বিংশ শতাব্দীর দর্শন
মধ্যযুগের শেষ দিক থেকে রাজনৈতিক এবং সামাজিক প্রাধান্যের মধ্যে দর্শনের অবলুপ্তি ঘটে। ওকহামের উইলিয়াম ছিলেন মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠতম দার্শনিকদের একজন। তাঁকে কাইজার পোপের বিরুদ্ধে বিজ্ঞাপন লেখার জন্যে ভাড়া করেছিলেন। কারণ সে যুগের জ্বলন্ত সমস্যাসমূহের সঙ্গে সাম্প্রদায়িক বিরোধের প্রত্যক্ষ সম্বন্ধ ছিল।
সপ্তদশ শতাব্দীতে দর্শনের অগ্রগতির সঙ্গে ক্যাথলিক গির্জার বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সংগ্রামের সম্পর্ক ছিল, তবে তা কোথাও কম কোথাও বেশি। সত্যিকার অর্থে মেইল ব্রাঁসেও ছিলেন একজন পুরোত, কিন্তু পুরোতদেরকে তার দর্শন পড়তে দেয়া হতো না। অষ্টাদশ শতাব্দীতে ফরাসিদেশে লকের শিষ্যবর্গ এবং উনবিংশ শতাব্দীতে ইংল্যাণ্ডে বেনথাপন্থীরা ছিলেন রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে সম্পূর্ণরূপে বামপন্থী এবং তাদেরই প্রভাবে আধুনিক বুর্জোয়া উদারনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গীর প্রসার ঘটেছে। কিন্তু অগ্রগতির ব্যাপারে দর্শন এবং রাজনীতির মধ্যে পারস্পরিক সম্বন্ধের কোন সুনির্দিষ্ট রূপ আভাসিত হয়ে ওঠে নি। দর্শনের দিক দিয়ে যদিও হিউম ছিলেন বামপন্থী কিন্তু ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন একজন টোরি সমর্থক। একমাত্র রাশিয়াতেই প্রাক-বিপ্লব আমল পর্যন্ত মধ্যযুগীয় দর্শনের ভাঙাগড়া অথবা কোন রূপান্তর ঘটেনি। ফলে দর্শন এবং রাজনীতির যে-কোন সম্পর্ক দীর্ঘকাল ধরে আলাদা আলাদাভাবে অস্তিত্ব বজায় রাখতে পেরেছিল! বলশেভিকরা হলো বস্তুবাদী এবং সাদা মানুষেরা আদর্শবাদী। তিব্বতে এদুয়ের সম্পর্ক অতি নিবিড়, এমনকি দার্শনিক প্রধানকেই রাষ্ট্রের দ্বিতীয় ব্যক্তি বলে গণ্য করা হয়। তাছাড়া অন্য কোনও দেশে দর্শনকে এত সম্মান দেয়া হয় না।
বিংশ শতাব্দীতে দর্শন আনুষ্ঠানিকভাবে তিনটি শাখায় বিভক্ত হয়ে গেছে। প্রথম শাখা জার্মান ধ্রুপদ দর্শনের অনুসারীদের নিয়ে গঠিত। দ্বিতীয় দলটা বের্গসঁ এবং প্রয়োগবাদীদের নিয়ে গড়ে উঠেছে। তৃতীয় দলে যারা আছেন, তারা দর্শনে বিশেষ সত্য লুকিয়ে আছে এবং সে সত্যে উপনীত হওয়ার জন্য বিশেষ পদ্ধতির প্রতি শ্রদ্ধাজ্ঞাপন না করে সরাসরি বিজ্ঞানের সঙ্গে সংযোগ রক্ষা করেন। চিহ্নিত করবার জন্য তাদেরকে বস্তুবাদী আখ্যা দেয়া যেতে পারে; তার পরেও তাদের অনেককে সে পরিচয়ে পরিচিত করা যায় না।
বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে যে পার্থক্য তা খুব তীক্ষ্ণ নয়। অংশতঃ এ গোষ্ঠী এবং অংশতঃ ও গোষ্ঠী বলে পরিচিত হয়ে থাকেন দার্শনিকেরা। উইলিয়াম জেমসকে প্রয়োগবাদ এবং বস্তুবাদের প্রতিষ্ঠাতা বলা যেতে পারে। ডক্টর হোয়াইটহেড তার সাম্প্রতিক গ্রন্থে কমবেশি বের্গসিয় দর্শনের স্বপক্ষে ওকালতি করেছেন। অনেক দার্শনিক আছেন যারা উপযুক্ত যুক্তি না দেখিয়ে আইনষ্টাইনের বৈজ্ঞানিক মতবাদকে কার্যের স্থান কাল পাত্রের ভিত্তিভূমি বলে ধারণা করে থাকেন। যুক্তির পার্থক্যের চেয়ে বাস্তবের পার্থক্য অধিকতর সুস্পষ্ট। তা সত্বেও মতামতের শ্রেণীবিন্যাসের প্রয়োজনে যুক্তির বিভিন্নতার প্রয়োজন রয়েছে।
জার্মান আদর্শবাদ বিংশ শতাব্দীব্যাপী প্রতিরক্ষা ভূমিকা পালন করে আসছে। অধ্যাপক ছাড়া আর যারা নতুন গ্রন্থের বিচার করেন, তারাই নতুন নতুন গোষ্ঠীকে তুলে ধরেছেন। সমালোচনাকে সম্বল করে গ্রন্থের বিচার করেন বলে তারা ভাবেন যে এ সমস্ত গোষ্ঠী এখন অত্যাধিক প্রতিপত্তিশালী; কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে জার্মানি, গ্রেটবৃটেন, ফ্রান্স (আমেরিকা নাও হতে পারে) এখন দর্শনের ক্লাসিক ঐতিহ্যকেই আঁকড়ে ধরে রয়েছে। একজন যুবক তার সমালোচনা না করে সমর্থন করলে হোমরা চোমরা কেউকেটা একটা হয়ে যেতে পারে।
বিরুদ্ধবাদীরা এর মধ্যে অনেক জার্মান দোষ বের করবার চেষ্টা করেছেন; কিছু অংশে তা জার্মানির বেলজিয়াম আক্রমনের জন্য দায়ীও বটে। এই দলের সমর্থকেরা। বিখ্যাত এবং সম্মানিত ছিলেন তাই তাদেরকে আক্রমণ করে ঘায়েল করা খুব সহজসাধ্য ব্যাপার ছিল না। ইমাইল বেজোস্ক এবং বানাল্ড বেসানকোয়েট মৃত্যুর পূর্বমুহূর্ত পর্যন্ত আন্তর্জাতিক কংগ্রেসে ফরাসি এবং বৃটিশ দর্শনের মুখপাত্র ছিলেন। এই সম্প্রদায়ের ধর্মীয় মোহগ্রস্থ এবং রক্ষনশীল দৃষ্টিভঙ্গি ধর্মের স্বপক্ষে এবং বিপ্লবের প্রতিকূলে সদাসর্বদা আত্মপক্ষ সমর্থনে তৎপর ছিল। এ গোষ্ঠীর মধ্যে যারা পূর্বাবস্থা অক্ষুণ্ণ রাখতে চাইতেন, তাদের দুর্বলতা এবং ঐতিহ্যের শক্তি দুই-ই ছিল। কিন্তু নতুন চিন্তাধারার সজীবতা তাদের ছিল না। বিশংশতাব্দীর ঠিক পুর্বমুহূর্তে ইংরেজি ভাষাভাষি অঞ্চলসমূহে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। ১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে যখন মি. ব্রাডলের এপিয়ারেন্স আ্যন্ড রিয়ালিটি (Appearence and reality) গ্রন্থ প্রকাশিত হয় তখন থেকে আমি দর্শন পাঠে গভীরভাবে মনোনিবেশ করি। ইংল্যাণ্ডে জার্মান। দর্শনের প্রকৃত স্বীকৃতি আদায় করার ব্যাপারে যাদের সংগ্রাম করতে হয়েছিল মি. ব্রাডলে তাদের একজন। ঐতিহ্যগত গোঁড়ামির সমর্থকদের তুলনায় তার দৃষ্টিভঙ্গি ছিল উর্ধ্বে। অন্যান্য সমসাময়িকের মতো তার এ্যাপিয়ারেন্স অ্যাণ্ড রিয়ালিটি আমার মধ্যে গভীরভাবে আবেদন সৃষ্টি করেছিল, যদিও সেসব গ্রন্থের মতামতের সঙ্গে আমি ভিন্ন ধারণা পোষণ করি, তবু সেগুলোকে আমি এখনো খুবই সম্মানের চোখে দেখে থাকি।
হেগেলপন্থীদের দৃষ্টিভঙ্গীর বৈশিষ্ট্য হলো একমাত্র ন্যায়শাস্ত্রই আমাদেরকে বাস্তব পৃথিবীর সব কিছু সম্পর্কে ওয়াকিবহাল করে তুলতে পারে। মি. ব্রাডলেও অংশতঃ তাই বিশ্বাস করতেন। তার মতামত হলো যেহেতু পৃথিবীটা বাইরের দিক থেকে দেখতে গেলে স্ববিরোধী এবং সে জন্য মায়াময়, সুতরাং ন্যায়শাস্ত্রের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হলে আশ্চর্যজনক কোন বৈশিষ্ট্য এর থাকতে পারে না। তার মধ্যে পরস্পর-সংশ্লিষ্ট বিচিত্র কিছু থাকতে পারে না এবং তার পৃথক পৃথক সত্তা এমনকি জানার জন্য কর্তা কর্মের মধ্যেও কোন বিভিন্নতা থাকতে পারে না সুতরাং একটি শর্তহীন সত্তার মধ্যেই সামাজিক বৈশিষ্ট্যটি নিরবধিকাল থেকে বিরাজমান এবং আকাক্ষা ও চিন্তাকে বাদ দিয়ে অনুভূতিরই সমগোত্রীয়।
ঘটনাগুলো ঘটনা নয়, আদতে আমাদের ভূপৃষ্ঠের যা কিছু ঘটে সব মায়া। এই মতবাদের ফলে নৈতিকতার ধ্বংসসাধন হওয়া উচিত; কিন্তু নৈতিকতা হলো প্রবৃত্তিগত এবং ন্যায়শাস্ত্রের আওতার বাইরে। হেগেলপন্থীরা যে আবেদন করে থাকেন প্রকৃত প্রস্তাবে তার মূলনীতি হলো যেহেতু হেগেলিয় দর্শন সত্য, সুতরাং আমাদের সে অনুসারে কাজ করা উচিৎ। কিন্তু তাদের জানা উচিত যে এ দর্শন সত্য হলে আমরা যেভাবে গ্রহণ করেছি সেভাবে না করে ভিন্নভাবে গ্রহণ করতাম।
এই দর্শনকে দু’দিক থেকে আক্রমণ করা হয়েছে। একদিকে আছেন নৈয়ায়িকেরা, যারা হেগেলের মধ্যে ভ্রান্তিকে সুস্পষ্টভাবে দেখিয়ে দিয়েছেন; তাছাড়াও সংযোগ, বহুত্ব, স্থান-কাল ইত্যাদি অনেক স্ববিরোধী তথ্যের অসারতা প্রমাণ করেছেন। অন্যদিকে ছিলেন তারা যারা চিন্তাকে ন্যায়শাস্ত্রের সৃষ্ট মতে সীমিত এবং অনুগত রাখতে অস্বীকার করলেন। তাদের মধ্যে উইলিয়াম জেমস এবং বেগ ছিলেন প্রধান। এই দু’মুখো আক্রমণের দু’একটি বিস্ফোরণকে বাদ দিলে দর্শন ন্যায়শাস্ত্র অনুসারে সঙ্গতিবিহীন ছিল না। ভিন্নরকমের জ্ঞানের প্রভাবে অনুপ্রাণিত বলে দু’য়ের মধ্যে প্রকৃতিগত প্রভেদ ছিল বিস্তর। দু’দলের আবেদনও দু’রকম। একদলের আবেদন ছিল আনুষ্ঠানিক এবং অন্য দলের মানবিক। আনুষ্ঠানিক আবেদন হেগেলিয় যুক্তি দেখিয়ে হেগেলিয় দর্শনকে মিথ্যা প্রতিপন্ন করল; স্বভাবতঃই মানবীয় আবেদন অধিকতর সফলতা অর্জন করে।
ইংরেজি ভাষাভাষী জগতে জার্মান আদর্শবাদের নাগপাশ যার প্রভাবে ছিন্ন হয় তিনি হলেন উইলিয়াম জেমস। মনস্তত্ত্বে তার যে পরিচয় বিধৃত ছিল সে হিসেবে নয়, ছোট ছোট যে পুস্তকগুলো তার শেষ জীবনে এবং মৃত্যুর পরে ধারাবাহিকবাবে প্রকাশিত হয়েছে সেগুলো তাকে নতুন পরিচয়ে চিহ্নিত করেছে। মাইণ্ড (Mind) কাগজে ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত একটা প্রবন্ধে তিনি তার প্রবৃত্তিগত পক্ষপাতিত্ববোধকে অপূর্ব সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন প্রবন্ধটি তার মৃত্যুর পরে প্রকাশিত গ্রন্থাবলী র্যাডিক্যাল এমপিরিসিজমে সংযোজিত হয়েছে।
যেহেতু আমরা প্রধানত সংশয়বাদী, সেজন্য আমাদের কিছু সংখ্যক বিশ্বাসের অভিপ্রায় পরস্পরের কাছে অকপটভাবে স্বীকার করতে পারি। আমার সম্পর্কে আমি যা অকপটভাবে স্বীকার করতে পারি মূলতঃ সেগুলো সৌন্দর্যতত্ব সম্বন্ধীয় ন্যায়শাস্ত্রের সঙ্গে তার সম্পর্ক নেই। ব্রহ্মাণ্ডের নিখুঁত ত্রুটিহীন সর্বব্যাপ্ততা আমাকে সম্পূর্ণরূপে শ্বাসরুদ্ধ করে ফেলে। সম্ভাবনাহীন প্রয়োজনীয়তা, সম্বন্ধহীন বিষয়পুঞ্জ আমাকে অনুভব করতে বাধ্য করে যে কোন সংরক্ষিত অধিকার ব্যতিরেকেই আমি এমন একটা চুক্তিতে আবদ্ধ হয়েছি, তা যেন ব্যক্তিগত শয়নকক্ষহীন সমুদ্রতীরে বিরাট একটি বোর্ডিং হাউজে বাস করার মতো; যেখানে আমি সে অঞ্চলের সমাজ থেকে আত্নগোপণ করে থাকতে পারব। অধিকন্তু আমি তীক্ষ্ণভাবে সজাগ যে ঐ বিষয়ে আচারনিষ্ঠ ইহুদী এবং প্রাচীন ঝগড়াটে পাপীদের কিছু করার আছে। আমার ব্যক্তিগত জ্ঞান থেকেই বলছি, সব হেগেলপন্থীরা দাম্ভিক নয়, কিন্তু আমি অনুভব করি হেগেলপন্থী হওয়ার মধ্যেই সকল দাম্ভিকের পরিণতি। একটি গল্প আছে, দু’জন যাজককে ভুলক্রমে একটি শেষকৃত্য অনুষ্ঠান পরিচালনা করার জন্য নিমন্ত্রণ করা হয়েছিল। একজন এসেই শুরু করে দিল আমিই ধ্বংস আমিই জীবন, তখন অন্যজন প্রবেশ করে চিৎকার করে বলল আমিই ধ্বংস আমিই জীবন। দর্শন আমাদের অনেককে সে বিবদমান দু’যাজকের কথাই স্মরণ করিয়ে দেয়।
দর্শন বলতে অত্যন্ত সুরক্ষিত, বেদনাদায়ক এবং নিখুঁতভাবে নির্দেশিত এমন কিছুকে বোঝায় যা বিশাল অচেতন মৃদু নিঃশেষিত সঙ্গতির অতলান্ত গভীরতা এবং অজানা আবর্তের হয়ে কথা কয়।
উইলিয়াম জেমস হেগেলিয় দর্শনের সঙ্গে সামুদ্রপারের বোর্ডিং হাউজের তুলনা করেছেন, তিনি সেখানে কখনো বাস করেছেন বাজি রেখেও কেউ কখনো স্বীকার করবে না। ১৮৮৪ সালে এই প্রবন্ধের তেমন কোন প্রভাব ছিল না, কারণ তখন হেগেলিয় দর্শনের প্রাধান্য পুরোমাত্রায় বিরাজমান ছিল এবং প্রবৃত্তি যে তাদের মতামতের উপর প্রতিক্রিয়া করে তা দার্শনিকদের জানা ছিল না। ১৯৮২ সালে (প্রবন্ধে পুনঃমুদ্রণকালে) পরিস্থিতি বিভিন্ন কারনে পরিবর্তিত আকার ধারণ করে,তার মধ্যে হেগেল শিষ্যদের ওপর উইলিয়াম জেমসের প্রভাবকে অন্যতম ধরা যেতে পারে। তার লেখা ছাড়া তাকে ভাসাভাসার চেয়ে বেশি জেনেছি এ দাবি আমি করতে পারিনে। আমার ধারণা তার চরিত্রের তিনরকম বৈশিষ্ট্য যে-কেউ আবিষ্কার করতে পারে। এ তিনরকম বৈশিষ্ট্যের সমন্বয়ে তার দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে উঠেছিল। মনস্তত্ব এবং চিকিৎসাবিদ্যায় অধ্যয়নের প্রভাব শেষবার কিন্তু দর্শনের স্ফুরণে প্রথম তার মধ্যে মুকুলিত হয়ে উঠেছিল। খাঁটি সাহিত্যিক দার্শনিক প্লেটো, এ্যারিস্টোটল এবং হেগেল থেকে অনুপ্রেরণা-লব্ধ দার্শনিকদের তুলনায় বৈজ্ঞানিক এবং বস্তুবাদের প্রতি সামান্য পক্ষপাতসম্পন্ন রূপে তার দর্শন আত্নপ্রকাশ করেছিল। স্বাধীন ইচ্ছাশক্তির আলোচনার এত কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ অনুচ্ছেদে ছাড়া সর্বত্রই এ ধারণা প্রাধান্য বিস্ত রি করেছে। তার দর্শনের কাঠামোর দ্বিতীয় উপাদান হলো মরমী এবং ধর্মীয় পক্ষপাত তা তিনি তার ভ্রাতার মতো পিতার কাছ থেকে উত্তরাধিকার সূত্রে অর্জন করেছিলেন। এই পক্ষপাতই তার বিশ্বাস করার ইচ্ছা অথবা উইল টু বিলিভকে এবং আত্মা সম্বন্ধে গবেষণা করতে অনুপ্রাণিত করেছিল। তৃতীয়তঃ তিনি তার ভাইসহ নিউইংল্যাণ্ডের বিবেকের সমস্ত আন্তরিকতা সহযোগে স্বাভাবিক আড়ম্বরকে নস্যাৎ করে তার স্থলে ওয়াল্ট হুইটম্যানের গণতান্ত্রিক ভাবধারার প্রসার ঘটাতে চেয়েছিলেন। ওপরে উদ্ধৃত অনুচ্ছেদটির মধ্যে রুচিবাগীশতার প্রমাণ পাওয়া যায়, তিনি ব্যক্তিগত শয়ন কক্ষ ছাড়া সাগর পাড়ে বোর্ডিং হাউজের প্রতি তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করেছেন (হয়তো হুইটম্যান যা ভালোবাসতে পারতেন) আচারনিষ্ঠ ইহুদী বলে নয়, পাপী এ দাবীতেই তিনি গণতান্ত্রিক হওয়ার ইচ্ছা পোষণ করেন। কিন্তু তিনি নিশ্চিতভাবে একজন আচারনিষ্ঠ ইহুদী ছিলেন না এবং সম্ভবতঃ তিনিও অন্যান্য মানুষের এত কিছু পাপ করে থাকবেন। এ ক্ষেত্রে তিনি স্বভাবসুলভ বিনয় প্রকাশ করতে অকৃতকার্য হয়েছেন।
বিভিন্ন রকমের গুণাবলীর মিশ্রণের মধ্যেই শ্রেষ্ঠ মানুষদের বিশেষত্ব ফুটে ওঠে, যা অনেকসময় অসঙ্গত রূপও ধারণ করতে পারে, উইলিয়াম জেমসের ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল, তার সমসাময়িকেরা যা মনে করত তার তুলনায় তার ছিল অনেকগুণ বেশি। ধর্মীয় আশা-আকাঙ্ক্ষাকে বৈজ্ঞানিক অনুমানের মতো করে ব্যক্ত করার পদ্ধতি হিসেবে তিনি প্রয়োগবাদের স্বপক্ষে ওকালতি করেছিলেন। মন এবং পদার্থের বিরোধ দু’টোর কোনটাকেই না খর্ব করে, নিস্পত্তি করার পদ্ধতি হিসেবে চেতনা বলে কোনকিছু নেই এ বৈপ্লবিক মতবাদের প্রবর্তন করেন। তার দর্শনের দু’পর্যায়ে বহু সহমর্মী তার ছিল। শিলার এবং বেগর্স ছিলেন প্রথম পর্যায়ের মিতা এবং নিওরিয়ালিস্ট, যা নব্য বস্তুবাদীরা ছিলেন পরবর্তী পর্যায়ে। প্রধান ব্যক্তিদের মধ্যে একমাত্র ডিউয়ি উভয়পর্যায়ে তার সঙ্গে ছিলেন। প্রধান ব্যক্তিদের মধ্যে স্বীকৃত রয়েছে, সে জন্য অবশ্যই আলাদা আলাদাভাবে পর্যালোচনা করতে হবে।
জেমসের বিশ্বাস করার ইচ্ছা (Will to believe) ১৯৮৭ সালে প্রয়োগাদ (Pragmatisom) ১৯০৭ সালে শিলারের মানবতাবাদ (Humanism) এবং ডিউয়ির ন্যায়শাস্ত্র (Studies in logical theory) ১৯০৩ সালে প্রকাশিত হয়। বিংশশতাব্দীর প্রথম বছরসমূহে দর্শনজগত প্রয়োগবাদের গুণগানে মুখরিত ছিল। তার পরে বেগর্স কতিপয় পরীক্ষায় ফেলে তা অকেজো করে ফেললেন। প্রযোগবাদের তিনজন প্রতিষ্ঠাতার মধ্যে বিস্তৃত পার্থক্য রয়েছে, আমরা জেমস, শিলার এবং ডিউয়িকে যথাক্রমে ধর্মীয় সাহিত্যিক এবং বৈজ্ঞানিক অভিনেতা হিসেবে ধরে নিতে পারি। যদিও জেমস ছিলেন বহুমুখী, কিন্তু তার একমাত্র ধর্মীয় বোধেরই প্রয়োগবাদে উক্রান্তি ঘটেছে। চলুন আমরা এ সকল পার্থক্যের কথা ভুলে গিয়ে সম্পূর্ণমতবাদকে একীভূত সূত্র হিসেবে উপস্থিত করি।
এক রকমের সংশয়বাদ হলো এ মতবাদের ভিত্তিভূমি। ঐতিহ্যগত দর্শন ধর্মের ক্ষেত্রে মতবাদকে প্রমাণ করার অক্ষমতা প্রচার করল এবং বিরুদ্ধবাদীরা ধর্মকে অপ্রমাণ অথবা নিদেন পক্ষে স্পেনসারের মতো ধর্মবিশ্বাসকে প্রমাণ করা যায় না একথা প্রমাণ করার কথা ঘোষণা করল। সে যাহোক, ধর্মীয় মতবাদকে প্রমাণ অথবা অপ্রমাণ কিছুই করা যায় না। অনেক মতবাদের ক্ষেত্রে একই ফলশ্রুতি দেখা গেল; যাকে স্পেনসারের মতো মানুষেরা পরিবর্তনীয় মনে করলেন। সেগুলো হলো কার্যকারণ, সম্বন্ধ, আইনের সীমানা, স্মৃতির সাধারণ বিশ্বাস, অযোগ্যতা, অবরোহ পদ্ধতির যথার্থতা ইত্যাদি। প্রকৃত বিবেচনাসম্পন্ন দৃষ্টিভঙ্গি অনুসারে নিরীশ্বরবাদের উৎকণ্ঠিত রায়ের মধ্যে এ সকল উপাদানের বিলুপ্তি ঘটা উচিত! যতদূর পর্যন্ত আমরা দেখতে পাই ততদূর এগুলো প্রমাণ অপ্রমাণ কিছুই করা যায় না। জেমস বলেন বস্তুজ্ঞানসম্পন্ন মানুষ হিসেবে যদি আমরা বেচে থাকতে চাই, তাহলে এসব বিষয়ে আমাদের সন্দিহান থাকলে চলবে না। দৃষ্টান্তস্বরূপ আমরা অবশ্যই কল্পনা করতে পারি, যে খাদ্য অতীতে আমাদের পুষ্টিবৃদ্ধি করেছে ভবিষ্যতে তা আমাদের শরীরে বিষক্রিয়া করবে না। অনেক সময় তা আমরা ভুলে যাই এবং মারা পড়ি। জীবনের উন্নতি এবং আকাক্ষার প্রতিফলন ঘটানোর মধ্যেই বিশ্বাসের পরীক্ষার সাফল্য প্রমাণিত হয় এবং যে পর্যন্ত না আমরা বস্তুজগত সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ধারণা পোষণ করতে না পারি সে পর্যন্ত আমাদের বিশ্বাস বস্তুর সঙ্গে যাচাই করার সঙ্গতি রক্ষা করবে না। এ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে জেমস বিভিন্ন ধর্মীয় অভিজ্ঞতা (The varieties religious experiance) বইতে দেখাতে চেয়েছেন, অনেক সময় ধর্মবিশ্বাস পরীক্ষার পরে টিকে থাকে, সুতরাং তাকে সত্য বলে গ্রহণ করা উচিত। তিনি শুধু এ অর্থে বলেছেন যে বিজ্ঞানের সবচেয়ে বিশ্বাসযোগ্য থিয়োরিকে বাস্তবে প্রয়োগ করা যায় যখন তখনই আমরা তা সত্য বলে গ্রহণ করি এবং সে সম্পর্কে বই-ই হলো আমাদের জানাশোনার মাধ্যম।
বিজ্ঞান এবং ধর্মের সাধারণ অনুমানের মধ্যে প্রয়োগ করা যায় বলেই এই মতবাদ সম্পর্কে বলার মতো অনেক কিছু রয়েছে। কর্মক্ষম বলতে কি বুঝায় সে সম্পর্কে একটি সাবধানী সংজ্ঞা নিরূপণ এবং যে যে ক্ষেত্রে আমরা সত্য সম্পর্কে ওয়াকেবহাল নই, তা পূর্বাহ্নে নির্ধারণ করতে পারলে ধর্মীয় মতবাদের সঙ্গে ঝগড়া বাধাবার কোন প্রয়োজন পড়ে না। যেখানে আসল সত্য উদঘাটন করা দূরূহ নয় সে সম্পর্কে চলুন আমরা মামুলি দৃষ্টান্তের অবতারণা করি। যেমন ধরুন আপনি এক ঝলক বিজুলী শিখা দেখতে পাওয়ার পর বজ্রপাতের শব্দ আশা করবেন অথবা বজ্রপাত অতি দূরে হওয়ার শব্দ আপনার কর্ণগোচর হলো না অথবা আপনি সে ব্যাপারে মোটেই চিন্তা করলেন না। সাধারণতঃ এই শেষেরটা অত্যন্ত ইন্দ্রিয়গ্রাহ্য ব্যাপার, ধরুন আপনি উপরের দুটোর যে কোন একটিকেই গ্রহণ করলেন। যখন আপনি বজ্রপাতের শব্দ শুনলেন, আপনার বিশ্বাস তখন সত্য প্রমাণিত হলো না। তা বিচার করবেন একটি বাস্তব ঘটনা-বজ্রপাতের শব্দ শোনার প্রতিক্রিয়া অনুসারে, কিন্তু উদ্ভুত সুবিধা অসুবিধা হিসেবে নয়। প্রয়োগবাদীদের কারবার প্রধানতঃ সে সকল বিশ্বাস নিয়ে যা আমাদের অভিজ্ঞতার মধ্যে যে সকল ঘটনা ঘটে তার সাহায্যে যাচাই করা যায় না। আমাদের দৈনন্দিন বিশ্বাসের অনেকগুলো জাগতিক অভিজ্ঞতার মধ্যে সীমিত, যেমন অমুক অমুকের ঠিকানা হলো এই এই ইত্যাদি। আমাদের অভিজ্ঞতার সাহায্যে তা যাচাই করা যায় এবং এ সকল ক্ষেত্রে প্রয়োগবাদীদের বিচারপদ্ধতি অপ্রয়োজনীয়। অনেক ক্ষেত্রে বজ্রপাতের উপরোক্ত দৃষ্টান্তের এত তা মোটেই প্রয়োগশীল নয়, যেহেতু সত্যবিশ্বাস মিথ্যাবিশ্বাসের চাইতে কোন বাস্তব সুযোগ দান করে না এবং তা কোনকিছু সম্পর্কে যেমন চিন্তা করা হয়, তেমনি সুবিধাজনকও নয়। দৈনন্দিন জীবনের থেকে উদাহরণ না নিয়ে আড়ম্বরপূর্ণ উদাহরণ গ্রহণ করেন, এটা দার্শনিকদের একটি সাধারণ দোষ।
প্রয়োগবাদ চূড়ান্ত দার্শনিক সত্যের উদঘাটন করতে না পারলেও এর কতেক প্রয়োজনীয় গুণাবলী রয়েছে। প্রয়োগবাদই প্রথম উপলব্ধি করতে পেরেছে, যে সত্য আমরা আয়ত্ব করতে পারি তা প্রত্যেক মানবিক ধারণার মতো প্রমাদসাপেক্ষ এবং পরিবর্তনশীল। মানুষের জীবনের ঘটনাচক্রের বাইরে যা আছ তা সত্য নয়, সত্য হলো বিশ্বাসসমূহের গুণগত নির্যাস এবং বিশ্বাস হলো আত্নিক ঘটনাপুঞ্জ। অধিকন্তু ওদের সঙ্গে ঘটনার সম্বন্ধ ন্যায়শাস্ত্র যেভাবে কল্পনা করে তেমন সরল সহজ নয় এবং তা নির্দেশ করে দেয়া ন্যায়শাস্ত্রের প্রয়োগবাদের দ্বিতীয় গুণ। বিশ্বাসসমূহ অনেক সময় স্পষ্টতঃ জটিল, একটি বিশেষ ঘটনার দিকে সোজাসুজি না তাকিয়ে অনেকগুলো ঘটনার ধূসর জগতে নিয়ে যায় টেনে। সুতরাং বিশ্বাসসমূহ ন্যায়শাস্ত্রের পরিকল্পিত প্রস্তাবের মতো তীক্ষ্ণভাবে সত্য এবং মিথ্যার বিরোধিতা করে না সেগুলো হলো সত্য এবং মিথ্যার সুস্পষ্ট ছাপ বিশেষ। ওগুলো ধূসর কালো এবং বহুবর্ণের হতে পারে কিন্তু সাদা নয় কখনো। যে সকল মানুষ সত্যের সম্পর্কে শ্রদ্ধাসহকারে কথা বলে, ঘটনা সম্পর্কে তা মনে করলে তারা অধিকতর ভালো করত এবং জানতে পেতো মানুষের যে শ্রদ্ধেয় গুণগুলোর প্রতি তারা সম্মান পোষণ করে, মানুষের বিশ্বাসের মধ্যে তা পাওয়া যায় না। এর বাস্তব এবং থিয়োরিগত সুবিধা রয়েছে, যেহেতু মানুষ সত্য জানতে পেরেছে এ অজুহাতে পরস্পর পরস্পরের উপর অত্যাচার করে। মনঃসমীক্ষার দৃষ্টিকোণ থেকে বলতে গেলে তা এভাবে বলা যায় যে সকল মানুষ উচ্চতর আদর্শের কথা বলে তা শত্রুদের নির্যাতন করার একটা অজুহাতমাত্র। ভালো জিনিসের যেমন প্রচার লাগে না, তেমনি ভালো নৈতিকতার জন্য কোন বাজি রাখার প্রয়োজন পড়ে না।
সে যাহোক, বাস্তবে প্রয়োগবাদের একটি অত্যন্ত ক্ষতিকর দিক রয়েছে। এ মতবাদ অনুসারে বিশ্বাসের আকারে যা পুরস্কৃত করে, তাই সত্য। এখন কথা হলো ফৌজদারি আইনের প্রয়োগ করেও একটি বিশ্বাসের দাম হাসিল করা যায়। সপ্তদশ শতাব্দীতে ক্যাথলিক মতবাদ ক্যাথলিক দেশে এবং প্রোটেস্টান্ট মতবাদ প্রোটেস্টান্ট দেশে দাম পেয়েছে। উৎসাহী মানুষ রাষ্ট্রের সরকারযন্ত্র করায়ত্ব করে নিজস্ব মতামত ছাড়া অন্যন্য মতবাদকে নির্যাতন করে সত্যের উৎপাদন করতে পারে। বাড়াবাড়ির ফলে এ পরিণতি ঘটে এবং প্রয়োগবাদ সম্পূর্ণবাবে এ আওতায় পড়েছে।
প্রয়োগবাদীরা যা স্পষ্টভাবে নির্দেশ করে, সত্য পরিমাণ মতো এবং মানবিক ঘটনাবলীর সম্পদ বিশেষ তা মেনে নেয়ার পরও সম্পূর্ণভাবে মানবিক পরিস্থিতি থেকে উদ্ভূত বিশ্বাসে যে পরিমাণ সত্য থাকে অন্যান্য রকমের বিশ্বাসে সে পরিমাণ সত্যের নির্যাস থাকে না। আমাদের বিশ্বাস সমূহে সত্যের পরিমাণ বাড়াতে হলে আমাদেরকে একটা আদর্শের কল্পনা করতে হয় এবং যদি বাস্তব ঘটনার সাহায্যেই আদর্শের প্রতিষ্ঠা করা হয় তবে এ ব্যাপারে আমাদের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতার পরিধি খুবই সঙ্কীর্ণ; কোন গ্রহপূষ্ঠের অথবা গ্রহের নিকটস্থ কোন ঘটনার খুঁটিনাটির মধ্যেই সীমাবদ্ধ। বিজ্ঞাপনদাতাদের কৌশল থেকেই প্রয়োগবাদের উৎপত্তি, যারা বারবার তাদের একবাক্স পিনের দাম এক গিনি প্রচার করার ফলে মানুষ ছয় পেন্স প্রদান করতে রাজি হয়। কম আত্নবিশ্বাস নিয়ে প্রচার করলেও তাদের কথা প্রায়ই সত্যের আকার ধারণ করে। এ রকম মানুষের সৃষ্ট সত্যগুলো কৌতূহলোদ্দীপক যদিও সেগুলোর পরিধি খুবই সংকীর্ণ। এ সত্যের পরিধি বিস্তৃত করবার বাড়াবাড়িতেই মানুষ প্রোপাগাণ্ডার তাণ্ডবলীলায় মেতে ওঠে, যুদ্ধ ও মহামারী এবং দুর্ভিক্ষের রূঢ়তম আঘাতে তার সমাপ্তি ঘটে। ইউরোপের সাম্প্রতিক ইতিহাস এরকমভাবে প্রয়োগবাদের অসারতারও নিরপেক্ষ দৃষ্টান্ত।
প্রয়োগবাদীরা বেগর্সকে কেননা মিত্র বলে অভিনন্দিত করেছিলেন তা আশ্চর্য ব্যাপার, যেহেতু তার দর্শন তাদের দর্শনের সম্পূর্ণ বিপরীত ছিল প্রয়োগবাদীরা প্রয়োজনীয়তাকে সত্যের আসল সংজ্ঞা বলে শিক্ষা দিয়ে থাকেন। পক্ষান্তরে বেগর্স শিক্ষা দিয়েছেন, আমাদের মেধা বাস্তব প্রয়োজনের উপযোগী হিসেবে গড়ে ওঠে এবং পৃথিবীর যাবতীয় বস্তুর প্রতি দৃষ্টিপাত করে না, অগ্রাহ্য করে এবং প্রকৃতপ্রস্তাবে সত্যের ধারণা পোষণ করার প্রধান প্রতিবন্ধক। তিনি মনে করতেন, আমাদের এরকমের সজ্ঞা বা (Intuition) নামে একজাতীয় ইন্দ্রিয়বৃত্তি আছে; কষ্ট করলে পরে আমরা তা ব্যবহার করে যদিও আপাতঃদৃষ্টিতে ভবিষ্যৎ সম্পর্কে নয় থিয়োরিগতভাবে অতীত বর্তমানের প্রত্যেক জিনিস সম্পর্কে জ্ঞান লাভ করতে পারব। অনেক বেশি জ্ঞান নিয়ে অসুবিধায় পড়তে হয় বলে আমার মগজের উৎকর্ষ সাধন করেছি, ভুলে যাওয়াই হলো যার কাজ। কিন্তু মগজের কারণেই আমরা সবকিছু মনে করতে পারি এবং মগজ চালুনির মতো ঠেলে দেয় বলে আমরা শুধু প্রয়োজনীয় সবকিছু ও ভ্রান্তিসমূহকে মনে করতে পারি। বের্গসের মতে প্রয়োজনীয়তা হলো ভুলের উৎসবিশেষ। পরম্ভ মরমীর ধ্যান থেকে যে সত্যে পৌঁছনো যায় তাতে বাস্তব সুবিধার সকল চিন্তা অনুপস্থিত থাকে। তা সত্বেও বেগর্স প্রয়োগবাদীদের এত যুক্তির চেয়ে কর্মকেই বেশি প্রাধান্য দিয়েছেন, হ্যামলেটের চেয়েও যে লোককে তিনি ভালো মনে করতেন এবং বুদ্ধিবৃত্তিক কারণে রাজাকে বাঁচাতে দেয়ার চাইতে, স্বতস্ফূর্ত স্বজ্ঞায় অনুপ্রাণিত হয়ে ভেসডিমোনাকে হত্যা করা অধিকতর শ্রেয় মনে করেনে। একারণেই প্রয়োগবাদীরা তাকে মিত্র বলে মনে করেছিলেন।
বের্গসঁর ডনিস ইমিডিয়েট দ্যালা ক’সাস ১৮৮৯ সালে, মেটেরিয়েল এট মেমোয়ার ১৮৯৬ সালে প্রকাশিত হয়। ১৯০৭ সালে (L Evalution Creatrice) ল্যা ইভসন ক্রিটিজ প্রকাশিত হবার সঙ্গে সঙ্গে তিনি বিখ্যাত হয়ে পড়েন। তার এই বইটি অন্যান্য বইয়ের চেয়ে উৎকৃষ্ট ছিল না, কিন্তু তাতে উপাদানের তুলনায় ছন্দ হিল্লোল বেশি ছিল বলে অতি সহজে মানুষকে অভিভূত করেছিল। বইটির শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত কোন যুক্তি ছিল না। সুতরাং কুযুক্তিও ছিল না। বইটিতে কল্পনাকে উজ্জীবিত করার এত ভাবাবেগপূর্ণ কবিত্বের একটি মনোরম বর্ণাঢ্য ছবি ছিল। যে দর্শনের পক্ষে ওকালতি করেছেন, তা সত্য কি মিথ্যা সে সম্পর্কে একটি বর্ণও উচ্চারণ করেন নি; কিন্তু প্রশ্ন বের্গসঁ অন্যের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন, তা কোনমতেই অপ্রয়োজনীয় নয়। তার আপন থিয়োরি মতে তিনি এক্ষেত্রে যথার্থ, কেননা সত্যকে স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ দিয়েই জানা যায়, বুদ্ধিবৃত্তি দিয়ে নয়; সুতরাং যুক্তি-প্রমাণের কেনো প্রয়োজন পড়ে না।
বের্গসঁর দর্শনের বেশিরভাগই ঐতিহ্যিক দর্শনকে একটু উন্নত ধরনের ভাষায় ব্যক্ত করা হয়েছে। পরস্পরব্যাপ্ত মতবাদ অনুসারে (The doctrine of interpenetration) বিভিন্ন বস্তু পরস্পর প্রকৃত সম্পর্কশূন্য নয় বিশ্লেষাত্মক বুদ্ধিবৃত্তি অনুসারে সে গুলোকে খণ্ডিত হিসেবে চিন্তা করা হয়, পারমেনাইডস (Pamenides) থেকে ব্রাডলে (Bradley) পর্যন্ত প্রাচী প্রতিটির সকলের তাই ধারণা। বের্গ দু’উপায়ে এ মতবাদকে মহিমামণ্ডিত করেছেন। প্রথমতঃ তিনি বস্তুর সজ্ঞা বা স্বতস্ফূর্ত আবেগের সঙ্গে প্রবৃত্তির সংযোগ সাধন করেছেন। বোলতা ডিম পাড়ার পূর্বে শুক কীটকে হত্যা না করে হুল ফুটিয়ে অবশ করে ফেলে এবং তাই হলো বোলতার ইনট্যুইশন বা স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ। (যেহেতু ড. পেকহাম এবং মিসেস পেকহাম দেখিয়েছেন যে বেচারা বোলতা বিজ্ঞানের মানুষের চাইতে তার বুদ্ধিবৃত্তিকে ভুল পথে পরিচালনা করছে না, সুতরাং দৃষ্টান্তটি ধোপে টিকে না। এজন্য তার মতবাদে আধুনিক বিজ্ঞানের প্রভাব পড়েছে এবং তাকে উদ্ভিদসম্বন্ধীয় উদাহরণ দিতে অনুপ্রাণিত করেছে, তার মতবাদ জীববিজ্ঞানসম্বন্ধীয় সর্বাধুনিক গবেষণার উপর প্রতিষ্ঠিত বলে তিনি অসতর্কভাবে চিন্তা করেছেন। দ্বিতীয়তঃ বুদ্ধিবৃত্তিক বিশ্লেষণে যেমন দেখা যায় তেমনি তিনি বস্তুর আলাদা আলাদা অস্তিত্বকে পাত্র বা বিস্তৃতি এবং কাল বা স্থায়ীত্বের ব্যাপ্ততাকে সজ্ঞা বা ইনটুইশান আখ্যায় আখ্যায়িত করেছেন। তা তাকে কাল ও পাত্র সম্পর্কে অনেক অভিনব তথ্য পেশ করতে অনুপ্রাণিত করেছে। এ শব্দগুলোর মামুলি অর্থ চিন্তা করলে সেগুলোকে খুবই যুক্তিযুক্ত এবং মৌলিক বলে মনে হয়। পাত্র অথবা বিস্তৃতির মধ্যে স্থিত যা তাকেই পদার্থ বলা যায়। আমরা সজ্ঞা বা ইনটুইশানের দৃষ্টিকোণ থেকে দৃষ্টিপাত করলে দেখতে পাব, তা হলো বুদ্ধিবৃত্তির সৃষ্ট একটি উপকথা মাত্র।
নির্বচিত শব্দগুলোকে বাদ দিলে বের্গসঁ তার দর্শনের এ অংশ প্লাটিনাসের (Plotinus) সঙ্গে নতুন কিছু সংযোজন করেন নি। নির্বাচিত শব্দসম্ভার আবিষ্কার করা নিঃসন্দেহে ক্ষমতার পরিচায়ক, কিন্তু দার্শনিকের চাইতে কোম্পানির পদোন্নতিতে ইচ্ছুক ব্যক্তিরাই সেজন্যে অধিক লালায়িত। যা তাকে ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় করেছিল, তা তার দর্শনের কোনও অংশবিশেষ নয়। তিনি তার মতবাদকে প্রাণবন্ত এবং অবশ্যম্ভাবী বলে মনে করতেন। তার শ্রেষ্ঠতম এবং উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট হলো, তিনি মরমীবাদের সঙ্গে সময়ের প্রগতির বিশ্বাসের সংশ্লেষ ঘটিয়েছেন। এতে তিনি কি পরিমাণ সাফল্যলাভ করেছেন তা আমাদের দেখা উচিত। প্রাত্যহিক মরমীবাদ ধ্যানশীলতার উপর নির্ভরশীল, যা সময়ের অনিত্যতা সম্পর্কে দৃঢ় বিশ্বাস পোষণ করে, তা নিঃসন্দেহে অলস মানুষের দর্শন বলে আখ্যা পেতে পারে। আত্মার গহণ রাত হলো মরমীবাদের উজ্জ্বল গৌরচন্দ্রিকা, যা কোন মানুষের মধ্যে তখনই উদয় হয় যখন একজন মানুষ নৈরাশ্যজনকভাবে কর্মবিমুখ হয়ে পড়ে অথবা আকস্মিকভাবে বাস্তবকর্মের প্রতি আকর্ষণ হারিয়ে বসে। কর্মচাঞ্চল্য দ্বারা চালিত হলে কোন ধ্যানের দরকার পড়ে না। আমাদের সাধারণ নিয়ম হলো, সম্ভব হলে আমরা সে সকল বিশ্বাসকে আঁকড়ে থাকি যা আমাদের আত্মসম্মানকে অক্ষণ রাখে। মনঃসমীক্ষা সাহিত্য এ ধরনের উদ্ভট দৃষ্টান্তে ভরপুর। যে ব্যক্তি ধ্যানে আত্মনিয়োগ করেছে আপাততঃ তাদের চোখে ধ্যানই জীবনের সত্যিকার পরিণতি এবং যারা জাগতিক ক্রিয়াকর্মে লিপ্ত থাকে তাদের দৃষ্টিকোণ সত্যিকার জগতের ছবি উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে না। এই ভিত্তিতে ঐতিহ্যিক মরমীবাদের বাকি মতবাদসমূহ সম্বন্ধে স্থির সিদ্ধান্তে আসা যায়। শ্রেষ্ঠ মরমীদের মধ্যে বোধহয় লাওসে প্রথম, যিনি কাস্টম হাউজে তার মালপত্র পরীক্ষার জন্য অপেক্ষা করার সময় বই লিখে ফেলেছিলেন। যেমনটি প্রত্যাশিত ছিল তার বইয়ের সর্বত্র-কর্ম যে কিছু নয়, সে মতবাদে ভরপুর।
কিন্তু বের্গসঁ মরমীবাদকে কর্ম এবং জীবন বিশ্বাসীদের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে চেষ্টা করেছিলেন, যারা বাস্তবতার প্রগতিতে বিশ্বাসী কোন ক্রমেই ধরাপৃষ্ঠে তাদের অস্তিত্ব সম্পর্কে নিস্পৃহ ধারণা পোষণ করতে পারে না। মরমীরা হচ্ছে প্রবৃত্তিগতভাবে নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে ডুবে যাওয়া সক্রিয় মানুষ আর প্রাণবাদীরা হচ্ছে কর্মের প্রতি রোমান্টিক প্রশংসা পোষণকারী নিষ্ক্রিয় মানুষ। ১৯১৪ সনের আগে পৃথিবী এরকম মানুষে পরিপূর্ণ ছিল। তাদের প্রবৃত্তির ভিত্তিস্থল ছিল বিতর্কিত এবং সংশয়বাদ ভালোবাসার উত্তেজনা এবং অযৌক্তিক একটি ধর্মের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করত, তারা মনে করত তাদের কর্তব্য হলো মানুষকে মানুষ হত্যা করার জন্য অনুপ্রাণিত করা এবং তাদের এ লালিত বিশ্বাসের ক্ষেত্রভূমিতেই সে ধর্মের সন্ধান পেয়েছিল। ১৯০৭ সালে তাদের কোন নির্গমণ পথ ছিল না, কিন্তু বের্গ একটি উত্তম বিকল্পের ব্যবস্থা করেছিলেন।
বের্গসঁর মতবাদ মাঝে মাঝে এমন ভাষায় ব্যক্ত করা হয়েছে যা ভুলপথে নিয়ে। যেতে পারে, তার কারণ হলো, যে সকল জিনিসকে তিনি কাল্পনিক মনে করেছেন তা অনেক সময় বাস্তবের মতো মনে হবে। তার মতামতের ভুল বোঝাবুঝির সম্ভাবনা এড়িয়ে যেতে পারলে সময় সম্পর্কে তার মতামত নিম্নরূপঃ ধারাবাহিকভাবে কতকগুলো মুহূর্ত অথবা ঘটনার সমাহার নয়, সময় নিরবচ্ছিন্নভাবে প্রসারমান, যার মধ্যে ভবিষ্যৎকে পূর্বাহ্নে দেখা যায় না; কেননা তা সম্পূর্ণভাবে নতুন এবং অকল্পনীয়। যা কিছু সত্যিকারভাবে ঘটে থাকে তার সমস্ত কিছু গাছের কাণ্ডের প্রত্যেকটি বলয়চিহ্নের মতো রক্ষিত থাকে। (এটা তার বাড়িয়ে বলা নয়। সুতরাং পৃথিবী চিরাচরিত ভাবে পূর্ণতা এবং সমৃদ্ধির পানে এগিয়ে যাচ্ছে। সমাজের অবাস্তব স্মৃতির তুলনায় যা কিছু বাস্তব জীবনে ঘটে থাকে প্রকৃত সজ্ঞা বা ইনটুইশনের দর্পণে বর্তমান তাকে। অপরিবর্তনশীলতা হলো ব্যাপ্তি এবং নতুন কিছু করার উত্তেজনাকে বলা হয় প্রাণশক্তি-সজ্ঞা যা ইনটুইশনের সত্যিকারের স্মৃতির অন্বেষণ করা আত্মশৃঙ্খলার ব্যাপার; তা কিভাবে করা হবে, তা তিনি আমাদেরকে বলে দেননি। যোগীরা যে পদ্ধতিতে তা করে থাকেন, তিনি ওরকম কোন পদ্ধতির কথা বলে থাকবেন, এরকম সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে।
যদি কেউ ন্যায়শাস্ত্রের মতো সামাজিক বিষয়ে বের্গসঁর দর্শনকে প্রয়োগ করার দুঃসাহস করে তাহলে পরিবর্তিত দর্শনের মধ্যে কতিপয় অসুবিধা দেখা যাবে। সময়কে ধারাবাহিক অনুক্রম এবং বিভিন্ন অংশকে বাহ্যিক বলে বিবেচনা করার জন্যে বের্গসঁ অঙ্কবিদদের অক্লান্তভাবে তিরষ্কার করেছেন। আদতে যদি পৃথিবীতে সত্যিকার মহত্ত্ব বলতে যেমন তিনি বলেছেন তেমন কিছু থাকে (যে দিকটি ছাড়া তার দর্শন আকর্ষণীয় গুণপনা থেকে বঞ্চিত হয়ে পড়বে। পৃথিবীতে যা আসে স্থায়ী হয়। (যা তার ব্যপ্তিবাদ দর্শনের সরল তাৎপর্য) তাহলে অতীতের যে কোন অস্তিত্বের যোগফল পরবর্তীকালের যে কোন যোগফলের সমান হবে। সম্পূর্ণ এবং অংশবিশেষের সম্বন্ধ অনুপাতে বিভিন্ন যুগে পৃথিবীর সমূহ অবস্থার মধ্যে এ গুণের অনুক্রম প্রকাশিত এবং এই অনুক্রমের মধ্যে অংকবিদেরা আকাক্ষিত গুণসমূহ খুঁজে পান। কিন্তু বের্গসঁ সেগুলোকে নির্বাসনে পাঠাতে চান। পৃথিবীর পরবর্তী অবস্থার যে সকল উপাদান সংযোজিত হয়েছে, তা যদি প্রাচীন উপাদানের বাহ্যিক সংযোজন না হয়, তাহলে বলতে হয় সত্যিকারের কোন মহত্ব নেই, সৃষ্টিশীল বিবর্তন কিছুই সৃষ্টি করে নি এবং আমরা আবার প্লাটিনাসের পদ্ধতিতে ফিরে এসেছি। অবশ্য এ দ্বিমূখী সমস্যার বের্গসঁ উত্তর দিয়েছেন যে জন্মের ফলে সবকিছুতে পরিবর্তন আসে কিন্তু তারপরেও তা একই রকম থেকে যায়। সে যা হোক, তার এ ধারণা বড় রহস্যময়; তা ভেদ করা বিধিনিন্দুক মানুষের পক্ষে সম্ভব নয়। মূলত বের্গর্সর আবেদন মরমি ধর্মে, যুক্তিতে নয়, কিন্তু যেখানে তার ধর্ম যুক্তির দিগন্তের বাইরে সেখানে আমরা তাকে অনুসরণ করতে পারিনে।
ইতিমধ্যে বিভিন্ন দিক দিয়ে একটি দর্শন গড়ে উঠেছে, যাকে অনেক সময় বস্তুবাদ বলে অবিহিত করা হয়েছে, কিন্তু আদতে তা বহুত্ববাদ পদ্ধতি বিশ্লেষণের মাধ্যমে আলাদা দর্শন হিসেবে বিশেষিত করা হয়েছে। কোনক্রমেই তা বস্তুবাদী দর্শন নয়, বরঞ্চ কোন কোন অংশে বার্কলের আদর্শবাদের সঙ্গে তার মিল বর্তমান। যে যুক্তিতর্কের উপর কান্ট এবং হেগেলের দর্শন প্রতিষ্ঠিত, সেগুলোকে অস্বীকার করে গেলে কান্টিয় এবং হেগেলিয় মতবাদের সঙ্গেও তার কোন মিল নেই। পৃথিবীর মৌলিক উপাদান মানসিক এবং বস্তুগত দু’টোর কোনটাই নয়, বরঞ্চ এমন কিছু, যা অধিকতর মৌলিক এবং সরল, যার থেকে মন এবং পদার্থ দুটোই গঠিত হয়েছে, জেমসের এ মতবাদ গ্রহণ এবং এর বিকাশের দিকে উত্তরোত্তর অধিকভাবে সে দর্শন ঝুঁকে পড়েছে।
১৮৯০ সালে খুব প্রাচীনেরা ছাড়া জার্মান আদর্শবাদের বিরুদ্ধে যারা দাঁড়িয়েছিলেন, তার মধ্যে জেমস ছিলেন বলতে গেলে একমাত্র খ্যাতিমান পুরুষ। ডিউয়ি এবং শিলার তখনো গভীরভাবে অনুভব করেন নি, এমনকি জেমসকেও একজন মনস্তত্ববিদ বলে ধরা হতো। দর্শনের ক্ষেত্রে তার আবেদনের কথা কেউ গুরুত্ব সহকারে চিন্তাও করেননি। ১৯৭০ সালে প্রয়োগবাদের দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরঞ্চ কড়াকড়িভাবে বাস্তবদৃষ্টিভঙ্গি থেকে জার্মান আদর্শবাদের বিরুদ্ধে একটি বিদ্রোহ সংগঠিত হয়। জার্মানিতে, Frege-এর রচনাবলী (যা শুরু হয় ১৮৭৯ সালে, কিন্তু সাম্প্রতিক কালে ছাড়া পঠিত হয় নি, Husser এর উল্লেখযোগ্য রচনা Logische Unter Such ungen ১৯০০ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত হওয়ার পর ব্যাপকভাবে প্রভাব বিস্তার করে। Meinong এর Ueber Annahmen ১৯০২ সালে Gogen Stands theoric এবং Psychologic ১৯০২ সালে প্রকাশিত হয় এবং একই দিকে বিশেষ প্রভাবশালী ছিল। ইংল্যাণ্ডে G. E Moore এবং আমি এ মতবাদের সমর্থনে ওকালতি করতে শুরু করি। তার প্রবন্ধ The nature of judgement ১৮৯৯ সালে Principia Ethica ১৯০৩ সালে ও আমার Principles of Mathematics ১৯০৩ সালে ফরাসিদেশে Conturat একই ধরনের দর্শন প্রবলভাবে প্রধান্য বিস্তার করে। আমেরিকাতে উইলিয়াম জেমসের Redical Empricism (তার প্রয়োগবাদকে বাদ দিয়ে) নতুন ন্যায়শাস্ত্রের সঙ্গে সংমিশ্রণে কিছু পরবর্তী সময়ে সম্পূর্ন ভিন্ন একটি নতুন দর্শনের জন্ম দেয়। উপরে যে সব ইউরোপিয় দর্শনগ্রন্থের কথা বলা হলো ওগুলোর তুলনায় আরো বেশি বিদ্রোহ ছিল এ নব-বস্তুবাদ। যদিও Mach এর Analyseder Emfindungen-এর অংশবিশেষের শিক্ষাকে জোরদার করেছিল।
যে নতুন দর্শনের সূচনা হলো এখনো কোন চূড়ান্ত রূপ পরিগ্রহ করে নি এবং কোন অংশে এখনো অপরিপক্ক রয়ে গেছে। তাছাড়াও বিভিন্ন সমর্থকের মতামতের মধ্যে প্রচণ্ড পার্থক্য রয়ে গেছে। তার আবার কোন অংশে দুর্বোধ্য। এ সকল কারণে কতকগুলো প্রয়োজনীয় বৈশিষ্ট্যকে তুলে ধরা ছাড়া এ সম্পর্কে আর কিছু বলা একরূপ অসম্ভব।
নতুন দর্শনের প্রথম বৈশিষ্ট্য হলো কোন কোন বিশেষ দার্শনিক পদ্ধতি এবং দর্শনকে বিশেষ কোন মার্কামারা জ্ঞান অর্জনের উপায় বলে স্বীকার করে না। নতুন মতবাদ বিশেষ বিজ্ঞানে সমস্যার সাধারণীকরণের পার্থক্য এবং অভিজ্ঞতালব্ধ প্রমাণ যেখানেই নেই, সেখানে অনুমান করা ছাড়া আর সকল ব্যাপারেও দর্শনকে বিজ্ঞানের সঙ্গে এক করে দেখে। এ দর্শন মতে সব রকমের জ্ঞান বিজ্ঞানভিত্তিক, বিজ্ঞানসম্মত উপায়ে অর্জন এবং প্রমাণ করতে হয়। পূর্ববর্তী দর্শনের বেলায় যেমন ব্রহ্মাণ্ডকে দেখা এবং ধারণাতে প্রতিভাস রচনার পদ্ধতি প্রচলিত ছিল, নতুন দর্শনের তা অচল হয়ে দাঁড়াল। নিজস্ব ন্যায়শাস্ত্রের মতে পৃথিবীর যে আপাতঃ বিখণ্ডিত এবং বিশৃঙ্খল প্রকৃতি বর্তমান তা অস্বীকার করার কোনও কারন নেই। ধ্বংসপ্রাপ্ত দৈত্যের বিশেষ হাড় থেকে যেমন কঙ্কাল সম্পর্কে ধারণা করা যায়, তেমনি পৃথিবীকে কোন বিশেষ অনুষঙ্গ থেকে ভালোভাবে জানার এত আঙ্গিক বিশিষ্ট্য কোন কিছু মনে করে না। জার্মান আদর্শবাদের যেমন লব্ধজ্ঞানের প্রকৃতি থেকে বিশ্বের প্রকৃতি সম্বন্ধে একক ধারণা পোষণ করা হতো, এ দর্শনে তেমন কোন বিশেষ প্রচেষ্টায় মনে করে, তার কোন মরমি তাৎপর্য এবং মহাজাগতিক গুরুত্ব নেই।
জ্ঞানতত্ব, ন্যায়শাস্ত্র এবং অঙ্কের নিয়মনীতি হলো নতুন দর্শনের তিনটি প্রধান মৌলিক উৎস। কান্টের সময় থেকে জ্ঞানকে অভ্যন্তরীণ ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়ার পারস্পরিক ধারণা বলে মনে করা হতো। সে অনুসারে জ্ঞাত বস্তুকে আমাদের সে বিষয়ে জ্ঞান দ্বারা শোধিত করে নেয়া হয়, যা সকল অবস্থাতেই আমাদের জ্ঞানের কারণে নতুন বৈশিষ্ট্যে মণ্ডিত হয়ে দেখা দেয়। জানা না হলে কোন বস্তুর অবস্থিতি ন্যায়শাস্ত্রানুসারে অসম্ভব, তাও বিশ্বাস করা হতো। (যদিও কান্ট তা করেন নি। সুতরাং যথাযথ জানার পরে যে গুণগুলো আবিষ্কার করা গেলো, প্রত্যেক ব্যাপারে সেগুলোর উপস্থিতি অবশ্যম্ভাবী। পক্ষান্তরে নতুন দর্শন জানা বস্তু এবং কোন মনের অগোচর কোনো বস্তুর অবস্থিতির কি সামান্য কারণ থাকতে পারে, সে সম্বন্ধে কোন পার্থক্য করে না। ফলতঃ জ্ঞানতত্ব বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের রহস্য দ্বারা উদঘাটন করার যাদুকরি চাবিকাঠি থেকে যায় এবং আমাদেরকে বিজ্ঞানের শ্রমসাপেক্ষ অনুসন্ধানের জগতে নিক্ষেপ করা হয়েছে।
একইভাবে ন্যায়শাস্ত্রে আঙ্গিক মতবাদের স্থলে পরমাণুবাদকে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কোন বিষয়ের সঙ্গে কোন বিষয়ের সম্বন্ধের ফলে তার অভ্যন্তরীণ প্রকৃতিতে পরিবর্তন আসে, সে কারণে ভাবা হতো কোন বিষয়ে পুঙ্খানুপুঙ্খ জ্ঞান থাকলে সমগ্র বিশ্ব সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খ জ্ঞান অর্জন করা যায়। নতুন দর্শন অনুসারে কোন বস্তু সম্পর্কে প্রাজ্ঞ ধারণা ন্যায়শাস্ত্রমতে সে বস্তুর সঙ্গে অন্য বস্তুর সম্বন্ধ নিরূপন করতে আমাদের অনুপ্রাণিত করে না। একটি দৃষ্টান্ত দিলে বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বোঝা যাবে। লাইবনিজ Leibnitz মনে করতেন (এ ব্যাপারে তিনি আধুনিক আদর্শবাদীদের সঙ্গে একমত) কোনো লোক ইউরোপে থাকলে এবং ভারতে তার স্ত্রীর মৃত্যু হলে স্ত্রীর মৃত্যুর মুহূর্তে তার মধ্যে অভ্যন্তরীণ প্রতিক্রিয়ার সঞ্চার হবে। সাধারণ জ্ঞান বলে যে মৃত্যুর সংবাদ না শোনা পর্যন্ত তার মধ্যে কোন গভীরতর পরিবর্তন অসম্ভব। নতুন দর্শনে এই মতবাদকে গ্রহণ করা হয়েছে এবং এর ফলাফল প্রথমে যা মনে হয়েছিল তার চেয়ে অনেক সুদূরপ্রসারী।
অঙ্কের মৌলনীতির সঙ্গে সবসময়ে দর্শনের একটা গুরুত্বপূর্ণ সম্বন্ধ রয়েছে। অঙ্ক দৃশ্যতঃ অধিক পরিমাণে পূর্ববর্তী নিশ্চিত জ্ঞান পরিবেশন করে এবং অধিকসংখ্যক দর্শনে পূর্ববর্তী জ্ঞানের প্রাধান্য বর্তমান। জেনোর (Zeno) সময় থেকে একটি আদর্শবাদী সম্প্রদায়ের দার্শনিকেরা, অঙ্ক সত্যিকার দার্শনিক উপনিত হতে সমর্থ এবং দার্শনিকেরা অধিকতর সুস্থ জ্ঞান পরিবেশন করতে পেরেছে বলে মনে করত। এর মধ্যে কান্টের দর্শন অনেক পরিমাণে এবং হেগেলের দর্শন আরো বেশি পরিমাণে প্রতিফলিত হয়েছে। উনবিংশ শতাব্দীতে অঙ্কবিদেরা কান্টের দর্শনের এ অংশকে সম্পূর্ণভাবে নাকচ করে ফেলেন। লোবাত চেভস্কি (Lavat Chvoski) নন ইউক্লিডিয়া জ্যামিতির আবিষ্কার করে কান্টের অঙ্কভিত্তিক যুক্তির লোকোত্তর সৌন্দর্যতত্ত্বের প্রাধান্য খর্ব করে ফেলেন। ওয়েবার স্ট্রস (Wabre strass) প্রমাণ করলেন অতি ক্ষুদ্রতম রাশির মধ্যে নিরবচ্ছিন্ন প্রসারমানতা অনুপস্থিত। জর্জ কেন্টোর একটি প্রসারমানতা এবং একটি অসীমতার থিয়োরি আবিষ্কার করে প্রাচীন আপাতঃবিরোধী সত্য, যেগুলোর উপর দার্শনিকেরা পরস্পর বিতর্কে প্রবৃত্ত হয়েছিলেন, তা সমাধান করে ফেলেন! ফ্রেজ (frege) দেখালেন যে পাটিগণিত ন্যায়শাস্ত্রকেই অনুসরণ করে, কিন্তু কান্ট তা অস্বীকার করেছেন। সাধারণ আঙ্কিক পদ্ধতিতে এ ফলসমূহ অর্জিত হয়েছে এবং গুণের টেবিলে করলে যেমন হতো তেমনি নিখুঁত এবং নির্ভুল। গ্রন্থাকারদের লেখা পড়ে দার্শনিকেরা এ পরিস্থিতির সম্মুখীন হননি। নতুন দর্শন শুধু নতুন ফলশ্রুতির সমন্বয় সাধন করে ধারাবাহিক অজ্ঞতার ধারক বাহকদের উপর সহজ বিজয় অর্জন করতে সমর্থ হয়েছে।
নতুন দর্শন শুধু সমালোচনামূলক নয়, বিজ্ঞান যেমন পুঙ্খানুপুঙ্খ পরীক্ষা মূলকভাবে গঠনমূলক, এও তেমনি গঠনমূলক। আঙ্কিক ন্যায়শাস্ত্র নামে এর একটা আলাদা গঠনপদ্ধতি রয়েছে, যা অন্যান্য ঐতিহ্যিক শাখার চাইতে অধিকতর দর্শনেরই সমগোত্রীয়। কোন বৈজ্ঞানিক মতবাদের দার্শনিক প্রতিক্রিয়া কি, আগে তা নিরূপন করা সম্ভব ছিল না। তাদের মধ্যে বাস্তব ভিত্তি কি এবং সম্পর্ক কি তার নির্ধারণ আঙ্কিক ন্যায়শাস্ত্র সম্ভব করে তুলেছে। এই পদ্ধতির সাহায্যে পদার্থবিদ্যা এবং অঙ্কবিদ্যার দর্শনের প্রচুর অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ডক্টর হোয়াইটহেড তার সাম্প্রতিক তিনটি গ্রন্থে পদার্থবিদ্যার ক্ষেত্রে যে পরিবর্তন ঘটেছে তা পেশ করেছেন। অন্যন্য বিষয়েও পদ্ধতি যে সমানভাবে ফলপ্রসু প্রমাণিত হবে তা বিশ্বাস করার কোন সঙ্গত কারণ নেই, এবং তা অত্যন্ত ঘঘারালো প্যাচালো বলে এখানে উদ্ধৃত করা গেল না।
অনেক আধুনিক বহুবাদী দার্শনিক বক্তব্যের ন্যায়শাস্ত্রীয় বিশ্লেষণের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েছেন। প্রথমে এ পদ্ধতি অত্যন্ত শ্রদ্ধাসহকারে ব্যাকরণে প্রয়োগ করা হয়েছিল। মেনং (Meinong) দৃষ্টান্ত দিয়ে বলেছেন, যখন আমরা গোলাকার এবং বর্গাকার কোনকিছু একথা বলতে পারি সহজে তখন অস্তিত্বহীন হলেও গোলাকার এবং বর্গাকার কোনকিছু সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে আমরা ধরণা পোষণ করি। বর্তমান প্রবন্ধের লেখকও এ ধরণের ধারণা পোষণ করা থেকে মুক্ত ছিলেন না, কিন্তু ১৯০৫ সালে বর্ণনাতত্ত্বের সাহায্যে কিভাবে সে ধরণার নিরসন ঘটাতে হয় তা আবিষ্কার করে। গোলাকার এবং বর্গাকার কোন কিছুকে নির্দেশ করা হয় না। একইসঙ্গে গোলাকার বর্গাকার কোন হাস্যকর বস্তুতে সময় নষ্ট করা উদ্ভট ঠেকে কিন্তু এরকম বিষয়সমূহ অনেক সময় ন্যায়শাস্ত্রের পরীক্ষার পরও টিকে থাকে। অধিকাংশ ন্যায়শাস্ত্রীয় তত্ত্বের নিন্দা করা হয়; কারণ সেগুলো অস্পষ্টতার দিকে টেনে নিয়ে যায় সুতরাং নৈয়ায়িকদের অস্পষ্টতা সম্বন্ধে সজাগ এবং নিরসনের উপায় সম্বন্ধে হুঁশিয়ার হতে হবে। যাদের প্রাসঙ্গিক জ্ঞান নেই তাদের কাছে গবেষণাগারে পরীক্ষালব্ধ ফলকেও তুচ্ছ মনে হবে এবং অস্পষ্টতা হলো নৈয়ায়িকদের জন্য হাতে-কলমে পরীক্ষা নিরীক্ষা বিশেষ।
বক্তব্যের নৈয়ায়িক বিশ্লেষণের পূর্ববর্তী প্রভাবের দরুন সর্বপ্রথম নতুন দর্শনে নিষ্কাম দর্শন এবং মধ্যযুগীয় বস্তুবাদের জোরাল একটি সংমিশ্রণ ঘটেছিল যা বাস্ত বের মতো বিমূর্ত সবকিছুর অস্তিত্বেও বিশ্বাস করত। এই ভঙ্গি থেকে ন্যায়শাস্ত্র অধিকতর পরিপূর্ণতা লাভ করে এবং অধিকতর স্বাধীন হয়ে পড়ে। বাকি যা থাকে তা আমাদের সাধারণজ্ঞানকে মুছাহত করার এত মারাত্মক তেমন কিছু নয়।
যদিও শুরুতে নতুন দর্শনের সঙ্গে অন্য যে কোন বিজ্ঞানের চাইতে বিশুদ্ধ গণিতের সম্বন্ধ ছিল অনেক বেশি, তবু বর্তমানে এতে পদার্থবিজ্ঞানের প্রভাবই অধিক। তা হয়েছে আইনস্টাইনের কর্মের মাধ্যমে। যা স্থান কাল এবং পাত্রের ধারণার মৌলিক পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে। আপেক্ষিক তত্ব বিশ্লেষণ করবার স্থান এ নয়, কিন্তু এর কতিপয় দার্শনিক ফলাফল এড়িয়ে যাওয়া অসম্ভব। দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে দু’টো বিশেষ আপেক্ষিকবাদ তত্বে দুরকমের বিশেষ উপাদান বর্তমান (১) সর্বব্যাপ্ত এবং সবকিছু ধারণক্ষম এমন কোন কাল নেই যার মধ্যে ব্রহ্মাণ্ডের সকল ঘটনার স্থান সংকুলান হতে পারে। (২) প্রাকৃতিক বস্তুকে পর্যবেক্ষণ করার সনাতন অথবা আত্মগত ক্ষমতা আগে যেমন কল্পনা করা হতো, যদিও তার চেয়ে অনেক ব্যাপক এবং টেনসর ক্যালকুলাস (Tensor Calculas) নামে একজাতীয় আঙিক পদ্ধতিতে তা দেখানো যেতে পারে। আমি পরবর্তী বিষয় সম্পর্কে কিছু বলতে চাইনে, কারণ তা অসহনীয়ভাবে দুর্বোধ্য এবং বিষয়াগত।
গবেষণালব্ধ ফলাফলের প্রয়োজনে গাণিতিক ফর্মূলানির্ভর একটি থিয়োরির মাধ্যমেই সময়কে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে, প্রাথমিকভাবে দর্শনের দূরবীক্ষণের ওপর নির্ভর করলে আমাদের চলবে না। মন্টেসকুর (Montesquieur) থিয়োরি এবং আমেরিকার সংবিধানের মধ্যে যে পার্থক্য এ দুয়ের পার্থক্যও তেমনি। দৃষ্টিতে যা পড়ে তা হলো, কোন নির্দিষ্ট পদার্থে যখন কোন ঘটনা ঘটে তখন যে দর্শক তার গতিতে অংশগ্রহণ করে তার দৃষ্টিভঙ্গীতে একটি নির্দিষ্ট সময় সঙ্গতি ধরা পড়ে। কিন্তু বিভিন্ন পদার্থের বিভিন্নস্থানে যে ঘটনা ঘটে সকল অবস্থার সময় সঙ্গতি মেনে চলে না। সংক্ষেপে বলতে গেলে পৃথিবী থেকে সূর্যে আলোক সঙ্কেত প্রেরণ করে আবার যদি পৃথিবীতে ফেরত আনতে হয়, তা হলে তা প্রেরণ করার প্রায় ষোল মিনিট পরে ফিরে আসবে। এই ষোল মিনিট সময়ের মধ্যে পৃথিবীতে যে সকল ঘটনা ঘটবে তা আলোক সঙ্কেত ফিরে আসার পরে বা পূর্বে ঘটবেনা। আমরা যদি কল্পনা করি পর্যবেক্ষকেরা সূর্য এবং পৃথিবীর সকল সম্ভাব্য দিকে ঘুরে ঘুরে ঐ ষোল মিনিটে পৃথিবীর যাবতীয় ঘটনা এবং সূর্যের থেকে প্রত্যাগত আলোক সঙ্কেতের দিকে লক্ষ্য করছে, এবং আমরা যদি ধরে নেই যে আলোর গতিবেগ সম্পর্কে হিসেবে রাখার জন্য নিখুঁত ক্রনোমিটার যন্ত্র ব্যবহার করতে দেয়া হলো তাহলে কোন কোন পর্যবেক্ষক ঐ ষোল মিনিটের মধ্যে পৃথিবীর কোন ঘটনাকে সূর্যপ্রত্যাগত আলোকসঙ্কেতের পূর্ববর্তী, কেউ একই সময়ে এবং কেউ পরে ঘটেছে বলে বিচার করবে। তারা সকলেই সমানভাবে সত্য অথবা সমানভাবে মিথ্যা। কিন্তু পদার্থবিজ্ঞানের নের্ব্যক্তিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করলে পৃথিবীর ঘটনা সূর্য থেকে আলোক সঙ্কেত নিয়ে আসার আগে পরে, কিংবা এক সময়েও ঘটেনি। ঘটনা কোন পদার্থের আগে ঘটল এবং যে ঘটনা অন্য কোন পদার্থে পরে ঘটল যদি ক থেকে খ তে আলোক সঞ্চালিত হতে না পারে তা হলে আমরা বলতে পারবো না ক এর ঘটনা (ক এর সময়ক্রম অনুসারে) পূর্বে ঘটেছে খ এর ঘটনা ক এর ঘটনার প্রতিক্রিয়ার ফলে (খ এর সময়ক্রম অনুসারে) পরে ঘটেছে। তা না হলে দুটো ঘটনার প্রতিনিধিত্ব করতে পারবেনা।
আমরা আলো সম্পর্কে যে মামুলি ধারণা পোষণ করি গতি যদি তার সঙ্গে তুলনীয় হতো তাহলে বস্তুবিশ্বকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে বিচার করা অসম্ভব হয়ে দাঁড়াত এবং আজকের যুগ পর্যন্ত আমাদের প্রারম্ভিক যুগের চিকিৎসকদের নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হতো! পদার্থ বিদ্যার কিছু আবিষ্কার হয়েছে একথা বললে আইনস্টাইনের নাম না করে উপায় নেই, কেননা তার আবিষ্কার ব্যতিরেকে নিউটনিয় পদার্থবিদ্যা অফলিত থেকে যেত। তেজস্ক্রিয় পদার্থের যে কণিকাসমূহ বিচ্ছুরিত হয় তার গতিবেগ প্রায়ই আলোর গতিবেগের সমান এবং এ কণিকাসমূহের প্রকৃতি পদার্থ বিদ্যার নতুন আপেক্ষিক গুরুত্বের সাহায্য ছাড়া বোধগম্য হয়ে উঠে না। পুরনো পদার্থবিদ্যা যে প্রমাদপূর্ণ তাতে কোন সন্দেহ নেই এবং দর্শনের দৃষ্টিকোণ থেকে দোষ অল্প বলাটা কোন একটা কৈফিয়ত নয়। আমাদের মনকে কিছু অংশে এ বিশ্বাসে তৈরি করে নিতে হবে যে, বিভিন্নস্থানে যে বিভিন্ন ঘটনা ঘটে তার মধ্যে নির্দিষ্ট কোন সময় সঙ্গতি নেই। এই একটি কারণে কাল এবং পাত্র দু’টো আলাদা বহুবিন্যাসের বদলে কালপাত্র একটি বহুবিন্যাসের (Multifold) প্রবর্তন করা হয়েছে। যে সময়কে আমরা মহাজাগতিক মনে করি আদতে তা লোক্যাল টাইম বা স্থানীয় সময় যা পৃথিবীর সঙ্গে আটলান্টিক পাড়ি দেয়া জাহাজ যেমন ঘড়ি বদলায় না তেমনি একান্তভাবেই সম্পৃক্ত।
আমাদের স্বাভাবিক ধারণাতে সময়ের ভূমিকাই সকল কিছু বলে যখন আমরা বিবেচনা করি, আমরা কাল্পনিকভাবে হলেও পদার্থবিদেরা যা করেছে, তা বুঝতে পারি যদি, তাহলে আমাদের দৃষ্টিভঙ্গীতে যে আমূল পরিবর্তন আসবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। প্রগতির ধারণার কথাই বলা যাক না, যদি সময়সঙ্গতি কোন নিয়ম মেনে না চলে তাহলে সময়কে মাপার যে পদ্ধতি অবলম্বিত হবে সে অনুসারে প্রগতি অথবা প্রতীপগতি নির্ধারিত হবে। যদি দু’জন পর্যবেক্ষক দু’স্থান থেকে একটি নির্দিষ্ট স্থানের দূরত্ব নিখুঁতভাবে নির্ণয় করার জন্য সম্ভাব্য সকল উপায় অবলম্বন করে থাকে এবং তাদের গতি আপেক্ষিকভাবে দ্রুত হয়, তাহলে পর্যবেক্ষকরা দূরত্ব সম্পর্কে আলাদা আলাদা সিদ্ধান্তে উপনীত হবে, এভাবে দূরত্বের ব্যাপ্তির ধারণারও তারতম্য ঘটে। দূরত্ব নিশ্চিতভাবে বাস্তব পদার্থের মধ্যবর্তী শূন্যের মধ্যে নয় বলে দূরত্বের ধারণাও ঝাপসা হয় এবং তা পরিষ্কার বোঝা যায়। দূরত্বটা কোন বিশেষ সময়ের কেননা দুটি পদার্থের মধ্যে ক্রমাগত দূরত্বের পরিবর্তন ঘটেছে এবং নির্দিষ্ট সময় হলো আত্মগত ধারণা, পর্যবেক্ষক যে পথে প্রথম ভ্রমণ করেছে তার উপর নির্ভরশীল।
আমরা কোন নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে অনেকগুলো ঘটনার সমাহারের কথা বলতে পারিনে, আমাদেরকে শুধু একটি মাত্র ঘটনা সম্পর্কে বলতে হবে। এই বিরতিকে একজন পর্যবেক্ষকের পর্যবেক্ষণ থেকে সম্পূর্ণভাবে মুক্ত দুটো ঘটনার পরস্পরের মধ্যবর্তী কিছুটা সম্বন্ধ রয়েছে, যাকে বিরতি বলা যেতে পারে। পর্যবেক্ষক বিভিন্নভাবে নির্দিষ্ট সময় এবং সাময়িক গঠনের নিরিখে ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করবে কিন্তু বিশ্লেষণের নিরপেক্ষ মূল্যমানের দাবীদার নয়। বিরতি হলো নিরপেক্ষ বাস্তব ঘটনা কিন্তু তাকে বিভিন্ন উপাদানে খণ্ডিত করলে নিরপেক্ষ বজায় থাকে না।
এটা স্পষ্ট যে, আমাদের নিরেট পদার্থ সম্পর্কে আনন্দিত ধারণা টিকতে পারে না। একখণ্ড পদার্থ নির্দিষ্ট কতেক নিয়মানুসারে সংঘটিত ঘটনা পরম্পরা ছাড়া আর কিছু নয়। পদার্থ সম্পর্কে ধারণা তখনই জাগলো যখন দার্শনিকদের ‘বস্তুর ধারণা সম্বন্ধে কোন সন্দেহ ছিল না! কাল এবং পাত্রের ব্যাপ্তিতে পদার্থ পদার্থসার এবং শুধু কালের ব্যাপ্তিতে মন বস্তুর সারভাগ রূপে বর্তমান ছিল। দিন গত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দর্শনে এই সারভাগের ধারণা ক্রমে ঝাপসা হয়ে আসে কিন্তু আপেক্ষিকতত্ত্ব আবিষ্কার না হওয়া পর্যন্ত পদার্থবিজ্ঞনে তা ক্ষতিজনক নয় বৃলে টিকে রইল। বস্তুসারের যে ঐতিহ্যিক ধারণা তা দুরকমের উপাদানে গঠিত হয়েছে। প্রথমতঃ বস্তুসারের ন্যায়শাস্ত্রীয় গুণ অনুসারে কোন প্রতিজ্ঞার কর্তা হিসেবে আসতে পারে, কিন্তু কর্ম হিসেবে নয়। দ্বিতীয়তঃ তা এমন কিছু যা বহুকাল আগে থেকে বর্তমান অথবা ভগবানের ক্ষেত্রে সময়েরও অতীত। এ দুরকমের গুনের মধ্যে কোন প্রয়োজনীয় সম্বন্ধ নেই এবং তা ধারণাও করা হয়নি। কারণ পদার্থবিদ্যা শিক্ষা দিয়েছে প্রত্যেক খণ্ড পদার্থের মৃত্যু নেই, কিন্তু ধর্মতত্ত্ব শিক্ষা দিয়েছে আত্মার মৃত্যু নেই। সুতরাং উভয় ধারণাতেই সারভাগের বৈশিষ্ট্য বিরাজিত, সে যা হোক বর্তমানে পদার্থবিজ্ঞান আমাদের ভাবতে বাধ্য করে যে নৈয়ায়িক অর্থে সারবস্তু হলো ক্রমবিলীয়মান ঘটনা। তার মানে সেগুলোকে কর্তা হিসেবে ব্যবহার করা যায় কিন্তু কর্ম হিসেবে নয়। একখণ্ড পদার্থকে আমরা একটি সত্তা বলে মনে করলেও তা ছায়াছবিতে স্থায়ী লক্ষ্যের মতো অনেকগুলো সত্তার মাখামাখির সৃষ্টি ছাড়া আর কিছু নয়।মনের সম্পর্কেও একই কথা কেনো বলবোনা আমরা, তার কোন সঙ্গত কারণ নেই। স্থায়ী অহং-এর ধারণা অণুর মতই অলীক। কিন্তু দুটোর মধ্যে শুধু কতকগুলো কৌতূহলোদ্দীপক সম্বন্ধের জট বর্তমান।
আধুনিক পদার্থবিদ্যা ম্যাক (Mach) এবং জেমস (James) এর পরামর্শমতে আমাদের ভাবতে অনুপ্রাণিত করল যে পদার্থজগৎ এবং মানসিকজগৎ একই উপাদানে গঠিত। নিরেট পদার্থ স্পষ্টতঃ ধারনা এবং স্থায়ী অহং থেকে ভিন্নতর ছিল। কিন্তু যদি পদার্থ এবং অহং দুটোর পরস্পর সুবিধাজনক সংমিশ্রণ থেকে সৃষ্টি হতো তাহলো, ও দুটো যে একই উপাদানে সৃষ্টি তা কল্পনা করতে বিশেষ বেগ পেতে হয় না। অধিকন্তু আজ পর্যন্ত আত্মগত ধারনা অথবা দৃষ্টিভঙ্গি চিহ্নিত বৈশিষ্ট্যটি বিদ্যমান তা পদার্থবিদ্যাকে যে আক্রমণ করেছে, কিন্তু মনের তেমন চিহ্নিত বৈশিষ্ট্য ধরা পড়েনি। বিভিন্ন স্থান থেকে ফটো ক্যামেরার সাহায্যে একই জিনিসের ছবি তোলা হলেও কিন্তু ছবি ভিন্ন ভিন্ন ধরনের হবে। এমনকি ক্রনোমিটার, এবং মাপন দণ্ড ও আধুনিক পদার্থবিদ্যার কর্তপদীয় ভুমিকা গ্রহন করে, সেগুলো প্রাকৃতিক ঘটনার হিসেব না রেখে, প্রাকৃতিক ঘটনার সঙ্গে সম্বন্ধের হিসেব রাখে। এভাবে পদার্থবিদ্যা এবং মনস্তত্ত্ব পরস্পরের দিকে পরস্পর এগিয়ে এসেছে; মন এবং বস্তুর দ্বৈতবাদ ভেঙে পড়েছে
এটা উল্লেখ করা বোধহয় উচিত যে আধুনিক পদার্থবিদ্যা প্রাচীন অথবা পরিচিত অর্থে কোন শক্তিকে স্বীকার করেনা! আমরা আগে চিন্তা করতাম যে সূর্য পৃথিবীতে শক্তি বিকিরণ করছে। এখন আমরা চিন্তা করি কালপাত্রকে সূর্যের আশেপাশে এমনভাবে সাজিয়ে রাখা হয়েছে, যাতে করে অন্য কোন কিছুর বদলে পৃথিবীর ঘুরতে বেশি সুবিধা হয়। আধুনিক পদার্থবিদ্যার অবিসংবাদিত নীতি হলো Principal of least action নীতি। তাহলে এক স্থান থেকে অন্যস্থানে যেতে হলে কোন কিছুর যে পথে ভ্রমণ করতে নূন ক্রিয়া করতে হবে সে পথই পছন্দ করবে। (ক্রিয়া হলো একটি বিষয়গত শব্দ বর্তমান মুহূর্তে তার অর্থের কোন প্রয়োজন আমাদের নেই।) খবরের কাগজের সাংবাদিক এবং অন্যান্য লেখক নিজেদের শক্তিমন্ত দেখতে চায় যারা, তারা গতি শব্দটার খুবই ভক্ত। গতিবিজ্ঞানে গতি বলে কোনকিছুর অস্তিত্ব নেই। পক্ষান্তরে চিরন্তন অলসতা থেকেই সমস্ত কিছু উৎসারিত সুতরাং অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করার মতো অবয়ব বিশিষ্ট তেমন কিছুর অস্তিত্ব নেই। আধুনিক বিজ্ঞানের যে প্রমাণ তা যারা বিরাট আইন এবং প্রাকৃতিক শক্তির দোহাই পাড়ে তার চেয়ে লাউসের ধারণার অধিকতর নিকটবর্তী। বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে সমূহবাদী দর্শনের তুলনায় আধুনিক বস্তুবাদী এবং বহুবাদী দর্শনের অবদান অনেক কম। মধ্যযুগে দর্শন ছিল ধর্মতত্বের সেবাদী এবং বর্তমানে দর্শন এক কথায় বই বিক্রেতাদের তালিকায় এসে পৌঁছেছে। সাধারণতঃ ধর্মের মহাসত্যকে প্রমাণ করাই দর্শনের কর্তব্য বলে মনে করা হয়। কিন্তু নব্যবস্তুবাদ সেগুলোকে প্রমাণ অপ্রমাণ কিছুই করার কথা বলে না। শুধুমাত্র বিজ্ঞানের মুল ধারণাগুলো বুঝিয়ে দেয়া, বিভিন্ন বিজ্ঞানের সংশ্লেষ সাধন করে পৃথিবীর যে সকল ক্ষেত্রে বিজ্ঞান নানা অভিযানে সাফল্য অর্জন করেছে তা একটিমাত্র বোধগম্য যুক্তিতে ধরে দেয়াই নব্য বস্তুবাদের লক্ষ্য। পিছনে পড়ে রইল কি, তার সম্পর্কে মাথা ঘামায় না। অজ্ঞতার জ্ঞানে, রূপান্তরিত করার মতো কোন তাবিজ-কবজও নতুন দর্শন দেয় না। যারা বোঝে দাম দেয়, তাদের বুদ্ধিবৃত্তিক আনন্দ দিয়ে থাকে, কিন্তু অন্যান্য দর্শনের এত বৃথা অহংকার করে তোষামোদী করে না। যদি তা নীরস এবং বিষয়গত হয়ে থাকে তাহলে ব্রহ্মাণ্ডের উপরে দোষ চাপায় না, কেননা কবি এবং মরমীরা যে রকমটি চায় তার চেয়ে গাণিতিক পদ্ধতিতেই তার ক্রিয়া-কর্ম চলে। হতে পারে তা দুঃখময় কিন্তু একজন গাণিতিক তাতে দুঃখের কিছু খুঁজে পাবেনা।