় কী!!
কিন্তু এ বৈশ্য-প্রভুত্বের সবচেয়ে যা প্রধান কথা তা হচ্ছে আধুনিক যুগের নূতন ব্যবস্থায় এই যে-সব অতিকায় শিল্পবাণিজ্যের প্রতিষ্ঠান মহাজনদের মূলধনে ও চেষ্টায় গড়ে উঠেছে এগুলি যত লোকের অন্ন জোগাচ্ছে এর পূর্বে ইউরোপের পক্ষে তা অসাধ্য ছিল। আর অন্ন বাড়লে যে জীবও বাড়ে এটা প্ৰাণবিদ্যার একবারে প্রথম ভাগের কথা। ফলে গেল একশো বছরের মধ্যে ইউরোপের লোকসংখ্যা দ্বিগুণ হয়েছে। এবং এখন এ বিরাট জনসংঘের জীবিকা জোগাতে হলে ইউরোপের আধুনিক শিল্প-বাণিজ্যের চাকা একদিনও অচল হলে চলবে না। এর আয়তন যদি একটু খাটো কি বেশ একটুকু মন্দা হয় তবে ইউরোপ তার সমস্ত লোকের মুখে আর অন্ন দিতে পারবে না। উনবিংশ শতাব্দীর শিল্প-বাণিজ্যে যে লোক বেড়েছে, বিংশ শতাব্দীতে তাদের বাঁচিয়ে রাখতে হলে সেই শিল্প-বাণিজ্য ছাড়া আর গতি নেই, এ যে কত সত্য জার্মান যুদ্ধের এক আঁচড়েই তা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। যুদ্ধের ধাক্কায় এ শিল্প-বাণিজ্যের কল যেই একটু বিকল হয়েছে অমনি ইউরোপ জুড়ে কলরব; ইংল্যান্ডে চিনি নেই, ফ্রান্সে কয়লা নেই, জার্মনিতে চর্বির জন্য হাহাকার, অস্ট্রিয়ায় দুধ না পেয়ে শিশু মরছে। আর একথা আরও স্পষ্ট হয়েছে, গেল-যুদ্ধের ফলে মূলধনী মহাজনদের বিরুদ্ধে আন্দোলনের রকম-সকমে। রুশিয়ার বোলশেভিক, জার্মানির সোস্যালিস্ট, কি ইংল্যান্ডের ন্যাশান্যালিজেশন পন্থী এমন কথা কারও মুখে ওঠেনি যে, এই যে আধুনিক ইউরোপের দৈত্যাকৃতি সব শিল্প-বাণিজ্য, যা কলের ও কাজের চাপে মানুষকে পিষে ফেলছে, একে ভাঙা দরকার। কেননা ইউরোপ মৰ্মে মৰ্মে জানে যে, এই শিল্প-বাণিজ্যই তার প্রাণ। একে মারতে গেলে মরতে হবে। তাই এখন সবারই লক্ষ্য কী করে এই শিল্প-বাণিজ্যকেই বহাল ও সচল রাখা চলে, কিন্তু তার বর্তমান মালিক মহাজনদের ছেটে ফেলা যায়। এ চেষ্টা সফল হবে কি না তা ইউরোপের ভাগ্যবিধাতাই জানেন। কিন্তু যত দিন না হবে, ততদিন বৈশ্য ইউরোপীয় সমাজ ও রাষ্ট্রের মাথায় চড়েই থাকবে। কেননা ইউরোপের মুখের অন্ন তার হাতের মুঠোয়।
৪
বলা বাহুল্য ইউরোপের বৈশ্য-প্ৰভুত্বের বেগ কেবল ইউরোপ বা ইউরোপিয়ান জাতিগুলির মধ্যেই আবদ্ধ নেই; পৃথিবীময় সে নিজেকে জানান দিচ্ছে। কেননা ইউরোপ আজ সমস্ত পৃথিবীর প্রভু। এবং স্বভাবতই এ প্রভুত্বের প্রয়োগ হচ্ছে ইউরোপের প্রভু বৈশ্যের মারফত, তারই সুবিধা ও প্রয়োজনমতো। ইউরোপের বিজ্ঞান আজ বাহুবলে ইউরোপকে অজেয় ও দুৰ্নিবার করেছে। এবং সমস্ত পৃথিবী প্রত্যক্ষে বা পরোক্ষে ইউরোপের জিত রাজ্য। কিন্তু এ জয় অশ্বমেধের রাজচক্রবর্তীর জয় নয়। যুদ্ধের উল্লাস কি জয়ের গৌরব এর লক্ষ্য নয়। এর উদ্দেশ্য হল জিত দেশ ও পরাজিত জাতিকে ইউরোপের কারখানার কলের চাকায় জুড়ে দেওয়া। যে শিল্প-বাণিজ্য ইউরোপকে অন্নবস্ত্র দিচ্ছে ইউরোপের বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগ তার চাই-ই চাই। সেখানকার মাটির রস টেনেই ওরা বেঁচে রয়েছে। যে কাঁচামাল কলে-তৈরি শিল্পে পরিণত হবে, তা প্রধানত আসছে ইউরোপের বাইরে নন-ইউরোপিয়ান লোকদের দেশ থেকে। জীবনযাত্রার যে-সব উপকরণ, বিশেষ করে খাদ্য, যা ইউরোপের মাটিতে জন্মে না বা কলে গড়া চলে না, তাও বেশির ভাগ আনতে হবে ওখান থেকেই। অবশ্য এ দুই জিনিস ইউরোপ গায়ের জোরে কেড়ে নিতে চায় না। তার কারখানার তৈরি শিল্পের বিনিময়েই কিনতে চায়। কিন্তু এদের জোগান যাতে অব্যাহত, আর পরিমাণ যাতে প্রয়োজনমতো হয় সে ব্যবস্থা তাকে করতেই হবে। কেননা কারখানার কল একদিনও বসে থাকলে চলবে না। সুতরাং এ-সব গরম দেশের অলস লোকেরা যদি নিজের ইচ্ছায়, অথবা লাভের লোভে এ-সব জিনিস যথেষ্ট পরিমাণে উৎপন্ন করে সুবিধা দরে জোগান দিতে না চায় তখন ইউরোপকে বাধ্য হয়েই হাতে চাবুক নিতে হয়, সঙিনের খোচায় এদের কাজের ইচ্ছাকে জাগিয়ে রাখতে হয়। এমনকী দুই-চারজনার হাত পা কেটে দিয়ে তাদের বাকি সঙ্গীদের হাত-পা’গুলো যাতে কলের চাকার বেগের সঙ্গে তাল রাখতে উৎসাহী হয়। সে চেষ্টা থেকেও পশ্চাৎপদ হলে চলে না। জার্মান অধ্যাপক নিকলাই তার যুদ্ধ ও জীবতত্ত্ব’ নামের পুথিতে লিখেছেন যে, পৃথিবীর পঞ্চাশ কোটি ইউরোপিয়ান ও ইউরোপ থেকে ছড়িয়ে-পড়া শ্বেত মানুষের হাতে এখনই এমন যন্ত্রপাতি আছে যে, আসছে বিশ বছরের মধ্যে তাঁরা পৃথিবীর একশো কোটি নানা জাতির অ-শ্বেত মানুষদের একেবারে নির্মূল করে উচ্ছেদ করতে পারে। এবং ফলে সমস্ত পৃথিবীটা কেবলমাত্র, অন্তত নিজেদের চোখে, উন্নততর শ্বেত জাতিদেরই বাসস্থল হয়। এ বিশ বছরের পরে, অর্থাৎ— যখন চিন তার সমস্ত লোককে আধুনিক অস্ত্র ও যুদ্ধ-বিদ্যায় শিক্ষিত করে তুলবে এবং নিজের ‘ড্রেডনট’ ও কামান গোলা নিজেই তৈরি করতে শুরু করবে, যেমন এখন জাপান করছে, হয়তো এ আর সম্ভব হবে না। কিন্তু ইউরোপ যে এ-কাজে হাত দেবে না তা নিশ্চয়, কেননা ব্যাপারটা এমন ভয়ানক যে কল্পনায় তাকে ফুটিয়ে তুললেই পিছিয়ে আসতে হয়। এবং অধ্যাপক নিকলাই-এর মতে এ জেহাদ প্রচার করা মানে স্বীকার করা যে প্রকৃত জীবনযুদ্ধে, যেখানে জয়ী হতে হয় পরকে মারার শক্তিতে নয়, নিজের বাঁচার শক্তিতে, শ্বেতের চেয়ে অ-শ্বেত শ্ৰেষ্ঠ। সুদূর ও সূক্ষ্ম তত্ত্বের আলোচনায় এখানে একটা হাতের কাছের মোটাকথা চোখ এড়িয়ে গেছে। ইউবোপ যদি আসছে বিশ বছরের মধ্যে পৃথিবীর সব অ-শ্বেত জাতিগুলিকে উচ্ছেদ করতে সমর্থ হয় তবে তার পরের দশ বছরের মধ্যে ইউরোপ আর বর্তমান ইউরোপ থাকবে না। তার কল-কারখানার বেশির ভাগই অচল হবে। তার শিল্প-বাণিজ্য সমাজ-রাষ্ট্র সব ব্যবস্থারই মুলে টান পড়বে। কারণ পৃথিবীজুড়ে শস্যক্ষেত্রে, মাঠে, অরণ্যে যে-সব কৃষ্ণ, তাম্র, পীত হাত দ্রব্যসম্ভার জুগিয়ে ইউরোপের সভ্যতার স্কুল শরীরকে স্কুলতর করে তুলছে তার সবগুলিকে যদি সাদা হাত দিয়ে বদল করতে হয় তবে কারখানার কলে দেবার মতো হাত ইউরোপে আর বেশি অবশিষ্ট থাকে না। ইউরোপের লোকসংখ্যার ইউরোপে বসে অন্নসংস্থান অসম্ভব হয়। যে-সব ভিত্তির উপর ইউরোপের বর্তমান সভ্যতা দাঁড়িয়ে আছে তার মধ্যে একটা প্রধান হল নন-ইউরোপিয়ান ও অ-শ্বেত লোকদের পরিশ্রমের ফল সহজে ও স্বল্পমূল্যে পাওয়া। প্রাচীন গ্রিক-রোমান পণ্ডিতেরা দাসের শ্রম বাদ দিয়ে নিজেদের সভ্যতার অস্তিত্ব কল্পনা করতে পারতেন না। আধুনিক ইউরোপীয় পণ্ডিতেরা যে পারেন তার কারণ নােমরূপের বদল ঘটালে জানা-জিনিস চিনতে পণ্ডিতদের কষ্ট হয়; আর মনে যা ওঠে তা স্পষ্ট করে খুলে বলার অভ্যাস প্রাচীন পণ্ডিতদের যত ছিল আধুনিক পণ্ডিতদের তা নেই।
ইউরোপের বৈশ্য-প্রভুত্বের খোঁচা এমনি করে ইউরোপের বাইরে তাম্র কালো পীত সব রঙের লোকের গায়ে এসেই বিঁধছে। ইউরোপের বৈশ্য চায়। এরা নিরলস হয়ে তার কারখানার কাজের উপাদান আর মজুরের খাদ্য জোগায়। কিন্তু এ ছাড়া এর আরও একটা দিক আছে। ইউরোপ যেমন এদের কর্মশীলতা চায় তেমনি সঙ্গে সঙ্গে চায়। এ কর্মক্ষমতা সীমা ছাড়িয়ে না। ওঠে এবং বিপথে না চলে। শিল্পের উপাদান জোগান এবং কৃষি পশু থেকে খাদ্য উৎপাদন, এতেই নিঃশেষ না হয়ে যদি এদের শক্তি ও বুদ্ধি নবশিল্পের নূতন বিদ্যা শিখে উপাদানকে শিল্পদ্রব্যে পরিণত করার দিকে চলে সেটা ইউরোপের চোখে অমঙ্গল। কেননা ইউরোপের আধুনিক শিল্পবাণিজ্যের মোটকথা বাকি পৃথিবী উপাদান ও খাদ্য জোগাবে, আর ইউরোপ ওই উপাদান থেকে তৈরি শিল্পদ্রব্যের এক অংশ বিনিময়ে ফিরিয়ে দেবে। যদি এ ব্যবস্থা উলটে গিয়ে খাদ্য ও শিল্পসামগ্ৰী দুই-ই বাইরে থেকে ইউরোপের দরজায় উপস্থিত হয় তবে বদল দিয়ে এদের ঘরে নেবার মতো জিনিস ইউরোপের বড় বেশি থাকবে না। কেননা ইউরোপ যে শিল্প-বাণিজ্যে আর সবাইকে ছাড়িয়ে গেছে সে তার দেশের প্রকৃতির গুণে নয়, লোকের প্রকৃতির গুণে। কিন্তু এ কথা যেমন গৌরবের তেমনি আশঙ্কার। যে-সব দেশে প্রকৃতি ইউরোপের চেয়ে অকৃপণা, সে দেশের লোকের মনের পঙ্গুত্ব ও শক্তির খর্বতার উপর এ শ্রেষ্ঠত্ব টিকে আছে। মন সচল হলেও যে ইউরোপের শিল্প-বাণিজ্যের নূতন কৌশল শিখে শক্তি সঞ্চয়ে দেরি হয় না তার পরিচয় জাপান দিয়েছে। এবং যেখানেই এ পরিচয়ের আভাস পেয়েছে, ইউরোপ তার নাম দিয়েছে ‘আতঙ্ক’। কারণ ইউরোপের বিশ্বপ্রেমিকেরা যা-ই বলুন-না, ধন ও শক্তিতে ইউরোপ এখন যেমন আছে তেমনি থাকবে, আবার বাকি পৃথিবীটাও ধনী ও শক্তিশালী হয়ে উঠবে, জ্ঞান ও বিজ্ঞানের বর্তমান অবস্থায় এর কোনও সম্ভাবনা নেই। ইউরোপ প্ৰধান হয়েছে, আর সবাই ছোট ও খাটো আছে বলে। সে প্রাধান্য বজায় থাকবে – আর সবাইকে ছোট ও খাটো করে রাখতে পারলে।
৫
বৈশ্য-ইউরোপের চাপ পৃথিবীর যে-সব প্রাচীন সভ্য জাতিগুলির উপর এসে পড়েছে তাদের সবারই মনে হয়েছে ওর হাত থেকে রক্ষার উপায় ওই বৈশ্যত্বকে ধার করে তার উপর শিল্প, বাণিজ্য, সমাজ ও রাষ্ট্র গড়া। কেননা চোখে দেখতে ইউরোপের বাহুতে বল দিচ্ছে তার সব অদ্ভুত কৌশলী কাজের সরঞ্জাম ও উপকরণের বিচিত্র বাহুল্য। আর এ সরঞ্জাম ও উপকরণ সবই জোগাচ্ছে তার বৈশ্যের কর্মব্যবস্থা। প্রাচ্য দেশের মধ্যে সবচেয়ে প্রাচ্য জাপান পাশ্চাত্যের এই কৰ্মকৌশল অল্পদিনেই আয়ত্ত করেছে। এবং ফলে পশ্চিম ইউরোপের প্ৰবল জাতিগুলির মতো ইউরোপের চোখে সেও একটা প্রধান জাতি। তারও কারখানার কলে ইউরোপের মতো মজুর খাটিয়ে শিল্প-সামগ্ৰী তৈরি হচ্ছে; সেগুলো জাহাজে উঠে পৃথিবীর বাজারের যত ফাঁক জায়গা দরকারি, অদরকারি, সাচ্চা, ঝুঁটো, ভারী ও ঠুনকো মালে ভরে দিচ্ছে, এবং আর সবার মাল সরিয়ে নিজের জন্য কতটা জায়গা খালি করা যায় তার চেষ্টা দেখছে। মহাজনি-জাহাজের পেছনে তারও মনোয়ারি জাহাজ সেজে রয়েছে; এবং পৃথিবীর শান্তির জন্য ইউরোপের আর পাঁচজন শান্তিপ্রয়াসীর মতো সেও কামান, বন্দুক, গোলা, গুলি তৈরি করে যাচ্ছে। বিশ্বহিতের বাণী তার মুখ থেকেও সমান তেজে ও সমান বেগেই বেরোচ্ছে; এবং মানবজাতির সভ্যতা রক্ষা ও বিস্তারের জন্য দুর্বল জাতির সুফলা দেশের গুরুভার বহনে তার পীত-স্কন্ধের ঔৎসুক্য কোনও শ্বেত-স্কন্ধের চেয়ে কম নয়। বৃদ্ধ চিন ডাইনে ইউরোপ ও বীয়ে জাপান দুদিক থেকে খোঁচা খেয়ে ওই বৈশ্যত্বের দিকে লুব্ধনেত্ৰে তাকাচ্ছে। কিন্তু তার প্রাচীন সভ্যতার গভীর শিকড়, আর প্রকাণ্ড দেহের বিরাট বিপুলতা তাকে সোজাসুজি ইউরোপের বৈশাত্বের পাঠশালায় ঢুকতে দিচ্ছে না। ইউরোপের নবীন বিদ্যার বেগ তার প্রাচীন সভ্যতাকে একটা নূতন সৃষ্টির পথে নিয়ে যাবে, এশিয়া সেই আশায় তাকিয়ে আছে। এবং সমস্ত বাধা কাটিয়ে পাছে চিন নিজের বৈশ্যমন্ত্রে জাপানের মতোই সিদ্ধিলাভ করে সেই আতঙ্কে ইউরোপ মাঝে মাঝে চার দিক হলদে দেখছে।
আমাদের ভারতবর্ষে এ বৈশ্য-তন্ত্রের খাস তালুক। কেননা এ মহাদেশ ইউরোপের সেই দেশের অধীন রাজ্য যেখানে বৈশা-তন্ত্রের মূর্তি সবচেয়ে প্রকট, আর বৈশ্য-প্ৰভুত্বের মহিমা সবচেয়ে উঁচু। এবং ‘কনস্টিটিউশন্যাল ল’র পুথিতে যাই থাকুক আমরা সবাই জানি ব্রিটেনের বৈশ্যােরাজই আমাদের রাজা। স্বভাবতই প্ৰজার জাতির চোখে উন্নতি মানে রাজার জাতির মতো হওয়া। সেইজন্য আমাদের দুঃখ, দৈন্য, দুর্দশার কথা যখনই ভাবি তখন সহজেই মনে হয় এর প্রতিকারের উপায ভারতবর্ষকে বিলাতের মতো বড় বড় কারখানায় ভরে ফেলা; দেশের লোককে গ্রামের মাটি থেকে উপড়ে এনে শহরের কলে জুড়ে দেওয়া। এবং সেজন্য সর্বপ্রথম দরকার সকলে মিলে বৈশাকে দেশের মাথায় তোলা যাতে যার-ই মগজে বুদ্ধি আর মনে উৎসাহ আছে তার দু’চোখ এদিকে পড়ে। আমাদের সরকারি বে-সরকারি রাজপুরুষেরাও ভারতবর্ষের যে-জাতি বৈশ্যামহিমা যতটা আয়ত্ত করেছে তাকে ততটা উন্নত বলে স্বীকার ও প্রচার করেন। এবং আমাদের বড়-ছোেটর প্রমাণ যে তাদের হাতের মাপকাঠি সে কথা বলাই বাহুল্য।
বাধ্য হয়েই স্বীকার করতে হবে যে এ মাপে বাঙালির উন্নতির বহর বড় বেশি নয়। আরব সমুদ্রের তীরের দুই-একটি জাতির কাছে তো আমরা দাঁড়াতেই পারি না। এমনকী যাঁরা বাংলার বাইরে থেকে কেবল পাগড়ি কি টুপি নিয়ে এসে বাংলার বুকের উপর দিয়ে মোটর হঁহাকাচ্ছেন, তাদের পাশেও আমরা নিতান্ত খাটো। আমাদের নিত্য দুঃখ-দৈন্যের চাপিটা যখনই কোনও নৈমিত্তিক কারণে একটু বেড়ে ওঠে তখনই এই ব্যাপার নিয়ে আমাদের আন্দোলন, আলোচনা, ধিক্কার, অনুশোচনার সীমা থাকে না। কলেজ-ফেরত বাঙালির ছেলে নিরক্ষর অ-বাঙালির ব্যবসায়ে কেরানিগিরির উমেদার, এই উদাহরণ তুলে আমরা বাঙালির মতি গতি এবং সর্বোপরি আমাদের বিদ্যালয়, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার দুরবস্থা স্মরণ করে যুগপৎ ক্রুদ্ধ ও ক্ষুব্ধ হয়ে উঠি। এ শিক্ষা যে কেবল ব্যৰ্থ নয়, উন্নতির পথে পায়ে শিকল তাতে আর সন্দেহ থাকে না। কেননা শিক্ষিত বাঙালির চেয়ে যে নিরক্ষর দিল্লিওয়ালা শ্রেষ্ঠ এর পরিচয় তো একের মোটরকার ও অন্যের ছেড়া জুতোতেই সুপ্রকাশ। কিন্তু বাঙালির মনের এমনই মোহ যে এর প্রতিকারে কেউ স্কুল কলেজ তুলে দেবার উপদেশ দেয় না। প্রস্তাব হয় এগুলিতে অন্যরকম শিক্ষা দেওয়া হোক। শিল্পবিদ্যালয় ও কারবার শেখার স্কুলে দেশটা ভরে ফেলা যাক। অথচ সকলেই জানি মোটরবিহারী দিল্লিওয়ালা কি শিল্প, কি সওদাগরি কোনও স্কুলেই কোনওদিন পড়েনি।
জার্মানযুদ্ধ আরম্ভ হবার পর থেকে পৃথিবী-জোড়া দুরবস্থার সঙ্গে সঙ্গে আমাদের বাংলাদেশের অবস্থা অতি সংকটের জায়গায় এসে পৌছেছে। এ সংকট যে কত বড়, আর আমাদের দারিদ্র্যের ব্যাধি যে কত প্ৰবল তা আমরা এর যে-সব বিষ-চিকিৎসার ব্যবস্থা দিচ্ছি। তা দেখলেই বোঝা যায়। আচাৰ্য প্রফুল্লচন্দ্র তার উচ্চশিক্ষিত ছাত্রদের উপদেশ দিচ্ছেন, ‘সবাই মাড়োয়ারি হও; আর উপায় নেই।’ এ কথা বেরিয়েছে তার মুখ থেকে যার সমস্ত জীবন বৈশ্যত্বের একটা প্ৰতিবাদ। ধনের গৌরব ও ক্ষমতার মোহ যার কাছে প্রলোভনের জিনিসই নয়। যাঁর নৈষ্ঠিক ব্ৰহ্মচৰ্য আর ঋষির তপস্যা বিংশ শতাব্দীর ব্রিটিশ ভারতবর্ষেও জ্ঞানের তপোবন ও শিষ্যের মণ্ডলী গড়ে তুলেছে। যিনি বিদ্যা ও প্রতিভা দিয়েছেন দেশের সেবায়, নিজেকে লোপ করে। এ যুগে যিনি কারখানা গড়ে তুলেছেন নিজের পকেট নয় দেশের মুখ চেয়ে। আর ‘মাড়োয়ারি হওয়া’ ব্যাপারটি কী তা গেল-যুদ্ধের টানে সবার সামনে বে-আবু হয়েই দেখা দিয়েছে। মাড়োয়ারিগিরি হচ্ছে ইউরোপীয় বৈশ্যত্বের কবন্ধ। ইউরোপের বৈশ্য পৃথিবীই লুট করুক, আর দেশের মাথায়ই চড়ে বসুক, দেশকে সে ঠিকই অন্ন জোগাচ্ছে। আজকের ইউরোপের ধনসৃষ্টির সে যে মূল উৎস তাতে সন্দেহ করা চলে না। কিন্তু মাড়োয়ারিগিরি ধনসৃষ্টির পথ দিয়েই হাঁটে না। ব্যাবসা-বাণিজ্যের ওই উত্তমাঙ্গটি তার নেই। তার কাজ হল বিদেশের তৈরি জিনিস চড়া দরে দেশের মধ্যে চালানো, আর দেশের উৎপন্ন ধন সস্তা দরে বিদেশির হাতে তুলে দেওয়া। এবং এই হাত বদলানোর কারবার থেকে যত বেশি সম্ভব দেশের ধন, যার সৃষ্টিতে তার কড়ে আঙুলেরও সাহায্য নেই, নিজের হাতে জমা করা। সেজন্য যে তীব্ৰ লোভ ও একাগ্র স্বার্থপরতা দরকার তার নাম ব্যাবসা-বুদ্ধি। এ ব্যাবসা-বুদ্ধি যে কত বড় নির্লজ্জ আর কতদূর হৃদয়হীন গেল-যুদ্ধের সময় পৃথিবীর সব দেশে তা প্রমাণ হয়েছে। দেশের নিতান্ত দুৰ্দশা ও সংকটের সময়ও দেশ-জোড়া দুরবস্থার ভিত্তির উপর নিজের ধনের ইমারত গড়ে তুলতে কোনও দেশের কোনও বৈশ্য কিছুমাত্র গ্লানি বোধ করেনি। এবং এক রাজদণ্ডের শাসন ছাড়া এদের নিষ্ঠুরতা আর কোনও কিছুরই বাধা মানেনি।
ধনসৃষ্টির সঙ্গে নিঃসম্পর্ক সওদাগরি ইউরোপেও যথেষ্টই আছে। কিন্তু সেখানে সেটা ধন উৎপাদন ও ধন বিতরণের আনুষঙ্গিক উপদ্রব। আর মাড়োয়ারিগিরি হল নিছক উপদ্ৰব। উৎপাত এটা যেমন হাস্যকর তেমনি সংকটজনক। দেশের কৃষক নিরন্ন বলে স্বল্পমূল্যে তার শ্রমের ফল হতে জমা করে দেশের লোক নিরুপায় বলে চড়া দামে তা বিক্রি করার মধ্যে কোথায় যে দেশের ধনবৃদ্ধি ও উপকার আছে তা অর্থ-নীতিশাস্ত্রের মহামহোপাধ্যায়েরাও আবিষ্কার করতে পারবেন না। আর গলা যদি নেহাতই কাটা যায়। তবে ছুরিটা বাঙালির না হয়ে অ-বাঙালির এতে এমনকী ক্ষুব্ধ হবার কারণ আছে। সম্ভাবনাটা সুদূর, কিন্তু যদি সত্যই বাংলার গোটা শিক্ষিত-সমাজটা ‘মাড়োয়ারি’ই হয়ে ওঠে। তবে নিশ্চয় জানি আচাৰ্য প্রফুল্লচন্দ্ৰই সবার আগে বলবেন এর চেয়ে বাঙালিজাতির না খেয়ে মরাই ভাল ছিল।
৬
ইউরোপের বৈশ্যত্ব বাংলার মাটিতে ভাল ফলেনি। অথচ ইউরোপের সঙ্গে বাঙালির পরিচয় ভারতবর্ষের সব জাতির চেয়েই বেশি। বাংলার বাইরে বাঙালি তো একরকম খ্রিস্টান বলেই পরিচিত। কথা এই যে, যে ইউরোপের সঙ্গে বাঙালির নাড়ির যোগ সেটা বৈশ্য ইউরোপ নয়, ব্ৰাহ্মণ ইউরোপ। কল-কবজ ও ব্যাবসা-বাণিজ্যের আধুনিক ইউরোপ ছাড়াও আর একটা আধুনিক ইউরোপ আছে, যে ইউরোপ প্রাচীন গ্রিক সভ্যতার উত্তরাধিকারী, যে আধুনিক ইউরোপ মানুষের মনকে মুক্তি দিয়েছে, জ্ঞানের দৃষ্টি যেমন সূক্ষ্ম তেমনি উদার করেছে। যার কাব্য, সাহিত্য, কলা, দর্শন, বিজ্ঞান, মানুষের সভ্যতার ভাণ্ডার জ্ঞান, সত্য, সৌন্দর্যে ভরে দিয়েছে। এই ইউরোপের আনন্দলোকই বাঙালির মন হরণ করেছে, কলের ধোঁয়ায় কালো ইউরোপ নয়। সেইজন্য বাংলার মাটিতে এখনও জামসেটজি তাতা জন্মোনি, কিন্তু বাংলাদেশ রামমোহন ও রবীন্দ্রনাথের জন্মভূমি। এখনও বড় কলওয়ালা কি ভারী সওদাগরের আমরা নাম করতে পারিনে, কিন্তু জগদীশ বসু ও প্রফুল্লচন্দ্র বাঙালি জাতির মধ্যেই জন্মেছেন। বাঙালির নাড়িতে পশ্চিম থেকে প্রাচীন ভারতীয় আর্য ও মধ্যযুগের মুসলমান সভ্যতা, দক্ষিণ থেকে দ্রাবিড় ও পূর্ব থেকে চিন সভ্যতার রক্ত এসে মিশেছে। ইউরোপীয় আৰ্য-সভ্যতার বিদ্যুৎস্পর্শে যদি এই অপূর্ব প্রয়াগ-ভূমিতে আমরা একটি অক্ষয় নূতন সভ্যতা গড়ে তুলে মানবজাতিকে দান করতে পারি। তবেই আধুনিক বাঙালি জাতির জন্ম সার্থক। না হলে আমরা পায়ে হেঁটে চলি কি মোটরগাড়িতে দৌড়াই, তাতে কিছুই আসে যায় না। কিন্তু এ সার্থকতার জন্য ইউরোপের যে উৎস থেকে জ্ঞান ও সৌন্দৰ্য উৎসারিত হচ্ছে তা থেকে চোখ ফিরিয়ে যেখানে তার কারখানায় মাল তৈরি হচ্ছে সেখানে দু’চোখ বদ্ধ করে রাখলে চলবে না; বাঙালির মাড়োয়ারি হওয়া একেবারেই পোষাবে না।
বাঙালিকে অবশ্য আগে বাঁচতে হবে। কিন্তু সেজন্য চাই নূতন ধন সৃষ্টি করা, দেশের অন্নকে বহু করা। বেদের ঋষি অন্নের সৃষ্টির জন্য নিজের হাতে হাল ধরেছেন। আজ পৃথিবীর সেই দিন এসেছে। যখন অন্নসৃষ্টির ভার কেবল বৈশ্য বহন করতে পারে না। তার ব্ৰাহ্মণের সাহায্য চাই। এই সাহায্য বাঙালির জ্ঞান-বিজ্ঞান ভারতবর্ষকে দান করবে। যার চোখ আছে তিনিই এর আরম্ভ দেখতে পেয়েছেন। বৈশ্যত্বের নামে নয়, এই ব্ৰাহ্মণত্বের নামে ডাক দিলে তবেই নবীন বাঙালির সাড়া পাওয়া যাবে। এই ব্ৰাহ্মণত্বের ছায়ায় বাংলাদেশে এমন বৈশ্যত্ব গড়ে উঠুক। যার হাতে ধন দেখে কি শাস্ত্রকার কি দেশের লোক কেউ ভীত হবে না। যে বৈশ্য প্রাচীন সংহিতার অনুশাসন মত ‘ধৰ্ম্মেণ চ দ্রব্যবৃদ্ধাবাতিষ্ঠেদ যত্নমুত্তমম্, ধর্মানুসারে দ্রব্যবৃদ্ধির জন্য উত্তম যত্ন করবে; দদ্যাচ্চ সৰ্ব্বভূতানামন্নমেব প্ৰযত্নতঃ, এবং অতি যত্নে সৰ্বভুতকে পর্যাপ্ত অন্ন দান করবে।
শ্রাবণ ১৩২৭