বাগবাদা গাঁয়ের সেই যে মহেশ চৌধুরী, যার ছেলে বিভূতি গিয়াছে আসল সরকারি জেলে, যার দুটি মেয়ে গিয়াছে শ্বশুরবাড়ি নামক নকল সামাজিক জেলে, যার উপর রাজা সায়েবের ভয়ানক রাগ, আশ্রমে যে একেবারেই আমল পায় না, সুযোগ পাইলেই সকলের সামনে যাকে অপদস্থ করিবার জন্য সদানন্দকে বিপিন বিশেষভাবে বলিয়া রাখিয়াছে, মানুষটা সে একটু খাপছাড়া কিন্তু তুচ্ছ নয়। তুচ্ছ নয় বলিয়াই অবশ্য তার উপর রাজা সায়েবের এত রাগ, আশ্রমে তাকে অপাংক্তেয় করিয়া রাখিবার জন্য বিপিনের এত চেষ্টা। চারিদিকের অনেকগুলি গ্রামে মহেশ চৌধুরীর যথেষ্ট প্রভাব প্রতিপত্তি আছে, যেটা গড়িয়া তুলিবার জন্য কারো চেষ্টা করিতে হয় নাই, মহেশ চৌধুরীর জীবনযাপনের একনিষ্ঠ প্রক্রিয়া বহুকাল ধরিয়া তিলে তিলে যার জন্ম দিয়াছে। লোকে তাকে শ্রদ্ধা করে, বিশ্বাস করে, ভালবাসে। কিভাবে জানিয়াছে, কেন জানিয়াছে, জেরা করিলে কেহ বলিতে পারিবে না, কিন্তু সকলেই জানে, মনে মনে মহেশ চৌধুরী সকলের মঙ্গল কামনা করে, লোকটার ভক্তি ও নিষ্ঠা আন্তরিক, সকল সময় সকল বিষয়ে নিৰ্ভয়ে নিশ্চিন্ত মনে লোকটাকে বিশ্বাস করা যায়। লোকটা বুদ্ধিমান কিন্তু চালাক নয়, ভিতরে বাহিরে মিল আছে লোকটার–দৈনন্দিন। জীবনের কারবারে মানুষের সঙ্গে মানুষের যে অসংখ্য দেওয়া-নেওয়া চলে, তার মধ্যে মহেশ চৌধুরীর কাছে পাওনা গ্রহণ করিতে আশাভঙ্গের সম্ভাবনা নাই।
[লেখকের মন্তব্য : কোনো মানুষ সম্বন্ধে জনসাধারণের ধারণা অসংখ্য ব্যক্তিগত ধারণার সমষ্টি, কিন্তু ধারণাগুলি নির্দিষ্ট পর্যায়ভুক্ত, সীমাবদ্ধ বৈচিত্র্যহীন। যার ব্যক্তিত্বের দুটি একটি বিশিষ্ট দিক মাত্র অত্যন্ত স্পষ্ট ও স্থূলভাবে মানুষের কাছে আত্মপ্রকাশ করে, যার সম্বন্ধে মানুষ নিজের ধারণা কটির মধ্যে সামঞ্জস্য খুঁজিয়া পায়, নিজের মনে যতগুলি বিভিন্ন টাইপ সৃষ্টি করিবার ক্ষমতা মানুষের থাকে, তার মধ্যে কোনো একটি টাইপের সঙ্গে মানুষ যাকে মোটামুটি মিলাইয়া লইতে পারে, কেবল তারই ব্যক্তিত্বকে মানুষ স্বীকার করে। ব্যক্তিত্ব আসলে পরাশ্রয়ী, ব্যক্তিত্বের বিকাশে পরধর্মানুশীলনের প্রয়োজন, এইজন্য জোরালো ব্যক্তিত্বসম্পন্ন মানুষের পক্ষে এটা ভয়াবহ বটে। যার ব্যক্তিত্বের প্রভাব যত বেশি, তাকে তত বেশি পরের ইচ্ছায় চলিতে হয়, নেতার চেয়েও সে পরাধীন। ব্যক্তিত্বকে প্রভাবশালী করিবার মূলমন্ত্র পরের মনে ধারণা জন্মাইয়া দেওয়া সে ছোট, আমি বড়, তার যা কিছু আছে কম, আমার সে সব আছে অনেক বেশি। সুতরাং পরের ছোট-বড়, কম-বেশির সংস্কার ও ধারণা অনুসারে আমার ব্যক্তিত্ব নিয়ন্ত্রিত না হইলে সেটা নিছক ব্যক্তিস্বাতন্ত্রে পরিণত হয় মাত্র! এ পর্যন্ত মোট কথা, কোনো জটিলতা নাই। গোলমাল আরম্ভ হয় বিশ্লেষণ যখন সেই স্তরে পৌঁছায়, যেখানে ব্যক্তিত্বের সংগঠনে প্রকাশ্য ও প্রচ্ছন্ন মামলাগুলি পৃথক করিতে হয়, সমগ্র প্রক্রিয়াটার পিছনে কতখানি ক্রিয়াশক্তি অচেতন ও কতখানি সচেতন তাও পৃথক করিতে হয়।
আমার এ সব কথা বলিবার উদ্দেশ্য এই। সদানন্দ ও মহেশ চৌধুরীর ব্যক্তিত্বের একটি মৌলিক সামঞ্জস্যের কথা আমি সোজাসুজি আপনাদের বলিয়া দিতে চাই। সদানন্দ, বিপিন, মাধবীলতা, এদের ব্যক্তিত্বের যে সব দিক আমি ফুটাই তুলিতে চাহিয়াছি এবং চাই গল্পের মধ্যেই তা আপনা হইতে ফুটিয়া উঠিয়াছে এবং উঠিতেছে। কিন্তু মহেশ চৌধুরী ও সদানন্দের ব্যক্তিত্বের মধ্যে যে সামঞ্জস্যটা আমি দেখাইতে চাই, গল্পের মধ্যে আপনা হইতে সেটা পরিস্ফুট করিয়া তোলা আমার সাধ্যাতীত। কারণ, দুজন মানুষকে কাছাকাছি টানিয়া আনিয়া অথবা দুজনের মধ্যে একটি মধ্যস্থ খাড়া করিয়া একজনের ব্যক্তিত্বরূপী সচেতন মননশক্তির সঙ্গে অপরজনের ব্যক্তিত্বরূপী অচেতন মননশক্তির পার্থক্য সহজেই স্পষ্ট করিয়া তোলা যায়, কিন্তু সামঞ্জস্য কোনো রকমেই দেখানো যায় না। যাই হোক, বিশ্লেষণের প্রয়োজন নাই। কেবল বলিয়া দিই। মহেশ চৌধুরীর মধ্যে যে অচেতন মননশক্তি সকলের প্রীতি অর্জন করিয়াছে এবং সদানন্দের মধ্যে যে সচেতন মননশক্তি সকলের মধ্যে জাগাইয়াছে সভয় শ্রদ্ধা, মূলত তার মধ্যে কোনো পার্থক্য নাই।
মহেশ চৌধুরী প্রত্যেকদিন আশ্রমে যাতায়াত করে, সাধারণত বিকালের দিকে। সকালেও মাঝে মাঝে আশ্রমে তার আবির্ভাব ঘটে, খুব ভোরে। রাত্রে সে ঘুমায় কিনা অনেকের সন্দেহ আছে, প্রাতঃভ্রমণে বাহির হয় একরকম শেষত্রে। ঠিহাতে চার মাইল পথ হাঁটিয়া হাজির হয় আশ্রমে, আবছা আলো অন্ধকারে এদিকে খোজে, ওদিকে খোজে, রাত্রি শেষে কার সঙ্গে যেন খেলিতেছে লুকোচুরি খেলা, খেলার সাথীটি তার কুটিরের পিছনে, গাছের আড়ালে, ঝোপের মধ্যে কোথাও গা ঢাকা দিয়াছে। খুঁজিতে খুঁজিতে যায় নদীর ধারে। কোনোদিন হয়তো সদানন্দের সঙ্গে দেখা হইয়া যায়। তৎক্ষণাৎ প্ৰণাম করিয়া মহেশ চুপ করিয়া দাঁড়াইয়া থাকে। সদানন্দ যদি প্রথমে কথা বলে তো বলে, নতুবা মহেশ চৌধুরী মুখ খোলে না।
কে, মহেশ?
আজ্ঞে হ্যাঁ প্ৰভু। বড় জ্বালা প্ৰভু মনে, বড় কষ্ট পেয়েছি সমস্ত রাত। তাই ভাবলাম ভোরবেলা প্রভুর চরণ দর্শন করে–
সদানন্দের ধারণা, জ্বালা তারও আছে। সে বলে, তোমায় না আশ্রমে আসতে বারণ করে দিয়েছি?
না এসে পারি না প্রভু।
বটে? বেশ, বেশ। তোমার মতো আর দু-একটি ভক্ত জুটলেই আশ্রম ছেড়ে আমায় বনে-জঙ্গলে পালাতে হবে। তা তোমার আসল মতলবটা কি বল তো শুনি?
চরণে ঠাঁই চাই প্ৰভু–মনে শান্তি চাই।
পাগল? মাথা খারাপ মহেশ চৌধুরীর? এ রকম অন্ধ ভক্ত সদানন্দের আরো আছে, কিন্তু এমন নাছোড়বান্দা কেউই নাই। বাড়াবাড়ির জন্য ধমক দিলে, ভাবপ্রবণ ভক্ত সমিয়া যায়, মুখ হইয়া আসে কালো, ভক্তিও যেন উবিয়া যায় খানিকটা। কিন্তু মহেশ চৌধুরী কিছুতেই দমে না, কিছুতেই হাল ছাড়ে না। সদানন্দের অবজ্ঞা, অবহেলা, কড়া কথা, এ সবও যেন তার কাছে পরম উপভোগ্য। বড় রাগ হয় সদানন্দের–বড় আনন্দ হয়। মনে হয়, আসলে মহাপুরুষ সে কেবল এই একজন মানুষের কাছে, প্রায় দেবতার সমান। আর সকলে তাকে ঠকায়, শুধু দাম দেয়, শুধু তার দাবি মেটায়। তারই বলিয়া দেওয়া মন্ত্রে পূজা করে তার। কিন্তু মহেশ চৌধুরী কিছু জানে না, কিছু মানে না, নিজের রচিত একটিমাত্র মন্ত্র বলিয়া সে পূজা করে–তুমি আমায় চাওবা না চাও দেবতা, আমি তোমায় চাই।
একটু ভয়ও করে সদানন্দের মহেশ চৌধুরীর কাছে দাঁড়াইয়া থাকিতে, তার সঙ্গে কথা বলিতে। বাস্তব অভিজ্ঞতার মালমসলায় জীবনের যে আদর্শ সে সৃষ্টি করিয়া গিয়াছে নিজের জন্য, সে আদর্শ অবাস্তব কল্পনা কিনা, অর্থহীন স্বপ্ন কিনা, আজো এ বিষয়ে সদানন্দের সন্দেহ মেটে নাই। যে আত্মপ্রত্যয়ের নিচে এ সন্দেহ চাপা থাকে, মহেশ চৌধুরীর দাঁড়ানোর ভঙ্গিতে, চোখের দৃষ্টিতে, মুখের কথায় তা যেন উবিয়া যাইতে থাকে দেবতার সামনে পূজারীর মতো মহেশ চৌধুরী দাঁড়াইয়া থাকে, পোষা কুকুরের মতো তাকায়, স্তব করার মতত কথা বলে–তবু। মনে হয়, আর যত ভক্ত তার আছে, যাদের মধ্যে অনেকে মনে মনে তার সমালোচনাও করে কম। বেশি, তাদের ভুলাইতে কোনোদিন তার কষ্ট হইবে না, ভুলিবার জন্য শিশুর মতো তারা উদগ্রীব হইয়া আছে, কিন্তু এই অন্ধ ভক্তটিকে ভুলানোর ক্ষমতা তার নাই। মহেশ চৌধুরীর পূজা গ্রহণ করিলে বর দিবার সময় ফাঁকি চলিবে না, ভেজাল চলিবে না। অবাস্তব পাগলামির পুরস্কারকে করিয়া তুলিতে হইবে বাস্তব। কাব্যের জন্য কবিকে যেমন নারীকে দিতে হয় খাঁটি রক্তমাংসের দেহটি।
তোমার ছেলে ছাড়া পেয়েছে মহেশ?
আজ্ঞে না। ও কি আর ছাড়া পাবে!
এ্যাঁ? সে কি কথা–ছাড়া পাবে বৈকি, দুদিন পরেই ছাড়া পাবে। ভেবো না।
এই কি বাস্তব পুরস্কারের নমুনা? ইচ্ছার বিরুদ্ধে দুটি মিষ্টি কথা বলা, একটু অনিশ্চিত আশ্বাস দেওয়া, হিসাব করিলে যার দাম কানাকড়িও হয় না, কিন্তু মহেশ চৌধুরীর কাছে যা অমূল্য?
কোনোদিন সদানন্দ কথা না বলিয়া পাশ কাটিয়া চলিয়া যায়, মহেশ চৌধুরী ঠায় দাঁড়াইয়া যতক্ষণ দেখা যায় তাকে দেখে, তারপর আবার আপন মনে তপোবনে ঘুরিয়া বেড়ায় আর সদানন্দের সম্মুখে পড়ে না। এখানে সে অনাহুত, অবাঞ্ছিত, আগন্তুক, বিপিনের শাসনে আশ্রমের কেউ তার সঙ্গে কথা পর্যন্ত বলে না, মাঝে মাঝে রীতিমতো অপমানও জোটে, তবু মোহাচ্ছনের মতো সে আশ্রমের চারিদিকে ঘুরিয়া বেড়ায়, ধীরে ধীরে আশ্রমের জাগরণ লক্ষ্য করে।
সদানন্দের অজ্ঞাতবাসের খবরটা মহেশ চৌধুরী পাইল সাতুনার শ্রীধরের বাড়িতে। বাগবাদায় নিজের বাড়ি হইতে আশ্রমে যাওয়ার পথে শ্রীধরের বাড়ি পড়ে, মহেশ চৌধুরী এখানে কিছুক্ষণ বসিয়া যায়। বিশ্রামও হয়, জানাশোনা অনেকের সঙ্গে কথা বলাও হয়, অনেকের খবর পাওয়া যায়। আজ শ্রীধরের সদরের বড় ঘরটার দাওয়ায় তোক জুটিয়াছে অনেক। যারা অপরাজ্ৰে যাইবে ভাবিয়াছিল, সদানন্দ সাতদিন দর্শন দিবে না শুনিয়া তাদের মধ্যে অনেকেই শ্রীধরের এখানে আসিয়া জুটিয়াছে। শ্ৰীধর একটি নূতন বই সংগ্রহ করিয়াছে কোথা হইতে, কামরূপের এক রোমাঞ্চকর প্রামাণ্য উপন্যাস। কাল চারটি পরিচ্ছেদ পাঠ করা হইয়াছিল, আজ সকলে আসিয়া জুটিলেই বাকি অংশটুকু পড়া আরম্ভ হইতে পারিবে।
মহেশ চৌধুরী বলিল, কেউ দর্শন পাবে না?
শ্ৰীধর বলিল, বিপিনবাবু তাই বললেন চৌধুরী মশাই। প্ৰকৃত ভক্ত ছাড়া কেউ দর্শন পাবে না–প্রভুর জন্য যে সর্বস্ব ত্যাগ করতে পারে, জীবন বিসর্জন দিতে পারে, কেবল সেই দর্শন পাবে।
প্রভুর জন্য তোমরা সর্বস্ব ত্যাগ করিতে পার না, জীবন বিসর্জন দিতে পার না শ্ৰীধর?
উৎসুক দৃষ্টিতে মহেশ চৌধুরী সকলের মুখের দিকে চাহিতে থাকে, সকলে স্বস্তিবোধ করে, চোখ নামাইয়া নেয়। বৃদ্ধ শ্রীধরের স্তিমিত চোখ দুটি বোধহয় তামাকের ধোঁয়াতেই বুজিয়া যায়।
আমি প্রভুর চরণদর্শন করতে যাব শ্রীধর।
সকলে স্তব্ধ হইয়া থাকে। অহংকারের কথা নয়, মহেশ চৌধুরীর অহংকার আছে কিনা সন্দেহ। সকলে তা জানে। কিন্তু একটা কথা প্ৰায় সকলের মনেই খচখচ করিয়া বিধিতে থাকে, কঠিন একটা সমস্যা। সর্বস্ব ত্যাগ করিতে পারে, জীবন বিসর্জন দিতে পারে, এত বড় ভক্তই যদি মহেশ চৌধুরী হয়, সদানন্দ তাকে আমল দেয় না কেন, কেন তাকে শিষ্য করে না? এই সমস্যা আজ বহুদিন সকলকে পীড়া দিতেছে, এ বিষয়ে নিজেদের মধ্যে তারা অনেক আলোচনা করিয়াছে, মনে মনে অনেক মাথা ঘামাইয়াছে। কারো মনে এ সন্দেহও জাগিয়াছে যে, মানুষটা মহেশ চৌধুরী কি আসলে তবে ভালো নয়, তার নীতি, ধর্ম, ভক্তি, নিষ্ঠা সব লোকদেখানো ভালোমানুষি?
মহেশ চৌধুরী উঠিয়া দাঁড়াইয়া বলে, যাই, একবার ঘুরে আসি আশ্রম থেকে।
কয়েকজন কৌতূহলভরে তার সঙ্গ নিলে সে তাদের ফিরাইয়া দেয়, বলে, না, আজ আর তোমাদের গিয়ে কাজ নেই ভাই। প্রভু যখন বারণ করে দিয়েছেন, মিছিমিছি গোলমাল না করাই ভালো।
আশ্রমে গিয়া মহেশ চৌধুরী যাকে সামনে পাইল তাকেই প্রভুর চরণদর্শনের জন্য ব্যাকুলভাবে আবেদন জানাইতে লাগিল। কেউ জবাব দিল, কেউ দিল না। তখন মহেশ চৌধুরী গিয়া ধরিল বিপিনকে।
বিপিন বলিল, সাতদিন পরে আসবেন।
মহেশ চৌধুরী মিনতি করিয়া বলিল, আপনি একবার প্রভুকে গিয়া বলুন, প্রভুর জন্য আমি সর্বস্ব ত্যাগ করব, জীবন বিসর্জন দেব। আপনি বললেই প্রভু আমায় ডেকে পাঠাবেন।
বিপিন রাগিয়া বলিল, কে আপনাকে সর্বস্ব ত্যাগ করতে, জীবন বিসর্জন দিতে সেধেছে। মশায়? কেন আসেন আপনি আশ্রমে? যান, যান, বেরিয়ে যান আমার আশ্রম থেকে।
কিছুক্ষণ পঁড়াইয়া থাকিয়া মহেশ চৌধুরী ধীরে ধীরে বাড়ি ফিরিয়া গেল। ফিরিয়া আসিল শেষ রাত্রে।
সদানন্দের সদরের কুটিরের সামনে কদমগাছটার তলায় বসিয়া পড়িল। কুটিরের আড়াল হইতে সূর্য উঠিলেন মাথার উপরে, তারপর আকাশ ঢাকিয়া মেঘ করিয়া আসিয়া ঘণ্টাখানেক বৃষ্টি হইয়া গেল, তারপর আবার কড়া রোদ ঢালিতে ঢালিতে সূর্য আড়াল হইলেন অন্য একটি কুটিরের আড়ালে, গাছতলা হইতে মহেশ নড়িল না। রোদে পুড়িয়া, জলে ভিজিয়া খাওয়া ছাড়িয়া কি তপস্যা করিতে বসিয়াছে গাছতলায়? এত জায়গা থাকিতে এখানে তপস্যা করিতে বসা কেন? আশ্রমের সকলে সমুখ দিয়া যাওয়ার সময়ে বিস্ময় ও কৌতূহলভরা দৃষ্টিতে তাকে দেখিতে থাকে তাকে দেখিবার জন্য কেউ আসে না বটে, কিন্তু এদিক দিয়া যাতায়াত করার প্রয়োজন আজ যেন সকলের বাড়িয়া যায়।
বেলা বাড়িতে তিন চার বার মহেশ চৌধুরীর বাড়ি হইতে লোক আসিয়া ফিরিয়া গিয়াছিল। বর্ষণের আগে আসিয়াছিল কেবল চাকর, গোমস্তা। বর্ষণের পরে আসিল মহেশের ভাগ্নে শশধর। গাছতলায় মাটিতে উপবিষ্ট মামার জলে-ভেজা মূর্তি দেখিয়া বেচারা কাঁদিয়া ফেলে আর কি! কিন্তু সেও মহেশের তপস্যা ভঙ্গ করিতে পারিল না। তবে দেখা গেল ছেলেটার বুদ্ধি আছে। নিজে হার মানিয়া সে ফিরিয়া গেল বটে, কিন্তু বিকালবেলা হাজির হইল একেবারে মামিকে সঙ্গে করিয়া।
ভাগ্নে কেবল কাঁদিয়া ফেলার উপক্ৰম করিয়াছিল, স্বামীর অবস্থা দেখিয়া স্ত্রী কাঁদিয়াই আকুল। কেন তার মরণ হয় না? যার স্বামী পাগল, ছেলে পাগল, সে কেন সংসারে বাঁচিয়া থাকে নিত্য নতুন যন্ত্ৰণা সহ্য করিতে? কাঁদিতে কাঁদতে হাতের বালা দিয়া বিভূতির মা কপালে আঘাত করিল। রক্ত বাহির হইল একটু ডান চোখের জলের ধারাটা লাল হইয়া গেল।
মহেশ চৌধুরী কাতরভাবে বলিল, শোন, শোন, আহা এমন করছ কেন? বাড়ি ফিরে যাও, আমি ঠিক সময়ে যাব।
খোলা জায়গায় ফাঁকা গাছতলায় এমন নাটকের অভিনয় চলিতে থাকিলে দর্শকের সমাগম হইতে দেরি হয় না। একে একে আশ্রমের প্রায় সকলেই আসিয়া হাজির হয়, এলোমেলোভাবে চারিদিকে দাঁড়াইয়া দুজনকে দেখিতে থাকে, পুরুষেরা ব্যাপারটা অনেকটা হাল্কাভাবেই গ্রহণ করে, মেয়েদের মধ্যে দেখা দেয় চাপা উত্তেজনার চাঞ্চল্য, অনেকে ছোট্ট হাঁ করিয়া চোখ বড় বড় করিয়া চাহিয়া থাকে, শেষবেলার আলোেয় দাঁত করে ঝকঝক, চোখ করে চকচক। আশ্রমে দাঁত মাজার নিয়ম বড় কড়া, দাঁতে ময়লা থাকিলে সদানন্দ রাগ করে, মেয়েদের দাঁত তাই সত্যই ঝকঝক করে কারো বেশি। রত্নাবলীর দাঁতগুলি বোধহয় সকলের চেয়ে বেশি সুন্দর, আর বেশি। ঝকঝকে, চোখও তার বড় আর টানা। তবু গাছতলার ব্যাপার দেখিতে দেখিতে গায়ের আঁচল টানিয়া টানিয়া সে দুহাতে পুঁটলি করিতে থাকে, তারপর রক্তপাত ঘটামাত্র আঁচলসমেত হাত দিয়া চাপা দেয় নিজের মুখ। কাদে কিনা বলা যায় না, কিন্তু সর্বাঙ্গ থরথর করিয়া কাপে। কী কুৎসিত যে দেখায় তার পরিপুষ্ট অঙ্গের অনাবৃত অংশের ঢেউতোলা কাঁপুনি! শশধর অভিভূত হইয়া থাকে। মাধবীলতা তাড়াতাড়ি মহেশ চৌধুরীর স্ত্রীর কাছে গিয়া আঁচল দিয়া তার কপালের রক্ত মুছিয়া দেয়।
তারপর আবির্ভাব ঘটে বিপিনের। রাগ করিয়া লাভ নাই, সে তাই রাগ করে না, আশ্চর্য হইবার ভান করিয়া বলে, আপনি যান নি এখনো?
মহেশ চৌধুরী বলে, আজ্ঞে না। আপনাকে তো বলেছি, একবার প্রভুর চরণ দর্শন করতে না দিলে আমি উঠব না।
তা হলে সাতদিন আপনাকে এখানে থাকতে হবে।
তাই থাকব।
বিপিন একটু হাসিল, আপনার ভক্তিটা কিন্তু বড় খাপছাড়া চৌধুরী মশায়। প্রভুর আদেশ অমান্য করতে আপনার বাঁধবে না, প্রভুর চরণদর্শনের জন্য আপনি ব্যাকুল।
মহেশ চৌধুরী নিশ্চিন্তভাবে বলিলেন, ও আদেশ আমার জন্য নয়।
মাধবীলতা বলিল, না, সত্যি, উনি জানিয়েছেন, সাতদিন কেউ দর্শন পাবে না। সাতদিন উনি একমনে সাধনা করবেন কিনা।
আমি আড়াল থেকে একবার দর্শন করেই চলে আসব।
তা কি হয়?
সন্ধ্যা হইল, রাত্রি বাড়িতে লাগিল, মহেশ চৌধুরী গাছতলার মাটি কামড়াইয়া পড়িয়া রহিল। নিরীহ, শান্ত, ভীরু মানুষটা যে আসলে এমন একগুঁয়ে, সদানন্দ ছাড়া এতকাল আর কে তা জানিত। তাকে কিছু খাওয়ানোর চেষ্টাও ব্যর্থ হইয়া গেল। মাধবীলতা আর রত্নাবলী কোনোরকমে তার স্ত্রীকে একটু দুধ খাওয়াইয়া শশধরকে ডাকিয়া নিয়া গেল আশ্রমের রাত্রির আহার্যের ব্যবস্থায় ভাগ বসাইতে। রাত্রে আশ্রমে রান্না হয় না, কিন্তু পেট ভরাইতে শশধরের অসুবিধা হইল না–দুধ, ছানা, মিষ্টি, ফলমূল এ সবের অভাব নাই। খাওয়ার পর সে আসিয়া আবার মামা-মামির কাছে বসিয়া রহিল গাছতলায়। রাত্রি দশটা পর্যন্ত আশ্রমের দু-এক জনকে সেখানে দেখা গেল, তারপর একজনও রহিল না। রাত্রি দশটার পর কারো কুটিরের বাহিরে থাকা বারণ বিপিন ও সদানন্দ ছাড়া।
রাত প্রায় এগারটার কাছাকাছি গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টিও নামিল, ছাতি-মাথায় বিপিনও হাজির হইল গাছতলায়। দাতে ব্যর্থ হওয়ায় বিপিন গলা, মুখ, চোয়াল, কান, সমস্ত ঢাকিয়া সযত্নে কম্ফৰ্টার জড়াইয়াছে। ঠাণ্ডা লাগিলে তার দাঁতের ব্যথা বাড়ে। মুখের ঢাকা একটু সরাইয়া সে বলিল, আপনারা দাওয়ায় উঠে বসবেন, যান। মাদুর আর বালিশ দিচ্ছি। মহেশ চৌধুরী স্ত্রীকে বলিলেন, যাও না দাওয়ায়, যাও না তোমরা? বৃষ্টিতে ভিজে যে মারা পড়বে তুমি! যাও, দাওয়ায় যাও।
বিভূতির মা বলিল, আর তুমি?
এক কথা এক শ বার কেন বলছ? বললাম না প্রভুকে দর্শন করতে না দিলে আমি উঠব না এখান থেকে? তুমি এখানে বসে থেকে কি করবে, তাতে লাভটা কি হবে শুনি?
তুমি এখান থেকে না উঠলে আমিও উঠব না।
সন্ধ্যা হইতে এ বিষয়ে দুজনের মধ্যে অনেক তর্ক, রাগারাগি হইয়া গিয়াছে, মহেশ চৌধুরী আর কিছু বলিল না, কেবল শশধরকে হুকুম দিল দাওয়ায় গিয়া বসিতে। শশধর দাওয়াতে গেল, বিপিন মাদুর আর বালিশ আনিয়া দিলে তৎক্ষণাৎ মাদুর বিছাইয়া শুইয়াও পড়িল। আফসোস করিয়া বলিল, বর্ষাকালে এ কি ঠাণ্ডা মশায়, এ্যাঁ? এ কি শালার শীতকাল নাকি?
বিপিনের সহানুভূতি জাগিবার লক্ষণ নাই দেখিয়া গলা নামাইয়া আবার বলিল, বৌটা এসেছে কাল ছমাস বাপের বাড়ি ছিল। কি গরমটা কাল রাতে, তা বৌ বলে কিনা বাবু, বাদলার দিন ঠাণ্ডা লাগবে।–বলে—
আপনি বাড়ি ফিরে যান না?
শশধর উঠিয়া বলিল—আমিঃ মামি কাল বাড়ি ফিরেই কি করবে জানেন? কানটি ধরে বলবে, বেরো বাড়ি থেকে। কেবল আমাকে নয় মশায়, নিজের জন্য কি আমি ভাবি–বৌটাকে সুদ্ধ। গায়ে দেবার দিতে পারেন কিছু কাপড়চোপড় যা হোক?
বিপিন একটা চাদর আনিয়া দিল। কিন্তু বাদল রাতে সদানন্দের সদর দাওয়ায় চাদর মুড়ি দিয়া আরাম করিবার অদৃষ্ট বেচারির ছিল না। বিভূতির মা ডাকিয়া বলিল, ও শশী, ভদ্রলোকের
কাছ থেকে ছাতিটা চেয়ে রাখ, আর জিজ্ঞেস কর আরো যদি ছাতি থাকে একটা
একটা কেন, আরো তিনটা ছাতি ছিল, সবগুলি আনিয়া দাওয়ায় শশধরের কাছে ফেলিয়া বিপিন ভিতরে চলিয়া গেল। দাঁতের অসহ্য যন্ত্রণায় তার মাথার মধ্যে ঝিমঝিম করিতেছিল, ইচ্ছা হইতেছিল মাটিতে শুইয়া হাত-পা ছুড়িতে থাকে, আর চিৎকার করিয়া কদে।
ছাতি নিয়া শশধর গাছতলায় গেল, একটি ছাতি খুলিয়া দিল মামির হাতে, আরেকটি ছাতি খুলিয়া মহেশ চৌধুরীকে দিতে গেলে সে বলিল না, আমার ছাতি চাই না।
স্ত্রী বলিল, কেন? এখেনে ধনে দিয়েছ, না খেয়ে বসে থাকবে, তা না হয় বুঝলাম বিষ্টি যখন পড়ছে, ছাতিটা মাথায় দিতে দোষ কি?
মহেশ চৌধুরী বলিল–নিজে থেকে আমি করব না।
তখন মহেশ চৌধুরীর স্ত্রী আবার এমনভাবে নিজের মরণের জন্য আফসোস আরম্ভ করিল যে, মনে হইল, আবার বুঝি আজ অপরাত্নের মতো বালার আঘাতে নিজের কপাল কাটিয়া রক্ত বাহির করিয়া ছাড়িবে। কিন্তু খানিক আফসোস করিয়া নিজের ছাতিটা বন্ধ করিয়া শশধরকে ফেরত দিল, বলিল, যা তুই, দাওয়ায় শো গে যা শশী।
শশধর একটা নিশ্বাস ফেলিয়া বলিল, থাক, আমি বসে বসে ভিজি এখানে, আমিই বা বাদ যাব কেন।
তারপর মিনিট দুই সব চুপচাপ। এ অবস্থায় গাছের পাতায় বাতাসের মৃদু শো শো শব্দ আর গাছের পাতা হইতে জল ঝরিবার ক্ষীণ জলো জলো আওয়াজ ছাড়া আর কোনো শব্দ কানে শোনাও পাপ। মনে অবশ্য অনেক কথা টগবগ করিয়া ফুটিতে থাকে এবং সেগুলি স্মৃতিও নয়।
সারাটা জীবন আমায় তুমি জ্বালিয়ে খেলে, আমার শনিগ্ৰহ তুমি। আমার সব ব্যাপারে তোমার বাহাদুরি করা চাই, হাঙ্গামা বাধানো চাই। যদি শান্তি পাবার জন্যে গাছতলায় ধন্না দিয়ে পড়ে থাকি, তোমার কি তাতে, কেন তুমি এসে আমার মন বিগড়ে দেবে, কে ডেকেছিল তোমায়? স্বামীভক্তি দেখানো হচ্ছে স্বামীর একটা কথা শুনবে না, স্বামীভক্তি দেখাতে গাছতলায় এসে ভেজা চাই। কি অদ্ভুত সতী রে আমার! স্বামীর শান্তি নষ্ট করে সতীত্ব ফলানো।
বৃষ্টি আর বাতাস দুয়েরই বেগ বাড়িতে থাকে। মহেশ চৌধুরীর রাগ আর জ্বালাবোধ কিন্তু না বাড়িয়া এই সামান্য ভসনার মধ্যেই একেবারে ক্ষয় হইয়া যায়। আরো অনেকক্ষণ জের টানিতে পারিত, বলিতে পারিত আরো অনেক কথা, কিন্তু কিছুই না বলিয়া একেবারে চুপ হইয়া গেল। অন্ধকারে এত কাছাকাছি বসিয়াও কেহ কারো মুখ দেখিতে পাইতেছে না। গাঢ় অন্ধকারে শুধু একটি আলোর বিন্দু চোখে পড়ে। কিছুদূরের একটি কুটিরে কে যেন একটি আলো জ্বালিয়া জানালা খুলিয়া রাখিয়াছে। জাগিয়া আছে না ঘুমাইয়া পড়িয়াছে মানুষটা কে জানে! এত রাত্রে চোখে ঘুম নাই, এমন শান্তিহীন অভাগা কে আছে সাধু সদানন্দের আশ্রমে? সদানন্দের যে শিষ্য, সদানন্দের আশ্রমের কুটিরে যে বাস করিবার অধিকার পায়, জীবনের সব জ্বালাপোড়ার ছোঁয়াচ তো সঙ্গে সঙ্গে তার মন হইতে মুছিয়া যাইবে, সন্ধ্যার সঙ্গে শিশুর মতো দুচোখ ভারি হইয়া আসিবে শিশুর চোখের ঘুমে? আলোর বিন্দুটি নিভিয়া গেলে মহেশ চৌধুরী স্বস্তির নিশ্বাস ফেলে। তাই বটে। কোনো দরকারে কেউ আলো জ্বালিয়া রাখিয়াছিল–ঘুম আসিতেছিল না বলিয়া নয়। দুই হাত। জড় করিয়া মহেশ চৌধুরী মনে মনে সদানন্দের চরণে মাথা লুটাইয়া প্ৰণাম করে। হে মহেশ চৌধুরীর জীবন্ত দেবতা, মহেশ চৌধুরীর কল্যাণের জন্যই তুমি তাকে অবহেলা করিয়া দূরে ঠেলিয়া রাখ, দুঃখের আগুনে পুড়িয়া মহেশ চৌধুরীর মন যেদিন নির্মল হইবে, সেইদিন পায়ে ঠাঁই দিয়া। মহেশ চৌধুরীর সমস্ত দুঃখ দূর করিয়া তাকে তুমি শান্তি দিবে, এ কথা জানিতে কি বাকি আছে মহেশ চৌধুরীর? এই ধৈর্যের পরীক্ষায় শিষ্য না করিয়া শিষ্যের মতোই তাকে যে প্রকারান্তরে আত্মশুদ্ধির কঠোর সাধনায় নিযুক্ত করিয়াছ, সেই সাধনায় সিদ্ধিলাভের জন্য মহেশ চৌধুরী জীবন দিতে প্রস্তুত আছে। কিন্তু আজ এই বিপদে তুমি তাকে রক্ষা কর। তুমি কি দেখিতে পাইছে না। প্রভু মহেশ চৌধুরীকে বাড়িতে ফিরাইয়া নেওয়ার জন্য, মহেশ চৌধুরীর সাধনা ব্যর্থ করার জন্য। একজন কি অন্যায় আবদার আরম্ভ করিয়াছে। রাতদুপুরে গাছতলায় সম্মুখে বসিয়া নীরবে বৃষ্টির জলে ভিজিতেছেঃ স্ত্রী বলিয়া নয়, ছেলের মা বলিয়া নয়, একজন স্ত্রীলোকের এত কষ্ট চোখে দেখিয়া স্থির থাকার মতো মনের জোর যে মহেশ চৌধুরীর নাই প্রভু।
সদানন্দ অবশ্য তখন ঘুমাইতেছিল। আজ বেশ ঠাণ্ডা পড়িয়াছে। কিন্তু জানা থাকিলেও মহেশ চৌধুরীর কিছু আসিয়া যাইত না। পাথরের দেবতার কাছেও মানুষ প্রার্থনা জানায় ঘুমন্ত মানুষ তো জীবন্ত। নয় কি?
পরদিন চারিদিকে খবর ছড়াইয়া গেল, মহেশ চৌধুরী সস্ত্রীক সাধুবাবার আশ্রমে ধন্না দিয়াছে। চারিদিক হইতে নরনারী দেখিবার জন্য আসিয়া জড়ো হইতে লাগিল সদানন্দের আশ্রমে আসিয়া তারা আজ মহেশ চৌধুরীর দর্শনপ্রার্থী।
শেষরাত্রে বৃষ্টি বন্ধ হইয়া গিয়াছিল, সকালবেলা ভিজা পৃথিবীতে সোনালি রোদ উঠিয়াছে। মহেশ চৌধুরী ও তার স্ত্রী দুজনের গায়ে রোদ পড়িয়া দেখাইতেছে যেন মূৰ্তি-ধরা বিশৃঙ্খলা ও অবাধ্যতা, কিন্তু অপার্থিব জ্যোতি দিয়া আবৃত। দুজনের গায়ে আবরণের মতো পড়িবে বলিয়া রোদের রংটা আজ বেশি গাঢ় হইয়াছে নাকি?
রত্নাবলী ও উমা আসিয়াছিল সকলের আগে, রোদ উঠিবারও আগে। রত্নাবলী চোখ বড় করিয়া বলিয়াছিল–সমস্ত রাত এখানে ছিলেন?
মহেশ চৌধুরী বলিয়াছিল, থাকবার জন্যেই তো এসেছি মা।
মহেশ চৌধুরীর কথা বলিবার ধরন পর্যন্ত এক রাত্রে বদলাইয়া গিয়াছে।
মারা পড়বেন যে আপনারা?
মহেশ চৌধুরী করুণ চোখে স্ত্রীর দিকে চাহিয়া রহিল। দেবতা কি প্রার্থনা শুনিবেন, এই বিপদে তাকে পথ দেখাইয়া দিবেন না?
কাল শেষরাত্রির দিকে কতবার যে তার মনে হইয়াছে সব শেষ করিয়া দিয়া স্ত্রীর হাত ধরিয়া কোনো একটি আশ্রমে চলিয়া যায়। মনে হইয়াছে, এমনভাবে একজনকে কষ্ট দিবার কোনো অধিকার তার নাই, সে তার প্রতিজ্ঞা রক্ষা করিলেই বা এ জগতে কার কি আসিয়া যাইবে, প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ করিলেই বা কার কি আসিয়া যাইবে, সব কি তার নিজেরই বিকৃত অহংকারের কথা নয়? সাধুজীর চরণদর্শন না করিয়া উঠিবে না বলিয়া গাছতলায় ধন্না দিয়াছে, চরণদর্শন হইবার আগে উঠিয়া গেলে লোকের কাছে একটু নিন্দা হইবে, লোকে বলিবে মহেশ চৌধুরীর মনের জোর নাই। নিজের কাছে নিজের দামটাও একটু কমিয়া যাইবে বটে, মনে হইবে বটে যে, আমি কি অপদাৰ্থ, ছি! কিন্তু নিজের কথা ভাবিয়া আরেকজনকে যন্ত্রণা দিলে, মারিয়া ফেলিবার সম্ভাবনা ঘটাইলে, তাতে কি নিজের অপদার্থতা আরো বেশি প্রমাণ হইয়া যাইবে না, নিজের মধ্যে অশান্তি বাড়িয়া যাইবে না?
রোদ উঠিবার পর আসিল মাধবীলতা। কে জানে কেন, এ আশ্রমে কোনো ব্যাপারে সকলের চেয়ে মাধবীলতার সাহসটাই সবচেয়ে বেশি হইতে দেখা যায়। বোধহয় কোনো কোনো ব্যাপারে
সে সকলের চেয়ে ভীরু বলিয়া।
আসিয়াই মহেশকে সে দিতে আরম্ভ করিল বকুনি। বলিল, মাথা খারাপ হয়ে থাকে, অন্য কোথাও গিয়ে পাগলামি করুন না? আমরা আপনার কাছে কি অপরাধ করেছি?
অপরাধ? অপরাধের কথা কি হল মা?
মহেশ চৌধুরী হাত জোড় করিল।
তফাতে শতাধিক নরনারী ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়া আছে, মাধবীলতার মুখের রং যেন রোদের সঙ্গে মিশ খাইয়া যাইবে।
তবে আমাদের এত কষ্ট দিচ্ছেন কেন? এটা তো হাট নয়, আশ্রম তত এটা? দেখুন তো–চেয়ে কি লোক জমতে শুরু করেছে। এর মধ্যে আশ্রমের কাজ চলে কি করে, আমরাই বা থাকি কি করে? একটু শান্তি পাবে বলে যারা আশ্রমে আসে, সাহস মাধবীলতার একটুও কমে নাই, তবে আবেগটা বাড়িতে বাড়িতে একটু অতিরিক্ত হইয়া পড়ায় গলাটা রুদ্ধ হইয়া গেল।
মহেশ চৌধুরী বলিল, তোমাদের অসুবিধা হচ্ছে মা? আচ্ছা আমি ওদের যেতে বলছি।
যেতে গরজ পড়েছে ওদের!
কিন্তু তারা গেল। মহেশ চৌধুরী ঘুরিয়া বসিয়া সকলকে চলিয়া যাইতে অনুরোধ জানাইল, বলিল যে, এই গাছতলায় তার মরণ হইবে, এটা যদি তারা না চায়, তবে যে যার বাড়ি ফিরিয়া যাক। ভঙ্গি দেখিয়া প্রথমে মাধবীলতার মনে হইয়াছিল, মহেশ চৌধুরী বুঝি লম্বা বক্তৃতা দিবে, কিন্তু একটু অনুযোগ দিয়া ও নিজের মরণের ভয় দেখাইয়া কয়েকটি কথায় সে বক্তব্য শেষ করিয়া দিল এবং এমনভাবে কথাগুলি বলিল, যেন শ্রোতারা সকলেই তার শুভাকাঙ্ক্ষী আত্মীয়। কিছুক্ষণের মধ্যে সকলে আশ্রমের সীমানা পার হইয়া চলিয়া গেল। বাড়ি সকলে গেল না, আশ্রমের কাছেই খবরের লোভে ঘোরাফেরা করিতে লাগিল, কিন্তু গাছের জন্য আশ্রমের ভিতর হইতে তাদের আর দেখা গেল না, মাঝে মাঝে দু-একজন করিয়া আশ্রমের ভিতরে ঢুকিয়া মহেশকে দেখিয়া চলিয়া যাইতে লাগিল, আশ্রমের মধ্যে আর ভিড় হইল না।
বিপিন ভিতর হইতে ব্যাপারটা লক্ষ করিতেছিল। দাঁতের ব্যথা এখনো তার সম্পূর্ণ কমে নাই, কিন্তু হয় রোদ উঠিয়াছে বলিয়া অথবা ব্যাপারটা দেখিয়া উত্তেজনা হইয়াছে বলিয়া, মাথায় জড়ানো সমস্ত কাপড় খুলিয়া ফেলিয়া সে চুপ করিয়া বিছানায় বসিয়া রহিল।
মাধবীলতা একটা পাক দিয়া আসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, আচ্ছা, আপনি কি চান?
প্রভুর চরণদর্শন করতে চাই।
শুনিয়া মাধবীলতা আবার পাক দিয়া আসিতে গেল।
বেলা বাড়িতে থাকে, ভিজা জামা ও কাদামাখা পরনের কাপড় ক্ৰমে ক্ৰমে শুকাইয়া যায়, গুমোট হয় দারুণ। মহেশ একসময় স্ত্রীকে বলে, আচ্ছা এবার তো তুমি ফিরে যেতে পার?
বিভূতির মার চোখ জবাফুলের মতো লাল হইয়াছে, চোখের পাতা বুজিয়া বুজিয়া আসিতেছে। শুধু মাথা নাড়িল।
মহেশ চৌধুরী খানিকক্ষণ গুম খাইয়া থাকিয়া বলিল, চল, আমিও যাচ্ছি।
শুনিয়া বিভূতির মার লাল চোখে পলক পড়া বন্ধ হইয়া গেল–সাধুজীর চরণদর্শন না করেই যাবে?
কি করব? নারীহত্যার পাতক তো করতে পারি না।–জ্বর এসেছে না তোমার?
হয়তো আসিয়াছে জ্বর, হয়তো আসে নাই, সেটা আর এখন বড় কথা নয়, বিভূতির মা এখন আর বাড়ি ফিরিয়া যাইতে চায় না। এখানে বসিবার সময় বলিয়াছিল বটে যে স্বামী লইয়া ফিরিয়া যাইবে কিন্তু এখন আর সদানন্দের চরণদর্শনের আগে সেটা করিতে চায় না। স্বামীর প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হইবে ভয়ে? ভয় সেটাই বটে কিন্তু মহেশ যা ভাবিতেছে তা নয়, স্বামীর প্রতিজ্ঞা ভঙ্গ হইবে ভাবনায় তো বিভূতির মার ঘুম আসিতেছে না। এখন বড় ভয় এই যে, এত কাণ্ডের পর তার পাগল স্বামী সদানন্দের দর্শনলাভ না করিয়াই বাড়ি ফিরিয়া গেলে, তার সঙ্গে সে ঘর করিবে কি করিয়া? সেই তিলে তিলে দিনের পর দিন দগ্ধানোর চেয়ে এইখানেই একটা হেস্তনেস্ত হইয়া যাক।
যুক্তিটা যে খুবই জোরালো, তাদের সম্পর্কের হিসাব ধরিলে প্রায় অকাট্য, মনে মনে মহেশ তা অস্বীকার করিতে পারিল না কিন্তু অনাহারে অনিদ্রায় রোদে পুড়িয়া বৃষ্টিতে ভিজিয়া গাছতলায় বসিয়া বসিয়া দিবারাত্রি কাটানোর পর যুক্তিতে বেশি কিছু আসিয়া যায় না। পরের কাছে বিনয়ে কাদা হইয়া হাত জোড় করা যায় কিন্তু নিজের লোকের অবাধ্যতায় গা জ্বলিয়া যায়। মহেশ চৌধুরীর দাতে দাঁত ঘষিবার প্রক্রিয়াটা কাছে দাঁড়াইয়া কেউ লক্ষ করিলে চমকাইয়া যাইত।
তুমি থাক তবে আমি ফিরে চললাম।
যাও।
আমি চলে গেলেও তুমি একা বসে থাকবে?
কি করব না বসে? এখন গেলেই চিরকাল তুমি আমায় দুষবে, বলবে আমার জন্য তুমি প্ৰতিজ্ঞা ভঙ্গ করেছিলে।
তোমায় দুষব?
দুষবে না?
খানিকক্ষণ হতভম্বর মতো স্ত্রীর মুখের দিকে চাহিয়া থাকিয়া মহেশ চৌধুরী বলিল, আমি নিজেই যখন চলে যাচ্ছি, তোমায় দুষব কেন?
এবার বিভূতির মা যেন একটু রাগ করিয়াই বলিল, দ্যাখ, তোমার সঙ্গে আমার সে সম্পর্ক নয়, ওসব মারপ্যাচ আমাদের মধ্যে চলবে না রাস্তার লোককে ওসব বলে বুঝিও। নিজেই চলে যে যাচ্ছ তুমি, কার জন্য যাচ্ছ শুনি? বাড়ি গিয়ে যে ছটফট করবে, সেটা তলে তলে দগ্ধাবে কাকে শুনি? তোমায় চিনতে তো আমার বাকি নেই। তুমি হলে … তুমি হলে … মাথা নত করিয়া নিঃশব্দে কাঁদিতে লাগিল।
কেঁদ না বলিয়া মহেশ চৌধুরী বিহ্বলের মতো বসিয়া রহিল। এ জগতে কোনো প্রশ্নেরই কি শেষ নাই? মানুষ বিচার করিবে কি দিয়া? খুজিলেই সত্যের খুঁত বাহির হয় নিজে খোঁজ বন্ধ। করিয়া দিলেও রেহাই নাই, প্রতিনিধি যদি খোজে নিজের জ্ঞান-বুদ্ধির হিসাবে তাতেও খুঁত বাহির হওয়া আটকায় না। নিজে যা হোক কিছু ঠিক করিয়া নিতে পারিলেই অন্যে তা মানিবে কেন, অন্যেও যাহোক কিছু ঠিক করিয়া নিতে গিয়া নূতন কিছু আবিষ্কার করিবেই। সুতরাং এখন কৰ্তব্য কি? যা ভালো মনে হয় তাই করা?
কি করা ভালো?
হে মহেশ চৌধুরীর জীবন্ত দেবতা—
না, দেবতার কাছে আবদার চলিবে না। দেবতার কি জানে মহেশ চৌধুরী? দেবতা ও তার সম্পর্কের মধ্যে কোনটা মারপ্যাচ আর কোনটা মারপ্যাচ নয়, তা কি সে নিঃসন্দেহে জানিতে পারিয়াছে, যেমন জানিতে পারিয়াছে স্বামী নামক দেবতা সম্বন্ধে তারই সম্মুখে উপবিষ্টা তারই এই স্ত্রীটি? এরকম না জানিলেই বা কৰ্তব্যনির্ণয় চলিবে কেন? মহেশ চৌধুরীর ক্লেশ বোধ হয়। দেবতাকে আত্মসমৰ্পণ করিয়াছে কিন্তু দেবতার সঙ্গে নিজের সংযোগটা কেমন, সে সম্বন্ধে নিজের পরিষ্কার ধারণা নাই, এ কেমন আত্মসমৰ্পণ? চোখ-কান বুজিয়া বিচার-বিবেচনা না করিয়া নিজেকে দিলেই কি আত্মসমর্পণ হয়? কোনো প্রত্যাশা না থাকিলেই? তবে সদানন্দের জন্যও কেন নিঃসন্দেহ হইতে পারে না যে যা ঠিক করিয়াছে তাই ঠিক? তার সম্বন্ধে কৰ্তব্যনিৰ্ণয় করিতে তার স্ত্রীর কেন একবারও দ্বিধা করিতে হয় না, ভুল করিবার ভয়ে ব্যাকুল হইতে হয় না? মহেশ চৌধুরী কি তবে স্ত্রীলোকেরও অধম? অথবা?
একটা প্রশ্ন যেন মনের তলায় কোনখানে উঁকি দিতে থাকে, মহেশ চৌধুরী ঠিক বুঝিয়া উঠিতে পারে না। কেমন একটা রহস্যময় দুর্বোধ্য অনুভূতি হইতে থাকে। আসল কথা, বিভূতির মার শেষ কথাগুলিতে সে একেবারে চমৎকৃত হইয়া গিয়াছিল, সকল বিষয়ের মূল্যনির্ণয়ের অভ্যস্ত মানসিক প্রক্রিয়াটা একেবারে গোড়া ধরিয়া নাড়া খাইয়াছিল। সমস্ত চিন্তার মধ্যে ঘুরিয়া ফিরিয়া কেবল মনে। হইতেছিল, এ কথাটা তো মিথ্যা নয়, ওর সঙ্গে আমার যে সম্পর্ক, এ জগতে আর কারো সঙ্গে তো তা নেই, কোনোরকম মারপ্যাচ ওর সঙ্গে আমার তো চলতে পারে না! কি আশ্চর্য!
তারপর মাধবীলতা এক সময়ে ফিরিয়া আসিয়া বলিল, চলুন আপনারা সাধুজীর চরণদর্শন করবেন।
মহেশ যেন বিশেষ অবাক হইল না, কৃতার্থও বোধ করিল না। সহজভাবে কেবল বলিল, অনুমতি দিয়াছেন?
এ কথার জবাবে মাধবী বলিল, প্রণাম করেই চলে আসবেন কিন্তু কথাবার্তা বলে জ্বালাতন করবেন না।
আমরা দুজনেই যাব তো?
হ্যাঁ, আসুন।
কিন্তু বিভূতির মা স্বামীকে গৃহে ফিরাইয়া লইয়া যাইতে আসিয়াছে, সদানন্দের চরণদৰ্শন করিতে আসে নাই, সে উঠিল না। বলিল, আমি এখান থেকেই মনে মনে প্ৰণাম জানাচ্ছি, তুমি যাও, প্রণাম করে এস।
একা যাইতে মহেশের ভালো মন সরিতেছিল না; একসঙ্গে এত দুর্ভোগ সহ্য করিবার পর সাফল্যটা ভোগ করিবে একা? একটু অনুরোধ করিল, বুঝাইয়া বলিবার চেষ্টা করিল যে, এমন। একটা অনুগ্রহ পাইয়া কি হেলায় হারাইতে আছে? কিন্তু বিভূতির মা কিছুই বুঝিল না। তখন মাধবীলতার সঙ্গে মহেশকে একাই ভিতরে যাইতে হইল। কাপড়ে কাদা লাগিয়াছিল, এখন শুকাইয়া পাপড়ের মতো শক্ত হইয়া উঠিয়াছে। মহেশ একবার ভাবিল কাপড়টা বদলাইয়া সদানন্দের সামনে যায়, তারপর আবার ভাবিল, থাক, হাঙ্গামায় কাজ নাই। সদানন্দের সঙ্গে সাক্ষাতের ব্যবস্থাটা বিপিনের বদলে মাধবীলতার মধ্যস্থতায় হইতেছে কেন এ কথাও মহেশের। মনে হইতেছিল। ভাবিল, তার কাছে নিজে নত হইতে বিপিনের হয়তো লজ্জা করিতেছিল, তাই মেয়েটাকে দূতী করিয়া পাঠাইয়া দিয়াছে।
কিন্তু সদানন্দের অভ্যর্থনা এ ধারণা তার মন হইতে বলপূর্বক দূর করিয়া দিল। রাগে আগুন হইয়া সদানন্দ বলিল, এর মানে? আমি না বারণ করে দিয়েছি, সাত দিন কেউ আমার দৰ্শন পাবে না?
সদানন্দ নদীর দিকে জানালার কাছে পাতা চৌকিতে বসিয়াছিল, সেইখান হইতে কুদ্ধ চোখে। চাহিয়া রহিল। মহেশ তখন ঘরের চৌকাঠ পার হইয়াছে, সেইখানে থমকিয়া দাঁড়াইয়া পড়িল।
মাধবীলতা তাড়াতাড়ি চৌকির কাছে আগাইয়া গেল। নিচু গলায় ফিসফিস করিয়া বলিল, আপনার পায়ে ধরছি, রাগ করবেন না। অনেক ব্যাপার হয়ে গেছে, আমি সমস্ত বলছি আপনাকে। আপনি শুধু এই ভদ্রলোককে একবার প্রণাম করে চলে যেতে দিন। বলিয়া মুখ আরো তুলিয়া
সদানন্দের চোখে চোখে চাহিয়া মিনতি করিয়া বলিল, দেবেন না?
সদানন্দ বলিল, আচ্ছা।
আসুন, প্রণাম করে যান।
মহেশ নড়ে না দেখিয়া সদানন্দও ডাকিয়া বলিল, এস মহেশ।
মহেশ অবাধ্য শিশুর মতো মাথা নাড়িয়া বলিল, না প্ৰভু, আপনি আমায় ডাকেন নি, এই মেয়েটি আমায় ফাঁকি দিয়ে এনেছে। না জেনে আপনার কাছে আমি এ কি অপরাধ করলাম প্রভু! আপনি ডাকেন নি জানলে তো আমি আসতাম না।
সদানন্দ শান্তভাবে বলিল, তাই নাকি? তা, এখন কি করবে?
আমি ফিরে যাচ্ছি প্রভু। আপনি নিজে ডাকলে এসে প্রণাম করে যাব।
মাধবীর মুখখানা পাংশু হইয়া গিয়াছিল, সে ভীতকণ্ঠে বলিয়া উঠিল, আবার গাছতলায় গিয়ে ধন্না দেবেন? মরে যাবেন যে আপনারা দুজনেই?
মুখের চেয়ে মাধবীর চোখের পরিবর্তন ঘটিতেছিল বিচিত্ৰতর, এবার চোখ ছাপাইয়া জল ঝরিয়া পড়িল। কত ভাবিয়া কত হিসাব করিয়া নিজের দায়িত্বে এত বড় একটা কাজ করতে গিয়া বুকটা ভয়ে ও উত্তেজনায় ঢিপঢিপ করিতেছিল, সদানন্দ দেবতা না দানব মাধবীর জানা নাই কিন্তু এমন ভয় সে করে সদানন্দকে যে, কাছে আসিলেই তার দেহ-মন কেমন একসঙ্গে আড়ষ্ট হইয়া যায়, সদানন্দ তাকে বুকে তুলিয়া লইলেও যে জন্য সে নূতন কিছুই আর অনুভব করিতে পারে না, অনায়াসে সদানন্দের মুখের দিকে প্যাট প্যাট করিয়া চাহিয়া থাকিতে পারে। কিন্তু সে তো গা এলাইয়া দেওয়ার কথা, কোনো হাঙ্গামাই তাতে নাই। এতকাল নিজের ও সদানন্দের মধ্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে যা কিছু ঘটিয়াছে, তাতে তার নিজের কিছুই করিবার বা বলিবার থাকে নাই, সদানন্দই সমস্ত করিয়াছে ও বলিয়াছে। আজ প্রথম নিজেকে মানুষটার নিষেধ অমান্য করিতে সক্রিয় করিয়া তুলিয়া ভিতরটা তার আবেগে ফাটিয়া পড়িতেছিল। তাই তার পরিকল্পনাকে ব্যর্থ করিয়া মহেশ আবার গাছতলায় ধন্না দিতে যাইবে, এই আশাভঙ্গের সুযোগ অবলম্বন করিয়া সে কাঁদিয়া ফেলিল। তার উদ্দেশ্যটা যথারীতি সফল হইলে, সদানন্দকে প্রণাম করিয়া মহেশ বাড়ি ফিরিয়া গেলে, অন্য কোনো উপলক্ষে সে অবশ্য কাঁদিত। উপলক্ষ না পাইলে বিনা উপলক্ষেই
কাদিত।
সদানন্দ অপলক চোখে মাধবীলতার চোখে জল ভরিয়া উপচিয়া পড়ার প্রক্রিয়াটা দেখিতেছিল। এ দৃশ্য সে আগেও দেখিয়াছে, মাধবীর চোখ তখন তার চোখের আরো কাছে ছিল। তবু এমন স্পষ্টভাবে আর কোনোদিন কি মাধবীর চোখের কান্না দেখিয়াছে ইতিপূর্বে?
একটু ভাবিয়া স্নিগ্ধকণ্ঠে সদানন্দ বলিল, মহেশ, আমি তোমায় পরীক্ষা করছিলাম?
পরীক্ষা প্ৰভু?
হ্যাঁ পরীক্ষায় তুমি উত্তীর্ণ হয়েছ। আমি সব জানি মহেশ, তুমি আসবার এক মুহূর্ত আগে আমি আসন ছেড়ে উঠেছি। দরজা বন্ধ ছিল, তুমি আসবে বলে দরজা খুলে রেখেছি! তোমায় দেখে রাগের ভান করছিলাম, আমায় না জানিয়ে কেউ কি আমার কাছে আসতে পারে মহেশ? এখন বাড়ি যাও, কদিন বিশ্রাম করে আমার সঙ্গে এসে দেখা কোরো। দেখি, তোমার প্রার্থনা পূর্ণ করতে পারি কিনা।
শুনিতে শুনিতে টলিতে টলিতে মহেশ চৌধুরী কোনোরকমে খাড়া ছিল, সদানন্দের কথা শেষ হইলে প্রণাম করিবার জন্য আগাইতে গিয়া দড়াম করিয়া পড়িয়া গেল।
সুতরাং বিভূতির মাকেও শেষ পর্যন্ত ভিতরে আসিয়া সদানন্দের চরণদৰ্শন করিতে হইল, শশধরও আসিল। বিপিন আসিয়া চুপ করিয়া একপাশে দাঁড়াইয়া রহিল, একবার শুধু সে চোখ তুলিয়া চাহিল সদানন্দের দিকে, তারপর আর মনে হইল না যে আশপাশে কি ঘটিতেছে, এ বিষয়ে তার চেতনা আছে।
আধঘণ্টা পরে মহেশ চৌধুরীকে একটু সুস্থ করিয়া এবং একটু গরম দুধ খাওয়াইয়া শশধর। ধরিয়া বাহিরে লইয়া গেল। বাইরে দেখা গেল বিরাট কাণ্ড হইয়া আছে–শদুই নরনারী সেই কদমগাছটার তলে ভিড় করিয়া দাঁড়াইয়া। শ্রীধরকেও তাহাদের মধ্যে দেখা গেল।
মহেশকে দেখিয়া জনতা জয়ধ্বনি করিয়া উঠিল–মহেশ চৌধুরীকি জয়।
জনতার মধ্যে একজনও অবাঙালি আছে কিনা সন্দেহ, মহেশ চৌধুরীও যে খুঁটি বাঙালি সন্তান। তাও কারো অজানা নাই, তবু জয়ধ্বনিতে মহেশ চৌধুরীর নামের সঙ্গে কোথা হইতে যে একটি কি যুক্ত হইয়া গেল।
তারপর কয়েকজন যুবক মহেশ চৌধুরীকে কাঁধে চাপাইয়া গ্রামের দিকে রওনা হইয়া গেল। কাঁধে চাপাইল একরকম জোর করিয়াই, মহেশ চৌধুরীর বারণও শুনিল না, বিভূতির মার ব্যাকুল মিনতিও কানে তুলিল না।
যতক্ষণ দেখা গেল, আশ্রমের সকলেই একদৃষ্টে চাহিয়া রহিল, তারপর ছোট ছোট দলে আরম্ভ হইল আলোচনা। বিপিন সদানন্দের কুটিরের সামনে দাঁড়াইয়া আগাগোড়া সমস্ত ব্যাপারটা লক্ষ করিয়াছিল, শোভাযাত্রা গাছের আড়ালে অদৃশ্য হইয়া গেলে কাহারো সঙ্গে একটি কথা না বলিয়া সে সটান গিয়া নিজের বিছানায় শুইয়া পড়িল। সে যেন হার মানিয়াছে, হাল ছাড়িয়া দিয়াছে, অথবা দাঁতের ব্যথায় আবার কাতর হইয়া পড়িয়াছে।
মাধবীলতা সদানন্দের ঘরে ফিরিয়া গেল। তাহার ব্যাখ্যা ও কৈফিয়ত বাকি আছে। সদানন্দ সাগ্রহ অভ্যর্থনা করিল, এস মাধবী।
কোথায় আসিবে মাধবী? কাছে? পাঁচ-সাত হাত তফাত হইতে এমনভাবে ডাকিলে তাই অর্থ হয়। মহেশ চৌধুরী খানিক আগে টলিতে টলিতে সদানন্দের দিকে আগাইবার চেষ্টা করিয়াছিল, মাধবীলতা কাঁপিতে কাঁপিতে পায়ে পায়ে আগাইতে লাগিল, মহেশ চৌধুরীর মতো দড়াম করিয়া পড়িয়াও গেল না। কিন্তু কাছে যাওয়ারও তো একটা সীমা আছে? তাই হাতখানেক ব্যবধান থাকিতে মাধবীলতা থামিয়া পড়িল।
সদানন্দ হাত ধরিয়া তাকে পাশে বসাইয়া দিল। চিবুক ধরিয়া মুখখানা উঁচু করিয়া বলিল, মাধবী, তুমি তো কম দুই মেয়ে নও!
ওঁর স্ত্রী যে মরে যাচ্ছিলেন।
তাহলে অবশ্য তুমি লক্ষ্মী মেয়ে। সদানন্দ একমুখ হাসিল।
মাধবীলতা থামিয়া থামিয়া সংক্ষেপে সমস্ত ব্যাপারটা সদানন্দকে জানাইয়া দিল, নিজের কাজের কৈফিয়তে বলিল যে, সদানন্দ পাছে রাজি না হয় এই ভয়ে একেবারে মহেশ চৌধুরীকে সঙ্গে করিয়া লইয়া আসিয়াছিল।
বলিয়া মাধবী হঠাৎ দাবি করিয়া বসিল সদানন্দের কৈফিয়ত, কাদ কাঁদ হইয়া বিনা ভূমিকায় সে প্রশ্ন করিয়া বসিল, কিন্তু আপনি ও কথা বললেন কেন মহেশবাবুকে?
আমি তো জানতাম না মাধবী এত কাণ্ড হয়ে গেছে। তুমি ডেকে এনেছ জানলে কি আর আমি রেগে উঠতাম?
না, তা নয়। আপনি মিছে কথা বললেন কেন? কেন বললেন আপনি সব জানতেন, ওকে পরীক্ষা করছেন?
সদানন্দ বিব্রত হইয়া বলিলেন, ওটা কি জান মাধবী–
কিন্তু মাধবী ওসব কথা কানে তোলে? আকুল হইয়া সে কাঁদিতে আরম্ভ করিয়া দিল আর বলিতে লাগিল, কেন আপনি মিছে কথা বললেন। কেন বললেন!