বাড়ি যেতে অনেকটা দূর থেকেই তারা দেখতে পেল, বাইরের দরজায় একটা কেরোসিনের ডিবে জ্বলছে পথটা আলোকিত করে। আর পথের মাঝে আলোয় কম্পিত ছায়া ফেলে বউ একটি দাঁড়িয়ে আছে—এদিক পানে চেয়ে।
মহিম ভরতের চকিতে একবার চোখাচোখি হল। ভরতের চোখে অভিযোগ, মহিম সেই অভিযোগ মেনে অপ্রতিভ। কারণ তারা উভভয়ই বুঝতে পারল, রাত্রের নির্জন পথে উদ্বেগে দাঁড়িয়ে আছে অহল্যাই।
তাদের দুজনকে চোখে পড়া মাত্র আলো নিয়ে অহল্যা অন্তর্ধান হল। তাতে তার ক্রোধের মাত্রা পরিস্ফুট হল আরও বেশি।
মহিম আর ভরত বাড়ি ঢুকে হাত মুখ ধুয়ে সোজা রান্নাঘরে গিয়ে হাজির হল। অহল্যা থালায় ভাত বেড়ে প্রস্তুত। কেউ-ই কোনও কথা বলছে না। মহিম আর ভরত কথা বলতে ভরসা পেল না।
তারা বসা মাত্র ভাতের থালা এগিয়ে দিয়ে অহল্যা হেঁসেল গুছোতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
ভরত জিজ্ঞেস করল, খাবে না তুমি?
কোনও জবাব পাওয়া গেল না। কিন্তু ভরতের খাওয়া আটকাল না তাতে। সে খেতে খেতেই বলল, পথে আবার একটু কথায় কথায় দেরি হয়ে গেল। এ ছোঁড়া আবার এত রাতে বলে—গোবিনের ডাঁয় যাবে।
গেলেই তো হত। নিস্পৃহ গলায় বলল বটে কথাটা অহল্যা, কিন্তু তাতে রাগের মাত্রা প্রকাশ পেল আরও বেশি।
মহিম হাত গুটিয়ে নিয়ে কিছু একটা বলবার উদ্যোগ করতেই মানিকের গলা শোনা গেল। ছেলেমানুষ, বছর যোলো বয়স। বাপ-মা নেই বলে এই বয়সেই কামলার কাজ করছে। ডাকাবুকো ডানপিটে, ভূতপ্রেতের দোসর ব্রহ্মদত্যির হুকুমে চলা মানিক। কোনও কিছুতে প্রত্যয় নেই। বড় মানে না, ছোট মানে না, মানে না জাত-বিজাত—মানে খানিকটা অহল্যাকে। এই মানার মধ্যে আছে হয়তো বিচিত্র মনের রঙ, যার হদিস অহল্যারও জানা নেই বুঝি।
মানিক উঠোন থেকেই বলে উঠল, কাকি গো, মহিমকাকা বাবুদের বাড়ি থেকে তো চলে আসছে অনেকক্ষণ! বলতে বলতে কাছে এসে তাদের দেখতে পেয়েই বলে উঠল, হেই দ্যাখো, ভরতকাকাও এসে পড়ছে। তোমাদের লেগে কেমন করতেছিল কাকি। বাইরে গেলে তোমরা ঘরে ফিরতে ভুলে যাও কেন বলো তো বাপু?
হ্যাঁ, এমনি পাকা পাকা কথা মানিকের। কিন্তু ভরত তো সাধারণত রাত্রি করেই আসে, আজকের ব্যাপারটা মহিমের জন্য। এবং আজকের ব্যাপারটা, এই উদ্বেগে ভয়ে মানিককে পাঠানো, আর সেটা ধরা পড়ে যাওয়া, বিশেষ করে এই মুহূর্তেই, তাতে সে খানিকটা লজ্জা পেল। কিন্তু লজ্জায় সে অপ্রতিভ হতে চাইল না।
বলল মানিককে, নে হইছে। ঘটি ভরে জল নিয়ে বোস দি নি। ভাত কটা খেয়ে নে।
বটে, সে আশায় হেঁসেল নিয়ে বসে আছ কাকি তুমি? মানিক বলল, পাগলা বামুনদের বাড়িতে যে আজ পেট ঠেসে খাওয়ালে। ওদের সেই গড়পাড়ের হিজল গাছটা আজ একা একাই চুপিয়ে নাবিয়ে দিলাম কি না।
বেশ করছিস! অহল্যা বলল, তা বলে পেটে তোর চাড্ডি ভাতের জায়গা নাই নাকি রে!
কথার শেষে সে লক্ষ করল মহিম খাচ্ছে না। ভরত ভীষণ গম্ভীর। মাঝে মাঝে সে লক্ষ করছে মানিককে। বুঝতে পারল এ হতচ্ছাড়া হারামজাদা ছেলেটা তার ঘরের হাঁড়ি থেকে নিঘাত কিছু গিলবে। এ নিয়ে অহল্যাকে বহুদিন বহু কথা বলেছে, কিন্তু তার প্রতি বউটির মায়া দেখলে গা জ্বলে। নিজে না খেয়ে খাওয়ায় সে মানুকে ছোঁড়াকে।
আর মহিম বুঝল মানিককে যে চাট্টি ভাত খাওয়ার জন্য অহল্যা ডাকছে—সে ভাত অহল্যার নিজের জন্য রাঁধা। রাগ হয়েছে, তাই নিজে না খেয়ে সে খাওয়াতে চায় মানিককে।
চিরকাল যেমন সে করে, আজও তাই করল। হাত গুটিয়ে বলল, বলছে তো ওর পেট ভরা আছে। তুমি খাবে না?
কোনও জবাব দিল না অহল্যা।
ভরতের খাওয়া প্রায় শেষ। এ-সব রাগ-অভিমানের দিকে সে বড় একটা খেয়াল করে না। নিতান্ত গম্ভীর ভারী মানুষ, ঘরের কর্তা। মান-অভিমান-সাধাসাধি ওসব মহিম-অহল্যার মধ্যে সীমাবদ্ধ। ভরতের তা নেই, আর মনে করে বোধ হয় সে যে, তা থাকতেও নেই। কেবল বলল, নেও নেও, খেয়ে নেও।
বলে আগা করে ঘটি ধরে ঢকঢক করে জল খেয়ে উঠে পড়ল সে।
কই, ভাত বাড়ো? মহিম আবার বলল, ইচ্ছা করে দেরি করছ নাকি?
না, ইচ্ছা করে নয়। তাই এত রাতে আবার পশ্চিমপাড়ায় যাবার সাধ হইছিল।
তা বটে। মহিম বুঝল এত রাতে আবার আড্ডার ইচ্ছাটা অপরাধই। সে বলল, যাই নাই তো। তবে?…খেয়ে নেও।
বড় অল্পেতে অহল্যা রাগে। বড় সহজে তার দাবি আদায় করতে চায় সে। অভিমানিনী বেশি, মন তার কিছুতেই যেন তুষ্ট হতে চায় না। এমনি সাধারণ সরল চাষী বউ। তবু এক-একসময় আসে—তার একটা চরম পরিণতির সময়, যখনকার ভাব কথা হাসি গান কিছুরই কোনও হদিস পায় না কেউ। মহিম নয়, ভরত নয়। কঠোরতায় বিহ্বলতায় সে এক অপূর্ব অহল্যা। কলকাতায় পাগলা গৌরাঙ্গের চোখের জলের কথা শুনে অহল্যা কী কঠিন রূঢ়তায় বলে উঠেছিল, যেমন কর্ম তার তেমন শাস্তি। পাগলা গৌরাঙ্গের প্রতি তার নিষ্ঠুরতা দেখলে মহিম আশ্চর্যই হয়। হ্যাঁ, সেদিন মহিমকে নিয়ে ফিরে আসার পথে উমার মতো সেই বিদ্রূপ আর ডঙ্কা বাজিয়ে ফেরার মতো হাসিতে বঙ্কিম রেখায় বেঁকে গিয়েছিল তার ঠেটি। কিন্তু মহিম তো চোখের জলই ফেলেছিল। সেদিন এ সাধারণ বউটির কোনও মায়ার উদ্রেকের লক্ষণ দেখা যায়নি মহিমের কান্নয়। বরং রাগ করেই বলেছিল, তবে ফিরে যাও তোমার পাগলা বামুনের কাছে।
অহল্যা দেখল অপরাধ স্বীকারে কী করুণ আর শিশুর মতো হয়ে উঠেছে মহিমের মুখখানি। নিছক মাটির মন তার, তাও বুঝি খালের জলের ধারে নরম মাটির মতো। হাওয়ার টানে শুকোয়, রৌদ্রে জমে যায় আবার জোয়ারের এক ধাক্কাতেই গলে গলে মিশে যায়, একেবারে তুলয়ে যাওয়ার মতো।
আর এমনি গলে যাওয়ার মুহূর্তে তারই অজান্তে তার চোখ দুটো পলকহীন হয়ে পড়ে। সে চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে মহিম মনের হদিস পায় না অহল্যার। এ চোখের মধ্যে জমিদারের পুত্রবধূর উম্মুস আর তীব্রতা না থাকলেও বিস্মিত বিমুগ্ধতায় আচ্ছন্ন।
কই, খাও, মহিম বলল।
অহল্যা যেন আচমকা নিশ্বাস ফেলে আরও গভীর হয়ে ওঠে। বলে, আর যমের বাড়ি গিয়ে খাব।
ও! রাগ তা হলে কমেনি অহল্যার এখনও। মহিম সোজা বাঁ হাত দিয়ে অহল্যার একটা পা চেপে ধরল। এই পা ছুঁয়ে বলছি আর দেরি হবে না।
অহল্যা হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠল। ছাড়ো ছাড়ো হয়েছে। বলল আগে, খাবে কি না।
খাচ্ছি খাচ্ছি। অত দরদ দেখাতে হবে না।
বলে, খাবে না। হ্যাঁ! বলে মহিম আবার খেতে শুরু করল।
মানিকও হাসছিল। অহল্যা মাথা নিচু করে তখনও বুঝি হাসছিল, তাই তার শরীরটা দুলে দুলে উঠছিল দমকে দমকে। মাথা নিচু করেই সে ভাত বাড়তে লাগল দুটো থালায়। একটা মানিকের, একটা তার।
মহিম খেয়ে ওঠবার সময়ও দেখল অহল্যা মাথা নিচু করে আছে। বললে, তুমি খানিক পাগলও বটে বউদি।
বলে সে বেরিয়ে গেল।
সামনের বাড়া ভাতের থালায় কয়েক ফোঁটা চোখের জল করতেই তাড়াতাড়ি চোখ মুছল অহল্যা।
ও! অহল্যা বুঝি কাঁদছে। কেন?
তা বুঝি কেউ জানে না। এ তার সেই বাঁধা বীণার তারে বেসুর? যে স্বগত বেসুরের ধ্বনি আর রূপ বাইরে ঢাকা পড়ে থাকে? যার তরঙ্গ কোথাও কোন বিপর্যয়ের সৃষ্টি করে না, নিতান্তই
একলার?
—নে মানিক, ভাত কটা নিয়ে বাইরে বোস। থালাটা এগিয়ে দিল।
তার চোখের জল দেখে বিস্মিত বিমুঢ় মানিক থালাটা নিয়ে গিয়ে বাইরে বসল। কিছু বলতে পারল না।
হাত মুখ ধুয়ে মহিম আবার এদিকে আসতেই অহল্যা তাকে ডাকল।
জমিদার বাড়িতে কী কথা হল বললে না?
বলব। বলে মহিম বেশ উৎসাহের সঙ্গেই চেপে বসল ঘরের দরজাটির গোড়ায়।
ঘুমন্ত ভরতের নিশ্বাসের উচ্চধ্বনি শোনা গেল।