“শ্যামের নাগাল পালাম না গো সই—ওগো মরমেতে মরে রই”—টক্—টক্—পটাস্—পটাস্, মিয়াজান গাড়োয়ান এক একবার গান করিতেছে—টিটকারি দিতেছে ও শালার গোরু চলতে পারে না বলে লেজ মুচড়াইয়া সপাৎ সপাৎ মারিতেছে। একটু একটু মেঘ হইয়াছে—একটু একটু বৃষ্টি পড়িতেছে—গোরু দুটা হন্ হন্ করিয়া চলিয়া একখানা ছকড়া গাড়ীকে পিছে ফেলিয়া গেল। সেই ছকড়ায় প্রেমনারায়ণ মজুমদার যাইতেছিলেন—গাড়ীখানা বাতাসে দোলে—ঘোড়া দুটা বেটো ঘোড়ার বাবা—পক্ষিরাজের বংশ—টংয়স টংয়স ডংয়স ডংয়স করিয়া চলিতেছে—পটাপট্ পটাপট্ চাবুক পড়িতেছে কিন্তু কোনোক্রমেই চাল বেগড়ায় না। প্রেমনারায়ণ দুইটা ভাত মুখে দিয়া সওয়ার হইয়াছেন—গাড়ীর হোঁকোঁচ হোঁকোঁচে প্রাণ ওষ্ঠগত। গোরুর গাড়ী এগিয়ে গেল তাহাতে আরো বিরক্ত হইলেন। এ বিষয়ে প্রেমনারায়ণের দোষ দেওয়া মিছে—অভিমান ছাড়া লোক পাওয়া ভার। প্রায় সকলেই আপনাকে আপনি বড়ো জানে। একটুকু মনের ক্রটি হইলেই কেহ কেহ তেলে বেগুনে জ্বলে উঠে—কেহ কেহ মুখটি গোঁজ করিয়া বসিয়া থাকে। প্রেমনারায়ণ বিরক্ত হইয়া আপন মনের কথা আপনি বলিতে লাগিলেন—চাকরি করা ঝাক্মারি—চাকরে কুকুরে সমান—হুকুম করিলে দৌড়িতে হয়। মতে, হলা, গদার জ্বালায় চিরকালটা জ্বলে মরেছি—আমাকে খেতে দেয় নাই—শুতে দেয় নাই—আমার নামে গান বাঁধিত—সর্বদা ক্ষুদে পিঁপড়ার কামড়ের মতো ঠাট্টা করিত—আমাকে ত্যক্ত করিবার জন্য রাস্তার ছোঁড়াদের টুইয়ে দিত ও মধ্যে মধ্যে আপনারাও আমার পেছনে হাততালি দিয়া হো হো করিত। এ সব সহিয়া কোন্ ভালো মানুষ টিকিতে পারে? ইহাতে সহজ মানুষ পাগল হয়। আমি যে কলিকাতা ছেড়ে পলাই নাই এই আমার বাহাদুরি—আমার বড়ো গুরুবল যে অদ্যাপিও সরকারগিরি কর্মটি বজায় আছে। ছোঁড়াদের যেমন কর্ম তেমনি ফল। এখন জেলে পচে মরুক—আর যেন খালাস হয় না—কিন্তু এ কথা কেবল কথার কথা, আমি নিজেই খালাসের তদ্বিরে যাইতেছি। মানিবওয়ারি কর্ম, চারা কি? মানুষকে পেটের জ্বালায় সব করিতে হয়।
বৈদ্যবাটীর বাবুরামবাবু বাবু হইয়া বলিয়াছেন। হরে পা টিপিতেছেন । এক পাশে দুই—একজন ভট্টাচার্য বসিয়া শাস্ত্রীয় তর্ক করতেছে—আজ লাউ খেতে আছে—কাল বেগুন খেতে নাই—লবণ দিয়ে দুগ্ধ খাইলে সদ্যগোমাংস ভক্ষণ করা হয় ইত্যাদি কথা লইয়া ঢেঁকির কচ্কচি করিতেছেন। এক পাশে কয়েকজন শতরঞ্চ খেলিতেছে । তাহার মধ্যে একজন খেলোয়াড় মাথায় হাত দিয়া ভাবিতেছে—তাহার সর্বনাশ উপস্থিত উঠসার কিস্তিতেই মাত। এক পাশে দুই-একজন গায়ক যন্ত্র মিলাইতেছে—তানপুরা মেঁও মেঁও করিয়া ডাকিতেছে। এক পাশে মুহুরীরা বসিয়া খাতা লিখিতেছে —সম্মুখে কর্জদার প্রজা ও মহাজন সকলে দাঁড়াইয়া আছে—অনেকের দেনা-পাওনা ডিক্রি ডিস্মিস হইতেছে—বৈঠকখানা লোকে থই থই করিতেছে। মহাজনেরা কেহ কেহ বলিতেছে—মহাশয় কাহারো তিন বৎসর—কাহারো চার বৎসর হইল আমরা জিনিস সরবরাহ করিয়াছি, কিন্তু টাকা না পাওয়াতে বড়ো ক্লেশ হইতেছে—আমরা অনেক হাঁটহাঁটি করিলাম—আমাদের কাজকর্ম সব গেল। খুচরা খুচরা মহাজনেরা যথা—তেলওয়ালা, কাঠওয়ালা, সন্দেশওয়ালা তাহারাও কেঁদে ককিয়ে কহিতেছে—মহাশয় আমরা মারা গেলাম—আমাদের পুঁটিমাছের প্রাণ—এমন করিলে আমরা—কেমন করে বাঁচিতে পারি ? টাকার তাগাদা করিতে করিতে আমাদের পায়ের বাঁধন ছিড়িয়া গেল, —আমাদের দোকান-পাট সব বন্ধ হইল, মাগ ছেলেও শুকিয়ে মরিল। দেওয়ানজী এক একবার উত্তর করিতেছে—তোরা আজ যা, টাকা পাবি বই কি—এত বকিস্ কেন? তাহার উপর যে চোড়ে কথা কহিতেছে অমনি বাবুরামবাবু চোখ-মুখ ঘুরাইয়া তাহাকে গালিগালাজ দিয়া বাহির করিয়া দিতেছেন। বাঙালী বড়োমানুষ বাবুরা দেশসুদ্ধ লোকের জিনিস ধারে লন—টাকা দিতে হইলে গায়ে জ্বর অইসে —বাক্সের ভিতর টাকা থাকে কিন্তু টাল-মাটাল না করিলে বৈঠকখানা লোকে সরগরম ও জমজমা হয় না। গরীব-দুঃখী মহাজন বাঁচিল কি মরিল তাহাতে কিছু এসে যায় না, কিন্তু এরূপ বড়োমানুষি করিলে বাপ পিতামহের নাম বজায় থাকে। অন্য কতকগুলা ফতো বড়োমানুষ আছে—তাহাদের উপরে চাকন চিকণ, ভিতরে খ্যাঁড়। বাহিরে কোঁচার পত্তন ঘরে ছুঁচার কীর্তন, আয় দেখে ব্যয় করিতে হইলেই যমে ধরে—তাহাতে বাগানও হয় না—বাবুগিরিও চলে না। কেবল চটক দেখাইয়া মহাজনের চক্ষে ধূলা দেয় —ধারে টাকা কি জিনিস পাইলে দুআওরি লয়— বড়ো পেড়াপীড়ি হইলে এর নিয়ে ওকে দেয় অবশেষে সমন-ওয়ারিন বাহির হইলে বিষয়-আশয় বেনামী করিয়া গা ঢাকা হয়।
বাবুরামবাবুর টাকাতে অতিশয় মায়া—বড়ো হাত ভারি—বাক্স থেকে টাকা বাহির করিতে হইলে বিষম দায় হয়। মহাজনদিগের সহিত কচ্কচি ঝক্ঝকি করিতেছেন, ইতিমধ্যে প্রেমনারায়ণ মজুমদার আসিয়া উপস্থিত হইলেন এবং কলিকাতার সকল সমাচার কানে কানে বলিলেন। বাবুরামবাবু শুনিয়া স্তব্ধ হইয়া থাকিলেন —বোধ হইল যেন বজ্র ভাঙিয়া তাহার মাথায় পড়িল। ক্ষণেক কাল পরে সুস্থির হইয়া ভাবিয়া মোকাজান মিয়াকে ডাকাইলেন। মোকাজান আদালতের কর্মে বড়ো পটু। অনেক জমিদার নীলকর প্রভৃতি সর্বদা তাহার সহিত পরামর্শ করিত। জাল করিতে —সাক্ষী সাজাইয়া দিতে— দারোগা ও আমলাদিগকে বশ করিতে —গাঁতের মাল লইয়া হজম করিতে —দাঙ্গা-হাঙ্গামের জোটপাট ও হয়কে নয় করিতে নয়কে হয় করিতে তাহার তুল্য আর একজন পাওয়া ভার। তাহাকে আদর করিয়া সকলে ঠকচাচা বলিয়া ডাকিত, তিনিও তাহাতে গলিয়া যাইতেন এবং মনে করিতেন আমার শুভক্ষণে জন্ম হইয়াছে— রমজান ঈদ শবেবরাত আমার করা সার্থক — বোধ হয় পীরের কাছে কষে ফয়তা দিলে আমার কুদ্রত আরও বাড়িয়া উঠিবে। এই ভাবিয়া একটা বদনা লইয়া অজু করিতেছিলেন, বাবুরামবাবুর ডাকাডাকি হাঁকাহাঁকিতে তাড়াতাড়ি করিয়া আসিয়া নির্জনে সকল সংবাদ শুনিলেন। কিছুকাল ভাবিয়া বলিলেন — ডর কি বাবু ? এমন কত শত মকদ্দমা মুই উড়াইয়া দিয়েছি — এ বা কোন ছার ? মোর কাছে পাকা পাকা লোক আছে — তেনাদের সাথে করে লিয়ে যাব — তেনাদের জবানবন্দিতে মকদ্দমা জিত্ব, কিছু ডর কর না — কেল খুব ফজরে এসবো, এজ্ চললাম।
বাবুরামবাবু সাহস পাইলেন বটে, তথাপি ভাবনায় অস্থির হইতে লাগিলেন। আপনার স্ত্রীকে বড়ো ভালোবাসিতেন, স্ত্রী যাহা বলিতেন সেই কথাই কথা — স্ত্রী যদি বলিতেন এ জল নয় — দুধ, তবে চোখে দেখিলেও বলিতেন এ জল নয় — এ দুধ — না হলে গৃহিণী কেন বলবেন ? অন্যান্য লোকে আপন আপন পত্নীকে ভালবাসে বটে, কিন্তু তাহারা বিবেচনা করিতে পারে যে স্ত্রীর কথা কোন্ বিষয়ে ও কতদূর পর্যন্ত শুনা উচিত। সুপুরুষ আপন পত্নীকে অন্তকরণের সহিত ভালবাসে কিন্তু স্ত্রীর সকল কথা শুনিতে গেলে পুরুষকে শাড়ী পরিয়া বাটীর ভিতর থাকা উচিত। বাবুরামবাবু স্ত্রী উঠ বলিলে উঠিতেন — বস বলিলে বসিতেন। কয়েক মাস হইল গৃহিণীর একটি নবকুমার হইয়াছে — কোলে লইয়া আদর করিতেছেন — দুই দিকে দুই কন্যা বসিয়াছে, ঘরকন্নার ও অন্যান্য কথা হইতেছে, এমতো সময়ে কর্তা বাটীর মধ্যে গিয়ে বিষণ্ণভাবে বসিলেন এবং বলিলেন—গিন্নী ! আমার কপাল বড়ো মন্দ—মনে করিয়াছিলাম মতি মানুষমুনুষ হইলে তাহাকে সকল বিষয়ের ভার দিয়া আমরা কাশীতে গিয়া বাস করিব, কিন্তু সে আশায় বুঝি বিধি নিরাশ করলেন।
গৃহিণী। ওগো—কি—কি—শীঘ্র বলো, কথা শুনে যে আমার বুক ধড়ফড় করতে লাগল—আমার মতি তো ভালো আছে ?
কর্তা। হাঁ—ভালো আছে—শুনিলাম পুলিশের লোক আজ তাহাকে ধরে হিঁচুড়ে লইয়া গিয়া কায়েদ করিয়াছে।
গৃহিণী। কি বল্লে ?—মতিকে হিঁচুড়িয়া লইয়া গিয়া কায়েদ করিয়াছে? ওগো, কেন কয়েদ করেছে? আহা বাছার গায়ে কতই ছড় গিয়াছে, বুঝি আমার বাছা খেতেও পায় নাই—শুতেও পায় নাই ! ওগো কি হবে? আমার মতিকে এখুনি আনিয়া দাও।
এই বলিয়া গৃহিণী কাঁদিতে লাগিলেন—দুই কন্যা চক্ষের জল মুছাইতে মুছাইতে নানা প্রকার সান্ত্বনা করিতে আরম্ভ করিল। গৃহিণীর রোদন দেখিয়া কোলের শিশুটিও কাঁদিতে লাগিল।
ক্রমে ক্রমে কথাবার্তার ছলে কর্তা অনুসন্ধান করিয়া জানিলেন মতিলাল মধ্যে মধ্যে বাড়িতে আসিয়া মায়ের নিকট হইতে নানা প্রকার ছল করিয়া টাকা লইয়া যাইত। গৃহিণী এ কথা প্রকাশ করেন নাই—কি জানি কর্তা রাগ করিতে পারেন—অথচ ছেলেটিও আদুরে—গোসা করিলে পাছে প্রমাদ ঘটে। ছেলেপুলের সংক্রান্ত সকল কথা স্ত্রীলোকদিগের স্বামীর নিকট বলা ভালো। রোগ লুকাইয়া রাখিলে কখনই ভালো হয় না। কর্তা গৃহিণীর সহিত অনেকক্ষণ পর্যন্ত পরামর্শ করিয়া পরদিন কলিকাতার যে স্থানে যাইবেন তথায় আপনার কয়েকজন আত্মীয়কে উপস্থিত হইবার জন্য রাত্রিতেই চিঠি পাঠাইয়া দিলেন।
সুখের রাত্রি দেখিতে দেখিতে যায়। যখন মন চিন্তার সাগরে ডুবে থাকে তখন রাত্রি অতিশয় বড়ো বোধ হয়। মনে হয় রাত্রি পোহাইল কিন্তু পোহাইতে পোহাইতেও পোহায় না। বাবুরামবাবুর মনে নানা কথা, নানা ভাব, নানা কৌশল, নানা উপায় উদয় হইতে লাগিল। ঘরে আর স্থির হইয়া থাকিতে পারিলেন না, প্রভাত না হইতে ঠকচাচা প্রভৃতিকে লইয়া নৌকায় উঠিলেন। নৌকা দেখিতে দেখিতে ভাঁটার জোরে বাগবাজারের ঘাঁটে আসিয়া ভিড়িল। রাত্রি প্রায় শেষ হইয়াছে—কলুরা ঘানি জুড়ে দিয়েছে—বলদেরা গোরু লইয়া চলিতেছে—ধোবার গাধা থপাস থপাস করিয়া যাইতেছে—মাছের ও তরকারির বাজরা হু-হু করিয়া আসিতেছে, ব্রাহ্মণ পণ্ডিতেরা কোশা লইয়া স্নান করিতে চলিয়াছেন—মেয়েরা ঘাটে সারি সারি হইয়া পরস্পর মনের কথাবার্তা কহিতেছে। কেহ বলিছে, বাপ ঠাকুরঝির জ্বালায় প্রাণটা গেল—কেহ বলে, আমার শাশুড়ী মাগী বড়ো বৌকাঁটকি—কেহ বলে, দিদি, আমার আর বাঁচতে সাধ নাই—বৌছুঁড়ী আমাকে দু’পা দিয়া থেত্লায়, বেটা কিছুই বলে না; ছোঁড়াকে গুণ করে ভেড়া বানিয়েছে—কেহ বলে, আহা অমন পোড়া জাও পেয়েছিলাম দিবারাত্রি আমার বুকে বসে ভাত রাঁধে,—কেহ বলে, আমার কোলের ছেলেটির বয়স দশ বৎসর হইল— কবে মরি কবে বাঁচি এই বেলা তার বিয়েটি দিয়ে নি।
এক পশলা বৃষ্টি হইয়া গিয়াছে। আকাশে স্থানে স্থানে কানা মেঘ আছে। রাস্তাঘাট সেঁত সেঁত করিতেছে। বাবুরামবাবু এক ছিলিম তামাক খাইয়া একখানা ভাড়া গাড়ী অথবা পাল্কির চেষ্টা করিতে লাগিলেন কিন্তু ভাড়া বনিয়া উঠিল না—অনেক চড়া বোধ হইল। রাস্তায় অনেক ছোঁড়া একত্র জমিল। বাবুরামবাবুর রকম সকম দেখিয়া কেহ কেহ বলিল—ওগো বাবু, ঝাঁকা মুটের উপর বসে যাবে? তাহা হইলে দু-পয়সায় হয়। তোর বাপের ভিটে নাশ করেছে—বলিয়া যেমন বাবুরাম দৌড়িয়া মারিতে যাবেন অমনি দড়াম করিয়া পড়িয়া গেলেন। ছেঁড়াগুলো হো হো করিয়া দূরে থেকে হাততালি দিতে লাগিল। বাবুরামবাবু অধোমুখে শীঘ্র একখানা লকাটে রকম কেরাঞ্চিতে ঠকচাচা প্রভৃতিকে লইয়া উঠিলেন এবং খন্ খন্ ঝন্ ঝন্ শব্দে বাহির সিমলের বাঞ্ছারামবাবুর বাটীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। বাঞ্ছারামবাবুর বৈঠকখানায় উকিল বটলর সাহেবের মুৎসুদ্ধি—আইন-আদালত মামলা-মকদ্দমায় বড়ো ধড়িবাজ। মাসের মাহিনা ৫০ টাকা কিন্তু প্রাপ্তির সীমা নাই, বাটীতে নিত্য ক্রিয়াকাণ্ড হয়। তাহার বৈঠকখানায় বালীর বেণীবাবু, বহুবাজারের বেচারামবাবু, বটতলার বক্রেশ্বরবাবু আসিয়া অপেক্ষা করিয়া বসিয়াছিলেন।
বেচারাম। বাবুরাম। ভালো দুধ দিয়া কালসাপ পুষিয়াছিলে। তোমাকে পুনঃপুনঃ বলিয়া পাঠাইয়াছিলাম আমার কথা গ্রাহ্য করো নাই—ছেলে হতে ইহকালও গেল—পরকালও গেল। মতি দেদার মদ খায়—জোয়া খেলে—অখাদ্য আহার করে। জোয়া খেলিতে খেলিতে ধরা পড়িয়া চৌকিদারকে নির্ঘাত মারিয়াছে। হলা, গদা ও আর-আর ছোঁড়ারা তাহার সঙ্গে ছিল। আমার ছেলেপুলে নাই। মনে করিয়াছিলাম হলা ও গদা এক গণ্ডুষ জল দিবে এখন সে গুড়ে বালি পড়িল। ছোঁড়াদের কথা আর কি বলিব ? দূঁর দূঁর।
বাবুরাম। কে কাহাকে মন্দ করিয়াছে তাহা নিশ্চয় করা বড়ো কঠিন —এক্ষণে তদ্বিরের কথা বলুন।
বেচারাম। বাবুরাম যা ইচ্ছা তাই করো—আমি জ্বালাতন হইয়াছি—রাত্রে ঠাকুরঘরের ভিতর যাইয়া বোতল বোতল মদ খায়—চরস গাঁজার ধোঁয়াতে কড়িকাট কালো করিয়াছে—রূপা-সোনার জিনিস চুরি করিয়া বিক্রি করিয়াছে। আবার বলে একদিন শালগ্রামকে পোড়াইয়া চুন করিয়া পানের সঙ্গে খাইয়া ফেলিব। আমি আবার তাহাদের খালাসের জন্য টাকা দিব ? দূঁর দূঁর।
বক্রেশ্বর। মতিলাল এত মন্দ নহে—আমি স্বচক্ষে স্কুলে দেখিয়াছি তাহার স্বভাব বড়ো ভালো —সে তো ছেলে নয়, পরেশ পাথর, তবে এমনটা কেন হইল বলতে পারি না।
ঠকচাচা। মুই বলি এসব ফেল্ত বাতের দরকার কি ? ত্যাল-খেড়ের বাতেতে কি মোদের প্যাট ভরবে? মকদ্দমাটার বনিয়াদটা পেকড়ে সেজিয়া ফেলা যাওক।
বাঞ্ছারাম। (মনে মনে বড়ো আহলাদ—মনে করিতেছেন বুঝি চিড়া-দই পেকে উঠিল) কারবারী লোক না হইলে কারবারের কথা বুঝে না। ঠকচাচা যাহা বলিতেছেন তাহাই কাজের কথা। দুই-একজন পাকা সাক্ষীকে ভালো তালিম করিয়া রাখিতে হইবে—আমাদিগকে বটলর সাহেবকে উকিল ধরিতে হইবে—তাতে যদি মকদ্দমা জিত না হয় তবে বড়ো আদালতে লইয়া যাব—বড়ো আদালতে কিছু না হয়—কৌন্সেল পর্যন্ত যাব,—কৌন্সেলে কিছু না হয় তো বিলাত পর্যন্ত করিতে হইবে। এ কি ছেলের হাতে পিটে ? কিন্তু আমাদিগের বটলর সাহেব না থাকিলে কিছুই হইবে না। সাহেব বড়ো ধমিষ্ঠ—তিনি অনেক মকদ্দমা আকাশে ফাঁদ পাতিয়া নিকাশ করিয়াছেন আর সাক্ষীদিগকে যেন পাখী পড়াইয়া তইয়ার করেন।
বক্রেশ্বর। আপদে পড়িলেই বিদ্যা-বুদ্ধির আবশ্যক হয়। মকদ্দমার তদ্বির অবশ্যই করিতে হইবেক। বেতদ্বিরে দাঁড়াইয়া হারা ও হাততালি খাওয়া কি ভালো ?
বাঞ্ছারাম। বটলর সাহেবের মতো বুদ্ধিমান উকিল আর দেখতে পাই না। তাঁহার বুদ্ধির বলিহারি যাই। এ সকল মকদ্দমা তিনি তিন কথাতে উড়াইয়া দিবেন। এক্ষণে শীঘ্র উঠুন—তাঁহার বাটিতে চলুন।
বেণী। মহাশয় আমাকে ক্ষমা করুন। প্রাণ বিয়োগ হইলেও অধর্ম করিব না। খাতিরে সব কর্ম করতে পারি কিন্তু পরকালটি খোয়াইতে পারি না। বাস্তবিক দোষ থাকলে দোষ স্বীকার করা ভালো—সত্যের মার নাই—বিপদে মিথ্যা পথ আশ্রয় করিলে বিপদ বাড়িয়া উঠে।
ঠকচাচা। হা-হা-হা-হা—মকদ্দমা করা কেতাবী লোকের কাম নয়—তেনারা একটা ধাব্কাতেই পেলিয়ে যায়। এনার বাত মাফিক কাম করলে মোদের মেটির ভিতর জলদি যেতে হবে—কেয়া খুব।
বাঞ্ছারাম। আপনাদের সাজ করিতে দোল ফুরাল। বেণীবাবু স্থিরপ্রজ্ঞ —নীতিশাস্ত্রে জগন্নাথ তর্ক পঞ্চানন, তাঁহার সঙ্গে তখন একদিন বালীতে গিয়া তর্ক করা যাইবেক। এক্ষণে আপনারা গাত্রোত্থান করুন।
বেচারাম। বেণীভায়া ! তোমার যে মত আমার সেই মত—আমার তিন কাল গিয়েছে—এককাল ঠেকেছে, আমি প্রাণ গেলেও অধর্ম করিব না—আর কাহার জন্যে বা অধর্ম করিব? ছোঁড়ারা আমার হাড় ভাজা ভাজা করিয়াছে—তাদের জন্যে আমি আবার খরচ করিব—তাদের জন্য মিথ্যা সাক্ষী দেওয়াইব ? তাহারা জেলে যায় তো এক প্রকার আমি বাঁচি। তাদের জন্যে আমার খেদ কি? তাদের মুখ দেখিলে গা জ্বলে উঠে—দূঁর দূঁর ! ! !