০২.৩ অধ্যক্ষ প্রচার – দ্বিতীয় অধিকরণ (অধ্যায় ২৪-৩৬)

চতুৰ্বিবংশ অধ্যায়
৪১শ প্রকরণ-সীতাধ্যক্ষ বা কৃষিকৰ্ম্মাধ্যক্ষ

কৃষিশাস্ত্র, শুল্কশাস্ত্র (ভূমির সিরাসমূহ বিষয়ক শাস্ত্র), বৃক্ষের আয়ুৰ্বেদশাস্ত্র স্বয়ং উত্তমরূপে জানিয়া কিংবা তৎ তৎ শাস্ত্রে অভিজ্ঞ ব্যক্তিগণের সহায়তা লইয়া, সীতাধ্যক্ষ (রাজকীয় কৃষিকৰ্ম্মাধ্যক্ষ) সর্বপ্রকার ধান্য, পুষ্প, ফল, শাক, কন্দ, মূল, বাল্লিক্য (কুষ্মাণ্ড প্রভৃতি বলীজাত ফল), ক্ষৌম ও কার্পাসের বীজ যথাসময়ে সংগ্রহ করিবেন।

তিনি (সীতাধ্যক্ষ) বহু হলদ্বারা পরিকৃষ্ট নিজ (বা সরকারী) ভূমিতে (মতান্তরে, সেই সেই বীজের উপযোগপ্রাপ্ত ভূমিতে)। উক্ত বীজসমূহ দাস (ক্রীতদাসাদি), কৰ্ম্মকর (বেতনভোগী কৰ্ম্মকর) ও কৰ্ম্মম্বারা দণ্ডনিস্ক্রয়কারী পুরুষগণদ্বারা বপন করাইবেন।

(সীতাধ্যক্ষ) এই সব দাসাদিকে ভূমিকৰ্ষণের (হলদি) যন্ত্রপাতি, (অন্যান্য রজ্জুপ্রভৃতি) উপকরণ ও বলীবৰ্দের সঙ্গে সংসর্গ (অর্থাৎ এগুলির রক্ষাভার) হইতে নিবারিত রাখিবেন। সেইরূপ কারু, কৰ্ম্মার (লৌহকার), কুট্টাক (তক্ষা), মেদক (খনক; ভেদক-পাঠ সঙ্গততর), রজ্জুবৰ্ত্তক (রজ্জুনিৰ্ম্মাণকারী) ও সৰ্পগ্রহদিগের (সৰ্পগ্রহণকারীদিগের) সহিতও (ইহাদিগকে) সংসৃষ্ট রাখিবেন না।

(কারু প্রভৃতির) দোষে কৃষিকৰ্ম্মের যে ফলহানি ঘটিবে, সেই হাপিত (নাশিত) ফলের পরিমাণানুসারে তাহাদের প্রতি অর্থদণ্ড বিহিত হইবে।

(শস্যনিষ্পত্তির উপযোগী বৃষ্টিপাতের পরিমাণ নিরূপিত হইতেছে।) জাঙ্গল বা মরুপ্ৰায় দেশ সম্বন্ধে (বর্ধমানার্থক কুম্ভে) ষোড়শ দ্ৰোণ-পরিমিত বর্ষণজল জমা হইলে, ইহাই শস্যনিম্পাদনে পৰ্য্যাপ্ত বর্ষণের সূচনা বলিয়া পরিগণিত হইবে। অনুপ বা জলপ্ৰায় প্রদেশ সম্বন্ধে ইহায় দেড়গুণ অর্থাৎ ২৪ দ্ৰোণ বর্ষা পৰ্য্যাপ্ত বলিয়া গৃহীত হইবে। কোন কোন দেশে। কতখানি বর্ষা হইলে ফসল পৰ্যাপ্ত হইবে তাহা বলা হইতেছে,-অশ্বক-দেশে (মহারাষ্ট্র প্রদেশে) ১৩ই দ্রোণ ও অবন্তী-দেশে ২৩ দ্ৰোণ বর্ষপ্রমাণ বলিয়া গৃহীত। অপরান্ত-প্রদেশে (কঙ্কণ-নামক পাশ্চাত্ত্যদেশে) অপরিমিত বর্ষার প্রয়োজন; হিমবৎ-প্রদেশে ও যে-সব দেশে কুল্য বা খালদ্বারা আনীত জলদ্বারা কৃষিকৰ্ম্ম সাধিত হয় সে-সব দেশে স্বস্বকালের উচিত। বর্ষণদ্বারা শস্য-নিম্পত্তি ঘটে।

বর্ষণের চারি মাসের অর্থাৎ শ্রাবণ, ভাদ্র, আশ্বিন ও কাত্তিকের মধ্যে প্রথম মাস (অর্থাৎ শ্রাবণ) ও চরম মাস (অর্থাৎ কাত্তিক)—এই উভয় মাসে (উক্ত দেশসমূহের পক্ষে বৰ্ণিত পৰ্য্যাপ্ত) বর্ষণপরিমাণের ঐ অংশ ও মধ্যম দুই মাসে (অর্থাৎ ভাদ্র ও আশ্বিন মাসে) ঔ অংশ পাওয়া গেলেই (বর্ষণ-সম্বন্ধে) সংবৎসর শোভন বলিয়া পরিজ্ঞাত হইতে পারে।

বর্ষণজনিত সু-সংবৎসরের উপলব্ধি হয় বৃহস্পতি গ্রহের স্থান (মেষাদিরাশিতে অবস্থান), গমন (তদন্যরাশিতে সংক্রমণ) ও গর্ভাধান (অর্থাৎ বৃহস্পতির। গীতির ফলে অগ্রহায়ণ প্রভৃতি মাসে তুষারপাত প্রভৃতি) হইতে, শুক্রগ্রহের উদয়, অস্ত ও চার (অর্থাৎ আষাঢ় মাসের পঞ্চমী প্রভৃতি নয়টি তিথিতে ইহার সঞ্চার) হইতে এবং সূৰ্য্যের প্রকৃতি বা স্বভাবের (মণ্ডলবেষ্টনাদিরূপ) বিকৃতি বা অন্যথাভাব হইতে।

বর্ণিতরূপ সূৰ্য্য হইতে শস্যের বীজনিম্পত্তি, বর্ণিতরূপ বৃহস্পতি হইতে শস্যের স্তম্ব বৰ্দ্ধন, এবং বণিতরূপ শুক্র হইতে বৃষ্টি অনুমিত হইতে পারে।

যদি তিন মেঘ (বর্ষা-বাদল) সপ্তাহ-কাল পৰ্য্যন্ত অবিচ্ছিন্নভাবে বর্ষণ করে। অর্থাৎ এইভাবে সপ্তাহকাল পৰ্য্যন্ত যদি তিন বার বর্ষণ হয়), এবং যদি অশীতি বার মেঘ সান্দ্র-বিন্দুবষী হয়, এবং ষষ্টি বার আতপযুক্ত মেঘ বর্ষণ করে, তাহা হইলে এইরূপ বৃষ্টিই সম (অর্থাৎ অনূর্ধন ও অনতিরিক্ত) বলিয়া লোকহিতকর হইবে ॥ ১।৷

যে স্থানে (মেঘ বা পর্জ্জন্য) বায়ু ও আতপকে পৃথক করিয়া বিভক্ত করিয়া অর্থাৎ বায়ু ও রৌদ্রকে নিজ নিজ কাৰ্য্য করিতে অবসর দিয়া এবং (ভূমিতে) তিন বার কর্ষণের অবসর উৎপাদনা করিয়া বর্ষণ করে, সেই স্থানে শস্যাগমনিশ্চিত। ২।৷

তৎপর (অর্থাৎ যথোক্ত বর্ষণপ্রমাণ অবগত হইয়া, সীতাধ্যক্ষ) প্রচুর জলদ্বারা নিম্পাদ্য ও অল্প জলদ্বারা নিম্পাদ্য শস্য বপন করাইবেন।

শালি, ব্রীহি (ধান্যাদি), কোন্দ্রব্য, তিল, প্রিয়ঙ্গু, দারক ও বরক-এই সাত প্রকার শস্যের বীজ বর্ষার পূর্ব্বভাগে বপন করিতে হয়। মুদগ, মাষ ও শৈম্ব (শিম্ব বা শিম প্রভৃতি)-এই তিন প্রকার শস্যের বীজ বর্ষার মধ্যভাগে বপন করিতে হয়। আর, কুসুম্ভ, মনুর, কুলুখ, যব, গোধুম, কলায়, অতসী ও সর্ষপ-এই আট প্রকার শস্যের বীজ বর্ষার শেষভাগে বপন করিতে হয়।

অথবা, উক্ত শস্যাদির বীজ বপন তৎতৎ, বীজের সম্যক নিম্পত্তির উপযোগী ঋতু অনুসারেও করা যাইতে পারে।

যে ক্ষেত্রে বপন করা হইয়াছে তদাতিরিক্ত ক্ষেত্রে অর্ধসীতিকেরা (অর্থাৎ যাহারা ফসলের অৰ্দ্ধভাগ নেওয়ার স্বীকারে বপন করে তাহার) বপনকাৰ্যভার লাইতে পারিবে। অথবা যাহারা (স্বামিসম্বন্ধীয় বীজাদি লইয়া) কেবল স্বশরীরের আয়াসমাত্ৰিদ্বারা উপজীবিকা অজ্জন করে, তাহারা ফসলের ১/৪ বা ১/৫ অংশ স্বীকার করিয়া বপন্যাদি কাৰ্য্য করিতে পারে। (উক্ত বপনকারীরা) ফসলের অনিৰ্দ্ধারিত অংশও স্বামীর ইচ্ছানুসারে তাহাকে দিতে পারে, কিন্তু, তাহাদের কোনও কষ্ট উপস্থিত হইলে এই প্রকার ব্যবস্থা না-ও করা যাইতে পারে।

(শাস্ত্রানুসারে রাঙ্গাই ভূমি ও জলের অধিপতি, তাই রাজপ্ৰাপ্য ভূমিকরের ন্যায়। জলকরাও কৃষকদিগকে দিতে হয়। সম্প্রতি সেই জলকর নির্ণীত হইতেছে, যথা)-কৃষকেরা নিজ পরিশ্রমে নিম্পাদিত (তড়াগাদি) সেতু হইতে (কুম্ভাদি ভরিয়া) হস্তে বহনপূর্ব্বক জল নিয়া কৃষিকৰ্ম্ম করিলে সেই জলব্যবহার-জন্য (রাজাকে) ১/৫ অংশ দিবে, স্কন্ধে বহনপূর্ব্বক জল নিয়া কৃষিকৰ্ম্ম করিলে ১/৪ অংশ, দিবে, এবং স্রোতযন্ত্র অর্থাৎ খাল প্রভৃতি জলসারণী হইতে জল নিয়া কৃষিকৰ্ম্ম করিলে ফসলের ১/৩ অংশ দিবে।

(স্বসেতুভিন্ন অন্য) নদী, সরোবর, তড়াগ ও কূপ হইতে (অরঘাটাদি ধূম্রদ্বারা) জল ব্যবহার করিয়া কৃষিকৰ্ম্ম করিলে (কৃষকেরা) (রাজাকে) ফসলের ১/৪ অংশ দিনে।

(সীতাধ্যক্ষ) কৃষিকৰ্ম্মে অপেক্ষিত জলের (প্ৰাচুৰ্য্য ও অপ্ৰাচুৰ্য্য) অনুসারে কেদারক্ষেত্রে বাপ্য, হেমন্তকালে বাপ্য, কিংবা গ্ৰীষ্মকালে বাপা, শস্য বাপিত কৱিবেন।

(সর্বপ্রকার ফসলের মধ্যে) শালিধান্যাদির ফসল উত্তম (ইহাতে অল্প আয়াস ও ব্যয় হয়-ফল অধিক)। কদলী প্রভৃতি যণ্ডের ফসল মধ্যম। ইক্ষুর ফসল অধম। কারণ, ইহার বিপন্যাদিতে নানাপ্রকার বিন্ন (মনুষ্য ও মূষিকাদির উপদ্রব) আছে ও ইহা অত্যন্ত ব্যয়সাধ্য।

(কুষ্মাণ্ডাদি) বল্পীফলের উত্তম বাপদেশ হুইল জলেরা পৰ্য্যন্তদেশ, যাহাতে জলের ফেন আঘাত করে। পিপ্পলী, মৃন্ধীক (আঙ্গুর) ও ইক্ষুর উত্তম বপনস্থান হইল জলের পরিবাহ বা উচ্ছাসের পরিসর-প্রদেশ। শাক ও মূলের উত্তম বাপস্থান কূপপার্শ্বস্থ ভূমিভাগ। হরিতক বা সবজীর ফসলের উত্তম স্থান হইল হরণি বা কুল্যাদির পর্যন্তপ্রদেশ (মতান্তরে, হরণি তড়াগাদির রিক্তভূত অৰ্দ্ধপ্রদেশ)। পালি বা ক্ষেত্রমধ্যস্থিত সেতু বা জলবন্ধ হইল ছেদনযোগ্য গন্ধ, ভৈষজ্য, উশীর, হীবের (বালাখ্য গন্ধদ্রব্য বিশেষ) ও পিণ্ডালুক (কচাল প্রভৃতি রোমকান্দ) প্রভৃতির উত্তম বপনস্থান। (সীতাধ্যক্ষ) স্ব স্ব যোগ্য ভূমিতে স্থলপ্ররোহিণী ও জলপ্ৰায়প্রদেশপ্ররোহিণী ওষধি স্থাপিত বা বাপিত করিবেন।

(ক্ষেত্রে বপনযোগ্য বীজসমূহের সংস্কারপ্রথা নির্দ্দিষ্ট হইতেছে।) ধন্যবীজসমূহের সাতদিবস পৰ্য্যন্ত তুষার-পায়ন (অর্থাৎ রাত্রিতে তুষার পানের জন্য রক্ষণ) ও উষ্ণশোষণ (অর্থাৎ দিবাভাগে রৌদ্রে রক্ষণ) করিতে হইবে। কোশীধান্যসমূহেরও (মুদ্রগামাষাদির বীজেরও) তিন দিন বা পাঁচ দিন পৰ্য্যন্ত এই কাৰ্য্য (অর্থাৎ তুষার-পায়ন ও উষ্ণশোষণ) করিতে হইবে। (ইক্ষু প্রভৃতি) কাণ্ডবীজের (অর্থাৎ ষাঁহাদের টুকরাগুলি বপন করিতে হয়) ছিন্নপ্রদেশগুলিতে মধু, ঘুত ও শূকরের বাসা (চকবী) গোময়যুক্ত করিয়া লেপন করিতে হয়। (সূরণাদি) কন্দগুলির ছেদলেপ কেবল মধু ও ঘৃতদ্দ্বারা করিতে হয়। (কার্পাসাদি) অস্থিবীজসমূহে গােময়দ্বারা লেপ দিতে হয়। (আত্ম-পনসাদি) বৃক্ষের বীজনিবেশগৰ্ত্তে তৃণাদিদ্বারা দাহ বা উষ্ণতা দিতে হয় এবং যথার্থ সময়ে (অর্থাৎ পুষ্পফলাদির প্রসব সময়ে)। গরুর অস্থি ও গোময়দ্বারা দোহাদ দিতে হয়।

উক্ত সর্বপ্রকার বীজ যখন অঙ্কুরিত হইবে, তখন সেগুলিকে মহি-নামক ওষধির ক্ষীরের সহিত মিশ্ৰিত করিয়া আর্দ্র ক্ষুদ্র মৎস্যদ্বারা সেচন করিতে হয়।

কার্পাসবীজের সার ও সৰ্পের নিৰ্ম্মেক (সৰ্পত্নক) একসঙ্গে করিয়া ধূপিত করিতে হইবে। এই সম্মিলিত উভয়বিধ দ্রব্যের (ধূপনজনিত) ধূম যেখানে থাকিবে সেখানে কোন সৰ্প থাকিতে পারে না।৷ ৩।৷

সর্বপ্রকার বীজেরই প্রথম বপন সময়ে, ইহার প্রথম বীজমুষ্টি স্বর্ণ সংযুক্তজলদ্বারা সিক্ত করিয়া বপন করিতে হয়। নিম্নবৰ্ত্তী মন্ত্রও তৎসঙ্গে পাঠ করিতে হয়, যথা—

 প্রজাপতি, কাশ্যপ (সূৰ্য্যপুত্র) ও (পর্জ্জন্য)। দেবকে সর্বদা নমস্কার জানাইতেছি। সীতাদেবী (কৃষির অধিষ্ঠাত্রী দেবীর নাম এখানে ‘সীতা’ বলিয়া ধ্ৰুত হইয়াছে।) আমার বীজ ও ধনসমূহের বৃদ্ধি বিধান করূন।৷ ৪।৷

(সীতাধ্যক্ষ) ষণ্ডবাট-পালক, গো-পালক, দাস ও অন্যান্য কৰ্ম্মকরের জন্য প্রত্যেক পুরুষের পরিশ্রমের অনুরূপ ভক্ত বা ভোজন দানের ব্যবস্থা করিবেন। এবং (তিনি) তাহাদের বেতন-জন্য প্রত্যেককে প্রতিমাসে ১.২৫ পণ দিবেন। (তিনি) প্রত্যেকের কৰ্ম্মানুসারে, কারুদিগকে (তক্ষণদিকে) ভক্ত (ভোজন) ও বেতন (মাসিক নগদ মাহিনী) দিবার ব্যবস্থা করিবেন। দেবকাৰ্য্যের জন্য (বৃক্ষ হইতে স্বয়ং) পতিত পুষ্প ও ফল, এবং নবশস্য-নামক ইষ্টির (নবান্নক্রিয়ার) উদ্দেশ্যে (স্বয়ং পতিত) ব্রীহি ও যব শ্রোত্রিয় ব্ৰাহ্মণের ও তপস্বীরা আহরণ করিতে পারিবেন। আর যাহারা উদ্ভাবৃত্তি করিয়া জীবিকা চালান তাহারা (খলনিবেশিত) ধান্যসমূহের সমীপগত কণিশাদি সংগ্রহ করিতে পারিবেন।

চতুর (অর্থাৎ অর্থসঞ্চয়বিধানজন্তু) ব্যক্তি যথাসময়ে সমূৎপন্ন সর্বপ্রকার শস্যাদি (রক্ষণস্থানে) প্রবেশ করাইবেন এবং তেমন চতুর ব্যক্তি কখনই পলাল (বা তুষা) পৰ্য্যন্ত ক্ষেত্রে রাখিবেন না।৷ ৫।৷

প্রকর বা ধান্যনিবেশস্থান (গোল) সমূচ্ছিত অৰ্থাৎ উচ্চ করিয়া তৈয়ার করাইতে হইবে। এই গৃহগুলির শিরোদেশ যেন পরস্পর সংশ্লিষ্ট না হয় এবং তুচ্ছাকার (অর্থাৎ প্রচণ্ড বায়ু প্রভৃতিদ্বারা অপহারযোগ্য) না হয়—সেদিকে দৃষ্টি রাখিতে হইবে ॥ ৬।৷

মণ্ডলের সমীপে (অর্থাৎ যে স্থানে বালীবদ্দক মণ্ডলভ্বমণ করিয়া স্তম্বধান্যের বিশ্লেষণ করে তৎসমীপেই) খল-প্রকর (অর্থাৎ ধান্য মাড়িবার খামারসমূহ) নিৰ্ম্মিত করা হইবে। যাহারা খালে কৰ্ম্মকর তাহাদের নিকট অগ্নি থাকিবে না।“ বরং তাহারা সঙ্গে সঙ্গে জল রাখিবে (যেন অগ্নিীদাহ উপস্থিত হইলে অগ্নিপ্রশমার্থ তাহারা সেই জল ব্যবহার করিতে পারে)। ৭।৷

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্ৰে অধ্যক্ষপ্রচার-নামক দ্বিতীয় অধিকরণে সীতাধ্যক্ষ-নামক চতুর্বিংশ অধ্যায় (আদি হইতে ৪৫ অধ্যায়) সমাপ্ত।

.

পঞ্চবিংশ অধ্যায়
8২শ প্রকরণ-সুরাধ্যক্ষ

সুরাধ্যক্ষ দুৰ্গে, জনপদে বা স্কন্ধাকরে (সেনানিবেশস্থানে) সুরা ও তৎকিন্থের (সুরাবীজের) ব্যবহার বা ব্যাপার, তৎকৰ্ম্মকুলে উৎপন্ন নিপুণ সুরা ও কিশ্বব্যবহারিগণদ্বারা করাইবেন এবং এই ব্যাপার তিনি একমুখভাবে (অর্থাৎ একস্থানে দ্রব্য রাখিয়া কেন্দ্রীকরণহিসাবে), বা বহুমুখভাবে (অর্থাৎ অনেক স্থানে দ্রব্য রাখিয়া বিকেন্দ্রীকরণহিসাবে) চালাইবেন, অথবা, ক্রয় ও বিক্রয়ের অবস্থা বুঝিয়া অন্যতরভাবে বা উভয়ভাবেও চালাইতে পারেন। নির্দ্দিষ্ট স্থানের অতিরিক্ত স্থানে (সুরা ও কিশ্বের) উৎপাদনকারী, ক্রয়কারী ও বিক্রয়কারীদিগের উপর ৬০০ পণ দণ্ড বিহিত হইবে। (তিনটি কারণে) সুরাধ্যক্ষকে পৰ্য্যবেক্ষণ করিতে হইবে যেন গ্রাম হইতে সুরা (অর্থাৎ সুরামত্ত ব্যক্তিগণ) বাহিরে নিঃস্থত না হইতে পারে এবং গৃহ হইতে গৃহস্তরে বা জনাকীর্ণ স্থানে যাইতে না পারে-ইহার প্রথম কারণ এই যে, এইরূপ ব্যবস্থা না থাকিলে তৎতৎকৰ্ম্মে নিযুক্ত ব্যক্তিগণের প্রমাদে বা অনবধানতায় পতিত হইবার ভয় হইতে পারে; দ্বিতীয় কারণ, ধৰ্য্যজনদিগের মৰ্য্যাদা অতিক্রান্ত হইবার ভয় হইতে পারে; তৃতীয় কারণ, তীক্ষ্ম (কঠোরস্বভাব শূরা)-গণের (অনুচিত কাৰ্য্যে) উৎসাহ (, শস্ত্রাদিপ্রয়োগসম্বন্ধে) বাড়িয়া যাইবার ভয়ও হইতে পারে।

(রাজমুদ্রাদিদ্বারা) চিহ্নিত অল্প পরিমাণ সুরা, যথা—১/৪ কুড়ব, ১/২ কুডুবে বা ১ কুড়ুব, অথবা ১/২ প্রস্থ বা ১ প্রস্থ পরিমাণ তাহারাই (বাহিরে) নিত্বে পাব্লিবে যাহাঁদের শৌচ বা শুচিত (সুরাধ্যক্ষেরও) পরিজ্ঞাত আছে।

যাহারা সুরা লইয়া অন্যত্র সঞ্চরণের অনুমতি পাইবে না, এমন লোকেরা (নির্দ্দিষ্ট) পানাগারে বা মদের দোকানে মদ্যপান করিতে পারিবে। (কোন মদ্যপায়ীদ্বারা) নিক্ষেপ, উপনিধি (মুদ্রাযুক্ত ন্যাস), প্রয়োগ (আধি বা বন্ধক) ও (চোরাদিদ্বারা) অপহৃত বা অন্যভাবে প্ৰাপ্ত দ্রব্যসমূহের কিংবা বে-আইনী ভাবে উপগত দ্রব্যসমূহের তত্ত্ব জানিবার অভিপ্ৰায়ে এবং অস্বামিক (বা অনবগতমালিক) কুপ্য দ্রব্য ও হিরণ্য (নগত টাকা) পাইয়া, (মন্তব্যবসায়ী) নিক্ষেপাদি রক্ষাকারীকে (পানাগার হইতে) অন্য কোন স্থানে কোন ছলনায় (সুত্ৰাধ্যক্ষের সহায়তায়) ধরাইয়া দিবে। এবং (পানাগারে) কেহ আয়ের অধিক ব্যয়কারী কিংবা আয়তি বা উত্তরকালের জন্য সঞ্চয় না। রাখিয়া ব্যয়কারী (মদ্যপায়ীকেও) ধরাইয়া দিবে।

অনর্ঘের সৰ্ত্তে (বিনা মূল্যে বা অল্পমূল্যে) ও কালান্তরে দেয় মূল্যের সৰ্ত্তে (সুরাবিক্রয়ী) কাহাকেও উত্তম সুর দিতে পারিবে না, কিন্তু দুষ্ট বা দোষযুক্ত সুরা দিতে পারিবে। সেই দুষ্ট সুরাও (উত্তম সুরা বিক্রয়ের স্থান হইতে) অন্যত্র বিক্রয় করাইতে হইবে। (এই দুষ্ট সুরা) দাস ও (ক্ষুদ্র) কৰ্ম্মকরদিগকে বেতনরূপে (অর্থাৎ বেতনের পরিবর্তে) দেওয়া যাইতে পারে। অথবা, (এই দুষ্ট সুরা) (উদ্ভাদি) বাহন-পশুর পানীয় দ্রব্যরূপে বা শূকরের পোষণার্থ ব্যবহৃত হইতে পারে।

সুরাধ্যক্ষকে তেমন পানাগার প্রস্তুত করাইতে হইবে-যাহাতে অনেক কক্ষ্যা বা কামরা থাকিবে, যাহাতে ভিন্ন ভিন্ন শয্যা ও আসন থাকিবে, যাহাতে পৃথক পানোপযোগী স্থানও থাকিবে, যাহাতে গন্ধদ্রব্য, মাল্য ও জল রক্ষিত থাকিবে এবং যাহা ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে ভোগ্যবস্তুর সমাবেশে সুখকর হইবে।

গূঢ়পুরুষেরা (পানাগারে কৰ্ম্মকরাদিরূপে) অবস্থিত থাকিয়া (মদ্যপায়ীদিগের) বায় প্রকৃতিসিদ্ধ (অর্থাৎ সাধারণ) কিংবা উৎপত্তি-সিদ্ধ (অর্থাৎ অপূর্ব্ব উপায়ে প্ৰাপ্ত)। ইহা জানিয়া লইবে এবং তাহারা আরও জানিবে-কোন আগন্তুক (বিদেশাগত লোক) সেখানে আসিয়াছে কি না।

(এই গূঢ়পুরুষেরা) মদ্যপানে মত্ত হইয়া সুপ্ত ক্ৰেতাদিগের (শরীরে অবস্থিত) অলঙ্কার, আচ্ছাদন ও (সঙ্গে রক্ষিত) হিরণ্য (নগদ টাকা) সম্বন্ধেও তত্ত্ব জানিয়া রাখিবো। সেই (অলঙ্কারাদির) নাশ ঘটিলে, (মদ্যবিক্ৰেত) বৃণিকেরু তাহা পূরণু করিয়া দিতে ও তৎ পরিমিত অর্থদণ্ডও (রাজসরকারের ৈ দিতে বাধ্য থাকিবে।

পৃথক পৃথকৃস্থিত একান্ত কক্ষ্যাগুলিতে যে-সব আগন্তক (বিদেশাগত) ও স্বদেশনিবাসী আৰ্য্যভাবে প্রতীয়মান লোকেরা মদমত্ত অবস্থায় শুইয়া আছে তাহাদের অভিপ্ৰায় মদ্যবণিকেরা নিজ-নিজ রুচিরাকৃতি দাসী দ্বারা অবগত হইবে

মেদক, প্রসন্না, আসব, অরিষ্ট, মৈরেয় ও মধু-এই ছয় প্রকার সুরার নিরূপণ कद्रा झ्छ्रेष्ठCछ।

এক দ্ৰোণ-পরিমিত জল, ১/২ আঢ়ক-পরিমিত তণ্ডুল বা চাউল ও তিন প্রস্থ পরিমিত কিণ্ব (সুরাবীজ)-এই তিন বস্তুর মিশ্রণের নাম মেদকযোগ (অর্থা এই বস্তুগুলি মিলিত হইলে মোদক-নামক সুরা প্রস্তুত হয়)।

১২ আঢ়ক-পরিমিত পিষ্ট (ময়দা বা আটা) ও ৫ প্রস্থ-পরিমিত কিণ্ব বা তৎস্থলে পুত্রক-নামক বৃক্ষের ছাল ও ফলযুক্ত (বক্ষ্যমাণ) জাতিসম্ভার (পাঠালোগ্র প্রভৃতি যোগ) মিশাইয়া প্রসন্নাযোগ (অর্থাৎ প্রসন্না-নামক সুরা) তৈয়ার করা যায়।

১ তুলা (বা ১০০ পল)-পরিমিত কপিখফলসার, ৫ তুলা (বা ৫০০ পল) পরিমিত ফাণিত (কাঁচা ইক্ষুরস = রাব, ইহার নামান্তর) ও ১ প্রস্থ মধু মিশাইয়া আসবযোগ তৈয়ার করা যায়। এই যোগে যদি এক-চতুর্থাংশ কপিখাদির পরিমাণ অধিক করা হয়, তাহা হইলে এই আসবযোগ উত্তম বলিয়া পরিজ্ঞাত হয়, এবং ইহাতে যদি কপিখাদির পরিমাণ এক চতুর্থাংশ কম করা হয়, তাহা হইলে ইহা নিকৃষ্ট আসবযোগ বলিয়া পরিজ্ঞাত হয়।

প্রত্যেক রোগের উপশমের জন্য চিকিৎসকগণ যে ভাবে অরিষ্ট প্রস্তুত করেন সেইভাবেই (অর্থাৎ বৈদ্যাপ্রসিদ্ধ উপায়ে) অরিষ্টযোগ বুঝিতে হইবে।

মেষশৃঙ্গী-নামক বৃক্ষের ছালের কাথদ্বারা আন্দ্রীকৃত ও গুল বা গুড়ের প্রতিবাপ বা মিশ্রণে যদি ত্রিফলার যোগ দেওয়া হয়, কিংবা ত্ৰিফলার স্থলে পিপুল ও মরিচের সম্ভার দেওয়া হয়, তাহা হইলে ইহা মৈরেয়যোগ বলিয়া আখ্যাত হয়। সর্বপ্রকার গুল বা গুড়যুক্ত মন্ধ্যেই ত্রিফলা সম্ভার ব্যবহৃত হইয়া থাকে।

মৃদ্বীকা বা দ্রাক্ষার রস হইতে প্রস্তুত সুরার নাম মধু। এই মধুর উৎপত্তিদেশের নামানুসারে দুইটি আখ্যান (দ্ব্যাখ্যানং পাঠই সমীচীন মনে হয়) বা নাম হয়, যথা-কাপিশায়ন (অর্থাৎ কপিশা-নামক নদীতীরস্থ দেশজাত) ও হারাহূরক (অর্থাৎ হরহূর-নামক নগরে জাত) !

মাষকল্ক হইতে ভাবিত জল, কাঁচাই হউক বা সিদ্ধই হউক, ১ দ্ৰোণ-পরিমিত লইয়া, তাহাতে ১.৩ দ্ৰোণ-পরিমিত তণ্ডুলিপিষ্ট মিশাইয়া এবং তাহাতে ১ কর্ষপরিমিত মোরটাদি বস্তু যোগ করিয়া কিশ্ব-নামক যোগ বা বন্ধ (অর্থাৎ সুরাবীজ) প্রস্তুত করিতে হয়।

মেদক ও প্রসন্না-নামক সুরাতে এক প্রকার সম্ভারযোগ দেওয়া হয় এবং এই যোগ পাঠা (অপর নাম অম্বষ্ট, ইহা এক প্রকার বৃক্ষ), লোগ্র, তেজোবতী (গজপিঙ্গলী), এলা (এলাচী), বালুক, মধুক (মধুৰ্যষ্টি), মধুরূসা (আঙ্গুর, মতান্তরে দূর্ব), প্রিয়ঙ্গু দারুহরিদ্র, মরিচ ও পিপ্পলীর প্রত্যেকটির, চূর্ণ পাঁচ কর্ষ-পরিমিত লইয়া প্রস্তুত করিতে হয়। যদি কটশর্করা মধুকের কন্যায় মুক্ত করিয়া (মেদক ও প্রসন্ন-নামক সুরাতে) মিশ্রিত করা হয়, তাহা হইলে এই উভয় প্রকার সুরার বর্ণ প্রসাদগুণযুক্ত হয় (অর্থাৎ মনোরম হয়)।

আসবসম্ভার (বা আসব-নামক সুরার মসলা) তৈয়ার করিতে হইলে, চোচ (দারুচিনি), চিত্রক, বিড়ঙ্গ ও গজপিপ্পলী এইগুলির প্রত্যেকটি এক কর্ষ পরিমাণ এবং ক্রমুক (গুবাক), মধুক, মুস্তা (মূথা) ও লোঞ-এইগুলির প্রত্যেকটির দুই কর্ষ পরিমাণ লইয়া ইহা (সম্ভার) প্রস্তুত করিতে হয়। যে কোন দ্রব্যের আসিব করিতে হইলে, উক্ত (চোচাদি) দ্রব্যসমূহের ১/১০ ভাগ করিয়া দিলে সেই আসবের বীজবন্ধ প্রস্তুত হইতে পারে।

শ্বেতসুরা-নামক সুরা প্রস্তুত করিতে হইলে প্রসন্না-সুরা প্রস্তুত করার যোগই প্রযুক্ত হইবে (টীিকাকারদিগের মতে, ইহাতে প্রসন্নার সম্ভার ও বীজবন্ধ ব্যবহার করিতে হয় না।)।

(সুরার নিম্নলিখিত প্রকারভেদও হইতে পারে, যথা–(১) সহকার সুরা (অর্থাৎ যে সুরাতে আম্ররস বা আম্রতৈলাদি মিশ্রিত করা হয়), (২) রসোত্তর (অর্থাৎ যে সুরাতে গুড়প্রতিবাপ যোগ করা হয়), (৩) বীজোত্তরা যাহার অপর নাম মহাসুরা (অর্থাৎ যাহাতে বীজবন্ধদ্রব্যের মাত্রার আধিক্য থাকে) ও (৪) সম্ভারিকী (অর্থাৎ যে সুরাতে সম্ভারের মাত্রার আধিক্য থাকে)।

উক্ত সর্বপ্রকার সুরাতে যদি মোরটা (মূলপুম্পিক-নামক বলীভেদ), পলাশ (কিংশুক)–পত্তর (লোহমারক, ইহা এক প্রকার ঔষধ), মেষশৃঙ্গী, করঞ্জ ও ক্ষীরবৃক্ষের (বটাদি বৃক্ষের) কষায়দ্বারা ভাবিত করিয়া দগ্ধ কটশর্করার চুর্ণ, লোগ্র, চিত্রক, বিড়ঙ্গ, পাঠা, মুস্তা, কলিঙ্গ্যীব (কলিঙ্গদেশে উৎপন্ন। যব), দারুহরিদ্রা, ইন্দীবর, শতপুষ্পাপ, অপমাৰ্গ, সপ্তপর্ণ, নিঙ্গ ও আস্ফোতের (বা আস্ফোট বা অর্কবৃক্ষের) কঙ্কের সহিত (সেই শর্করার) অর্ধ পরিমাণ যুক্ত করিয়া, ইহার অদৃশ্যনখমুষ্টিমেয় পরিমাণ এককুম্ভ বা খারী-পরিমিত রাজার পানযোগ্য তৎ তৎ সুরাতে প্রক্ষিপ্ত করা যায়, তাহা হইলে ইহা সুরাগুলিতে প্রসাদ-গুণ আনয়ন করে। (অর্থাৎ সুরাগুলিকে মনোরম করিতে পারে।) এবং যদি ইহাতে পঞ্চপলপরিমিত ফাণিত প্রদত্ত হয়, তাহা হইলে ইহার রস বা স্বাদ বন্ধিত হইতে পারে। কুটুৰী বা গৃহস্থের (বিবাহাদি) গৃহকৃত্যে শ্বেতসুর ও ঔষধের জন্য অরিষ্ট কিংবা অন্যপ্রকার সুরা তৈয়ার (বা ব্যবহার) করিতে পারিবে।

(বসন্তাদি) উৎসবে, (বন্ধুবান্ধবের) সমাজে (বা মিলনে) ও যাত্রাতে (অর্থাৎ ইষ্টদেবতাদির শোভাযাত্রাতে) চারিদিন পৰ্য্যন্ত সুরা ব্যবহারের আদেশ (সুরাধ্যক্ষ) দিতে পারিবেন। (উক্ত উৎসবাদিতে সুরাধ্যক্ষের) অনুমতি না লইয়া যাহারা সুরাপান করিবে তাহাদিগের প্রহবণ বা তুষ্টিভোজনের পরে, (সুরাধ্যক্ষ)। তাহাদিগের নিকট হইতে প্রতিদিনের হিসাবে দণ্ড গ্রহণ করিবেন। (মতান্তরে, রাজকৰ্ম্মকরেরা বিনা অনুমতিতে যে কয়েকদিন মদমত্ত হইয়া কৰ্ম্মহানি উৎপাদনা করিবে, সেই দৈনিক হানি অনুসারে তিনি দণ্ড ব্যবস্থা করিবেন,–এই ব্যাখ্যা)

সুরাপাকাকাৰ্য্যে ও কিণ্বপ্রস্তুতকরণকাৰ্য্যে (তদ-রসে অনভিজ্ঞ) স্ত্রীলোক ও বালকগণকে নিযুক্ত করা উচিত হইবে।

যাহার রাজপণ্য-হিসাবে নহে, কিন্তু নিজের উৎপাদিত পণ্য হিসাবে মদ্য প্রস্তুত করিয়া বিক্রয় করিবে, তাহারা সুরকা (সাধারণ সুরা), মোদক, অরিষ্ট, মধু ফলাম (তাল-নারিকেলাদি ফলের রসদ্বারা নিৰ্ম্মিত সুর) ও অম্লশীধুর (অর্থাৎ গুড় প্রতিবাপ হইতে উৎপাদিত সুরার) জন্য শতকরা পাঁচ পণ করিয়া দণ্ড দিতে বাধ্য হইবে।

(উক্ত শুল্কের অতিরিক্ত) প্রতিদিনের (সুরা) বিক্রয় ও বৈধরণ (তোল ও মাপের জন্য কর।) নিৰ্দ্ধারণ করিয়া (সুরাধ্যক্ষ) (ষোড়শভাগরূপ) মানব্যাজী ও (বিংশতিভাগরূপ) হিরণ্যব্যাজী আদায় করিবেন; কিন্তু, (তিনি) উচিত করই অনুবর্তন করিবেন (অর্থাৎ স্বেচ্ছায় কর ধাৰ্য্য করিবেন না)। ১।৷

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্ৰে অধ্যক্ষপ্রচার-নামক দ্বিতীয় অধিকরণে সুরাধ্যক্ষ-নামক পঞ্চবিংশতি অধ্যায় (আদি হইতে ৪৬ অধ্যায়।) সমাপ্ত।

.

ষড়বিংশ অধ্যায়
৪৩শ প্রকরণ-সূনাধ্যক্ষ

যে-সব মৃগ, পশু, পক্ষী ও মৎস্য রাজার আদেশে অভয়লাভের পাত্র বলিয়া উদঘোষিত এবং রাজকীয় সর্বাতিথিবনে (মতান্তরে, ঋষিদিগের ব্রহ্মসোমারণ্যে) বাস করে-সেগুলিকে যাহারা বন্ধন করিবে, প্রহার করিবে ও তাহাদের প্রতি মারণাদি হিংসা প্রদৰ্শন করিবে, সুনাধ্যক্ষ (প্রাণিবধস্থানে অধিকৃত রাজপুরুষ) তাহাদিগকে উত্তম সাহস দণ্ডে দণ্ডিত করাইবেন। (কিন্তু) কুটুম্বভারণশীল গৃহস্থ্যগণ যদি অভয়াবনে স্থিত মৃগাদিবিষয়ে বন্ধন, বধ ও হিংসার আচরণ করে, তাহা হইলে (সুনাধ্যক্ষ)। তাহাদিগকে মধ্যম সাহস দণ্ড দেওয়াইবেন।

যে-সব মৎস্য ও পক্ষী (আক্রমণকারীর প্রতি) হননাদিতে প্রবৃত্ত হয় না, সে-সব মৎস্য ও পক্ষীর বন্ধ, বধ ও হিংসার জন্য (তিনি) অপরাধী ব্যক্তির প্রতি ২৬.৭৫ পণ দণ্ড বিধান করিবেন, এবং তদ্রুপ মৃগ ও পশুর বন্ধ, বধ ও হিংসার জন্য অপরাধী ব্যক্তির প্রতি ইহার দ্বিগুণ (অর্থাৎ ৫৩.৫ পণ্য) দণ্ড বিধান করিবেন।

ঘাতকের প্রতি হিংসায় প্রবৃত্ত, (কিন্তু) অস্বামিক বা অরক্ষিতবনগত পশুদিগের হত্যাকারী হইতে (সুনাধ্যক্ষ) মারিত পশুর ষষ্ঠভাগ রাজাদেয় বলিয়া গ্রহণ করিবেন। (এইরূপ অবস্থায় মারিত পশুর বা ধূত) মৎস্য ওপক্ষিগণ হইতে (তিনি) দশম অংশ বা তদধিক এবং মৃগ ও পশুগণ হইতেও (তিনি) দশম অংশ বা তদাধিক রাজাদেয় শুল্করূপে গ্রহণ করিবেন।

(বনগৃহীত) জীবন্ত পক্ষী ও মৃগসমূহ হইতে ইহার ষষ্ঠভাগ (মৃগাধ্যক্ষ) অভয়াবনে ছড়াইয়া দিবেন।

(কোন কোন প্ৰাণীকে রক্ষা করিতে হইবে তাহার নিরূপণ করা হইতেছে।) হস্তী, অশ্ব, পুরুষ (মানব), বৃষ ও গর্দভের আকৃতিধারী সমুদ্রজাত মৎস্য (জলচর প্রাণিবিশেষ) এবং সরোবরে, নদীতে, তাড়াগে ও কুল্যাতে (খালে) উদ্ভূত মৎস্য; এবং ক্ৰৌঞ্চ, উৎক্রোশক (কুরর), দাতুত্যুহ (জলকাকবিশেষ), হংস, চক্রবাক, জীবঞ্জীবক, ভৃঙ্গরাজ (মোরগের মত পক্ষিবিশেষ, চকোর, মত্তকোকিল, ময়ুর, শুক (তোতা বা টিয়াজাতীয় পক্ষিবিশেষ) ও মদনশারিকা (মত্ত ময়না)-এই সব বিহার বা ক্রীড়ার্থ পক্ষিসমূহ; এবং অন্যান্য প্রকারের মঙ্গল্য (মঙ্গলসূচক) প্ৰাণী-উ-পক্ষিই হউক, বা মৃগ হউক,-এই সব প্ৰাণিবৰ্গকে হিংস (মারণ) ও আবাধ (তাড়নাদি ক্লেশ) হইতে রক্ষা করিতে হইবে। এই রক্ষাকৰ্ম্মের অতিক্রম লক্ষিত হইলে (সুনাধ্যক্ষকে?) প্রথম সাহস দণ্ড দিতে হইবে।

(বাজারে) অস্থিশূন্য অভিনব মৃগ ও পশুর মাংস বিক্রয় করা যাইবে। যদি বিক্রীত মাংসে অস্থি থাকে, তাহা হইলে বিক্রয়কারীকে অস্থি-পরিমিত মাংস (অস্থির পরিবৰ্ত্তে) পূরণ করিয়া দিতে হইবে। ওজনে কাহাকেও মাংস কম দেওয়া হইলে, বিক্রেতাকে হীনমাংসের আটগুণ দণ্ডরূপে দিতে হইবে (প্রাচীন টীকাকারের মতে, এই ক্ষতিপূরণাৰ্থ মাংস হইতে অষ্টমাংস ক্রেতা পাইবেন এবং অবশিষ্ট সাতভাগ সুনাধ্যক্ষকে দিতে হইবে)।

(মৃগপশুদিগের মধ্যে) বৎস, বীর্যসেচনকারী পুংগবাদি ও ধেনু কখনও কেহ বধ করিতে পারিবে না। ইহাদিগের হননকারীকে ৫০ পণ দণ্ড দিতে হইবে। ক্লেশ দিয়া কেহ (এই পশুগুলিকে) ঘাতিত করিলে, তাহাকেও ৫০ পণ দণ্ড দিতে হইবে।

যে মাংস সুনাতে (রাজকীয় পশুবধিস্থানে) মারিত পশুর মাংস নহে, মস্তক, পাদ ও অস্থিৰিহীন পশুর মাংস, দুৰ্গন্ধযুক্ত মাংস ও (রোগাদি বশত:) স্বয়ংমুত পশুর মাংস তাহা (বাজারে) বিক্রয় করা যাইবে না। ইহার ব্যতিক্রম হইলে অপরাধীর প্রতি ১২ পণ দণ্ড বিহিত হইবে।

অভয়বনে, সঞ্চারী হিংস্র পশু, মৃগ, ও (ব্যাঘ্রাদি) ব্যালজন্তু এবং মৎস্য, রক্ষাস্থান হইতে বহির্গত হইয়া অন্যত্র গেলে, বন্ধ (প্রহারাদি) ও বন্ধন প্ৰাপ্ত হইতে পারে। ১।৷

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রে অধ্যক্ষপ্রচার-নামক দ্বিতীয় অধিকরণে স্বনাধ্যক্ষ-নামক ষড়বিংশ অধ্যায় (আদি হইতে ৪৭ আধ্যায়।) সমাপ্ত।

.

সপ্তবিংশ অধ্যায়
৪৪শ প্রকরণ-গণিকাধ্যক্ষ

গণিকাধ্যক্ষ-নামক রাজকীয় অধিকারী গণিকা বংশে উৎপন্ন, অথবা অ-গণিকা বংশে উৎপন্ন রূপবতী ও যৌবনবতী ও (গীতবাদিত্ৰাদি) কলাসম্পন্ন কামিনীকে (প্রতিবর্ষে)। ১০০০ পণ বেতনে (রাজকুলের) গণিকারূপে নিযুক্ত করিবেন। (তিনি) অন্যত্র একজন প্রতি গণিকাকেও নিযুক্ত করিতে পারেন, তবে রাজপরিচর্য্যারূপ কাৰ্য্য সে (প্রতিগণিকা) নিজে অৰ্দ্ধাটুকু করিবে এবং (পূর্ব্ব নিযুক্ত গণিকা) অবশিষ্ট অৰ্দ্ধাংশ করিবে—এইরূপ করণীয়-বিভাগ (তাহাকে) করিয়া দিতে হইবে। (এইস্থলে কুটুম্ব শব্দের অর্থ নিৰ্দিষ্ট কৰ্ত্তব্যকরণ)।

কোন গণিকা যদি কাৰ্য্য ছাড়িয়া চলিয়া যায়, বা মারা যায়, তাহা হইলে তাহার কন্যা বা ভগিনী তাহার কাৰ্য্যভার গ্রহণ করিবে (এবং তৎত্যাজ্য সম্পত্তিও গ্রহণ করিবে)। অথবা, সেই গণিকার মাতা অপর একজনকে প্রতিগণিকারূপে স্থাপন করিবে। তাহাদের অভাবে (অর্থাৎ কন্যা, ভগিনী বা মাতৃনিযুক্ত প্রতিগণিকা না থাকিলে) রাজাই (গণিকাধন) হস্তগত করিবেন।

(গণিকাধ্যক্ষ গণিকার) সৌভাগ্য (পুরুষাকর্ষণে মনোরমতা) ও তদীয় অলঙ্কারবৃদ্ধির আনুগুণ্যে, এত সহস্ব পণ দেওয়ার ক্রমে, কনিষ্ঠ, মধ্যম ও উত্তম শ্রেণীতে বিভক্ত করিবেন (অর্থাৎ কনিষ্ঠাকে এক সহস্ব, মধ্যমাকে দুই সহস্ব ও উত্তমাকে তিন সহস্ব পণ বেতন দিবেন)।

(গণিকাধ্যক্ষ) তাহাদিগকে শোভার উৎকর্ষজন্য (রাজার) ছত্র ও ভৃঙ্গার, ব্যজন ও শিবিকা, পীঠিকা (রাজার বসিবার বিশিষ্ট আসন) ও রথ-সম্বন্ধী কৰ্ম্মকরণে (অর্থাৎ তৎতৎদ্রব্য বহনাদি ক্রিয়াতে সেবার্থ) নিযুক্ত করিবেন।

(গণিকার) রূপযৌবনাদির স্থিতিজন্য সৌভাগ্যের ভঙ্গ হইলে (অর্থাৎ তাহার রূপ ও যৌবনের বয়স অতিক্রান্ত হইয়া গেলে) (গণিকাধ্যক্ষ)। তাহাকে (পরবৰ্ত্তিনী ভোগ্য গণিকার) মাতৃস্থানীয়া করিয়া রাখিতে পারেন (অর্থাৎ পরবৰ্ত্তিনী গণিকা তাহার শিক্ষাধীন থাকিবে, এইভাবে রাজকুলে তাহাকে মাতৃকার পদ দেওয়া যাইতে পারে)।

গণিকা যদি রাজসেবা হইতে মুক্তি চাহে, তাহা হইলে তাহাকে ২৪০০০ পণ নিষ্ক্রয় (মুক্তিমূল্য) দিতে হইবে। গণিকাপুত্র ১২০০০ পণ নিষ্ক্রয় দিলে দাস্যতা হইতে মুক্ত হইতে পারিবে। (নিক্রয় না দিতে পারিলে), গণিকাপুত্র আট বৎসর। পৰ্য্যন্ত (রাজকুলে) কুশীলবের (বা চারণের) কৰ্ম্ম করিবে (তৎপর তাহার দাস্যমুক্তি)।

ভোগার্হ বয়ঃক্রম অপক্রান্ত হইলে গণিকার দাসী (পরিচারিক) (রাজার) কোষ্ঠীগারে বা মহানসে (রন্ধনশালায়) কৰ্ম্ম করিতে পারিবে। যদি সে এইরূপ কাজে প্রবেশ না করে অথচ সে যদি অন্য কোন পুকষকর্তৃক (ভোগার্থ স্বগৃহে) রক্ষিত হয়, তাহা হইলে সে (যাহার দাসী সেই গণিকাকে, মতান্তরে, রাজাকে অর্থাৎ রাজসরকারে) মাসিক ১.২৫ পণ দিতে বাধ্য থাকিবে।

(গণিকাধ্যক্ষ) গণিকার ভোগ (ভোক্তার নিকট হইতে প্ৰাপ্ত ধন), দায় (মাতৃকুলক্রমে আগত ধন), আয় (ভোগাতিরিক্ত ধনাগম), ব্যয় ও আয়তি (উত্তরকালে সংস্থান) এই সব বিষয় নিবন্ধপুস্তকস্থ রাখিবেন। আর গণিকার অত্যধিক ব্যয় নিবারণ করিবেন।

মাতার হাতে না রাখিয়া আভরণ রক্ষার জন্য অন্যত্র ন্যন্ত করিলে, (গণিকাকে) ৪.২৫ পণ দণ্ড দিতে হইবে। (বস্ত্রভাজনাদিরূপ অন্যান্য) দ্রব্যসম্পত্তি বিক্রয় করিলে বা বন্ধক রাখিলে তাকাকে ৫০.২৫ পণ দণ্ড দিতে হইবে।

বাকপিারুন্যের অপরাধ হইলে (অর্থাৎ কাহারও প্রতি কঠোর বা কুৎসিত বাক্য প্রয়োগ করিলে) (গণিকাকে) ২৪ পণ দণ্ড দিতে হইবে। দণ্ডপারুষ্যের অপরাধ হইলে (অর্থাৎ কাহাকেও করপাদ বা দণ্ডাদিদ্বারা তাড়না করিলে) তাহাকে উক্ত দণ্ডের দ্বিগুণ অর্থাৎ ৪৮ পণ দণ্ড দিতে হইবে। সে যদি কাহারও কৰ্ণ ছেদন করিয়া ফেলে, তাহা হইলে তাহাকে ৫০.২৫ পণ এবং আরও ১/২ পণ ও ঐ পণ, অর্থাৎ ৫১.৭৫ পণ দিতে হইবে।

যে পুরুষ কোন কুমারীর উপর তাহার ইচ্ছার বিরুেন্ধে বলাৎকার করিবে: তাহাকে উত্তম সাহস দণ্ড দিতে হইবে। আর কুমারীর ইচ্ছা সত্ত্বেও তদুপরি বলাৎকারকারীকে প্রথম সাহস দণ্ডে দণ্ডিত হইতে হইবে।

কামনারহিত গণিকাকে যে পুরুষ (স্বগৃহে) অবরুদ্ধ করিবে, অথবা, তাহাকে অন্যত্র লুকাইয়া রাখিবে, কিংবা কোনপ্রকার ব্রণ বা (দন্তনখাদিদ্বারা) ক্ষত উৎপাদনা করিয়া তাহার রূপ নষ্ট করিবে, তাহাকে ১০০০ পণ দণ্ড দিতে হইবে। গণিকার শরীরগত বিশেষ বিশেষ স্থানে ব্রণাদি উৎপাদনা করিলে অপরাধীর দণ্ড বদ্ধিত হইতে পারে এবং এই দণ্ড ২৪০০০ পণ যে নিষ্ক্রয়মূল্য অবধারিত করা হইয়াছে ইহার দ্বিগুণ অর্থাৎ ৪৮০০০ পণ পৰ্য্যন্ত উঠাইতে পারা যাইবে-মতান্তরে, “স্থানবিশেষ’ শব্দদ্বারা গণিকার উত্তমাদি ভেদের প্রাধান্য অনুসরণ করিয়াও দণ্ডবৃদ্ধি কল্পিত হইতে পারিবে)। অথবা, দণ্ড সহস্ৰাপণ পৰ্য্যন্ত হইতে পারে (এই বাক্যটি সমস্ত আদর্শপুস্তকেই পাওয়া যায় সত্য, কিন্তু পূৰ্বাপর বাক্যগুলির সঙ্গে ইহার অর্থসঙ্গতি বুঝা যায় না বলিয়া, ইহা প্রক্ষিপ্ত বাক্যও হইত্বে পারে)।

যে গণিকা (রাজকুলে ছত্রভৃঙ্গারাদি গ্রহণের কৰ্ম্মে) অধিকার বা নিয়োগ প্ৰাপ্ত হইয়াছে তাহাকে ঘাতিত করিলে অপরাধীকে নিশ্রুয়ামূল্যের তিনগুণ (অর্থাৎ ৭২০০০ পণ।) দণ্ড দিতে হইবে। আর মাতৃকা, কুমারী ও রূপদাসী (যে দাসী প্রতিকৰ্ম্ম বা গন্ধমাল্যাদি দ্রব্য প্রস্তুত করে, কিংবা যে রূপদ্বারা আজীবিকা অর্জনের জন্য দাসীবৃত্তি অবলম্বন করে)-এই তিনজনের ঘাত বা মারণ সাধিত হইলে অপরাধীকে উত্তম সাহস দণ্ড দিতে হইবে।

সর্বপ্রকার অপরাধধস্থলেই যে দণ্ডের ব্যবস্থা করা হইয়াছে তাহা প্রথম অপরাধেই প্রযোজ্য প্রথম দণ্ড বলিয়া গৃহীত হইবে। দ্বিতীয়বার সেই অপরাধ করা হইলে, অপরাধীর উপর প্রথম দণ্ডের দ্বিগুণ দণ্ড ও তৃতীয় বার হইলে ইহার তিনগুণ দণ্ড বিহিত হইবে, কিন্তু চতুর্থবার একই অপরাধ করিলে অপরাধীর উপর বিচারকের ইচ্ছানুসারে দণ্ড বিহিত হইতে পারিবে (অর্থাৎ দণ্ড চারিগুণও হইতে পারে, কিংবা অপরাধীর সর্বস্বহরণ বা প্রবাসনাদি আরও গুরুতর দণ্ড ব্যবস্থিত হইতে পারে।)।

রাজার আজ্ঞা পাইলেও যদি গণিকা কোন পুরুষবিশেষের ভোগার্থ তৎসমীপে না যায়, তাহা হইলে তাহার উপর এক সহস্ব কশাঘাত দণ্ড বিহিত হইবে, অথবা তদণ্ডের অভাবে ৫০০০ পণ অর্থদণ্ড হইবে।

সম্ভোগের বেতন লইয়াও (পুরুষের প্রতি) দ্বেষকারিণী গণিকাকে ভোগবেতনের দ্বিগুণ অর্থদণ্ডরূপে দিতে হইবে। গণিকা যদি রাত্ৰিতে বসতি বা সম্ভোগের বেতন লইয়া, কোন ব্যাজে পুরুষকে ভোগ না করিতে দিয়া সময় কাটাইয়া দেয়, তাহা হইলে তাহাকে ভোগবেতনের আটগুণ অর্থদণ্ড দিতে হইবে। কিন্তু, পুরুষের কোন প্রকার (সংক্রামক) ব্যাধি বা অন্যপ্রকার পুরুষদোষের জন্য গণিকার সম্ভোগবিষয়ে আপত্তি হইলে, তাহার কোন দণ্ড হইবে না।

কোন পুরুষকে হত্যা করিলে গণিকাকে সেই পুরুষের সেই চিতাগ্নিতেই দগ্ধ করা যাইতে পারে, অথবা তাহাকে (গলাতে শিলাবন্ধনপূর্ব্বক) জলে নিমজ্জিত করিয়া মারিতে পারা যাইবে।

যদি কোন পুরুষ গণিকার নিজ আভরণ, অন্য অর্থ (গৃহদ্রব্যাদি) বা ভোগ (অর্থাৎ ভোগবেতন) অপহরণ করে, তাহা হইলে তাহাকে অপহৃত দ্রব্যের মূল্যের আটগুণ অর্থদণ্ড দিতে হইবে। গণিকা (গণিকাধ্যক্ষের নিকট) তাহার ভোগবেতন, আয়তি (উত্তরণকালে সম্ভাব্য আমদানী) ও (কৃতসহবাস) পুরুষের সম্বন্ধে সব সংবাদ নিবেদন করিবে।

এই সমস্ত বিধানদ্বারা, নট (অভিনয়কারী) নৰ্ত্তক, গায়ক (কণ্ঠগায়ী), বাদক (বংশীপ্রভৃতি যন্ত্রবাস্থ্যকর), বাগ জীবন (কথকতাদ্বারা জীবিকাকারী), কুশীলব (নৰ্ত্তকীদ্বারা নাচগান করাইয়া জীবিকাকারী), প্লাবক (রজ্জুপ্রভৃতিদ্বারা খেলাগ্রদৰ্শক), সৌভিক (ঐন্দ্রজালিক) ও চারণ (ভাট) ও স্ত্রীব্যবহারীদিগের (অর্থাৎ স্ত্রীদ্বারা জীবিকাকারীদিগের) স্ত্রী ও যাহারা গোপনে ব্যভিচার কাৰ্য্যে রত। সেই সব স্ত্রীও ব্যাখ্যাত হইল। (অর্থাৎ গণিকাবিধিগুলি তাহাদের উপরও প্রযোজ্য)।

(নটনৰ্ত্তকাদির) দল যদি অন্য দেশ হইতে (শিল্পপ্রদৰ্শনার্থ) আগত হয়, তাহা হইলে তাহাদিগকে (প্রত্যেক?) প্রদৰ্শনীর বেতন বা করম্বরূপ (রাজসরকারে) ৫ পণ দিতে হইবে।

রূপাজীবা বা রূপদ্বারা জীবিকাকারিণী গণিকাকে প্রতিমাসে (রাজসরকারে) দুই দিবসের লব্ধ ভাগবেতন কররূপে দিতে হইবে (অর্থাৎ প্রতিমাসের সমগ্র) আয়ের ২/৩০ বা ১/১৫ ভাগ রাজাদেয় হইবে)।

যে (আচাৰ্য্য) গণিকা, দাসী (গণিকাতিরিক্ত বেশ্যা) ও রঙ্গোপজীবিনীদিগকে (নাটাদির স্ত্রীদিগকে)-গীত, বাদ্য, পাঠ্য (আখ্যায়িকাদির পাঠকৌশল), নৃত্য, নাট্য, অক্ষর (লিপিবিদ্যা), চিত্র, বীণা, বেণু (বাঁশী), মৃদঙ্গ, পরিচিত্তজ্ঞান (অর্থাৎ পরকৃত ইঙ্গিত ও আকার জানা), গন্ধসংযুহন (গন্ধযোগ প্রস্তুত করা), মাল্যসম্পাদন (মাল্যগাথা), সংবাহন (অঙ্গমৰ্দ্দন) ও বৈশিক কলার (বেশ্যাদিগের শিক্ষণীয় বিদ্যার) জ্ঞান শিক্ষা দিবেন, (রাজা) রাজমণ্ডল (অর্থাৎ নগরগ্রামাদি হইতে উখিত রাজকররূপ আয়) হইতে তাহার আজীব বা বৃত্তি ব্যবস্থা করিবেন।

গণিকাপুত্রদিগকে ও রঙ্গোপজীবী দিগকে সব তালা বচরগণের (অর্থাৎ যাহারা সঙ্গীতে তাল রক্ষা করিয়া নৃত্য ও অভিনয়াদি সম্পাদন করে তাহাদিগের) মূখ্য বা প্রধান (অর্থাৎ আচাৰ্য্যস্থানীয়) করা হইবে।

উক্ত তালাবচরদিগের (রঙ্গোপজীবীদিগের) সংজ্ঞাবিশেষে ও ভাষাবিশেষে অভিজ্ঞাত স্ত্রীদিগকে, তাহাদের (রাজার অর্থদানাদিদ্বারা বশীকৃত) বন্ধুবান্ধবের সহায়তায় রাজকাৰ্য্যে নিযুক্ত রাখিয়া, (রাজা) তাহাদিগকে (নিজদেশের) অজিতেন্দ্ৰিয় দূন্য লোকদিগের উপর (শত্রুদ্বারা প্রযুক্ত)। চর বা গুপ্তচরদিগের হত্যা বা প্রমাদসাধন করার জন্য প্রয়োগ করিবেন। ১।৷

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্ৰে অধ্যক্ষপ্রচার-নামক দ্বিতীয় অধিকারণে গণিকাধ্যক্ষ নামক সপ্তবিংশ অধ্যায় (আদি হইতে ৪৮ অধ্যায়।) সমাপ্ত।

.

অষ্টাবিংশ অধ্যায়
৪৫শ প্রকরণ-নাবধ্যক্ষ

নাবধ্যক্ষ স্থানীয়াদি নগরে (অর্থাৎ স্থানীয় দ্রোণমুখ খার্বটিক ও সংগ্রহণনামক নগরাদিতে) সমূদ্রকুলসমীপস্থ (নৌকা যাতায়াত-পথ), সমুদ্র ও নদীর সঙ্গমস্থ তরণপথ এবং দেবসরোবর (অর্থাৎ সর্বদা ষে সরোবর জলসমৃদ্ধ থাকে), বিসরঃ (অর্থাৎ যে সরোবরের জল শুকাইয়া যায়), ও নদীতীরণ-পথ অবেক্ষণ করিবেন (অর্থাৎ রাজকীয় নৌবিভাগে নৌকাভাড়া, তরদেয় প্রভৃতি আদায়কাৰ্য্য পৰ্য্যবেক্ষণ করিবেন)।

সমুদ্র-নদী প্রভৃতির বেলাভূমি ও কুলে বাসকারী গ্ৰামজনেরা ক্লপ্ত বা তরুণীজন্য রাজার আদেয় নিয়ত কর দিবে।

যাহারা মৎস্য বন্ধন করে সেই ধীবরের রাজকীয় নৌকাব্যবহারের ভাড়ারূপে (ধৃত মৎস্যাদির)। ষষ্ঠ ভাগ দিবে। বণিকেরা পত্তন (কুলনগরে বা বন্দরে) প্রবত্তিত নিয়মানুসারে পণ্যের পঞ্চম বা ষষ্ঠভাগ মূল্য শুল্করূপে প্রদান করিবে। রাজকীয় নৌকাদ্বারা যাতায়াতকারী লোকেরা যাত্রাবেতন অর্থাৎ যাতায়াতের ভাড়া দিবে। শঙ্খ ও মুক্তাগ্রহণকারীরাও (রাজনৌকা ব্যবহার করিলে) নৌকাভাটক বা নৌকাভাড়া দিবে, (কিন্তু,) তাহারা নিজ নিজ নৌকা দ্বারাও তরণকাৰ্য্য করিতে পারিবে।

শঙ্খমুক্তাদিবিষয়ে ইহাদের অধ্যাক্ষের (অর্থাৎ নবধ্যক্ষের) কৰ্ত্তব্য খন্যধ্যক্ষের কৰ্ত্তব্যনিরূপণেই ব্যাখ্যাত হুইয়াছে বুঝিতে হইবে (অর্থাৎ খনিজাত বস্তুর জন্য খন্যধ্যক্ষ যেমন কৰ্ম্মান্তাদি স্থাপন করেন ও সেই সব দ্রব্যের ব্যাপার পর্য্যবেক্ষণ করেন, নাবিধ্যক্ষও মৎস্যশঙ্খাদিসম্বন্ধে সেইরূপ ব্যবস্থা করিবেন)

পত্তনাধ্যক্ষদ্বারা ব্যবস্থিত বলিয়া নিবন্ধপুস্তকে লিখিত পণ্যপত্তনে প্রচলিত চরিত্র বা নিয়মাচার নাবধ্যক্ষ পালন করিয়া চলিবেন (অর্থাৎ ইহার অতিবৰ্ত্তন করিবেন না)।

(নাবধ্যক্ষ) দিগভ্বমে পতিত কিংবা ঝড়বাতাসে আহত নৌকাকে পিতার ন্যায় অনুগ্রহ করিয়া বাঁচাইবেন। নৌকাতে যে-সব পণ্য। জলে দূষিত হইয়াছে সেগুলির উপর ধার্ঘ্য শুল্ক (তিনি) লাইবেন না, কিংবা (অবস্থা বুঝিয়া) অৰ্দ্ধশুল্ক লইবেন।

(বাতাহত্যাদি) নৌকাগুলির শুদ্ধ দান বিষয় নির্দ্দিষ্ট হইলে পর (অর্থাৎ ইহারা সর্বশুল্করহিত হইবে, অথবা, অৰ্দ্ধশুল্কদায়ী হইবে ইহা ঠিক হইলে) সেগুলিকে পণ্যপত্তিনে যাত্রার সময় উপস্থিত হইলেই পাঠাইয়া দিতে হইবে। চলন্ত অবস্থার নৌকাগুলি শুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত হইলে, তাহাদের কাছে শুদ্ধ চাহিয়া লইতে হইবে। যে-সব নৌকাতে হিংসাকারী (চোর-দস্যরা) থাকিবে সেগুলিকে নষ্ট করিতে হইবে। (আবার) যে নৌকাগুলি শক্রর দেশের দিকে যাইতেছে এবং যেগুলি পণ্যপত্তন বা বন্দরের নিয়ম উল্লাজঘন করিয়া পলাইতে চাহে সেগুলিকে নষ্ট করিতে হইবে।

মহানৌকাসমূহকে (অর্থাৎ বড় বড় নৌকাগুলিকে), হেমন্ত ও গ্রীষ্মকালেও লবাহুল্য-বশতঃ নৌ-তরণীয়া মহানদীগুলিতে (নাবধ্যক্ষ)-শাসক (নৌকাচালন বিষয়ে প্রধান নিৰ্দেশক অধিকারী), নিয়ামক (পোতবাহ বা নৌকাচালক), দাত্রগ্ৰাহী (রজ্জু প্রভৃতি কাটিবার জন্য যে হস্তে দাত্র বা দা ধরাণ করিয়া থাকে), রশ্মিগ্রাহী (নৌকাতে রাজু গ্রহণকারী) ও উৎসেচক (নৌকামধ্যে জল প্রবেশ করিলে ইহার সেচনকারী) দ্বারা অধিষ্ঠিত করিয়া, প্রয়োগ করিবেন। আর যে সব নদী কেবলমাত্র বর্ষাকালে নৌ-তরণীয়া হয়। সেই ক্ষুদ্র নদীগুলিতে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র নৌকার ব্যবস্থা করিবেন।

এই নৌকাগুলিকে নির্দ্দিষ্ট তীর্থে (ঘাট বা স্টেশনে) বাঁধিতে হইবে, কারণ, তাহা না হইলে রাজার দ্বেষকারীর (শত্রুপ্রিযুক্ত তীক্ষ্ণা ও রসদ প্রভৃতির) তরণভয় থাকিয়া যাইবে (অর্থাৎ বাধা ঘাটে নৌকাগুলি আবদ্ধ থাকিলে পৰ্য্যবেক্ষণকাৰ্য্য সরল হইবে)।

অনির্দ্দিষ্ট সময়ে (অর্থাৎ নিশীথ-সময়াদিতে) ও অতীর্থে (যাহা নির্দ্দিষ্ট ঘাঁটি নহে তথায়) যে ব্যক্তি (নৰ্দ্ধ্যাদি) পার হইবে, তাহাকে প্রথম সাহস দণ্ডে দণ্ডিত হইতে হইবে। আবার নির্দ্দিষ্ট কালে ও নির্দ্দিষ্ট ঘাটেও যদি কেহ বিনা অনুমতিতে (ন্যাদি) পার হয়, তাহা হইলে তাহাকে ২৬.৭৫ পণ দণ্ড দিতে হইবে।

(এই তারাদণ্ড কাহাদের উপর। প্রযুজ্যমান হইবে না।–তাহা এখন বলা হইতেছে।) ধীবর, কাষ্ঠবাহী, তৃণবাহী, পুষ্পবাটপালক (অর্থাৎ ফুলের বাগান রক্ষাকারী মালী), ফলবাটপালক ষণ্ডপালক (শাকসবজী, রক্ষাকারক) ও গোপালকদিগের প্রতি (এই অসময়ে বা অঘাটে, বা বিনা অনুমতিতে নির্দ্দিষ্ট সময়ে ও ঘাটে পার হওয়ার অপরাধ-জনিত) দণ্ড প্রযুক্ত হইবে না। চোরাদি বলিয়া যাহারা শঙ্কার পাত্র তাহাদের পশ্চাতে যাহারা যাইবে এবং যাহারা দূতের পশ্চাতে যাইবে, তাহারাও সেই দণ্ড হইতে নিস্কৃতি পাইবে। সেনাতে ব্যবহার্ভাব্য ভাণ্ড যাহারা পার করিবে ও যাহারা গুপ্তচর রূপে নিযুক্ত তাহাদেরও এই দণ্ড দিতে হইবে না। যাহারা নিজের তরণ-সাধন নৌকাদিদ্বারা (নৰ্দ্ধ্যাদি) পার হইবে এবং যে সব জলময় প্রদেশের নিকটস্থ গ্রামবাসী (ধান্যাদি) বীজ, ভক্ত দ্রব্য (খাওয়ার জিনিষ) ও (গৃহস্থের অন্যান্য প্রয়োজনীয়) উপকরণ পার করাইবে তাহারাও উক্ত দণ্ডে দণ্ডিত হইবে না।

ব্ৰাহ্মণ, প্রব্রজিত। (অর্থাৎ গৃহত্যাগী সন্ন্যাসী), বালক, বৃদ্ধ, ব্যাধিগ্রস্ত, রাজশাসনহারী ব্যক্তি ও গর্ভিণী স্ত্রীলোক কেবলমাত্র নাবধ্যক্ষের মুদ্রা (বা মুক্তিপত্র) প্রদৰ্শন করিলেই নদ্যাদি (বিনা শুল্কে) পার হইতে পারিবে।

যাহারা প্রবেশের অনুমতি পাইয়া পরদেশ হইতে আগত, কিংবা যাহারা (অনুমতি না পাইয়াও) অনুজ্ঞাত বণিকসার্থের অধিষ্ঠানে আছে তাহারা (রাজার দেশে) প্রবেশ লাভ করিতে পারিবে।

(নাবধ্যক্ষ)। সেই ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করাইবেন যে ব্যক্তি অন্যের স্ত্রী, কন্যা বা বিত্তের অপহরণকারী বলিয়া নিম্নবণিত চিহ্নসমূহ ধারণ করে, যথা— যে ব্যক্তি শঙ্কিত (চকিতভাবে চলনশীল অর্থাৎ সন্দেহের পাত্র), আবিগ্ন (সন্ত্রম বা ত্ররাযুক্ত), স্বশক্তির অধিক ভাণ্ডভার বহনকারী, মাথার উপর বৃহদাকার বোঝা লইয়া প্ৰায় আবৃতমুখ, সদ্যঃ সদ্যঃ পরিব্রাজকের চিহ্নধারী হইয়া সন্ন্যাসী বলিয়া পরিচিত, পরিব্রাজকের লিঙ্গ বা চিহ্ন সদ্যঃপরিত্যাগকারী, ব্যাধিগ্রস্ত বলিয়া পরিচিত হইলেও ব্যাধিচিহ্নশন্য, ভয়কারণে (মুখাদিতে) বিকারযুক্ত, সারযুক্ত (রত্নাদি) ভাণ্ড-গোপ্রনকারী, শাসন বা লেখ্য-গোপনকারী, শস্ত্রগোপনকারী ও (ঔপনিষদপ্রকারণে উক্ত) অগ্নিযোগের দ্রব্যাদি গোপনকারী, হস্তে বিষধারী; দীর্ঘ পথের পথিক ও (অন্তপালাদির) মুদ্রা-রহিত।

(এখন নদী প্রভৃতি তরণের ভাড়া সম্বন্ধে বলা হইতেছে।)

(অজাদি) ছোট পশুর জন্য এবং হস্তে গ্রহণের যোগ্য ভারধারী মানুষের জন্য তরশুল্ক দিতে হইবে এক মাষক। মস্তকে বা শরীরে (অর্থাৎ স্কন্ধাদিতে) বহনযোগ্য ভারবিশিষ্ট লোকের এবং গো ও অশ্বের ভাড়া দুই মাষক। উষ্ট্র ও মহিষের ভাড়া চারি মাষক। ছোট যানের (গাড়ী প্রভৃতির) ভাড়া পাঁচ মাষক। গরুর গাড়ীর ভারা চয় মাষক। শকট বা বড় গাড়ীর ভারা সাত মাষক। পণ্যদ্রব্যের এক ভার অর্থাৎ ২০ তুলা-পরিমিত পণ্যের ভাড়া ১/৪ পণ। ইহা দ্বারা (মহিষাদিদ্বারা) ভাণ্ডভার বহনের ভাড়াও নির্দ্দিষ্ট হইল (অর্থাৎ এক এক ভারের জন্য এক মাষক ভাড়া) বুঝিতে হইবে। (উক্ত ভাড়া লঘুনদীবিষয়ক) কিন্তু, মহানদী সকল পার হইতে গেলে উক্ত তরবেতন দ্বিগুণিত দিতে হইবে।

জলময় প্রদেশের উপকূলে যে গ্রামবাসীরা বাস করে তাহাদিগকে (নাবিকের জন্য) নির্দ্দিষ্ট ভক্ত ও বেতনও দিতে হইবে।

প্রত্যন্ত প্রদেশে (অর্থাৎ প্রদেশসীমান্তে) তরণে নিযুক্ত রাজপুরুষেরা (ব্যাপারীদিগ হইতে) অতিবাহিক শুল্ক (অর্থাৎ অতিবাহন নিমিত্তক রাজভাব্য করা; মতান্তরে, শুল্ক ও আতিবাহিক কর) ও বর্তনী-নামক কর (অন্তপালের নিকট দেয় পথ ব্যবহারের করা) সংগ্রহ করিবে। মূদ্র বিরহিত হইয়া (কোন ব্যাপারী মাল লইয়া) পার হইলে (নাবিধ্যক্ষের কৰ্ম্মকরের) তাহার ভাণ্ড বা মালপত্র ছিনাইয়া রাখিবো। আর যে ব্যক্তি পুরুষের বহনের অতিরিক্ত ভার লইয়া অকালে ও ঘাটবিহীন স্থানে ন্যাদি। পার হইবে তাহার ভাণ্ড বা মালপত্রও কাডিয়া নেওয়া চলিবে।

(সরকারী) নৌকা (শাসক-নিয়ামকাদি) পুরুষ ও উপকরণবিহীন অবস্থায় ও সংস্কার করার অভাবে বিপন্ন হইলে, নাবিধ্যক্ষকে নষ্ট ও বিনষ্ট মালের জন্য ক্ষতিপূরণ করিয়া দিতে হইবে।

আষাঢ় মাসের পূর্ণিমা দিবস হইতে পরবর্তী এক সপ্তাহ এবং কাৰ্ত্তিক মাসের পূৰ্ণিমার পরবত্তী এক সপ্তাহ—এই উভয় কালের মধ্যে (বর্ষাকালে তরণীয় নদীসমূহে) নাবিকেরা তার বা তরুণবেতন সংগ্রহ করিবে। (নাবিধক্ষের নিকট তাহারা) নিত্যই কৰ্ম্মসম্বন্ধীয় বিশ্বাসযোগ্য হিসাব প্রদান করিবে এবং প্রতিদিন প্ৰাপ্ত নৌকাভাড়াও তাঁহাকে দিবে ॥ ১।৷

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্ৰে অধ্যক্ষপ্রচার-নামক দ্বিতীয় অধিকরণে নাগবধ্যক্ষনামক অষ্টাবিংশ অধ্যায় (আদি হইতে ৪৯ অধ্যায়) সমাপ্ত।

.

উনত্রিংশ অধ্যায়
 ৪৬শ প্রকারণ-গোধ্যক্ষ

গোধ্যক্ষ নিম্নলিখিত আট প্রকার কাৰ্য্যের তত্ত্বাবধান করিবেন, যথা–(১) বেতনোপগ্রাহিক, (২) করপ্রতিকর, (৩) ভগ্নোৎসৃষ্টক, (৪) ভাগানুপ্রবিষ্টক, (৫) ব্রজপৰ্য্যগ্র, (৬) নষ্ট, (৭) বিনষ্ট ও (৮) ক্ষীরঘৃতসঞ্জাত। (অনন্তর এই আটটি কাৰ্য্যের স্বরূপ ক্রমশঃ বর্ণিত হইতেছে)।

গোপালক (গোপালনকারী ভৃত্য), পিণ্ডারক (মহিষপালক ভূত্য), দোহক (গোমহিষাদির দুগ্ধ দোহনকারী ভৃত্য), মন্থক (দধি প্রভৃতির মন্থনকারী ভৃত্য) ও লুব্ধক (জঙ্গলে গোমহিষাদিকে ব্যালভয় হইতে রক্ষাকারী ভৃত্য)–এই পাঁচ প্রকার কৰ্ম্মকর নগদ টাকা (ও অন্নবস্ত্ৰাদিরূপ) বেতনব্দদ্বারা ভূত হইয়া শত শত ধেনু’র পালনকাৰ্য্য সম্পাদনে নিযুক্ত থাকিবে। তাহারা দুগ্ধক্ষ্মতাদি বেতনরূপে পাইবে না) কারণ, দুগ্ধধৃতরূপ ভূতি পাইয়া কাজ করিলে তাহারা (অধিক দুগ্ধ ঘৃতাদির লোভে) বৎসগুলিকে (দুগ্ধ বেশী খাইতে না দিয়া সেগুলিকে) উপহত বা কৃশিত করিবে। গবাদি রক্ষার এই প্রকার উপায়কে বেতনোপগ্ৰাহিক বলা হয়। (অর্থাৎ এই উপায়ে কেবল শুল্ক নগদ টাকা ইত্যাদিই বেতনরূপে এই কৰ্ম্মকরেরা গোধ্যক্ষের বিভাগ হইতে পাইবে।)

জরদগবী (বৃদ্ধ গরু), (দুগ্ধদাত্রী) ধেনু, গর্ভিণী গাভী, প্রথমগৰ্ভবতী গাভী, ও বৎসতরী (যে বৎসা অল্পদিন পূর্বে স্তন্যন্ধয়তা ত্যাগ করিয়াছে।)–এই পাঁচ “প্রকার গাভীর সমবিভাগক্রমে (অর্থাৎ প্রত্যেকের কুড়িটি লইয়া) এক শত সংখ্যা একজন ‘পালক (কৰ্ম্মকর) পালন করিবে। এই কৰ্ম্মকর (উক্ত গাভীসকলের মালিককে) প্রতিবর্ষে আট বারিক (অর্থাৎ ৮৪ কুডুব) ঘৃত, পুচ্ছগণনায় দেয় ১ পণ কর (অর্থাৎ প্রত্যেক পশুর জন্য ১ পণ কর) ও মৃত পশুর রাজমুদ্রাঙ্কিত চৰ্ম্ম দিবে। এই প্রকার গোরক্ষণের নাম করপ্রতিকর।

ব্যাধিগ্রস্তা, বিকলাঙ্গী, অনন্যদোহী (অর্থাৎ যে ধেনু এক বিশিষ্ট জনেরই দোহনীয়া), দুৰ্দোহা (অর্থাৎ যে ধেন্সকে দোহন করিতে হইলে পাদবন্ধনাদির প্রয়োজন হয়), ও পুত্রস্ত্রী (অর্থাৎ যে ধেনুর গর্ভস্রাব ঘটিয়াছে, অথবা, যে মৃত্যুবৎসা’)—এই পাঁচ গাভীর সমবিভাগক্রমে (অর্থাৎ প্রত্যেকের কুড়িটি লইয়া) একশত সংখ্যার পালনকারী কৰ্ম্মকরেরা গাভীজাত দুগ্ধশ্বতাদি (পূর্বোক্ত রীতিতে) রাজভাগরূপে (অধ্যক্ষকে) প্রদান করিবে। এইভাবে গোরক্ষণের নাম ভগ্নোৎসৃষ্টক।

শত্রুচক্রের ছলনার ভয়ে ও আটবিকদিগের অপহরণের ভয়ে (রাজত্রজে) (রক্ষার্থ) প্রবেশিত পশুদিগের (গাভী প্রভৃতির) পালনজন্য বেতনদানের নিয়মানুসারে পশুস্বামীরা দুগ্ধ ঘৃতাদির আমদানীর দশম ভাগ রাজসরকারে দিতে বাধ্য থাকিবে। এই প্রকার গোরক্ষণ ভাগানুপ্রবিষ্টক-নামে আখ্যাত হয়।

বৎস (স্তন্যন্ধয় বাছুর), বৎসতর (স্তনপানত্যাগী বড় বাছুর), দম্য (কৃষ্যাদিকৰ্ম্মে শিক্ষা পাইবার যোগ্য), বহনকারী ষাঁড়, (বীৰ্য্য সেচনকারী) বৃষ ও উক্ষা (হালাদিচালনে যোগ্য বৃষ)—এই ছয় প্রকার পুংগব হইতে পারে। যুগবাহন ও শকটবাহনকারী বৃষভ (বা বীৰ্য্যসেচনকারী), সুনামহিষ (মাংসমাত্রোপযোগী মহিষ), ও পৃষ্ঠ ও স্কন্ধবাহী—এই চারি প্রকার মহিষ হইতে পারে। গাভী ও মহিষী সাত প্রকার হইতে পারে, যথা-(১) বৎসিক (স্তনপায়িনী), (২) বৎসতরী (ত্যক্তস্তনপানী), (৩) প্রষ্ঠৌহী (প্রথমগৰ্ভবতী), (৪) গভিণী, (৫) ধেনু (দুগ্ধদাত্রী), (৬) অপ্রজাতা (বিজনানাহঁ বয়স অপ্ৰাপ্ত) ও (৭) বন্ধ্যা। দুইমাস ও একমাস পূৰ্ব্বেজাত বৎস ও বৎসাদিগকে উপজা সংজ্ঞায় অভিহিত করা হয়। মাসজাত ও দ্বিমাসজাত বৎসাদিকে (তপ্তমুদ্রাদ্বারা) চিহ্নিত করিতে হইবে। (গোধ্যক্ষকে) মাস ও দুইমাস পৰ্য্যন্ত রাজব্রজে থাকিয়াছে এমন (অজ্ঞাতস্বামিক) বৎসাদিকেও চিহ্নিত করিতে হইবে। অঙ্ক (স্বস্তিকাদি কৃত্রিম চিহ্ন), চিহ্ন (পুচ্ছাদির শ্বেতত্রপ্রভৃতিরূপ স্বাভাবিক চিহ্ন), বর্ণ (শুক্ল-কৃষ্ণাদি রঙ) ও শৃঙ্গের বিশেষ লক্ষণ-এই সক লক্ষণ সহ উক্ত উপজা-নামক বৎসাদির সংখ্যা প্রভৃতি বিবন্ধপুস্তকে-(গোধ্যক্ষ) লেখাইয়া রাখিবেন। এই ভাবে গবাদি রক্ষণের নাম ব্রজপ্রৰ্য্যগ্র।

নষ্ট গোধন তিন প্রকার হইতে পারে, যথা-(১) চোরকর্তৃক অপহৃত, (২) অন্য যুথে প্রবিষ্ট ও (৩) অবলীন (অর্থাৎ বনমধ্যে স্বযুথ হইতে ভ্বষ্ট)।

কৰ্দমে পতিত, বিষমে অর্থাৎ গৰ্ত্তাদিতে পতিত, ও ব্যাধি ও জরাগ্রস্ত, বেগযুক্ত জলপ্রবাহাদিতে পতিত ও আহারদোষে দূষিত হইয়া (যে-সব গবাদি৷) বিপন্ন হয়; এবং বুক্ষপাত, অতট বা ভৃগুপতন, বড় বড় কাষ্ঠপাত ও শিলাপাত দ্বারা (যে সব গবাদি) অভিঘাত প্ৰাপ্ত হয়; এবং বিদ্যুৎপাত, ব্যাল বী। হিংস্রপাণ্ড ও নক্রের আক্রমণ ও বনবহিদ্বারা (যে-সব গবাদি) বিপন্ন হয়-সে-সব বিনষ্ট পৰ্য্যায়ে গণিত হইবে। (পালিকাদিরা) এ-গুলিকে প্রমাদস্থান হইতে রক্ষা করিয়া চলিবে (মতান্তরে, তাহাদের প্রমাদে যে-সব গবাদি বিনষ্ট হইবে সেগুলিকে তাহারা পূরণ করিয়া দিতে বাধ্য থাকিবে)।

এইভাবে গোধ্যক্ষকে গবাদি পশুর সংখ্যা জানিয়া রাখিতে হইবে।

যে (গোপালক) গবাদি নিজে হনন করে বা অন্যদ্বারা হনন করায়, কিংবা নিজে হরণ করে বা অন্যদ্বারা হরণ করায়, তাহার উপর বিধদণ্ড বিহিত হইবে।

কোন (গোধ্যক্ষের অধীন) কৰ্ম্মচারী যদি বে-সরকারী পশুর রূপ রাজকীয় চিহ্নদ্বারা চিহ্নিত করিয়া পরিবর্তন করে, তাহা হইলে তাহাকে প্রথম সাহস দণ্ড দিতে হইবে।

যে ব্যক্তি চোরাপহৃত নিজদেশীয় গবাদি আনিয়া প্রত্যাৰ্পণ করিবে, সে (মালিক হইতে) প্রতি পশুর জন্য এক পণ প্ৰাপ্ত হইবে। আর, যে ব্যক্তি পরদেশীয় পশুকে (চোরাদি হইতে) মোচন করিতে পারিবে, (সে পশুস্বামী হইতে) পশুটির মূল্যের অৰ্দ্ধ প্ৰাপ্ত হইবে।

গোপালকের বালপশু (অল্পবয়স্ক গবাদি), বুদ্ধপশু ও ব্যাধিগ্রস্ত পশুদিগের বিপদের প্রতিকার চিন্তা করিবে।

(গোপালকগণ) ব্যাধ ও কুকুরগণ পোষকদিগের দ্বারা চোর, ব্যাল বা হিংস্রজন্তু ও শত্রুর উপদ্রব্য-ভয় দূর করিয়া ঋতু-বিভক্ত। (অর্থাৎ ঋতুভেদে তৃণজলাদির সমৃদ্ধি যে যে অরণ্যে সমূচিত বলিয়া ব্যবস্থিত তেমন) অরণ্যে (গবাদির) চারণ করাইবে।

(শব্দশ্রবণে) ত্ৰাসযুক্ত গবাদিপশুর (গলাতে) শব্দকারী ঘণ্টা বাধিয়া দিতে হইবে, যেন তৎশ্রবণে সৰ্প ও হিংস্রজন্তুরা ত্ৰাসযুক্ত হইয়া পলায় ও যেন পশুগুলির গোচরস্থান অবগত হওয়া যায় (অর্থাৎ কোন ভূমিভাগের তাহারা চরিয়া বেড়াইতেছে তাহা জানা যায়)।

গোপালকেরা গবাদিপশুকে তেমন জলেই (স্নানপানাদি করাইবার জন্য) নামাইবে, যেখানে আবিষম ও বিস্তীর্ণ তীর্থ বা ঘাট আছে এবং যেখানে কর্দম ও নক্রাদি জলজন্তু নাই; এবং (তাহারা সতর্কতার সহিত) পশুগুলিকে রক্ষা করিবে।

(তাহারা) কোন গবাদি পশু-চোর, (ব্যাঘ্রাদি) হিংস্রজন্তু, সৰ্প ও নক্রদ্বারা গৃহীত হইলে, কিংবা ব্যাধি ও জরাগ্রস্ত হইয়া মৃত হইলে, তৎক্ষণাৎ (গোধ্যক্ষের নিকট) সেই সংবাদ নিবেদন করিবে, তাহা না করিলে তাহাদিগকে প্রত্যেক বিপন্ন পশুর মূল্য (শাস্তিরূপে) দিতে হইবে।

(ব্যাধিপ্রভৃতি স্বাভাবিক) কারণে মৃত গো ও মহিষের রাজচিহ্নিত চৰ্ম্ম, ছাগ ও মেষের কৰ্ণে কৃত চিহ্ন এবং অশ্ব, গর্দভ ও উষ্ট্রের পুচ্ছ ও অঙ্কযুক্ত চৰ্ম্ম আহরণ করিয়া (মরণপ্রত্যয় উৎপাদনার্থ গোধ্যক্ষসমীপে) উপস্থাপিত করিবে এবং এই সব মুতপশুর কেশ, চৰ্ম্ম বন্তি (মূত্ৰাশয়), পিত্ত, স্নায়ু (অস্ত্র), দন্ত, খুর ও শৃঙ্গও সংগ্রহ করিয়া আনিবে (এই সব বস্তু কুপ্যাগারে ব্যবহারার্থ দিতে হইবে)।

(মৃতপশুগুলির) অপক মাংস তাহাদিগকে আর্দ বা শুল্ক অবস্থায়ই বিক্রয় করিয়া ফেলিতে হইবে।

সেই সব পশুর (দুগ্ধ হইতে উৎপাদিত) ঘোল কুকুর ও বরাহের খাদ্যরূপে দিতে হইবে।

সেনার ভোজ্যবস্তুরূপে কুচিকা (ঘনীকৃত তক্রবিকার বা ছানা) সংগ্রহ করিয়া রাখিতে হইবে।

আর কিলাট (নষ্ট বা স্মৃটিত দুগ্ধ), (গোমহিষাদির ভক্ষ্য)। ঘাণ (ঘাণী?) হইতে প্ৰাপ্ত পিষ্ট তৈলবীজপিণ্ডের (খোলের) ক্লোদন কাৰ্য্যের জন্য আহৃত হইবে।

যে কোন ব্যক্তি (গবাদি) পশু বিক্রয় করিলে, প্রত্যেক (বিক্রীত) পশুর জন্য ই পাণ (গোধ্যক্ষের নিকট) জমা দিবে।

গোপালকের বর্ষা, শরৎ ও হেমন্ত ঋতুতে দুই বেলাতেই (গোমহিষাদির) দোহন করিতে পারিবে। (কিন্তু,) শিশির, বসন্ত ও গ্রীষ্ম ঋতুতে কেবল একবেলা (অর্থাৎ রাত্ৰিতেই) দোহন করিতে হইবে।

দ্বিতীয় বেলাতে দোহন করিলে অপরাধীর অঙ্গুষ্ঠচ্ছেদ রূপ দণ্ড হইবে (গ্রীষ্মকালেও অনেক দেশে ২/৩ বার দোহনপ্রথা আছে, সেই স্থানের জন্য সম্ভবতঃ এই নিয়ম)।

দোহনকাল অতিক্রম করিয়া দোহন করিলে অপরাধীকে দণ্ডরূপে সেই দিনের বেতনফল হইতে বঞ্চিত হইতে হইবে।

এতদ্দ্বারা নাসাবোধন, (নূতন গবাদির) শিক্ষণ, যুগপিঙ্গন (অর্থাৎ আদান্ত পশুকে দান্ত পশুর সহিত যুগে যোজন করা) ও বর্তনের (প্রচারণাঢ়ি শিক্ষার) সময় অতিক্রমকারী কৰ্ম্মকরেরও কৰ্ম্মফল (অর্থাৎ বেতন-) হানিরূপ দণ্ড হইবে। গাভীর এক দ্ৰোণ-পরিমিত দুগ্ধ হইতে এক প্রস্থ ঘৃত পাওয়া যায়। মহিষীর (এক দ্ৰোণ-পরিমিত দুগ্ধ হইতে) ই প্রস্থ অধিক (অর্থাৎ ১ প্রস্থ)। ঘৃত পাওয়া যায়। ছাগী ও মেধীর (এক দ্ৰোণ-পরিমিত দুগ্ধ হইতে) ঔ প্রস্থ অধিক (অর্থাৎ ১ই প্রস্থ স্থত পাওয়া যায়। অথবা, এই পশুগুলি সম্বন্ধে দধিমন্থন হইতে প্ৰাপ্ত স্বতের পরিমাণই প্রমাণ ধরা যাইবে, কারণ, বিশিষ্ট ভূমি, তৃণ ও জল ব্যবহারে পশুগুলির দুগ্ধ ও ঘুতের পরিমাণ (অথবা দুগ্ধে ঘুতের পরিমাণ) বৃদ্ধি পাইয়া থাকে। (সম্ভবতঃ, ইহা উপরি উক্ত ক্ষীরঘুতসঞ্জাতের নিরুপণ গোধ্যক্ষের অধ্যক্ষতাকাৰ্য্যের অন্যতম কাৰ্য্য)।

যদি কোনও ব্যক্তি পশুযূথে রক্ষিত (বীৰ্য্যসেচনকারী) বৃষকে অন্য বৃষের সহিত যুদ্ধ করায়, তাহা হইলে তাহার উপর প্রথম সাহস দণ্ড বিহিত হইবে।; এবং ইহাকে বধ করাইলে তাহার উত্তম সাহস দণ্ড হইবে।

পশুগুলির বর্ণ বা রঙ অনুসারে দশ-দশটি পশুর এক একটি বর্গ করিয়া (এমন দশটি বর্গদ্বারা রচিত শতাত্মিক পাল) রক্ষা করিতে হইবে।

গবাদির বনে বাস ও বিচরণের দিগ্নিভাগ অর্থাৎ নিয়মিত স্থান ব্যবস্থিত করিতে হইলে দেখিতে হইবে-পশুগুলির প্রচার বা চরিবার স্থান কতদূর বা কোথায়, ইহাদের দলের মোগা কেমন, ও ইহাদের রক্ষা করার সামর্থ্য গোপালকদিগের কতখানি আছে।

গোধ্যক্ষ অজ (ছাগ) প্রভৃতি পশুর উর্ণা (গাত্ররোম) প্রতি ছয় মাসে একবার গ্রহণ করাইতে পারিবেন।

ইহাদ্বারা অশ্ব, গর্দভ, উষ্ট্র ও বরাহের ব্রজও ব্যাখ্যাত হইল (অর্থাৎ এই পশুগুলি সম্বন্ধেও উপরি পৰ্যালোচিত সব ব্যবস্থা খাটিবে)।

বলীবর্দের মধ্যে যে-গুলির নাসাবোধন হইয়াছে এবং যে-গুলি শ্রেষ্ঠ অশ্বের মত গতিশীল ও (রথদি–) বাহক হইতে পারে, সেগুলির খাদ্যের পরিমাণ নিম্নলিখিতরূপ হইবে, যথা–অৰ্দ্ধভার (অর্থাৎ দশ তুলা-পরিমিত) ব্যবস (হরিত ঘাস), ইহার দ্বিগুণ অর্থাৎ ২০ তুলা (সামান্য)। তৃণ, এক তুলা ঘাণপিণ্যাক (খোল), ১০ আঢ়ক কণকুণ্ডক (অর্থাৎ সূক্ষ্ম অন্নাকণাযুক্ত অন্নের কল্ক বা মাড়), ৫ পল (সৈন্ধব) মূখলবণ, ১ কুড়িব নাসা-সেচনার্থক তৈল, ও ১ প্রস্থ পানাৰ্থ তৈল। ইহাদের জন্য আরও নিতে হইবে ১ তুলা মাংস, ১ আঢ়ক দধি, ১ দ্ৰোণ যাব, অথবা, ১ দ্ৰোণ-পরিমিত মাষ্যদ্বারা নিৰ্ম্মিত পুলাক (অর্থাৎ অৰ্দ্ধপক সিৰ্ব্বথ)।

১ দ্ৰোণ দুগ্ধ, অথবা ১/২ আঢ়ক সুরা, ১ প্রস্থ স্নেহদ্রব্য (তৈল বা স্থত), ১০পল ক্ষার দ্রব্য (গুড় প্রভৃতি) ও ১ পল শৃঙ্গিবের (অর্থাৎ আর্দ্রক শুষ্ঠী)। এই দ্রব্যগুলি মিলাইয়া (অগ্নিদীপনার্থক) বলীবর্দ পশুকে পান করাইতে হইবে।

অশ্বতর (খচ্চর), অন্য পুংগব ও গর্দভের জন্য উপরি উক্ত (খাদ্য ও পানীয়ের এক চতুর্থাংশ কম হইতে পারিবে। মহিষ, উষ্ট ও (শকটাদির উপযোগী কৰ্ম্মকরণে যুক্ত বলীবর্দর জন্য দ্বিগুণ বিধা ধাৰ্য্য করিতে হইবে। (দুগ্ধদাত্রী) গাভীর জন্যও উক্ত পানীয় দ্রব্য (ও খাদ্যদ্রব্যের) দ্বিগুণ পরিমাণ দিতে হইবে। (বলীবর্দাদির) কৰ্ম্মকালের পরিমাণ ও (ধেনু প্রভৃতির দুগ্ধবাহুল্যাদি) ফল লক্ষ্য করিয়া খাদ্য ও পানীয়ের বিধান করিতে হইবে (অর্থাৎ প্রয়োজন হইলে দ্বিগুণেরও অধিক পরিমাণ দেওয়া যাইতে পারিবে)। সব পশুর জন্য তৃণ ও জলের প্রচুরতার দিকে লক্ষ্য রাখিতে হইবে। এই পৰ্য্যন্ত গোমণ্ডলসম্বন্ধীয় বিধা প্রভৃতি ব্যাখ্যাত হইল।

যে-যুথে সংখ্যায় একশত গৰ্দভ বা অশ্ব থাকিবে তাহাতে পাঁচ-পাঁচটি করিয়া ঋষভ (অর্থাৎ তজ্জাতীয় পুরুষ পশু) রাখিতে হইবে, যে-যুথে একশত করিয়া অজ (ছাগ) বা মেষ থাকিবে তাহাতে দশ-দশটি করিয়া ঋষভ (পুরুষ পশু) এবং যে-যুথে একশত সংখ্যক গরু, মহিষ বা উষ্ট থাকিবে তাহাতে চারি-চারিটি ঋষভ (পুরুষ পশু) রাখিতে হইবে ॥ ১ ॥

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্ৰে অধ্যক্ষপ্রচার-নামক দ্বিতীয় অধিকরণে গোধ্যক্ষ-নামক উনত্রিংশ অধ্যায় (আদি হইতে ৫০ অধ্যায়) সমাপ্ত।

.

ত্রিংশ অধ্যায়
৪৭শ প্রকারণ-অশ্বাধ্যক্ষ

(রাজকীয়)। অশ্বাধ্যক্ষ নিম্নলিখিত (সাতপ্রকার) অশ্বের সংখ্যা (নিজ নিবন্ধপুস্তকে) লেখাইয়া রাখিবেন, যথা—(১) যে অশ্বসমূহ (বিক্রয়ার্থ) পণ্যাগারে রক্ষিত হইতেছে; (২) যে-গুলি ক্রয়দ্বারা লব্ধ; (৩) যে-গুলি যুদ্ধে প্ৰাপ্ত; (৪) যে-গুলি নিজা শ্বদ্বারা উৎপন্ন; (৫) যো-গুলি অন্য রাজাকে সাহায্য প্রদানের পরিবর্তে প্ৰাপ্ত; (৬) যে-গুলি অন্যদ্বারা (অর্থের পরিবৰ্ত্তে) পণ বা অধিরূপে স্থিত ও (৭) যে-গুলি অল্প সময়ের জন্য অন্য হইতে নিজ প্রয়োজনে আনীত; এবং সেই সঙ্গে অশ্বগুলির কুল (অর্থাৎ পারসীক-কাম্বোজাদি কোন দেশে জন্ম), বয়স, (শুক্লকৃষ্ণাদি) বর্ণ, চিহ্ন, বৰ্গীকরণ (পারসীকাদিভেদে বিভাগ) ও প্ৰাপ্তিস্থানের বিষয়ও লেখাইবেন।

(তিনি) যে-সব অশ্ব অপ্রশস্ত (অর্থাৎ স্বভাবতঃ দোষযুক্ত), অঙ্গবিকল ও ব্যাধিগ্রস্ত, (সে-সবের পরিবর্তন ও চিকিৎসার জন্য) সরকারের নিকট ख्रांनांझेब्रु ब्रांथिंदन।।

এক মাসের জন্য পৰ্য্যাপ্ত (নগদ খরচ ও অশ্বভোজ্যাদি) যথাক্রমে রাজকোশ ও কোষ্ঠাগার হইতে লইয়া অশ্ববাহ (সহিস) অশ্ব-পরিচর্য্যার কাৰ্য্য চালাইবে।

(অশ্বাধ্যক্ষ) এমন অশ্বশালা (বা মাদুরা) নিৰ্ম্মাণ করাইবেন, যাহা অশ্বের সংখ্যানুসারে দীর্ঘ বা আয়ত হইবে, যাহা অশ্বের লম্বতার দ্বিগুণ বিস্তারযুক্ত হইবে, যাহা (চতুর্দিকে) চারিটি দ্বার-যুক্ত থাকিবে এবং যাহার মধ্যস্থল অশ্বগণের উপাবৰ্ত্তন বা প্রলুঠনের জন্য পৰ্য্যাপ্ত হইবে, যাহাতে প্রগ্ৰীব বা বারান্দা থাকিবে, যাহার দ্বারদেশের বহির্ভাগ (উভয় পাৰ্থে আসন-জন্য কাষ্ঠ–) ফলক-যুক্ত থাকিবে, এবং যাহা (বিষাদির প্রতিকারার্থ) বানর, ময়ুর পৃষত (মৃগাবিশেষ) নকুল, চকোর, শুক ও শারিকাদ্বারা পরিব্যাপ্ত থাকিবে।

(অশ্বাধ্যক্ষকে অশ্বশালা) প্রত্যেক অশ্বের জন্য এমনভাবে পূৰ্ব্ব বা উত্তরমুখী স্থান নিবেশিত করিতে হইবে, যাহাতে অশ্বের দৈর্ঘ্যানুসারে চৌকোণ, চাকচিক্যযুক্ত কাষ্ঠফলকের আস্তরণ থাকিবে, যাহাতে (যবসাদি) ভক্ষণের উপযোগী কোষ্ঠ নিৰ্ম্মিত থাকিবে এবং যাহাতে (অশ্বের) মল ও মূত্র ত্যাগের সুবিধা থাকিবে। (রাজভবনের উত্তর-পূর্ব্বভাগে অশ্বশালা থাকা উচিত এরূপ অন্যত্ন বলা হইয়াছে, কিন্তু, অশ্বের সংখ্যাবাহুলা-জন্য যদি অন্যদিকে অশ্বশালার নিৰ্ম্মাণ আবশ্যক হয়, তাহা হইলে সেই) অশ্বশালার অবস্থানবশতঃ (দ্বারাদির) দিগ্নিভাগ কল্পনা করিয়া নিতে হইবে। বড়বা! (প্রসবিনী অশ্ব), বৃষ, (বীৰ্য্যসেচনকারী অশ্ব) ও কিশোর (অর্থাৎ ৬ মাস হইতে ৩ বৎসর বয়স্ক অশ্বশিশু)-গণের জন্য একান্ত স্থান (অর্থাৎ অন্যান্যের দৃষ্টির অগোচর স্থলে পৃথক পৃথকভাবে স্থান) নির্দ্দিষ্ট থাকিবে।

কোন বড়বা (ঘোটকী) শিশু প্রসব করিলে পর, ইহাকে তিনদিন পৰ্য্যন্ত (প্রতিদিন) একপ্রন্থ-পরিমিত ঘৃত পান করিতে দিতে হইবে। ইহার পর ইহাকে দশ দিবস পৰ্য্যন্ত (প্রতিদিন) একপ্রন্থ-পরিমিত সজ, এবং স্নেহদ্রব্য (তৈলাদি)-মিশ্ৰিত ভৈষজ্য (কোথাদি ঔষধ) পানাৰ্থ দিতে হইবে। তদনন্তর পুলাক (অর্থাৎ অৰ্দ্ধসিদ্ধ যাবাদি), যবস (ঘাস) ও ঋতুযোগ্য (অন্যান্য শস্যাদিরূপ) আহার দিতে হইবে।

প্রসবের দশদিন পরে, ছয় মাস পৰ্যন্ত কিশোরকে (অশ্বশিশুকে) এক কুড়ব সক্ত এবং ইহার চতুর্থাংশ ঘৃত ইহাতে মিশাইয়া দিতে হইবে এবং একপ্রস্থ দুগ্ধও ইহার আহাৰ্য্যরূপে দিতে হইবে। তাহার পর তিন বৎসর পর্য্যন্ত (প্রতিদিন) একপ্রন্থ-পরিমিত যাব দিতে হইবে এবং (দরকার হইলে) প্রতিমাসে অৰ্দ্ধপ্রস্থপরিমিত যাব বাড়াইয়া (প্রতিদিন) দিতে পারা যাইবে। (ইহার পরে) চারি বৎসর বয়স পৰ্য্যন্ত একন্দ্ৰোণ-পরিমিত যাব (প্রতিদিন) দেওয়া যাইতে পারিবে, ইহার পর, কিশোরের চারিবর্ষ বা পঞ্চবর্ষ পূর্ণ হইলে, ইহা (সান্নাহাদি) কৰ্ম্মের উপযুক্ত হইবে এবং তখন তাহার প্রমাণও (নিম্নোক্ত কায়প্রমাণও) পূর্ণ হইবে।

উত্তম অশ্বের মুখ ৩২ অঙ্গুল-পরিমিত হইবে; মুখ-পরিমাণের পাঁচগুণ অর্থাৎ ১৬০ অঙ্গুল ইহার আয়াম বা দৈর্ঘ্য হইবে। ইহার জঙ্ঘা ২০ অঙ্গুল-পরিমিত হইবে; এবং ইহার উৎসেধ বা উচ্চতা জজঘা-পরিমাণের চারিগুণ অর্থাৎ ৮০ অঙ্গুল হইবে। (উত্তম অশ্বের যে পরিমাণ বলা হইল তাহা হইতে) ৩ অঙ্গুল কম পরিমাণ হইবে মধ্যম অশ্বের, এবং তদপেক্ষায়ও ৩ অঙ্গুল কম পরিমাণ হইবে অধম অশ্বের। (উত্তম অশ্বের) পরিণাহ বা পরিক্ষেপ (মোটাই) ১০০ অঙ্গুলপরিমিত হইবে। মধ্যম অশ্বের পরিক্ষেপ (উত্তম অশ্বের পরিক্ষেপের পরিমাণ হইতে) পঞ্চভাগ কম হইবে অর্থাৎ ৮০ অঙ্গুল-পরিমিত হইবে এবং অধম অশ্বের পরিক্ষেপ তদপেক্ষায়ও পঞ্চভাগ কম হইবে অর্থাৎ ৬৪ অঙ্গুল-পরিমিত হইবে (মতান্তরে, ৬০ অঙ্গুল হইবে।)।

উত্তম অশ্বের জন্য শালি (ধান্য), ব্রীহি (সাধারণ চাউল), বা প্রিয়ঙ্গুর দুই দ্রোণ-ইহা অৰ্দ্ধশুষ্ক, অথবা অৰ্দ্ধসিদ্ধও হইতে পারে—কিংবা উক্ত পরিমাণের মুদগ (মুগ) ও মাষের পুলাক (অর্থাৎ ভক্তিসিকৃথ) (ভোজনাৰ্থ) দিতে হইবে এবং পানাৰ্থ স্নেহের (অর্থাৎ তৈল বা ঘৃতের) একপ্রস্থ, লবণ পাঁচ পল, মাংস পঞ্চাশ পল, এবং খাদ্যপিণ্ডের ক্লেদনের জন্য (অর্থাৎ ভিজাইবার জন্য) (মাংসাদির) রস এক আঢ়ক, কিংবা, ইহার দ্বিগুণ (অৰ্থাৎ ২ আঢ়ক) দধি দিতে হইবে। পাঁচ পল (গুড়াদি) ক্ষরিদ্রব্যের সহিত একপ্রস্থ সুরা বা তদ্বিগুণ (অর্থাৎ ২ প্রস্থ) দুগ্ধও (অপরাহ্নে) দিতে হইবে।

এবং যে অশ্বগুলি দীর্ঘ পথ চলিয়া ও অধিক ভার বহন করিয়া ক্লান্ত হইয়াছে তাহাদের খাওয়ার জন্য একপ্রন্থ-পরিমিত স্নেহদ্রব্য দিতে হইবে-ইহাই তাঁহাদের জন্য অনুবাসনাখ্য বন্তিচিকিৎসা (মতান্তরে, খাওয়ার জন্য যেমন এক প্রস্থ মোহ দিতে হইবে, তেমন অনুবাসনচিকিৎসার জন্যও একপ্রস্থ স্নেহ দিতে হইবে —এইরূপ অনুবাদ)। আবার এক কুড়ুব (অর্থাৎ প্রন্থের চতুর্ভাগ)-পরিমিত মেহ (অশ্বের) নাসিকাসেচন-জন্য দিতে হইবে। যবস (বা হরিত শস্যের) অৰ্দ্ধভার (অর্থাৎ দশ তুলা) এবং ইহার দ্বিগুণ (অর্থাৎ বিশ তুলা) তৃণ, অথবা ছয় হস্ত পরিক্ষেপ-পরিমিত তৃণস্তম্বসংঘাত (অর্থাৎ দুই বাহুর আলিঙ্গনদ্বারা গ্ৰাহ তৃণস্তম্বস্তৃপ) দিতে হইবে।

(উত্তম অশ্বের নিমিত্ত বিহিত খাদ্যাদির পরিমাণ হইণ্ডে) এক-চতুর্থাংশ কম আহাৰ্য্যাদি মধ্যম অশ্বের জন্য বিহিত এবং তদপেক্ষায়ও এক-চতুর্থাংশ কম আহাৰ্য্য অধম অশ্বের জন্য বিহিত হইবে। রথ বহনকারী কিংবা বীৰ্য্যসেচনকারী মধ্যম অশ্বের জন্যও উত্তম অশ্বের আহাৰ্য্যাদি বিহিত বলিয়া ধরা হইবে এবং রথীবাহী কিংবা বীৰ্য্যসেচনকারী অধম অশ্ব মধ্যম অশ্বের আহাৰ্য্যাদি পাইবে।

বড়বা বা ঘোটকী ও খচ্চরজাতীয় ঘোটকের জন্য উক্ত বিধার পরিমাণের এক= চতুর্থাংশ কম বিধা বিহিত এবং এই বিধা হইতেও এক-চতুর্থাংশ কম বিধা কিশোর অশ্বের জন্য নির্দ্দিষ্ট হইবে। এইভাবে (অশ্বের জন্য বিধা প্রদানের প্রকার নিরূপিত হইল।)

(অশ্বের) বিধা বা আহারের যে পাচক, যে (অশ্বের) সুত্র বা রশ্মিগ্রাহী পরিচারক ও যে (অশ্বের) চিকিৎসক, তাহারাও বিধাভোগী হইবে অর্থাৎ তাহাদের নিজ ব্যবহারার্থ তাহারা সরকারপক্ষ হইতে বিধা পাইতে অধিকারী হইবে।

যে-সব অশ্বযুদ্ধ, ব্যাধি ও জরার নিমিত্ত ক্ষীণ হইয়া পড়ে এবং যাহারা (সান্নাহ্যাদি) কৰ্ম্মকরণে অসমর্থ সেগুলিকে কেবল উদরপূত্তির জন্য আহাৰ্য্য দিতে হইবে। যে-সব অশ্ব (শক্তিশালী হইলেও) যুদ্ধকৰ্ম্মের অযোগ্য সেগুলিকে পুরবাসী ও জনপদবাসীদিগের প্রয়োজনাৰ্থ বৃষরূপে অৰ্থাৎ বীৰ্য্যসেচকরূপে বড়বাতে প্রয়োগ-জন্য রাখিতে হইবে।

যুদ্ধাদিকৰ্ম্মে প্রযুক্ত হইবার উপযুক্ত অশ্বগুলির মধ্যে সেই সেই অশ্বই উত্তম বলিয়া গৃহীত হইবে, যাহার কাম্বোজ, সিন্ধু, আরাট্ট (পাঞ্জাবের উত্তরপূর্ব্বস্থ দেশবিশেষ), ও বনায়ু (আরবদেশের প্রাচীন নাম) দেশে উৎপন্ন। আর বাহুলীক (অর্থাৎ প্ৰাচীনদিগের মতে, যে দেশ পাঞ্জাবের পাঁচ নদী ও সিন্ধুনদের অন্তর্বত্তী দেশ), পাপেয় (সম্ভবতঃ উত্তর-পশ্চিম সীমান্তদেশের অন্তভূক্ত কোন দেশ), সৌবীর (গুজরাটপ্রদেশের দেশবিভাগের প্রাচীন নাম) তিতল দেশে উৎপন্ন অশ্ব মধ্যম। অবশিষ্ট (পূর্বোক্ত দেশ সমূহ হইতে অতিরিক্ত সুরাষ্ট্রাদি দেশজাত) অশ্ব অধম।

উপযুক্ত অশ্বগুলির তীক্ষ্ণগতিত্র (অর্থাৎ অত্যল্প কশাঘাতেই কাৰ্য্যপটুতা), ভদ্রগতিত্ব (অর্থাৎ কশাঘাতের মাত্রানুসারেই কাৰ্য্যপটুতা) ও মন্দগতিত্ব (অর্থাৎ বেশী কশাঘাতে কাৰ্য্যপরতা) লক্ষ্য করিয়া তাহাদিগকে সান্নাহ্য যুদ্ধসম্বন্ধীয়) বা ঔপবাহ্যক (সাধারণ যানাদিবহনযোগ্য) কৰ্ম্মে নিযুক্ত করিতে হইবে।

(শালিহোত্ৰাদিদ্বারা অভিহিত) সংগ্রামসম্বন্ধীয় সৌষ্ঠবযুক্ত কৰ্ম্মকে সান্নাহ্য কৰ্ম্ম বলা হয়।

আর (অশ্বের) ঔপবাহ্য কৰ্ম্ম পাঁচপ্রকার হইতে পারে, যথা-বল্গন (ঘূর্ণনগতি), নীচৈৰ্গত (অবিকৃতগতিতে ঘূর্ণন), লঙ্ঘন (লম্ফপ্রদান), ধোরণ (নানাগতিতে দৌড়ান) ও নারোষ্ট্র (ইসারাতে গমন)। তন্মধ্যে বল্গন ছয় প্রকার হইতে পারে, যথা (১) ঔপবেণুক (অর্থাৎ একহস্ত-পরিমিত পরিক্ষেপের মধ্যেই মণ্ডলাকারে ঘূর্ণন), (২) বৰ্দ্ধমানক (অর্থাৎ পরিক্ষেপের যে মণ্ডল লইয়া গতি আরদ্ধ তাঁহাই রক্ষা করিয়া ঘূর্ণন), (৩) যমক (অর্থাৎ যুগপৎ দুইপ্রকার পরিক্ষেপবিশিষ্ট মণ্ডলে ঘূর্ণন) (৪) আলীঢ়প্লুত (অর্থাৎ একপাদ সন্ধুচিত করিয়া অন্য পাদ প্রসারিত করিয়া প্লাতিযুক্ত ঘূর্ণন), (৫) পূর্ব্বগ (অর্থাৎ শরীরের পূর্বাৰ্দ্ধদ্বারা ঘূর্ণন) ও (৬) ত্রিকচালী (অর্থাৎ শরীরের পশ্চাদ্ধদ্বারা ঘূর্ণন)।

মস্তক ও কর্ণদ্বয় অবিকৃত রাখিয়া অশ্ব যে বন্ধন করে, তাহাঁই নীচৈৰ্গত বলিয়া অভিহিত হয়। এই নীচৈৰ্গত ষোল প্রকার হইতে পারে, যথা-(১) প্রকীর্ণক (অর্থাৎ সর্বপ্রকার গতির সংকর যাহাতে আছে), (২) প্রকীৰ্ণোত্তর (প্রকীর্ণ হইলেও যাহাতে একটি গতিই প্রধান), (৩) নিষন্ন (অর্থাৎ যাহাতে পৃষ্ঠভাগ অকম্পিত থাকে), (৪) পার্শ্বানুবৃত্ত (অর্থাৎ যাহাতে একদিকে তিৰ্যক গতি লক্ষিত হয়), (৫) উস্মিমার্গ (অর্থাৎ জলের তরঙ্গের মত উন্নত ও আনত গতিবিশিষ্ট চলন), (৬) শরভক্রীড়িত। (অর্থাৎ শরভজন্তুর ক্রীড়ার মত গতি), (৩) শরভপ্লুতি (অর্থাৎ শরভের লম্বনের মত চলা), (৮) ত্রিতাল (অর্থাৎ তিন পাদে চলা), (৯) বাহ্যানুবৃত্ত (অৰ্থাৎ দক্ষিণে ও বামে ঘুরিয়া চলা), (১০) পঞ্চপাণি (অর্থাৎ তিন পাদ একবার রাখিয়া অন্য পাদ দুইবার রাখিয়া চলা), (১১) সিংহায়ত (অর্থাৎ সিংহের ন্যায় চলা), (১২) স্বাধুত (অর্থাৎ একেবারেই অতিদীর্ঘগতি), (১৩) ক্লিষ্ট (অর্থাৎ চালক ছাড়াই ছুটিয়া চলা), (১৪) শ্লিঙ্গিত (অর্থাৎ শরীরের অগ্রভাগ অবনত করিয়া চলন), (১৫) বৃংহিত (অর্থাৎ শরীরের অগ্রভাগ উন্নত করিয়া চলন) ও (১৬) পুষ্পাভিকীর্ণ (অর্থাৎ গোমূত্রিকার ন্যায়। এদিক-ওদিক হইয়া চলা)।

লঙঘন সাত প্রকার হইতে পারে, যথা-(১) কপিপ্লুত (অর্থাৎ বানরের মত লম্ফ দেওয়া), (২) ভেকপ্লুত (অর্থাৎ ভেকের মতন লম্ফ দেওয়া), (৩) এণপ্লুত (অর্থাৎ হরিণের মত লম্বন্ধ দেওয়া), (৪) একপাদপ্লুত (অর্থাৎ তিন পাদ সন্ধুচিত করিয়া কেবল এক পাদদ্বারা লম্ফ দেওয়া), (৫) কোকিলসঞ্চারী (অর্থাৎ কোকিলের মত বািঢ় করিয়া লম্বন্ধ দিয়া সঞ্চরণ:), (৬) উরস্য (অর্থাৎ চারি পাদই সঙ্কচিত করিয়া বুক দিয়া লম্বন্ধ দেওয়া ও (৭) বকচারী (অর্থাৎ বকের ন্যায় মাঝে ধীরে চলিয়া হঠাৎ লম্ফ দেওয়া)।

ধোরণ আট প্রকার হইতে পারে; যথা-(১) কাঙ্ক (অর্থাৎ কঙ্ক-নামক পক্ষীর মত গতি), (২) বারিকাঙ্ক (অর্থাৎ, হংসাদির মত সমানগতি), (৩) মায়ুর (অর্থাৎ ময়ুরগতি), (৪) অৰ্দ্ধমায়ুর (অর্থাৎ কিছু কিছু ময়ূরের মত গতি), (৫) নাকুল (অর্থাৎ নকুলের মত গতি), (৬) অৰ্দ্ধনাকুল (অর্থাৎ কিছু কিছু নকুলের মত গতি), (৭) বারাহ (অর্থাৎ শূকরের ন্যায় গতি) ও (৮) অৰ্দ্ধবারাহ (অর্থাৎ কিছু কিছু বরাহের ন্যায়। গতি)।

শিক্ষালব্ধ সংজ্ঞা বা সঙ্কেতের অনুরূপ চলার নাম নারোষ্ট্র। (এই পৰ্য্যন্ত অশ্বের ঔপৰ্বাহ কৰ্ম্ম নিরূপিত হইল)।

(উত্তম, মধ্যম ও অধম) রথীবাহী অশ্বের যথাক্রমে ছয়, নয় ও বার যোজন দূর পৰ্য্যন্ত পথ চলা ব্যবস্থিত (মতান্তরে, অধম, মধ্যম ও উত্তম অশ্বের যথাক্রমে এইরূপ পথ চলা ব্যবস্থিত)। আর উত্তম, মধ্যম ও অধম পৃষ্ঠভারবাহী অশ্বের যথাক্রমে পাঁচ, সাড়ে সাত ও দশ সোজন দূর পৰ্য্যন্ত পথ চলা ব্যবস্থিত (মতান্তরে, পূর্ব্ববৎ অধমাদিক্রমে)।

(উক্ত তিন প্রকার) অশ্বের মাৰ্গ বা গতিও তিন প্রকার, যথা-(১) বিক্রম (শনৈঃ শনৈঃ গমন বা মন্দগতি), (২) ভদ্রাশ্বাস (বা মধ্যমগতি) ও (৩) ভারবাহ্য (অর্থাৎ ভারবহনকারী লোকের ন্যায় তীব্রগতি বা দ্রুতগতি)।

(ভিন্ন ভিন্ন অশ্বের চলনের) ধারা বা ক্রমও পাচপ্রকার হইতে পারে, যথা–(১) বিক্রম (ধীরে গমন), (২) বল্গিত (মণ্ডলাকারে গমন), (৩) উপকণ্ঠ (লাফাইয়া লাফাইয়া চলা), (৪) উপজব (প্রথমে অধিক বেগে ও পরে অল্প বেগে চলা) ও (৫) জব (প্রথমে-অল্প বেগে পরে অধিক বেগে চল)।

যোগ্য আচাৰ্য্যেরা (অর্থাৎ অশ্বশিক্ষকেরা) তাহাদের (অর্থাৎ রথ্য ও পৃষ্ঠবাহ্য অশ্বগুলির) মুখাদিতে বন্ধনযোগ্য নানাপ্রকার। পৰ্য্যাণাদি সাজসম্বন্ধে উপদেশ করিবেন। সুত বা সারথির রথ ও অশ্বের সংগ্রামসম্বন্ধীয় অলঙ্কারবিষয়ে উপদেশ করিবেন। অশ্বগণের চিকিৎসকেরা অশ্বের শরীরের হ্রাস ও বৃদ্ধির প্রতীকারসম্বন্ধে ও ভিন্ন ভিন্ন ঋতুতে উপযোগী আহারসম্বন্ধে উপদেশ করিবেন।

সুত্রগ্ৰাহ (অর্থাৎ অশ্বের রশ্মিধারক), অশ্ববন্ধক (অর্থাৎ খলীন বা লাগাম, পৰ্য্যাণ বা জীনাদি বন্ধনকাৰ্য্যে অধিকৃত পরিচারক), যাবসিক (অর্থাৎ ঋতুর অনুগামী ঘাসাদি আহারদাতা), বিধাপাচক (অর্থাৎ শালিমূদগ প্রভৃতির পাচক), স্থানপাল (অর্থাৎ অশ্বের অবস্থানদেশের শোধক কৰ্ম্মচারী) কেশকার (অর্থাৎ অশ্বের কেশাদি যথাসময়ে কাটিয়া ছাটিয়া দেয় নে কৰ্ম্মকর) ও জাঙ্গলবিদেরা (বিষবিদ্যাপটু অশ্ব-চিকিৎসকেরা) নিজ নিজ নিয়ত কৰ্ম্মদ্বারা অশ্বের পরিচর্য্যা করিবে।

এই সব কৰ্ম্মচারীরা নিজ কৰ্ত্তব্যের অতিক্রম (অকারণ বা অন্যথাকরণ) করিলে, তাহাদিগের (অতিক্রম–) দিবসের বেতন কাটিয়া লওয়া হইবে। নীরাজনক্রিয়ার জন্য (অর্থাৎ অশ্বের উপদ্রব শান্তির জন্য ক্রিয়মাণ দীপাদিদ্বার সৎকারবিশেষের জন্য) যে অশ্বকে বাধিয়া রাখা হইয়াছে, অথবা যে অশ্বকে চিকিৎসার জন্য উপরুদ্ধ করা হইয়াছে, সেই অশ্বকে কৰ্ম্ম করাইলে অপরাধীর দ্বাদশ পণ দণ্ড হইবে। (চিকিৎসা–) ক্রিয়া বা ঔষধের অকরণ-জন্য (অশ্বের) ব্যাধির বৃদ্ধি ঘটিলে, তাহার প্রতীকার-জন্য যত খরচ হইবে ইহার দ্বিগুণ মূল্য (অশ্বাধ্যক্ষকে) দণ্ডরূপে দিতে হইবে। আর চিকিৎসা ক্রিয়া ও ভৈষজ্যের দোষে অশ্বের বিপত্তি ঘটিলে, অশ্বের মূল্য যতটা ততটা দণ্ডরূপে তাঁহাকে দিতে হইবে।

এতদ্দ্বারা অর্থাৎ অশ্বের পরিচর্য্যা ও চিকিৎসা প্রভৃতির নিরূপণ হইতে, গোমণ্ডল, গর্দভ, উষ্ট্র ও মহিষ, এবং অজ (ছাগ) ও অবিক (মেষ)-সম্বন্ধেও পরিচর্য্যাদির কথা ব্যাখ্যাত হইল বুঝিতে হইবে (অর্থাৎ অপরাধ প্রতিপন্ন হইলে গোধ্যক্ষ প্রভৃতির উপরও অনুরূপ দণ্ড ব্যবস্থিত হইবে)।

(শরৎ ও গ্রীষ্মকালে অশ্বাধ্যক্ষ লক্ষ্য করিবেন যেন।) প্রতিদিন অশ্বের দুইবার স্নান করান হয় এবং তাহাকে গন্ধ ও মাল্য দেওয়া হয়, এবং কৃষ্ণপর্বে (অর্থাৎ অমাবস্যায়) ভূতবলি ও শুক্লপর্বে (অর্থাৎ পূর্ণিমা-তিথিতে) স্বস্তি বাচনের ব্যবস্থা থাকে। ১।৷

আশ্বিন মাসের নবম দিনে (অশ্বের) নীরাজনা (বা আরাত্রিক বা আরতি) করাইতে হইবে এবং অশ্বাধ্যক্ষকে যাত্রার প্রারম্ভে ও অবসানে এবং (অশ্বের) ব্যাধির সময়ে শান্তিকাৰ্য্যে নিরত থাকিয়া (নীরাজনা করাইতে হইবে)। ২।৷

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্ৰে অধ্যক্ষপ্রচার-নামক দ্বিতীয় অধিকরণে অশ্বাধ্যক্ষনামক ত্রিংশ অধ্যায়। (আদি হইতে ৫১ অধ্যায়।) সমাপ্ত।

.

একত্রিংশ অধ্যায়
৪৮শ প্রকরণ-হস্ত্যধ্যক্ষ

হস্ত্যধ্যক্ষ নিম্নলিখিত কাৰ্য্যগুলির অনুষ্ঠান-বিষয়ে পৰ্য্যবেক্ষণ করিবেন,–(তিনি) হস্তিবনের রক্ষাকাৰ্য্য বিধান করিবেন; শিক্ষাকৰ্ম্মগ্রহণদ্বারা দান্ত হস্তী, হস্তিনী ও হস্তীশাবকের জন্য শালাসমূহের, (দাড়াইবার আলান বন্ধন? স্থানের, শয্যার (শয়নস্থানের), (সান্নাহাদিক) কৰ্ম্মের, বিধার বা আহাৰ্য্যদ্রব্যের ও যবসের (কাঁচা ঘাসের) প্রমাণ নির্ণয় করিয়া দিবেন; হস্তীকে দম্যাদি কৰ্ম্মে শিক্ষালাভের জন্য আযুক্ত বা আসক্ত করাইবার বন্দোবস্ত করিবেন; হস্তীর বন্ধন (আলানাদি), (অঙ্কুশাদি) উপকরণ, (বৰ্ম্ম-তোমরাদি) সাংগ্রামিক অলঙ্কার এবং (হস্তীর জুন্য) চিকিৎসক, অনীকস্থ (গজশিক্ষক) ও উপস্থায়ুক বর্গের (উপস্থান বা পরিচর্য্যায় রত কৰ্ম্মকর) কাৰ্য্যসম্বন্ধে সমস্ত বিধান করিবেন।

(তিনি) এইরূপ হস্তিশালী নিৰ্ম্মাণ করাইবেন,–যাহার উৎসেধ (উচ্চতা) বিষ্কম্ভ (বিস্তার) ও আয়াম (দীর্ঘতা) হস্তীর যাহা উৎকৃষ্ট আয়াম বা দীর্ঘত (অর্থাৎ ৯ হাত) তাহার দ্বিগুণ হইবে (অর্থাৎ হস্তিশালার উচ্চতা, বিস্তার ও দীর্ঘতা ১৮ হাত-পরিমিত হইবে), যাহাতে হস্তিনীর জন্য অতিরিক্ত স্থানের ব্যবস্থা থাকিবে, যাহা প্রগ্ৰীব বা মুখশালা-(বারান্দা-) যুক্ত থাকিবে, যাহাবে কুমারী-নামক হস্তিবন্ধনন্তম্ভোপরি রক্ষিত তুলাষন্ত্রের মত দণ্ড পৰ্যাপ্তভাবে সংগৃহীত থাকিবে, এবং যাহার মুখ বা দ্বার পূর্ব্বদিকে বা উত্তরদিকে অবস্থিত থাকিবে।

(তিনি) হস্তীর মুত্র ও পুরীষ (মল) ত্যাগের জন্য এমন স্থান নিৰ্ম্মাণ করাইবেন যাহাতে হস্তীর আয়াম-পরিমিত অর্থাৎ নয়। হাত-পরিমিত এক মসৃণ বন্ধনস্তম্ভ প্রোথিত থাকিবে এবং যাহাতে জমি ঢাকিবার জন্য চারিকোণযুক্ত কাষ্ঠফলক (অগ্রোন্নতভাবে,) পাতা থাকিবে। (তিনি) হস্তীর জন্য পূর্বোক্ত স্থানের মাপের অনু গুণ এক শয্যা নিৰ্ম্মাণ করাইবেন, যাহার উন্নত স্থান অৰ্দ্ধপঞ্চম হস্ত। (অর্থাৎ সাড়ে চারিহাত) পরিমিত থাকিবে-কিন্তু, এই শয্যা সান্নাহ ও ঔপবাহ্য হস্তীর জন্য দুর্গ (বা নগর) মধ্যে নিবেশিত থাকিবে এবং দম্য ও ব্যাল হস্তীর জন্য দুৰ্গ-বহির্ভাগে নিবেশিত থাকিবে।

দিনমানকে সমান আট ভাগে বিভক্ত করা হইলে ইহার প্রথম ও সপ্তম ভাগে হাতির স্নানকাল বুঝিতে হইবে এবং এই দুই বার স্নানের পরেই হাতিকে বিধা বা পাক আহাৰ্য্য দিবার কাল বুঝিতে হইবে। পূর্বাহ্নে হাতির ব্যায়ামকৰ্ম্মের জন্য নির্দ্দিষ্ট কাল থাকিবে। অপরাহ্নে পানের কাল নির্দ্দিষ্ট থাকিবে। রাত্রিকে সমান তিন ভাগে বিভক্ত করা হইলে ইহার দুই ভাগ সময় হাতিকে ঘুমাইতে দিতে হইবে এবং অবশিষ্ট তৃতীয় ভাগ তাহাকে বিশ্রামার্থ উপবেশন ও উত্থানজন্য দিতে হইবে।

গ্রীষ্মেই হাতি ধরার উপযুক্ত কাল (তখন হাতি গ্রীষ্মের তাপবশতঃ ক্ষীণবল থাকে বলিয়া গ্রহণযোগ্য হয়) এবং বিংশতিবর্ষ-বয়স্ক হাতিই (অর্থাৎ সেই বয়সের নীচে না হয়)৷ গ্রহণযোগ্য হয়।

স্তন্যন্ধয় বা মাতৃস্তন্যপায়ী (যাহার নাম বিক্ক), মৃঢ়-নামক হাতি, (অর্থাৎ যাহার দাঁত হস্তিনীর দাতের সমান পরিমাণ-বিশিষ্ট), মৎকুণ্ব-নামক হাতি (অর্থাৎ যাহার দাঁত নিষ্ক্রান্ত হয় নাই) ও ব্যাধিগ্রস্ত হাতি এবং গর্ভিণী ও বিক্ক হাতিকে স্তন্যপান-দাত্রী হস্তিনী গ্রহণযোগ্য নহে। প্রমাণে যে হাতির উচ্চতা সাত হাত, আয়াম বা দৈর্ঘ্য নয়। হাত ও পরিণাহ বা পরিক্ষেপ (অর্থাৎ মোটাই) দশ হাত এবং যাহার বয়স চল্লিশ বৎসর সে হাতিই উত্তম বলিয়া পরিজ্ঞাত। যে হাতির বয়স ত্রিশ বৎসর তাহাকে মধ্যম বলিতে হইবে (ইহার প্রমাণ উচ্চতায় ছয় হাত ইত্যাদি পরে বলা যাইবো) এবং যে হাতির বয়স পঁচিশ বৎসর তাহাকে অবর বা অধম বলা যায় (ইহার প্রমাণ উচ্চতায় পাঁচ হাত ইত্যাদিও পরে বলা যাইবে)।

শেষোক্ত দুই প্রকার হাতির (অর্থাৎ মধ্যম ও অধম হাতির) বিধা বা আহাৰ্য্য দেওয়ার বিধি চতুৰ্ভাগ করিয়া কম হইবে অর্থাৎ উত্তম হাতির জন্য যেপরিমাণ বিধার ব্যবস্থা আছে তাহা হইতে এক চৌথ কম বিধা পাইবে মধ্যম হাতি এবং মধ্যম যাহা পাইবে তদপেক্ষায় এক চৌথ কম বিধা পাইবে অধম হাতি।

পূর্ণ সাত অরত্বি বা সাত হাত উচ্চ হাতির জন্য প্রত্যেক অরত্নির হিসাবে এইরূপ বিধা ব্যবস্থিত হইবে, যথা-এক দ্রোণ তণ্ডুল, অৰ্দ্ধ আঢ়ক তৈল, তিন প্রস্থ ঘৃত, দশ পল লবণ, পঞ্চাশ পল মাংস, ভুক্তিপিণ্ডের সেচনার্থ এক আঢ়ক (মাংসসংস্কৃত) রস অথবা, (রসাভাবে) ইহার দ্বিগুণ দধি, দশ পল ক্ষার (গুড়াদি দ্রব্য), মধ্যাহ্নে পানের জন্য এক আড়ক মদ্য অথবা, (মদ্যাভাবে) ইহার দ্বিগুণ দুগ্ধ, গাত্রে মাখিবার জন্য একপ্রস্থ তৈল, মাথায় দেওয়ার জন্য এক প্রস্থের অষ্ট ভাগ অর্থাৎ অৰ্দ্ধ কুডুব তৈল, (রাত্ৰিতে) প্রদীপের জন্য ততখানি (অর্থাৎ প্রস্থের অষ্ট ভাগ) তৈল। ২.২৫ ভার (৪৫০০ পল), যবস বা হরিত শস্যাদি ও ২.৫ ভার শুদ্ধ শম্প দিতে হইবে। কিন্তু, কড়ঙ্গর বা শ্যল্লকীর পত্ৰাদি সম্বন্ধে কোন নিয়ম নাই। (অর্থাৎ উক্ত বিধার সাতগুণ-পরিমিত বিধা সাত হাত উচ্চ উত্তম হস্তীকে দিতে হইবে; সম্ভবতঃ ‘প্রত্যেক অরত্নির হিসাবে” এই ব্যাখ্যা ছাড়িয়া অরতুি সম্বন্ধে সাত হাত উচ্চ হাতির জন্যই এইরূপ বিধা বুঝিতে হইবে, ইহার সাত গুণ নহে)। আট হাত উচ্চ যে হাতির নাম অত্যরাল হাতি তাহার ভোজন সাত হাত উচ্চ হাতির সমানই থাকিবে।

উপরিউক্ত সাত হাত ও আট হাত উচ্চ হাতি ছাড়া যে (মধ্যম) হাতি উচ্চতায় ছয় হাত ও যে (অধমু) হাতি উচ্চতায় পাঁচ হাত তাহারা যথাক্রমে উত্তম হাতির জন্য বিধেয় বিধার এক-চতুর্থাংশ কম এবং মধ্যম হাতির জন্য বিধেয় বিধার এক-চতুর্থাংশ কম বিধা পাইবে।

ক্রীড়ার জন্য (কৰ্ম্মের জন্য নহে) যদি বিক্ক হস্তী গ্রহণযোগ্য হয়-তাহা হইলে ইহাকে দুগ্ধ ও যাবস দ্বারাই পোষণ করিতে হইবে।

সাত অবস্থায় হাতির সাত প্রকার শোভা কল্পনীয় হয়, যথা-হাতির যে অবস্থায় কেবল ত্রক ও অস্থি দেখা যায় এবং যাহাতে রুধির উপজাত হয়। সেই অবস্থার শোভার নাম সঞ্জাতিলোহিতা। যে অবস্থায় কিঞ্চিৎ মাংস উৎপন্ন হওয়ায় অস্থি ছন্ন হইতে থাকে। সে অবস্থার শোভার নাম প্রতিচ্ছন্না। যে অবস্থায় দুই পার্থেই মাংসলেপ ঘটাতে ইহা মসৃণ দেখা যায়। সেই অবস্থার শোভাকে সংলিপ্তপক্ষা বলা হয়। যে অবস্থায় হাতির সব অবয়বে সমানভাবে মাংস দৃষ্ট হয়। সে অবস্থার শোভা সমকক্ষ্যা বলিয়া আখ্যাত। যে হাতির শরীরের এক স্থানে নীচ ও অন্য স্থানে উচ্চ মাংস দেখা যায়, সেই অবস্থার শোভা ব্যতিকীৰ্ণমাংসা বলিয়া অভিহিত। যে অবস্থায় হাতির পৃষ্ঠবংশে উৎপন্ন মাংসের সমান মাংস পৃষ্ঠবংশপাশ্বেও লক্ষিত হয়। সেই অবস্থার শোভাকে সমতল্পতলা নাম দেওয়া হয় এবং যে অবস্থায় হাতির পৃষ্ঠের আকৃতি, পাৰ্থদ্রয়ের মাংসের উন্নতির জন্য দ্রোণীর মত দেখায় সে অবস্থার শোভা জাতদ্রোণিকা বলিয়া কথিত হয়।

উপরিউক্ত শোভার অনুসরণ করিয়া ভদ্র (উত্তম) হস্তী, মন্দ (মধ্যম) ও }মুগ (অধম) হস্তীকে ব্যায়াম ও পরিশ্রম শিক্ষা দেওয়াইতে হইবে এবং ভদ্রাদি সঙ্কারজনিত মৃগহস্তীকেও (অর্থাৎ ভদ্রমন্দ, ভদ্রমৃগ ইত্যাদিকেও) সান্নাহাদি কৰ্ম্মে শিক্ষা দেওয়াইতে হইবে। অথবা, সকল হাতিকেই ( শরদাদি) ঋতু অনুসরণ করিয়া শিক্ষা দেওয়াইতে হইবে ॥ ১ ॥

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্ৰে অধ্যক্ষপ্রচার-নামক দ্বিতীয় অধিকরণে হস্ত্যধ্যক্ষ-নামক একত্রিংশ অধ্যায় (আদি হইতে ৫২ অধ্যায়) সমাপ্ত।

.

দ্বাত্রিংশ অধ্যায়
 ৪৮শ প্রকরণ-হস্ত্যধ্যক্ষ-হস্তিপ্রচার

কৰ্ম্মভেদানুসারে–হস্তী চারি প্রকার, যথা-(১) দম্য (অৰ্থাৎ শিক্ষাদ্বারা দমনযোগ্য, (২) সান্নাহ (যুদ্ধকাৰ্য্যের উপযোগী), (৩) ঔপবাহ্য (সোওয়ারী বহনযোগ্য) ও (৪) ব্যাল (ঘাতক বৃত্তিযুক্ত)।

তন্মধ্যে দম্য হস্তী পাঁচ প্রকার, যথা-(১) স্কন্ধগত (যে হস্তী মনুষ্যকে স্কন্ধে লাইতে কোনরূপ উপদ্রব করে না), (২) স্তম্ভগত (যে হস্তী স্তম্ভে বন্ধন সহ করে), (৩) বারিগত (যে হস্তী সহজে বারি বা বারী অর্থাৎ গজবন্ধনী বা গজবন্ধনশালাতে প্রবেশ করে—“বারী তু গজবন্ধনী” ইত্যমরঃ; “বারির্বাগগজবন্ধন্যোঃ স্বী কীবেহঙ্গুনি বালুকে” ইতি মেদিনী), (৪) অবপাতগত (যে হস্তী তৃণচ্ছন্ন করিয়া রচিত গৰ্ত্তে আসিয়া পতিত হয়) এবং (৫) যুথগত (যে হস্তী দান্ত হস্তিনীর সহিত বিহারার্থ যুথে বা গজদলে উপস্থিত হয়)। দম্যহস্তীর পরিচর্য্যা বিক্ক বা হস্তিশিশুর পরিচর্য্যার মত হইবে, অর্থাৎ তাহাকেও দুগ্ধ, ঘাস ও ইক্ষুকাণ্ডাদি দিতে হইবে।

সান্নাহ্য হস্তীর সাত প্রকার ক্রিয়ামার্গ বিহিত হইতে পারে, যথা(১) উপস্থান অর্থাৎ অগ্রপশ্চাদ্রত্তী অবয়বের নমন ও উন্নমন করা এবং ধ্বজা, উল্কা, বেণু ও রজ্জুপ্রভৃতি লঙ্ঘন করা; (২) সংবৰ্ত্তন অর্থাৎ ভূমিতে শয়ন, উপবেশন ও রেখা-গৰ্ত্ত প্রভৃতি লঙ্ঘন করা; (৩) সংযান অর্থাৎ সরল, বক্র, গোমূত্রিকাকার কিংবা মণ্ডলাকার গতিবিশেষে চতুৰ্য্য; (৪) বিধাবধ অর্থাৎ শুণ্ড, দন্ত বা গাত্রদ্বারা অশ্ব, মানুষ বা রথাদির বন্ধসাধন; (৫) হস্তিযুদ্ধ অর্থাৎ অন্য হস্তীর সহিত যুদ্ধ; (৬) নাগরায়ণ অৰ্থাৎ নগরের গোপুর, আটালক ও পরিঘ প্রভৃতির ভঞ্জন; ও (৭) সাংগ্ৰামিক অর্থাৎ সৌপ্তিকাদি প্রকাশযুদ্ধে প্রবৰ্ত্তন। সান্নাহ হস্তীর উপাচরণ বা পরিচর্য্যাদিতে লক্ষ্য রাখিতে হইবে-যেন হস্তী কক্ষ্যা বা মধ্যবন্ধনে, কণ্ঠভূষাবন্ধনে ও (পূর্ব্বকায় ও পশ্চাদ্রত্তী কায়ের উন্নতত্বাদি গজশাস্ত্রোক্ত ক্রিয়াদ্বারা) অন্য যুথাদিতে প্রবেশকরণে কৌশল লাভ করিতে পারে।

ঔপবাহ্য হস্তী আট প্রকার, যথা-(১) আচরণ অর্থাৎ যে হস্তী পূর্ব্ব ও অপর কায়ের উচ্চ-নীচ করা প্রভৃতি সর্বপ্রকার গজগতির অনুসরণ করিতে পারে; (২) কুঞ্জরৌপ্যবাহ্য অর্থাৎ যে হস্তী অন্য হস্তীর সহিত এক সঙ্গে ঔপবাহ্য কাৰ্য্য করিতে পারে; (৩) ধোরণ অর্থাৎ যে হস্তী এক পক্ষ বা পার্শ্ব ধরিয়াই সর্বকৰ্ম্ম করে; (৪) আধানাগতিক অর্থাৎ যে হস্তী দুই তিন প্রকারের গতিতে চলিতে জানে; (৫) ষষ্ট্যুপবাহ্য অর্থাৎ যে হস্তী যষ্টি তাড়নায় কৰ্ম্ম করে; (৬) তোত্রোপ বাহ, অর্থাৎ যে হস্তী তোত্র বা কণ্টকময় বেণু বা অঙ্কুশাদির তাড়নায় কৰ্ম্ম করে } (৭) শুদ্ধোপবাহ্য অর্থাৎ যে হস্তী যষ্টি বা তোত্রের তাড়না ব্যতিরেকেই মাহুতের পদাঘাতাদি সংজ্ঞাদ্বারাই চলিতে পারে এবং (৮) মাৰ্গায়ুক অর্থাৎ যে হস্তী শিকারকৰ্ম্মে শিক্ষাপ্ৰাপ্ত। ঔপবাহ্য হস্তীর উপাচরণ বা পরিচর্য্যাকাৰ্য্য তিন প্রকারের হইতে পারে, যথা-(১) শারদকৰ্ম্ম-ইহা চারি প্রকার-(ক) হস্তী অতিমাত্রায় স্থূল থাকিলে ইহার রুশীকরণ, (খ) কৃশ থাকিলে ইহার স্থূলীকরণ, (গ) লোহিত বা মন্দাগ্নি হইলে ইহার অগ্নিদীপন এবং (ঘ) ইহা প্রকৃতিস্থ থাকিলে ইহার স্বাস্থ্যরক্ষণ; (২) হীনকৰ্ম্ম অর্থাৎ হস্তী ব্যায়ামে বিমুখ থাকিলে ইহাকে ব্যায়ামে প্রবৰ্ত্তন ও (৩) নারোষ্টকৰ্ম্ম অর্থাৎ হস্তীকে সংজ্ঞা বা ইসার শিক্ষা দেওয়া।

ব্যাল বা ঘাতক হস্তীর ক্রিয়া-মাৰ্গ একপ্রকার। ইহার উপাচরণ বা পরিচর্য্যা এইরূপ-ইহাকে নিয়মিত করিয়া এক লোকই রক্ষা করিবে। অথবা, আষম্যদণ্ডদ্বারাই কেবল ইহাকে রাখিতে হইবে।

উপদ্রবকারী হস্তী নিম্নলিখিতরূপ হইতে পারে, যথা—(১) কৰ্ম্মশঙ্কিত অর্থাৎ শিক্ষাকৰ্ম্মসময়ে যে হস্তী প্রতিকুলচারী হইয়া উঠে; (২) অবরুদ্ধ অর্থাৎ ষে হস্তী কৰ্ম্মের অনুপযোগী বলিয়া উপেক্ষিত; (৩) বিষম অর্থাৎ যে হস্তী যদুচ্ছায় অনুষ্ঠানকারী; (৪) প্রভিন্ন অর্থাৎ যে হস্তী মদদোষে দুষ্ট; (৫) প্রভিন্নবিনিশ্চয় অর্থাৎ যে হস্তী মদদোষে বা বিধাদোষে অত্যন্ত ব্যাকুলীভুত এবং (৬) মদহেতুবনিশ্চয় অর্থাৎ যে হস্তী সর্বদাই মদমত্ত থাকায় তাহার মদহেতুত্র মবিজ্ঞাত থাকে।

সাধারণতঃ ব্যাল হস্তী সর্বক্রিয়াতেই দোষযুক্ত অর্থাৎ দুষ্টকৰ্ম্মে দূষিত। ইহার ভদ চারিপ্রকার, যথা-(১) শুদ্ধ অর্থাৎ যে ব্যাল হস্তী কেবল ঘাতুক (হস্তিশাস্ত্রানুসারে অষ্টাদশ দোষে দুষ্ট); (২) সুব্রত অর্থাৎ যে ব্যাল হস্তী কেবল চালক পঞ্চদশ দোষে দুষ্ট); (৩) বিষম অর্থাৎ যে ব্যাল হস্তী ঘাতন ও চালন এই উভয়কৰ্ম্মের দোষে দুষ্ট; ও (৪) সর্বদোষপ্রদুষ্ট অর্থাৎ যে ব্যাল হস্তী উক্ত তেত্রিশ ও নিজের উনবিশংতি দোষে দুষ্ট।

হস্তীদিগের বন্ধন ও আবশ্যকীয় অন্যান্য উপকরণ দ্রব্যসম্বন্ধে অনীকস্থ অর্থাৎ হস্তিশিক্ষাবিচক্ষণ শিক্ষকেরাই প্রমাণ অর্থাৎ তাহাদের কথানুসারে সে-সব করণীয়। তন্মধ্যে, আলান অর্থাৎ হস্তীবন্ধন স্তম্ভ, গ্রৈবেয়ক অর্থাৎ হস্তীর গ্ৰীবাবন্ধনের শৃঙ্খল; কক্ষ্য অর্থাৎ হস্তীর কক্ষবন্ধনরজ্জু, পারায়ণ অৰ্থাৎ হস্তীতে আরোহণসময়ের আলম্বনরজ্জু, পরিক্ষেপ অর্থাৎ হস্তীর পদবন্ধন-পাশ বা রজ্জু, ও উত্তর অর্থাৎ কলাপাদি গলবন্ধনবিশেষ, ইত্যাদি দ্রব্যগুলিকে বন্ধন বলা হয়। অঙ্কুশ, বেণু (বা দণ্ড) ও যন্ত্র (পাঞ্চালিকাদিরূপ যন্ত্র যাহা আয়ুধাগারাধ্যক্ষ প্রকরণে উক্ত হইয়াছে) ইত্যাদি দ্রব্যকে উপকরণ বলা হয়। বৈজয়ন্তী হস্তীর উপর রক্ষণীয় পতাকা, অথবা কণ্ঠহার-বিশেষ), ক্ষুর প্রমালা (নক্ষত্রমালানামক মালাবিশেষ, ২য় অধিকরণে ১১ অধ্যায় দ্রষ্টব্য), আস্তরণ (অম্বারীর নীচে পাতিবার বস্ত্রবিশেষ) ও কুথ (হস্তীর বুল) ইত্যাদি দ্রব্যকে ভূষণ বলা হয়। বৰ্ম্ম (কবচ), তোমার (অপর নাম শৰ্বল, চতুৰ্হস্ত-পরিমিত আয়ুধবিশেষ; সম্ভবতঃ যাহাকে বাঙ্গালীরা শাবল বলে), শরাবাপ (তুণীর বা বাণাধান) ও (অন্যান্য) যন্ত্র প্রভৃতিকে সাংগ্ৰামিক (যুদ্ধসম্বন্ধী) অলঙ্কার বলা হয়।

নিম্নলিখিত কৰ্ম্মকরসমূহকে লইয়া হস্তীর ঔপস্থায়িকবর্গ অর্থাৎ উপস্থান বা পরিচর্য্যায় নিযুক্ত লোক বুঝিতে হইবে, যথা-(১) চিকিৎসক (অর্থাৎ হস্তীর পীড়াদির উপশমজন্য নিযুক্ত গজবৈদ্য), (২) অনীকস্থ (হস্তিশিক্ষক), (৩) আরোহক (গজশাস্ত্রজ্ঞ গজারোহী), (৪) আধোরণ (গজশাস্ত্রজ্ঞ গজকৰ্ম্মকুশল পুরুষ), (৫) হস্তিপক (হস্তীরক্ষক), (৬) ঔপচারিক (হস্তীর চারণ, উদ্বাৰ্ত্তন ও অভ্যঞ্জনাদি কাৰ্য্যসম্পাদক), (৭) বিধাপাচক (হস্তীর আহাৰ্য্য বস্তুর পাককারী), (৮) যাবসিক (যবসদানকারী), (৯) পাদপাশিক (হস্তীর পাদবন্ধনকারী), (১০) কুটীরক্ষক (গজশালার রক্ষণ ও শুচীকরণাদিতে ব্যাপৃত পুরুষ), (১১) ঔপশায়িক (হস্তীর শয়নশালায় অধিকৃত পুরুষ) প্রভৃতি।

চিকিৎসক, কুটীরক্ষক ও বিধাপাচক (হস্তীর আহার হইতে প্রত্যেকে নিজের জন্য) এক প্রস্থ-পরিমিত অন্ন, এক প্রস্থতি বা অৰ্দ্ধাঙ্গুল-পরিমিত স্নেহ (, তৈলঘৃতাদি) ও দুই পল-পরিমিত ক্ষার (গুড়াদি) ও লবণ লইতে পারিবে। আর চিকিৎসক ব্যতীত অপর দুই জন (অর্থাৎ কুটীরক্ষক ও বিধাপাচক) দশপলপরিমিত মাংসও লাইতে পারিবে।

পথচলার সময়ে (পথি’শব্দ পরবত্তী সমাসবদ্ধ পদের সহিত সংযোজিত করিলে–পথগমনে অভিতপ্ত হস্তীর সহিত অর্থাম্বয় হইবে), হস্তী যদি ব্যাধি, কৰ্ম্ম, মদ ও জরাতে অভিতপ্ত হয়; তাহা হইলে চিকিৎসকেরা ইহার প্রতীকার করিবে।

নিম্নবর্ণিত দোষ হইলে ঔপস্থায়িকদিগের দণ্ডের কারণ উপস্থিত হইবে, যথাহস্তীর থাকিবার স্থানের অশুদ্ধি বা অমার্জনাদিজনিত আবর্জন রাখা, হস্ত্রীকে খাওয়াইবার জন্য ব্যবস না নেওয়া, স্থল বা শক্ত ভূমিতে হস্তীকে শোয়ান, তাড়নের অযোগ্য মৰ্ম্মাদি স্থানে আঘাত করা, হস্তীর উপর অনধিকারী অপর লোককে চড়ান, অসময়ে হস্তীকে চালন, আভুমি বা বিষমদেশে চালন, অতীর্থে বা ঘাট-শুন্য স্থানে হস্তীকে জলে নামান, এবং তরুগহনে হস্তীকে নেওয়া সুতরাং এইগুলি অত্যয় বা দণ্ডস্থান বলিয়া নির্দেশ করা হইয়াছে। এই দণ্ড তাহাদের ভক্ত (ভাত) ও বেতন হইতে আদায় করা হইবে।

(হস্তীর বলবৃদ্ধি ও বিক্সের শান্তির জন্য) চাতুর্মাস্যের ঋতুসন্ধিতে অর্থাৎ কাৰ্ত্তিক, ফাত্তন ও আষাঢ় মাসের পৌর্ণমাসীতে, তিনবার নীরাজনা বা আরাত্রিক করিতে হইবে; এবং অমাবস্তাতে ভূতাবলি, ও পূর্ণিমাতে সেনানী বা কাৰ্ত্তিকেয়ের ইজ্যা বা পূজা করিতে হইবে ॥ ১।

প্রত্যেক আড়াই বৎসরে নদীচারী হস্তীর ও প্রত্যেক পাঁচ বৎসরে গিরিচর হস্তীর দন্ত কাটিতে হইবে-কিন্তু, দেখিতে হইবে যেন হস্তীর দন্তমূলের পরিণাহ বা পরিক্ষেপমানের দ্বিগুণ দস্তভাগ ছাড়িয়া দিয়া দন্ত কাটা হয়। ২।৷

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্রে অধ্যক্ষপ্রচার-নামক দ্বিতীয় অধিকরণে হস্তধ্যক্ষাপ্রকরণোক্ত হস্তিপ্রচার-নামক দ্বাত্রিংশ অধ্যায় (আদি হইতে ৫৩ অধ্যায়) সমাপ্ত।

.

ত্রয়োস্ত্রিংশ অধ্যায়
৪৯শ-৫১শ প্রকরণ-রথাধ্যক্ষ, পত্ত্যধ্যক্ষ ও সেনাপতির কাৰ্য্য

অশ্বাধ্যক্ষ প্রকারণে উক্ত বিধানসমূহদ্বারা রথাধ্যক্ষের করণীয়ও ব্যাখ্যাত বলিয়া বুঝিতে হইবে (অর্থাৎ সেই প্রকরণে অশ্বের জন্য শালানিৰ্ম্মাণ, অশ্বের বিধা বা আহাৰ্য্যাদি যাহা যাহা অভিহিত হইয়াছে, রথের জন্যও সে-সব বুঝিয়া লাইতে হইবে)।

রথাধ্যক্ষকে রথ তৈয়ার ও মেরামত করার জন্য কৰ্ম্মান্ত বা কারখানা করাইতে হইবে।

দ্বাদশাঙ্গুলাত্মক যে পুরুষ-পরিমাণ, সেই পুরুষ-পরিমাণের দশ পুরুষ উচ্চ এবং তথাভূত বার পুরুষ বিস্তৃত রথই (উত্তম শ্রেণীর রথ)। বিস্তৃতিতে এক এক পুরুষ কমাইয়া ছয় পুরুষ পৰ্য্যন্ত বিস্তৃত আরও ছয় প্রকার রথ হইলে, এই ছয় প্রকার রথ এবং পূর্বের দশ পুরুষ উচ্চ ও বার পুরুষ বিস্তৃত এক প্রকার, মোটের উপরু, এই সাত প্রকার রথ প্রস্তুত হইতে পারে।

বিভিন্ন-প্রকার কাৰ্য্যের উপযোগী (নিম্নলিখিত) রথভেদ-সমূহ রথাধ্যক্ষ নিৰ্ম্মাণ করাইবেন, যথা-(১) দেবরথ (যাত্রা ও উৎসবাদিতে দেবপ্রতিমা সঞ্চারণ করাইবার উপযোগী রথা), (২) পুষ্পরথ (বিবাহাদি। মঙ্গলকাৰ্য্যে ব্যবহারের উপযোগী রথা), (৩) সাংগ্ৰামিক রথ (যুদ্ধে ব্যবহারের উপযোগী রথ) (৪) পারিযাণিক রথ (সাধারণ পথসঞ্চারণের উপযোগী রথ), (৫) পরপুরাভিযাণিক রথ (শক্রির দুর্গাদি ভঞ্জনের উপযোগী রথা) ও (৬) বৈগয়িক রথ (অশ্বাদির চৰ্য্যাশিক্ষার উপযোগী রথা)।

(রথাধ্যক্ষ) বাণ, (ধনুরাদি) অস্ত্র, (তোমরাদি) প্রহরণ, আবরণ (ঢাকিবার বস্ত্ৰাদি) ও অন্যান্য (বল্পাদি) উপকরণ দ্রব্যের রচনা এবং সারথি, রথিক (রথব্যবহারী সৈনিকাদি), ও রথ্যের (রখবাহ অশ্বাদির) স্ব স্ব কৰ্ম্মে নিযুক্তিসম্বন্ধে সমস্ত বিষয় জানিবেন। আবার কৰ্ম্ম সমাপ্ত না হওয়া পৰ্য্যন্ত (তিনি) ভূত (নিয়মিতভাবে কাৰ্য্যকারী শিল্পী) ও অভূতাদিগের (আগন্তু শিল্পীদিগের) ভক্ত ও বেতনসম্বন্ধে, তাহাদের উপযুক্ত রক্ষণ ও তাহাদের অনুষ্ঠেয় কৰ্ম্মসম্বন্ধে এবং তাহাদের দ্বারা কৃত কৰ্ম্মের অনুরূপ। অর্থদানকৰ্ম্ম ও মানদানকৰ্ম্মসম্বন্ধে সমস্ত তত্ত্ব জানিয়া রাখিবেন।

ইহা দ্বারা অর্থাৎ রথাধ্যক্ষের ব্যাপারদ্বারা পত্ত্যধ্যক্ষের ব্যাপারও ব্যাখ্যাত হইল বুঝিতে হইবে। এই পত্ত্যধ্যক্ষ মৌলবল (রাজধানীরূপ মূলস্থানে বাসকারী সৈন্য), ভৃতবল (বেতনভোগী সৈন্য), শ্রেণিবল (জনপদবৰ্ত্তা আয়ুধীয়গণ), মিত্রবল (মিত্ররাজার সৈন্য), অমিত্রবল (শত্রুরাজার সৈন্য) ও অটবীবলের (অটবীপালের অধিকৃত সৈন্যের) সারিতা ও ফল্গুতার বিষয় অবগত থাকিবেন।

তথা পত্তাধ্যক্ষ নিম্নযুদ্ধ (গৰ্ত্তাদি নীচ স্থানে যুদ্ধ), স্থলযুদ্ধ (খোলা ভূমিতে যুদ্ধ), প্রকাশযুদ্ধ (সম্মুখে উপস্থিত থাকিয়া যুদ্ধ), কূটযুদ্ধ (কপটযুদ্ধ), খনকযুদ্ধ (ভূমি খনন পূর্ব্বক সেখানে অবস্থিত থাকিয়া যুদ্ধ), আকাশযুদ্ধ (উচ্চস্থানে বা ব্যোমযানে চড়িয়া যুদ্ধ), দিবা যুদ্ধ ও রাত্রিযুদ্ধের শিক্ষাবিষয়ে নিপুণভাবে পরিচিত থাকিবেন। পত্তিদিগের স্বকৰ্ম্মে নিয়োগ ও অনিয়োগ সম্বন্ধে সব বিষয় তিনি জানিয়া রাখিবেন।

সেনাপতি (চতুরঙ্গসেনা ও মৌলাদিবলের নায়ক) (অশ্বাধ্যক্ষাদি একৈকসেনাঙ্গের অধিপতিদিগের) সব কাৰ্য্যই জানিয়া রাখিবেন; এবং তাঁহাকে নিম্ন যুদ্ধাদি সর্বপ্রকার যুদ্ধ, (ধনুরাদি) প্রহরণ ও (আস্বীক্ষিকী প্রভৃতি) নানাপ্রকার বিদ্যাতে শিক্ষিত হইয়া এবং হস্তী, অশ্ব ও রথ চালনে অত্যন্ত নিপুণ হইয়া চতুরঙ্গ বলের বা সেনার অনুষ্ঠান (নানাবিধ কৰ্ত্তব্য-করণ) তাহাদের অনুষ্ঠান-বিষয়ে সব তত্ত্ব জানিয়া রাখিতে হইবে।

সেনাপতি তাহার (সেনাব্যায়ামাদির জন্য) স্বভূমি, যুদ্ধের কাল, শত্রুর সেনা, অভিন্ন শত্রুবৃহের ভেদসাধন, ভিন্ন নিজ বৃহের সন্ধান বা সংশ্লেষণ, সংহত বা একত্র মিলিত শক্রিসেনার বিঘটন, বিঘটিতদিগের বধ, শক্রদুর্গের ধ্বংস ও যুদ্ধযাত্রার কালসম্বন্ধে সব বিষয় বিচারপূর্ব্বক লক্ষ্য করিয়া রাখিবেন।

সৈন্যগণের শিক্ষাবিষয়ে রত থাকিয়া, (সেনাপতি) তাহাদের অবস্থান, অভিযান ও প্রহরণ-ব্যবহার-বিষয়ে, তুৰ্য্যধ্বনি, ধ্বজ ও পতাকাদ্বারা যুদ্ধে বৃহাবদ্ধ স্বাসেনার জন্য সংকেত ব্যবস্থা করিবেন। ১।৷

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্ৰে অধ্যক্ষপ্রচার-নামক দ্বিতীয় অধিকরণে রথাধ্যক্ষ, পত্ত্যধ্যক্ষ ও সেনাপতির কাৰ্য্যনামক ত্রয়ন্ত্রিাংশ অধ্যায় (আদি হইতে ৫৪ অধ্যায়) সমাপ্ত।

.

চতুস্ত্রিংশ অধ্যায়
 ৫২শ-৫৩শ প্রকরণ—মুদ্রাধ্যক্ষ ও বিবীতাধ্যক্ষ

মুদ্ৰাধ্যক্ষ (রাজকীয় চিহ্নযুক্ত লেখ্যাদি বা মুদ্রাসম্বন্ধে অধিকারী প্রধান রাজপুরুষ) (রাজ্যে প্রবেশকারী ও তথা হইতে নিশ্রুমণকারীকে) এক মাষক খাজনা লইয়া মুদ্রা প্রদান করিবেন।

মুদ্রাযুক্ত লোকই জনপদে প্রবেশলাভ ও তথা হইতে নিশ্রুমণ করিতে পারিবে।

জনপদবাসী কোন ব্যক্তি মুদ্রা না লইলে তাহার ১২ পণ দণ্ড হইবে। কেহ কৃটি বা কপট মুদ্রা প্রদৰ্শন করিলে, তাহাকে প্রথমসাহসদণ্ড দিতে হইবে। অন্য জনপদভব ব্যক্তি কুটিমুদ্রা দেখাইলে, তাহাকে উত্তমসাহসদণ্ড দিতে হইবে।

বিবীতাধ্যক্ষ (অর্থাৎ গোচারণার্হ তৃণযুক্ত প্রদেশের অবেক্ষণকারী অধ্যক্ষ) (লোকের) মুদ্রা পরীক্ষা করিবেন (অর্থাৎ কেহ অমূদ্র বা কুটিমুদ্রাহস্ত হইয়া বিবীতপথ দিয়া যাতায়াত করে কি না, তাহা জানিবার জন্য মুদ্রা পরীক্ষা করিবেন)।

(চোর ও অপসর্পের সঞ্চার-নিমিত্তক) দুইটি ভয়যুক্ত স্থানের মধ্যে (বিবীতাধ্যক্ষ)। বিবীত স্থাপন করিবেন। চোর ও হিংস্র জন্তুগণের অবস্থান-ভয়ে (তিনি) নিম্নপ্রদেশগুলি (অর্থাৎ গভীর খাতস্থানগুলি) ও অরণ্যগুলিকে শোধিত রাখিবেন (অর্থাৎ তন্নিবারণ-জন্য পরীক্ষা করিবেন)।

যেস্থানে জলের অভাব, সেই স্থানে (বিবীতাধ্যক্ষ) কৃপ, সেতুবন্ধ ও উৎস স্থাপন করিবেন এবং সেখানে পুষ্পবাধ ও ফলবাটও স্থাপন করিবেন।

লুব্ধক (শিকারী) ও চণ্ডালের অরণ্যের মধ্যে ভ্রমণ করিতে থাকিবে, (অর্থাৎ চোর ও শত্রুর প্রবেশ-পরিহারার্থ এইরূপ করিবে)।

চোর ও শত্রুদিগের আগমন লক্ষ্য করিলেই তাহারা নিজে ধরা না দিয়া শঙ্খ ও দুন্দুভির শব্দ উৎপাদন করিবে-যাহাতে ধরা না দিতে হয় তজন্য তাহারা পৰ্বতে বা বৃক্ষের উপর আরোহণ করিবে, অথবা শীঘ্বগামী (অশ্বাদি) বাহনে উঠিয়া (অন্তপালাদির নিকট) চলিয়া যাইবে।

(তাহারা) শত্রু ও আটবিক জনদিগের সঞ্চার লক্ষ্য করিলে রাজার নিকট সেই সংবাদ মুদ্রাযুক্ত গৃহকপোতদ্বারা পাঠাইয়া দিবে, অথবা, (দিনের বেলায় এই বিপদ আসিলে) ধূমপরম্পর্যদ্বারা ও (রাত্ৰিতে এই বিপদ আসিলে) অগ্নিজালন-পরম্পরন্থদ্বারা এই সংবাদ (রাজকুলে) পৌছাইয়া দিবার বন্দোবস্ত করিবে।

(বিবীতাধ্যক্ষ)। দ্রব্যবনে ও হস্তিবনে যে আজীব (অর্থাৎ ব্যবসাদি উপজীব্য পদার্থ) হইতে পারে তাহার স্থাপন করাইবেন এবং তিনি বৰ্ত্তনী-নামক কর (যাহা দুৰ্গমার্গে চলাচল-জন্য দেয় কর), চোররক্ষণ (অর্থাৎ চোর হইতে রক্ষণজন্য দেয় কর, যাহার নাম পরবত্তীকালে চৌরোদ্ধরণিক-নামক করা হইয়াছিল), সার্থতিবাহ্য (অর্থাৎ সাৰ্থ ব বণিকসংঘের অতিবাহনাৰ্থ দেয় করা), গোরক্ষ্য (গোরক্ষানিমিত্তক দেয় কর) ও (আজীবপদার্থের ক্রয়বিক্রয়ারূপ) ব্যবহারও স্থাপনা করিবেন। ১।৷

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্ৰে অধ্যক্ষপ্রচার-নামক দ্বিতীয় অধিকরণে মুদ্রাধাক্ষ ও বিবীতাধ্যক্ষ-নামক চতুঞ্জিংশ অধ্যায় (আদি হইতে ৫৫ অধ্যায়।) সমাপ্ত।

.

পঞ্চত্রিংশ অধ্যায়
৫৪শ-৫৫শ প্রকরণ-সমাহৰ্ত্তার ব্যাপার এবং গৃহপতি, বৈদেহক
ও তাপস-বেশধারী গূঢ়পুরুষগণের কাৰ্য্য

সমাহর্ত্তা (সৰ্ব্বপ্রকার আয়স্থান হইতে রাজার্থের সম্যক আহরণকারী মহামাত্র) জনপদকে চারিভাগে বিভক্ত করিয়া, (প্রত্যেক বিভাগস্থিত) গ্রাম সমূহকেওঁ উত্তম, মধ্যম ও অধমরূপে কল্পনা করিয়া ভাগ করিবেন, এবং সেগুলির প্রত্যেকটির ও গ্ৰামমণ্ডলীর পরিমাণ নিবন্ধপুস্তকে লিপিবদ্ধ করাইয়া রাখিবেন এবং কোন কোন গ্রাম পরিহার (অর্থাৎ রাজকর-মুক্তি) ভোগ করে, কোন গ্রাম (প্রতি বৎসর) কতসংখ্যক আয়ুধীয় (আয়ুধধারী সৈনিক) পুরুষ প্রদান করে, আবার কোন কোন গ্রাম রাজকরের পরিবর্তে কত পরিমাণ ধান্য, (গবাদি) পশু, হিরণ্য (নগদ টাকা), কুপ্য (কাষ্ঠাদি দ্রব্য) ও বিষ্টি (রাজকীয় কাৰ্য্য করার জন্য কৰ্ম্মকর।) নিয়তভাবে প্রদান করে-তাহাও পৃথক পৃথক নিবন্ধপুস্তকে লিখাইয়া রাখিবেন।

সমাহৰ্ত্তার নিযুক্ত গোপ-নামক রাজপুরুষ (উত্তম হইলে) পাঁচ পাঁচ গ্রামের এক এক বর্গের, অথবা, (অধম হইলে) দশ দশ গ্রামের এক এক বর্গের (সুতরাং মধ্যম হইলে ছয় সাতটি গ্রামের এক এক বর্গের) কাৰ্য্যসমূহ সম্বন্ধে চিন্তা করিবেন। (অর্থাৎ এক এক জন গোপ পঞ্চগ্ৰামী-চিন্তক, দশগ্ৰামী-চিন্তক ইত্যাদিরূপ হইয়া কাৰ্য্যভার গ্রহণ করিবেন)।

তিনি (গোপ) প্রত্যেক গ্রামের পরিমাণ (নদীপ্রভৃতি)-দ্বারা সীমাবচ্ছেদপূর্ব্বক (নিবন্ধপুস্তকে) লিপিবদ্ধ করাইবেন এবং প্রত্যেক ক্ষেত্রের পরিমাণ ও (তৎসম্বন্ধ) নিম্নলিখিত অষ্টাদশ বস্তুর সংখ্যানসহকারে লিখাইয়া রাখিবেন, যথা-অমুক ক্ষেত্র কৃষ্ট (অর্থাৎ যে ক্ষেত্র কর্ষণের উপযোগী, অথবা যে ক্ষেত্র কৃষ্টপচ্য বা কর্ষণদ্বারা পচ্য ব্রীহিপ্রভৃতির উৎপাদক), অমুক ক্ষেত্র আকৃষ্ট (অর্থাৎ কর্ষণের অযোগ্য, অথবা যাহা আকৃষ্টপচ্য নীবারাদির উৎপাদক), অমুক জমি স্থলভূমি (অর্থাৎ অপেক্ষাকৃত উচ্চভূমি), অমুক ক্ষেত্র কেদার (শালেয়াদির উৎপাদক), অমুক জমি আরাম বা উপবন (বাগিচা), অমুক স্থান ষণ্ড (কদলীপ্রভৃতির ক্ষেত্র), অমুক স্থান বাট (বা ইক্ষুপ্রভৃতির ক্ষেত্র), অমুক জমি বন (অর্থাৎ গ্রামবাসীর জন্য কাষ্ঠাদির উৎপাদক), অমুক স্থান বাস্তুভুমি, অমুক স্থান চৈত্য (অর্থাৎ বৌদ্ধাদির আয়তন, বা উদ্দেশাবৃক্ষ), अर्मुक স্থান দেবগৃহ (দেবালয়), অমুক স্থান সেতুবন্ধ (অর্থাৎ যাহাতে জল বাধিয়া রাখি বার তড়াগাদি আছে), অমুক স্থান শ্মশানক্ষেত্র, অমুক স্থান সত্র বা অন্নদানশালা, অমুক স্থান প্রপা (বা পথিকদিগের পানীয়শালা), অমুক স্থান (তীর্থাদি) পুণ্যস্থান, অমুক স্থান বিবীত বা গোপ্রচার-প্রদেশ ও অমুক স্থান (শকটাদির যাতায়াতজন্য) পথ (অর্থাৎ এইরূপ ভাবে নির্দেশপূর্ব্বক নিবন্ধপুস্তকে লিখাইতে হইবে)। এইরূপ সংখ্যান-সহকারে (গ্রামের) উক্ত সীমা ও ক্ষেত্রগুলির মৰ্য্যাদা (চতুর্শিদকুস্থিত সীমাবচ্ছেদক চিহ্ন), তৎসম্বন্ধ অরণ্য (ক্ষেত্রমধ্যস্থ চলাচলের) পথ, সেগুলির পরিমাণ, সম্প্রদান (কে কাহাকে কত জমি দিয়াছে তাহার ইয়ত্তা), বিক্রয়, অনুগ্রহ (ধান্যাদি ঋণরূপে দিয়া কৃষকদিগের উপকারাদি করণ), ও পরিহারের (করমোক্ষের) নিবন্ধনও ব্যবস্থা করিবেন (অর্থাৎ নিবন্ধপুস্তকে লিপিবদ্ধ করিয়া রাখিবেন)। এবং (তিনি গ্রামবাসীদিগের) কোন গৃহ রাজকর দেয় ও কোন গৃহ রাজকর দেয় না।–তাহারও নির্দেশ (নিবন্ধপুস্তকে) লিপিবদ্ধ রাখিবেন।

গ্ৰামস্থিত গৃহগুলিতে কোথায় কত ব্ৰাহ্মণাদি চতুৰ্বর্ণের লোক বাস করে, কত কৃষক, গোরক্ষক (গোয়াল), বৈদেহক (বণিক), কারু (শিল্পী), কৰ্ম্মকর ও দাস থাকে, (মোটের উপর) কত (মনুষ্যাদি) দ্বিপদ ও চতুষ্পদ জন্তু থাকে এবং কোন স্থান হইতে কত হিরণ্য (নগদ টাকা), বিষ্টি (কৰ্ম্মকর বা মজুর), শুল্ক ও দণ্ড (সৈনিকসংখ্যা, মতান্তরে জরিমানা) উখিত হয়-তাহাও তিনি নিবন্ধপুস্তকে লেখাইবেন।

(গোপ) প্রত্যেক কুলের (পরিবারের) লোকের মধ্যে কয়জন স্ত্রীলোক, কয়জন পুরুষ, কয়জন বালক ও কয়জন বৃদ্ধ আছে তাহার পরিমাণ জানিয়া রাখিবেন এবং গ্রামের লোকদিগের (ব্রাহ্মণাদি) হিসাবে করণীয় কৰ্ম্ম, চরিত্র, আজীব (জীবনধারণের বৃত্তি) ও ব্যয়-সম্বন্ধে সব বিষয় জানিয়া রাখিবেন।

এই প্রকার ভাবে জনপদের প্রত্যেক চতুর্থ ভাগের সব কাৰ্য্যাবলী স্থানিকনামক রাজপুরুষ চিন্তা করিবেন (অর্থাৎ সব কাৰ্য্যের পৰ্য্যবেক্ষণ করিবেন)।

গোপ ও স্থানিক-নামক রাজপুরুষদিগের এলাক-স্থানে (কণ্টকশোধনপ্রকরণে উক্ত) প্রদেষ্ট নামক অধিকারী পুরুষেরা নিজ নিজ কণ্টকশোধন কাৰ্য্যের অনুষ্ঠান করিতে পারিবেন এবং (যাহারা স্বয়ং রাজকরের আদায়ক তাহাদিগের নিকট হইতে) বলি বা রাজকর সংগ্রহ করিবেন (অন্য ব্যাখ্যাযাহারা বলী অর্থাৎ রাজার্থের উত্থাপনে বাধা দান করিবে তেমন লোকদিগকে প্রগৃহীত বা দমিত করিবেন)।

(সম্প্রতি সমাহৰ্ত্তার আজ্ঞাধীন গৃহপতি, বৈদেহক ও তাপসের বেশধারী গূঢ়পুরুষগণের গ্রাম ও জনপদে নিযোজনসম্বন্ধে বলা হইতেছে।) সমাহর্তৃদ্বারা নিযুক্ত গৃহপতি-ব্যঞ্জন গূঢ়পুরুষগণ যে-যে ‘গ্ৰামে (চরের কাৰ্য্যে) নিযুক্ত হইয়াছে, সেই সেই গ্রামের ক্ষেত্রসংখ্যা, গৃহসংখ্যা ও কুলসংখ্যা জানিয়া রাখিবে। (তাহারা আরও জানিবে যে,) কোন ক্ষেত্রের মান (আয়ামবিস্তারাদি-পরিচ্ছিন্ন পরিমাণ) কতখানি ও ইহাতে কি কি শস্য কত পরিমাণে উৎপন্ন হয়; এবং কোন গৃহে কাহার ভোগ বা স্বত্বস্বামিত্র আছে (সুতরাং ইহার স্বামী ভোগের জন্য কতখানি কর দেয়) ও কোন গৃহে লোকেরা পরিহার বা করামুক্তি ভোগ করে, এবং কোন কুলে বা পরিবারে (ব্রাহ্মণাদি) কোন বর্ণের লোক বাস করে ও তাঁহাদের (যাজন-কর্ষণাদি) কৰ্ম্ম কি করিতে হয়। সেই সেই কুলের জঙ্ঘাগ্র অর্থাৎ ইহাতে বাস্তব্যকারী লোক ও দ্বিপদ, চতুষ্পদাদি জন্তুর সংখ্যা কত এবং (লোকদিগের) আয় ও ব্যয় কত-এই সব বিষয়ও তাহারা জানিবে। তাহারা আরও জানিবে যে কোন ব্যক্তি সেই সব গ্রামে আগে বাস করিয়া অন্যত্র প্রবাসের জন্য প্রস্থান করিয়াছে এবং কোন ব্যক্তি অন্যত্র আগে বাস করিয়া সেই সব গ্রামে আসিয়া আবাস স্থির করিয়াছে এবং এইরূপ করার কারণই বা কি। এবং তাহারা জানিবে-এই সব গ্রামে কোন কোন অনুপযুক্ত (নৰ্ত্তকীকুটনী প্রভৃতি) স্ত্রীলোক ও কোন কোন অনভিপ্ৰেত (বিট-কিতবাদি) পুরুষ আবাসার্থ আগমন ও প্রবাসার্থ তথা হইতে অন্যত্র গমন করে, এবং সেখানে শক্রপ্রযুক্ত গুপ্তচরগণের কাৰ্য্যপ্রবৃত্তিও কতখানি আছে।

এই প্রকার (সমাহৰ্ত্তনিযুক্ত) বৈদেহকব্যঞ্জন গূঢ়পুরুষেরা, রাজার স্বদেশজাত (পণ্যাধ্যক্ষপ্রকারণে উক্ত) রাজপণ্যসমূহের এবং (খন্যধ্যক্ষাপ্রকরণে উক্ত শঙ্খহীরকাদি) খনিজাত দ্রব্য, (তড়াগাদিতে উৎপন্ন মৎস্যাদি) সেতুজাত দ্রব্য, (কুপ্যাধ্যক্ষপ্রকারণে উক্ত) বনজাতদ্রব্য, কৰ্ম্মান্তে বা কারখানায় জাতদ্রব্য, ও (সীতাধ্যক্ষপ্রকারণে উক্ত ব্রীহি প্রভৃতি) ক্ষেত্রজাত দ্রব্যসমূহের পরিমাণ ও মূল্য (বাজার দর) জানিবে। তাহারা আরও জানিবে যে, পরদেশজাত এবং জলপথ ও স্থলপথদ্বারা আনীত (রত্নাদি) সারপণ্য ও (শাকাদি) ফন্তুপিণ্য ক্রয়বিক্রয়কৰ্ম্ম-সম্বন্ধে কত পরিমাণে আসিয়াছে ও ইহাদের মূল্য কত। এবং সেই সব দ্রব্যের ব্যবহার বা ব্যাপার-কাৰ্য্যে বণিকেরা (শুল্কাধ্যক্ষাপ্রকরণে উক্ত) শুদ্ধ, (অন্তপালের নিকট দেয়) বক্তানী-নামক কর, (বিবীৰ্তাধ্যক্ষের গ্রাহ সার্থতিবাহনাৰ্থ) অতিবাহিক কর, (রক্ষিপুরুষদিগের সংস্থানে দেয়) গুল্মদেয়। কর, (নাবাধ্যক্ষদেয় নদীতারণাদিজন্য) তরদেয় কর, ভাগ (পণ্যসমূহের উৎ অংশ অথবা, সহব্যবহারীদিগের বিভাগে প্ৰাপ্য অংশ), ভক্ত (ব্যাপারীদিগের বলীবৰ্দাদির ভোজনাদি নিমিত্তক খরচ) ও পণ্যগৃহে (দ্রব্যাদি রাখিবার) ভাড়া কত পরিমাণ দিয়াছে, তাহাও সব জানিবে।

এই প্রকার সমাহর্ত্তনিযুক্ত তাপসব্যঞ্জন গূঢ়পুরুষেরা কৃষক, গোরক্ষক (গোয়াল), বৈদেহক (বাণিক্‌) ও (গোপাদি) অধ্যক্ষগণেরও শৌচাশৌচ (শুদ্ধ অশুদ্ধ ব্যবহার)-সম্বন্ধে সব জানিবে। (উক্ত তাপসব্যঞ্জন গূঢ়পুরুষদিগের) পুরাণচোরের বেশধারী শিষ্যগণও চৈত্য (বৌদ্ধাদির আয়তন বা উদ্দেশাবৃক্ষ), চতুষ্পথ, শূন্যস্থান (নির্জন স্থান), উদপান (কৃপাদিজলাধার) নদী, নিপান (কৃপনিকটস্থ জলাশয়), তীর্থায়তন (পুণ্যজলপ্রদেশ), আশ্রম, অরণ্য, পৰ্বত ও বনগহনে অবস্থিত থাকিয়া চোর, শত্রু ও (শত্রুপ্রযুক্ত তীক্ষ্ণাদি) প্রবীর (সাহসিক) পুরুষদিগের সেখানে প্রবেশন, অবস্থান ও (তথা হইতে) গমনের প্রয়োজন কি, সেই সব বিষয় সম্যক উপলব্ধি করিবে।

এইভাবে উত্থানযুক্ত বা উদ্যোগী হইয়া সমাহৰ্ত্ত জনপদবিষয়ে চিন্তা করিবেন।; এবং (তাম্নিযুক্ত গৃহপতিব্যঞ্জনাদি) সংস্থা-নামক গূঢ়পুরুষেরা জনপদসম্বন্ধে সব কাৰ্য্য পৰ্য্যবেক্ষণ করিবে। এই সংস্থাগুলির উপর দৃষ্টি রাখিবার জন্য অন্য তৎসদৃশ সংস্থাও নিযুক্ত থাকিবে ॥ ১।

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্ৰে অধ্যক্ষপ্রচার-নামক দ্বিতীয় অধিকরণে সমাহর্তৃপ্রচার ও গৃহপতি-বৈদহক-তাপসব্যঞ্জনদিগের কাৰ্য্য-নামক পঞ্চত্রিংশ অধ্যায় (আদি হইতে ৫৬ অধ্যায়) সমাপ্ত।

.

ষট ত্রিংশ অধ্যায়
 ৫৬শ প্রকরণ-নাগরিকের কৰ্ত্তব্য

সমাহৰ্ত্তা যেমন জনপদের; কাৰ্য্যসম্বন্ধে চিন্তা করেন, নাগরিকও (নগরের কাৰ্য্যে নিযুক্ত মহামাত্র পুরুষও) তেমন নগরের কাৰ্য্য সম্বন্ধে চিন্তা করিবেন। (অর্থাৎ গোপ ও স্থানিকের সহায়তায় সর্বপ্রকার। কাৰ্য্যভার গ্রহণ করিবেন)। (নাগরিকের অধীনস্থ) গোপ-নামক অধিকারী পুরুষ (উত্তম) দশটি কুলের, (মধ্যম) বিংশতি কুলের ও (অধম) চল্লিশ কুলের চিন্তাভার গ্রহণ করিবেন। তিনি (গোপ) সেই সব কুলে বিদ্যমান স্ত্রীলোক ও পুরুষদিগের জাতি, গোত্র নাম ও কৰ্ম্ম (ব্যবসায়) সহ তাহাদিগের সংখ্যা, আয় ও ব্যয় জানিয়া রাখিবেন (অর্থাৎ এই সব বিষয়ের হিসাব লিপিবদ্ধ রাখিবেন)।

এই প্রকার স্থানিক-নামক অধিকারী পুরুষ দুর্গ বা নগরের চতুর্ভাগের চিন্তাভার গ্রহণ করিবেন (অর্থাৎ চারিটি বিভাগ বা ওয়ার্ডে নগরকে বিভক্ত করিয়া নাগরিক ইহার প্রত্যেকটিতে এক জন স্থানিক নিযুক্ত করিবেন এবং তাঁহার কৰ্ত্তব্য হইবে নগরবাসী স্ত্রীপুরুষগণের জাতি, গোত্র নাম ও কৰ্ম্ম এক তাহাদের সংখ্যা, আয় ও ব্যয়ের হিসাব রাখা)।

(নগরে) যাহারা ধৰ্ম্মশালার তত্ত্বাবধায়ক তাহারা পাষণ্ডী (অর্থাৎ পাশুপাতশাক্য-ভিক্ষু প্রভৃতি বিভিন্ন সম্প্রদায়ের) পথিকদিগকে (গোপ ও স্থানিকের নিকট) আবেদন করিয়া সেখানে বাস করিতে দিতে পারিবেন। এবং তাহারা যাঁহাদের সম্বন্ধে স্বয়ং ভালরূপ জানেন। সেই সব তপস্বী ও শ্রোত্ৰিয়াদিগকে (সেখানে নিজ দায়িত্বে) বাস করিতে দিতে পারিবেন।

কারুগণ ও শিল্পীরা (নিজের বিশ্বস্ত) স্বজনকে নিজ নিজ কৰ্ম্মস্থানে বাস করিতে দিতে পারিবে। বৈদেহকেরাও (বণিকেরাও) স্বকৰ্ম্মস্থানসমূহে (বিশ্বস্ত) তৎতৎপণ্য-ব্যবসায়ী দিগকে বাস করিতে দিতে পারিবে। (কিন্তু), যে পণ্য-বিক্রয়ী অনির্দ্দিষ্ট দেশে ও অনির্দ্দিষ্টকালে পণ্যসমূহের বিক্রয়কারী ও যে অস্বীয় (অর্থাৎ পরকীয়া) পণ্যের ব্যবহার বা ব্যাপার করে, (, বৈদেহকদিগকে গোপ ও স্থানিকের নিকট) তাহাদিগের নাম জানাইয়া দিতে হইবে।

শৌণ্ডিক (মদ্যবিক্রেতা), পাক্কমাংসিক (পক্কমাংসবিক্রেতা), ঔদনিক (অন্নবিক্রেতা) ও রূপাজীবা (বেশ্যা) বিশেষ পরিচিত লোককে (নিজ নিজ স্থানে) বাস করিতে দিতে পারে এবং যে লোক অত্যধিক ব্যয় করে ও জীবনানপেক্ষী কৰ্ম্ম করে, (অর্থাৎ অতিমাত্রায় মদ্যাদিপান আরম্ভ করে), তাহাদিগকে সেই সব লোকের সূচনা (গোপ ও স্থানিকসমীপে) করিতে হইবে।

যে ব্যক্তি প্রচ্ছন্নভাবে (অর্থাৎ নিজ অপরাধ প্রকাশের ভয়ে অন্যকে না জানাইয়া) (শাস্ত্ৰাদিদ্বারা বা দুষ্টব্যাধিপ্রভৃতিদ্বারা উৎপাদিত) ব্রণের চিকিৎসা করাইতে আসে এবং যে ব্যক্তি (রোগ ও মরণোৎপাদক) অপথ্য, দ্রব্য ব্যবহার করে বা প্রস্তুত করে, চিকিৎসককে গোপ ও স্থানিকের নিকট তাহাদিগের নাম নিবেদন করিতে হইবে এবং (যাহার বাড়ীতে এইরূপ অপকাৰ্য্য করা হইবে সেই) গৃহস্বামীকেও উক্ত রূপ নিবেদন করিতে হইবে; এবং তাঁহারা (চিকিৎসক ও গৃহস্বামী) তাহা করিলেই দোষমুক্ত বলিয়া গণ্য হইবেন। অন্যথা (অর্থাৎ তদ্রুপ নিবেদন না করিলে) তাহারা উভয়েই অপরাধীর সমান দোষযুক্ত গণ্য হইবেন।

(গৃহস্বামী তদীয় গৃহ হইতে) প্রস্থানকারী ও (তদীয় গৃহে) আগমুনকারীর নামও (গোপ ও স্থানিকের নিকট) নিবেদন করিবেন। অন্যথা সেই রাত্রিতেযদি সেই লোকের (কোনও প্রকার চৌৰ্য্যাদি দোষে) দোষী হয়, তাহা হইলে গৃহস্বামীকেও সেই দোষের ভাগী করিতে হইবে। যদি কোন রাত্রি ক্ষেমযুক্তই (অর্থাৎ চৌৰ্য্যাদি-রাহিতই) থাকিয়া যায়, তথাপি (আনিবেদনকারী গৃহস্বামীকে) ৩ পণ দণ্ড দিতে হইবে।

সুপথচারী ও উৎপথচারী লোকেরা (মতান্তরে মহামাগাচারী বৈদেহকাদিব্যঞ্জন লোকেরা ও বিবীতপথচারী গোপালকাদিব্যঞ্জন লোকেরা) নগরের বাহিরে ও ভিতরে যে সব দেবগৃহ, পুণ্যস্থান, বন শ্মশানস্থান আছে সেখানে কোনও ব্যক্তিকে ব্রণযুক্ত, (শাস্ত্ৰাদি) আবাঞ্ছনীয় উপকরণহস্ত, নিজ শক্তির অধিক ভারযুক্ত ভাণ্ডবাহী, ভীত বা ত্রস্ত, (রাত্ৰিজাগরণাদির ফলে) অত্যন্ত নিদ্রাপন্ন, দীর্ঘপথসঞ্চারে ক্লান্ত, বা অজ্ঞাতপূর্ব্ব বলিয়া দেখিতে পাইলে তাহাদিগকে ধরিয়া ফেলিবে (অর্থাৎ গোপ ও স্থানিকের হস্তে সমৰ্পণ করার জন্য গ্রেপ্তার করিবে)।

এই প্রকারে (নগরের) অভ্যন্তরে যে সব শূন্যগুহ, শিল্পশালা, শৌণ্ডিকাবাস (মদের দোকান), ঔদনিকাবাস (অন্নবিক্রয়স্থান বা হোটেল), পাঙ্কীমাংসিকাবাস (পক্কমাংসবিক্রয়স্থান), দৃতিবাস (জুয়ারীর আডডা) ও পাষণ্ডাবাস (বৌদ্ধাদি সম্প্রদায়ের লোকদিগের আয়তন) আছে, সেই সব স্থানে (নাগরিকের অধীনস্থ গূঢ়পুরুষেরা সব্রণাদি লোকের) অন্বেষণ করিবে (অর্থাৎ সেই সব স্থানে অন্বেষণের ফলে সেইরূপ দোষী লোক পাইলে তাহারা তাহাদিগকে নাগরিকদের নিকট সমৰ্পণ করিবে)।

গ্রীষ্মকালে দিনের মধ্যম দুই চতুর্থ ভাগে (অর্থাৎ দ্বিতীয় ও তৃতীয় প্রহরে সকলের পক্ষেই তৃঋদিনিৰ্ম্মিত গৃহে) অগ্নি-প্রজালন নিষিদ্ধ। এই নিষেধের অমান্যকারীকে ১/৮ পণ্য অগ্নিদণ্ড দিতে হইবে। (কিন্তু, তাহারা) (পাককৰ্ম্মাদির জন্য গৃহের) বাহিরে অগ্নির আশ্রয়স্থান (চুল্পী প্রভৃতি) করিয়া লাইতে পারিবে।

কোনও লোক যদি পাচটি জলের ঘটী বাড়ীতে না রাখে (মতান্তরে দুপুরবেলা ১২২.৫ টা হইতে বৈকাল ৫.৫ টা পৰ্য্যন্ত পাঁচ ঘটিকা অগ্নির কার্য চালায়), তাহা হইলে তাহাকে ১/৪ পণ দণ্ড দিতে হইবে। (গৃহের দ্বারদেশে) জলকুন্তু, দ্রোণী (দারুময় জলাধার), নিঃশ্রেণী (অধিরোহিণী বা সিড়ি) পরশু (কুঠার), শূৰ্প (অভিমুখে ধূমপ্রসার-নিবারণ জন্য কুলো), অঙ্কুশ (দহমান বস্তুর আকর্ষণ জন্য হুক্), কচগ্রহণী (চিরুণীর মত বস্তুবিশেষ যা দ্বারা পটলস্থিত তৃণাদি অগ্নিদাহকালে অপসরণ করা যায়) ও দৃতি (চৰ্যনিৰ্ম্মিত উদকপাত্রবিশেষ) না রাখিলে (গৃহস্বামীর) ১/৪ পণ দণ্ড হইবে।

(গ্ৰীষ্মকালে) তৃণ ও কট (চাটাই)-দ্বারা নিৰ্ম্মিত (গৃহসমূহ) উঠাইয়া ফেলিতে হইবে। অগ্নিজীবীদিগকে (অর্থাৎ যে সব কৰ্ম্মকার অগ্নির সাহায্যে জীবিকা অর্জন করে তাহাদিগকে) একস্থানে বাস করিতে দিতে হইবে। রাত্রিতে অন্যস্থানে সঞ্চারণ না করিয়া গৃহস্বামীরা স্ব স্ব গৃহের মুখস্বারে বাস করিবে। রথ্যাতে (গাড়ীর রাস্তাতে) সহস্ব সহস্ব জল-কুম্ভপঙক্তি থাকিবে এবং চতুষ্পথে (চৌরাস্তায়), (নগরাদির) দ্বারদেশে ও রাজপরিগ্রহেও (অর্থাৎ রাজকোষগৃহ, কুপ্যগৃহ, পণ্যগৃহ, কোষ্ঠাগার ও গজশালা প্রভৃতিতেও) তাহা থাকিবে।

যদি কোন গৃহস্বামী কোন বাড়ীতে অগ্নিীদাহ দেখিয়া সাহায্যাৰ্থ সেদিকে ধাবিত না হয়, তাহা হইলে তাহার ১২ পণ দণ্ড হইবে। গৃহস্বামীর বাড়ীতে যে ব্যক্তি ভাড়া দিয়া বাস করে সে-ও যদি ঐ অবস্থায় ধাবিত না হয়, তাহা হইলে তাহার ৬ পণ দণ্ড হইবে। (গৃহস্বামীর) প্রমাদাবশতঃ তদগুহে আগুন লাগিলে তাহার ৫৪ পণ দণ্ড হইবে (কোন কোন ব্যাখ্যাকারের মতে এই দণ্ড হইবে প্রমাদী গৃহরক্ষকের প্রতি)।

যে ব্যক্তি (অন্যের গৃহে) অগ্নিসংদীপন করে, (ধরা পড়িলে) তাহাকে সেই অগ্নিদ্বারাই বধ করিতে হইবে (কণ্টকশোধন অধিকরণের। ১১শ অধ্যায়েও আদীপকের দণ্ড বিহিত আছে)।

রথ্যার (গাড়ীর রাস্তার) উপর ধূলি (বা তজ্জাতীয় আবর্জনাদি) নিক্ষেপ করিলে, অপরাধীর ১/৮ পণ দণ্ড হইবে। (রথ্যাতে) পঙ্কমিশ্ৰিত জলদ্বারা নিরোধ ঘটাইলে অপরাধীর ১/৪ পণ দণ্ড হইবে। রাজমার্গে উক্ত দুইপ্রকার দোষ (অর্থাৎ পাংসুন্যাস ও পঙ্কমিশ্ৰিত জলদ্বারা নিরোধ) ঘটিলে, অপরাধীর দ্বিগুণ দণ্ড হইবে (অৰ্থাৎ যথাক্রমে ১/৪ ও ১/২ পণ দণ্ড হইবে)।

(রাজমাৰ্গস্থিত) পুণ্যস্থান, উদকস্থান (কূপতড়াগাদি), দেবগৃহ ও রাজপরিগ্রহে (রাজকোষগৃহাদিতে) বিষ্ঠা বিসর্জন করিলে, অপরাধীর (যথাক্রমে) উত্তরোত্তর এক পণ অধিক করিয়া দণ্ড দিতে হইবে (অর্থাৎ রাজমার্গে ১ পণ, পূণ্যস্থানে ২ পণ দণ্ড দিতে হইবে)। (কিন্তু, তৎ-তৎ-স্থানে মূত্র পরিত্যাগ করিলে অপরাধীর দণ্ড পূর্বোক্ত দণ্ডের অৰ্দ্ধ হইবে।

(কিন্তু,) সেই সব স্থানে, ভৈষজ্য (বিরেচনদ্রব্য-সেবন), (মুতিসার প্রমোহাদি) ব্যাধি ও ভয়নিমিত্তক বিষ্ঠামূত্রত্যাগে অপরাধীরা দণ্ডণীয় হইবে না।

বিড়াল, কুকুর, নকুল ও সৰ্পের মৃতদেহ নগরের মধ্যে ফেলিয়া রাখিলে অপরাধীর ৩ পণ দণ্ড হইবে। গর্দভী, উষ্টি, অশ্বতর (খচ্চর), অশ্ব ও অন্যান্য পশুর মৃতদেহ সেস্থানে নিক্ষেপ করিলে অপরাধীর ৬ পণ দণ্ড হইবে। মানুষের মৃতদেহ সেখানে ফেলিলে অপরাধীরা ৫০ পণ দণ্ড হইবে।

মৃতদেহ লইয়া যাওয়ার জন্য নির্দ্দিষ্ট পথ ব্যতীত অন্য পথে তাহা লইয়া গেলে, এবং নগরের যে দ্বারা দিয়া শব্র নিষ্ক্রমণের ব্যবস্থা আছে সেই দ্বার ব্যতীত অন্য দ্বারা দিয়া তাহা নিলে, অপরাধীর প্রথমসাহসদণ্ড হইবে। এবং দ্বাররক্ষকেরা (প্রতিষেধ না করিলে) তাহাদিগকে ২০০ পণ দণ্ড দিতে হইবে। (নির্দ্দিষ্ট) শ্মশান ব্যতীত অন্যত্র শব প্রোথিত ও দাহিত করিলে অপরাধীর ১২ পণ দণ্ড হইবে।

রাত্রির উভয় দিকে অর্থাৎ রাত্রির প্রথমভাগে ও শেষভাগে, (যথাক্রমে) ছয় নালিকা (অর্থাৎ ২৪ মিনিট করিয়া ৬× ২৪ = ১৪৪ মিনিট বা ২.৪ ঘণ্টা) অতীত হইবার সময় একবার ও ছয় নালিকা অবশিষ্ট থাকিবার সময়ে আর একবার যামভুৰ্য (অর্থাৎ পথে জনসঞ্চারের নিরোধসূচক বাস্থ্যঘোষণা) করা হইবে (ইহার তাৎপৰ্য্য এই যে, রাত্ৰিতে এই দুইবার তুৰ্য্যনিনাদের মধ্যবৰ্ত্তী সময়ে পথে জনসঞ্চার নিষিদ্ধ-ইহাই তাৎকালিক সান্ধ্য আইন)। এই তুৰ্যশব্দ শোনা গেলে পর, যদি কোনও লোক (এই নিষিদ্ধসঞ্চার সময়ের) প্রথম যামে (অর্থাৎ ত্রিযামা বা রাত্রির প্রথম ৪৮ মিনিটের মধ্যে) ও পশ্চিম যামে (বা তৃতীয় ৪৮ মিনিটের মধ্যে)। রাজবাড়ীর নিকটে সঞ্চরণ করে তাহার প্রতি ১.২৫ পণ্য অকালে সঞ্চরণজনিত অপরাধের জন্য দণ্ড বিহিত হইবে। এবং (সে যদি) এই নিষিদ্ধ সময়ে মধ্যম যামে বা মধ্যবৰ্ত্তী ৪৮ মিনিটের মধ্যে তাহা করে, তাহা হইলে তাহার উপর উক্ত দণ্ডের দ্বিগুণ অর্থাৎ ২.৫ পণ দণ্ড ধার্য হইবে। নগরের বহির্দেশে এই অপরাধের জন্য অপরাধীর উপর চতুগুণ অর্থাৎ ৫ পণ দিওঁ বিহিত হইবে।

(উক্ত নিষিদ্ধ সময়ে) যে স্থানে সঞ্চরণশীল লোককে সহজেই চোরাদি বলিয়া আশঙ্কা করা যাইতে পারে এমন স্থানে চলিবার সময়ে কেহ ধরা পড়িলে, কিংবা (অবগুণ্ঠনাদি) চিহ্নযুক্ত অবস্থায় সে ধরা পড়িলে, কিংবা তাহার পূর্ব্বকৃত চোৰ্য্যাদি বৃত্তি প্রতীত হওয়ায় সে ধরা পড়িলে, তাহাকো (তাহার নাম, ধাম, আগমনাদির কারণসম্বন্ধে) প্রশ্ন করিতে হইবে।

(এমন কোনও ব্যক্তি যদি) রাজকীয় নিবাস ও কোশগৃহাদিতে (অনুমতি ব্যতীত প্রবেশ করে ও নগররক্ষার জন্য নিৰ্ম্মিত প্ৰাকারাদিতে আরোহণ করে, তাহা হইলে তাহার উপর মধ্যমসাহসদণ্ড বিহিত হইবে।

অসময়ে পথে সঞ্চরণশীল ব্যক্তিরা তখনই ধূত হইবে না, যখন তাহারা সূতিকা (অর্থাৎ সূতিকায় শুশ্বষা), চিকিৎসক (অর্থাৎ তাহাঁকে ডাকা), প্ৰেত (অর্থাৎ মৃতদেহের শ্মশানে নিহঁরণ), প্রদীপ যান (প্রদীপ লইয়া নিজকে প্রকাশ করিয়া গমন), নাগরিকতুৰ্য্য (নাগরজনের একত্রীকরণসূচক তুৰ্য্যধ্বনি), প্ৰেক্ষা (রাজার অনুজ্ঞাত নাটকাদির প্রয়োগ-দৰ্শন) ও অগ্নির (অর্থাৎ নিজের বা পরের বাড়ীতে অগ্নিদাহের) কারণে বাড়ীর বাহিরে সঞ্চারণ করে এবং তাহাদের হস্তে (নাগরিকন্দি-প্রদত্ত) মুদ্রা বা মুদ্রাযুক্ত ছাড়পত্র থাকিলে তাহারা অগ্ৰাহ হইবে (অর্থাৎ গ্রেপ্তারের যোগ্য হইবে না।)।

চাররাত্ৰিতে (অর্থাৎ মহোৎসবাদির জন্য অনুমতিসঞ্চারা রাত্ৰিতে) যে-সব মনুষ্য প্রচ্ছন্নবেশে (নিজের স্বরূপ লুকাইয়া), অথবা, বিপরীত বেশে (যথা স্ত্রীলোক পুরুষের বেশে ও পুরুষ স্ত্রীলোকের বেশে) পথে চলে, কিংবা পরিব্রাজকের বেশে চলে, এবং যাহারা দণ্ড ও শস্ব হস্তে লইয়া চলে, তাহাদিগের দোষ পরীক্ষা করিয়া দণ্ড দিতে হইবে।

অক্ষণ-সঞ্চারেও যে লোক অবাৰ্য্য (অর্থাৎ যাহার সঞ্চারণে অনুমতি আছে) তাহাকে বারণ করিলে এবং যে লোক বাৰ্য্য (অর্থাৎ বারণের যোগ্য) তাহাকে বারণ না করিলে, রক্ষিপুরুষদিগকে অক্ষণসঞ্চারের যে দণ্ড বিহিত আছে (অর্থাৎ ১.২৫ পণ) তাহার দ্বিগুণ (অর্থাৎ ২.৫ পণ) দণ্ড দিতে হইবে। যে রক্ষিপুরুষ কোন দাসী স্ত্রীলোককে বলাৎকার-সহকারে গমন করিবে, তাম্বুকে প্রথমসাহসদণ্ড দিতে হইবে; (গণিকাদি) আদাসী স্ত্রীলোককে গমন করিলে তাহার উপর মধ্যমসাহসদণ্ড এবং কাহারও ভাৰ্য্যারূপে পরিগৃহীত স্ত্রীলোককে (সে দাসীই হউক, বা আদাসীই হউক না কেন) গমন করিলে উত্তমসাহসদণ্ড তদুপরি প্রযোজ্য হইবে; (কিন্তু), কোন কুলস্ত্রীকে গমন করিলে তাহাকে বধাদণ্ডে দণ্ডিত করিতে হইবে।

যদি (কোনও ব্যক্তি) যে কোন চেতনবিষয়ক ও অচেতনবিষয়ক রাত্রিদোষ (অর্থাৎ রাত্ৰিতে লক্ষিত দোষ) নাগরিকের (বা নগরাধিকারী শ্রেষ্ঠ রাজপুরুষের) নিকট নিবেদন না করে, কিংবা (রক্ষিপুরুষাদির) কোনও প্রকার প্রমাদের কারণ (যথা মন্ত পানাদি) উপস্থিত হইলে তাহা তীহাকে না জানায়, তাহা হইলে তাহার উপর তদীয় অপরাধের অনুরূপ দণ্ড বিহিত হইবে (এই বাক্যে কোন কোন ব্যাখ্যাকার “নাগরিকস্য’ পদটিকে “নগরবাসী যে কোন লোকের।” এই অর্থে ব্যবহৃত বলিয়া গ্রহণ করিয়া “আশংসতঃ” পদটিকে ইহার বিশেষণ বলিয়া ধরিয়াছেন, কিন্তু, প্রসঙ্গপৰ্য্যালোচনায় এই ব্যাখ্যা সমীচীন মনে হয় না।)। নাগরিক সর্বদাই উদকস্থান (নদীকূপতড়াগাদি), মার্গ (প্রবেশ ও নিৰ্গমের রাস্তা), ভূমি (স্থলভূমি), ছন্নপথ (সুরঙ্গাদি), বগ্র (প্ৰাকারাদির আধারাভূত মৃত্তিকাস্তুপ), প্ৰাকার (দুর্গের প্রাচীর) ও অন্যান্য (অট্টালিকপরিখাদিরূপ।) রক্ষা সাধন দ্রব্যসমূহের অবেক্ষণ করিবেন এবং নষ্ট (স্বামীর প্রমাদে যে দ্রব্য হায়াইয়া গিয়াছে), প্রশ্বত (স্বামী যে দ্রব্য ভুলিয়া গিয়াছে) ও অপহৃত (যে, দ্বিপদ বা চতুষ্পদাদি জন্তুপ্রভৃতি স্বয়ং অন্যত্র চলিয়া গিয়াছে) দ্রব্যসমূহের রক্ষণকাৰ্য্য চালাইবেন (অর্থাৎ যতক্ষণ সেই সব বস্তুর মালিক না পাওয়া যাইবে ততক্ষণ সেগুলিকে তিনি রক্ষা করিবেন)।

কারাগারে অবস্থিত বালক, বৃদ্ধ, ব্যাধিগ্রস্ত ও অনাথ-(অসহায়–) জনদিগকে (রাজার) জন্মনক্ষত্রের দিনে ও পূৰ্ণিমাতিথিতে কারামুক্ত করিয়া দিতে হইবে। পুণ্যকৰ্ম্মাচরণশীল ব্যক্তিরা যদি কোনও আকস্মিক অপরাধে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন, তাহা হইলে তাহারা সময় বা সংবিৎ (অর্থাৎ “ভবিষ্যতে এইরূপ অপরাধ আর করিব না’ ইত্যাদিরূপ প্রতিজ্ঞা)-দ্বারা প্রতিবদ্ধ হইয়া নিজের দোষের অনুরূপ নিশ্রুয়া (অর্থদণ্ড) দিতে পারেন (অর্থাৎ কারা-বাসের পরিবর্তে অর্থদণ্ড দিয়া নিষ্কৃতি লাভ করিতে পারেন)।

প্রতিদিবস অথবা প্রত্যেক পঞ্চমদিনে কারাগারে আবদ্ধ লোকদিগকে (নিক্রয়গ্রহণদ্বারা) বিশোধিত করিতে হইবে (অর্থাৎ তাহাদিগকে বন্ধনমুক্ত করিয়া দিতে হইবে) এবং এই বিশোধন তিনপ্রকার হইতে পারে, যথ (১) কয়েদীরা (ভারবহনাদি) কায়িক কৰ্ম্ম করিয়া, কিংবা (২) শারীরিক দিওঁ ভুগিয়া, অথবা, (৩) হিরণ্য বা নগদ টাকা প্রদান করিয়া বন্ধন-মুক্তি পাইতে কোন নূতন দেশ জয় করিয়া লাভ করিলে, কিংবা যুবরাজের অভিষেক হইলে, অথবা, পুত্রের জন্ম হইলে (রাজা) কারাবন্ধন হইতে কয়েদীদিগের মোক্ষা বিধান করিতে পারেন। ২।৷

কৌটিলীয় অর্থশাস্ত্ৰে অধ্যক্ষ প্রচার-নামক দ্বিতীয় অধিকরণে নাগরিকের কৰ্ত্তব্য-নামক ষটত্রিংশ অধ্যায় (আদি হইতে ৫৭ অধ্যায়) সমাপ্ত।

.

.

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *