৫
তা নতুন নতুন ঘটনা তো ঘটবেই। বারোটা পরিবার। একটা দু’টো তিনটে ক’রে প্রায় সকলের সংসারেই ঘটনা ঘটছে রোজ, দিবারাত্র, চব্বিশ ঘণ্টা। কিছুই অঘটন না ঘটিয়ে সুখে পেটভরে ভাত খাবে, হাওয়া খাবে, গল্প করবে, সেই সোনার যুগ পৃথিবীতে কোনদিনই ছিল না। এখন এসব অঘটনকে লোকে বাড়াবাড়ি ক’রে দেখছে খামকা।
পরম নিশ্চিন্ততা, নির্ভরতা, শান্তি ও অনন্ত সুখ স্বর্গেই সম্ভব মাটির পৃথিবীতে নেই, থাকবেও না।
আর কত তুচ্ছ জিনিস নিয়ে কত বড় ঘটনা হয়।
এক ঘরের ঘটনা তিন ঘরকে জড়িয়ে ধরে। যে রাতে রুচি এ বাড়িতে এল, সেই রাত্রেই ঘটল একটা।
শেখর ডাক্তারের ঘরে।
কি, না রাত্রে খাওয়া-দাওয়ার পর শেখর ডাক্তারের স্ত্রী প্রভাতকণা বড় মেয়ের মনের ইচ্ছাটা জানতে পারল। কি, না টেলিফোনে চাকরি করবার মতলব করেছে সুনীতি।
শুনেই প্রভাতকণা সাঁই সাঁই করে উঠল।
আর ডাক্তারনীর চীৎকার একবার আরম্ভ হলে থামতে চায় না। একটু আগে বলছিল কে গুপ্ত। এ বাড়ির ছোট-বড় সবাই জানে।
সুনীতি গত বছর ম্যাট্রিক পাস করেছে। বিয়ের আলাপ এসে গেছে এর মধ্যে দু’তিনটা। এই জন্যও শেখর ডাক্তার একটু ব্যস্ত। একটু তাড়াতাড়ি চাইছিলেন জায়গাটা পাল্টাতে, যদি শহরের দিকে, টালিগঞ্জ বালিগঞ্জ না হোক, অন্তত গড়পার বাগবাজারের দিকেও চলে যেতে পারতেন তো অ্যাসোসিয়েশনটা ভাল পেতেন, হয়তো পসারও জমত ভাল। রাজসাহী থেকে এসে রাজেন ঘোষাল, কি এক সূত্রে শেখর তরফদারের মামাতো ভাই, প্রায় দেড় বছরের প্রাক্টিসেই গাড়ি-বাড়ি করে ফেলল। বসেছিল দর্জিপাড়ায়। ঘিঞ্জি হলেও কত ভাল সে-সব জায়গা। কত বড় ঘরের মানুষ থাকে। এ কি আর এই বস্তি! ধুলো, মশা, মাছি, নর্দমার পচা গন্ধ শোঁকা মানুষ।
এদের অসুখ হলেও পয়সা খরচ করতে চায় না। তা ছাড়া পয়সা নেই দলের বেশিরভাগ। পয়সা এবং হ্যাঁ, মেয়ের বিয়ে, অন্তত ভাল জায়গায় গিয়ে না বসা পর্যন্ত ভাল ছেলে পাওয়া যাবে না। বেলেঘাটায় ভাল ছেলে নেই, শেখর এবং প্রভাতকণা দুজনেই মর্মে মর্মে টের পেয়েছিল।
সুনীতির বিয়ে। ও যাতে সুখে থাকে, এই ভাবনার মধ্যে হঠাৎ ওর টেলিফোনে ঢুকবার ইচ্ছাটা প্রভাতকণার কানে বেখাপ্পা টেকল। ‘কেন, ওর কি রোজগারে ভাঁটা পড়েছে যে, তুই চাকরি করতে যাচ্ছিস। কে পরামর্শ দিয়েছে তোকে, কার কথায় নাচছিস আগে বল। প্রভাতকণা প্রবলবেগে ধমক দিয়ে উঠল মেয়েকে। প্রভাতকণা অনেকটা আঁচ করে নিয়েছে। ‘কে বলেছে বলো!’ চক্ষু রক্তবর্ণ করল ডাক্তারের স্ত্রী। চোখের জল মুছে ভয়কাতুরে গলায় সুনীতি বলল, ‘প্রীতি।’
ন’নম্বর ঘরের ভুবনবাবুর মেয়ে। প্রীতি বড়, বীথি ছোট, ভদ্রলোকের ছেলেমেয়েরা সংখ্যা সবচেয়ে বেশি। বাড়ির সবাই বলে ভুবনের মাছির ঝাঁক। ভুবন চৌধুরী আজ তিন বছর শয্যাশায়ী। বৌবাজারে কত সুন্দর বাড়িতে ছিল।
খাস রাধাবাজারে এক পারসীর ঘড়ির দোকানে চাকরি করত। ভাল ঘড়ি সারাতে পারে ভুবন। গ্যাসট্রিক আলসারে শেষ করে দিয়ে গেছে তার সব। চাকরি গেল, জমানো টাকা ছিল কিছু, তা-ও গেল। বীথির মা’র গয়নাগাটি বিক্রি হ’ল। এদিকে ছেলেময়ে হয়ে গেল দেখতে দেখতে অনেকগুলো। কলকাতার বাড়িভাড়া চালাতে না পেরে চলে এসেছে এখানে। সস্তা ঘরে। তা উপোসে মরতে হ’ত সবাইকে, যদি বড় মেয়ে প্রীতি কোনরকমে ম্যাট্রিক পাস দিয়ে তাড়াতাড়ি টেলিফোনে ঢুকে না পড়ত।
‘তাই বল, যত সব ছোটলোকের আড্ডা এই বাড়িতে, হুঁ, আমার মেয়ের মাথা খাবার জন্য তোমরা তৈয়ার। বলি, অ প্রীতির মা, প্রীতির মা ঘরে আছেন?’ প্রভাতকণা লাফিয়ে উঠানে নেমে ন’নম্বর ঘরের দরজার কাছে ছুটে যায়।
কেরোসিনের ডিবি জ্বেলে ঘরের মেঝেয় ব’সে প্রীতির মা একটা কাঁথা বিছিয়ে সবে সেলাই করতে বসেছে। বাচ্চাগুলোকে খাইয়ে-দাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে এ সময়টায় তার একটু অবসর। প্রীতির ফিরতে এখনো দেরি। প্রীতির বাবা মেঝের একপাশে শুয়ে নিজের হাতেই বাতের তেল মালিশ করছে।
প্রভাতকণার চিৎকার শুনে প্রীতির মা উঠে ঘরের দরজায় এসে দাঁড়ায়।
‘কি রকম আক্কেল শুনি আপনার মেয়ের। বলি আপনার কি শাসন নেই, ডাকচাপ নেই?’
‘কেন, কি করেছে আমার মেয়ে?’ প্রীতির মা প্রভাতকণার মূর্তি দেখে অবাক।
‘কি কইরেছে, কি না কইরেছে!’ প্রভাতকণা বিকৃতমুখে গর্জন ক’রে উঠল। ‘আর একদিন শুনছি প্রীতি ফোলানি দিচ্ছে আমার মেয়েকে আপিস ঢোকাতে, আপনি শাসন না করেন, আমি প্রীতির মাথার চুল টেনে ছিঁড়ব বলে রাখছি। যত সব বেলেল্লেপনা, যত সব বদমাশি।’
‘আপনি আস্তে কথা বলুন, আপনি ভাল করে কথা বলুন।’ প্রীতির মা চৌকাঠ পার হয়ে বাইরে এসে দাঁড়াল। আমার মেয়ে কবে বলেছে, আপনার মেয়েকে আপিসে ঢুকতে,–আপনার অনুমতি ছাড়া মেয়ে আপিসে ঢুকবেই বা কেন।’
‘চাইছে, প্ৰীতি চাইছে সুনীতিকে দলে টানতে। আমার জানতে বাকি নাই।’ চোখ পাকিয়ে দু’হাত ঘুরিয়ে প্রভাতকণা নাটকীয় ভঙ্গিতে আরম্ভ করল : ‘আপিসের কীর্তি শুনতে আমার বাকি আছে কিছু। দ্যাশে থাকতে বেবাক হুনছি, এখানে আইস্যা তো দেখছি। ক্যান্ আমার ভাতের হাঁড়িতে কি ঠাডা পড়ছে যে পেটের মাইয়াকে বেশ্যা বানামু।’ যখন রাগ হয় দেশী উচ্চারণগুলো ডাক্তার-গিন্নীর জিহ্বায় খরখরে হয়ে উঠে।
রাগে, দুঃখে প্রীতির মা ঠকঠক করে কাঁপছিল। প্রভাতকণার চিৎকার শুনে অন্য সব ঘরের লোকেরাও এসে বাইরে দাঁড়িয়েছে। উঠানে রীতিমত ভিড়।
‘আপনি এসব কি আবোল-তাবোল বকছেন। আপনাদের ইচ্ছা না থাকে, মেয়েকে কাজে দেবেন না, সে আলাদা কথা; কিন্তু বেশ্যা-ফেশ্যা এসব কি, এখানে আরো পাঁচটা ভদ্রপরিবার থাকে ভুলে যাচ্ছেন।’ কমলার গলা।
‘আ-রে আমার ভদ্দরলোক রে!’ প্রভাতকণা গলার স্বরকে আরো বিকৃত ক’রে তুলল। ‘ভদ্দরলোকের মাইয়াছাইল্যা ব্যাটাছেলের গতরে গতর লাগিয়ে খুব আপিস করুক। আমি দিমু না আমার মেয়েরে, ফর্সা কথা। তা আপনাকে এখানে ডাকল কে মোক্তারী করতে! আপনার গা অত জ্বলছে কেন?’ কটমট করে প্রভাতকণা কমলার দিকে তাকায়। ‘অ, আপনি যে আপিসের দলের মনে ছিল না, সেইজন্য প্রীতির হয়ে উকিলগিরি করছেন।’
‘কে ইতর-ছোটলোক দশজন এখানে আছে জিজ্ঞাসা করুন। আপনার মত এমন ছোটলোক মুখ এ বাড়িতে কারোর নেই।’ কমলা সুযোগ বুঝে কথা বলতে ছাড়ল না।
‘ছোটলোক তুই, তোরা।’
উঠোনের এধারে গণ্ডগোল পাকাতে আরম্ভ করেছে, দেখতে দেখতে ওধারে আর এক গণ্ডগোলের সৃষ্টি। কি? না, প্রমথর দিদিমা নিজের চোখে দেখেছে বলাইর বৌকে আট নম্বর ঘরের কয়লা নিয়ে পালাতে। হিরণের নতুন আধ মণ কয়লা, সবে তো কাল বিকেলে কিনে আনা হ’ল। আর সবাই যা ক’রে অর্থাৎ শোবার ঘরের ভিতর একধারে যেভাবে হোক, জায়গা করে কয়লা-ঘুঁটে কি কাঠ ঠেসে ঠেসে না রেখে হিরণ কয়লাটা বাইরে বারান্দায় রেখেছিল এবং শেষ রাত্রে যখন প্রস্রাব করতে বেরোয়, তখন নাকি প্রমথর দিদিমা দেখে বলাইর বৌ দু’চাকা কয়লা তুলে কাপড়ের নিচে সেটা তাড়াতাড়ি লুকিয়ে ফেলে নিজের ঘরের দিকে সরে পড়ছে। অন্ধকার রাত হলেও সাদা কালো জিনিসটা বেশ মালুম হচ্ছিল। ‘আধ মণ ময়লা এখানে কে বললে? কিছুতেই আধ মণ হবে না। ক’বেলা আর রান্না হয়েছে। তাই তো বলি, কয়লাওলা এবার ওজনে কম দিলে নাকি! ভাবছি আর জগৎকে বকছি।’ চিৎকার করছিল বিমল হালদার। ফ্যাক্টরিতে ওভারটাইম খেটে রাত সওয়া আটটায় সে ঘরে ফিরেছে। ফিরে হিরণের মুখে প্রমথর দিদিমার নিজ-চোখে দেখা কয়লা চুরির কাহিনী শুনে বিমল ভয়ানক চটে গেছে। ‘যত সব হাড়হাভাতে এসে এখানে ঠাঁই নিয়েছে। তাই তো বলি কয়লা থাকে না, ঘুঁটে থাকে না, কাঠ কিনে কুলোতে পারি না। যায় কোথায় এসব। এমন ধারা চুরি হতে থাকলে রাজার ধনই কি আর চোখে ঠেকে! যত সব চোর ছোটলোক এসে বাসা বেঁধেছে এই বস্তিতে।’
‘চোর ছোটলোক তুই, তোরা।’ ঘরের ভিতর আর থাকতে না পেরে বলাই চৌকাঠের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। কেননা, বিমল তাকেই, তার পরিবারকে লক্ষ্য করেই এসব কথা বলছিল, এখন আর তা ঢাকা-চাপা নেই। বিকেলে কলতলায় সবাই যখন লাইন দিয়ে জল ধরতে দাঁড়িয়েছিল, তখন ময়নাকে মুখের ওপর হিরণ জেরা করছিল, তার মা কয়লা পেল কোথায়? রাত্রে হিরণের কয়লা চুরি করে নিয়ে গিয়ে তবে আজ ওরা উনুন ধরাতে পেরেছে। ড্যাবডেবে চোখে ময়না হিরণের দিকে তাকিয়ে কথাগুলো হজম করেছে। তারপর ঘরে ফিরে গিয়ে মাকে বলেছে। নিত্য অভাব-অনটনে জর্জরিত হয়ে বলাই বলাইর স্ত্রী এ বাড়ির মধ্যে সকলের চেয়ে বেশি নীরব হয়ে গেছে। পাশের ঘরের লোকটির সঙ্গেও কথা বলতে তারা সঙ্কোচবোধ করে। পরনে কাপড় নেই, রাত্রে ঘরে আলো জ্বলে না, সপ্তাহে চারদিন উনুনে আগুন পড়ে না। এই হীনতাবোধ, এই অসহায়তার দরুন দিন থেকে দিন তারা মৃতপ্রায় হয়ে আছে। আজ সরাসরি চুরির কুৎসা তাদের ঘরে ছুঁড়ে মারতে তারা মুখ খুলতে বাধ্য হয়েছে। বলাই ঘরে না ফেরাতক ময়নার মা চুপ ছিল। বলাই সব শুনে গর্জন করে উঠেছে। ‘বটে! সব কাঠ-কয়লাওলা রাজাবাদশা এসে জুটেছেন এখানে। ক’পহা কামাচ্ছেন গালার কলে মজুরী খেটে, আমার কি জানা নেই–’ ইত্যাদি।
বিমল ঘরে ফিরে সব শুনে তার চেয়েও জ়োর চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলেছে। ‘আমি পুলিসে খবর দেবে, বাড়িওয়ালার কাছে রিপোর্টে করব। চোর-ছ্যাঁচড়দের না তাড়ালে আমরা এবাড়ি কালই ছেড়ে দেব সব–’
‘কত শালা এবাড়ি ছেড়ে দিয়ে রাজপুরীতে গিয়ে ঠাঁই নিচ্ছে, আমার জানা আছে,–লম্বা কথা বলতে সব শালাকেই শুনি।’
‘ছোটলোক, রাস্তার কুকুর খেতে পায় না তবু কত বড় গলা, তুমি যাও না, গিয়ে ক’ঘা মুখে বসিয়ে দাও।’ চৌকাঠের ওপারে দাঁড়িয়ে ফিসফিসে গলায় হিরণ স্বামীকে তাতাচ্ছে। বিমল দাঁড়িয়ে রাগে দাঁতে দাঁত ঘসছে। সাহস পাচ্ছিল না রোগা টিঙটিঙে শরীর নিয়ে বিশালদেহ বলাইর সঙ্গে গিয়ে লড়ে। অনাহারে, অর্ধাহারে থেকেও মানুষের শরীর এত বড় থাকে কি ক’রে ভাবছিল সে; কিন্তু বিমল লক্ষ্য করেনি বলাইর কাঠামোটাই বড়, আসলে গায়ের মাংস ঝুলে পড়ছে, স্নায়ু ঢিলে হয়ে গেছে,’কোটরগত চক্ষুদ্বয়, বিশীর্ণ গণ্ডদেশ।
‘থাক বাবা, আর চেঁচিয়ে কাজ নেই।’ চৌকাঠের ওধারে দাঁড়িয়ে ময়না বাবাকে ডাকছে, ‘বনমালীকে অনেক ব’লে-কয়ে চার পয়সার মুড়ি ধারে আনতে পেরেছি, তুমি ওই দিয়ে জল খাও, সারাদিন আজ মুখে কিছু দাওনি।’
‘কারখানায় কাজ ক’রে লাট বনে গেছেন, হুঁ, বাড়িওয়ালার কাছে রিপোর্ট করবেন। কত শালার রিপোর্ট পারিজাত কানে তুলেছে, আর তার বিহিত করছে আমার জানা আছে–’একটা আধপোড়া বিড়ি তৃতীয়বার ধরাবার চেষ্টা করতে করতে রাগে আক্রোশে বলাই কাঁপছিল। আর ঘরের ভিতর দুঃখে অপমানে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলাইর স্ত্রী মনোরমা কাঁদছিল। কান্নার শব্দ ছাপিয়ে তার কথাগুলো পরিষ্কার শোনা যাচ্ছিল। ‘আমরা গরীব বটে, কিন্তু আজ অবধি এবাড়ির কারো কুটোটা হাত দিয়ে ছুঁয়েছি, কেউ দেখেছে বলতে পারবে…’
ইতিমধ্যে শিবনাথ ঘরে ফেরে। সুরুচি চৌকাঠে দাঁড়িয়ে। মঞ্জুর খাওয়া হয়ে গেছে। ওকে ঘুম পাড়িয়ে দরজায় দাঁড়িয়ে সে নতুন আস্তানার বিচিত্র কলরব শুনেছে। শিবনাথও একটু সময় কান পেতে শুনলে। ‘তোমার খুব খারাপ লাগছে রুচি?’ শিবনাথ অল্প হেসে প্রশ্ন করল।
‘লাগলেও উপায় কি।’রুচি সংক্ষেপে উত্তর করল। শিবনাথ আর কিছু বলতে সাহস পেলে না।
বলাই ও বিমলের ঘরের গোলমাল হয়তো তখন থেমে গেছে। প্রভাতকণা ও কমলার ঝগড়ায় একটু ভাঁটা পড়েছে, এমন সময় শোনা গেল আর এক দিকের হৈ-চৈ। কি? না হিরুর মা অর্থাৎ রমেশবাবুর স্ত্রী মুখ খুলে অমল চাকলাদারের বৌ কিরণকে যাচ্ছে-তাই গালাগালি করছে। কমলা কাল ওদের ঘর থেকে আধ সের আটা ধার নিয়েছিল, আজ সকালে ফিরিয়ে দেবার কথা, সকাল বিকাল সন্ধ্যা পার হয়ে রাত এখন ন টা বাজতে চলল, কমলা আটা ফিরিয়ে দিল না। রমেশ-গিন্নী প্রথমটায় অসন্তুষ্ট, তারপর রেগে নিজের মনে গজগজ করতে করতে সারাটা বিকেল কাটিয়েছে। এখন সরাসরি কিরণের ঘরের দরজায় গিয়ে হানা দিতে ইতস্ততঃ করল না।
‘বলি, যদি সময় মত জিনিস ফিরিয়ে না দিতে পার তো পরের কাছ থেকে হাত পাত কেন? মুখে আঙুল গুঁজে পড়ে থাকতে পার না?
কিরণ অনুনয়ের কণ্ঠে বার বার বলছে, ‘আজ উনি মাইনে পাননি মাসিমা, পাওয়ার কথা ছিল। মাইনে পেলে আপিস থেকে ছুটি নিয়ে চলে এসে রেশন তুলতেন। কাল টাকা পাবেন, কাল রেশন এনে আপনার আটা ফিরিয়ে দেব।’
‘যত সব হাভাতে এসে জুটেছে এখানে। মল্লিকা অর্থাৎ রমেশবাবুর স্ত্রী ফোঁস করে উঠল। ‘আমরাও রেশনের চাল-আটা খাই,–তাতেও কুলোয় না, চোরা বাজার থেকে ডবল দাম দিয়ে হপ্তার শেষে সের দু’সের করে কিনতে হচ্ছে–ভাবলাম সারাদিনে যখন পেলাম না, সন্ধ্যাসন্ধে আটাটা ফেরত পাব। ওমা, এ কি কাণ্ড, আজ না কাল, বলি আমি কি সোয়ামীর বাচ্চার মুখে এখন উনুনের ছাই তুলে দেবো, অ্যা, এদিকে আমার উনুনের কয়লা ধরে গন-গন করছে, ভাজা হ’ল, ডাল করলাম, এই দিই, এই দিচ্ছি ক’রে তিনি রাত দশটায় এসে এখন আমায় মহামন্ত্র শোনাচ্ছেন কাল দেব,–না বাপু, তুমি আর কারো কাছ থেকে আমার আটা ধার করে এনে দাও। ঘরে কি আর আমার চাল নেই, আছে –আমি আর বাচ্চা দুটো না হয় খেলাম, কর্তার রাতে আটা ছাড়া আর কিছু হজম হয় না, তা আমরাই-বা, নতুন ছোলার ডালটা করলুম, রুটি না খেয়ে ভাত খাই কোন্ দুঃখে। এ বাড়ির রকমসকম দেখে আমার চোখে কড়া পড়েছে,–কারো কাছ থেকে সুপুরিটাও ধার করি না, এখন আমি আটা চাইতে পরের দরজায় যেতে পারব না। আমার আটা দাও। আটায় টান পড়েছে।’
কিরণ অসহায় চোখে মল্লিকাকে দেখছে। ঘরের ভিতর অমল মাথায় হাত দিয়ে চুপ করে বসে ভাবছে। তিনদিন আগে তাদের মাইনে হবার কথা ছিল। কিন্তু কারখানায় স্ট্রাইক চলেছে বলে সেটি আটকে গেছে। অমলের হাত শূন্য। আজ দেব, কাল দেব, ক’রে দোকান থেকে প্রতিবেশীদের কাছ থেকে জিনিসপত্র ধারকর্জ ক’রে দু’দিন চালিয়েছে। কালও যে সে মাইনে পাবে, তার নিশ্চয়তা নেই। কালও রমেশের ঘরের আটা ফেরত দিতে পারা যাবে না, এই দুশ্চিন্তায় সে মরে যাচ্ছিল। এ-বাড়ির আর কেউ ধার কর্জ দেয় না। সবাই নাকি ঠেকে শিখেছে। ধার দিয়ে সময় মত তা আদায় করা কঠিন। তবু নিরুপায় হয়ে কমলা শেষটায় রমেশ রায়ের স্ত্রী মল্লিকার কাছে আটা চেয়ে এনেছিল। কিন্তু এক সন্ধ্যা পার না হতে যে মল্লিকা এমন মারমুখী হয়ে তাদের দরজায় এসে হানা দেবে, কিরণ ও অমল বুঝতে পারেনি।
‘বলো বৌ, এখন আমি কি করি?’ মল্লিকা ভদ্রতার মাথা খেয়ে কিরণের হাতে হ্যাঁচকা টান মারল। ‘আমার কয়লা পুড়ে যাচ্ছে
ফাঁসির আসামীর মত দাঁড়িয়ে কিরণ। ভয়ে তার মুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। বিধু মাস্টারের স্ত্রী ও ছেলেমেয়েরা ছুটে এসেছে কিরণের দরজায়, এগারো নম্বরের ঘরের লোকেরা এসেছে, নিজেদের ঘরের গোলমাল থামতে প্রীতি, বীথি এসে উঁকি দিয়েছে আট নম্বরের ঘরের দরজায়। ব্যাপার কি! মল্লিকা দু’হাত শূন্যে ঘুরিয়ে সবাইকে শুনিয়ে শুনিয়ে বলছে, ‘ভাল মানুষের মত এসে চাইতে ঘরের জিনিস বার ক’রে দিলাম, এখন সেটি আদায় করতে আমার প্রাণ বেরিয়ে যাচ্ছে, এর বিচার তোমরা কর ভাই, উপকার করে আমি মহা ঠকেছি।’ মল্লিকা একে একে সকলের মুখের দিকে তাকাল। কিরণও তাকায়। কিন্তু সাহায্য বা সহানুভূতির প্রশ্রয় একটি চোখেও দেখতে পেল না। কারো মুখে হুঁ-হাঁ শব্দ নেই। বরং সকলের চেহারা দেখে মনে হ’ল এই ব্যাপারে কিরণই অপরাধী। কন্ট্রোলের দিনে ছটাক কাচ্চার ওজনে সবাই খাদ্য পায়। কাজেই ধারের আটা ফিরিয়ে না দিয়ে অমল চাকলাদারের বৌ খুব অন্যায় করেছে! এমন সময় ভিড় ঠেলে হঠাৎ একজন এসে দাঁড়াল। বারো নম্বরের নতুন ভাড়াটে। রুচি। দূরে থেকে দাঁড়িয়ে সে সব শুনছিল। মল্লিকাকে বলল, ‘আমার কিছু আটা আছে, এখন চালিয়ে দিচ্ছি, নিন।
বীথি বলল, ‘আপনারা এখানে নতুন এসেছেন, রেশন কার্ড করা হয়নি নিশ্চয়, ঘরের জিনিস ছেড়ে দিলে শেষটায় অসুবিধা হবে।’
এক সেকেন্ড কি ভেবে রুচি বলল, ‘তা একরকম চালিয়ে নেওয়া যাবে।’
বীথি নীরব।
পিছন থেকে কে একবার কেশে উঠল
মল্লিকা গলা নামিয়ে বলল, ‘আপনার কাছ থেকে নেওয়াটা তো বড় কথা নয় দিদি, আজ না হয় চালিয়ে দিচ্ছেন, কিন্তু কাল যখন আপনার আটা আমাকে ফিরিয়ে দিতে হবে, আমাকে চোরাবাজারের ডবল দাম দিয়ে কিনে তবে তো সেটা শোধ করতে হবে। কি বলিস বীথি?’
বীথি মাথা নাড়ল।
রুচি বলল, ‘কাল আপনাকে দিতে হবে না। সোম-মঙ্গলবার রেশন এনে সেটা ফেরত দিলেও আমার অসুবিধা হবে না।’
‘অই একই কথা।’ মল্লিকা আবার গলা চড়া করল। ‘আমার এক সের যতক্ষণ না ফিরে পাচ্ছি, আর একজনেরটা শোধ করতে হলে দেড়া দাম দিয়ে কিনে তা করতে হবে। তাছাড়া সোম-মঙ্গলবারও যে কিরণ আটা ফেরত দিতে পারবে আমার ভরসা হয় না।
এতক্ষণ কিরণ আশ্বস্ত হয়ে রুচির দিকে তাকিয়েছিল। এবার মাটির দিকে তাকাল। মল্লিকা আর সেখানে না দাঁড়িয়ে রাগে গজ গজ করতে করতে সরে পড়ল। গায়ে পড়ে কিরণের পক্ষ হয়ে নবাগতা রুচির এই উপকার করতে আসা রমেশ-গিন্নী ভাল চোখে দেখল না। যেন দাঁড়িয়ে কিরণকে আরো কতক্ষণ অপমান করার ইচ্ছা ছিল, সেটি হ’ল না দেখে বিরক্ত হয়ে মল্লিকা সরে গেল।
রুচিও আর সেখানে দাঁড়াল না। আস্তে আস্তে নিজের ঘরের দিকে চলে গেল। প্রীতি, বীথি ও বিধু মাস্টারের ছেলেমেয়েরা মল্লিকার পিছু পিছু সরে পড়েছে। কিরণ একটা লম্বা নিশ্বাস ছেড়ে আস্তে আস্তে দরজার পাল্লা দুটো ভেজিয়ে দিলে। অমল চাকলাদারের ঘরে আজ আলোও জ্বলল না, উনুনেও আগুন পড়ল না।
.
ঝগড়াঝাঁটি কতক্ষণের জন্যে বন্ধ হলেও বাড়ির কলগুঞ্জন থামে না। একটু কান পাতলে শোনা যায় ঘরে ঘরে রান্নাবান্নার খাওয়াদাওয়ার শব্দ। শব্দ এবং নানা রকমের গন্ধ ভেসে বেড়াচ্ছে। শেখর ডাক্তারের ঘরে ইলিশ মাছ ভাজা হচ্ছে, তার গন্ধ। বিধু মাস্টারের ঘরে এবেলা কাছিমের মাংস রান্না হচ্ছে, তার গন্ধ। হীবুর বাবা রমেশ রায় ফেরার পথে বেলেঘাটা পুলের ধার থেকে সস্তায় দু’টো কুমড়ো কিনে এনেছেন। রুটি দিয়ে খাবে বলে মল্লিকা ঘটা করে সেগুলি ভাজছে। কিরণের ওপর, তার চেয়েও বোধ করি রুচির ওপর রেগে জোরে জোরে খুন্তি নাড়ছে। কমলা এবেলা কয়লা ধরায়নি। স্টোভ জ্বেলে পরটা ভাজছে। স্টোভের ভস্ ভস্ শব্দ এবং পরটা ভাজার ঘিয়ের গন্ধ সারা বাড়ি ছড়িয়ে পড়েছে। দালদা কি অন্য ভেজাল ঘি না, খাঁটি গাওয়া ঘি। এই ঘি কমলা কোথায় পায়, তা নিয়ে কারো কারো ঘরে আলোচনা হচ্ছে। প্রীতির মা’র ঘরে এবেলা বিশেষ কিছু হয়নি। বেগুনভাজা আর বিউলি ডাল। বিউলি ডাল সিদ্ধ হতে আরম্ভ করলে তার গন্ধটাও কম যায় না! প্রীতির মা ডাল ভেজে নেয় বলে গন্ধটা আরো বেশি কড়া হয়। বিমল হালদারে ঘরের রান্না হচ্ছে নতুন মূলো ও চিংড়ি মাছ দিয়ে চচ্চড়ি। মাছটা নরম। ফেরার পথে বৈঠকখানার বাজার থেকে সে একটু সস্তা দরে কিনে এনেছিল। পচা চিংড়ি মাছের গন্ধ বাড়ির অন্য সব গন্ধকে টেক্কা দিয়েছে এবং চিংড়িচচ্চড়ি দিয়ে ভাত মেখে খেতে খেতে চড়া গলায় সে হিরণকে বলছিল, ‘ওয়ান্ডারফুল রান্না হয়েছে তোমার, মাছটা একেবারে ফ্রেস ছিল।’ শুনে পাশের ঘরের অমল বিছানায় শুয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলেছে। অবশ্য অভুক্ত চাকলাদার দম্পতিকে শোনাতে বিমল তার স্ত্রীর রান্নার প্রশংসা করছিল না, তার লক্ষ্য ছিল বলাইর ঘর। তেমনি শেখর ডাক্তার ইলিশ মাছ খেতে খেতে মাছ ও রান্নার প্রচুর প্রশংসা করছিল গলা বড় করে। বিধু মাস্টারের ছেলেমেয়েরা ঘরে মাংস পাক হচ্ছিল বলে আহ্লাদে প্রচণ্ড চিৎকার ও দাপাদাপি শুরু করেছিল। আর শব্দ হচ্ছিল পাঁচু ভাদুড়ীর ঘরে। সন্ধ্যার পর খালপারের শুঁড়ীখানায় পুরো দু’পাঁইট সাবাড় ক’রে এইমাত্র ভাদুড়ী ঘরে ফিরে হৈ-হল্লা আরম্ভ করেছে, বৌকে অকথ্য ভাষায় গালিগালাজ করছে। কাউকে বাজারে পাঠিয়ে ইলিশ মাছ কি মাংস আনিয়ে রান্না ক’রে রাখতে ক্ষতি ছিল কি ছোটলোকের মেয়ের! ঘরে কি পয়সা ছিল না, না পাঁচুর পয়সার কিছু অভাব আছে! মদ খেয়ে এসে সে শুধু ডাল দিয়ে ভাত খাবে কেন? এই ছিল তার বক্তব্য। শব্দ ও কোনরকম গন্ধ ছিল না বলাইর ঘরে, অমলের ঘরে। রুচির রান্না ও খাওয়া সকাল সকাল সারা হয়েছে বলে সে-ঘরও নীরব ছিল। আর নীরব ছিল রুচির পাশের ঘর। এগারো নম্বর ঘরে কেউ তখন উঁকি দিলে দেখতে পেত কে. গুপ্ত তখনো ঘরে ফেরেনি। স্ত্রী সুপ্রভা একটা সুজনি মুড়ি দিয়ে চুপচাপ শুয়ে আছে। ঘরের এক পাশে একটা ডিজ লণ্ঠন জ্বলছে। আলোটা যতটা সম্ভব কমিয়ে রাখা হয়েছে। আর সেই স্বল্প আলোয় ব’সে পনরো ষোল বছর বয়সের একটি ছেলে। কাগজ জ্বালিয়ে এলুমিনিয়মের কেটলিতে ক’রে জল গরম করছে। কে. গুপ্তর বড় ছেলে। নাম রুণু। মাথার চুল বড় হয়ে কপালে ঘাড়ে এসে পড়েছে। যেন কতকাল চুল কাটা হয়নি। গায়ে একটা ছেঁড়ামতন হাওয়াই শার্ট। হাফপ্যান্ট পরনে। কাগজের ধোঁয়ায় ঘরের ভিতর অন্ধকার হয়ে আছে। যেন কাগজটা ভিজা বলে ভাল জ্বলছে না। একবার নিভে যেতে হ্যারিকেনের চিমনি তুলে এক টুকরো কাগজ জ্বেলে রুণু ফের জল গরম করছে। কেটলির ঢাকনা তুলে এক একবার আঙুল ডুবিয়ে দেখছে জল কতটা গরম হ’ল। কিন্তু যথেষ্ট গরম হয়নি বলে মুখে মৃদু বিরক্তিসূচক শব্দ ক’রে আবার কেটলির ঢাকনা বন্ধ ক’রে দিয়ে রুণু কাগজ জ্বালছে। বাড়িতে এক সন্ধ্যার মধ্যে তিন চারটে ঝগড়া হয়ে গেল। কিন্তু সুপ্রভা একবারও উঠে বাইরে যায়নি। কারা ঝগড়া করছে, কি নিয়ে কলহ সে-সব জানবার কি দেখবার এতটুকু আগ্রহ নেই তার। সেই বিকেল থেকে সুপ্রভার চায়ের তেষ্টা পেয়েছে। ঘরে চা চিনি কি জল গরম করার কাঠ ঘুঁটে কিছুই ছিল না। চা খাবে না ঠিক করেছিল সুপ্রভা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তৃষ্ণা দমন করতে না পেরে মেয়ে বেবিকে পাঠিয়েছিল বনমালীর দোকানে ধারে চা চিনি আনতে। দোকানের সামনে বাবাকে বসে থাকতে দেখে বেবি সাহস পায়নি সেখান থেকে ধারে কিছু আনতে। বেবি ফিরে এসেছিল। সুপ্রভা তাকে আবার পাঠিয়েছে, মোড়ে ক্ষিতীশের চায়ের দোকানে। ক্ষিতীশ এই বাড়ির রমেশ রায়ের ভাই। ছোটখাট একটা দোকান খুলেছে। সেখানে খুচরা চা চিনি বিক্রি হয় না। তৈরী চা বিক্রি হয়। কিন্তু দোকান বেশি রাত অবধি খোলা থাকে না। সন্ধ্যা-সন্ধি উনুন নিভিয়ে দেওয়া হয়। বেবি একটা কাঁচের গ্লাস সঙ্গে নিয়ে গেছে। যদি পায় তৈরী চা নিয়ে আসবে, নয়তো ক্ষিতীশের দোকান থেকে চেয়ে এমনি একটু চা ও চিনি আনবে। যদি তৈরী চা এসে যায় তবে রুণুর গরম জলের দরকার পড়বে না। কিন্তু রুণু বলছে, তবু সে খানিকটা গরম জল করে রাখবে। সুপ্রভার যতটা চায়ের দরকার গ্লাসে রেখে বাকি যেটুকু থাকবে তা-ই গরম জলের সঙ্গে মিশিয়ে রুণু সেটাকে পরিমাণে বাড়িয়ে একটু চা খাবে। ঠাণ্ডা পড়েছে, তারও আজ চা খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। বস্তুত পার্ক স্ট্রীটের বাড়িতে থাকতে সুপ্রভা রুণু বেবি সকলেই দু’বেলা চা খেত। এখানে এসে সে-সব বন্ধ হয়ে গেছে। কেবল গুপ্ত সাহেব সকালে এক কাপ চা খান। বিকেলে আর তাঁর চায়ের দরকার হয় না। বিকেল পাঁচটার পর থেকে কিসের তৃষ্ণায় তিনি ছটফট করেন বেবি রুণুও টের পায়। সুপ্রভা তো বটেই।
রুণু কেটলির জল পরীক্ষা করতে আর একবার ঢাকনা তুলল। কাগজ জ্বালাতে আবার হ্যারিকেনের চিমনি খুলল। অত্যধিক নাড়াচাড়ার দরুন আলোর শিখাটা কাঁপছে। সেই সঙ্গে উল্টেল্টাদিকের টিনের বেড়ায় রুণুর চুল বোঝাই প্রকাণ্ড মাথার ছায়াটা নাচছে। ঘরে টেবিল চেয়ার আলনা খাট ইত্যাদি কিছুই নেই। এ-বাড়িতে রমেশ রায় ও শেখর ডাক্তার, আর হ্যাঁ, কমলার ঘর ছাড়া অন্য কোনো ঘরে কাঠের জিনিস নেই। সুপ্রভা মেঝের ওপর একটা রাগ্ বিছিয়ে শুয়ে আছে। তার শিয়রের দিকে একটা কেরোসিন কাঠের বাক্স। বাক্সের ওপর কয়েকটা খালি টিন সাজানো। এককালে এই পরিবারে হরলিক্স্, ওভ্যালটিন, বাটার, জ্যাম, জেলি প্রচুর আসত, টিনগুলো তার নিদর্শন। শূন্য টিনগুলো যে পার্ক স্ট্রীটের বাসা থেকে বিনা কারণে বয়ে আনা হয়েছে তাও নয়। দামী বোয়ম ও অন্যান্য পাত্র বিক্রি করে দেওয়ার পর সংসারের নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিস রাখবার জন্যে এখন এগুলো ব্যবহৃত হচ্ছে। কে. গুপ্তর রুপোর বাটি গ্লাস চামচ তো বটেই, বেশির ভাগ কাঁসার বাসন-কোসনই বিক্রি করা হয়েছে। এখন একসঙ্গে রুণু, বেবি এবং গুপ্ত সাহেব যদি ভাত খেতে বসেন তবে থালা গ্লাসে কুলোয় না। আগে পরে খেতে হয়। আগে তারা টেবিল চেয়ারে বসে খেয়েছে। টেবিলে গোল হয়ে সুপ্রভা বসত, গুপ্ত সাহেব বসতেন, রুণু বসত, বেবি বসত। সকালবেলা অফিসে তাড়া থাকত বলে বেশির ভাগ রাত্রেই গুপ্ত সাহেব সকলকে নিয়ে একসঙ্গে বসে গল্প করতে করতে খেয়েছেন। সুপ্রভা নিজের হাতে বেবি ও রুণুকে কাঁটাচামচ ব্যবহার করতে শিখিয়েছিল। কাঁটা- চামচ দূরে থাক, ঘরে এখন একটা সাধারণ চায়ের চামচও নেই। বেবিকে এখন চা করতে হলে ভয়ানক অসুবিধেয় পড়তে হয়। কখনো খুন্তির ডাঁটা, কখনো বা গরম চায়ে আঙুল ডুবিয়ে বাটির দুধ চিনি মেশাতে হয়। ঘরের কাজকর্ম বেশির ভাগ এখন বেবিই করে। মাঝে মাঝে রুণু সাহায্য করে। সুপ্রভা এসব করেও না, দেখেও না। তা ছাড়া বেলায় বেলায় ভারি কিছু যে রান্না হয় তা-ও না। ভাতে ভাত ফুটানো কি ডাল সিদ্ধ করা বা রুটি করা। এসবের জন্যে সুপ্রভা আর উনুনের ধারে যায় না। অধিকাংশ সময়ই সুপ্রভার শুয়ে কাটে। তা ছাড়া কে. গুপ্তর অফিসে যাওয়ার তাড়া নেই বলে এখন যত বেলায় খুশি যদি রান্না চাপানো হয় তাতে অসুবিধা হয় না। আর প্রত্যহ নিয়মিত রন্ধনোপযোগী খাদ্য-সম্ভার ঘরে না থাকলে কাজকর্মের যে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয় এই সংসারেও সেটি বেশ ভালভাবে দেখা দিয়েছে। কদিন দেখা যায় হাঁড়িতে জল ফুটছে। টাকার অভাবে রেশন আনা হয়নি। রুণু গেছে ধারে কোথাও চাল আনতে। বেবি বনমালীর দোকানের সামনে ঘুর ঘুর করছে কখন কে. গুপ্ত সামনের বেঞ্চিটা থেকে উঠে যাবে, আর ও গিয়ে বনমালীকে এটা ওটা ধার দিতে পারে কিনা জিজ্ঞেস করবে। এমন নয় যে কে. গুপ্ত উঠে গেলে বনমালী বেবিকে বেশি ধার দেবে। ইচ্ছা না থাকলে দেবেই না এবং অধিকাংশ সময় বেবিকে বিফল মনোরথ হয়ে ঘরে ফিরতে হয়। তবু, এমনি, বিশেষ করে এ-বাড়ি আসার পর থেকে বাবার সামনে যেতেই যেন বেবির লজ্জা করে। যেন সে হঠাৎ বড় হয়ে গেছে। গুপ্ত সাহেব অধিকাংশ সময় বাড়িতে থাকেন না বলে বেবি স্বস্তিবোধ করে। রুণুর মনের অবস্থাও অনেকটা তাই। আশ্চর্য, সুপ্রভারও মেজাজ ভাল থাকে স্বামী বাড়ি না থাকলে। বেকার পুরুষ সংসারে কত অবাঞ্ছিত কে. গুপ্ত তার প্রকৃষ্ট দৃষ্টান্ত। মদ খাওয়ার জন্যে নয়। পাঁচু ভাদুড়ীও মদ শায়। কিন্তু গালিগালাজ না করলে ভাদুড়ীর-বৌ ভাদুড়ী যতক্ষণ বাড়িতে থাকে খুশিবাসি থাকে।
এবার রুণুর কেটলির জল ফুটতে আরম্ভ করে। সুপ্রভা একটা হাই তুলল। রুণু একবার উঠে বারান্দায় উঁকি দেয়। ‘বেবি এল?’ সুপ্রভা প্রশ্ন করল। ‘না।’ চৌকাঠ থেকে ফিরে এসে রুণু বলল, ওটা ভয়ানক আড্ডাবাজ হয়ে গেছে, মা। যেখানে যায় এমন গল্প জমিয়ে বসে।’ সুপ্রভা নীরব। রুণু বলল, ‘ক্ষিতীশ এই বাড়ির লোক। জানাশোনা। তার সঙ্গে গল্প করুক ক্ষতি নেই, সেদিন আমি দেখলাম সেই কোথায় রাসমণির বাজারে পালেদের মুদির দোকানে বসে আড্ডা মারছে। মদন পালের ছেলে মোহনটার সঙ্গে দিব্যি গল্প জুড়ে দিয়েছে।’
সুপ্রভা তথাপি নীরব। রুণু অনেকটা নিজের মনে বলতে লাগল, ‘এসব জায়গা ভাল না। মদন পালের ছেলে মোহনটা এই বয়সেই বিয়ে করে ফেলেছে। ওদের কি। দেদার পয়সা। লেখাপড়া করারও দরকার নেই। ক্লাশ ফোর অবধি বোধ করি পড়েনি। হাতে তিনটে আংটি। আমার চেয়ে এক বছরের বেশি বড় হবে কি? বিয়ে করে ফেলল। সিগ্রেট তো মুখে লেগেই আছে। সেদিন মোহনকে দেখলাম বাজারের একটা গলির মধ্যে ঢুকতে। গলিটা খারাপ আমি টের পেয়েছি।’
‘আঃ, কি বকর বকর আরম্ভ করলি রুণু!’ সুপ্রভা হঠাৎ ধমক দিয়ে উঠল। রুণু চুপ করল। বারান্দায় কার পায়ের শব্দ হয়। সুপ্রভা ও রুণু দু’জনকেই চকিতে কান খাড়া করে ধরে। শব্দ মিলিয়ে যায়। ঘাড় ফিরিয়ে মার দিকে তাকিয়ে রুণু আস্তে আস্তে বলে, ‘না, আমি বলছিলাম বেবিটা যেখানে যার-তার দোকানে যাচ্ছে কেন? ওর কি
বাধা দিয়ে বিরক্তকণ্ঠে সুপ্রভা বলল, ‘ওর দোষ কি? বনমালী আর ধারে কত জিনিস দেবে। সেদিন মদন পালের দোকান থেকে বেবি ধারে সরষে তেল নিয়ে এল। তোরা বসে বসে খাবি। একটা পয়সা আয় নেই। ধার-কর্জ করতে বেবিকে এখন যেখানে সেখানে যেতে হচ্ছে, আমি করব কি।’
রুণু চুপ ক’রে রইল। সেকেন্ড ক্লাসে উঠে ওর পড়া বন্ধ হয়ে গেছে। রুণু একটু অবাকই হ’ল মার কথা শুনে। এখানে এসে অবধি দুঃখ করছিল সুপ্রভা ছেলেমেয়ে দুটোর আর লেখাপড়া হ’ল না ব’লে। আজ হঠাৎ রুনুর কিছু করা না করার কথায় সে ভীষণ চমকে উঠল। চমকে মার মুখের দিকে তাকিয়ে ফের কালিপড়া লণ্ঠনটার দিকে স্থির নিবিষ্ট চোখে চেয়ে রইল। ভাবল, কেবল কি বাবা কিছু করছে না বলে মার মনে দুঃখ, সংসারে এ অনটন! রুণু এখনই চাকরি-বাকরিতে ঢুকে পড়ুক মার এই ইচ্ছে?’মা!’ মুখ তুলে রুণু আস্তে ডাকল। কিন্তু সুপ্রভা সাড়া দিলে না। রুণু টের পেল মা নিঃশব্দে কাঁদছে। মা অনেক সময় মুখ ভার করে থাকে, মন খারাপ করে থাকে। কিন্তু কাঁদতে সে এই প্রথম দেখল, দেখল না ঠিক, টের পেল। স্তব্ধ বিমূঢ় হয়ে কিশোর ভাবতে লাগল তবে তো তার আর বসে থাকা ঠিক না, যাহোক একটা কিছু চাকরি-বাকরি করে।…
‘কে?’
‘আমি।’ বলতে বলতে বেবি এসে ঘরে ঢুকল। হাতে কাঁচের গ্লাসে ভর্তি চা। গ্লাস গরম বলে বেবি ফ্রকের তলার দিকটা গুটিয়ে গ্লাসের নিচে রেখে সেটা ধরে এনেছে।
‘অনেক চা নিয়ে এলি।’ চোখ বড় ক’রে রুণু বেবির মুখের দিকে তাকায়। বিষণ্ণতা কেটে গিয়ে তার মুখের চেহারা একটু হাসিখুশি হয়ে উঠেছে। বেবি শব্দ করল না। গ্লাসটা মেঝের ওপর নামিয়ে রেখে কোঁচকানো ফ্রকটা টেনেটুনে ঠিক করতে লাগল। রুণুর ঠিক এক বছরের ছোট বেবি। তা ছাড়া বেশ বাড়ন্ত গড়ন। দেহের অনুপাতে ফ্রকটা ছোট-ছোট ঠেকছে। যেন আঁট জামা না পরে কাপড় পরলেই ওকে মানায়। এত বড় মেয়ে বেবির ফ্রক পরা নিয়ে এ বাড়িতে বেশ কথাবার্তা হয়ে গেছে। বিধু মাস্টারের স্ত্রী তো সেদিন সুপ্রভার মুখের উপর বলল, ‘মেয়ের শরীরের গড়ন ফ্রকে আর লুকানো যাচ্ছে না দিদি,–এই বেলা শাড়িটাড়ি পরতে দিন।’ সুপ্রভা কোন কথা বলেনি। বেবি এখন শাড়ি পরতে আরম্ভ করবে। এতকাল তার চিন্তায় ছিল না। ফ্রক পরে বেবি স্কুলে গেছে। বাড়িতেও ফ্রক পরেছে। সুপ্রভা বেবিকে লরেটোতে ভর্তি করে দিয়েছিল। কেবল লরেটোর ছাত্রী ব’লে নয়, পার্ক স্ট্রীটে যতদিন কাটিয়ে এসেছে, বেবি কি তার চেয়ে বড় বাড়ন্ত শরীরের মেয়েদের কোনদিন শাড়ি পড়তে দেখেছে ব’লে সুপ্রভার মনে পড়ে না। কিন্তু এটা পার্ক স্ট্রীট নয়। এটা কুলিয়া-টেংরা।’ কিন্তু মাস্টারের বৌ গম্ভীর গলায় বলছিল, ‘তা ছাড়া বস্তিবাড়ি! পাঁচ রকমের লোকের বাস, দিদি। মেয়েছেলেকে একটু রেখেঢেকে চলতে শিখতে দেওয়া ভাল।’ হয়তো অন্য সময় হলে অর্থাৎ আগের অবস্থা তাকলে সেদিনই রাগ ক’রে সুপ্রভা নিজে দোকানে গিয়ে মেয়ের জন্যে তিন জোড়া শাড়ি কিনে আনত। বিধু মাস্টারের বৌয়ের মুখ যাতে একেবারে বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু সে-অবস্থা তো নেই, আঁট ফ্রকটার বদলে একটু বড় ঢিলেঢালা ক’রে আর একটা জামা বেবিকে তৈরী ক’রে দেওয়ার সঙ্গতি আজ সুপ্রভার নেই। নিজের অক্ষমতা এবং পাঁচজনের কথা ইত্যাদির দরুণ সুপ্রভার সকল রাগ গিয়ে পড়ে মেয়ের ওপর। যেন বেবিকে দেখলেই সুপ্রভা বিরক্ত হয়ে ওঠে, আর তার বুকের ভিতর টনটন করতে থাকে। এই ক’মাসে বেবি যেন বেশি বড় হয়ে গেছে।
নিজের জন্যে একটুখানি একটা কাপে ঢেলে গ্লাশের বাকি চা সুপ্রভা ছেলেকে দিয়ে দেয়।
‘তুই একটু খাবি, বেবি?’ রুণু বোনকে প্রশ্ন করে। ‘না, আমি ক্ষিতীশদার দোকান থেকে খেয়ে এসেছি।’ বেবি রুণুর দিকে না তাকিয়ে মার দিকে তাকায়।
‘পয়সার কথা কিছু বলল ক্ষিতীশ?’
‘না তো!’ একটা ঢোক গিলল বেবি। ‘বরং বলল, তোরা বাড়ির লোক। যখন ইচ্ছে চা নিয়ে যাস, খেয়ে যাস। পয়সার দরকার হলে আমি গিয়ে মাসিমাকে বলব।’
সুপ্রভা আর কিছু বলল না। ছোট একটা নিঃশ্বাসে ফেলে চা খেতে লাগল।
‘তোর কথা জিজ্ঞেস করেছিল ক্ষিতীশদা।’ বেবি ভাইয়ের দিকে তাকায়। ‘সবাই আমার দোকানে আসে তোমার ভাইকে একদিন দেখলাম না।’
মুখের চা-টুকু গিলে রুণু জিহ্বার একটা শব্দ করল। ‘কুলিয়া-টেংরার রেস্টুরেন্ট! কত বড় দোকান ক্ষিতীশের। এসব দোকানে গিয়ে জানো মা, চা খেতে আমার এমন গা ঘিনঘিন করে।
তা করা স্বাভাবিক। শহরে বড় বড় রেস্টুরেন্ট দেখেছে ছেলেমেয়েরা। অবশ্য রুণু বা বেবিকে সুপ্রভা কোনোদিন একলা কোনো খাবারের বা চায়ের দোকানে পাঠায়নি। সবাই একসঙ্গে বেড়াতে বেরিয়েছে কি সিনেমা দেখতে গেছে। ফেরার পথে গুপ্ত সাহেব ছেলেমেয়ে এবং স্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে বড় বড় রেস্টুরেন্টে বসে খেতেন। চা খাওয়া শেষ হতে সুপ্রভা বাটিটা হাত থেকে নামিয়ে রাখল।
‘অ, তুই বসে বসে সেখানে চা-টা খেলি, তাই এত রাত হ’ল।’ রুণু বেবির চোখের দিকে তাকায়।
‘চা-টা নয়।’ কপালের চুলগুলো হাত দিয়ে পিছনের দিকে ঠেলে দেয় বেবি। ‘এক কাপ চা শুধু, আর একটা বিস্কুট। এখানকার বিস্কুট ভাল না– ‘
রুণু আর একটা কি প্রশ্ন করত, থেমে গেল। বাইরে বারান্দায় গুপ্তর গলার শব্দ শোনা গেল। ঢেকুর তুলছে। চা খেতে সুপ্রভা উঠে বসেছিল। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়ল। রুণু মাথা গুঁজে পোড়া কাগজের টুকরোগুলো পরিষ্কার করতে ব্যস্ত হয়ে উঠল। যেন হাতের কাছে হঠাৎ কোন কাজ না পেয়ে বেবি বিমূঢ় ভীত চোখে দরজার দিকে তাকায়। কিন্তু বাবা তখনি ঘরে ঢোকে না। যেন বারান্দায় ছেঁড়া মোড়াটার ওপর বসে। অন্ধকারে ছেঁড়া মোড়ার ওপর বসে কে. গুপ্ত হকিন্স আওড়াচ্ছিল : give beauty back, beauty, beauty, beauty.
অন্য ঘরের বাসিন্দারা তখন ঘুমোয়নি। গড়গড়া টানতে টানতে শেখর ডাক্তার নিম্নকণ্ঠে স্ত্রীকে বলল, ‘সাহেব আজ পুরো একটা পাঁইট ঢেলে এসেছে, মেজাজ খুলেছে। কবিতা আওড়াচ্ছে শোন।‘
বিধু মাস্টারের বৌ স্বামীকে বলছিল : পয়সা নেই, হাঁড়ি চড়ে না ঘরে, কিন্তু মিনসের গলা কোনদিন শুকনো থাকে না। আজ আবার কোথা থেকে খেয়ে এল।’
‘এরা হ’ল উদ্যোগী লোক।’ বিধুমাস্টার চাপা গলায় হেসে স্ত্রীর কথার জবাব দেয়। ‘বনমালীর দোকান থেকে উঠে একলা খালের দিকে যাচ্ছিল তখন দেখলাম। শেষ অবধি কোনো মক্কেল জুটিয়েছে আর কি।’
‘হাইলি এডুকেটেড। তা ছাড়া ভাল ঘরের ছেলে।’ চাপা মৃদু গলায় শিবনাথ রুচিকে বলছিল। ‘এই হ’ল ফ্ৰাশট্রেশান। করবার ইচ্ছা ছিল, ক্ষমতা ছিল, কিন্তু কিছুই হ’ল না; শেষ পর্যন্ত সব আশা আকাঙ্ক্ষা ধূলিসাৎ হ’ল। তাই না ওর এ-অবস্থা।’
‘তোমার তো চাকরি নেই, গুপ্ত সাহেবের মত বেকার হলে। মনের দুঃখে মদ ধরবে নাকি।’ রুচির ঠাট্টার সুর। ‘পাশাপাশি ঘরে রয়েছ। ছোঁয়াচ লাগতে কতক্ষণ।’
‘পাগল।’ শিবনাথ পাশ ফিরে শোয়। ‘মদ খাওয়ার লোক অন্যরকম, তাদের জাতই আলাদা।’
রুচি আবার কি বলতে যাচ্ছিল থেমে গেল। দশ নম্বর ঘরের পুরুষেরা গলা। একশ দিন বলেছি তোমায়। বদমায়েসটা যখন বারান্দায় বসে থাকে রাত্রে তুমি বাইরে যাবে না।’
‘আমি কি জানতুম বেবির বাবা অন্ধকারে ওখানে ব’সে আছে।’ স্বামীর কাছে ধমক খেয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল কিরণ। ‘আমি তো রোজ বলি তোমাকে বাড়ি ছেড়ে দাও।’
‘যখন ছাড়বার ঠিকই ছাড়ব। কিন্তু তোমার চলাফেরা সংশোধন কর।’ বৌয়ের ওপর ভয়ানক চটে গেছে অমল। রাগে অন্ধকার ঘরে তর্জন-গর্জন করছে। ‘একশ দিন বলেছি রাত্রে বাইরে গিয়ে কাজ নেই। জায়গা ভাল না। একটা অতিরক্তি হাঁড়ি পর্যন্ত কিনে আনলাম সেদিন। কিন্তু কথা মোটেই কানে ঢোকে না তোমার, কেমন?’
যেন কিরণ আর কিছু বলছে না। তার কান্নার ফোঁপানি শুধু শোনা যায়।
তিন নম্বর ঘরে স্ত্রীলোকের হাসির শব্দ শোনা গেল। বিধু মাস্টারের স্ত্রী লক্ষ্মীমণির গলা। তা যত অনুচ্চ স্বরে কথা বলুক লক্ষ্মীমণির প্রত্যেকটি বচন বস্তির সব ঘরের বাসিন্দাই পরিষ্কার শুনতে পেল : ‘খেতে দিতে পারিস না, পরনের কাপড় নেই, বৌয়ের শাসনের বহর দেখ। পুরুষ কেউ বারান্দায় উঠোনে থাকলে বৌকে রাত্রে পায়খানায় প্রস্রাবখানায় যেতে দিতে আপত্তি, ফুটোনি কত!
‘ছোকরার খুঁতখুঁতে মন। এসব লোকের উচিত পরিবার নিয়ে আলাদা ফ্ল্যাটবাড়ি ভাড়া ক’রে থাকা।’ লক্ষ্মীমণির স্বামী বিধু মাস্টারের উপদেশাত্মক মন্তব্য শোনা যায়।
‘ফ্যালেট বাড়ি!’ আর এক ঘরে বিকৃতস্বরে কে মন্তব্য করে : ‘ছাল নাই কুকুরের বাঘা নাম। হপ্তার রেশন আসে না, ঘরভাড়া আটকে গেছে, সে-লোক কিনা আলাদা বাড়ি আলাদা ঘরে গিয়ে থাকবে বৌ নিয়ে, তবেই হয়েছে।’
রুচি বুঝতে পারল মন্তব্যটা রমেশ-গিন্নীর। একটু আগে আটা নিয়ে কিরণের সঙ্গে যিনি কোঁদল ক’রে এসেছেন। কিন্তু এত সব মন্তব্য শোনা সত্ত্বেও, রুচি অবাক হ’ল, অমল চুপ ক’রে থাকেনি। অনর্গল সে বৌকে শাসাচ্ছে. ‘এম-এ, বি-এ পাস করিনি ব’লে কি বিউটি কথার মানে আমি বুঝি না, অ্যা,–তোমায় দেখলেই ওই শালা এসব বলে কেন আমায় বোঝাতে পার! : আরো দশটা মেয়েছেলে তো আছে এবাড়ি, কই আর কারো বেলা তো শালা এসব বলে না, কি বল, চুপ ক’রে আছ কেন, এ-প্রশ্নের সদুত্তর দিতে পার তুমি অ্যাঁ?’
স্ত্রীকণ্ঠ নীরব। কান্নার শব্দও আর শোনা যাচ্ছে না। এধারের বারান্দায় একলা অন্ধকারে ব’সে কে. গুপ্ত তখনো অবিশ্রাম হপকিন্স আওড়াচ্ছে : Beauty… মশার কামড়, রাত্রির হিম, এঘর ওঘরের কটূক্তি, কিছুই তাকে নিবৃত্ত করছে না। সুপ্রভা সব দেখছে শুনছে, কিছু বলছে না। দারিদ্র্যের প্রথম অবস্থায় হিম ও শিশিরের ফোঁটাকে সে ভয় করত। কিন্তু যখন দেখলে সমুদ্রে তার শয্যা বিছানো হয়েছে তখন আর এসবে সে ভয় করে না। আগে স্বামীর যেটুকুন উচ্ছৃঙ্খলতা ছিল তা বাড়ির বাইরে থেকে যেত, বাড়িতে এলে সেটা আর প্রকাশ পেত না। এখন ঘর বাইর সমান ক’রে ফেলেছে গুপ্ত। কেবল কি স্বামী, এতবড় মেয়ে বেরি ধারে দু’পয়সার নুন আনতে, একটু চা খেতে রাতদিন হন্যে কুকুরের মত এখানে ওখানে ঘুরছে দেখে সুপ্রভা চুপ করে আছে, চোখ বুজে আছে। হাল ভেঙ্গে গেলে নৌকা স্রোতের টানে ভেসে যায়, তলিয়ে যায়, এ তো জানা কথা। সুপ্রভা প্রতিবাদ করবে কার বিরুদ্ধে, কিসের বিরুদ্ধে?
৬
‘পাখি সব ক’রে রব রাতি পোহাইল নয়’, শিশুদের কলরবে এখানে রাত্রি প্রভাত হয়। যে-ঘরের শিশুরা পেটপুরে খেয়ে ঘুমিয়েছিল সকালে উঠে আবার খাবে বলে তারা চিৎকার করতে থাকে। যে-ঘরের শিশুরা রাত্রে অভুক্ত থেকেছিল, রাত ভোর না হতে তারা তো কাঁদবেই। আর সেই কান্না থামবার জন্য চলে কিল চড় চোখরাঙানি। ঘরে ঘরে চিৎকার প্রবল এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়। কিন্তু খেয়ে ঘুমোক কি না খেয়ে রাত কাটাক, সকালে চোখ মেলার সঙ্গে সঙ্গে যাতে বাচ্চারা খাওয়ার কথা ভুলে থাকে তার একটা সুন্দর উপায় আবিষ্কার করেছে বিধুমাস্টারের স্ত্রী লক্ষ্মীমণি। হাজার রকমের ছড়া তার মুখস্থ। ‘নোটন নোটন পায়রাগুলি ঝোটন বেঁধেছে; ‘হাট্টিমা টিম টিম তারা মাঠে পাড়ে ডিম’; গর্ধভ সাইকেলে চড়ে বর্ধমান যায় ইত্যাদি হাল্কা ছড়া থেকে আরম্ভ করে আজি এ প্রভাতে রবির কর কেমনে পশিল প্রাণের পর অথবা দেশ দেশ নন্দিত করি সন্দ্রিত তব ভেরী প্রভৃতি গুরুগম্ভীর গান, কবিতা লক্ষ্মীমণির ছেলে-মেয়েরা সুন্দর গাইতে পারে, আবৃত্তি করতে পারে। লক্ষ্মীমণি আগে আগে বলে যায়, সন্তানেরা মাকে অনুসরণ করে। এমন কি যে শিশুটি কথা বলতে পারে না, সেটিও মার বুকের দুধ খাওয়া ভুলে গিয়ে ভাইবোনদের মতন আওড়ায় আ টিম টিম দিম দির্ঘ…
তারপর একটু ফরসা হতেই লক্ষ্মীমণি শয্যাত্যাগ করে। বলতে কি এবাড়িতে সকলের আগে বিধ মাস্টারের স্ত্রী ঘরের দোর খুলে বেরিয়ে উঠোনে নামে। ততক্ষণে ঝাঁটা হাতে মেথর এসে গেছে। এবং উঠোনে কেউ জল দিক না দিক তার জন্য অপেক্ষা না করে দড়ি-বালতি নিয়ে লক্ষ্মীমণি পাতকুয়ার দিকে ছুটে যায়, তারপর বালতি বালতি জল এনে উঠোনে নর্দমায় ঢালতে থাকে আর চড়া গলায় মেথরকে হুকুম দেয় এ জায়গা সাফ কর, ওখানে শ্যাওলা জমেছে ভাল করে ঝাঁটা মার, উঁহু হল না, ময়লা রয়ে গেছে এধারটায়। জল ঠালতে লক্ষ্মীমণির এতটুকু আলস্য নেই। বরং এ-কাজে তার উৎসাহ বেশি। অথচ পালা করে সব ঘরের বৌ ঝি-র এক- দিন একদিন মেথর এলে বাড়ির উঠোনে নর্দমায় জল ঢালার কথা। কাল রমেশ গিন্নীর জল ঢালার পালা ছিল। কিন্তু আলস্যবশত হোক কি পায়ে একটু বাতের জোর হয়েছিল বলে হোক তিনি বেলা না হওয়া তক শয্যা ছেড়ে উঠেন নি। তাই বলে উঠোন ধোয়ানো বাকি থাকে নি, লক্ষ্মীমণিই বালতি বালতি জল ঢেলে সে-কাজ করিয়েছে। আজ জল ঢালার পালা কমলার। কিন্তু কমলার ঘুম ভাঙ্গছে না। মেথর এসে ডাকাডাকি করতে লক্ষ্মীমণির আর শুয়ে থাকা হয় না। অর্ধেক উঠোন ধোয়ানো হয়ে যাবার পর দোর খুলে বেরিয়ে আসে কমলা। হাতে টুথ ব্রাস, তোয়ালে সাবান। লক্ষ্মীমণি জল ঢালছে দেখে কমলার মুখখানা হাসিতে ভরে ওঠে, ‘আহা, আমার উঠতে দেরি হয়ে গেল। দিদি আজও জল দিচ্ছেন।’
‘তাতে কি।’ সবগুলো দাঁত বার করে লক্ষ্মীমণি হাসে। ‘আর একদিন ঢালবেন, আজই তো জল ঢালা শেষ হল না। আজ না হয় আমিই ধুইয়ে দিলাম।
‘সত্যি দিদির একাজে আলস্য নেই।’ কমলা উঠোনে নেমে আসে। ‘আজ সকালে আমার এখানে আপনার চা খাওয়ার নেমন্তন্ন রইল।’
‘আহা, একটুখানি জল ঢেলেছি কি না ঢেলেছি তো আবার,–বেশ, নেমন্তন্ন করেছেন যখন সেটা রক্ষা করবই। আমার এত গুমোর নেই। আমি সকলের ঘরেই যাই, সবার সাথে মিশি।’
‘তা কি আমি জানি না, তা কি আর চোখে দেখছি না।’ কমলা মুখে দাঁতন গুঁজল। ‘আমি এক্ষুণি মুখ ধুয়ে এসে স্টোভ ধরাচ্ছি। চট্ করে জলটা ঢেলে দিয়ে আপনিও মুখ-হাত ধুয়ে আসুন।’
‘মতলববাজ, ভয়ানক ফাঁকিবাজ মেয়েটা।’ শিবনাথ রুচির দিকে তাকিয়ে নিচু গলায় হাসে। রুচি বলে, সংসারের নিয়মই তাই। কৌশলে মানুষ মানুষকে দিয়ে কাজ করিয়ে নেয়। এক কাপ চা খাওয়ার নেমন্তন্ন করল, তার মানে আর একদিন জল ঢালার পালা এলে আবার বেলা করে শয্যা ত্যাগ করবে, তারপর উঠোন ধোয়ানো শেষ হলে দোর খুলে বেরিয়ে এসে হেসে বলবে, ‘দিদি আহা, এ কি করছেন। যাকগে, আপনার সকালের চা-টা আমার এখানেই হবে।’
একটা চোখ বুজে শিবনাথ আরো জোরে মাথা নেড়ে নিঃশব্দে হাসে, ‘যা বলেছ। তুমিও ঐ করবে। বাব্বাঃ, এত বড় উঠোনে বালতি বালতি জল ঢালতে হলে হয়েছে আরি কি। তার চেয়ে যদি এক বাটি চা ঘুষ দিয়ে ডিউটিটা মাস্টারের বৌয়ের ঘাড়ে চাপাতে পার,–মন্দ কি। রুচি কথা বলল না স্বামীর প্রস্তাবটা সে অনুমোদন করতে পারছে না। মুখের এমন ভান করে দরজার ফাঁক দিয়ে লক্ষ্মীমণির জল ঢালা দেখতে লাগল। শিবনাথ ঘাড় বাড়িয়ে রুচির কানের কাছে মুখ নিয়ে বলল ‘ছেলেমেয়ে হবে মহিলার।’
‘হুঁ। রুচি মুখ না সরিয়ে উত্তর করল, ‘দেখতেই তো পাচ্ছ।’
‘সাত আট মাস এটা ওঁর। তার কম হবে না, কি বল?’
রুচি শিবনাথের কথার জবাব দিলে না।
শিবনাথ স্ত্রীর কানের কাছ থেকে মুখ না সরিয়ে গুজগুজ করে হাসল। ‘সাংঘাতিক মেয়ে, বাবা! এ সময়েও এত জল ঢালতে পারে।’
‘কি করবে, আর কেউ উঠোনে জল দেয় না দেখে ওকেই ঢালতে হচ্ছে, উপায় কি! উঠোন ধোয়ানো তো আর ফেলে রাখা যায় না।’
‘আহা সে কথা হচ্ছে না।’শিবনাথ অবশ্য হাসি বন্ধ করল না। ‘বলছিলাম এই অ্যাডভান্সড স্টেজে এমন পরিশ্রম সবাই করতে পারে না। এত বড় উঠোনে জল ঢালা কি মুখের কথা!
রুচি নীরব।
‘বস্তির মেয়েরা এসব কাজ খুব পারে। পুঁই মূলোর ঘণ্ট খেয়েও গায়ে কেমন জোর রাখে দ্যাখো।’
রুচি চোখ বড় ক’রে শিবনাথের দিকে ফিরে তাকাল। একটা বিস্ময়, একটা বেদনা সেই চোখে। কিন্তু তা ছাড়াও আর একটা জিনিস ছিল রুচির তাকানোর মধ্যে। ভর্ৎসনা। শিবনাথ সেটা ধরতে পারল কি। তখনো সে দাঁত বার ক’রে হাসছে। অগত্যা চোখের ধার কমিয়ে রুচিও বেশ একটু মোটা ক’রে হাসল। ‘ভালই তো হ’ল। আস্তে আস্তে এখানে থেকে আমার গায়েও এমন জোর আসবে, এদের মত শক্তসমর্থ হয়ে উঠব।’
এবার শিবনাথ ফ্যালফ্যাল্ চোখে স্ত্রীর দিকে তাকাল। ‘কিন্তু তাই বলে তুমি তো আর ছেলেমেয়ে পেটে ধরছ না। তুমি প্রমিজ করে বসে আছ ওই একটিই যথেষ্ট, আর না। কাজেই তোমার এ-অবস্থা আর হবার ভয় নেই। ‘
রুচি নীরব। স্থির চোখে বাইরের দিকে তাকিয়ে রইল।
তা ছাড়া এখানে এই বাড়িতে যে আমরা চিরকাল থাকতে এসেছি তা-ই বা তোমাকে কে বললে। বলছি তো আমার একটা সুবিধা হলেই–’
‘লক্ষ্মীমণির স্বামীও ছ’বছর ধরে চেষ্টা করছে এখান থেকে নড়তে। পারেনি।’ অতি সংক্ষেপে অত্যন্ত স্পষ্ট গলায় কথাটা বলে রুচি শয্যাত্যাগ করল। মঞ্জুর ঘুম ভেঙ্গেছে। কাঁদছে না ঠিক। চোখ ছলছল করছে, পাশের কোন্ ঘরের উনোনের ধোঁয়া গলগল ক’রে এঘরে এসে ঢুকে চোখ কানা করে দিচ্ছে। ধোঁয়ায় ওর চোখে জল এল বুঝি।
‘ডেন’–মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে হঠাৎ যেন অসহায় চাপা গলায় শিবনাথ গর্জন করে উঠল। ‘এই নরকে বেশিদিন বাস করলে টি. বি. না হয়ে যায় না। যত শীগগির সম্ভব আমাদের আমাদের এখানকার আস্তানা গুটোতে হবে।’
‘কিছু হবে না।’ রুচিও উনুনে আঁচ দেবার উদ্যোগ আয়োজন করছিল। ‘থাকতে থাকতে সব সয়ে যায়। এখানে আর দশটি শিশুর মত মঞ্জুরও ধোঁয়াটোয়া সয়ে যাবে।’
রাগ ক’রে রুচি কথাগুলো বলেছে কি না মঞ্জুকে কোলে নিয়ে হাত দিয়ে ওর চোখ মোছাতে মোছাতে শিবনাথ ভাবে।
.
আর এবাড়িতে নতুন ভাড়াটের সঙ্গে যেচে সকলের আগে আলাপ পরিচয় করে লক্ষ্মীমণি। কাল নিতান্তই পথে পরিচয় ক’রে কমলা আগে ভাগে রুচির ঘরে ঢুকে জমিয়ে ফেলেছিল, কতকটা এই কারণে, আর সারাক্ষণ শিবনাথ রুচির প্রায় গায়ের সঙ্গে লেগেছিল ব’লে লক্ষ্মীমণি ওধারে ঘেঁষেনি।
না হলে পরিচয় করতে আলাপ জমাতে লক্ষ্মীমণি সকলের চেয়ে বেশি ওস্তাদ।
দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পর শিবনাথ একটু বেরিয়েছে কি লক্ষ্মীমণি ভিজা কাপড়ে রুচির ঘরে এসে ঢুকল। ‘আমার সংসারের খাওয়া-দাওয়া শুরু ও শেষ হ’তে সেই বেলা তিনটা। বলে কিনা রাবণের ঝাঁক।’
আলাপের শুরুতেই বিধু মাস্টারের বৌ হাসল। ‘দিদির ছিমছাম সংসার দেখলে চোখ জুড়ায়।’
বিছানায় সবে একটু কাত হয়ে শুয়ে মঞ্জুকে ঘুম পাড়াতে পাড়াতে রুচি একটু ঘুমের চেষ্টা করছিল। কাল জিনিসপত্র টানা-হেঁচড়া পথের কষ্ট, এখানে এসেই আবার নতুন ক’রে সব গুছানো সাজানোয় রুচি ক্লান্ত হয়ে পড়েছে। এরকম হবে ও জানে। তাই স্কুলে বাড়ি বদলের জন্য পুরো দু’টো দিনের ছুটি চেয়ে নিয়েছে।
হেসে রুচির ঠোঁটের দিকে একটু সময় তাকিয়ে থেকে লক্ষ্মীমণি বলল, ‘দিদির পান খাওয়ার অভ্যেস নেই?’
‘না।’ সংক্ষেপে উত্তর ক’রে বেশ সতর্ক চোখে রুচি তিন নম্বর ঘরের প্রতিবেশিনীকে দেখতে লাগল। গর্ভবতী স্ত্রীলোকের দিকে প্রথমটায় সব মেয়েই যেমন সতর্ক ভয়ে তাকায়।
‘কি দেখছেন?’
রুচির দেখা শেষ হয়ে গেছে এমন একটা সময় অনুমান ক’রে লক্ষ্মীমণি খুক্ করে হাসল।
‘আগো দিদি, হাসিও পায় দুঃখও লাগে। কিন্তু করব কি। বলে কিনা, কর্তার ইচ্ছায় কর্ম, স্বামী মোদের ধর্ম।‘
মেয়েমানুষ রুচির, তাই ওই একটা প্রসঙ্গেই অন্তরঙ্গতা নিবিড় হয়ে উঠেছে ভেবে তেমনি খুকখুক ক’রে হাসতে হাসতে লক্ষ্মীমণি মাথাটা নুইয়ে উপবিষ্ট রুচির মাথার সমান্তরালে এনে ফিসফিস করে বলল, ‘কি ক’রে পারেন বোন, সত্যি আপনাদের দেখলে দেবতা মনে হয় কিন্তু কি করব। সংসারে তরী চালাবার হাল যার হাতে, সে যদি অবুঝ হয় তো আমি স্ত্রীলোক করব কি, করবার কে। আসে আসুক? বার্লি খেয়ে বাচ্চা বড় হচ্ছে দেখতে যদি অসাধ্য না লাগে, হোক না একটার পর একটা। এই নিয়ে আমার তেরো বার গর্ভ হ’ল। বয়েস? আমি আপনার চেয়ে বড় হব না দিদি।’
যেন কথার শেষে হঠাৎ একটা দীর্ঘনিশ্বাস শুনল রুচি। চমকে নবপরিচিতার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখল সত্যি সেখানে হাসি নিভে গেছে, মেঘলা আকাশের মত মুখখানা করুণ থমথমে।
‘আপনি বসুন।’ এই এতক্ষণ পর রুচি যেচে আলাপ করতে আসা ভদ্রমহিলাকে বসতে বলল।
‘না দিদি, বসব না। নেয়ে এলাম, ভিজে কাপড় পরনে।’
দেখা গেল সেসব ভাবনা ধরাবাঁধা সৌজন্যতার পালিশ রক্ষার মাথাব্যথা বিধু মাস্টারের স্ত্রীর তিলমাত্র নেই। সহজ ঠাণ্ডা হাসি হেসে মুখের গুমোট মেঘটা কাটিয়ে দিয়ে বলল, ‘দিদির ওই একটি মেয়েই বুঝি। সাত বছরে পা দেবে দেখে বেশ মনে হ’ল। আর বুঝি চান না?’
রুচি গম্ভীর হয়ে চুপ করে রইল।
এবার যেন লক্ষ্মীমণি একটু সতর্ক হ’ল। এবং সেভাবেই আলাপটা গড়াতে দিলে। ‘খাওয়া- দাওয়া হয়ে গেছে আপনার?
‘হ্যাঁ।’ রুচির মাথা নাড়ল এবং চুপ করে রইল।
‘কর্তা আপিসে বেরোলেন বুঝি?’
‘হ্যাঁ।’ রুচি মিথ্যা কথাই বলল।
‘আপনাদের রেশন কার্ড করিয়েছেন?’
‘না।’ রুচি বলল, ‘এদিকে শুনছি ব্ল্যাকে খুব চাল পাওয়া যাচ্ছে?’
‘জানি না দিদি।’ আলাপটা বড় বেশি ঘষামাজা। পরিচয়ের মধ্যে ফাঁক রাখতে চাইছে অনুমান করে লক্ষ্মীমণি চেহারা কেমন অপ্রসন্ন করে তুলল।
‘মাস্টার মানুষ। সরল সিধা লোক। ব্ল্যাক-ফ্ল্যাক জানেও না। যাবেও না এই পথে। ঠিকা ঝিকে পাকা ঝি নাম লিখিয়ে দশখানা রেশন কার্ড করিয়েছি। ঠিকে ঝি-ও অবশ্য বেশিদিন রাখতে পারলাম না দিদি। একলা হাতে এখন সব করি। তা কি বলছিলাম। হ্যাঁ রেশন। না ব্ল্যাক কেন। দশখানা কার্ডের সব চাল আনলে আমার সংসার খেয়ে তুষ্ট থাকে। কর্তা নিয়মের বাইরে পা বাড়ান না। সেই দশখানা কার্ডের সব চাল কেনবার টাকা কি আমাদের মত গরীব লোকের ঘরে সব সময় থাকে দিদি। দু’হপ্তা পুরো রেশন আনি, দু’হপ্তা অর্ধেক। তাই তো বলছি, খুব কাজের কথা দিয়ে আলাপটা আরম্ভ করেছিলাম দিদি, খুব বেঁচে গেছেন। আমাদের মত লোভী বেড়াল নন যে ভাজা খাবার আশায় আশায় বার বার গরম কড়ায়ের দিকে জিভ বাড়াবেন, আর জিভ পুড়িয়ে কালো করবেন। স্বামী-স্ত্রীর জীবন কি আর সুধার ভাণ্ডার আছে দিদি, পোড়ার যুদ্ধের আগুন লেগে সেই যে হাঁড়ি গরম হয়ে আছে আর ঠাণ্ডা হচ্ছে না। ছেলেমেয়ে কম থাকলে বা ছেলেমেয়ে না থাকলে ঘরদুয়ার ঝলমল করে; কত ভাল লাগে দেখতে জামা-কাপড়, জুতো-গামছা, বাসন-কোসন, বিছানা পাটি। কি নাম আপনার খুকুর? হ্যাঁ, মঞ্জু। খুকির বাবাকে তখন ডাকতে শুনলাম।’ একটু থেমে লক্ষ্মীমণি বলল, ‘খুকির বাবা কোন আপিসে চাকরি করেন দিদি?’
রুচি একটা মিথ্যা আপিসের নাম বলল ও চুপ ক’রে রইল।
খুব বেশি না, তবু খানিকটা সতর্কভাবে পা বাড়াবার মতন ক’রে লক্ষ্মীমণি বলল, ‘আমাদের কর্তা আর আপনার কর্তা বয়সে খুব বেশি বেশকম হবে না। তখন আমার বড় মেয়ের কামিজটায় সাবান মাখাতে পাতকুয়ায় যেতে যেতে দেখলাম। একটা আধটা চুল পেকেছে কানের ধারে। কেমন দিদি, আপনার ওঁর বয়েস পঁয়ত্রিশের ওপরে গেছে–খুব ভুল আন্দাজ করলাম কি।’
শিবনাথের বয়স যথার্থ আন্দাজ করতে কৃতকার্য হয়েছে আশ্বাস দিয়ে যেন একটু করুণা ক’রেই রুচি মহিলাকে প্রশ্ন করল, ‘কোন হসপিটালে যাচ্ছেন? ধারে-কাছে রাত-বেরাতে বেড খালি পাওয়ার সুবিধা আছে তো?’
‘তা দিদি থাকেই।’ এবার গালভরা হাসি হেসে লক্ষ্মীমণি আন্দাজে ঢিল ছোঁড়ার মতন হঠাৎ মুহূর্মুহূ দু-তিনবার রুচির আপাতমস্তক নিরীক্ষণ করল। পরে যেন কিছুটা হতাশ হয়ে বলল, ‘না থাকলেও ওরা ক’রে দেয়। কংগ্রেসের আমলে আমার তো মনে হয় দিদি অই একটা বিষয়ে সুবিধা হয়েছে। ফেরায় না কাউকে। খাট খালি না থাক, মেঝেতে শুতে দেবে। দেশী লোক এখন সব হাসপাতালে হাসপাতালে কাজ করে, নার্স চৌদ্দ আনা বাঙালী মেয়ে। মার ব্যথা বোনের ব্যথা ওরা বোঝে। মাছ দেয় না এখন আর, তবু পেট ভরে তিনদিন বিউলি ডাল পুঁই শাক খাওয়ায়। গরীব দেশ, পারবে কোথায় মাছমাংস খাওয়ার্ডে। শুনি তো বলাবলি করে সব। আর তিন দিনেই খালাস দেয়। তা দিদি, আমার ত মনে হয় ভাল করে ওটা। সাতদিন ধরে রাখলে আমাদের কত লোকের সংসারে এদিকের কি হত? আমার রাণী যখন হয়, মমতা সাত বছরের। ও পারে নিচের ছোট ছোট পাঁচটা ভাই-বোনকে সামলাতে? তবু তো কর্তা সাতদিন ইস্কুলে ছুটি নিল। নিজের হাতে রাঁধল বাড়ল, অজয়কে শশাঙ্ককে হিরণকে নীলিমাকে রোজ দুপুরবেলা নাওয়াল খাওয়াল, নিজে ঘুমিয়ে ওদের ঘুম পাড়াল। রাত্রে পারেনি, রাতে ট্যুইশনি ছিল। তখন মমতা একলা হাতে সব করেছে, গুছিয়েছে। এদিক থেকে আমি সুখী দিদি। বরং কর্তা যদি আর ক’টা দিন বেশি ছুটি পেত, দিন পনরো হাসপাতালে পড়ে থাকতেও আমার খারাপ লাগত না। আ, চারিদিকে খালি ট্যাঁ ট্যা ট্যা ট্যা–সে এক মজা দিদি,–সেই এক দৃশ্য! আর নার্সদের ধমক। চুপ করান শিশুকে, বাচ্চা সামলান। শিশু পেটে নেই আপনার এখন মনে রাখবেন। হাত পা অসাবধানে নাড়াচাড়া করলে, হুঁশ না রেখে ঘুমোলে শিশুর কি অবস্থা হয়, কাল সকালে উঠে দেখবেন। চ্যাপটা হয়ে দলা পাকিয়ে একেবারে আসি।’ বলে হঠাৎ খিলখিল করে হাসতে হাসতে প্রায় রুচির গায়ের ওপর ঢলে পড়ে লক্ষ্মীমণি। কিন্তু রুচি তা হতে দিলে না। খাট ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল। তার কারণও ছিল। ঘরে আর দুটি মেয়ে এসে ঢুকেছে। কমলা আর প্রীতির ছোট বীথি। দুজনকে দেখে লক্ষ্মীমণিরও হাসি এবং কথা হঠাৎ একসঙ্গে বন্ধ হয়ে গেল।
‘আমরা শুনেছি। আর চুপ থাকছেন কেন।’ যেন চোখ বড় ক’রে কমলা নার্স বিধু মাস্টারের স্ত্রীকে শাসালো।
‘কেবল হাসপাতাল আর হাসপাতলের গল্প। ছেলে হওয়া আর বাচ্চা হওয়ার ঘ্যানঘ্যানানি। বাপরে বাপ, হাসপাতালে গিয়ে গিয়ে আর সাধ মেটে না!’
বীথি ঠিক শাসালো না। খোঁচা দিলে। মেয়েটিকে দেখে রুচির মনে হ’ল উনিশ-কুড়ি হবে বয়স। পরনের কাপড়টা একটু ময়লা। কিন্তু তা হলেও বেশ টেনেটুনে ঘুরিয়ে পরা। সবুজ অঁচলটা পিঠ থেকে আলগা হয়ে কাঁচা কচি ধানের ছড়ার মতন ঝুলছে। যেন আঁচল ঝুলিয়ে কথা কওয়াতেই ওর আনন্দ। তাই কথার সঙ্গে কোমরটা ঈষৎ আন্দোলিত করছিল মেয়েটি। খুব মৃদুভাবে প্রায় দেখা যায় না মতন করে। রুচি দেখল, বিধু মাস্টারের স্ত্রী দেখল না। কেন না বীথির কথার খোঁচায় লক্ষ্মীমণি সেই যে মাটির দিকে চোখ নামাল, আর চোখ তুলতে পারলে না। ‘আপনাদের মতন মূর্খ মায়েরা এখনো অনেক অনেক আছেন বলে এ-জাতটা আজ ভাল হাতে ডুবছে। আজ ভারত স্বাধীন হয়েছে। স্বাধীন দেশ। গলা ফাটিয়ে চিৎকার করলে কি হবে। কুড়িতে পা দিতে ছটির মা হওয়া, ছিঃ।
বলতে বলতে বীথি নিজেই লক্ষ্মীমণির কাছ থেকে তিন হাত দূরে, অর্থাৎ টিনের বেড়াটা ঘেঁসে দাঁড়াল, একটা ক্যালেন্ডারের সঙ্গে গাল ঠেকিয়ে।
‘বীথির বাড়াবাড়ি এটা। বেশি পাকামি।’ কমলা একটু ধমকের সুরে বলল, শত হলেও তিনি তোর মার বয়েসী। তোর মা আর লক্ষ্মীদি সমান হবে।’ কথাটা বলে ফেলেই অবশ্য কমলা ঠোঁট টিপে হাসে আর আড়চোখে লক্ষ্মীমণিকে একবার দেখে রুচির দিকে তাকায়। কিন্তু রুচি গম্ভীর। রুচি লক্ষ্য করল লক্ষ্মীমণির মুখ পাংশু হয়ে গেছে। মহিলার জন্য রুচির কেমন কষ্ট হ’ল। একটু পর তিনি আস্তে আস্তে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন।
‘আহা, সেজন্য কি আর মাকে আমরা কম কথা শোনাই।’ ভুরু উঁচিয়ে ঠোঁট বেঁকিয়ে বীথি তখন কমলাকে বলছে, ‘দিদি আর আমি রাতদিন বলছি, কী দরকার ছিল আমাদের এতগুলো ভাইবোন দিয়ে, কী লাভ হ’ল চারগণ্ডা ছেলেমেয়ে সংসারে এনে। গায়ের কাপড় নেই, পেট ভরে খেতে পারছে না। এসব মূর্খতা ছাড়া আর কিছু না।’
এবার কমলাও গম্ভীর
একটু চুপ থেকে বীথি বলল, ‘যাকগে, আমার কাজের কি করলে কমলাদি বলো, সেজন্যই তোমাকে ডেকে নিয়ে এলাম। মার সঙ্গে আজ সকালেও খুব ঝগড়া করলাম।’
‘কেন?’ কমলা বীথির চোখে চোখ রাখল।
‘দিদি যে-টাকা ঘরে আনে তাতে তেরো দিনের বেশি চলে না। তারপর থেকে সারা গুষ্টি উপোস চলে। মা বলছিল আমাকে একটা কাজে ঢুকে পড়তে। বললাম, ট্রেনিংয়ে আছি, আর মাস চার বাকি আছে। কিন্তু ঐ যে বলে রাঁধতে সয়, বাড়তে সয় না। আমাদের অবস্থা’ তাই। চার মাস অপেক্ষা করার উপায় নেই। মার ইচ্ছা আজই আমি কোন আপিসে-টাপিসে ঢুকে পড়ি।’
‘কেন, প্রীতি পারলে না তোকে ওর আপিসে ঢোকাতে। অনেকদিন তো ও টেলিফোনে আছে।’
‘টেলিফোনে শীগগির ছাঁটাই আরম্ভ হবে শোননি বুঝি? এখন আর নতুন লোক নিচ্ছে না। তা ছাড়া–’ বীথি হঠাৎ থামল।
‘কি বল্ ‘
‘আমি ম্যাট্রিক পাস নই তুমি জানো, সেজন্যেই আরো বেশি অসুবিধা হচ্ছে। আপিসে ঢুকতে কি আর আমি চেষ্টা কম করছি। মা সেসব জানে না, বাড়িতে ব’সে থেকে দেখে না। ভাবলাম, এমনি যখন সময় যাচ্ছে, তার চেয়ে বিনি পয়সায় গুরু ট্রেনিংটা নিয়ে রাখি। টাইপরাইটিং শিখতে পারতাম, কিন্তু তা শিখতে পয়সা লাগে।
‘কত আর পয়সা লাগে’কথাটা প্রায় বলতে বলতে কমলা থেমে গেল, ছোট্ট একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, ‘দেখি আমি তোর জন্যে চেষ্টা করছি, সুবিধা হচ্ছে কোথায়।’ যেন হঠাৎ প্রসঙ্গটা চাপা দিতে কমলা রুচির দিকে তাকিয়ে অল্প হাসল, ‘আপনার আজ ছুটি?’
রুচি মাথা নাড়ল।
‘খাওয়া-দাওয়া শেষ?’
রুচি মৃদু হেসে ঘাড় নেড়ে বলল, ‘বসুন।’
কিন্তু কমলা বসল না। ঘুরে ঘুরে ঘরের জিনিসপত্র দেখতে লাগল। ‘ও, আপনিও এই সাবান গায়ে মাখেন?’ঘরে সেল্ফ নেই। একটা কাঠের বাক্সের ওপর পুরোনো খবরের কাগজ বিছিয়ে রুচি তেলটা সাবানের কেসটা কোনোরকমে রাখতে পেরেছে। কমলা সেই বাক্সটার সামনে দাঁড়িয়ে। বীথিও সরে গিয়ে সেখানে দাঁড়ায়।
‘কি সাবান?’বীথি কেসটার দিকে হাত বাড়ায়। কমলা বলল, অনেক দাম একটা কেকের। তোমাদের এই খালপারের দোকানে এসব পাবে না।’ এমন সুর করে কথাটা বলল কমলা এবং ভুরু ও চোখের এমন ক্ষুরধার ভঙ্গি করল যে, এই সম্পর্কে আর কোনো প্রশ্ন করতেই যেন বীথি সাহস পেলে না। কমলা রুচির দিকে চোখ ফেরালো। ‘যাকগে আপনার সঙ্গে আমার অন্তত একটা দিকে রুচির মিল আছে। সত্যি, আছি বটে এ-বাড়িতে, কিন্তু ঐ এক প্রীতি ছাড়া কারো সঙ্গে মিশব, দু’দণ্ড বসে কথা বলব এমন মানুষ পাই না। লো-টেস্ট, বুঝলেন ভয়ানক লো-টেস্ট এখানকার মানুষের। ইচ্ছেই করে না কারো সঙ্গে কথা বলি।’
রুচি অবশ্য তখনো সাবানটার কথা ভাবছিল। এটা ওরা এখানে এসে কেনেনি। কবে মুক্তারামবাবু স্ট্রীটে থাকতে এক বাক্স পীয়ার্স সোপ কিনে এনেছিল শিবনাথ। তখন ওর চাকরি ছিল। দুটো অনেকদিন আগে শেষ হয়ে গেছে। কৃপণের ধনের মত রুচি একটা কেক ট্রাঙ্কের তলায় লুকিয়ে রেখেছিল। তারপর একদিন ভুলে গেছে। ওর মনেই ছিল না। সব ভাল ভাল জিনিস বিক্রি করে হাতছাড়া করে খুইয়ে ফেললেও এমন একটা সম্পত্তি তার ঘরে এখনো আছে যে এই বাড়ির লোকেরা দেখলে অবাক হয়ে যাবে। বাক্স-পেটরা নাড়াচাড়া করতে গিয়ে পরশুদিন এটা বেরিয়ে পড়েছে। দেখে রুচি যত খুশি হয়নি, শিবনাথ হয়েছে তার চতুর্গুণ। তৎক্ষণাৎ ওটা, যেন সন্দেশ পেয়েছে, রুচির হাত থেকে কেড়ে নিয়ে শিবনাথ নিজের কেসে পুরেছে। সাবান দেখে কমলার হঠাৎ খুশি হওয়ায় রুচির এখন সেই কথা মনে পড়ল।
‘ঐ যে বলে পাঁকে থাকি তবু পাখায় তা আটকাতে দিই না, সেই হাঁসের মতন কোনোরকমে এই বস্তিতে বেঁচে আছি আর কি।’ কথার শেষে কমলা খিলখিল হাসল। রুচি চুপ। অবাক হ’ল সে ভেবে তবু কেন কমলা দিনের পর দিন এখানে আছে, কী উদ্দেশ্য,–আর কোথাও ভালভাবে বাস করার সংস্থান ওর আছে যখন। কিন্তু কমলা যেমন তার কারণ বলে না, বলবে না কাউকে, রুচিও সে-প্রশ্ন করা থেকে নিবৃত্ত রইল।
‘ঘরে ডিসইনফ্যাকটান্ট মানে, ফিনাইল লাইজল কিছু রেখেছেন তো? ফ্লিট আছে?’
‘হ্যাঁ’ রুচি সংক্ষেপে উত্তর করল।
‘উঃ, মাছি, কী ভীষণ মাছি এখানে। আপনি কল্পনাও করতে পারবেন না। একটু গরম পড়লে দেখবেন। আলপিনটি রাখবার জায়গা থাকে না কোথাও, মেঝে বারান্দা যেন মাছি দিয়ে বুনে রাখা হয়েছে এমন। তেমনি মশা। রাত বলে রাত, দিনের বেলাই কামড়ে গায়ের চামড়া ঝাঁজরা করে দেয়। বাপ্! সেইজন্যে আমি যেদিন হাসপাতালে ডিউটি না-ও থাকে, ঘরে থাকি না, বেরিয়ে যাই, তাই বলে বেলেঘাটা চিংড়িঘাটায় কি আর থাকি! কোলকাতায় চলে যাই। ফুটপাতে ঘুরি। শহরের ফুটপাথেরও একটা চার্ম আছে, কি বলেন?’ কমলা আবার খিলখিল হাসল।
রুচি হ্যাঁ না কিছু বলল না। গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ ইনি। যেন টের পেয়ে কমলা একটু দমে গেল।
‘কেবল মশা মাছি! গরমের দিনে টিন তেতে কী অবস্থা হয় বৌদিকে একবার ব’লে রাখো’ বাঁথিও হাসে।
‘হ্যাঁ, টিকটিকি আরশোলাগুলো পর্যন্ত টিকতে পারে না। কিছু পালিয়ে যায়, বাকিগুলো গরমে ভাজা হয়ে ঝুরঝুর ক’রে পড়ে মাথায় ঘাড়ে।’
রুচি এবার বিশীর্ণ একটু হাসল।
আবহাওয়া তরল হয়ে এসেছে টের পেয়ে বীথি হুট ক’রে কথাটা তুলল। এখানে হালে মেয়েদের একটা সমিতি করা হয়েছে। ‘দীপালি সঙ্ঘ’ এর নাম। বীথি সম্পাদিকা, আগে ভার বড় বোন প্রীতি ছিল। কিন্তু টেলিফোনের চাকরিতে ঢুকে ও আর সময় পাচ্ছে না ব’লে বীথি ওটা এখন দেখাশোনা করছে। বড় মেয়ে এতে খুব বেশি নেই। ছোট মেয়েদের নিয়েই মুখ্যতঃ এই সমিতি। নাচ, গান, সূচের কাজ, রান্না, রুগীর সেবা ইত্যাদি সবকিছুই একটু একটু শেখানো হয়। কিছু বই রাখা হয়েছে। একখানা মাসিক পত্রিকা, একটা সাপ্তাহিক এবং একখানা বাঙলা দৈনিক কাগজ রাখা হচ্ছে। প্রেসিডেন্ট পারিজাতবাবুর স্ত্রী শ্রীমতী দীপ্তি রায়। কমলা বলল, ‘আমার মনে হয় এ-ধরনের সমিতি সঙ্ঘ হওয়া খারাপ না। বড়দের মন বিষিয়ে গেছে। কিন্তু যারা কচি, যাদের মন এখনো বরফের মত সাদা, ছাপ পড়েনি কিছুর, হোক না ধনী হোক গরীব, এক সঙ্গে এক জায়গায় এসে মিশতে পারলে পরস্পরের ব্যবধানটা অনায়াসে ভুলে যায়। বীথির বোন কুঙ্কুমের গায়ে সুতীর জামা আর পাড়ার নিবারণ ঘোষের মেয়ে চম্পার গায়ে সিল্ক এটা তখনকার মত, যতক্ষণ সমিতির উঠোনে ছুটোছুটি ক’রে ওরা কানামাছি খেলে মনে রাখে না। পারিজাত একটু দাম্ভিক, কিন্তু দীপ্তি চমৎকার মানুষ। মিশুক, অমায়িক, অহঙ্কার নেই। এই ধরনের একটা সমিতি এপাড়ায় গড়ে উঠেছে শুনে নিজে থেকে ভাল টাকা চাঁদা দিয়েছে। এই বছরের জন্যে দীপ্তিকে প্রেসিডেন্ট করা হয়েছে।’
‘আমাকে কি করতে হবে?’ কমলার দিকে মুখ ফিরিয়ে রুচি প্রশ্ন করল।
‘মানে কোন বাধ্যবাধকতা, জোর জুলুম নেই, যার যেমন খুশি, যার যতটুকুন সামর্থ্য সাহায্য করলে আমরা সন্তুষ্ট হই।’ বলা শেষ করে বীথি পিঠের আঁচলটা আন্দোলিত ক’রে হাত দিয়ে কপালের চুল পিছনে ঠেলে দিল।
‘আট আনা এক টাকা যা খুশি আপনি দিতে পারেন, বিশ পঞ্চাশ দিলেও যে ওরা খুব পেয়ে গেছে বলে লাফাবে তা নয়,’কমলা রুচিকে বোঝাল, ‘কেননা, টাকাটা ততটা না, যতটা আপনার সদিচ্ছা ও সহানুভূতির ভিকিরি ওরা।’
‘অবশ্য এখুনি আপনাকে যে দিতে হবে তা নয়–সবে তো কাল এলেন। জানিয়ে রাখলাম। কমলাদিকে ধরে নিয়ে এসে আপনার সঙ্গে পরিচয় করলাম।’
বীথির চোখে চোখ রেখে রুচি বলল, ‘বেশ, আমি সাধ্যমত সাহায্য করব। আমার পুরো সহানুভূতি আছে আপনাদের সমিতির প্রতি।’
কমলার হাত ধ’রে বীথি বেরিয়ে গেল। রুচি হাল্কা নিশ্বাস ফেলল। না, এখানকার সবটাই মাছি মশা নোংরা, বছর বছর সন্তানের জন্ম দেওয়া, দারিদ্র্য, কলহ, নিন্দা, পরশ্রীকাতরতায় ভরা নয়। আলো আছে, আলোর একটা শিখা যেন কতক্ষণের জন্যে চোখের সামনে তুলে ধরে গেল ন’নম্বর ঘরের মেয়েটি। বীথির গায়ের ময়লা রং বেশভূষার মলিনতা সত্ত্বেও ওর চোখের উজ্জ্বল দীপ্তি, ভ্রূরেখার উদ্ধৃত গরিমা বেশ কিছুক্ষণের জন্য রুচির চোখের সামনে ভাসতে লাগল। শিক্ষা, সুযোগ, যত্ন ও স্নেহ পেলে আরো ভাল হ’ত, একটা কিছু করতে পারত ওই মেয়ে, মনে মনে বলল রুচি।
কিন্তু একটু পর তার এই বিমুগ্ধ ভাব কেটে গেল। শুনল কোন্ ঘরে কে চিৎকার করছে। আর একজন কাঁদছে যেন। রুচি কান খাড়া করল।
‘মুখপুড়ি! মার বয়সী তাকে অসম্মান করতে পারিস তুই, আমি স্বপ্নেও ভাবতে পারি না। এই কি তোর সমিতির শিক্ষা। না না এসব হবে না, সেইজন্যেই বলছি একটা কিছুতে তুমি ঢুকে পড়ো, গরিব মানুষ আমি। ঘরে পয়সা আসা নিয়ে কথা। তোমার ভাই বোন উপোস আধপেটা থেকে দিন কাটায়, আর ওদিকে পারিজাতের স্ত্রীর সঙ্গে ঘুরে কেবলই সমিতি করবে, নাচ-গান নিয়ে মেতে থাকবে, হতে দেব না। ছি ছি, এত ভাল মানুষ লক্ষ্মীদি, তাকে তুই এসব কি বলেছিস, এ্যাঁ!’
ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদছিল একজন।
রুচি অনেকক্ষণ কান পেতে থেকেও বুঝল না এই কান্না লক্ষ্মীমণির না বীথির। বাইরে একটা কাক ডাকছিল। কাদের ঘরে এখনো উনুন জ্বলছে। নতুন ক’রে কয়লা দিয়েছে যেন আবার, রাশি রাশি ধোঁয়া ঢুকছে জানালা দিয়ে। রুচি জানালা বন্ধ করে দিয়ে শুয়ে পড়ল।
৭
সমস্ত সন্ধ্যাটা শিবনাথ খালপাড় ধরে হাঁটল। নতুন জায়গায় সে বেড়াতে এসেছে বটে, পরিচিত হতে চায়।
পরিচিত হওয়াও তার একান্ত দরকার।
আজকালই যে সে একটা চাকরি বাগিয়ে ফেলবে তার স্থিরতা নেই, আজকাল কেন, অনেকদিনেও না।
শহরের বাইরে চলে এসেছে, মানে কথায় কথায় এখন সে আর ডালহৌসী চৌরঙ্গীতে হাজির থাকতে পারছে না। একদিন যাতায়াতেই অনেকগুলো পয়সা বেরিয়ে যায়। অথচ কর্মস্থল তার সেখানেই।
তাছাড়া, এবার বাড়িবদলের পর হাতে একটা পাঁচ টাকার নোট ও কিছু খুচরো পয়সা ছাড়া আর কিছু নেই।
এখন থেকে তাদের বেশ কিছুদিন, রুচির মাইনে পাওয়া অবধি টাইট হয়ে চলতে হবে। এখানে হট্ করে ধার কর্জ পাওয়ারও সম্ভাবনা নেই। পাড়া প্রতিবেশী?
এদের ওপর লোকে ভরসা করে বটে।
প্রতিবেশী, মানে বাড়ির অন্য ভাড়াটে থেকে শেষ দিকটায় শিবনাথ কিছু ধারকর্জ পায়নি এবং চায়ওনি। কেননা তার চাকরি নেই–একথা মুক্তরামবাবু স্ট্রীটের বাড়ির লোকেরা জেনে ফেলেছিল।
তবু পানের দোকানটায়, রাস্তার ওপারের মুদি দোকানে ধারে অনেকদিন পর্যন্ত শিবনাথ জিনিস এনেছিল।
এখানে এখনি সে-সব হবে না।
বাড়ির লোক? যেন চৌদ্দ আনা ভাড়াটের অবস্থা শিবনাথ একটা রাত আর আজ এই সারাদিনে জেনে ফেলেছে।
কেউ না, কারো কাছে হাত পাতলে একটা আধলা ধার দেবে না। যদি হাজার বছরও শিবনাথ এ বাড়িতে থাকে এবং হাজার বছরও ওরা জানতে না পারে, শিবনাথ বেকার তবু না। বেড়াতে বেরিয়ে সে একথাটাই বেশি করে ভাবছিল।
একজনের আয়ে দশ পনরো বিশজন খাচ্ছে।
টেলিফোন চাকরি করে একটা মেয়ের আয়ের ওপর ওর বাপ মা আর তিন গণ্ডা ছেলেমেয়ে নিয়ে চৌদ্দটা মুখ খাচ্ছে। মাস্টাররের এগারোটা মুখ, (বারোটা হবে শীগগীর), ডাক্তারের পোষ্য বেশি না হলেও খুব যে একটা ভাল আয়, হালচাল দেখে শিবনাথ ভরসা করতে পারল না। বাড়ি ছাড়ছি, শহরে যাচ্ছি, মেয়ের বিয়ে দিচ্ছি ব’লে হোমিওপ্যাথ যতই লাফাঁক।
রাস্তার ওপর কাঁঠাল গাছতলায় আর একটা টিনের ঘরেই ডিস্পেন্সারী। সাইনবোর্ডে ডাক্তারের নাম দেখে শিবনাথ চিনেছে। একখানাও পুরো নয়, আলমারীয় নিচেটা ভেঙে গেছে ব’লে শিবনাথের সন্দেহ হয়েছে। কাঠ দিয়ে সামনের দু’দিকের মুখ বন্ধ ক’রে রাখা। ভাঙা আলমারীর ওপরের আধখানায় দু’ সারিতে চার ছ’ ডজন ওধুধের শিশি সাজিয়ে রেখে হোমিওপ্যাথের মাসিক রোজগারটা কত হবে শিবনাথ বেশ অনুমান করতে পারল। কৌতূহল বশত ডিপেন্সারীর দরজায় সে একবার উঁকি দিয়েছিল। শেখর ডাক্তার গভীর মনোযোগ সহকারে খবরের কাগজ পড়ছিল। ছ’পয়সা দামের বাংলা দৈনিক
আর থাকে ওধারের ঘরে ফ্যাক্টরির ছেলে দু’টি। সকালে একটির কাজে বেরোনোর পোশাক দেখে, জুতোর রং দেখে শিবনাথ ধরে ফেলেছে ক টাকা ডেইলী কামায় ছোঁড়া। আর একজন শীগির ছাঁটাইয়ে পড়ছে শোনা যাচ্ছে।
আর থাকে সেই যে সাবান ফেরি ক’রে সংসার চালায়, সেলুনওলা এবং কে. গুপ্ত।
এক, কমলার অবস্থাই ভাল। শিবনাথের তাই ধারণা।
কেনই বা হবে না। শিবনাথ ভাবল।
খটুনি বেশি বলে নার্সদের মাইনেও মোটামুটি ভাল হয়। অন্তত ইস্কুলের টিচারদের চেয়ে বেশি।
রুচির চেয়ে কমলা বেশি রোজগার করে। শিবনাথ কাল সন্ধ্যায় প্রথম দেখেই টের পেয়েছি। বেশভূষা এবং কথাবার্তায় কেমন একটু আভিজাত্যও আছে।
আর, সচ্ছল ওদিকের ঘরের রমেশের অবস্থা। শিবনাথ টের পেয়েছে।
কিন্তু লোকটার চালচলন এবং কথাবার্তা শুনে শিবনাথের মনে হয়েছে ব্যাটা শাইলক নাম্বার ওয়ান। অনুনয় বা ভিক্ষা নয়, বুকে ছুরি বসালেও হাতের মুঠ থেকে পয়সা ছাড়বে না, এমন। কেন জানি লোকটার ভুরু দেখেই শিবনাথের এই ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে।
যদি কেউ ধার দেয়, অবশ্য দেবার ক্ষমতা থাকাটা খুব বড় কথা নয়, উদার ও মার্জিত দৃষ্টিভঙ্গিই আসল। এবং এ বাড়ির একজনেরই তা আছে। কমলার। পোষ্য নেই। সিঙ্গল লাইফ। আনছে। খাচ্ছে। মেজাজটা ভাল, হাঁটতে হাঁটতে শিবনাথ অনুমান করল। দু’টো চারটে টাকা ঠেকে গেলে রুচি চাইতে পারবে।
হাঁটতে হাঁটতে শিবনাথ বেশ দূরে চলে যায়।
রাস্তার দু’পাশে বড় বড় গাছের গুঁড়ি। আস্ত অথবা টুকরো। ছোট ছোট টিলার মত স্তূপ ক’রে সাজিয়ে রাখা। শাল গাছ আছে, সেগুন, পলাশ, মহুয়া, সুন্দরী জারুল। এত কাঠ দিয়ে কি হয়, কারা কেনে এবং কোথা থেকে এসব আসে ভাবতে ভাবতে শিবনাথ হাড়ের কল, চামড়ার কল পর্যন্ত চলে গেল। ধোঁয়া এ-তল্লাটে লেগেই আছে। শহরতলি পরিচ্ছন্ন, ফাঁকা, নির্ঘুম, নির্ঝঞ্ঝাট থাকবে শিবনাথের আশা ছিল। কিন্তু এখন দেখছে এখাতে বসতি আরো বেশি, ধোঁয়া আরো গাঢ়। ট্রাম-বাস না থাকলেও ঠেলাগাড়ি ও মোষের ভিড়ে পথচলা কষ্টকর। তবু শিবনাথের হাঁটতে ভাল লাগছিল এইজন্য যে, কোমল নীলাভ বেশ বড়সড় আকাশের রুপোর পাতের মত এক চিলতে চাঁদ মাথার ওপর অনেকক্ষণ ধ’রে অনেক দূর এগোবার পরও সে দেখতে পাচ্ছিল। চারতলা ছ’তলার বাধা ছিল না। গাছ এবং ইলেকট্রিকের খুঁটি থাকলেও তারা আকাশ ও চাঁদকে একেবারে ঢেকে রাখতে পারে নি। বরং পাতার ফাঁক দিয়ে, তারের নিচে দিয়ে চাঁদ ও আকাশকে আরো নতুন আরো সুন্দর ঠেকছিল। তারপর অবশ্য গাছের সারি শেষ হ’ল এবং আলোর খুঁটিগুলো আর দেখা গেল না। সেখানে আকাশ আরো বড়, চাঁদ আরো উজ্জ্বল। যেন জলের ওপর চাঁদ ঝুলছে। জ্যোৎস্নার ঝিলমিলে অনেকগুলো রেখা শিবনাথ একজায়গায় এক সঙ্গে দেখতে পেল। সল্ট লেক? কাগজে যা নিয়ে জোর লেখালেখি চলছে। এই অঞ্চলের শীগির ডেভেলপমেন্ট হবে। এ-সম্পর্কে শিবনাথ নিশ্চিন্ত। তখন অবশ্য আর লোকে নাক সিঁটকাবে না, নিন্দা করবে না এখানে টিনের ঘরে কেন সে রুচিকে নিয়ে মঞ্জুকে নিয়ে থাকতে এল। ঘরের জায়গায় ঘর হয়তো থাকবে, কিন্তু বারোটা পরিবারের সভ্য সুশ্রী ও সুস্থভাবে বাস করার উপযোগী বারোখানা পরিচ্ছন্ন কামরা হবে তখন। এই বারান্দা থেকে ও-বারান্দা দেখা যায় না; দেয়াল পার হয়ে তবে আর একটি ঘরের দরজা। হয়তো এটাই একটা খুব ফ্যাশনেবল্ ফ্ল্যাট বাড়িতে পরিণত হবে ভাবতে ভাবতে এবং তারপর, তখন অবধি কে কে এবাড়িতে থেকে যাবে যেন মনে মনে হিসাব করতে করতে শিবনাথ শরীরে মোচড় দিয়ে চাঁদ ও আকাশ পিছনে রেখে বাড়ি ফেরার রাস্তা ধরল।
রাস্তার পাশের অন্ধকার একটা গলি থেকে ছোট্ট মানুষটি বেরিয়ে এল। যথেষ্ট আলো না থাকলেও শিবনাথ প্রথম দেখেই চিনল। বিধুমাস্টার।
দুই হাত তুলে শিবনাথকে নমস্কার জানিয়ে মাস্টার আগে কথা বলল, ‘বেড়াতে বেরিয়েছেন?
‘হ্যাঁ, আপনি এখানে?’
‘হ্যাঁ, একটি ছাত্রীকে পড়াই।’
‘কোন্ ক্লাশের।’
‘ফার্স্ট ক্লাশে পড়ে। বেশ ইন্টেলিজেন্ট মেয়ে। আমি পড়িয়ে আরাম পাই। অথচ দেখুন, এতবড় লোকের মেয়ে। না, ধনী মেয়ের লেখাপড়া করে না। রাতদিন আমোদ ফূর্তি গানবাজনা সিনেমা পিকনিকে সময় কাটায়, বদনাম থাকলেও বিদিশা দত্ত অন্য ধাঁচের মেয়ে। আমার তো খুব ভাল লাগে। ও এবার স্কলারশিপ পাবেই।
কেন জানি একটু হাসতে গিয়ে শিবনাথ গম্ভীর হয়ে গেল। তারপর প্রশ্ন করল, ‘পড়ানো শেষ করে এখন বাড়ি ফিরছেন নাকি?’
‘হ্যাঁ–না, আর এক জায়গায় আর একজনকে, ঠিক পড়ানো নয়। আকবরের প্যাসেজের দু’টো শক্ত লাইনের মানে বলে দিয়ে আসব। এই তো কাছেই।’
কে সে। ছাত্র কি ছাত্রী। ধনীর মেয়ে না গরিব। আকবরের প্যাসেজের মাত্র দু’টো শব্দের মানে ব’লে দেওয়ার জন্য মাসিক ব্যবস্থা কি–বেশ ইচ্ছা হ’ল শিবনাথের জানতে, জিজ্ঞেস করতে, কিন্তু দেখা গেল, বিধুবাবু এক এক ক’রে নিজের সব বলতে শুরু করেছেন।
চামেলী চ্যাটার্জি। বাবা কি এক কমার্স চেম্বারের চেয়ারম্যান। হাজার টাকার ওপর মাইনে। বিদিশার বন্ধু। যদি লেগে যায়। বিদিশা হঠাৎ আমায় সেদিন বলতে কথাটা খেয়াল হল। বলল, আমার টিচার, আমাকে পড়াচ্ছেন পরিচয় দিয়ে চামেলীদের বাড়ি মাঝে মাঝে যাবেন। একটা দু’টো সাবস্টেন্স ট্রানশ্লেসন দেখেটেকে দিতে থাকুন, দু’টো ইংরেজী শব্দের মানে বলে দিয়ে আসুন। রাখবে,–আমার তো মনে হয়, বিশেষ–চামেলীর মা লোক ভাল। আপনার বয়েস হয়েছে, গরিব এবং আমাকে বেশ কিছুদিন ধ’রে পড়াচ্ছেন জানতে পারলে চামেলীর জন্যও রেখে দেবে। ও ইংরেজীতে বেশ কাঁচা।’
বিধুবাবুর ক’টা ট্যুইশানি হাতে আছে শিবনাথের জানতে ইচ্ছা হ’ল। কিন্তু সে-সব প্রশ্ন না করে গম্ভীরভাবে বলল, ‘চামেলীকে পড়িয়ে তারপর বাড়ি ফিরবেন বুঝি।’
‘হ্যাঁ, পড়িয়ে ঠিক না, একটু দেখিয়ে। আকবরের প্যাসেজটা বেশ কঠিন। বিদিশাকে তিনবার sovereign কথাটার মানে ব’লে দিতে হয়েছে, তারপর মনে রাখল।’
শিবনাথ চুপ করে রইল।
‘না, কই, একটা ছাড়া ট্যুইশানি জোটাতে পারলাম না। আর, কী ক’রে পারব। উকিল মোক্তার মার্চেন্ট-অফিসে কেরানী সবাই কোমর কেছে ট্যুইশানি করতে লেগে গেছে, ওই যে বলে ডিমান্ডের চেয়ে সাপ্লাই বেশি। ঝুড়ি ঝুড়ি প্রাইভেট টিউটর গজিয়েছে মশাই খালের এপারে ওপারে।’
শিবনাথ অল্প হেসে শুধু মাথা নাড়ল।
‘হ্যাঁ, সকালে তাই একটু এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করি। কিন্তু সুবিধা করতে পারছি কই।‘
শিবনাথ চুপ।
‘আপনি সল্টলেক পর্যন্ত হেঁটে এসেছেন?’
শিবনাথ ঘাড় নাড়ল।
‘মর্নিং-ওয়াক্ একটু একটু আমিও আরম্ভ করেছি। যদিও উদ্দেশ্য ঠিক সেটা নয়’–যেন নিজের মনে কথাগুলো ব’লে পরে মাস্টার কতক্ষণ কি ভাবল, তারপর শিবনাথের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে বলল, ‘আমরা পারব না, আমার নিজের কথা আলাদা। আমি না পারি করতে হেন কাজ সংসারে নেই, মানে রিক্সা টানতেও লজ্জা করবে না। কী করব, উপোসে তো মরতে পারব না। কিন্তু ওরা ভদ্রলোক, অতিরিক্ত বাবু হয়ে গেছে, আমাদের ছেলে-মেয়েদের কথা বলছি মশাই।’ হঠাৎ অসহায়ভাবে বিধুবাবু শিবনাথের দিকে তাকালেন ‘কানুটাকে আমি নিজে বলে, ওর মাকে দিয়ে বলেও পারলাম না রাজী করাতে। ফুলকপির সীজন এসে গেল। ধাপার ওধারে চাষীরা নিজেদের ক্ষেত থেকে তুলে আনে। সস্তায় ছাড়ে। হাতে করে, দোষ কি যদি দু’চারটে মাথায়ও দিতে হয়, শেয়ালদা খুব বেশি দূর কি প্রায় ডবল দামে এক একটা কপি বিক্রি করতে পারবি। নতুন ফসল। এই তো সবে বেরুতে আরম্ভ করেছে মশাই।’
‘কানুর কত বয়েস?’ হঠাৎ শিবনাথ প্রশ্ন করে বসল। ‘আপনার ছেলেমেয়ে ক’টি।’
‘তা আর প্রশ্ন করবেন না।’ বিধুবাবু শিবনাথের দিকে ঘাড় ফিরিয়ে হাসল। ‘ষষ্ঠীর কৃপায় ছেলেমেয়ের সংখ্যা কম কি! বারোটি সন্তানের পিতা আমি। দু’টি মরেছে। দশটি জীবিত আছে। আর একটি শীগির ভূমিষ্ঠ হবে।’
শিবনাথ নীরব।
‘হ্যাঁ, কানু আমার বড় ছেলে।’ বিধুবাবু বললেন, ‘কিন্তু কথায় বলে–পণ্ডিতের ঘরে যত গাধা গরু জন্মায়। তিনবার হারামজাদা ম্যাট্রিক ফেল্ করেছে। তা চারবার একলা তোকে চান্স দেবো যে, আমার সে-সামর্থ্য কোথায়। তার নিচে এতগুলো আছে। মমতা সাধনার এবার ফোর্থ সেকেন্ড ক্লাস। কতগুলো বই লাগছে দু’জনের, কত টাকার ধাক্কা একবার হিসাব করতো?’
‘ছেলেমেয়েরা ইস্কুলে ফ্রি-শিপ পাচ্ছে তো?’ শিবনাথ প্রশ্ন করল।
‘না, গেলবার এক সাবজেক্টে ফেল্ করাতে সাধনার ফ্রি-শিপ কাটা গেছে, সেই জন্যেই তো আরো মুশকিলে পড়ে গেছি মশাই, পড়বেন না, দেখতেও উনি মেনকা উর্বশী নন–বিয়ে হবে না। তার চেষ্টাও করব না, যাগে সে-কথা হচ্ছে না, মাথায় এত গোবর থাকলে তুই কোন্ জন্মে ম্যাট্রিকের দরজা পার হবি আমি বুঝতে পারছি না’–আমার ক’টা ছেলেমেয়ে মশাই এমন হবে, মমতাটা একটু ভাল, তা-ও অঙ্কে ভীষণ কাঁচা, চানু আর সুমু কেমন হবে এখনো বলা যায় না। আরগুলো তো দুধের। ওরা আমাকে ভাল ক’রে ঠেকিয়েছে, বড় ছেলেটা আর বড় মেয়েটা।’ যেন দীর্ঘশ্বাস ফেলতে গিয়ে বিধুবাবু হঠাৎ দাঁতে দাঁত ঘষলেন।
শিবনাথ চুপ থেকে হাঁটতে লাগল।
‘বাজারে গিয়েছিলেন আজ?’ মাছ পেয়েছিলেন?’
‘না, সুবিধা হয়নি।’ শিবনাথ একটু কাশল।
‘চালানি ইলিশ আর চিংড়ি ছাড়া আমি তো কিছু দেখলাম না।’
শিবনাথ চুপ। বিধুবাবু প্রশ্ন করলেন, ‘ডাক্তারকে ডিসপেন্সারীতে দেখলেন?’
‘না।’ শিবনাথ বলল। ‘দু একজন রুগী বসে আছে দেখলাম।’
‘ঐ দু’ একজনই।’ যেন নিজের মনে বিধুবাবু হাসলেন। ‘মশাই, চোখে ধুলো দিয়ে আর ক’দিন লোকের পয়সা খাওয়া যায়।’
শিবনাথ মাস্টারবাবুর মুখের দিকে তাকায়।
‘মশাই বলবেন না কারো কাছে। অবশ্য অনেকেই এখন জানে। শেখর হোমিওপ্যাথির ‘হ’ শেখেনি। ছিল ব্যাঙ্কের হেড ক্লার্ক–এটা অবশ্য ওর মুখে শোনা,–আমার তো মনে হয় অর্ডিনারী লেজার ক্লার্ক ছিল। লেখাপড়ার দৌড় কত চেহারা দেখেই বুঝতে পারবেন। ব্যাঙ্কে কাজ করার সময় থেকেই নাকি হোমিওপ্যাথির চর্চা। আমি বিশ্বাস করি না। চাকরিটি খুইয়ে এসে এই ব্যবসা ধরেছিল। কথায় আছে না, যার নেই অন্যগতি সে ধরে হোমিওপ্যাথি।’–বলে বিধুবাবু বেশ শব্দ ক’রে হেসে উঠলেন। শিবনাথ পিছনে ও দুপাশে তাকাল। ভদ্রলোকের পোশাক-পরা তেমন কাউকে দেখা গেল না। মুটে, ঠেলাওয়ালা, রিক্সাওলা এইসব। হঠাৎ শিবনাথের প্রায় কানের মধ্যে মুখটা ঢোকাবার চেষ্টা ক’রে বিধুবাবু ফিসফিস করে উঠলেন। ‘আমি কতদিন চোখে দেখিছি মশাই, স্পিরিটের সঙ্গে কলের জল মিশিয়ে ওষুধ ব’লে চালাচ্ছে। আর মানুষ অন্ধের মত তা পয়সা দিয়ে কিনে খাচ্ছে।’
‘তাই নাকি!’ শিবনাথ ফিসফিস করে উঠল।
‘তাই কি না!’ নিজের চোখে দেখবেন। থাকুন না। দু’দিন পারিজাতের খোঁয়াড়ে বসবাস করুন। আস্তে আস্তে জন্তু-জানোয়ারগুলোকে চিনতে পারবেন।’
কথা শেষ ক’রে বিধু মাস্টার শব্দ করে হাসেন। শিবনাথ চুপ থেকে হাঁটতে লাগল। বিধুবাবুও কিছুক্ষণের জন্যে নীরব থেকে হাঁটেন। বাঁ-দিকের আর একটা গলির কাছাকাছি এসে হঠাৎ তিনি থমকে দাঁড়ান।
‘আচ্ছা চলি।’
‘চামেলীদের বাড়ি এসে গেছে বুঝি?’ শিবনাথও হাঁটা বন্ধ ক’রে দাঁড়ায়।
‘হ্যাঁ, আর একটু ভিতরের দিকে এগোতে হবে।’ যেন কথাটায় তেমন জোর না দিয়ে বিধুবাবু তার চেয়ে প্রয়োজনীয় কথা পাড়েন। ‘আপনি আবার কথায় কথায় না বলে দেন, অবশ্য বললেও কিছু হবে না; আমার আপনার চেয়ে ঢের বেশী পুরু শেখরের গায়ের চামড়া। হবেই। হাড়কিপ্টে চশমখোর। একটা টাকা–বুঝলেন, পারতপক্ষে আমি ওর কাছে হাত পাতি না, তবু আজ সকালে একটু বাজার সওদা করব বলে অনেক ভেবে-চিন্তে ওর কাছে একটা টাকা কর্জ চেয়েছিলাম। টাকা তো দিলেই না, উল্টেল্ট ও আমাকে ইন্সাল্ট করলে।’
‘কি রকম?’ শিবনাথ ঢোক গিলল।
‘বলে কিনা, মাসের দশ তারিখ না পেরোতে তোমরা সবাই এর-ওর কাছে ধার করতে লেগে যাও, একদিন না একবার না, ফি মাসে, বছর-ভর, এখানে এসে অবধি দেখছি, তোমাদের কাণ্ড-কারখানা দেখলে আমার লজ্জা করে।’
‘আর কি বললে?’ যেন প্রশ্ন করতে মনে মনে তৈরী হয় শিবনাথ।
‘বললে এতগুলো ক’রে এক একজনের পুষ্যি দারিদ্র্যের প্রধান কারণ এটা, আমার তো মনে হয় তোমাদের যাদের আয় কম তাদের ছেলেপুলে না হওয়াই উচিত, তাছাড়া, আজকাল বিজ্ঞানের যুগে ভাল উপায় বেরিয়েছে।’
একটু সময় চুপ থেকে পরে মৃদু হেসে শিবনাথ প্রশ্ন করল, ‘ডাক্তার ইয়ে আরম্ভ করছে নাকি? তারও তো ছেলেমেয়ে কম না।’
বৃদ্ধাঙ্গুলি তুলে এবং মুখের একটা বিকৃত ভঙ্গি ক’রে বিধুবাবু বললেন, ‘ছাই করছে, ওই মুখেই বলে, নিষ্টুর পর থেকে নাকি সে জন্মনিয়ন্ত্রণের চেষ্টা ক’রে আসছে। আমি বিশ্বাস করি না। বুঝলেন মশাই, শেখর যদি তুলসী হাতে নিয়েও একথা বলে আমি বিশ্বাস করব না। নিন্টুর চার বছর, তারপর আর ওদের কোনো ইসু নেই, এর আর কিছু–’, বলতে বলতে হঠাৎ আবার শিবনাথের কানের ভিতর মুখ ঢোকাবার চেষ্টা ক’রে বিধুবাবু ফিসফিস করে ওঠেন এবং বক্তব্য শেষ হ’তে মুখটা সরিয়ে এনে শব্দ ক’রে হাসলেন : ‘মুখে সকলের কাছে ব’লে বেড়ায় আমার স্ত্রীর চেয়ে ওর স্ত্রী বয়সে ছোট, কিন্তু বললে হবে কি। শেখর করবে বার্থকন্ট্রোল, তবেই হয়েছে! আর তাছাড়া, ওর নিজেরও হেল্থ ভেঙ্গে পড়েছে, দেখছেন তো কেমন প্যাকাটির মত হাত পা’গুলো হয়েছে, হবে না? রাতদিন লোকের চোখে ধুলো দিয়ে পয়সা উপায়ের কথা যারা চিন্তা করে তাদের এই হয়। দেখবেন, শেখর একদিন করোনারী থ্রম্বসীস কি ঐ ধরনের একটা সাংঘাতিক কিছুতে য়্যাটাড্ হয়ে হঠাৎ মারা যাবে।’
শিবনাথ কথা বলল না।
‘ব্যর্থ-কন্ট্রোল! চোরের মুখে হরিনাম।’ বিধুবাবু এবার নিজের মনে বিড়বিড় ক’রে উঠলেন। ‘এর জন্যে যতটা ইয়ে মানে সংযমের দরকার শেখরের তা নেই, আমি হলপ করে বলতে পারি।’ (শিবনাথের দিকে তাকিয়ে) ‘এসেছেন নিজের চোখেই দেখবেন; বাড়িতে এতগুলো মেয়েছেলে, হারামজাদা এমন হাঁ করে তাকিয়ে থাকে দেখে আমার নিজেরই লজ্জা করে। স্কাউড্রেল।’
শিবনাথ তথাপি নীরব দেখে বিধু বললেন, ‘আচ্ছা আমি চলি, ওদিকে আবার চামেলী ব’সে থাকবে।’
‘আচ্ছা আচ্ছা’, শিবনাথ ঘাড় নাড়ল। মাস্টার গলির অন্ধকারে অদৃশ্য হ’তে সে আবার হাঁটতে আরম্ভ করে। টাকা কর্জ না পাওয়াতে ডাক্তার সম্পর্কে বিধুবাবুকে এ বিষোদ্গার কিনা চিন্তা করে শিবনাথ এক সময় মনে মনে হাসল।
৮
একটু গলির ভিতরে রেস্টুরেন্ট। ইলেকট্রিকের খুঁটি এখান অবধি আসে নি। তা ছাড়া প্রকাণ্ড একটি কড়ি-গাছ ডালপালা ছড়িয়ে আছে ব’লে দোকানের সামনেটা বেশ অন্ধকার। টিমটিমে একটা কেরোসিনের বাতি ঝুলতে রেস্টুরেন্টের দেওয়ালে। দুটো লম্বা বেঞ্চ, একটা কেরোসিন কাঠের টেবিল, কাঁচ-পরানো দু’তিনটা টিনে কিছু মুড়ি, বিস্কুট ও চিঁড়ের চাকতি সাজিয়ে ক্ষিতীশের চায়ের দোকান। অদূরে একটা প্যাকিং বাক্স তৈরীর কারখানা। জায়গাটা এমনি চুপচাপ। কেবল কারখানা থেকে কাঠ-চেরা মেশিনের একটানা ঘসঘস শব্দ আসছে। দুটি হিন্দুস্থানী কি নিয়ে বেশ কিছুক্ষণ তর্কবিতর্ক ও বচসা করার পর আবার এখন থেমে গেছে। কারখানার সামনে একটা লরী দাঁড়িয়ে। যেন কল বিগড়ে গেছে গাড়িটা আজ আর চলবে না। ড্রাইভার নেই। আলো নেই। কে একজন, খুব সম্ভব কারখানার লোক রেস্টুরেন্টের টেবিলটার ওপর পা তুলে দিয়ে বসে বসে বিড়ি ফুঁকছে। তার সামনে একটা শূন্য কাঁচের গ্লাস। তলায় একটু চা পড়ে আছে। এই লোকটি কি অন্য কোন খদ্দের চা খেয়ে গ্লাসটা টেবিলের ওপর রেখে গেছে, শিবনাথ বুঝতে পারল না।
হাঁ, একটু ইতস্ততঃ করছিল বৈকি শিবনাথ। ময়লা কাপড়চোপড় পরা দেখতে প্রায় ইতরশ্রেণীর মত খদ্দেরের পাশে টুলের ওপর হুট করে বসতে রুচিতে বাধছিল বলে শিবনাথ দোকানে ঢোকার পরও এক মিনিট দাঁড়িয়ে রইল।
‘বসুন স্যার, আমার হয়ে গেছে।’ বিড়িটা তাড়াতাড়ি মুখ থেকে নামিয়ে লোকটি সোজা হয়ে বসল। ‘এ পাড়ায় আপনি নতুন এসেছেন বুঝি?’
‘হ্যাঁ।’ গম্ভীর গলায় উত্তর ক’রে শিবনাথ লোকটি ও নিজের মধ্যে বেশ খানিকটা ব্যবধান রেখে বেঞ্চির এক পাশে বসল। এক কাপ চায়ের দাম কত নেয় এখানে?’
‘চার পয়সা। এর আগে কলকাতায় ছিলেন বুঝি?’
‘হাঁ’ শিবনাথ ঘাড় ফিরিয়ে আবার আপাদমস্তক লোকটিকে দেখল। বিড়ি নিভে গেছে, দেশলাই জ্বেলে বিড়ি ধরাচ্ছে। বিড়ি ধরিয়ে এক ঝলক ধোঁয়া শিবনাথের মুখের দিকে ছেড়ে দিয়ে লোকটি দাঁত বের করে হাসল। ‘বাবুর দল শহর ছেড়ে আস্তে আস্তে খালপারের দিকে আসছে। জায়গাটার জেল্লা বাড়ছে দিনকে দিন। তা শহরের মতন মাজাঘষা রেস্টুরেন্ট পাবেন না এখানে। কি করে হবে–এ তল্লাটে তো আর ভদ্রলোক বলতে কিছু ছিল না। কেরোসিন কাঠের টেবিল আর তেলের বাতি আর আমরা দু চারটে কুলি-মুটে খদ্দের নিয়ে ক্ষিতীশ দোকান খুলেছিল। এবার আপনারা এসেছেন, যদি শালার কপাল খোলে। কইরে, বাবুকে চা দে।
হঠাৎ এখন শিবনাথের নজরে পড়ল দোকানে আর কাউকে দেখা যাচ্ছে না। তার পিছনে একটা চটের পর্দা ঝুলছে। হয়তো সেখানে উনুন এবং ক্ষিতীশ উনুনের পাশে কাজে ব্যস্ত আছে, শিবনাথ অনুমান করতে যাবে, এমন সময় সেখান থেকে পুরুষ, না, একটি মেয়ের গলার স্বর ভেসে এল। ‘বাবুকে বসতে বলো জলটা একটু ফুটবে।’
শিবনাথ চমকে লোকটির মুখের দিকে তাকাল।
‘বুঝতে পারছেন না।’ লোকটিও শিবনাথের চোখেৰ দিকে গোল চোখে তাকিয়ে মুখব্যাদান করে হাসে। ‘চৌরঙ্গীর চায়ের দোকানে মেমসাহেব মেয়েমানুষ যেমন খদ্দেরকে চা এনে দেয়, ক্ষিতীশও আপনাদের জন্যে সে রকম কিছু একটা এখানে চালু করতে চাইছে। না হলে বাবুরা ভিড়বে কেন? মধু না থাকলে ভোমরা আসে না!’
শিবনাথ নীরব ফ্যালফ্যাল্ চোখে লোকটির বত্রিশ দাঁতের নিঃশব্দ হাসি দেখে কেমন চমকে উঠে, যেন ভয় পায় এবং দারুণ অস্বস্তি বোধ করে।
‘হা-হা।’ এবার লোকটি শব্দ ক’রে হাসল। ‘তা ক্ষিতীশের বুদ্ধি আছে। বলুন স্যার, মেয়ে না রাখলে আপনাদের শহরে এমন কোন্ কারবারটা চলছে। চায়ের দোকান, দুধের দোকান, সেলুন, লন্ড্রি, আপিস, মায় শেয়ালদা ইষ্টিশানে পর্যন্ত সেদিন দেখে এলাম মেয়েছেলে টিকিট বিক্রি করছে।’
শিবনাথ চুপ।
হঠাৎ লোকটি সরে এসে শিবনাথের গা ঘেঁষে বসলে এবং বিধু মাস্টারের মত মুখটা প্ৰায় শিবনাথের কানের ভিতর ঢোকাবার চেষ্টা করে ফিসফিস করে উঠল : ‘কেনই বা হবে না, বিয়ে-থা হচ্ছে না যখন ধিঙ্গী সেজে ঘরের অন্ন ধ্বংস করবে, তাই বাপ-মা ঠেলে ঠেলে ওদের পাঠাচ্ছে দোকানে আর আপিসে। বছর দুই যাক না দেখবেন ব্যাটাছেলেরা আর কোন জায়গায় পাত্তা পাবে না। সাধে কি এত ছাঁটাই চলছে। মেনকা উর্বশীদের ঠাঁই করতে হবে তো– হঠাৎ কে একজন এসে দোকানে ঢুকতে লোকটির মুখের কথা থেমে গেল এবং ব্যস্ত হয়ে শিবনাথের কানের কাছ থেকে মুখটা সরিয়ে নিয়ে সোজা হয়ে বসল।
‘আবার তুই আমার দোকানে ঢুকেছিস সাধন। তোকে না বলেছি আমার দোকানে আসতে পারবি না। আবার এলি?’
ভীত, সঙ্কুচিত হয়ে সাধন মুখ নিচু করল।
‘চা খেতে হয়, খালপারে আরো পাঁচটা দোকান আছে, সেসব জায়গায় গিয়ে খা। আমার এখানে না।
‘আজকে আর ধারে খাইনি ক্ষিতীশ, পয়সা দিয়েছি।’
‘পয়সা দিলেও এখানে তুমি চা পাবে না। হ্যাঁ, আমার এক কথা। বাজে লোক এসে দোকানে আড্ডা দেবে, আমি পছন্দ করি না।’কথা শেষ করে ক্ষিতীশ আর কোনদিকে না তাকিয়ে হনহন করে সোজা পর্দার আড়ালে চলে গেল।
সাধন এক মিনিট তেমনি নীরব নতমুখ থেকে পরে গজগজ করে কি জানি বলতে বলতে আস্তে আস্তে দোকান থেকে বেরিয়ে গেল।
‘শালা বদমাশ। মেয়েমানুষের গন্ধ পেলে আর কথা নেই। পই পই করে বারণ করে দিয়েছি এখানে না। কুলি-মজুরের জন্যে ‘তৃপ্তি নিকেতন’ খোলা হয়নি। তোদের জন্যে আরো পাঁচটা দোকান আছে খালের এপার-ওপার। সেখানে বসে চা খা, আড্ডা মার গিয়ে। তুই-ই বা ওকে চা দিতে গেলি কেন? তোকে নিয়ে আমি পারি না।’
পর্দার আড়াল থেকে বললেও শিবনাথ সব শুনল।
‘আমি নিষেধ করেছি, ও শোনেনি।’ মেয়ের গলা।
হারামজাদারা কেন এখানে আসে, তুই কি বুঝিস না!’ ক্ষিতীশের ক্রুদ্ধকণ্ঠ ‘এমনধারা করলে তোকেও আর আমি দোকানে ঢুকতে দেব না, বেবি। হ্যাঁ, আমার এক কথা।’
শিবনাথ চমকে উঠল! বেবি? নামটা পরিচিত নয় কি!
এবং এক মিনিট পর চায়ের পেয়ালা হাতে ক’রে মেয়েটি যখন পর্দার এপারে এসে দাঁড়াল, বিস্ময়ে হতবাক্ হয়ে গেল শিবনাথ। তার প্রতিবেশী কে. গুপ্তের দুহিতা!
শিবনাথকে দেখে বেবিও চমকে ওঠে। হাতের পেয়ালাটা একবার কেঁপে ওঠে বৈকি! কিন্তু পরমুহূর্তেই বেবি সামলে নেয়। বরং স্মিত হেসে সংযত হাতে বাটিটা শিবনাথের সামনে টেবিলের ওপরে রাখে।
‘বিস্কুট দেব?’
‘না।’ রুমাল বের করে শিবনাথ কপাল মুছল।
‘তুই এখন বাড়ি যা, রাত হয়েছে। চা খেয়েছিস?’ বলতে বলতে ক্ষিতীশ এক পেয়ালা চা হাতে নিয়ে পর্দার বাইরে এল। বেবি মাথা নেড়ে জানাল ‘হুঁ’।
‘তোর মার জন্য চা নিয়ে যা।’
‘আচ্ছা।’ ঘাড় নেড়ে বেবি আবার পর্দার আড়ালে গিয়ে ঢুকল এবং একটু পর একটা কাঁচের গ্লাসে ক’রে চা নিয়ে বেরিয়ে এল, তারপর আর কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা রাস্তায় নেমে গেল।
ক্ষিতীশ হাতের পেয়ালায় মুখ দিয়ে শিবনাথের পাশে বসল। ‘চিনতে পারলেন মেয়েটিকে?’
‘হ্যাঁ। আমাদের বাড়িতে থাকে।’
‘ভদ্দরলোকদের দিনকে দিন কি অবস্থাটা হচ্ছে একবার দেখুন।’ বাটিতে আর একটা চুমুক দিয়ে ক্ষিতীশ একটু সময় চুপ করে রইল।
শিবনাথ নিঃশব্দে চায়ের বাটি মুখের কাছে তোলে।
‘দিনরাত চব্বিশ ঘণ্টা এখানে ঘুর-ঘুর। না করি আর কি ক’রে। চোখের ওপর তো দেখছি। ভাত খেতে পায় না তো চা আর জলখাবার! শুকিয়ে মুখটা কেমন আসির মত হয়ে যাচ্ছে দেখলেন তো! না হলে এই বয়সে কত লাবণ্য কেমন জেল্লা থাকত চেহারার।’ ক্ষিতীশ বিড়ি ধরায়। ‘আপনার চলে?’
‘না’,শিবনাথ মাথা নাড়াল। ‘আমার সিগারেট আছে’।
‘আসে, এসে বলে মা একটু চা খাবে, দাদা একটু চা খাবে, এক বাটি চা দিন, কাল-পরশু দামটা দিয়ে দেব। শুনে মনে মনে হাসি–দুঃখও হয়। কত কাল-পরশু চলে যাচ্ছে। তা করবে কি, কোথা থেকে দেবে চায়ের পয়সা। যেন নিজের মনে কথা বলে ক্ষিতীশ লম্বা নিঃশ্বাস ছাড়ে। ‘শহরে থাকতে মেমদের ইস্কুলে’ কি নাম, হ্যাঁ, লরেটোতে পড়ত। বাপের পয়সা ছিল। চা-জলখাবারই বা কম খেয়েছে কি! তাই তো জিহ্বা চুকচুক করে এখন এক ফোঁটা গরম জলের জন্যে। হা-রে কপাল! তা আসে আসুক, খায় খাক। বারণ করি না। আমারও একটা কাজ হয় যতক্ষণ দোকানে থাকে। সন্ধ্যার পর শেয়ালদা গেলাম কিছু সওদা আনব বলে। দোকানে বেবিটাকে রেখে গেলাম। বললাম, বাবুরা কেউ এলে একটু চা ক’রে দিবি। তা দেখলেন তো কাণ্ডখানা। পিছন ফিরেছি, আর ঐ শালা ঢুকল এখানে আড্ডা মারতে। মেয়েছেলের গন্ধ পেলে মাছির মত এসে সব জোটে কোথা থেকে–’ বলতে বলতে ক্ষিতীশ হঠাৎ থামল। ব্যস্তসমস্তভাবে আর একজন এসে দোকানে ঢুকল। শিবনাথ দেখেই চিনল ক্ষিতীশের দাদা রমেশ রায়।
রমেশ রায়ের গায়ে একটা বেশ ভারি মতন গরম কোট। গলায় মালার জড়ানো, মাথায় গরম কাপড়ের টুপি। কেবল তাই নয়, পায়ে মোজা, হাতে দস্তানা দেখে শিবনাথের হাসি পেল। কেননা এতটা ঠাণ্ডা পড়েনি যে, এমনভাবে গরম কাপড় দিয়ে সর্বশরীর মুড়ে রাখতে হবে।
ক্ষিতীশ হাত থেকে চায়ের বাটি নামিয়ে রেখে উঠে দাঁড়ায়।
‘চা খাবে নাকি?’
‘না।’ বলে গম্ভীরভাবে রমেশ রায় কেক্-বিস্কুটের টিনগুলোর দিকে চেয়ে থাকে। ক্ষিতীশ হাতের লুকানো বিড়িটা কায়দা করে নিভিয়ে ফেলে।
‘পাঁচু আসে এখানে চা খেতে? পাঁচু ভাদুড়ি?’
‘হ্যাঁ, মাঝে মাঝে আসে।’ ক্ষিতীশ দাদার মুখের দিকে তাকায়। চোখ বড় করে রমেশ রায় বলল, ‘খবরদার, ওই শালাকে দোকানে ঢুকতে দিবি না।’ বলে রমেশ শিবনাথের দিকে তাকায়। ‘নমস্কার, রায়সাহেবের বাড়িতে আপনি নতুন ভাড়াটে এসেছেন?’
‘হ্যাঁ, শিবনাথ প্রতিনমস্কার জানায়। এ-বাড়ির সবচেয়ে প্রতিষ্ঠাবান বিত্তশালী লোকটির সঙ্গে তার এই প্রথম আলাপ হয়।
‘মশাই, দোকান খুলেও কি আর স্বস্তিতে আছি।’ রমেশ রায় শিবনাথের পাশে বসল। ‘পাঁচুকে আপনি দেখেছেন তো?’
‘হ্যাঁ, পাঁচ নম্বর ঘরের ভাড়টে।’
শালার সিফিলিস আছে, বুঝলেন।’ রমেশ রায় চোখ-মুখের বিকৃত ভঙ্গি করল। ‘বেশ্যাবাড়ি পড়ে থাকে। ওর এসব হবে না তো কার হবে। তাই। হাজার বার ক’রে আমি ক্ষিতীশকে বলছি, না, এখানে না। ওই ব্যারাম নিয়ে শালা এখানে খেয়ে যাবে, আর সেই বাটিতে ক’রে আপনারা ভদ্রলোকেরা চা খাবেন, এটা ঠিক না, কি কি বলেন?’
‘নিশ্চয়ই।’ শিবনাথ মাথা নাড়ল।
‘তা, কে ভদ্রলোক কে ছোটলোক, সহজে কি আর চেনা যায়?’ রমেশ রায় আবার চোখ- মুখের বিকৃত ভঙ্গি করল। ম্যাট্রিক ফেল্ করে ক্ষিতীশ যখন বাড়িতে বসা, আর কোন কাজকর্ম জোটাতে পারে না, তখন অনেক ভেবেচিন্তে কিছু পুঁজি দিয়ে দোকানটা ক’রে দিলাম। আগে তো আর এ-তল্লাটে কুলি-মজুর ছাড়া কিছু ছিল না। যখন দেখলাম শহর থেকে, পাকিস্তান থেকে, ভাল ভাল লোকেরা এসে বাস করতে শুরু করেছে, মনে একটু আশা জাগল, ভাল একটা রেস্টুরেন্ট খুললে তা চলবে, লোকসান হবে না। এখন দেখছি, আমার স্পেকুলেশান ঠিক হয়নি।’রমেশ রায় থামল। শিবনাথ একটা সিগারেট ধরালে। ক্ষিতীশ উঠে পর্দার আড়ালে গিয়ে কি যেন করছে। পেয়ালাপিরিচের টুং-টাং শব্দ হয়। যেন সেগুলো ধোয়া হচ্ছে।
‘অমল চাকলাদারকে চেনেন তো?’ রমেশ প্রশ্ন করল।
‘হ্যাঁ, দশ নম্বরের ভাড়াটে।’ শিবনাথ রমেশের চোখে চোখ রাখল।
‘উনিশ টাকা শালার কাছে পাওনা মশাই। কেমনরে ক্ষিতিশ, উনিশ টাকা কত আনা যেন বাকি পড়েছে?’
‘এগারো আনা।’ পর্দার ওপার থেকে ক্ষিতীশ জবাব দেয়।
‘তা’হলে মশাই বুঝুন কি ক’রে আর কারবার চলে’। হাত ঘুরিয়ে রমেশ বলল, ‘চাকরি বাকরি করে, ভদ্রলোক ছেলে। কাজে যাবার আগে চা-টা টোস্টা-টা খেয়ে যেত, বলত, মাসের শেষে একসঙ্গে সব দাম মিটিয়ে দেবে। এখন বাছাধনের চাকরি নেই শুনলাম।’
শিবনাথ নীরব।
‘তোমার চাকরি নেই, বুঝলাম উপোস করে মরবে, কিন্তু আমার পাওনা মেটায় কে? এখন বলুন মশাই, পারিজাতের বাড়ির আপনিও তো একজন ভাড়াটে। অমল চাকলাদারও ভাড়াটে। এতগুলো টাকা বাকি পড়েছে, আপনারা আমায় বলে দিন, এর কি বিহিত করা যায়।’
শিবনাথ নিরুত্তর।
‘আমি আদায় করব। ভদ্রলোক চিনে ফেলেছি। গলায় গামছা দিয়ে উনিশ টাকা এগারো আনা আদায় না করছি তো আমার নাম রমেশ রায় নয়।’ উত্তেজনায় রমেশের মুখ-চোখ লাল হয়ে গেল। শিবনাথ দেওয়ালের দিকে চোখ ফেরায়।
‘তা আবার শালার গুমোর কত!’ যেন নিজের মনে রমেশ এবার গগজ্ করে কথা কয়। ‘কেন, এ-তল্লাটে একটা না, চার ছ’টা গেঞ্জির কারখানা আছে। কত ভাল ভাল ঘরের বৌ- ঝিরা এখন কারখানায় ঢুকে কাজ করছে। দে না বৌকে পাঠিয়ে। কিন্তু একবার সেই প্রস্তাব দিন, দেখবেন চাকলাদার আপনাকে রুখে মারতে আসবে।’
রমেশ চোখ-মুখের এবং হাতের এমন ভঙ্গি করে কথা বলল সে, শিবনাথ না হেসে পারল না।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ, এক জায়গায় আছেন, দেখবেন। দেখেছেন নিশ্চয়ই ওর বৌকে। অমলের ধারণা কমলার চেয়ে রূপসী মেয়ে এ দেশে আর একটি নেই। শালার ভাত জোটে না খেতে, বৌয়ের রূপের দেমাকে পেট ফাটো-ফাটো। হাসি পায় মশাই, হাসি পায়। আমরা জানি,–পারিজাতের সঙ্গে উঠতে বসতে, আমার সঙ্গে তো কথা হয়। দু’মাসের বাড়ি-ভাড়া জমেছে। এ মাসে ভাড়া ক্লিয়ার করতে না পারলে অমলকে দারোয়ান দিয়ে ঘাড়ে ধরে তুলে দেবে। ভদ্রলোক! কত দেখলাম। ধোপদুরস্ত জামা কাপড় পরে পারিজাতের বাড়িতে এসে ঘর ভাড়া করে থাকতে আরম্ভ করে। বাস্, দু’মাস ছ’মাস যেতে না যেতে খোলস খসে গিয়ে আসল রং বেরিয়ে পড়ে। কত দেখছি–হ্যাঁ হা।’ রমেশ এবার বিকট সুরে হেসে উঠল। তারপর হঠাৎ গম্ভীর হয়ে শিবনাথের কানের কাছে মুখ দিয়ে গলা নিচু করে বলল, ‘নতুন এসেছেন, আপনাকে আমি হুঁশিয়ার করে দিচ্ছি, পারতপক্ষে কাউকে একটা আধলা ধার দেবেন না, দিয়েছেন কি মারা পড়েছেন। মশাই বাইরে সাবান শাড়ির বাহার, ভিতরে ফুটুশ। সাবধানে পা না ফেললে বিপদে পড়বেন।’ বলে রমেশ উঠে দাঁড়াল।
‘পাঁচুকে আর দোকানে ঢুকতে দিবিনে, বুঝলি? হারামজাদার ভেনারেল ডিজিজ।’
ক্ষিতীশ ঘাড় নাড়ল। দাদাকে উঠতে দেখে সে পর্দার এপারে এসে দাঁড়িয়েছে।
‘আর, গরম জলটল দিয়ে কাপ-ডিসগুলো ভাল ক’রে ধুয়ে তবে এঁদের চা দিবি।’ শিবনাথকে, চোখের ইঙ্গিতে দেখিয়ে দিয়ে রমেশ ভাইকে উপদেশ দিলে। ক্ষিতীশ দ্বিতীয়বার ঘাড় নাড়ল। উপদেশ দেওয়া শেষ করে রমেশ আবার ব্যস্ত-সমস্তভাবে দোকান থেকে বেরিয়ে গেল।
.
এক সময় দোকান থেকে বেরিয়ে শিবনাথ ভাবছিল। এখানে এসে যেন এই প্রথম কেমন একটা অজানা আশঙ্কায় তার বুকের ভিতর ঢিবঢিব করছিল। কেন তার কারণ ঠিক অনুমান করতে পারল না যদিও সে। শেখর ডাক্তার শিশিতে জল ভরে ওষুধ বলে চালাচ্ছে। কে. গুপ্তর মেয়ে রোজ ধারে চা খায় ও মার জন্য নিয়ে যায় বলে ক্ষিতীশ সময় সময় বাবুদের চা তৈরি করে দিতে বেবিকে দোকানে রেখে অন্য কাজে বেরুচ্ছে। অমল চাকলাদার বেকার হয়ে রেস্টুরেন্টের বিল শোধ করতে পারছে না, তাই রমেশ ওর গলায় গামছা দিয়ে টাকা আদায় করবার মতলব করেছে। পাঁচু ভাদুড়ীর কুৎসিত রোগ আছে বলে তাকে আর রেস্টুরেন্টে ঢুকতে দেওয়া হবে না। এর কোন্টার সঙ্গে শিবনাথের মনে হঠাৎ একটা কালো ভয়-সিসিরে ছায়াপাতের কারণ থাকতে পারে, ভাবতে ভাবতে একবার শিবনাথ রাস্তার মাঝখানে দাঁড়িয়ে পড়ে। স্ত্রী-কন্যা নিয়ে সেও ওই বাড়িতে সারি সারি ঘরের একখানা ভাড়া নিয়ে বাস করতে আরম্ভ করেছে বলে কি? কিন্তু সে-সব পরিবারের সঙ্গে শিবনাথের মিল কোথায়, হয়তো কোনো পরিবারের সঙ্গেই কোনটার মিল নেই, একটা বাড়িরই বারোখানা কামরা যদিও, যেমন হারমোনিয়মের বারোটা রীড। কিন্তু এক একটার এক এক রকম সুর। তা হলেও, তা হওয়া সত্ত্বেও বারোটা রীডের সমষ্টিগত সুর মিলিয়েই কি ঐকতান সৃষ্টি হয়? এক উঠোন, একটা কুয়ো, এর উনুনের ধোঁয়া ওর ঘরে যাচ্ছে, ওর রান্নার গন্ধ এর নাকে আসছে, এই শিশুর কান্না ওই শিশু শুনছে, এক সংসারের অভাবের দীর্ঘশ্বাস আর এক সংসারকে ভাবিয়ে তুলছে বলে কি? কুয়াশা-কুণ্ঠিত শীত-শীত সন্ধ্যায়ও শিবনাথের কপাল ঘামে। পকেট থেকে রুমাল বার করে সে ঘাম মুছল। সাংঘাতিক রকমের একটা ক্যাচর ক্যাচর আওয়াজ তুলে মোষের গাড়িটা শিবনাথের গা ঘেঁষে চলছিল। হঠাৎ গাড়োয়ানের হৈ-রৈ শব্দে শিবনাথ রাস্তার একপাশে সরে গিয়ে আবার আস্তে আস্তে হাঁটতে আরম্ভ করল। তা হলেও, তা হওয়া সত্ত্বেও রুচি আর মঞ্জুকে নিয়ে শিবনাথের সংসারের চেহারাটাই অন্য সবগুলো থেকে স্বতন্ত্র। নিশ্চয়ই শিবনাথের এখানেই জোর। রমেশ রায়ের মত সে চায়ের দোকান খুলে বসেনি। শেখর ডাক্তারের মত হাড়কিপ্টে চশমখোর বলে তার বদনাম নেই, বিধু মাস্টারের সংসার যেমন বাচ্চায় পিলপিল করছে, শিবনাথের সে অবস্থা হয়নি তা ছাড়া, এসব ছেড়ে দিয়েও সবচেয়ে যেটি বড় কথা, রুচি উচ্চশিক্ষিতা। এ-বাড়িতে আর পাঁচটি মেয়ে কেন, কোনো পুরুষই রুচির চেয়ে বেশি লেখাপড়া করেনি। তাছাড়া কমলাক্ষী গার্লস স্কুলে রুচির পার্মানেন্ট চাকুরি। ফ্যাক্টরি না। ধর্মঘট এবং ছাঁটাইয়ের প্রশ্ন সেখানে অনুপস্থিত। তা ছাড়া শিবনাথেরও ডিগ্রী আছে। আজ সে বেকার। চাকুরি নেই। কিন্তু একটু চেষ্টা করলেই দু’তিনটা ট্যুইশানি সে সহজেই বাগাতে পারবে। এবং তার ট্যুইশানি বিধুমাস্টারের ট্যুইশানি হবে না। ছাত্রী বিদিশা দত্তর সখী চামেলীকে ভবিষ্যতের আশা বুকে জ্বেলে বিনি পয়সায় ইংরেজী প্যাসেজের মানে বলে দিতে সে পাগলের মত ছুটবে না। কেন না বিধুমাস্টারের মত শিবনাথের রোজগার খেতে এতগুলো মুখ হাঁ-করে বসে নেই। ভাবতে ভাবতে সকালবেলা মেথরের কাজে সাহায্যনিরতা বালতি-হাতে লক্ষ্মীমণির চেহারাটা হঠাৎ শিবনাথের মনে পড়ে গেল। ফুল,–বিধুমাস্টারের মত বোকা লোকদের এ-দিনে বেঁচে থাকার কোন অর্থই হয় না, নিজের মনে বিড়বিড় করে উঠল শিবনাথ। যেন তার শিস দিতে ইচ্ছা হচ্ছিল এমন হাল্কা হয়ে গেল মন। একটা সিগারেট ধরালে সে। ছিমছাম মাজাঘষা নির্মল এবং অত্যন্ত সুরক্ষিত তার সংসার। এর মূলে চৌদ্দ আনাই রয়েছে রুচির বুদ্ধি, ব্যক্তিত্ব। তার উন্নত আধুনিক মনের স্বচ্ছ বিভায় ছোট্ট সংসারটি ঝলমল করছে। ভেবে শিবনাথের বড় ভাল লাগল। রুচিকে বোধ হয় আর কোনোদিন এত ভাল লাগেনি তার, এমন ভাল করে আর দশটি সঙ্গে সে যাচাই করে দেখেনি, আজ, এখন, ক্ষিতীশের দোকান থেকে হঠাৎ মন খারাপ করে বেরিয়ে এসে খালের ধারের রাস্তা ধরে কিছুক্ষণ হাঁটবার পর যেমন দেখছিল।
.
একটি কিশোর এবং একটি কিশোরী।
শিবনাথ ঠিক ধরতে না পারলেও দু’জনের কথাবার্তা শুনে কিছুটা আঁচ করতে পারল এরা কারা।
জায়গাটা বেশ ফাঁকা এবং নির্জনে। দু’দিকে কপির ক্ষেত। সন্ধ্যার পর সিরসিরে মেঠো হাওয়া বইছিল। কিন্তু ধোঁয়া এবং ধুলো একেবারে ছিল না বলে হাঁটতে শিবনাথের ভাল লাগছিল। ময়লার খাল এবং রেললাইন পিছনে ফেলে সে অনেকদূর এসে পড়েছে। ছোট্ট একটা ঝোঁপের কাছাকাছি এসে ঠাণ্ডা অনুচ্চ দুটি কিশোরকণ্ঠ শুনে শিবনাথ ধমকে দাঁড়াল। মাথার ওপর তারার ঝিকিমিকি। ক্ষেতগুলো থেকে ওলকপির কেমন একটা মিষ্টি গন্ধ ভেসে আসছিল। ঝোঁপের ওপার থেকে পাথরের সিঁড়ি ডিঙ্গিয়ে লাফিয়ে চলা ঝর্নাধারার মত একটি কণ্ঠের কলহাস্য শিবনাথের কানে এসে লাগল। মেয়েটি হাসছে।
‘আজ আমাদের ভাত রান্না হয়নি। এ-বেলা ও-বেলা উনুনে আগুন দিতে হল না।’
‘ভালই তো, বেঁচে গেলি, কাজকর্ম করতে হল না তোর। কি খেলি?’
’ধাপার মাঠ থেকে বাবা কাল এক আঁটি মুলো চুরি করে এনেছিল।’
‘সারাদিন বুঝি মুলো খেয়ে আছিস?’
‘তুই, তোরা?’
‘ও-বেলা মুলো সেদ্দ আর ভাত হয়েছিল। এ-বেলা একটা বিস্কুট আর এক মগ জল।’
‘বিস্কুটের পয়সা কে দিলে? তোর বাবা, মা?’
‘বেবি।’ ফ্রকের তলায় দু’টো গুঁজে এনেছিল। একটা মা খেল, একটি আমি খেলাম।
‘তোর বাবা আজ মদ খেয়েছে?’
‘জানি না। হয়তো খায়নি। রোজ আর কে এত মাগ্না বোতল খাওয়াবে। তোর বাবা মদ খায় না?’
‘নাঃ, যখন বড়বাজারে বাবার ফলের কারবার ছিল, দুধ মিশিয়ে মাঝে মাঝে সিদ্ধি খেত। সিদ্ধি চিনিস কাকে বলে?’
‘তুই আমায় সিদ্ধি চেনাস, খুব চালাক হয়ে গেছিস মাইরি। তোরা যেমন কোলকাতায় ছিলি, আমরাও ছিলাম মনে রাখিস। পার্ক স্ট্রীটে কত বড় বাড়ি ছিল আমাদের।’
‘তোর বাবা ভয়ানক অসভ্য।’
‘কেন? তোকে কিছু বলেছে নাকি?’
‘আমাকে? তোর বাবা? এ-বাড়ির একটাও ব্যাটাছেলে আমার সঙ্গে কথা বলতে সাহস পায় না, জানিস?’
‘সত্যি সারাক্ষণ তুই এমন কট্মটে চেহারা করে রাখিস। যেন কত বড় মেয়েটি হয়ে গেছিস।’
‘তোর চেয়ে আমি বড় মনে রাখিস।’
‘কক্ষনো না। তোর বয়েস এখন কত শুনি?’
‘চৌদ্দ।’
খিলখিল মিঠা হাসিতে জায়গাটা ভরে গেল।
শিবনাথও মনে মনে হাসল। পারিজাতের বস্তির বাসিন্দা এরাও। কে. গুপ্তর ছেলে আর সাবানের ফেরিওয়ালা বলাইর মেয়ে।
‘আমার পনরো পার হয়ে গেছে।‘
‘তবে আর কি, এখন বিয়েটিয়ে করে সংসারী হয়ে যা। কিশোরীও এক ঝলক হাসল। ‘না রে, মন ভাল না।’ কিশোরের দীর্ঘশ্বাস শোনা গেল। ‘বাবার রুজিরোজগার নেই, আড্ডা মেরে আর মদ খেয়ে দিন কাটাচ্ছে, বেবি বড় হচ্ছে, আমার লেখাপড়া বন্ধ, মা সারাদিন শুয়ে থেকে বড় বড় নিশ্বাস ফেলছে, এসব দেখে কিছু ভাল লাগে না। এক এক সময় ইচ্ছে করে–
‘তুই এক কাজ কর্ না।’ ছেলেটির কথা থামিয়ে দিয়ে মেয়েটি প্রশ্ন করল, ‘সাইকেল জানিস?’
‘কেন?’
‘খবরকাগজ ফেরি করলে ভাল রোজগার হয়। বাবা বলছিল। বাবা সাইকেল জানে না বলে মুশকিলে পড়েছে। কাপড়কাঁচা সাবানের এখন একদম বিক্রি নেই। সাইকেল চালাতে জানলে খবরকাগজ ধরত।’
‘ও-সব আমি পারব না। লোকের বাড়ি ঘুরে কাগজ বিলানো, ধ্যেৎ লজ্জা করবে।’
একটু সময় মেয়েটি চুপ করে রইল।
‘আজ চুল বাঁধলি না?’
‘বেঁধেছিলুম ও-বেলা। এক ফোঁটা তেল নেই ঘরে তো আর চুল-টুল বাঁধব কি, ইচ্ছে করে না। অঃ, করছিস কি, ছেড়ে দে, ভীষণ লাগে।’
‘না দেখছিলাম, তোর চুল তেল না দিয়েও ভারি নরম।’
‘মেয়েমানুষের চুল নরম থাকবে না তো কি শক্ত থাকবে?’
কতক্ষণ দু’জনের কোন কথা শোনা গেল না। বেশ অস্বস্তিবোধ করছিল শিবনাথ, কেমন যেন অপরাধী বোধ করছিল নিজেকে অজানিতভাবে, হঠাৎ এখানে ঝোঁপের পাশে এসে পড়ে চুপি চুপি এদের কথা শুনছিল বলে। কিন্তু শিবনাথ তখন জায়গাটা ছেড়ে উঠে আসতে পারল না। সিসিরে বাতাস, ফিকে অন্ধকার, তারার ঝিকিমিকি ও পাশের ক্ষেত থেকে উঠে-আসা কপির সুন্দর মিষ্টি গন্ধের আমেজ তাকে সেখানে আরো কিছুক্ষণ ধরে রাখল। সিগারেট খাবার ইচ্ছা থাকলেও সে সিগারেট ধরাল না।
‘তুই একটা কাজে-টাজে ঢুকে পড় না, সাবান ফেরি করে যখন তোর বাবা সংসার চালাতে পারছে না!’
‘লেখাপড়া জানি না, আমার চাকরি দেবে কে?’
‘আজকাল মেয়েদের আবার চাকরির অভাব। কত মেয়ে কাজে ঢুকছে দেখিস না? পারিজাতের গেঞ্জির কারখানায় অনেক মেয়ে নিচ্ছে। ও-পাড়ার বেলা টগর চাঁপা কুন্দ সব ঢুকেছে। শুনছি তো এবার পরীক্ষায় পাস দিতে না পারলে আমাদের বাড়ির বিধুমাস্টারের দুই মেয়েকেও ঢুকিয়ে দেবে। তুই তো পারিজাতের বৌয়ের সমিতিতে নাম লিখিয়েছিস। একটু বললেই তো ফ্যাক্টরিতে কাজ পাস।’
‘লিখিয়েছিলুম সমিতিতে নাম। আর যাই না। পারিজাত আমার বাবাকে কুত্তা বলেছে।’
‘কবে কোথায় কখন? তুই শুনলি কি ক’রে?’ কিশোরকণ্ঠে গর্জন করে উঠল।
নিবন্ত স্তিমিত গলায় কিশোরী বলল, ‘পারিজাতের উঠানে পেয়ারাতলায় আমরা সমিতির মেয়েরা ক্যারম খেলছি সেদিন। বৌয়ের পাশে দাঁড়িয়ে পারিজাত খেলা দেখছিল। এমন সময় সেখানে সরকার গিয়ে বলল, অমল চাকলাদার, বলাই নন্দী আর কে. গুপ্তর ঘরভাড়া বাকি পড়েছে।’
‘তারপর?’
‘শুনে পারিজাত গরম হয়ে বলল, কুত্তা দুটোকে তাড়াতে না পারলে মন ঠাণ্ডা হচ্ছে না। কাঁহাতক মাসের পর মাস ভাড়া নিয়ে ঝামেলা পোহাবেন সরকার। কুকুর দুটোকে কালই নোটিশ দিয়ে দিন।’
‘শুনে সরকার কিছু বলল না?’
‘দাঁত বার করে হাসছিল।’
একটু পরে কিশোরের প্রশ্ন শোনা গেল, ‘তারপর থেকে বুঝি তুই সমিতিতে যাওয়া বন্ধ করেছিস?’
‘হ্যাঁ।’
‘বেশ করেছিস, আর যাসনি ও-বাড়ি।’
একটু থেমে থেকে পরে কিশোরী বলল, ‘আমাদের বারো ঘরের সব ভাড়াটে মিলে যদি ভাড়া বন্ধ করে দিই, খুব আক্কেল হয়।’
কিশোর তৎক্ষণাৎ কোনো কথা বলল না। যেন একটু সময় কি ভেবে পরে আস্তে আস্তে বলল, ‘আমি একদিন পারিজাত শালার মাথার খুলি উড়িয়ে দেব। টাকার গরমে শালা সব মানুষকে কুকুর বেড়ালের মত দেখছে।’
‘খুলি উড়িয়ে দিলে তোকে পুলিসে ধরে নিয়ে গিয়ে ফাঁসি দেবে।’
‘আগে তো শালা মরবে।’
কিশোর কিছু বলল না।
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর কিশোর একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলল। ‘উঃ! কত কাল সিনেমা দেখি না।’
‘আমি সেদিন ফাঁকতালে একটা বই দেখে নিলাম।’
‘কবে, কার সঙ্গে গেছলি, কি বই দেখলি?’
‘এটম বম্, কমলাদি দেখালে। আমাকে আর বীথিকে। নন্দনকানন হাউসে।’
‘ওটার সঙ্গে মিশবি না। আমি কতদিন বলেছি তোকে, কমলাটা একেবারে বাজে মেয়ে। ঠোঁটে রং মাখে আর টেনে নাকিসুরে কথা কয়, ও কক্ষনো ভাল হতে পারে না।’
‘আহা, যেন এ বয়সেই কত মেয়ে চিনিস তুই!’
‘তবে কি, আমাদের পার্ক স্ট্রীটের বনানী চ্যাটার্জিকে দেখেছি। ডোভার লেনে মামার বাসা। সে-পাড়ায় নন্দিতা রায়কে দেখতাম। আর টালিগঞ্জে ছোটকাকুর বাসায় থাকতে দেখতাম রমলা সান্যালকে। কোলকাতায় ছড়িয়ে আছে এসব মেয়ে। কিছু কিছু এখন বস্তিতেও গজাচ্ছে। ঠোঁটে রঙ মাখে, টেনে টেনে কথা কয়, আর কোমর নাচায়।’
‘আঃ, তুই ভয়ানক বাজে বকিস! কমলাদি ওরকম মেয়ে না।’
‘দেখবি আস্তে আস্তে। বীথিটাকে বখাচ্ছে, তোরও মাথা খাবে। কতর সীটে গেছলি তিনজনে!
‘দশ আনা। এক টাকা চৌদ্দ আনা গেল কেবল টিকিটে। ট্রামবাসে তেরো আনা। আর রেস্টুরেন্টে দু’টাকা খেলাম। কমলাদিই খাওয়ালে।’
‘তবেই বোঝ কোথায় তিনি এত পয়সা পান। নার্সগিরি ক’রে কত আর তাঁর রোজগার হয় শুনি?’
‘কি জানি, জানি না।’ যেন হঠাৎ বিরক্ত হয়ে উঠল মেয়েটি। ‘তুই কি বলতে চাস্ শুনি?’
‘কিছুই না।’ প্রবীণের কণ্ঠ কিশোরের। ‘বলছিলাম চাকরি ছাড়াও ওর অন্যরকম রোজগার আছে।’
কিশোরী চুপ।
‘সেদিন দেখলাম হাতে নতুন ঘড়ি। আগের মাসে জুতো কিনল, শাড়ি কিনল একজোড়া। বেশ দামী শাড়ি। মাকে দেখাতে এনেছিল। বাবা বারান্দায় বসা ছিল। শাড়ি দেখিয়ে কমলা ঘর থেকে বেরিয়ে গেলে পর বাবা ওর সম্পর্কে যা ওপিনিয়ন দিলে, অবশ্য ঘুরিয়ে বলেছিল কথাটা মাকে। কিন্তু আমি বুঝে গেলাম।’
‘কি বুঝলি? সেজন্যই তো কমলাদি সেদিন বলেছিল তোর বাবা ভয়ানক অসভ্য।’
‘তাই বল, ওটা কমলার কথা, আমার বাবা অসভ্য।’ কিশোর অল্প শব্দ ক’রে হাসে। ‘ঠিক ধরেছে। জহুরী জহর চেনে। বাবাও ওকে চিনে ফেলেছে। বুঝলি, একটা কমলা না। দশটা কমলা বাবার আপিসে চাকরি করত। কমলা করবে এবাড়িতে ফুটোনি। বাবার সামনে। সেজন্যেই তো বাবা ওকে দু’চোখে দেখতে পারে না।’
তোর পায়ে ধরি, ওর কথা এখন রাখ। কাজের কথা বল্। আমায় কবে সিনেমা দেখাবি? খুব ভাল হয়েছে শুনছি আনারকলি।’
‘দাঁড়া বলেছি তো, একদিন আমাতে তোতে একটা ভাল ছবি দেখব।’ স্তিমিত নিষ্প্রিভ গলায় কিশোর বলে, ‘কিছুতেই পাঁচ সিকে পয়সা যোগাড় করতে পারছি না।’
‘পাঁচ সিকে, আর বাস ভাড়া। আনারকলি হচ্ছে সেই কোথায় শ্যামবাজার। এখানে! রেস্টুরেন্ট না হয় না-ই খাওয়া গেল। যাতায়াতের ভাড়া নিয়ে অন্ততঃ দুটো টাকা লাগবেই।’ দাঁড়া, আমার এক ফ্রেন্ড-এর কাছে গোটা পাঁচেক টাকা ধার চেয়েছি। হয়তো দেবে। পাঁচ সাত দিন দেরি হতে পারে।’
‘কে ফ্রেন্ড? ও সেই যে একটা ছেলে এসেছিল একদিন তোর কাছে! কোট-পেন্টলুন পরা।
‘হ্যাঁ, স্যুট পরে এসেছিল সন্তোষ। পার্ক স্ট্রীটে বাসা। ওদের আর ঠিক দুটো বাড়ি পরেই থাকতাম আমরা। মস্ত বড়লোক সন্তোষের বাবা। কী সব মেশিনারীর দোকান আছে মিশন রো-তে।’
‘হ্যাঁ, মন্দ না দেখতে, চুলগুলো খুব সুন্দর।
‘তোর খুব পছন্দ হয়েছিল?’
‘যাঃ, কি বলতে কি বুঝিস।
‘হো-হো।’ তরল স্নিগ্ধ হাসি মাঠের বুকে ছড়িয়ে পড়ে! ‘আসুক আর একদিন সন্তোষ। বলব ময়না তোর প্রেমে পড়েছে।’
‘এই রুণু!’
‘ওর চুল সুন্দর, আমার চেয়ে অনেক বেশি সুন্দর, কেমন রে?’
‘আমি চললাম। অসভ্য। আমি বলেছি নাকি তোর চুলের চেয়ে ওর চুল সুন্দর? নাকটা খ্যাঁদা, কপালটা উঁচু। স্যুট পরলে কি হবে। বানরের মত দেখায়।’
‘মাইরি?’ রুণু হাসে।
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ।’ দৃপ্ত শাণিত গলা ময়নার। ‘ছেঁড়া শার্ট-পেন্টলুন হলে হবে কি। এই চেহারার কাছে ওই চেহারা দাঁড়াতে পারে না। এমন অদ্ভুত নাক পাবে কোথায়। সত্যি একখানা নাক নিয়ে এসেছিলি সংসারে? দেখি।’
‘আঃ লাগে।’
‘আ-হা, ননীর শরীর,’ মৃদু ঝোঁপের ভিতর দিয়ে কাঠবেড়ালের চলার মতন খসখসে গলার স্বর। ‘না ছুঁতে ভেঙে যায়, কেমন?’
শিবনাথ সর্বাঙ্গে রোমাঞ্চ অনুভব ক’রে একসময় উঠে দাঁড়ায়।
৯
বনমালীর দোকানের সামনের পায়া-ভাঙ্গা বেঞ্চে বন্ধুকে বসতে দিয়ে কে. গুপ্ত হাসল, ‘এই আমার রাজসিংহাসন ব্রাদার, বোস।’
চমৎকার, চমৎকার।’ বন্ধুর চারদিকে চোখ বুলিয়ে রাজসিংহাসনে বসল। ‘খুব ভাল জায়গায় এসে আস্তানা গেড়েছে যা হোক। কে. গুপ্ত জোরে হাসে। বন্ধুকে তার বস্তির ঘর উঠোন পাইখানা সব দেখিয়ে এখন বৈঠকখানায় অর্থাৎ মুদিদোকানের সামনে নিয়ে এসেছে, দু’জনে ব’সে অনেকদিন পরে একটু সুখদুঃখের গল্প করবে বলে।
‘হ্যাভ এ স্মোক।’ কে. গুপ্ত বন্ধুকে বিড়ি অফার করল। বুদ্ধিমান চারু রায় কোনপ্রকার দ্বিধা না করে হেসে হাত বাড়িয়ে বিড়ি তুলে নিলে।
‘খাকী।’ গুপ্ত চোখ বড় বরে হেসে বন্ধুর দিকে তাকায়।
‘দ্যাটস অলরাইটল। তারপর কেমন আছ? ছেলেমেয়ে ভাল আছে? ওয়াইফ কি সিক্?’
‘না।’ গুপ্ত মাথা নাড়ল। ‘মন খারাপ তাই অহোরাত্র শুয়ে কাটান।’
চারু রায় এসম্পর্কে আর কিছু প্রশ্ন না করে বরং অধিকতর উচ্ছল হাসবিচ্ছুরিত চোখে বন্ধুর দিকে তাকায়। দারুণ জায়গায় এসে বাসা বেঁধেছ ভায়া। ভাবছিলাম, তাই তো, কোথায় গেল আমাদের গুপ্ত, এমন শৌখিন লোক এমন সুখের পায়রা কোলকাতার আড্ডা ছেড়ে দিয়ে কোন্ বনে উড়ে যেতে পারে আমরা বন্ধুরা কেবলই বলাবলি করছিলাম। এ্যাঁ, ইন দি লঙ রান তুমি যে দেখছি সুন্দর মৌ-বনটিতে এসে যাকে বলে গা-ঢাকা দিয়ে আছ।’
বনমালী হাঁ ক’রে তাকিয়ে রীমলেশ চশমা পরা দাঁড়িগোঁফ কামানো ফর্সা ধবধবে চারু রায়ের মেয়েলী চেহারা দেখছিল। কথা শুনে এখন মুখ টিপে হাসল।
‘মৌ–বনই বটে, মৌ-মাছির ঝাঁক।’ গুপ্ত খুশি হয়ে ঘাড় নাড়ে, কিন্তু পরক্ষণেই মুখ কালো করে। দুঃখের বিষয় মধু খাওয়া হয় না।’ টাকা বাজানোর মত দু’আঙুলের মাথায় বাড়ি মেরে কে. গুপ্ত হতাশ ভঙ্গিতে বন্ধুর দিকে তাকাল, ‘এই না হলে ভুবন মিছে।’
‘দরকার কি।’ ক্রিজ করা পেন্টলুন সমেত পায়ের ওপর আর এক পা তুলে দিয়ে চারু হঠাৎ মেরুদণ্ড টান করে সোজা হয়ে বসল? টাকা খরচ করে মধু খাওয়ার চেয়ে মধু বিক্রি করে টাকা রোজগার করছ না কেন? ওটাই তোমার এখন করা উচিত।’
‘কে কিনবে শুনি, কার কাছে বিক্রি করব?’
‘হোপলেস।’চারু হতাশ ভঙ্গিতে আকাশের দিকে তাকালো, একটু যেন ভাবল কি, তারপর গুপ্তর দিকে চোখ নামিয়ে মৃদু হাসল। ‘আমি, আমরা। তুমি কি চারু প্রডাকসনের নাম ভুলে গেছ?’
গুপ্ত চোখ বড় করল।
‘নতুন বইয়ের হাত দিয়েছ নাকি?’
‘হ্যাঁ।’ চারু দৃপ্ত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল। ‘কাগজে বিজ্ঞাপন দেখছ না?’
‘কাগজ আর পড়ি না।’
‘না পড়া ভাল। কিন্তু আমি তো এলাম তোমাকে জানাতে। আমার এখন একটা না, এক ঝাঁক মৌমাছির দরকার, দাও, পার দিতে?’
‘এত!’
‘হ্যাঁ এত।’ বুক ফুলিয়ে চারু সতেজ ভঙ্গিতে বলল। ‘কয়েক ডজন মেয়ের দরকার আমার ছবিতে। আই ওয়ান্ট ডজনস আর গার্লস্, দাও।’
গুপ্ত কথা বলে না।
‘এমন ছবিতে হাত দিয়েছি আমি যা আর সব বাংলা আর হিন্দীকে একসঙ্গে কানা করে দেব।’
‘অনেক মেয়ের পার্ট আছে বুঝি বইয়ে।’
‘হ্যাঁ, অনেক সেক্স। দেখি কোন্ ব্যাটারা টেক্কা দেয় চারু রায়ের ডিরেকশনের সঙ্গে, কোন্ ছবি মাথা তোলে মায়াকাননকে ছাড়িয়ে।
‘ছবির নাম মায়াকানন হবে বুঝি?’ ওধার থেকে বনমালী প্রশ্ন করল।
চারু রায় এ-প্রশ্নের জাবাব দিলে না। পকেট থেকে সোনার সিগারেট কেস বার করে কে. গুপ্তকে সিগারেট অফার করল। সিগারেট ধরিয়ে গুপ্ত এক চোখ ছোট ক’রে বন্ধুকে বললে, ‘তা এ-বনের মৌমাছিদের কেমন দেখলে?’
‘ওটি কে, ওই যে বারান্দার খুঁটি ধরে দাঁড়িয়ে ছিল?’
‘ওটা কিস্তু না। বাজে। দেখলে না কেমন লম্বাটে ধরনের থুতনি।’ মুখ বিকৃত করল গুপ্ত এবং নাক দিয়ে সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ল। শেখর ডাক্তারের মেয়ে। অ্যান্ড শী ইজ গোয়িঙ টু বি ম্যারেড সুন।’
‘চুলোয় যাক।’ ভক্ করে একগাল ধোঁয়া বার ক’রে চারু ঠোঁট বাঁকা করল। ‘আর একটিকে দেখলাম মাগ্ হাতে কুয়োতলার দিকে যাচ্ছিল! শ্যামলা চেহারা।’
হ্যাঁ, এর বড়টাই টেলিফোন কাজ করে। মন্দ না। ফেসকাটিং ভাল।’ গুপ্ত ঘাড় নেড়ে বলল, ‘বীথি নাম।’
চারু কিছু বলল না, শুধু একটা লম্বা নিশ্বাস ফেলল।
‘কিন্তু আসলটিকে তুমি দ্যাখেনি।’ গুপ্ত মিটিমিটি হাসল! ‘হাজবেন্ড ঘরে ছিল ব’লে বারান্দায় বেরিয়ে আসতেই সাহস পেলে না।’
’কত নম্বর ঘর?’ চারু ভ্রূকুঞ্চিত করল। ‘চার্মিং?’
‘বলে কিনা চার্মিং।’ গুপ্ত জোরে সিগারেট টান দিল। তারপর বেশ খানিকটা ধোঁয়া গলাধঃকরণ ক’রে বাকিটা মুখ থেকে ছাড়বার সময় তাই দিয়ে সুন্দর একটা রিং তৈরি করে ফেলল। ধোঁয়ার চাকাটা ঘুরতে ঘুরতে একদিকে উঠে যাবার পর কে. গুপ্ত বলল, ‘তোমার সেক্সের ছবির হিরোইন হতে পারে।’
‘এমন!’ চারু ভ্রু টান করল। ‘আহা, একবার দেখতে পেলাম না।’
‘পাগল হয়ে যাবে রায়। আমি অলরেডি পাগল হয়েছি।’ কে. গুপ্ত হপকিন্স আওড়ায়–
How to keep is there any, any, is there none such, nowhere known some, bow or brooch or braid or brace, lace…latch or catch or key to keep.
Back beauty, keep it, beauty, beauty beauty… from vanishing away?
‘এভেলেবল?’ চারু ভুরু কুঁচকোয়।
‘তা জানি না।’ গুপ্ত মাথা নাড়ল। তবে কানাঘুষা শুনছি শ্রীমান শীগির বেকার হচ্ছে, হয়তো হয়েই গেছে! কাল কোন্ ঘর থেকে আটা ধার করে এনেছিলেন বধূ। সেটা আর ফিরিয়ে দিতে না পেরে খুব অপমানিতা হয়েছেন।’
চারু গম্ভীর হয়ে কি ভাবে।
‘আমার মৌবনের কুইন।’ গুপ্ত বেশ জব্দ করে হাসে। ‘একবার প্রপোজ করতে পার। ভাল টাকা দিয়ে শ্রীমানটাকে যদি বশ করতে পার, অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে বুঝিয়ে বলতে হবে আজকাল অনেক কুলীন ঘরের বৌ-ঝিরা ফিল্মে নামছে, দোষের কিছু নেই, নতুন মফস্বল থেকে এসেছে, বুঝবে না–’ গুপ্ত হঠাৎ থামল। কেননা তার কথা এমনিও চাপা পড়ে গেছে একটা মোটরের শব্দে। গুপ্ত, চারু রায় এবং ওধারে আর একটা বেঞ্চে বসা শিবনাথ, বলাই ও দোকানের ভিতর থেকে বনমালী ঘাড় টান করে দেখল অদূরে লিচুতলায় কর্পোরেশনের জলের গাড়ি এসে দাঁড়িয়েছে।’
এ-পাড়ায় বাসিন্দা বেড়েছে। পাইপের জলে কুলোচ্ছে না বলে দু’বেলা পিপে গাড়িতে ক’রে ‘পানীয় জল’ বিলানো হয়। গাড়ি এসে দাঁড়াতে না দাঁড়াতে পিল পিল্ করে ছুটে আসে মানুষ। সে-এক কাণ্ড। কে আগে জল ধরবে এই নিয়ে মারামারি। লাইন করে সাজিয়ে রাখা কলসী বালতি ডেক্চি গামলা হঠাৎ ঝন্ঝন্ শব্দ ক’রে ছত্রখান হয়ে যায়। কেননা যতটা সময় গাড়ি দাঁড়াবার ও যত গ্যালন জল ঢালবার কথা তার চেয়ে প্রায়ই বালতি কলসীর সংখ্যা বেশি হয়ে যায় বলে শেষ পর্যন্ত আর লাইনের নিয়ম রক্ষা হয় না। এর মাথায় ওপর দিয়ে ওর বালতি ছুটে যায়, ওর পায়ের ফাঁক দিয়ে এর ডেকচি বেরিয়ে আসে। চলকানো জলে কারো মাথা ভেজে, কারো ব্লাউজ। বকাবকি ঝকাঝকি।
‘হরিবল’। দৃশ্য দেখে ঘাড় ফেরাল।
‘আমাদের চোখ সওয়া হয়ে গেছে, দেখতে দেখতে গা-সওয়া।’ কে. গুপ্ত শেষ টান দিয়ে সিগারেটের টুকরোটা দুরে ছুঁড়ে ফেলে দেয়। ‘এখানে বসে অই ত দেখি।’
‘এখানকার ম্যানেজমেন্ট আরো ভাল হওয়া উচিত।’ ছোট্ট একটা নিশ্বাস ছেড়ে চারু রায় বলল, ‘এতগুলি ভদ্দরলোকের বাস যেখানে, সেখানে–’ কথা তার হঠাৎ থেমে যায়। কে. গুপ্ত প্রায় হুমড়ি খেয়ে পড়ে বন্ধুর একটা হাত চেপে ধরল। ‘দ্যাট, দ্যাট লেডী, এ কুইন, লুক ইয়ন্ডার।’চারু রায়ের কানের কাছে ফিসফিস করে উঠল কে. গুপ্ত। চারু রায় চমকে লিচুতলার দিকে ঘাড় ঘোরায়। তারপর হাঁ করে তাকিয়ে দেখে।
মাটির কলসী কাঁখে বিধুমাস্টারের দুই মেয়ে মমতা সাধনা, পিছনে একটা বড় বালতি হাতে ময়না বীথি টগর। তারপর করবী ছন্দা বেবি। ওদের হাতে মাগ্ ঘটি। এবং বেবির ঠিক পিছনেই চলছিল কমলা। দশ নম্বর ঘরের গৃহিণী। আঁচল খসে খোঁপাটা দেখা যাচ্ছে। একটা বড় কুন্দফুল গোঁজা। আর কলসীর ভারে যৌবনপুষ্ট শরীরে দোলা লাগছিল। গভীর জলের বুকের মন্থর ঢেউয়ের মতন। কমলার পিছনে আর কেউ ছিল না। শেষ পর্যন্ত ওর সবটাই দেখা গেল, তারপর বাসকের বেড়ার আড়াল পড়ে যাওয়াতে আর কিছু দেখা গেল না। জল নিয়ে ঘরে ফেরার দল অদৃশ্য হ’ল।
দেখা শেষ হ’তে চারু ঘাড় ফেরায়।
‘মক্ষীরাণী কিনা?’ গুপ্ত চোখ বড় করে আছে।
তৎক্ষণাৎ কথার জবাব না দিয়ে চোখ বুজে চারু কি যেন চিন্তা করল, তারপর সোনার ডিবে থেকে সিগারেট তুলে বন্ধুকে একটা অফার করে এবং নিজে একটা মুখে গুঁজে তাতে অগ্নিসংযোগ করল। সিগারেট দুটো টান দেবার পর আস্তে আস্তে বলল, ‘দ্যাখো গুপ্ত, যজ্ঞ যখন আরম্ভ করেছি, সম্পন্ন করবই। আই উইল ট্রাই, মাস্ট ট্রাই। আই লাইক টু হ্যাভ অল দোজ ফেসেস। কি নাম বললে আগের দুটির? বাপ মাস্টার? তাতে আটকায় না, আটকাচ্ছে না আজকাল। লিলুয়া থেকে আমি ডলিকে পেয়েছি, বাপ মাস্টার ঠিক নয়, টোলের পণ্ডিত। আরো গোঁড়া আরো ভীরু। কিন্তু কী করবে, পেট বড় কি মান বড়। বরানগরের সুমিতার বাবা তো রিসার্চ স্কলার। মফস্বলের কোন্ কলেজের প্রোফেসর ছিলেন এককালে। বুড়ো বয়স তার অন্ধ হয়ে গিয়ে কি আর হবে, সুমি গাইতে পারে ভাল, দিলেন ফিল্মের ঢুকিয়ে। তেমনি আমার মীরা, চিত্রা, পাখি বোস, টেবি রায়। মোট আটটি মেয়ে আমি জোগাড় করতে পেরেছি এবং বংশ বল গোত্র বল পরিবারের শিক্ষাদীক্ষা ও সামাজিক মর্যাদা বিচার করলে কেউ তারা হীন নয়। কাজেই এখানেও যে আমি একেবারে নিরাশ হব বলা চলে না।’
‘গুপ্ত চুপ ক’রে সিগারেট টানতে লাগল।’
‘আরো আট দশটি মেয়ের আমার দরকার হবে। অ্যান্ড অল শ্যড বি নিউ ফেসেস। ছবি তোলার কাজে এই হল আমার প্রিন্সিপল। বিশেষ যে-সমাজ অবলম্বন করে আমার গল্প সেই সমাজের সেই অবস্থার মুখগুলোকে একত্র করে বই আরম্ভ করতে না পারা তক প্রাণ ঠাণ্ডা হবে না। আন্ডারস্ট্যান্ড?’
গুপ্ত কথা না কয়ে ঘাড় নাড়ল।
‘মায়াকানন মধ্যবিত্ত বাঙ্গালী সমাজ নিয়ে ছবি?’ ওধারের বেঞ্চের শিবনাথ প্রশ্ন করে। ‘ক্ষয়িষ্ণু নরনারীর গল্প?
‘হ্যাঁ।’
‘তার ওপর সেক্স-এর কড়া রঙ!’ এপাশ থেকে কে. গুপ্ত দাঁত বের করে হাসল। ‘চমৎকার ছবি হবে।
ইকনমিক ফ্রাসট্রেসান আর সেক্স অঙ্গাঙ্গী জড়িত’, চারু রায় বক্তৃতা ক’রে বলল, ‘যুদ্ধোত্তর জার্মেনীতে এই হচ্ছে, জাপানে হচ্ছে। আজ বাংলাদেশেও যা ঘটছে, তার প্রথম ছবি আমি তুলব। অ্যান্ড দিস্ উইল বি এ গ্রেট পিক্চার। কথা শেষ করে চারু ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। সবাই শুনে চুপ।
‘এই ছবি দেখলে গায়ে কাঁটা দেবে, রক্ত হিম হবে, অথচ ছবি শেষ হয়ে যাবার পরও লোকে জায়গা ছেড়ে উঠতে চাইবে না।’
‘এত অ্যাপীল, এমন ইন্টারেস্টিং?’ ওধার থেকে শিবনাথ চোখ বড় করল।
‘হ্যাঁ।’ চারু এবার শিবনাথকে সিগারেট অফার করল। ‘আছে নাকি আপনার জানাশোনা মেয়ে। মোটামুটি ইন্টেলিজেন্ট মডারেট শিক্ষিত। চেহারা যে খুব একটা মেনকা উর্বশী হতে হবে, তার তার কিছু নেই। ধরুন মিস ইভা চ্যাটার্জি সাবানের কারখানায় কাজ করছে, ওর অপ্সরী রূপ হবার দরকার নেই। সাধারণ প্লট, কমন জিনিস নিয়ে গল্প হলে কি দরকার, কাদের দরকার বুঝতে পারছেন?’
অল্প হেসে শিবনাথ মাথা নাড়ল।
‘হ্যাঁ, জানাশোনা এমন কাউকে অবশ্য দেখছি না।’
‘না, না, তোমার টু-সীটার নিয়ে দিনকতক ঘোরাঘুরি কর এ-পাড়ায়, একটু চেষ্টা করলে, খোঁজাখুজি করলে পেয়ে যাবে মনের মত মুখ।’ গুপ্ত বন্ধুকে উৎসাহ দিয়ে তার সোনার ডিবে থেকে নিজেই হাত বাড়িয়ে একটা সিগারেট তুলে নিলে। ‘চাকরিই তো করছে এখন চৌদ্দ আনা। ঘরে ব’সে আর কটা মেয়ে। এসো মাঝে মাঝে, আমরা বলে কয়ে দেখব’খন।
‘ডিসেন্টভাবে থাকবার মেয়েদের এখন অই তো একটি লাইন।’ পকেট থেকে সিল্ক-এর রুমাল বের করে মুখখানা একবার মুছল। ‘একটু পার্টস আছে এমন মেয়েদের কেরিয়ার গড়ে তোলার কত বড় সুযোগ!’ আমাদের বাংলা দেশের মেয়েরা বোম্বে মাদ্রাজের মত সাড়া দিতে পারছে না।’
‘ভীরু, বড় লাজুক।’ ওধার থেকে শিবনাথ বলল, ‘একটু দেরি করছে। কিন্তু দেবে সাড়া।’
চারু রায় আর মন্তব্য করল না।
‘আচ্ছা, আজ উঠি ব্রাদার।’ একটু পর কে. গুপ্তের দিকে তাকিয়ে সে উঠে দাঁড়াল। আর এক শনিবার আসব। কুইনকে জুটিয়ে দাও গুপ্ত। বলে কয়ে দ্যাখো। তোমাকে আমি মোটা কমিশন দেব। এ বিউটিফুল ওম্যান। কী নাম না যেন বললে হ্যাঁজবেন্ডের, কত নম্বর ঘর?
‘অমল চাকলাদার, দশ নম্বর ঘর।’ কে. গুপ্ত কিরণের স্বামীর নাম ও ঘরের নম্বর বলল। চারু নোট বইয়ে টুকে নিলে।
‘মাঝে মাঝে দেখতে পাবেন মশাই, আসব এ-পাড়ায়, চলি আজ, নোট বই পকেটে পুরে চারু শিবনাথের দিকে তাকায়।’
‘আসবেন বইকি’, হেসে শিবনাথ বেঞ্চ ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ‘রিলিজ্ড হোক। মায়াকানন ছবি আমি দেখতে ভুলব না।’
যেন এ কথার উত্তর দেওয়া অনাবশ্যক মনে করল চারু রায়। অথবা যেন উত্তরে কি বলবে ভেবেও মুখে সেটা আর প্রকাশ করলে না, মুচকি হেসে হরিতকী গাছের ছায়ায় রাখা তার হলদে টু-সীটারে গিয়ে চাপল।
গাড়িটা অদৃশ্য হ’তে কে. গুপ্ত বেশ শব্দ করে হসল। শালা সিনেমার মেয়ে খুঁজতে গেরস্ত পাড়া অবধি ধাওয়া করছে।’
‘আমাদের পাড়ায় একটাও মেয়ে পাবে না।’ বলাই এই প্রথম মুখ বলল।
‘তোরা সেইজন্যেই তো না খেয়ে মরিস হতভাগার দল।’ কে. গুপ্ত বলাইয়ের দিকে তাকায়। ‘কেন, দে-না তোর ময়নাকে ঢুকিয়ে,–ভাল চেহারা, উঠতি বয়েস, বলব চারুকে?
‘ময়নার মা আপত্তি করবে।’
‘তাতে বয়ে গেল। তুই বাপ। তোর অনুমতি থাকলেই হ’ল।’
‘নাঃ।’ যেন একটু সময় কি ভেবে বলাই মাথা নাড়াল। ‘সিনেমায় ঢুকলে ছেলেমেয়ের চরিত্তির বিগড়ে যায়। ওটা ভালো রাস্তা না সাহেব।’
‘তবে মরগে যাও।’ ভ্রূকুঞ্চিত করলে গুপ্ত। ‘আমি ভেবেছি বছর দুই যাক, আমার বেবিটাকে ঢুকিয়ে দেব। প্রমিনেন্ট নাক-চোখ আছে। একটু দিশা থাকলে শাইন করতে পারবে।’
‘তাই দাও, তাই দিও গুপ্ত। এখানে ভাঙ্গা টুলে বসে গাছের পাতা গুনলে দিন যাবে কেন।’ বলে বনমালী মুচকি হাসে। দেখে শিবনাথও হাসল।
‘কি মশাই, আপনারও প্রেজুডিস আছে নাকি। চান্স পেয়ে ওয়াইফ যদি ফিল্মে নামতে চান আপনি আপত্তি করবেন নাকি?’
হঠাৎ এ-প্রশ্নের জবাব দিতে হবে, যেন প্রস্তুত নেই, এমন ভাল ক’রে শিবনাথ গুপ্তর মুখের দিকে তাকায়।
‘বলুন তো চারুকে বলি, রাজী আছেন?’
এবার বেশ অপ্রস্তুত হয়ে ও ঈষৎ আরক্ত হয়ে শিবনাথ মাটির দিকে তাকায়। যেন ভদ্রলোকের অসহায় ভাব লক্ষ্য ক’রে বনমালী বলল, ‘ওঁরটা উনি পরে ঠিক করবেন। তুমি আগে বলে কয়ে অমলকে রাজী করাও গুপ্ত। আহা ঐ চেহারা পর্দার উঠলে শহরসুদ্ধ লোক ভেঙ্গে পড়বে ছবি দেখতে।’কথা শেষ ক’রে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বেশ চড়া গলায় সে হাসল, তারপর হঠাৎ গুপ্তর চোখে চোখ রেখে গম্ভীর গলায় বলল, ‘খবরদার, ওটি করতে যেওনা গুপ্ত! বৌ-পাগলা মানুষ অমল। এমনধারা প্রস্তাব দিতে গেলে তোমার মাথা আল্গা ক’রে দেবে ও দায়ের কোপে।’
‘তোর মতন গজমূর্খ কিনা আমি।’ তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে কে. গুপ্ত মাথাটা কাত করল। ‘অমলের কানে এ-প্রস্তাব দিতে যাব কেন? বলতে হয় সোজাসুজি কিরণকেই একদিন নিরিবিলি ডেকে বলব–জিজ্ঞেস করব, রাজী কিনা।’
‘সেই নিরিবিলি তোমায় দিচ্ছি কে, পাচ্ছ কোথায় একলা যে ভুলিয়ে ভালিয়ে ওকে সিনেমায় নামাবে।’ বেশ তাচ্ছিল্যের ভঙ্গিতে বনমালী কে. গুপ্তর দিকে তাকায়। ‘বাড়িভরা মানুষ। এখন এখানে রাস্তায়ও রাতদিন লোক গিসগিস করে।
‘শালা, ঈশ্বর সহায় হলে পাড়া ঠাণ্ডা হ’তে কতক্ষণ। ধর কলেরা লেগে চৌদ্দ আনা লোক সাফ হয়ে গেলে, বাকি দু’আনা পালাল প্রাণের ভয়ে। রইল শুধু কিরণ, আর আমি, আর তুই। আমি তোর দোকানের দরজায় এমনি ব’সে আছি। কর্পোরেশনের জলের গাড়ি এল জল দিতে। বস্তি থেকে কলসী কাঁখে বেরিয়ে এলো সেদিন একলা কিরণ। এমন দিনও তো আসতে পারে, কি বলেন মশাই।’
কে. গুপ্ত শিবনাথের দিকে চেয়ে টেনে টেনে হাসে। ঈশ্বর সহায় থাকলে সংসারে কি না হয়।’
শুনে শিবনাথ, বনমালী ও বলাই একসঙ্গে হেসে উঠল।
সেদিন সকালে আড্ডা জমল ভাল।
ঠিক দুপুরটি হলে শহর থেকে ফেরিওয়ালা এখানে আসতে আরম্ভ করে। চীনা সিঁদুর আসে, আলতা আসে, সেফটিপিন, ধূপকাঠি, কাগজের ফুল, আয়না চিরুনি, চুলের কাঁটা, ফিতা–
এত বড় কাঠের বাক্সের মাথায় দোকান সাজিয়ে হাজার রকমের মনোহারী নিয়ে সাড়ে ছ’আনা আসে, কাঁচ পরানো বাক্স বুকে ঝুলিয়ে আসে রেশমি মেঠাই, অবাক-খাবার। আঙুর আপেল বেচাতে আসে, কেউ বা শুধু কলা। কেউ না ডাকলেও ফেরিওয়ালা বস্তিতে ঢোকে এবং সোজা উঠোনে চলে আসে।
আর মাছির মতন ঝাঁক বেঁধে তখন সকলের আগে ছেলেমেয়েগুলো ফেরিওয়ালার বেসাতি ঘিরে দাঁড়ায়। পিছনে দাঁড়ায় বৌ-ঝিরা, সকলের পিছনে বুড়ীর দল। তারা চোখে কম দেখতে পায় এবং ঠেলাঠেলি করার মতন গায়ে জোর পায়না বলে জিনিস দাম করার চাইতে সামনের মাথাগুলোকে দন্তহীন মাড়ি দিয়ে চিবোতে বা প্রত্যেকটিকে এই মুহূর্তে যমপুরীতে পাঠাতে পছন্দ করে বেশি। ভাগ্যিস ক্ষীণ কণ্ঠের অভিসম্পাত বা তিরস্কার কারো কানে পৌঁছায় না। যুবতীর কলহাসি, বালিকার চিৎকার, শিশুর আবদারে কান্না বা হাসিতে কানে তালা লেগে যায়। জিনিস কেনার চেয়ে দেখার, হাতাবার এবং শুধুই দরদস্তুর করার আগ্রহ দেখে ফেরিওয়ালারা ক্রমাগত চিৎকার করতে থাকে এবং বেসাতি গুটিয়ে তখনি সরে পড়ার ভয় দেখাতে থাকে। কিন্তু এসেই ও চলে যাবে সাধ্য কি, রাস্তা কোথায়! কাচ্চাবাচ্চা এবং বড় মানুষের দঙ্গলের মধ্যে আটকা পড়ে লোকটা হাঁসফাঁস করতে থাকে এবং ভবিষ্যতে এ-বস্তিতে আর ঢুকবে না ব’লে সবাইকে শুনিয়ে প্রতিজ্ঞা করে। যদিও বাড়ির লোকগুলো এবং তার চেয়েও বেশি সে নিজে জানে যে কাল আবার ঠিক এমন সময় তাকে এই উঠোনেই ফিরি নিয়ে এসে দাঁড়িতে হবে।
অনেকক্ষণ হাতে নিয়ে নাড়াচাড়া করার পর বিমল হালদারের বৌ হিরণ কাঁচের বাটিটা কিনল। বীথির বড় বোন প্রীতি কিনল প্লাস্টিকের কুরশী-কাঁটা। কমলা কিনল জুতোর কালি। রমেশ-গিন্নীও অনেকক্ষণ ইতস্তত করার পর মেজো মেয়ের আবদারে একটা স্নো ও একটা পাউডার-পাফ কিনলে। ডাক্তারের মেয়ে কিনল লাল সবুজ সুতোর লাছি। একটা টেবিল ক্লথ তৈরী করছে সে। সম্ভবত, বিয়ে হলে ওটা ওর বরের টেবিলে বিছাবে, মনে মনে ঠিক ক’রে এখন রাতদিন ওটা নিয়েই পড়ে আছে। চার কোণায় চারটে গোলাপ, মাঝখানে শুধু তিনটি পাতা। একটা ফুল ও পাতার কাজ একটু বাকি আছে, তাই আজ আরো খানিকটা সুতো কিনে নিলে। ডাক্তার-গিন্নী প্রভাতকণা টেবিল ঢাকনাটা তাড়াতাড়ি সেরে ফেলতে মেয়েকে চাপ দিচ্ছে। এবং এখন সুনীতির সুতো কিনতে খাওয়া শেষ না হতে এঁটো হাতে ছুটে এসেছে উঠানে ও বাঁ-হাতে লাছি দু’টো তুলে নিয়ে বার বার পরীক্ষা করছে রংটা পাকা কি কাঁচা! এবং গলা বড় করে তিনবার ফেরিওয়ালাকে জিজ্ঞেস করল টেবিল ঢাকনার কাজ হবে, ধোপে টেঁকবে কি না, এ-ঢাকনা জামায়ের টেবিলে থাকবে। হেসে ফেরিওয়ালা ঘাড় কাত করে বলেছে, এক ধোপ কেন সাত ধোপেও রং উঠবে না। শহরের তিনটে পাড়ায় এইমাত্র সে বারো লাছি সুতো বিক্রি ক’রে এল। সেদিন বালিগঞ্জে বিক্রি করেছে বিশ লাছি। বিধু মাস্টারের বৌ ছোট দু’ছেলে ও এক মেয়ের জন্যে তিনটে পেন্সিল কিনে পয়সার অভাবে আর কিছু কিনতে পারে না।
‘আর কারো কিছু চাই?’ ফেরিওয়ালা হাঁক দেয়, যেন দোকান গুটিয়ে এখনি উঠবে, ঘন ঘন সকলের মুখের দিকে তাকায়। কিরণ হাত থেকে কাঁচের কুঁজোটা নামিয়ে রাখল, ময়না সাবানটা কিনতে পারলে না। হিরুর মা ও প্রমথর মা শেষমুহূর্তে একটা করে কাঁচের গ্লাস ও কুঁজো কিনল এবং সেজো মেয়ের আবদার রাখতে রমেশ-গিন্নী প্লাস্টিকের বড় সোপ-কেসটা কিনল। পাঁচু ভাদুড়ীর বৌ কিনল আলতা। আর কেউ কিছু কিনবে না, এই বেলা দোকান তোলা যায়, ফেরিওয়ালা ভাবছিল, এমন সময় তিন লাফে ঘর থেকে ছুটে বেরিয়ে এল এক পুরুষ। অমল চাকলাদার। এসেই কিরণের হাত ধরে হিড় হিড় করে তাকে নিয়ে গেল ঘরে। কি ব্যাপার! উঠোনে দাঁড়ানো আর দশটি মেয়ের চোখে বিস্ময়, ফেরিওয়ালা হতভম্ব। ভূয় পেয়ে তিনটি শিশু একসঙ্গে কেঁদে উঠল।
কান খাড়া রাখল সবাই দশ নম্বর ঘরের দিকে।
কিরণ কাঁদছে।
‘শাসন করছে।’ নিচু গলায় একজন আর একজনকে বলল।
‘মেরেছে, মারছে ওই শোন।’ চাপা হাসি হেসে রমেশ-গিন্নী বলল, ‘এদিক না থাক ওদিক আছে মরদের, একটি ছুঁচ কিনতে পারলে না, মেয়েটা মার খেয়ে মরছে।’
‘কেন কি হয়েছে, কি দোষ করল কিরণ?’ কে একজন প্রশ্ন করতে ঠোঁট বেঁকিয়ে আর একজন উত্তর দেয় : ‘ছোটলোক, ছোটলোকের বাস এখানে, রাতদিন মারপিট কান্না হৈ-রৈ লেগেই আছে, কারণ, আর অকারণ কি? ভাল ভদ্রপাড়ায় ঘর পেলে আমি কালই উঠে যেতুম।’
চোখ ফিরিয়ে সবাই দেখল প্রভাতকণা। এঁটো ডানহাতটা শূন্যে তুলে রেখে বাঁ-হাতে সুনীতিকে ধ’রে ডাক্তার-গিন্নী সকলের আগে উঠোন ছেড়ে ঘরে উঠে গেল।
‘বেশি অহংকার হয়েছে ডাক্তারনীর।’ বীথির মা বিধু মাস্টারের স্ত্রীর কানে কানে বলে। ‘পয়সার গরম!’
‘অহংকার ভাল না, অহংকারে পতন ঘটে।’ অনেকটা আবৃত্তির মতন সুর ক’রে লক্ষ্মীমণি মন্তব্য করে। এবং হয়ত পুরো কবিতাই একটা শিক্ষকগিন্নী সেখানে দাঁড়িয়ে মুখস্ত বলে যেত কিন্তু সেটা পারল না, হ’ল না কিরণের কান্নার বাড়াবাড়িতে। চিৎকার করে কাঁদছে এখনও।
আর কেউ কোনো কথা বলছে না।
বেসাতি তুলে ফেরিওয়ালা আস্তে আস্তে উঠোন থেকে সরে যায়! এবার একদঙ্গল ছেলেমেয়ে তার পিছনে লেগেছে। তারা মুখ দিয়ে গলা দিয়ে নানারকম আওয়াজ বার করছে, শ্লোগান আওড়াচ্ছে : ‘সাড়ে ছ’আনা অনেক দর, জিনিসপত্তর সত্তা কর।’ আর একদল বলছে ‘ফেরিওয়ালার জুলুম–চলবে না’ ইত্যাদি। তাদের এই ধরনের আন্দোলন করার কারণ পয়সার অভাবে তারা কেউ একদিনও লোকটার কাছ থেকে কিছু কিনতে পারে না। অথচ কী সে না আনে! লাট্টু, লাটাই, রবারের বল, লুডো, প্লাস্টিকের মাউথ-অর্গান পর্যন্ত। অতিরিক্ত খেলনার মধ্যে আজ এনেছিল প্লাস্টিকের তৈরি একটা প্যাগোডা এবং একটা মোটর সাইকেল। তাতে একজন মেমসাহেব বসা। রাস্তায় নেমেও ফেরিওয়ালার পিছন পিছন বাচ্চাগুলো অনেকদূর ছুটে যায়।