০৫. বিবাহের পর স্বামী-স্ত্রী

বিবাহের পর স্বামী-স্ত্রীর অবারিত অনুরাগের মাঝে একটি স্বচ্ছ অন্তরাল রচনা করিয়া তাহাকে মধুর তর করিয়া তুলিবার জন্য যে-তৃতীয়। ব্যক্তিটির আবির্ভাব শুধু বাঞ্ছনীয় নয়, প্রয়োজনীয়, সেই তৃতীয় ব্যক্তিটিকে ত্যাগ করিয়া সহসা স্বামী যদি অন্তর্হিত হয়, তবে ব্যাপারটা সত্যই বিসদৃশ হইয়া উঠে। সুধী-কে পাশে না দেখিয়া প্রদীপের স্নায়বিক দৌর্বল্য উপস্থিত হইল। কিছু একটা কথা অনায়াসে বলা যাইতে পারে বটে, কিন্তু শালবীথিকে বেষ্টন করিয়া প্রশান্ত ধ্যান-গাম্ভীর্যের মত যে-সন্ধ্যা ঘনাইয়া উঠিতেছে, একটা সামান্য ও সাধারণ কথা বলিয়া তাহার তপোভঙ্গ করিবার দুঃসাহস প্রদীপের হইল না। যেমন বসিয়া ছিল তেমনই বসিয়া রহিল। অদূরে নমিতা সঙ্কোচে, ভীরুতায় একেবারে এতটুকু হইয়া গেছে। নিজের বসিবার ভঙ্গীটি হইতে সুরু করিয়া। এই অর্থহীন নিস্তব্ধতা পৰ্যন্ত তাহার কাছে অত্যন্ত বিশ্রী হইয়া উঠিল।

এমন মুস্কিলে কে কবে পড়িয়াছে! এত নিকটবর্তী হইয়া ও এমন অনুচ্চারিত পরিচয় লইয়া কাহারা মুহূর্ত গুণিয়াছে! শালের বনে সুস্নিগ্ধ সন্ধ্যায় হৃদয়ের ভাষায় আলাপ করিবার জন্য মানুষের মুখের ভাষা। যথেষ্ট সূক্ষ্ম হয় নাই কেন? ইহার চেয়ে যদি প্রদীপদের মেসের কাছে গ্যাসপোসটের সঙ্গে ধাক্কা খাইয়া একটা ছাড়া গাড়ি উল্টাইয়া পড়িত, তাহা হইলে গাড়ির মধ্য হইতে আহত সুধী ও নমিতাকে নামাইয়া তাহার ঘরের ষ্টোতে দুধ গরম করিয়া খাওয়াইয়া আলাপ জমাইতে বেগ পাইতে হইত না। কিম্বা, কল্পনা করা যাক, সুধী ও নমিতা বোটানিক্যাল গার্ডেনে হাওয়া খাইতে গিয়া একটা বেঞ্চিতে। বসিয়া বিশ্রাম করিতেছে, এমন সময় ছোরা-হস্তে এক গুণ্ডার আবির্ভাব হইল, অমনি পেছন হইতে যুযুৎসুর এক পাচ কসিয়া নিমেষে প্রদীপ ব্যাপারটাকে ইন্দ্রজালের চেয়েও রোমাঞ্চময় করিয়া তুলিল—এমন সাহসিক কীর্তি যে সে দুই একটা করে নাই তাহা নয়। তাহা হইলে স্বতঃপ্রবৃত্ত হইয়া আলাপ করিবার ভার পড়িত নমিতারই উপর (ধরা যাক সুধী উপস্থিত ছিল না ), প্রদীপকে তাহা হইলে এমন ঘামিতে হইত না। কোনো একটা দুর্ঘটনা ঘটিলে আলাপটা কথা না কওয়ার মতই সহজ হইয়া উঠিত। এই সময় শুক্ননা পাতার ভিড় সরাইয়া একটা সাপ আসিয়া দেখা দিলেও অসঙ্গত হইত না—হিংস্র সাপ অনায়াসে কবিতার বিষয়ীভূত হইতে পারিত। কথা কহিতে পারিবে না, অথচ এই অতলস্পর্শ স্তব্ধতায় আত্মার গভীরতম পরিচয় গ্রহণ করিতে হইবে, মানুষের ভাষাকে বিধাতা এত অসম্পূর্ণ ও নিস্তেজ করিয়াছেন কেন? যাহা প্রত্যক্ষ তাহাই ত জ্ঞানের একমাত্র মূল নয়; কিন্তু যাহা প্রকাশের অতীত হইয়াও অনুভবের অগোচর নয়, সেই চেতনাকে নমিতার প্রাণে সঞ্চারিত করিয়া দিবার উপায় কোথায়? এই নীরব আকাশকে ব্যঙ্গ না করিয়া সন্ধ্যার সঙ্গে অকৃত্রিম সঙ্গতি রাখিয়া এই হৃদয়চাঞ্চল্যটিকে প্রকাশিত করিবার অমিতশক্তি বাঙলা-ভাষা কবে লাভ করিবে?

সুখনিদ্রার মত অন্ধকার গাঢ় হইয়া উঠিতেছে, অথচ সুধীর ফিরিবার নাম নাই। অবশেষে প্রদীপের মুখে অজ্ঞাতসারে ভাষা আসিল : “আর বসে কাজ নেই, চল।” এবং এই একটি মাত্র আহ্বানে নমিতা উঠিয়া পড়িল দেখিয়া, প্রদীপের খেয়াল হইল যে সে কথা বলিতে পারিয়াছে। এবং একবার যখন ব্যুহদ্বারের বিপুল বাধা পরাভূত হইয়াছে, তখন প্রদীপকে আর পায় কে? মাঠটুকু পার হইয়া রাস্তায় নামিয়াই প্রদীপের রসনায় ভাষা অনর্গল হইয়া উঠিল : “দেখ, আমাদের দেশে মেয়ে-পুরুষে সহজ পরিচয়ের বাধা বিস্তর, কিছুতেই আমরা সামঞ্জস্য রাখতে পারি না। তোমরা আমাদের কর সন্দেহ, আমরা তোমাদের করি অশ্রদ্ধা। তাই আমরা মধুর সখ্যের আস্বাদ থেকে বঞ্চিত হয়ে, আত্মাকে খৰ্ব্ব ও কর্মশক্তিকে পঙ্গু করে’ রেখেছি। আমরা কিছুতেই সহজ হতে পারি না—সে আমাদের পক্ষে দুঃসাধ্য সাধনা। জড়িমার আবরণ রচনা করে আমরা আত্মরক্ষা করি —তোমরা হও সতী, আমরা হই সাধু। কিন্তু তা যে কত অসার, তার মূল্য যে কত অল্প, তা আমরা বুঝি যখন একে-অন্যের বন্ধুতায় নতুন করে আবার আমরা আবিষ্কৃত হই, যখন আমাদের জীবন প্রসারিত আয়তন লাভ করে।—দেখো, হোঁচট খেয়ে না—”

এই সব কথার উত্তর দিতে হইলে বড়-বড়ো কথা না কহিলে বেমানান হইবে, তাহার জন্য নমিতা এখনো প্রস্তুত হয় নাই; তাই হোঁচট খাইবার কথায় সামান্য একটু হাসিয়া নমিতা চুপ করিয়া রহিল। প্রদীপ জিজ্ঞাসা করিল,—“সুধী হঠাৎ আমাকে ডেকেছে কেন বলতে পারো?”

নমিতা কহিল,—“কাশ্মীর বেড়াতে যাবেন, আপনি সঙ্গী হবেন তার।”

প্রদীপ। কাশ্মীর? হঠাৎ? পৃথিবীতে এত লোক থাকতে কাশ্মীরের শীত সইতে আমি তার সঙ্গী হ’ব, আমার অপরাধ?

নমিতা। জানি না, কিন্তু তার অপরাধ আরো গুরুতর। আমাকে সঙ্গে নেবেন না। বলুন তো এটা তার অত্যাচার নয়?

প্রদীপ। তোমাকে সঙ্গে নেবে না কেন?

নমিতা। সে-প্রশ্ন আমি তাকে করেছিলাম। তিনি বল্লেন, “আমি বিশ্রাম করতে যাচ্ছি, সম্ভব হয় তো প্রদীপের সঙ্গে উপন্যাসটা শেষ করে ফেলব।

প্রদীপ। তুমি গেলে তার বিশ্রামের ব্যাঘাত হবে কেন? নমিতা। প্রথমত, আমি গেলে অনৈক্য ঘটবে, দ্বিতীয়ত, তার সাহিত্য-সাধনা সিদ্ধ হবে না।

কথাটা বলিয়া ফেলিয়াই নমিতা বুঝিল, তাহাদের গোপন মনোমালিন্যের এই ইতিহাসটুকু ব্যক্ত না করিলেই ভালো হইত। কিন্তু তাহার উত্তরে প্রদীপ যাহা বলিয়া বসিল, তাহাতেও তাহার লজ্জা কম হইল না। প্রদীপ কহিল,—“তোমাকে একা ফেলে রেখে আমি ওর সঙ্গী হ’ব আমাকে ও এত বোকা ভাবলে কিসে? তোমার সান্নিধ্যে ও যদি শ্রান্ত হয়ে থাকে, তা হলে ওর নৈকট্যে আমাকে সন্ন্যাসী হতে হবে নিশ্চয়।” বলিয়া কথাটাকে লঘু করিবার চেষ্টায় সে হাসিয়া ফেলিল। কিন্তু নমিতা আর কোন কথাই কহিতে পারিল না, ধীরে ধীরে চলিতে লাগিল। মনে হইল তাহাদের দুর্লক্ষ্য গোপন বেদনাটা প্রদীপের চোখে ধরা পড়িয়াছে। ধরা পড়িয়াছে বলিয়াই তাহার কথায় এমন স্পষ্টতা আসিয়াছে। ইহা নমিতার অভিপ্রেত ছিল না। স্বামীর কাছে কবে ও কেমন করিয়া যে সে তাহার রহস্য-মাধুৰ্য হারাইয়াছে, এমন নিবিড় মিলনে কবে যে অবসান ঘটিয়া অবসাদ আসিল, তাহা নির্ধারণ করিবার মত জ্যোতির্বিদ্যা নমিতার জানা ছিল না। নমিতাকে সুধী যে-পরিমাণ স্নেহ করে তাহার বিশেষণ দিতে গেলে অপর্যাপ্ত বলিতে হয়, অথচ নমিতাকে তাহার ভাল লাগে না—এই মনস্তত্ব বুঝিবার মন তাহার নাই। এই বেদনাটি মনেমনে লালন করিবার অবকাশে নমিতার মনে এই বিশ্বাস ছিল যে, একদিন স্বামীর চক্ষে সে এত মহিমা ও মর্যাদা লইয়া উদ্ভাসিত হইবে, যাহার তুলনায় তাহার কল্পনাকায়া সাহিত্য-লক্ষ্মী নিত, নিরাভরণ। তাহারই জন্য সে স্বামীর কাছে মনে-মনে একটি শিশু কামনা করিয়াছে। এবং এই কামনার ভুল ব্যাখ্যা করিয়া স্বামী তাহাকে ভাবিয়াছেন গ্রাম্য, স্কুল। স্বামী তাহাকে বলিতেন,—“তুমি যে আমার স্ত্রী এই কথা সব সময়েই মনে রাখতে হয় বলে আমার ভালো লাগে না।” অথচ, এই প্রকার কৃত্রিম বিবাহজাত মিলনকে মাধুৰ্যপূৰ্ণ করিয়া তুলিবার জন্য যে বিবাহের পরেও দীর্ঘকালস্থায়ী প্রণয়োপাসনার প্রয়োজন আছে, তাহা প্রথমে স্বামীই বিস্মৃত হইয়াছিলেন। প্রেমকে প্রবুদ্ধ করিবার জন্য যে-অনন্যপরায়ণ প্রতীক্ষা দরকার, তাহার ধৈৰ্য্য হারাইতে স্বামীই দ্বিধা করেন নাই। আজ সহসা নমিতা তাহার কাছে আবিষ্কৃত হইয়া গেছে!

বাড়ি আসিবার পথটুকু শীঘ্রই ফুরাইয়া গেল। সুধী তখনো ফিরিয়া : আসে নাই। নমিতা আসিয়া শুধাইল,—“মা বল্লেন, আপনার চা এখন নিয়ে আসবে?”

প্রদীপ কহিল,—“মাকে বোলো, এখন চা খেলে আমার ক্ষুধার অকালমৃত্যু ঘটবে।”

নমিতা হাসিয়া বলিল,—“রাতের খাওয়া হতে আমাদের বাড়িতে বেশ দেরি হয়, অতএব চা খেলে আপনার ক্ষুধা মরে গিয়েও ফের নবজীবন লাভ করবার সময় থাকবে।”

প্রদীপ কহিল,—“যদিও ক্ষুধাকে বাঁচিয়ে রাখবার ধৈৰ্য্য আমার আছে, তবু যখন বলছে, নিয়ে এস। দেখো, অতিমাত্রায় অতিথিপরায়ণ হ’য়ো না। অসুখ করিয়ে শেষে সেবার বেলায় ছুটি নেবে, সেটা। আতিথ্যের বড়ো নিদর্শন নয়।”

রাত্রের খাওয়ায় দেরি হয় বটে, কিন্তু সকলে একসঙ্গে বসিয়া খায়— একই চতুষ্কোণ টেবিলের চারধারে চেয়ার পাতিয়া। দৃশ্যটা দেখিয়া প্রদীপ মুগ্ধ হইয়া গেল। পারিবারিক প্রীতির এই দৃষ্টান্তটির মধ্যে সে নরনারীর সমানাধিকারের সঙ্কেত পাইল। এত আনন্দ করিয়া, এত পরিতৃপ্তির সঙ্গে সে কোনোদিন আহার করিয়াছে বলিয়া তাহার মনে হইল না। আহাৰ্য্য বস্তুগুলি অরুণাই বটিয়া দিতেছিলেন, স্বাভাবিক সঙ্কোচের বাধা সরাইয়া বন্ধু নমিতাও তাহার অভিভাবকদের সম্মুখে সামান্য প্রভা হইয়া উঠিয়াছে, কথোপকথনের ফাঁকে-ফাঁকে উমার কলহাস্য বিরাম মানিতেছে না। নানা বিষয় নিয়া কথা হইতেছে—ভারতবর্ষের পরাধীনতা হইতে সুরু করিয়া গো-মাংসের উপকারিতা পৰ্যন্ত; সবাই সাধ্যমত টিপ্পনি কাটিতেছে, এবং অবনীবাবু তাহার স্বাভাবিক গাম্ভীর্যের মুখোস খুলিয়া যেই একটু রসিকতা করিতেছেন, অমনি সবাই সমস্বরে উচ্চহাস্য করিয়া নিজের নিজের পরিপাক-শক্তিকে সাহায্য করিতেছে। প্রদীপ যে এই বাড়িতে একজন আগন্তুক অতিথিমাত্র, তাহা তাহাকে কে মনে করাইয়া দিবে? সামান্য খাইবার মধ্যে যে এত সুখ ছিল, মানুষের হাসি যে সত্যই আনন্দজনক,–এই সব স্বতঃসিদ্ধ তথ্যগুলি সম্বন্ধে সে হঠাৎ সচেতন হইয়া উঠিল। অরুণা প্রদীপকে লক্ষ্য করিয়া কহিলেন,—“সব আমার নিজের হাতের রাধা, তোমার মুখে রুচছে ত’?” দাঁতের ফাঁক হইতে মাছের কাটা খসাইতে-খসাইতে অবনীবাবু কহিলেন,—“তুমি কি আশা কর তোমার এই প্রশ্নের উত্তরে প্রদীপ বলবে যে রুচছে না, ন্যাকার করছে? প্রদীপের সত্যবাদিতায় নিশ্চয়ই তুমি সুখী হবে না। ভদ্র হবার জন্যে কেন যে এ-সব মামুলি কথা বল তোমরা, ভেবে পাইনে।” উমা টিপ্পনি কাটিল,—“আর প্রদীপবাবু যদি ভদ্রতর হ’বার জন্যে বলেন যে স্বৰ্গসভায় সুধা খাচ্ছি, তা হলে তার সেই অতিশয়োক্তিকে তুমি সন্দেহ করূবে; তাতেও তুমি সুখী হবে না।” প্রদীপ কহিল,—“অতএব কোননা বাক্‌-বিস্তার না করে নিঃশব্দে খেয়ে চলাই আমার পক্ষে ভদ্রতম হবে।”

খাওয়ার পরে শুইবার ঘরে আসিয়া সুধী নমিতাকে কহিল, —“তুমি মা’র কাছ আজ শোও গে; প্রদীপের সঙ্গে রাত্রে আমার ঢের পরামর্শ আছে।”

প্রদীপ প্রতিবাদ করিয়া উঠিল : “না বৌদি, অত আড়ম্বরে কজি নেই। খেয়ে-দেয়ে পরামর্শ করবার মতো ধৈৰ্য্য ও অনিদ্রা বিধাতা আমাকে দেননি। বুঝলে সুধী, স্ত্রীকে ত্যাগ করে বন্ধুকে শয্যার পার্শ্ব দেওয়ার আতিথ্য এ-যুগে অচল হয়ে গেছে। তোমাদের ঘরের পাশেই যে ছোট বারান্দাটুকু আছে, তাতেই একটা মাদুর বিছিয়ে দাও, আমি এত প্রচুরপরিমাণে নাক ডাকাবো যে, জানলাটা খুলে রাখলেও তোমাদের প্রেমগুঞ্জন শুতে পাব না। ভয় পাবার কিছুই নেই, সুধী। তা ছাড়া না-ঘুমিয়ে বসে-বসে কলম কাড়াব, আমি আজো তত বড় সাহিত্যিক হইনি।”

মাথা নাড়িয়া সুধী কহিল,—“না, এ-ঘরে আজ নমিতার শোওয়া হবে না, তোমার সঙ্গে আমার অনেক গোপন কথা আছে।”

প্রদীপ। কী গোপন কথা? কাশ্মীর যাওয়ার কথা তো? তোকে সোজাসুজি বলে রাখছি সুধী, বৌদি না গেলে আমি যাব

কখনো।

সুধী। অত দূরে যাবার নমিতার কোনো দরকার নেই।

প্রদীপ। আর, আমারই জন্যে যেন কাশ্মীরের সিংহাসন খালি পড়ে আছে। বৌদির সান্নিধ্যে সাত মাস থেকে তোর যদি হাঁপানি উঠে থাকে, তবে তোর সঙ্গে একদিন থেকে আমার হবে প্লুরিসি।

নমিতাকে ঘর হইতে হঠাৎ চলিয়া যাইতে দেখিয়া, সুধী গম্ভীর হইয়া কহিল,—“সত্যি প্রদীপ, বিয়ের পর এই একঘেয়েমি আমাকে ক্লান্ত করে ফেলেছে। আমি দিন কয়েকের জন্যে বিশ্রাম চাই, চাই বৈচিত্র্য।”

প্রদীপ জোর দিয়া কহিল,—“এ তোর অত্যন্ত বাড়াবাড়ি, সুধী। বিয়ে এত ক্লান্তিকর হয়ে উঠবে এই যদি তোর ধারণা ছিল, তবে বিয়ে করা তোর পক্ষে নিদারুণ পাপ হয়েছে।”

সুধী। ধারণা আমার আগে ছিলো না। তাই বলে ভুলকে সংশোধন কবে না—আমি তত ভীরু নই। নমিতা আমাকে তৃপ্ত করতে পারে নি।

প্রদীপ। কিন্তু বিয়ের আগে এই নমিতার রূপ ও তার বাপের টাকা হোর নয়নতৃপ্তিকর হয়ে উঠেছিল—তুই লোভী! বিয়ে করে’ ফেলে নমিতার ওপর বীতরাগ হওয়া নীতিতে তো বটেই, আইনেও দণ্ডনীয় হওয়া উচিত।

সুধী। তা আমি বুঝি। তাই প্রকাশ্যে আমি আমার এই ঔদাসীন্যের পরিচয় দিতে সব সময়েই ক্লেশ বোধ করেছি। আমি নমিতাকে ভালোবাসি না এমন নয়, কিন্তু ভালো লাগে না। আমার রুচির সঙ্গে ওর মিল নেই।

প্রদীপ। সেজন্যে নমিতাকে দায়ী কলে অন্যায় হবে। তোর ব্যক্তিত্বের মধ্যে ওর ব্যক্তিত্বকে সঙ্কুচিত করে রাখার চেয়ে তাকে একটা স্পষ্ট ও উজ্জ্বল মূর্তি দেওয়ার চেষ্টা করাই উচিত মনে করি। মোট কথা জানিস কি সুধী, এই সব জায়গায় স্বামীকে তার অহঙ্কারের চূড়া। থেকে নেমে আসতে হয় স্ত্রীর সঙ্গে এক সমতল ভূমিতে,নইলে সঙ্গতির আর আশা নেই। তুই যেমন আপশোষ করছি, নমিতাও তেনি হয় তো তার ভাগ্যকে ভৎসনা করূছে। ভাবছে, কেন সাহিত্যিককে বিয়ে কলাম—এর চেয়ে একটি গৃহস্থকেরানি শতগুণে লোভনীয় ছিল। বিয়ের অপর নামই হচ্ছে স্ত্রী-পুরুষের শারীরিক একটা রফা। সন্ধির সর্ত ভাঙতে গেলেই আসে সামাজিক অশান্তি; আমরা সত্য লোক, ওটাকে এই জন্যেই এড়িয়ে যেতে চাই যে, অশান্তিটা কালক্রমে মনেও সংক্রামিত হয়। ভুল সংশোধন করার অর্থ আরেকটা ভুল করে বসা নয়। বিয়েটা দুইটা জীবনের সঙ্গে সমাজকে এমন ভাবে জড়িয়ে আছে যে, তাকে ভাঙার চাইতে জোড়াতালি দিতে গেলে অগৌরব হয় না। ডিভোর্সের আমি পক্ষপাতী,—কিন্তু ভালো লাগে না’ এই ওজুহাতকেই যদি বিবাহচ্ছেদের প্রধান কারণ বলে স্বীকার করা যায়—তা হ’লে পৃথিবীতে আত্মহত্যাও অত্যন্ত সুলভ হয়ে উঠবে। নমিতা তেমন লেখা-পড়া শেখেনি, রাজধানীর আবহাওয়ায় তার অঙ্গসজ্জা রাজসংস্করণ লাভ করেনি বা সে স্নায়ুহীন কবিপ্রিয়া না হয়ে সংসারকৰ্ম্মক্ষমা গৃহিণী হতে চায়—এই যদি তার ক্রটির নমুনা হয়, তবে বিয়ের আগে তোরই সাবধান হওয়া উচিত ছিলো, এখন তোর কাজ হচ্ছে নমিতাকে তোর উপযুক্ত করে তোলা।

সুধী। যে-কাজে আনন্দ নেই, সে-কাজে আমার মন ওঠে না। আচ্ছা এক কাজ করা যায় না? বাঙলা-সমাজ আঁৎকে উঠবে হয় তো।

প্রদীপ। কি?

সুধী। ধ আমি যদি আজ নমিতাকে ত্যাগ করি—হ্যাঁ, অন্য কোনো কারণে নয়, খালি তাকে আমার ভালো লাগে না বলে— এবং তার বিস্ময়ের ভাবটুকু কাটতে না কাটতেই, যদি তুই ওকে লুফে নিস—ব্যাপারটা কেমন হয়?

এমন একটা গুরুতর কথার উত্তরে কেহ যে এত জোরে হাসিয়া উঠিয়া প্রশ্নটাকে ব্যঙ্গ করিবার সাহস দেখাইতে পারে, তাহা সুধীর জানা ছিল না। তাহার মনে হইল, কথাটা বলিয়া ফেলিয়া সে যেন কি-একটা অপরাধ করিয়াছে। নমিতা কি-একটা কাজে বারান্দা দিয়া যাইতেছিল, প্রদীপ ডাকিয়া উঠিল : “সঙ্গে তুমি কি কি জিনিস নেবে, তার একটা ফর্দ আজ এক্ষুনি করে ফেলতে হবে। লেপ দু’খানা হলেই চলবে—লেপ গায়ে দিয়ে ট্রেনে ট্র্যাভেল করার মত সুখ আর নেই। শুনে যাও, বৌদি।”

“আস্‌চি”—বলিয়া নমিতা অন্তর্হিত হইতেই প্রদীপ কহিল, “কাশ্মীর ছেড়ে কাকে গেলেই ভালো করতিস, সুধী।”

অল্পক্ষণ পরেই নমিতা আসিল, তাহার সংসারের সব কাজ সমাধা হইয়াছে। প্রদীপ কহিল,—“যাবে তো, কিন্তু তোমার অনেক কাজ করতে হবে, মনে থাকে যেন। চা করে দেবে, গাড়ি ধবার সময়। প্ল্যাটফর্মে তাড়াতাড়ি হাঁটতে হবে, ভুলে লাগেজের গাড়িতে উঠে পড়বে না, গাড়ির ঝাঁকুনির টাল সামলাতে গিয়ে শেকল টেনে দেবে না, কলিশান্ হ’লে বাড়ির জন্যে মন-কেমন করূলে জরিমানা দেবে।”

নমিতা হাসিয়া উঠিল। ভারতের ভূস্বর্গে সশরীরে আরোহণ। করিতে পারিবে ভাবিয়া, আরেকটু হইলে সে ছোট খুকির মত হাততালি দিয়া উঠিত। স্বামীকে উদ্দেশ্য করিয়া কহিল,—“কবে যাচ্ছি?”

সুধী-র উৎসাহ যেন উবিয়া গেছে। বিরসকণ্ঠে কহিল,—“যেদিন সুবিধে হবে।” পরে প্রদীপকে লক্ষ্য করিয়া বলিল,-“তোমার সঙ্গে কাশ্মীর যাওয়ার আমার উদ্দেশ্যই ছিল আমার মনের এই সমস্যাকে পরিষ্কার করে তুলতে। যখন এ সম্বন্ধে তোমার কোনো সহানুভূতি নেই, তখন কাশ্মীর যাওয়া বন্ধ রইলো। বাকি জীবনটা এখানেই যা হোক্ করে কাটিয়ে দেব’খন।”

“জীবন-সম্বন্ধে তোমার এই দিব্যজ্ঞান দেখে বাধিত হ’লাম।” কিন্তু চাহিয়া দেখিল নমিতার মুখ চূণ হইয়া গেছে। আবহাওয়াটাকে হাল্কা করিবার জন্য, মুখে হাসি আনিয়া প্রদীপ কহিল,—“সুবিধে আমার কাল-ই হচ্ছে। কালকেই আমি সকালের ট্রেনে কল্কাতা গিয়ে গাড়ি-টাড়ি সব রিজার্ভ করে আসছি। কাগজ-পেন্সিল নিয়ে এস বৌদি, কি-কি জিনিস কিনে নিতে হবে, তার একটা হিসেব করে’ নেওয়া দরকার। আমরা তীর্থ করূতে যাচ্ছি না যে, পথের কষ্টভোগকে আমরা স্বর্গারোহণের দাম বলে মেনে নেব। আমরা যাচ্ছি বেড়াতে পান থেকে চুণ খসলেই আমাদের মুস্কিল। রেলের কামরাটাকে আমরা একটা অতি-আধুনিক ড্রয়িংরুম করে’ ছাড়বো।”

নমিতার মুখ তবুও প্রসন্ন হইল না। একান্তে প্রদীপকে বলিবার জন্যই সে একটু নিম্নস্বরেই কহিল,—“মুখ থেকে কথা যখন একবার বেরিয়েছে তখন আর তার নড়চড় হবে না, দেখবেন।”

প্রদীপ জোর দিয়া বলিয়া উঠিল,—“বেশ তো, নাই বা গেল সুধী— তুমি আর আমি যাবো। তুমি তার জন্যে ভেবো না, কাশ্মীর হোক, লিলুয়া পর্যন্ত আমরা যাবোই,আমি আর তুমি।”

দেখিতে-দেখিতে তাহাদের দুই জনের আলাপ এত জমিয়া উঠিল যে, তাহারা এক সময়ে টাই-টেবিল খুলিয়া বধে মেইল ও লাহোর এক্সপ্রেসের স্পিড়-এর তারতম্য বাহির করিতে অঙ্ক কষিতে বসিল। সুধী কখন চেয়ার ছাড়িয়া বিছানায় গিয়া শুইয়াছে, তাহা নমিতা লক্ষ্য করিলেও প্রদীপের খেয়াল ছিল না; সে গল্প নিয়া এমন মাতিয়া উঠিয়াছে! নমিতা তন্ময় হইয়া কথা শুনিতেছিল, শ্রোত্রী হিসাবে তাহাকে কেহ কোনো দিন এত প্রাধান্য দেয় নাই—এই ক্ষণ-বন্ধুতাটি তাহার কাছে এত রমণীয় লাগিতেছিল যে, স্বাভাবিক সঙ্কোচ বিসর্জন দিয়া নিজের কথা কিছু বলিতে পারিলে তাহার তৃপ্তির শেষ থাকিত না।

সেই সুযোগ আসিল। প্রদীপ হঠাৎ সচেতন হইয়া কহিল, “নজের কথাই পাঁচ কাহণ বলে যাচ্ছি—আমার জীবন-ইতিহাসের আদ্যোপান্ত নেই, বৌদি। আমি একটা চলমান গ্রহ—কখনো-কখন বা কারো অচল উপগ্রহ হয়ে থাকি। তোমার বাপের বাড়ির কোননা বৃত্তান্তই জানা হ’ল না। বর্তমানের বন্ধুতাকে অতীত কালেও বিস্তৃত করে দিতে হয়। এই কথা মনে রাখা চাই বৌদি, যে, বহু আগেই আমাদের দেখা হ’বার কথা ছিল—হয় নি, সে একটা আকস্মিক দুর্ঘটনা মাত্র।”

কি বলিবে নমিতা কিছু ভাবিয়া পাইল না। তবু কথা কহিবার অদম্য-উচ্ছাসে অসংলগ্ন ভাষায় যাহা সে বলিয়া চলিল, তাহা গুছাইয়া সংক্ষেপে এই:

নমিতার বাবা রঙুপুরে ওকালতি করিতেন। তাহার এক দাদা ছিল, বছর দুই আগে স্বদেশী করিতে গিয়া পুলিশের হাতে যে মার খাইয়াছিলেন, তাহাতেই মারা গিয়াছেন। সেই শশাকেই বাবা ভাঙিয়া পড়িলেন; সমস্ত সংসার ছত্রখান হইয়া গেল। বাবা ওকালতি করিয়া টের পয়সা জমাইয়াছিলেন, খুড়া-মহাশয় চালাকি করিয়া তাহাতে হাত দিলেন। মা ও তাহার ছোট বোনটি এখন তাহার কাকারই আশ্রিত। কাকা কলিকাতায় দালালি করেন, অবস্থা মোটেই স্বচ্ছল নয়—তবে বাবার জমাননা পয়সা হাতড়াইয়া এখন একটু সুরাহা করিতে পারিয়াছেন। কাকার স্বভাব অত্যন্ত রুক্ষ, কাকিমা তাহারই সহধর্মিণী। সম্পর্কের দাবিতে গুরুজন হইলে কি হইবে, কাকার প্রতি নমিতার মন মোটেই প্রসন্ন নয়। মা’র প্রতি তাহাদের ব্যবহার ঠিক গুরুভক্তির পরিচায়ক হইয়া উঠে নাই। মা বিষয়বুদ্ধিহীন—এমন কেহ নাই যে, তাহাদের এই সম্পত্তি-সঙ্কটের সময় সাহায্য করে; মা যে কাকার আশ্রয় ছাড়িয়া অন্যত্র বাসা করিবেন, তদারক করিবার জন্য তেমন। আত্মীয় অভিভাবকও তাহাদের নাই। নমিতাকে ভালো ঘরে বিবাহ দিবার জন্য তাহার বাবার একান্ত অভিলাষ ছিল, সেই জন্য যথেষ্ট টাকাও রাখিয়া গিয়াছিলেন। সৌভাগ্যক্রমে তাহার ভালো ঘরে বিবাহ হইয়াছে বটে, (এখানে নমিতা একটু হাসিল) কিন্তু পণের টাকা দিয়া বিবাহের যাবতীয় খরচেই নাকি বাবার বিত্ত প্রায় নিঃশেষ হইয়া আসিয়াছে। কাকা যে মা ও তাহার ছোট মেয়েকে এতদিন ভরণপোষণ করিতেছেন, তাহার টাকা নিশ্চয়ই ছাত ফুড়িয়া পড়িতেছে না। নমিতা মেয়ে হইয়া জন্মিয়া মা ও ছোট বোটির কাছে অপরাধী হইয়া আছে। এমন সুযোগ্য জামাই পাইয়া মা যে আত্মীয়-গৌরবে উল্লসিত হইয়া উঠিয়াছিলেন, তাহা তাহার সামান্য দিবাস্বপ্ন মাত্র।

হঠাৎ চেয়ার হইতে উঠিয়া নমিতা বলিল,—“যান, এক্ষুনি শুয়ে পড়ুন গে। আমি মার ঘরে যাচ্ছি। মা আবার এত রাত পর্যন্ত গল্প করেছি টের পেলে বকূবেন হয় তো।” বলিয়া নমিতা বারান্দার দরজা দিয়া চলিয়া যাইতেছিল, প্রদীপ তাহাকে বাধা দিল; কহিল, “তুমি কি পাগল হয়েছ নাকি? মা’র বকুনি খাবার লোতে তুমি তোমার এই উত্তপ্ত সুখশয্যা অতিথিকে ছেড়ে দিয়ে যাবে, এতে সতীধর্মের অবমাননা হবে, বৌদি। বারান্দায় একটা ডেক্‌-চেয়ার দেখা যাচ্ছে, না? দাঁড়াও।”

নমিতাকে এক পা-ও নড়িবার অবকাশ না দিয়া প্রদীপ তাড়াতাড়িতে তাহাকে ঈষৎ স্পর্শ করিয়া বারান্দায় চলিয়া আসিল এবং দ্বিরুক্তি না করিয়া পেছন হইতে দরজাটা টানিয়া শিকল তুলিয়া দিল।

ডে-চেয়ারটায় বসিল বটে, কিন্তু ঘুম আসিবার নাম নাই। তাই বলিয়া অন্ধকার আকাশে দৃষ্টি প্রসারিত করিয়া, অস্তমান চাঁদের দিকে চাহিয়া দীর্ঘশ্বাস ফেলিবার মত দৌর্বল্য প্রদীপের ছিল না। চক্ষুর পাতা দুইটাকে জোরে চাপিয়াও নিদ্রাকে বন্দী করা যাইতেছে না— নানা পারম্পর্যহীন ছবি অন্তর-চক্ষুর সামনে ভাসিয়া উঠিয়া তাহাকে উদ্বস্ত করিয়া তুলিয়াছে। নমিতাদের ঘরের আলো কখন নিবিয়া গেল, তাহা টের পাওয়া মাত্রই প্রদীপের কেমন একটা বিশ্বাস হইল যে, নমিতারো দুই চোখে শুষ্ক, বেদনাহীন বিনিদ্রতা বিরাজ করিতেছে। প্রাচীরের ব্যবধানের অন্তরাল হইতে প্রদীপের আত্মা যেন নমিতার আত্মার স্পর্শ পাইল, সেই স্পর্শরসে স্নান করিতে করিতে অতলস্পর্শ নিদ্রার সমুদ্রে সে ডুবিয়া গেল।

সকালে চায়ের টেবিলে সুধী বলিল,-“কাল রাতে একটু জ্বরভাব হয়েছে। গাড়ি ইত্যাদি ঠিক করতে আজকেই তোমার কলকাতা গিয়ে কাজ নেই, প্রদীপ। চায়ের সঙ্গে এই দুটো ইনফ্লুয়েঞ্জা ট্যাবলেট খাচ্ছি—বিকেলেই মাথাটা ছাড়বে হয়ত। রাত্রের ট্রেনে যেয়ো।”

সেই জ্বরই সতেরো দিন পরে যখন ছাড়িল, তখন সুধী কাশ্মীর উত্তীর্ণ হইয়া যে-পথে পাড়ি জমাইয়াছে সে-পথ ঘুরিয়া-ফিরিয়া পুনরায় পৃথিবীতে আসিয়া সমাপ্ত হয় নাই। আবার এই ধূলার ধরণীতেই প্রত্যাবর্তন করিতে হইবে—এমন একটা বৈচিত্র্যহীন পৌঁনঃপুন্যতে অভিসারিক আত্মা অমৰ্যাদা বোধ করে। সুধী আর এই মৃত্তিকায় ফিরিয়া আসিবে না, আকাশের অগণন তারার মধ্য হইতে সে একটিকে বাছিয়া লইয়া সেইস্থানে অবতীর্ণ হইবে; সেখানে নবজন্মের নবতর আস্বাদ পাইবে, নরদেহ লইয়া তাহা কল্পনা করিবারও তাহার সাধ্য ছিল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *