০৫. বেচারা বিজয়বাবু

বেচারা বিজয়বাবু। সাতে নেই, পাঁচে নেই, নিতান্ত ভলোমানুস, আজ এ কী বিপদেই পড়েছেন! বেলা ন”টা থেকে ‘বাণী বনে’ লোকের পর লোক আসছে। জয়ন্তীর উদ্যোগীরা, পরীক্ষিৎবাবুর সাহিত্যিক ভক্তরা, খবরের কাগজের লোকেরা, কলকাতার গণ্যমান্য ব্যক্তিরা – কেউ বাদ নেই। সবাই এসে জানতে চায় ব্যাপার কী! ব্যাপার কী, তা কি বিজয়বাবুই জানেন! ছোকরার দল আর নড়ে না, তারা প্রাণপণে চেঁচামেচি করছে, আর নিমাইকে ফরমায়েশ করে বার বার চা খাচ্ছে। দু একজন এমন কথাও বলেছে যে বিজয়বাবুই দাদাকে সরিয়েছেন, হয়তো আরও কিছু খারাপ কাজ করেছেন; কারণ, কে না জানে, পরীক্ষিৎ মজুমদার তাঁর উইলে এই ভাইকেই সমস্ত সম্পত্তি দিয়ে গেছেন। ঘোরতর কলরব করতে করতে তারা বলছে – “শিগগিরি বার করে দিন ওঁকে, নয়তো আপনাকে আস্ত রাখবো না।” নিজের সম্বন্ধে নানারকম বিশেষণ বিজয়বাবুর কানে পৌঁছচ্ছে, যা মোটেই সুশ্রাব্য নয়। ভদ্রলোকের অবস্থা প্রায় কাঁদো কাঁদো। একে তো এই বিপদ, তার উপর এই অত্যাচার। তিনি বসে বসে ভাবতে লাগলেন, দাদা অজ্ঞাতবাস করুন আর নাই করুন, তাঁকে অবিলম্বে কোনো গোপন জায়গায় পালাতে হবে, নয়তো প্রাণেই বাঁচবেন না। এই একা বাড়িতে আজকের দিনটাও যে তিনি কাটাতে পারবেন, এমন মনে হল না।

দুপুরের দিকে নিতান্ত অবসন্ন হয়ে তিনি মহিমবাবুকেই ফোন করলেন। এ বিপদে মহিমবাবু ছাড়া আর বন্ধু কে? মহিমবাবু বাড়িতে ছিলেন না, ‘হরকরা’র আপিসে তাঁকে পাওয়া গেল।
“দাদা, প্রাণ তো বেরিয়ে গেল।”
মহিমবাবু বললেন, “বুঝেছি। আমার আপিসেওও সেই অবস্থা। লোকের পর লোক, ফোনের পর ফোন। কী আর করবে – সইতে হবে। আমার ফটোগ্রাফারও গিয়েছিল, তোমার ছবি তুলে এনেছে।”
“ছবি! ছবি কেন?”
“তুমি কিছুই বোঝ না, বিজয়। ‘হরকরা’য় ছাপা হবে ছবি – বিকেলে একটা এডিশন বেরুচ্ছে। সমস্ত দেশ খবরের জন্য হাঁ করে রযেছে, তা তো বোঝো? এখনও আছে লোক?”
“কয়েকটা ছোকরা এখনও বসে আছে। আমি আর নীচে নামছি না। এ বড়িতে আমার আর থাকা পোষাবে না।”
“কী যে বল! এত বড় একজন লোকের ভাই হওয়া কি সোজা কথা! তোমার সঙ্গে দেখা করতে, তোমার সঙ্গে কথা বলতে কত লোক আসবে – আর তুমি পালিয়ে যাবে – তা কি হয়?”
“ছোঁড়ারা বলছে কি জানেন? দাদাকে দাকে নাকি আমিই…”
“ওঃ, ও-রকম কত কথাই বেরুবে! ওতে কান দিলে কি চলে?”
“তা ওদের যে রকম মেজাজ দেখছি, এক সময় হয়তো আমাকে মারধোরই করবে! তাহলে?”

মহিমবাবু হেসে বললেন, “তুমি বড্ড ভীরু, তুমি বড্ড ভীরু!”
“ভীরু বলুন আর যাই বলুন, আমার একটুও ভালো লাগছে না আর।”
“আচ্ছা, আচ্ছা, রাত্রিতে না হয় চঞ্চলকে পাঠিয়ে দেব। হ্যাঁ, শোন – এত লোক যে এসেছিল, তার মধ্যে উপেন ধরকে দেখেছিলে?”
“কই না!”
“তবেই তো দেখেছ? উপেন ধর যদি নির্দোষ হত তাহলে নিশ্চয়ই আসত।”
“তাও তো বটে!”
“উপেন ধর যে আসেনি, তাও তুমি লক্ষ কর নি? নাঃ, বিজয় তোমাকে নিয়ে মুশকিলেই পড়া গেছে… আচ্ছা, রেখে দিচ্ছি। যখন যা দরকার, জানিও।”

ফোন রেখে দিয়ে মহিমবাবু কলম তুলে নিলেন।।‘হরকরা’র একটা বৈকালিক এডিশন বেরোবে, তার জন্যে একটা সম্পাদকীয় প্রবন্ধ লিখছিলেন। আজ দিনটা তিনি বড়ব্যস্ত; সকাল থেকে বহু লোক এসেছে আপিসে, সকলের সঙ্গেই দেখা করেছেন, দু চারটা করে কথাও বলতে হয়েছে। সকলের মুখেই উদ্বেগের দুশ্চিন্তার ছায়া। মফস্বল থেকে জয়ন্তীর যে সব ডেলিগেট এসেছেন, তাঁদের মধ্যে কয়েকজন কিছু উষ্মাও প্রকাশ করে গেছেন। রেলভাড়া খরচ করে এসেছেন, হোটেল খরচা করে আছেন, আর এখন কিনা নাটকের নায়কই উধাও! এ কী কাণ্ড! দেশের লোক নিয়ে তামাশা করা হচ্ছে নাকি! মহিমবাবু সকলকেই যথাসম্ভব সান্ত্বনা দিয়েছেন, পরামর্শ করে স্থির হয়েছে, কাল সকালের মধ্যে কোনো খবর যদি না পাওয়া যায়, তাহলে জয়ন্তীর তারিখ অনির্দিষ্টভাবে পেছিয়ে দিতে হবে। তা ছাড়া আর উপায়ই বা কী!

মহিমবাবু বলে রেখেছিলেন, চঞ্চল আপিসে এলেই যেন তাঁর কাছে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। একটার মিনিট পাঁচেক পরে চঞ্চল তাঁর কমরায় এসে ঢুকল। মহিমবাবু তখন প্রবন্ধ শেষ করে সেদিনকার অন্যান্য কাগজগুলোর উপর চোখ বুলোচ্ছিলেন।
“বোসো চঞ্চল।”
উপরিওয়ালা হিসেবে মহিমবাবু সত্যি ভালো। তাঁর চাকুরেদের সকলকে বসতে বলেন, এমন কি তিনি যখন কোনো কাজে কারও টেবিলের ধারে যান, কেউ যেন উঠে না দাঁড়ায় এই হল এ আপিসের নিয়ম।
“এটা একটু পড়ে দ্যাখ তো,” তাঁর সদ্যলিখিত প্রবন্ধটা এগিয়ে দিলেন চঞ্চলের দিকে।
মিনিট দশেক পরে মুখের সামনে থেকে সেদিনের ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ’ নামিয়ে বললেন, “পড়লে?”
“পড়লুম।”
“কেমন হয়েছে?”
“বেশ ভলো।”
“আমাকে খাতির করে বলছ?”

চঞ্চল লজ্জিত হয়ে বললে, “না, না, সত্যি খুব ভলো লীডার হয়েছে। আপনি তাহলে মনে করেন, বৃন্দাবন গুপ্তেরই এই কাজ? এই যে লিখেছেন – “গত ত্রিশ বৎসর ধরিয়া যে বিষাক্ত শত্রুতা, যে দুঃসহ নির্যাতন, সাহিত্য জগতের উপদ্রবসদৃশ কতিপয় ব্যক্তির কুটিল চক্রান্তপ্রসূত যে লাঞ্ছনা পরীক্ষিৎবাবু ভোগ করিয়া আসিতেছেন, আজ বুঝি তাহারই চরম পরিণতি দেখিতে পাইলাম। তাঁহার এই আকস্মিক অন্তর্ধান, যাহা সমগ্র দেশবাসীর পক্ষে মর্ম বিদারক, তাহা যদি কাহারও মুখে পাশবিক হাস্য ফুটাইয়া থাকে, সে বা তাহারা শুধু পরীক্ষিৎবাবুরই শত্রু নয়, তাহারা সাহিত্যের শত্রু, সমাজের শত্রু, স্বদেশের শত্রু, তাহাদের পশুত্ব প্রকাশিত ও দণ্ডিত করা প্রত্যেক সত্যপরায়ণ ব্যক্তিরই কর্তব্য।”“

নিজের রচনার অংশ শুনে মহিমবাবু গম্ভীর হয়ে রইলেন, কিছু বললেন না। চঞ্চল বললে, “একটু বেশি কড়া হয়ে গেছে না?”
“কড়া? তুমি বলছ কি চঞ্চল! এ তো কিছুই হয় নি। নেহাৎই আইন বাঁচিয়ে লিখতে হয় বলে, নয়তো দেখতে।”
“আপনার কি মনে হয়, বৃন্দাবন গুপ্ত ক্রাইম করতে পরে?”
“শুধু করতে পরে না, অনেক করেছে। তুমি সেদিনের ছেলে – তুমি আর ওর কথা কী জান।”
“তাহলে আপনি কি নিশ্চিন্ত জানেন যে, এটা ওরই কাজ?”
“নিশ্চয় করে কি আর বলা যায়? তবে হ্যাঁ – কিছু যোগাযোগ থাকা থাকা খুবই সম্ভব।”
চঞ্চল উত্তেজিতভাবে বললে, “তবে তো বৃন্দানবাবুকেই সকলের আগে অ্যারেস্ট করা দরকার।”
“তা হয়তো পুলিশ করেওছে এতক্ষণে। ব্যস্ত হয়ো না, বসো। ইন্সপেক্টর রণজিৎ সামন্ত এক্ষুণি আসবেন – তোমার সঙ্গে একটু কথা বলবেন। ততক্ষণে একটু চা খওয়া যাক।”

মহিমবাবু প্রায় ঘণ্টায় ঘণ্টায় চা খান, বাড়ির মতো আপিসেও তাঁর চাযের সরঞ্জাম সর্বদাই প্রস্তুত। কয়েক মিনিটের মধ্যেই চা এল। চায়ে চুমুক দিযে মহিমবাবু বললেন, “কাল কখন মেস-এ ফিরলে?”
“কাল আর ফিরলুম কোথায়, আজ সকালে ফিরেছি।”
মহিমবাবু একটু হেসে বললেন, “বেশ কাজের ছেলে তুমি, চঞ্চল। জীবনে তোমার উন্নতি হবে।”

চঞ্চল লজ্জিত হয়ে চায়ের পেয়ালায় নাক ডুবিয়ে রইল।
“তা, এ ব্যাপারটার তুমি কিছু করতে পার কিনা দ্যাখ না।”
“কোন ব্যাপারটা?”
“এই পরীক্ষিতের ব্যাপারটা।”
চঞ্চল অবাক হয়ে বললে, “এর আমি কী করব?”
“আমি ভাবছিলুম কী – ব্যাপারটা পুলিশের হাতে ছেড়ে দিয়ে তো নিশ্চিত থাকা যায় না।”
“না থেকে উপায়ই বা কী?”
“হ্যাঁ, পুলিশ যা করবার তা তো করছেই। কিন্তু তোমাকে সত্যি বলছি, ওদের উপর আমার ঠিক ভরসা হয় না। আমরা নিজেরা কিছু চেষ্টা করলে দোষ কী? এই ধর, তুমি। তোমার বুদ্ধি আছে, সাহস আছে, কোনো কাজেই তুমি পেছ পা নও। ধর, তুমি যদি এটা নিয়ে উঠে পড়ে লাগো?”

মহিমবাবুর কথা শুনতে শুনতে চঞ্চলের মনে বিরাট একটা অ্যাডভেঞ্চারের কল্পনা ফুটে উঠল। এতবড় একটা রহস্যের সমাধান তাকে দিয়ে হবে এ-কথা ভাবতেই রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল সে। অসম্ভব শোনায়, কিন্তু কে জানে – হয়তো তাই হবে। খুব বিনীত সুরে সে বললে, “আপনি আমাকে কী করতে বলেন?”
কিন্তু মহিমবাবু এ প্রশ্নের জবাব দেবার আগেই একজন বেয়ারা ঢুকে খবর দিলে যে লালবাজার থেকে ইন্সপেক্টর সায়েব এসেছেন।
“তাঁকে আসতে বল।”
রণজিৎবাবু ঘরে ঢুকতেই মহিমবাবু বললেন, “এই যে – এই আমার বিখ্যাত সাব-এডিটর চঞ্চল নাগ। আর ইনি ইন্সপেক্টর রণজিৎ সামন্ত।”
রণজিৎবাবু বললেন, “এতো একেবারে ছেলেমানুষ দেখছি!”
“ছেলেমানুষ কিন্তু কাজের মানুষ।”

চঞ্চল মাথা নিচু করে চুপ করে রইল। ইন্সপেক্টর তাকে কালকের ঘটনা সম্বন্ধে কয়েকটা প্রশ্ন করলেন, পকেট থেকে নোট বই বের করে তার উত্তরগুলো মিলিয়ে নিলেন।
“ঠিক আছে। তারপর আর কী খবর?”
“খবর তো আপনার কাছে।”
রণজিৎবাবু বললেন, “আমাদের নিযমমাফিক খোঁজ খবর সবই নিয়েছি। পরীক্ষিৎবাবুর ড্রাইভার যা বলেছে তাতে ভুল নেই।”
“কেন, ড্রাইভারকেও আপনারা সন্দেহ করেছিলেন নাকি?”
যতক্ষণ উল্তোটা প্রমাণিত না হয়, সকলকেই সন্দেহ করতে হয়।”

মহিমবাবু একটু ঠাট্টার সুরেই বললেন, “সন্দেহ যত খুশি লোককে করুন, তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু কাজ কিছু এগিয়েছে কি?”
“সেন্ট্রাল এভিনিউর এ. বি. সি. গারাজ বলেছে, কাল রাত প্রায় সাড়ে আটটায় পরীক্ষিত্টবাবুর গাড়ির একটা টায়ার তারা বদলে দিয়েছে। ড্রাইভারের সই করা ভাউচারও দেখাল। গড়ির ব্রেকডাউন হয়েছিল ইডেন গার্ডেনের সামনে, এ. এ. বি-র সাহায্য নিয়ে গাড়িটাকে এ. বি. সি. গারাজে নিযে যাওয়া হয় – এ. এ. বি-র লোক যা বলল তার সঙ্গে ড্রাইভারের কথায় কোনো গরমিল নেই।”
“তাহলে কাঞ্চা সন্দেহমুক্ত হল। তারপর?”
“তারপর ঐ নিমাই -”
মহিমবাবু দু-হাত শূন্যে তুলে বললেন, “রক্ষে করুন! নিমাইকে সন্দেহ!”
“লোকটার অত বেশি কান্নাকাটি দেখেই আমার কেমন কেমন লাগছিল। কিন্তু ওর বিরুদ্ধেও কোনো এভিডেন্স আছে বলে মনে হয় না।”
“বাঁচালেন মশাই। নিমাইকে সন্দেহ করলে আমাকেও করতে পারেন।”

এ সব ঠাট্টা একটুও গায়ে না মেখে রণজিৎবাবু বলতে লাগলেন, “তারপর বৃন্দাবন গুপ্তর কথা।”
“হ্যাঁ, হ্যাঁ, তার কী করলেন?
“তাকে অ্যারেস্ট করেছি।”
“অ্যারেস্ট করেছেন?”
“হ্যাঁ, করেছি। কিন্তু করে বিশেষ লাভ হবে বলে মনে হয় না। অমন দুর্দান্ত লেখক, কিছু চেহারা দেখে দয়া হয়। একে তো ভয়ানক বেঁটে, তার উপর এমন রোগা যে, লোকটা আছে কি নেই অনেক কষ্টে ঠাহর করতে হয় -”
“বলেন কী! আপনিও দেখছি সাহিত্যিক হয়ে উঠলেন!”
“সাহিত্যিকের পাল্লায় পড়ে হয়তো ও রোগে ধরেছে। কেঁদে কেটে অস্থির ভদ্রলোক। আমার পায়ে ধরতে বাকি রেখেছেন। “আমি এর কিছুই জানি নে, আমি এর কিছুই জানি নে।” কেবল এ কথা বলেন আর ফোঁসফোঁস কাঁদেন।”
“ভারি মজর ব্যাপার তো।”
“হ্যাঁ, ব্যাপারটা একটু মজারই হয়েছিল। ভিজিটিং কার্ড মিলিয়ে দেখলুম – এটা ওঁরই কার্ড বটে, জাল নয়।”
“না, না, জাল তো নয়ই।”
“জাল যে নয়ই আমরা তা বলব না, যতক্ষণ প্রমাণ না পাই, তবে আপনার কথা আলাদা। সাহিত্য জগতের নাড়িনক্ষত্রের খবর রাখেন আপনি।”
মহিমবাবু বিনীতভাবে বললেন, “না না, সে রকম কিছু নয়। খবরের কাগজের লাইনে থাকলে নানা লোকের নানা জিনিস জেনে ফেলতেই হয়, সে জন্য চেষ্টা করতে হয় না।”
“কার্ডের কথায় বৃন্দাবনবাবু একেবারে ডুকরে কেঁদে উঠলেন। “ও নিশ্চয়ই আমার কোনো শত্রুর কাজ, আমি দশ বছরের মধ্যেও প্রিন্সেপ ঘাটে যাই নি, কাল আটটার সময় আমি সিনেমায় ছিলুম – এই দেখুন টিকেটের কাউণ্টার ফয়েল।”“
“তা উনি নিজে গিয়েছিলেন, তা তো কেউ বলছে না। লোক লগিয়েছিলেন। এবং সে লোক সম্ভবত উপেন ধর।”
“বাঃ, আপনি দেখছি সমস্ত জিনিসটাই চমৎকার ভেবে রেখেছেন।”

মহিমবাবু গম্ভীরভাবে বললেন, “আমি ডিটেকটিভ নই, কমন সেন্স থেকে বলছি। চঞ্চলকে জিগ্যেস করুন না, উপেন ধরকে ওরা দেখেছিল কিনা।”
“হ্যাঁ, সে কথা তো শুনেছি। যাই হোক, বৃন্দাবনবাবুকে তো হাজতে এনে রেখেছি। কষ্টই হচ্ছে ভদ্রলোকের জন্য।”
“আপনারা পুলিশের লোক, আপনাদের বলে দেওয়া বাহুল্য যে অনেক ডেঞ্জারাস ক্রিমিনাল দেখতে ও রকম হাবাগোবা গোবেচারা হয়।”
“তা ঠিক, চেহারা দেখে ক্রিমিনাল চিনতে পারলে তো আর কথাই ছিল না। তবে এভিডেন্স হিসেবে একটা ভিজিটিং কার্ড অবশ্য কিছুই নয়। যে কোনো লোকের কার্ড খুব সহজেই যোগাড় করা যায়, তারপর জায়গা বুঝে ফেলে রাখলেই হল।”
“ঠিক ঐ তারিখে ঐ জায়গায় এত লোক থাকতে, বৃন্দাবন গুপ্তেরই কার্ড কে ওখানে ফেলে রাখতে যাবে? আর তার উদ্দেশ্যই বা কী হতে পরে?”

রণজিৎবাবু একটু চুপ করে তেকে বললেন, “হ্যাঁ, সন্দেহের যথেষ্ট কারণ আছে বইকি। সে জন্যই তো অ্যারেস্ট করা হল। কিন্তু দু চারকিনের মধ্যে আরও এভিডেন্স যদি না পাওয়া যায় তবে বোধহয় ছেড়েই দিতে হবে।”
“চেষ্টা করলে এভিডেন্সের অভাব হবে বলে মনে হয় না।”
“চেষ্টার ত্রুটি হবে না। কিন্তু আসল লোকটিকে ধরা গেল না, মহিমবাবু।”
“কে সে?”
“উপেন ধর। তার হোটেলের ঠিকানায় খুঁজে নিয়ে দেখলুম, কাল থেকে সেও ফেরার। নানা জায়গায় খোঁজা হল, লোকটার পাত্তাই নেই।”

মহিমবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “তাহলে উপেনবাবুর উপর খুব গভীরভাবেই সন্দেহ পড়ছে। কিন্তু ও পালাবে কোথায়? ওকে পাকড়াও করতে হবে, রণজিৎবাবু।”
“অনেকগুলো চর তো লাগিয়ে দিয়েছি – আর নানা জায়গার রেলওয়ে পুলিশও খবর পেয়ে গেছে। লুকিয়ে তাকে থাকতে হবে না।”
“না না, উপেন ধরকে চাই-ই। বৃন্দাবন অতি ঘোড়েল লোক, তার কাছ থেকে কিছু বের করা শক্ত হবে, কিন্তু উপেনটা একটা ল্যাগব্যাগে সং। ওকে দুই ধমক দিলেই সব বেরিয়ে আসবে। আঃ, পালিয়ে গেল লোকটা।”
“উপেন ধরের খোঁজে লালবিহারী মালাকারের ওখানেও গিয়েছিলুম।”
“গিয়েছিলেন? বেশ করেছিলেন। তবে লালবিহারীবাবুর সঙ্গে উপেন ধরের কোনো যোগাযোগ এখন আর নেই। আলাদা কোম্পানি করেছে, তাই নিয়েই ঘোরাঘুরি করেছিল। তা, লালবিহারীবাবু কিছু বললেন?”
“বললেন – তিনি যে পুরস্কার ঘোষণা করেছেন, তার টাকাটা আরও বাড়িয়ে দিতে পারেন, যদি তাতে কোনও কাজ হয়।”
“আহা – এ কাজ সবাই নিজের গরজেই করবে, এর জন্য কি আর পুরস্কার ঘোষণার দরকার করে। তবে এদেশে এত বড়লোক থাকতে, ওঁরই এদিকে মন গেল – লোকটি মহা সদাশয় বটে।”
“সুন্দর বাড়িটি লালবিহারীবাবুর। পয়সা যেমন আছে, ভোগ করতে জানে। বাড়ির গৃহপ্রবেশের সময় আপনার কাগজে ছবি দেখেছিলুম, আজ আসল বাড়িটি দেখে চোখ ধন্য হল।”

মহিমবাবু হেসে বললেন, “ব্যবসা ছাড়া কোনো দিকেই লালবিহারীবাবুর মন ছিল না। এখন যে সাহিত্যে টাহিত্যে একটু আধটু উৎসাহ হয়ছে তার কারণ আমিই। পরীক্ষিৎবাবুকে দু একদিন নিয়েও গিয়েছি তাঁর বাড়িতে। এ সব কারণেই এ ব্যাপারে তাঁর এতখানি গরজ দেখছেন।”
রণজিৎবাবু বললেন, “হ্যাঁ, তাই দেখছি।”

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *